ইতালি থেকে একটা চিঠি এসেছে
ইতালি থেকে একটা চিঠি এসেছে কাকাবাবুর নামে। তাঁর বন্ধু রুডলফ আন্তোনিও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আল্পস পাহাড়ে একটা অভিযানে যাওয়ার জন্য। ইতালি, ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের মাঝখানে এই আল্পস পাহাড়। ইউরোপে সবচেয়ে বড়, উপরে বরফ ঢাকা। আগে ফরাসি দেশ থেকে ইতালি যেতে হলে এই পাহাড় পেরিয়ে যেতে হত। অনেক উঁচু পর্যন্ত ঘোরানো ঘোরানো সেই রাস্তা এখনও আছে। এখন আল্পসের পেটের ভিতর দিয়ে একটা টানেল তৈরি হয়েছে। খুব সম্ভবত সাড়ে ষোলো কিলোমিটার লম্বা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টানেল। গাড়িটাড়ি সেই টানেলের মধ্যে দিয়ে এদেশওদেশ চলে যেতে পারে অনেক কম সময়ে। অত বড় টানেলের মধ্যে যদি কোনও গাড়ি হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়, তাতে খুব বিপদ। অন্য গাড়িও পার হতে পারে না। দারুণ ট্রাফিক জ্যাম, সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা।
কিছুদিন আগে, আল্পসের সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা গাড়িতে আগুন ধরে যায়। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্য কয়েকটা গাড়িতে, অনেক লোকের মৃত্যু হয়। সব কিছু পরিষ্কার করতে বেশ কিছুদিন লেগেছিল। তারপরেও বিপদ কাটেনি। সেই নিদারুণ দুর্ঘটনার স্মৃতিতে এখন সব গাড়িই ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে যায়। তারই মধ্যে এক-এক দিন সন্ধেবেলা হঠাৎ সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা খুব জোর আওয়াজ শোনা যায়। কোনও গাড়িটাড়ি কিংবা যন্ত্রপাতির আওয়াজ নয়, অন্যরকম। সেই আওয়াজ শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে।
সেটা কীসের আওয়াজ কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। স্থানীয় গ্রামবাসীদের ধারণা, ওটা পাহাড়ের কান্না। মানুষ অত বড় একটা পাহাড়ের পেট ফুটো করে দিয়েছে, পাহাড় তা সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু পাহাড়ের কি প্রাণ আছে যে, সে কাঁদবে? সেই আওয়াজটা শুধু সন্ধেবেলাতেই হয় কেন? অনেক ভাবে অনুসন্ধান চালিয়েও সেই শব্দের কারণ বোঝা যায়নি। শব্দটাও থামছে না। অনেক গাড়ির চালক এখন আর ভয়ের চোটে সেই টানেল দিয়ে যায় না। তারা যাচ্ছে সেই উপরের রাস্তা দিয়ে। তাতে সময় বেশি লাগছে, খরচও বেশি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা ওই টানেল কি শেষ পর্যন্ত এমনি-এমনি পড়ে থাকবে?
রুডলফ আন্তোনিও লিখেছেন যে, তিনি এগারো জনের একটি দল নিয়ে আল্পস পাহাড়ে যাচ্ছেন সামনের মাসে। দরকার হলে অন্তত এক মাস থাকবেন সেখানে। পাহাড়ের কান্না রহস্যের সমাধান না করে ফিরবেন না। তার খুব ইচ্ছে, রাজা রায়চৌধুরী এই দলে যোগ দিন। রাজা রায়চৌধুরী হিমালয়ের দেশের মানুষ। হিমালয়ের তুলনায় আল্পস তো বাচ্চা ছেলে। রুডলফ জানেন যে, রাজা রায়চৌধুরী হিমালয়ে অনেক ঘুরেছেন। সুতরাং তিনি পাহাড়ের রহস্য ভাল বুঝবেন।
চিঠিটা পেয়ে কাকাবাবু খুব খুশি হলেন। রুডল্ফের সঙ্গে তিনি একবার একটি অভিযানে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায়। মানুষটি খুবই মজাদার, সবসময় হাসি-ঠাট্টা করতে ভালবাসেন। ওঁর সঙ্গে খুব চমৎকার সময় কাটে। পাহাড়ের কান্নার রহস্যটা জানারও খুব ইচ্ছে কাকাবাবুর।
চিঠি লেখার বদলে এখন ই-মেলেই চট করে উত্তর দেওয়া যায়। সম্মতি জানিয়ে উত্তর দেওয়ার জন্য কাকাবাবু কম্পিউটার খুলে বসার পর তার একটা খটকা লাগল। তিনি এখন ইতালি চলে গেলে কর্নেলের চ্যালেঞ্জের কী হবে? সে নির্ঘাত ভাববে যে, কাকাবাবু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ভয়ে! নাঃ, আগে ওটার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
সন্তু এখন পুরোপুরি সুস্থই হয়ে উঠেছে বলা যায়। সে কলেজেও যেতে শুরু করেছে। শিগগিরই তার পরীক্ষা। কিন্তু হাঁটার বদলে দৌড়োবার চেষ্টা করলেই সন্তুর বুকে একটা তীব্র ব্যথা হয়। সে বুকে হাত চেপে বসে পড়ে। এই ব্যথাটা থাকে প্রায় কুড়ি মিনিট। কোনও ওষুধেই এই ব্যথা সারছে না। এ জন্য কাকাবাবু খুবই চিন্তিত। রিভলভারের গুলির ক্ষত শুকিয়ে গেলেও ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষত কিন্তু রয়েই গিয়েছে। ডাক্তাররাও সেটার কারণ ধরতে পারছেন না। তা হলে কি সন্তুকে এই ব্যথা নিয়েই কাটাতে হবে সারাজীবন? সে আর দৌড়োতে পারবে না। বয়স বাড়লে তো ব্যথাটা আরও বাড়তে পারে।
এ-কথা ভাবলেই কাকাবাবুর সারা শরীর জ্বলে ওঠে রাগে। তখনই আবার প্রতিজ্ঞা করেন, ওই কর্নেলকে শাস্তি দিতেই হবে। জীবনে কখনও তিনি মানুষ খুন করেননি। কিন্তু ওই কর্নেলটাকে মারতে তাঁর হাত কাঁপবে না। ভোপালের সেই জঙ্গলেই তিনি কর্নেলকে মেরে ফেলতে পারতেন। একটুখানি দ্বিধা করেছিলেন। তাই লায়লা নামের মেয়েটা বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে গেল কর্নেলকে নিয়ে।
সন্তুর এই অবস্থা দেখে তিনি ঠিক করেছেন, আর দ্বিধা করবেন না। হয় তিনি নিজে মরবেন, অথবা কর্নেলকে সরিয়ে দেবেন পৃথিবী থেকে। অনেক দিন অবশ্য ওদের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। কর্নেলের হাতে গুলি লেগেছিল, কিন্তু সেটা কতটা সিরিয়াস? হাতের পাঞ্জায় গুলি লাগলে তো মানুষ মরে না। সেরে উঠতেও বেশি দিন লাগার কথা নয়।
সে কি তবে লুকিয়ে আছে? ভীমবেটকায় কাকাবাবু সারারাত কাটালেন, তখনও সে এল না। ওই জায়গাতেই ওর ভাইকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটাই ছিল প্রতিশোধ নেওয়ার শ্রেষ্ঠ জায়গা। পুলিশটুলিশ কেউ ছিল না, তাও সে এল না কেন?
কাকাবাবুই ঠিক করেছিলেন যে, কর্নেল যদি কোথাও লুকোবার চেষ্টা করে, তা হলে তিনি ঠিক তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেবেন। কিন্তু তার আগে ইতালি আর আল্পস পাহাড় ঘুরে এলে হয় না? এমন লোভনীয় প্রস্তাব!
রুডলফকে সেদিনই কিছু উত্তর না দিয়ে দু-তিন দিন চিন্তা করার সময় নিলেন। ঠিক দুদিন পরে মাঝরাতে এল কর্নেলের টেলিফোন।
গম্ভীর গলায় সে বলল, রায়চৌধুরী, আমাদের খেলার কথা ভুলে যাওনি তো?
কাকাবাবু বললেন, না, ভুলব কেন? তোমারই তো পাত্তা নেই। এখন কি হাফ টাইম চলছে নাকি?
কর্নেল বলল, না, না, সেসব কিছু নয়। তুমি তৈরি থাকো। আবার শিগগির দেখা হবে।
কাকাবাবু বললেন, কোথায় দেখা হবে, বলো! আমি নিজেই সেখানে যাব।
কর্নেল বলল, আমি জায়গার নাম বলব, আর অমনি তুমি পুলিশকে সেটা জানিয়ে দেবে! ওসব হবে না। তুমি অপেক্ষা করো, হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে। হঠাৎ মুখোমুখি আসাটাই এ-খেলার মজা।
কাকাবাবু এবার কড়া গলায় বললেন, আমি দিনের পর দিন তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব? আমার অন্য কাজ নেই?
কর্নেল হাসতে হাসতে বলল, অত রেগে যাচ্ছ কেন, রায়চৌধুরী? রাগলেই দুর্বল হয়ে যাবে। খেলায় পুরো মনোযোগ দিতে পারবে না। তোমার অন্য কাজ থাকে তো করো না। তাতে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। তোমার যেখানে খুশি যেতে পারো।
কাকাবাবু বললেন, যদি দেশের বাইরে চলে যাই?
কর্নেল বলল, আর কদিন পরেই তো পৃথিবীর বাইরে চলে যাবে!
এর পরেই লাইন কেটে দিল কর্নেল।
কাকাবাবু কিছুক্ষণ বিছানার উপর চুপ করে বসে রইলেন। মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছে, এখন আর সহজে ঘুম আসবে না। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তিনি উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলেন।
পরদিনই তিনি রুডলকে জানিয়ে দিলেন যে, এখন তার পক্ষে আল্পস পাহাড়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুঃখিত। কাকাবাবু ঠিক করলেন, তিনি চুপচাপ বসে থাকবেন না। নিজের কাজ করে যাবেন।
আপাতত তাঁর কাজ একটা বই পড়ে তার ভূমিকা লেখা। তার খুব চেনা একজন ইতিহাসের পণ্ডিত সোমনাথ মন্দিরের উপর একটা বই লিখেছেন, এখনও ছাপা হয়নি। এক হাজার বছর আগে গজনির সুলতান মামুদ এই বিখ্যাত মন্দির আক্রমণ করে লুটপাট করেন। কাকাবাবু নিজে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে চাকরির সময় ওই ভাঙা মন্দিরের কাছে কয়েক সপ্তাহ ছিলেন, অনেক খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কলকাতায় বসে এরকম কাজ করা যায় না। অনবরত মানুষজন দেখা করতে আসে। কোনও নিরিবিলি জায়গায় থাকলে ভাল হয়।
তিন দিন পরেই কাকাবাবু ট্রেনে চেপে চলে এলেন ময়ূরভঞ্জ। সেখান থেকে একটা গাড়িতে চেপে ধুলাগড়, দুঘণ্টার মধ্যেই।
পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই ছোট্ট জায়গাটায় রয়েছে একটা মস্ত বড় জমিদারবাড়ি। এখনকার দিনে জমিদার বলে কিছু নেই। এইসব বাড়ির মালিকরাও গরিব হয়ে গিয়েছে। তাই বাড়িগুলোও ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ধুলাগড়ের এই বাড়িটা শিমুলতলার সেই ভূতের বাড়িটার চেয়েও বড়, অনেকটা অংশই অটুট আছে। বাড়িতে কিছু লোকজন থাকে, আলো জ্বলে। তাই এটাকে কেউ ভূতের বাড়ি বলে না।
এই বাড়িটার বর্তমান মালিকরা চার ভাই। তাদের দুভাই-ই থাকেন ভুবনেশ্বরে, একজন বিলেতে। শুধু একজনই রয়ে গিয়েছেন ধুলাগড়ে। তিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। গ্রামের মানুষদের বিনা পয়সায় ওষুধ দেন। এই মহেন্দ্র ভঞ্জদেও কাকাবাবুর খুব ভক্ত।
কাকাবাবু আগে দুবার এখানে এসে থেকেছেন। মহেন্দ্র ভঞ্জদেও তো কাকাবাবুকে দেখে খুব খুশি। তিনি পণ্ডিত মানুষ। ওড়িয়া ভাষা, বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি এরকম অনেক ভাষা জানেন। ইচ্ছে করলে তিনি অন্য ভাইদের মতো বিদেশে কিংবা কোনও বড় শহরে গিয়ে অনেক টাকাপয়সা রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু দু-একবার বাইরে গিয়েও টিকতে পারেননি। এই পাহাড় আর জঙ্গল তাকে টানে। গ্রামের গরিব মানুষদের সেবা করার জন্যই তিনি হোমিওপ্যাথি শিখেছেন। গ্রামের লোক তার পুরো নাম জানেও না বোধহয়! সবাই বলে মহা-ডাক্তার।
তিনি কাকাবাবুকে বললেন, কী ব্যাপার রাজাবাবু, এবার আপনি একা এলেন? আপনার মন্ত্রী আর সেনাপতি কই?
কাকাবাবুদের বংশের কেউ কোনওদিন রাজা কিংবা জমিদার ছিলেন না। তবু তার নাম রাখা হয়েছে রাজা। কেউ রাজাবাবু বলে ডাকলে অনেক সাধারণ লোক ভাবে, সত্যিই বুঝি তিনি রাজা ছিলেন। মহেন্দ্রকে বারণ করলেও শোনেন না। তিনি রাজাবাবু বলে ডাকবেনই।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু আর জোজোর পরীক্ষা সামনেই। তাই ওদের আনিনি। আমি যদি বেশিদিন থাকি, তখন ওরা বেড়াতে আসবে।
মহা-ডাক্তার বললেন, থাকুন না, এখানে দু-তিন মাস থাকুন। স্বাস্থ্য ভাল হয়ে যায়। এখানকার জল এত ভাল যে, পাথরও হজম হয়ে যায়।
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি তো পাথর খাই না। ডাল-ভাত খাই। তা এমনিতেই হজম হয়ে যায়।
মহা-ডাক্তার বললেন, শুধু ডাল-ভাত খাবেন কেন? আপনাকে হরিণের মাংসও খাওয়াব।
কাকাবাবু বললেন, আমি হরিণের মাংসও খাই না। হরিণের মতো একটা সুন্দর প্রাণীকে মারা আমি একেবারেই পছন্দ করি না।
মহা-ডাক্তার বললেন, রাজাবাবু, আপনি শুধু মাছ খেতে ভালবাসেন, তা জানি। এখানে বড় বড় মাছও পাওয়া যায়। আচ্ছা রাজাবাবু, মাছও তো দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু তাদের আমরা মেরে খাই।
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। কিন্তু কিছু তো খেতে হবে। মাছের স্মৃতিশক্তি খুব কম। ওদের মারার সময় তেমন একটা ব্যথাট্যথাও পায় না। আমরা যে গাছের ফল ছিঁড়ে খাই, পুরো গাছ কেটে কেটে চাল-ডাল হয়, গাছও তো জীবন্ত প্রাণী, তাই না? মাছের চেয়েও গাছের বোধহয় বেশি ব্যথা লাগে।
মহা-ডাক্তার বললেন, সেকথা ভাবলে তো কিছুই খাওয়া যায় না। ঠিক আছে, আপনাকে আমি একদিন খিচুড়ি খাওয়াব। আমি নিজে রান্না করি। ওরকম খিচুড়ি বাঙালিরা রান্না করতে জানে না।
মহা-ডাক্তারের একটা পুরনো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি আছে। সে গাড়ির ড্রাইভারের নাম রাবণ। একালে কারও এরকম নাম শোনাই যায় না। রাবণের বাঁ হাতের তিনটে আঙুল নেই, তবু সে দিব্যি গাড়ি চালাতে পারে। একবার তাকে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঘ আক্রমণ করেছিল, সেই বাঘের সঙ্গে লড়াই করে সে বেঁচে যায় কোনওক্রমে। শুধু ওই তিনটে আঙুল খোয়া যায়।
ওই গাড়িতে চেপে মহা-ডাক্তার গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা করতে যান। কাকাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন একদিন। গ্রামের মানুষ মহা-ডাক্তারকে খুব ভক্তি করে। তিনি ওষুধ দিয়েও কোনও পয়সা নেন না। তবু তারা জোর করে লাউ, কুমড়ো, কঁচাকলা কিংবা মাছ তুলে দেয় গাড়িতে। চিকিৎসা করা ছাড়া অন্য সময় তিনি নিজের হাতে রান্না করেন নানারকম। আর বই পড়েন। কথা বলার সঙ্গী বিশেষ কেউ নেই। কাকাবাবুকে পেয়ে সর্বক্ষণই গল্প করতে চান।
দিনতিনেক থাকার পরই কাকাবাবু বুঝলেন, এখানে থাকলে তার নিজের কাজ হবে না। মহা-ডাক্তার ছাড়াও গ্রামের কিছু কিছু বয়স্ক লোক হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে কথা বলতে। এ-বাড়িতে মাটির তলায় দুখানা ঘর আছে। লোহার গেট লাগানো। বোধহয় এককালের জমিদাররা ওসব ঘরে দুষ্ট প্রজাদের বন্দি করে রাখত। বাইরের লোককে এড়িয়ে নিরিবিলিতে থাকার জন্য কাকাবাবু একদিন মাটির তলায় একটা ঘরে কিছুক্ষণ কাটালেন। ভেবেছিলেন, ওখানে বসেই লেখাপড়া করবেন। কিন্তু সে-ঘরে অসহ্য গরম। বাইরের কোনও হাওয়া আসে না। আগেকার দিনের লোকেরা এসব ঘরে থাকত কী করে?
কাকাবাবু কয়েকদিন পর মহা-ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, মহেন্দ্র, তোমাদের একটা আউট হাউজ ছিল না মোষমুণ্ডি পাহাড়ের উপরে? আমি একবার দেখেছিলাম।
মহা-ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, আছে এখনও। সেটা বিক্রি করার খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু খদ্দের পাচ্ছি না।
কাকাবাবু বললেন, সেখানে গিয়ে আমি কয়েকটা দিন থাকতে পারি না? বেশ নিরিবিলিতে লেখাপড়া করব?
মহা-ডাক্তার বললেন, না, না, ওখানে থাকবেন কী করে? কাছাকাছি জন-মনিষ্যি নেই। কিছু নেই। আগেকার দিনে বাপ-দাদারা যখন জঙ্গলে শিকার করতে যেতেন, তখন ওই বাড়িটা বানানো হয়েছিল। তারা সঙ্গে অনেক দলবল নিয়ে যেতেন। রান্নার লোক, জল তোলার লোক, পাহারাদার সবই থাকত। এখন আর শিকারে যাওয়া হয় না, ওখানেও কেউ থাকে না। সেই জন্যই তো বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছি।
কাকাবাবু বললেন, ধরো, আমি যদি বাড়িটা কিনতে চাই, তা হলে একবার দেখে আসতে হবে তো!
মহা-ডাক্তার বললেন, আপনি কিনতে চাইলেও আপনাকে বিক্রি করব। কারণ, আমি জানি, আপনি ওখানে থাকতে পারবেন না। কেউ যদি কারখানা টারখানা বানাতে চায়, তার পক্ষে সুবিধেজনক। এখনও ওখানে কিছু কিছু হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আছে। একা থাকা ওখানে অসম্ভব।
কাকাবাবু বললেন, জানো তো, নেপোলিয়ন বলতেন, অসম্ভব বলে কোনও কিছুই তার ডিকশনারিতে নেই। ইচ্ছে করলে সব কিছুই সম্ভব। তুমি শুধু আমার সঙ্গে একজন লোক দাও, যে রান্নাবান্না করে দেবে। তাতেই আমি ঠিক থেকে যেতে পারব।
মহা-ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে, চলুন, আমিও যাব আপনার সঙ্গে। রান্নার লোক, কাজের লোকও যাবে। কয়েকটা দিন হইহই করে কাটিয়ে আসা যাবে। হরিণ না হোক, দু-একটা বুনো শুয়োর শিকারও করে ফেলতে পারি।
কাকাবাবু মনে মনে বললেন, এই রে, দলবল মিলে গেলে তো তার নিজের কাজ কিছুই হবে না। সারাক্ষণ হইচই করে কাটবে। তিনি মুখে বললেন, না, না, মহেন্দ্র, তোমাকে যেতে হবে না। তোমাকে অনেক রোগী দেখতে হয়, সে বেচারারা অসুবিধেয় পড়ে যাবে।
মহা-ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, রোজ রোগী দেখতে হয়। কিন্তু রাজাবাবু, ডাক্তারদের কি ছুটির দরকার নেই? পৃথিবীতে আর সকলেই ছুটি পায়, শুধু ডাক্তাররাই ছুটি পাবে না! সারা বছর ধরে রোজ রোগী দেখতে হবে?
কাকাবাবু বললেন, তাও তো বটে। ডাক্তারদের ছুটি অবশ্যই দরকার। তা হলে এক কাজ করা যাক। প্রথমে আমি একাই যাই, আমার কাজ শেষ করি। তারপর তোমাকে খবর দেব। তখন তুমি চলে এলে কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটানো যাবে। এর মধ্যে তুমি রোগীদের তোমার ছুটির কথা জানিয়ে দাও।
মহা-ডাক্তার বললেন, খবর দেবেন কী করে? ওখানে কি টেলিফোন আছে? ইলেকট্রিসিটিও নেই। বাসটাস চলে না, সেরকম রাস্তাও নেই। আগেকার দিনে বাড়ির কর্তারা ঘোড়ায় চেপে যেতেন। আপনাকেও ঘোড়া নিয়েই যেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, তাই যাব। এই খোঁড়া পা নিয়েও আমার ঘোড়া চালাতে অসুবিধে হয় না। আর খবর দেওয়ার ব্যাপারে, এটা তো মোবাইল ফোনের যুগ। সেই ফোন একটা সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার কাজ শেষ হলেই ফোন করব তোমাকে।
কাকাবাবুর জেদ দেখে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন মহা-ডাক্তার।
পরদিনই ঘোড়ায় চেপে রওনা দিলেন কাকাবাবু। সঙ্গে আর একটি ঘোড়ায় পিছন পিছন চলল যদু, তার সঙ্গে চাল-ডাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র। সে রান্নাবান্না আর কাকাবাবুর দেখাশোনা করবে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু আর এবড়োখেবড়ো রাস্তা। জোরে ঘোড়া ছোটানো যায় না। প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে গেল। দূর থেকে, টিলার উপরে বাড়িটাকে দেখায় একটা ভাঙা দুর্গের মতো। পাশাপাশি দুটো গম্বুজ। ঘোড়া থামিয়ে সেদিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাকাবাবু আপন মনে হেসে উঠলেন। নিজেকে তার মনে হল, এক বিখ্যাত গল্পের বইয়ের চরিত্রের মতো। তিনি যেন ডন কুইকজোট (অন্য উচ্চারণে ডনকুহাটি) আর যদু হচ্ছে সাঙ্কো পাঞ্জা। একটা ভাঙা বাড়িকে দুর্গ ভেবে আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। হাতে একটা বর্শা থাকলেই মানিয়ে যেত!
তিনি যদুকে জিজ্ঞেস করলেন, যদু, এ-বাড়ির যা অবস্থা দেখছি, এখানে থাকা যাবে তো? খুব অসুবিধে হবে?
যদু বলল, না, আইজ্ঞা। থাকা যাবে। শুধু একটাই অসুবিধা। পানির বড় অভাব। বাড়ির মধ্যে পানি নাই।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে পানি কোথায় পাওয়া যাবে? যদু বলল, তিলং ঝরনা আছে। সেখান থেকে সব পানি আনতে হয় আইজ্ঞা।
কাকাবাবু বললেন, রান্নার জল আর খাবার জলটুকু শুধু নিয়ে এসো। এখনও তো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বৃষ্টির জলে স্নান সেরে নেব।
গেটের কাছে যেতেই শোনা গেল ফোঁস ফোঁস শব্দ। একটা নয়, তিনতিনটে কালো রঙের সাপ। যদু অবশ্য সাপ দেখে ঘাবড়াল না। পা দিয়ে ধপাধপ করে আওয়াজ করতেই সাপ তিনটে সরসরিয়ে চলে গেল মাঠের দিকে।
কাকাবাবু বললেন, এই সাপেরা বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল নাকি? যাই হোক, আমাদের তো রাস্তা ছেড়ে দিল দেখছি। দোতলার কোনও ঘরে থাকা যাবে?
যদু বলল, যাবে আইজ্ঞা। দুইখান ঘর ভাল আছে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে চিন্তা নেই। সাপেরা দোতলায় ওঠে না। নীচে নামার সময় একটু সাবধানে নামলেই হবে। সাপের গায়ে পা না পড়লে তো কামড়ায় না।
যদু দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না, না, কোনও ভয় নাই।
গেটের বাইরে এবং ভিতরেও ঝোপ-জঙ্গল হয়ে আছে। বেশ কয়েকটা ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাল। উপরে ওঠার সিঁড়িটার একপাশও বিপজ্জনক ভাবে ভাঙা। অনেক দিন এ-বাড়িতে কেউ থাকেনি, বোঝা যায়। মহেন্দ্র কেন আপত্তি করছিলেন, তাও বোঝা গেল। তবু, দোতলায় এসে কাকাবাবুর বেশ পছন্দ হয়ে গেল জায়গাটা। ঘরের জানলাগুলো যদিও ভাঙা, কিন্তু অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ঢেউ খেলানো পাহাড়, বড় বড় গাছ, আর অনেকখানি আকাশ।
কাকাবাবু সঙ্গে অনেক বইপত্র এনেছেন। সারাদিন এখানে লেখা ও পড়ার জন্য সময়ের কোনও অভাব হবে না। তবে রাতে অসুবিধে হবে। হারিকেন আনা হয়েছে, তাতে পড়াশোনা করা যায় না। তবে, ব্যাটারিচালিত টু-ইন ওয়ান আনা হয়েছে, তাতে রেডিয়ো শোনা যাবে, গানও শোনা যাবে।
প্রথম রাতটা ভালই কেটে গেল।
পরদিন সকালে কাকাবাবু বেরিয়ে পড়লেন আশপাশের জায়গা ঘুরে দেখতে। ঘোড়া নিয়ে আসায় সুবিধে হয়েছে, পাহাড়ের উপর কাকাবাবুকে হাঁটতে হবে না। ক্রাচ দুটো রেখে যাবেন ভেবেও সঙ্গে নিলেন। কখন কী কাজে লাগবে, তার ঠিক নেই।
গরম কমে এসেছে অনেকটা। আকাশ প্রায় নীল, মাঝে মাঝে শুধু দেখা যায় সাদা রঙের মেঘ। যখন-তখন দু-এক পশলা বৃষ্টি হলেও শরৎকাল এসে গিয়েছে। বোঝা যায়। যদিও টিলার উপরে বাড়ি, তবু সামনের খানিকটা জায়গা সমতল। বড় বড় গাছ রয়েছে বটে, কিন্তু ঠিক জঙ্গল বলা যায় না। পাশের পাহাড়টা একেবারে ঘন সবুজ বনে ঢাকা। সমতল জায়গাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে বিরাট গাছ। ঠিক দেওয়ালের মতো সেই দিকটা খাড়া নেমে গিয়েছে। পাছে কেউ হঠাৎ পড়ে না যায়, তাই আগেকার জমিদাররা এখানে অনেকটা পাঁচিল গেঁথে দিয়েছিলেন। সে-পাঁচিল অবশ্য এখন অনেকটাই ভাঙা।
দুটো হরিণ কাকাবাবুর ঘোড়ার সামনে দিয়ে জোরে দৌড়ে চলে গেল। একটা ময়ূরও দেখা গেল একটু পরে। এখনও এখানে কিছু কিছু বন্য প্রাণী আছে। একসময় বাঘও ছিল। মহা-ডাক্তার বলেছেন, কয়েকটা বাঘ মাঝে মাঝেই দেখা যায়। কাকাবাবু হরিণ আর ময়ূর দেখে খুশি হলেও মনে মনে ভাবলেন, বাঘটাঘ না দেখাই ভাল।
বেশ কিছুক্ষণ বেড়ানোর পর কাকাবাবু ফিরে এলেন বাড়িটায়। জায়গাটা সত্যি খুব সুন্দর। এই বাড়িটাকে সারিয়ে টারিয়ে একটা টুরিস্ট লজ কিংবা হোটেল বানালে অনেক লোক এখানে এসে থাকতে পারে। কিন্তু তার আগে রাস্তা বানাতে হবে, জলের ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি লোকজন আসা-যাওয়া শুরু করলে হরিণ-ময়ূররাও আর থাকবে না।