Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সংহতি || Rana Chatterjee

সংহতি || Rana Chatterjee

সংহতি

পরশু রাত থেকে চোখের পাতা এক করতে পারেনি রসুল মিয়া! মাঝ রাতে সেই যে ধর-ফর করে উঠে পড়ল, সারাটা রাত দাওয়াতে বসে ওই বাঁশ বাগানের নিকষ কালো অন্ধকারদিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো, নাহ কোনোরকম আশার আলো বা জোনাকির আলোক বিন্দুরও  দেখা মিলল না !

সাকিনা কিন্তু সদাহাস্য, শুভচিন্তক এই মানুষটা কে এমন আকুল হতে বিগত দেড় দশকেও দেখেনি -নইলে বসে থাকার কি আর লোক এই সদাই মানুষের কাজে ব্যস্ত পাশের মানুষটা !সেই যে বছর হঠাৎ করে ফুলে ফেঁপে ওঠা কোপাই নদী কেমন আস্ত ছোট্ট গ্রাম মির্জাপুর কে ভাসিয়ে ছিল, আর পাঁচ জন মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বয়সের তোয়াক্কা না করে সে রক্ষা করেছিলো গ্রামের বাচ্চা -বুড়ো আর গবাদি পশুগুলোকে।

সেদিনটা আজও চোখে ভাসে সাকিনার তার জীবনের দগদগে ক্ষতের কাহিনী। মা মরা মেয়েটার ভরসার মানুষ আব্বাজান যে  টুপ করে বৃষ্টি ফোঁটার মতো ঝরে যাবে ওই  ঘন কালো বর্ষার রাতে কে ভেবেছিল! শতছিদ্র খড়ের চালের জল আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টার মাঝেই  সাকিনার ঘুম ভাঙলো ভোর রাতে  বাবার নিথর দেহের স্পর্শে !পরে জেনেছিল এ এক অদৃশ্য হত্যাকারী রোগ, ছোবলের মতো নিঃশব্দে এসে প্রাণ নিয়ে পালায়  যা সেরিব্রাল অ্যাটাক না কি যেন বলে যেন ! 

তারপর সেই কোপাই নদীর ফুঁসে ওঠার দিন আরও কিছু পাড়া প্রতিবেশী, গবাদী পশুদের সাথে ওঠে এসেছিল পরিত্যক্ত এক স্কুল বিল্ডিংয়ে ।সেই শুরু রসুলকে কাছে পাওয়া ।এক দায়িত্ববান পুরুষের সান্নিধ্য যে খুঁটির মতো এই অনুভব প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারে সাকিনা।পরের কটা বছর অক্লান্ত পরিশ্রমে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম কমলপুরের এই ধারটায় প্রায় গোটা দশেক মুসলিম পরিবারের বাস শুরু । বহু কষ্টে পরিত্যক্ত স্কুল বাড়িটাকে নিজেরাই মেরামত করে বাচ্চাদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় আর তারপর থেকেই রসুল মিঞার স্বপ্নের বীজ বোনা শুরু ।আজ আর এই দিকটা কে চেনাই যাবে না।সবুজের সমারোহে সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর অপূর্ব সৌন্দর্য আর বর্ধমান -সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনের ট্রেনের আনাগোনা যেন প্রকৃতি কে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। 

বেশ কয়েক বছর চাঁদা তুলে স্কুলগৃহটা কে মেরামত তো করা হয়েছেই সেই সঙ্গে রসুল দের নিজ উদ্যোগে আর পাঁচ জন কে নিয়ে এসডিও অফিসে বারবার ধর্ণা দিয়ে  কমলপুরের রাস্তাঘাটে এখন সুন্দর মোরাম রাস্তা, দুপাশে পরিকল্পিত সবুজায়ন ।সেই জল জমা হাঁটু জলের দুর্দিন শেষ, পরিত্যক্ত জমিতে এখন সোনা ফসলের বাহার।একটা স্বপ্ন নিয়ে রসুলের  হাত ধরে এই  এলাকার আজ যে আমূল পরিবর্তন, তা কমলপুর কেন এই এলাকার সকল বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ একবাক্যে স্বীকার করে । 

গতকাল স্কুলে থাকাকালীন, রসুলের হাতে একটা সেচ দপ্তরের চিঠি আসে।বিষয় ছিল তাদের এই দশ বারো টি  পরিবার কে ওই সরকারী খাস জমি থেকে উঠে যেতে হবে অন্যত্র ।এই জমিতে সরকারের ট্যুরিজম প্রকল্প, ইকো পার্ক -নদী কেন্দ্রিক পর্যটন হবে । এই কারণে যে পুরনো স্কুল বাড়ি পরে আছে সেখান থেকে বহু আগেই পরিকল্পনা করে  স্কুল টিকে সরিয়ে কমলপুরের ভিতরে নতুন করে গড়া হয় । 

রাজনৈতিক পটবদল আর কমলপুরের মতো হিন্দু গ্রামে আর যাই হোক এই মুসলিম পরিবার গুলো ঠাঁই যেন না পায় এমন একটা চাপা গুঞ্জন অনেকের মধ্যে। জোর করতে চাইলে বিরোধ অবধারিত এটা নিয়ে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার এককাট্টা ।

রসুলের কানেও গেছে গ্রাম্য এমন প্রতিবাদ।বছর পঞ্চান্নের তার  শরীরে বয়সের ভারে দুর্বলতা বাসা বাঁধাছে।এমন চিন্তার দিনে কোথায় গিয়ে উঠবে তারা আর তার সাধের স্কুল এই ভাবনা বেশ চাপ তার রাতের ঘুম কাড়ছে !সাতটা দিন কেবল ভাবতে ভাবতেই আর দুশ্চিন্তায় পেরিয়ে গেল। স্কুলের পথেও আর যেতে মন চায় না তাঁর। এমনি তেই ছাত্র সংখ্যা কম হলেও তবু যে কজন আসে বেশিরভাগ এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তাদের কি হবে ভেবে নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে রসূলের। বাচ্চাদের কোলাহলও কেমন যেন থেমে গেছে, হয়তো খবরটা ততদিনে সবার কানেও চাউর হয়ে গেছে রসুল মাস্টারের সাধের স্কুল বন্ধ হবে!

সাকিনার মাধ্যমে আঁচ পেয়েছে কমলপুরের গোড়া হিন্দুদের একাংশ আগে থেকেই বিক্ষোভ দেখিয়ে গেছে সরকারি অফিস, গ্রাম জুড়ে ।তাদের এই  হিন্দু গ্রামে কোনো  মুসলিম পরিবারকে কোনমতেই ঠাঁই দেওয়া চলবে না এমন দাবিতে পোস্টার নানান দেওয়াল জুড়ে ! সেদিন বাইরে ডাক্তার দেখাতে বেরিয়েও খুব অস্বস্তি হচ্ছিল রসুল-সাকিনার, হঠাৎ করে যেন ধর্মটা তাদের গায়ে বিশ্রী ভাবে সেঁটে গেছে, চারিদিকে ফিসফাস গুঞ্জন । 

সারারাত বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি, কেমন যেন বাড়ির পরিবেশটা থমকে গেছে!সদা উদ্যোমী মানুষটা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এই কদিনে ।সকলের নিয়ে চিন্তাশীল এই মানুষটাকে আজ যেন একটু বেশিই স্বার্থপর লাগছে সাকিনার কর্মঠ মানুষটার ওভাবে মৌনতা বজায় রাখায়। তখন প্রায় চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিট ঘড়িতে, একটা ভ্যানে চেপে যৎসামান্য কাগজ পত্তর, বই জামাকাপড় নিয়ে সাকিনাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে সব মায়া ত্যাগ করে। গন্তব্য ভোরের কোপাই স্টেশন ।সেখান থেকে বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে কলকাতা শহরের নতুন আস্তানার খোঁজে । হঠাৎ একি !  ভোরের স্টেশন এমনিতেই ফাঁকা থাকে …কিন্তু লোকে লোকারণ্য যে ! বাইরে এসডিও সান্যাল বাবুর গাড়িও নজরে এলো।

হাতের ব্যাগটা সাকিনার হাতে দিয়ে ইশারায় দূরের বেঞ্চে বসতে বলতেই, রসুল দেখে সবাই তাদের দিকেই যেন এগিয়ে আসছে ! এ কি কমলপুরের নারায়ণ মন্দিরের কূল পুরোহিত মহাশয়ও যে হাতজোর করে তাদের দিকে, সঙ্গে আরো শ খানেক গ্রাম বাসি । এসডিও সাহেব বলে উঠলেন, “একি রসুল ভাই, আপনি শেষে  লুকিয়ে আমাদের ছেড়ে !!” কথাটা যেন কেড়ে নিয়ে  পুরোহিত মশাই বললেন, “ভগবান -আল্লাহ সব এক রসুল ভাই, আমরা সবাই সিধান্ত নিয়েছি আর যাইহোক, আমাদের স্বপ্নের রূপকারকে আমরা ছাড়ছি না।সেই সঙ্গে আপনাদের ওই সকল পরিবার গুলোও আমাদের গ্রামের মাঝেই নতুন মহল্লায় থাকবেন ঐক্যের নিদর্শন হয়ে।” উপস্থিত সকলের সমস্বরে “হ্যাঁ -হ্যাঁ আমাদের সাথেই থাকতে হবে ” ধ্বনি, রসুল -সাকিনাকে এক অদৃশ্য মায়াটানে আছন্ন করে তুলেছিল ।ওনারা আশ্বস্ত করলেন, যে কজন বিরোধিতা করেছিল তাদের বোঝানো হয়েছে তবু যদি বাধা দেয় একঘরে করা হবে শুনে রসূল আরও অবাক।ভাবলো এদের হলো কি, কোন অদৃশ্য জাদুবলে সব পাল্টে গেল!যাইহোক সকলের মিলিত অনুরোধে ট্রেন এলেও রসুল- সাকিনারা নিজেদের স্বপ্নের জায়গায় ফিরে এলো।  রাত ভোর বর্ষণ শেষে পূর্ব আকাশ যেন আজ বড্ড বেশি ঝক ঝক করছে ঐক্যের বাতাবরণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *