Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মনু আমার হাত ধরিয়া একটা কেওড়া গাছে উঠিল। নিবারণ আমাদের পাশের একটা গরান গাছের আড়ালে লুকাইয়া দাঁড়াইল, গাছে উঠিল না। খানিকটা পরে সে দেখি গাছের গুঁড়ির ওদিক হইতে এদিকে ঘুরিতেছে। আমরা গাছে উঠিবার সময় জ্বলন্ত মশাল দুইটি মাটিতে নামাইয়া রাখিয়াছি, তাই বোধ হয় নিবারণ বাঁচিয়া গেল।

মনু আমার গা ঠেলিয়া নিঃশব্দে আঙুল দিয়া আমাদের ডান দিকের একটা বেতঝোঁপের দিকে দেখাইল। মশালের আলোতে দেখিয়া আমার গা কেমন করিয়া উঠিল। সমস্ত হাত-পা অবশ হইয়া গেল। প্রকান্ড একটা বাঘ ডান দিকের বেতঝোঁপ হইতে বাহির হইয়া খানিকটা আসিয়া দাঁড়াইয়া নিবারণের দিকে চাহিয়া আছে। মশালের আলো পড়িয়া উহার চক্ষু দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। আবার নিবিয়া গেল। আবার জ্বলিয়া উঠিল। মনু জাতে মগ, সাহসী বীর বটে! ও দেখি নামিয়া পড়িতে চাহিতেছে নিবারণকে বাঁচাইবার জন্য। অথচ আমি জানি মনু সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। মনু যদি লাফায়, তবে আমাকেও লাফাইয়া পড়িতে হইবে–আমি গাছে বসিয়া থাকিব না। কিন্তু কী লইয়া নামি? মাথার উপরের দিকে একটা মোটা ডালের সন্ধানে চাহিলাম। মরিতে হয় তো যুদ্ধ করিয়া মরিব। এমন সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়িল। মনু উত্তেজিতভাবে আমাকে আর এক ঠেলা মারিল। সম্মুখে চাহিলাম। ওদিকের বড়ো কেওড়া গাছের ওপার হইতে একটা বাঘিনী বাহির হইয়া আমাদের গাছের তলার দিকে আসিতে আসিতে দাঁড়াইল, সম্ভবত জ্বলন্ত মশালের আলোয় ভয় পাইয়া। ঠিক বলা কঠিন। সঙ্গেসঙ্গে বাঘটা আরও আগাইয়া আসিল। তারপর দু-টিতে একত্র হইতেই বাঘিনী জিভ বাহির করিয়া বাঘের গা চাটিতে লাগিল। নিবারণ ঠিক উহাদের পাশেই কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়াইয়া আড়ষ্ট হইয়া আছে। উহার দিকে ইহারা দু-টিতে যেন অবজ্ঞাভরেই দৃষ্টি দিলে না। না, বেঁচে গেল এযাত্রা। বাঘ ও বাঘিনী ক্রমশ খালের উজানের জঙ্গলের দিকে চলিয়া গেল। আমরা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। নিবারণের হাতের ইশারায় আমরা গাছ হইতে নামিলাম।

মনু বলিল–খুব বেঁচে গিয়েছ!

নিবারণ শুকনো মুখে হাসি আনিয়া বলিল–ভারি।

আমি বলিলাম–নিবারণ, গিয়েছিলে আর একটু হলে।

তা আর না!

ভয় করছিল?

করবে না? সাক্ষাৎ যম। জানিস মনু, আমি ভাবছিলাম যদি বাঘে থাবা মারে, তবে কোথায় আগে মারবে। কানে যেন না মারে, ক-দিন থেকে আমার কানে ব্যথা। আবার ভাবছি, বাবুদের ওই নতুন ছেলেটা কখনো বনে আসেনি, ওটাকে কেন মরতে নিয়ে এলাম।

আমরাও চুপ করে বসে থাকতাম না নিবারণ। মনু লাফ দিয়েছিল আর একটু হলে।

মনু লাফিয়ে কী করত? নিজে মরত, তোমাকেও মারত বই তো নয়!

অনেক রাত্রে আমরা বাড়ি আসিলাম। পরদিন নিবারণ আসিয়া আমাদের ডাকিল।

বলিলাম–কোথায়?

নেমন্তন্ন খেতে চলো।

কোথায় আবার?

মনু আর তুমি চলো।

তিনজনেই আমরা চলি। অনেক দূর চলি খালের পথে। সুন্দরবনে ডিঙি ছাড়া চলার পথ নাই। সব দিকে ডিঙি, সব দিকে খালের পথ। দুইটি বাঁক ছাড়াইয়া দেখি, একটা উঁচু ট্যাঁকে অনেক লোক একত্র হইয়া কী উৎসব করিতেছে। ডিঙি হইতে নামিতে তাহাদের ভিতর হইতে কয়েকজন আগাইয়া আসিয়া আমাদের বলিল–আসুন বাবু, আপনাকে এনেছে বুঝি নিবারণ? এসো গো মনু সাহেব–

মনু বলিল–আমি সাহেব নই—

তাহারা হাসিয়া বলিল–বেশ, চলে এসো। তুমি যা আছ, তা আছ।

নিবারণকে বলিলাম– কে এরা?

আমাদের গাঁয়ের লোক। আমাদের গাঁয়ের নাম ঝাউতলা। ওরা আজ এখানে এসেছে বনবিবির দরগায় পুজো দিতে।

একজন বলিল–সেজন্যেই বাবু ও জায়গাটার নাম বনবিবির ট্যাঁক।

আমি উহাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আলাপ করিলাম। উহারা বেশ সরল, অমায়িক। একজনের নাম কালু পাত্র। বয়স আমার বাবার চেয়েও বেশি বলিয়া মনে হইল। কিন্তু একেবারে ছোটো ছেলের মতো সরল। আমার সঙ্গে কালু পাত্রের বড়ো ভাব হইয়া গেল। কালু পাত্র আমাকে সঙ্গে করিয়া গিয়া দেখাইল, একটা প্রাচীন কেওড়া গাছের তলায় চার পাঁচটি ছাগল বাঁধা। অনেক মেয়ে-পুরুষ গাছতলায় বসিয়া গল্প করিতেছে। একটা হাঁড়িতে অনেকখানি খেজুর গুড়। এক কলসিভরতি দুধ।

নিবারণকে বলিলাম–পুজো করবে কে?

আমরাই।

পুরুত আসেনি?

না, পুরুত থাকে না। কালু পাত্র সব করবে।

বাজনা বাজিয়া উঠিল। তিনটি ঢোল এবং একাট কাঁসি বাজিতেছিল। একটি মেয়ে গরানফুলের মালা ঢুলির গলায় পরাইয়া দিল। উহাই নাকি নিয়ম। আজ ঢুলিকে সম্মান দেখানো মস্ত বড়ো নিয়ম। ইহাদের পূজার কিছু বুঝিলাম না। কোনো নিয়ম নাই। পাঁচটা ছাগল প্রাচীন দরগাতলায় বলি দেওয়া হইল। সেই মাংস পাক হইল।

কালু পাত্র আমার কাছে আসিয়া বলিল–বাবু, ঝাল খান?

বেশি নয়। কম করে দিতে বলো।

এটা আমাদের বছরের পুজো। বনবিবির দরগায় পুজো না দিয়ে কোনো কাজ হবে না আমাদের।

কী কাজ?

যেকোনো কাজ। আমরা এই জঙ্গলের লোক। বনবিবিকে তুষ্ট না রাখলে বাঘে নিয়ে যাবে।

বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস করেন না, ও-কথা বলবেন না বাবু।

কেন?

আমার চোখে দেখা। এখানে বাস করে বনবিবিকে মানিনে যিনি বলেন, তাঁর মস্ত বড়ো বুকের পাটা।

আমি তো বলছি।

আপনি বিদেশি লোক, আপনার কথা আলাদা। আমরা মোম-মধু সংগ্রহ করি, কাঠ কাটি, এই ভাবে পয়সা জোগাড় করি। জঙ্গলের মধ্যে আমাদের মুখের অন্ন। বনবিবিকে পুজো না দিলে চলে?

আমি বনবিবিকে পুজো করব, যদি তিনি আমার একটা কাজ করেন।

কী কাজ?

সে এখন বলব না। তোমাকে বলব গোপনে।

তারপর সে কী নাচ আর ঢুলির বাদ্য। ঢুলিরাও নাচে, লোকজনও নাচে। অনেক বেলায় সেই প্রাচীন কেওড়াতলায় আমরা খাইতে বসিয়া গেলাম। আমাদের মাথার উপর নীল আকাশ। নীচে দিয়া ভাটার টানে খালের জল কলকল করিয়া পাশের নদীর দিকে চলিয়াছে। নিবারণ ও কালু পাত্র পরিবেশন করিল। মোটা চালের রাঙা ভাত, বেগুনপোড়া ও প্রসাদী মাংস। মাংস প্রচুর দিল, যে যত খাইতে পারে। মেয়েরা আসিয়া আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া যত্ন করিয়া আমাদের খাওয়ার তদারক করিতেছিলেন।

একটি মেয়ে আমাকে বলিলেন–তুমি কে বাবা? কোথায় থাক?

মনু বলিল–আমাদের বাড়ি। কেন?

মেয়েটি থতমতো খাইয়া গেলেন। অপ্রতিভ মুখে বলিলেন–না, তাই বলছি।

মনু বলিল–যাও এখান থেকে—

আমি বাধা দিয়া বলিলাম–কেন, উনি মন্দ কথা কী বলেছেন?

মনু উত্তেজিত স্বরে বলিল–তুমি চুপ করো।

কেন চুপ করব?

আলবৎ চুপ করবে।

মুখ সামলে কথা বলো, মনু।

তুমি মুখ সামলে কথা বলো কিন্তু বলে দিচ্ছি। জান কি, কোথায় এসেছ?

জানি বলেই বলছি! তোমরা ডাকাত, আমাকে চুরি করে এনেছ। আনোনি? তুমিও তাদের সাহায্য করেছ। আমার মা-বাপ নেই, তাঁদের জন্য আমার মন কাঁদে না? তুমি ভেবেছ কী মনু?

যিনি এনেছেন, তাঁর কাছে এসব কথা বলো ভাই, আমি আনিনি।

তুমি জান না কে এনেছে? তুমি কেন তাকে অনুরোধ করো না আমাকে ছেড়ে দিতে?

আমি ছেলেমানুষ, আমার কথা কে শুনবে? তবে একটা কথা তোমায় বলে দিচ্ছি, কখনো আমায় ডাকাত–একথা আর বলবে না। আমি তোমাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসি, তাই বলছি একথা।

বললে না হয় তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে, এ ছাড়া আর কী করবে?

আমাদের কাছে যাহারা আসিয়াছিল, তাহারা বেগতিক বুঝিয়া অনেকে সরিয়া পড়িল ইতিমধ্যে। কিন্তু সেই মেয়েটির কথা কখনো ভুলিব না। তিনি আমাদের কাছে আসিয়া মনুর ও আমার ঝগড়া থামাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

আমাকে বার বার বলিলেন–চুপ করো বাবা–

না, কেন চুপ করব? আমি ভয় করি না।

থামো বাবা থামো!

নিবারণ আসিয়া মনুকে হাত ধরিয়া অন্য দিকে লইয়া গেল। সেই সময় মেয়েটিও চলিয়া গিয়া অন্য মেয়েদের ভাত খাওয়াইতে লাগিলেন। এক সময় আড়চোখে উহাদের দিকে চাহিয়া দেখিয়া মেয়েটি চট করিয়া আমার কাছে আসিলেন। আমার হাত ধরিয়া বলিলেন–এসো—লুকিয়ে–

আমরা গিয়া একটি গোলপাতার ঝোপে দাঁড়াইলাম। তাঁহার প্রসন্ন মুখের দিকে চাহিয়া আমার মাকে দেখিতে পাইলাম। এই বিজন অরণ্যের মধ্যেও বিশ্বের পিতা ভগবান এমন স্নেহরস পরিবেশনের ব্যবস্থা করিয়াছেন।

বলিলাম–কী মা?

তুমি কে বাবা?

আমার নাম নীলু রায়, আমার দাদামহাশয়ের নাম ভৈরবচন্দ্র মজুমদার, বাড়ি পলাশগাছি, জেলা খুলনা। আমাকে ওরা ধরে এনেছে।

কী করে?

আমি সব খুলিয়া বলিলাম। মায়ের মতো স্নেহ পাইয়া এতদিন পরে আমার বড়ো কান্না পাইল। আমার বাবা নাই, জ্ঞান হইয়া অবধি মাকে ছাড়া আর কাহাকেও চিনি না। আমার সে মা আমার অভাবে কী কষ্টই না জানি পাইতেছে! রোজ রাত্রে মার কথা ভাবিয়া আমি কাঁদি। ভগবান ছাড়া আর কে সে-কথা জানে!

মেয়েটি আমার চোখের জল নিজের আঁচল দিয়া মুছিয়া দিলেন।

চুপ করো বাবা, কেঁদো না ছিঃ—

আমি সেজন্যে কাঁদিনি। শুধু ভাবছি মা কেমন করে আছেন—

সব বুঝেছি। আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। একটা কথা বলি—

কী?

তোমার হাতে টাকা আছে?

কিছু না। গলায় সোনার হার ছিল, সে ওরা খুলে নিয়েছে।

মনু জানে?

না। ও ভালো ছেলে। আমাকে খুব ভালোবাসে।

মেয়েটি আঁচলের গিরো খুলিয়া আমার হাতে দুইটি টাকা দিয়া বলিলেন–এই নাও, রাখো।

আমি ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম–না, এ আপনি রাখুন।

নাও না। আমার কথা শোনো।

না।

আবার একগুঁয়েমি। ছিঃ, রাখো!

আমি মেয়েটির মুখের দিকে আবার চাহিলাম। আমার মায়ের গলার স্নেহ-ভর্ৎসনার সুর। না, মেয়েটির মনে কষ্ট দিতে পারিব না, যেমন পারিতাম না আমার মায়ের মনে।

মেয়েটি বলিলেন–এই টাকা যত্ন করে রাখবে। কাজে লাগবে এর পরে।

কী আর কাজে লাগবে! ওরা দেখলে কেড়ে নেবে। আচ্ছা ওরা কী করে–আমাকে নিয়ে কী করবে?

শুনেছি হাটে বিক্রি করে।

কোথাকার হাটে?

যাদের ধরে, তাদের কেনা-বেচার হাটে বেচে। এরা অমন কেনে-বেচে, আমি শুনেছি। মনুর কোনো দোষ নেই। ওর সঙ্গে ভাব রেখো। আমি চেষ্টা করব তোমাকে ছাড়াতে। কিন্তু আমরা ওদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করি। ওদের ভয়ে আমাদের কিছু করবার জো নেই। ওদের তুষ্ট না রাখলে সুন্দরবনে আমাদের কাজ চলবে না। তবুও আমি বলছি, আমি চেষ্টা করব। তোমাকে উদ্ধার করবার যা চেষ্টা দরকার, তা আমার দ্বারা হবে। একথা কিন্তু কারো কাছে প্রকাশ করবে না, কেমন?

ঠিক আছে।

আমি যাই আজ। দাঁড়ান, আপনাকে প্রণাম করি।

না, আমার পায়ে হাত দিও না। আমরা ছোটো জাত।

আপনি মা, মায়ের আবার জাত কী? দাঁড়ান।

আমি প্রণাম করিলাম, তিনি চিবুকে হাত দিয়া চুমু খাইলেন, মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন।

অনেকদিন পরে মনে বল ও আনন্দ পাইলাম। আজ আমার বনবিবির দরগায় আসা সার্থক। কিংবা দয়াময়ী বনবিবিই একটি অসহায় ছোটো ছেলের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন।

রাত্রি অনেক হইয়া গিয়াছিল, আমরা নিবারণের সঙ্গে ফিরিলাম। মনুর দিকে চাহিয়া বলিলাম–আমার ওপর রাগ করেছ ভাই?

মনু বলিল–না।

আমি অন্যায় কথা বলিনি।

ওর সামনে বললে, তাই রাগ হয়েছিল। যা হোক, তুমিও কিছু মনে কোরো না।

ব্যাপারটা মনুকে সব খুলিয়া বলি নাই। কী জানি কী মনে করিবে হয়তো। মগ ডাকাতের ছেলে, উহার মনের খবর আমি সব কি জানি?

জলের ধারের জঙ্গলে হঠাৎ দৃষ্টি পড়িল। হেঁতাল গাছের ঝোঁপ ঠিক জলের ধারেই। কী সুন্দর সাদা ফুল ফুটিয়া আছে ঝোঁপের মাথায়! আমি যেমন সেদিকে চাহিয়াছি, অমনি ঝোঁপের ভিতর হইতে নিঃশব্দে কী একটা আসিয়া জলের ধারে দাঁড়াইল। কালোমতো কী একটা জানোয়ার। চুপ করিয়া দাঁড়াইতে দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি মনুকে দেখাইব ভাবিতেছি, এমন সময় সেটা জলে ঝাঁপ মারিল এবং নৌকার দিকে সাঁতরাইয়া আসিতে লাগিল।

চিৎকার করিয়া বলিলাম–মনু! নিবারণ!

উহাদের সাড়া নাই। ভাটার টানে নৌকা আপনা-আপনি চলিয়াছে, উহারা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে নাকি?

এমন সময় নিবারণ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সবেগে দাঁড়ের বাড়ি মারিল জানোয়ারটার মাথায়। সঙ্গেসঙ্গে ভীষণ গর্জন বাঘের এবং নিবারণ ও মনু দুইদিক হইতে জানোয়ারটার মাথায় দুড়দাড় মারিতে লাগিল। বাঘটা মুখ ঘুরাইয়া ডাঙার দিকে চলিল। তাহার দেহের বেগ শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। ডাঙায় উঠিয়া সেটা হেঁতাল ঝোঁপের মধ্যে মিশিয়া গেল। তারপর একটা আর্ত চিৎকার করিয়া উঠিল।

এতক্ষণে নিবারণ বলিল– উঃ, আজ তোমাকে নিয়েছিল আর একটু হলে!

মনু বলিল–ঝগড়া করতে ব্যস্ত ছিলে, এদিকে যে হয়ে গিয়েছিল! নিবারণ আর আমি দু-জনেই টের পাই। আমরা দাঁড় হাতে তৈরি ছিলাম। তুমি চেঁচিয়ে উঠে সব মাটি করলে। আরও কাছে এলে ওটার মাথার খুলি গুড়ো করে দিতাম।

নিবারণ বলিল–আমার মনে হয় ওটা ঘায়েল হয়েছে। কাল খুঁজতে হবে এই ঝোপে। ওঃ, আজ তোমাকে যমের মুখ থেকে বাঁচানো হয়েছে।

মনু বলিল–উঃ, আর একটু হলে কী সর্বনাশ হত!

দেখিয়া খুশি হইলাম–আমার বিপদ হইতে উদ্ধারের জন্য উহারা সকলেই সুখী। পরদিন সকালে একটু রৌদ্র উঠিলে আমরা ডিঙি করিয়া সেই হেঁতালঝোঁপ খুঁজিতে গেলাম। অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজিয়াও কোথাও মৃত বাঘের চিহ্নও পাইলাম না। নিবারণ এক স্থানে রক্তের দাগ পাইল বটে, বাঘের থাবার দাগও দেখা গেল কিন্তু কিছু দূর পর্যন্ত, তারপর যেন বাঘটা হঠাৎ আকাশপথে উড়িয়া গিয়াছে।

মনু বলিল–কী ভাই নিবারণ, বাঘ কোথায় গেল?

তাই তো! পায়ের দাগ কোথায় গেল?

বাঘ এখানেই আছে, কোথাও যায়নি।

তা হয় তো খুঁজে বার করো।

নিবারণ এইবার খুঁজিয়া খালের ধারের কাদায় আসিয়া কী একটা চিহ্ন দেখিয়া উত্তেজিত সুরে বলিল–শিগগির এসো, বাঘ পাওয়া গেছে।

আমরা ছুটিয়া গেলাম। কই বাঘ? কোথায়? কিছুই তো আমাদের চোখে পড়ে না। নিবারণ একটা শুকনো হিজলপাতার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল–ওই দেখছ না! রক্তমাখা হিজলপাতাটা বাঘের থাবায় উলটে গিয়েছে? থাবার রক্ত?

মনু বলিল–বাঘ কোথায়?

–বাঘ ওপারে! ডিঙিতে ওঠো– কোথায় আছে, আমি বুঝতে পেরেছি।

ডিঙিতে খাল পার হইয়া মস্ত বড়ো একটা বেতঝোঁপ। তাহার পাশে একটা ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ। সেই ঘন জঙ্গলে ইটের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ কোথা হইতে আসিল। আমি খুব অবাক হইয়া গেলাম। নিবারণকে বলিলাম কথাটা? তাহার বা মনুর এ সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহল দেখিলাম না।

নিবারণ বলিল–অত কথায় আমাদের দরকার কী বাপু? যা করতে এসেছ তাই করো।

দেখতেও তো এসেছি।

দেখবে আবার কী?

কারা এই জঙ্গলে বাড়ি করেছিল, এটা জানবার কথা নয়?

বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছি, দেবতারা করেছিল।

দেবতাদের কী গরজ?

তা জানি নে বাপু, যা শুনেছি তাই বললাম।

ব্যাস! ইহার বেশি উহাদের কৌতূহলের দৌড় নাই, ও কী করিবে? আমরা সেই ইষ্টক স্থূপে উঠিয়া এখানে-ওখানে খুঁজিতেছি, এমন সময়ে নিবারণ বিজয়গর্বে চিৎকার করিয়া বলিল–ওই যে!

গিয়া দেখি এক জায়গায় ইটের আড়ালে বাঘটা মরিয়া পড়িয়া আছে। হাঁ করিয়া উঁচু দিকে মুখ করিয়া দাঁতের পাটি বাহির করিয়া চিত হইয়া শুইয়া আছে।

মনু এক লাফে বাঘটার কাছে যাইতেই নিবারণ সতর্ক চিল্কারে তাহাকে সাবধান করিয়া দিল।

মরবে! মরবে! খবরদার।

তাই মনু বাঁচিয়া গেল।

সে এক অদ্ভুত ও ভীষণ দৃশ্য। মৃত বাঘটা হঠাৎ এক লম্ফে চিত অবস্থা হইতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। পরক্ষণেই একটা লাফ দিল আমার দিকে।

আমার দূরত্ব ছিল তাহার লাফের পাল্লার বাহিরে, তাই রক্ষা পাইলাম। মনু মরিত যদি নিবারণ তাহাকে সতর্ক না করিত। বাঘটার সেই শেষ লাফ– সেই যে মাটিতে পড়িয়া গেল, আর উঠিল না। আমরা দেখিলাম, নিবারণ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ। সে এখনও আমাদের বারণ করিতেছে–খবরদার, বিশ্বাস নেই, ও হল সাক্ষাৎ যম, ওর কাছেও যেও না। আগে দেখি ভালো করে—

নিবারণ ভূপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত বাঘটার গায়ে একটা ঢিল মারিল।

আমি বলিলাম–নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছ—

নিবারণ আর একটা ঢিল ছুড়িল। এবারও বাঘ নড়িল না। তখন আমরা সবাই মিলিয়া কাছে গেলাম। বাঘের মাথার পিছন দিকে নিবারণের দাঁড়ের জবর ঘা লাগিয়া খুলি চিরিয়া ঘিলু ঝরিতেছে। বাঘের শক্ত প্রাণ বটে! এ অবস্থাতেও অমন লাফ দিতে পারা সোজা শক্তির কথা! মস্ত বড়ো বাঘ। আমরা তিনজনে সেটাকে টানিয়া-হেঁচড়াইয়া জলের ধারে আনিলাম। ডিঙিতে উঠানো বড়ো কঠিন কাজ। এক হাঁটু কাদার মধ্য দিয়া অত বড়ো ভারি মৃত জন্তু ডিঙি পর্যন্ত নেওয়াই মুশকিল।

বলিলাম–এটা এখানে থাক, চলো লোক ডেকে আনি—

নিবারণ বলিল–তা থাকবে না, চামড়া নষ্ট হবে—

কীসে?

এখুনি শকুন পড়বে এর ওপর, চামড়াখানা যাবে। সুন্দরবনে শেয়াল নেই।

তবে আমি আর মনু থাকি, তুমি যাও।

এই বনে তোমাদের রেখে যেতে সাহস করিনে। তোমরা জঙ্গলের জান কী? কতরকম বিপদ ঘটতে পারে, তুমি কী খবর রাখ? দেখি দাঁড়াও, একটা মোটা ডাল–

এমন সময় খাল দিয়া আর একখানা ডিঙি যাইতে যাইতে আমাদের ও-অবস্থা দেখিয়া থামিল। নিবারণের মুখে সব শুনিয়া বলিল–বা রে ছোকরার দল। বলিহারি সাহস! সুন্দরবনে দাঁড় দিয়ে বাঘ মারা এই নতুন শোনা গেল বটে।

আমরা বলিলাম বাঘের মৃতদেহটা ডিঙিতে তুলিতে সাহায্য করিতে। তাহারা আমাদের সঙ্গে বাঘটা আমাদের ডিঙিতে তুলিয়া দিয়া গেল।

আমি তাহাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম–এ কোথাকার নৌকো?

সরষেখালির।

সে কত দূর?

পাঁচ-ছ ক্রোশ এখান থেকে।

যাবেন কোথায়?

আমরা বড়ো চরের ট্যাঁকে মাছ ধরতে যাব। তুমি কোথায় থাক বাবু?

মনু আমার গায়ে ধাক্কা দিয়া বলিল–চলো চলো, বাজে কথা বলে লাভ নেই। ও আমাদের বাড়ির ছেলে। কেন, কী দরকার তোমাদের?

কেন, বললে দোষ কী?

না, বলার দরকার নেই। আমি ভালো ভাবেই তোমায় বলছি, ওতে আমাদের বিপদ হতে পারে।

কী বিপদ?

পুলিশে ধরবে আমার বাবাকে। বুঝলে?

আমি কথা বলিলাম না! বুঝিলাম মনুর সঙ্গ আমাকে ছাড়িতে হইবে। ও আমায় নজরবন্দি রাখিয়াছে–পাছে ওর বাবা বিপদে পড়েন, পাছে আমি পালাই। এ জীবন আমার মন্দ লাগিতেছে না। মনুকে আমি ভাইয়ের মতো ভালোবাসি। কিন্তু আমার মায়ের কাছে যাইতে আমার কী আকুল আগ্রহ, ও তাহার কী বুঝিবে?

সেদিন হইতে মনু আমার প্রতি খুব প্রসন্ন হইল। আমাকে ভাগ না দিয়া কোনো জিনিস খায় না, কোথাও গেলে আমায় সঙ্গে না লইয়া যায় না।

একদিন আমাকে বলিল–তোমাকে একটা নতুন জিনিস দেখাব–চলো যাই–

সেদিন নিবারণ আমাদের সঙ্গে ছিল না, শুধু আমি আর ও। আমি দাঁড় টানি, ও হাল ধরে। অবশ্য খালের ভিতর দিয়া যাইতে হাল ধরিতে কোনো কষ্ট নাই।

কিছু দূরে গিয়া দু-জনে জঙ্গলের মধ্যে নামিলাম। বড়ো বড়ো গোলপাতা গাছ জঙ্গলের ধারে নত হইয়া আছে। বেত ডাঁটার অগ্রভাগ ভাটার টানে দুলিতেছে। বাতাবি লেবুর মতো সেই ফলগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়িয়া গাছতলায় গড়াগড়ি যাইতেছে। বাঁদরের পাল হুপ হুপ করিয়া এগাছে-গাছে লাফালাফি করিতেছে। ইহারা মুখপোড়া হনুমান জাতীয় বানর নয়, রাঙামুখ বুপীবাঁদর। হনুমান হইতে আকারে কিছু ছোটো।

একস্থানে গিয়া মনু বলিল– চেয়ে দেখো, তুমি অবাক হয়ে যাবে।

কী দেখব?

এগিয়ে চলো।

সত্যিই অবাক কান্ড!

সেই ঘন বনের মধ্যে প্রকান্ড একটা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। শুধু একটা বাড়ি নয়, আশপাশে আরও অনেক বাড়ির চিহ্ন দেখা যাইতেছে। বড়ো বড়ো পাথরের খিলান খসিয়া পড়িয়াছে, দুর্ভেদ্য বেতজঙ্গলে পাথরে কড়ির হাঙরমুখ ঢাকা পড়িয়াছে। মনু বলিল–আরও দেখবে?

হুঃ।

চলো রানির জঙ্গল দেখিয়ে আনি—

কত দূর?

এখান থেকে দূর আছে। বাঘের ভয় আছে পথে।

–চলো যাব।

কিন্তু বেশি দূর যাইতে-না-যাইতে আর একটি বড়ো বাড়ির ধ্বংসস্তূপে আমাদের পথ আটকাইয়া গেল। বড়ো বড়ো পাথর ও ইটের জমাট চাঁই, বেতলতার শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ। এক স্থানে একটা মন্দির। মন্দিরের ছাদটা দাঁড়াইয়া আছে, অন্ধকার গর্ভগৃহে মনে হইল এখনও বিগ্রহ জীবন্ত।

মনু তাড়াতাড়ি বলিল–ও কি? কোথায় যাও? ঢুকো না, ঢুকো না। আমি ততক্ষণে ঢুকিয়া পড়িয়াছি। মন্দিরের বহু শতাব্দীর জমাট অন্ধকারে দেবতার বেদি আবিষ্কার করিতে পারিলাম, মনে হইল কোন অতীতকালের বাংলায় পূজাবেদিতে অর্ঘ্য সাজাইয়া নিবেদন করিতে আসিয়া পথভ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি–সে অতীত দিনে ফিরিয়া যাইবার সকল পথ আজ আমাদের রুদ্ধ।

কে আমাকে হাত ধরিয়া সে বাংলায় ফিরাইয়া লইয়া যাইবে?

কেহ নাই।

আমাদের সে অতীত দিনের পূর্বপুরুষদের আজ আমরা আর চিনিতে পারিব না।

তাহারাও আমাদের আর চিনিতে পারিবে কি তাহাদের বংশধর বলিয়া?

হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কীসের গর্জন শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। মনু বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে, সে আমাকে দেখিতে পাইতেছে না ভগ্নদেউলের অন্ধকারে।

বিকট ফোঁস ফোঁস শব্দে অন্ধকার যেন আমার দিকে দাঁত খিচাইতেছে, কোথায় আছে কালসর্প আমার অতি কাছে, এই ঘন আঁধারের মধ্যে সে আমার জীবনলীলার অবসান বুঝি করিয়া দিল! উচ্চরবে আর্তকণ্ঠে ডাকিলাম–মনু! মনু! সাপ! সাপ! শিগগির এসো–

আমার ডান পায়ের পাশেই আবার সেই ফোঁস ফোঁস শব্দ এবং সঙ্গেসঙ্গে আমার গায়ে কে যেন শক্ত লাঠির ঘা বসাইয়া দিল। আবার ফোঁস ফোঁস শব্দ।

মনু আসিয়া বলিল– কী? কী?

খেয়ে ফেললে, বড়ো সাপ!

সরে এসো। এক লাফে ওই ইটের ওপর উঠে যাও।

সঙ্গে সঙ্গে আমার ডান পায়ে আর একটা লাঠির বাড়ি এবং ঝাঁটার কাঠি ফোঁটানোর মতো বেদনা। একটা মস্ত ইট কী পাথর ছোঁড়ার শব্দ শুনিলাম। মনু বোধ হয় কালসর্পের দিকে ছুড়িয়া মারিল। আমার কাছে ছুটিয়া আসিয়া বলিল–কামড়েছে?

হুঁ।

কোথায়? চলো তাড়াতাড়ি বাইরে! এক-শো বার বারণ করলাম, ওর মধ্যে ঢুকো না। আমার সব কথা তোমার টক লাগে!

এখন ভাই কথা বোলো না বেশি। চলো বাইরে যাচ্ছি।

আমি ধরে নিয়ে যাই।

কিছু না, আমি নিজে যেতে পারব।

দুইটা ছোটো ছিদ্র দেখা গেল গোড়ালির কাছে। মনু আমার কোমরের কাপড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া তিনটি শক্ত বাঁধন দিল। তারপর আমার হাত ধরিয়া ডিঙিতে উঠাইয়া অতি দ্রুত ডিঙি বাইতে লাগিল–কিন্তু উলটো দিকে, যেদিকে বাড়ি সেদিকে নয়। আমি ভুল দেখিতেছি না তো?

বলিলাম–ভাই মনু—

চুপ–

আমার শেষ হয়ে এসেছে—

আবার!

মার সঙ্গে ভাই দেখা হল না–

আঃ—

–তুই আমার বড়ো বন্ধু ছিলি—

–আবার বকে! চুপ!

আমার মনে হইল আমরা উলটো দিকে চলিয়াছি। আগেই মনে হইয়াছিল–বলিয়াছি। ও কোথায় চলিয়াছে পাগলের মতো এ অন্ধকারের মধ্যে দিয়া?

একটা জায়গায় ডিঙি রাখিয়া সে আমাকে নামাইয়া লইল। জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় গোলপাতায় ছাওয়া একখানা কুটির। কুটিরের সামনে গিয়া সে ডাকিল–ওস্তাদজি, ওস্তাদজি—

ঘর হইতে বাহির হইয়া আমাদের সামনে যে আসিল তাহাকে দেখিয়া হাসিব কি কাঁদিব বুঝিতে পারিলাম না। লোকটা কি যাত্রাদলের নারদ? কারণ সেইরকমই সাদা লম্বা দাড়ি, তাহার বয়স যে কত তাহা আমার বুঝিবার কথা নয়। তবে সে যে অতি বৃদ্ধ, এ বিষয়ে কোনো ভুল নাই।

বৃদ্ধ আসিয়া অন্ধকারের মধ্যে আমাদের দেখিয়া ভয় পাইয়া গেল। থতমতো খাইয়া বলিল–কে বাবা তোমরা?

মনু বলিল–আমি। ভালো করে চেয়ে দেখো। আমার এই ভাইকে জাতসাপে কামড়েছে। সময় নেই–একে বাঁচাও।

ওস্তাদ তখনি আমার কাছে আসিয়া বলিল–দেখি দেখি, কোথায়?

এই যে, দাঁতের দাগ দেখো।

ঠিক।

বাঁচবে?

তেনার হাত, আমি কী জানি? যা বলি তা করো।

বলো।

একে আরও বাঁধন দিতে হবে; দড়ি দিচ্ছি।

আমাকে ইহারা দুজনে মিলিয়া কী কসিয়াই বাঁধিল! এ যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু বোধ হয় ভালো ছিল।

হঠাৎ কানে গেল মনু বলিতেছে–ঘুমিও না ভাই–এই, ঘুমিও না—

ঘুমাইতেছি? কে বলিল?

কিন্তু পরক্ষণেই আমার মনে হইল দেশের বাড়ির দাওয়ায় আমি বসিয়া আছি। মা একবার আসিয়া বলিলেন–কী হয়েছে নীলু, বাবা আমার, কোথায় কী হয়েছে দেখি?

মা আমায় গায়ে তাঁহার পদ্মহস্ত বুলাইয়া দিলেন। তারপর একথালা গরম ভাত ও মাগুরমাছের ঝোল আনিয়া আমায় খাওয়াইতে বসিলেন।

আমি বলিলাম–মা তোমাকে কত দিন দেখিনি—

মা হাসিলেন, কী প্রসন্ন হাসি!

বলিলাম–ওরা ধরে রেখেছিল, তোমার কাছে আসতে দিচ্ছিল না। এই সময়ে আরও অনেক লোক আসিল আমাদের পাড়ার। বিলু পিসি, কার্তিক, সুনু, বৃন্দাবনদা। উহারা আমায় দেখিয়া বড়ো খুশি। সকলেই বলিল–ওমা, আমাদের নীলু যে আবার ফিরে এসেছে! ও নীলু? নীলু?

আমি তন্দ্রা থেকে জাগিয়া উঠিলাম যেন। না, কেহ কোথাও নাই। মনু আমার চুলের ঝুটি ধরিয়া টানিতেছে আর বৃদ্ধ ওঝা আমার পায়ের উপর ছপাৎ ছপাৎ বেতের বাড়ি মারিতেছে।

মনু উহাকে জিজ্ঞাসা করিল–কীরকম বুঝছ ওস্তাদজি।

ওস্তাদ বৃদ্ধ বলিল–আশা আছে। ঘুমিয়ে না পড়ে আবার! ঘুমোলে চলবে না–ঘুমের মধ্যেই মরে যাবে। আমাকে ডাকিয়া বলিল–জলতেষ্টা পাচ্ছে?

–হুঁ।

–মনু, ওকে গরমজলটা খাইয়ে দাও এবার।

–তুমি ততক্ষণ মারো বেত। এই দেখো ঢুলছে—

দু-জনে মিলিয়া কী মার আমায় মারিল আর কী পরিশ্রমটাই করিল। ছেলের জন্যে বাবা যেমন কষ্ট ও চেষ্টা করে, বৃদ্ধ ওঝা তাহার চেয়ে একটুও কম কষ্ট আমার জন্যে করেনি।

মনু বলিল–ওস্তাদজি, এবার কী মনে হয়?

হয়ে গেল।

শেষ হয়ে গেল?

আমাদের কাজ শেষ হল।

বেঁচে গেল তো?

আলবৎ। নইলে আর ওঝাগিরি করব না।

বেলা হইল। গাছের মাথায় প্রাতঃসূর্যের রোদ পড়িয়াছে। বসন্তবৌরি পাখির ডাক শোনা যায় বনের মধ্যে। অনেকক্ষণ আগে বাঁধনগুলি কাটা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার পা অবশ, কসিয়া বাঁধন দেওয়ার ফলে আমার পা আড়ষ্ট–হাঁটিবার উপায় নাই।

ওস্তাদ খাইতে দিল আমাকে। একটা পাতায় গরমভাত ও গরম ফ্যান, জংলি গোঁড়া লেবু একটা আস্ত আর নুন। কোনো উপকরণের বাহুল্য নাই। সেই ভাত আর লেবুর রস সোনা হেন মুখ করিয়া খাইলাম। ডিঙিতে উঠিবার সময় ওস্তাদ বৃদ্ধকে নমস্কার করিয়া বলিলাম–আবার আসব।

অবশ্য আসবে, বাবা।

তুমি খুব বাঁচা বাঁচিয়েছ আজ।

তেনার হাত, তিনি বাঁচিয়েছেন।

ডিঙি বাহিয়া যাইতে যাইতে কেবলই মনে হইতেছিল, এ আমার জীবনের এক নতুন প্রভাত। মানুষের মধ্যে যে ভগবান বাস করেন, তাহা আজ বুঝিয়াছি। নতুবা মনু আমার কে? কেন সে এত প্রাণের টান দেখাইল আমাকে বাঁচাইতে? বৃদ্ধ ওঝা আমার কে? কেন সে সারারাত্রি জাগিল আমায় জীবন দিতে? মনুকে আজ নতুন চোখে দেখিতেছি। ও আমার ভাই। উহাদের কাছে সারাজীবন থাকিতে পারি। মা না থাকিলে নিশ্চয় থাকিতাম।

মনু বলিল–ভালো মনে হচ্ছে!

হুঁ।

বলছিলে যে শেষ হয়ে গেল।

তুমি না থাকলে তাই হত। তুমি আমার ভাই।

থাক। কাল না কত কথা বলছিলে, মনে নেই?

সেসব ভুলে যা মনু। দুই-ভাইয়ের মতো থাকব এখন থেকে।

একটা কথা।

কী?

বাড়ি গিয়ে এসব কথা কিন্তু বলতে পারবে না মাকে বা বাবাকে। কেমন?

তুমি যা বলবে ভাই। বললাম তো, তুমি আমার ভাই আজ থেকে।

মনু কথার উত্তর না দিয়া একটুমাত্র হাসিল।

ইতিমধ্যে শীতকাল পড়িল। জঙ্গলের মধ্যে বর্ষার কাদা অনেকটা শুকাইয়া আসিল। পাশের নদীর দুইধারের ঝোপে পেতনিপোতার সাদা ফুল পেঁজাতুলার রাশির মতো শোভা পাইতে লাগিল। এই সময় মনুর বাবা দেখি বজরা সাজাইয়া অস্ত্রশস্ত্র লইয়া রোজই কোথায় বাহির হইয়া যায়। অনেক রাত্রিতে ফেরে। আমাদের ঘরে অনেক কাপড়চোপড়, খাবার জিনিস আর ধরে না।

একদিন মনুকে বলিলাম কথাটা।

মনু বলিল–ভাই, আমাকেও তো বড়ো হলে ওই করতে হবে। বাবাকে বারণ করব কেন?

তুমি আমার ভাইয়ের মতো। তোমাকে আমি ভালো পথে নিয়ে যেতে চাই।

তা হবে না। বাবা যা বলেন তাই হবে, তবে একটা কথা।

কী?

বাবা বলছিলেন, ক্রমে পুলিশের ভয় বাড়ছে। এ কাজ আর চলবে না?

তবে?

কী করি বলো তুমি।

আমি পথ বলে দিতে পারি। সে-কথা কি তোমার বাবা শুনবেন? লেখাপড়া শেখো। কানাইডাঙায় ডাক্তারবাবু স্কুল খুলেছেন। সেখানে ভরতি হও। কী করে খাবে দেখতে হবে তো?

তুমি বাবাকে বোলো। নিবারণ আমাদের লইয়া মাছ ধরিতে চলিত রোজই দুপুরের পর। এদিনও আসিল। বলিল –একটা জিনিস তোমাকে দেখাব। ফাঁদে বাঘ পড়ে না, বলেছিলে না?

বলিলাম–পড়েছে নাকি?

চলো দেখবে।

দূর হইতে দেখিলাম চার-পাঁচখানা ডিঙি পশোর নদীর দিকে চলিয়াছে। আমাদের ডিঙিও সেগুলির পিছনে পিছনে চলিল। নিবারণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, উহারা মাছ ধরিতে চলিয়াছে।

কিন্তু সেদিন অমন বিপদে পড়িতে হইবে জানিলে বোধ হয় নিবারণের সঙ্গে যাইতাম না।

পশোর নদীর মধ্যে গিয়া দেখি সেখানে আরও অনেক জেলেডিঙি। ইহারা ডাঙায় নামিয়া রান্না করিয়া খাইতেছিল। আমরা জাল ফেলিতেই মস্ত বড়ো একটা দয়ে-ভাঙন জালে আটকাইল। মাছটার ওজন আধ মণের উপর। দয়ে-ভাঙন সামুদ্রিক মাছ, এতদিন ইহাদের মধ্যে থাকিবার ফলে আমি এই মাছ চিনিয়াছিলাম। খাইতে খুব সুস্বাদু। অন্য সামুদ্রিক মাছ আমার মুখে রুচিত না, কেবল এই মাছ ছাড়া।

মাছটা ডিঙিতে তুলিতে গিয়া ডিঙি কাত হইয়া গেল।

কীভাবে পা পিছলাইয়া আমি জলে পড়িয়া গেলাম, সঙ্গেসঙ্গে সেই মস্ত মাছটা আমার দিকে তাড়া করিয়া আসিল; দয়ে-ভাঙন মাছ মানুষকে তাড়া করে কখনো শুনি নাই; চিৎকার করিতেই নিবারণ দাঁড় তুলিয়া মাছটার গায়ে এক ঘা মারিল। সেটা একবার ঝাঁপটা মারিতেই জালের দড়ি ছিঁড়িয়া গেল। মাছ আসিয়া আমার হাঁটু কামড়াইয়া ধরিল। আমি ডিঙির কানা ধরিতে চেষ্টা করিলাম, নাগাল পাইলাম না। মাছটার টান এবং ভাটার টানে মিলিয়া আমাকে ডিঙি হইতে দূরে লইয়া ফেলিল। একবার এক ঝলক লোনা-জলের খাবি খাইয়া বুঝিলাম মাছ আমাকে জলের তলায় লইবার চেষ্টা করিতেছে।

সেই সময় নিবারণ চিৎকার করিয়া অন্য ডিঙির লোকেদের ডাক দিল। একজন দূর হইতে এই ব্যাপার দেখিয়া এই দিকে ডিঙি বাহিয়া দ্রুত আসিতেছিল।

এসব এক মিনিটের মধ্যে ঘটিয়া গেল। পরের মিনিটে মনে হইল, আমি একটা অন্ধকার অতলস্পর্শ গুহার দিকে চলিয়াছি। গুহাটা ক্রমশ বড়ো হইতেছে, ক্রমশ আমাকে গিলিয়া খাইতে আসিতেছে।

অনেক লোক মিলিয়া কোথায় যেন চিৎকার করিতেছে শুনিলাম। তারপর আমি নিজের চেষ্টায় গুহা হইতে জোর করিয়া মাথা উঠাইয়া আবার দেখি সামনে বিস্তৃত পোের নদী, ওপারের সবুজ গোলগাছ ও হেঁতালঝোঁপের সারি। অস্পষ্ট দেখাইতেছে দূরের তটরেখা। নদীর বুকে রৌদ্র চিকচিক করিতেছে।

কে একজন বলিয়া উঠিল কানে গেল–বেঁচে আছে! বেঁচে আছে।

আমি আশ্চর্য হইয়া ভাবিলাম– কে বাঁচিয়া আছে, কাহার কথা বলিতেছে ডিঙির লোকেরা?

অমনি আবার বুঝিলাম মাছটা আমাকে একটা প্রবল ডানার ঝাঁপটা মারিয়া অবশ করিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল। আমার হাঁটু তখন মুক্ত, যে কারণে হউক, মাছটা আমাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। এবার কামড়াইবার পূর্বেই আমাকে ডিঙিতে উঠিতেই হইবে। জলের জানোয়ার জলে বাঘের মতো শক্তি ধরে। আমি সেখানে অসহায়। এবার আমাকে ডুবাইয়া মারিবে।

আমি সাঁতার দিয়া ডিঙির দিকে আসিবার চেষ্টা করিতেই আর একটা ভীষণ ডানার ঝাঁপটা খাইলাম। এবারের ঝাঁপটায় আমার সারাদেহ যেন অবশ হইয়া গেল। আমি দুই-পা জলের উপর ভাসাইয়া জল ঠেলিয়া ডিঙির কাছে আসিতে চেষ্টা করিলাম।

অনেকগুলি হাত একসঙ্গে আমাকে টানিয়া ডিঙির উপর তুলিয়া লইল। ডিঙির উপর উঠিতেই আমি হাঁটুর নীচে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করিলাম। এতক্ষণ যন্ত্রণা বুঝিতে পারি নাই। হাঁটুর নীচে চাহিয়া দেখি, রক্তে সে জায়গাটা লাল হইয়া গিয়াছে।

নিবারণ বলিল–এঃ, কী কামড় দিয়েছে দেখো!

যন্ত্রণায় আমি মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া পড়িতেছিলাম–মাঝে মাঝে জ্ঞান হইতেছিল। অনেকে কী সব শিকড়-বাকড়ের রস মাখাইতে লাগিল, বাঁধাবাঁধি করিল। যখন ভালো জ্ঞান হইল, তখন দেখি মনু আমার শিয়রে। আনন্দে উহার হাত জড়াইয়া ধরিয়া বলিলাম–ভাই মনু, আমি কোথায়?

চুপ করো। তুমি বাড়িতে।

কী করে এলাম?

কাল রাতে দিয়ে গিয়েছে।

সে কী কথা! কাল রাত্রির কথার মানে বুঝিলাম না। দুপুরে আমাকে মাছে কামড়াইয়াছিল জানি। এতক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল না–

বলিলাম–এখন বেলা কত?

বিকেল হয়েছে।

মাছটা মারা হয়েছে?

কোন মাছ?

যে মাছ আমাকে কামড়েছিল?

তোমাকে মাছ কামড়ায়নি।

কে কামড়ে ছিল?

হাঙরে।

সে কী? আমি যে দেখলাম দয়ে-ভাঙন মাছ জালে পড়ল—

সেটা দয়ে-ভাঙন নয়, সেটা মস্ত ভীষণ মানুষ-খেকো হাঙর।

আমায় সারাদেহ শিহরিয়া উঠিল, চৈতন্য আবার লোপ পাইবার উপক্রম হইল। হাঙরের হাতে পড়িয়া কী করিয়া বাঁচিয়া ফিরিলাম? সর্বনাশ! বাঁচিয়া আছি তো?

ডাকিলাম–ও ভাই মনু—

কথা বোলো না!

হাঙর কী করে জানা গেল? কে বললে হাঙর?

সেটা মারা পড়েছে। কাল দেখো তার পেটে একটা মানুষের হাতের বালা পাওয়া গিয়েছে। হাঙর মিষ্টি জলেও যায়। কোনো গ্রামের কাউকে ধরেছিল–ছোটো মেয়ের হাতের বালা।

দেখি বালাটা?

না, এখন চুপ করে থাকো। কাল সব দেখাব।

পরদিন অনেকখানি সুস্থ হইয়া উঠিলাম। নিবারণ আসিয়া বলিল–বাঘ দেখেছ? ফাঁদে পড়েছিল যে–

কোথায় বাঘ?

তোমাকে যে বাঘ প্রায় শেষ করেছিল হে! জলের বাঘ!

তুমি কি আমাকে ওই বাঘ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে?

, ডাঙার বাঘও দেখাবো। দাঁড়াও জলের বাঘ দেখাই।

নিবারণ সেই প্রকান্ড হাঙর আমার সামনে টানিয়া আনিল। তাহার বিকট দশনপাটি দেখিয়া বুঝিলাম কাল জলের মধ্যে আমার কী বিপদ গিয়াছে। এই ভীষণ বাঘের হাত হইতে নিতান্ত যে রক্ষা পাইয়াছি, তাহা ভগবানের দয়া।

মনু বলিল–এই দেখো সেই বালা। এর আসল দাঁত তুমি দেখোনি। চামড়ার খাপে ঢাকা থাকে, এই দেখো দেখাই।

ছোট্ট বালা দুইটি হাতে করিয়া কষ্ট হইল। কোন বালিকার প্রাণনাশ করিয়াছে এই হিংস্র নরখাদক জানোয়ারটা? দেখিতে অবিকল দয়ে-ভাঙন অথবা আড়মাছের মতো। কে জানে সেটা অত ভীষণ জানোয়ার! খাপে ঢাকা উহার ছেদনদন্তগুলি ক্ষুরের মতো তীক্ষ্ণ ও ভয়ানক।

পায়ের নীচের দিকে চাহিয়া দেখি অনেকটা পটি দেওয়া বাঁধা। এক মাস পরে জংলি লতাপাতার রস মাখাইতে মাখাইতে ঘা সারিয়া গেল। সকলে বলিল, পুনর্জন্ম! কারণ হাঙরের দাঁতের বিষে ঘা পচিয়া মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এদেশে প্রবাদ আছে–কুমিরে নিলে বরং বাঁচে, হাঙরের ঘায়ে সাবাড়!

রোগশয্যায় শুইয়া বড়ো দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি।

বাড়ি হইতে বেশিদূর কোথাও যাই না আজকাল। একটা কেওড়া গাছের ছায়ায় বসিয়া ছবি আঁকি মনে মনে, নয়তো মনুর সঙ্গে গল্প করি। বই পড়িতে ভালোবাসি–কিন্তু এখানে বাংলা বই কোথায়? দেশে আমার বাবার কত ভালো ভালো বই আছে–এখন মনে পড়িল। সেদিন বিকালে কেওড়াতলায় বসিয়া বড়ো মন খারাপ হইয়া গেল। যদি এযাত্রা মরিয়া যাইতাম তবে মার সঙ্গে দেখার আশাও চিরতরে লুপ্ত হইত। মা কী ভাবিতেছেন কী জানি? তিনি কি রোজ আমার কথা ভাবিয়া চোখের জল ফেলেন না? মনু পিছন হইতে আসিয়া চোখ টিপিয়া ধরিল।

ছেড়ে দাও হে, আমি জানি।

কী ভাবছ?

উহার দিকে চাহিয়া বলিলাম–জান না?

সে বলিল–জানব কী করে?

খুব জান!

বাড়ির কথা তো?

তবে? মার কথা!

মনু চুপ করিয়া গেল। আমার বড়ো দুঃখ হয়, আমার দুঃখের কথায়, কষ্টের কথায় ও সহানুভূতি দেখায় না কেন? মনু আমাকে বলিল–আমাকে লেখাপড়া শেখাবে? আমি বলিলাম–বাংলা না ইংরেজি? মগ-ভাষা তো জানি নে। কত গল্প হইত দু-জনে। সবই ভালো। কিন্তু বাড়ির কথা বলিলে মনু চুপ হইয়া যায়। কিছুক্ষণ বসিয়া সে চলিয়া গেল। তারপরে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। আমার পিছন হইতে কে আসিয়া আমার মাথায় হাত দিল। চমকিয়া পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলাম সেদিনকার বনবিবিতলার সেই মা! আমার হাতে একছড়া পাকা কলা ও চারিটি বড়ো মুড়ির মোয়া দিয়া বলিলেন–তোমার জন্যে এনেছি, খাও। সব শুনলাম নিবারণের কাছে, হাঙরে নাকি ধরেছিল তোমায়?

অবাক হইয়া মার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম–হুঁ।

কোথায় দেখি?

এই যে হাঁটুতে।

আহা হা, কী সর্বনাশ!

তিনি আমার পাশে বসিয়া অনেক ভালো ভালো কথা বলিলেন। আমাকে কলা ও মুড়ির সব মোয়াগুলি খাওয়াইলেন, আমার নিজের মা আজ এখানে থাকিলে এরকমই করিতেন। এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলেন–তোমাকে বাড়ি পাঠাবার চেষ্টা করেছি অনেক, কিন্তু পেরে উঠছি না। এদের সবাই ভয় করে কিনা।

আমি বলিলাম–কী চেষ্টা করেছেন?

ডিঙি ভাড়া করে তোমাকে পাঠাবার চেষ্ট করেছি, কেউ যেতে চায় না।

দরকার নেই এখন। আপনার কোনো বিপদ হয় এ আমি চাই না।

কতদিন হল এনেছে তোমায়?

তিন বছর হয়ে গিয়েছে। তেরো বছর বয়সে এনেছিল, এখন আমার বয়েস ষোলো।

আহা-হা! কী করে আছেন তোমার মা? তোমার যেতে ইচ্ছে হয় তো?

অনেক সয়ে গিয়েছে মা। আপনাকেই মা বলে ডাকি।

তিনি হাসিয়া আমার মাথায় হাত দিয়া আদর করিলেন। আমার জন্যে আবার খাবার লইয়া আসিবেন বলিলেন। আমি কি খাইতে ভালোবাসি–মুড়ির মোয়া? মাছের তরকারি? উহারা মগ–মাছের তরকারি রান্নার কী জানে? তিনি ভালো ভাবে তরকারি রান্না করিয়া আমাকে খাওয়াইতে আসিবেন! মা চলিয়া গেলেন।

কতক্ষণ পর্যন্ত আমি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলাম সে-দিকে।

মনু একদিন আমায় বলিল–ভাই, তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে। চলো নিবারণ আসবার আগে আজ আমরা ডিঙি নিয়ে বার হই।

পশোর নদীর মধ্যে পড়িয়া আমরা ধীরে ধীরে অনেক দূরে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে সেখানে একস্থানে ডিঙি বাঁধিয়া মনু আমায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে লইয়া গেল। তখন গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষা দেখা দিয়েছে। নাবাল জমি ডুবিতে শুরু হইয়াছে। মৌমাছির উপদ্রবে জঙ্গলে হাঁটা নিরাপদ নয়, কারণ এ সময় মৌমাছির ঝাঁক গৃহহারা হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। বেতের টক ফল খাইতে খাইতে আমরা কত দূর গেলাম।

সেখানে জঙ্গলের মধ্যে একটা গোলপাতার ঘর দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া মনুকে জিজ্ঞাসা করিতেই সে বলিল–এখানে এসো, বসা যাক। এ আমাদের ঘর। তোমাকে আর আমাকে আজ এখানে আসবার কথা বাবা বলে দিয়েছে।

কেন?

আজ আমাদের বোম্বেটের কাজে ভরতি হতে হবে।

সে কী কথা।

তাই। এটা জলের ডাকাতদের ঠাকুরঘর। এখানে দীক্ষা হয়।

দীক্ষা?

ডাকাতদের কাজে ভরতি হবার আগে এখানে পুজো দিতে হয়। অনেক কিছু করতে হয়। তোমাদের কথায় তাকে দীক্ষা বলে তো, সেদিন বইয়ে পড়লে যে!

মনুকে ইতিমধ্যে আমি বই পড়াইয়াছি খানকতক, বাংলা বেশ ভালো শিখাইয়াছি। বিদ্যার গুণে উহার মন যে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হইতেছে, এ আমি বুঝিয়াছি। হাজার হউক, আমাদের বয়স বাড়িয়াছে, অনেক কিছু বুঝি, অনেক কিছু ভাবি। মনুর বাবা এ সমস্ত তত পছন্দ করেন না, তাও জানি। মনুর অনুরোধে তিনি খুলনা হইতে বাংলা বই মাঝে মাঝে আনিয়া দিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাকে বলেন, বেশি বই পড়িয়া কি বাঙালি বনিয়া যাইবি নাকি? অত বই পড়ার মধ্যে কী আছে?

মনুর কথা শুনিয়া প্রমাদ গনিলাম। আমাকেও কি ডাকাত হইতে হইবে নাকি?

মনু বলিল–আমার অনুরোধে তোমাকে বিক্রি করা হয়নি। তোমার আমার ভাব দেখে বাবা ঠিক করেছেন আমাদের একসঙ্গে রাখবেন। নইলে আরাকানে কিংবা রেঙ্গুনে তোমাকে বিক্রি করা হত।

বল কী!

তাই।

এখন কী করবে ভাবছ?

তুমি যা বলবে তাই করব। ওই জন্যেই একটু আগে এখানে তোমাকে নিয়ে এলাম।

বেশি কথা বলিবার সময় পাওয়া গেল না। মনুর বাবা ও আরও কয়েকজন লোক একখানা ছিপে আসিয়া পড়িল। এই দস্যুদের আমি দেখিতে পারি না। মনুর বাবার মধ্যে মানুষের হৃদয় নাই জানি, থাকিলে আমায় এভাবে বন্দি করিয়া রাখিতে পারেন কি?

মনুর বাবা বলিলেন–সব তৈরি হয়ে নাও। আজ তোমাদের ভরতি হবার দিন। নেয়ে এসো নদীর জলে। মুরগি বলি দিয়ে আমরা কাজ আরম্ভ করব।

আমি বলিলাম–কী কাজ?

বললাম যে, আমাদের দলে তোমাদের ভরতি করে নেব আজ!

মনুকে নিন। আমি ডাকাতি করব না।

তোমার কথায় হবে?

দেখুন আপনি আমার বাবার মতো। মিথ্যে কথা বলব না আপনার সঙ্গে। আমি ভদ্রবংশের ছেলে, এ কাজ আমার নয়। আমার বয়েস হল সতেরো বছর, সব বুঝি।

ওসব চলবে না।

মানুষ খুন আমার দ্বারা হবে না। লুঠপাটও হবে না।

তোমাকে বিক্রি করে দেব, জান? কেনা চাকর হয়ে চীন দেশে গিয়ে থাকতে হবে।

যা হয় করুন। ডাকাতি আমার দ্বারা হবে না।

মনু বলিল–বাবা, আমারও এই মত।

মনুর বাবা ভয়ানক রাগিয়া গেলেন। আমাকে বলিলেন–তোমার সঙ্গে মিশে মনুও উচ্ছন্নে গিয়েছে তা আমি সন্দেহ করেছি আগে থেকেই। আজ শুধু তোমাদের পরীক্ষা করবার জন্যেই এখানে এনেছি, তা জান? কী করতে চাও তোমরা? কী করে খাবে এর পরে?

আমি আকাশের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিলাম–ওঁর ওপর নির্ভর করুন। তিনি যা করেন। পরের জিনিস লুঠ করে খেতে তিনি নিশ্চয় বলবেন না। আপনারও বয়েস হয়েছে, ভেবে দেখুন।

মনুর বাবা একে রাগিয়া ছিলেন, এবার আমার মুখে ভগবানের কথা শুনিয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া আমাকে লাঠি তুলিয়া মারিতে আসিলেন। মনু গিয়া তাঁহার হাতের লাঠি ধরিয়া ফেলিল। তাঁহার সঙ্গের লোকেরাও বাধা দিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–এরা যা বলছে ভেবে দেখুন সর্দারজি। ডাকাতি করা চলবে না। দু-খানা পুলিশ লঞ্চ সর্বদা ঘুরছে শুধু এক পশোর নদীতে। ফরেস্ট বিভাগের লোকও আজকাল খুব সতর্ক।

মনু বলিল–বাবা, আপনারা যা করেছেন, তা করেছেন। কাল বদলাচ্ছে না? ভেবে দেখুন, আগে যা করেছেন, তা এখন আর করতে পারেন কি?

এই পর্যন্ত কথা হইয়াছে, এমন সময় জঙ্গলের ওধারে হুইসিল শোনা গেল এবং সঙ্গেসঙ্গে একবার বন্দুকের আওয়াজ হইল। আমরা জঙ্গলের দিকে ছুটিয়া যাইতেছি, এমন সময় জনাচারেক পুলিশের পোশাক পরা লোককে অদূরে দেখিতে পাইলাম। ইহারা সকলেই বাঙালি, দেখিয়াই মনে হইল।

একজন আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিল। চাহিয়া দেখিলাম, মনুর বাবার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। তিনি বেশ বুঝিয়াছেন, এবার আর কোনো উপায় নাই। পুলিশ কি তাঁহার সন্ধানে আসিল। পরক্ষণেই দেখা গেল তাহা নহে, পুলিশ ইহারা নয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক। আমাদের বলিল– কে?

মনুর বাবা বলিলেন–যাত্রী।

কীসের?

পুজো দিতে এসেছি ঠাকুরের কাছে।

কীসের ঘর এ?

বনবিবির দরগাঘর।

তুমি তো দেখছি মগ, কী নাম, কী করো?

আমার নাম টুং পে নু। আমি মাছ-ধরা-জেলে, এরা সব আমার লোক।

কোথায় মাছ ধর?

পশোর নদীর মধ্যে আর খালে।

মাছ-ধরা পাশ আছে? দেখাও!

এখানে তো মাছ ধরতে আসিনি হুজুর। দরগাতলায় পুজো দিতে এসেছি।

খবরদার গাছ কাটবে না।

না না, সে কী কথা! গাছ কাটব কেন?

তাহাদের মধ্যে একজন আমার দিকে অনেকক্ষণ হইতে চাহিয়াছিল, আমার কাছে আসিয়া বলিল– এ কে?

মনুর বাবা বলিলেন–আমার এখানে কাজ করে।

এ তো দেখছি বাঙালি।

ওর কেউ নেই। অনেকদিন থেকে আমার কাছে আছে।

তোমার নাম কী ছোকরা?

আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করিতেছে। চাহিয়া দেখি উহাদের সকলের মুখ সাদা হইয়া গিয়াছে। এমনকী মনুরও। এই তো আমার অবসর, এই সময় কেন বলি না আমার আসল কথা? উহারা দু-জন বন্দুকধারী লোক। উহাদের কাছে ইহারা কী করিবে? আমার মুক্তির এই তো শুভক্ষণ উপস্থিত!

মনুর দিকে চাহিয়া দেখিলাম। তাহার চোখ-মুখে কাতর প্রার্থনার আকুতি। মনুর বাবার মুখও শুকাইয়া গিয়াছে। উদবিগ্ন দৃষ্টি আমার মুখের দিকে নিবদ্ধ। ভগবান এবার কি সুবিচার করিয়াছেন, দয়া করিয়া কি শুভক্ষণ জুটাইয়া দিয়াছেন? একবার মুখের কথা খসাই না কেন?

কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, ইহাও এক প্রকারের বিশ্বাসঘাতকতা। মনুকে ভাই বলিয়া ডাকি, তাহার বাবাকে এরূপ হীনভাবে ধরাইয়া দিলে আমার ভালো হইবে বটে কিন্তু উহাদের সর্বনাশ হইবে। মনু কোনো অপরাধ করে নাই, সে তখন নিতান্ত বালক ছিল–বাবা যাহা করেন, সে কীভাবে তাহাতে বাধা দিতে পারিত?

এসব চিন্তাভাবনা চক্ষের নিমেষে মনের মধ্যে করিয়া ফেলিলাম। ভাবিবার সময় কই? বড়ো হইয়াছি, আগের চেয়ে অনেক কিছু বুঝি। পুলিশের লোকের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, আমার নাম নীলমণি রায়। আমি এদের এখানে কাজ করি? অনেক দিন আছি।

পুলিশের লোক বলিল– তোমার কেউ নেই?

ঢোক গিলিয়া বলিলাম–না।

আচ্ছা যাও, গাছ যেন কাটা না পড়ে।

উহারা সবাই একযোগে চলিয়া গেল।

মনুর বাবা আমার কাছে আসিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া কী দেখিল, তারপর আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল–সাবাশ ছেলে! বাহবা বাবা! মনু আমার হাত দু-খানা ব্যগ্রতার সহিত জড়াইয়া ধরিল। সঙ্গের দু-একজন লোক বলিল–ভালো বংশের ছেলে বটে, বাঃ।

মনুর বাবা আমার ও মনুর দিকে চাহিয়া বলিলেন– বোসো এখানে! আমি আজ বড়ো বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম একটা কাঁচা কাজ করবার জন্যে। এমন কাঁচা কাজ জীবনে কখনো করিনি। জীবনটি আজ চলে যেত। এই ছোকরা আজ আমাদের সকলের প্রাণ বাঁচিয়েছে। যে আমার বন্দি, তাকে নিয়ে দিনমানে কখনো এক বার হইনি, আজ তা বার হয়েছিলাম। নীলু বড়ো ভালো ছেলে, তাই আজ আমরা সবাই বেঁচে গেলাম। চলো আজ বাড়ি যাই, আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–কী খেতে চাও বলো? বড়ো মাছ না খাসির মাংস? যা ইচ্ছে বলো!

আমার মনের মধ্যে একটি অপূর্বভাব আসিয়াছে তখন। খাওয়া অতি তুচ্ছ তাহার কাছে।

বলিলাম–যা হয় খাওয়াবেন, সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু আমার দু-একটি কথা শুনবেন কি দয়া করে? মনুকে ভাইয়ের মতো দেখি, এ মুখের কথা নয়, তা তো দেখলেন!

মনুর বাবা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন–না না, আগে বলো কী খাবে? বড়ো মাছ না খাসির মাংস?

খাসির মাংস।

বেশ, আমি এখুনি জোগাড় করে আনছি। তুমি আর মনু বাড়ি যাও। তোমাদের সঙ্গে কথা আছে।

আমাকে সন্ধ্যার পর মনুর বাবা তাঁহার কাছে ডাকিলেন। আমি কোনো কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। মনুর বাবা বলিলেন– দেখো, আজ তোমার কাজে বড়ো সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমাদের আজ পুলিশে না ধরিয়ে দিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করেছ। তুমি যা খেতে চাও–অর্থাৎ খাসির মাংস, কাল সকালে তোমাকে খাওয়াব—

আমি মাথা নীচু করে বললাম–আমাকে মুক্তি দিন–

–সে তো তুমি আজ নিজের ইচ্ছেতে নাওনি! তোমাকে ছেড়ে দিতাম আজই, কিন্তু মনু তোমাকে বড়ো ভালোবাসে, তাই ভেবে পিছিয়ে যাচ্ছি। ওর লেখাপড়া যদি একটু হয়, তবে এ কাজ বন্ধ করে দেব। পুলিশ বড়ো পেছনে লেগে আছে, এ কাজ আর চলবে না।

আমাকে এখন কী করতে বলেন?

তোমাকে আমি ছেড়েই দিলাম। যেখানে খুশি যেও, ইচ্ছে হয় আমাকে বোলো। যা খেতে চাও তোমাকে খাওয়াব, কিন্তু একেবারে চলে যেও না। তুমি আমার ছেলের মতো। তুমি চলে গেলে তো আমাদের বড়ো কষ্ট হবে। মনুকে তুমি মানুষ করে দাও।

আমি চুপ করিয়া রহিলাম। এ জীবন বেশ লাগিতেছিল। বদ্ধ জীবনের চেয়ে অনেক ভালো। দিনে দিনে এ জীবনকে আমি ভালোবাসিয়াছি। কেবল ভাবি, মা কেমন আছেন, কীভাবে আছেন! সেদিন বসিয়া অনেক কিছু ভাবিলাম। বাড়ি তো যাইবই, কিন্তু এ জীবনের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হইয়া যাইব–আর এখানে ফিরিতে পারিব না, আর এ জীবনে ফিরিতে পারিব না। তার চেয়ে আর কিছুদিন থাকিয়া যাই। মনুর উপর একটা মায়া পড়িয়াছে, হঠাৎ ছাড়িয়া গেলে সে তো কষ্ট পাইবে।

মনুকে লইয়া বিকালে বাহির হইলাম। এক জায়গায় একটা গাছের গুঁড়ির মধ্যে কী পাখি

বাসা বাঁধিয়াছিল, মনু আমাকে দেখাইতে লইয়া গেল।

আমি বলিলাম–ওর মধ্যে হাত দিও না যেন, সাপ থাকে।

সে আর আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না। মনে নেই সেই সাপের কথা!

মনে নেই আবার?

কথা শেষ হইতে-না-হইতে মস্ত বড়ো একটা গোখুরা সাপ গাছের খোড়লের ভিতর হইতে ফোঁস করিয়া উঠিল। মনু অমনি সাপটার গলা চাপিয়া ধরিল ডান হাতে। সাপটা তাহার হাতে পেঁচ দিয়া জড়াইতে লাগিল। সে এক ভয়ানক দৃশ্য হইল দেখিতে। আমি তাড়াতাড়ি হাতের দা দিয়া সাপটাকে খানিকটা কাটিয়া ফেলিলাম–তাহাতে সে এমন জোর করিতে লাগিল যে মনু তাহার মুখ আর চাপিয়া রাখিতে পারে না। মনুর হাতের উপর আমিও জোর করিয়া চাপিয়া ধরিলাম। ইতিমধ্যে বিপদের উপর বিপদ– কোথা হইতে আর একটা সাপ দেখি আমাদের দুজনের মাথার উপর দুলিতেছে। ডালে তাহার ল্যাজ আটকানো। আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম। কিন্তু সাপটা আমার কাছেও আসিল না, ক্রমে দূরে সরিয়া যাইতে লাগিল এবং থুতুর মতো জিনিস আমাদের দিকে জোরে ফেলিতে লাগিল।

মনু বলিল–সাবধান! চোখ ঢাকো–চোখ ঢাকো–চোখ অন্ধ হয়ে যাবে—

আমি চোখ ঢাকিলে মনু মারা পড়ে, মনুও চোখ ঢাকিতে পারে না। চোখ অন্য দিকে ফিরাইয়া যতদূর সম্ভব চোখ বাঁচাইতেছি–মনুকে বলিলাম–খুব সাবধান, চোখ সাবধান–

সাপের থুতু লাগিতেছে আমার ঘাড়ে, মাথার চুলে, কানের পাশে। চোখ ভয়ে চাহিতে পারিতেছি না, মনুরও নিশ্চয় সেই অবস্থা। মিনিট দশ বারো এই অবস্থায় কাটিল, সাপের থুতু-বৃষ্টি আর থামে না। চাহিয়া দেখিতে ভরসা পাইতেছি না, সাপটা আমাদের কাছে আসিতেছে না দূরে যাইতেছে।

আমাদেরও সেখান হইতে চলিয়া যাইবার কোনো উপায় নাই। সাপটা একটা কেয়াঝোঁপের মধ্যে–যে জায়গাটুকু ফাঁক, সেখানেই ওই সাপটা থুতু ছুড়িতেছে। কেয়াকাঁটার মধ্যে হাতে সাপ জড়ানো অবস্থাতেই শেষে সন্তর্পণে ঢুকিয়া গেলাম দু-জনে। হাত-পা কাঁটায় ছড়িয়া গিয়া রক্তপাত হইতে লাগিল। সেই কেয়াবনের মধ্যে দাঁড়াইয়া আমি সন্তর্পণে সাপটাকে প্যাঁচাইয়া কাটিয়া তিনটুকরা করিলাম–শোল কিংবা ল্যাটা মাছের মতো। রক্তে মনুর কাপড় ভাসিয়া গেল। মরা সাপটাকে হাত হইতে খুলিয়া ফেলিয়া সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরি।

রাত্রে কিন্তু ভাত খাইয়া মনু আমাকে বলিল–আবার সেই গাছের খোড়লে যেতে হবে এখন!

আমি আশ্চর্য হইয়া বলিলাম– কেন?

আছে মজা।

কী শুনি না? একবার বিপদে পড়ে আশ মেটেনি?

তা নয়। আমি ওখানে বিনা কারণে তখন যাইনি।

কী কারণে বলো। সেবার তো প্রাণ যেতে বসেছিল।

ওখানে সাপের মণি আছে।

কী সাপ?

সে আমি কী জানি, চলো দেখাবো।

সত্যই সাপের মণি আছে। আমি কখনো শুনিনি। মনু আমাকে সে অন্ধকার-রাত্রে বনের মধ্যে কেয়াগাছের কাঁটার পাশে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইল। দু-জনে তারপর সেই গাছটার ডালে উঠিয়া বসিলাম।

আমি বললাম–মণি কই? গাছে উঠলে কেন?

সাপ আমাদের গাছের তলা দিয়ে যাবে একটু পরে।

কী সাপ?

গোখুরা বা অজগর। নিজের চোখেই দেখো।

কিছুক্ষণ পরে ঘোর অন্ধকারে আমাদের গাছের নীচে একটা জোনাকির মতো কী জিনিস চলিয়া-ফিরিয়া বেড়াইতে লাগিল। স্নিগ্ধ স্থির আলো, জোনাকির মতো একবার জ্বলিয়া আবার নিবিয়া যায় না। মনু বলিল–দেখেছ?

অই নাকি?

অই তো! তোমার কী মনে হয়?

বুঝতে পারছি না।

জিনিসটা অনেকক্ষণ নড়িয়া বেড়াইল। তারপরে আমাদের গাছটার ঠিক নীচে আসিয়া স্থির হইয়া রহিল। কী জিনিস কিছুই বুঝিলাম না।

মনু বলিল– সেই সাপটা!

কোনটা?

যেটা থুতু ফেলেছিল?

তুমি কী করে জানলে?

আমি অনেক দিন থেকে দেখছি।

মনি কী করে নেবে?

