রাজর্ষি – (31-35)
একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মোগল-সৈন্যের কর্তা হইয়া নক্ষত্ররায় পথের মধ্যে তেঁতুলে-নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে বিশ্রাম করিতেছিলেন। প্রভাতে রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “যাত্রা করিতে হইবে মহারাজ, প্রস্তুত হোন।”
সহসা রঘুপতির মুখে মহারাজ শব্দ অত্যন্ত মিষ্ট শুনাইল। নক্ষত্ররায় উল্লসিত হইয়া উঠিলেন। তিনি কল্পনায় পৃথিবীসুদ্ধ লোকের মুখ হইতে মহারাজ সম্ভাষণ শুনিতে লাগিলেন। তিনি মনে মনে ত্রিপুরার উচ্চ সিংহাসনে চড়িয়া সভা উজ্জ্বল করিয়া বসিলেন। মনের আনন্দে বলিলেন, “ঠাকুর, আপনাকে কখনোই ছাড়া হইবে না। আপনাকে সভায় থাকিতে হইবে। আপনি কী চান সেইটে আমাকে বলুন।”
নক্ষত্ররায় মনে মনে রঘুপতিকে তৎক্ষণাৎ বৃহৎ একখণ্ড জায়গির অবলীলাক্রমে দান করিয়া ফেলিলেন।
রঘুপতি কহিলেন, “আমি কিছু চাহি না।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “সে কী কথা! তা হইবে না ঠাকুর। কিছু লইতেই হইবে। কয়লাসর পরগনা আমি আপনাকে দিলাম– আপনি লেখাপড়া করিয়া লউন।”
রঘুপতি কহিলেন, “সে-সকল পরে দেখা যাইবে।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “পরে কেন, আমি এখনি দিব। সমস্ত কয়লাসর পরগনা আপনারই হইল; আমি এক পয়সা খাজনা লইব না।”
বলিয়া নক্ষত্ররায় মাথা তুলিয়া অত্যন্ত সিধা হইয়া বসিলেন।
রঘুপতি কহিলেন, “মরিবার জন্য তিন হাত জমি মিলিলেই সুখী হইব। আমি আর কিছু চাহি না।” বলিয়া রঘুপতি চলিয়া গেলেন। তাঁহার জয়সিংহকে মনে পড়িয়াছে। জয়সিংহ যদি থাকিত তবে পুরস্কারের স্বরূপ কিছু লইতেন– জয়সিংহ যখন নাই তখন সমস্ত ত্রিপুরা রাজ্য মৃত্তিকার সমষ্টি ছাড়া আর-কিছু মনে হইল না।
রঘুপতি এখন নক্ষত্ররায়কে রাজাভিমানে মত্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহার মনের মধ্যে ভয় আছে পাছে এত আয়োজন করিয়া সমস্ত ব্যর্থ হয়, পাছে দুর্বলস্বভাব নক্ষত্ররায় ত্রিপুরায় গিয়া বিনাযুদ্ধে রাজার নিকট ধরা দেন। কিন্তু দুর্বল হৃদয়ে একবার রাজ্যমদ জন্মিলে আর ভাবনা নাই। রঘুপতি নক্ষত্ররায়ের প্রতি আর অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন না, কথায় কথায় তাঁহার সম্মান দেখাইয়া থাকেন। সকল বিষয়ে তাঁহার মৌখিক আদেশ লইয়া থাকেন। মোগল-সৈন্যেরা তাঁহাকে মহারাজা সাহেব বলে, তাঁহাকে দেখিলে শশব্যস্ত হইয়া উঠে– বায়ু বহিলে যেমন সমস্ত শস্যক্ষেত্র নত হইয়া যায় তেমনি নক্ষত্ররায় আসিয়া দাঁড়াইলে সারি সারি মোগল-সেনা একসঙ্গে মাথা নত করিয়া সেলাম করে। সেনাপতি সসম্ভ্রমে তাঁহাকে অভিবাদন করেন। শত শত মুক্ত তরবারির জ্যোতির মধ্যে বৃহৎ হস্তীর পৃষ্ঠে রাজচিহ্ন-অঙ্কিত স্বর্ণমণ্ডিত হাওদায় চড়িয়া তিনি যাত্রা করেন, সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসজনক বাদ্য বাজিতে থাকে– সঙ্গে সঙ্গে নিশানধারী রাজনিশান ধরিয়া চলে। তিনি যেখান দিয়া যান, সেখানকার গ্রামের লোক সৈন্যের ভয়ে ঘরবাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়া যায়। তাহাদের ত্রাস দেখিয়া নক্ষত্ররায়ের মনে গর্বের উদয় হয়। তাঁহার মনে হয়, আমি দিগ্বিজয় করিয়া চলিয়াছি। ছোটো ছোটো জমিদারগণ নানাবিধ উপঢৌকন লইয়া আসিয়া তাঁহাকে সেলাম করিয়া যায়– তাহাদিগকে পরাজিত নৃপতি বলিয়া বোধ হয়; মহাভারতের দিগ্বিজয়ী পাণ্ডবদের কথা মনে পড়ে।
একদিন সৈন্যেরা আসিয়া সেলাম করিয়া কহিল, “মহারাজ সাহেব!” নক্ষত্ররায় খাড়া হইয়া বসিলেন।
আমরা মহারাজের জন্য জান দিতে আসিয়াছি– আমরা জানের পরোয়া রাখি না। বরাবর আমাদের দস্তুর আছে, লড়াইয়ে যাইবার পথে আমরা গ্রাম লুঠ করিয়া যাই– কোনো শাস্ত্রে ইহাতে দোষ লিখে না।”
নক্ষত্ররায় মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক কথা, ঠিক কথা।”
সৈন্যেরা কহিল, “ব্রাহ্মণ-ঠাকুর আমাদের লুঠ করিতে বারণ করিয়াছেন। আমরা জান দিতে যাইতেছি, অথচ একটু লুঠ করিতে পারিব না, এ বড়ো অবিচার।”
নক্ষত্ররায় পুনশ্চ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক কথা, ঠিক কথা।” “মহারাজার যদি হুকুম মিলে তো আমরা ব্রাহ্মণ-ঠাকুরের কথা না মানিয়া লুঠ করিতে যাই।”
নক্ষত্ররায় অত্যন্ত স্পর্ধার সহিত কহিলেন, “ব্রাহ্মণ-ঠাকুর কে! ব্রাহ্মণ-ঠাকুর কী জানে! আমি তোমাদিগকে হুকুম দিতেছি তোমরা লুঠপাট করিতে যাও।”
বলিয়া একবার ইতস্তত চাহিয়া দেখিলেন, কোথাও রঘুপতিকে না দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন।
কিন্তু রঘুপতিকে এইরূপে অকাতরে লঙ্ঘন করিয়া তিনি মনের মধ্যে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিলেন। ক্ষমতামদ মদিরার মতো তাঁহার শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হইতে লাগিল। পৃথিবীকে নূতন চক্ষে দেখিতে লাগিলেন। কাল্পনিক বেলুনের উপরে চড়িয়া পৃথিবীটা যেন অনেক নিম্নে মেঘের মতো মিলাইয়া গেল। এমন-কি, মাঝে মাঝে কদাচ কখনো রঘুপতিকেও নগণ্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। সহসা বলপূর্বক গোবিন্দমাণিক্যের প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। মনে মনে বার বার করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমাকে নির্বাসন! একটা সামান্য প্রজার মতো আমাকে বিচারসভায় আহ্বান! এবার দেখি কে কাহাকে নির্বাসিত করে। এবার ত্রিপুরাসুদ্ধ লোক নক্ষত্ররায়ের প্রতাপ অবগত হইবে।”
নক্ষত্ররায় ভারী উৎফুল্ল ও স্ফীত হইলেন।
নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অনর্থক উৎপীড়ন ও লুঠপাটের প্রতি রঘুপতির বিশেষ বিরাগ ছিল। নিবারণ করিবার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু সৈন্যরা নক্ষত্ররায়ের আজ্ঞা পাইয়া তাঁহাকে অবহেলা করিল। তিনি নক্ষত্ররায়ের কাছে আসিয়া বলিলেন, “অসহায় গ্রামবাসীদের উপরে কেন এ অত্যাচার!”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “ঠাকুর, এ-সব বিষয়ে তুমি ভালো বোঝ না। যুদ্ধবিগ্রহের সময় সৈন্যদের লুঠপাটে নিষেধ করিয়া নিরুৎসাহ করা ভালো না।” নক্ষত্ররায়ের কথা শুনিয়া রঘুপতি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন। সহসা নক্ষত্ররায়ের শ্রেষ্ঠত্বাভিমান দেখিয়া তিনি মনে মনে হাসিলেন। কহিলেন, “এখন লুঠপাট করিতে দিলে পরে ইহাদিগকে সামলানো দায় হইবে। সমস্ত ত্রিপুরা লুঠিয়া লইবে।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “তাহাতে হানি কী? আমি তো তাহাই চাই। ত্রিপুরা একবার বুঝুক, নক্ষত্ররায়কে নির্বাসিত করার ফল কী। ঠাকুর, এ-সব বিষয় তুমি কিছু বোঝ না– তুমি তো কখনো যুদ্ধ কর নাই।”
রঘুপতি মনে মনে অত্যন্ত আমোদ বোধ করিলেন। কিছু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেলেন। নক্ষত্ররায় নিতান্ত পুত্তলিকার মতো না হইয়া একটু শক্ত মানুষের মতো হন, এই তাঁহার ইচ্ছা ছিল।
দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ত্রিপুরায় ইঁদুরের উৎপাত যখন আরম্ভ হয় তখন শ্রাবণ মাস। তখন ক্ষেত্রে কেবল ভুট্টা ফলিয়াছিল, এবং পাহাড়ে জমিতে ধান্যক্ষেত্রেও পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তিন মাস কোনোমতে কাটিয়া গেল– অগ্রহায়ণ মাসে নিম্নভূমিতে যখন ধান কাটিবার সময় আসিল তখন দেশে আনন্দ পড়িয়া গেল। চাষারা[১] স্ত্রীলোক বালক যুবক বৃদ্ধ সকলে মিলিয়া দা হাতে লইয়া ক্ষেত্রে গিয়া পড়িল। হৈয়া হৈয়া শব্দে পরস্পর পরস্পরকে আহ্বান করিতে লাগিল। জুমিয়া রমণীদের গানে মাঠ-বাট ধ্বনিত হইয়া উঠিল। রাজার প্রতি অসন্তোষ দূর হইয়া গেল– রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হইল। এমন সময় সংবাদ আসিল, নক্ষত্ররায় রাজ্য আক্রমণের উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানায় আসিয়া পৌঁছিয়াছেন এবং অত্যন্ত লুঠপাট উৎপীড়ন আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন– এই সংবাদে সমস্ত রাজ্য শঙ্কিত হইয়া উঠিল।
এ সংবাদ রাজার বক্ষে ছুরির মতো বিদ্ধ হইল। সমস্ত দিনই তাঁহাকে বিঁধিতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া কেবলই প্রত্যেক বার নূতন করিয়া তাঁহার মনে হইতে লাগিল নক্ষত্ররায় তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে। নক্ষত্ররায়ের সরল সুন্দর মুখ শতবার তাঁহার স্নেহচক্ষের সম্মুখে দেখিতে লাগিলেন এবং সেই সঙ্গেই মনে হইতে লাগিল, সেই নক্ষত্ররায় কতকগুলো সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তলোয়ার হাতে লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে। এক-একবার তাঁহার মনে মনে ইচ্ছা করিতে লাগিল একটি সৈন্যও না লইয়া নক্ষত্ররায়ের সম্মুখে বৃহৎ রণক্ষেত্রে একা দাঁড়াইয়া সমস্ত বক্ষস্থল অবারিত করিয়া নক্ষত্ররায়ের সহস্র সৈনিকের তরবারি এক কালে তাঁহার হৃদয়ে গ্রহণ করেন।
তিনি ধ্রুবকে কাছে টানিয়া বলিলেন, “ধ্রুব, তুইও কি এই মুকুটখানার জন্য আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতে পারিস।” বলিয়া মুকুট ভূমিতে ফেলিয়া দিলেন, একটি বড়ো মুক্তা ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল।
ধ্রুব আগ্রহের সহিত হাত বাড়াইয়া কহিল, “আমি নেব।”
রাজা ধ্রুবের মাথায় মুকুট পরাইয়া তাহাকে কোলে লইয়া কহিলেন, “এই লও– আমি কাহারও সহিত ঝগড়া করিতে চাই না।” বলিয়া অত্যন্ত আবেগের সহিত ধ্রুবকে বুকে চাপিয়া ধরিলেন।
তাহার পরে সমস্ত দিন ধরিয়া “এ কেবল আমারই পাপের শাস্তি” বলিয়া রাজা নিজের সহিত তর্ক করিতে লাগিলেন। নহিলে ভাই কখনো ভাইকে আক্রমণ করে না। ইহা মনে করিয়া তাঁহার কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা হইল। তিনি মনে করিলেন, ইহা ঈশ্বরের বিধান। জগৎপতির দরবার হইতে আদেশ আসিয়াছে, ক্ষুদ্র নক্ষত্ররায় কেবল তাহার মানবহৃদয়ের প্ররোচনায় তাহা লঙ্ঘন করিতে পারে না। এই মনে করিয়া তাঁহার আহত স্নেহ কিছু শান্তি পাইল। পাপ তিনি নিজের স্কন্ধে লইতে রাজি আছেন– নক্ষত্ররায়ের পাপের ভার যেন তাহাতে কতকটা কমিয়া যায়।
বিল্বন আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, এ সময় কি আকাশের দিকে তাকাইয়া ভাবিবার সময়?”
রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, এ সকল আমারই পাপের ফল।”
বিল্বন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, এই-সকল কথা শুনিলে আমার ধৈর্য থাকে না। দুঃখ যে পাপেরই ফল তাহা কে বলিল, পুণ্যের ফলও হইতে পারে। কত ধর্মাত্মা আজীবন দুঃখে কাটাইয়া গিয়াছেন।”
রাজা নিরুত্তর হইয়া রহিলেন।
বিল্বন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ কী পাপ করিয়াছিলেন যাহার ফলে এই ঘটনা ঘটিল?”
