Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্যোমকেশ ও বরদা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

ব্যোমকেশ ও বরদা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

বেশি দিনের কথা নয়‌, ভূতান্বেষী বরদাবাবুর সহিত সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের একবার সাক্ষাৎকার ঘটিয়াছিল। ব্যোমকেশের মনটা স্বভাবত বহির্বিমুখ‌, ঘরের কোণে মাকড়সার মত জাল পাতিয়া বসিয়া থাকিতেই সে ভালবাসে। কিন্তু সেবার সে পাক্কা তিনশ’ মাইলের পাড়ি জমাইয়া সকলকে চমকিত করিয়া দিয়াছিল।

ব্যোমকেশের এক বাল্যবন্ধু বেহার প্রদেশে ডি.এসপি’র কাজ করিতেন। কিছুদিন পূর্বে তিনি মুঙ্গেরে বদলি হইয়াছিলেন এবং সেখান হইতে ব্যোমকেশকে নিয়মিত পত্ৰাঘাত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। তাঁহার সাদর নিমন্ত্রণের অন্তরালে বোধ হয় কোনো গরজ প্রচ্ছন্ন ছিল; নচেৎ পুলিসের ডি.এস.পি. বিনা প্রয়োজনে পুরাতন অর্ধবিস্মৃত বন্ধুত্ব ঝালাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিবেন। ইহা কল্পনা করিতেও মনটা নারাজ হইয়া উঠে।

ভাদ্র মাসের শেষাশেষি; আকাশের মেঘগুলা অপব্যয়ের প্রাচুর্যে ফ্যাকাসে হইয়া আসিয়াছে‌, এমন সময় একদিন ব্যোমকেশ পুলিস-বন্ধুর পত্ৰ পাইয়া এক রকম মরিয়া হইয়াই বলিয়া উঠিল‌, ‘চল‌, মুঙ্গের ঘুরে আসা যাক।’

আমি পা বাড়াইয়াই ছিলাম। পূজার প্রাক্কালে শরতের বাতাসে এমন একটা কিছু আছে যাহা ঘরবাসী বাঙালীকে পশ্চিমের দিকে ও প্রবাসী বাঙালীকে ঘরের দিকে নিরন্তর ঠেলিতে থাকে। সানন্দে বলিলাম‌, ‘চল।’

যথাসময়ে মুঙ্গের স্টেশনে উতরিয়া দেখিলাম ডি.এস.পি. সাহেব উপস্থিত আছেন। ভদ্রলোকের নাম শশাঙ্কবাবু; আমাদেরই সমবয়স্ক হইবেন‌, ত্ৰিশের কোঠা এখনো পার হয় নাই; তবু ইহারি মধ্যে মুখে ও চালচলনে একটা বয়স্থ ভারিক্কি ভাব আসিয়া পড়িয়াছে। মনে হয়‌, অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে অধিক দায়িত্ব ঘাড়ে পড়িয়া তাঁহাকে প্রবীণ করিয়া তুলিয়াছে। তিনি আমাদের সঙ্গে লইয়া কেল্লার মধ্যে তাঁহার সরকারী কোয়াটারে আনিয়া তুলিলেন।

মুঙ্গের শহরে ‘কেল্লা’ নামে যে স্থানটা পরিচিত তাহার কেল্লাত্ব এখন আর কিছু নাই; তবে এককালে উহা মীরকাশিমের দুর্ধর্ষ দুর্গ ছিল বটে। প্রায় সিকি মাইল পরিমিত বৃত্তাকৃতি স্থান প্রাকার ও গড়খাই দিয়া ঘেরা-পশ্চিম দিকে গঙ্গা। বাহিরে যাইবার তিনটি মাত্র তোরণদ্বার আছে। বর্তমানে এই কেল্লার মধ্যে আদালত ও সরকারী উচ্চ কর্মচারীদের বাসস্থান‌, জেলখানা‌, বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ ছাড়া সাধারণ ভদ্রলোকের বাসগৃহও দুচারিটি আছে। শহর বাজার ও প্রকৃত লোকালয় ইহার বাহিরে; কেল্লাটা যেন রাজপুরুষ ও সম্রাস্ত লোকের জন্য একটু স্বতন্ত্র অভিজাত পল্লী।

শশাঙ্কবাবুর বাসায় পৌঁছিয়া চা ও প্রাতরাশের সহযোগে তাঁহার সহিত আলাপ হইল। আমাদের আদর অভ্যর্থনা খুবই করিলেন; কিন্তু দেখিলাম লোকটি ভারি চতুর‌, কথাবাতায় অতিশয় পটু। নানা অবাস্তর আলোচনার ভিতর দিয়া পুরাতন বন্ধুত্বের স্মৃতির উল্লেখ করিতে করিতে মুঙ্গেরে কি কি দর্শনীয় জিনিস আছে তাহার ফিরিস্তি দিতে দিতে কখন যে অজ্ঞাতসারে তাঁহার মূল বক্তব্যে পৌঁছিয়াছেন তাহা ভাল করিয়া লক্ষ্য না করিলে ঠাহর করা যায় না। অত্যন্ত কাজের লোক তাহাতে সন্দেহ নাই‌, বাক্যের মুন্সিয়ানার দ্বারা কাজের কথাটি এমনভাবে উত্থাপন করিতে পারেন যে কাহারো ক্ষোভ বা অসন্তোষের কারণ থাকে না।

বস্তুত আমরা তাঁহার বাসায় পৌঁছিবার আধঘণ্টার মধ্যে তিনি যে কাজের কথাটা পাড়িয়া ফেলিয়াছেন তাহা আমি প্রথমটা ধরিতেই পারি নাই; কিন্তু ব্যোমকেশের চোখে কৌতুকের একটু আভাস দেখিয়া সচেতন হইয়া উঠিলাম। শশাঙ্কবাবু তখন বলিতেছিলেন‌, ‘শুধু ঐতিহাসিক ভগ্নস্তৃপ বা গরম জলের প্রস্রবণ দেখিয়েই তোমাদের নিরাশ করব না‌, অতীন্দ্ৰিয় ব্যাপার যদি দেখতে চাও দেখাতে পারি। সম্প্রতি শহরে একটি রহস্যময় ভূতের আবির্ভাব হয়েছে—তাঁকে নিয়ে কিছু বিব্রত আছি।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ভূতের পেছন বিরত থাকাও কি তোমাদের একটা কর্তব্য নাকি?’

শশাঙ্কবাবু হাসিয়া বলিলেন‌, ‘আরে না না। কিন্তু ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে–। হয়েছে কি‌, মাস ছয়েক আগে এই কেল্লার মধ্যেই একটি ভদ্রলোকের ভারী রহস্যময়ভাবে মৃত্যু হয়। এখনো সে-মৃত্যুর কিনারা হয়নি‌, কিন্তু এরি মধ্যে তাঁর প্রেতাত্মা তাঁর পুরনো বাড়িতে হানা দিতে আরম্ভ করেছে।’

ব্যোমকেশ শূন্য চায়ের পেয়ালা নামাইয়া রাখিল; দেখিলাম তাহার চোখের ভিতর গভীর কৌতুক ক্রীড়া করিতেছে। সে সযত্নে রুমাল দিয়া মুখ মুছিল‌, তারপর একটি সিগারেট ধরাইয়া ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘শশাঙ্ক‌, তোমার কথা বলবার ভঙ্গীটি আগেকার মতই চমৎকার আছে দেখছি‌, এবং সদ্য-ব্যবহারে আরো পরিমার্জিত হয়েছে। এখনো এক ঘণ্টা হয়নি মুঙ্গেরে পা দিয়েছি‌, কিন্তু এরি মধ্যে তোমার কথা শুনে স্থানীয় ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। —ঘটনাটা কি‌, খুলে বল।’

সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। শশাঙ্কবাবু ব্যোমকেশের ইঙ্গিতটা বুঝিলেন এবং বোধ করি মনে মনে একটু অপ্রতিভ হইলেন। কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া কিছুই ধরা গেল না। সহজভাবে বলিলেন‌, ‘আর এক পেয়ালা চা? নেবে না? পান নাও। নিন। অজিতবাবু। আচ্ছা—ঘটনাটা বলি তাহলে; যদিও এমন কিছু রোমাঞ্চকর কাহিনী নয়। ছ’মাস আগেকার ঘটনা–

শশাঙ্কবাবু জর্দা ও পান মুখে দিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন—

‘এই কেল্লার মধ্যেই দক্ষিণ ফটকের দিকে একটি বাড়ি আছে। বাড়িটি ছোট হলেও দোতলা‌, চারিদিকে একটু ফাঁকা জায়গা আছে। কেল্লার মধ্যে সব বাড়িই বেশ ফাঁকা—শহরের মত ঘেঁষাঘেষি ঠাসাঠাসি নেই; প্রত্যেক বাড়িরই কম্পাউন্ড আছে। এই বাড়িটির মালিক স্থানীয় একজন ‘রইস-তিনি বাড়িটি ভাড়া দিয়ে থাকেন।

‘গত পনেরো বছর ধরে এই বাড়িতে যিনি বাস করছিলেন তাঁর নাম—-বৈকুণ্ঠ দাস। লোকটির বয়স হয়েছিল—জাতিতে স্বর্ণকার। বাজারে একটি সোনারূপার দোকান ছিল; কিন্তু দোকানটা নামমাত্র। তাঁর আসল কারবার ছিল জহরতের। হিসাবের খাতপত্র থেকে দেখা যায়‌, মৃত্যুকালে তাঁর কাছে একান্নখানা হীরা মুক্ত চুনি পান্না ছিল—যার দাম প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।

‘এই সব দামী মণি-মুক্ত তিনি বাড়িতেই রাখতেন-দোকানে রাখতেন না। অথচ আশ্চর্য এই যে তাঁর বাড়িতে একটা লোহার সিন্দুক পর্যন্ত ছিল না। কোথায় তিনি তাঁর মূল্যবান মণি-মুক্তা রাখতেন কেউ জানে না। খরিদার এলে তাকে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসতেন‌, তারপর খরিদারকে বাইরের ঘরে বসিয়ে নিজে ওপরে গিয়ে শোবার ঘর থেকে প্রয়োজন মত জিনিস এনে দেখাতেন।

‘হীরা জহরতের বহর দেখেই বুঝতে পারছ লোকটি বড় মানুষ। কিন্তু তাঁর চাল-চলন দেখে কেউ তা সন্দেহ করতে পারত না। নিতান্ত নিরীহ গোছের আধাবয়সী লোক‌, দেবদ্বিজে অসাধারণ ভক্তি, গলায় তুলসীকঠি-সর্বদাই জোড়হস্ত হয়ে থাকতেন। কিন্তু কোন সৎকার্যের জন্য চাঁদা চাইতে গেলে এত বেশি বিমর্ষ এবং কাতর হয়ে পড়তেন যে শহরের ছেলেরা তাঁর কাছে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা ছেড়েই দিয়েছিল। তাঁর নামটাও এই সূত্রে একটু বিকৃত হয়ে পরিহাসচ্ছলে ‘ব্যয়-কুণ্ঠ’ আকার ধারণ করেছিল। শহরলুদ্ধ বাঙালী তাঁকে ব্যয়-কুণ্ঠ জহুরী বলেই উল্লেখ করত।

‘বাস্তবিক লোকটি অসাধারণ কৃপণ ছিলেন। মাসে সত্তর টাকা তাঁর খরচ ছিল‌, তার মধ্যে চল্লিশ টাকা বাড়িভাড়া; বাকি ত্ৰিশ টাকায় নিজের‌, একটি মেয়ের আর এক হাবাকালা চাকরের গ্ৰাসাচ্ছাদন চালিয়ে নিতেন; আমি তাঁর দৈনন্দিন খরচের খাতা দেখেছি‌, কখনও সত্তরের কোঠা পেরোয়নি। আশ্চর্য নয়?—আমি ভাবি‌, লোকটি যখন এতবড় কৃপণই ছিলেন তখন এত বেশি। ভাড়া দিয়ে কেল্লার মধ্যে থাকবার কারণ কি? কেল্লার বাইরে থাকলে তো ঢের কম ভাড়ায় থাকতে পারতেন।’

ব্যোমকেশ ডেক-চেয়ারে লম্বা হইয়া অদূরের পাষাণ-নির্মিত দুর্গ-তোরণের পানে তাকাইয়া শুনিতেছিল; বলিল‌, ‘কেল্লার ভিতরটা বাইরের চাইতে নিশ্চয় বেশি নিরাপদ্‌্‌, চোর-বদমাসের আনাগোনা কম। সুতরাং যার কাছে আড়াই লক্ষ টাকার জহরত আছে সে তো নিরাপদ স্থান দেখেই বাড়ি নেবে। বৈকুণ্ঠবাবু ব্যয়-কুণ্ঠ ছিলেন বটে। কিন্তু অসাবধানী লোক বোধ হয় ছিলেন না।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলুম। কিন্তু কেল্লার মধ্যে থেকেও বৈকুণ্ঠবাবু যে চোরের শেনদৃষ্টি এড়াতে পারেননি। সেই গল্পই বলছি। সম্ভবত তাঁর বাড়িতে চুরি করবার সঙ্কল্প অনেকদিন থেকেই চলছিল। মুঙ্গের জায়গাটি ছোট বটে‌, তাই বলে তাকে তুচ্ছ মনে কোরো না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না না‌, সে কি কথা!’

‘এখানে এমন দু’ চারটি মহাপুরুষ আছেন যাঁদের সমকক্ষ চৌকশ চোর দাগাবাজ খুনে তোমাদের কলকাতাতেও পাবে না। বলব কি তোমাকে‌, গভর্নমেন্টকে পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে হে। এখানে মীরকাশিমের আমলের অনেক দিশী বন্দুকের কারখানা আছে জান তো? কিন্তু সে-সব কথা পরে হবে‌, আগে বৈকুণ্ঠ জহুরীর গল্পটাই বলি।’

এইভাবে সামান্য অবাস্তর কথার ভিতর দিয়া শশাঙ্কবাবু পুলিসের তথা নিজের বিবিধ গুরুতর দায়িত্বের একটা গৃঢ় ইঙ্গিত দিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন–

‘গত ছাব্বিশে এপ্রিল-অৰ্থাৎ বাংলার ১২ই বৈশাখ-বৈকুণ্ঠবাবু আটটার সময় তাঁর দোকান থেকে বাড়ি ফিরে এলেন। নিতান্তই সহজ মানুষ‌, মনে আসন্ন দুর্ঘটনার পূবাভাস পর্যন্ত নেই। আহারাদি করে রাত্রি আন্দাজ ন’টার সময় তিনি দোতলার ঘরে শুতে গেলেন। তাঁর মেয়ে নীচের তলায় ঠাকুরঘরে শুতো‌, সেও বোপকে খাইয়ে দাইয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে দোর বন্ধ করে দিলে। হাবাকাল চাকরিটা রাত্ৰে দোকান পাহারা দিত‌, মালিক বাড়ি ফেরবার পরই সে চলে গেল। তারপর বাড়িতে কি ঘটেছে‌, কেউ কিছু জানে না।

‘সকালবেলা যখন দেখা গেল যে বৈকুণ্ঠবাবুঘরের দোর খুলছেন না‌, তখন দোর ভেঙে ফেলা হল। পুলিস ঘরে ঢুকে দেখলে বৈকুণ্ঠবাবুর মৃতদেহ দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। কোথাও তাঁর গায়ে আঘাত-চিহ্ন নেই‌, আততায়ী গলা টিপে তাঁকে মেরেছে; তারপর তাঁর সমস্ত জহরত নিয়ে খোলা জানলা দিয়ে প্রস্থান করেছে।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আততায়ী তাহলে জানলা দিয়েই ঘরে ঢুকেছিল?’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘তই তো মনে হয়। ঘরের একটি মাত্র দরজা বন্ধ ছিল‌, সুতরাং জানলা ছাড়া ঢোকবার আর পথ কোথায়! আমার বিশ্বাস‌, বৈকুণ্ঠবাবু রাত্রে জানলা খুলে শুয়েছিলেন; গ্ৰীষ্মকাল-সে–রাত্রিটা গরমও ছিল খুব। জানলার গরাদ নেই‌, কাজেই মই লাগিয়ে চোরেরা সহজেই ঘরে ঢুকতে পেরেছিল।’

‘বৈকুণ্ঠবাবুর হীরা জহরত সবই চুরি গিয়েছিল?’

‘সমস্ত। আড়াই লক্ষ টাকার জহরত একেবারে লোপাট। একটিও পাওয়া যায়নি। এমন কি তাঁর কাঠের হাত-বাক্সে যে টাকা-পয়সা ছিল তাও চোরের ফেলে যায়নি-সমস্ত নিয়ে গিয়েছিল।’

‘কাঠের হাত-বাক্সে বৈকুণ্ঠবাবু হীরা জহরত রাখতেন?’

‘তাছাড়া রাখবার জায়গা কৈ? অবশ্য হাত-বাক্সেই যে রাখতেন তার কোনো প্ৰমাণ নেই। তাঁর শোবার ঘরে কারু ঢোকবারই হুকুম ছিল না‌, মেয়ে পর্যন্ত জানত না তিনি কোথায় কি রাখেন। কিন্তু আগেই বলেছি‌, তাঁর একটা লোহার সিন্দুক পর্যন্ত ছিল না; অথচ হীরা মুক্তা যা-কিছু সব শোবার ঘরেই রাখতেন। সুতরাং হাত-বাক্সেই সেগুলো থাকত‌, ধরে নিতে হবে।’.

‘ঘরে আর কোনো বাক্স-প্যাঁটুরা বা ঐ ধরনের কিছু ছিল না?

‘কিছু না। শুনলে আশ্চর্য হবে‌, ঘরে একটা মাদুর‌, একটা বালিশ‌, ঐ হাত-বাক্সটা‌, পানের বাটা আর জলের কলসী ছাড়া কিছু ছিল না। দেয়ালে একটা ছবি পর্যন্ত না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পানের বাটা! সেটা ভাল করে দেখেছিলে তো?’

শশাঙ্কবাবু ক্ষুব্ধভাবে ঈষৎ হাসিলেন—’ওহে‌, তোমরা আমাদের যতটা গাধা মনে কর‌, সত্যিই আমরা ততটা গাধা নাই। ঘরের সব জিনিসই অতিপতি করে তল্লাস করা হয়েছিল। পানের বাটার মধ্যে ছিল একদলা চুন‌, খানিকটা করে খয়ের সুপুরি লবঙ্গ—আর পানের পাতা। বাটাটা পিতলের তৈরি‌, তাতে চুন খয়ের সুপুরির জন্য আলাদা খুবরি কাটা ছিল। বৈকুণ্ঠবাবু খুব বেশি পান খেতেন‌, অন্যের সাজা পান পছন্দ হত না বলে নিজে সেজে খেতেন।–আর কিছু জানতে চাও এ সম্বন্ধে?’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল‌, ‘না না‌, ওই যথেষ্ট। তোমাদের ধৈর্য আর অধ্যবসায় সম্বন্ধে তো কোনো প্রশ্ন নেই; সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। সেই সঙ্গে যদি একটু বুদ্ধি-কিন্তু সে যাক। মোট কথা দাঁড়াল এই যে বৈকুণ্ঠবাবুকে খুন করে তাঁর আড়াই লক্ষ টাকার জহরত নিয়ে চোর কিম্বা চোরেরা চম্পট দিয়েছে। তারপর ছমাস কেটে গেছে। কিন্তু তোমরা কোনো কিনারা করতে পারোনি। জহরতগুলো বাজারে চালাবার চেষ্টা হচ্ছে কি না-সে খবর পেয়েছ?’

‘এখনো জহরত বাজারে আসেনি। এলে আমরা খবর পেতুম। চারিদিকে গোয়েন্দা আছে।’

‘বেশ। তারপর?’

‘তারপর আর কি–ঐ পর্যন্ত। বৈকুণ্ঠবাবুর মেয়ের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তিনি নগদ টাকা কিছুই রেখে যেতে পারেননি; কোথাও একটি পয়সা পর্যন্ত ছিল না। দোকানের সোনা-রূপা বিক্রি করে যা সামান্য কিছু টাকা পেয়েছে সেইটুকুই সম্বল। বাঙালী ভদ্রঘরের মেয়ে‌, বিদেশে পয়সার অভাবে পরের গলগ্রহ হয়ে রয়েছে দেখলেও কষ্ট হয়।’

‘কার গলগ্রহ হয়ে আছে?’

‘স্থানীয় একজন প্রবীণ উকিল–নাম তারাশঙ্করবাবু। তিনিই নিজের বাড়িতে রেখেছেন। লোকটি উকিল হলেও ভাল বলতে হবে। বৈকুণ্ঠবাবুর সঙ্গে প্রণয়ও ছিল‌, প্রতি রবিবারে দুপুরবেলা দু’জনে দাবা খেলতেন—’

‘হঁ। মেয়েটি বিধবা?

‘না‌, সধবা। তবে বিধবা বললেও বিশেষ ক্ষতি হয় না। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল‌, স্বামীটা অল্প বয়সে বয়াটে হয়ে যায়। মাতাল দুশ্চরিত্র–থিয়েটার যাত্রা করে বেড়াত‌, তারপর হঠাৎ নাকি এক সার্কাস পাটির সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে নিরুদ্দেশ। তাই মেয়েকে বৈকুণ্ঠবাবু নিজের কাছেই রেখেছিলেন।’

‘মেয়েটির বয়স কত?

তেইশ-চব্বিশ হবে।’

চরিত্র কেমন?’।

‘যতদূর জানি‌, ভাল। চেহারাও ভাল থাকার অনুকুল–অর্থাৎ জলার পেত্নী বললেই হয়। স্বামী বেচারাকে নেহাৎ দোষ দেওয়া যায় না–’

‘বুঝেছি। দেশে আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই?’

‘না-থাকারই মধ্যে। নবদ্বীপে খুড়তুতো ভায়েরা আছে‌, বৈকুণ্ঠবাবুর মৃত্যুর খবর পেয়ে কয়েকজন ছুটে এসেছিল। কিন্তু যখন দেখলে এক ফোঁটাও রস নেই‌, সব চোরে নিয়ে গেছে‌, তখন যে-যার খসে পড়ল।’

ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; তারপর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘ব্যাপারটার মধ্যে অনেকখানি অভিনবত্ব রয়েছে। কিন্তু এত বেশি দেরি হয়ে গেছে যে আর কিছু করতে পারা যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমি বিদেশী‌, দুদিনের জন্য এসেছি‌, তোমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তুমিও বোধ হয় তা পছন্দ করবে না।’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘না না‌, হস্তক্ষেপ করতে যাবে কেন? আমি অফিসিয়ালি তোমাকে কিছু বলছি না; তবে তুমিও এই কাজের কাজী‌, যদি দেখে শুনে তোমার মনে কোনো আইডিয়া আসে তাহলে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করতে পার। তুমি বেড়াতে এসেছ‌, তোমার ওপর কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে তোমাকে বিব্রত করতে আমি চাই না।’

শশাঙ্কবাবুর মনের ভাবটা অজ্ঞাত রহিল না। সাহায্য লইতে তিনি পুরাদস্তুর রাজী‌, কিন্তু ‘অফিসিয়ালি কাহারো কৃতিত্ব স্বীকার করিয়া যশের ভাগ দিতে নারাজ।

ব্যোমকেশও হাসিল‌, বলিল‌, ‘বেশ‌, তাই হবে। দায়িত্ব না নিয়েই তোমাকে সাহায্য করব।–ভাল কথা‌, ভূতের উপদ্রবের কথা কি বলছিলে?’

শশাঙ্কবাবু বলিলেন‌, ‘বৈকুণ্ঠবাবু মারা যাবার কিছুদিন পরেই ঐ বাড়িতে আর একজন বাঙালী ভাড়াটে এসেছেন‌, তিনি আসার পর থেকেই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব আরম্ভ হয়েছে। সব কথা অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না‌, কিন্তু যে সব ব্যাপার ঘটছে তাতে রোমাঞ্চ হয়। পনেরো হাত লম্বা। একটি প্ৰেতাত্মা রাত্রে ঘরের জানোলা দিয়ে উঁকি মারে। বাড়ির লোক ছাড়াও আরো কেউ কেউ দেখেছে।’

‘বল কি?’

‘হ্যাঁ।–এখানে বরদাবাবু বলে এক ভদ্রলোক আছেন-আরো! নাম করতে না করতেই এসে পড়েছেন যে! অনেকদিন বাঁচবেন। শৈলেনবাবুও আছেন।–বেশ বেশ। আসুন। ব্যোমকেশ‌, বরদাবাবু হচ্ছেন্ন ভূতের একজন বিশেষজ্ঞ। ভুতুড়ে ব্যাপার ওঁর মুখেই শোনো।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress