ময়ূর, চঞ্চরী ও শিলাবতী
পরদিন প্রাতঃকালে ময়ূর, চঞ্চরী ও শিলাবতী সাজসজ্জা করিয়া বাহির হইলেন। অদ্ভুত তাঁহাদের পরিচ্ছদ; ময়ূরের পরিধানে পায়জামা, মাথায় টোপ, হাতে ধনুর্বাণ; শিলাবতী কৃষ্ণবস্ত্রে দেহ আবৃত করিয়া মাথায় ফলের ঝুড়ি লইয়াছে; চঞ্চরীর শরীর আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। তিনজনে পদব্রজে দিল্লীর দিকে চলিলেন। সঙ্গীরা পান্থশালায় রহিল; তাহাদের কাজ আপাতত শেষ হইয়াছে।
দিল্লীর দক্ষিণ দ্বারে মানুষ গরু গাধা উটের ভিড়। অধিকাংশ প্রবেশ করিতেছে, কিছু বাহিরে আসিতেছে। দিল্লীর প্রাকারচক্রের বাহিরে মানুষের বসতি কম নয়।
দিল্লী নগরী প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে হিন্দু রাজার রাজধানী ছিল, কিঞ্চিদধিক শতবর্ষ পূর্বে মুসলমানেরা তাহা অধিকার করিয়াছে। স্থাপত্য শিল্পে দুই জাতীয় শিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। বড় বড় অট্টালিকা ও মসজিদ আছে, কিন্তু পথগুলি সংকীর্ণ। নগরের আনাচে-কানাচে নিম্নতন শ্রেণীর মানুষের বাস। কোনোটি হিন্দুপল্লী, কোনোটি মুসলমান-মহল্লা। রাজভবনের চারিপাশে অনেকখানি উন্মুক্ত স্থান, এখানে অহোরাত্র অশ্বারোহী রক্ষীর দল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সর্বোপরি কুতবমিনারের অভ্রংলিহ শিখর নগরীর শিয়রে দাঁড়াইয়া ইসলামের জয় ঘোষণা করিতেছে।
তিনজনে নগরে প্রবেশ করিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইল; দূর হইতে রাজপ্রাসাদ দেখিল। প্রাসাদের শীর্ষে বহু পারাবত উড়িতেছে। সুলতান আলাউদ্দিনের পায়রা পোর শখ আছে, বিশেষত দূত-পারাবত। শত ক্রোশ দূরে ছাড়িয়া দিলেও তাহারা স্বস্থানে ফিরিয়া আসে।
নগরদর্শন শেষ করিতে দ্বিপ্রহর হইল। তখন ময়ূর দরিদ্র হিন্দুপল্লীতে গিয়া বাসা ভাড়া লইল। দুইটি ক্ষুদ্র ঘর, সম্মুখে সংকীর্ণ দালান; দুইটি ঘরের একটিতে ময়ূর থাকিবে, অন্যটিতে থাকিবে শিলাবতী ও চঞ্চরী। চাল-ডাল, হাঁড়ি-কলসি কিনিয়া তিনজনে সংসার পাতিয়া বসিল। কতদিন থাকিতে হইবে তাহার স্থিরতা নাই।
আজ সকালে শিলাবতীর কালো মুখ দেখিয়া চঞ্চরী ভয় পাইয়াছিল, ক্রমে ভয় কাটিয়াছে। সে ঘরে আসিয়া বোরকা খুলিয়া ফেলিল। উচ্ছলিত কণ্ঠে বলিল—কী সুন্দর নগর! কত মানুষ, কত বাড়ি। কী উঁচু স্তম্ভ! আমি আর ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।
শিলাবতী শুষ্ক স্বরে বলিলেন—সেই চেষ্টাই হচ্ছে।
অপরাহ্নে তাঁহারা আবার বাহির হইলেন। ময়ূর রাস্তার একটা চৌমাথায় তীর-ধনুকের খেলা দেখাইল। শূন্যে তীর ছুঁড়িয়া দ্বিতীয় তীর দিয়া ফিরাইয়া আনিল। চঞ্চরীর বোরকা-ঢাকা মাথায় ডালিম রাখিয়া তীর দিয়া ডালিম বিদ্ধ করিল। অনেকগুলি দর্শক জুটিয়া গিয়াছিল, ময়ূর কিছু পয়সা পাইল। . পরদিন সকালে তাহারা আবার বাহির হইল। এবার ময়ূর নগরের অন্যদিকে গিয়া খেলা দেখাইল। ধীরে ধীরে তাহারা রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হইতেছে।
অপরাহ্নে তাহারা প্রাসাদের আরও নিকটস্থ হইল। এখানে সিপাহী দর্শকের সংখ্যাই বেশি, কিছু সাধারণ নাগরিকও আছে। দুই-একটি প্রৌঢ়া বৃদ্ধা স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া খেলা দেখিতেছে।
খেলা দেখাইতে দেখাইতে ময়ূর লক্ষ্য করিল, ভিড়ের মধ্যে একজন লোক আছে যাহাকে সে পূর্বে দেখিয়াছে; খঞ্জ সাজিয়া যে তাহার মাথায় লাঠি মারিয়াছিল সেই মামুদ। মামুদকে সে চিনিতে পারিলেও মামুদ তাহাকে নূতন বেশভূষায় চিনিতে পারে নাই; শিলাবতীর গুণ্ঠন-ঢাকা মুখও দেখিতে পায় নাই। মামুদের খঞ্জভাব এখন আর নাই, সে একাগ্র . চক্ষে খেলা দেখিতেছে। ময়ূর নির্বিকার মুখে খেলা দেখাইয়া চলিল।
ভিড়ের মধ্যে একটি স্থূলকায়া প্রৌঢ়া রমণী নিষ্পলক নেত্রে শিলাবতীর অর্ধাবগুণ্ঠিত মুখ দেখিতেছিল; ক্রমে শিলাবতীর দৃষ্টি তাহার উপর পড়িল। দুইজনের চক্ষু অনেকক্ষণ পরস্পরের মুখে সম্বদ্ধ হইয়া রহিল।
তীর-ধনুকের খেলা শেষ হইলে দর্শকের দল ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। ময়ূর মাটি হইতে পয়সা কুড়াইতেছে এমন সময় মামুদ আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইল। মামুদের আকৃতি সরীসৃপের ন্যায়, চিবুকের নীচে চুটকি দাড়ি; পান চিবাইতে চিবাইতে দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল—খাসা খেলা দেখিয়েছ। তুমি তো দিল্লীর লোক নও, মুলুক কোথায়?
ময়ূর উত্তর দিল না, পয়সা কুড়াইয়া কোমরে রাখিল। মামুদ বলিল—তা তুমি পাঠান মোগল উজবুক যে হও, আমার কি। কাছেই শরাবখানা আছে, চল না সেখানে খেলা দেখাবে। অনেক পয়সা পাবে।
ময়ূর এবারও কথা বলিল না, শিলাবতীর দিকে তাকাইল। দেখিল, তিনি সেই স্থূলকায়া প্রৌঢ়া রমণীর সহিত কথা কহিতেছেন। দুই-চারিটি কথা বলিয়াই তিনি মুখ ফিরাইলেন, রমণী চলিয়া গেল।
মামুদ কিন্তু দমিবার পাত্র নয়, সে চঞ্চরীর দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল—বোরকা-ঢাকা ওটি বুঝি তোমার বিবি? বিবি নিয়ে দিল্লীতে এসেছ, খুব সাবধান। এখানে খুবসুরৎ বিবি বেবাক চুরি যায়। তবে যদি ভাল মুসাফিরখানায় থাকো তাহলে ভয় নেই। আমি একটি ভাল মুসাফিরখানা জানি–
ময়ূর ধনুতে শর-যোজনার ভান করিয়া বলিল—বেশি কথা বললে পেট ফুটো করে দেব।
মামুদ লাফাইয়া পশ্চাৎপদ হইল এবং দূরে দাঁড়াইয়া গলার মধ্যে গজগজ করিয়া বোধ করি তুর্কী ভাষায় খিস্তিখেউড় গাহিতে লাগিল।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, শিলাবতী ও চঞ্চরীকে লইয়া ময়ূর ফিরিয়া চলিল। কিছুদূর গিয়া ময়ূর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল মামুদ দূরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতেছে। সে একটু বিমনা হইল। মামুদ অতি নিম্নশ্রেণীর দূবৃত্ত, দিল্লীতে নবাগত ব্যক্তিদের ঠকাইয়া কিংবা সুবিধামত রাহাজানি করিয়া উদরপূর্তি করে; সে ময়ূরকে চিনিতে পারে নাই তাহা নিঃসন্দেহ, চিনিতে পারিলে তাহার কাছে ঘেঁষিত না। কিন্তু মামুদ ক্ষুদ্র প্রাণী হইলেও তাহার সম্বন্ধে সাবধান থাকা আবশ্যক। ক্ষুদ্র প্রাণী অনেক সময় বৃহৎ কার্য ভ্রষ্ট করিয়া দিতে পারে।
গৃহে ফিরিয়া চঞ্চরী বোরকা খুলিবার জন্য ঘরে প্রবেশ করিলে ময়ূর চুপিচুপি শিলাবতীকে জিজ্ঞাসা করিল—যে স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কথা বলছিলেন সে কে?
শিলাবতী মুখ টিপিয়া হাসিলেন—কবুতর বিবি।
রাত্রির আহারের পর চঞ্চরী ঘুমাইয়া পড়িলে শিলাবতী নিঃশব্দে ময়ূরের ঘরে আসিলেন, বলিলেন—ময়ূর ভাই, আমি আবার বেরুব, কবুতর বিবির সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজ তুমি যেখানে খেলা দেখিয়েছিলে সেখানে সে আসবে।
ময়ূর বলিল—যাওয়া প্রয়োজন?
শিলাবতী বলিলেন—নিতান্ত প্রয়োজন।
ময়ূর উদ্বিগ্ন স্বরে বলিল—কিন্তু আপনি একা যাবেন, চলুন, আমি সঙ্গে যাই।
শিলাবতী বলিলেন—না, চঞ্চরীকে একা রেখে যাওয়া নিরাপদ নয়। তুমি চিন্তা করো না, চাঁদের আলো আছে, আমি পথ চিনে যেতে পারব।
শিলাবতী কৃষ্ণ বস্ত্রে অঙ্গ ঢাকিয়া চলিয়া গেলেন। কবুতর বিবি হারেমের পুরাতন দাসী, যখন ইচ্ছা অন্দরে-বাহিরে যাতায়াত করে, কেহ তাহাকে বাধা দেয় না। শিলাবতী নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া দেখিলেন এক দেবদারু বৃক্ষের ছায়ায় কবুতর বিবি অপেক্ষা করিতেছে।
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে শিলাবতী ফিরিলেন। ময়ূর ধনুর্বাণ লইয়া দালানে বসিয়া ছিল; হ্রস্বস্বরে দুইজনের কথা হইল। তারপর উভয়ে আশান্বিত মনে নিজ নিজ কক্ষে শয়ন করিতে গেলেন।