Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 8

উল্কা-রহস্য || Sunil Gangopadhyay

সন্তু আলো জ্বেলেই দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে। বাথরুমের দরজা খোলা। বারান্দার দিকের দরজাটা বন্ধ, তবু সন্তু সেই দরজা খুলে একবার দেখল, সেখানেও কেউ নেই।

কাকাবাবুকে কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, এটা সন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। ঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন নেই। সেরকম কিছু হলে সন্তুর ঘুম ভাঙত না, তা কি হয়। কাকাবাবুর ক্রাচ জোড়া নেই, জুতো নেই। বালিশের তলায় হাত দিয়ে সন্তু দেখল, রিভলভারটাও নেই।

কাকাবাবু নিজেই কোথাও বেরিয়েছেন এত রাত্রে! সন্তুকে ডাকেননি।

সন্তুর প্রথমে খুব অভিমান হল। এরকম আগে কখনও হয়নি। সন্তুকে বাদ দিয়ে কোথাও যাননি কাকাবাবু। এবার তিনি সন্তুকে অনেক কিছুই বলছেন না। পাঞ্জাবে কাকে টেলিফোন করলেন?

সন্তুর হাঁটুতে অত্যন্ত চোট লেগেছিল বলেই কাকাবাবু এবার বেশ ঘাবড়ে গেছেন। সন্তুর বিশ্রাম নেওয়া দরকার বলেই তিনি নিজের অসুখের ভান করে তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। কাকাবাবু বলেছিলেন, এখানে তাঁদের বিপদের আশঙ্কা আছে, অথচ তিনি এই রাত্তিরে বেরিয়ে গেলেন একা-একা?

ঘরের অন্য দরজাটাও বন্ধ। ইয়েল লক, বাইরে বেরিয়ে টেনে দিলেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। কাকাবাবু খুব সাবধানে আওয়াজ না করে বেরিয়ে পড়েছেন। সন্তু জামাজুতো পরে নিল, চাবিটা পকেটে নিয়ে বাইরে এসে দেখল, বাংলোর সব কটা বারান্দায় আলো জ্বলছে। কোথাও কেউ জেগে নেই। গেটের কাছে একটা টুলে বসে ঘুমে ঢুলছে একজন পুলিশ কনস্টেবল।

কাকাবাবু কোথায় যেতে পারেন, তা সন্তু আন্দাজ করতে পারল না। কোথায় সে কাকাবাবুকে খুঁজতে যাবে?

অভিমানটা যেন বাষ্পের মতন গলা ঠেলে ওপর উঠতে চাইছে। কাকাবাবু তাকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন?

এখন সন্তু একা-একা ঘরে শুয়ে থাকবে নাকি? অসম্ভব!

সামনে দিয়ে বেরুতে গেলে হয়তো পুলিশটি জেগে উঠবে। সন্তু ফিরে এল নিজের ঘরে।

বারান্দার রেলিং টপকে বাগানে নেমে পেছনদিকের গেটটা খুলল নিঃশব্দে। তারপর খুব সাবধানে চারদিকটা দেখে নিল। কোথাও কেউ নেই। বেলাভূমিতেও জনমানবের চিহ্ন নেই। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলেও হাওয়া বইছে খুব জোরে।

সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সন্তু প্রথমে খুব অবাক হয়ে গেল। ঢেউয়ের মাথায় পর পর কতকগুলো মালা ভেসে আসছে। জ্বলজ্বল করছে মালাগুলো। এত মালা আসছে কোথা থেকে?

তারপর সন্তুর মনে পড়ল, ওগুলো আসলে ফসফরাস। ঢেউয়ের সাদা ফেনায় ফসফরাস মিশে থাকে, দিনের আলোয় দেখা যায় না, অন্ধকারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অনেকদিন সমুদ্রের ধারে আসেনি সন্তু, তাই তার মনে ছিল না।

ব্যাখ্যাটা জানার পরেও মনে হয় সমুদ্রের বুকে ভাসছে শত-শত আলোর মালা। একেবারে তীরের কাছে এসে সেগুলো ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

সন্তু চলে এল একেবারে জলের রেখার সামনে।

আজও অনেক জেলে ডিঙি তোলা আছে পাড়ের ওপর। সেগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সন্তু খানিকটা দূরে একটা আলো দেখতে পেল।

চতুর্দিকে অন্ধকারের মধ্যে আলোর বিন্দু। কৌতূহলী হয়ে সন্তু নৌকোগুলোর আড়ালে-আড়ালে এগোল সেই দিকে।

খানিকটা কাছে যাওয়ার পর সন্তু বুঝতে পারল, জলে একটা মোটর বোট ভাসছে, আলো জ্বলছে তার ভেতরে।

ডাকবাংলোর বেয়ারার সঙ্গে গল্প করতে করতে সন্তু শুনেছিল, এখানে এখন খুব ভাল চিংড়ি মাছ উঠছে বলে বড়-বড় মাছের ব্যবসায়ীরা এসে উপস্থিত হয়েছে। তাদের মোটর বোট আছে। তিন-চারখানা মোটর বোট এখানে ঘোরাঘুরি করে। সমুদ্রের বুকে অনেকখানি বেড়াবার জন্য সেই বোট ভাড়াও পাওয়া যায়। সে-কথা শুনেই সন্তুর খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার বোটে করে সমুদ্রের বুকে বেড়াবার।

পাশাপাশি দুখানা বোট রয়েছে, তার মধ্যে আলো জ্বলছে একটাতে।

আরও কাছে গিয়ে সন্তু শুনতে পেল কারা যেন কথা বলছে একটার ভেতরে। কী বলছে শোনা যাচ্ছে না।

চটপট জুতো খুলে হাতে নিয়ে, প্যান্ট গুটিয়ে সন্তু জলের মধ্যে নেমে পড়ল। ঢেউ-এর শব্দের জন্য জলের মধ্যে তার পায়ের শব্দ কেউ শুনতে পাবে না। বোটের সামনের দিকের ক্যাবিনে আলো জ্বলছে। সন্তু চলে এল তার কছে। খুব সন্তর্পণে কাচের জানলার একপাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, দুজন লোক ভাত খাচ্ছে মুখোমুখি বসে। তাদের মধ্যে একজন লোককে সন্তু আগে কোথাও দেখেছে।

মুখের মাত্র একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে সন্তু, তাই ঠিক বুঝতে পারল না লোকটাকে কোথায় দেখেছে সে। এখানেই, না অন্য কোথাও, কিন্তু চেনা চেনা। লাগছে ঠিকই। গোপালপুরে এসে বেশি লোকের সঙ্গে সন্তুর দেখাই হয়নি!

তা হলে?

একটা বড় ঢেউ এসে ধাক্কা মারতেই বোটটা বেশ দুলে উঠল, সন্তুও পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। প্যান্ট ভিজে গেল অনেকটা। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।

বোটের গা ধরেধরে ফিরে আসতে-আসতে সন্তুর মনে হল, ভেতরে গিয়ে লোকটার মুখ একবার দেখে এলে হয় না?

পরক্ষণেই তার আবার মনে হল, এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যদি সে ধরা পড়ে যায়? কাকাবাবু কিছু জানতে পারবেন না। কাকাবাবু অনেকবার করে বারণ করেছেন তাকে বাইরে যেতে।

হয়তো এটা একটা সাধারণ মাছধরা বোট। ভেতরের লোকটাকে সন্তু কলকাতায় কোথাও দেখে থাকতে পারে। তবু লোকটাকে ভাল করে না দেখে তার কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনের মধ্যে অস্বস্তি থেকে যাবে।

ওই দুটো লোক ছাড়া বোটে আর কেউ নেই মনে হচ্ছে। ওরা ভাত খাওয়ায় ব্যস্ত। সন্তু টপ করে একবার উঠে ভেতরে গিয়ে ভাল করে দেখে আসতে পারে ধরা পড়তে যাবে কেন?

আর দ্বিধা না করে সন্তু খুব আস্তে-আস্তে নিঃশব্দে উঠে পড়ল বোটের ওপর। না দাঁড়িয়ে সে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোতে লাগল সিঁড়ির দিকে। এটা মোটর বোট আর লঞ্চের মাঝামাঝি। ওপরের ডেকে কিছু নেই, নীচে শুধু একটা ক্যাবিন।

সমুদ্রের ঢেউ কখনও থামে না, অনবরত ঢেউয়ের গর্জনে ওপর থেকে নীচের লোক দুটোর কথাবার্তা শোনার কোনও উপায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে পা টিপেটিপে নামল সন্তু। ক্যাবিনের দরজাটা খোলা। লোক দুটো এখনও খাচ্ছে।

একজন লোক সন্তুর অচেনা। বাকি লোকটাকে সন্তুর চিনতে কোনও অসুবিধে হল না। আসামে জাটিংগার পাখি দেখতে যাওয়ার সময় সন্ধেবেলা যে জিপটায় চেপে গিয়েছিল সত্তরা, সেই জিপের ড্রাইভার।

আসামে তাদের খাদের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গোপালপুরের পদ্মনাভনের উধাও হওয়ার সম্পর্ক সত্যি তা হলে আছে? আর কোনও সন্দেহ। রইল না! সন্তু লাফ দেওয়ার আগে এই লোকটা তাকে ধরতে এসেছিল। এই লোকটা এখানেও এসেছে।

এক্ষুনি গিয়ে কাকাবাবুকে খবরটা দেওয়া দরকার। পুলিশ এই লোকটাকে ধরতে পারলেই সব খবর বেরিয়ে যাবে। সন্তু একা এখানে কিছু করতে পারবে না।

সন্তুর সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে আসা উচিত, তবু সে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা কী কথা বলছে, তা না শুনে কিছুতেই সে ফিরে যেতে চাইছে না।

ওদের মধ্যে একজন বলল, আজ হাওয়ার খুব জোর। এর মধ্যে বোট চালানো খুব রিস্কি।

অন্য লোকটি বলল, সারাদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি আর ভাল লাগে না। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। আজ আর কি কোথাও যেতে হবে?

ড্রাইভারটি বলল, এখনও বুঝতে পারছি না। আমিও ভাবছি শুয়ে পড়ব। এখানে দুজনের জায়গা হয়ে যাবে।

অন্য লোকটি বলল, হ্যাঁ, হয়ে যাবে কোনওরকমে।

অতি সাধারণ কথাবার্তা। এটা সাধারণ মাছধরা বোটও হতে পারে। আসামের ড্রাইভারটা এখানে এসে কাজ নিয়েছে? তা হলেও ওই লোকটা যে সন্তুকে মারতে গিয়েছিল, তাতে তো সন্দেহ নেই। ওকে পুলিশে ধরাতেই হবে। আর দেরি করা ঠিক নয়।

সন্তু পেছন ফিরতেই শুনতে পেল ড্রাইভারটি বলছে, শুনছি তো আজকের বেশি আর থাকতে হবে না। কাল পদ্মনাভনকে সরিয়ে দেবে।

পদ্মনাভন! এরা জানে পদ্মনাভন কোথায় আছে। পুলিশ কিংবা কাকাবাবু যা জানতে পারেননি, সন্তু বাইচান্স তা জেনে ফেলেছে।

সন্তু তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ডেকের ওপর মুখ বাড়িয়েই আবার নিচু করে নিল মাথা। সর্বনাশ! দুজন লোক টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে একেবারে বোটের কাছে এসে গেছে।

একজন আলো ফেলল ডেকের ওপর। অন্যজন চেঁচিয়ে ডাকল, বাঘা! বাঘা।

নীচের ক্যাবিন থেকে একজন উত্তর দিল, যাই!

চোখের পলকে রেলিং ধরে গড়িয়ে নেমে এসে সন্তু চলে গেল সিঁড়ির নীচে। সে জায়গাটা ঘন অন্ধকার, কিসের যেন বস্তা রাখা হয়েছে কয়েকটা। আর-একটু হলেই সন্তু ধরা পড়ে যেত। তার বুকটা ধড়ফড় করছে। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। এখান থেকে যে-কোনও উপায়ে পালাতেই হবে।কাকাবাবুকে খবরটা দিতে না পারলে ব্যর্থ হয়ে যাবে সব কিছু।

অন্য লোক দুটো উঠে এসেছে বোটের উপর। সন্তুর নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করল। আর এক মিনিট সময় পেলে সে নেমে পড়ার সময় পেয়ে যেত। ড্রাইভারটিকে চিনতে পারার পরই তার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল।

এঞ্জিনের গোঁ-গোঁ শব্দ শুরু হল। বোটটা এবার স্টার্ট দেবে। সন্তু ভাল সাঁতার জানে। কিন্তু সে যে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারও উপায় নেই। একবার সে উঁকি মেরে দেখল সিঁড়ির ঠিক ওপরেই একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মোটর বোটটা ছুটতে শুরু করল।

এত রাত্রে কি এরা মাছ ধরতে যাচ্ছে? বোটটায় সন্তু মাছধরা জাল দেখতে পায়নি। ভেতরে মাছ-মাছ গন্ধও পায়নি। এরা কোথায় যাচ্ছে কে জানে?

একটুও নড়াচড়া না করে সন্তু নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। ধরা পড়লে আর বাঁচার উপায় থাকবে না। কুমার সিং-এর ড্রাইভার তাকে ঠিক চিনতে পারবে। যারা পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেয়, তারা এখানে তাকে মেরে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। তার দেহটাও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোনওদিন। হাঙর-টাঙরেরা খেয়ে ফেলবে। কাকাবাবু জানতেই পারবেন না, সন্তু কোথায় গেল!

মোটর বোটটা তীব্র বেগে ছুটছে। আর লাফাচ্ছে অনবরত। মাঝে-মাঝে জলের ঝাপটা চলে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ভিজে যাচ্ছে সন্তুর সারা গা, ওপরে লোকগুলো কী যেন কথা বলছে, শোনা যাচ্ছে না কিছুই।

কতক্ষণ ধরে বোটটা চলছে তা বুঝতে পারছে না সন্তু। মনে হচ্ছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা। হয়তো অতটা নয়, তবু একভাবে একটুও নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে তার এক-একটা মিনিটকেই এক ঘন্টা বলে মনে হচ্ছে। হাঁটুর কাছটা চুলকোচ্ছে, কিন্তু নিচু হতেও সাহস করছে না সন্তু।

কেউ একজন নামছে সিঁড়ি দিয়ে। পাতলা কাঠের সিঁড়ি, মাঝখানে ফাঁক-ফাঁক। সিঁড়ির পেছনে জায়গাও খুব কম। লোকটার পা সন্তুর গায়ে লেগে যেতে পারে। সন্তু নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে, কিন্তু তার বুকের মধ্যে ধৰ্ধক আওয়াজটা কি শোনা যাবে।

এই সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় পেছন ফিরে নামতে হয়, আর ওঠবার সময় সামনের দিকে ফিরে। এবার হয়তো লোকটা সন্তুকে দেখতে পাবে না, কিন্তু ওঠবার সময়?

ধরা পড়ে গেলে সন্তু কী দিয়ে লড়াই করবে? হাতের নখ আর দাঁত ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র নেই তার কাছে। এদের হাতে মরার চেয়ে যে-কোনও উপায়ে সে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়বার চেষ্টা করবে। তারপর যা হয় হোক। কিন্তু এরা চারজন।

হঠাৎ এঞ্জিনের আওয়াজটা থেমে গেল। সমুদ্রের বুকে এতদূর এসে এরা থামছে কোথায়? এখানে কোনও দ্বীপ আছে? গোপালপুরের কাছাকাছি কোনও দ্বীপের কথা সন্তু শোনেনি।

যে-লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল, সে আবার দুপদাপ করে ওপরে উঠে গেল। সে একটু ভাল করে তাকালেই সন্তুকে দেখতে পেয়ে যেত। কিন্তু সে কিছুই সন্দেহ করেনি।

বোটটা একেবারে থেমে গেছে। কয়েকজন নামছে মনে হল। সন্তু তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে। সবাই নেমে যাচ্ছে কি না আগে বোঝ দরকার।

মিনিট পাঁচেক পরে আবার একজন সিঁড়ি দিয়ে নেমে ক্যাবিনের মধ্যে ঢুকে গেল। ওপরে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার একটা ঝুঁকি নিতেই হবে।

সন্তু টপ করে সিঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওপরের ডেকে উঁকি মারল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্তু এক দৌড়ে সামনের দিকে চলে এসে একটা লাফ মারতে গিয়েও থেমে গেল।

মোটর বোটটা জলে ভাসছে বটে, কিন্তু একটু দূরেই তীর দেখা যাচ্ছে। সন্তু জলের মধ্যে লাফ দিলে ঝপাং করে শব্দ হবে। ক্যাবিনের ভেতরের লোকটা সেই শব্দ শুনে ফেলতে পারে। অন্য লোকগুলো নেমে চলে গেছে, তাদের আর দেখা যাচ্ছে না।

সন্তু লাফ না দিয়ে বোটটার একদিক ধরে ঝুলে পড়ে খুব আস্তে জলে নামল। তারপর একটু হেঁটে ডাঙায় পৌঁছেই একটা দৌড় লাগাল।

মুক্তি! মুক্তি! ওরা তাকে ধরতে পারেনি। আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না।

এই জায়গাটা গোপালপুর থেকে যতই দূরে থোক, দিনের আলো ফুটলে সন্তু ঠিকই ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় খুঁজে পাবে। রাত্তিরটা তাকে লুকিয়ে কাটাতে হবে। যতদূর সম্ভব সরে যেতে হবে এই লঞ্চ থেকে।

এখানকার আকাশে মেঘ বিশেষ নেই। খানিকটা জ্যোৎস্না ফুটেছে। জায়গাটা ঠিক কী রকম, তা সন্তু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করল।

এটা কোনও দ্বীপ কিনা তা বোঝা গেল না। বেলাভূমির বেশ কাছেই পর পর সার দেওয়া অনেকগুলো বাড়ি। পঞ্চাশ-ষাটটা তো হবেই। একটু কাছে গিয়ে সন্তু যে কটা বাড়ি দেখতে পেল, সবগুলো ভাঙা। কোনওটার দেওয়াল ধসে গেছে, কোনওটার ছাদ নেই, কোনও বাড়িতেই মানুষ আছে বলে মনে হয় না।

গোপালপুরেও এরকম কিছু ভাঙা বাড়ি দেখেছে সন্তু। যারা সমুদ্রের খুব কাছে বাড়ি বানিয়েছিল, কোনও একদিন সমুদ্র প্রবল উত্তাল হয়ে এগিয়ে এসে ঢেউয়ের ধাক্কায় তাদের বাড়ি ভেঙে দিয়েছে। এখানেও বোধ হয় এক সময় গোপালপুরের মতন একটা শহর গজিয়ে উঠেছিল, সমুদ্র হঠাৎ একদিন এগিয়ে এসে দিয়েছে সব লণ্ডভণ্ড করে। সমুদ্র তার সীমানার ওপর হস্তক্ষেপ সহ্য করে না।

এর যে-কোনও একটা ভাঙা বাড়িতে সন্তু রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে। রাত্তিরে আর কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না। কাল সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাকাবাবুকে খবরটা দিতে হবে।

একটা ভাঙা বাড়িতে ইট-ফিট সরিয়ে সন্তু সবেমাত্র বসেছে, এই সময় দেখতে পেল একজন লোক আবার বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বোটটার দিকে। লোকটা বোটের ওপর উঠে গেল। এক মিনিট বাদেই কিছু একটা জিনিস নিয়ে নেমে এল আবার।

চাঁদের আলো লোকটার মুখে পড়েছে। সন্তুর চিনতে কোনও কষ্ট হল না। কুমার সিং!

এই লোকটা কাকাবাবুকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল। সন্তুর কাছে যদি এখন রিভলভার থাকত তা হলে সে ঠিক লোকটাকে গুলি করত।

এরা সবাই এখানে আড্ডা গেড়েছে। এতগুলো বাড়ির মধ্যে কোনটাতে ওরা লুকিয়ে আছে তা জানা দরকার। পুলিশ ডেকে এনে একটা-একটা করে বাড়ি খুঁজে দেখতে গেলে ওরা তার মধ্যে পালাবে।

সন্তু বেরিয়ে এসে কুমার সিংকে অনুসরণ করতে লাগল।

মাঝে-মাঝে সে পেছনদিকটাও দেখে নিচ্ছে। কিছুতেই সে ধরা দেবে না। চিহ্নগুলোও মনে রাখছে ভাল করে।

এটা একটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর। শুধু যে সামনের দিকের বাড়িগুলোই ভেঙেছে তা নয়, পেছনদিকেও সব বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে খুব সম্ভবত সমুদ্রের ঢেউ এখানেও বাড়িগুলোর ওপরে এসে পড়ে। তাই কেউ আর সারাবার চেষ্টা করেনি। গোটা শহরটাই পরিত্যক্ত।

কুমার সিং অনেকগুলো বাড়ির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে বাড়িটার দরজা বলে কিছু নেই। পুরো দোতলাটাই ভেঙে পড়েছে সামনের দিকে। এক সময় বেশ বড় বাড়ি ছিল বোঝা যায়। হোটেল-টোটেলও হতে পারে।

সন্তু চলে গেল পেছনদিকে।

ভেতরের কোনও একটা ঘর বোধ হয় আস্ত আছে, সেখান থেকে একটা আলোর শিখা আসছে।

বাড়িটা চেনা হয়ে গেল, এখন সন্তুর ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু ওই ঘরটার মধ্যে কে-কে রয়েছে তা দেখার দারুণ কৌতূহল কিছুতেই দমন করতে পারল না সন্তু। এখানে চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে গেছে, অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

সন্তু একটু-একটু করে এগিয়ে গেল ভেতরে।

যে ঘরে আলো জ্বলছে সে ঘর থেকে কিছু কথাবার্তাও ভেসে আসছে।

এ বাড়ির দোতলাটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেও ওপরে ওঠার সিঁড়িটা রয়ে গেছে। সন্তু পা টিপেটিপে সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। তারপর শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। ঘরের ছাদটায় একটা ফুটবলের মতন গোল গর্ত হয়ে আছে। সেখান দিয়ে ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়।

একদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে একজন লম্বা মতন লোক। হাত-পা বাঁধা, মুখে দশ-বারো দিনের দাড়ি, মাথার চুল উসকো-খুসকো। এই

তা হলে পদ্মনাভন! কাকাবাবুর আগে সই পদ্মনাভনের হদিস পেয়ে গেল।

পদ্মনাভনের সামনে টুলের ওপর বসে আছে একজন তোক। তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সন্তু। সেই লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুমার সিং।

সেই লোকটি হিন্দিতে কুমার সিংকে জিজ্ঞেস করল, রাও এল না?

কুমার সিং বলল, উনি মোটর বোটে এলেন না। গাড়িতে আসছেন।

লোকটি বিরক্তভাবে বলল, কেন, বোটে এল না কেন? জায়গা তো ছিল!

কুমার সিং বলল, আজ খুব হাওয়া দিচ্ছে। সমুদ্র খুব রাফ। তাই উনি বোটে আসতে ভয় পেলেন। সেইজন্য গাড়িতে আসবেন।

লোকটি বলল, রাও একটা ভিতুর ডিম। গাড়িতে আসবে তো এত দেরি করছে কেন? আজ রাতেই এখান থেকে হায়দরাবাদ চলে যাব। জায়গাটা খুব হট হয়ে উঠছে।

তারপর লোকটি পদ্মনাভনের দিকে ফিরে বলল, শুনলে তো? আজ রাতেই আমরা এ জায়গা ছেড়ে চলে যাব। যথেষ্ট হয়েছে। দিনের পর দিন কাজ নষ্ট।

পদ্মনাভন কোনও কথা বললেন না। লোকটি আবার বলল, পাথরটা কোথায় আছে বলবে? না মরবে?

পদ্মনাভন বললেন, পাথরটা নেই, এ-কথা কতবার বলব! আমার কাছেও নেই। তোমরা আমার ঘর খুঁজে দেখেছ, সেখানেও নেই।

লোকটি বলল, কোথাও বালির মধ্যে পুঁতে রাখতে পারো। সেই জায়গাটা বলে দাও, তোমাকে ছেড়ে দেব। পাথরটা চাই, তোমাকে মারতে চাই না।

পদ্মনাভন বললেন, আমি কি তোমার মতন বোকা যে, এই কথা বিশ্বাস করব? পাটা পেলেও তুমি আমাকে মারবে তা জানি। পাথরটা তুমি পাবে না। সেটা আমি নষ্ট করে ফেলেছি। ওটা ঝুটো পাথর।

লোকটি বলল, পাঁচ হাজার টাকায় কিনে তুমি পাথরটা নষ্ট করে ফেলেছ? কী করে নষ্ট করলে? সেটা আমাকে দেখাও।

পদ্মনাভন এবার বেশ তেজের সঙ্গে বললেন, ওরে গাধা, আমি কি তোর মতন মিথ্যে কথা বলি? বলছি নষ্ট করে ফেলেছি, সত্যি নষ্ট করেছি। ওটা তুই কিছুতেই পাবি না।

কুমার সিং বন্দী পদ্মনাভনকে এক লাথি মেরে বলল, আমাদের মালিককে তুই গাধা বলছিস। তোকে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব!

পদ্মনাভন বললেন, যেভাবেই আমাকে মারো, পাথরটা পাবে না।

সেই লোকটি বলল, কীভাবে মারব, বলে দিচ্ছি। এখন তোমার শরীরে ইঞ্জেকশান দিয়ে চারগুণ ঘুমের ওষুধ ভরে দেব। তুমি আরামসে ঘুমোবে। তারপর তোমাকে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে দিয়ে আসব। ঘুমোতে-ঘুমোতেই তুমি মরে যাবে জলে ড়ুবে। জলের প্রাণীরা যদি তোমার শরীরটা খেয়ে নাও ফেলে, ভাসতে ভাসতে তীরে এসে লাগে, তা হলেও খুনের কোনও চিহ্ন থাকবে না। হাত-পা বাঁধাও থাকবে না। পুলিশ ভাববে, তুমি নিজেই সমুদ্রে ড়ুবে গেছ। অ্যাকসিডেন্ট। আমরা গোপালপুরের দিকে না গিয়ে এখান থেকেই চলে যাব।

পদ্মনাভন বললেন, এটা তো বেশ ভাল ব্যবস্থা। আমার কোনও কষ্ট হবে। রাজীব, তোের এই গুণ্ডাটাকে বারণ কর আমাকে লাথি মারতে।

লোকটি বলল, যতই সাহসের বড়াই করো, আজ তোমার শেষ রাত।

তারপর সে কুমার সিংকে জিজ্ঞেস করল, ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ আনতে মাধব রাও এত দেরি করছে কেন?

কুমার সিং বলল, সিরিঞ্জ আমিই এনেছি, সার।

লোকটি বলল, তা হলে কাজ সেরে ফেলা যাক। আমি ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিচ্ছি, তোমরা একে বোটে করে সমুদ্রের অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দাও। কই দেখি সিরিঞ্জ আর অ্যামপিউল।

সন্তুর গলা শুকিয়ে গেছে। এরা সত্যি-সত্যি পদ্মনাভনকে মেরে ফেলবে? কোনওরকমে আটকানো যায় না?

ওদের কথা থেমে গেছে। ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিল নাকি?

উত্তেজনা দমন করতে না পেরে সন্তু গর্তটার মধ্যে মুখ বাড়াবার চেষ্টা করতেই একটা কাণ্ড হল।

সেই গর্তের পাশটা ফেটে গিয়ে ছাদের খানিকটা অংশ সন্তুকে নিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল নীচে। পড়তে-পড়তেও সন্তু একটা রড ধরে ঝুলবার চেষ্টা করল, পারল না।

পড়ার পর বেশি চোট না লাগলেও উঠে দাঁড়াবার সময় পেল না সন্তু, কুমার সিং দৌড়ে এসে তার টুটি চেপে ধরল।

রাজীব নামের লোকটি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ আবার কে? ছাদে উঠে বসে ছিল?

কুমার সিং বলল, এই বিচ্ছুটা রাজা রায়চৌধুরীর সঙ্গে ছিল। ওর ভাইপো হয়।

রাজীব বেশ ভয় পেয়ে বলল, মাই গড! তা হলে সে লোকটাও এসে পড়েছে নিশ্চয়ই। সে লোকটা তো জাদুকর। কিছুতেই মরে না।

কুমার সিং বলল, না, রাজা রায়চৌধুরী কী করে আসবে? তাকে আমি দেখেছি, রাত বারোটার সময় সি ফ্রন্ট হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। নিজের চোখে দেখেছি। সে আমায় দেখতে পায়নি। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই আমাদের বোটের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল।

রাজীব গর্জন করে উঠল, অপদার্থের দল। মোটর বোটে কেউ লুকিয়ে থাকে কি না, তা ভাল করে দেখে নিতে পারো না? এখন এ ছেলেটাকে নিয়ে

কী করা যায়?

কুমার সিং বলল, পাহাড়ের খাদে পড়ে গিয়েও মরেনি। আর চান্স নেওয়া উচিত নয়। সার, এর গলা মুচড়ে শেষ করে দেব?

রাজীব বলল, না, না, আমি এখানে খুনের কোনও চিহ্ন রাখতে চাই না। একেও ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেকশান করে দিলেই হয়। তারপর জলে ফেলে দেব। দুজনকে এক জায়গায় ফেলবে না। অন্তত চার-পাঁচ মাইল দূরে।

সন্তু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারল না। কুমার সিং তার দুহাত মুচড়ে পেছনে নিয়ে এসে এক হাতে তার গলাটা টিপে রেখেছে। কুমার সিং-এর সঙ্গে জোরে সে পারবে না, তার নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে।

কুমার সিং-এর ড্রাইভার এর মধ্যে এক কলসি জল নিয়ে এল।

রাজীব বলল, আমাকে গেলাসে জল দে তো, তারপর কাজ শেষ করে ফেলব।

জল খেয়ে নিয়ে রাজীব সিরিঞ্জে ওষুধ ভরল।

পদ্মনাভন সন্তুর দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ধন্যবাদ; যুবক। তুমি আকাশ থেকে খসে পড়লে, তার ফলে আমি অন্তত পাঁচ মিনিট বেশি বেঁচে গেলাম। না হলে আগেই এরা আমাকে শেষ করে দিত।

তারপর রাজীবের দিকে ফিরে বললেন, রাজীব শর্মা, তুমি এক সময় বিজ্ঞানী ছিলে, এখন মানুষ খুন করতে যাচ্ছ? তুমি এত নীচে নেমে যাবে? পুলিশ তোমাকে ধরতে না পারলেও তুমি নিজে তো জানবে তুমি খুনি। সারা জীবন পাপী থেকে যাবে।

রাজীব বলল, এখন নিজের প্রাণের ভয়ে ওসব বড়-বড় কথা বলছ। একদিন ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে, মনে নেই?

পদ্মনাভন বললেন, তুমি পর পর কয়েকটা কাজে ভুল করেছিলে, তারপরেও আমার মুখে-মুখে তর্ক করেছ, তাই তোমাকে বকেছি। তোমাকে তো তাড়িয়ে দিইনি। তুমি নিজেই চলে গেলে।

রাজীব বলল, তুমি আমাকে টিকতে দাওনি। তুমি স্বার্থপর। তুমি কক্ষনো চাওনি যে, অন্য কারুর সুনাম হোক। শুধু নিজে বিখ্যাত হতে চেয়েছিলে।

পদ্মনাভন বললেন, কাজে ভুল করলে নাম করবে কী করে? সে যাই হোক, ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে গিয়ে তোমার ক্ষতি কিছু হয়নি। তুমি ব্যবসা করে এর মধ্যেই বিরাট বড়লোক হয়েছ শুনেছি। তবু আমার ওপর এত রাগ?

কুমার সিং বলল, সার, এইসব কথা বলে লোকটা দেরি করিয়ে দিচ্ছে।

রাজীব বলল, ঠিক বলেছ। ওর কোনও চালাকি আর শুনছি না। ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিচ্ছি। বাঘা, ওকে চেপে ধরে থাক তো।

পদ্মনাভন বললেন, ঠিক আছে। আমাকে মারতে চাও যখন, মারো। কিন্তু এই ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। অতটুকু ছেলে, ওর জীবনের আরও কতখানি বাকি আছে। ওকে মেরো না!

রাজীব বলল, ছেড়ে দেব! আর বেরিয়ে গিয়ে ও সব বলে দেবে না?

পদ্মনাভন বললেন, তোমাদের ও চেনে না। তোমরা পালিয়ে গেলে ও যাকে যাই বলুক, তাতে তোমাদের কোনও ক্ষতি হবে না। ওকে ছেড়ে দাও,

আমি পাথরটার সন্ধান তোমাদের বলে দিচ্ছি।

সন্তু চমকে পদ্মনাভনের দিকে তাকাল। উল্কা-পাথরটা তা হলে নষ্ট হয়নি! সেটা এখনও লুকোনো আছে।

রাজীব বলল, পাথরটা আমাকে দেবে? কোথায় আছে সেটা?

পদ্মনাভন বললেন, আমার ঘরের কার্পেটের তলায় ভাল করে খুঁজে দেখো!

রাজীব শর্মা এবার হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর হিংস্র গলায় বলল, পদ্মনাভন, তুমি আমাদের অত মুখ ভেবেছ? তোমার ঘর অনেকবার খুঁজে দেখা হয়েছে। কার্পেটের তলায় অতবড় একটা পাথর থাকবে?

বাঘা এসে পদ্মনাভনের দু হাত চেপে ধরল। সিরিঞ্জটা উঁচু করে তুলল রাজীব শর্মা।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা গুলির শব্দ হল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রাজীব শর্মা।

তারপর হাত বাঁধা একটা লোককে কেউ ঠেলে ফেলে দিল ঘরের মধ্যে। তার পেছনে রিভলভার হাতে কাকাবাবু।

হাত বাঁধা লোকটাকে দেখে চমকে উঠল সন্তু। দাড়িওয়ালা জজসাহেব!

কাকাবাবু রিভলভারটা সকলের দিকে ঘুরিয়ে তীব্র গলায় বললেন, কেউ একটু নড়লেই সোজা গুলি চালাব। কোনওরকম দয়া-মায়া করব না। তোমরা সবাই অমানুষ!

কুমার সিং সন্তুকে ছেড়ে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। রাজীব শর্মার হাতে গুলি লেগেছে, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে।

কাকাবাবু ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বললেন, পদ্মনাভন, তুমি বিপদ নিয়ে খেলা করার অভ্যেসটা এখনও ছাড়লে? এ যে সাঙ্ঘাতিক খেলা।

পদ্মনাভন বললেন, রায়চৌধুরী? তুমি ঠিক সময়ে এসে পড়লে? এবারেও তা হলে বেঁচে গেলাম? এই রাস্কেলগুলোর হাতে আমার একটুও মরতে ইচ্ছে করছিল না। এই জায়গাটার সন্ধান পেলে কী করে?

মাটিতে পড়ে থাকা জজসাহেবের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাকাবাবু বললেন, এই মাধব রাও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল?

সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, কাকাবাবু! সাবধান!

কুমার সিং কাকাবাবুর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে একটা লোহার রড দিয়ে মারতে গেল। সন্তু লাফিয়ে উঠেও তাকে ধরতে পারল না। কাকাবাবু ঘুরে দাঁড়াবার আগেই কুমার সিং লোহার রড দিয়ে মারল কাকাবাবুর হাতে। রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল ঘরের এককোণে।

কুমার সিং চেঁচিয়ে বলল, বাঘা, ওটা ধর ধর।

এই সময় নাটকের মতন একটা কাণ্ড হল। বাইরে থেকে আর-একজন লোক লাফিয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। বাঘাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে রিভলভারটা তুলে নিল সে।

পীতাম্বর পাহাড়ী ওরফে অম্বর! তার কাঁধে পরিচিত ঝোলা।

অম্বর রিভলভারটা নাচাতে-নাচাতে বলল, সাবধান! সাবধান! আমি কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট! কেউ বেগড়বাঁই করলেই গুলি মারব! কাকাবাবু আর সন্তু ছাড়া আর যাকে-তাকে গুলি মারব!

তার হাতটা এমন থরথর করে কাঁপছে দেখেই বোঝা যায় সে জীবনে কখনও। রিভলভার ধরেনি। তবু সে সেটা নিয়ে লাফাচ্ছে আর বলছে, সাবধান! সাবধান।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়াবার সময় ক্রাচ দুটো ফেলে দিলেন। তারপর অম্বরকে আদেশের সুরে বললেন, অম্বর, তুমি ওটা সন্তুর হাতে দিয়ে দাও।

কাঁপা কাঁপা হাতে সন্তুকে দিতে গিয়ে অম্বর রিভলভারটা মাটিতে ফেলে দিল। আবার ঘরের মধ্যে শুরু হয়ে গেল একটা হুটোপুটি। সন্তু পা দিয়ে রিভলভারটা সরিয়ে দিল অনেক দূরে।

কুমার সিং লোহার রডটা তুলে এবার সরাসরি মারতে গেল কাকাবাবুর মাথায়।

কাকাবাবু সোজা তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুটো হাত তুললেন মাথার ওপর। কাকাবাবুর একটা পা ভাঙা, কিন্তু তাঁর দু হাতে কতখানি জোর,

তা অন্য লোকে বুঝতে পারে না। রাগে তাঁর মুখখানা লাল হয়ে গেছে।

কুমার সিং খুব জোরে মারলেও কাকাবাবু রডটা ধরে ফেললেন। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সেটা। তারপর কুমার সিং-এর একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন।

ধোপারা যেমনভাবে কাপড় কাচে, সেইভাবে কাকাবাবু কুমার সিংকে শূন্যে তুলে এক আছাড় মারলেন। প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হল। মনে হল, যেন কুমার সিং-এর মাথাটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

কাকাবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আমার দিকে রিভলভার তুলেছিলে, আমাকে লাথি মেরে খাদে ফেলে দিয়েছিলে, আবার আমার হাতে মেরেছ, তোমাকে আমি এমন শাস্তি দেব-

অম্বর বাঘাকে দুটো ঘুসিতে কাত করে চলে এসেছে কাকাবাবুর পাশে। কাকাবাবু রাগের চোটে আবার কুমার সিংকে শূন্যে তুলে আছাড় মারতে গেলেন।

এবার অম্বর কাকাবাবুর কাঁধ চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলল, কাকাবাবু, কাকাবাবু, কী করছেন? ও যে মরে যাবে! ছেড়ে দিন, ওকে এবার আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি ওকে কী শাস্তি দিই দেখুন!

কাকাবাবু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন। সত্যিই তো, আর-একবার আছাড় দিলে লোকটা শেষ হয়ে যাবে। তিনি কুমার সিংকে আস্তে নামিয়ে দিলেন মাটিতে।

কুমার সিং-এর মাথা ফেটে চৌচির হয়নি, কিন্তু লেগেছে প্রচণ্ড। একদিকের মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ভয়ে মুখখানা চুপসে গেছে তার। সে ভেবেছে, কাকাবাবুর বুঝি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিছুতেই তাঁকে মারা যায় না।

কাঁধের ঝোলাটা থেকে একটা ছোট্ট বেতের বাক্স বের করল অম্বর। তার ঢাকনা খুলতে-খুলতে সে বলল, আমি কাকাবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট! এবার তোমার কী অবস্থা করি দ্যাখো! অন্য লোককে মারতে তোমার হাত কাঁপে না, তাই না?

বেতের বাক্সটা থেকে ফস করে একটা সাপ বের করে সে ছুঁড়ে দিল কুমার সিং-এর গায়ে। সে বিকট চিৎকার করে উঠল। বলতে লাগল, বাঁচাও! বাঁচাও!

সাপটা বেশ বড়। ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করতে-করতে সেটা জড়িয়ে ধরল কুমার সিংকে।

অন্য সবাই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল।

সন্তু ফ্যাকাসে মুখে বলল, এ কী করলেন? ওকে সাপে কামড়ে দেবে?

অম্বর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওটার বিষ দাঁত নেই। আমি ভেঙে রেখেছি। এই সাপটা আমি সব সময় সঙ্গে রাখি লোককে ভয় দেখাবার জন্য।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress