Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হাতে মাত্র তিনটে দিন || Suchitra Bhattacharya

হাতে মাত্র তিনটে দিন || Suchitra Bhattacharya

০১-৩. পার্থমেসো ফিরল বাড়িতে

দরজা খুলেই টুপুরের দু’চোখ খুশিতে চকচক। পার্থমেসো ফিরল বাড়িতে, হাতে ইয়া এক প্লাস্টিকের ঝোলা। ভুরভুর সুগন্ধ বেরোচ্ছে ঝোলা থেকে। লোভনীয় খাবারের ঘ্রাণ।

টুপুর ভুরু নাচাল, কী এনেছ গো?

জানবি, জানবি। অত তাড়া কীসের? ডাইনিং টেবিলে ঝোলা নামিয়ে ধীরেসুস্থে জুতো ছাড়ল পার্থ। গ্রাম্ভারি গলায় বলল, আজ নর্থ ক্যালকাটা গিয়েছিলাম, বুঝলি। তোদের হাতিবাগানের কাছেই। আমার এক ক্লায়েন্ট সেই কবে সুভেনির ছাপিয়েছে, এখনও পয়সা দেওয়ার নামটি নেই। ফোন করলেই বলে, নেক্সট উইক। কাঁহাতক সহ্য হয়, দিয়েছি আজ তার অফিসে হানা। আমায় সশরীরে দেখে এমন ঘাবড়েছে…!

অমনি পেমেন্ট দিয়ে দিল, তাই তো?

অর্ধেকটা। তাই বা কম কী বল? আমি তো আজ ফুটো কড়িটিও আশা করিনি। পার্থ গাল ছড়িয়ে হাসল, টাকাটা পেয়ে এত আনন্দ হল, সোজা চলে গেলাম উত্তর কলকাতার বিখ্যাত অ্যালেনস কিচেনে। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা চিকেন চপ আর প্রন কবিরাজি কিনে ফেললাম।

ওয়াও! টুপুর প্রায় লাফিয়ে উঠল। প্যাকেটের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, এ তো এখনও গরমাগরম গো! সুদূর গ্রে স্ট্রিট থেকে উড়ে এলে নাকি?

ওড়াই বটে। মেট্রো ধরে সাঁ কালীঘাট, সেখান থেকে ট্যাক্সিতে সোজা ঢাকুরিয়া। পার্থ এদিক-ওদিক চোখ চালাল, তোর মাসি কোথায় রে?

বুমবুমকে পড়াচ্ছে।

ভেরি গুড। চটপট দুটো প্লেট নিয়ে আয় তো। তোর মাসি টের পাওয়ার আগে দু’জনে দু’খানা চপ সাবাড় করে দিই।

তা মিতিনমাসিকে ফাঁকি দেয় সাধ্য আছে পার্থমেসোর! গোয়েন্দা বলে কথা, ঠিক এসে গিয়েছে বিড়াল-পায়ে। টুপুর রান্নাঘর থেকে প্লেট আনার আগেই জারি হয়ে গেল নির্দেশ, আগে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর আহার।

অগত্যা পার্থ বেজার মুখে বাথরুমে এবং মিতিন যথারীতি পাকা গৃহিণীর ভূমিকায়। চপ-কাটলেটগুলো বের করে পরিপাটি সাজিয়ে ফেলল প্লেটে। টুপুরকে কফির জল চড়াতে বলে কুচকুচ পেঁয়াজ-শসা কাটছে। পারতপক্ষে দোকানের স্যালাড খায়না মিতিন, কাউকে খেতেও দেয় না। বেশিক্ষণ কেটে রাখা শসা-পেঁয়াজে নাকি জীবাণু টানে খুব।

পার্থ পোশাক-টোশাক বদলে ফিরল ডাইনিং টেবিলে। একখানা চিকেন চপ তুলে নিয়ে পেল্লাই কামড় বসাল। তারিয়ে-তারিয়ে চিবোচ্ছে। সঙ্গে কফিতে চুমুক। পুলকিত স্বরে বলল, আহা, বয়ে আনার পরিশ্রমটা সার্থক। বেড়ে বানিয়েছে কিন্তু।

কলকাতার এই সাবেকি দোকানগুলোর গুডউইল তো এমনি এমনি গজায়নি। মিতিনের টুকুস মন্তব্য, এদের মাল-মেটিরিয়ালও এক নম্বর, হাতের কেরামতিও লা-জবাব।

তবে রোজ-রোজ তো অদ্দূর থেকে আনা যায় না। পার্থ গলাখাঁকারি দিল, মাঝে-মাঝে তো ঘরেও বানাতে পারো।

খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আমি এখন চপ-কাটলেট ভাজব?

অসুবিধে কোথায়? বসেই তো আছ। টিকটিকিগিরির প্রতিভাটা নয় রান্নাঘরে লাগালে।

মিতিনের হাতে সত্যিই এখন কাজ নেই। তার জন্য কোনও ছটফটানি আছে বলেও মনে হচ্ছে না। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর চারদিন হল এ বাড়িতে এসেছে টুপুর। এর মধ্যে একটি বারও কম্পিউটার পর্যন্ত খুলতে দেখল না মাসিকে। ফোনাফুনি নেই, ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি নেই, বাইরে বেরোচ্ছে না, সারাদিন হয় গল্পের বইয়ে ডুবে আছে, নয়তো গান। চলছে অবিরাম রবীন্দ্রসংগীত কিংবা পুরনো আমলের হিন্দি গান। যে গানগুলো শুনলেই টুপুরের হাই ওঠে। রান্নাঘরেও মোটে ঢুকছে না মিতিনমাসি। আরতিদি যা রেঁধে দিয়ে যাচ্ছে তাই গিলে নিচ্ছে চুপচাপ। মাসিকে এত উদাসীন, এমন নিস্পৃহ জীবনে দেখেনি টুপুর।

তবু পার্থমেসোর খোঁচাটা টুপুরের ভাল লাগল না। বেকার মানুষকে কাজের খোঁটা দেওয়া কি উচিত? দেশে হঠাৎ চোর ডাকাত কমে গেলে মাসি কী করবে?

রিনরিনে গলায় টুপুর প্রতিবাদ জানাল, মিতিনমাসি মোটেই এখন বসে নেই মেসো। মগজটাকে কয়েক দিন রেস্ট দিচ্ছে শুধু।

দেখিস বাবা, বেশি বিশ্রামে মগজে না মরচে ধরে যায়।

কী আশ্চর্য, এহেন টিপ্পনীতেও মিতিন দিব্যি নির্বিকার। কাসুন্দি ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে কবিরাজি কাটলেট খাচ্ছে। হঠাৎ কী মনে পড়তে থামল। একটা প্লেটে আধখানা কবিরাজি নিয়ে বলল, দাঁড়া, এটা বুমবুমকে দিয়ে আসি। বেচারা দশমিকের অঙ্কে হাবুডুবু খাচ্ছে।

মিতিন ঘরে যাওয়ামাত্র পার্থর খিকখিক হাসি, দেখলি তো, তোর মাসি কেমন কায়দা করে কাটল?

কাটাকাটির কী আছে?

বুঝলি না? আজকাল আর কেউ ডাকছে না তো, তাই আঁতে লাগছে!

জেনেশুনে মাসিকে তা হলে হার্ট করছ কেন?

অ। তোরও গায়ে ফোঁসকা পড়ছে বুঝি? পার্থর স্বরে কৌতুক। এক চুমুকে কফি শেষ করে বলল, জব্বর একখানা চামচি হয়েছিস বটে মাসির। একজনকে ছ্যাঁকা দিলে অন্যজনের চামড়া জ্বলে।

টুপুর ফোঁস করে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই পার্থ ধাঁ। খবরের কাগজ মুখে সোফায় ধপাস। সুদোকু ছেড়ে ইদানীং আবার আগ্রহ বেড়েছে শব্দজব্দে, মন দিয়ে সমাধান করছে ধাঁধার।

ঠিক তখনই সেন্টারটেবিলে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনে সুরেলা ঝংকার।

পার্থর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটল। ভুরু কুঁচকে বলল, তোর মাসির কাণ্ডটা দ্যাখ। এখানে মোবাইল ফেলে…, যা, দিয়ে আয় তো।

মুঠোফোনখানা তুলে টুপুর খুদে মনিটরটা দেখল। নাম নেই, শুধু নাম্বার। অর্থাৎ অচেনা কেউ। মাসির ঘরের দিকে এগোতে এগোতেই ফোনটা কানে চেপেছে, হ্যালো?

আমি কী প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জির সঙ্গে কথা বলছি?

ঈষৎ জড়ানো গলা। যেন একটু কাঁপছেও। পরিষ্কার বাংলায় বললেও সামান্য অবাঙালি টান আছে উচ্চারণে।

টুপুর তাড়াতাড়ি বলল, না, আমি ওঁর বোনঝি। আপনি কে বলছেন?

আমার নাম শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালা। ম্যাডাম আমাকে চিনবেন না। ওঁর সঙ্গে আমার একটা জরুরি দরকার আছে। একবার কথা বলা যাবে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।

দৌড়ে গিয়ে মিতিনকে ফোনটা দিল টুপুর। আবছা একটা রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, তাই নড়ল না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শুনছে। মিতিনমাসির সংলাপ থেকে অবশ্য কিছুই আন্দাজ করার জো নেই। হুঁ, হ্যাঁ, ও আচ্ছা, ঠিক আছে এই সবই আউড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। শেষে অবশ্য গুছিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের ডিরেকশনটা দিল। তারপর ফোন অফ করে পায়ে-পায়ে উঠে এল বাইরের ঘরে। নীরবে।

টুপুরও এসেছে পিছু-পিছু। কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গো ভদ্রলোকের? ওই শেঠ রুস্তমজি না কী যেন…!

ঠিক বোঝা গেল না। ভদ্রলোকের নাকি খুব বিপদ। এক্ষুনি একবার ওঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করছিলেন।

কোথায় থাকেন?

চৌরঙ্গিতে। হ্যানোভার কোর্টে।

তুমি যাবে এখন?

হুঁ। ভদ্রলোক গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দেখি গিয়ে, শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালা কী গাড্ডায় পড়লেন।

পার্থ কান খাড়া করে শুনছিল। চোখ গোল-গোল করে বলল, শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালা? সে তো খুব ধনী ব্যবসায়ী!

ইয়েস। ফেমাস কার্পেট মার্চেন্ট। গোটা ইন্ডিয়ায় ওঁদের শোরুম আছে।

জানি তো। ওদের ব্র্যান্ডনেম ফ্যান্টাসি।

টুপুর অবাক মুখে বলল, কার্পেট ব্যবসায়ীর এমন কী ঘটল যে, মিতিনমাসিকে এক্ষুনি দরকার?

অনেক কিছুই হতে পারে। পার্থ খবরের কাগজখানা ভাঁজ করে রাখল। বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, হয়তো সম্পত্তি নিয়ে বখেড়া। হয়তো জাল উইলটুইল বেরিয়েছে।

তার জন্য এমন অসময়ে…! গাড়িটাড়ি পাঠিয়ে…?

তা হলে নির্ঘাত মণিমাণিক্য কিছু খাওয়া গিয়েছে। রুস্তমজি নাম শুনেই তো বুঝছিস ভদ্রলোক পারসি? ওঁদের ধনদৌলতের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই রে। হয়তো পূর্বপুরুষের টেনিসবল সাইজের চুনি ছিল, কিংবা প্ল্যাটিনামের মুকুট…!

পারসিরা সবাই খুব বড়লোক হয় বুঝি?

দু’-চার পিস গরিব থাকতেও পারে, আমি দেখিনি। শিক্ষাদীক্ষাই বল, কি ব্যবসা-বাণিজ্য, সবেতেই ওরা ঢের এগিয়ে। গুণ আছে ওদের। এমনি-এমনি কি সেই পারস্যদেশ… এখন যাকে বলে ইরান… সেখান থেকে এসে এ দেশে জাঁকিয়ে বসতে পারে?

তা বটে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা তো চাট্টিখানি কাজ নয়।

ওরা ভারতকে আর বিদেশ বলে ভাবেই না। ইনফ্যাক্ট, এ দেশে পা রাখার পর থেকেই ওরা ইন্ডিয়ান হতে চেয়েছে এবং হয়েও গিয়েছে। বড় ইন্ডাষ্ট্রিয়ালিস্ট থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ল-ইয়ার, কবি, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, সব লাইনেই ওরা সফল। স্বাধীনতা সংগ্রামেও ওরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে। জাতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট তো পারসি, দাদাভাই নওরোজি। মাদাম কামা নামে এক পারসি মহিলা তো ইউরোপে পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকে বিপ্লবীদের অস্ত্র সাপ্লাই করতেন। দু-দুখানা কাগজ বের করতেন জেনেভায় বসে। বন্দে মাতরম আর তলোয়ার।

ইন্টারেস্টিং!

ইন্ডিয়ায় পারসিদের প্রথম আগমনের কাহিনিটা আরও ইন্টারেস্টিং। নিশ্চয়ই জানিস না

না মানে… ইতিহাস বইয়ে তো নেই…!

জি কে-টা আরও বাড়া। পার্থ সোফায় হেলান দিল। চোখ নাচিয়ে বলল, পারসিদের সম্পর্কে কতটুকু কী জানিস বল তো?

এই যেমন ধরো, ওদের ধর্মগুরুর নাম জরথুস্ত্র। ওরা আগুনকে পুজো করে।

একদম ভুল ধারণা। পারসিরা অগ্নির উপাসক নয়। তবে ওরা আগুনকে খুব পবিত্র বলে মানে। ওদের মন্দিরে আগুনকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখে। পার্থ সেন্টারটেবিলে পা তুলে দিল, যাক গে, ঠিকঠাক ইনফরমেশনগুলো ব্রেনে পুরে নে। অ্যারাউন্ড সাতশো খ্রিস্টাব্দে পারস্য আক্রমণ করেছিল আরবরা। তখন জরথুস্ত্রবাদী পারসিদের অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালায়। প্রথমে তারা আশ্রয় নিয়েছিল বর্তমান ইরানের খোরাসানে। পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে শ’খানেক বছর কাটিয়ে বাসা বাঁধে পারস্য উপসাগর উপকূলে। হরমুজ প্রদেশে। বছর পনেরো পর সাত-সাতখানা জাহাজে চড়ে তারা হাজির হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে। গুজরাতের পাশে। দিউতে। তখন ওখানে রাজা ছিলেন জদি রানা। পাক্কা উনিশটা বছর দিউয়ে প্রায় ঘাপটি মেরে ছিল পারসিরা। হঠাৎ একদিন ওদের ওপর নজর পড়ল রাজার। অমনি রাজসভায় ডাকলেন পারসি প্রধানকে। বললেন, আপনারা কি এ দেশে পাকাপাকি থাকতে চান? প্রধানের সঙ্গে এক পারসি পুরোহিতও এসেছিলেন সভায়। তাঁর নাম নের‍্যোসং। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, যদি আপনি অনুমতি দেন…। শুনে জদি রানা পাঁচ-পাঁচখানা শর্ত দিলেন পারসিদের।

কী শর্ত?

প্রথমত, তাদের ধর্মটা যে ঠিক কী, রাজাকে ভাল করে বোঝাতে হবে। দু’নম্বর শর্ত, নিজেদের ভাষা ছেড়ে এখানকার ভাষায় কথা বলতে হবে। তিন নম্বর, পারসি মেয়েরা যেন ভারতীয় পোশাক পরে। চার নম্বর, কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র রাখা চলবে না। আর পাঁচ নম্বরটা ভারী মজার। বিয়ের শোভাযাত্রা করতে হবে রাত্তিরে। মানে অন্ধকার নামার পর।

এমন আজব শর্ত কেন?

রাজারাজড়ার খেয়াল। যাই হোক, ওরা কিন্তু প্রতিটি শর্ত অক্ষরে-অক্ষরে মেনেছিল। ক্রমে-ক্রমে ওরা অ্যাইসান ভারতীয় বনে গেল… এখন মেয়েরা যেভাবে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরে, সে তো পারসি মহিলাদের নকল করে। আমাদের বেঙ্গলে প্রথম কে ওই স্টাইলে শাড়ি পরেছিল জানিস? জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। রবি ঠাকুরের মেজবউদি। প্রথম ভারতীয় আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের…!

তোমার জ্ঞানের ঝাঁপিটা এবার বন্ধ করবে? অনেকক্ষণ পর মিতিনের গলা বেজে উঠল। ঘুরে টুপুরকে বলল, তুই কি মেসোর গল্পই গিলবি? না আমার সঙ্গে বেরোবি?

এ যে মেঘ না চাইতেই জল! টুপুর তোতলা গলায় বলল, যে যে-যে-যেতেই পারি।

চটপট তা হলে তৈরি হয়ে নে। এক্ষুনি গাড়ি এসে যাবে। মিতিন শোওয়ার ঘরের দিকে এগোতে গিয়েও কী ভেবে ঘুরে দাঁড়াল। পার্থকে বলল, আমার ফিরতে সম্ভবত দেরি হবে।

সে আমি বুঝে গিয়েছি। বুমবুমকে খাইয়ে দিতে হবে, তাই তো?

চাইলে নিজেও ডিনার সেরে নিয়ো।

দেখা যাবেখন। পার্থ মিটিমিটি হাসল। চোখ টিপে বলল, যাক, শেষ পর্যন্ত তবে বেকার দশা ঘুচল, অ্যাঁ?

তো?

রোদ্দুর উঠেছে দেখলেই খড় শুকিয়ে নিয়ে কিন্তু।

মানে?

কেস যদি টেক-আপ করো, গোড়াতেই অ্যাডভান্স নেবে। রেটটা একটু চড়ার দিকে রেখো। যে জিনিস হারিয়েছে, অন্তত তার দামের ফাইভ পার্সেন্ট।

ভুল করছ। রুস্তমজির হিরে-জহরত কিছু খোয়া যায়নি।

কী করে শিয়োর হলে?

ভদ্রলোকের গলা শুনে। এমন নার্ভাস স্বর…! মিতিন মাথা দোলাল, উঁহু, মিস্টার জরিওয়ালার বিপদ অনেক-অনেক বেশি গভীর।

যেমন? কোনও আনন্যাচারাল ডেথ? খুনটুন গোছের কিছু?

তা হলে তো আগে পুলিশ ডাকত।

আর কী হতে পারে?

সহজ উত্তর একটা আছে। হয়তো আমার অনুমানটা ভুলও নয়।

কী বলো তো?

ভাবো। ভাবতেই থাকে। দেখো, মাথা চুলকে-চুলকে যেন টাক না পড়ে যায়।

.

০২.

নিঃশব্দে ছুটছিল গাড়িটা। ধবধবে সাদা বিদেশি মোটরকার। কলকাতার রাস্তায় এই মডেলের গাড়ি খুব বেশি চোখে পড়ে না। চেহারায় যেন গর্বিত রাজহাঁসের ভাব। গাড়ির সিটগুলোও কী নরম, আহা। মৃদু এ সি চলছে অন্দরে। যতটুকুতে বেশ আরাম হয়, ঠিক ততটুকুই। ড্যাশবোর্ডের দামি পারফিউম হালকা সৌরভ ছড়াচ্ছে। সবে রাত আটটা, কলকাতার রাস্তায় এখনও যথেষ্ট কোলাহল, কিন্তু কাঁচঘেরা শকটে বসে কিচ্ছুটি টের পাওয়ার জো নেই। গাড়ির চলনও ভারী মসৃণ। ঝাঁকুনি ছাড়াই দিব্যি পার হচ্ছে পথের খানাখন্দ।

টুপুরের একটা ছোট্ট শ্বাস পড়ল। ইস, মিতিনমাসি যে কবে একখানা এরকম গাড়ি কিনবে।

সুখ-সুখ আবেশের মধ্যেই গাড়ি পৌঁছোল এক প্রাচীন অট্টালিকায়। ড্রাইভারটি ভারী ফিটফাট। নিখুঁত কামানো গাল, সরু গোঁফ, পরনে আকাশ-নীল উর্দি, মাথায় টুপি। বয়স বছর বত্রিশ তেত্রিশ, চেহারাতে একটা চেকনাই আছে। আদবকায়দাও জানে। গাড়ি চালানোর সময় দু’বার মোবাইল বেজেছিল, ধরে হাউহাউ করে কথা বলেনি। দু’বারই নম্বর দেখে কেটে দিয়েছে লাইন। এখনও ইঞ্জিন বন্ধ করে ত্বরিত পায়ে নেমে এল সিট থেকে। মিতিন-টুপুরের দরজা খুলে দাঁড়াল। সসম্মানে বলল, সেকেন্ড ফ্লোরে চলে যান। লিট আছে। তিনতলায় ডান দিকে সাহেবের ফ্ল্যাট।

গাড়ি থেকে নেমে অভ্যেস মতোই এদিক-ওদিক চোখ চালাল টুপুর। দেখল, মূল ফটক থেকে তারা অনেকটা ভিতরে দাঁড়িয়ে। গেটের ওপারে রাজপথ, তার ওপারে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের চূড়া দেখা যাচ্ছে। ফটক আর অট্টালিকার মাঝে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। ছায়া-ছায়া অন্ধকার মাখা! আগে এখানে মূর্তিটুর্তি বসানো ফোয়ারা ছিল বোধ হয়, এখন নেহাতই ভগ্নস্তূপ টিকে আছে শুধু লোহার ঘেরাটোপখানা।

জবরদস্ত ইমারতে প্রবেশের মুখে চার ধাপ সিঁড়ি। মিতিনের সঙ্গে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে টুপুর বলল, বাড়িটা অন্তত এক দেড়শো বছরের পুরনো, কী বলো?

একশো আশি পেরিয়েছে। আঠেরোশো বাইশে তৈরি।

জানলে কী করে?

ফটকে লেখা আছে। সারাক্ষণ হাঁ করে থাকিস না, চোখ কানটাও খোলা রাখ।

সরি। আচ্ছা, বাড়িটার নাম হ্যানোভার কোর্ট কেন গো? ওই নামের কোনও সাহেবের বাড়ি ছিল কি এটা?

সম্ভবত না। ওই সময় রাজারাজড়াদের নামে বাড়ির নামকরণের একটা চল ছিল। আঠেরোশো বাইশে ইংল্যান্ডে রাজত্ব করত হ্যানোভার বংশ। বোধহয় সেই সুবাদেই…!

ও।

কথায়-কথায় মাসি-বোনঝি লিফটের দরজায়। কোলাপসিবল গেট লাগানো প্রাচীন আমলের ঢাউস লিফট। উঠলও ভারী ধীর লয়ে।

বেরিয়েই অদূরে রুস্তমজির নেমপ্লেট বসানো প্রকাণ্ড দরজা। ডোরবেল বাজানোমাত্র কপাট খুলে গিয়েছে। একজন বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশের সুদর্শন ভদ্রলোক খানিকটা যেন উদভ্রান্ত চোখে তাকাচ্ছেন এদিক-ওদিক। চওড়া করিডরখানা শুনশান দেখে বুঝি বা স্বস্তি পেলেন সামান্য। তাড়াহুড়োর স্বরে বললেন, আসুন। প্লিজ, কাম ইনসাইড।

মিতিনরা ঢোকামাত্র বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ভদ্রলোক হাতজোড় করে মিতিনকে বললেন, আমিই রুস্তমজি। আপনি নিশ্চয়ই…?

প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। মিতিন প্রতিনমস্কার জানাল। টুপুরকে দেখিয়ে বলল, মাই নিস। এবং সহকারীও বটে।

রুস্তমজি যেন শুনেও শুনলেন না। টানা লম্বা প্যাসেজ ধরে হাঁটছেন মিতিনদের নিয়ে। অতিকায় এক সুসজ্জিত ড্রয়িংহলে ঢুকে থামলেন। কারুকাজ করা ভারী সোফায় আসন গ্রহণ করতে বললেন মিতিনদের। নিজেও বসলেন মুখোমুখি। এক রাজকীয় ডিভানে। মিতিন কোনও প্রশ্ন করার আগেই বলে উঠলেন, আপনারা যখন এলেন… লিফটম্যান ছিল কি?

না তো।

আর কেউ?

উঁহু। শুধু আমরা দুজনেই তো…!

দ্যাটস গুড। দ্যাটস বেটার।

আপনার বিপদটা বোধহয় অনুমান করতে পারছি। মিতিন সোফায় হেলান দিল। তার চোখ সার্চলাইটের মতো ঘুরছে রুস্তমজির মুখমণ্ডলে। হঠাৎই জিজ্ঞেস করল, কে কিডন্যাপড হয়েছে? আপনার ছেলে? নাকি মেয়ে?

আমার একমাত্র ছেলে। রনি। আজই বিকেলে…। রুস্তমজি ঢোক গিললেন, আপনি বুঝে ফেলেছেন?

এ তো ভেরি সিম্পল গেস মিস্টার জরিওয়ালা। একমাত্র অপহরণের ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা ব্যাপারটাকে সাধ্যমতো গোপন রাখতে চায়।

হুম। রুস্তমজির মুখটা ভারী শুকনো দেখাল। ধরা-ধরা গলায় বললেন, বুঝছেনই তো, ছেলের লাইফ অ্যান্ড ডেথের প্রশ্ন।

পুলিশকেও জানাননি নিশ্চয়ই?

প্রশ্নই আসে না। ওরা যেভাবে আমায় শাসাল…!

অর্থাৎ অপহরণকারীদের ফোনকল আপনি পেয়েছেন?

না হলে জানব কী করে রনিকে আটকে রেখেছে। ওরা টাকা চায়। এক কোটি।

টুপুর প্রায় আঁতকে উঠল, এক কো..ও..ও..টি?

আগামী বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে টাকাটা দিতে হবে। তা হলেই আমি রনিকে ফেরত পাব। আমি ওদের চাহিদা মেটাতে রাজি হয়েছি।

মিতিন গম্ভীর স্বরে বলল, টাকা যখন দেবেনই স্থির করেছেন, আমাকে ডাকলেন কেন?

রুস্তমজি একটুক্ষণ চুপ। তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, দেখুন ম্যাডাম, ঈশ্বরের কৃপায় ব্যবসাসূত্রে আমি মোটামুটি অর্থবান। এক কোটি টাকা তেমন ছোট অঙ্ক নয় বটে, তবে আমার কাছে খুব বেশিও নয়। রনির প্রাণের বিনিময়ে ওই টাকা আমি ব্যয় করতে প্রস্তুত। কিন্তু…!

কিন্তু কী?

আমি একজন ধর্মপ্রাণ পারসি। যতটা সম্ভব মহান জরথুস্ত্রের অনুশাসন মেনে চলি। তিনি বলেছেন, শুভ-অশুভের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত শুভই জেতে। এবং অশুভকে সাজা পেতে হয়। অন্যায় যে করেছে তাকে শাস্তি পাওয়ানোটাই ধর্মপ্রাণ পারসির কর্তব্য। এতেই আমাদের ঈশ্বর অর্থাৎ আহুরমাজদা সন্তুষ্ট হন।

বুঝেছি। আপনি চান অপহরণকারীরা ধরা পড়ুক। তাই তো?

হ্যাঁ ম্যাডাম। টাকা যাক ক্ষতি নেই। আমি আমার রনিকেও চাই, আর অহরিমান অর্থাৎ শয়তানের সেই অনুচরদের শাস্তিও চাই। তেমন একটা শোরগোল না করে যাতে ওদের পাকড়াও করা যায় তার জন্যই আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমার স্ত্রী পইপই করে মানা করেছিল, তবুও…?

মিতিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। একবার দেখল টুপুরকে, আবার কী যেন ভাবল। মাথা নেড়ে বলল, ওকে! নো প্রবলেম। চ্যালেঞ্জটা আমি নিচ্ছি।

পারবেন তা হলে লোকগুলোকে ধরতে? কথা দিচ্ছেন?

দেখা যাক। চেষ্টা তো একটা করি। মিতিন সোজা হয়ে বসল, ঘটনাটা ঠিক কীভাবে, কোথায় ঘটেছে আগে খুলে বলুন। ..

আজ বিকেলে… রনির স্কুল ছুটির পর… আমি অবশ্য খবরটা পেলাম সন্ধে নাগাদ। রুস্তমজিকে ভারী বিচলিত দেখাল, মানে কোত্থেকে যে শুরু করি…!

ঘাবড়াবেন না। আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি, আপনি পরপর জবাব দিয়ে যান। মিতিন সামান্য ঝুঁকল। দেখাদেখি টুপুরও। মিতিন জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলের বয়স কত?।

আট। গত মাসে ওর এইটথ বার্থডে গিয়েছে।

কোন ক্লাসে পড়ে? কোন স্কুলে?

সেন্ট পিটার্স। এই তো সবে ফোরে উঠল।

যাতায়াত করে কীভাবে?

বাড়ির গাড়িতে। আপনি যে গাড়িতে এলেন, সেটাতেই…?

আপনার কি এই একটিই গাড়ি?

না। একটা হন্ডা সিটিও আছে। তবে রনি বি এম ডব্লিউটা পছন্দ করে বলে বিকেলেও অফিস থেকে ওটাই পাঠিয়ে দিই। রনিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গাড়ি আবার অফিসে চলে আসে।

আজও নিশ্চয়ই গিয়েছিল গাড়ি?

হ্যাঁ। অশোক তো বললেন আড়াইটেতেই…?

অশোক কে? আপনার ড্রাইভার?

না। আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি। অশোক মজুমদার। এইসব টুকিটাকি ব্যাপার অশোকবাবুই হ্যান্ডেল করেন। রোজই আড়াইটে নাগাদ গাড়িটা উনি রওনা করিয়ে দেন। আমার অফিস ক্যামাক স্ট্রিটে, রনির স্কুল মৌলালিতে। ছুটি হয় তিনটেয়। প্রাইমারি সেকশন তো, তাই এক ঘণ্টা আগে। রোজই মোটামুটি ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছে যায় গাড়ি। দু-চার মিনিট দেরি হলে রনি অপেক্ষা করে। ওদের স্কুলের নিয়মকানুন খুব কড়া। ড্রাইভার গিয়ে আইডেন্টিটি কার্ড না দেখালে দরোয়ান বাচ্চাকে ছাড়ে না। আজ ড্রাইভার গিয়ে শোনে, রনি আগেই চলে গিয়েছে।

কী করে স্কুল ছাড়ল? আই-ডি কার্ড ছাড়া?

সেখানেই তো জটটা পেকেছে। রনিকে না পেয়ে ড্রাইভার প্রায় পড়িমড়ি করে এসে লীলাকে, আই মিন রনির মাকে আগে রিপোর্ট করে। লীলাও হতবাক। সঙ্গে-সঙ্গে স্কুলে ফোন করেছে। এবং আশ্চর্য কাণ্ড, রনিদের প্রিন্সিপাল-ম্যাডাম খোঁজ নিয়ে জানান, দরোয়ান নাকি স্কুলের নিয়ম মাফিক আইডেন্টিটি কার্ড দেখেই রনিকে ছেড়েছে।

সে কী? আই-ডি কার্ড দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে?

স্কুলের তো তাই বক্তব্য।

হুম। তারপর?

তারপর আরকী, লীলার প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। আমায় বহুবার ফোন করেছিল। কিন্তু আমি তখন এমন ব্যস্ত…! সেল্স ম্যানেজারদের নিয়ে মিটিং চলছিল… মোবাইলটা সুইচড অফ রেখেছিলাম। আমাকে না পেয়ে শেষে লীলা নিজেই দৌড়েছিল স্কুলে।

ম্যাডাম তো অফিসের লাইনেও চেষ্টা করতে পারতেন!

লীলার বোধহয় তখন মাথায় আসেনি। এমন পাজলড হয়ে গিয়েছিল…! সত্যি বলতে কী, লীলার অতগুলো মিসড কল দেখে ফোন করে যখন ঘটনাটা শুনলাম, আমারই হাত-পা ছেড়ে যাওয়ার দশা। সঙ্গে সঙ্গে আমিও কাজকর্ম ফেলে বাড়ি ছুটেছি।

ম্যাডাম তখন বাড়িতে?

জাস্ট ফিরেছে। স্কুলে দরোয়ান ছাড়া কাউকে তো পায়নি। বড়দেরও তার অনেক আগেই ছুটি হয়ে গিয়েছে। এবং ওই একই কথা আউড়ে গিয়েছে দরোয়ান। আই-ডি কার্ড দেখেই নাকি সে…! রুস্তমজি বড় করে একটা শ্বাস টানলেন, রনিকে না পেয়ে লীলা প্রায় পাথর তখন। আমাকে দেখে এমন ডুকরে কেঁদে উঠল…! তাকে সামলাব, না পুলিশে খবর দেব ভেবে পাচ্ছি না…! ঠিক সেই সময়েই ফোনটা এল।

মোবাইলে?

না। ল্যান্ডলাইনে। নাম্বারটা কলার লিস্টে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে সাইডটেবিল থেকে হ্যান্ডসেটখানা তুললেন রুস্তমজি। বোতাম টিপে নাম্বারটা বের করে মিতিনকে বাড়িয়ে দিলেন।

চোখ কুঁচকে নাম্বারটা দেখল মিতিন। টুপুরকে বলল, নোট করে নে।

রুস্তমজি বললেন, ওই নাম্বার থেকে কি কিছু ট্রেস করা যাবে?

সম্ভাবনা কম। এটা পাবলিক বুথের নাম্বার। বলে মিতিন আবার ঝুঁকেছে, ফোনে এগজ্যাক্টলি কী বলল?

প্রথমে তো ফোনটা লীলা তুলেছিল। ওদিক থেকে হুমকি শুনেই লীলা কাঁপতে-কাঁপতে আমায় রিসিভার দিয়ে দিল। আমার গলা পেয়ে লোকটা ফের থ্রেটন করল, কাল সকাল আটটার মধ্যে পঞ্চাশ লাখ চাই। নইলে রনিকে আর ফেরত পাব না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রনি যে আপনার কাছেই আছে, প্রমাণ কী? লোকটা তখন রনির গলাও শুনিয়ে দিল। খুব কাঁদছিল ছেলেটা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল ম্যাডাম। তবু মরিয়া হয়ে বললাম, এই রাত্তিরেই নগদ পঞ্চাশ লাখ জোগাড় করব কোত্থেকে? আমার একটু সময় চাই।

রাজি হল?

লোকটা তখন আর-একজনের সঙ্গে বোধহয় আলোচনা করল। দুজনেরই গলা শুনতে পেয়েছি আমি। তারপর খানিকক্ষণ কোনও শব্দ নেই। সম্ভবত মাউথপিস চেপে রেখেছিল হাত দিয়ে। অ্যাট লাস্ট আমাকে জানাল, সে সেভেনটি টু আওয়ার্স টাইম দিতে পারে, তবে টাকা চাই পুরো ওয়ান ক্রোড়। আমি আর কোনও দরাদরি করিনি। কারণ, পঞ্চাশ লাখ টাকার চেয়ে আড়াই দিন সময় আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান। এতে হয়তো শয়তানদের ধরতে সুবিধে হবে আমাদের।

কিন্তু বিপদের ঝুঁকিও তো বেড়ে গেল। ছেলেটা আরও আড়াই দিন কিডন্যাপারদের খপ্পরে থাকবে।

দেখুন ম্যাডাম, আমি ব্যবসা করে খাই। একটু আধটু মানুষ চিনি। যারা ছেলের বাবার প্রেশারে বেশি সময় দিতে রাজি হয়, আর তার এগেনস্টে ডবল টাকা চায়, তারা নিজেদের স্বার্থেই আমার রনিকে ঠিকঠাক রাখবে।

হুঁ। মিতিন মাথা দোলাল। অল্প সময় নিয়ে বলল, একটা প্রশ্ন। আপনি অফিস থেকে কি হন্ডা সিটি ধরে ফিরেছেন আজ?

না। ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। ওই গাড়িটা তো বাড়িতে ছিল। বাড়িতেই থাকে। লীলার জন্য।

তারও ড্রাইভার আছে নিশ্চয়ই?

সে এখন ছুটিতে। গত সপ্তাহে দেশে গিয়েছে।

কোথায় দেশ?

বিহার। জাহানাবাদ।

বদলি ড্রাইভার নেই?

প্রয়োজন হয় না। দরকারে লীলা নিজেই ড্রাইভ করে।

আপনার বি এম ডব্লিউর ড্রাইভারটি নিশ্চয়ই বিশ্বস্ত?

তারক ভাল ছেলে। অশোক ওকে চমৎকার রিক্রুট করেছেন। রনিকে না দেখতে পেয়ে খুব ভেঙে পড়েছে তারক। রনির সঙ্গে খুব ভাব তো। ছেলেটা আজ ভয়ও পেয়েছে ভীষণ।

কেন?

ভাবছে, বোধহয় চাকরিটা গেল।

রনিকে নিয়ে আসার কার্ডটা কি তারকের কাছেই থাকে?

হ্যাঁ। আজ অবশ্য লীলাকে দিয়ে দিয়েছে।

মিতিন আবার একটা কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, থেমে গেল। হলের ও প্রান্তে দরজায় এক মহিলা। পরনে প্রিন্টেড সালোয়ার, খাটো কামিজ। পাতিয়ালা সুট। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। টকটকে ফরসা রং, সোনালি রং করা চুল, তীক্ষ্ণ নাক এবং বেশ দীর্ঘাঙ্গি। সুন্দর মুখখানা বিশ্রীরকম ফুলে আছে, বড়-বড় চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল।

রুস্তমজি আলাপ করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন মহিলার সঙ্গে, তার আগে টলমল পায়ে ছুটে এলেন মহিলা। মিতিনের পাশে ধপ করে বসে পড়লেন। কোনও প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়েই খপ করে চেপে ধরলেন মিতিনের হাতখানা। তার পরেই আচমকা আর্তনাদ, দোহাই আপনার, লোকগুলোকে ধরতে গিয়ে রনির যেন কোনও বিপদ না ঘটে। রুস্তমজি যাই বলুক, আমি শুধু আমার ছেলে ফেরত চাই।

মিতিন হাত রাখল লীলার পিঠে। অঝোরে কেঁদে চলেছেন লীলা। থামছেই না কান্না।

.

০৩.

দেওয়ালে বেশ কয়েকখানা ছবি। তেল রঙে আঁকা। কোনও অয়েল পেন্টিং-এ পাগড়িওয়ালা পুরু গোঁফ জাঁদরেল পুরুষ, কোনওটায় বা হ্যাট-কোট পরা এদেশি সাহেব। চোগা চাপকানধারীও আছেন একজন। তিনজন মহিলার ছবিও দৃশ্যমান। তাঁদের প্রত্যেকেরই পরনে শাড়ি আর কায়দার ব্লাউজ। প্রতিটি তৈলচিত্ৰই বলে দেয়, রুস্তমজি অভিজাত ঘরানার মানুষ।

টুপুর চোরা চোখে ছবিগুলো দেখছিল। রুস্তমজির কাজের মেয়েটি কফি রেখে গিয়েছে, সঙ্গে বিস্কুট আর কাজুবাদাম। কফিমগ এখনও হাতে তোলেনি টুপুর। অস্বস্তি হচ্ছে। অজস্র বহুমূল্য শো-পিসে সাজানো, পেল্লাই একখানা গ্র্যান্ড পিয়ানো শোভিত হলঘরখানা এখন যা অস্বাভাবিক রকমের থমথমে! মিতিনমাসির মুখে রা নেই, রুস্তমজিও নিশ্চুপ। লীলা অবশ্য খানিকটা সামলেছেন, দুহাত কপালে রেখে তিনিও এখন স্থির। এমন পরিবেশে কি কফিতে চুমুক দেওয়া যায়!

মিতিনই অবশেষে নীরবতা ভাঙল। নরম স্বরে লীলাকে বলল, আমি এখন আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করব। মানে, আমার তো এখনও অনেক কিছু জানার আছে…!

লীলা কপাল থেকে হাত সরালেন। জোরে একবার নাক টেনে সোজা হয়ে বসলেন। চোখের কোলটা মুছে নিয়ে বললেন, ইয়েস!

আপনি যখন গাড়ি নিয়ে স্কুলে পৌঁছোলেন, তখন ঠিক কটা বাজে?

ঘড়ি তো দেখিনি। লীলার স্বরে প্রখর অবাঙালি টান, বিকেল পাঁচটা হবে।

তখন স্কুলে দরোয়ান ছাড়া আর কেউ ছিল না?

না। রনিদের প্রিন্সিপাল মিসেস রায় নাকি তার পাঁচ মিনিট আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন।

দরোয়ান কি আপনাকে দেখে অবাক হয়েছিল?

ভীষণ। সে তো বারবার হলফ করে বলল, কার্ড দেখে তবে রনিকে ছাড়া হয়েছে। তবে কার্ডটা কে দেখিয়েছে মনে করতে পারল না।

দরোয়ানের সঙ্গে কথা বলার পর আর কি আপনি প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে ফোন করেছিলেন?

করা উচিত ছিল। তবে… তখন আমি এমন ডিসটার্বড ছিলাম… রুস্তমজিকেও ফোনে পাচ্ছি না… আমার ব্রেন কাজ করছিল না।

তক্ষুনি রুস্তমজির অফিসে গেলেন না কেন? রনির স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথেই তো রুস্তমজির অফিস, তাই না?

ঠিকই তো! কেন যাইনি? রুস্তমজিকে তো তুলে আনতে পারতাম। লীলাকে ভারী বিহ্বল দেখাল। একটু ভেবে বললেন, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তারক বোধহয় আমায় জিজ্ঞেস করেছিল বাড়ি ফিরব কি না… আমি বোধহয় ঘাড় নেড়েছিলাম। বাড়ি পৌঁছোনোর

আগেই অবশ্য রুস্তমজির ফোন এসে গেল।

আর-একটা প্রশ্ন। আপনাদের অন্য ড্রাইভারটি তো ছুটিতে সে কি আগে থেকেই ছুটির কথা বলে রেখেছিল?

রাকেশ তো হঠাৎই দেশে গেল। ওর মা নাকি খুব অসুস্থ।

ও। মিতিন আলগা মাথা নাড়ল। অন্যমনস্কভাবে একটা কাজুবাদাম হাতে তুলল। ঘুরে রুস্তমজিকে বলল, আচ্ছা, আপনার হ্যান্ডসেটে তো দেখলাম ছটা বত্রিশে কিডন্যাপারের ফোন এসেছিল?

রুস্তমজির ঠোঁট নড়ল, হ্যাঁ, টাইমটা তো তাই।

একটা ব্যাপার আমার কিন্তু স্ট্রেঞ্জ লাগছে। আপনার স্ত্রী স্কুলে গিয়েছিলেন পাঁচটা নাগাদ। মৌলালি থেকে আপনার বাড়ি আধঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। অর্থাৎ মোটামুটি সাড়ে পাঁচটা। আপনিও পৌঁছেছেন তার পর-পরই। বড়জোর পৌনে ছটায়। কিডন্যাপারের ফোন আসার অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে। এতক্ষণ টাইম পেয়েও আপনি পুলিশকে জানালেন না…?

বিশ্বাস করুন, উপায় ছিল না। আড়চোখে লীলাকে দেখে নিলেন রুস্তমজি। গলা নামিয়ে বললেন, লীলা তখন এত এক্সাইটেড ছিল,..! ক্রমাগত বলছে, তোমার জন্য রনি মিসিং হল, তোমার জন্য রনির বিপদ ঘটেছে,..! ওকে শান্ত করতে গিয়েই…!

এক সেকেন্ড। এক সেকেন্ড। ম্যাডাম আপনাকে দোষারোপ করছিলেন কেন?

কারণ একটা আছে। যদিও আমি সেটাকে আমল দিতে চাই না।

তবু শুনি?

লীলার ইচ্ছে ছিল, বাইপাসের দিকে যে গ্লোবাল স্কুলটা হয়েছে, রনি সেখানে পড়ুক। মূলত আমার জেদেই রনি সেন্ট পিটার্সে ভরতি হয়। ওসব এ সি ক্লাসরুম, এ সি স্কুলবাস, চোখ ধাঁধানো পরিমণ্ডল আমার পছন্দ ছিল না।

লীলা বললেন, আসল কথাটা বলছ না কেন? তুমি কখনওই ট্র্যাডিশনের বাইরে যেতে চাও না।

বটেই তো। আমি সনাতন ধারার স্কুলিংই পছন্দ করি। আমার বিশ্বাস, মিশনারি স্কুলগুলোতেই বেটার চরিত্র গঠন হয়। তা ছাড়া আমি নিজেও সেন্ট পিটার্সের ছাত্র। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর দুর্বলতা থাকবে না?

আপনি চমৎকার বাংলা বলেন তো! প্রচুর বাঙালি বন্ধুবান্ধব আছে নিশ্চয়ই?

আমি খুব একটা মিশুকে মানুষ নই ম্যাডাম। ক্লাব-পার্টিতেও তেমন যাইটাই না। একমাত্র উইকে এক-দুদিন আমাদের পারসি ক্লাবে…! রুস্তমজি একটু থামলেন। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন, কলকাতায় এখন আমরা সাকুল্যে সাতশোজন পারসি বাস করছি। মাত্র শআড়াই পরিবার। ওই ক্লাবেই তাদের অনেকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়, নিজেদের সুখদুঃখের গল্প করি…!

তা হলে এত ভাল বাংলা শিখলেন কোত্থেকে?

আমরা এখানে প্রায় পৌনে দুশো বছর আছি ম্যাডাম। এসেছিলাম সেই আঠেরোশো উনচল্লিশে। যে বছর প্রথম এখানে অগ্নিমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

এজরা স্ট্রিটে?

তার পাশের গলিতে। পারসি চার্চ স্ট্রিটে। মন্দিরটা অবশ্য বহুকালই বন্ধ। ওখানকার পবিত্র আগুন তো এখন রাখা আছে। আমাদের দ্বিতীয় অগ্নিমন্দির আতস আদ্রনে। লালবাজারের কাছে। রুস্তুমজি ফিকে হাসলেন, প্রায় সাত পুরুষ যেখানে বাস করছি সেখানকার ভাষা তো মাদার টাং-এর মতো সড়গড় হয়ে যাওয়া উচিত, নয় কি? তার উপর আমরা বিজনেসম্যান, লোকাল ল্যাঙ্গোয়েজের উপর দখল না থাকলে ব্যবসা চালাতেও তো অসুবিধে।

তা বটে। মিতিন মৃদু হাসল, আচ্ছা, আপনারা ভারতের কোত্থেকে এসেছিলেন? গুজরাত?

না, মুম্বই।

কার্পেট ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টই কি আপনাদের পারিবারিক ব্যবসা?

আগে আরও অনেক কিছু ছিল। জরি দিয়ে শুরু। তারপর জুটমিল, কাপড়ের কল, স্টিমশিপ…। কারখানাগুলো তো অনেক দিনই বন্ধ, তবে কার্গোশিপের বিজনেসটা আছে।

আপনিই চালান?

না। আমার বাবা শিপিং-এর ব্যবসাটা ভাইকে দিয়েছেন। সে থাকে মুম্বইয়ে, ওখানেই তার কাজকারবার।

আপনার বাবা-মা কি জীবিত?

অবশ্যই। তাঁরা এখন ভাইয়ের কাছে। কলকাতাতেও আসেন মাঝে মাঝে। বিশেষ করে নওরোজের টাইমে কলকাতায় থাকাই তাঁদের বেশি পছন্দ।

নওরোজ… মানে আপনাদের নিউ ইয়ার?

না, না, এটা অন্য উৎসব। প্রাচীনকালে পারস্যে আমাদের সম্রাট জামশেদ যেদিন সিংহাসনে বসেছিলেন, সেই দিনটাকে আমরা নওরোজ হিসেবে পালন করি।

উৎসবটা বসন্তকালে হয় না?

শীতের শেষে, বসন্তের শুরুতে। শান্তভাবেই বললেন রুস্তমজি, তবে এবার যেন তাঁকে খানিক অসহিষ্ণু দেখাল। বিনয়ী সুরেই বললেন, ম্যাডাম, এসব প্রশ্নের সঙ্গে কি রনির কিডন্যাপিং এর কোনও সম্পর্ক আছে?

হয়তো নেই। আবার থাকতেও তো পারে। আসলে আপনাদের পরিবারের সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু বুঝে নিতে চাইছি।

তা হলে একবারেই বলে দিই। আমার পূর্বপুরুষ মুম্বই থেকে প্রথমে এসেছিলেন হুগলিতে। সেখান থেকে কলকাতায় এসেই আবার মুম্বই চলে যান। তারপর আবার কলকাতায় ফিরে চিনদেশের সঙ্গে আফিং-এর ব্যবসা শুরু করেন। তারপর জাহাজ…। আস্তে আস্তে অন্য বিজনেসেও নেমে পড়েন। আর আমার স্ত্রী লীলার এক পূর্বপূরুষ ছিলেন জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান। নিশ্চয়ই তাঁর নাম শুনেছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই। ওঁকে তো এককালে ইন্ডিয়ান ফিল্মের রাজা বলা হত। ওঁর নামেই তো কলকাতার ম্যাডান স্ট্রিট।

এখন অবশ্য লীলার সমস্ত আত্মীয়স্বজনই মুম্বইয়ে সেটল্ড। আমারও কলকাতায় আর কোনও নিয়ার রিলেটিভ নেই। আর কিছু জানার আছে কি?

আপাতত এই যথেষ্ট। মিতিন যেন রুস্তমজির মৃদু উষ্মাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। একই রকম স্বচ্ছন্দ সুরে বলল, আবার কিডন্যাপিং-এ ফিরি। কোথায়, কখন, কীভাবে টাকা দিতে হবে তা কি কিডন্যাপার জানিয়েছে?

রুস্তমজি ঈষৎ থতমত। তারপর দুদিকে মাথা নাড়লেন, না।

অর্থাৎ আবার ফোন আসবে।

মনে তো হচ্ছে।

আপনি কি টাকাটার অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছেন?

হয়ে যাবে।

তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আবার ফোন আসুক, তারপর এগোবেন। মিতিন গলা ঝাড়ল, আচ্ছা, কিডন্যাপারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, কোনও আওয়াজ কানে এসেছে কি? ট্রেনের শব্দ কি বাসের হর্ন, কিংবা দোকানবাজারের হট্টগোল…?

বোধহয় একটা সাইকেলরিকশার ভেঁপু…, আমি ঠিক শিয়োর নই।

আর দুটো কোয়েশ্চেন। এমন কেউ আছে কি, যে আপনার কাছ থেকে এভাবে বাঁকা পথে টাকা আদায়ের চেষ্টা করতে পারে? কোনও পারিবারিক শত্রু বা বিজনেস এনিমি? অথবা আপনার উপর কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে…?

রুস্তমজির চওড়া কপালে মোটা মোটা ভাঁজ। মিনিটখানেক চিন্তা করে বললেন, সরি ম্যাডাম। আমি তো তেমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।

সেকেন্ড কোয়েশ্চেন, রনির অপহরণের সংবাদটা এখনও পর্যন্ত কে কে জানে?

র‍্যানসাম চাওয়ার ব্যাপারটা শুধু আপনারাই জানলেন। তবে রনিকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে, এটা তো তারক বুঝছে। আমাদের কাজের মেয়ে লছমিও। এ ছাড়া সেন্ট পিটার্সের দরোয়ানও কিছুটা অনুমান করতে পারে। প্লাস, রনিদের প্রিন্সিপালও হয়তো খানিকটা আঁচ পেয়েছেন। রুস্তমজি লীলার দিকে তাকালেন, তুমি নিশ্চয়ই কাউকে ফোনটোন করোনি?

আমি কাকে ফোন করব? ঝেঁঝে উঠতে গিয়েও লীলার স্বর করুণ হয়ে গেল সহসা। কাঁদোকাঁদো মুখে মিতিনকে বললেন, আপনি কিছু একটা করুন ম্যাডাম। যত টাকা চাইবেন, দেব। শুধু আমার বাচ্চা যেন সহি-সলামত ফিরে আসে।

ভাবছেন কেন, বাহাত্তর ঘণ্টা সময় তো আমরা পেয়েছি। মিতিন লীলার হাতে হাত রাখল, তবে কাজে নামার আগে কয়েকটা জিনিস চাই।

কী দেব বলুন?

রনির কয়েকটা রিসেন্ট ফোটো। আর স্কুলকে একটা চিঠি, যাতে আমি প্রিন্সিপালের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে পারি। তবে চিঠিতে কিডন্যাপিং-এ খবরটা উল্লেখ করার দরকার নেই।

আর?

আপনার দুই ড্রাইভারের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার।

আমি দিচ্ছি। রুস্তমজি শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এক্ষুনি।

আপনাকে আর-একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

কী?

গাড়িটা অনর্থক বের করার দরকার নেই। আমরা নিজেরাই চলে যাব।

পলকের জন্য বিস্ময় ফুটে উঠল রুস্তমজির মুখে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মিতিনের দিকে। তারপর ঘাড় দুলিয়ে বললেন, বেশ, তাই হবে। তবে যদি কিছু পারিশ্রমিক অ্যাডভান্স করি, তাতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি নেই?

তাড়া কীসের মিস্টার জরিওয়ালা? মাত্র তো বাহাত্তর ঘণ্টার মামলা! তার পরেই না হয়…!

রুস্তমজি আর জোরাজুরি করলেন না। দরকারি জিনিসগুলো একটা বড় খামে পুরে, ছলছল-চোখ লীলাকে ফের আশ্বাসবাণী শুনিয়ে, হ্যানোভার কোর্ট ছাড়ল মিতিন।

ট্যাক্সিতে উঠেই টুপুর বলল, রুস্তমজির গাড়িটা নিলে না কেন?

মিছিমিছি কেন আর ছেলেটাকে খাটাই। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।

অজুহাতটা যেন কেমন-কেমন? তুমি কি তারককে সন্দেহ করছ?

জবাব নেই। ঠোঁটে কুলুপ এঁটেছে মিতিন। চোখ বুজে হেলান দিল সিটে। টুপুরও যেন অবসন্ন বোধ করছিল। মনটা ভার হয়ে আসছে। লীলার হাউহাউ কান্না এখনও বাজছে কানে। আহা রে, মা বলে কথা। লোকগুলো কী নিষ্ঠুর রে বাবা! রনি তো বুমবুমেরই বয়সি হবে, ওইটুকুনি বাচ্চাকে টাকার লোভে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে? শুধু কি তাই, মেরে ফেলারও ভয় দেখাচ্ছে। হয়তো কিছু খেতে দেয়নি, হয়তো মারধর করছে…! না, জঘন্য নরপশুগুলোর কড়া শাস্তি হওয়া দরকার।

ভেজা ভেজা গলায় টুপুর ডাকল, মিতিনমাসি?

উঁ?

বদমাশদের পাকড়াও করা যাবে তো?

দেখি!

মিতিনমাসির গলায় কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? কেসটা অবশ্য বেশ জটিল। কোনও ক্লু-ই তো নেই। ফোন বুথটা খুঁজে পাওয়া গেলেই কি বজ্জাতদের ধরা যাবে? অসম্ভব। বাচ্চার আইডি কার্ড পর্যন্ত যারা নকল করতে পারে, তারা নিশ্চয়ই দুঁদে শয়তান। সময়টা বড় কম। মাত্র তিন দিন। তাই বোধহয় বেশি দুর্ভাবনায় পড়েছে মিতিনমাসি। রুস্তমজি তো পুলিশকেও জানাচ্ছেন না, পুরোপুরি মিতিনমাসির উপর ভরসা করে বসে, এও তো এক ধরনের মানসিক চাপ। সবচেয়ে বড় ঝঞ্ঝাট, শয়তানদের ধরতে হবে অতি সাবধানে। একবার যদি তারা টের পায় রুস্তমজি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন…!

ফাঁকা রাস্তায় শাঁ শাঁ ছুটছে ট্যাক্সি। গড়িয়াহাটের ব্রিজ পেরোল। হঠাৎই নড়েচড়ে উঠল মিতিন। ব্যাগ খুলে মোবাইল বের করল। টকটক বোতাম টিপে ফোন কানে চাপল।

কয়েক সেকেন্ডের প্রতীক্ষা। তারপরই মিতিনের গলা বাজল, অনিশ্চয়দা? আমি মিতিন বলছি।

টুপুরের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। করছে কী মিতিনমাসি? সরাসরি পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধানকে জানিয়ে দিচ্ছে ঘটনাটা?

না, অনিশ্চয় অঙ্কেলের কাছে পাবলিক বুথটার অবস্থান জানতে চাইল মিতিনমাসি। কারণটা ভাঙল না, ঠাট্টা করে এড়িয়ে গেল।

ফোন অফ করে মিতিন বলল, বাড়ি ফিরে যেন মেসোর সঙ্গে বেশি গল্পে মাতিস না। খেয়েই শুয়ে পড়বি।

কেন গো?

কাল একটা কঠিন দিন। অনেক ছোটাছুটি আছে।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *