সেই বিশাল প্রাসাদ
গাড়িটা একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল সেই বিশাল প্রাসাদ।
রোদ্র নেই বলে বিকেলবেলাতেই সন্ধে-সন্ধে ভাব। সেই ম্লান আলোয় বাড়িটাকে মনে হয় আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিক থেকে আর একদিকের যেন শেষ নেই।
কাকাবাবু মহাবিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, এত বড় বাড়ি, আমি যে আগে ধারণাই করতে পারিনি।
অসিত বলল, এ যে প্রায় কাল।
কাকাবাবু বললেন, আমি একবার ওড়িশার একটা পুরনো আমলের ফাঁকা রাজবাড়িতে থেকেছিলাম। কিন্তু সে-বাড়িটাও এত বড় নয়।
অসিত বলল, এমন একটা গজাস বাড়ি ভেঙে ফেলবেন? খুবই অন্যায় কথা কিন্তু!
বিমান বলল, কী করি বলুন তো! এ-বাড়ি এমনিতেই ভেঙে পড়ছে। পুরো মেরামত না করলে আর রক্ষা করা যাবে না। তার জন্য লক্ষ-লক্ষ টাকা দরকার, সে-টাকা কোথায় পাব বলুন।
দীপা বলল, মাঠের মধ্যে এরকম একটা জগদ্দল-মাকা বাড়ি রেখেই বা লাভ কী? আমরা তো কেউ এখানে থাকতে আসব না।
বিমান বলল, আমার আর দু ভাইয়ের মধ্যে একজন থাকে দিল্লিতে, আর-একজন জাপানে। তারাও কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। তারাই আমাকে বলেছে বিক্রি করে দিতে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যিনি কিনেছেন, তিনি এটা ভেঙে ফেলতে চাইছেন কেন?
বিমান বলল, কিনেছেন এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক। তাঁর পাইপের কারখানা আছে আসানসোলে। এ বাড়িটা ভেঙে তিনি এখানে আর একটা কারখানা তৈরি করবেন।
অসিত বলল, এত চমৎকার একটা প্যালেসের বদলে হবে চিমনিওয়ালা কারখানা! ছি ছি।
কাকাবাবু বললেন, ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ওল্ড অর্ডার চেইঞ্জেথ, ইলডিং প্লেস টু নিউ!
দীপা বলল, রবীন্দ্রনাথেরও লেখা আছে, হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এসেছে দুজন লোক। একজনের বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ, অন্যজন বেশ বৃদ্ধ।
বৃদ্ধটিকে বিমান বলল, রঘুদা, মালপত্রগুলো নামিয়ে নাও, আর শিগগির চায়ের জল চাপাতে বলল। চা, দুধ চিনি আমি সঙ্গে এনেছি।
গাড়ি থেকে নেমে কাকাবাবুকে বলল, আসুন, আগে আমাদের ঘরগুলো দেখে নিই।
সামনেই একটা বিরাট সিংহ দরজা। দু পাশের দুটো পাথরের সিংহ একেবারে ভাঙা। লোহার গেটটা কিন্তু অটুট আছে। ভেতরে এককালে নিশ্চয় বাগান ছিল, এখন জংলা হয়ে আছে। তারপর ধাপেধাপে অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে, মুর্শিদাবাদের নবাব প্যালেসের মতন।
কাকাবাবু কাচ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যেতেই অসিত এগিয়ে এসে ভদ্রতা করে বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করব?
কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ। দরকার হবে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আমার কোনও কষ্ট হয় না। নামার সময় বরং কিছুটা অসুবিধা হয়।
বিমান বলল, আরও সিঁড়ি আছে। এটা একতলা। একতলার ঘরগুলো ব্যবহার করা যায় না। আবর্জনায় ভর্তি। দোতলায় চার-পাঁচখানা ঘর মোটামুটি ঠিক আছে।
কাকাবাবু বললেন, এখানে কাছাকাছি নদী আছে নিশ্চয়ই?
দীপা বলল, না, নদী-টদি নেই ধারেকাছে।
কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে সাধারণত নদীর ধারেই এরকম বড় বাড়ি তৈরি করা হত।
বিমান বলল, ঠিক বলেছেন, শুনেছি, আগে একটা নদী ছিল। সেটা শুকিয়ে গেছে অনেকদিন। তবে দিঘি আছে দুটো বেশ বড় বড়।
দোতলায় উঠে এসে বিমান বলল, আমাদের ঘরগুলো অবশ্য পাশাপাশি হবে না। এদিকে দুটো আছে ব্যবহার করা যায়। আর একটা একটু দূরে।
অসিত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আপনারা এদিকে থাকুন। আমাকে দূরের ঘরটা দিন।
বিমান বলল, ঠিক আছে। কাকাবাবু আমাদের পাশেই থাকবেন। তাতে দীপার যদি ভূতের ভয় একটু কমে।
একটা ঘরের তালা খুলে বিমান সুইচ টিপে আলো জ্বালল।
কাকাবাবু বললেন, ইলেকট্রিসিটি আছে, যাঃ, তা হলে তো অনেকটাই রহস্য চলে গেল। এসব জায়গায় টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলবে, হঠাৎ ঝড়ে সেই লণ্ঠন উলটে গিয়ে ভেঙে যাবে, তবেই তো মজা!
দীপা বলল, ইলেকট্রিসিটি থাকলে আমি আসতাম নাকি? রাত্তিরবেলা আলোর চেয়েও বেশি দরকার ফ্যান। ফ্যান না চললে আমি ঘুমোতেই পারি না।
ঘরটায় আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। একটা মাঝারি ধরনের খাট, একটা দেওয়াল আলমারি আর কয়েকটা চেয়ার। একটা ছোট শ্বেত পাথরের টেবিল। ঘরটা অবশ্য অন্য সাধারণ ঘরের চারখানা ঘরের সমান। এত জায়গা খালি পড়ে আছে যে মনে হয়, সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলা যায়।
অসিত চেয়ারগুলো আর খাটটায় একবার হাত বুলিয়ে বলল, এগুলো তো তেমন পুরনো নয়।
বিমান বলল, আগেকার জিনিস তেমন কিছু নেই। অনেক নষ্ট হয়ে গেছে, আমার বড়মামা বেশ কিছু ফার্নিচার বিক্রিও করে দিয়েছেন। জমিদারি-টমিদারি তো কিছু আর ছিল না, অন্য আয়ও ছিল না, বড়মামা এখানকার জিনিসপত্র বিক্রি করে খরচ চালাতেন।
কাকাবাবু বললেন, উনি বৃদ্ধ বয়েসেও একা থাকতেন এত বড় বাড়িতে?
বিমান বলল, আগে দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন ছিল কয়েকজন। এখানে থেকে কোনও লাভ নেই বলে তারাও চলে গেছে আস্তে-আস্তে। বড়মামা মাঝে-মাঝে যেতেন কলকাতায়। আমাদের বাড়ি থাকতেন না, উঠতেন গ্র্যাণ্ড হোটেলে। কিছু একটা ব্যবসা করতেন শুনেছি, তবে সে ব্যবসা সাকসেসফুল হয়নি কখনও। টাকাটাই নষ্ট হয়েছে শুধু।
দীপা বলল, আসলে পাগল লোক ছিলেন, সেটা বলো না।
বিমান হেসে বলল, ঠিক পাগল নয়, পাগলাটে! আমার বাবা তো বলেন, আমাদের মামাবাড়ির সবাই ছিটগ্রস্ত! আমার মা সুন্ধু?
দীপা আবার বলল, তোমাদের এক দাদু একেবারে বদ্ধ পাগল ছিলেন না?
বিমান বলল, যা, ক্রিশ্চানদাদু! তাঁর গল্প পরে বলব! পুরনো বংশগুলোতে যেন কিছু একটা অভিশাপ লাগে, আস্তে-আস্তে শেষ হয়ে যায় এইরকমভাবে। বড়মামার পর রাও বংশ শেষ হয়ে গেল!
কাকাবাবু বললেন, রাও!
বিমান বলল, টাইটেল শুনলে অবাঙালি মনে হয় তো? আমার মামারা অবাঙালিই ছিলেন এককালে। নবাবি আমলে বাংলাদেশে এসে সেই করেছিলেন। হয়তো লড়াই করে নবাব আলিবর্দিকে খুশি করেছিলেন।
অসিত বলল, এইসব পুরনো বাড়িতে গুপ্তধন-টুপ্তধন থাকে অনেক সময়। দেখুন বাড়ি ভাঙার সময় কিছু পেয়ে যেতে পারেন!
বিমান বলল, সে গুড়ে বালি! আমার ছোটভাই, যে জাপানে থাকে, সেই ধীমানের মাথাতেও এই চিন্তা এসেছিল। বাড়িটা আমাদের ভাগে পড়বার পর ধীমান একবার এসেছিল এখানে। আমরা দু ভাই সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। দামি জিনিস প্রায় কিছুই নেই। আগেই যে-যা পেরেছে বিক্রি করে দিয়েছে। এ বাড়িতে সুড়ঙ্গ-টুরঙ্গ কিছু নেই।
কাকাবাবু বললেন, যাক, বাঁচা গেছে! সুড়ঙ্গ দিয়ে হাঁটাচলা করা আমাদের পক্ষে বড্ড কষ্টকর! অথচ আমার এমনই ভাগ্য, কতবার যে সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাতে হয়েছে কিংবা চোর তাড়া করতে হয়েছে তার ঠিক নেই! এখানে এসে গুপ্তধনও খুঁজতে হবে না, সুড়ঙ্গতেও ঢুকতে হবে না।
অসিত বলল, সুড়ঙ্গ যে নেই, সে-বিষয়ে আপনি শিওর হলেন কী করে? হয়তো আপনারা খুঁজে পাননি। আগেকার দিনে গোপনে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো থাকতই!
বিমান বলল, সেরকম কিছু থাকলে আমার মা অন্তত জানতেন। আমার মা তো জন্মেছেন এই বাড়িতে। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, ওঁদের ছোটবেলা থেকেই গুপ্তধন আর সুড়ঙ্গ খোঁজা শুরু হয়েছিল। আমার ছোটমামা অনেক দেওয়াল ভেঙে ফেলেছেন। নাঃ, ওসব কিছু নেই।
অসিত ছোট শ্বেত পাথরের টেবিলটা টোকা মেরে পরীক্ষা করে বলল, এটা মন্দ নয়। তবে মাত্র ষাট-সত্তর বছরের পুরনো। চলুন, আমার ঘরটা দেখা যাক।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু ঘরটার পেছন দিকের একটা জানলা খুললেন। অনেকদিন এ-জানলা খোলা হয়নি বোঝা যায়। বড় পেতলের ছিটকিনি আটা, খুলতে বেশ জোর লাগল।
জানলাটা খুলতেই এমন একটা সরু আর তীক্ষ আওয়াজ শোনা গেল যে, কাকাবাবু চমকে উঠলেন। তারপর ঝটাপট শব্দে উড়ে গেল একটা চিল। জানলার বাইরেই চিলটা বাসা করেছে, জানলা খোলায় সে বেশ বিরক্ত হয়েছে।
জানলা দিয়ে একটা সুন্দর দৃশ্য দেখা গেল।
বৃষ্টি থেমে গেছে, পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ। কাছেই একটা মস্ত বড় ঝিল, সেখানে ফুটে আছে অজস্র পদ্মফুল। ঝিলের ওপারের আকাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। দারুণ লালের ছড়াছড়ি।• আকাশ থেকে লাল-লাল শিখা এসে পড়েছে পদ্মফুলগুলোর ওপর।
কাকাবাবু মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন সেই দৃশ্য।
একটু পরেই দরজার কাছ থেকে একজন বলল, সার, চা দেওয়া হয়েছে। আপনাকে ডাকছেন?
কাকাবাবু পেছন ফিরে দেখলেন অল্পবয়েসী কাজের লোকটিকে।
কাকাবাবু বললেন, চলো, যাচ্ছি।
বারান্দাটা প্রায় একটা রাস্তার মতন চওড়া, তার পাশে-পাশে ঘর। কাকাবাবু ডান দিকে একটুখানি গিয়েই দেখতে পেলেন, ডাইনিং রুম। এ-ঘরেও প্রায় বিশেষ কিছুই নেই, একটা বড় কাঠের টেবিল আর কয়েকখানা সাধারণ চেয়ার, দেওয়ালের গায়ে একটা কাচ-ভাঙা আলমারি। টেবিলটার পালিশ উঠে গেছে। জমিদার বাড়িতে এসব একেবারেই মানায় না!
অসিত টেবিল-চেয়ারগুলোয় হাত বুলিয়ে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, আপনার মামা ভাল-ভাল জিনিস সব বিক্রি করে দিয়ে বাজে ফার্নিচারে ভরিয়ে রেখে গেছেন বাড়িটা। আমার ঘরে যে খাটটা রয়েছে, সেটার দাম একশো টাকাও হবে না।
বিমান লজ্জা পেয়ে বলল, আপনি তা হলে আমাদের ঘরটায় এসেই থাকুন। সেখানে একটা পুরনো পালঙ্ক আছে।
অসিত বলল, না, না, তার দরকার নেই। ঘরটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। জানলা দিয়ে অনেকখানি ফাঁকা মাঠ দেখা যায়, দূরে একটা জঙ্গল।
দীপা বলল, খাবারগুলো জুড়িয়ে যাবে, আগে খেয়ে নিন।
দুজন কাজের লোক টেবিলের ওপর কয়েকটা প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেল। একটাতে হ্যামবার্গার, একটাতে প্যাটিস, একটাতে সন্দেশ।
কাকাবাবু বললেন, এ কী, এর মধ্যে এতসব খাবার জোগাড় করলে কী করে?
দীপা বলল, আমি সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এখানে কী পাওয়া যাবে, না যাবে তার ঠিক নেই।
বিমান বলল, দীপা গাড়ি ভর্তি করে ভাল চাল, মুগের ডাল, পাঁপড়, আচার, চিজ, মাখন এইসব নিয়ে এসেছে।
কাকাবাবু বললেন, খাওয়াদাওয়া তা হলে বেশ ভালই হবে মনে হচ্ছে।
বিমান বলল, কালকে দিঘিতে জাল ফেলিয়ে মাছ ধরব।
অসিত একটা হ্যামবার্গারে কামড় দিয়ে বলল, চা-টা খাওয়ার পর আমরা পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখব।
বিমান বলল, সন্ধে হয়ে গেল। সব জায়গায় কিন্তু আলো নেই। ইলেকট্রিক রয়েছে মাত্র চার-পাঁচখানা ঘরে।
অসিত বলল, আমার কাছে বড় টর্চ আছে।
বিমান বলল, ঠিক আছে আমরা যতটা পারি দেখব। তবে সারা বাড়িটা কাল দিনের আলোতেই ভাল দেখা যাবে।
কাকাবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, এতদিনের পুরনো বাড়ি, এখানে সেকালের কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই?
বিমান বলল, সেরকম কিছু নেই। আমি ছেলেবেলায় এসে কয়েকখানা তলোয়ার আর বশা দেখেছিলাম। কিছু বন্দুক-পিস্তল ছিল। কিন্তু সবই বিক্রি হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত বড়মামার ঘরে একটা রাইফেল ছিল। সেটাও আমি থানায় জমা দিয়ে দিয়েছি। আমাদের কলকাতার বাড়িতে রাইফেল রাখার কোনও মানে হয় না। এখানে থাকলে চুরি হয়ে যেত!
অসিত বলল, পুরনো ফায়ার আর্মসের অনেক দাম হয়। ইস, আমাকে একবার দেখালেন না!
দীপা বলল, হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা দুখানা ছুরিও পাওয়া গিয়েছিল। সে দুটো আমরা রেখে দিয়েছি।
অসিত ব্যস্ত হয়ে বলল, কই, কই, দেখান তো?
দীপা বলল, সে দুটো কলকাতার বাড়িতে রয়েছে। আর-একটা বেশ ছোট্ট সুন্দর পাথরের বাক্সও পেয়েছিলাম। দেখলেই মনে হয়, গয়নার বাক্স। কিন্তু তার মধ্যে একটুকরো গয়নাও নেই!
বিমান বলল, বড়মামা তো অনেকদিন বেঁচেছেন, দামি জিনিস সবই বিক্রি করে দিয়ে গেছেন।
অসিত বলল, খালি গয়নার বাক্সেরও অনেক দাম হতে পারে। সেটা কতদিনের পুরনো সেটা দেখতে হবে।
দীপা জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী করে বোঝেন কতদিনের পুরনো?
অসিত বলল, তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। সামান্য একটুকরো কাগজও পরীক্ষা করে বলা যায়, কতদিন আগে সেটা তৈরি হয়েছিল।
কাকাবাবু হেসে বললেন, মনে করো দীপা, তোমার ওই গয়নার বাক্সটা ছিল বেগম নূরজাহানের, তা হলেই ওটার দাম হয়ে যাবে কয়েক লক্ষ টাকা। আমি কলকাতায় একটা বাড়িতে একটা সাধারণ কাচের দোয়াত দেখেছিলাম, সেই দোয়াতটা সম্রাট নেপোলিয়ান ব্যবহার করতেন। সেইজন্যই সেটার অনেক দাম।
অসিত বলল, ওই দোয়াতটা কোন বাড়িতে আছে আমি জানি। আমি পাঁচ লক্ষ টাকা দাম দিতে চেয়েছিলাম, তাও তারা বিক্রি করতে রাজি হয়নি।
দীপা বলল, একটা দোয়াতের দাম পাঁচ লাখ টাকা?
বিমান বলল, নেপোলিয়ানের দোয়াত!
চা-পর্ব শেষ হতে সবাই বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
বারান্দাটা দুদিকেই চলে গেছে অনেকখানি। বিমান বলল, ডান দিকটায় অনেকখানি ভাঙা। ছাদ খসে পড়েছে। বিশেষ কিছু দেখার নেই। চলুন, বাঁ দিকটা দেখা যাক।
অসিত বলল, চলুন, পরে ডান দিকটাও দেখব।
অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরেটা, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু কাকাবাবুর ক্রাচের আওয়াজ হতে লাগল খট খট করে। পর পর। ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। কোনওটাতেই তালা নেই, বিমান দরজা ঠেলে ঠেলে খুলে দেখতে লাগল। তিন-চারখানা ঘরে কিছুই নেই। একটা ঘরে অনেকগুলো ভাঙা চেয়ার-টেবিল উলটোপালটা করে রাখা। একটা ঝাড়লণ্ঠন চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে, মনে হয়, ওপর থেকে একদিন খসে পড়েছিল, তারপর আর কেউ সেটাতে হাত দেয়নি।
অসিত জিনিসগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।
দীপা খানিকটা অধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওগুলো কালকে ভাল করে দেখবেন। এখন চলুন, তাড়াতাড়ি একবার চক্কর দিয়ে আসা যাক।
অসিত ঝাড়লণ্ঠনের একটা প্রিজম তুলে নিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে, চলুন।
আর-একটা ঘরে রয়েছে শুধু বালিশ আর তোশক। লাল মখমলের কয়েকটা তাকিয়া বেশ দামি মনে হলেও সেগুলো ছিঁড়ে তুলো বেরিয়ে এসেছে।
দীপা বলল, এই ঘরটায় কি বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ। এখানে কোনও বাঘ-টাঘ লুকিয়ে নেই তো?
কাকাবাবুর সঙ্গেও টর্চ রয়েছে। তিনি ওপরের দিকে আলো ফেলে বললেন, ওই দ্যাখো, কত চামচিকে বাসা বেঁধে আছে। চামচিকের এইরকম গন্ধ হয়!
দীপা বলল, চলো, চলো, শিগগির এখান থেকে বেরিয়ে চলো।
আর-একটুখানি যাওয়ার পর বারান্দাটা একদিকে বাঁক নিয়েছে। সেখানে ছাতের দিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। পাশে একটা খালি ঘর, তার দরজা খোলা।
সেখানে দাঁড়িয়ে বিমান বলল, আমার ছোটমামা এখান থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন।
দীপা বলল, পড়ে গিয়েছিলেন, না ঠেলে মেরে ফেলা হয়েছিল?
বিমান বলল, অনেকে তা-ই বলে। কিন্তু শুধু-শুধু কেউ ঠেলে ফেলবে কেন?
দীপা বলল, তোমার মা-ও তো বলেন, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল!
অসিত বারান্দার রেলিংটায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এটা তো বেশ মজবুতই রয়েছে এখনও, এখান দিয়ে শুধু-শুধু কারও পড়ে যাওয়া তো স্বাভাবিক নয়!
বিমান বলল, মোট কথা, কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি না, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কাকাবাবু বললেন, বিমান, তোমার ওই ছোটমামা কতদিন আগে মারা গেছেন?
বিমান বলল, প্রায় কুড়ি বছর!
কাকাবাবু বললেন, ওঃ অতদিন আগে। তা হলে আর ওই ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। এখন তো আর ওই রহস্যের সমাধান করা যাবে না।
অসিত জিজ্ঞেস করল, ওপরের সিঁড়িটা ছাদে গেছে? নিশ্চয়ই মস্ত বড় ছাদ।
বিমান বলল, ছাদে একখানা ঘর আছে, সেটাই ছিল আমাদের ক্রিশ্চান দাদুর ঘর। সেটা বছরের পর বছর তালাবন্ধই পড়ে থাকে।
দীপা বেশ জোরে বলে উঠল, ওখানে এখন যাওয়া হবে না। না, না, কিছুতেই না। দিনের বেলা দেখবেন।
অসিত বলল, ছাদে যেতে তো ভালই লাগবে। বাইরেটাও অনেকখানি। দেখা যাবে।
দীপা আবার সেইরকমভাবে বলল, কাল সকালে।
অসিত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের খালি ঘরটায় কিসের যেন একটা শব্দ হল।
চমকে ঘুরে দাঁড়াল চারজনই।
বিমান টর্চ সেদিকে ফিরিয়ে বলল, কে?
আর কোনও সাড়া নেই, শব্দ নেই।
আর এগোতে যেতেই দীপা হাত চেপে ধরে বলল, এই, তুমি ভেতরে যেও না!
বিমান বলল, দাঁড়াও, দেখি ভেতরে কী আছে। তুমি শব্দ শোনোনি?
অসিত এগিয়ে গিয়ে টর্চের জোরালো আলো ফেলতেই দেখা গেল, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়ামূর্তি। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, খালি গা। আলোয় যেন চকচক করে উঠল তার দু চোখ।
দীপা ও মা গো বলে আর্ত চিৎকার করে উঠল।
অসিত নিজের টর্চটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, আপনারা কেউ, আলোটা ধরুন তো! ক্যামেরা! আমি ক্যামেরা বার করছি।
কাকাবাবু ততক্ষণে পকেটের রিভলভারে হাত দিয়েছেন, ওটা সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকে। কিন্তু তিনি রিভলভারটা বার করলেন না। সেই মূর্তিটা ছুটে এল ওদের দিকে। বিমান আর দীপাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল সিঁড়ির দিকে। কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলেন না।
বিমান আর দীপা দুজনেই দারুণ ভয় পেয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
অসিত ততক্ষণে ক্যামেরা খুলে বলল, চলে গেল? ভূতটা চলে গেল?
কাকাবাবু হেসে বললেন, ঘরটার এক কোণে একটা বিছানা পাতা আছে। ভূতেরা বিছানা পেতে শোয়, এমন কখনও শুনিনি।
সত্যিই এবার দেখা গেল, ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা মাদুর, বালিশ, ছেঁড়া কাঁথার বিছানা। কিছু এঁটো শালপাতা, একটা কলকে।
কাকাবাবু বললেন, আমরা বোধ হয় কারও ঘুম ভাঙিয়েছি। আমাদের চেয়েও ও বেচারা ভয় পেয়েছে বেশি।
অসিত বলল, যাঃ! প্রথম ভূতটা ফসকে গেল।
বিমান উঠে দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ গরম করে বলল,এখানে কে থাকবে? কারও তো থাকার কথা নয়।
সে গলা চড়িয়ে ডাকল, রঘুদা! ভানু!
দু-তিনবার ডাকতেই ছুটতে ছুটতে এল অল্প বয়েসী কাজের ছেলেটি।
বিমান জিজ্ঞেস করল, ভানু! এখানে কে থাকে?
ভানু বলল, কেউ না তো!
বিমান প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, কেউ থাকে না তো কার বিছানা পাতা রয়েছে? ভূতে পেতেছে?
ভানু ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে বলল, তা হলে বোধ হয় দিনু পাগলটা?
দিনু পাগলটা মানে?
এত বড় বাড়ি, সব ঘরে তো নজর রাখা যায় না? খুব বৃষ্টিবাদলায় গ্রামের কিছু লোক এ-ঘরে ও-ঘরে এসে শুয়ে থাকে।
তার মানে, যার খুশি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে? রাত্তিরবেলা বাইরের সব দরজা বন্ধ করে রাখতে পারো না?
পেছন দিকের অনেকগুলো দরজাই একেবারে ভাঙা। বন্ধ করব কী করে? এই সিঁড়িটার নীচের দরজাটা পুরোটাই নেই!
কাকাবাবু বললেন, কয়েকদিন পর বাড়িটা পুরোটাই ভেঙে ফেলা হবে। এই কটা দিন গ্রামের লোক যদি শুতে চায়, শুয়ে নিক না ক্ষতি কী?
দীপা বলল, ওমা, যে-সে এসে ঢুকে পড়বে! দোতলায় উঠে আসবে? তারপর যদি রাত্তিরবেলা আমাদের গলা টিপে মেরে ফেলে?
বিমান বলল, ভানু, যেমন করে হোক, এই সিঁড়ির মুখটা আটকাও! একতলায় তো অনেক ভাঙা দরজা-জানলা পড়ে আছে, সেইগুলো দিয়ে যা হোক একটা কিছু করো! কেউ যেন ওপরে আসতে না পারে।