দোবাকির গল্পকথা
“হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে”…..
দূর থেকে ভেসে আসছে বাউলের করুণ আর্তি।কাসাই চরের খেজুর গুড় কারিগরদের চালা থেকে ভেসে আসছে গানের সুর।অস্তরবির লালিমায় দিগন্ত নববধূর সাজে সেজেছে।হিমেল হাওয়াটা দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সরষে ক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে অনন্তের পানে!নদীঘাটের একলা আশুদ গাছটা যেন একাত্ম হয়ে শুনছে বাউলের আর্তি।
….”শুনি কড়ি নাই যার তুমি তারে কর পার
আমি দীন ভিখারি নাইকো কড়ি দেখো ঝুলি ঝেড়ে
….”কাসাই চরের এই দিকটাতে শীতের সময় শিউলিরা খেজুর গুড় তৈরির আড়ত করে।চারপাশের গ্রামগুলো থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করে এখানে নলেন গুড় ,খেজুর লবাত(পাটালি) তৈরি করে।
নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করতে থাকে চরের বাতাস।নদীচরের দুপাশেই নদীর ঘাট!জল ভেঙে গ্রামের মানুষ চরে আসে হামেশাই।চরের কচি কচি সবুজ ঘাসে গরু ছাগল মুখ ডুবিয়ে খায়, রাখাল আড় বাঁশি বাজায়, গুড়কারিগরদের সাথে গল্প করে।সাতবউনি থানের পাশে এই দোবাকির চর।
জঙ্গল কন্যা কাসাইয়ের তন্বী শরীরএমন একে বেঁকে এগিয়েছে যে দুপাশে বয়ে চলা কিশোরী কাসাই এর বুকে এক বিশাল চর জেগে উঠেছে।স্বচ্ছ তোয়া কিশোরী কাসাইএর চরের দুপাশে কোথাও হাঁটুডোবা কোথাও বা কোমর সমান জল!
এই চরের চালায় গুড় কারিগরদের সাথে এসে জুটেছে এক বাউল ও তার চেলা।প্রৌঢ় বাউল তার শিষ্যকে নিয়ে পরিক্রমায় বেরিয়েছিল।এই চরের শিউলিরা ওদের সাদরে নিজেদের চালায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে।সারাদিন মাধুকরীর পর রাতে গুড কারিগরদের চালায় বসে গানের আসর।বাউল গান ও দেহতত্ত্বের গানে ভেসে যায় পৌষালী হিমেল রাত!মকর সংক্রান্তির মেলা বসবে কাসাই ঘাটে!সাত বোনের মেলা,,,,..সাতবউনির মেলা।দুর দুরান্ত থেকে মানুষজন আসবে এখানে। বাউল আনন্দও তার শিষ্য কানাই এই মেলাতেই এসেছে। মেলার দেরি আছে সপ্তাহখানেক।এর মধ্যেই বাউলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে, তাইতো রোজ সাঁঝের প্রদীপ জ্বালার পরপরই গুড় কারিগরদের চালায় বসে গানের আসর!একতারা খমক সারিন্দার মধুর স্বরে ভেসে যায় কাসাই চর!
আশপাশের গ্রামের বয় বৃদ্ধরা আসে গান শুনতে। প্রৌড় বাউল এর সাথে আলাপচারিতায় সময় কাটায়।আনন্দ বাউলের শিষ্য কানাই বছর ১৫ কিশোর।১৩ বছর আগে তুলসী চারার মেলায় এই বছর দুয়েকের বাচ্চাটিকে কুড়িয়ে পায় আনন্দ!মেলার ভীড়ে একা একা কাঁদছিল।আনন্দ অনেক চেষ্টা করেকিন্তু ওর আত্মজনের কোন খোঁজ পায় না !তখন থেকেই কানাই ওর সাথী !ওকে বাবা বলে ডাকে! কানাই কে অবলম্বন করেই বাঁচার চেষ্টা করে ভাগ্যবিড়ম্বিত আনন্দ।
বড় বেদনা বিধুর ওর জীবন কাহিনী।কাসাই তীরেরএক সম্পন্ন চাষী গৃহস্থের সন্তানও।বাবা মা মরা ছেলেটা দাদুর আদরে স্নেহে মানুষ হচ্ছিল!বাদ সাধলো ওর গানের শখ !গলাটিও বেশ সুরেলা!গানের নেশায় বারবার বাড়ি ছেড়ে বাউল আখড়াতে পড়ে থাকে!দাদু মারা যাবার পরতো আর পিছুটান ছিল না!নানা আছিলায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে জ্ঞাতিরা!ওর একার পক্ষে তাদের সাথে লড়াই করা সম্ভব হয়নি।যে গুরুর সন্ধানে সে ঘর ছেড়েছিল একদিন তার দেখা সে পেল ঠিকই কিন্তু সেখানেও বঞ্চনার শিকার হল!কিছু ক্ষমতাবান শিষ্য ওকে গুরু সান্নিধ্য থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করে।
আবার একদিন গুরু আশ্রম থেকে অচিন পথে বেরিয়ে পড়ে আনন্দ!সঙ্গী শুধু তার কণ্ঠের সুর! পথে পথে কাটে তার দিন… মাস… বছর!তুলসী চারার মেলায় তার টগর এর বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়।আনন্দের মায়াবী কন্ঠের জাদুতে মোহিত হয় বৈষ্ণব দম্পতি!ওকে নিয়ে আসে এই দোবাকির চরে ওদের ভদ্রাসনে।মেয়ে টগরের সাথে কোণ্ঠী বদল করিয়ে থীতু করে।বছর দুয়েক সুখেই কাটে আনন্দের!কিন্তু ও যে “জনম দুঃখী কপাল পোড়া” সুখ তো ওর কপালে সয়না।জয়দেবের মেলায় গিয়েছিল সপরিবারে!এখানেই মহামারী কলেরাতে আক্রান্ত হয় সকলে! টগর তার বাবা-মা সবাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় আনন্দ কে ছেড়ে!ভাগ্য বিড়ম্বিত আনন্দ শান্তির খোঁজে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ায়।
এমনই এক মেলায় সে কুড়িয়ে পেয়েছিল কানাই কে!ওর মনে হয়েছিল ঠাকুর কানাইরুপে ওকে বাঁচার রসদ দিলেন।সেই থেকে আনন্দ কানাই এর মা বাপ।তার গানের উত্তরাধিকার সে কানাই কে দিয়ে যেতে চায়। তাই একসাথে চর্চা করে।রাঢ়ে বিভিন্ন জায়গার মকর সংক্রান্তিতে মেলা বসে, দোবাকি র সাত বোনের মেলা তাদের মধ্যে একটি। আনন্দ অনেক বছর পরে মেলায় এলো তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন সায়ন্বে তার সংসার খেলাঘরের স্মৃতিচারণ করতে চাইছিল।তাই বিভিন্ন নামী মকর মেলা ছেড়ে সেই দোবাকিতে এসেছে।
ফেলে যাওয়া সংসারে র স্মৃতি চিরতরে মন থেকে মুছে ফেলার আগে শেষবারের মতো দেখে যেতে চায় তার সংসার খেলা ঘরকে।
সেদিন আনন্দ কানাই কে সাথে করে মাধুকরীতে বেরিয়েছে।চরের বসতিতে চলে তাদের পরিক্রমা!দেহতত্ত্বের সুরে ভেসে যায় চরের বাতাস।নিজের অজান্তে আনন্দের পা এসে থামে ওর ফেলে যাওয়া ভদ্রাসনের সামনে!খড়েছাওয়া মাটির দুটি ঘর সামনেএক ফালি বারান্দা!বাঁশের বেড়ায় তরুলতার বাহার! সবুজ পাতার ফাঁকে লাল ফুলে সমারোহ।সোনালী কমলা গাঁদা ফুলের বান ডেকেছে সামনের বাগানে!বাউলের গানের সুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক বছর বারোর কিশোরী এক প্রৌড়া।সাদরে বাউল কে আহ্বান জানাই ঘরে।!আনন্দর সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারে যে এই প্রৌড়া ও কিশোরী হলো টগরের সম্পর্কিত বোন ওবোনঝি।সৌরভী ও পুটি।
ঘর ছাড়া হওয়ার পর এই আশ্রমে ওরাই এসে বসবাস করছিল!সৈরভীর স্বামী কয়েক বছর আগেই মারা গেছে।মা ওমেয়ে গ্রামের চালকূটে মুড়ি ভেজে সবজি চাষ করে দিনাতিপাত করে।
আনন্দের পরিচয় পেয়েই দুজনে খুব খুশি হয়ে পড়ে !আনন্দের মনে একটা স্বপ্ন ঝিলিক দিয়েওঠে…..পুটির সাথে যদি কানাইয়ের কোন্ঠি বদল হয় তাহলে ওর দায়িত্ব শেষ।কানাই পুটির সংসার সাজিয়ে সে পাড়ি দেবে অচেনার পথে।শেষ পিছুটান ফেলে অচিন খোঁজে!দ্বিধাগ্রস্ত আনন্দ প্রস্তাবটা দিতে কিন্তু কিন্তু করে! সৈরভী প্রস্তাব শুনে খুব খুশি হয় ।সে বলে আশ্রমের আসল অধিকারী তো আনন্দই।তার পালিত সন্তান কানাই তো আশ্রমের আসল উত্তরাধিকারী এদের সংসার হলে সেই আশ্রমে আনন্দ সৈরভীও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
মকর সংক্রান্তির পূর্ণ লগ্নে কানাই পুটির কনঠী বদল হয়।দো বাকি চর আনন্দে উদ বেল হয়ে ওঠে।বাতাসে বসন্ত রাগ বাজতে I।আনন্দমুখর পৌষালী নিশি!নলেন গুড় গুড় পিঠের গন্ধে মাতোয়ারা চরাচর।আনন্দ মুখ আশ্রম ছেড়ে নদী ঘাটের আসুদ তলায় বসে আনন্দ ,কাঁধের ঝুলি হাতে একতারা এক মনে গেয়ে চলে….
মিলন হবে কত দিনে ও আমার মনের মানুষের সনে….
সেই আর্তিটি হিমেল বাতাসে ভর করে উড়ে চলে অনন্তের উদ্দেশ্যে।সব পিছুটান ছেড়ে আবার পথে নামে আনন্দ বাউল….
অচেনার আনন্দে…… অচিন খোঁজে।