নিরুপমা হোটেলের ম্যানেজার
নিরুপমা হোটেলের ম্যানেজার হরিশচন্দ্র হোড় ঘুম ভেঙেই ঘড়ি দেখলেন–সাড়ে, ছটা। তিনি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ইঃ, আজ বেজায় দেরি হয়ে গেছে। তিনি ডাকলেন, ‘গুণধর!’
তকমা-উর্দি পর সদর খানসামা গুণধর এসে দাঁড়াল। শীর্ণকান্তি অত্যন্ত কর্মকুশল চৌকশ লোক, হোটেলের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির প্রতি নজর আছে। হরিশচন্দ্র তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেড-টি দেওয়া হয়েছে?’
গুণধর বলল, ‘আজ্ঞে। তেতলার সবাই চা নিয়েছেন, কেবল দোতলার দুনম্বর ঘরে টোকা দিয়ে সাড়া পেলাম না।’
হরিশচন্দ্র বললেন, ‘দোতলার দু’নম্বর–রাজকুমারবাবু। পনেরো মিনিট পরে আবার টোকা দিও।–বাজারে কে গেছে?’
‘জেনারেলকে নিয়ে সরকার মশায় গেছেন।’
‘বেশ। আমার চা নিয়ে এস।’ হরিশচন্দ্র উঠে কক্ষ-সংলগ্ন বাথরুমে প্রবেশ করলেন।
রাসবিহারী অ্যাভেন্ম ও গড়িয়াহাটার চৌমাথা থেকে অনতিদূরে নিরুপমা হোটেল। দেশী হোটেল হলেও তার ভাবভঙ্গী একটু বিলিতি-ঘেষা। চাকরেরা খানসামার মত তকমা-উর্দি পারে, সদর দরজার সামনে সকাল বিকেল জেনারেলের মত সাজপোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে এবং যোগ্য ব্যক্তিকে সেলাম করে। তিনতলা বাড়ির প্রত্যেক তলায় আটখানি ঘর। নীচের তলায় ম্যানেজারের দু’টি ঘর, বাসকক্ষ ও অফিস; টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজানো ডাইনিং রুম; রান্নাঘর, বাবুর্চিখানা, চাকরদের ঘর, স্টোর-রুম ইত্যাদি। হোটেলে দেশী ও বিলিতি দুরকম খাদ্যই পাওয়া যায়, যার যেমন ইচ্ছা খেতে পারেন। হোটেলে থাকার মাশুল বিলিতি হোটেলের চেয়ে কম, কিন্তু সাধারণ দেশী হোটেলের চেয়ে বেশি। ছোট হোটেল, তাই অধিকাংশ সময়ই পূর্ণ থাকে, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অতিথি এখানে আসেন।
আধঘণ্টা পরে হরিশচন্দ্র বাথরুম থেকে বিলিতি পোশাক পরে বেরুলেন। দোহারা আকৃতির লোক, তাই কোট-প্যান্ট পরলে বেশ মানায়; বয়স আন্দাজ পায়তাল্লিশ, চোখের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞতা এবং সংসারবুদ্ধি পরিস্ফুট।
টেবিলের ওপর চা এবং প্রাতরাশ সাজিয়ে গুণধর দাঁড়িয়ে ছিল, হরিশচন্দ্র খেতে বসলেন। চা টেস্ট মাখন ও দু’টি অর্ধ সিদ্ধ ডিম। আহারের সময় হরিশচন্দ্র কথা বলেন না, পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রাতরাশ শেষ করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘রাজকুমারবাবুর খবর আর নিয়েছিলে?’
গুণধার বলল, ‘আম্ভেজ্ঞ, এবারও সাড়া পাওয়া গেল না।’
হরিশচন্দ্র ভ্রূকুটি করলেন। তারপর উঠে অফিস-ঘরে গেলেন। দেরাজ থেকে চাবির গোছা নিয়ে পকেটে ফেললেন, ‘চল, দেখি।’
ফাল্গুন মাস হলেও সাতটার সময় বেলা চড়েছে; কলতলায়, রান্নাঘরে, ডাইনিং রুমে বিষ্ণু-চাকরের কর্মতৎপরতা। আটটার সময় অতিথিদের ব্রেক-ফার্স্ট দিতে হবে।
সিঁড়িতে উঠতে উঠতে হরিশচন্দ্র পশ্চাদ্বতী গুণাধরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাল রাত্তিরে
গুণধর বলল, ‘আজ্ঞে, ছিলেন। রাত্রি পৌঁনে ন’টার সময় আমি নিজের হাতে তাঁকে ডিনার পৌছে দিয়েছি।’
‘রাত্তিরে সদর দরজা। কখন বন্ধ হয়েছিল?’
‘আপনি ফিরলেন এগারোটার সময়, তারপর আমি সদর বন্ধ করেছি।’
দোতলায় এক সারিতে আটটি ঘর, সামনে টানা বারান্দা। সিঁড়ির মুখেই ঘরের নম্বর আরম্ভ হয়েছে। সব দরজা ভেজানো। হরিশচন্দ্র দুনম্বর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটু কড়াভাবে টোকা দিলেন।
কেউ সাড়া দিল না। হরিশচন্দ্র তখন ডাক দিলেন, ‘রাজকুমারবাবু!’
এবারেও সাড়া এল না। হরিশচন্দ্র আরো গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ‘রাজকুমারবাবু!’ তবু সাড়া নেই। হরিশচন্দ্র তখন দোরের হ্যান্ডেল ঘোরালেন, কিন্তু হ্যান্ডেল ঘুরল না। দোরে ইয়েল তালা লাগানো, চাবি না ঘোরালে বাইরে থেকে দোর খুলবে না।
হরিশচন্দ্র পকেট থেকে চাবির গোছা বার করলেন। এই সময় দুনম্বর ঘরের দুদিক থেকে দরজা খুলে দু’টি মুণ্ড উঁকি মোরল। এক নম্বর থেকে যিনি উঁকি মারলেন তিনি একটি বর্ষীয়সী। মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’ তিন নম্বর ঘর থেকে গলা বাড়িয়েছিলেন মধ্যবয়স্ক একটি পুরুষ; বললেন, ম্যানেজারবাৰু্্, আমার জ্বর হয়েছে শীগগির একজন ডাক্তার ডেকে পাঠান।
মহিলাটি বেরিয়ে এলেন, বললেন, ‘আমি ডাক্তার।’ তিনি হরিশ্চন্দ্বকে পেরিয়ে তিন নম্বর ঘরের সামনে গেলেন। তিন নম্বরের অধিবাসী শচীতোষ সান্যাল আরক্ত চক্ষু বিস্ফারিত করে একবার ডাক্তারের পানে তাকালেন, তারপর দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন, ‘আসুন।’
হরিশচন্দ্র গোছা থেকে চাবি বেছে নিয়ে তালায় পর্যালেন, দরজা একটু ফাঁক করে ভিতরে দেখলেন; কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর দরজা টেনে আবার বন্ধ করে দিলেন।
বারান্দায় কেউ নেই। হরিশচন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে খাটো গলায় গুণধারকে বললেন, ‘গুণধর, তুমি এখানে থাকো, কোথাও যেও না। আমি এখনি আসছি।’ তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা। উত্তেজনায় শীৎকারের মত শোনাল।
তিনি পা টিপে টিপে নীচে নেমে গেলেন। তিন নম্বর ঘরে মহিলা ডাক্তার শোভনা রায় রোগী শচীতোষ সান্যালকে বিছানায় শুইয়ে তাঁর টেম্পরেচার নিলেন, নাড়ি দেখলেন, জিভ পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, ‘কিছু নয়, সামান ঠাণ্ডা লেগেছে। দুটো অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে শুয়ে থাকুন।’
শচীতোষ বললেন, ‘জ্বর কত?’
‘নাইনটি-নাইন।’
‘গায়ে যে ভীষণ ব্যথা।’
‘ও কিছু নয়। দো-রসার সময় হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে যায়। আমি অ্যাসপিরিনের বড়ি পাঠিয়ে ििछ!’
‘আপনার ফি কত?
‘ফি দিতে হবে না।’
তিন নম্বর থেকে বেরিয়ে শোভনা রায় দেখলেন, গুণধর দুনিম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ ঘরে কী হয়েছে?’
গুণধর কেবল মাথা নাড়ল। শোভনা রায় আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন।
নীচে হরিশচন্দ্র তখন নিজের অফিস-ঘর থেকে পুলিসকে ফোন করছেন, ‘শীগগির আসুন, খুন হয়েছে–!’
গত রাত্রে ইন্সপেক্টর রাখাল সরকারের বাড়িতে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের নেমন্তন্ন ছিল। সরকার মশায় দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার অধিকারী থানাদার। ব্যোমকেশরা যখন কেয়াতলায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করতে আরম্ভ করেছিল তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল; পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হলো। সরকার মশায় পুলিস হলেও অত্যন্ত মিশুক এবং সহৃদয় বুড়ি বয়সে বোমকেশের চেয়ে কিছু ছোট, তাই বন্ধুত্বের সঙ্গে অনেকখানি সম্ভ্রম মেশানো ছিল।
ব্যোমকেশের সঙ্গে অজিতও এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। গল্পসল্প চলল। অনেক রাত পর্যন্ত। রাত বাড়ল কিন্তু গল্প শেষ হলো না। খাওয়া-দাওয়ার পর অজিত উঠি-উঠি করছে দেখে রাখালবাবু বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, আপনি আজ রাতটা না হয় এখানেই থেকে যান। কাল সকালে একেবারে বড়ির কাজ তদারক করে বাসায় ফিরবেন।‘
ব্যোমকেশ বলল, ‘মন্দ কথা নয়। অজিত তুমি আজ ফিরে যাও, আমি কাল কাজকর্ম দেখে ফিরব।’
অজিত চলে গেল। কলকাতা শহরে এপাড়া থেকে ওপাড়া যাওয়া বিদেশ-যাত্রার সমান।
পরদিন সকাল পৌনে আটটার সময় ব্যোমকেশ চা-জলখাবার খেয়ে বেরুবার উপক্রম করছে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রাখালবাবু ফোন ধরে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে শুনলেন : দুএকটা কথা বললেন, তারপর ফোন রেখে দিয়ে ব্যোমকেশকে বললেন, ‘থানা থেকে বলছিল। আমার এলাকায় একটা হোটেলে খুন হয়েছে। বেশ রহস্যময় ব্যাপার মনে হচ্ছে। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’
ব্যোমকেশ বলল, ‘রহস্যময় খুন! নিশ্চয় যাব।’
ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার ব্যোমকেশকে নিয়ে যখন নিরুপমা হোটেলে পৌঁছুলেন তখন থানা থেকে দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে হোটেল দখল করেছে। সদর দরজায় একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের লোককে হোটেলে রাখা হয়েছে, বাইরের লোককে বাইরে।
রাখালবাবু্, হরিশচন্দ্রের অফিসে প্রবেশ করে দেখলেন, পুলিসের ডাক্তার কালো ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। রাখালবাবু বললেন, ‘এই যে ডাক্তার এসে গেছেন দেখছি–আপনি হোটেলের ম্যানেজার?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আপনিই লাশ আবিষ্কার করেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
ইন্সপেক্টর সরকার এবং ব্যোমকেশ বক্সী পাশাপাশি চেয়ারে বসলেন, রাখালবাবু বললেন, ‘বেশ। আপনি কী জানেন সংক্ষেপে বলুন।’
আজ সকাল থেকে যা যা ঘটেছিল হরিশচন্দ্র বললেন। শুনে রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকালেন, ব্যোমকেশ একটু ঘাড় নাড়ল। রাখালবাবু তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক কাজ করেছেন। চলুন ডাক্তার, এবার লাশ পরিদর্শন করা যাক।।’
হরিশচন্দ্র আগে আগে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চললেন; তাঁর পিছনে রাখালবাবু্, ব্যোমকেশ ও ডাক্তার।
দোতলায় দুনম্বর ঘরের সামনে গুণধরের বদলে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। হরিশচন্দ্র চাবি দিয়ে ঘর খুলে দিলেন। তখন ঘরের ভিতরটি দেখা গেল।
ঠিক দরজার সামনে মেঝের ওপর একটি পুরুষের মৃতদেহ ডানদিকে কত হয়ে পড়ে আছে; পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। মুখখানা দেখে চমকে উঠতে হয়; কেউ যেন ধারালো ছুরি দিয়ে মুখখানাকে ফাল-ফালা করে কেটেছে, তারপর অত্যন্ত অযত্নভরে আবার জোড়া দিয়েছে। কাটা দাগগুলো তাজা নয়, অনেকদিনের পুরনো; শুকনো ক্ষতের দাগ মুখখানাকে কদাকার করে দিয়েছে।
মৃত্যুর কারণ কিন্তু অন্যত্র। গেঞ্জির বুকের ওপর খানিকটা রক্ত শুকিয়ে আছে।
দোরের কাছ থেকে কিছুক্ষণ মৃতদেহ পরিদর্শন করে রাখালবাবু বললেন, ‘ডাক্তার, আপনি আগে লাশ পরীক্ষা করুন। আপনার কাজ হয়ে গেলে আমরা ঘরে ঢুকব।’
ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করলেন, বাকি তিনজন লাশের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যোমকেশ একবার আড়চোখে হরিশচন্দ্রের মুখের পানে তাকালো, কিন্তু সেখানে ভয়ার্তি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
‘কী ব্যাপার বলুন দেখি? আমাকে এখনি বেরুতে হবে, কিন্তু পুলিস বেরুতে দিচ্ছে না। এর মানে কি?’ মহিলা কণ্ঠের উষ্ণ স্বর শুনে তিনজনে পিছু ফিরে তাকালেন। একটি মহিলা ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’
হরিশচন্দ্র পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি এক নম্বর ঘরে থাকেন, ডক্টর মিসেস শোভনা রায়।’
রাখালবাবু মিনতির সুরে বললেন, ‘দেখুন, এই ঘরে কাল রাত্রে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। এ হোটেলে যাঁরা আছেন। সকলকেই আমাদের জেরা করতে হবে। জেরা করার আগে কাউকে বাইরে যেতে দিতে পারি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্তু থাকুন, সকলের আগে আমি আপনাকে জেরা করে ছেড়ে দেব।’
মহিলাটির মুখের ভাব বদলে গেল, তিনি শঙ্কিত চক্ষে চেয়ে বললেন, ‘খুন হয়েছে! আমার পাশের ঘরে খুন হয়েছে। কখন? কে খুন করেছে?’
ইন্সপেক্টর মাথা নেড়ে বললেন, ‘তা এখনো জানা যায়নি। আপনি নিজের ঘরে গিয়ে বসুন, আমরা এখনি আসছি।’
মহিলাটি একটু ইতস্তত করলেন, একবার দুনম্বর ঘরের দিকে উঁকি মারলেন, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন উপস্থিত হয়েছিল, রাখালবাবু তাদের বললেন, ‘তোমরা একজন তেতলায় এবং একজন দোতলায় যত অতিথি আছেন। সকলের নাম-ধাম ঠিকানা নিয়ে নাও, কাল রাত্রে কে কোথায় ছিল খবর নাও। কেবল এক নম্বর আর তিন নম্বর ঘরে তোমাদের যাবার দরকার নেই, ওঁদের আমি জেরা করব।’
সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পরে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘এবার লাশ সরাতে পারেন।’
রাখালবাবু বললেন, ‘কি দেখলেন?’
ডাক্তার উত্তর দিলেন, ‘ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে; ছুরি কিংবা ওই রকম কোনো সরু ধারালো অস্ত্র। পাঁজরার ফাঁক দিয়ে একেবারে হৃদযন্ত্রে প্রবেশ করেছে। এ পেশাদার খুনীর কাজী : ওই একটি বই ক্ষতচিহ্ন নেই, প্রথম মারেই মর্মস্থানে পৌঁচেছে।’
‘হুঁ। মৃত্যুর সময়?’
‘অটপ্সি না করে নিশ্চয়ভাবে বলা শক্ত, সম্ভবত কাল রাত্ৰি নটা থেকে বারোটার মধ্যে।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘মুখের দাগগুলো কতদিনের পুরনো?’
‘দশ বারো বছরের কম নয়।’ ‘বয়স কত হবে? মুখ দেখে তো বোঝা যায় না।’
‘চল্লিশের আশেপাশে–আচ্ছা, এখন আমি চলি। তাড়াতাড়ি লাশ পাঠিয়ে দেবেন, আজই কাটবো। কাল রিপোর্ট পাবেন।’ ডাক্তার চলে গেলেন।
রাখালবাবু হরিশচন্দ্রকে বললেন, ‘আপনি নিজের কাজে যান। অফিসেই থাকবেন। এ ঘরের চাবিটা আমায় দিন।’
আধঘণ্টা পরে লাশ চালান করে দিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। অর্থাৎ—অতঃ কিম?
ব্যোমকেশ এক নম্বর ঘরের দিকে আঙুল দেখালে, ‘মহিলাটির সওয়াল-জবাব আগে সেরে নিন। মহিলা এবং ডাক্তারের অধিকার আগে।’
‘ঠিক ঠিক। ওঁকে ছেড়ে দিয়ে তারপর এ ঘরটা দেখা যাবে।’ রাখালবাবু দুনম্বরের দোরে ঢাবি দিয়ে বললেন, ‘আসুন।’
এক নম্বরের দোরে টোকা দিতেই দোর খুলে গেল। মহিলাটির মুখ অপ্রসন্ন। তাঁর বেঁটে নিরেট গোছের শরীরটি আঁটসাঁট পোশাকের মধ্যে যেন অধীরতায় ফেটে পড়বার উপক্রম করছে। তিনি বললেন, ‘যত শীগগির পারেন আমাকে ছেড়ে দিন দারোগাবাবু। আমার কাজের ক্ষতি হচ্ছে।’
‘দুচারটে প্রশ্ন করেই আপনাকে ছেড়ে দেব।’ রাখালবাবু খাতা পেন্সিল বার করে প্রশ্ন আরম্ভ করলেন, ‘আপনার পুরো নাম?’
‘মিসেস শোভনা রায়।’
‘বয়স?’
‘উনপঞ্চাশ।’
‘স্বামীর নাম?’
‘স্বর্গীয় রামরতন রায়।’
‘আপনি ডাক্তার। কোথায় ডাক্তারি করেন?’
‘বহরমপুরে।’
‘কলকাতায় এসেছেন কেন?’
‘আমি গাইনকোলজিস্ট, প্রধানত স্ত্রী-রোগের চিকিৎসা করি। সেবা সদনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, মাঝে মাঝে আসি।’
‘কলকাতায় আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’
‘আমার কোথাও কেউ নেই।’
‘ছেলে।পুলে?’
না। একটা মেয়ে ছিল, অনেকদিন মরে গেছে।’
মিসেস রায়ের মুখ ক্ষণেকের জন্য কঠিন হয়ে উঠল, তারপর আবার স্বাভাবিক হলো। মহিলাটির মুখখানি সুশ্ৰী নয়, কঠিন হলে আরো কুশ্রী দেখায়।
‘কলকাতায় যখন আসেন। এখানেই ওঠেন?’
‘হ্যাঁ। এখানে উঠলে সুবিধে হয়।’
‘এবার কবে এসেছেন?’
‘পরশু।‘
‘কাল রাত্রে পাশের ঘরে রাজকুমার বসু নামে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। তাঁকে আপনি চিনতেন?’
‘না, কখনো নাম শুনিনি।’
‘আগে কখনো দেখেননি? পাশাপাশি ঘরে ছিলেন। তাই জিজ্ঞাসা করছি।’
‘না। ও মুখ দেখলে মনে থাকত।’
‘কাল রাত্রি আটটার পর আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘আটটার সময় আমি সেবা সদন থেকে ফিরে আসি।। ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড়-চোপড় বদলে নীচে ডাইনিং রুমে খেতে গেলুম। ন’টার আগেই ঘরে ফিরে এলুম। তারপর আর ঘর থেকে বেরোইনি।’
‘রাত্রে কিছু জানতে পেরেছিলেন?’
‘আমি সওয়া ন’টার সময় শুয়ে পড়েছিলুম; কিন্তু বার বার ঘুমের বিঘ্ন হচ্ছিল। পাশের ঘরের শব্দে চটকা ভেঙে যাচ্ছিল।’
‘পাশের ঘরে শব্দ হচ্ছিল?’
‘ঘরে শব্দ হচ্ছিল। কিনা শুনতে পাইনি। কিন্তু ঘরের দরজা বার বার খুলছিল। আর বন্ধ হচ্ছিল।’
‘রাত্রি তখন কত?’
‘ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে।’
‘আপনি কিছু করলেন?’
‘কী করব! হোটেলে অনেক অবিবেচক লোক আসে, তারা পরের সুবিধা অসুবিধা বোঝে না।’
‘আজ সকলে কখন জানতে পারলেন?’
‘খুন হয়েছে আপনার কাছে জানলাম। ভোরবেলা চাকর বেড়-টি দিয়ে গেল। তারপর আমি তৈরি হয়ে বেরুতে যাচ্ছি, নীচে ব্রেক-ফার্স্ট খেয়ে কাজে যাব, এমন সময় পাশের ঘরে দোর-ঠেলাঠেলি চেঁচামেচি শুনতে পেলুম। বেরিয়ে দেখলুম ম্যানেজার; জিজ্ঞেস করলুম কী হয়েছে, সে কিছু বলল না। তারপর তিন নম্বর ঘরে গেলাম—’
‘তিন নম্বর ঘরে গেলেন কেন?’
‘তিন নম্বরের ভদ্রলোকটির শরীর খারাপ হয়েছে, ডাক্তার খুঁজছিলেন। তাই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলুম।’
‘তাকে আগে থাকতে চিনতেন বুঝি?
‘দেখেছি। কিন্তু চেনা-পরিচয় কিছু ছিল না। তাঁর নামও জানি না।
‘ও-কি হয়েছে ভদ্রলোকের?’
‘ঠাণ্ডা লেগে সামান্য জ্বর হয়েছে।’
রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন, ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে জানাল আর কোনো প্রশ্ন নেই। রাখালবাবু শোভনা রায়কে বললেন, ‘আপাতত আর কোনো প্রশ্ন নেই, আপনি কাজে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে কলকাতা ছাড়বেন না।’
শোভনা রায়ের মুখ বিরক্ত হয়ে উঠল। তিনি উত্তর না দিয়ে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালেন।
দুনম্বর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে রাখালবাবু বললেন, ‘মহিলাটির মেজাজ একটু কড়া। ভয় পাননি; বোধহয় পুলিসের কার্যকলাপের সঙ্গে পরিচয় আছে। ডাক্তার তো।—যাহোক, আসুন দেখা যাক ঘরের মধ্যে আততায়ী কোনো চিহ্ন রেখে গেছে। কিনা।–কনস্টেবল হাজরা, তুমি নীচে গিয়ে হেড-অফিসে ফোন করে–যেন ফিঙ্গারপ্ৰিণ্ট এক্সপার্টদের পাঠানো হয়।’ কেলেস্টরল সালুট করে চলে গেল। য়াখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দোর ভেজিয়ে
ঘরটি আয়তনে দশ ফুট বাই বারো ফুট। একটি একহারা লোহার খািট; ছোট টেবিল এবং চেয়ার, দেয়ালে আয়না লাগানো। তার পাশে কাপড় রাখার আলনা; মাথার ওপর ফ্যান। দু’জনে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টি ফেরালেন।
রাখালবাবু বললেন, ‘বিছানাটা দেখেছেন?’
‘দেখেছি। বিছানা এবং আলনা— দুইই দ্রষ্টব্য।’
বিছানা দেখে মনে হয় কাল রাত্রে রাজকুমার বসু বিছানায় শুয়েছিল; চাদর একটু কুঁচকে আছে, বালিশের ওপর মাথার দাগ। আলনায় একটি কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি টাঙানো রয়েছে।
রাখালবাবু বললেন, ‘হুঁ। কি মনে হচ্ছে?’
‘মনে হচ্ছে কাল রাত্রে রাজকুমার বসু কাপড় পাঞ্জাবি ছেড়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে শুয়েছিল। তারপর একসময় দোরে টোকা পড়ল। রাজকুমার বিছানা থেকে উঠে যেই দোর খুলল আততায়ী অমনি বাইরে থেকে তার বুকে ছুরি মারল। রাজকুমার পড়ে গেল। আর উঠল না। আততায়ী দরজা টেনে বন্ধ করে চলে গেল। আমার বিশ্বাস আততায়ী ঘরে ঢোকেনি, ফিঙ্গারপ্ৰিণ্ট এক্সপার্ট রাজকুমার ছাড়া আর কারুর আঙুলের ছাপা ঘরের মধ্যে পাবে না। দোরের হাতলে আততায়ীর আঙুলের ছাপা হয়তো ছিল, কিন্তু এখন আর পাওয়া যাবে না। তার ওপর আরো অনেক আঙুলের ছাপা পড়েছে।’
রাখালবাবু বললেন, ‘তা বটে। তবু অধিকন্তু ন দোষায়। আসুন, ঘরটা তল্লাশ করে দেখা यांक।?
ব্যোমকেশ বলল, ‘আপনি তল্লাশ করুন। আমি কোনো জিনিসে হাত দেব না, তাতে আঙুলের ছাপ বেড়ে যাবে।’
‘বেশ, আপনি তাহলে দাঁড়িয়ে তদারক করুন।’
রাখালবাবু বিধিবদ্ধভাবে তল্লাশ আরম্ভ করলেন। টেবিলের দেরাজ, পাঞ্জাবির পকেট, বিছানার তেশকের নীচে, সর্বত্র অনুসন্ধান করলেন। কিন্তু কিছু পেলেন না। অবশেষে খাটের তলা শুধু একটা সুটকেস টেন বার করলেন। মৃতের এই একটিমাত্র মাল ধরে আছে, আর কিছু নেই।
সুটকেসের গায়ে চাবি লাগানো ছিল, রাখালবাবু ডালা তুললেন। দেখা গেল, দু’ সেট জামাকাপড় রয়েছে। কাপড়ের নীচে এক গোছা দশ টাকার নোট, আর একটি ডায়েরির আকারের ছোট বাঁধানো খাতা।
খাতাটি সরিয়ে রেখে রাখালবাবু প্রথমে দশ টাকার নোটগুলি শুনলেন; একশো কুড়িখানা নোট, অর্থাৎ ঠিক ১২০০ টাকা। তিনি নোটগুলি নিজের পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, ‘দেখা যাচ্ছে, যে খুন করেছে তার টাকার লোভ নেই।’ তিনি খাতাটি তুলে নিলেন।
খাতার নাম পৃষ্ঠায় নাম লেখা রয়েছে–সুকান্ত সোম। রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ বলল, ‘রাজকুমার নামটা তাহলে মেকি। কিন্তু–সুকান্ত সোম! যেন কোথায় শুনেছি, মাথার মধ্যে একটা ঘন্টি বাজছে। আপনি শোনেননি?’
‘মনে পড়ছে না।’ রাখালবাবু খাতার পাতা ওলটাতে লাগলেন। প্রত্যেক পাতার মাথায় একটি শহরের নাম, যেমন–কাশী কলকাতা কটক। শহরের নীচে কয়েকটি নাম ও ঠিকানা, সম্ভবস্থলে টেলিফোন নম্বর। কলকাতার পাতায় চারটি নাম লেখা আছে, প্রায় প্রত্যেক নামের পাশে একটি টাকার অঙ্ক। যথা—
মোহনলাল কুণ্ডু
১১৭ডি, পানাপুকুর লেন
শ্যামাকান্ত লাহিড়ী ৫০০্
৩০/১, লোক কলোনী
জগবন্ধু পাত্র ৪০০্
৫৬, রাম ভাদুড়ী লেন
লতিকা চৌধুরী ৩০০্
১৭, গান্ধী পার্ক
খাতাখানা ব্যোমকেশের হাতে দিয়ে রাখালবাবু বললেন, ‘দেখুন যদি কিছু হদিস পান।’
ব্যোমকেশ খাতাখানা মন দিয়ে পরীক্ষা করে বলল, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে লোকটার পেশা ছিল ব্ল্যাকমেল করা।’
‘অন্য পেশা কি সম্ভব নয়? যেমন ধরুন, বীমার দালাল।’
‘অসম্ভব বলছি না। কিন্তু বীমার দালালকে কেউ খুন করে না। তারা ছদ্মনামেও ঘুরে বেড়ায় না।’
‘তাহলে আপনি মনে করেন, রাজকুমার বসু যাদের ব্ল্যাকমেলা করছিল তাদের মধ্যে কেউ তাকে খুন করেছে?’
‘কলকাতার ফিরিস্তিতে যাদের নাম আছে তাদের সওয়াল করলে কতকটা আন্দাজ করা যাবে।–চলুন, এবার তিন নম্বর মক্কেলের সঙ্গে দেখা করা যাক।’
‘চলুন।’
তিন নম্বর ঘরে শচীতোষ সান্যাল বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিলেন, পদশব্দ শুনে ঘাড় তুললেন। বললেন, ‘কে?’
রাখালবাবু সংক্ষেপে বললেন, ‘পুলিস।’
শচীতোষবাবু উঠে বসলেন, চক্ষু গোল করে বললেন, ‘পুলিস! কী চাই?’
রাখালবাবু বললেন, ‘আপনাকে দুচারটে প্রশ্ন করতে চাই। জানেন বোধহয় পাশের দুনিম্বর ঘরে খুন হয়েছে।’
শচীতোষবাবু মুহুর্তকাল নির্বাক থেকে আঁৎকে উঠলেন, ‘খুন হয়েছে! কে খুন হয়েছে?’
তিন নম্বর ঘরটি আয়তনে এবং আসবাবপত্রে অন্য দু’টি ঘরের অনুরূপ। রাখালবাবু বিছানার ধারে বসলেন। ব্যোমকেশ চেয়ারে বসল। রাখালবাবু বললেন, ‘দু নম্বরে যিনি ছিলেন কাল রাত্রে তিনি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম রাজকুমার বসু। আপনি তাঁকে চিনতেন নাকি?’
‘রাজকুমার বোস-না, চিনতাম না। কে খুন করেছে?’
‘তা এখন জানা যায়নি। আপনার নাম কি?’
‘শচীতোষ সান্যাল।’
‘নিবাস?’
‘ভাগলপুর। — আমার শরীর খারাপ, ডাক্তার শুয়ে থাকতে বলেছে।’
‘কোন ডাক্তার?’
‘মেয়ে ডাক্তার। ঠাণ্ডা লেগেছে, অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে শুয়ে থাকতে বলল। আচ্ছা, মেয়েরা কি ভাল ডাক্তার হয়?’
‘হাতে বাধা নেই। ঠাণ্ডা লাগালেন কি করে?
‘কাল সন্ধ্যের পর বেরিয়েছিলাম। গায়ে আলোয়ান ছিল না, ঠাণ্ডা লেগে গেছে।’
‘রাত্তিরে ঘর থেকে বেরোননি?’
‘না। ন’টার সময় ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে ঘরে ঢুকেছিলাম, আর বেরোইনি।’
‘ও কথা থাক। আপনি কবে কলকাতায় এসেছেন?’
‘তিন দিন হলো। আজ ফিরে যাবার কথা, কিন্তু
‘আপনি কলকাতায় এসেছেন কেন?’
‘আমার ঘিয়ের ব্যবসা আছে, গাঙ্গুরামকে ঘি যোগান দিই। তাই মাঝে মাঝে আসতে হয়। আচ্ছা, ঠাণ্ডা লাগা থেকে তো নিউমোনিয়া হতে পারে।’
‘তা পারে, কিন্তু আপনার হবে না। আপনি বেশ তাগড়া আছেন।–বয়স কত?’
‘বিয়াল্লিশ। দেখতে তাগড়া বটে, কিন্তু আমার শরীর ভারি পলকা, একটুতেই রোগে ধরে। বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে; কিছু খেলে রোগ বেড়ে যাবে না তো?’
‘গরম দুধ আর পাউরুটি খান। — রাজকুমার বোসকে তাহলে চিনতেন না?’
‘না, কখনো নাম শুনিনি।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘সুকান্ত নামটা কখনো শুনেছেন?’
শচীতোষ বললেন, ‘সুকান্ত? না। আমার শালার নাম ছিল শ্ৰীকান্তকুমার লাহিড়ী, মারা গেছে।’
রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাত্রে আপনি পাশের ঘরে কোনো শব্দ শুনেছিলেন?’
‘শব্দ? নাঃ। খেয়ে এসেই শুয়েছি, শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। বউ বলে, আমি একবার ঘুমেলে ডাকাত পড়লেও ঘুম ভঙে না। পাশের ঘরের লোকটাকে কী দিয়ে খুন করেছে? বন্দুক দিয়ে?’
‘না, ছুরি দিয়ে।’ রাখালবাবু উঠে পড়লেন, ‘আপনি পুলিসকে খবর না দিয়ে কলকাতা ছেড়ে যাবেন না। চলুন ব্যোমকেশদা।’
নীচে অফিস-ঘরে হরিশচন্দ্র জবুথবুভাবে বসেছিলেন, ব্যোমকেশদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন, কুষ্ঠিত প্রশ্ন করলেন, ‘কী হলো?’
রাখালবাবু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘এবার আপনাদের, অর্থাৎ হোটেলের স্টাফের এজেহার নেব। আপনাকে দিয়েই আরম্ভ করি। বসুন।’
তিনজনে বসলেন। রাখালবাবু সওয়াল-জবাব আরম্ভ করলেন, ‘আপনার পুরো নাম?’
‘হরিশচন্দ্র হোড়।’
‘আপনি হোটেলের ম্যানেজার। এখানেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন আছেন?
‘আট বছর।’
‘মৃত রাজকুমার বোস সম্বন্ধে কী জানেন বলুন।’
হরিশচন্দ্র মোটা খাতা বার করে খুললেন, ‘রাজকুমার বসু্্, ঠিকানা আদমপুর, পাটনা। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি বছরে দু’বার এখানে আসতেন, দু’ তিনদিন থাকতেন। হোটেল থেকে বেরুতেন না, এই অফিসে এসে তিন-চারজন বন্ধুকে টেলিফোন করতেন। তাঁরা এসে সন্ধ্যের পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। এর বেশি আমি কিছু জানি না।’
‘এবার তিনি কবে এসেছিলেন?’
‘পরশু।‘
‘টেলিফোন করেছিলেন?’
‘পরশু রাত্রে এলেন, সে-রাত্রে টেলিফোন করেননি। কাল সকালে করেছিলেন।’
‘রাজকুমারবাবু যখন আসতেন ওই দু’ নম্বর ঘরেই থাকতেন?’
না, যখন যে-ঘর খালি থাকত সেই ঘরে থাকতেন।’
‘রাজকুমারবাবুকি কাজ করতেন। আপনি জানেন?
‘আজ্ঞে না।’
‘আপনি কাল রাত্ৰে নিশ্চয় হোটেলেই ছিলেন?’
‘আজ্ঞে–’। হরিশচন্দ্র একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ঘণ্টা দুয়ের জন্যে একবার বেরিয়েছিলাম। আমি হোটেলে থাকি বটে, কিন্তু আমার পরিবার বাইরে ভাড়া বাড়িতে থাকে; মাঝে মাঝে তাদের দেখতে যাই। কাল রাত্রে অতিথিরা খেতে বসবার পর আমি বেরিয়েছিলাম, তারপর এগারোটা নাগাদ ফিরে আসি।’
‘আপনার অবর্তমানে হোটেলের ইন-চার্জ থাকে কে?’
‘সদার খানসামা গুণধর গুঁই।’
‘গুণধরকে একবার ডাকুন।’
গুণধরকে ডাকা হলো, সে এসে দাঁড়াল। আবার প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হলো।
‘রাজকুমার বোস–যিনি খুন হয়েছেন–তাঁর সম্বন্ধে তুমি কী জান?’
‘আজ্ঞে, বেশি কিছু জানি না। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন, দু’ তিনদিন থেকে চলে যেতেন।’
‘তোমার সঙ্গে তাঁর কোনো কথাবার্তা হতো না?’
‘আজ্ঞে, খুব কম। ফাই-ফরমাস করতেন, তার বেশি নয়।’
‘তাঁর দেখাশোনা করত কে?’
‘আজ্ঞে, আমি করতাম। সকালে বেড়-টি নিয়ে যেতাম, তারপর ব্রেকফার্স্ট লাঞ্চ ডিনার সব আমিই পৌঁছে দিতাম। দোতলায় যাঁরা থাকেন আমিই তাঁদের দেখাশোনা করি। তেতিলায় দেখাশোনা করে–’
‘ও—তাহলে রাজকুমারবাবু ডাইনিং রুমে খেতে নামতেন না।’
‘আজ্ঞে না।‘
‘কাল তুমি তাঁকে শেষবার কখন দেখেছ?’
‘রাত্রি পৌঁনে ন’টার সময় তাঁকে ডিনার দিতে গেছলাম, তারপর নাটার সময় এটো বাসন-কোসন আনতে গেছলাম। তখন তিনি বেঁচে ছিলেন।’
‘বুঝলাম। কিন্তু তিনি ডাইনিং রুমে যেতেন না কেন বলতে পার?’
‘তা-জানি না হুজুর। তবে— বোধহয়–তাঁর মুখখানা কাটাকুটি হয়ে বড় ইয়ে হয়ে গিয়েছিল-তাই তিনি সহজে লোকের সামনে বেরুতেন না।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে লোক আসত?’
‘তা আসত হুজুর।’
‘কাল কে কে এসেছিল তুমি জান?
‘আমি জানি না, জেনারেল সিং বলতে পারে।’
‘জেনারেল সিং।’
‘আজ্ঞে, আমাদের দারোয়ান। তার নাম রামপিরিত সিং, সবাই তাকে জেনারেল সিং বলে ডাকে।‘
‘ডাকো জেনারেল সিংকে।’
ভোজপুরী জোয়ান রামপিরিত সিং এসে গোড়ালিতে গোড়ালি ঠেকিয়ে স্যালুট করল। আখাম্বা চেহারা, জাঁদরেল পোশাক, ইয়া গোঁফ। রাখালবাবু তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, জেনারেল বটে। তুমি হোটেলের সদরে পাহারা দাও?’
রামপিরিত বলল, ‘জি। সকালে নটা থেকে বারোটা, বিকেলে পাঁচটা থেকে দশটা আমার ডিউটি।‘
‘হোটেলে যারা অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতে আসে তাদের নাম-ধাম তুমি লিখে রাখ?’
‘জি না, সে-রকম হুকুম নেই। যারা ভাল সাজ-পোশাক পরে আসে তাদের স্যালুট করি, যারা অতিথির রুম নম্বর জানতে চায় তাদের রুম নম্বর বলি।’
‘কাউকে আটকাও না?’
‘জি, ভাল জামা-কাপড় পরা থাকলে আটকাই না।’
‘আর যদি ছেঁড়া জাম-কাপড় হয়?’
‘তখন কটমট করে তাকাই।’
‘শাবাশ। এবার বল দেখি, কাল সন্ধ্যের পর দোতলার দু’ নম্বর ঘরের বাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?’
‘জি, এসেছিল। দু’জন মরদ আর একজন ঔরৎ। রাত্রি সওয়া ন’টার সময় এলেন ঔরৎ, তিনি ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে দোতলায় গেলেন; পাঁচ মিনিট পরে তিনি চলে গেলেন।’
‘তাঁর বয়স কত?
‘বিশ-পঁচিশ হবে হুজুর। গোরী, পাতলা লম্বা চেহারা, চোখে চশমা ছিল।’
‘বেশ। তারপর?’
‘তারপর সাড়ে ন’টার সময় এলেন এক মরদ। তিনি ঘরের নম্বর নিয়ে ওপরে গেলেন, পাঁচ মিনিট পরে ফিরে চলে গেলেন। এর চেহারা দুবলা, মুছ-দাড়ি আছে। থোড়া থোড়া।’
‘তারপর?’
‘পৌঁনে দশটার সময় আর একজন মরদ এলেন। মোটা-তাজা শরীর, খাঁটি বাঙ্গালী বাবু। তিনিও ওপরে গিয়ে পাঁচ মিনিট ছিলেন। তারপর আমার ডিউটির মধ্যে আর কেউ আসেনি হুজুর।’
জেনারেল রামপিরত সিং-এর চেহারা যত স্থূলই হোক, স্মৃতিশক্তি যে খুব তীক্ষ্ণ তাতে সন্দেহ নেই। রাখালবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘বহুৎ আচ্ছা। তুমি এখন আরাম কর গিয়ে।’
জেনারেল জোড়া পায়ে স্যালুট করে চলে গেল।
রাখালবাবু পকেট থেকে ১২০০ টাকার নোট বার করে হরিশচন্দ্রের হাতে দিলেন, বললেন, ‘আপাতত এ টাকাটা আপনার কাছে রাখুন, মৃতের সুটকেসে পাওয়া গেছে। টাকার জন্যে একটা রসিদ দিন।‘
ঘরে একটি লোহার সিন্দুক ছিল, হরিশচন্দ্র নোটগুলি সিন্দুকে রেখে রসিদ লিখে দিলেন। ব্যোমকেশ ভুরু কুঁচকে বসে রইল।
ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল, রাখালবাবু তাদের প্রশ্ন করলেন, ‘কি হলো?’
একটি সাব-ইন্সপেক্টর বলল, ‘আমি তেতলায় গিয়েছিলাম। সকলের নাম-ধাম লিখে দুয়েছি, সকলেই বলল, ন’টার পর ভিলার খেয়ে তার ঘরে ফিরে এসেছিল, আর ঘর থেকে বেরোয়নি।’
‘তাদের কথা সত্যি কিনা যাচাই করেছিলে?’
‘কি করে যাচাই করব? প্রত্যেকের আলাদা ঘর। তবে একটা প্রমাণ আছে, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ হলে একটা চাকর তেতলার সিড়ির সামনে শোয়; তাকে ডিঙিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব নয়। আমি চাকরিটাকে জিজ্ঞেস করেছি, সে বলল, রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সে শুতে গিয়েছিল, তারপর আর কেউ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামেনি।’
‘বেশ। —আর তুমি?’
দ্বিতীয় সাব-ইন্সপেক্টর বলল, ‘দোতলাতেও একই অবস্থা। সকলের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়েছি। দোতলার সিঁড়ির মুখে যো-চাকরটা শোয় সে বলল, পৌঁনে এগারোটার সময় সে শুতে গিয়েছিল, তারপর আর কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি।’
ম্যানেজার বললেন, ‘রাত্রে যদি কোনো অতিথির কিছু দরকার হয়, তাই এই ব্যবস্থা।’
‘বুঝলাম।’–রাখালবাবু ঘড়ি দেখলেন, বারোটা বেজে গেছে। তিনি ব্যোমকেশকে বললেন, ‘এখানকার কোজ আপাতত এই পর্যন্ত। চলুন এবার বেরিয়ে পড়া যাক, রাস্তায় কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। ভাগ্যক্রমে চারজন মক্কেলের বাড়ি কাছাকাছির মধ্যেই, বেশি ঘোরাঘুরি করতে হবে না। আপনার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল–’
ব্যোমকেশ বলল, ‘কোনো ক্ষতি নেই, আমি অজিতকে টেলিফোন করে দিচ্ছি।’
সে টেলিফোন তুলে নিল। হরিশচন্দ্র বললেন, ‘যদি আপত্তি না থাকে এখানেই আপনাদের সকলের আহারের ব্যবস্থা করেছি।’
রাখালবাবু হেসে বললেন, ‘খুব ভাল কথা।’