Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাত তখন তিনটে || Nirendranath Chakravarty

রাত তখন তিনটে || Nirendranath Chakravarty

“মামাবাবু, তুমি হিপনোটিজমে বিশ্বাস করো?”

ভাদুড়িমশাইয়ের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সেন্টার টেবিলের উপরে পেয়ালা-পিরিচ নামিয়ে রেখে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “কেন, তুই বুঝি বিশ্বাস করিস না?”

কৌশিক বলল, “কেন করব? এতে যদি বিশ্বাস করি তো জড়িবুটি তাগা তাবিজ আর মারণ-উচাটন কী দোষ করেছে?”

মালতী বলল, “বাজে কথা বলিস না, কৌশিক। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন একবার আমাদের অ্যানুয়াল ফাংশানে এক ম্যাজিশিয়ান এসেছিল। থার্ড ইয়ারের একটা মেয়েকে স্টেজে ডাকিয়ে এনে সে যা কাণ্ড করেছিল, উঃ, ভাবতেই এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়।”

বিকেলের বৈঠকে অরুণ সান্যালও আজ হাজিরা দিয়েছেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল বলে গত দু’দিন তিনি চেম্বারে যাননি। আজ জ্বর নেই, তবে আজও তিনি রুগি দেখবেন না। মালতীর কথা শুনে মৃদু গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কাণ্ডটা আসলে তোমাকে নিয়ে নয় তো?”

মালতী বলল, “তার মানে?”

“না…মানে,” আমতা-আমতা করে অরুণ সান্যাল বললেন, “গল্পটা তো আগেও তোমার কাছে শুনেছি, তাই বলছিলুম যে, তুমিও তো তখন থার্ড ইয়ারে পড়তে, তাই না?”

ঝাঁঝিয়ে উঠে মালতী বলল, “পড়তুম তো কী হয়েছে? থার্ড ইয়ারে কি আমি একাই পড়তুম? আর-কোনও মেয়ে আমার সঙ্গে পড়ত না? আর তা ছাড়া, ম্যাজিশিয়ান ডাকল আর আমিও অমনি সুড়সুড় করে স্টেজে গিয়ে উঠলুম, আমাকে কি এতই বোকা ভাবছ নাকি?”

বাপ-মায়ের ঝগড়া দেখে কৌশিক মুখ টিপে হাসছিল। এদিকে আমি দেখলুম গল্পটাই একেবারে মাঠে মারা পড়তে চলেছে। মালতীকে একটা মৃদু ধমক দিয়ে বললুম, “আঃ, কী ছেলেমানুষি হচ্ছে। যা বলছিলে বলো। ম্যাজিশিয়ান তো থার্ড ইয়ারের সেই মেয়েটাকে স্টেজে ডাকিয়ে আনল। কী হল তারপর?”

মালতী বলল, “আগে ওকে চুপ করতে বলুন তো, কিরণদা। গল্পের মধ্যে যদি টিপ্পনী কাটতে থাকে তো আমি আর একটা কথাও বলব না।”

অরুণ সান্যল বললেন, “ঠিক আছে, এই আমি চুপ করলুম। দু’একটা মন্তব্য যদি করতেই হয় তো গল্প শেষ হবার পরে করব। ততক্ষণ আর মুখ খুলছি না। ওঅর্ড অব অনার।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নে, এবার বল কী বলবি। মেয়েটা তো স্টেজে গিয়ে উঠল। কী হল তখন?”

“সে আর বোলো না, দাদা,” মালতী বলল, “যা হল, তা বিশ্বাস করা যায় না।”

কৌশিক বলল, “যায় কি না-যায়, সেটা আমরা বুঝব, মা। যা হয়েছিল, অত বিতং না-দিয়ে সেটা সরাসরি বলে ফ্যালো তো।”

“ওরেব্বাবা, তারপরে তো…”

“মন্তর পড়ে মেয়েটাকে একটা পরি বানিয়ে দিল নিশ্চয়?”

এই শেষ প্রশ্নটা সদানন্দবাবুর। ভাদুড়িমশাইয়ের কীর্তিকাহিনীর খবর তো সবাই রাখেন, তাই সদানন্দবাবুকেও তাঁদের না চিনবার কথা নয়। তবু বলি, সদানন্দবাবু আমার প্রতিবেশী। বৃদ্ধ মানুষ। নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করেন। দিনে তিন কাপ চা খান, তবে তাতে দুধ-চিনি মেশান না। বছর কয়েক আগে একটা খুনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলেন, তখন ভাদুড়িমশাই তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। ভাদুড়িমশাই বাঙ্গালোর থেকে এক হপ্তার জন্যে কলকাতায় এসেছেন শুনে সদানন্দবাবুও আজ আমার সঙ্গে এসে যতীন বাগচি রোডের এই বৈকালিক আড্ডায় যোগ দিয়েছেন।

তাঁর প্রশ্ন শুনে আমরা হেসে উঠলুম। তাতে তিনি একটু কুঁকড়ে গিয়ে বললেন, “কেন, মন্তর পড়ে কাউকে পরি বানানো যায় না?”

মালতী বলল, “না, না, পরি-টরি নয়, তাকে একটা মেনিবেড়াল বানিয়ে দিয়েছিল।”

সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তাঁর চোখ একেবারে গোল হয়ে গেছে। সোফার উপরে জোড়াসন হয়ে বসে ছিলেন। সেখান থেকে ঝুঁকে পড়ে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, “অ্যাঁ, মেনিবেড়াল, সত্যি?”

“এক বর্ণও মিথ্যে নয়।”

“মেয়েটার হাতে-পায়ে লোম গজিয়ে গেসল?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দূর মশাই, ম্যাজিশিয়ানরা কি সেকালের মুনিঋষি নাকি যে, কারুর উপরে একবার রেগে গেলেই হল, কমন্ডলু থেকে অমনি দু’ ফোঁটা জল ছিটিয়ে তাকে পাথর কিংবা গাছ বানিয়ে দেবে?”

আমি বললুম, “ডাইনিবুড়ি তার ম্যাজিক-ওয়ন্ড ছুঁইয়ে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে শুয়োর কিংবা ব্যাং বানিয়ে দিত, এ-সব গল্প এককালে পড়েছি বটে। কিন্তু সে তো রূপকথার গল্প।”

মালতী বলল, “না, কিরণদা, রূপকথার গল্প নয়, আমাদের সুলোচনা সত্যি-সত্যি বেড়াল হয়ে গিয়েছিল।

কৌশিক বলল, “তার মানে আমাদের লামডিঙের সুলোচনামাসি? কই, আগে কক্ষনো আমাকে বলোনি তো?”

মালতী বলল, “কেন বলব? তোর বন্ধুদের সব কথা তুই আমাকে বলিস? আজ নেহাত কথাটা উঠে পড়েছে, তাই সকলের সামনে বলছি। কিন্তু খবর্দার, কথাটা যেন সুলোচনা জানতে না পারে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হয়েছে রে বাবা, হয়েছে। তোর গপ্পোটা এখন শেষ কর দিকিনি।”

মালতী বলল,” শেষ তোমরা করতে দিচ্ছ কোথায়?”

অরুণ সান্যাল চুপচাপ একটা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, “অনেকক্ষণ আমি কথা বলিনি, কিন্তু এখন আর না-বলে পারা যাচ্ছে না। আসলে মুশকিলটা হয়েছে এই যে, মালতী ইজ আ ভেরি ব্যাড স্টোরি-টেলার। ওর বলে নেওয়া উচিত ছিল যে, সুলোচনার চেহারা কিছুমাত্র পাল্টায়নি, শুধু তার স্বভাবটাই পালটে গেসল। তাও মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে। হিপনোটিজমের প্রভাব কেটে যাবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই বল। তো ম্যাজিশিয়ান কী করল?”

মালতী বলল, “স্টেজের উপরে একটা চেয়ার ছিল, সুলোচনাকে সেই চেয়ারে বসিয়ে, স্টেজের আলো একদম ডিম করে দিল। তারপর বাঁ-হাতে একটা চেনসুদ্ধ পকেট-ঘড়ি ঝুলিয়ে, ডাইনে-বাঁয়ে খুব আস্তে-আস্তে সেটাকে দোলাতে দোলাতে সুলোচনাকে বলল, ‘সরাসরি এই ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকুন।’ তারপর ডান হাতটা তার মুখের কাছে বার দুই খুব আলতো করে নাড়াতেই দেখি সুলোচনার মাথাটা কেমন যেন সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। তারপর সে—”

“তারপর সে সুলোচনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী? তা-ই না?”

প্রশ্নটা ভাদুড়িমশাইয়ের। মালতী তাঁর তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, দাদা। তুমি কী করে জানলে?”

