অন্ধকার জিমনাশিয়ামে
অন্ধকার জিমনাশিয়ামে গগনচাঁদ বসে আছে। একা। অথর্বের মতো।
কিছুক্ষণ সে মেঘচাপা আকাশের দিকে চেয়ে ছিল। আকাশের রং রক্তবর্ণ। কলকাতার আকাশে মেঘ থাকলে এ রকমই দেখায় রাত্রিবেলা।
এখন রাত অনেক। বোধহয় এগারোটা। কাল রাতে বৃষ্টির পর গ্যারাজ-ঘরটা জলে থইথই করছে। অন্তত ছয়-সাত ইঞ্চি জলে ডুবে আছে মেঝে। জলের ওপর ঘুরঘুরে পোকা ঘুরছে। কেঁচো আর শামুক বাইছে দেয়ালে। ও রকম ঘরে থাকতে আজ ইচ্ছে করছে না। মনটাও ভাল নেই।
অন্ধকার জিমনাশিয়ামের চারধারে এক বার তাকাল গগন। একটা মন্ত টিনের ঘর, চারধারে বেড়া। হাতের টর্চটা এক বার জ্বালল। সিলিং থেকে রিং ঝুলছে, অদূরে প্যারালাল বার, টানবার ম্প্রিং, রোমান রিং, স্ন্যান্টিংবোর্ড কত কী! একজন দারোয়ান পাহারা দেয় দামি যন্ত্রপাতি। একটু আগে দারোয়ান এসে ঘুরে দেখে গেছে। মাস্টারজি মাঝে মাঝে এ রকম রাতে এসে বসে থাকে, দারোয়ান তা জানে। তবে গগনকে দেখে অবাক হয়নি। জিমনাশিয়ামের ছোট্ট উঠোনটার শেষে দারোয়ানের খুপরিতে একটু আগেও আলো জ্বলছিল। এখন সব অন্ধকার হয়ে গেছে। গগনের কাছে চাবি আছে, যাওয়ার সময়ে বন্ধ করে যাবে। কিন্তু ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না গগনের। পচা জল, নর্দমার গন্ধ, পোকামাকড়। তবু থাকতে হয়। গ্যারাজ-ঘরটার ভাড়া মোটে ত্রিশ টাকা, ইলেকট্রিকের জন্য আলাদা দিতে হয় না, তবে একটা মাত্র পয়েন্ট ছাড়া অন্য কিছু নেই। গগনের রোজগার এমন কিছু বেশি নয় যে লাটসাহেবি করে। এ অঞ্চলে বাড়িভাড়া এখন আগুন। একটা মাত্র ঘর ভাড়া করতে কত বার চেষ্টা করেছে গগন, একশোর নীচে কেউ কথা বলে না। অবশ্য এ কথাও ঠিক, গগন একটু স্থিতু মানুষ, বেশি নড়াচড়া পছন্দ করে না। গ্যারাজ-ঘরটায় তার মন বসে গেছে। অন্য জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করলে তার মন খারাপ হয়ে যায়। গ্যারাজ-ঘরটায় বেশ আছে। সে। শোভারানি বকাবকি করে, ভাড়াটেদের ক্যাচক্যাচ আছে, জলের অসুবিধে আছে, তবু খুব খারাপ লাগে না। কেবল বর্ষাকালটা বড় জ্বালায় এসে। তবু বর্ষা বৃষ্টি হক, না হলে মুরাগাছার জমি বুক ফাটিয়ে ফসল বের করে দেবে না। মানুষের এই এক বিপদ, বর্ষা বৃষ্টি গরম শীত সবই তাকে নিতে হয়, সবকিছুই তার কোনওনা-কোনওভাবে প্রয়োজন। কাউকেই ফেলা যায় না। এই যে অঞ্চলে এত মশা, গগন জানে এবং বিশ্বাসও করে যে, এইসব মশার উৎপত্তি এমনি এমনি হয়নি। হয়তো এদেরও প্রকৃতির প্রয়োজন আছে। এই যে সাপখোপ বোলতা-বিছে, বাঘ-ভালুক– ভাল করে দেখলে বুঝি দেখা যাবে যে এদের কেউ ফেলনা নয়। সকলেই যে যার মতো এই জগতের কাজে লাগে।
