Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাস্টার মশাই || Rana Chatterjee

মাস্টার মশাই || Rana Chatterjee

মাস্টার মশাই

“আরে ভাই দাঁড়া, একটু তো আস্তে চল, ওহ্ আমি কি  পারি রে, তোর সাথে দৌড়াতে “!- এই বলে শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে টুসকি বসে পড়ল ঝোপ জঙ্গলের মাঝেই ।কতই না চেনা এই জায়গা, পায়ে পায়ে এগিয়ে একসময় এই সরু পথ, ভাঙা সান বাঁধানো নতুন পুকুরের ঘাটে পৌঁছাতো। কতবার গ্রামে থাকাকালীন যে এই পথ ধরে মাঠে জমি দেখতে  টুসকিরা  গেছে তার ইয়ত্তা নেই।আজ জনমানব শূন্য এই পথ, জঙ্গল আগাছার  কব্জায়। বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে নাম বিহীন লতা গুল্মরাও বংশ বিস্তারে গ্রাস করেছে অস্থায়ী রাস্তাকে।

হাঁফিয়ে বসে পড়তেই  ততক্ষণে টুসকির লাল টুকটুকে শাড়ির নিচের অংশ জুড়ে বড় আপন করে চোর কাঁটার দল ঝাঁকে ঝাঁকে খোশ মেজাজে হাজির!”কি হলো রে দিদি, আর তো একটু খানি, ওই দেখ মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি দেখা যাচ্ছে, ওইতো খড়ের চাল”, টুসকিও ঘাড় তুলে দেখে যেন এবার স্বস্তি পেল ।

ভাবা যায়! সে কি আজকের কথা নাকি, প্রায় পনের বছর আগে শেষ যখন এখানে থাকতো টুসকিরা, কি জমজমাট টাই না ছিল এই বামুন পাড়া । এখন অযত্নে পড়ে থাকা মাটির দালান গুলো চর্ম রোগের মতো চোকলা ছেড়ে একে অপরকে বিদ্রুপ করে যেন হাসছে !কোনো বাড়ির দরজায় উই পোকাদের আগ্রাসন তো  কোনো ঘরের দরজায় ঝুলছে জং ধরা তালা!দু দশক ধরে সন্তানদের পড়াশোনা সহ সুযোগ সুবিধা দিতে গ্রামের বাসিন্দাদের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা যতো বেড়েছে আর ততো খালি হয়েছে গ্রামগুলো। কত তাজা স্মৃতির ভার নিয়ে বাড়ি গুলো যেন কারুর অপেক্ষায় ।

সেটা ছিল দুহাজার পাঁচ সাল, টুসকি তখন ক্লাস ফোরের ছাত্রী । দুদিকে বিনুনী ঝুলিয়ে, কাঁধে ব্যাগ আর চাটাই নিয়ে বাবার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে গ্রামের পাঠশালায় পড়তে আসতো । আজ খুব মনে পড়ছে খড়ের লম্বা চালা নামানো গোবর নিকানো বারান্দা আর ভাঙা জরাজীর্ণ ইঁট বের করা বিশাল বড়ো এক শ্রেণীকক্ষ, সারি দিয়ে বসা অভাবী বাচ্চা গুলোকে কত্ত দরদ দিয়ে শশী মাস্টার মশাই জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে পড়াতেন । হাতে থাকা তাল পাতার পাখা আর ওনার গম গম গলা যেভাবে ক্লাস শাসন করতো সেই দৃশ্য ভাবলে আজও রোমাঞ্চিত হয় টুসকি । চোর কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে উড়ে  আসা শীতল বাতাসে হারিয়ে যায় টুসকি, কানে যেনো এখনো এক নাগাড়ে বাজতে থাকে সুর করে ছাত্রদের পড়া “একে চন্দ্র ….দুয়ে পক্ষ …”।

“কইরে দিদি ওঠ, দেরি হচ্ছে যে”-  ভাইয়ের ডাকে সম্বিত ফিরতেই “হ্যাঁ রে, চল চল ভাই “বলে শাড়ির নোংরা ঝেড়ে আবার এগুতে থাকে দুটোতে । জ্যাঠুর ছেলে রন্টি একটা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ঝোপ সরাতে সরাতে রাস্তা দেখিয়ে এগিয়ে চলে সামনে ।

“মাস্টার মশাই, ও মাস্টার মশাই, বাড়িতে আছেন! দেখুন আপনার সাথে আমরা কারা দেখা করতে এসেছি “! এক নাগাড়ে রন্টির ডাকের সঙ্গে সঙ্গে ওমনি পুকুর ঘাট থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের সুরেলা গলা, “দাদু বিছানায় শুয়ে আছে, খুব অসুস্থ “। এক চিলতে সামনের বারান্দায় রান্নার কিছু সস্তা, পচন ধরা কানা বেগুন, পাকা দুচারটে ভেন্ডি, খানিক কুমড়ো আর গোটা চারেক আলু ইতস্তত ছড়িয়ে আছে।এই পরিবেশ যেন পরিবার টির বাস্তব, ক্ষয়িষ্ণু ছবি তুলে ধরেছে ।উঠোনের এক পাশে নোংরা আবর্জনা স্তূপীকৃত ভাবে জমা, মাছি ভ্যান ভ্যান করছে এমন এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ।”

“ভাইরে, দেখ মনে হচ্ছে, কেউ যেনো ঘরের ভেতরে মশারিতে শুয়ে আছে ” কথাটা বলেও জনশূন্য বাড়িটার উঠানে অপ্রস্তুত হয়ে দুজনা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দাঁড়িয়ে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ!

কালকেই ওরা কলকাতা থেকে ঝোঁকের মাথায় দেশের বাড়ি চলে এসেছে মা আর জেম্মা কে সঙ্গে করে ।তেমন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না, ঠিক যেনো  অনেকটা “উঠল বাই তো কটক যাই “এর মতো হই হই করে পুরানো স্মৃতি তাজা করার সুযোগ। টুসকির সেই ক্লাস ফোরে পড়া কালীন, কলকাতায় ফ্লাট কিনে রায় বাড়ির বাসিন্দারা কলকাতায় চলে আসে।তারপর থেকে বছরের কোনো বার পুজায় আসা হত, কখনো বা হয়ে উঠত না সব মেম্বারদের ।শেষ টুসকি এসেছে একবার ক্লাস নাইনে আর একবার কলেজে উঠে। ওই বছর ঠাকুমাকে দাহ করতে নিয়ে আসা হয়েছিল গ্রামে নিজস্ব ভিটেতে।

মাঝের বছরগুলো কলেজ, ইউনিভারসিটি, এম ফিল করতে করতে বিয়ে হয়ে যায় টুসকির । বছর পার হওয়া তো নয় যেন স্রোতের মতো জল বয়ে গেছে তরতাজা স্মৃতিগুলোর ওপর দিয়ে।বরের হাত ধরে বিদেশ বিভুঁইয়ে টানা ষোল মাস থেকে  দুই মাসের জন্য শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি কাটাতে এসেছে সে।আর গতকাল সকালে  রন্টির সাথে দেশের বাড়ি যাবার হুজুগ শুনে রায় গিন্নিরাও না করতে পারেন নি ।বাড়ির কূল দেবতা শ্রীধর নারায়ণ কে সেবা করার এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করতে আছে ! সব মিলিয়ে হই হই করে বিকালে গাড়ি নিয়ে  বেরিয়ে পরে বাড়ির পাঁচ মেম্বার গণ।

খুব ভোরে পুকুরে জেলে দের মাছ ধরতে আসার হই হই  আর ভয়ে  হাঁস গুলোর  প্যাঁক প্যাঁক ডাকে ঘুম ভাঙলো দেরিতে ওঠা টুসকির। নেট দুনিয়ায় আছড়ে পড়া  আজ “শিক্ষক দিবস “এর অনর্গল ম্যাসেজ, পোস্ট দেখে কিছু একটা করলে কেমন হয় এটা রন্টি কে বলতেই পরিকল্পনা রেডি। মাস্টার মশাই কেমন আছেন একবার যদি দেখা করা যেত ভাবনাটা আসায় তারই ফলশ্রুতিতে ওরা দুই ভাইবোন  এখন এই নিঝুম ঘরের দাওয়ায় ।

“কে গো বাছারা, কিছু কি বলবে “, এক মধ্যবয়সী শতছিন্ন ময়লা কাপড় পড়া মহিলার পরম স্নেহের পরশে ঘুরে তাকায় টুসকি, রন্টিরা। ওনাকে অনুসরণ করে হাজির হয়, স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে হাড় কঙ্কাল বার হওয়া শায়িত মানুষটার পাশে ।একদম চমকে ওঠে টুসকি, শশী মাস্টার  মশাইয়ের একি চেহারা টাই হয়েছে !চোখের কোল দুটো অজান্তেই ভিজে ওঠে তার টুসকির।

ইতিমধ্যে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকা মানুষটির যে ক’ খানা হাড় কঙ্কাল আছে সেটাও মিশে গেছে তক্তায় বিছানো ময়লা কাঁথাতে!” …ও বাবা  একবারটি তাকিয়ে দেখো, তোমার ছাত্র ছাত্রীরা এয়েছে দেখা করতে শহর থেকে, ” মহিলাটি বুঝিয়ে দিতেই একটা যেনো অদ্ভুত প্রাণ সঞ্চারিত হলো ব মশাইয়ের চোখে বিদ্যুৎ গতিতে!ওনার বৌমার হাতে কিছু টাকা আর বাড়ির কূল দেবতার উদ্দেশ্যে আনা কিছু গোটা ফল, সামগ্রী তুলে দিলো টুসকি । ওখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে সংকল্প নিলো নামী ডাক্তার হাজব্যান্ডকে অনুরোধ করে শহরে এনে মাস্টার মশাইয়ের যদি চিকিৎসা চালানো যায়!অমন সরলমনা ছাত্রঅন্ত প্রাণ নিখাদ মানুষটার জন্য কিছু করতে পারলে যে কি পরিমান গর্বিত হবে টুসকি এটা ভেবে তার মন ভরে গেলো।এক মুখ খোঁচা খোঁচা বৃদ্ধ  অসুস্থ মাষ্টারমশাই কে ভালো করতেই হবে সংকল্প করে ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে  বাড়ি মুখো হলো দুজন।

তখনও যেনো দূর থেকে ভেসে আসছে মনের আকাশে শশী মাস্টার মশায়ের গগন ভেদী আওযাজ, “পনের এক্কে পনেরো, পণেরো দুই গুনে ত্রিশ “, তিন পনেরো পয়তাল্লিশ “। ফেরার পথে গ্রামের ওলাইচন্ডি তলার পাশে সেদিনের ওই পড়াশোনা করার পরিত্যক্ত চালা ঘরটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নীরব যন্ত্রণায় পা চালালো  ভাই বোনে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *