কোচবিহার শহরে প্লেনেও যাওয়া যায়
কোচবিহার শহরে প্লেনেও যাওয়া যায়। আগেকার আমলের ড্রর্নিয়ের প্লেন, এতই ছোট যে, সতেরো-আঠারো জনের বেশি যাত্রী আঁটে না। প্লেনটার কোথাও ফুটোফাটা আছে কি না কে জানে, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে সন্তুকে একেবারে শীতে কাঁপিয়ে দিল। কাকাবাবুর অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরে।
এক সময় হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো সন্তু, এই লাইন দুটো কোন কবিতায় আছে?
নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি,
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি…
সন্তু থতমত খেয়ে গেল। লাইন দুটো তার মুখস্থ, রবীন্দ্রনাথের লেখা তাও জানে, রচনা লেখার সময় এই লাইন দুটো কোটেশান হিসেবেও ব্যবহার করেছে। কিন্তু কোন কবিতার লাইন, তা তো মনে পড়ছে না!
কাকাবাবু বললেন, পারবি না? বাবু কহিলেন বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে। এটা কোন কবিতায় আছে?
সন্তু লজ্জা পেয়ে বলল, দুই বিঘা জমি।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এই বাংলা দেশকে নিয়ে কী কী কবিতা আছে বলতে পারিস?
সন্তু আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। কেউ জিজ্ঞেস করলে মনে পড়ে না। অথচ এরকম অনেক কবিতা পড়েছে সে।
হঠাৎ মুখ-চোখ উজ্জ্বল করে সে বলল, ধনধান্যপুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা। তাহার মাঝে আছে দেশ এক—সকল দেশের সেরা…
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ডি এল রায়ের এই গানটা আছে বটে, কিন্তু এর মধ্যে বাংলা কিংবা বাংলাদেশ নামটা কোথাও নেই। আমাদের ছেলেবেলায় আর-একটা গান খুব জনপ্রিয় ছিল, বঙ্গ আমার জননি আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ, কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন, কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ!
কাকাবাবু প্রায় জোরে-জোরে গাইতেই শুরু করে দিলেন গানটা। প্লেনের মধ্যে সবাই চুপচাপ মুখ বুজে বসে থাকে, কিংবা পাশের লোকের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। কেউ গান গায় না। অনেক যাত্রী ঘাড় তুলে এদিকে তাকাচ্ছে। সন্তুর অস্বস্তি বোধ হল। কিন্তু কাকাবাবুর কোনও ভুক্ষেপ নেই। খানিকটা গাইবার পর তিনি বললেন, প্লেন থেকে যতবার নিজের দেশটাকে দেখি, আমার কেমন যেন একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব আসে মনের মধ্যে। এমন সুন্দর আমাদের দেশ, অথচ মানুষ কত কষ্টে আছে, কত দারিদ্র।
ককপিটের দরজা খুলে মাথায় টুপি-পরা সুন্দর চেহারার একজন লোক এই দিকে এগিয়ে এল। কাকাবাবুর দিকে দৃষ্টি। সন্তু ভাবল, এই রে, লোকটি নিশ্চয়ই কাকাবাবুর গান গাইবার জন্য আপত্তি জানাতে আসছে!
লোকটি ওদের কাছেই এসে থামল। তারপর নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে খুঁজতে লাগল কী যেন।
কাকাবাবু নিজের ভাবে বিভোর হয়ে ছিলেন, চমকে গিয়ে বললেন, আরে? কে? ওহো, অরিন্দম, তুমি এই প্লেনের পাইলট বুঝি? থাক, থাক, পায়ে হাত দিতে হবে না।
অরিন্দম তবু কাকাবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল, অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
কাকাবাবু বললেন, এ প্লেন তো আর কোচবিহারের পরে যাবে না। কোচবিহারেই যাচ্ছি। তুমি ককপিট ছেড়ে উঠে এলে কী করে?
অরিন্দম বলল, কো-পাইলট আছে, ভয় পাবেন না। কোচবিহারে যাচ্ছেন, ওখানকার রাজা নেমন্তন্ন করেছেন বুঝি?
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, দেখছিস, আমি যে-সে লোক নই। সবাই ভাবে, রাজা-মহারাজারা আমাকে হরদম ডাক পাঠায়।
তারপর অরিন্দমের দিকে ফিরে বললেন, না হে, সেসব কিছু না। এমনই যাচ্ছি কোচবিহারে বেড়াতে। তা ছাড়া আমি যতদূর জানি, কোচবিহারের রাজা-রানিরা এখন সবাই থাকেন কলকাতায়। ওখানকার দারুণ সুন্দর রাজবাড়িটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অরিন্দম বলল, এই যে একেবারে সামনের সিটে যিনি বসে আছেন, তিনি এখানকার বড় রাজকুমার। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব?
কাকাবাবু বললেন, না, না, কোনও দরকার নেই। আমি নিরিবিলিতে দু-চারটে দিন এদিকে কাটিয়ে যেতে চাই।
অরিন্দম ফিরে গেল ককপিটে। তার একটু পরেই প্লেনটা নামতে লাগল
নীচের দিকে। বেশ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি স্পর্শ করল।
জিনিসপত্র ফেরত পেতে বেশি সময় লাগল না। অরিন্দম নিজে কাকাবাবুর সুটকেসটা বয়ে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, ইস, আগে জানলে আমি ছুটি নিয়ে আপনার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে পারতাম এখানে। আমাকে এই প্লেন নিয়েই ফিরে যেতে হবে একটু বাদে।
এয়ার স্ট্রিপের বাইরে একটা বাস আর দু-একখানা গাড়ি রয়েছে, আর একঝাঁক পুলিশ।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এত পুলিশ কেন?
অরিন্দম বলল, আজ একজন মন্ত্রীর ফেরার কথা আছে শুনেছি। মন্ত্রী থাকলে পুলিশ থাকবেই।
একটা জিপ গাড়ির বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ অফিসার। কপালের ওপর একটা হাত রেখে রোদ আড়াল করেছে। হাতখানা সরিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল, মিঃ রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু ঠিক চিনতে পারলেন না। লোকটির দিকে হাত তুলে নমস্কার করলেন।
লোকটি সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, আমায় চিনতে পারছ? সেই যে সেবারে তোমরা বজ্র লামার গুম্ফায় ঢুকে বিপদে পড়েছিলে? আমি তখন ছিলাম দার্জিলিং জেলার এস. পি.। সেই সময় দেখা হয়েছিল, মনে নেই? এখন কোচবিহারে বদলি হয়ে এসেছি।
সন্তু বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। আপনিই তো অনির্বাণ মণ্ডল।
অনির্বাণ মণ্ডল বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এসে পড়েছেন, খুব ভাল হয়েছে। এখানে পর-পর দুটো রহস্যময় খুন হয়েছে। খুনি ধরা পড়েনি, কাউকে সন্দেহও করা যাচ্ছে না। আপনার কাছ থেকে নিশ্চয়ই সাহায্য পাওয়া যাবে।
কাকাবাবু বললেন, না, না, ওসব খুনটুনের মধ্যে আমি নেই। রক্তারক্তির কথা শুনলেই আমার গা গুলোয়। আমি আর সন্তু এখানে বেড়াতে এসেছি। মিঃ মণ্ডল, আপনি সেবারে শেষদিকে আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন, সেজন্য ধন্যবাদ।
অনির্বাণ মণ্ডল বললেন, আমাকে মিঃ মণ্ডল আর আপনি বলছেন কেন? শুধু অনির্বাণ বলে ডাকবেন। আমি আপনার ভক্ত। কোচবিহারে বেড়াতে এসেছেন, উঠবেন কোথায়?
সার্কিট হাউসে।
আগে থেকে বুক করা আছে?
না, তা নেই। কেন, সেখানে জায়গা পাওয়া যাবে না?
অনেক আগে থেকে সব ঘর বুন্ড থাকে। আমার সঙ্গে চলুন, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেখানে না হয়, আমার বাংলোতে থাকবেন। তাতে আমি বেশি খুশি হব।
অরিন্দম বলল, তা হলে কাকাবাবু আর সন্তুকে আমি মিঃ মণ্ডলের হাতে সমর্পণ করলাম। আমি এবার চলি।
ওদের সুটকেস দুটি এস. পি. সাহেবের জিপে তোলা হল। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে একজন বডিগার্ড। সন্তু আর কাকাবাবু বসলেন। পেছনে। গাড়ি চলতে শুরু করার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, বর্জ লামার গুম্ফায় যে ফুটফুটে ছোট্ট ছেলেটি ছিল, ওখানে সবাই বলত তার বয়েস নাকি তিনশো বছর, সেই ছেলেটি এখন কেমন আছে?
অনির্বাণ বলল, সে ভালই আছে। তাকে একবার দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে শেষ যা খবর পেয়েছি, ওই ছেলেটির যে বিশেষ একটা শক্তি ছিল, মাঝে-মাঝে ওর শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ বইত, ওকে ছুঁলে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতন মনে হত, সে-শক্তিটা ওর নষ্ট হয়ে গেছে। আর ও কাউকে ছুঁয়ে দিলে কিছুই হয় না। ও এখন গুম্ফার পাঠশালায় পড়াশুনো করছে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে।
সন্তু বলল, সত্যিই কি কেউ তিনশো বছর বাঁচতে পারে?
অনির্বাণ বলল, বাইবেলে ম্যাথুসেলা নামে একজনের কথা আছে। সে কিছুতেই মরতে চায়নি, তিনশো বছর আয়ু চেয়েছিল?
কাকাবাবু বললেন, মহাভারতেও তো যযাতির কথা আছে। রাজা যযাতি চেয়েছিলেন অনন্ত যৌবন! খুব বেশিদিন বেঁচে থাকাটা মোটেই ভাল না। নতুন-নতুন যেসব ছেলেমেয়ে জন্মাবে, তাদের জন্য এই পৃথিবীতে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে না?
সার্কিট হাউসে পৌঁছে দেখা গেল সত্যিই কোনও ঘর খালি নেই। শুধু সবচেয়ে ভাল ঘরখানি কোনও মন্ত্রী-টন্ত্রি ধরনের ভি. আই. পি.র জন্য বন্ধ করা থাকে। অনির্বাণ মণ্ডলের আদেশে সেই ঘরখানাই খুলে দেওয়া হল। খাবারদাবারেরও সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
অনির্বাণ বলল, তা হলে আপনারা এখন বিশ্রাম নিন। এদিকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান আছে? তা হলে আমি গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, কাছাকাছি কোনও জঙ্গলে ঘুরে আসতে চাই। একটা গাড়ি পেলে তো ভালই হয়!
অনির্বাণ বলল, বিকেলেই গাড়ি পাঠাব। চিলাপাতা ফরেস্টের দিকে যদি যান, পথেই পড়বে পায়রাডাঙ্গা নামে একটা জায়গা। সেখানে পরশু রাতেই একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে একটা মস্ত বটগাছের ওপরের দিকের ডালে। লোকটি ওই গ্রামের এক দোকানদার। কোনও কারণে রাত্তিরবেলা একা বাইরে বেরিয়েছিল, গাছে উঠে কিন্তু আত্মহত্যা করেনি। সেরকম কোনও চিহ্ন নেই। কিছু একটা জিনিস দেখে সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছিল মনে হয়, তাই গাছে উঠে পড়েছিল। কী দেখে সে অত ভয় পেতে পারে? বাঘ বা হাতি বা সাপ যদি হয়, ওসব দেখতে এখানকার মানুষ অভ্যস্ত, গাছে উঠতে আর তেমন ভয় নেই। কিন্তু লোকটা সেখানে বসেও ভয়েই মরে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, আবার ওই কথা? খুন, জখম আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগে না। তোমাদের মতন পুলিশদেরই কাজ এইসব সমস্যার সমাধান করা।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, লোকটি ইউ এফ ও দেখে ভয় পায়নি তো?
অনির্বাণ মণ্ডল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার ভেতরে এসে একটা সোফায় বসে পড়ে বলল, ইউ এফ ও? ওহো, এবার বুঝেছি, সন্তু কাকাবাবুর হঠাৎ কেন কোচবিহারে আগমন! ইউ এফ ও রহস্য?
তারপর সে হা-হা করে জোরে হেসে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, এখানকার ইউ ওফ ওর খবর কাগজে ছাপা হয়েছে, রেডিয়োতেও বলেছে। এব্যাপারে তোমাদের পুলিশের বক্তব্য কি শুধু অট্টহাসি?
অনির্বাণ বলল, না কাকাবাবু, সত্যিকারের ইউ এফ ও দেখা গেলে তো আমিই ছবি তুলতাম। জানেনই তো, গ্রামের লোক একটা কিছু হুজুগ পেলেই মেতে ওঠে। তিলকে তাল করে। ওটা একটা আর্মির হেলিকপটার। আমি নিজে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বনবাজিতপুরের মতন একটা নগণ্য গ্রামে আর্মির হেলিকপটার প্রায়ই মাঝরাত্তিরে এসে চক্কর দেয় কেন?
অনির্বাণ বলল, ওই হেলিকপটার চালায় কর্নেল সমর চৌধুরী। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, বেশ মজার মানুষ। অনেক ব্যাপারে উৎসাহ আছে। টোবি দত্তর বাড়িতে নীল আলোটা কেন জ্বলে সেটা উনি দেখতে যান।
কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্তটাই বা কে? আর নীল আলোর ব্যাপারটার কথাও তো কিছু কাগজে লেখেনি!
অনির্বাণ বলল, আসল কথাটাই তো লেখেনি! টোবি দত্তকে নিয়েই যত কৌতূহলের সৃষ্টি। টোবি দত্তের অন্য একটা নাম আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সবাই টোবি দত্ত বলেই জানে। এই টোবি দত্তর বয়েস হবে পঞ্চাশ বাহান্ন, বেশ লম্বা আর শক্ত চেহারার মানুষ। এককালে এই টোবি দত্তের বাড়ি ছিল দিনহাটায়, সেখানকার ইস্কুলে পড়ত, সাধারণ গরিবের ছেলে, ক্লাস নাইনে পড়তে-পড়তে হঠাৎ সে একদিন উধাও হয়ে যায়। নিরুদ্দেশ। তারপর পঁয়তিরিশ বছর কেটে গেছে, কেউ তার কোনও খোঁজখবর পায়নি। হঠাৎ গত বছর সে ফিরে এসেছে এখানে। এর মধ্যে তার বাবা-মা মারা গেছেন, আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। টোবি দত্ত এখন দারুণ বড়লোক। বিদেশের কোনও জায়গা থেকে অনেক টাকা রোজগার করেছে।
সন্তু বলল, এন আর আই?
কাকাবাবু বললেন, আজকাল সব কিছুর সংক্ষেপে নাম দেওয়া চালু হয়ে গেছে। কোনটা যে কী, তা অনেক সময় বোঝা যায় না। এন আর আই মানে, যে-ভারতীয়কে বিশ্বাস করা যায় না, তাই না! নন রিলায়েল ইন্ডিয়ান।
অনির্বাণ হেসে বলল, এন আর আই মানে সবাই জানে নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান, যে-ভারতীয় বিদেশে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আপনার দেওয়া মানেটাই বোধ হয় ঠিক। টোবি দত্তর রকমসকম কিছুই বোঝা যায় না। পুলিশকেও সে নাজেহাল করে দিতে পারে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? সে কোনও, অপরাধ-টপরাধ করেছে নাকি?
অনির্বাণ বলল, না, সেরকম কিছু করেনি। টোবি দত্ত অনেক টাকা খরচ করে বনবাজিতপুর গ্রামে মস্ত বড় একটা বাড়ি বানিয়েছে। বাড়িটা প্রায় দুর্গের মতন। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না।
কাকাবাবু বললেন, লোকে ইচ্ছেমতন বাড়ি বানাবে, তাতে পুলিশের কী বলার আছে?
অনির্বাণ বলল, একটা অতি সাধারণ গ্রামে অত বড় একটা বাড়ি বানাবার কোনও মানে হয়? সে বাড়িতে সে একা থাকে। গ্রামের কোনও লোকের সঙ্গে সে মেশে না। কাউকে সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেয় না। এতে কৌতূহল তো হবেই। দিনহাটার সুনীল গোপ্পী নামে একজন লোক ওই টোবি দত্তের সঙ্গে ইস্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। সেই সুনীল গোপ্পী একদিন রাস্তায় টোবি দত্তকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কী রে টোবি, এতদিন কোথায় ছিলি? টোবি দত্ত তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলেছিল, কে আপনি? আপনাকে আমি মোটেই চিনি না। আমার ডাকনাম ধরে ডাকার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, এতে বোঝা যাচ্ছে লোকটির স্বভাব রুক্ষ ধরনের। তা হলেও তো পুলিশের মাথা গলাবার কোনও কারণ নেই।
অনির্বাণ বলল, সেটাও মেনে নিচ্ছি। আমি এমনই সাধারণ ভদ্রতার সঙ্গে ওর সঙ্গে একদিন কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমাকেও পাত্তা দেয়নি। তবু পুলিশের মাথা গলাবার একটা কারণ আছে। টোবি দত্তর বাড়িতে মাঝে-মাঝে রাত্তিরবেলা একটা অদ্ভুত নীল রঙের আলো জ্বলে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অদ্ভুত নীল আলো! ব্যাপারটা কী?
অনির্বাণ বলল, আলোটা জ্বলে ওপরের দিকে, আকাশের দিকে। দারুণ জোর আলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, একটা নীল আলোর শিখা মেঘ-টেঘ ফুঁড়ে একেবারে মহাশূন্যে চলে গেছে। এমন তীব্র আলো কী করে জ্বালে তা কে জানে!
কাকাবাবু খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে বললেন, হুঁ, কী করে জ্বালে এবং কেন জ্বালে। আকাশে আলো দেবার দায়িত্ব তাকে কে দিয়েছে?
অনির্বাণ বলল, ঠিক এই প্রশ্নগুলোও আমার মাথাতেও এসেছিল। সেইজন্য আমি দ্বিতীয়বার টোবি দত্তর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ওর বাড়িতে। দরজা খুলেই আমাকে কী বলল জানেন?
একটু থেমে, সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে অনির্বাণ আবার বলল, টোবি দত্ত আমাকে দেখেই বলল, গেট আউট!
সন্তু হেসে ফেলল।
কাকাবাবু বললেন, লোকটার সাহস আছে স্বীকার করতেই হবে। তুমি এই জেলার পুলিশের বড় কত্তা, তোমাকে গ্রাহ্যই করল না?
অনির্বাণ বলল, আমারও হাসি পেয়ে গিয়েছিল। আমার মুখের ওপর কেউ এরকম চোটপাট করে না। আমি বললাম, মশাই রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার কাছে এমনই দু-একটা ব্যাপার জানতে এসেছি। তাতে সে বলল, আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে আমি রাজি নই। তারপরেও আমি নরম করে বললাম, আপনার ছাদে একটা জোর আলো জ্বলে, ওই আলোটা একবার দেখে যেতে চাই। তাতে সে বলল, আমার ছাদে আমি যেমন ইচ্ছে আলো জ্বালাব, তাতে আপনার কী? যাকে-তাকে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেবই বা কেন? এই বলে সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল!
কাকাবাবু বললেন, লোকটি বেআইনি কিছু বলেনি। যে-কেউ ইচ্ছে করলেই বাড়ির ছাদে আলো জ্বালতে পারে। সে আলো নীল হবে না লাল হবে, টিমটিম করে জ্বলবে কিংবা কতখানি জোরালো হবে, তা নিয়ে কোনও আইন নেই।
অনিবার্ণ বলল, আমার সঙ্গে আরও দুজন পুলিশ অফিসার ছিল, তারা তো আমাকে এরকম অপমানিত হতে দেখে রাগে ফুঁসছিল। একজন তো রিভলভার বের করে প্রায় গুলি করতে যায় আর কী! আমি তাকে থামালাম। টোবি দত্ত লোকটা আইন জানে। সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া আমি তার বাড়ির মধ্যে ঢুকতে পারব না। সে কোনও বেআইনি কাজ না করলে সার্চ ওয়ারেন্ট বের করব কী করে?
কাকাবাবু বললেন, তোমরা মুখ চুন করে ফিরে এলে?
অনির্বাণ বলল, তা ছাড়া আর উপায় কী বলুন! টোবি দত্তর ওপর নজর রাখার জন্য আমি লোক লাগিয়েছি। তারপর একটা পার্টিতে আমার কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে কর্নেল সমর চৌধুরীর কৌতূহল জাগল। জানেনই তো, আমাদের এখানে কাছাকাছি আর্মির একটা বড় বেস আছে। সমর চৌধুরী চুপিচুপি হেলিকপটার নিয়ে টোবি দত্তর বাড়ির ওপর ঘুরপাক খেয়ে এসেছেন কয়েকবার। কিছুই দেখতে পাননি। হেলিকপটারটা কাছাকাছি এলেই আলোটা নিভে যায়। তারপর মিশমিশে অন্ধকার। দেখা যায় না কিছুই। গ্রামের লোক টোবি দত্তর বাড়ির আলোটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, কিন্তু রাত্তিরবেলা ওই হেলিকপটারটা দেখলেই ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করে!
কাকাবাবু বললেন, আর একখানা ইউ এফ ও ভেজাল বলে প্রমাণিত হল। ওরে সন্তু, আমাদের আর ইউ এফ ও দেখা হল না! তবে টোবি দত্তর বাড়ির নীল আলোটা একবার দেখা যেতে পারে, কী বলল!
অনির্বাণ বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব সেখানে।