সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ২৭
ছ’মাস বাদে বাপী আবার কলকাতার মাটিতে পা ফেলল।
এই আসাটা হঠাৎ কিছু ব্যাপার নয়। দু-তিন মাস যাবৎ আসার প্রস্তুতি চলছিল। গায়ত্রী রাই চোখ বোজার পর থেকে বানারজুলির সঙ্গে শিকড়ের যোগটা ঢিলে হয়ে গেছে। বানারজুলি ছেড়ে গেলে হয়তো আবার একদিন বানারজুলি ভালো লাগতে পারে। প্রথম কিছু দিন এখান থেকে একেবারে পালানোর ঝোঁক মাথায় চেপে বসেছিল। তার পিছনে আক্রোশ ছিল। অভিমান ছিল। বানারজুলি তাকে বেঁচে থাকার বিত্ত যুগিয়েছে। অকৃপণ হাতে জীবনের বোঝা টানার কড়ি ঢেলেছে। নিয়েছে তার ঢের বেশি। নিয়ে নিয়ে সেই ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত বুকের ভিতরে একটা মরুভূমি তৈরি করেছে।
কিন্তু কোথা থেকে কোথায় পালাবে? যেখানে যত দূরেই যাক, জীবনের এই বোঝাটাকে কোথাও ফেলে রাখা যাবে না। একই সঙ্গে আবার এক বিপরীত অনুভূতির তাড়না অবাক করেছে ওকে। মৃত্যুর ওধারে কি জানে না। কেউ জানে না। কিন্তু অলক্ষ্য থেকে কেউ কি দেখে? কে কি ভাবছে টের পায়? সব ছেড়েছুড়ে পালানোর চিন্তা যতবার মাথায় আসে, ততবার অদৃশ্য একখানা মুখ আর শান্ত ঠাণ্ডা দুটো চোখ যেন খুব কাছ থেকে ওকে দেখে, নিষেধ করে। আভিজাত্য গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্ব ভরা এমন একখানা মুখ আর দুটো চোখের সস্নেহ শাসন কেউ কখনো তুচ্ছ করতে পেরেছে! বাপীর ভেতরটা হাঁসফাঁস করে ওঠে। চারদিকে তাকায়। মনে হয় গায়ত্রী রাই খুব কাছে আছে। খুব কাছ থেকে দেখছে। খুব কাছ থেকে নিষেধ করছে।
পালানোর সংকল্প মাথা থেকে সরেছে। এবার তাহলে কি? খুব কাছের যাকে দেখতে পাচ্ছে না, অসহিষ্ণু সরোষ প্রশ্নটা যেন তাকেই। কি তাহলে? যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃত্তটাকে আরো বড় করতে হবে? আরো অনেক বড় ঢের বড়? জঙ্গলের উদোম সন্ন্যাসী ওকে আগে বাড়তে বলেছিল—আগে বাড়লে পেয়ে যাবে। চোখ-কান বুজে এই পথেই সামনে এগোবে এখন? কিন্তু কি পাবে? অনেক টাকা, তারপর আরো অনেক টাকা? তারপর আরো অনেক অনেক অনেক টাকা? তারও পরে?
ঠিক তক্ষুণি সেই আশ্চর্য কাণ্ডটা ঘটে গেল। বুকের তলার কালীবর্ণ আকাশটাকে এক ঝলক বিদ্যুৎ পলকের জন্য দুখানা করে চিরে দিয়ে গেল। ওই পলকের মধ্যেই বাপীর ঘেমে ওঠার দাখিল। দুর্যোগে ভরা অন্ধকারের আড়ালে এখনো কোনো সুদূর প্রত্যাশার আগুন জ্বলছে কিনা জানে না। সেটাই একপ্রস্থ ঝলসে গেল কিনা জানে না। কিন্তু আপাতত ওটা ওই অন্ধকারের ওধারেই থাকুক। পরে ভাববে। পরে বুঝতে চেষ্টা করবে। খুব কাছে যার অস্তিত্ব অনুভব করছে অথচ দেখতে পাচ্ছে না—সেও না কিছু বুঝতে পারে।
তার ইচ্ছে মেনে বৃত্ত বড় করার ঝোঁকটাকে বড় করে তুলতে গেল। আপাত পিছু টান কিছু নেই। ব্যবসার দিক থেকে ভাগ্যের পাশায় আবার নূতন যে দান পড়েছে তার দাক্ষিণ্যে বৃত্ত বিস্তারের কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই কলকাতার দিকে চোখ বাপীর।
সংকল্পের কথা গোড়ায় ঊর্মিলাকে জানায় নি। ঊর্মিলা তখনো এখানে। বিজয়ও। টেলিগ্রামে মায়ের মামাবাড়ির খবর পেয়ে পরদিন সকালের প্লেনেই ওরা ছুটে এসেছিল। ঊর্মিলা মরা মায়ের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে কিছু ঠাণ্ডা হতে পেরেছে। কিছু হালকা হতে পেরেছে। বাপীর সে সম্বলও নেই কোনো দিন। খরচোখে ওর আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না দেখেছে। হিংসা করেছে।
সমস্ত ব্যবসা আর বিত্ত চুল-চেরা দু’ ভাগ করে গায়ত্রী রাই এক ভাগ বাপী আর একভাগ মেয়ে-জামাইকে দিয়ে গেছে। দিয়ে গেছে বলতে এই মর্মে নির্দেশ রেখে গেছে। ঊর্মিলা একটু ঠাণ্ডা হাত তার মায়ের শোবার ঘরের বড় সিন্দুক খোলা হয়েছিল। গায়ত্রী রাই মেয়ের সামনেও এটা বড় একটা খুলত না। ওই পেল্লায় সিন্দুকে থরে থরে সাজানো দশ আর একশ টাকার বান্ডিল দেখে বিজয় মেহেরার দু’চোখ ঠিকরে পড়ার দাখিল। কোন্ ঘরের মেয়ে নিয়েছে এ যেন নতুন করে অনুভব করেছে। এ ছাড়া ছোট-বড় সোনার বারও পঁচিশ-তিরিশটা হবে। হীরে জহরতও আছে কিছু।
সিন্দুক থেকে একটা মস্ত বড় আর একটা ছোট খাম বার করে বাপী ঊর্মিলার হাতে দিয়েছে। দুটোরই যত্ন করে মুখ আঁটা। বলেছে, কি লিখে গেছেন আমি জানি না, খুলে দেখো।
ছোট খামে মেয়ে-জামাইয়ের প্রতি গায়ত্রী রাইয়ের সংক্ষিপ্ত নির্দেশ। পড়ে ঊর্মিলা নিঃশব্দে সেটা আবার বাপীর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। পড়তে পড়তে গলার কাছে বাপীর কিছু বুঝি আবার দলা পাকিয়ে উঠেছে। ব্যবসার যাবতীয় দায়দায়িত্ব যেমন বাপীর হাতে আছে তেমনি থাকবে। জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে তার বরাদ্দ টাকা, চালু হারে কমিশন আর অন্যান্য সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে নিট লাভের আট আনা অংশ মেয়ে-জামাই পাবে। মালিকানা সম্পর্কে অন্য যে—কোনো সিদ্ধান্ত দু’তরফের বিবেচনাসাপেক্ষ। ঘরে এবং ব্যাঙ্কের সমস্ত নগদ টাকা, সোনা ইত্যাদিরও অর্ধেক বাপী তরফদার পাবে, বাকি অর্ধেক মেয়ে-জামাইয়ের। কোয়েলা ঝগড়ু, বা বাদশা ড্রাইভারকেও ভোলেনি। তাদের জন্যও কিছু থোক টাকা আলাদা সরানো আছে। ভুটান পাহাড়ের বাংলোটা একলা মেয়ে পাবে। ব্যবসায়ের জন্য যদি সে বাড়ির দরকার হয়, তার ন্যায্য ভাড়াও মেয়ের নামে জমা হবে।
বড় খামে উত্তরবাংলার আর তার বাইরে বহু ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা-কড়ির হদিস, ব্যাঙ্কের পাস-বই চেক-বই ইত্যাদি। এই টাকাও প্রায় অভাবিত পরিমাণ। প্রতিটি অ্যাকাউন্ট মেয়ে আর মায়ের নামে। তাই মেয়ের প্রতি মায়ের নির্দেশ, সে-যেন বাপীর প্রাপ্য অর্ধেক তাকে দিয়ে দেয়।
মোটামুটি হিসেব কষা হতে বিজয় মেহেরার মুখে কথা সরে না। ব্যাঙ্ক আর সিন্দুকের নগদ টাকা ভাগে চার লক্ষর ওপরে দাঁড়াচ্ছে। এর ওপর সোনা হীরে জহরতের ভাগ। কিন্তু তখনই সব কিছুর ফয়সালা করার মতো সময় নেই হাতে। নগদ টাকা আর সোনা ইত্যাদির অর্ধেক বুঝে নিয়ে সস্ত্রীক বিজয় কলকাতা চলে গেছে। বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা পরের যাত্রায়। যাবার আগে ঊর্মিলা চুপি চুপি বাপীকে বলে গেছল, ওর কাছে সব একবারে ফাঁস করে দিয়ে ভালো কাজ করলে না বোধ হয়। কলকাতায় চাকরি ভালো লাগছে না, আবার বাইরে কাজের চেষ্টায় আছে। এত হাতে পেয়ে এখন মতিগতি কি হয় দেখো।
বলেছে বটে কিন্তু বাইরে পাড়ি দেবার ব্যাপারে ঊর্মিলারও তেমন বাধা কিছু আছে মনে হয়নি। পরের দু’তিনটে চিঠিতেও এই তোড়জোড়ের আভাস দিয়েছে ঊর্মিলা। লিখেছে তার ঘরের লোক এখন বেপরোয়া হয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, আর বলছে, কাজ হাতে না পেলেও চলেই যাবে। বিদেশে ওদের জন্য উল্টে কাজই নাকি হাঁ করে আছে।
তিন মাসের মাথায় ওরা বানারজুলি এসেছে আবার। বিজয়ের খুশি ধরে না। ওর কলকাতার চাকরির মেয়াদ আর দেড়-দু মাস মাত্র। আগামী জুলাইয়ের শেষে ওরা আমেরিকা চলল। সেখান থেকে বিজয়ের বড় চাকরির প্রতিশ্রুতি মিলেছে, শুধু নিজের খরচে সেখানে গিয়ে পৌঁছুনোর দায়। এবারে বাপীকে বিজয় সরাসরি একটা প্রস্তাব দিয়েছে। এখানকার ব্যবসায়ে অর্ধেক মালিকানার ব্যাপারে তার বা ডলির কিছুমাত্র আগ্রহ অথবা লোভ নেই। ব্যাঙ্কগুলোতে যে-টাকা মজুত আছে তার অর্ধেক বাপীর পাওনা। বাপী সে টাকাটা ছেড়ে দিলে তারাও অর্ধেক মালিকানার শর্ত ছেড়ে দেবে। কতকালের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে জানে না, আধা-আধি বাখরার হিসেবনিকেশের মধ্যে থাকতে চায় না।
এর থেকে বাঞ্ছিত আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বাপীর মুখ দেখে মন বোঝা ভার। সে ঊর্মিলাকে জিগ্যেস করেছে, তোমারও এই মত তাহলে?
সে জবাব দিয়েছে, আপত্তির কিছু নেই, তবে ব্যাঙ্কগুলো থেকে ফ্রেন্ডের দুলক্ষ টাকার ওপর পাওনা—অর্ধেক মালিকানার বদলে অত দিতে হলে তার না ঠকা হয়ে যায়।
বাপী হেসেই বলেছিল, ঠকলে আখেরে তোমরাই।
এমন সম্ভাবনার কথা ভেবেই হয়তো গায়ত্রী রাই লিখে রেখে গেছল, ব্যবসায় মালিকানা সম্পর্কে অন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত দু’তরফের বিবেচনাসাপেক্ষ। অতএব বাপীর বিবেকও পরিষ্কার।
মালিকানা বদল হয়ে গেল। কিন্তু নামের বেলায় বাপী শুধু একটা রাই হেঁটে দিল। নতুন নাম রাই অ্যান্ড তরফদার। ভক্ত যেমন সর্বদা তার আরাধ্য দেবদেবীর ছবি সঙ্গে রাখে, বাপীও ঠিক সেই মন নিয়ে ওই ইষ্টদেবীর নাম গোড়ায় বসিয়ে রাখল।
বাপীর লক্ষ্য এরপর কলকাতা। আপাতদৃষ্টিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের ঝোঁকটাই বড়। কিন্তু এদিকের সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার ফাঁকে আরো দুটো মাস কেটেছে। উত্তরাঞ্চলের সব থেকে বড় হার্ব-ডিলার এবারে জাঁকের সঙ্গে কলকাতার বাজারে নামতে চলেছে এই প্রচার আগে থাকতেই শুরু করেছে। প্রচারের চমক বাড়ানোর মতো একটি চৌকস লোকও ঠিক সময়ে জুটে গেছে।
জুটিয়েছে আবু রব্বানী। লোকটার নাম জিত মালহোত্রা। ইউ-পি’র ছেলে। বাপীর বয়সী হবে। স্মার্ট, সুশ্রী। যোগাযোগই বটে। আর কেউ হলে তার পরিচয় শুনেই হয়তো ছেঁটে দিত। কিন্তু আবুর সুপারিশের ফলে বাপীর আগ্রহ বাড়ল। চা-বাগানের সেই ছেলে, বাপীর আগে গায়ত্রী রাই যাকে কাজে বহাল করেছিল। কাজে-কর্মে চতুর ছিল। কিন্তু মেয়ের অর্থাৎ ঊর্মিলার দিকে চোখ যেতে যার আবার মূষিকদশা। আবু বলেছিল, মেয়ের দিকে ছোঁকছোঁক করতে দেখে মা ওকে তাড়িয়েছিল। পরে ঊর্মিলা বাপীকে বলেছিল, তার মতলব বুঝে সে-ই মাকে বলে ওকে তাড়িয়েছে।
বাপীকে এই বানারজুলিতে কে না চেনে। সকলের চোখের ওপর দিয়েই আজ ভাগ্যের এই জায়গাটিতে পৌঁছেছে। জিত মালহোত্রা আবুকে ধরেছে। নিজের ভাগ্য সে আর একবার যাচাই করে দেখতে চায়।
বাপী তাকে নিয়ে আসতে বলেছিল। দেখে আর দুচার কথা বলে পছন্দ হয়েছে। তার এই দেখার চোখ আলাদা। সপ্রতিভ মুখে অভিবাদন জানাতে বাপী চুপচাপ মুখের দিকে খানিক চেয়ে ছিল। তারপর বলেছিল, নাম জিত, কিন্তু প্রথমেই তো হেরে পালিয়েছিলে—।
ও সবিনয়ে জবাব দিয়েছে, মহিলা মালিক, তাই একটু বেশি অ্যাম্বিশাস হয়ে পড়েছিলাম। ভুলের খেসারত দিয়েছি। আর এমন ভুল হবে না।
—আমার কাছে এলে অমন ভুলের সুযোগ কিছু নেই। আমার অন্য কিছু দরকার।
—বলুন।
—বিশ্বাস। এই প্রথম আর এই শেষ শর্ত!
বাপীর যা পছন্দ তাই করেছিল লোকটা। আর উৎরেও গেছল। বিনীত অথচ সপ্রতিভ আবেদন নিয়ে সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর নিরুচ্ছ্বাস গলায় বলেছিল, আমি বিয়ে করেছি, একটা বাচ্চা আছে। ওদের ভালবাসি। বিশ্বাস হারিয়ে ওদের পথে বসানোর হিম্মত আমার নেই। তাছাড়া বিশ্বাস কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে সেটা ছ’বছর ধরে আপনাকে দেখে শিখেছি। এরপর আমারও এই একমাত্র পুঁজি জানব
বাপী তাকে বহাল করেছে। খেতাব প্রাইভেট সেক্রেটারী। কাজ যোগাযোগ আর প্রচার। চা-বাগান থেকে সর্বসাকুল্যে মাইনে পেত পৌনে তিনশ’ টাকা। বাপী সেটা পাঁচশ’য় তুলেছে। বাইরে থাকাকালে এর ওপর থাকা-খাওয়ার খরচ পাবে। এ ছাড়া ভালো পোশাক-আশাকের জন্যও গোড়ায় কিছু থোক টাকা দেওয়া হবে তাকে। আর যা বোঝানোর তাও সোজাসুজি বুঝিয়ে দিয়েছে।— এ টাকা কিছু না আমি জানি। তুমি কতটা বড় হবে সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে।
এক মাস আগে রাই অ্যান্ড তরফদারের মালিক জিত মালহোত্রাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। গতবারে বড়বাজারের যে-সব মার্চেন্ট-এর সঙ্গে বাপী দেখা করে এসেছিল তাদের প্রত্যেকের নামে শুভেচ্ছাসহ চিঠি পাঠিয়েছে। বড় বড় ওষুধের কারখানার হোমরা-চোমরাদের কাছেও! সঙ্গে কোম্পানীর গাদা গাদা ঝকঝকে ক্যালেন্ডার আর ফ্যাশানের ডায়ারি। বনজ ওষুধের কারবারে প্রচারের এই গোছের চটক তখন পর্যন্ত কলকাতায়ও নতুন। কিছুদিনের মধ্যে জিত জানিয়েছে, কেউ তাদের হেলাফেলা করেনি, অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
মন সব থেকে বেশি খারাপ আবু রব্বানীর। ব্যবসার মালিকানা বদলের ফলে বরাত ওরই সব থেকে বেশি খুলেছে। এখানকার সব কিছুর তদারকের ভার বাপী ওর কাঁধে চাপিয়েছে। জঙ্গলের হেড বীটম্যানের চাকরি ওকে ছাড়তেই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। জঙ্গলের বড় সাহেব খুশি থাকার ফলে ওর ঘরসহ চারিদিকের খানিকটা জমি বাপী আবুর নামেই কিনে ফেলতে নিশ্চিন্ত। এরপর আর সরকারী জমিতে বসবাসের দায় থাকল না। এখানে সকলের মাথার ওপর ওকে বসিয়ে দেবার ব্যাপারে বাপীর মনে এতটুকু দ্বিধা ছিল না। লেখাপড়ার ঘাটতি পুষিয়ে দেবার লোক তিন-চারজন আছে।
আবুর তবু মন খারাপ, কারণ দোস্ত-এর মতিগতির ওপর তার খুব আস্থা নেই। কলকাতা কেমন জানে না। কিন্তু শুনেছে সে এক আজব শহর। সেখানে ব্যবসা ফেঁদে বসলে বানারজুলির সঙ্গে যোগটা শেষে ঢিলে হয়ে যাবে কিনা কে জানে। বাপী কথা দিয়েছে, দরকার হলে মাসের মধ্যে চারবার করেও এখানে এসে দেখাশুনা করে যাবে। আর দরকার না হলেও মাসে বার দুই আসবেই। হাওয়াই জাহাজে এক ঘণ্টার তো ব্যাপার। আর আবুরই বা যখন-তখন চলে যেতে বাধা কোথায়?
আবুর তবু খুঁতখুঁতুনির একটা কারণ দুলারি ফাঁস করেছে। ছ’মাস হতে চলল মেমসায়েব বেহেস্তে পাড়ি দিয়েছে, তার মেয়েও বিয়ে-থা করে সরে পড়েছে—এত টাকা আর এত বড় ব্যবসা নিয়েও বাপীভাই একলা পড়ে আছে—এখনো বিয়েসাদির নাম নেই। দুলারিকে নাকি বলেছে, তোমার বাপীভাইয়ের রাজার ভাগ্য রাজার মেজাজ, কিন্তু তার মধ্যে একজন ফকির মানুষও লুকিয়ে আছে। কবে না সব বিলিয়ে দিয়ে মুসাফির হয়ে চলে যায়!
শুনে বাপী হেসেছিল। কিন্তু ভিতরে কোথায় কেটে কেটে বসেছে। ওর ভিতরে লোভের মূর্তিটা ওরা দেখেনি। সেই দানবকে ওরা জানে না। জীবনে যা ঘটে গেছে তাই শেষ বলে ওই দানব আজও মেনে নিতে পারেনি। যে মনের ওপর অগাধ বিশ্বাস সেই মন আজও বলছে, আরো কিছু ঘটতে বাকি। আরো অনেক বাকি। তা না হলে সমস্ত মন এখন কলকাতার দিকে কেন? এখনো আগে বাড়ছে কেন? আরো টাকা আরো টাকা আরো টাকা? আর কিছুই না?
তাই যদি হবে, তাহলে সংগোপনের কিছু লোলুপ চিন্তা মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয় কেন? বাপী তরফদার ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছে, বিবেকের ছড়ি উঁচিয়ে হেঁটে দিতেও চেয়েছে। কিন্তু ওরা ফিরে ফিরে এসেছে। আসছে।…প্রথম দিন কলকাতার সেই নামী হোটেলে মিষ্টি বলেছিল, দু’তিন ঘণ্টা পর পর সমস্ত মুখে জল দেওয়াটা বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে। বাথরুম থেকে ফিরে আসার পর কানে মাথায় জলের ছিটে দেখেছিল বাপী। ভেতর ঠাণ্ডা থাকলে এই বাতিক কেন?
ঊর্মিলা আর বিজয় মেহেরার প্রসঙ্গে নির্লিপ্ত সুরে মিষ্টি বলেছিল, অমন মা যখন সহায়, সংকট আবার কি—ইনজিনিয়ারকে হটিয়ে দাও। তার জবাবে বাপী বলেছিল, রাজত্ব বা রাজকন্যায় লোভ নেই—বারো বছর ধরে পৃথিবীর সব বাধা আর সক্কলকে হটিয়ে একজনের জন্যেই বসে আছে।…শুনে মিষ্টির চাউনি ওর মুখের ওপর খানিক স্থির হয়েছিল, চাপা ঝাঁঝে বলেছিল, তুমি মোস্ট আপ্র্যাকটিকাল মানুষ। বলেছিল, একটা মেয়ের দশ বছরের সঙ্গে বারোটা বছর জুড়লে কি দাঁড়ায়, আর কত কি ঘটে যেতে পারে—ভেবেছিল? শুধু নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়েই বারোটা বছর কাটিয়ে দিলে?
…কি ঘটে যেতে পারে বাপী পরে জেনেছে। কিন্তু মিষ্টির সেই অসহিষ্ণুতা আর ঝাঁঝের ফাঁকে কিছু চাপা যন্ত্রণাও ঠিকরে পড়ছিল নাকি?
…ছেলেপুলে হতে গিয়ে মিষ্টির প্রাণসংকট হয়েছিল। বড় ডাক্তার বলেছে, বাজে হাতে পড়ে মেয়েটার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু বাপী যখন দেখেছে সে-রকম ক্ষতির কোনো চিহ্ন চোখে পড়েনি। উল্টে আগের থেকেও তাজা সুন্দর লোভনীয় মনে হয়েছে। তাহলে ক্ষতিটা কি? আর ছেলেপুলে হবে কি হবে না সেই সংশয়? তাই যদি সত্যি হয়, সেই বড় ডাক্তারের হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে আপত্তি হবে না—এমন চিন্তাও যে করেছিল বাপী অস্বীকার করতে পারবে?
—সুদীপ নন্দী বলেছিল, বউ ঘরে নেওয়া দূরে থাক, তারা ছেলেকেই দূর দূর করে তাড়িয়েছে। অসিত চ্যাটার্জির মদের নেশা বাপী স্বচক্ষেই দেখেছে। জুয়ার নেশার কথাও শুনেছে। মিষ্টির মা মনোরমা নন্দী জামাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ। কতবার করে সে নাকি মেয়েকে বলেছে, কাগজের বিয়ে ছিঁড়ে ফেললেই ছেঁড়ে। এই ছেঁড়ার ব্যাপারে দীপুদাও বোনকে অনেক বুঝিয়েছে। সব কিছুর নিষ্পত্তি যদি হয়ে গিয়ে থাকে, নিভৃতের এই চিন্তার সলতেগুলো দপ করে জ্বলে জ্বলে ওঠে কেন, হাতছানি দেয় কেন? এক-এক ফুঁয়ে বাপী তো কতবার করে সেগুলো নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। সব থেকে বেশি চোখে ভাসে শেষের দিনে মিষ্টির সেই মুখ। ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির ছোঁয়া লেগে ছিল। যার নাম ঠিক হাসি নয়, হাসির মতো কিছু। দু চোখ তুলে ওকে শুধু কিছু বোঝাতে চেয়েছিল। কোনো অভিযোগ ছিল না, দু’চোখে শুধু মিনতি ছিল।
বাপী নামে কোনো পুরুষ ওই মেয়ের জীবন থেকে একেবারে মুছে গিয়ে থাকলে এমনটা হত না। হতে পারে না।
কিন্তু বাপী তবু এইসব লোভের বুদবুদগুলো সজাগ বিশ্লেষণের আয়নায় ফেলে বড় করে দেখতে চায় না। মিষ্টি ওকে মোস্ট আনপ্র্যাকটিকাল বলেছিল। মর্মান্তিক সত্যি কথাই বলেছিল। স্বপ্নের জালে বাস্তব কিছু ছেঁকে তোলা যায় না। মনের তলায় যা আছে—থাক। তাদের কানাকানিতে কান দেবার সময় বা সুযোগ যদি আসে কখনো, আজকের বাপী তরফদারকে তখন কেউ আনপ্র্যাকটিকাল বলবে না। স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাটানোর খোঁটাও আর কেউ দেবে না। আপাতত ও শুধু সামনে এগোচ্ছে, আগে বাড়ছে। কি পাবে আগে থাকতে তার হিসেব কষে কাজ নেই।
জুনের শেষদিনে বাপী ঊর্মিলার চিঠি পেল। রাগারাগি করে লিখেছে, আসি—আসি করেও আসছে না কেন—জুলাইয়ের শেষে কলকাতা ছেড়ে ওরা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, এরপর দেখা আর কবে হবে? আর লিখেছে, চটপট চলে না এলে এরপর গাড়িও ফসকে যাবে—ওটা নেবার জন্য ওখানে অনেকে হাঁ করে আছে, বিজয় ওটার গতি করার জন্যও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রথম দফায় গায়ত্রী রাইয়ের সিন্দুকের মোটা টাকা হাতে পেয়েই কলকাতায় গিয়ে কোনো বিদায়ী সাহেবের কাছ থেকে প্রায় নতুন একটা ঝকঝকে বিলিতি গাড়ি কিনে ফেলার খবর ঊর্মিলা চিঠিতে লিখেছিল। সব কিছু পাকাপাকি ফয়সলার জন্য ওরা গেলবারে আসতে সেই গাড়ির প্রসঙ্গও বাপীই তুলেছিল। ঊর্মিলাকে বলে দিয়েছিল, বাইরে চলে যাবার আগে গাড়ি যেন না বেচে দেয়— তারই দরকার হবে।
এদিকের ব্যবস্থা সব পাকা করে বাপী মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। কলকাতায় মাল চালানোর জন্য শিলিগুড়ির ডিলারের মারফৎ নতুন একটা বড় ট্রাক কেনা হয়েছে। সেটা এসে পৌঁছুনোর অপেক্ষা। তাও এসে গেল।
জুলাইয়ের তৃতীয় দিন বিকেলে এরোপ্লেন থেকে নামে বাপী তরফদার আবার কলকাতার মাটিতে। এবারে আসার তফাতটুকু শুধু তার মাথার মধ্যে। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। বৃষ্টিও পড়ছে, তবে জোরে নয়। এই অভ্যর্থনাও বাপীর মেজাজের সঙ্গে মিলছে।
বাপী তরফদার সামনে এগলো। আগে বাড়ল।