বিজয় নিজেদের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল
পরদিন সকাল আটটার সময় বিজয় নিজেদের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু আসতেই তাঁদের দোতলায় দীপার ঘরে নিয়ে গেল। বলল–’এইটে দীপার ঘর। এই ঘরেই তার যা কিছু আছে, বিশেষ কিছু নিয়ে যায়নি।’
বেশ বড় ঘর। জানলার পাশে খাট বিছানা, অন্য পাশে টেবিল চেয়ার বই-এর আলমারি। পিছনের দেয়ালে একটি এস্রাজ বুলছে। টেবিলের মাঝখানে ছোট্ট একটি জাপানী ট্রানজিস্টার রাখা আছে। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে একবার সন্ধানী চোখ ফিরিয়ে বলল–’দীপা দেবীর দেখছি গানবাজনার শখ আছে।’
বিজয় বলল—’হ্যাঁ, একটু-আধটু এস্রাজ বাজাতেও জানে। নিজের চেষ্টাতে শিখেছে।’
‘লেখাপড়া কত দূর শিখেছেন?’
‘স্কুলের পড়া শেষ পর্যন্ত পড়েছে। কলেজে দেওয়া হয়নি।’
‘আপনার বাবা বাড়িতে আছেন?’
‘না। বাবা মা হাসপাতালে গেছেন।’
‘দেবাশিসবাবু ভাল আছেন। আমি টেলিফোনে খবর নিয়েছিলাম। বোধহয় দু-তিন দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।’
‘হ্যাঁ। আপনারা চা খাবেন?’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে বলল–’আপত্তি কি? একবার হয়েছে, কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়।‘
‘আচ্ছা, আমি চা নিয়ে আসছি, আপনারা দেখুন। বই-এর আলমারির চাবি খুলে দিয়েছি। খাটের তলায় দুটো ট্রাঙ্ক আছে, তার চাবিও খোলা।’
বিজয় বেরিয়ে যাবার পর ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে বলল–’ঘরে তল্লাশ করার মত বিশেষ কিছু নেই দেখছি। আমি বই-এর আলমারিটা দেখি, তুমি ততক্ষণ ট্রাঙ্ক দুটো হাঁটকাও।’
রাখালবাবু খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক দুটো টেনে বার করলেন, ব্যোমকেশ আলমারি খুলে বই দেখতে লাগিল। বইগুলি বেশ পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো; প্রথম সারিতে কবিতা আর গানের বই; সঞ্চয়িতা গীতবিতান দ্বিজেন্দ্রগীতি নজরুলগীতিকা প্রভৃতি। দ্বিতীয় থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কয়েক ভলুম গ্রন্থাবলী। নীচের থাকে স্কুল-পাঠ্য বই। দীপা স্কুলে পড়ার সময় যে বইগুলি পড়েছিল সেগুলি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে।
ব্যোমকেশ বইগুলি একে একে খুলে দেখল, কিন্তু কোথাও এমন কিছু পেল না। যা থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আধুনিক কোনো লেখকের বই আলমারিতে নেই, এমন কি শরৎচন্দ্রের বইও না; এ থেকে পারিবারিক গোঁড়ামির পরিচয় পাওয়া যায়, দীপার মানসিক প্রবণতার কোনো ইশারা তাতে নেই।
‘ব্যোমকেশদা, একবার এদিকে আসুন।’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি একটা খোলা ট্রাঙ্কের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, সামনে মেয়েলী জামাকাপড়ের স্তুপ, হাতে পোস্টকার্ড আয়তনের একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা। খাতাটি ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে রাখালবাবু বললেন-‘কাপড়-চোপড়ের তলায় ছিল। পড়ে দেখুন।’
অটোগ্রাফের খাতা। বেশির ভাগ পাতাই খালি, সামনের কয়েকটি পাতায় উদয়মাধব প্রভৃতি বাড়ির কয়েকজনের হস্তাক্ষর, দু-একটি মেয়েলী কাঁচা হাতের নাম দস্তখত। তারপর একটি পাতায় একজনের স্বাক্ষরের ওপর একটি কবিতার ভগ্নাংশ-তোমার চোখের বিজলী-উজল আলোকে, পরাণে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে।–তারপর আর সব পৃষ্ঠা শূন্য।
অটোগ্রাফের খাতাটি যে দীপার তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, মলাটের ওপরেই তার নাম লেখা রয়েছে।
যিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটু মোচড় দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন তাঁর নামটি অপরিচিত নয়, তিনি বিশেষ একটি আড্ডার নিয়মিত সভ্য।
ব্যোমকেশ খাটো গলায় বলল–’হুঁ! আমাদের সন্দেহ তাহলে মিথ্যে নয়।’
বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চট্ট করে অটোগ্রাফের খাতাটি পকেটে পুরে রাখালবাবুকে চোখের ইশারা করল।
বিজয় দুহাতে দু’ পেয়ালা চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল, বলল—’আসুন। কিছু পেলেন?’