গগন উঠে জিমনাশিয়ামের ভিতরে এল। মস্ত মস্ত গোটাকয় আয়না টাঙানো দেয়ালে। অন্ধকারেও সেগুলো একটু চকচক করে ওঠে। গগন টর্চ জ্বেলে আয়না দেখে। গত চার-পাঁচ বছরে এ সব আয়না তার কত চেলার প্রতিবিম্ব দেখিয়েছে। কোথায় চলে গেছে সব! আয়না কারও প্রতিচ্ছবি ধরে রাখে না। এই পৃথিবীর মতোই তা নির্মম এবং নিরপেক্ষ। টর্চ জ্বেলে গগন চারিদিক দেখে। ওই রিং ধরে একদা বুল খেয়ে গ্রেট সার্কেল তৈরি করেছে ফলি! বুকে মস্ত চাই পাথর তুলেছে। বিম ব্যালান্স আর প্যারালাল বার-এ চমৎকার কাজ করত ছেলেটা। শরীর তৈরি করে। সাজানো শরীরের প্রদর্শনী গগনের তেমন ভাল লাগে না। বরং সে চায় ভাল জিমন্যাস্ট তৈরি করতে, কি মুষ্টিযোদ্ধা, কি জুডো খেলোয়াড়। সেসব দিকে ফলি ছিল অসাধারণ। যেমন শরীর সাজানো ছিল থরে বিথরে মাংসপেশিতে, তেমনি জিমন্যাস্টিকসেও সে ছিল পাকা। ফলিকে কিছুকাল জুডো আর বক্সিং শিখিয়েছিল গগন। টপাটপ শিখে ফেলত। সেই ফলি কোথায় চলে গেল।
ভূতের মতো একা একা গগন জিমনাশিয়ামে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে এধার-ওধার দেখে। মেঝেয় বারবেলের চাকা পড়ে আছে কয়েকটা। পায়ের ডগা দিয়ে একটা চাকা ঠং করে উলটে ফেলল সে। এক হাতে রিং ধরে একটু ঝুল খেল। প্যারালাল বার-এ উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভাল লাগছে না। মনটা আজ ভাল নেই! ফলিকে কে মারল? কেন ফলি ও সব নেশার ব্যবসা করতে গেল?
আজ সন্ধেবেলা ফিরে এসে গ্যারাজ-ঘরে বসে সে অনেকক্ষণ উৎকণ্ঠ থেকেছে। না, শোভারানিদের ঘর থেকে তেমন কোনও সন্দেহজনক শব্দ হয়নি! রাত নটায় নরেশও ফিরে এল। স্বাভাবিক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল ওপর থেকে। তার মানে ওরা এখনও ফলির মৃত্যুসংবাদ পায়নি। বড় আশ্চর্য কথা! ফলিকে এখানে সবাই একসময়ে চিনত। তবু তার মৃতদেহ কেন কেউ শনাক্ত করতে পারেনি? কেবলমাত্র পুলিশ আর কালু ছাড়া! তাও পুলিশ বলেছে, ফলি অ্যাবসকন্ডার। ফলি ফেরারই বা ছিল কেন?
মাথাটা বড্ড গরম হয়ে ওঠে।
গগনচাঁদের বুদ্ধি খুব তৎপর নয়! খুব দ্রুত ভাবনা-চিন্তা করা তার আসে না! সবসময়ে সে ধীরে চিন্তা করে। কিন্তু যা সে ভাবে তা সবসময়ে একটা নির্দিষ্ট যুক্তি-তর্ক এবং গ্রহণ বর্জনের পথ ধরে চলে। হুটহাট কিছু ভাবা তার আসে না। গগন বহুকাল ধরে নিরামিষ খায়। সম্ভবত নিরামিষ খেলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কিছু ধীর হয়ে যায়। নিরামিষ খাওয়ার পিছনে আবার গগনের একটা ভাবপ্রবণতাও আছে। ছটফটে জ্যান্ত জীব, জালে বদ্ধ বাঁচার আকুলতা নিয়ে মরে যাওয়া মাছ কিংবা ডিমের মধ্যে অসহায় ভ্রণ, এদের দেখে তার বড় মায়া হয়। আরও একটা কারণ হল, আমিষ খেলে মানুষের শরীরের স্বয়ং-উৎপন্ন বিষ টকসিন খুব বেড়ে যায়। টকসিন বাড়লে শরীরে কোনও রোগ হলে তা বড় জখম করে দিয়ে যায় শরীরকে। কেউ কেউ গগনকে বলেছে, নিরামিষভোজীরা খুব ধীরগতিসম্পন্ন, পেটমোটা। গগন তার উত্তরে তৃণভোজী হরিণ বা ঘোড়ার উল্লেখ করেছে, যারা ভীষণ জোরে ছোটে। তাদের পেটও মোটা নয়। নিরামিষ খেয়ে গগনের তাগদ কারও চেয়ে কম নয়। গতিবেগ এখনও বিদ্যুতের মতো। জুডো বা বক্সিং শিখতে আসে যারা তারা জানে গগন কত বড় শিক্ষক। তাও গগন খায় কী? প্রায় দিনই আধ সেরটাক ভাল আর সবজি-সেদ্ধ, কিছু কাঁচা সবজি, দু-চারটে পেয়ারা বা সময়কালে কমলালেবু বা আম, আধ সের দুধ, সয়াবিন, কয়েকদানা ছোলাবাদাম। তাও বড় বেশি নয়। শরীর আন্দাজে গগনের খাওয়া খুবই কম। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনও দিনই সে বেশি মাথা ঘামায় না। এইসব মিলিয়ে গগন। ধীরবুদ্ধি, শান্ত, অনুত্তেজিত, কোনও নেশাই তার নেই।
মেয়েমানুষের দোষ নেই, তবে আকর্ষণ থাকতে পারে।
যেমন বেগম। ফলি যখন গগনের কাছে কসরত করা শিখত, তখন বহুবার বেগম এসেছে জিমন্যাশিয়ামে। সে বেড়াতে আসত বোনের বাড়ি, সেই তকে জিমন্যাশিয়ামে ছেলেকে দেখে যেত। ব্যায়ামাগারটাই ছিল বলতে গেলে ফলির বাসস্থান।
গগনের আজও সন্দেহ হয়, শুধু ছেলেকে দেখতেই আসত কি না বেগম। বরং ছেলেকে দেখার চেয়ে ঢের বেশি চেয়ে দেখত গগনকে! তার তাকানো ছিল কী ভয়ংকর মাদকতায় মাখানো। বড় বড় চোখ, পটে-আঁকা চেহারা, গায়ের রং সত্যিকারের রাঙা। রোগা নয়, আবার কোথাও বাড়তি মাংস নেই। কী চমৎকার ফিগার! প্রথমটায় গগনের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু গগন বিভিন্ন ব্যায়ামকারীর কাছে ঘুরে ঘুরে নানা জিনিস শেখাচ্ছে, স্যান্ডো গেঞ্জি আর চাপা প্যান্ট পরা তার বিশাল দেহখানা নানা বিভঙ্গে বেঁকেছে, দুলছে বা ওজন তুলবার সময় থামের মতো দৃঢ় হয়ে যাচ্ছে, এ সবই বেগম অপলক চোখে দেখেছে। বেগমের বয়স বোঝে কার সাধ্য! তাকে ফলির মা বলে মনে হত না, বরং বছর দু-তিনেকের বড় বোন বলে মনে হত। ফলি একদিন বলেছিল, মা চমৎকার সব ব্যায়াম জানে, জানেন গগনদা! এখনও রোজ আসন করে।
বেগম প্রথমে ভাববাচ্যে কথা বলত। সরাসরি নয়, অথচ যেন বাতাসের সঙ্গে কথা বলার মতো করে বলত, কত দিন এখানে চাকরি করা হচ্ছে? কিংবা জিজ্ঞেস করত, জামাইবাবুর সঙ্গে কারও বুঝি খুব খটাখটি চলছে আজকাল। পরের দিকে বেগম সরাসরি কথা বলত। যেমন একদিন বলল, আপনার বয়স কত বলুন তো?
বিনীতভাবে গগন জবাব দিল, উনতিরিশ।
একদম বোঝা যায় না। বিয়ে করেছেন?
না।
কেন?
গগন হেসে বলে, খাওয়াব কী? আমারই পেট চলে না।
অত যার গুণ তার খাওয়ার অভাব!
তাই তো দেখছি।
আপনি ম্যাসাজ করতে জানেন?
জানি।
তা হলে আপনাকে কাজ দিতে পারি, করলেন?
গগন উদাসভাবে বলল, করতে পারি।
একটা অ্যাথলেটিক ক্লাব আছে, ফুটবল ক্লাব, খেলোয়াড়দের ম্যাসাজ করতে হবে। ওরা ভাল মাইনে দেয়।
গগন তখন বলল, আমার সময় কোথায়?
খুব হেসে বেগম বলল, তা হলে করবেন বললেন কেন? ওই ক্লাবে গেলে সব ছেড়ে যেতে হবে। হোলটাইম জব। সময়ের অভাব হবে না। আর যদি ছুটকো-ছাটকা মাসাজ করতে চান, পক্ষাঘাতের রুগি-টুগি, তাও দিতে পারি।
গগন বলি, ভেবে দেখব।
আসলে গগন ও সব করতে চায় না, সে চায় ছাত্র তৈরি করতে! ভাল শরীরবিদ, জিমন্যাস্ট, বক্সার, জুডো-বিশেষজ্ঞ। সে খেলোয়াড়দের পা বা রুগির গা মাসাজ করতে যাবে কেন?
কিন্তু ওই যে সে ম্যাসাজ জানে ওটাই তার কাল হয়েছিল। কারণ এবার বেগম নাকি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকায়। খবর এল, ম্যাসাজ দরকার। প্রথমে গগন যায়নি। সে কিছু আন্দাজ করেছিল। কিন্তু বেগম ছাড়বে কেন? খবরের পর খবর পাঠাত। বিরক্ত হয়ে একদিন বাপুজি কলোনির বাড়িতে যেতে হয়েছিল গগনকে।
হেসে বলেছিল, খুব ব্যথা বুঝলেন।
গগন পাখানা নেড়ে-চেড়ে বলল, কোথায়?
বেগম বলল, সব ব্যথা কি শরীরে? মন বলে কিছু নেই?
তারপর কী হয়েছিল তা আর গগন মনে করতে চায় ন। তবে এটুকু বলা যায়, গগনের মেয়েমানুষে আকর্ষণ আছে, লোভ না থাক। বেগমের বেলা সেটুকু বোঝা গিয়েছিল। বলতে গেলে, তার জীবনের প্রথম মেয়েমানুষ ওই বেগম। কিছুকাল খুব ভালবেসেছিল বেগম তাকে। তারপর যা হয়? ও সব মেয়েদের একজনকে নিয়ে থাকলে চলে না! গগন তো তার ব্যবসার কাজে আসত না। বেগম তাই অন্য সব মানুষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর বেগমের দেহের সুন্দর ও ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে গগন সরে এল একদিন।
আয়নায় কোনও প্রতিচ্ছবি থাকে না। পৃথিবীতে কত ঘটনা ঘটে, সব মুছে যায়। অবিকল আয়নার মতো।
ফলির কথাই ভাবছিল গগন। ফলি বেঁচে নেই। তার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল ফলি। মানুষ হিসেবে ফলি হয়তো ভাল ছিল না, নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ছাত্র হিসেবে ফলি ছিল উৎকৃষ্ট। ও রকম চেলা গগন আর পায়নি।
অন্ধকার জিমন্যাশিয়ামে প্যারালাল বার-এর ওপর বসে গগনের দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল নেমে এল। বিড়বিড় করে কী একটু বলল গগন। বোধহয় বলল, দূর শালা! জীবনটাই অদ্ভুত!
অনেক রাতে গগন যখন গ্যারাজ-ঘরে ফিরল তখন সে খুব অন্যমনস্ক ছিল। নইলে সে লক্ষ করত, এত রাতেও পাড়ার রাস্তায় কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে কী যেন আলোচনা করছে। আশপাশের বাড়িগুলোয় আলোও জ্বলছে।
গগন যখন তালা খুলছে তখন একবার টের পেল এ বাড়ি সে বাড়ির জানালায় কারা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখল তাকে। নরেশ মজুমদারের ঘরে স্টিক-লাইট জ্বলছে। এত রাতে ও রকম হওয়ার কথা নয়। রাত প্রায় বারোটা বাজে। এ সময় সবাই নিঃসাড়ে ঘুমোয়। কেবল অদূরে একটা বাড়ির দোতলায় নানক চৌধুরীর ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলে।
গগন ঘরে এসে প্রায় কিছুই খেল না। ঠান্ডা দুধটা চুমুক দিয়ে শুলে রইল বাতি নেভাল না। ঘরে জল খেলছে, কোন পোকা-মাকড় রাতবিরেতে বিছানায় উড়ে আসে। বর্ষাকালে প্রায় সময়েই সে বাতি জ্বেলে ঘুমোয়। নরেশ মজুমদারের মিটার উঠুক, তার কী।
ঘুম না এলে গগনচাঁদ জেগে থাকে। চোখ বুজে মটকা মারা তার স্বভাব নয়। আজও ঘুম এল না, তাই চেয়ে থেকে কত কথা ভাবছিল গগন। ভিতর দিকে গ্যারেজ-ঘরের ছাদের সঙ্গে লাগানো, উঁচুতে একটা চার ফুট দরজা আছে। ওই দরজাটা সে আসবার পর থেকে বরাবর বন্ধ দেখেছে। সম্ভবত কোনও দিন ওই দরজা দিয়ে সহজে গ্যারাজে ঢোকা যাবে বলে ওটা করা হয়েছিল। বৃষ্টি-বাদলার দিনে ঘর থেকে নরেশ তার বউ নিয়ে সরাসরি গ্যারাজে আসতে পারত। এখন গ্যারাজে গাড়ি নেই, গগন আছে। তাই দরজাটা কড়াক্কড় করে বন্ধ। প্রায় সময়েই গগন দরজাটা দেখে। হয়তো কখনও ওই দরজা থেকে নেমে আসবার কাঠের সিঁড়ি ছিল। আজ তা নেই। ওও সুড়ঙ্গের মতো দরজাটাই আছে কেবল। রহস্যময়।
আশ্চর্য এই, আজ দরজাটার দিকে তাকিয়ে গগন দরজাটার কথাই ভাবছিল। ঠিক এই সময়ে হঠাৎ খুব পুরনো একটা ছিটকিনি খোলার কষ্টকর শব্দ হল। তারপরই কে যেন হুড়কো খুলহেবলে মনে হল। সিলিং-এর দরজাটা বার দুই কেঁপে উঠল।
ভয়ংকর চমকে গেল গগনচাঁদ। বহুকাল এমন চমকায়নি। সে শোয়া অবস্থা থেকেট করে উঠে বসল। প্রবল বিস্ময়ে চেয়ে রইল দরজার দিকে।
তাকে আরও ভয়ংকর চমকে দিয়ে দরজার পাল্লাটা আস্তে খুলে গেল। আর চার ফুট সেই দরজার ফ্রেমে দেখা গেল, শোভারানি একটা পাঁচ ব্যাটারির মস্ত টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
গগন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। অবাক চোখে চেয়ে ছিল। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। চোখ বড়।
শোভারানি সামান্য হাঁফাচ্ছিল। বেগমের বোন বলে ওকে একদম মনে হয় না। শোভা কালো, মোটা, বেঁটে। মুখশ্রী হয়তো কোনও দিন কমনীয় ছিল, এখন পুরু চর্বিতে সব গোল হয়ে গেছে।
শোভারানি ঝুঁকে বলল, এই এলেন?
হুঁ।-বলে বটে গগন, কিন্তু সে ধাতস্থ হয়নি।
এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
বাইরে।
ঘোরের মধ্যে উত্তর দেয় গগন। ওরা কি তবে ফলির খবরটা পেয়েছে। তাই হবে। নইলে এত রাতে গুপ্ত দরজা দিয়ে শোভা আসত না। শোভারানির মুখে অবশ্য কোনও শোকের চিহ্ন নেই। বরং একটা উদবেগ ও আকুলতার ভাব আছে।
শোভা বলল, লাইনের ধারে যে মারা গেছে কাল সে কে জানেন?
জানি। একটু ইতস্তত করে গগন বলে।
সবাই বলছে ফলি। সত্যি নাকি?
লুকিয়ে লাভ নেই। বার্তা পৌঁছে গেছে। গগন তাই মাথা নাড়ল। তারপর কপালে হাত দিল একটু।
ফলিকে কে দেখেছে?
গগন বলল, পুলিশ দেখেছে। আর রিকশাওলা কালু।
ঠিক দেখেছে?– তীব্র চোখে চেয়ে শোভা জিজ্ঞেস করে।
তাই তো বলছে। গগন ফের কপালে হাত দেয়।
শোভারানি ঠোঁট উলটে বলল, আপদ গেছে।
বলেই ঘরে আলো থাকা সওে টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলল মেঝেয়। বলল, ঘরে জল ঢেকে দেখছি।
বর্ষাকালে ঢোকে রোজ। গগন যান্ত্রিক উত্তর দেয়।
বলেননি তো কখনও!
গগন আস্তে করে বলে, বলার কী! সবাই জানে।
শোতা মাথা নেড়ে বলে, আমি জানতাম না।
গগন উত্তর দেয় না। শোভার কাছে এত ভদ্ৰব্যবহার পেয়ে সে ভীষণ ভালমানুষ হয়ে যাচ্ছিল।
শোভা টর্চটা নিভিয়ে বলল, শুনুন, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।
গগন উঠে বসে উর্ধ্বমুখে যেন কোনও স্বর্গীয় দেবীর কথা শুনছে, এমনভাবে উৎকর্ণ হয়ে ভক্তিভরে বসে থাকে। বলে, বলুন।
কালু একটা গুজব ছড়িয়েছে।
কী?
ফলিকে যে খুন করেছে তাকে নাকি ও দেখেছে।
গগন মাথা নেড়ে বলল, জানি।
কী জানেন?
কালু ও কথা আমাকেও বলেছে।
কে খুন করেছে তা বলেনি? শোভা ঝুকে খুব আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে।
গগন মাথা নাড়ে, না। ও পাঁচশো টাকা দাবি করে খুনির কাছে। বলবে না।
শোভা হেসে বলে, সেই পাঁচশো টাকা কালু পেয়ে গেছে।
শোভারানির হাসি এবং শোকের অভাব দেখে গগন খুব অবাক হয়। ফলির মৃত্যুতে কি শোভার কিছু যায়-আসেনি? বোনপোটা মরে গেল, তবু ও কীরকম যেন স্বাভাবিক।
গগন ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, কার কাছে পেয়েছে?
শোভা অদ্ভুত একটু হেসে বলল, ও বলছে, টাকা নাকি ওকে আপনি দিয়েছেন।
আমি! আমি টাকা দিয়েছি!
খুব আস্তে গগনের বুদ্ধি কাজ করে। প্রথমটায় সে বুঝতেই পারল না ব্যাপারটা কী। ভেবে ভেবে জোড়া দিতে লাগল। তাতে সময় গেল খানিক।
শোভা বলল, একটু আগে কালুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
গগন তেমনি দেবী-দর্শনের মতো উর্ধ্বমুখ হয়ে নীরব থাকে। বুঝতে সময় লাগে তার। তারপর হঠাৎ বলে, আমি ওকে টাকা দিইনি।
শোভা ঠোঁট ওলটাল! বলল, ও তো বলছে!
আর কী বলছে?
শোভা হেসে বলে, খুনির নামটাও বলেছে।
কে?
বলেই গগন বুঝতে পারে তার গলার স্বর তার নিজের ফাঁকা মাথার মধ্যে একটা প্রতিধ্বনি তুলল, কে!
শোভা তার চোখে চেয়ে থেকে বলল, ও আপনার নাম বলছে
আমি! আমার নাম—- বলে গগন মাথায় হাত দিয়ে বলে, না তো ও মিথ্যা কথা বলছে।
শোভা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলল, কালু মদ-গাঁজা খায়। ওর কথা কে বিশ্বাস করে, আহাম্মক ছাড়া। তবে ফলিকে কেউ খুন করে থাকলেও অন্যায় করেনি আমি তো সেজন্য জোড়াপাঁঠা মানসিক করে রেখেছি।
গগন উত্তর দিতে পারে না মাথাটা ফাঁকা লাগছে। সে শুধু শোভার দিকে চেয়ে থাকে।
শোভা বলে, শুনুন যদি ফলিকে কেউ মেরে থাকে তো আত্মার দুঃখের কিছু নেই। আমার স্বামী কাঁদছেন। তার বোধহয় কাঁদবারই কথা। তিনি ঠিক করেছিলেন, আমাদের বিষয়-সম্পত্তি সব ফলির লমে লিখে দেবেন। উইল নাকি করেও ছিলেন। আমি সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারিনি। ফলির জন্ম ভাল নয়।
গগন উত্তর দিতে পারছিল না। তবু মাথা নাড়ল।
শোভা বলল, আপনি বা যে-কেউ ওকে খুন করে থাকলে ভাল কাজই হয়েছে। পেস্তা নামে যে বাচ্চা মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল, সে এখনও আমার কাছে আসে। তার বোধহয় আর বিয়ে হবে না। ফলির গুণকীর্তির কথা কে না জানে! অপু আমার স্বামীকে কিছু বোঝানো যাবে না। তিনি সম্ভবত পুলিশ ডেকে আজ রাতেই আপনাকে গ্রেফতার করাকেন।
আমাকে!
শোভা সামান্য উমার সঙ্গে বলে, ও রকম ভ্যাবলার মতো অছেন কেন? এ সময়ে বুদ্ধি ঠিক না রাখলে ঝামেলায় পড়বেন।
গগন হঠাৎ বলল, কী করব?
শোভা বলে, কী আর করবেন, পালাবেন!
গগন দিশাহারার মতো বলল, পালাব কেন?
সেটা বুঝতে আপনার সময় লাগবে। শরীরটাই বড়, বুদ্ধি ভীষণ কম। পুলিশে ধরলে আটক রাখবে, মামলা হবে, সে অনেক ব্যাপার। বরং পালিয়ে গেলে ভাবার সময় পানে।
কোথায় পালাব?
সেটা যেতে যেতে ভাববেন। এখন খুব বেশি সময় নেই। এইখান দিয়ে উঠে আসতে পারবেন?
গগন হাসল এবার। সে শরীরের কসরতে ওস্তাদ-লোক। গ্যারাজঘরের ছাদের দরজায় ওঠা তার কাছে কোনও ব্যাপার নয়। মা নেড়ে বলল, খুব।
তা হলে বাতিটা নিবিয়ে উঠে আসুন। এখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ভাল রাস্তা আছে। কেউ দেখবে না। দেয়াল টপকে ওদিকে এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের কারখানার মাঠ দিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠবেন। দেরি করবেন না। উঠে আসুন।
গগন বাতি নিভিয়ে দেয়। শোভা টর্চ জেলে রাখে। গগন পোশাক পরে নেয়। দুটো-একটা টুকিটাকি দরকারি জিনিস ভরে নেয় ঝোলা ব্যাগে। তারপর হাতের ভর দিয়ে দরজায় উঠে পড়ে।
শোভা টর্চ জ্বেলে আগে আগে পথ দেখিয়ে দেয়। মেথরের আসবার রাস্তায় এলে শোভারানি তাকে বলে, এই রাস্তা দিয়ে চলে যান। টাকা লাগবে?
গগন মাথা নাড়ে, না।
শোভা হেসে বলে, লাগবে। সদ্য সদ্য পাঁচশো টাকা বেরিয়ে গেছে, এখন তো হাত খালি!
গগন বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে তাকায়।
আর শোভারানি সেই মুহূর্তে তাকে প্রথম স্পর্শ করে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার প্যান্টের পকেটে বোধহয় কিছু টাকাই গুঁজে দেয়। খুব নরম স্বরে বলে, বেগম খারাপ। আমি খারাপ নই। আমি বিশ্বাস করি না যে আপনি খুন করেছেন। এখন যান। গ্যারাজ-ঘরের ভিতরটা আমি উঁচু করে দেব। সময়মতো ফিরে এসে দেখল্লে ঘরটা অনেক ভাল হয়ে গেছে। আর জিনিসপত্র যা রইল তা আমি দেখে রাখ। এখন আসুন তো।
গগন মাথা নাড়ে। তারপর আস্তে করে গিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের পাঁচিল টপকায়। মাঠ পেরোয়।
কয়েকটা টর্চবাতি ইতস্তত কাকে যেন খুঁজছে। গগন মাথা নিচু করে এগোয়। একটা বড় গাড়ি এসে থামল কাছেই কোথাও। গগন বাদবাকি পটুকু দৌড়ে পার হয়ে যায়। ফের পাঁচিল টপকে বড়রাস্তায় পড়ে।
রাতের ফাঁকা রাস্তা। কোথাও কোনও যানবাহন নেই। কেবল একটা ট্যাক্সি সওয়ারি খালাস করে ধীরে ফিরে যাচ্ছে। গগন হাত তুলে সেটাকে থামায়। সচরাচর সেট্যাক্সিতে চড়ে না। পয়সার জন্যও বটে, তা ছাড়া বাবুয়ান তার সয়না। আজ উঠে বসল। কারণ অবস্থাটা আজ গুরুতর। তা ছাড়া শোভারানির দেওয়া বেশ কিছু টাকাও আছে পকেটে।
পৃথিবীটাকে ঠিক বুঝতে পারে না গগনচাঁদ। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ মেঘলা করে আসে। গ্যারাজ-ঘরে জল ওঠে আধ-হাটু। জীবনটা এ রকমই। মাঝে মাঝে বিনা কারণে এ রকম পালাতে
অবস্থাটা এখনও ঠিক বুঝতে পারে না গগন। তবু সেজন্য তার চিন্তা হয় না। এখন সে শোভারানির কথা ভাবে। ভাবতে বেশ ভাল লাগছে তার।