ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি ঘটে গেল
ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, কাকাবাবু প্রথমে কিছু বুঝতেই পারলেন না।
কুমার সিংরা সবাই মিলে দুদিন ধরে দারুণ যত্ন করছে, খাওয়াচ্ছে দাওয়াচ্ছে, অনেক জায়গা দেখাচ্ছে, তাদের সঙ্গে শত্রুতার কোনও প্রশ্নই নেই। তবু হঠাৎ তারা এরকম ব্যবহার করবে, সেরকম কোনও সন্দেহই হয়নি।
কাকাবাবু শুধু বুঝতে পারলেন, তিনি একটা খাদে গড়িয়ে পড়ছেন। তাঁর হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা!
একটু আগেই টর্চের আলোয় দেখা গেছে যে, খাদটা খুব গভীর। এত উঁচু থেকে পড়লে বাঁচার কোনও আশাই নেই।
কাকাবাবু ভাবলেন, তা হলে কি এবার সত্যি মরতে হবে?
এর আগে কতবার, কতরকম বিপদে পড়তে হয়েছে। সাঙ্ঘাতিক বুদ্ধিমান শত্রুদের মুখখামুখি পড়েও কাকাবাবুর কখনও মৃত্যুভয় হয়নি। তাঁর এমনই প্রবল আত্মবিশ্বাস যে, সব সময়েই মনে করেন, কোনও না কোনও উপায়ে বেঁচে যাবেনই। একদিন-না-একদিন সব মানুষকেই মরতে হয়। কিন্তু অন্য লোকের ইচ্ছেয় তিনি কিছুতেই মরতে রাজি নন।
কিন্তু এখানে এটা কী হল? কোনও কথা নেই বার্তা নেই, লোকগুলো তাঁকে ঠেলে ফেলে দিল? আগে থেকে বিপদের একটুও আঁচ পাননি তিনি।
কাকাবাবু গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছেন। কোনও পাথরের খাঁজ কিংবা গাছের ডাল যে ধরে ফেলবেন, তারও উপায় নেই। তাঁর হাত দুটো পেছনদিকে বাঁধা।
কুমার সিং আর ভুবন দাসকে আগে কখনও দেখেননি কাকাবাবু। লোক দুটো অতি-সাধারণ, দুর্ধর্ষ বদ লোক হওয়ার যোগ্যতাও এদের নেই, শুধু-শুধু তাঁকে ওরা মারতে চাইল কেন?
এক জায়গায় কিসে যেন খুব জোরে কাকাবাবুর মাথা ঠুকে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এবার বুঝি জ্ঞান চলে যাবে।
কাকাবাবু ভাবলেন, জীবনে কি কিছু ভাল কাজ করিনি? দু-চারজন মানুষের কি উপকার করিনি আমি? তবু এরকম অকারণে প্রাণ দিতে হবে?
এর পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ঠিক কতক্ষণ পরে তাঁর জ্ঞান ফিরল তা তিনি বুঝতে পারলেন না। চোখৃ. খোলার পর প্রথমেই তিনি ভাবলেন, সন্তু? সন্তু কোথায়? তার কী হল?
তারপর তিনি বোঝবার চেষ্টা করলেন, কোথায় এসে পড়েছেন, হাত-পা কিছু ভেঙেছে কি না।
চতুর্দিকে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাথার মধ্যে এখন ঝিমঝম করছে বটে, কিন্তু শরীরে আর কোথাও ব্যথা নেই। শীতের ভয়ে আজ একটা বেশ মোটা ওভারকোট গায়ে দিয়ে বেরিয়েছিলেন, তাই শরীরে চোট লাগতে পারেনি। একটা মস্তবড় গামছা দিয়ে ওরা মুখটা বেঁধেছে, তার গিটটা পেছনদিকে, তার জন্যও মাথাটা বেঁচে গেছে।
যাক, তা হলে এ-যাত্রাতেও মরতে হল না। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে কাকাবাবু ভাবলেন, হুঁ, এবারে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু কোথায় এসে পড়া গেল? পিঠের কাছটা নরম-নরম। কাকাবাবু অনুভব করলেন, তিনি যেন একটা দোলনায় শুয়ে আছেন। সেটা তাঁর শরীরের চাপে একটু-একটু নিচু হচ্ছে। তাঁর মুখে লাগছে লতাপাতার স্পর্শ।
এক সময় দোলনাটা ছিঁড়ে গেল। কাকাবাবু আবার পড়ে গিয়ে গড়াতে লাগলেন।
কিন্তু এবারে বেশি নীচে পড়েননি, জায়গাটাও খাড়া নয়, ঢালু। বেশি জোরে গড়াচ্ছেন না। পা দিয়ে মাটিতে চাপ দিতে দিতে নিজেই থেমে যেতে পারলেন।
এবারে কোনওরকমে উঠে বসে তিনি ভাবলেন, লোকগুলো মহাবোকা! মেরে ফেলতেই যখন চেয়েছিল, তখন জায়গাটা ভাল করে দেখে নিতে পারেনি? আসামে বেশি বৃষ্টি হয় বলে এখানকার সব জঙ্গলেই লতা-গুল্ম আর আগাছায় ভর্তি, কঠিন পাথর দেখাই যায় না, ঢাকা পড়ে থাকে। এই খাদটাও পুরো খাড়া নয়। এক জায়গায় ঢালু হয়ে গেছে। এরকম জায়গায় পড়লেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুবই। .ওরা ঠিকমতো জায়গা বাছেনি।
সন্তুকে ওরা কী করল? ধরে রেখেছে?
কাকাবাবু বেশি নড়তে-চড়তে সাহস করলেন না। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, আবার কোথাও খাদ আছে কি না কে জানে! এ পর্যন্ত যখন বাঁচা গেছে, তখন দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করাই ভাল।
হঠাৎ তাঁর দুপুরবেলার সাপটার কথা মনে পড়ে গেল। সেপ্টেম্বর মাস, বর্ষা এখনও শেষ হয়নি, এই সময় সব সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। অন্ধকারে কোনও সাপের গায়ে পা দিলে আবার এক বিপদ হবে। সবচেয়ে ভাল উপায় একেবারে চুপ করে বসে থাকা। কিংবা শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া। নড়াচড়া না করলে সাপ কামড়াবে না। ঘুমন্ত লোকের গায়ের ওপর দিয়ে বিষাক্ত সাপ চলে গেছে, তবু কামড়ায়নি, এমন শোনা গেছে অনেকবার।
কাকাবাবু শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ঘুম আসবার আশা নেই।
তিনি একাগ্র হয়ে ভাববার চেষ্টা করলেন, কুমার সিং, ভুবন দাস কিংবা এখানকার অন্য কোনও লোককে আগে দেখেছেন কি না। না দেখেননি, এই জায়গাতেও তিনি আসেননি। এদের সঙ্গে শত্রুতা থাকার কোনও কারণ নেই। এরা কি তবে ভাড়াটে গুণ্ডা?
শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে লাগলেন কাকাবাবু। বারবার ভাবছেন সন্তুর কথা। যখন তাঁকে কুমার সিং ঠেলে ফেলে দেয়, তখন সন্তু একটু পেছনে পড়েছিল। সন্তু কি ব্যাপারটা দেখেছে? যদি দেখে থাকে, তা হলে সেই সময়ে সাহায্য করার বদলে সন্তু যদি পেছন ফিরে দৌড়ে পালিয়ে যায় তা হলে সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দুজনে একসঙ্গে মরা কিংবা ধরা পড়ার কোনও মানে হয় না।
আবার বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে, কোনও উপায় নেই।
কাকাবাবুর একটা গাধার কথা মনে পড়ল।
একবার হাজারিবাগে একটা ডাকবাংলোয় থাকার সময় কাকাবাবু জানলা দিয়ে একটা গাধাকে দেখেছিলেন। কোনও ধোপার গাধা হবে, দড়ি দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা। দারুণ বৃষ্টি পড়ছিল, প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলল সেই বৃষ্টি, সেই গাধাটাকে কেউ খুলে দেয়নি। সেটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, আর মাঝে-মাঝে করুণ সুরে ডাকছে। কাকাবাবু একবার ভেবেছিলেন, তিনি ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গাধাটাকে খুলে দেবেন। তারপর মনে হয়েছিল, তিনি খুলে দিলে গাধাটা যদি পালিয়ে যায়? ধোপা এসে চ্যাঁচামেচি করলে কী বলবেন?
কাকাবাবুর মনে হল, তাঁর অবস্থাও সেই গাধাটার মতন।
এত জোর বৃষ্টি হচ্ছে যেন মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়ছে। অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে মাঝে-মাঝে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। বোধ হয় গড়িয়ে পড়ছে। পাথর। এর মধ্যে একটা মাথায় এসে পড়লেই সর্বনাশ!
একসময় বৃষ্টিও থামল, ভোরের আলোও ফুটল।
এত বৃষ্টিতে ভিজে কাকাবাবুর ঠাণ্ডা লেগে গেছে খুব। তিনি হাঁচ্চো-হাঁচ্চো করে কয়েকবার হাঁচলেন। ওভারকোটটা ভিজে এমন ভারী হয়ে গেছে, যেন মনে হচ্ছে গায়ের ওপর একটা বর্ম চাপানো।
আর একবার হ্যাঁচ্চো করতেই তিনি তার একটা প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন। বৃষ্টির জন্যই বোধ হয় তাঁর মুখের বাঁধনটা একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল, হ্যাঁচ্চোর চোটে তা একেবারেই খুলে গেল।
আবার তিনি পর-পর দুবার হাঁচ্চো করলেন, এবার তিনবার প্রতিধ্বনি হল।
কাকাবাবুর খটকা লাগল। প্রতিধ্বনি বেশি হচ্ছে কেন? এ কী অদ্ভুত জায়গা!
আবার তাঁর নাক শুল-শুল করছে, হ্যাঁচ্চো করতে যাবেন, তার আগেই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলেন।
তা হলে তো এটা প্রতিধ্বনি নয়, কাছাকাছি কোথাও মানুষ আছে।
আলো ফুটতেই নানারকম পাখি ডাকতে শুরু করেছে। কাকাবাবুর মাথার কাছে ভোঁ-ভোঁ করছে একটা ভোমরা।
এখানে বড় গাছ বিশেষ নেই, ঝোপঝাড়-আগাছাতেই ভর্তি। কাকাবাবু যেখানে শুয়ে ছিলেন, তার পাশেই বেশ বড় গর্ত একটা। অন্ধকারে হাঁটতে গেলে ওটার মধ্যে পড়লে নির্ঘাত পা ভাঙত। পাহাড়ের নানা জায়গা থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে সেই গর্তটায় পড়ছে, কলকল শব্দ হচ্ছে।
কাকাবাবু একটা গাছে পিঠ দিয়ে আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। ওভারকোটটা খুলে ফেলতে পারলে ভাল হত, কিন্তু হাত যে বাঁধা! তবু ভাগ্যিস ওরা পা বাঁধেনি।
একটু দূরে আর-একবার হাঁচ্চো শুনে তিনি সেদিকে সাবধানে এগোলেন। একেই তাঁর একটা পা অকেজো, তার ওপর হাত দুটোও বাঁধা, ঢালু জায়গায় হাঁটতে গেলে যে-কোনও মুহূর্তে তাঁর পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তিনি এক-একটা গাছ দেখে-দেখে সেই পর্যন্ত গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাল সামলে নিচ্ছেন।
একটু পরে দেখতে পেলেন, এক জায়গায় ঝোপের মধ্যে একটা হলদে রঙের রেন কোটের অংশ দেখেই চিনলেন ওটা সন্তুর।
তিনি দুইবার সন্তুর আম ধরে ডেকেও কোনও সাড়া পেলেন না।
এবারে তিনি প্রায় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সন্তুর পাশে।
হাত ভোলা নেই তাই মাথা দিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দিলেন সন্তুর পিঠে। সঙ্গে-সঙ্গে বলতে লাগলেন, সন্তু, সন্তু, আর ভয় নেই। আমি এসে গেছি!
তবু সন্তু সাড়া দিল না। একটু নড়চড়লও না।
কাকাবাবুর একবার বুক কেঁপে উঠলেও পরক্ষণেই ভাবলেন, ও তো হেঁচেছে কয়েকবার। তা হলে অজ্ঞান হয়ে আছে।
তিনি কোনওক্রমে সন্তুকে চিত করিয়ে দিয়ে দেখলেন, ওর নিশ্বাস পড়ছে। ওর মুখের একটা পাশে রক্ত লেগে আছে। সন্তুর হাতও বাঁধা নয়, মুখও বাঁধা নয়।
কাকাবাবু একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। যাক, সন্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে, সে বেঁচে আছে। ওর জ্ঞান না ফিরলে এখান থেকে যাওয়া যাবে না। সবচেয়ে আগে তাঁর হাতের বাঁধনটা খোলা দরকার। যদি নাইলন না হয়, সাধারণ দড়ি দিয়ে বেঁধে থাকে, তা হলে কোনও ধারালো পাথরে কিছুক্ষণ ঘষলেই কেটে যাবে।
সেরকম কোনও পাথর চোখে পড়ল না। ঢালু জায়গা, এখান দিয়ে অবিরাম বৃষ্টির জল গড়ায়, তাই সব পাথরই মসৃণ। কাকাবাবু একটা গাছ বেছে নিয়ে তার কাছে গিয়ে উলটো হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সেই গাছের গায়ে ঘষতে লাগলেন হাতের বাঁধন।
সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে গাছটা নরম হয়ে আছে। দড়ির ঘষায় গাছের চোকলাবাকলা খসে পড়ছে, দড়ির কিছু হচ্ছে না। দড়িটা যদি নাইলনের হয়, তা হলে সারাদিন ধরে ঘষলেও কোনও লাভ হবে না।
অজ্ঞান অবস্থাতেই সন্তু আর-একবার হেঁচে উঠল। হাতের ঘষাটা থামিয়ে কাকাবাবু সন্তুর দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর চোয়ালটা কঠিন হয়ে গেল। তিনি মনে-মনে বললেন, বেঁচে যখন গেছি, তখন এখান থেকেও উদ্ধার পাবই ঠিক। তারপর কুমার সিং আর ভুবন দাসের টুটি চেপে ধরতে হবে। পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই গিয়ে ওরা লুকোতে পারবে না।
আরও কয়েকবার দড়ির বাঁধনটা ঘষে-ঘষে কাটার চেষ্টা করে কাকাবাবু হাল ছেড়ে দিলেন। দড়িটা নিশ্চয়ই নাইলনের, গাছে ঘষে কোনও লাভ হবে না। সন্তুর হাত-পা বাঁধা নেই, সন্তু জেগে উঠলেই তাঁর বাঁধনটা খুলে দিতে পারবে।
কাকাবাবু কাছে গিয়ে সন্তুকে ধাক্কা দিলেন। সন্তু চোখ মেলছে না। এটা ঘুম হতেই পারে না, সন্তুর ঘুম এত গাঢ় নয়। সন্তু অজ্ঞান হয়ে আছে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে অজ্ঞান? খুব বেশি চোট লেগেছে ওর? থুতনির কাছে একটা জায়গায় অনেকখানি কেটেছে, সেখান থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। তবে ওই ক্ষতর জন্য তো অজ্ঞান হয়ে থাকার কথা নয়। •
হাত বাঁধা অবস্থায় কাকাবাবুর এখন আর কিছুই করার সাধ্য নেই। তিনি কাছে বসে রইলেন, আর মাঝে-মাঝে সন্তুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।
এইরকমভাবে কেটে গেল আরও এক ঘন্টা।
আস্তে-আস্তে রোদ ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে আর জঙ্গলে।
ভিজে ওভারকোটটা গা যেন কামড়ে ধরে আছে। কাকাবাবু শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন। মাঝে-মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘুম এসে যাচ্ছে, জ্বরও এসেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে জেগে থাকতেই হবে।
পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার পরেও বেঁচে গেছেন বটে, কিন্তু জবজবে ভিজে পোশাক পরে এমনভাবে বসে থাকলে ঠাণ্ডা লেগেই মরতে হবে।
আরও অনেকটা সময় কেটে গেল, তবু সন্তুর জ্ঞান ফিরল না।
হঠাৎ খানিকটা দূরে কিসের যেন একটা শব্দ শোনা গেল।
এতক্ষণ পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি জঙ্গলে। কোনও জন্তু-জানোয়ার দেখা যায়নি। এখন যেন মনে হচ্ছে বড় কোনও জানোয়ার জঙ্গলের লতা-পাতা-ডাল ঠেলে-ঠেলে আসছে এদিকেই।
বাঘ কিংবা ভাল্লুক হতে পারে না, তারা চলার সময় শব্দ করে না। হাতি হতে পারে। আসামের জঙ্গলে প্রচুর হাতি আছে। তারা এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে চলে আসে। হাতিরা তাড়া করে এসে মানুষ মারে না সাধারণত, তাদের চলার পথ থেকে দূরে সরে থাকলেই হল। কিন্তু হাতিরা যদি এখান থেকেই যেতে চায়? তা হলে তাদের পায়ের চাপেই চ্যাপটা হয়ে যেতে হবে!
সন্তুকে কাকাবাবু সরাবেন কীভাবে? কোন দিকেই বা সরাবার চেষ্টা করবেন?
এবার যেন মানুষের গলার গুনগুন আওয়াজ পাওয়া গেল!
কোনও মানুষ এদিকে আসছে বুঝতে পেরে কাকাবাবুর প্রথমে খুব ভরসা জাগল। এবার সাহায্য পাওয়া যাবে।
পরে মুহূর্তেই মনে হল, যদি কুমার সিংরা আসে? ওরা হয়তো দেখতে আসছে, কাকাবাবু আর সন্তু সত্যি-সত্যি মরেছে কি না!
ওরা কাকাবাবুর রিভলভারটা কেড়ে নেয়নি, সেটা এখনও রয়ে গেছে। কোটের পকেটে। কিন্তু হাত বাঁধা, সেটা ব্যবহার করার কোনও উপায় নেই। অসহায় রাগে কাকাবাবু ছটফট করতে লাগলেন। তবু এই অবস্থাতে, তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, যদি কুমার সিং আসে, তাকে সাঙ্ঘাতিক শাস্তি দিতেই হবে।
এবার লোকটিকে দেখা গেল। পীতাম্বর পাহাড়ী!
তার হাতে একটা লম্বা চিমটে, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুট, মাথায় টুপি। সে গুনগুন করে গান গাইছে। কাকাবাবু তাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন না। চুপ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
অম্বর এদিকেই আসছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর চিমটে দিয়ে বাড়ি মারছে ঝোপঝাড়ে। তারপর হঠাৎ কাকাবাবুকে দেখতে পেয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তারপর চোখ দুটো গোল-গোল করে বলল, এ কী, এ কী, এ কী! কাকাবাবু! এত সকালে জঙ্গলে? পাহাড়ের এত নীচে? বেড়াতে এসেছেন বুঝি? আপনার তো বেড়াবার খুব শখ!
তারপর সন্তুর দিকে চোখ পড়তেই সে আবার বলল, ও কী? সন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? অ্যাকসিডেন্ট? কী করে হল? কোথা থেকে পড়ে গেল?
কাকাবাবু এবার গম্ভীরভাবে বললেন, অম্বরবাবু, আমার হাতের বাঁধনটা খুলে দেবেন প্লিজ?
অম্বর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, অ্যাঁ? আপনার হাত বাঁধা? কে এমন করল? নিশ্চয়ই কুমার সিং? লোকটা ভাল না, প্রথম দেখেই আমি বুঝেছিলাম! কাল রাত্তিরে আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। ওই লোকটা যেতে দিল না! কখন থেকে এইরকম হাত বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন? ঠিক কী হয়েছিল খুলে বলুন তো?
কাকাবাবু বললেন, আপনি আগে আমার হাত দুটো খুলে দিন।
অম্বর কাকাবাবুর পাশে বসে পড়ে বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ওরে বাবা, এ যে নাইলনের দড়ি। খুব শক্ত করে গিট বেঁধেছে। জলে ভিজে আরও শক্ত হয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, আমার ওভারকোটের ভেতরের পকেটে দেখুন একটা ছুরি আছে।
অম্বর বলল, ছুরি তো আমার কাছেও আছে। জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরি, সবসময় কাছে একটা বড় ছুরি রাখি। কিন্তু নাইলনের দড়ি ছুরি দিয়েও সহজে কাটা যায় না। হাত দিয়েই গিটটা খুলতে হবে। আপনি আমাকে অম্বরবাবু বলছেন কেন? অম্বর আর তুমি বলে ডাকবেন। আপনার সম্পর্কে কত লেখা পড়েছি। এবার আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আমিও ঢুকে পড়লাম, ভাবতেই আমার দারুণ মজা লাগছে। এবারে বইটার নাম কী হবে? দস্যুর কবলে কাকাবাবু। তার মধ্যে আমিও একটা ক্যারেকটার। পীতাম্বর পাহাড়ী! না, না, আমার নামটা শুধু অম্বরই রাখবেন। পাহাড়ী পদবিটা অবশ্য রাখতে হবে, নইলে আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করবে না।
একটানা কথা বলতে বলতে এক সময় সে বলল, এই যে গিটটা খুলেছে।
কাকাবাবু হাত দুটো সামনে আনতে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেললেন। সারারাত ধরে হাত দুটো পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধা ছিল বলে কাঁধের কাছে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা হয়ে গেছে।
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে হাত দুটো সামনে-পেছনে করলেন কয়েকবার। তারপর খুলে ফেললেন ওভারকোটটা।
ঝুঁকে পড়ে সন্তুকে দু হাতে তুলে ধরে ব্যাকুলভাবে ডাকলেন, সন্তু! সন্তু!
অম্বর বলল, অন্য গল্পে থাকে, সন্তু অনেক কায়দা করে আপনাকে বিপদ থেকে বাঁচায়। এখানে সন্তু এতক্ষণ চুপ করে শুয়ে আছে কেন? ওর তো হাত-পা বাঁধা নয়। এই যে সন্তুবাবু, উঠুন!
কাকাবাবু এবার ধমকের সুরে বললেন, আপনি এটাকে মজার ব্যাপার ভাবছেন? গল্প ভাবছেন! এটা জীবন মরণের প্রশ্ন। সন্তু অনেকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে আছে। সাঙ্ঘাতিক কোনও আঘাত না লাগলে ও অজ্ঞান হয়ে থাকত না। ওকে এক্ষুনি ওপরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সন্তুকে কোলে করে ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি রাস্তাটা দেখিয়ে দিন?
ধমক খেয়ে খানিকটা কাঁচুমাচু হয়ে গিয়ে অম্বর বলল, আপনি কোলে করে সন্তুকে নিয়ে উঠবেন! অসম্ভব! আপনারা অনেক নীচে নেমে এসেছেন। এখান থেকে হাফলঙ শহর অনেক উঁচু। কোনও সিঁড়িও নেই। আপনার একাই তো উঠতে কষ্ট হবে খুব। আপনার ক্রাচ দুটো কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই। যেতেই হবে। সন্তুকে এক্ষুনি ডাক্তার দেখাতেই হবে।
অম্বর বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, ব্যবস্থা করছি।
কোমর থেকে একটা ভোজালি বের করে সে একটা গাছের ডাল কাটল। তারপর সেটার পাতা-টাতা হেঁটে লাঠির মতন বানিয়ে কাকাবাবুর হাতে দিয়ে বলল, আপনি এটা নিয়ে আস্তে-আস্তে আসুন, কাকাবাবু! সন্তুকে আমার কাছে দিন। এভাবেও পুরোটা ওঠা যাবে না। কাছেই পাহাড়িদের একটা ছোট গ্রাম দেখে এসেছি। ওখান থেকে ঘোড়া জোগাড় করতে হবে।
সন্তু তো আর ছোটখাটো ছেলে নয়, সে কলেজে পড়ে, চেহারাটাও বড় হয়েছে বেশ। তাকে কোলে নিয়ে পাহাড়ি পথে ওঠা সহজ কথা নয়। অম্বর সন্তুকে কাঁধে নিয়ে চলল, একটু বাদেই হাঁপাতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল পাহাড়িদের বসতিটা। সন্তুকে নামিয়ে অম্বর ছুটে গিয়ে দুটো ঘোড়া জোগাড় করে আনল। সঙ্গে একজন লোক। কাকাবাবু একটা ঘোড়ায় চাপলেন, অন্য ঘোড়াটিতে অম্বর বসল সন্তুকে নিয়ে। পাহাড়ি লোকটি হেঁটে-হেঁটে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
এক সময় ওরা পৌঁছে গেল ডাকবাংলোর সামনে।
দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় বিচারকটি বসে আছেন বাংলোর বারান্দায়। এখন আর তিনি উদাসীন ভাব করলেন না। ওদের দেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন, কী ব্যাপার মিঃ রায়চৌধুরী, আপনারা সারারাত কোথায় ছিলেন? এ কী চেহারা! আপনার ভাইপোটিরই বা কী হয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, একটা অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।
অম্বর বলল, অ্যাকসিডেন্ট না ছাই! গুরুতর ব্যাপার। কাকাবাবুর হাত বাঁধা ছিল।
বিচারক আঁতকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? হাত বাঁধা? সে কী? ভোরবেলাতেই একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন। তিনি বললেন, একজন মিস্টার সিং ডায়েরি করে গেছে যে, কলকাতার দুজন লোক পা পিছলে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে।
কাকাবাবু এসব কথা কিছুই এখন শুনতে চান না।
তিনি অম্বরকে বললেন, শিগগির একজন ডাক্তার ডেকে আনো প্লিজ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি বলে অম্বর ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।
ডাকবাংলোর একজন বেয়ারাকে সামনে দেখে কাকাবাবু বললেন, তাড়াতাড়ি গরম জল নিয়ে এসো!
বেয়ারাটি ধরাধরি করে সন্তুকে ঘরের মধ্যে এনে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দৌড়ে গরম জল আনতে চলে গেল।
কাকাবাবু সন্তুর ভিজে সোয়েটার আর জামাটা খুলে ফেললেন। তারপর দুখানা কম্বল চাপা দিলেন ওর গায়ে। অজ্ঞান অবস্থাতেও সন্তুর শরীরটা শীতে কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
কাকাবাবু সন্তুর মাথার চুলে আঙুল দিয়ে খুঁজতে লাগলেন, কোনও গভীর ক্ষত আছে কি না। সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। মুখের কাটা জায়গা থেকে এখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে।
বেয়ারা চটপট গরম জল আনতেই তিনি তাতে তোয়ালে ভিজিয়ে সন্তুর সারা গা ঘষে দিতে লাগলেন। গরম জলের ছোঁয়ায় সন্তু উ-উ শব্দ করতে লাগল।
অম্বর ছেলেটি সত্যিই খুব করিৎকর্মা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে একজন ডাক্তারকে প্রায় ধরেই নিয়ে এল।
ডাক্তারটি সন্তুর মাথার কাছে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো?
কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, পা পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে গেছে।
তিনি অম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন, এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলার দরকার নেই।
বিচারকও ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আর কিছু বললেন না।
ডাক্তার সন্তুকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কাকাবাবু পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। একবার ডাক্তারের হাত কাকাবাবুর গায়ে লেগে গেল। তিনি চমকে উঠে বললেন, সাঙ্ঘাতিক গরম! আপনারও তো খুব জ্বর হয়েছে দেখছি!
কাকাবাবু অস্থিরভাবে বললেন, আমাকে নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। আপনি ওকে ভাল করে দেখুন!
কাকাবাবু সন্তুর সোয়েটার আর জামা-গেঞ্জি খুলে ফেলেছিলেন, প্যান্টটা খোলেননি। ডাক্তারবাবু প্যান্টটাও টেনে খুলে ফেলার পর দেখা গেল সন্তুর বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরটা একটা টেনিস বলের মতো ফুলে আছে।
কাকাবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, এ কী!
ডাক্তার বললেন, এই হাঁটুতেই তো সবচেয়ে বড় ইনজুরি দেখছি! আর কোথাও তেমন কিছু নেই। মাথাতেও আঘাত লাগেনি, বমিটমি করেনি!
তিনি সন্তুর সেই হাঁটুতে একটু টিপে দেখতে যেতেই সন্তু ছটফটিয়ে উঠল।
ডাক্তার এবার তাঁর ব্যাগ খুলে ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ বের করলেন। সন্তুকে একটা ইঞ্জেকশান দেওয়ার পর তিনি বললেন, এখন ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই। ভাল। ও আসলে যন্ত্রণার চোটে অজ্ঞান হয়ে আছে। জ্ঞান ফিরে এলে আরও কষ্ট পাবে। আমার মনে হচ্ছে, ওর হাঁটুর মালাইচাকি গুঁড়িয়ে গেছে!
কাকাবাবু বিবর্ণ মুখে ফিসফিসিয়ে বললেন, মালাইচাকি গুঁড়িয়ে গেছে?
ডাক্তার বললেন, এক্ষুনি এক্স-রে করা দরকার। এখানে একটাই মেশিন ছিল, তাও খারাপ হয়ে গেছে। ওর পা-টা সারাজীবনের মতন জখম হয়ে গেল। বোধ হয় ওর হাঁটুর কাছ থেকে কেটে বাদ দিতে হবে। এখানে ওর ঠিকমতন চিকিৎসা করানো যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে শিলচর কিংবা কলকাতায় নিয়ে যাওয়া উচিত।
কাকাবাবু পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, আমি এক্ষুনি ওকে শিলচর নিয়ে যাব! ট্রেন কটায়? গাড়ি! একটা গাড়ি চাই!
অম্বর আর বিচারক কাকাবাবুকে জোর করে টেনে সন্তুর বিছানার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
বিচারক বললেন, শান্ত হোন! মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এমনভাবে ভেঙে পড়লে আরও মুশকিল হবে।
কাকাবাবুর দু চোখ জলে ভরে গেল। তিনি অসহায়ভাবে বললেন, সন্তু! সন্তু খোঁড়া হয়ে যাবে? আমার মতন? আমি এক্ষুনি ওকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই। একটা গাড়ি, যত টাকা লাগে লাগুক, একটা গাড়ি…
বিচারক বললেন, আমি আজই শিলচর ফিরছি। আমার জন্য একটা গাড়ি আসছে এক ঘন্টার মধ্যে। সেই গাড়িতেই আমরা চলে যাব।
কাকাবাবু বললেন, এক ঘন্টা? আমি অতক্ষণ অপেক্ষা করতে চাই না। ট্রেন যাবে না এখন?
অম্বর বলল, সার, জজসাহেব ভাল কথাই বলেছেন। অন্য একটা গাড়ি ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দুপুরের আগে ট্রেন নেই। ট্রেনে ছ-সাত ঘন্টা সময় তো লাগবেই। গাড়িতে শিলচর পৌঁছনো যায় চার ঘন্টায়। জজসাহেবের গাড়িতে গেলেই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবেন।
সেটাই ঠিক হল শেষ পর্যন্ত। রাস্তায় সন্তুকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য দু-একটা ওষুধ দিয়ে ডাক্তারবাবু বিদায় নিলেন। অম্বর চটপট গুছিয়ে দিল সব জিনিসপত্র।
বেয়ারা ব্রেকফাস্ট আনলেও কাকাবাবু কোনও খাবার খেলেন না। শুধু গরম কফি খেলেন দু কাপ। প্রচণ্ড জ্বরে তাঁর শরীর ঝাঁ ঝাঁ করছে।
গাড়ির প্রতীক্ষায় তাঁরা বসে রইলেন বারান্দায়।
বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, কিছু মনে করবেন না, সব ব্যাপারটা জানতে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে। আপনার মুখ আর হাত বাঁধা ছিল। তার মানে, আপনাকে কেউ খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে?
কাকাবাবু মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লেন।
বিচারক আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভাইপোটিকেও ফেলে দিয়েছিল?
অম্বর বলল, নিশ্চয়ই তাই। সন্তুকেও কাছেই অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে।
বিচারক বললেন, আপনার মতন একজন ভদ্রলোক, এখানে পাখি দেখতে এসেছেন, কারও সঙ্গে ঝগড়া হয়নি, তবু হঠাৎ আপনাকে মেরে ফেলতে চাইবে কেন? আগে থেকে কি এখানকার কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল?
কাকাবাবু এবার দুদিকে মাথা নাড়লেন।
অম্বর আবার বলল, ইনি হচ্ছেন রাজা রায়চৌধুরী। বহু রহস্যের সমাধান করেছেন। কত আন্তজাতিক ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছেন। এঁর শত্রু থাকবে না? আপনি যেমন কাল বললেন, জজ হিসেবে আপনি অনেক চোর-ডাকাতকে শাস্তি দিয়েছেন, সেইজন্য আপনার ওপর অনেকের রাগ আছে। ইনি তো চোর-ডাকাতদের চেয়েও বড়-বড় রাঘববোয়ালদের শাস্তি দিয়েছেন। এঁর ওপর অনেকেই প্রতিহিংসা নিতে চাইবে।
বিচারক বললেন, এঁর সেই পরিচয়টা আমার জানা ছিল না। তবে তো খুব সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। কুমার সিং, ভুবন দাসও কি সেই দলের? ভোরবেলা একজন পুলিশ এসে বলে গেল, কুমার সিং জানিয়েছে যে, আপনাদের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ওরা অনেক খোঁজাখুজি করেও আপনাকে পায়নি। গুয়াহাটিতে খুব জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় ওরা হঠাৎ চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেইজন্যই পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়ে গেল।
অম্বর বলল, ওরাই তো ঠেলে ফেলে দিয়েছে। রাত্তিরবেলা নেমন্তন্ন খাওয়াবার নাম করে নিয়ে গেল।
বিচারক বললেন, ওদের দুজনকে কি আপনি আগে চিনতেন মিঃ রায়চৌধুরী? আপনি যে এখানে আসবেন, তা কি ওরা আগে থেকে জানত?
কাকাবাবু এবার আস্তে-আস্তে বললেন, না, ওদের আমি চিনি না। তবে ওরা জানত যে আমি আসছি। ওরাই আমাকে নেমন্তন্ন করে এনেছে। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, এই সময় আমার আসামের এই জায়গায় আসবার কথাই ছিল না। আমি গোপালপুরে ছুটি কাটাতে যাব ঠিক ছিল। অনেকদিন সমুদ্রের ধারে থাকিনি। গোপালপুর-অন-সি-তে আমাদের দুজনের জন্য হোটেলও বুক করা হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন আগে কলকাতায় একটা পার্কে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি আমাকে জাটিংগার পাখিদের কথা বললেন।
বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, সেই ভদ্রলোক কি ভুবন দাস কিংবা কুমার সিং?
কাকাবাবু বললেন, না। অন্য একজন মাঝবয়েসী লোক। আমি রোজ ভোরে পার্কে বেড়াতে যাই। একটা বেঞ্চে বসি। এক ভদ্রলোক সেই বেঞ্চে আমার পাশে বসলেন। তাঁর হাতে একটা পত্রিকা। সেই পত্রিকায় জাটিংগার পাখিদের ছবিটবি দিয়ে একটা লেখা ছিল। ভদ্রলোক নিজে থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ করে সেই পত্রিকাটি দেখিয়ে বললেন, আপনি জাটিংগার এই আকাশ থেকে পাখি পড়ার রহস্য সম্পর্কে কিছু জানেন?
আমি বলেছিলাম, ও সম্পর্কে শুনেছি বটে, কিন্তু বিশেষ কিছু জানি না। সে
ইদিন ওই পর্যন্তই কথা হল। পরদিন সকালে সেই ভদ্রলোক আবার এলেন, ওই পাখির কথা তুলে বললেন, আপনি তো কত রহস্য ভেদ করেন, একবার এই পাখির রহস্য ভেদ করে আসুন না!
আমি বললাম, গুণ্ডা বদমাশের চেয়ে পাখিদের রহস্য দেখতেই আমার ভাল লাগবে ঠিকই। পরে একসময় দেখতে যাব। এবার আমি গোপালপুরে যাচ্ছি।
তিনি বললেন, গোপালপুর তো যে-কোনও বছরই যেতে পারেন। জাটিংগার পাখি কবে শেষ হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। এবারেই দেখে আসুন না! হাফলঙে আমার এক আত্মীয় কাঠের ব্যবসা করে। সে আপনার থাকার জায়গা, ঘোরাঘুরির সব ব্যবস্থা করে দেবে। কোনও অসুবিধে হবে না।
আমি তখন বললাম, ঠিক আছে, গোপালপুর থেকে ঘুরে আসি, তারপর যাব।
তিনি বললেন, কালকেই আমাদের একটা গাড়ি কলকাতা থেকে সোজা হাফলঙ যাচ্ছে। একজন মাত্র যাত্রী থাকবে। আপনি স্বচ্ছন্দে যেতে পারেন। এতখানি পাহাড়ি রাস্তা বেড়াতে-বেড়াতে যাবেন, দেখবেন খুব ভাল লাগবে। গাড়িতে আসা হবে শুনে আমার লোভ হল। আসামের এদিকে আগে আসিনি। সন্তুও নেচে উঠল, তাই গোপালপুরের বদলে আমরা এখানে চলে এলাম।
অম্বর বলল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনাকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে টেনে এনেছে।
কাকাবাবু বললেন, কুমার সিংরা প্রথম থেকেই তো আমাদের খুব খাতির করছিল। জায়গাটাও খুব সুন্দর।
বিচারক বললেন, তা হলে কলকাতার পার্কের ওই লোকটারই রাগ আপনার ওপর। কোনও কারণে সে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। সেইজন্যই আমি অচেনা লোকের সঙ্গে বেশি কথা বলি না।
কাকাবাবু বললেন, সেই লোকটিকেও আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয়নি।
বিচারক বললেন, একেই বলে নিয়তি! আপনি যদি এখানে না এসে গোপালপুর যেতেন, তা হলে এসব দুভোগ কিছুই হত না। আপনার ভাইপোর পা-টাও নষ্ট হত না! তবু ভাগ্যিস প্রাণে বেঁচে গেছেন? গোপালপুর-অন-সি জায়গাটা খুব ভাল, তাই না? আমি কখনও যাইনি।
কাকাবাবু আর কোনও কথা বললেন না। গুম হয়ে বসে রইলেন।
একটু পরেই গাড়িটা এসে গেল। সন্তুকে এনে শুইয়ে দেওয়া হল পেছনের সিটে। কাকাবাবু তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসলেন। ইঞ্জেকশানের প্রভাবে সন্তু এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছ, তার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই।
অম্বর বলল, সার, আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে? যদি কোনও কাজে লাগতে পারি?
কাকাবাবু তার হাতটা ধরে বললেন, না, তার আর দরকার নেই। উত্তেজনার মাথায় তোমাকে অনেক বকাবকি করেছি। কিন্তু তুমি আমাদের খুব উপকার করেছ। তোমার আছে কৃতজ্ঞ।
অম্বর বলল, ওসব কী বলছেন, সার। এমন কিছুই করিনি। চিন্তা করবেন।, সন্তু ভাল হয়ে উঠবে। আবার দেখা হবে।
কাকাবাবু বললেন, আশা করি আবার দেখা হবে।
গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে নামতে লাগল। বেশ কিছুটা নেমে আসার পর দেখা গেল কার্ল জরগেন নামে জার্মান ছেলেটি কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে-হেঁটে আসছে। সে হাত তুলে গাড়িটা থামাল।
কাকাবাবু জানলা দিয়ে বললেন, তুমি লিফ্ট চাও? তোমাকে কোথাও নামিয়ে দিতে হবে?
ছেলেটি হেসে বলল, না, আমি হেঁটে-হেঁটে ঘুরতেই ভালবাসি। পাখি খুঁজতে বেরিয়েছি। কিন্তু আপনি কি ফিরে যাচ্ছেন নাকি? আজ সন্ধেবেলা আসবেন না?
কাকাবাবু বললেন, একটা খুব জরুরি কারণে আজ চলে যেতে হচ্ছে। সন্ধেবেলা আসব না। তবে, এখানে পরে আবার কখনও ফিরে আসব।
দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চিত ফিরে আসব। কুমার সিং আর ভুবন দাস এখন পালিয়েছে বটে। কিন্তু যেখানেই লুকিয়ে থাক, আমার হাত থেকে ওরা কিছুতেই নিষ্কৃতি পাবে না। ওদের শাস্তি দিতেই হবে।