রাখালবাবু কেবল গলার মধ্যে শব্দ করলেন, ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল—’সত্যান্বেষণের পথ বড় দুৰ্গম। কোথায় কোন কানা গলির মধ্যে সত্য লুকিয়ে আছে, কে বলতে পারে! যাহোক, নিরাশ হবেন না, দু-চার দিনের মধ্যেই আসামী ধরা পড়বে।’
তারপর দু’জনে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় যেতে যেতে রাখালবাবু বললেন–তাহলে এখন বাকি রইল শুধু আসামীকে গ্রেপ্তার করা। অবশ্য পাকা রকম সাক্ষীসাবুদ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে পাকড়ানো যাবে না।’
ব্যোমকেশ বলল-না, তাকে পাকড়াবার একটা ফন্দি বার করতে হবে। কিন্তু তার আগে নিঃসংশয়ভাবে জানা দরকার, দেবাশিসের স্ত্রী এ ব্যাপারে কতখানি লিপ্ত আছে।’
হাসপাতালে ডাক্তার গুপ্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। একটি নিভৃত ঘরে দীপার সঙ্গে ব্যোমকেশ ও রাখালবাবুর কথা হল। ব্যোমকেশ বলল–’আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। কেন প্রশ্ন করতে চাই এখন জানতে চাইবেন না, পরে আপনিই জানতে পারবেন।’
দীপা সহজভাবে বলল—’কি জানতে চান, বলুন।’ তার মুখে আতঙ্কের ভাব আর নেই, সে তার স্বাভাবিক সাহস অনেকটা ফিরে পেয়েছে।
সওয়াল জবাব আরম্ভ হল। রাখালবাবু অচঞ্চল চোখে দীপার মুখের পানে চেয়ে রইলেন।
ব্যোমকেশ বলল–’নৃপতি লাহা নামে একটি ভদ্রলোকের বাড়িতে যাঁদের নিয়মিত আড্ডা বসে তাঁদের আপনি চেনেন?
দীপার চোখের দৃষ্টি সতর্ক হল, সে বলল—’হ্যাঁ, চিনি। ওঁরা সবাই আমার দাদার বন্ধু।’
‘ওঁরা আপনার বাপের বাড়িতে যাতায়াত করেন?’
‘বাড়িতে কাজকর্ম থাকলে আসেন।’
‘এঁদের নাম নৃপতি লাহা, সুজন মিত্র, কপিল বসু প্রবাল গুপ্ত, খড়্গ বাহাদুর। এঁদের ছাড়া আর কাউকে চেনেন?’
‘না, কেবল এদেরই চিনি।’
‘আচ্ছা, নৃপতি লোহা বিপত্নীক আপনি জানেন?’
‘…যেন শুনেছিলাম।’
‘এঁদের মধ্যে আর কারুর বিয়ে হয়েছে কিনা জানেন?’
‘বোধহয়…আর কারুর বিয়ে হয়নি।’
‘প্রবাল গুপ্ত কি বিবাহিত?’
‘ঠিক জানি না…বোধ হয় বিবাহিত নয়।’
‘প্রবাল গুপ্ত বিবাহিত…সম্প্রতি স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে।’
‘…আমি জানতাম না।’
‘যাক। কপিল বসু লোকটিকে আপনার কেমন লাগে?
‘ভালই তো।’
‘ওর সম্বন্ধে কোনো কুৎসা শুনেছেন?’
‘না।’
‘আর সুজন মিত্র? সে সিনেমার আর্টিস্ট, তার সম্বন্ধে কিছু শোনেননি?’
‘না, ও-সব আমি কিছু শুনিনি।’
‘আপনি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সুজন মিত্রের অভিনয় কেমন লাগে?
‘খুব ভাল।’
‘উনি কেমন লোক?’
‘দাদার বন্ধু, ভালই হবেন। দাদা মন্দ লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন না।’
‘তা বটে। আপনি ফুটবল খেলা দেখেছেন?’
‘ছেলেবেলায় দেখেছি, যখন স্কুলে পড়তুম।’
‘খড়্গ বাহাদুরের খেলা দেখেছেন?’
‘না… রেডিওতে খেলার কমেন্টারি শুনেছি।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। —আপনার স্বামীর হৃদযন্ত্র বুকের ডান দিকে আপনি জানেন?’
ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে চাইল-‘জানেন?’
‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগে দুপুর রাত্রে আমার স্বামীর কম্প দিয়ে জ্বর এসেছিল। আমাকে ডাক্তার ডাকতে বললেন। আমি জানতুম না ওঁদের পারিবারিক ডাক্তার কে, তাই আমার বাপের বাড়ির ডাক্তারকে ফোন করলাম। সেনকাকা এসে ওঁকে পরীক্ষা করলেন, তারপর যাবার সময় আমাকে আড়ালে বলে গেলেন যে, ওঁর হৃদযন্ত্র উল্টে দিকে। এরকম নাকি খুব বেশি দেখা যায় না।’
প্রকাণ্ড হাফ-ছাড়া নিশ্বাস ফেলে ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল, বলল—’আমার বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। আর কিছু জানবার নেই, আপনি স্বামীর কাছে যান। — চলো রাখাল।’
হাসপাতালের বাইরে এসে ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে প্রশ্ন করল—’কি দেখলে? কি বুঝলে?’ রাখালবাবু বললেন–কোনো ভুল নেই, মেয়েটি নির্দোষ। প্রতিক্রিয়া যখন যেমনটি আশা করা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি পাওয়া গেছে। এখন কিং কর্তব্য?’
ব্যোমকেশ বলল—‘এখন তুমি থানায় যাও, আমি বাড়ি যাই। ভাল কথা, একটা বুলেট-প্রুফ গেঞ্জি যোগাড় করতে পার?’
‘পারি। কী হবে?’
‘একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। আজ রাত্রে গেঞ্জি নিয়ে আমার বাড়িতে এস, তখন বলব?’
সন্ধ্যের পর ব্যোমকেশ একা নৃপতির আড্ডায় গেল। সকলেই উপস্থিত ছিল, ব্যোমকেশকে ছেঁকে ধরল। নৃপতি তার সামনে সিগারেটের কৌটো খুলে ধরে বলল—’খবর নিয়েছি। দু-এক দিনের মধ্যেই দেবাশিসকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। ওর বিপন্মুক্তি উপলক্ষে আমি পার্টি দেব, আপনাকে আসতে হবে।’
ব্যোমকেশ বলল–’নিশ্চয় আসব।’
কপিল ব্যোমকেশের গা ঘেঁষে বসে আবদারের সুরে বলল–’আপনার সত্যান্বেষণ কত দূর অগ্রসর হল, বলুন না ব্যোমকেশবাবু।’
ব্যোমকেশ হেসে বলল—’দিল্লী দূরস্ত। শজারুর কাঁটার ওস্তাদটি কে তা এখনো জানা যায়নি। তবে একটা থিওরি খাড়া করেছি।’
সুজন গলা বাড়িয়ে বলল—’কি রকম থিওরি?’
ব্যোমকেশ সিগারেটে কয়েকটা ধীর মন্থর টান দিয়ে বলতে আরম্ভ করল—’ব্যাপারটা হচ্ছে এই। কোনো একজন অজ্ঞাত লোক শজারুর কাঁটা দিয়ে প্রথমে একটা ভিখিরিকে খুন করল, তারপর এক মজুরকে খুন করল, তারপর আবার খুন করল এক দোকানদারকে। এবং সর্বশেষে দেবাশিসবাবুকে খুন করবার চেষ্টা করল। চার বারই অস্ত্র হচ্ছে শজারুর কাঁটা। অর্থাৎ হত্যাকারী জানাতে চায় যে চারটি হত্যাকার্য একই লোকের কাজ।
‘এখন হত্যাকারী যদি পাগল হয় তাহলে কিছুই করবার নেই। পাগল অনেক রকম হয়; এক ধরনের পাগল আছে যাদের পাগল বলে চেনা যায় না; তারা অত্যন্ত ধূর্ত, তাদের খুন করার কোনো যুক্তিসঙ্গত মোটিভ থাকে না। এই ধরনের পাগলকে ধরা বড় কঠিন।
‘কিন্তু যদি পাগল না হয়? যদি পুলিসের চোখে ধুলো দেবার জন্যে কেউ পাগল সেজে শজারুর কাঁটার ফন্দি বার করে থাকে? মনে করুন, দেবাশিসবাবুর এমন কোনো গুপ্ত শত্ৰু আছে। যে তাঁকে খুন করতে চায়। সরাসরি খুন করলে ধরা পড়ার ভয় বেশি, তাই সে ভিখিরি খুন করে কাজ আরম্ভ করল; তারপর মজুর, তারপর দোকানদার, তারপর দেবাশিসবাবু। স্বভাবতাই মনে হবে দেবাশিসবাবু হত্যাকারীর প্রধান লক্ষ্য নয়, একটা বিকৃতমস্তিষ্ক লোক যখন যাকে সুবিধে পাচ্ছে খুন করে যাচ্ছে। হত্যাকারী যে দেবাশিসবাবুকেই খুন করবার জন্যে এত ভণিতা করেছে। তা কেউ বুঝতে পারবে না। —এই আমার থিওরি।’
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হয়ে রইল, তারপর নৃপতি বলল—’কিন্তু মনে করুন। এর পর আবার একটা খুন হল শজারুর কাঁটা দিয়ে! তখন তো বলা চলবে না যে দেবাশিসই হত্যাকারীর আসল লক্ষ্য।’
ব্যোমকেশ বলল–’না। তখন আবার নতুন রাস্তা ধরতে হবে।’
কপিল বলল–’খুনীকে কি ধরা যাবে?
ব্যোমকেশ বলল–’চেষ্টার ত্রুটি হবে না।’
এমন সময় কফি এল। প্রবাল উঠে গিয়ে পিয়ানোতে মৃদু টুং-টাং আরস্তু করল। ব্যোমকেশ কফি শেষ করে আরো কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে বাড়ি ফিরে চলল।
ব্যোমকেশ বাড়ি ফিরে আসার কয়েক মিনিট পরে পৌনে ন’টার সময় রাখালবাবু এলেন। তাঁর হাতে একটি মোড়ক। ব্যোমকেশ বলল–’এনেছ?’
রাখালবাবু মোড়ক খুলে দেখালেন; ব্রোকেডের মত কাপড় দিয়ে তৈরি একটি ফতুয়া, কিন্তু সোনালী বা রূপালী জরির ব্রোকোড নয়, স্টীলের জরি দিয়ে তৈরি। ঘন-পিনদ্ধ লৌহ-জালিক। জামার ভিতরে পরলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু এই কঠিন বর্ম ভেদ করা ছোরাছুরি তো দূরের কথা, পিস্তল রিভলবারেরও অসাধ্য।
ব্যোমকেশ জামাটি নিয়ে নেড়েচেড়ে পাশে রাখল, বলল—’আমার গায়ে ঠিক হবে। এখন আর একটা কথা বলি; আমাদের শজারুর পিছনে লেজুড় লাগাবার ব্যবস্থা করেছ?’
রাখালবাবু বললেন–সব ব্যবস্থা হয়েছে। আজ রাত্ৰি সাতটা থেকে লেজুড় লেগেছে, এক লহমার জন্যে তাকে চোখের আড়াল করা হবে না। দিনের বেলাও তার পিছনে লেজুড় থাকবে।’
ব্যোমকেশ বলল–’বেশ। এখন এস পরামর্শ করি। আমি পুকুরে চার ফেলে এসেছি–’
খাটো গলায় দু’জনের মধ্যে অনেকক্ষণ পরামর্শ হল। তারপর সাড়ে ন’টা বাজলে রাখালবাবু ওঠবার উপক্রম করছেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
ব্যোমকেশ ফোন তুলে নিয়ে বলল—’হ্যালো।’
অপর প্রাস্ত থেকে চেনা গলা শোনা গেল–’ব্যোমকেশবাবু? আপনি একলা আছেন?’
ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে সঙ্কেত-ভরা দৃষ্টিপাত করে বলল—’হ্যাঁ, একলা আছি। আপনি–’
‘গলা শুনে চিনতে পারছেন না?’
‘না। আপনার নাম?’
‘যখন গলা চিনতে পারেননি। তখন নাম না জানলেও চলবে। আজ সন্ধ্যের পর আপনি যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে আমি ছিলাম। একটা গোপন খবর আপনাকে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সকলের সামনে বলতে পারলাম না।’
‘গোপন খবর! শজারুর কাঁটা সম্বন্ধে?’
‘হ্যাঁ। আপনি যদি আজ রবীন্দ্র সরোবরের বড় ফটকের কাছে আসেন আপনাকে বলতে পারি।‘
‘বেশ তো, বেশ তো। কখন আসব বলুন।’
‘যত শীগগির সম্ভব। আমি অপেক্ষা করব। একলা আসবেন কিন্তু। অন্য কারুর সামনে আমি কিছু বলব না।’
‘বেশ। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরুচ্ছি।’
টেলিফোন রেখে ব্যোমকেশ যখন রাখালবাবুর দিকে তাকাল তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সে বলল, ‘টোপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ টোপ গিলেছে। এত শীগগির ওষুধ ধরবে ভাবিনি। রাখাল, তুমি—’
ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলে ফেলল, রাখালবাবু তাকে বুলেট-প্রুফ ফতুয়া পরাতে পরাতে বললেন—’আমার জন্যে ভাববেন না, আমি ঠিক যথাস্থানে থাকব। শজারুর পিছনে লেজুড় আছে, তিনজনে মিলে শজারুকে কাবু করা শক্ত হবে না।’
‘বেশ।’
ব্যোমকেশ ফতুয়ার ওপর আবার পাঞ্জাবি পরিল, তারপর রাখালবাবুর দিকে একবার অর্থপূর্ণ ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল। রাখালবাবু কব্জিতে ঘড়ি দেখলেন, দশটা বাজতে কুড়ি মিনিট। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। প্রচ্ছন্নভাবে যথাস্থানে যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে হবে।
রবীন্দ্র সরোবরের সদর ফটকের সামনে লোক চলাচল নেই; কদাচিৎ একটা বাস কিংবা মোটর হুস করে সাদার্ন অ্যাভেনু দিয়ে চলে যাচ্ছে।
ব্যোমকেশ দ্রুতপদে সাদার্ন অ্যাভেনু রাস্তা পেরিয়ে ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল; এদিক-ওদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। রবীন্দ্র সরোবরের ভিতরে আলো-আঁধারিতে জনমানব চোখে পড়ে না।
ব্যোমকেশ ফটকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খানিক ইতস্তত করল, তারপর ভিতর দিকে অগ্রসর হল। দু-চার পা এগিয়েছে, একটি লোক অদূরের গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল, হাত তুলে ব্যোমকেশকে ইশারা করে ডাকল। ব্যোমকেশ তার কাছে গেল, লোকটি বলল, চলুন, ওই বেঞ্চিতে বসা যাক।।’
জলের ধারে গাছের তলায় বেঞ্চি পাতা। ব্যোমকেশ গিয়ে বেঞ্চিতে ডানদিকের কিনারায় বসল। চারিদিকের ঝিকিমিকি আলোতে অস্পষ্টভাবে মুখ দেখা যায়, তার বেশি নয়। ব্যোমকেশ বলল—‘এবার বলুন, আপনি কি জানেন।’
লোকটি বলল–’বলছি। দেখুন, যার কথা বলতে চাই সে আমার ঘনিষ্ঠ লোক, তাই বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। সিগারেট আছে?’
ব্যোমকেশ সিগারেটের প্যাকেট বার করে দিল; লোকটি সিগারেট নিয়ে প্যাকেট ব্যোমকেশকে ফেরত দিল, নিজের পকেট থেকে বোধকরি দেশলাই বার করতে করতে হঠাৎ বলে উঠল—’দেখুন, দেখুন কে আসছে।’ তার দৃষ্টি ব্যোমকেশকে পেরিয়ে পাশের দিকে প্রসারিত, যেন ব্যোমকেশের দিক থেকে কেউ আসছে।
ব্যোমকেশ সেই দিকে ঘুরে বসল। সে প্রস্তুত ছিল, অনুভব করল তার পিঠের বাঁ দিকে বুলেট-প্রুফ আবরণের ওপর চাপ পড়ছে। ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে পিছু ফিরল। লোকটি তার পিঠে শজারুর কাঁটা বিঁধিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল, পলকের জন্যে হতবুদ্ধির মত চাইল, তারপর দ্রুত উঠে পালাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যোমকেশের বজ্রমুষ্টি লোহার মুগুরের মত তার চোয়ালে লেগে তাকে ধরাশায়ী করল।
ইতিমধ্যে আরো দু’টি মানুষ আলাদিনের জিনের মত আবির্ভূত হয়েছিল, তারা ধরাশায়ী লোকটির দু’হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। রাখালবাবু তার হাত থেকে শজারুর কাঁটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন–’প্রবাল গুপ্ত, তুমি তিনজনকে খুন করেছ এবং দু’জনকে খুন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছ। চল, এবার থানায় যেতে হবে।’