“জানব কেন, আন্দাজ করেছিলুম। তারপর?”

“সুলোচনা বলল, ‘আমার নাম সুলোচনা পাকড়াশি।’ ম্যাজিশিয়ান তাতে বলল, ‘না না, ও তো মানুষের নাম, অমন নাম বেড়ালের হয় না। আপনাকে আমি বেড়াল করে দিয়েছি, আপনার নাম এখন শ্রীমতী মার্জারিকা দেবী। বলুন, এখন আপনার নাম কী?…বলুন…বলুন…নিজের নামটা এঁদের জানিয়ে দিন…বলুন…নাম বলুন…। কী নাম আপনার?’ কী বলব দাদা, মস্ত একটা অসুখ থেকে উঠলে যেমন হয়, সেই রকমের দুর্বল আর জড়ানো গলায় সুলোচনা বলল, ‘আমার নাম শ্রীমতী মার্জারিকা দেবী। বোঝো ব্যাপার!

কৌশিক বলল, “অ্যাঁ, সুলোচনামাসি এই কথা বলল?”

মালতী বলল, “শুধু ওইটুকু হলে তো রক্ষে ছিল। তারপরে যা ঘটতে দেখলুম, সে তো আরও ভয়ংকর ব্যাপার। ম্যাজিশিয়ান বলল, ‘শ্রীমতী মার্জারিকা দেবী, আপনি তো একটা বেড়াল। তা হলে আপনি মানুষের ভাষায় নিজের নাম বললেন কেন? ওটা নিজের ভাষায় বলুন। বলুন…বলুন…বেড়ালরা যে-ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষায় আপনার নামটা এদের জানিয়ে দিন। তাতে সুলোচনা কী করল, আপনারা ভাবতে পারেন?”

সেই ফ্যাসফেসে গলাতেই সদানন্দবাবু বললেন, “কী করলেন তিনি?”

“সুলোচনা বলল, মেয়াও… মেয়াও… মিউ!”

সদানন্দবাবুর দু’চোখ অনেক আগেই গোল হয়ে গিয়েছিল, এবারে সে-দুটো কপালে উঠে গেল। সোফায় হেলান দিয়ে এমন ভঙ্গিতে তিনি বসে আছেন যে, দেখলে মনে হবে এইমাত্র তিনি ‘প্রফুল্ল’ নাটকের যোগেশের মতো তাঁর ব্যাঙ্ক ফেল পড়ার খবর পেয়েছেন। সেই অবস্থায় অস্ফুট গলায় বললেন, “জল খাব।”

পাশের টিপয়ে কাচের জার। তার থেকে গেলাশে জল গড়িয়ে অরুণ সান্যাল তাঁর দিকে এগিয়ে ধরলেন। ঢকঢক করে সবটা জল খেয়ে নিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “অ্যানাদার গ্লাস।”

কৌশিক বলল, “মা, তুমি বাড়িয়ে বলছ না তো?”

“এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না,” মালতী বলল, “ওই যে বললুম কথাটা ভাবতে গেলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখ। গোটা হল অন্ধকার। স্টেজের উপরেও খুব আবছামতো আলো। সেই আলোর মধ্যে, মাথাটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে, বসে আছে সুলোচনা। আর সেই ম্যাজিশিয়ান তারপর যা-কিছুই প্রশ্ন করছে, তার উত্তরে সে শুধুই বেড়ালের ডাক নকল করে বলে যাচ্ছে—ম্যাও ম্যাও। উরেব্বাবা রে বাবা, সে যে কী বীভৎস কাণ্ড, তা তোরা ভাবতেও পারবি না।”

কৌশিক বলল, “এ তো দেখছি পরশুরামের গল্পের সেই ‘ভুটে বললে হালুম’-এর মতো ব্যাপার।” কাজের মেয়েটি ইতিমধ্যে এসে আর-এক রাউন্ড চা দিয়ে গিয়েছে। আমার পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে বললুম, “ইশকুল-কলেজে এই ধরনের হিপনোটিজমের খেলা না-দেখানোই ভাল। মালতী, তোমাদের প্রিন্সিপ্যালের এটা অ্যালাও করা উচিত হয়নি। কোনও ছাত্রের মনের উপরে যাতে বড্ড বেশি চাপ পড়তে পারে, এমন কিছু কিন্তু খেলাচ্ছলেও দেখানো চলে না।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন, কিরণদা। তা ছাড়া সুলোচনার কথাটা একবার ভাবুন। ওই যে সে স্টেজে উঠে ‘ম্যাও ম্যাও’ করেছিল, তার ফলে নিশ্চয়ই পরদিন থেকে শি বিকেম দ্য অবজেক্ট অভ এভরিওয়ান’স রিডিকিউল! তাতে তার ব্যক্তিত্বের ক্ষতি হয়নি ভাবছেন? শুধু ব্যক্তিগত কেন, এতে শরীরেরও খুব ক্ষতি হয়। এমনকি, এর থেকে একটা কঠিন অসুখও দাঁড়িয়ে যেতে পারে।”