রাজা কহিলেন, “আপন ভাইকে নির্বাসিত করিয়াছিলাম।”
বিল্বন কহিলেন, “আপনি ভাইকে নির্বাসিত করেন নাই। দোষীকে নির্বাসিত করিয়াছেন।”
রাজা কহিলেন, “দোষী হইলেও ভাইকে নির্বাসনের পাপ আছেই। তাহার ফল হইতে নিস্তার পাওয়া যায় না। কৌরবেরা দুরাচার হইলেও পাণ্ডবেরা তাঁহাদিগকে বধ করিয়া প্রসন্নচিত্তে রাজ্যসুখ ভোগ করিতে পারিলেন না। যজ্ঞ করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিলেন। পাণ্ডবেরা কৌরবদের নিকট হইতে রাজ্য লইলেন, কৌরবেরা মরিয়া গিয়া পাণ্ডবদের রাজ্য হরণ করিলেন। আমি নক্ষত্রকে নির্বাসিত করিয়াছি, নক্ষত্র আমাকে নির্বাসিত করিতে আসিতেছে।”
বিল্বন কহিলেন, “পাণ্ডবেরা পাপের শাস্তি দিবার জন্য কৌরবদের সহিত যুদ্ধ করেন নাই, তাঁহারা রাজ্যলাভের জন্য করিয়াছিলেন। কিন্তু মহারাজ পাপের শাস্তি দিয়া নিজের সুখদুঃখ উপেক্ষা করিয়া ধর্ম পালন করিয়াছিলেন। ইহাতে আমি তো পাপ কিছুই দেখিতেছি না। তবে প্রায়শ্চিত্তের বিধি দিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমি ব্রাহ্মণ উপস্থিত আছি, আমাকে সন্তুষ্ট করিলেই প্রায়শ্চিত্ত হইবে।”
রাজা ঈষৎ হাসিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
বিল্বন কহিলেন, “সে যাহাই হউক, এখন যুদ্ধের আয়োজন করুন। আর বিলম্ব করিবেন না।”
রাজা কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না।”
বিল্বন কহিলেন, “সে হইতেই পারে না। আপনি বসিয়া বসিয়া ভাবুন। আমি ততক্ষণ সৈন্যসংগ্রহের চেষ্টা করিগে। সকলেই এখন জুমে গিয়াছে, যথেষ্ট সৈন্য পাওয়া কঠিন।”
বলিয়া আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বিল্বন চলিয়া গেলেন।
ধ্রুবের সহসা কী মনে হইল; সে রাজার কাছে আসিয়া রাজার মুখের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকা কোথায়?” নক্ষত্ররায়কে ধ্রুব কাকা বলিত।
রাজা কহিলেন “কাকা আসিতেছেন ধ্রুব।” তাঁহার চোখের পাতা ঈষৎ আর্দ্র হইয়া গেল।
প্রকৃতপক্ষে ইহাদের চাষা বলা যায় না। কারণ, ইহারা রীতিমত চাষ করে না। জঙ্গল দগ্ধ করিয়া বর্ষারম্ভে বীজ বপন করে মাত্র এইরূপ ক্ষেত্রকে জুম বলে, কৃষকদিগকে জুমিয়া বলে।
ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
বিল্বন ঠাকুরের বিস্তর কাজ পড়িয়া গেল। তিনি চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশে নানা উপহার-সমেত দ্রুতগামী দূত পাঠাইয়া দিলেন। সেখানে কুকি-গ্রামপতিদের নিকটে কুকি-সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। যুদ্ধের নাম শুনিয়া তাহারা নাচিয়া উঠিল। কুকিদের যত লাল (গ্রামপতি) ছিল তাহারা যুদ্ধের সংবাদস্বরূপ লাল বস্ত্রখণ্ডে বাঁধা দা দূতহস্তে গ্রামে গ্রামে পাঠাইয়া দিল। দেখিতে দেখিতে কুকির স্রোত চট্টগ্রামের শৈলশৃঙ্গ হইতে ত্রিপুরার শৈলশৃঙ্গে আসিয়া পড়িল। তাহাদিগকে কোনো নিয়মের মধ্যে সংযত করিয়া রাখাই দায়। বিল্বন স্বয়ং ত্রিপুরার গ্রামে গ্রামে গিয়া জুম হইতে বাছিয়া বাছিয়া সাহসী যুবাপুরুষদিগকে সৈন্যশ্রেণীতে সংগ্রহ করিয়া আনিলেন। অগ্রসর হইয়া মোগলসৈন্যদিগকে আক্রমণ করা বিল্বন ঠাকুর সংগত বিবেচনা করিলেন না। যখন তাহারা সমতলক্ষেত্র অতিক্রম করিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্গম শৈলশৃঙ্গে আসিয়া উপস্থিত হইবে, তখন আরণ্য, পর্বত ও নানা দুর্গম গুপ্ত স্থান হইতে তাহাদিগকে সহসা আক্রমণ করিয়া চকিত করিবেন স্থির করিলেন। বড়ো বড়ো শিলাখণ্ডের দ্বারা গোমতী নদীর জল বাঁধিয়া রাখিলেন–নিতান্ত পরাভবের আশঙ্কা দেখিলে সেই বাঁধ ভাঙিয়া দিয়া জলপ্লাবনের দ্বারা মোগলসৈন্যদিগকে ভাসাইয়া দেওয়া যাইতে পারিবে।
এদিকে নক্ষত্ররায় দেশ লুণ্ঠন করিতে করিতে ত্রিপুরার পার্বত্য প্রদেশে আসিয়া পৌঁছিলেন। তখন জুম কাটা শেষ হইয়া গেছে। জুমিয়ারা সকলেই দা ও তীরধনু হাতে করিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। কুকিদলকে উচ্ছ্বাসোন্মুখ জলপ্রপাতের মতো আর বাঁধিয়া রাখা যায় না।
গোবিন্দমাণিক্য বলিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না।”
বিল্বন ঠাকুর কহিলেন, “এ কোনো কাজের কথাই নহে।”
রাজা কহিলেন, “আমি রাজত্ব করিবার যোগ্য নহি, তাহারই সকল লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। সেইজন্য আমার প্রতি প্রজাদের বিশ্বাস নাই, সেইজন্যই দুর্ভিক্ষের সূচনা, সেইজন্যই এই যুদ্ধ। রাজ্য-পরিত্যাগের জন্য এ-সকল ভগবানের আদেশ।”
বিল্বন কহিলেন, “এ কখনোই ভগবানের আদেশ নহে। ঈশ্বর তোমার উপরে রাজ্যভার অর্পণ করিয়াছেন; যতদিন রাজকার্য নিঃসংকট ছিল ততদিন তোমার সহজ কর্তব্য অনায়াসে পালন করিয়াছ, যখনই রাজ্যভার গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে তখনই তাহা দূরে নিক্ষেপ করিয়া তুমি স্বাধীন হইতে চাহিতেছ এবং ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া আপনাকে ফাঁকি দিয়া সুখী করিতে চাহিতেছ।”
কথাটা গোবিন্দমাণিক্যের মনে লাগিল। তিনি নিরুত্তর হইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। অবশেষে নিতান্ত কাতর হইয়া বলিলেন, “মনে করো-না ঠাকুর, আমার পরাজয় হইয়াছে, নক্ষত্র আমাকে বধ করিয়া রাজা হইয়াছে।”
বিল্বন কহিলেন, “যদি সত্য তাহাই ঘটে তাহা হইলে আমি মহারাজের জন্য শোক করিব না। কিন্তু মহারাজ যদি কর্তব্যে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করেন, তবেই আমাদের শোকের কারণ ঘটিবে।”
রাজা কিঞ্চিৎ অধীর হইয়া কহিলেন, “আপন ভাইয়ের রক্তপাত করিব!”
বিল্বন কহিলেন, “কর্তব্যের কাছে ভাই বন্ধু কেহই নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কী উপদেশ দিয়াছিলেন স্মরণ করিয়া দেখুন।”
রাজা কহিলেন, “ঠাকুর, তুমি কি বল আমি স্বহস্তে এই তরবারি লইয়া নক্ষত্ররায়কে আঘাত করিব?”
বিল্বন কহিলেন, “হাঁ।”
সহসা ধ্রুব আসিয়া গম্ভীর ভাবে কহিল, “ছি, ও কথা বলতে নেই।”
ধ্রুব খেলা করিতেছিল, দুই পক্ষের কী একটা গোলমাল শুনিয়া সহসা তাহার মনে হইল দুইজনে অবশ্যই একটা দুষ্টামি করিতেছে, অতএব সময় থাকিতে দুইজনকে কিঞ্চিৎ শাসন করিয়া আসা আবশ্যক। এই-সকল বিবেচনা করিয়া তিনি হঠাৎ আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ছি, ও কথা বলতে নেই।”
পুরোহিত ঠাকুরের অত্যন্ত আমোদ বোধ হইল। তিনি হাসিয়া উঠিলেন, ধ্রুবকে কোলে লইয়া চুমো খাইতে লাগিলেন। কিন্তু রাজা হাসিলেন না। তাঁহার মনে হইল যেন বালকের মুখে তিনি দৈববাণী শুনিলেন।
তিনি অসন্দিগ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ঠাকুর, আমি স্থির করিয়াছি এ রক্তপাত আমি ঘটিতে দিব না, আমি যুদ্ধ করিব না।”
বিল্বন ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। অবশেষে কহিলেন, “মহারাজের যদি যুদ্ধ করিতেই আপত্তি থাকে, তবে আর-এক কাজ করুন। আপনি নক্ষত্ররায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে যুদ্ধ হইতে বিরত করুন।”
গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ইহাতে আমি সম্মত আছি।”
বিল্বন কহিলেন, “তবে সেইরূপ প্রস্তাব লিখিয়া নক্ষত্ররায়ের নিকট পাঠানো হউক।”
অবশেষে তাহাই স্থির হইল।
চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
নক্ষত্ররায় সৈন্য লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন, কোথাও তিলমাত্র বাধা পাইলেন না। ত্রিপুরার যে গ্রামেই তিনি পদার্পণ করিলেন সেই গ্রামই তাঁহাকে রাজা বলিয়া বরণ করিতে লাগিল। পদে পদে রাজত্বের আস্বাদ পাইতে লাগিলেন– ক্ষুধা আরও বাড়িতে লাগিল, চারি দিকের বিস্তৃত ক্ষেত্র, গ্রাম, পর্বতশ্রেণী, নদী সমস্তই ‘আমার’ বলিয়া মনে হইতে লাগিল এবং সেই অধিকারব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজেও যেন অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া অত্যন্ত প্রশস্ত হইয়া পড়িতে লাগিলেন। মোগল-সৈন্যরা যাহা চায় তিনি তাহাই তাহাদিগকে লইতে আলী-হুকুম দিয়া দিলেন। মনে হইল এ-সমস্তই আমার এবং ইহারা আমারই রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। ইহাদিগকে কোনো সুখ হইতে বঞ্চিত করা হইবে না– স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়া মোগলেরা তাঁহার আতিথ্যের ও রাজবৎ উদারতা ও বদান্যতার অনেক প্রশংসা করিবে; বলিবে, ‘ত্রিপুরার রাজা বড়ো কম রাজা নহে।’ মোগল – সৈন্যদের নিকট হইতে খ্যাতি লাভ করিবার জন্য তিনি সততই উৎসুক হইয়া রহিলেন। তাহারা তাঁহাকে কোনো-প্রকার শ্রুতিমধুর সম্ভাষণ করিলে তিনি নিতান্ত জল হইয়া যান। সর্বদাই ভয় হয় পাছে কোনো নিন্দার কারণ ঘটে।
রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, যুদ্ধের তো কোনো উদ্যোগ দেখা যাইতেছে না।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “না ঠাকুর, ভয় পাইয়াছে।”
বলিয়া অত্যন্ত হাসিতে লাগিলেন।
রঘুপতি হাসিবার বিশেষ কোনো কারণ দেখিলেন না, কিন্তু তথাপি হাসিলেন।
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “নক্ষত্ররায় নবাবের সৈন্য লইয়া আসিয়াছে। বড়ো সহজ ব্যাপার নহে।”
রঘুপতি কহিলেন, “দেখি এবার কে কাহাকে নির্বাসনে পাঠায়। কেমন?”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি ইচ্ছা করিলে নির্বাসনদণ্ড দিতে পারি, কারারুদ্ধ করিতেও পারি– বধের হুকুম দিতেও পারি। এখনো স্থির করি নাই কোন্টা করিব।”
বলিয়া অতিশয় বিজ্ঞভাবে অনেক বিবেচনা করিতে লাগিলেন।
রঘুপতি কহিলেন, “অত ভাবিবেন না মহারাজ। এখনো অনেক সময় আছে। কিন্তু আমার ভয় হইতেছে, গোবিন্দমাণিক্য যুদ্ধ না করিয়াই আপনাকে পরাভূত করিবেন।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “সে কেমন করিয়া হইবে?”
রঘুপতি কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য সৈন্যগুলোকে আড়ালে রাখিয়া বিস্তর ভ্রাতৃস্নেহ দেখাইবেন। গলা ধরিয়া বলিবেন– ছোটো ভাই আমার, এসো ঘরে এসো, দুধ-সর খাওসে। মহারাজ কাঁদিয়া বলিবেন– যে আজ্ঞে, আমি এখনি যাইতেছি। অধিক বিলম্ব হইবে না। বলিয়া নাগরা জুতোজোড়াটা পায়ে দিয়া দাদার পিছনে পিছনে মাথা নিচু করিয়া টাট্টু ঘোড়াটির মতো চলিবেন। বাদশাহের মোগল ফৌজ তামাশা দেখিয়া হাসিয়া ঘরে ফিরিয়া যাইবে।”
নক্ষত্ররায় রঘুপতির মুখে এই তীব্র বিদ্রূপ শুনিয়া অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িলেন। কিঞ্চিৎ হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া বলিলেন, “আমাকে কি ছেলেমানুষ পাইয়াছে যে এমনি করিয়া ভুলাইবে! তাহার জো নাই। সে হবে না ঠাকুর। দেখিয়া লইয়ো।”
সেইদিন গোবিন্দমাণিক্যের চিঠি আসিয়া পৌঁছিল। সে চিঠি রঘুপতি খুলিলেন। রাজা অত্যন্ত স্নেহপ্রকাশ করিয়া সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিয়াছেন। চিঠি নক্ষত্ররায়কে দেখাইলেন না। দূতকে বলিয়া দিলেন, “কষ্ট স্বীকার করিয়া গোবিন্দমাণিক্যের এতদূর আসিবার দরকার নেই। সৈন্য ও তরবারি লইয়া মহারাজ নক্ষত্রমাণিক্য শীঘ্রই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। গোবিন্দমাণিক্য এই অল্প কাল যেন প্রিয়ভ্রাতৃবিরহে অধিক কাতর হইয়া না পড়েন। আট বৎসর নির্বাসনে থাকিলে ইহা অপেক্ষা আরও অধিক কাল বিচ্ছেদের সম্ভাবনা ছিল।”
রঘুপতি নক্ষত্ররায়কে গিয়া কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য নির্বাসিত ছোটো ভাইকে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ একখানি চিঠি লিখিয়াছেন।”
নক্ষত্ররায় পরম উপেক্ষার ভান করিয়া হাসিয়া বলিলেন, “সত্য না কি! কী চিঠি? কই দেখি।” বলিয়া হাত বাড়াইয়া দিলেন।
রঘুপতি কহিলেন, “সে চিঠি মহারাজকে দেখানো আমি আবশ্যক বিবেচনা করি নাই। তখনই ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি। বলিয়াছি, যুদ্ধ ছাড়া ইহার আর কোনো উত্তর নাই।”
নক্ষত্ররায় হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বেশ করিয়াছ ঠাকুর! তুমি বলিয়াছ যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো উত্তর নাই? বেশ উত্তর দিয়াছ।”
রঘুপতি কহিলেন, “গোবিন্দমাণিক্য উত্তর শুনিয়া ভাবিবে যে, যখন নির্বাসন দিয়াছিলাম তখন তো ভাই বেশ সহজে গিয়াছিল, কিন্তু সেই ভাই ঘরে ফিরিয়া আসিবার সময় তো কম গোলযোগ করিতেছে না।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “মনে করিবেন ভাইটি বড়ো সহজ লোক নয়। মনে করিলেই যে যখন ইচ্ছা নির্বাসন দিব এবং যখন ইচ্ছা ডাকিয়া লইব সেটি হইবার জো নাই।” বলিয়া অত্যন্ত আনন্দে দ্বিতীয়বার হাসিতে লাগিলেন।
পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ
নক্ষত্ররায়ের উত্তর শুনিয়া গোবিন্দমাণিক্য অত্যন্ত মর্মাহত হইলেন। বিল্বন মনে করিলেন, এবারে হয়তো মহারাজা আপত্তি প্রকাশ করিবেন না। কিন্তু গোবিন্দমাণিক্য বলিলেন, “এ কথা কখনোই নক্ষত্ররায়ের কথা নহে। এ সেই পুরোহিত বলিয়া পাঠাইয়াছে। নক্ষত্রের মুখ দিয়া এমন কথা কখনোই বাহির হইতে পারে না।”
বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ, এক্ষণে কী উপায় স্থির করিলেন?”
রাজা কহিলেন, “আমি নক্ষত্রের সঙ্গে কোনোক্রমে একবার দেখা করিতে পাই, তাহা হইলে সমস্ত মিটমাট করিয়া দিতে পারি।”
বিল্বন কহিলেন, “আর দেখা যদি না হয়।”
রাজা। তাহা হইলে আমি রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইব।
বিল্বন কহিলেন, “আচ্ছা, আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখি।”
পাহাড়ের উপর নক্ষত্ররায়ের শিবির। ঘন জঙ্গল। বাঁশবন, বেতবন, খাগড়ার বন। নানাবিধ লতাগুল্মে ভূমি আচ্ছন্ন। সৈন্যেরা বন্য হস্তীদের চলিবার পথ অনুসরণ করিয়া শিখরে উঠিয়াছে। তখন
অপরাহ্ণ। সূর্য পাহাড়ের পশ্চিমপ্রান্তে হেলিয়া পড়িয়াছে। পূর্বপ্রান্তে অন্ধকার করিয়াছে। গোধূলির ছায়া ও তরুর ছায়ায় মিলিয়া বনের মধ্যে অকালে সন্ধ্যার আবির্ভাব হইয়াছে। শীতের সায়াহ্নে ভূমিতল হইতে কুয়াশার মতো বাষ্প উঠিতেছে। ঝিল্লির শব্দে নিস্তব্ধ বন মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। বিল্বন যখন শিবিরে গিয়া পৌঁছিলেন, তখন সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত গেছেন, কিন্তু পশ্চিম-আকাশে সুবর্ণরেখা মিলাইয়া যায় নাই। পশ্চিম দিকের সমতল উপত্যকায় স্বর্ণচ্ছায়ায় রঞ্জিত ঘন বন নিস্তব্ধ সবুজ সমুদ্রের মতো দেখাইতেছে। সৈন্যেরা কাল প্রভাতে যাত্রা করিবে। রঘুপতি একদল সেনা ও সেনাপতিকে সঙ্গে লইয়া পথ অন্বেষণে বাহির হইয়াছেন, এখনো ফিরিয়া আসেন নাই। যদিও রঘুপতির অজ্ঞাতসারে নক্ষত্ররায়ের নিকটে কোনো লোক আসা নিষেধ ছিল, তথাপি সন্ন্যাসীবেশধারী বিল্বনকে কেহই বাধা দিল না।
বিল্বন নক্ষত্ররায়কে গিয়া কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আপনাকে স্মরণ করিয়া এই পত্র লিখিয়াছেন।” বলিয়া পত্র নক্ষত্ররায়ের হস্তে দিলেন। নক্ষত্ররায় কম্পিত হস্তে পত্র গ্রহণ করিলেন। সে পত্র খুলিতে তাঁহার লজ্জা ও ভয় হইতে লাগিল। যতক্ষণ রঘুপতি গোবিন্দমাণিক্য ও তাঁহার মধ্যে আড়াল করিয়া দাঁড়ায়, ততক্ষণ নক্ষত্ররায় বেশ নিশ্চিন্ত থাকেন। তিনি কোনোমতেই গোবিন্দমাণিক্যকে যেন দেখিতে চান না। গোবিন্দমাণিক্যের এই দূত একেবারে নক্ষত্ররায়ের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতে নক্ষত্ররায় কেমন যেন সংকুচিত হইয়া পড়িলেন, এবং মনে মনে ঈষৎ বিরক্ত হইলেন। ইচ্ছা হইতে লাগিল রঘুপতি যদি উপস্থিত থাকিতেন এবং এই দূতকে তাঁহার কাছে আসিতে না দিতেন। মনের মধ্যে নানা ইতস্তত করিয়া পত্র খুলিলেন।
তাহার মধ্যে কিছুমাত্র ভর্ৎসনা ছিল না। গোবিন্দমাণিক্য তাঁহাকে লজ্জা দিয়া একটি কথাও বলেন নাই। ভাইয়ের প্রতি লেশমাত্র অভিমান প্রকাশ করেন নাই। নক্ষত্ররায় যে সৈন্যসামন্ত লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিয়াছেন, সে কথার উল্লেখ মাত্র করেন নাই। উভয়ের মধ্যে পূর্বে যেমন ভাব ছিল, এখনও অবিকল যেন সেই ভাবই আছে। অথচ সমস্ত পত্রের মধ্যে একটি সুগভীর স্নেহ ও বিষাদ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে– তাহা কোনো স্পষ্ট কথায় ব্যক্ত হয় নাই বলিয়া নক্ষত্ররায়ের হৃদয়ে অধিক আঘাত লাগিল।
চিঠি পড়িতে পড়িতে অল্পে অল্পে তাঁহার মুখভাবের পরিবর্তন হইতে লাগিল। হৃদয়ের পাষাণ-আবরণ দেখিতে দেখিতে ফাটিয়া গেল। চিঠি তাঁহার কম্পমান হাতে কাঁপিতে লাগিল। সে চিঠি লইয়া কিয়ৎক্ষণ মাথায় ধারণ করিয়া রাখিলেন। সে চিঠির মধ্যে ভ্রাতার যে আশীর্বাদ ছিল তাহা যেন শীতল নির্ঝরের মতো তাঁহার তপ্ত হৃদয়ে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্থির হইয়া সুদূর পশ্চিমে সন্ধ্যারাগরক্ত শ্যামল বনভূমির দিকে অনিমেষ নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। চারি দিকে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা অতলস্পর্শ শব্দহীন শান্ত সমুদ্রের মতো জাগিয়া রহিল। ক্রমে তাঁহার চক্ষে জল দেখা দিল, দ্রুতবেগে অশ্রু পড়িতে লাগিল। সহসা লজ্জায় ও অনুতাপে নক্ষত্ররায় দুই হাতে মুখ প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরিলেন। কাঁদিয়া বলিলেন, “আমি এ রাজ্য চাই না। দাদা, আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করিয়া আমাকে তোমার পদতলে স্থান দাও, আমাকে তোমার কাছে রাখিয়া দাও, আমাকে দূরে তাড়াইয়া দিয়ো না।”
বিল্বন একটি কথাও বলিলেন না– আর্দ্র হৃদয়ে চুপ করিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিলেন। অবশেষে নক্ষত্ররায় যখন প্রশান্ত হইলেন, তখন বিল্বন কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার পথ চাহিয়া গোবিন্দমাণিক্য বসিয়া আছেন আর বিলম্ব করিবেন না।”
নক্ষত্ররায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কি তিনি মাপ করিবেন?”
বিল্বন কহিলেন, “তিনি যুবরাজের প্রতি কিছুমাত্র রাগ করেন নাই। অধিক রাত্রি হইলে পথে কষ্ট হইবে। শীঘ্র একটি অশ্ব লউন। পর্বতের নীচে মহারাজের লোক অপেক্ষা করিয়া আছে।”
নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি গোপনে পলায়ন করি, সৈন্যদের কিছু জানাইয়া কাজ নাই। আর তিলমাত্র বিলম্ব করিয়া কাজ নাই, যত শীঘ্র এখান হইতে বাহির হইয়া পড়া যায় ততই ভালো।”
বিল্বন কহিলেন, “ঠিক কথা।”
তিনমুড়া পাহাড়ে সন্ন্যাসীর সহিত শিবলিঙ্গের পূজা করিতে যাইতেছেন বলিয়া নক্ষত্ররায় বিল্বনের সহিত অশ্বারোহণে যাত্রা করিলেন। অনুচরগণ সঙ্গে যাইতে চাহিল, তাহাদিগকে নিরস্ত করিলেন।
সবে বাহির হইয়াছেন মাত্র, এমন সময়ে অশ্বের ক্ষুরধ্বনি ও সৈন্যদের কোলাহল শুনিতে পাইলেন। নক্ষত্ররায় নিতান্ত সংকুচিত হইয়া গেলেন। দেখিতে দেখিতে রঘুপতি সৈন্য লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, কোথায় যাইতেছেন?”
নক্ষত্ররায় কিছুই উত্তর দিতে পারিলেন না। নক্ষত্ররায়কে নিরুত্তর দেখিয়া বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছেন।”
রঘুপতি বিল্বনের আপাদমস্তক একবার নিরীক্ষণ করিলেন, একবার ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন, তার পরে আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন, “আজ এমন অসময়ে আমরা আমাদের মহারাজকে বিদায় দিতে পারি না। ব্যস্ত হইবার তো কোনো কারণ নাই। কাল প্রাতঃকালে যাত্রা করিলেই তো হইবে। কী বলেন মহারাজ?”
নক্ষত্ররায় মৃদুস্বরে কহিলেন, “কাল সকালেই যাইব, আজ রাত হইয়া গেছে।”
বিল্বন নিরাশ হইয়া সে রাত্রি শিবিরেই যাপন করিলেন। পরদিন প্রভাতে নক্ষত্ররায়ের নিকট যাইতে চেষ্টা করিলেন, সৈন্যেরা বাধা দিল। দেখিলেন চতুর্দিকে পাহারা, কোনো দিকে ছিদ্র নাই। অবশেষে রঘুপতির নিকট গিয়া কহিলেন, “যাত্রার সময় হইয়াছে, যুবরাজকে সংবাদ দিন।”
রঘুপতি কহিলেন, “মহারাজ যাইবেন না স্থির করিয়াছেন।”
বিল্বন কহিলেন, “আমি একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি।”
রঘুপতি। সাক্ষাৎ হইবে না তিনি বলিয়া দিয়াছেন।
বিল্বন কহিলেন, “মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের পত্রের উত্তর চাই।”
রঘুপতি। পত্রের উত্তর ইতিপূর্বে আর-একবার দেওয়া হইয়াছে।
বিল্বন। আমি তাঁহার নিজমুখে উত্তর শুনিতে চাই।
রঘুপতি। তাহার কোনো উপায় নাই।
বিল্বন বুঝিলেন বৃথা চেষ্টা; কেবল সময় ও বাক্য-ব্যয়। যাইবার সময় রঘুপতিকে বলিয়া গেলেন, “ব্রাহ্মণ, এ কী সর্বনাশ-সাধনে তুমি প্রবৃত্ত হইয়াছ! এ তো ব্রাহ্মণের কাজ নয়।”