এক তাল গোবর ওর ওপর চাপা দিতে হবে। একটু পরে মণি নাবিয়ে রেখে সাপটা পোকামাকড় খুঁজবে, সেই সময়।

কিন্তু সে-সুযোগ সাপটা আমাদের দিল না! খানিকটা এদিক-ওদিক নড়িয়া-চড়িয়া সেটা চলিয়া গেল। আমরা আবার পরদিন সন্ধ্যার পর সেখানে গেলাম। সেদিনও সাপ আসিল বটে কিন্তু মণি নামাইতে তাহাকে দেখিলাম না। সে-রাত্রে আর কিছু হইল না, পরের রাত্রেও সেরকম গেল।

আরও দু-দিন কাটিল! মনু বল্লম লইয়া গিয়াছিল সেরাত্রে। বল্লম তুলিয়া মারিতে গেলে আমি উহার হাত ধরিয়া বারণ করিলাম। সাপের মণি আছে কিনা জানি না, কিন্তু শুনিয়াছি এভাবে মণি সংগ্রহ করিলে অমঙ্গল হয়। মনু ও আমি ফিরিয়া আসিলাম। দিনদশেক পরে মনু একটি মরা সাপ আমাকে দেখাইল। তাহার মাথার উপর একটা সাদা আঁশ। মনু বলল–এই দেখো মণি, কাল রাতে একা গিয়ে সাপটাকে মারি। আলো তখুনি নিবে গেল। বুড়ো সাপের মাথায় এইরকম আঁশ হয়, রাত্রে জ্বলে। একেই বলে সাপের মণি। সব সাপের হয় না, কোনো কোনো সাপ বুড়ো হয়ে গেলে এই আঁশ গজায়।

আমাদের ছোটো গ্রামটি থেকে কিছু দূরে একটা জায়গা আছে, তার নাম মগের ট্যাঁক। এখানে আমরা হরিণ মারিতে আসিয়াছি–নিবারণ, মনু ও আমি। আমি কখনো এখানে আসি নাই, হরিণ মারিব বলিয়াও আসি নাই, আমি আসিয়াছি এজন্য যে এখানে সমুদ্রের শোভা দেখিতে পাইব। মগের ট্যাঁক একেবারে সমুদ্রের ধারে। ঘোলা জলের সমুদ্র নয়, নীল ঊর্মিমুখর বিশাল সমুদ্র মগের ট্যাঁকের ঘন সবুজ দীর্ঘ তৃণভূমির একেবারে নীচে। অনেক সময় জোয়ারের জল তৃণভূমি ছুঁইয়া থাকে।

একটা বড়ো কেওড়া গাছে উঠিয়া আমরা সকলে বসিয়া আছি। সামনে হাত-পঞ্চাশ দূরে অকূল সমুদ্র! গাছের উপর হইতে কী অদ্ভুত সে-দৃশ্য! বড়ো বড়ো ঢেউয়ের দল আছাড় খাইয়া পড়িতেছে মগের ট্যাঁকের নীচের বেলাভূমিতে। সাদা সাদা ফেনার ফুল ঢেউয়ের মাথায়।

মনু বলিল– কেমন মাছ ধরবার জায়গা!

তার চেয়েও ভালো এর চমৎকার দৃশ্য!

সে তো সব জায়গায় আছে। এমন মাছের জায়গা কিন্তু কোথাও নেই। আরাকান থেকে মগ জেলেরা এসে এখানে আগে আগে মাছ ধরত। তাই এর নাম মগের ট্যাঁক। গোলপাতার ঘর বানিয়ে এখানে দু-তিন মাস বাস করত। মাছও যা ধরত–

ভুল করছ মনু-চমৎকার দৃশ্য সব জায়গায় নেই। এদিকে চেয়ে দেখো–এমন আকাশ, এমন নীল রং–

আমি তো কিছু দেখতে পাই না—

খুব দেখতে পাও। দেখার চেষ্টা করলে দেখতে পাবে–দেখতে শেখো।

এমন সময় আর একটি নতুন দৃশ্য আমাদের চোখে পড়িল। একপাল হরিণ অদূরের জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া তৃণক্ষেত্রের মধ্যে সঁড়িপথ দিয়া এদিকেই আসিতেছে। সরু পথ সুতরাং হরিণগুলো একটির পিছনে আর একটি–দীর্ঘ সারি একটি। পথও আঁকাবাঁকা, হরিণের দীর্ঘ সারির গতিও আঁকাবাঁকা। সবসুদ্ধ মিলিয়া একটি ছবি। মনু আমার দিকে চাহিল। তাহার হাতে বন্দুক। আমি ইশারায় বারণ করিলাম। এমন সুন্দর মনোরম হরিণের সারি কি বন্দুকের গুলির নিষ্ঠুর আঘাতে ভাঙিয়া দেওয়া যায়? সেটা মানুষের কাজ কি?

মনু না বুঝিয়া আমায় চুপি চুপি বলিল–তুমি গুলি করবে?

না।

তবে আমি মারি?

না, চুপ করে থাকো। শুধু দেখে যাও।

মনু আগের মতো আর নাই; নতুবা আমার কথা শুনিত না। সে মগ ডাকাতের ছেলে, বোঝে লুঠপাট, রক্তপাত। আমার সঙ্গে মিশিয়া সে বুঝিতেছে, নিষ্ঠুর রক্তপাতই জীবনের শেষ কথা নয়। দয়া বলিয়া জিনিস আছে, সৌন্দর্য বলিয়া জিনিস আছে। সবটা বুঝিতে পারে না, তবুও বুঝিতে চেষ্টা করে। হরিণের দল সমুদ্রের ধারে গিয়া দাঁড়াইল–মগের ট্যাঁকে নির্জন তটে, তট যেখানে সমুদ্রে ঢুকিয়াছে। সম্মুখে নীল সমুদ্র, তাহার তটে নির্জন তৃণভূমিতে বিচরণরত একদল হরিণ–ইহার মতো সুন্দর ছবি জীবনে দেখি নাই। বন্দুকের বেখাপ্পা আওয়াজ করিয়া সে-ছবি নষ্ট করিতে দিব না।

নিবারণ শিস দিল। শিসের শব্দে হরিণগুলি চমকিয়া এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিল।

নিবারণ বলিল–মারো, মারো, এইবার মারো–

মনু বলিল–অঃ, সব পালাল!

আমি বলিলাম–এমন ছবিটা ভেঙে দিলে নিবারণ?

নিবারণ গাছ হইতে লাফাইয়া হরিণের দলের পিছু পিছু ছুটিল। হরিণেরা প্রাণের ভয়ে তৃণভূমিতে ইতস্তত বিশৃঙ্খলভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সেই-বা কী সুন্দর ছবি। সবগুলি ঢুকিয়া পড়িল বনের মধ্যে এবং অদৃশ্য হইয়া গেল চক্ষের পলকে। নিবারণ উহাদের সঙ্গে বনের মধ্যে ঢুকিল।

মনু বলিল–ও কী দিয়ে হরিণ মারবে?

কী জানি!

আমরা সেই তৃণক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া সমুদ্র দেখিতেছি; মিনিট দশেক কাটিয়া গিয়াছে, এমন সময়ে জঙ্গলের মধ্যে নিবারণের আর্ত চিৎকার শুনিয়া দু-জনেই জঙ্গলের দিকে ছুটিলাম। আমায় মনে হইল গাছের উপর হইতে স্বরটি আসিয়াছে। মনুকে সাবধান করিয়া দিলাম– অজানা জঙ্গলে এভাবে না ছুটিয়া পথ দেখিয়া চলো। খানিকটা গিয়া দেখি নিবারণ একটা কেওড়া গাছের উপর বসিয়া পরিত্রাহি চিৎকার করিতেছে। কেন সে চিৎকার করিতেছে কিছু বুঝিলাম না। মনুকে আবার সাবধান করিয়া দিলাম।

মনু বলিল–কী নিবারণ?

নিবারণ হাত নাড়িয়া বলিল–এসো না, এসো না হোদো গাছের তলায় বাঘ–হরিণের দল তাড়া করেছিল। আমার গাছের তলায় বাঘ দাঁড়িয়ে আছে, তোমরা উঠে পড়ো।

উহার গাছের তলায় বড়ো বড়ো হোদো গাছের জঙ্গল। হোদো জঙ্গলে বাঘ লুকাইয়া থাকিলে বাহির হইতে বোঝা যায় না। হোদো কাছের পাতা বিদ্যাপাতার মতো, তবে চার হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। এগুলিকে ইংরেজিতে টাইগার ফার্ন বলে, তাহা পরে জানিয়াছিলাম। মনু আমার হাত ধরিয়া নিকটের গাছে উঠিতে যাইবে, এমন সময় হোদো জঙ্গল দুলাইয়া বাঘ নিঃশব্দে এক লাফ দিয়া, মনু পূর্বে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সেখানে আসিয়া পড়িল। অর্থাৎ মনু আমাকে লইয়া না সরিলে সেই ভীষণ বাঘটা অব্যর্থ লক্ষ্যে তাহাকে ও আমাকে পিষিয়া দিত। বাঘে খাওয়া কিংবা আঁচড়ানো কামড়ানো পরের কথা–সাত-আট মণ ওজনের একটা বাঘের তীব্র লাফের পূর্ণ ঝাঁপটেই তো আমাদের প্রাণ বাহির হইয়া যাইতে পারে!

মনু সঙ্গেসঙ্গে বন্দুক তুলিয়া গুলি করিল। গুলি খাইয়া বাঘ আর একটা লাফ মারিল। যেখানে আমরা দাঁড়াইয়াছিলাম। মনু গুলি করিয়া বাঁ-দিকে লাফ দিয়া সরিয়া গিয়াছে। বাঘ এবার আর এক লাফ মারিল কিন্তু আমাদের দিকে নয়–সেই টাইগার ফার্নের জঙ্গলের মধ্যে।

ততক্ষণ আমি আর মনু গাছের উপর ঠেলিয়া উঠিয়াছি।

নিবারণ বলিল–ভাই, আমাকে বাঁচাও।

আমরা বলিলাম–কেন, তুমিও তো গাছের ওপর—

আমার হাতে কী আছে, আমি নামব কেমন করে? ও যদি লাফ দিয়ে গাছে ওঠে।

কিছু ভয় নেই। চুপ করে থাকো। আহত বাঘ বড়ো ভয়ানক জানোয়ার।

সেই অবস্থায় রাত্রি নামিয়া আসিল। ভয়ে আমরা কেহ গাছ হইতে নামিতে সাহস করিলাম না। আহত বাঘটা হয়তো ওঁত পাতিয়া আছে টাইগার ফার্নের জঙ্গলে, কে জানে? নামিলেই লাফ দিয়া ঘাড়ের উপর পড়িবে। আকাশে নক্ষত্র উঠিল। সমুদ্রের তীর হইতে হাওয়া বহিতে লাগিল। সমুদ্রে ঢেউয়ে আলো জ্বলে, রাশি রাশি জোনাকি জ্বলে প্রত্যেক ঢেউয়ের উলটোনো পালটানোর খাঁজে খাঁজে। বাঃ রে!

মনু চেঁচাইয়া বলিল–নিবারণ! ঘুমিয়ে পড়ো না। পড়ে যাবে একেবারে, বাঘের মুখে—

নিবারণ বলিল–খিদে পেয়েছে, পেট জ্বলছে খিদেতে।

চুপ করে থাকো।

আমি বলিলাম–নক্ষত্র দেখো। মনু ও আমি দু-জনেই হাসিয়া উঠি।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress