১-২. হাসি পায় টুপুরের
এক-একসময়ে পার্থমেসোকে দেখে যা হাসি পায় টুপুরের! বিশেষত রোববারের সকালে। পার্থমেসোকে যেন ভূতে পায়! পাঁচ-পাঁচখানা বাংলা কাগজ ছড়িয়ে বসবে সোফায়। শব্দজব্দের পাতাগুলো খুলে। একবার এই কাগজের ছক মেলাচ্ছে, খানিক পরেই চলে যাচ্ছে আর-একটা কাগজে, সেটা শেষ না করেই আবার একটা কাগজ। ছক মেলাতে-মেলাতে কখনও আপন মনে গান গেয়ে উঠছে, কখনও অস্থির ভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কখনও বা সোফা ছেড়ে তড়াং লাফিয়ে উঠে পায়চারি করছে ঘরময়। পার্থমেসোর তখন পুরো বেভুল দশা। টুপুর তো ছার, ওই সময়ে মিতিনমাসি, বুমবুমকে দেখলেও চিনতে পারে না। সুখাদ্য ভরা প্লেট পর্যন্ত তখন চোখে পড়ে না মেসোর।
আজও প্রায় সেই হাল। ফ্রেঞ্চটোস্টের পাহাড় সামনে পড়ে, ছুঁয়েও দেখছে না। ঠকাঠক পেনসিল ঠুকছে কপালে, হঠাৎ-হঠাৎ ঘাড় ঝোঁকাচ্ছে কাগজে, পরক্ষণে ঠোঁট উলটে নাচাচ্ছে বুড়ো আঙুল। অর্থাৎ এই শব্দটাও লাগসই হল না।
কোনওমতে হাসি চেপে টুপুর বলল, কী গো মেসো, তোমার ব্রেন আজ ফেল মেরে গেল নাকি?
পার্থ যেন শুনতেই পেল না। চোখ পিটপিট করে বলল, শিশুরা কী টানতে ভালবাসে বল তো?
সদ্য কেনা প্রকাণ্ড স্মার্ট টিভিতে অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট দেখছিল বুমবুম। পুটুস করে বলে উঠল, হামা।
সেটা তো আমিও ভেবেছি। কিন্তু এক ধরনের ধর্মগুরু… দু’ অক্ষরের…
একটু দ্বিধা নিয়ে টুপুর বলল, মোল্লা? পাদ্রি?
মিতিন ইংরেজি কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। একটা ফ্রেঞ্চটোস্ট তুলে নিয়ে বলল, লামাও হতে পারে।
হ্যাঁ। লামাই হবে। আমার সঙ্গে আড়াআড়ি মিলবে, পার্থ ঘাড় দোলাল, কিন্তু রাত্রির এক বিশেষ রূপ… পাঁচঅক্ষর…
টুপুর অস্ফুটে বলল, নিশুতি রাত? কিংবা গভীর রাতে?
আসছে না।
থার্ড লেটারটা কি ‘স’? মিতিন জিজ্ঞেস করল, তা হলে নিঃসম্পাত হতে পারে।
হচ্ছে না। ফোর্থ লেটার সম্ভবত ‘ম’, পার্থ ভুরু কোঁচকাল, আসছে কিছু মাথায়?
উঁহু, দু’-চার সেকেন্ড চেষ্টা করে মিতিন হাল ছেড়ে দিল। কৌতূহলী সুরে বলল, তা প্রথম অক্ষরটা কী?
সেটাও তো ছাই আসছে না।… দু অক্ষরে পরিমাপ। কী-ই হতে পারে? মান? মিতি? কিন্তু ‘মা’ বা ‘মি’ দিয়ে কি কোনও বিশেষ ধরনের রাত হয় কি?
হুম। সত্যি বেশ কঠিন, মিতিন সায় দিল। খাবার চিবোতে- চিবোতে বলল, যাক গে, এবার কানটা একটু খাড়া করো। ঘরে তোমার মোবাইল বাজছে। যাও, ধরো।
অগত্যা পার্থকে উঠতেই হল। ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটায় মুখ বেজার। পেনসিল হাতে যাচ্ছে শোয়ার ঘরে।
টুপুর হাসতে-হাসতে বলল, শব্দ মেলানোর খেলায় কেন যে এত মজা পায় পার্থমেসো?
মানুষ জীবটা বড় আজব রে টুপুর। কে যে কীসে কেন আনন্দ পায়, তা কি ঠাহর করা সোজা কাজ? কোনও বিজ্ঞানী টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে রাতের পর রাত বসে থাকেন, তাতেই তার আনন্দ। কেউ হয়তো মাটির তলায় কী আছে তা খোঁজার নেশায় মজে থাকে দিনরাত। কেউ সমুদ্রের নীচে কী আছে তাই নিয়ে মশগুল, আবার কেউ বা হাজার-হাজার বছর আগের সভ্যতা খোঁজায় বিভোর। এত সব বৈচিত্র্য আছে বলেই না মানুষ দুনিয়ার সেরা প্রাণী। হাতি কিংবা গন্ডারের এত ধরনের শখ, খেয়াল নেই বলেই না বেচারারা এত শক্তিশালী হয়েও মানুষের হাতে লেজেগোবরে হচ্ছে। তারপর ধর, এই যে মানুষের জ্ঞানপিপাসা…
বাধ্য ছাত্রীর মতো মিতিনমাসির কথাগুলো শুনছিল টুপুর। এত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে ব্যাখ্যা করে মিতিনমাসি। সাধে কি টুপুর ছুটি পড়লেই মাসির বাড়ি ছুটে আসে। কত দুরূহ ব্যাপার যে জলের মতো বুঝিয়ে দেয় মাসি। এই যে সামার ভেকেশনে এবার সে ঢাকুরিয়া এসেছে, মাত্র তিনদিনেই কত কিছু যে জানা হয়ে গেল। সেই প্রাচীনকাল থেকে কত দেশের যে লোক এসেছে ভারতে, কীভাবে তারা এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে পুরোপুরি, এই ভারত থেকেই বা কোথায়-কোথায় মানুষ পাড়ি জমিয়েছিল, তারা এখন সেখানে কেমন আছে, সবই তো মাসির গল্প শুনে-শুনেই জানা হয়ে গেল টুপুরের। মাসির হাতে এখন তেমন কেসটেসও নেই, তাই সারাদিন মাসির সঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে, এটাও তো টুপুরের বাড়তি লাভ। এখন দিনকয়েকের জন্য কোথাও একটা বেড়ানো হয়ে গেলেই টুপুরের গরমের ছুটিটা সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়।
কথাও একটা চলছে বটে। ওড়িশায়। সিমলিপালের জঙ্গলে যাওয়ার। খোঁজখবর চালাচ্ছে পার্থমেসো, তবে প্রোগ্রামটা এখনও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারেনি। আজ মেসোকে আবার খোঁচাতে হবে। মেসোও বেড়াতে যথেষ্ট ভালবাসে, তবু বারবার ঠেলা না মারলে কাজ হবে না।
ভাবনার মাঝেই পার্থ ফিরেছে। কাঁচুমাচু মুখে মিতিনকে বলল, একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি, বুঝলে।
এ আর নতুন কী, মিতিন ঠোঁট টিপল, আমার কাছে কাউকে আসতে বলে বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছ, তাই তো?
হ্যাঁ…মানে…তুমি কী করে আন্দাজ করলে?
তোমার বলার ভঙ্গি দেখে, আরতি চা রেখে গিয়েছে। কাপ তুলে চুমুক দিল মিতিন। মুচকি হেসে বলল, চোর-ডাকাত, খুনি-বদমাশ চরিয়ে খাই মশাই, তোমার মতো একটা হাবাগোবা লোকের মনের কথা আঁচ করা কী এমন কঠিন?
পার্থ দুম করে চটে যাচ্ছিল, কী ভেবে থমকেছে। চোখ সরু করে বলল, তুমি কি আমাকে খেপাতে চাইছ?
যাক ঘট এখনও পুরো খালি হয়নি তা হলে! …তা কে আসছেন জানতে পারি?
আমার বউবাজার পাড়ারই একজন। মানে আমার প্রেসের কাছেই ভদ্রলোকের দোকান। আমার খুব একটা ঘনিষ্ঠ নন। প্রেসে ছাপাতে টাপাতে আসেন, সেই সূত্রেই চেনা, এই যা। তবে তোমার টিকটিকিগিরির যশোগাথা ওঁর কানেও পৌঁছেছে। আর তাই কী এক জটিল সমস্যা নিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। কাল রাত্তিরেই আসতে চাইছিলেন। বার্সেলোনার ফুটবল ম্যাচটা দেখব বলে আমিই নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম রোববার সকালে আসুন।
অ। তা কখন আসছেন?
এসে পড়েছেন, প্রায় গড়িয়াহাটা পেরিয়ে গিয়েছেন। বাড়ির ডিরেকশনটা আর-একবার জেনে নিলেন, বলেই পার্থ জলখাবারের প্লেটখানা টানল। দ্যাখ না-দ্যাখ ফ্রেঞ্চটোস্ট সাফ। হড়াসহড়াস চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। অন্য সময়ে মেসোর এই তাড়াহুড়ো দেখে হাসত টুপুর, এখন কেমন বুকটা ধুকপুক করছে। কেন আসছেন ভদ্রলোক? কোনও রহস্যটহস্য আছে নাকি? মিতিনমাসি কি নেবে কেসটা? যদি নেয়, তা হলে তো টুপুরের কপাল খুলে গেল! আরও-একবার মাসির শাগরেদি করার সুযোগ মিলবে, এ কি কম কথা?
হঠাৎ মিতিনমাসির গলা কানে এল টুপুরের, এখনই গোঁফে তা দিস না রে টুপুর। কাঁঠাল এখনও গাছে।
টুপুর তাড়াতাড়ি বলল, আরে ধুস। কাঁঠাল, না এঁচোড়, তাই কি এখনও জানি! এঁচোড় হলে তো গাছেই ঝুলে থাকবে। খসে পড়বে না। ঠিক কিনা?
উঁহু। কাঁঠালই মনে হচ্ছে, মিতিন পার্থর দিকে ফিরল, ভদ্রলোকের কীসের দোকান? সোনা-রুপোর?
না। বিয়ের কার্ড বানান।
পুরনো বিজনেস?
আদ্যিকালের। বোধহয় দু-তিন পুরুষ ধরে এই কারবার করছেন। দোকানের উপরতলায় বাড়ি। সেই বাড়ির বয়সও না হোক দেড়-দুশো বছর হবে। খসে-খসে পড়ছিল। রিসেন্টলি মেরামত হল, রংটং করাল।
নাম কী ভদ্রলোকের?
মনোজ। মনোজ বড়ুয়া। মাস তিন-চার আগে কাগজে মনোজবাবুর নামটা এসেছিল।
কেন?
কী সব প্রাচীন পুঁথিটুথি নাকি পাওয়া গিয়েছিল ওঁদের বাড়ি থেকে।
মিতিন কয়েক সেকেন্ড ভাবল। ঘাড় নেড়ে বলল, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সম্ভবত বৌদ্ধ কোনও ধর্মগ্রন্থ। ভদ্রলোকও নিশ্চয়ই বুদ্ধিস্ট?
সে আমি কী করে জানব? শুধু জানি, মনোজবাবুর দেশ পূর্ববঙ্গে। আই মিন, বাংলাদেশে৷
এবার থেকে এও জেনে রাখো বাঙালি বৌদ্ধদের পদবি সাধারণত বডুয়াই হয়।
তার মানে ফিল্মজগতের প্রবাদ পুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়াও বৌদ্ধ?
উনি তো বাঙালিই নন। অহমিয়া, মিতিন গুছিয়ে বসল, বড়ুয়া পদবিটার অনেক হিস্ট্রি আছে, বুঝলে। বড়ুয়া পদবির বাঙালি বৌদ্ধরা সকলেই প্রায় চট্টগ্রামের বাসিন্দা। তারা নাকি প্রায় পাঁচহাজার বছর ধরে ওখানে বাস করছে। শুনলে অবাক হবে, চট্টগ্রাম শব্দটা এসেছে চৈত্য গ্রাম থেকে। চৈত্য মানে জানো তো?
অতটা মুর্খ ভেবো না। চৈত্য শব্দটা এসেছে চিতা থেকে। অর্থাৎ কোনও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে পোড়ানোর পর তাঁর চিতাভষ্ম দিয়ে যে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়, তারই নাম চৈত্য।
কারেক্ট। অজস্র চৈত্য ছিল বলেই বড়ুয়াদের বাসস্থানের নাম চৈত্যগ্রাম। মুখে-মুখে সেটাই হয়ে গিয়েছে চট্টগ্রাম। ওখানকার বড়ুয়ারা ছিল মহাযানী বৌদ্ধ। আবার তারা হিন্দুদের অনেক আচার বিচারও মেনে চলত। পরে অবশ্য বার্মিজ আর সিংহলিদের সংস্পর্শে এসে তারা অনেকটাই গোঁড়া হয়ে যায়।
টুপুরের এসব কচকচানি ভাল লাগছিল না। অধৈর্য ভাবে বলল, কিন্তু ভদ্রলোক মাসির কাছে আসছেন কেন? পার্থমেসো, তিনি তোমায় কিছু বলেননি?
জানতেই চাইনি। আমার অত ফালতু কৌতূহল নেই। যাঁর কাছ থেকে দু’হাজার টাকা পেমেন্ট বের করতে চারবার তাগাদা মারতে হয়, আগ বাড়িয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে আমার ভারী দায় পড়েছে। তবে…
কী তবে?
মনোজবাবু কেন আসছেন তা আন্দাজ করতে তোর মাসির মতো টিকটিকি হওয়ার প্রয়োজন নেই। নির্ঘাত ওই পুঁথিটুথিগুলো খোয়া গিয়েছে। উনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন, তারা হয়তো পাত্তা দেয়নি, তাই তোর মাসির শরণাপন্ন হচ্ছেন।
একেবারেই ভুল অনুমান, মিতিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ক’দিন আগে যে পুঁথি নিয়ে কাগজে খবর বেরিয়েছে, সেটা চুরি গেলে অবশ্যই আর-একটা বড়সড় নিউজ হত। এবং পুলিশও চুরিটাকে হেলাফেলা করতে পারত না। সুতরাং রহস্যটা অন্য কিছু। আর তা যথেষ্ট গভীর।
ওই ভেবেই নাচো, পার্থ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, তবে একটা কথা বলে রাখছি। বিনে পয়সায় একদম খাটবে না। তাতে কিন্তু আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে।
টুপুর অবাক মুখে বলল, কেন?
বা রে, তোর মাসি মাগনায় কাজ উদ্ধার করে দিলে উনি তো ধরেই নেবেন, আমরা খুব মালদার। এবং আমাদের পয়সাকড়ি না দিলেও চলে। অতএব ভবিষ্যতে আমাকেও পেমেন্ট দিতে বহুত হয়রান করবেন।
পার্থমেশোর বিটকেল যুক্তিতে টুপুর হেসে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই কলিংবেলের ঝংকার। বুমবুম সাঁই ছুটে গিয়েছে দরজায়। পিছন পিছন পার্থ। পাল্লা খুলতেই দৃশ্যমান হয়েছেন মনোজ বড়ুয়া। বয়স বছর পঞ্চান্ন। বেঁটেখাটো। মাথাজোড়া টাক। গায়ের রং ফরসা। মুখটি মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মনোজ ভারী বিনয়ী ভঙ্গিতে নমস্কার করলেন মিতিনকে। পার্থর আহ্বানে পায়ে-পায়ে গিয়ে বসেছেন সোফায়।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন? না কফি? এই জ্যৈষ্ঠের গরমে এতটা পথ ড্রাইভ করে এলেন, ঠান্ডা শরবতও নিতে পারেন।
মনোজ যেন সামান্য চমকেছেন। হাতে গাড়ির চাবিটা ঝুলছিল, ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে রাখলেন পকেটে। সামান্য ইতস্তত করে বললেন, কিচ্ছু লাগবে না। প্লেন জল হলেই চলবে।
দিচ্ছি।…আপনি বোধহয় খুব ডিস্টার্বড আছেন, শান্ত হয়ে বসুন।
জল খেয়ে মনোজ একেবারে চুপচাপ। কথাই বলছেন না। ভদ্রলোককে সহজ করার জন্য মিতিনই শুরু করল আলাপচারিতা। সামনের সোফায় বসে বলল, আমাদের বাড়ি চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হয়নি?
জবাব দিলেন না মনোজ। শুধু ঘাড় নাড়লেন দু’দিকে।
আপনাদের আদি বাড়ি তো চট্টগ্রাম, তাই না?
প্রপার চট্টগ্রাম নয়। তবে তার কাছেই, এবার স্বর ফুটছে মনোজের, আমাদের দেশ রাঙামাটি।
একসময়ে যার নাম ছিল রক্তমৃত্তিকা?
হ্যাঁ।
আপনারা তো শুনলাম বউবাজারের পুরনো বাসিন্দা। রাঙামাটি থেকে সরাসরি চলে এসেছিলেন?
না। দশ-এগারো পুরুষ আগে আমরা ঢাকায় যাই। বিক্রমপুর। পরে সেখান থেকে কলকাতা।
ও…তা কলকাতায় এখন কে কে আছে আপনার?
আমার জেঠতুতো খুড়তুতো দাদা-ভাইরা, তাদের ফ্যামিলি, আমার স্ত্রী ছেলে…
যৌথ পরিবার নাকি আপনাদের?
ছিল। এখন যে যার মতো পৃথক।
একই বাড়িতে?
হ্যাঁ। আলাদা-আলাদা অংশে।
ও। তা শরিকে শরিকে সম্পর্ক কেমন? সদ্ভাব আছে?
মোটামুটি, বলে একটুক্ষণ থেমে রইলেন মনোজ। তারপর আচমকাই বদলে গিয়েছে তাঁর স্বর। কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, আমার দেবলের বড় বিপদ ম্যাডাম। আমি যে তাকে নিয়ে কী টেনশনে ভুগছি, আপনাকে বোঝাতে পারব না।
মিতিন ঝুঁকল সামান্য, কে দেবল?
আমার একমাত্র ছেলে। খেয়ালের ঝোঁকে বেরিয়ে এখন তার প্রাণসংশয় দশা। সে বেঁচে আছে, কী নেই, তাও বুঝতে পারছি না। আপনি অনুগ্রহ করে তার একটা খবর এনে দিন। ভগবান তথাগতর কৃপায় যদি সে এখনও জীবিত থাকে, দয়া করে তাকে রক্ষা করুন।
টুপুর স্তম্ভিত। পার্থ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। মিতিনের কপালে চওড়া ভাঁজ।
তিনজনের কেউই বুঝি কল্পনা করতে পারেনি, মনোজ বড়ুয়া এমন একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হবেন আজ।
.
০২.
মনোজ বড়ুয়ার কথাগুলো মোটেই বোধগম্য হচ্ছিল না টুপুরের। একে তো ঘটনার পরম্পরা থাকছে না, তার উপর ছেলে নিরুদ্দেশ, নাকি বাড়িতে বলে কয়েই গিয়েছে, তাও যেন স্পষ্ট হচ্ছে না। একবার বলছেন ছেলে কাশ্মীর থেকে ফোন করেছিল, পরক্ষণে বলছেন ফোনটা ছেলের নম্বর থেকে আসেনি, কেউ জোর করে দেবলকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিল। মাসি যে খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে, তারও জো নেই। মাঝে-মাঝেই গলা ছেড়ে যা হাউমাউ করে উঠছেন ভদ্রলোক। পার্থমেসো তো বিরক্ত হয়ে চলেই গেল পাশের ঘরে। টুপুরেরও কৌতূহল মাথায় উঠেছে, এখন এই ঘ্যানঘেনে ভদ্রলোক মানে-মানে বিদেয় হলেই সে যেন বাঁচে।
মিতিনেরও হিমশীতল রূপটা বদলে গেল আচমকা। রীতিমতো রূঢ় গলায় বলল, আমার এখন দরকারি কাজ আছে। আপনি এবার আসুন।
থতমত খাওয়া মুখে মনোজ বললেন, তা হলে আমার ছেলের ব্যাপারটা…
সরি, মিতিনের সাফ জবাব, বোগাস কেস আমি নিই না। ছেলে আপনার বহাল তবিয়তেই আছে, আপনি বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছেন।
কী বলছেন আপনি? মনোজের মুখ ফ্যাকাশে দেখাল, ছেলেকে বাঁচাতে বলার পিছনে একজন বাবার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
ধান্দাটা যে কী, সে আপনিই ভাল জানেন, বিচ্ছিরি কর্কশ স্বরে বলল মিতিন। টুপুর হাঁ। ঘরে আসা কোনও ভদ্রলোকের সঙ্গে মাসি এই সুরে কথা বলছে, এ যেন অকল্পনীয়। টুপুরকে আরও বিস্মিত করে মিতিন তেরিয়া ভাবে বলল, আপনার ছেলে যে সত্যিই নিপাত্তা, তার কোনও প্রমাণ আছে?
মনোজ এবার আমতা-আমতা করছেন, আসলে হয়েছে কী… পুলিশের কাছে তো যাইনি… ডায়েরিও লেখাইনি…
ধানাইপানাই ছাড়ুন। সাফ-সাফ বলুন, হ্যাঁ, কি না?
না।
সে কবে থেকে নিখোঁজ?
ধরুন বুধবার, একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন মনোজ। পরমুহূর্তে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, না-না, বুধবারেই তো দেবল ফোন করেছিল..
ফের উলটোসিধে বকছেন? মিতিন ধমক দিল, কোথা থেকে ফোন করেছিল ছেলে?
কাশ্মীরের শ্রীনগর। মানে তাই তো বলল দেবল।
সে কবে শ্রীনগর গিয়েছিল?
বোধহয় আগের দিন।… ওইদিনও হতে পারে।
আশ্চর্য, কবে ছেলে কাশ্মীর গিয়েছে তাও গুলিয়ে ফেলছেন?
সে আদৌ কোথাও যাচ্ছে কিনা, কিছুই তো বাড়িতে জানায়নি। আর পাঁচটা দিনের মতোই মঙ্গলবার সকালে চান-খাওয়া করে পিঠে ল্যাপটপ চাপিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর ফোন পেলাম তো ওই পরের দিন।
রোজ কোথায় যেত আপনার ছেলে? অফিসে?
না না। সারাটা দিন এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে পড়ে থাকত।
কেন? গবেষণা করত বুঝি?
ওই আর কী। খ্যাপামিও বলতে পারেন। অত ভাল রেজাল্ট করল এম এ পরীক্ষায়, কিন্তু চাকরিবাকরির লাইনে গেলই না। বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকাটাই ছিল ওর জীবন।
সে কী বিষয়ে রিসার্চ করছিল?
তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার বা ওই জাতীয় কিছু। আমি সঠিক বলতে পারব না।
হুম। তা মঙ্গলবারেও কি আপনার ছেলে এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে গিয়েছিল?
লাইব্রেরিয়ান বললেন, দুপুর বারোটা পর্যন্ত ওখানে ছিল দেবল। তবে অন্যদিনের মতো পড়াশুনো করছিল না, মাঝে-মাঝেই মোবাইল ফোনে কথা বলছিল, আর ল্যাপটপ খুলে কীসব কাজ করছিল। তারপর হঠাৎই ব্যাগ গুছিয়ে লাইব্রেরি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। রাতে খোঁজ নেই, পরের দিন সে শ্রীনগরে। তার পরের দিন থেকে আর কোনও সাড়াশব্দই নেই, মনোজের গলা আবার ধরা-ধরা, যে ছেলে বই ছাড়া দুনিয়ার কিচ্ছুটি জানে না, কলকাতা ছেড়ে নড়তেই চায় না, তার এমন বিচিত্র আচরণে নার্ভাস হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? চার-চারটে দিন চলে গেল, সে একটি বারের জন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করল না… আপনিই বলুন, এর পরেও কি বাবা-মা ভয় পাবে না?
আপনার ছেলে তো কচি খোকা নয় মনোজবাবু। হয়তো সে নিজের মনে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফোন করার কথা তার মাথাতেই নেই। সে যে বিপদে পড়েছে, এমন একটা উদ্ভট ধারণা আপনার হল কেন?
উদ্ভট নয় ম্যাডাম। বিশ্বাস করুন। দেবল শেষ ফোনটা ওর মোবাইল থেকে করেনি। সেটা এসেছিল একটা ল্যান্ডলাইন থেকে। ওর গলাটাও কেমন যেন শোনাচ্ছিল। উত্তেজিত। নার্ভাস। যা বলল, সেও তো কম মারাত্মক নয়।
কীরকম?
সে নাকি এক্ষুনি একটা বিপজ্জনক কাজে বেরোচ্ছে। সেই কাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা যতটা, প্রাণ হারানোর ঝুঁকিও নাকি ততটাই।
কেন? কোথায় যাচ্ছে সে?
স্পষ্ট কিছু জানাল না। শুধু বলল, কোন গুম্ফায় নাকি রত্নখনির সন্ধান মিলেছে। পিছনে ফেউ লাগার আগে সেখানে পৌঁছোতে হবে।
ফেউ? মানে? আরও কেউ সেই খনির খোঁজ পেয়েছে নাকি? রত্নখনি মানেটাই বা কী?
জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। তবে আমার মনে হয়…
মনোজ হঠাৎ চুপ করে গেলেন। ভাবছেন কী যেন। মিতিন চোখা স্বরে বলল, সম্প্রতি বাড়িতে একটা বৌদ্ধ পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল। তার সঙ্গে আপনার ছেলের হঠাৎ কাশ্মীর যাওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে কি?
মনোজ মাথা দোলালেন, আমিও তাই সন্দেহ করছি।
কেন?
কাগজে খবরটা প্রকাশ হোক, এটা দেবলের মোটেই ইচ্ছে ছিল না। আমার জেঠতুতো দাদার ছেলে অতি উৎসাহী হয়ে এক সাংবাদিক বন্ধুকে জানায়। তাতেই খবরটা চাউর হয়। খুব বিরক্ত হয়েছিল দেবল। তারপর থেকে পুঁথিগুলো সে নিজের জিম্মাতেই রাখত। এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতেও কখনও নিয়ে যায়নি। পাতাগুলোর ফোটো তুলে ওই ফোটোগুলো নিয়েই পড়াশোনা করছিল দেবল। ওই পুঁথি থেকেই হয়তো ও অজানা কিছু জানতে পেরেছিল। সেই টানেই হয়তো…
পুঁথিগুলো ঠিক কীরকম? তালপাতার? নাকি প্লেটের উপর লেখা?
কোনওটাই নয়। পুরনো কাগজের। ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছিল। একটা পাতলা কাঠের বাক্সে যত্ন করে রেখেছিল দেবল। বাক্সটা ধরুন দেড়ফুট বাই দেড়ফুট, মনোজ একটু থেমে থেকে বললেন, পরশু আবিষ্কার করলাম, কাঠের বাক্সখানা নেই। সম্ভবত দেবল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে।
সম্ভবত বলছেন কেন?
কারণ দেবল শেষ যেদিন ফোন করল, সেই রাত্রেই বাড়িতে একটা চোর এসেছিল। রেনপাইপ বেয়ে উঠে দেবলের চিলেকোঠার ঘরেই হানা দিয়েছিল চোর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে বাক্সটার সন্ধানেই এসেছিল। কিন্তু পায়নি।
কীভাবে বুঝলেন?
ওটা একদম সামনে থাকত যে। দেবলের মাথার বালিশের পাশে। ঘরে ঢুকলেই যে কারও চোখে পড়বে। ওই জিনিস খুঁজতে কেউ গোটা ঘর তছনছ করে? পায়নি বলেই বোধহয়… মনোজ ঢোক গিললেন, চোরের কথা ভেবেই তো আরও ভয় পাচ্ছি ম্যাডাম। বোধহয় এমন একটা কিছু আশঙ্কা করেই দেবল ফেউয়ের কথা বলছিল।
হতে পারে, মিতিন এবার নড়ে বসল, এখন মনে হচ্ছে আপনার আগমন নেহাত অযৌক্তিক নয়।
আপনি তা হলে দায়িত্ব নিচ্ছেন? মনোজের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, ছেলেটাকে বাঁচাবেন তো?
দাঁড়ান-দাঁড়ান। ব্যাপারটা আর একটু বুঝি, মিতিন আবার সহজ স্বরে কথা বলছে। মাসির হঠাৎ হঠাৎ বদলে ভেবলে যাওয়া টুপুরের মুখখানা একবার দেখে নিয়ে মিতিন বলল, ওই পুঁথি আপনি পেলেন কোত্থেকে?
বাড়িতেই তো ছিল। শোয়ার ঘরের মাথার একটা কুলুঙ্গিতে। আমরা অবশ্য একেবারেই জানতাম না। বহুকাল বাড়িটায় হাত পড়ে না, কড়িবরগার হাল খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে, তাই এবার আমার অংশে মিস্ত্রি লাগিয়েছিলাম। ওরাই কুলুঙ্গি থেকে একটা ছোট লোহার তোরঙ্গ বের করে। তার মধ্যেই কিছু পুরনো বইপত্রের সঙ্গে ছিল ওই পুঁথি। আমি ওর মূল্য বুঝতে পারিনি। দেবলই বলল ওটা নাকি অমূল্য সম্পদ। কোন এক সাহেবের লেখা।
কাগজে তো সে সব কথা ছিল না। শুধু লিখেছিল প্রাচীন এক মূল্যবান পুঁথি মিলেছে।
পাছে বেশি হইচই হয়, তাই দেবলই গোপন করেছিল।
আপনাদের বাড়িতে ওই পুঁথি এল কী করে?
সেই ধাঁধারও সমাধান করেছে দেবল। আমাদের বংশের ঠিকুজিকুলুজি ঘেঁটে ঘেঁটে ও দেখেছে, আটপুরুষ আগে আমাদের বড়ুয়া পরিবারেরই একজন বিক্রমপুর থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। নাম হেমকান্ত বড়ুয়া। তিনি বিয়ে-থা করেননি, বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল বিস্তর। সিকিম আর দার্জিলিংয়ের অজস্র গুম্ফাতেও যাতায়াত করেছেন বেশ কয়েকবার। সেই সময়েই নাকি ওই সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
এই সব তথ্য দেবল পেল কীভাবে?
ওই সাহেব আর হেমকান্ত নাকি এশিয়াটিক সোসাইটিতেই গবেষণা করতেন। তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে। সোসাইটির লাইব্রেরির পুরনো জার্নালেই নাকি এসবের উল্লেখ আছে। সাহেব নাকি এদেশেই মারা যান। তিব্বতে যাওয়ার পথে। দেবলের ধারণা, হেমকান্ত তখন পুঁথিটি রক্ষা করার জন্যে নিজের কাছে রেখেছিলেন। আমাদের এই কলকাতার বাড়িটি তৈরি হয় সিপাহি বিদ্রোহের আগের বছর। তখন থেকেই এবাড়িতে কোনও ভাবে রয়ে গিয়েছে পুঁথিটি। হেমকান্তর দৌলতে।
হুউউম, মিতিন মাথা দোলাল, এবার খানিকটা পরিষ্কার হল।… তা সাহেবের নামটা জানতে পারি?
বলেছিল দেবল। কী একটা খটোমটো নাম। মনে পড়ছে না। বটে।…
তা ওই পুঁথিটা কি আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। অন্তত তিন-চারবার।
কোন ভাষায় লেখা। সংস্কৃত? পালি? নাকি গ্রিক-ল্যাটিন?
দেখে আমার সংস্কৃত মনে হচ্ছিল। কিন্তু দেবল বলল, ওটা নাকি বাংলা। ওরকম সংস্কৃতের ছাঁদে বাংলা হরফ আমি আগে কখনও দেখিনি।
সাহেব বাংলায় লিখেছেন? আশ্চর্য তো! টুপুর প্রশ্ন করে ফেলল, কী লেখা ছিল?
প্ৰথম কয়েকপাতা ভগবান তথাগতর উদ্দেশে নিবেদিত শ্লোক। আমরা বৌদ্ধরা যাকে বলি সূত্র। তারপর হাতে আঁকা কয়েকটা ছবি। পাহাড় পর্বতের। মাঝে-মাঝে কিছু লাইন টানা। যেন কোনও দিকনির্দেশ। শেষে পাহাড়ের মাথায় অবলোকিতেশ্বর। তার নীচে কী সব হিজিবিজি কাটা আছে।
মিতিন শুনল নীরবে। মন্তব্য না করে হেলান দিয়েছে সোফায়। মিনিটখানেক পর হঠাৎই টানটান। গম্ভীর স্বরে বলল, আপনার কেসটা আমি নিলাম। তবে সফল যে হবই, এই গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
আপনি দায়িত্ব নিচ্ছেন, এটাই তো আমার সৌভাগ্য। এর পর বাকিটা আমার কপাল, মেঘ সরে এতক্ষণে একফালি হাসি ফুটেছে মনোজের মুখে। উৎসাহিত গলায় বললেন, আপনি তা হলে যাবেন কাশ্মীর?
যেতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পারলে কালই। একটুও সময় নষ্ট করা বোধহয় ঠিক হবে না।
টুপুর ফস করে বলে ফেলল, তা হলে তো মাসিকে প্লেনে যেতে হয়।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, যেভাবে ম্যাডামের সুবিধে। খরচখরচা নিয়ে ভাবতে হবে না, টুপুরকে চমকে দিয়ে পকেট থেকে দু’খানা হাজার টাকার বান্ডিল বের করলেন মনোজ, আপাতত এতেই চালিয়ে নিন। আমার জোয়ান ছেলেটাকে ভালয় ভালয় ফিরিয়ে আনতে পারলে পুরো পাঁচলাখই দেব ম্যাডাম।
মিতিন যেন একটুও অবাক হয়নি। নোটের তাড়ার দিকে তাকালই না। ঠান্ডা গলায় বলল, আমার যে আরও কয়েকটা প্রশ্ন আছে মনোজবাবু।
বলুন ম্যাডাম।
আপনি প্রথমেই পুলিশে না গিয়ে আমার কাছে এলেন কেন?
সত্যি বলবো? আমি চাই না ব্যাপারটা জানাজানি হোক। তা হলে হয়তো দেবলের বিপদ আরও বাড়তে পারে। তা ছাড়া পুলিশের উপর আমার তেমন আস্থা নেই। ওরা আমার আশঙ্কাকে আদৌ আমল দেবে কিনা তা নিয়েও আমার যথেষ্ট সংশয় আছে।
হুঁ।…আচ্ছা, শ্রীনগর থেকে আপনার ছেলে যে ফোন করেছিল, সেই নম্বরে আর যোগাযোগ করেছিলেন?
অনেকবার। শুধু রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ তুলছেই না।
নম্বরটা আমায় দিন। আর আপনার ছেলের মোবাইল নম্বরটাও।
মোবাইলটা তো সুইচড অফ হয়ে পড়ে।
তবু দিন। আপনার ছেলের ফোটোও চাই একটা।
এনেছি ম্যাডাম, বুকপকেট থেকে এবার একটা ছোট খাম বাড়িয়ে দিলেন মনোজ। বললেন, এটা রিসেন্ট ফোটো। গত মাসে বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তোলা।
খাম খুলে ফোটোটায় একবার চোখ বোলাল মিতিন। টুপুরও দেখছিল উঁকি মেরে। এক ঝকঝকে তরুণ, গালে দাড়ি, চোখে চশমা। ফোটোটা খামে চালান করে মিতিন সামান্য হালকা সুরে বলল, আমার উপর পুরো দায়টা চাপাচ্ছেন মনোজবাবু? আপনিও সঙ্গে চলুন।
উপায় নেই ম্যাডাম? ছেলের চিন্তায় তার মা প্রায় শয্যা নিয়েছেন। তাঁকে ফেলে নড়ি কী করে?
মিতিন আর কিছু বলল না। মনোজ গলা ঝাড়লেন, তা হলে এখন উঠি ম্যাডাম?
আসুন।
কদ্দুর কী এগোলেন টাইম টু-টাইম জানালে ভাল হয়। বুঝতেই তো পারছেন, কীরকম টেনশনে থাকব…
চেষ্টা করব। যদি জানানোর মতো কিছু ঘটে।
মনোজ বেরিয়ে যেতে না-যেতেই হুড়মুড়িয়ে পার্থর আবির্ভাব। বোঝাই যায় কান খাড়া করে এঘরের প্রতিটি বাক্য গিলছিল এতক্ষণ। নোটের গোছা হাতে তুলে ওজন দেখছে। খুশি-খুশি মুখে বলল, গোনার দরকার নেই। পুরো দু’লাখই আছে, কী বলো?
মনে তো হচ্ছে।
ভাগ্যিস লোকটাকে সত্যি-সত্যি ভাগিয়ে দাওনি!… তবে আমার কিন্তু বেশ অবাক লাগছে। চিপ্পুস পার্টি ঝটাকসে দু’লাখ ফেলে দিয়ে গেল… খুবই রহস্যজনক। বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করার জন্য…।
তোমার গবেষণা এখন থামাবে? চটপট গিয়ে নেটে বোসো। ফ্লাইটের টিকিটগুলো করো। যেন কালই বিকেল-বিকেল শ্রীনগর পৌঁছোতে পারি।
যথা আজ্ঞা শ্রীমতী টিকটিকি।
চল রে টুপুর, এক্ষুনি তোর মা’র সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।
বুমবুম ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে, কী মজা, কী মজা, আমরা পাহাড় দেখব!
ভাইয়ের উল্লাসধ্বনি শুনতে-শুনতে টুপুর শুকনো গলায় বলল, আজই আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দেবে বুঝি?
মিতিন মুচকি হেসে বলল, দূর বোকা। তোর গরমের জামাকাপড়গুলো আনাতে হবে না?
টুপুর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, আবার ধপ করে বসে পড়েছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে তড়াক-তড়াক। সে যে আনন্দে অজ্ঞান হয়ে যায়নি, এই ঢের। এই গরমে ভূস্বর্গ ভ্রমণ? ভাবা যায়!