এক ঘন্টা সময় চলে গেল
এর পর এক ঘন্টা সময় চলে গেল, সেই মৃতদেহটির জন্য। পুলিশ-লঞ্চের খালাসিরা একটা লম্বা বাঁশের আঁকশি দিয়ে মৃতদেহটাকে টেনে আনল কাছে। কিন্তু সেটাকে এ-লেঞ্চে তোলা হল না। ঠিক সেই সময় ইরিগেশান ডিপার্টমেন্টের একটা খালি লঞ্চ যাচ্ছিল, সেটাকে থামানো হল।
কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, সন্তু, তুই ভেতরে বসে থাক, এইসব দৃশ্য তোর না দেখাই ভাল।
সন্তু ওপরে না গেলেও একতলার জানলা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা।
কাকাবাবু আর রণবীর ভট্টাচাৰ্যও বসে রইলেন সেখানে।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, এই প্ৰশান্ত সঙ্গে থাকাতেই তো যত গণ্ডগোল। আমি যাচ্ছি। অন্য কাজে, নদী দিয়ে লাশ কেন ভেসে যাচ্ছে, তা আমার দেখার কথা নয়। এখানে সাপের কামড়ে অনেক লোক মরে। সাপের কামড় খেয়ে মরলে সেই মৃতদেহ পোড়ানো হয় না, জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং তাতে পুলিশের কিছু করার নেই। কিন্তু প্রশান্ত রয়েছে সঙ্গে, সে এখানকার এস ডি. পি. ও.; যে-লাশ ভেসে যাচ্ছে, সেটা সাপের কামড়ে মৃত্যু না খুনের ব্যাপার, সেটা তার জানা দরকার।
একটু বাদেই প্রশান্ত দত্ত এসে খবর দিল, মৃতদেহটির বুকে একটা ছুরি বিঁধে আছে। ভাগ্যিস ইরিগেশনের লঞ্চটা পাওয়া গেছে! সেই লঞ্চে, একজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে মৃতদেহটি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যানিংয়ে। সেখানে পোস্ট মর্টেমের ব্যবস্থা হবে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, ওহে প্ৰশান্ত, ডেডবডিট কার, এই লঞ্চের খালাসিরা কেউ চেনে?
প্ৰশান্ত দত্ত বলল, না, স্যার। কেউ চেনে না। এক কাজ করো না, এই সাধুবাবাকে একবার নিয়ে গিয়ে দেখাও না। সাধু এই অঞ্চলের লোক, চিনতে পারবে হয়তো!
সাধুর হাত-টাত বাঁধা হয়নি। এমনি মেঝেতে এক কোণে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এই কথা শুনে সে বলল, না, না, আমি যাব না। আমি দেখতে চাই না?
প্রশান্ত দত্ত তার কাছে গিয়ে দুপা ফাঁক করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। তারপর প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে বলল, ওঠে!
সেই এক ধমকেই কাজ হল। সাধুবাবা সুড়সুড় করে উঠে গেল। এবারে সন্তু আর বিমানও গেল ওদের সঙ্গে।
মৃতদেহটিকে পাশের লঞ্চের ডেকের ওপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ টাটকা মড়া, শরীরে কোনও বিকৃতি নেই। বছর তিরিশেক বয়েস লোকটির শুধু একটা পাজামা পরা, বুকের বাঁ দিকে একটা ছুরি বিধে আছে, সেই ছুরির হাতলের আধখানা ভাঙা।
সেই দিকে তাকানো মাত্রই ছোট সাধুর মুখখানা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ফারিত করে ফিসফিসিয়ে বলল, কী সর্বনাশ! হায় হায় হায়! কে এমন করল?
প্রশান্ত দত্ত জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি চেনো একে? কী নাম লোকটির?
ওর নাম হারু দফাদার। আমার আপনি খুড়তুতো ভাই! হারুকে যে দুদিন আগেও জীবন্ত দেখেছি।
এর পর কান্নায় ভেঙে পড়ল সাধু। প্রশান্ত দত্ত ইঙ্গিত করল ইরিগেশনের লঞ্চটাকে ছেড়ে দিতে।
একটু বাদে ছোট সাধুকে যখন নীচে ফিরিয়ে আনা হল, তখনও সে ফুঁপিয়ে কুঁপিয়ে কাঁদছে।
সব শুনে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, বাঃ সাধুবাবা, আপনাদের পরিবারটি তো চমৎকার। আপনার বুকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা থাকে, সেখান থেকে খসে পড়ে টাকা। আর আপনার খুড়তুতো ভাই বুকে ছুরি বিধিয়ে জলে ভাসে। তা কী কাজ করত। আপনার ভাই?
আকবর খান বললেন, যারা সাধারণ চাষবাস করে, তারা অন্যকে ছুরি মারে না, নিজেরাও ছুরি খেয়ে মরে না।
ছোট সাধু বলল, হারু জঙ্গলে মধু আনতে যেত।
আকবর খান বললেন, যারা জঙ্গলে মধু আনতে যায়, তারা অনেক সময় বাঘের মুখে পড়ে। কিন্তু সেরকম লোককে কেউ ছুরি মারবে কেন?
প্রশান্ত দত্ত বলল, হারু দফাদার নামটা বেশ চেনা-চেনা, কিছুদিন আগেই একটা ডাকাতির কেসে একে খোঁজা হচ্ছিল, যতদূর মনে পড়ছে। জানেন স্যার, কয়েকদিন ধরে এই তল্লাটে স্মাগলার আর ডাকাতদের মধ্যে নানারকম মারামারির খবর পাওয়া যাচ্ছে। নতুন একটা কিছু ঘটেছে বোধহয়।
কাকাবাবু বললেন, সেই বিদেশি লঞ্চের সঙ্গে এই সব ঘটনার কোনও যোগ নেই তো?
রণবীর ভট্টাচাৰ্য মুখ ফিরিয়ে বললেন, সেই বিদেশি লঞ্চ? হাঁ…সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়। লঞ্চটাতে মানুষজন যেমন ছিল না, তেমনি অন্য কোনও দামি জিনিসপত্রও কিছুই নেই। সেসব গেল কোথায়? এখানকার লোকেরাই লুটেপুটে নিয়েছে! তারপর বখরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে তারা।
কাকাবাবু ছোট সাধুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, সেই লঞ্চের কোনও মালপত্র তোমার কাছে এসেছিল?
ছোট সাধু বলল, লঞ্চের মালপত্র? না, না, স্যার! কোন লঞ্চের কথা বলছেন?
একটা জনশূন্য বিদেশি লঞ্চ সুন্দরবনে এসে ভিড়েছে, সে-কথা তুমি শোনোনি?
কই না তো! কলকাতার এক ব্যবসাদার তার টাকাগুলো এখানকার এক ভেড়িতে আমায় পৌঁছে দিতে বলেছিল, তাই টাকাগুলো আমি সাবধানে লুকিয়ে নিয়ে আসছিলুম। আর আপনারা ভাবলেন আমি চোরাই জিনিসের কারবার করি!
রণবীর ভট্টাচাৰ্য অট্টহাসি করে উঠলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবারে বলুন তো, কাকাবাবু, আপনি এদিকে কেন এলেন। হঠাৎ? এইসব চোর-ডাকাত আর স্মাগলাররা তো নিছক চুনোপুটি, এদের ধরবার জন্য নিশ্চয়ই আপনি আসেননি।
কাকাবাবু বললেন, না, আমি এসেছি। ঐ লঞ্চটা একবার নিজের চোখে দেখতে। আচ্ছ, সুন্দরবনে ঐ লঞ্চটাকে প্রথম কে দেখতে পায় বলো তো?
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সেটা আকবর সাহেবই ভাল বলতে পারবেন। আকবর খান বললেন, আমরা প্ৰথমে খবর পাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে। দত্ত ফরেস্টের এক রেঞ্জার হরিণভাঙা নদীতে গিয়েছিল টহল দিতে, তখন এক জেলেনৌকো তাকে খবর দেয় যে, খাঁড়ির মুখে একটা লঞ্চ ভাসছে, ভেতরে কোনও মানুষজন নেই। সেই রেঞ্জারের নাম সুখেন্দু বিশ্বাস, সে-ই প্রথম লঞ্চটার কাছে যায়। রেঞ্জার প্রথমে লঞ্চের মধ্যে মানুষজনের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। কেউ যেন বিদেশি ভাষায় কথা বলছে। একটু পরে সে বুঝতে পারে, ওটা আসলে রেডিও।
কী ভাষায় রেডিওর প্রোগ্রাম চলছিল, তা রেঞ্জারবাবু বলেছে?
না। সে বুঝতে পারেনি কোন ভাষা।
লঞ্চের ভেতরের আর-সব জিনিসপত্র লুটপাট হয়ে গেল, কিন্তু রেডিওটা কেউ নিল না কেন?
সেটা একটা কথা বটে! একটা বিদেশি রেডিও-র দাম তো নেহাত কম হবে না?
রেঞ্জার লঞ্চটা দেখার পর কী করল?
রেঞ্জার বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছে। লঞ্চটা যেখানে ভাসছিল, সেখানে জল বেশি গভীর নয়। রেঞ্জার লঞ্চটাকে সেখান থেকে না সরিয়ে
সেখানেই নোঙর ফেলে দেয়। তারপর খবর দেয় থানায়। এর মধ্যে আমি আর প্রশান্ত গিয়ে দেখে এসেছি লঞ্চটা। আজ সেটাকে গোসাবায় নিয়ে আসার কথা আছে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এই সাধুজিকে একটা কেবিনে ভরে রাখো। এসো, গোসাবা পৌঁছনো পর্যন্ত আমরা একটু তাস খেলি। কাকাবাবু, খেলবেন নাকি?
কাকাবাবু বললেন, না, তোমরা খেলো। আমি বরং ওপরে গিয়ে নদীর দৃশ্য দেখি। অনেকদিন এদিকে আসিনি।
বিমান আর সন্তুও কাকাবাবুর সঙ্গে উঠে গেল ওপরের ডেকে।
গোসাবা থানার দারোগা বললেন যে, প্রথমে দুজন লোককে পাঠানো হয়েছিল লঞ্চটা চালিয়ে নিয়ে আসবার জন্য। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সেই লঞ্চটার ইঞ্জিনের কিছু কিছু অংশও নিশ্চয়ই চুরি গেছে। তারপর আর একটা লঞ্চ পাঠানো হল সেটাকে টেনে আনবার জন্য। কিন্তু সেই দ্বিতীয় লঞ্চটাও চড়ায় আটকে গেছে, তারা ওয়ারলেসে খবর পাঠিয়েছে। এখন জোয়ার এলে লঞ্চটা যদি জলে ভাসে তো ভালই, নইলে সেটাকে টানবার জন্য আবার একটা লঞ্চ পাঠাতে হবে!
প্ৰশান্ত দত্ত রেগেমেগে বলল, যাঃ! এখানকার লোকদের দিয়ে কোনও কোজই ঠিকমতন হয় না! এখন উপায়? স্যার, আপনারা এতদূর এলেন—
রণবীর ভট্টাচাৰ্য কিন্তু একটুও উত্তেজিত হলেন না। তিনি বললেন, দাঁড়াও, খিদে পেয়েছে, আগে খেয়ে নিই। দ্যাখো তো, যে-পার্শে মাছগুলো কেন হল, তার ঝোল রান্না হয়েছে কি না?
লঞ্চে বসেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া হল। ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ, বেগুনভাজা আর মাছের ঝোল। খালাসিরা দারুণ রান্না করে।
বিমান বলল, এমন টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা। আমি আগে কোনওদিন এত ভাল মাছের ঝোল খাইনি।
খাওয়ার পর একটা পান মুখে দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে চিবোতে চিবোতে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এখন তা হলে কী করা যায়? ওহে প্ৰশান্ত গোসাবার টাইগার প্রজেক্টের একটা স্পিডবোট থাকে না? সেটা পাওয়া যাবে? দ্যাখো না, খোঁজ নিয়ে?
গোসাবা থানার দারোগা বললেন, হ্যাঁ স্যার, পাওয়া যাবে। স্পিডবোটটা আজ সকালেই এসেছে
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তবে এক কাজ করা যাক। আমি কাকাবাবু আর এদের নিয়ে স্পিডবোটটায় করে বিদেশি লঞ্চটা দেখে আসি। সেটা এখানে কতদিনে পৌঁছবে কে জানে! আমি সেটা ইনন্সপেকশান করতেই এসেছি। আকবর আর প্রশান্ত, তোমরা এখানে থেকে যাও!
একটু গলা নামিয়ে তিনি আবার আকবর আর প্রশান্তকে বললেন, তোমরা এখানে থেকে যতগুলো পারো চোর-ডাকাত আর স্মাগলারদের রাউণ্ড আপ, করো। ঐ বিদেশি লঞ্চ থেকে যে-সব জিনিসপত্র খোয়া গেছে, তার দুএকটা অন্তত উদ্ধার করা চাই। নইলে লঞ্চের মালিক কে ছিল কিংবা কোন দেশের, তা বার করা শক্ত হবে। এই সাধুবাবাকে একটু চাপ দাও, ও নিশ্চয়ই চোরাই মালের সন্ধান দিতে পারবে।
স্পিডবোটটায় চালক ছাড়া আর তিনজনের জায়গা আছে। রণবীর, কাকাবাবু, বিমান আর সন্তু তার মধ্যে এঁটে গেল কোনওক্রমে। কিন্তু রণবীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে সব সময় দুজন সাদা পোশাকের বডিগার্ড থাকে। তাদের কিছুতেই জায়গা হবে না।
রণবীর ভটাচার্য বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে বডিগার্ড দরকার নেই। ওরা এখানেই থাক। আমাদের আর কতক্ষণই বা লাগবে, স্পিডবোটে বড় জোর যাতায়াতে ঘন্টাতিনেক। নাও, এবার চালাও!
স্পিডবোটটা স্টার্ট নিতে না নিতেই রকেটের মতন একেবারে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সন্তু, শক্ত করে ধরে থেকে। একবার উল্টে জলে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই!
বলতে বলতে ঝাঁকুনির চোটে তিনি নিজেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলেন, কাকাবাবু তাঁর কাঁধটা। চট করে ধরে ফেললেন।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমি অবশ্য পড়ে গেলেও ক্ষতি ছিল না, আমি ভাল সাঁতার জানি। কিন্তু সন্তু সাঁতার জানো তো?
সন্তু বেশ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ!
কাকাবাবু বললেন, সন্তুও সাঁতার জানে, বিমানও সাঁতার জানে। কিন্তু মুশকিল তো আমাকে নিয়েই। খোঁড়া পায়ে আমি তো আজকাল আর ভাল সাঁতার দিতে পারি না! আমি পাহাড়ে উঠতে পারি, কিন্তু জলে পড়ে গেলেই কাবু হয়ে যাই।
স্পিডবোটের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, স্যার, এই নদীতে পড়লে সাঁতার জেনেও খুব লাভ হয় না। এই নোনা জলে কামঠ থাকে, কুচু করে পা কেটে নিয়ে যায়।
বিমান বলল, কামঠ কী? কাকাবাবু বললেন, একরকম ছোট হাঙর। খুব হিংস্র রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, কারুরই জলে পড়ার দরকার নেই। ওহে বাপু, তুমি সাবধানে ঠিকঠাক চালাও!
নদীর দুধারে অনেক লোক জলে নেমে কী যেন খোঁজাখুঁজি করছে। কারুর কারুর হাতে গাঢ় নীল রঙের ছোট ছোট জাল।
বিমান জিজ্ঞেস করল, ওরা কী করছে জলে নেমে!
চালক বলল, ওরা বাগদী চিংড়ির পোনা ধরছে। এটাই সিজন কিনা?
ওখানে কামঠ যেতে পারে না? ওদের ভয় নেই? কী করবে বলুন, মাছ না ধরলে যে ওরা খেতে পাবে না। ভয় আছে বই কী, মাঝে-মাঝে দুএকজনের পা কাটা যায়। তবে এক জায়গায় বেশি লোক থাকলে কামঠু কাছে আসে না।
আর কিছুক্ষণ যাবার পর কাকাবাবু বললেন, ছোট সাধু আমায় দেখে হঠাৎ বলেছিল, আজ রাত্রে আমার বাড়ি ফেরা হবে না। এটাই ভাগ্য, ও নিজেই আজ রাত্রে বাড়িতে ফিরতে পারবে না।
বিমান বলল, ব্যাটা ভণ্ড! আচ্ছা রণবীরবাবু, আপনি হঠাৎ ওর জামা খুলতে বললেন কেন? আপনি কী করে বুঝলেন…
কী জানি, লোকটির মুখ দেখেই আমার কেমন যেন মনে হল, ও একটু টাকার গরমে কথা বলছে! বুকে বাঁধা অতগুলো টাকা, হা-হা-হা।
কাকাবাবু বললেন, ও বেশি সাহস দেখিয়ে আমার সঙ্গে যেচে কথা বলতে এসেছিল। যদি দূরে দূরে থাকত, তাহলে বোধহয় আজ ধরাই পড়ত না।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, তবে, কাকাবাবু, ও বোধহয় এই কথাটা ঠিকই বলেছে। আজ রাত্তিরে আপনার না-ও ফেরা হতে পারে।
কাকাবাবু কিছু বলার আগেই বিমান বলল, সে কী! কেন?
জলের ব্যাপার তো! এই সব স্পিডবোট যখন-তখন খারাপ হয়। ধরুন যদি এটা খারাপ হয়ে গেল, তখন কী হবে? দেখছেন তো! দুপাশে জঙ্গল, পাড়ে নামাও যাবে না! তখন কোনও নৌকে ধরতে হবে কিংবা দৈবাৎ কোনও লঞ্চ যদি এদিক দিয়ে যায়-
দৈবাৎ কেন? এদিকে লঞ্চ পাওয়া যায় না?
খুব কম। ওহে মাস্টার, তুমি আবার স্পিডবোটটাকে খাঁড়ির মধ্যে ঢোকালে কেন?
চালক বলল, এদিক দিয়ে শর্টকাট হবে, স্যার!
এই যে দু দিকের জঙ্গল, এখানে বাঘ আছে? তোমরা তো টাইগার প্রজেক্টের লোক?
হাঁ, স্যার, তা আছে। এই তো বাঁ দিকে সজনেখালির জঙ্গল, ওখানে কয়েকটা বাঘ আছে।
বুকুন তা হলে! পাশের জঙ্গলে বাঘ, এর মধ্যে যদি স্পিডবোট খারাপ
বিমান বলল, যদি খারাপ নাও হয়, নদী এত সরু, এখানে এমনিতেই তো বাঘ আমাদের ওপরে লাফিয়ে পড়তে পারে।
যেন এটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই নয়। এইভাবে হাসতে হাসতে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, তা তো পারেই! বাঘ এর চেয়ে বেশি দূরেও লাফিয়ে যায়! তবে কথা হচ্ছে, কোনও বাঘ এখন এদিকে আসবে না। বাঘেরাও জেনে গেছে। যে, অ্যাডিশনাল আই. জি. রণবীর ভট্টাচার্য এই পথ দিয়ে যাচ্ছে। বাঘেরাও আমাকে ভয় পায়। হা-হা-হা-হা!
কাকাবাবু বললেন, স্পিডবোটে এত শব্দ হচ্ছে, এই জন্যই বাঘ এর কাছে ঘোিষবে না। বাঘেরা শব্দ পছন্দ করে না। মুনি-ঋষিদের মতনই বাঘ খুব নির্জনতাপ্রিয়।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য আগের মতনই হাসতে হাসতে বললেন, কাকাবাবু, আমি পাইলটসাহেবকে একটু ভয় দেখাচ্ছিলুম।
বিমান বলল, ভয় আমি পাইনি। তবে পরশু আমার ডিউটি আছে…
কাকাবাবু বললেন, আমি গোসাবা পর্যন্ত এসে ফিরে যাব ভেবেছিলুম। এত দূর আসতে হল—
বিমান বলল, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে কাকাবাবু। কাছাকাছি বাঘ আছে জেনে খুব উত্তেজনা হচ্ছে। এরকম অ্যাডভেঞ্চারে তো কখনও যাইনি! শুধু পরশু যদি ডিউটি না থাকত—
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আজ না হোক, কালকের মধ্যে ঠিক আপনাকে ক্যানিং পৌঁছে দেব। সেজন্য চিন্তা করবেন না। আমাকেও তো কাল বিকেলের মধ্যে চিফ মিনিস্টারকে রিপোর্ট দিতে হবে?
সন্তু অনেকক্ষণ থেকেই চুপ করে আছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে দু পাশের জঙ্গল দেখছে কী গভীর বন! একটুও ফাঁক নেই, মানুষের পায়ে চলার মতনও কোনও পথ নেই। নদীর দুধারে শুধু থকথকে কাদা, তার মধ্যে উঁচু উঁচু হয়ে আছে। শূল।
প্রতি মুহূর্তে সন্তুর মনে হচ্ছে, হঠাৎ যেন জঙ্গলের মধ্য থেকে গাঁক করে ডেকে একটা রিয়াল বেঙ্গল টাইগার বেরিয়ে আসবে।
আর একটা কথা ভেবেও সন্তুর অদ্ভুত লাগছে। এখন দুপুর তিনটে বাজে। সকাল আটটার সময়েও সন্তু জানত না যে, কয়েক ঘন্টার মধ্যে সে এইরকম একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে আসবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এত কম সময়ের মধ্যে এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা সন্তুর আগে কখনও হয়নি।
সরু নদীটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছে। এঁকেবেঁকে। প্ৰত্যেকবার স্পিডবোটটা বাঁক নেবার সময়েই সন্তুর মনে হচ্ছে, এইবারে একটা কিছু ঘটবে।
হঠাৎ স্পিডবোটটার স্পিড কমে এল, ইঞ্জিনের আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল।
রণবীর ভট্টাচার্যের একটুখানি তন্দ্ৰা এসেছিল, ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, খারাপ হয়ে গেল?
কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল চালক।
কী হে, কথা বলছি না কেন? খারাপ হয়ে গেছে?
কই, না তো! কিসের আওয়াজ?
শুনুন ভাল করে।
সন্তু, বিমান, কাকাবাবু কেউ-ই এতক্ষণ স্পিডবোটটার মোটরের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। এমনকী একটা পাখির ডাকও না।
এখন মোটরের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যেতে নিস্তব্ধ জঙ্গলটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। শোনা যেতে লাগল নানারকম পাখির ডাক। একটা পাখি ট-ব্ল-র-র, ট-র-র-র করে ডাকছে। মাথার ওপর দিয়ে দু তিনটে বেশ বড় পাখি কাঁক-কাঁক করে ডেকে উড়ে গেল।
একটুক্ষণ সবাই উৎকৰ্ণ হয়ে বসে থাকার পর শোনা গেল, দূরে, অনেক দূরে, কেউ যেন কাঁদছে। দু তিনজন মানুষের গলা।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, হঁ, কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি বটে। তোমার কান তো খুব সাফ। স্পিডবোট চালাতে চালাতে তুমিই আগে শুনেছ!
চালক বলল, স্যার, গতিক বড় সুবিধে বোধ হচ্ছে না। সঙ্গে জনা দু এক আর্মড গার্ড আনা উচিত ছিল।
কেন?
এই জঙ্গলের মধ্যে তো চোর-ডাকাতের অভাব নেই। আমরা সঙ্গে বন্দুক আনিনি, এই সুযোগে যদি ওরা লুটপাট করতে চায়…স্যার, এই জঙ্গলের রাজত্বে লুট করতে এসে ডাকাতরা একেবারে প্রাণেও মেরে যায়।
বটে? কান্নার আওয়াজ কোন দিক থেকে আসছে? ডান দিক থেকে না?
নদীটা সেখানে তিন দিকে ভাগ হয়ে গেছে। মাঝখানের জায়গাটা বেশ চওড়া। স্পিডবোটটা থেমে আছে সেখানে। কাকাবাবু তাঁর কালো বাক্সটা খুললেন। সন্তু জানে, ওর মধ্যে রিভলভার আছে!
রণবীর ভট্টাচার্য এতক্ষণ ইয়ার্কি-ঠাট্টার সুরে কথা বলছিলেন। এবারে যেন গা-ঝাড়া দিয়ে সেই ভাবটা ঘুচিয়ে ফেলে কঠোর গলায় বললেন, ডানদিকের ঐ খাঁড়িটা দিয়ে চলো, দেখি, কে কাঁদছে।
স্পিডবোটের চালক বলল, স্যার, ওটা দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, ওটা বড্ড সরু।
বলছি চলো! ফুল স্পিডে!
তারপর কাকাবাবুর অনুমতি নেবার জন্য রণবীর ভট্টাচাৰ্য জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী বলেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, দেখে আসা যাক!
স্পিডবোটের মোটর আবার গর্জন করে উঠল। তারপর ঘুরে গেল। ডান দিকে।
খানিক দূর যাবার পরেই দেখা গেল কিছু দূরে একটা নৌকে। কান্নার আওয়াজটা আসছে। সেখান থেকেই। স্পিডবোটের আওয়াজ পেয়েই বোধহয় নৌকোটা তাড়াতাড়ি ঢুকে গেল একটা ঝোপের মধ্যে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, এটা টাইগার প্রজেক্টের এরিয়া। এখানে কাঠ কাটা নিষেধ। ওরা বেআইনি কাঠ কাটতে এসেছে। টাইগার প্রজেক্টের স্পিডবোট দেখে ভয়ে লুকোচ্ছে এখন। কিন্তু ওরা কাঁদছিল কেন?
স্পিডবোটের চালক বলল, স্যার, এটা ফাঁদও হতে পারে। আর্মস ছাড়া ওদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।
রণবীর ভটাচার্য বললেন, তুমি ঐ নৌকোটার গায়ে গিয়ে লাগাও!
নৌকোটা মাঝারি ধরনের। মাঝখানে ছাঁইয়ে ঢাকা। কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। কান্নার আওয়াজও থেমে গেছে।
স্পিডবোটটা গায়ে লাগাবার পর রণবীর ভট্টাচার্য চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভেতরে কে আছে? নৌকের মালিক কে?
ডাক শুনে একটি উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে ছাঁইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। হাত জোড় করে বলল, স্যার, আমার চাচারে সাপে কেটেছে। এখনও প্ৰাণটা ধুকপুক করতেছে। আপনার বোটে করে নিয়ে গিয়ে চিকিচ্ছে করলে চাচা প্ৰাণে বেঁচে যেতি পারে, স্যার। দয়া করুন স্যার
এই জঙ্গলে কী করতে এসেছিল?
আমরা মধুর চাক ভাঙতে আসি, স্যার। পেটের দায়ে আসতি হয়, স্যার। কখনও এমন বিপদে পড়ি নাই। একটু দয়া করেন, আমার চাচারে বাঁচান।
তোমার চাচাকে সাপে কামড়েছে কতক্ষণ আগে?
আজ সকালে, ঠিক সূর্য ওঠার সময়ে।
এখনও জ্ঞান আছে তার?
কথা বলতে-বলতে রণবীর ভট্টাচার্য একবার কাকাবাবুর দিকে তাকালেন। কাকাবাবু কোলের ওপর কালো বাক্সটা নিয়ে স্থির হয়ে বসে আছেন। রণবীর ভট্টাচাৰ্য প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে খুব স্মাৰ্টভাবে উঠে গেলেন নৌকেটার ওপরে। তারপর বললেন, কই দেখি, তোমার চাচা কোথায়?
নিচু হয়ে তিনি ছাঁইয়ের মধ্যে মাথা গলাতেই ভেতর থেকে একজন একটা লাঠি দিয়ে তাঁর মাথায় মারতে গেল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা সরিয়ে এনে সেই লাঠিটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে, লাঠিধারি। হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল সামনে। রণবীর ভট্টাচার্য প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভার বার করে বললেন, আরে, এ যে দেখছি চ্যাংড়া ডাকাত, দেব নাকি-
রণবীর ভট্টাচাৰ্য কথা শেষ করতে পারলেন না। নৌকের খোলের মধ্যে গুড়ি মেরে আর একটা লোক লুকিয়ে ছিল, সে তক্ষুনি উঠে পেছন থেকে লাঠি দিয়ে মারল রণবীর ভট্টাচার্যের মাথায়, তাঁর রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল, তিনিও জ্ঞান হারিয়ে ঘুরে পড়লেন সেখানে।
দ্বিতীয় লাঠিধারী এবারে মুখ ফেরাতেই কাকাবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। কাকাবাবুর হাতে রিভলভার, তিনি শান্ত গলায় বললেন, লাঠিটা হাত থেকে ফেলে দেবে, না মাথার খুলিটা উড়িয়ে দেব?
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল নৌকের খোলের মধ্যে। এবারে প্রথম যে-ছেলেটি কথা বলেছিল, সে নৌকোর ছাঁইয়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল, তার হাতে একটা লম্বা নলওয়ালা বন্দুক।
সে বলল, দেখি কে কার মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। এই বুড়ো, তোর হাতের অস্ত্রটা ফেলে দে নৌকের ওপর।
কাকাবাবুর মুখে এখনও মৃদু হাসি। তিনি বললেন, তুমি আঙুল তোলার আগেই ছটা গুলি তোমায় ঝাঁঝরা করে দেবে। সাবধান।
সন্তু একেবারে কাঠ হয়ে বসে আছে। কাকাবাবুর একটা দুর্বলতা সে জেনে গেছে। কাকাবাবু ভয় দেখান বটে, কিন্তু কিছুতেই কারুকে মারবার জন্য গুলি ছুড়তে পারেন না। সেবারে ত্রিপুরায় সেই রাজকুমার ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছিল বলে মারুন দেখি আমাকে এই বলে এগিয়ে এসে কাকাবাবুর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিয়েছিল। এই ডাকাতটাও যদি সে-কথা বুঝে যায়? অরণ্যদেব এক গুলিতে অন্যের হাতের বন্দুক ফেলে দিতে পারেন, কিন্তু কাকাবাবু সে চান্সও নিতে পারেন না-যদি লোকটার গায়ে গুলি লাগে!
সন্তু মুখ ফিরিয়ে বিমানের দিকে তাকাতেই দেখল বিমান তার পাশে নেই। দারুণ ঝুঁকি নিয়ে বিমান সেই মুহূর্তে লাফিয়ে নৌকোটার ওপরে উঠে পড়েছে। বন্দুকধারীর বন্দুকের নলটা কাকাবাবুর দিকে তাক করা ছিল, সেটা সে ঘোরাবার আগেই বিমান সেটা খপ করে চেপে ধরল। তারপর দু জনে ঝাঁটাপটি করতে করতে একসঙ্গে ঝপাং করে পড়ে গেল জলে।
ঠিক সেই সঙ্গে-সঙ্গে কাকাবাবুর রিভলভার দুবার গর্জন করে উঠল।
এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল ব্যাপারটা যে, প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। সন্তু। তারপর দেখল যে, অন্য দুজন লাঠিধারী এর মধ্যে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল বলে কাকাবাবু তাদের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে গুলি করেছেন। লোকদুটো লাঠি ফেলে দিয়ে নৌকের পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়ে ভয়ে কাঁপছে।
কাকাবাবু বললেন, বিমানের কী হল দ্যাখ, সন্তু!
নদীর সেখানটায় জল খুব কম। বিমান এর মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, আমি ঠিক আছি।
বন্দুকধারীর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে বিমান বলল, হতভাগা! জলের মধ্যে আমার হাত কামড়ে ধরেছিল! আর একটু হলে গলা টিপে মেরেই ফেলতুম!
স্পিডবোটের চালক এবার নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে নৌকোটার ওপর গিয়ে ব্যাকুলভাবে ডাকল, স্যার! স্যার!
নৌকের খোলের মধ্য থেকে আস্তে-আস্তে উঠে বসলেন রণবীর ভট্টাচাৰ্য। এত কাণ্ডের পরেও কিন্তু তাঁর মুখে কোনও ভয় বা ব্যথার চিহ্নমাত্র নেই। হালকা গলায় তিনি বললেন, বাপ রে বাপ, এমন জোরে মেরেছে যে, চোখে একেবারে সর্ষেফুল দেখলুম। মাথাটা ফাটিয়ে দিয়েছে নাকি?
মাথার পেছনে হাত ঝুলিয়ে তিনি বললেন, ভিজে ভিজে কী লাগছে? রক্ত?
নৌকের খোলের মধ্যে খানিকটা জল থাকে, তার মধ্যে পড়ে গিয়ে রণবীর ভট্টাচার্যের জামা প্যান্ট খানিকটা ভিজে গেছে, মাথাও ভিজেছে। তাঁর মাথায় রক্তের চিহ্ন নেই।
রণবীর ভট্টাচার্য দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে বললেন, হাত ভেঙেছে? না। বোধহয়। পা দুটোতেও ব্যথা নেই। তা হলে ঠিকই আছে। বুড়ো বয়েসে কি আর মারামারি করা পোষায়?
তারপর ডাকাতদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, হঠাৎ আমাদের ওপর হামলা করতে গেলি কেন? কী চাস তোরা?
স্পিডবোটের চালক বলল, স্যার, গত শীতকালে আমাদের একটা বোট থেকে এরা একটা বন্দুক কেড়ে নিয়েছিল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এরাই কেড়ে নিয়েছিল?
ঠিক এই লোকগুলোই কি না তা জানি না! এই রকমই একটা খাঁড়ির মধ্যে লুকিয়ে ছিল সেই ডাকাতরা। সেই বন্দুকটার হদিস আজও পাওয়া যায়নি! যদি এরা আর কিছু না পায়, লোকের জামাকাপড় খুলে নিয়ে তাদের এই জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমার সার্ভিস রিভলভারটা কোথায় গেল? সেটা আবার জলে পড়ে গেল নাকি? দ্যাখো তো!
নৌকের খোলের মধ্যেই রিভলভারটা খুঁজে পাওয়া গেল। রণবীর ভট্টাচার্য স্পিডবোটে ফিরে এসে বললেন, এবার এ ব্যাটাদের নিয়ে কী করা যায়? শুধু শুধু সময় নষ্ট হয়ে গেল অনেকটা।
বিমান নদীর জল থেকে ডাকাতদের বন্দুকটা তুলে নিয়ে এল। তারপর সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, কান্ট্রি মেড গাদাবন্দুক!
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আপনার তো মশাই দারুণ সাহস! তখন আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে, আমি দেখলুম। আপনি খালি হাতে বন্দুকের নলটা চেপে ধরলেন!
বিমান বলল, কী করব, আমি দেখলুম, কাকাবাবু গুলি চালাতে দেরি করছেন.এ লোকটা যদি হঠাৎ আগেই গুলি করে বসে।.এদের তো কোনও
কাকাবাবু বললেন, ওর ওই গাদাবন্দুকের ঘোড়া টেপার আগেই আমি ওর ডানহাতটা উড়িয়ে দিতে পারতুম। তা হলে এই জোয়ান ছেলেটা চিরকালের মতন নুলো হয়ে যেত…। কিন্তু এই জঙ্গলের ধারে বেশিক্ষণ থাকা তো নিরাপদ নয়। হঠাৎ যদি বাঘ এসে পড়ে, তাহলে রিভলভার দিয়ে ঠেকানো যাবে না।
স্পিডবোটের চালক বোটের মোটর চালু করে দিল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এই বোকা ডাকাতগুলোকে তো এখন আমার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব না। আবার একেবারে ছেড়েও দেওয়া যায় না। তাহলে এক কাজ করা যাক। এদের নৌকোটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে এই লোকগুলোকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে যাওয়া যাক। ওদের জামাকাপড় অবশ্য কেড়ে নিয়ে লাভ নেই, ও দিয়ে আমরা কী করব!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জঙ্গলে ছেড়ে দিলে ওরা কি প্ৰাণে বাঁচবে?
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, সে আশা খুব কম। ওদের বাঁচার দরকার কী? ওরা তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল?
সরু চোখে লোকগুলির দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি আবার বললেন, দেখেছেন ব্যাটারা কত পাজি! একটা কথা বলছে না পর্যন্ত। কেঁদোকেটে দয়া চাইলেও না হয়। দয়া করা যেত।
কাকাবাবু বললেন, ওদের নৌকোটা আমাদের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলো। ওরাও চলুক।
শেষ পর্যন্ত তাই হল, একটা মোটা দড়ি দিয়ে নৌকোটা বাঁধা হল স্পিডবোটের সঙ্গে। লোকগুলোকে বসিয়ে দেওয়া হল তাদের নৌকোয়। তাদের লাঠিগুলো কেড়ে নেওয়া হল।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য স্পিডবোটের চালককে বললেন, এবারে আস্তে আস্তে চালাতে হবে, নইলে ওদের নৌকোটা হঠাৎ উল্টে যেতে পারে।
তারপর ঘড়ি দেখে তিনি বললেন, ইস, প্ৰায় এক ঘন্টা সময় বাজে খরচ হয়ে গেল। মেঘ করে আসছে, এর পর বৃষ্টি নামলে তো পুরোপুরি ভিজতে হবে?
কাকাবাবু বললেন, ভেবেছিলুম। বিদেশি লঞ্চটা একবার দেখেই ফিরে যাব আজ। কিন্তু দিনটা দেখছি ক্ৰমেই ঘটনাবহুল হয়ে উঠছে। আমি শুনেছিলুম বটে যে, সুন্দরবনে ইদানীং বাঘের উপদ্রবের চেয়েও ডাকাতদের উপদ্ৰব বেশি। কিন্তু এতটা যে বেড়ে উঠেছে, তা ধারণা করতে পারিনি।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সরকারি স্পিডবোট দেখেও ওরা ভয় পায়নি। একেবারে বেপরোয়া হয়ে গেছে। আমার মাথায় চোট মেরেছে, এ-কথা যদি পুলিশ মহল একবার জানতে পারে, তা হলে এ ব্যাটাদের এমন ধোলাই দেবে? বিমান বলল, আপনার মাথায় কি খুব জোরে মেরেছিল না। আপনি ইচ্ছে করে নীচে পড়ে গেলেন?
না, প্ৰথম মারটা বেশ জবাবর কষিয়েছিল। তবে ঘাড়ে লেগেছে। লাঠিটা মাথায় পড়লে মাথা ফেটে যেত। তারপর হেসে ফেলে তিনি বললেন, প্ৰায় দশ বারো বছর বাদে আমি এরকম মার খেলাম!
সন্তু বারবার পেছন ফিরে দেখছে নৌকোটাকে। ডাকাত তিনটে পাশাপাশি চুপ করে বসে আছে। ওদের হাত-পা বাঁধা হয়নি। দেখলে লোকগুলোকে হিংস্ৰ মনে হয় না, ডাকাত বলেও মনে হয় না। এমনি যে-রকম গ্রামের লোক হয়। কিন্তু আর একটু হলেই ওরা রণবীর ভট্টাচার্যের মাথা ফাটিয়ে দিত, কাকাবাবুকেও গুলি করত বোধহয়।
নদীটা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে, সামনে দেখা যাচ্ছে আর-একটা বড় নদী। জঙ্গলটা নদীর এক দিকে বেশ পাতলা। একঝাঁক হাঁস বসে ছিল সেই দিকে, স্পিডবোটের আওয়াজ পেয়ে সেগুলো একসঙ্গে উড়ে গেল। তারপরই সন্তু দেখল দুটো মুর্গি কক-কিক করে ডেকে পালাচ্ছে।
সন্তু চেঁচিয়ে বলল, এ কী, মুর্গি? জঙ্গলের মধ্যে মুর্গি?
বিমান বলল, বনমুৰ্গি বনমুর্গা! ওরা জঙ্গলে থাকে। খুব টেস্টফুল।
কাকাবাবু বললেন, না, বনমুর্গি নয়, ওগুলো এমনিই সাধারণ মুর্গি। এখানকার লোকেরা জঙ্গলে ঢোকার সময় বনবিবির পুজো করে, তখন একটা মুর্গি ছেড়ে দেয়।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, তারপর বনে থাকতে থাকতে এক সময় ওরাও বুনো হয়ে যায়। তাদের বাচ্চা হলে সেগুলিই হয়ে যাবে বনমুর্গা!
স্পিডবোটটা ছোট নদী ছেড়ে বড় নদীতে পড়বার ঠিক আগেই ঝপাং ঝপাং শব্দ হল।
পেছনের নৌকো থেকে ডাকাত তিনজন জলে লাফিয়ে পড়েছে।
সন্তু আর বিমান উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে। স্পিডবোটের চালক মুখ ফিরিয়ে ব্যাপারটা দেখেই বোটটা ঘোরাতে গেল ওদের দিকে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, যাক, যাক, আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
বিমান বলল, ওদের ধরা হবে না? ইচ্ছে করলেই ধরা যায়!
ডাকাত তিনটে ড়ুবসাঁতার কেটে পারের দিকে এগোচ্ছে, এক একবার তাদের মাথা ওপরে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
রণবীর ভট্টাচার্য হাসি-হাসি মুখে বললেন, আমি ভাবছিলুম ব্যাটারা পালাতে এত দেরি করছে কেন? ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ঝামেলা হত আমাদের। এদিকে থানা নেই, লোকবসতি নেই, ওদের রাখতুম কোথায়?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, ওরা জঙ্গলে থাকবে? যদি ওদের বাঘে ধরে?
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, ওরা সব জানে, কোন জঙ্গলে বাঘ আছে, কোথায় নেই। ঠিক জায়গা বুঝে লাফিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, কিংবা বোধহয় মুৰ্গি দুটো দেখে ওদের লোভ হয়েছে।
হঠাৎ মত বদলে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এদের একটা প্ৰায় পড়ে গিয়ে উঠেছে, বোটটা ওর কাছে নিয়ে চলো তো!
পাড়ের কাছে খুব কাদা, একজন ডাকাত জল ছেড়ে উঠে কাদার মধ্যে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে দৌড়োবার চেষ্টা করছিল, স্পিডবোটটা তার কাছাকাছি পৌঁছতেই রণবীর ভট্টাচাৰ্য রিভলভার উঁচিয়ে চোখ কাঁটমট করে বললেন, দেব? মাথাটা ফুটো করে দেব?
লোকটি এবারে হাত জোড় করে হাউমাউ করে কাঁদে বলল, দয়া করুন বাবু! এবারকার মতন বাঁচিয়ে দিন। আর কোনওদিন অন্যায় কাজ করব না। নাকে খত দিচ্ছি। বাবু, এবারে মাপ করে দিন।
ঠিক তো? মনে থাকবে?
নাকে খত দিচ্ছি। বাবু! কিরে কেটে বলছি, এরকম আর করব না।
অন্য দুটি লোক জল থেকে মাথা তুলেই আবার ড়ুব দিল।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, ঐ দুই স্যাঙাতকেও বলে দিস! মনে থাকে যেন! তবে, তোমাদের নৌকো আর বন্দুক ফেরত পাবে না। ফেরত নিতে চাও তো গোসাবা থানায় যেও!
স্পিডবোটটা আবার স্পিড নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বড় নদীতে পড়ল। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। জলে তার ছায়া পড়েছে, অন্ধকার অন্ধকার একটা ভাব। নদীতে বেশ বড় বড় ঢেউ।
কাকাবাবু বললেন, জোয়ার আসছে মনে হচ্ছে।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য স্পিডবোট-চালককে জিজ্ঞেস করলেন, সেই লঞ্চটর কাছে পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে? তুমি একবার গিয়েছিলে তো সেখানে?
হাঁ, সার। আর বেশি দুর নয়। নৌকোটা বাঁধা রয়েছে যে, নইলে আর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতুম।
দ্যাখা, যদি বৃষ্টি নামার আগে পৌঁছে দিতে পারো!
বলতে বলতেই নেমে গেল বৃষ্টি। দারুণ বড় বড় ফোঁটা। বসে বসে ভেজা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, নৌকোর ছাঁইয়ের মধ্যে ঢুকে গেলে মাথা বাঁচানো যায়। কাকাবাবু, যাবেন নাকি নৌকোতে?
কাকাবাবু বললেন, না, থাক। আবার ওঠাউঠি করা এক ঝামেলা। তোমরা যেতে পারো।
কেউই গেল না, বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজতে লাগল বসে বসে। খুব জোরে বাতাসও বইছে, পেছনের নৌকোটা ভীষণ দুলছে, সেজন্য স্পিডবোটেরও গতি কমে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, এতবড় নদী, অথচ এদিকে একটা নৌকো বা লঞ্চ দেখছি না।
রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, সমুদ্র তো বেশি দূরে নয়। এদিকে সার্ভিস লঞ্চ চলে না। মাছ ধরা নৌকো-টোকো যায় নিশ্চয়ই, আসলে মেঘ দেখে তারা ঘরে ফিরে গেছে।
স্পিডবোটের চালক বলল, কদিন ধরেই এখানে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।
সন্তু বলল, কলকাতায় তো একদম বৃষ্টি পড়েনি।
এদিকে একটু বেশি বৃষ্টি হয়। সমুদ্র কাছেই কিনা?
বিমান হঠাৎ বলে উঠল, ওই যে সামনে ঝাপসামতন কী দেখা যাচ্ছে? ওইটাই সেই লঞ্চটা না?