ভাদুড়িমশাই কোনও কথা বলছেন না, চা খেতে-খেতে শুধু মৃদু-মৃদু হাসছেন। চা শেষ হতে তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর গলগল করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “অরুণ, তুমি তো অসুখের কথা ভাবছ। অথচ হিপনোটিজমের সাহায্য নিয়ে অসুখ-বিসুখ সারাবার চেষ্টাও যে কিছু কম চলেনি, এমনকি নামজাদা সব সাহেব-ডাক্তাররাও যে সে-চেষ্টা অনেক কাল ধরে চালাচ্ছেন, তাও তুমি জানো নিশ্চয়। কিন্তু এক্ষুনি আমি সে-সব কথার মধ্যে যাচ্ছি না। আপাতত আমি শুধু একটা কথা জানতে চাই। হ্যাঁ রে, মালতী, এই যে জাদুকরটি তোদের কলেজে গিয়ে হিপনোটিজমের খেলা দেখিয়েছিল, তার নামটা তোর মনে আছে?”

“নামটা মনে পড়ছে না, দাদা,” একটুক্ষণ ভেবে মালতী বলল, “তবে পদবিটা ভুলিনি। পাশা।”

“কোন ভাষায় কথা বলছিল?”

“ইংরিজিতে। বাংলা যে একেবারেই বলছিল না, তা নয়। তবে ভাঙা-ভাঙা। এই ধরো দু’চার বছর কলকাতায় থেকে মারোয়াড়ি কি গুজরাটিরা যেমন বলে, সেই রকমের বাংলা আর কি।”

“জয় বাবা ফেলুনাথে মগনলাল যে-রকম বাংলা বলছিল, সেইরকম?”

“ঠিক ধরেছ,” মালতী বলল, “একেবারে সেইরকম। কিন্তু না, সে-লোকটা মারোয়াড়িও নয়, গুজরাটিও নয়। শুনলুম যে, ইজিপ্ট থেকে বছর খানেক হল এসেছে।”

“কিন্তু যার সম্পর্কে এত কথা তোর মনে আছে, তার পুরো নামটা তুই ভুলে গেছিস।”

“কেন, পুরো নামটা তোমার জানা দরকার? বলো তো সুলোচনাকে ফোন করি। পুরো নামটা তার হয়তো মনে থাকতে পারে। তাকে নিয়েই তো যত কাণ্ড।”

“না রে, বাবা,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এর জন্যে আর লামডিঙে ফোন করতে হবে না। তা ছাড়া, তুই ভুলে গেলে কী হয়, পুরো নামটা আমার ঠিকই মনে আছে। আনোয়ার পাশা। ইংরিজিতে লিখত অবশ্য এনভার। কিন্তু না, ইজিপশিয়ান নয়, আট-আনা ইন্ডিয়ান, আট-আনা ডাচ।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “তার মানে?”

“মানে আর কী, বাবা ইন্ডিয়ান, দিল্লির ওদিককার লোক, আর মা হচ্ছেন ওলন্দাজ মেমসাহেব। আনোয়ার পাশার আসল নামটাও জেনে রাখো, সুরিন্দার চৌহান।

“তা হলে সে ওই ইজিপশিয়ান নাম নিতে গিয়েছিল কেন?”

সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। সেটাকে অ্যাশট্রের মধ্যে পিষে দিতে-দিতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চালাক লোক তো, তাই জানত যে, গেঁয়ো যোগীরা কোনও দেশেই ভিখ পায় না, অথচ স্রেফ একটা বিদেশি নাম শুনলেই হল একেবারে ভর্তি হয়ে যায়। তার উপরে এ আবার কোন দেশের নাম? না মিশরের। সেই যেখানে মরা মানুষকে মমি করে রেখে দেওয়া হত। তো সেই ম্যাজিশিয়ানের খেলা দেখতে লোক না-জমে পারে? আনোয়ার পাশার শোম্যানশিপও তো খারাপ ছিল না।”

সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। বছর তিরিশেক আগে কলকাতায় এসেছিল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু এসেছিল বললে কমই বলা হয়, ছিলও কয়েক বছর। এখান থেকে ডিউরিং দ্য সেভেন্টিজ ম্যাড্রাসে যায়। সেখান থেকে আসে ব্যাঙ্গালোরে। তারপর সাউথ ইন্ডিয়ার আরও কয়েকটা জায়গায় বছর কয়েক কাটিয়ে বোম্বাইয়ে গিয়ে উদয় হয়।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “আপনি এত-সব খবর জানলেন কী করে?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বাঃ, এত বড় একজন গুণী লোক, আর আমি কিনা তার খবর রাখব না? কলকাতায় ওর শো দেখে ইস্টার্ন কুরিয়ার পত্রিকার সমালোচক যেদিন লেখে যে, এত বড় হিপানোটিস্ট এর আগে আর কখনও কলকাতার মঞ্চে খেলা দেখায়নি, সেদিন থেকেই আমি ওর খবর রেখে যাচ্ছি। তা আনোয়ার পাশা এখন কোথায় আছে, জানতে চাও?”

“কোথায়?”

ভাদুড়িমশাই ধীরেসুস্থে প্যাকেট খুলে আবার একটা সিগারেট ধরালেন, তারপর বললেন, “বোম্বাইয়ের জেলে।”

সদানন্দবাবু বললেন, “অ্যা, জেলে?…ইউ মিন প্রিজন?”

মালতী বলল, “বলো কী দাদা!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিকই বলছি। তোর বন্ধু সুলোচনাকে জানিয়ে দিতে পারিস যে, যে-লোকটা একদিন হিপনোটাইজ করে তাকে মেনিবেড়াল বানিয়ে ছেড়েছিল, বোম্বাইয়ের এক জেলখানায় সে এখন ঘানি ঘোরাচ্ছে?”

আমি বললুম,”কেন?”

“কেন আবার, লোকটা এমনিতেও খুব সুবিধের ছিল না, যেখানেই গেছে একটা করে বিয়ে করেছে, অর্থাৎ বিয়ের নাম করে গোটাকয় মেয়ের সর্বনাশ করেছে এই আর কী, তার উপরে আবার বোম্বাইয়ে এসে উল্টোপাল্টা আরও পাঁচ রকমের কাণ্ডকারখানায় জড়িয়ে গেল। ফলে আর শেষরক্ষা হল না।”

সুরিন্দার চৌহান ওরফে আনোয়ার পাশার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ভাদুড়িমশাই যা বললেন, সংক্ষেপে তার পশ্চাৎপট হচ্ছে এইরকম :

লোকটা বোম্বাইয়ে গিয়েছিল তিরাশি সালে। তখন তার পড়তির দশা। এদিকে বয়সও যেহেতু ষাটের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে, তাই বাইরে থেকে নতুন-নতুন সব সাজ-সরঞ্জাম আমদানি করে, কি দিশি মিস্ত্রিদের ঠিকমতো তালিম দিয়ে সেগুলো তৈরি করিয়ে নিয়ে হাল-আমলের ম্যাজিশিয়ানদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে দর্শক টানবে, এমন উদ্যম কিংবা আর্থিক সংগতি তখন আর তার ছিল না। হলের ভাড়া আর ডেকরেটরের পাওনা মেটাতে পারেনি বলে ত্রিবান্দ্রমে একটা মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিল, তার ইউনিটও সেখানেই ভেঙে যায়, তারপর সেখান থেকে বোম্বাইয়ে এসে উটকো ছুটকো জনা তিন-চার লোক জুটিয়ে যখন নতুন করে আবার আসর জমাবার চেষ্টা করে, তখন তার অবস্থা দাঁড়িয়েছে হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া নৌকোর মতো। খেলা বলতে ওই তাস আর রুমালের গুটিকয় স্টক আইটেম, কিন্তু বোম্বাইয়ের শহরতলি এলাকার দর্শকও তা দেখতে চায় না, ফলে শো-বিজনেস থেকে লোকটা ক্রমেই হটে যেতে থাকে।

কৌশিক বলল, “তা তো বুঝলুম, কিন্তু তাকে জেল খাটতে হল কেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খাটতে হত না, যদি না সে নেকিচাঁদ মাখিজার খপ্পরে পড়ত।”

“সে আবার কে?”

“সে একটা হাড়ে-বজ্জাত ইমপ্রেশারিয়ো।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রতিটি হলে তার লোক থাকত তো, তাই কোন হলে কে কীরকমের শো করছে, সে-সব জানতে তার কিছুমাত্র দেরি হত না। এটাও তার জানা হয়ে গিয়েছিল যে, ম্যাজিকের আর-পাঁচটা ব্যাপারে যতই পিছিয়ে থাক, হিপনোটিজমের খেলায় আনোয়ার পাশার জুড়ি নেই। সেই লোকের শোয়ে নাকি হল-এর অর্ধেকটাই খালি পড়ে থাকছে। বাস, এইটুকুই নেকিচাদের জানবার দরকার ছিল। সে সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকে। তা সেই সুযোগ আসতে দেরিও হয় না। এরই মধ্যে একদিন ধারকর্জ করে, মাহিম এলাকার একটা লজঝড় হল ভাড়া করে আনোয়ার পাশা তার শো দেখাবার ব্যবস্থা করেছিল। দর্শক সেদিনও বিশেষ জোটেনি। যে কয়েকজন জুটেছিল, প্রথম দু’তিনটে মামুলি খেলা দেখেই তারা রেগে গিয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। গালাগালিও চলতে থাকে অশ্রাব্য রকমের। ফলে শো ভেঙে যায়। ড্রপসিন ফেলে, পিছনের দরজা দিয়ে, আনোয়ার পাশাকে পালাতে হয়।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “নেকিচাঁদই লোক লাগিয়ে শো ভেঙে দেয়নি তো?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা আমি কী করে বলব। আমি শুধু এইটুকু জানি যে, আনোয়ার পাশা যে শস্তার হোটেলে ছিল, সেই রাত্তিরেই সেখানে লোক পাঠিয়ে নেকিচাঁদ তাকে ডাকিয়ে আনে। তাকে বুঝিয়ে বলে, শো-বিজনেসে তার আর কিছু হবার নেই, এ-লাইনে অনেক নতুন-নতুন ছেলেছোকরা এসে গেছে, তাদের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে তাকে না-খেয়ে মরতে হবে। সেটা অবশ্য খুব-একটা বুঝিয়ে বলবার দরকার ছিল না, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আনোয়ার পাশা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছিল। ফলে, হাতের মধ্যে কড়কড়ে একতাড়া নোট গুঁজে দিয়ে নেকিচাঁদ তাকে যখন অন্য রকমের কাজে নামতে বলে, এক কথায় সে রাজি হয়ে যায়।”

“হিপনোটাইজ করবার কাজ?”

“তা ছাড়া আর কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই যে তোমাকে বলছিলুম না, অরুণ, হরেক রকমের রোগ সারাবার কাজেও এই বিদ্যেটার প্রয়োগ কিছু কম হয়নি। তা নেকিচাঁদের মতন ধুরন্ধর লোক কি আর সে-দিকটার কথা জানত না? না-জানলে সে কাগজে-কাগজে এমন ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেবে কেন? বিজ্ঞাপনে বলা হল যে, ইজিপ্ট থেকে এক বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক এসেছেন। তিনি ওষুধ-বিষুধের ধার ধারেন না, স্রেফ হিপনোটিজমের সাহায্যে দুরারোগ্য সব অসুখ সারিয়ে দেন। ইউরোপ-আমেরিকার হাজার হাজার মানুষের নানা কঠিন রোগ তিনি এই অত্যাশ্চর্য পদ্ধতিতে সারিয়েছেন। এবারে বোম্বাইয়ের মানুষরাও তাঁর সাহায্য পাবেন। সিটিং-পিছু ভিজিট মাত্র পাঁচশো টাকা, তবে আজ পর্যন্ত কোনও ক্ষেত্রেই তিনটির বেশি সিটিংয়ের দরকার হয়নি। আরোগ্য একেবারে অবধারিত।”

অরুণ সান্যল বললেন, “কিন্তু আনোয়ার পাশা তো ডাক্তার নয়, সে তো ম্যাজিশিয়ান। হিপনোটিজমের সাহায্যে রোগ সারানো যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু যে-সব ডাক্তার বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও তো কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। আনোয়ার সে-সব পদ্ধতির কথা জানবে কী করে? আর না-জানলে তার বিদ্যেটাকে সে কাজেই বা লাগাবে কীভাবে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজে তো সে লাগায়নি, অকাজে লাগিয়েছিল। তা নইলে আর শোভা আগরওয়াল তার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে নালিশ করবে কেন?”

মালতী বলল, “শোভা আগরওয়াল কে?”

“ওদিককার নামজাদা বিল্ডিং কনট্রাক্টর যশোদানন্দন আগরওয়ালের দ্বিতীয় পক্ষের জোয়ান বউ। যশোদানন্দন মারা যাবার পরে বোম্বাইয়ের কাফ্ প্যারেড আর নরিম্যান পয়েন্টে তা অন্তত গোটা পাঁচেক বিশাল ফ্ল্যাট আর কয়েক কোটি টাকার মালকিন। একে তো নিঃসন্তান যুবতী বিধবা, তায় ব্যাংক-ব্যালান্সও প্রচুর। একবার ভেবে দ্যাখ দিকি, হিপনোটিস্ট আনোয়ার পাশা যার শাকরেদ, সেই নেকিচাদের পক্ষে এর চেয়ে ভাল টার্গেট আর কী হতে পারে?”

সদানন্দবাবু হাঁ করে গল্প শুনে যাচ্ছিলেন, অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কিন্তু গল্পটা যেখানে এসে পৌঁছেছে, তাতে আর পারলেন না, গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “তাকেও বেড়াল বানিয়ে দিল?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে না মশাই, তাকে বেড়াল-টেরাল বানানো হয়নি। শোভা আগরওয়াল হিস্টিরিয়ার রুগি। কথা ছিল তিন-সিটিংয়ে আনোয়ার পাশা তার ব্যামো সারিয়ে দেবে। তা থার্ড সিটিংয়েই যা ঘটবার তা ঘটে যায়। শোভাকে হিপনোটাইজ করে আনোয়ার তার দেওয়াল-আলমারির চাবি হাতায়, তারপর আলমারির লকার থেকে ক্যাশ পাঁচ লাখ টাকা আর বেশ-কিছু জড়োয়া গয়না নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ে।”

মালতী বলল, “ধরা পড়ল না?”

“ধরা না পড়লে আর জেলে পাঠানো হল কী করে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুনের কাছে লোনাভলা বলে একটা জায়গা আছে জানিস তো? খুব শুটিং-টুটিং হয়। নাম ভাঁড়িয়ে সেইখানে একটা হোটেলে গিয়ে উঠেছিল। পরদিনই সেই হোটেল থেকে অ্যারেস্ট করে নেকিচাদ আর আনোয়ার পাশাকে বোম্বাইয়ে নিয়ে আসা হল। এ হল চুরাশি সালের ঘটনা। মামলা চলেছিল পুরো তিন বছর। সাতাশি সালে রায় বেরুল। সেভন ইয়ারস ফর নেকিচাঁদ মাখিজা অ্যান্ড ফাইভ ইয়ারস ফর আনোয়ার।”

বললুম, “আপনি এত সব জানলেন কী করে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, ওদিককার প্রতিটি কাগজে এই মামলার খুঁটিনাটি খবর তখন বেরোয়নি? বড়লোকের বিধবাকে হিপনোটাইজ করে তার টাকা আর গয়নাগাটি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে রগরগে খবর আর কী হতে পারে! নেতাদের গালভরা সব স্টেটমেন্ট আর ছেঁদো বক্তৃতা নিয়ে কে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে, এইসব মুখরোচক খবরই তো লোকে পড়তে চায়। যা কিছু বললুম, তার চোদ্দো আনা তখন কাগজেই বেরিয়েছিল। বাকি দু’ আনা খোঁজ-খবর করে জানতে হয়েছে।”

কাজের মেয়েটি এসে বলল, “মামাবাবু, ফোনে একজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।” আমাদেরও উঠবার সময় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাদুড়িমশাই উঠতে দিলেন না। বললেন, একটুক্ষণ বসুন। আমি ফোনটা সেরে ফিরে আসি, তখন উঠবেন।”

ফিরে এসে বললেন, “কিরণবাবু, দিন কয়েকের ছুটি নিতে পারবেন?”

“কেন?”

“আমাকে একটু গিরিডি যেতে হবে। আপনিও চলুন না।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
Pages ( 1 of 21 ): 1 23 ... 21পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *