Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দিনের বেলায় ওরা পরস্পরের ধুলো কাদা মাখা চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রোফেসর লি তখনও কাজে ব্যস্ত, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে লোকজন টেনে বার করে বেড়াচ্ছেন, তিনি আর তাঁর ছাত্রেরা। পুলিশও এসেছে, দুটো রেডক্রসের হাসপাতাল গাড়িও এসেছে। আকাশে জাপানি বোমারু প্লেনগুলির চিহ্ন নেই।

রাত্রিটা কেটে গিয়েছে যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো। বেলা এখন দশটা–এখনও সে দুঃস্বপ্নের জের মেটেনি! বিনা কারণে এমন নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার তান্ডব যে চলতে পারে তা এর আগে, ভারতবর্ষে থাকতে বিমল কখনো ভেবেছিল?

কনসেশনে সেই সবজান্তা আমেরিকান পুলিশটা বলছিল–দেখবেন ওরা ইনসেনডিয়ারি বোমা ফেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে। এখানে অনেক বাড়িই কাঠের। তাতে আবার বোমার আগুন জলে নেবে না। বালি ছড়াতে হয় একরকম কল দিয়ে। প্রথম অবস্থায় বোমাটাকে বালি বোঝাই থলে দিয়ে চেপে ধরলেও আর স্পার্ক ছোটে না–কিন্তু সেসব করে কে?

চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল বললেন–কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে হাই এক্সপ্লোসিভ বোমায়। কাল সন্ধ্যা ও রাতের বোমা ফেলার দরুন চা-পেই পাড়া ও সাংহাইয়ের চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউতে সাত-আট-শো বাড়ির চিহ্ন নেই–মানুষ মারা পড়েছে তিন-শোর ওপর, মেয়ে-পুরুষ মিলিয়ে। জখম হয়ে হাসপাতালে গিয়েছে প্রায় পাঁচ শো। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বাঁচবার আশা নেই।

প্রোফেসর লি বললেন–আমাদের সবচেয়ে ভীষণ শত্রু যে এই বোমারু প্লেনগুলি, তা ক দিনের ব্যাপারে আমরা বুঝতে পারছি। তবুও তো এখনো ওরা সমবেতভাবে আক্রমণ করেনি–করলেও এক-শোখানা প্লেনের প্রত্যেক প্লেনখানা থেকে দু-টন বোমা ফেললে পাঁচ হাজার লোক কালই মেরে ফেলত।

সবজান্তা পুলিশম্যানটি বললে–জাপানি বম্বারগুলি এক-একখানা দু-টন বোমা বইতে পারে না মশায়– সে পারে জার্মান ডর্নিয়ের কিংবা ইটালির কাপ্রোনি—কিংবা–

ডেপুটি মার্শাল বললেন–আহা হা, ও সব এখন থাক–ও তর্কে কী লাভ আছে? এখন আমাদের দেখতে হবে যে দু-টি মার্কিন মহিলাকে কাল রাত্রে গুন্ডারা নিয়ে গিয়েছে, তাঁদের উদ্ধারের কী উপায় করা যায়, বোমা এখন এবেলা অন্তত আর পড়বে না–

এমন সময়ে একজন চীনা পুলিশ সার্জেন্ট মোটর সাইকেলে ছুটে এসে সংবাদ দিলে, কনসেশন অঞ্চলে চীনা পলাতক নর-নারীদের সঙ্গে কনসেশন পুলিশের ভয়ানক দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছে। ওরা ইয়াং সিকিয়াং-এর ব্রিজ পার হয়ে যাচ্ছিল, কনসেশন পুলিশ ব্রিজের ওমুখে মেশিনগান বসিয়েছে–তারা বলছে এত পলাতক লোক জায়গা দেবার স্থান নেই কনসেশনে। খাবার নেই, জল নেই। গেলে সেখানে দুর্ভিক্ষ হবে।

প্রোফেসর লি বললেন–কত লোক পালাচ্ছিল?

তা বোধ হয় দশ হাজারের কম নয়। অর্ধেক সাংহাই ভেঙে মেয়ে-পুরুষ সব পালাচ্ছে কনসেশনের দিকে। আপনারা সব চলুন, একটু বোঝান ওদের। রাত্রির ব্যাপারে সব ভয় খেয়েছে বড়।

কনসেশনের পুলিশদলকে চলে যেতে উদ্যত দেখে বিমল বললে–আজই মেয়ে দুটির ব্যবস্থা আপনাদের করতে হবে– দেরি হলে ওদের খুঁজে বার করা শক্ত হবে হয়তো।

চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল বললেন–সে-বিষয়ে ওঁরা কিছু সাহায্য করতে পারবেন । বদমাইশদের লিস্ট আমাদের কাছে আছে। আমি আজ এখুনি এর ব্যবস্থা করছি। ব্যস্ত হবেন না– বিদেশি গভর্নমেন্টের কাছে এজন্যে আমাদের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি।

সেদিন সারাদিন ওরা হাসপাতালে গেল না। ডাক্তার সাহেবকে জানিয়ে দিলে মিনি ও এ্যালিসের বিপদের কথা। কনসেশনে যাবার জন্যে দু-বার চেষ্টা করেও কৃতকার্য হল না। সে-পথ লোকজনের ভিড়ে বন্ধ হয়ে আছে, তা ছাড়া ইয়াং সিকিয়াংয়ের পুলের ওপারের মুখে মেশিনগান বসানো।

সারাদিন ধরে কী করুণ দৃশ্য সাংহাইয়ের বাইরের বড়ো বড়ো রাজপথগুলিতে! লোকজন মোট-পুঁটুলি নিয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে–সাংহাই থেকে যোনান যাবার রাজপথ পলাতক নর-নারীতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভয়ানক গরমে এই ভিড়ে অনেকে সর্দি-গর্মি হয়ে মারাও পড়ছে।

দু-খানা হাসপাতালের গাড়ি ওদের সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু ভিড় ঠেলে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব দেখে গাড়ি দুখানা শহরের উপকণ্ঠে এক জায়গায় পথের ধারেই দাঁড়িয়ে রইল। একখানা গাড়ির চার্জ নিয়ে বিমল সেখানে রয়ে গেল। সুরেশ্বর রইল তার সহকর্মী হিসেবে।

শীঘ্রই কিন্তু কী ভয়ানক বিপদে পড়ে গেল দু-জনেই। ওরা অনেকক্ষণ থেকেই ভাবছিল এই ভীষণ ভিড়ের মধ্যে জাপানি প্লেন যদি বোমা ফেলে তবে যে কী কান্ড হবে তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়।

বেলা দুটো বেজেছে। একজন তরুণ চীনা সামরিক কর্মচারী মোটরবাইকে সাংহাইয়ের দিক থেকে এসে ওদের অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির সামনে নামল। বললে–আপনারা এখান থেকে সরে যান–

বিমল বললে– কেন?

জাপানি সৈন্য শহরের বড়ো পাঁচিল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে–এখনও দুটো পাঁচিল বাকি–কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে ওরা সমুদ্রের ধারে সমস্ত দিকটা দখল করবে। আর আমরা খবর পেয়েছি পঞ্চাশখানা বোমারু প্লেন একঘণ্টার মধ্যে শহরের ওপর আবার বোমা ফেলবে।

এই লোকগুলির অবস্থা তখন কী হবে?

চীনের মহাদুর্ভাগ্য, স্যার। আপনারা বিদেশি, আপনাদের প্রাণ আমরা বিপন্ন হতে দেব না। আমরা মরি তাতে ক্ষতি নেই। অপনারা সরে যান এখান থেকে।

একটি গাছের তলায় একটি বৃদ্ধা বসে। সঙ্গে একটা পুঁটুলি, গোটা কতক মাটির হাঁড়ি কুঁড়ি। মুখে অসহায় আতঙ্কের চিহ্ন।

সামরিক কর্মচারীটি কাছে গিয়ে বললে– কোথায় যাবে?

বৃদ্ধা ভয়ে ভয়ে সৈনিকটির দিকে চাইল কিন্তু চুপ করে রইল। উত্তর দিলে না। সৈনিকটি আবার জিজ্ঞেস করলে– কোথায় যাবে তুমি? তোমার সঙ্গে কে আছে?

এবারও বুড়ি কিছু বললে না।

বিমল বললে–বোধ হয় কানে শুনতে পায় না। দেখছ না ওর বয়েস অনেক হয়েছে। চেঁচিয়ে বলো।

তরুণ সামরিক কর্মচারী বৃদ্ধার নাতির বয়সি। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বললে–ও দিদিমা, কোথায় যাচ্ছ?

বুড়ি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–কোথায় আর যাব? সবাই যেখানে যাচ্ছে।

এখানে বসে থেকো না। বোমা পড়বে এক্ষুনি। সঙ্গে কেউ নেই?

বোমার কথা শুনেই বুড়ি ভয়ে আড়ষ্ট হল, ওপরের দিকে চাইলে। বললে–আমি আর হাঁটতে পারছি না, আমার আর কেউ নেই, আমাকে তোমরা একখানা গাড়ির ওপর উঠিয়ে দাও।

বিমল বললে–আমি ওকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিচ্ছি। বড় বয়েস হয়েছে, এতখানি পথ ছুটোছুটি করে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে।

দু-জনে ওকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে ওঠালে।

এক জায়গায় একটি গৃহস্থ পরিবারের ঠিক এই অবস্থা। গৃহিণীর বয়েস প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ, সাত আটটি ছেলে-মেয়ে, সকলের ছোটোটি দুগ্ধপোষ্য শিশু, বাকি সব দুই, চার, পাঁচ, সাত এমনি বয়েসের। সঙ্গে একটিও পুরুষ নেই। ওরাও হাঁটতে না পেরে বসে পড়েছে।

জিজ্ঞেস করে জানা গেল বাড়ির কর্তা জাহাজে কাজ করেন–জাহাজ আজ কুড়ি দিন হল বন্দর থেকে ছেড়ে গিয়েছে। এদিকে এই বিপদ! কাজেই মা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বাড়ি থেকে কোথায় যাবেন ঠিক নেই।

এদের অসহায় অবস্থা দেখে বিমলের খুব কষ্ট হল। কিন্তু তার কিছু করবার নেই। কত লোককে সে হাসপাতাল গাড়িতে জায়গা দেবে?

সে-দিন শহরের এমন ভয়ানক অবস্থা গেল যে কে কার খোঁজ রাখে! মিনি ও এ্যালিসের উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই হল না। সারা দিনরাত এমনি করে কাটল।

রাত্রি শেষে জাপানি নৌসেনা সাংহাই শহরের দক্ষিণ অংশ অধিকার করলে। বিমল ও সুরেশ্বর তখন হাসপাতালে। ওরা কিছুই জানত না। তবে ওরা এটুকু বুঝেছিল যে অবস্থা গুরুতর। সারারাত্রি ধরে জাপানি যুদ্ধ-জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করলে। বোমারু প্লেনগুলির তেমন আর দেখা নেই, কারণ শহর প্রায় জনশূন্য। পথে-ঘাটে লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে।

রাত তিনটে। এমন সময় ওয়ার্ডের মধ্যে কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য ঢুকতে দেখে বিমল প্রথমটা বিস্মিত হল; তারপরই ওর মনে হল এরা চীনা নয়, জাপানি সৈন্য। ক্রমে পিলপিল করে বিশ ত্রিশজন জাপানি সৈন্য হাসপাতালের বড়ো হলটার মধ্যে ঢুকল। চারিদিকে শোরগোল শোনা গেল। রোগীর দল অধিকাংশই বোমায় আহত নাগরিক, তারা ভয়ে কাঠ হয়ে রইল জাপানি সৈন্য দেখে।

বিমল একা আছে ওয়ার্ডে। হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার খানিকটা আগে চলে গিয়েছেন। ওই এখন কর্তা। দু-জন চীনা নার্স ভয়ে অন্য ওয়ার্ড থেকে ছুটে এসে বিমলের পেছনে দাঁড়াল।

হঠাৎ একজন জাপানি সৈন্য বন্দুক তুলে জমির সঙ্গে সমান্তরালভাবে ধরলে–রাইফেলের আগার ধারালো বেয়নেট ঝকঝক করে উঠল। চক্ষের নিমেষে সে এমন একটা ভঙ্গি করলে তাতে মনে হল বিমলদের দেশে সিঁটকি জালে মাছ ধরবার সময় জালের গোড়ার দিকের বাঁশটা যেমন কাদাজলের মধ্যে ঠেলে দেয়–তেমনি। সঙ্গেসঙ্গে একটা অমানুষিক আর্তনাদ শোনা গেল। পাশের বিছানায় একটা চীনা যুবক রোগী শুয়ে ভয়ে ভয়ে ওদের দিকে চেয়েছিল –বেওনেট তার তলপেটটা গেঁথে ফেলেছে। চারিদিকে রোগীরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। রক্তে ভেসে গেল বিছানাটা। সে এক বীভৎস দৃশ্য।

বিমলের মাথা হঠাৎ কেমন বেঠিক হয়ে গেল এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড দেখে। সে এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বললে তোমরা কি মানুষ না পশু?

জাপানি সৈন্যেরা ওর কথা বুঝতে পারলে না–কিন্তু ওর দাঁড়াবার ভঙ্গি ও গলার সুর শুনে অনুমান করলে মানে যাই হোক, প্রীতি ও বন্ধুত্বের কথা তা নয়।

অমনি সব ক-জন সৈন্য ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বন্দুক তুললে।

বিমল চোখ বুজলে–ও-ও বুঝলে এই শেষ।

সেই দু-জন চীনা তরুণী নার্স, যারা ওর পেছনে এসে আশ্রয় নিয়েছিল–তারা ভয়ে দিশাহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। হাসপাতালের সবাই বিমলকে ভালোবাসত।

এমন সময় বিমলের কানে গেল পেছন থেকে একটা সামরিক আদেশের ক্ষিপ্র, স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ সুর। জাপানি ভাষায় হলেও তার অর্থ যেন কোন অদ্ভুত উপায়ে বুঝে ফেলে চোখ চাইলে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একজন জাপানি সামরিক কর্মচারী, লেফটেন্যান্টের ইউনিফর্ম পরা। সৈন্যেরা ততক্ষণ বেওনেট নামিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়েছে।

জাপানি অফিসারটি এগিয়ে এসে জাপানি ভাষাতেই কী প্রশ্ন করলে। তিন-চারজন সৈন্য একসঙ্গে ওর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কী বললে।

জাপানি অফিসার বিমলের দিকে চেয়ে ভাঙা ইংরেজিতে বললে–তুমি আমার সৈন্যদের গালাগালি দিয়েছ?

বিমল বললে–তোমার সৈন্যরা কী করেছে তা আগে দেখো। এটা রেডক্রস হাসপাতাল। এখানে কেউ যোদ্ধা নেই। অকারণে তোমার সৈন্যেরা আমার ওই রোগীটিকে খুন করেছে বেওনেটের ঘায়ে।

জাপানি অফিসার একবার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে রক্তাক্ত বিছানা ও মৃত রোগীর দেহটার দিকে চেয়ে দেখলে এবং তারপর সম্ভবত ভসনার সুরে সৈন্যদের কী বললে।

তারপর বিমলের দিকে চেয়ে বললে–তুমি কোন দেশের লোক?

ভারতীয়।

রেডক্রসের ডাক্তার?

না, আমি চীনা মেডিকেল ইউনিটের ডাক্তার।

ও! চীনেদের সাহায্য করতে এসেছ ভারতবর্ষ থেকে?

হ্যাঁ।

আমার সৈন্যদের অপমান করতে তুমি সাহস করো?

আমার সামনে আমার রোগী খুন করল ওরা, তার প্রতিবাদমাত্র করেছি।

হঠাৎ জাপানি অফিসারটি ঠাস করে একটা চড় মারলে বিমলের গালে। পরক্ষণেই সেই ক্ষিপ্ৰ তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট সামরিক আদেশের সুর গেল ওর কানে–রাগে অপমানে, চড়ের প্রবল ঘায়ে দিশাহারা ওর কানে। সব ক-জন সৈন্য মিলে তক্ষুনি ওকে ঘিরে ফেললে চক্ষের নিমেষে। দু-জন ওকে পিছমোড়া করে বাঁধলে চামড়ার কোমরবন্ধ দিয়ে। তারপর ওকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে চলল রাইফেলের কুঁদোর ধাক্কা দিতে দিতে। চীনা নার্স দু-জন ভয়ে কাঠ হয়ে চেয়ে রইল।

বিমলকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানটা একটা ছোটো মাঠের মতো। একদিকে একটা নীচু বাড়ি।

মাঠের এক পাশে একটি ছোটো টেবিল ও চেয়ার পেতে জনৈক জাপানি সামরিক কর্মচারী বসে। তার চারিপাশে সশস্ত্র জাপানি সৈন্যের ভিড়। কিছুদূরে দেওয়াল থেকে পনেরো হাত দূরে একসারি রাইফেলধারী সৈন্য দাঁড়িয়ে। আরও অনেক জাপানি সৈন্য মাঠটার মধ্যে এদিকে-ওদিকে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে।

এ জায়গাটাতে কী হচ্ছে বুঝতে পারলে না।

ওকে নিয়ে গিয়ে টেবিলের কিছুদূরে দাঁড় করালে সৈন্যরা, তখন ও চেয়ে দেখলে দু-জন চীনাকে জাপানি সৈন্যেরা ঘিরে টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। চেয়ারে উপবিষ্ট জাপানি অফিসারটি কী জিজ্ঞেস করছে সৈন্যদের। চীনা দু-টি সৈন্য নয়, সাধারণ নাগরিক, বিমল ওদের দেখেই বুঝলে। একটু পরেই জাপানি অফিসারটি কী একটা আদেশ দিয়ে হাত নেড়ে চীনা দু-টিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বললে।

জাপানি সৈন্যেরা তাদের টেনে নিয়ে গিয়ে মাঠের ওদিকে যে বাড়িটা, তার দেওয়ালের গায়ে নিয়ে দাঁড় করালে।

চীনা লোক দু-টির মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে–তারা কলের পুতুলের মতো জাপানিদের সঙ্গে চলল বটে, কিন্তু তাদের চোখের অবাক ভাব দেখে মনে হয় তারা বুঝতে পারেনি কেন তাদের দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হচ্ছে।

বিমলও প্রথমটা বুঝতে পারেনি, সে বুঝলে–যখন দশজন জাপানি সৈন্যের সারি এক যোগে রাইফেল তুললে।

একটা তীক্ষ্ণ, স্পষ্ট, সামরিক আদেশ বাতাস চিরে উচ্চারিত হল, সঙ্গেসঙ্গে দশটি রাইফেলের এক যোগে আওয়াজ। বিমল চোখ বুজলে।

যখন সে চোখ চাইলে, তখন প্রথমেই যে কথা তার মনে উঠল, স্থান ও অবস্থা হিসেবে সেটি বড়োই আশ্চর্যের ব্যাপার বলতে হবে। তার সর্বপ্রথম মনে হল–জাপানি রাইফেলের ধোঁয়া তো খুব বেশি হয় না! কেন একথা তার মনে হল এই নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে জীবনের এই ভীষণ সংকটময় মুহূর্তে, কে তা বলবে?

তারপরই বিমল দেওয়ালের দিকে চেয়ে দেখলে চীনা দু-টি উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। দু জন জাপানি সৈন্য তাদের মৃতদেহের পা ধরে হিঁচড়ে টেনে একপাশে রেখে দিলে। তারা পাশাপাশি পড়ে রইল এমন ভাবে, দেখে বিমলের মনে হল ওরা কোনো ঠাকুরের সামনে উপুড় হয়ে প্রণাম করছে।

মানুষকে মানুষ যে এমন ভাবে হত্যা করতে পারে, বিমল তা আজ প্রথম দেখেছে হাসপাতালে, আর দেখলে এখন।

এবার বিমলের পালা, বিমল ভাবলে।

কিন্তু চেয়ে দেখলে আর চারজন চীনাকে আবার কোথা থেকে নিয়ে এসে জাপানি সৈন্যেরা টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

এবারও পূর্বের মতো কথা-কাটাকাটি হল জাপানি অফিসার ও সৈন্যদলের মধ্যে।

তারপর আবার পূর্বের ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি! এই চীনা চারজনও উপুড় হয়ে পড়ল দেয়ালের সামনে আগের দু-জনের মতো।

চীনা ভাষা যদিও-বা কিছু কিছু শিখেছে বিমল, জাপানি ভাষার তো সে বিন্দুবিসর্গ জানে । কেন যে এদের গুলি করে মারা হচ্ছে, কী অপরাধে এরা অপরাধী, কিছু বোঝা গেল না। আর এখানে জাপানিরাই কথাবার্তা বলছে, চীনাদের বিশেষ কিছু বলবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।

বিমল ভাবছিল–এই দূর বিদেশে এখনি তার প্রাণ বেরোবে। মা-বাবার সঙ্গে আর দেখা হল না, হয়তো তাঁরা জানতেও পারবেন না যে তার কী হয়েছে। শুধু একখানা চিঠি যাবে তাঁদের কাছে, তাতে লেখা থাকবে, ছেলে তাঁদের মিসিং–খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!… কিন্তু এ্যালিসের কী হল! এ্যালিসের সঙ্গেও আর দেখা হবে না। এ্যালিসকে বড়ো ভালো লেগেছিল। কোথায় যে তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে! বেচারি এ্যালিস! বেচারি মিনি!

কিন্তু বিমলের পালা আসতে বড়ো দেরি হতে লাগল।

দলে দলে চীনা নাগরিকদের টেবিলের সামনে দাঁড় করানো চলতে লাগল। তারপর তাদের হত্যা করাও সমানভাবে চলছে।

মৃতদেহ ক্রমেই স্থূপাকার হয়ে উঠছে।

এ-রকম নিষ্ঠুর হত্যা-দৃশ্য আর দেখা যায় না চোখে।

বিমলকে এইবার দু-জন জাপানি সৈন্য নিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে। বিমল অনুভব করলে তার ভয় হচ্ছে না মনে–কিন্তু একটা জিনিস হচ্ছে।

জ্বর আসবার আগে যেমন গা বমি-বমি করে, ওর ঠিক তেমনি হচ্ছে শরীরের মধ্যে। মাথাটা যেন হঠাৎ বড়ো হালকা হয়ে গিয়েছে, আর কেমন যেন বমির ভাব হচ্ছে।

জাপানি সামরিক অফিসারটি ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলে–তুমি রাস্তায় কী করছিলে?

বিমল ইংরেজিতে বললে রাস্তায় সে কিছু করেনি। হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে এনেছে।

কোন হাসপাতাল?

চীনা রেডক্রস হাসপাতাল?

তুমি সেখানে কী করছিলে?

আমি ডাক্তার। ডিউটিতে ছিলাম, জপানি সৈন্যেরা একজন চীনা রোগীকে অকারণে বেওনেটের খোঁচায়–

পেছন থেকে দু-জন জাপানি সৈন্য ওকে রুক্ষ স্বরে কী বললে, বিমলের মনে হল তাকে চুপ করে থাকতে বলছে।

জাপানি অফিসারটি বললে–থামলে কেন? বলে যাও—

বিমল হাসপাতালের হত্যাকান্ডের কথা সংক্ষেপে বলে গেল।

জাপানি অফিসার চারিপাশের জাপানি সৈন্যদের দিকে চেয়ে জাপানি ভাষায় কী প্রশ্ন করলে। বিমলের দিকে চেয়ে বললে–তুমি সেই সৈন্যকে চিনতে পারবে?

না। অত ভালো করে দেখিনি তার চেহারা, তখন মাথার ঠিক ছিল না, তা ছাড়া জাপানি সৈন্যেরা সবাই আমার চোখে একই রকম দেখায়। দেখতে অভ্যস্ত নই বলে।

তুমি সিঙ্গাপুরের লোক?

আমি ভারতবাসী।

চীনা হাসপাতালে চাকুরি কর?

হ্যাঁ।

সরাসরি এসেছ চীনে?

এ প্রশ্ন করবার কারণ বিমল একটু একটু বুঝতে পারলে। এখানে সে একটা মিথ্যে কথা বললে। এই একমাত্র ফাঁক, এই ফাঁক দিয়ে সে এবারের মতো গলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তো করবে। তারপর যা হয় হবে। সে বললে–সরাসরি আসিনি। আন্তর্জাতিক কনসেশনে এসেছিলাম; ব্রিটিশ কনসুলেট অফিসে আমার নাম রেজেস্ট্রি করা আছে।

এই সময় একজন জাপানি সৈন্য কী বললে অফিসারটিকে। তার হাতে তিনটে জরির ব্যাণ্ড, দেখে মনে হয় সে একজন করপোরাল কিংবা কম্প্যানি কমাণ্ডার।

জাপানি অফিসার বিমলের দিকে কুটি করে বললে–তুমি একজন গুপ্তচর।

আমি একথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি। আমি ডাক্তার। তোমার সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই জানে আমি হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলাম, ওরা ধরে এনেছে।

আঙুলের টিপসই দাও দু-টি এখানে।

বিমল দু-খানা কাগজে টিপসই দিলে। তারপর জাপানি অফিসার কী আদেশ করলে জাপানি ভাষায়, ওকে দু-জন জাপানি সৈন্য ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে একটা কামানের গাড়ির ওপর বসালে। চারিধারে বহু জাপানি সৈন্য গিজ গিজ করছে। সকলেই ব্যস্ত, উত্তেজিত। কোথায় যাবার জন্য সকলেই যেন ব্যগ্র উৎসুক।

বিমল দেখলে তাকে এরা ছেড়ে দিলে না। মুক্তি যে দিয়েছে তা নয়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? জাপানি ভাষার সে বিন্দুবিসর্গ বোঝে না, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে । মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘড় ঘড় করে কামানের গাড়ি টানতে লাগল একখানা মোটর লরি। ওর দু-দিকে সাঁজোয়া গাড়ি চলেছে সারি দিয়ে।

সাংহাই অতি প্রকান্ড শহর, এর আর যেন শেষ নেই, ঘণ্টা দুই চলবার পরে শহরের বাড়ি-ঘর ক্রমে কমে আসতে লাগল। ফাঁকা মাঠ আর ধানের খেত। চীনদেশের এ অংশের দৃশ্য ঠিক যেন বাংলা দেশ, তবে এখানে কাছাকাছি নীচু পাহাড়শ্রেণি চোখে পড়ে।

কিছুদূরে একটা অনুচ্চ পাহাড়ের ওপারে ঘন ধোঁয়া। রাইফেল ছোঁড়ার শব্দ আসছে।

এক জায়গায় মাঠের মধ্যে পাইন বন। সেখানে কামানের গাড়ি দাঁড়াল। বিমল দেখলে একটি উঁচু ঢালু মতো জায়গা লম্বা সারি দিয়ে জাপানি সৈন্যরা উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেল ধরে ছুড়ছে, এক সঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটটা রাইফেলের আওয়াজ হচ্ছে।

ওপাশ থেকেও তার জবাব আসছে; এটি যে যুদ্ধক্ষেত্র এতক্ষণ পরে বিমল বুঝতে পারলে! ওদিকে চীনা নাইনথ রুট আর্মি জাপানিদের বাধা দিচ্ছে–চীনা সৈন্যবাহিনী সাংহাই ছেড়ে হটে গিয়েছে বটে, কিন্তু জাপানিদের আর এগোতে দেবে না।

আর একটু পরে বিমল লক্ষ করে দেখলে, পাইন বনের একপাশে গাছের তলায় একরাশ মৃতদেহ জাপানি সৈন্যের। স্ট্রেচারে করে বিমলের চোখের সামনে আরও দু-জন মরা কী জ্যান্ত সৈন্যকে নিয়ে এল, বিমল বুঝতে পারলে না। একটু পরে আহতদের আর্তনাদ কানে যেতেই চিকিৎসক বিমল চঞ্চল হয়ে উঠল। পাশের একজন জাপানি সৈন্যকে বললে পিজিন ইংলিশে–আমাকে ওখানে নিয়ে চলো, আমি ডাক্তার, ওদের দেখব।

সব মানুষের দুঃখই সমান। দুঃখপীড়িত মানুষের জাত নেই–তারা চীনা নয়, জাপানিও নয়। একটু পরে জাপানি অফিসারের সম্মতিক্রমে বিমল হতাহত সৈন্যদের কাছে গেল দেখতে, যদি তার দ্বারা কোনো সাহায্য হয়। যদি মড়ার গাদায় জড়ো করা সৈন্যদের মধ্যে দু-একজন সাংঘাতিক আহত লোক বার হয়–কারণ আর্তনাদ সেই গাদার মধ্যে থেকেই আসছিল।

আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বিমলের কিন্তু মনে হচ্ছিল না যে এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র।

বইয়ে পড়া বা কল্পনায় দেখা যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।

একটি শান্ত পাইন বন, গোটা তিনেক কামানের গাড়ি, রাইফেল হাতে কতকগুলি সৈন্য উপুড় হয়ে আছে–ওপারে পাহাড়ের ওপর কিছু ধোঁয়া।–

কেবল সম্মুখের হতাহত জাপানি সৈন্যগুলি পরিচয় দিচ্ছে যে বিমল কোনো শান্তিপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে নেই যেখানে সে রয়েছে সেখানে মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পর্ক বড়ো বেশি।

কিন্তু ওষুধপত্র কিছু নেই যা দিয়ে এই সব আহত সৈনিকদের চিকিৎসা চলে। এমনকী খানিকটা আইডিন পর্যন্ত বিমল অনেককে বলেও জোটাতে পারলে না। এদের হাসপাতাল শিবির অনেক দূরে–সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো বন্দোবস্ত নেই।

জাপানি সৈন্যেরা কিন্তু দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ের ওপারে চীনা সৈন্যদের রাইফেল নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। কারণ যে কী, কিছু বুঝলে না।

আবার কামানের গাড়িতে চড়ে সৈন্যবেষ্টিত হয়ে যাত্রা।

এবার জাপানিরা বিমলের সঙ্গে খানিকটা ভালো ব্যবহার করলে, কারণ আহত জাপানি সৈনিকদের ও যথেষ্ট সেবা করেছে। ও যে সাধারণ সৈনিক বা স্পাই নয়, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার–এই বিশ্বাস জন্মেছে সকলেরই।

পাহাড়ের ওপারে অনেকটা সমতল ক্ষেত্রের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র সৈন্যশিবির। ওর মধ্যে ঢুকেই বিমল বুঝতে পারলে, এটা চীনা আর্মির হাসপাতাল–প্রাথমিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল এখানে–এখন কিছু নেই, চীনা সৈন্য সব সঙ্গে করে নিয়ে পালিয়েছে, কেবল একটা বড়ো দস্তার টব পড়ে আছে–আর কিছু ব্যাণ্ডেজের তুললো। হাসপাতাল শিবির থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে এক গাছের তলায় এক চীনা সৈন্যকে পাওয়া গেল–হতভাগ্য গুরুতর আহত। রাইফেলের গুলি বোধ হয় জাপানিদের, তার শরীরের দুই জায়গায় বিধেঁছে–রক্তে তার ইউনিফর্ম ভিজে উঠেছে। একে যে ওর বন্ধুরা কেন শত্রুর হাতে ফেলে পালিয়েছে কিছু বোঝা গেল না।

একজন জাপানি সৈন্য ওর পা ধরে খানিকটা হেঁচড়ে নিয়ে চলল। লোকটার বেশ জ্ঞান রয়েছে–সে যন্ত্রণায় অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠতেই পেছন থেকে একজন জাপানি অফিসার এগিয়ে গেল তাকে দেখতে।

ওদের মধ্যে উত্তেজিত স্বরে জাপানি ভাষায় কী বলাবলি হল, বিমল বুঝলে না–হঠাৎ অফিসারটি রিভলবার বার করে আহত সৈনিকের মাথায় প্রায় নল ঠেকিয়ে গুলি করলে।

লোকটা যেন রিভলবার ছোঁড়ার সঙ্গেসঙ্গে নেতিয়ে পড়ল। ওর সকল যন্ত্রণার অবসান হয়েছে।

বিমল শিউরে উঠল–চোখের সামনে এ-রকম নিষ্ঠুর হত্যা দেখতে সে এখনও তেমন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। মাইল তিন দূরে একটা চীনা গ্রাম–যুদ্ধক্ষেত্রের বাঁ-দিক ঘেঁষে। ডান দিকে একটি অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণির দিকে জাপানি অফিসারটির ফিল্ড গ্লাস দিয়ে দেখছে সবাই, সেদিকে আঙুল দিয়ে কী দেখাচ্ছে–বিমল বুঝলে ওই পাহাড়টা বর্তমানে চীনা নাইনথ রুট আর্মির দ্বিতীয় ঘাঁটি। প্রথম ঘাঁটি ছিল পূর্বোক্ত পাইন বনের সামনের পাহাড়ে–তা গিয়েছে।

একস্থানে একদল জাপানি সৈন্য গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। তাদের পাশ দিয়ে বিমলদের দল কামানের গাড়ি নিয়ে চলে গেল। ওরা যেন খুব উত্তেজিত হয়ে কী বলাবলি করছে, বিমল বুঝতে পারলে না। একজন পিজিন ইংলিশ জানা জাপানি সৈন্যকে জিজ্ঞেস করলে…ওখানে কী হচ্ছে? সৈন্যটি বললে– শোনোনি তুমি? সাংহাই শহর এখন আমাদের হাতে। আজ সকালে আমাদের হাতে এসেছে।

অত বড়ো সাংহাই শহর তোমাদের হাতে সবটা এসেছে?

সব। ওরা এইমাত্র ফিল্ড টেলিফোনে খবর পেয়েছে।

যুদ্ধ হল কখন?

কাল সারারাত প্রায় দু-শো বহুবার প্লেন বোমা ফেলেছে–শুনছি বিস্তর লোক মরেছে। সাংহাইতে–

সকলেই সাধারণ নাগরিক বোধ হয়?

বেশিরভাগ। হাজার দুই তো শুধু চা-পেইতেই মরেছে–আর শুনছি কনসেশনে বোমা ফেলে ছ-শো পলাতক চীনাকে মারা হয়েছে। ভয়ানক যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে–হবেই তো– আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। সাংহাই কী, সারা এশিয়া আমরা দখল করব–তোমাদের ভারতবর্ষ তো বটেই। দেখে নিও তুমি–নাও, এগিয়ে চলো।

বিমল ভাবছিল সুরেশ্বর কী বেঁচে আছে। বোধ হয় না। চা-পেই পল্লির অত্যন্ত কাছে চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউতে চীনা রেডক্রস হাসপাতাল। জাপানি বম্বারগুলির বিশেষ দৃষ্টি হাসপাতালের ওপর। কাল রাত্রেই সুরেশ্বরের ডিউটি থাকবার কথা। সম্ভবত হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়েছে– রোগী, ডাক্তার, নার্সসুদ্ধ। ভাগ্যে এ্যালিস আর মিনি ওখানে ছিল না!

কিন্তু আন্তর্জাতিক কনসেশনে বোমা ফেলে আশ্রয়হীন চীনা নর-নারীদের মেরেছে, একথাটা বিমলের ভালো বিশ্বাস হল না। আন্তর্জাতিক কনসেশনে বোমা ফেলতে সাহস করে কখনো? ওটা নিতান্ত বাজে কথা বলছে।

ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কনসেশনের সম্পর্কে বিমলের এ অলৌকিক শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের ভাব দূর হয়েছিল–সাংহাই অধিকার করার পূর্বে ও পরে জাপানি বম্বার প্লেনগুলি সে কনসেশনের পবিত্রতা মানেনি–এ সংবাদ বিমল আরও ভালো জায়গা থেকে এর পরে শুনেছিল।

পথের মধ্যে একটা চীনা গ্রাম। বড়ো বড়ো ভুট্টাখেতের মধ্যে। তখন সন্ধ্যা হবার বেশি দেরি নেই। পূর্বোক্ত পাহাড় ও পাইনবন থেকে অন্তত পাঁচমাইল তখন আসা হয়েছে। জাপানি সৈন্যের একটা দল গ্রামটা দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল–এবং সবাই তক্ষুনি হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে প্রায় বুক ঠেকিয়ে, চুপি চুপি অগ্রসর হতে লাগল গ্রামখানার দিকে। বিমল শুধু ভাবছিল, ভগবান করেন–গ্রামটাতে লোক না থাকে–সব যেন পালিয়ে গিয়ে থাকে।

কিন্তু তা হল না। এ গ্রামের লোক যুদ্ধের বিশেষ কোনো খবর রাখত না–সাংহাই থেকে অন্তত পনেরো-ষোলো মাইল দূরে এই গ্রামখানা। এরা বেশ নিশ্চিন্ত ছিল যে চীনা নাইনথ রুট আর্মি তাদের রক্ষা করছে। হঠাৎ যে নাইনথ-রুট আর্মি ঘাঁটি ছেড়ে দিয়েছে–তা ওরা সম্ভবত জানত না।

জাপানি সৈন্যরা গ্রামখানাকে আগে চুপি চুপি গোল করে ঘিরে ফেললে। গ্রামে অনেকগুলো সাদা সাদা খোলার ঘর, খড়ের ঘর। শস্যের গোলা, দোকানপত্রও আছে। বেশ করে ঘেরার পরে জাপানিরা হঠাৎ একযোগে ভীষণ পৈশাচিক চিৎকার করে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে নিদ্রিত নর-নারী ঘুম ভেঙে বাইরে এসে অনেকে দাঁড়াল–অনেকে ব্যাপারটা কী না বুঝতে পেরে বিস্ময় ও কৌতূহলের দৃষ্টিতে জানলা খুলে চেয়ে দেখতে লাগল।

তারপর যে দৃশ্যের সূচনা হল তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অমানুষিক। বিমলের চোখের সামনে বর্বর জাপানি সৈন্যেরা নিরীহ গ্রামবাসীদের টেনে টেনে ঘর থেকে বার করতে লাগল, এবং বিনা দোষে বেওনেটের কিংবা বন্দুকের কুঁদোর ঘায়ে তার মধ্যে সাত-আটজনকে একদম মেরে ফেললে। ছুতো এই যে, তারা নাকি বাধা দিয়েছিল। বাকিগুলিকে এক জায়গায় জড়ো করে দাঁড় করিয়ে রাখলে–চারিধারে বেওনেট-চড়ানো রাইফেল হাতে জাপানি সৈন্যের দল।

দু-তিনখানা খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে। দুটো ছোটো ছোটো বাছুরকে ভয় দেখিয়ে মজা করতে লাগল, একটা পিচ গাছের ডালগুলি অকারণে ভেঙে গাছটাকে ন্যাড়া করে দিলে। তবুও বিমল সবটা দেখতে পাচ্ছিল না–একে অন্ধকার, গ্রামটাও লম্বায় বড়ো, ওদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে জানে না তার সামনে যেগুলি ঘটছে সেগুলি সে কেবল জানে। তবে নারী ও শিশুকণ্ঠের চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল, ওদিকের জাপানি সৈন্যেরা ঠিক বুদ্ধদেবের বাণী আবৃত্তি করছে না। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ এমনি চলল– বেশিক্ষণ ধরে নয়। তখন অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে এসেছে, কেবল জ্বলন্ত ঘরের চালের আলোয় সামনেটা আলোকিত।

হঠাৎ বিমলের যেন হুঁশ হল– সে তার আশে-পাশে চেয়ে দেখলে তার খুব কাছে। কোনো জাপানি সৈন্য নেই–লুঠপাঠের লোভে সবাই গ্রামের ঘর-দোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে বা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে জটলা করছে।

বিমল একবার পিছনের দিকে চাইলে– সেদিকে একখানা কামানের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির কাছে সৈন্য নেই। গাড়িখানা থেকে পঞ্চাশ গজ আন্দাজ দূরে একটি প্রাচীন সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভ। চীনদেশের অনেক পাড়াগাঁয়ে সহমৃতা বিধবার এমন পুরোনো আমলের স্মৃতিস্তম্ভ সে আরও দু-একটি দেখেছে, ততদূর পর্যন্ত বেশ দেখা যাচ্ছে অগ্নিকান্ডের আলোয়, কিন্তু তার ওপারে অন্ধকার–কিছু দেখা যায় না।

বিমল আস্তে আস্তে পিছনে হটতে হটতে দশ-বারো পা গিয়ে হঠাৎ পেছনে ফিরে ছুট দিয়ে সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভটার আড়ালে একটি অন্ধকার স্থানে এসে দাঁড়াল।

ওর বুক ঢিপ ঢিপ করছে, যদি জাপানিরা তাকে এখন ধরে তবে এখুনি গুলি করে মারবে। কিন্তু ওদের হাতে বন্দি হয়ে এভাবে থাকার চেয়ে মৃত্যুপণ করেও মুক্তির চেষ্টা তাকে করতে হবে।

স্মৃতিস্তম্ভটার গায়ে একটা ডোবা। অন্ধকারের মধ্যেও মনে হল ডোবাটায় বেশ জল আছে। বিমল তাড়াতাড়ি ডোবার জলে নামল–তার কেমন মনে হল জলে নেমে সে যদি গলা ডুবিয়ে থাকে, তবেই সব চেয়ে নিরাপদ–ডাঙায় ছুটে পালাবার চেষ্টা করলে বেশিদূর যেতে না-যেতেই সে ধরা পড়বে।

এই ডোবায় নামবার জন্যেই যে এ যাত্রা বেঁচে গেল সেটি সে খানিকটা পরেই বুঝতে পারলে।

অল্পক্ষণ–বোধ হয় দশ-বারো মিনিটের পরেই ভীষণ চিৎকার ও বহু রাইফেলের সম্মিলিত আওয়াজ শোনা গেল। খুব একটা হইচই দুপ দাপ পালানোর শব্দ, আবার চেঁচামেচি–একটা ঘোর বিশৃঙ্খলার ভাব!

বিমল তখন ডোবার জলে গলা ডুবিয়ে বসে আছে। যদি ডাঙায় থাকত তবে অন্ধকারে ছুটন্ত রাইফেলের গুলিতে হয়তো তার প্রাণ যেত।

ব্যাপারটা কী? বিমল দেখলে সেই জাপানি কামানের গাড়িটা ঘিরে একটা খন্ডযুদ্ধ ও হাতাহাতি আরম্ভ হয়েছে সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভটার ওপারে। হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ফাটবার ভীষণ আওয়াজে হঠাৎ সমস্ত জায়গাটা যেন কেঁপে উঠল। একটি–দুটি–তিনটি। জাপানি কামানের গাড়ির কাছ থেকে জাপানি সৈন্যেরা হটে যাচ্ছে একটা বাগানের দিকে।

বিমল এবার ব্যাপারটা কিছু কিছু বুঝলে। চীনা সৈন্যের একটা দল জাপানিদের অতর্কিতে আক্রমণ করেছে। জাপানিরা ফিল্ডগানগুলি একেবারে ছুঁড়তে পারলে না। দু-টির একটিও না। চীনারা বুদ্ধি করে আগেই সে দু-টি কামানই ঘেরাও করে দখল করলে। চীনা সৈন্যের এই দলটা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুঁড়ে জাপানিদের দলের জটলা ভেঙে দিলে।

কিছুক্ষণ পরে রাইফেলের ও হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের আওয়াজ থেমে গেল। জাপানিরা কামানের গাড়ি ও বন্দিদের ফেলে পালিয়েছে। বিমল বেশ দেখতে পেলে কাছাকাছি কোথাও জাপানি সৈন্য একটিও নেই। কাদামাখা পোশাকে সতর্কতার সঙ্গে সে ধীরে ধীরে ডোবার জল থেকে উঠল ডাঙায়।

একজন সৈনিকের চড়া আওয়াজ তার কানে গেল– কে ওখানে?

বিমল আশ্চর্য হল এ পুরুষের গলা নয়– মেয়েমানুষের মতো সরু গলা। বিমল কথার উত্তর দেবার আগে দু-জন রাইফেলধারী চীনা সৈনিক ওর দিকে এগিয়ে এল ইলেকট্রিক টর্চ হাতে। তারা ওকে দেখে যেমন অবাক হল, বিমলও ওদের দেখে তেমনি অবাক হয়ে গেল।

এরা পুরুষ মানুষ নয়, দু-জনেই মেয়ে; বয়েসও বেশি নয়। কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে। বেশ সুশ্রী দু-জনেই–সৈন্যবিভাগের আট-সাঁট খাকি পোশাকে এদের দেহের লাবণ্য বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি।

তারা বিমলকে ধরে নিয়ে গেল গ্রামের সদর রাস্তার ওপরে।

অবাক কান্ড! সকলেই মেয়ে সৈনিক! এদের মধ্যে পুরুষ মানুষ নেই একজনও। এই সুশ্রী তরুণীর দল এতক্ষণ হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুড়ছিল এবং এরাই জাপানি ফিল্ড গান দু-টি ঘেরাও করে দখল করেছে।

বিমলের মনে পড়ল চীনা নাইনথ-রুট আর্মির সঙ্গে একটি নারী বাহিনি আছে সে সাংহাই চীনা রেডক্রস হাসপাতালে শুনেছিল বটে।

এরাই সেই চীনা মেয়ে-যোদ্ধার দল।

এদের কমাণ্ডান্ট কিন্তু মেয়ে নয়–পুরুষ। একটি পাইনকাঠের পুরোনো ভাঙা টেবিলের সামনে সম্ভবত একটা উপুড় করা কলসি বা ওইরকম কোনো হাস্যকর জিনিস পেতে খুব লম্বা গোঁপওয়ালা কমাণ্ডান্ট বসেছিলেন। মেয়েরা বিমলকে ধরে নিয়ে গেল সেখানে।

বিমলের মনে হল সমগ্র নারী বাহিনীর মধ্যে এই লোকই ইংরেজি জানে এবং বেশ ভালো আমেরিকান টানের ইংরেজি বলে।

বিমলের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে প্রশ্ন করলে–তুমি জাপানিদের লোক?

না। আমি চীনা হাসপাতালের ডাক্তার।

কোথাকার হাসপাতাল?

সাংহাইয়ের রেডক্রস হাসপাতাল। আমাকে ওরা বন্দি করে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল।

তুমি কোন দেশের লোক?

ভারতবর্ষের। চীনা মেডিকেল ইউনিটের আমি সভ্য।

কম্যাণ্ডান্ট বিস্ময়ের সুরে বললে–ও! তা ডোবায় জলে কী করছিলে? বিমল লজ্জিত হল। এতগুলি মেয়ের সামনে।

বললে–লুকিয়ে ছিলুম। ওদের অসতর্ক মুহূর্তে ওদের হাত থেকে পালিয়ে ডোবার জলে লুকিয়েছিলুম। তার পর হঠাৎ হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের আওয়াজ আর চিৎকার শুনলাম, তখনই ভাবলাম চীনা সৈন্য আক্রমণ করেছে ওদের।

কথাবার্তা চলছে এমন সময়ে গ্রামের পথে কী একটা গোলমাল উঠল। কমাণ্ডান্টকে ঘিরে যারা ছিল, তারা চমকে উঠে সেদিকে ছুটতে লাগল। আবার কি জাপানি সৈন্যের দল আক্রমণ করেছে?

বিমল চেয়ে দেখল জনকয়েক সৈন্য যেন কাউকে ধরে আনছে–তাদের পেছনে পেছনে অনেক সৈন্য মজা দেখতে আসছে।

ব্যাপার কী? হয়তো কোনো জাপানি সৈন্য ওদের হাতে ধরা পড়েছে, তাকে সকলে মিলে ধরে আনছে–নিশ্চয়ই।

কিন্তু দলটি কমাণ্ডান্টের কাছে এসে পৌঁছে যখন ওদের প্রথামতো সামরিক অভিবাদন করে দু-জন বন্দিকে এগিয়ে নিয়ে দাঁড় করালো কম্যাণ্ডান্টের সামনে–বিমল চমকে উঠে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। কারণ কিছুক্ষণ পরে তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরোলো–এ্যালিস! মিনি! সামনের শীর্ণকায়া মূর্তি দু-টি এ্যালিস ও মিনি ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু ওদের হাত পা বাঁধা–মুখে কাপড় দিয়ে বাঁধা। এমন শক্ত করে বাঁধা যে ওদের কথা বলবার উপায় নেই।

ভয়ানক রাগ হল বিমলের এক মুহূর্তে এই চীনা নারী বাহিনীর ওপর। মেয়ে হয়ে মেয়ের ওপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার! ওদের এমন করে বেঁধে আনার অর্থ কী? ওরা ছিলই-বা কোথায়?

কম্যাণ্ডান্ট উত্তেজিত সুরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল। ইতিমধ্যে এ্যালিস ও মিনির হাত-পা মুখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। ব্যাপারটি ক্রমশ যা জানা গেল তা হল এই

চীনা নারী সৈন্যেরা এদের গ্রামের একটি ঘরের মধ্যে অন্ধকার কোণে এই অবস্থাতেই পায়। বাইরে থেকে ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল–কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ সন্দেহ করে ওরা দরজা ভেঙে দেখতে পায় এদের। ওরা বুঝতে পেরেছে যে এরা ইউরোপীয় বা আমেরিকান মহিলা। কিন্তু চীনের এই সুদূর পাড়াগাঁয়ে একা অন্ধকার ঘরের কোণে এদের কে এ অবস্থায় এনে ফেলেছে তা না বুঝতে পেরে সবাই মহাবিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

হঠাৎ বিমল বলে উঠল–এ্যালিস! মিনি!

প্রথমে চমকে উঠে ওর দিকে চাইলে এ্যালিস। বিমলকে দেখে সে যেন প্রথমটা চিনতে পারলে না–তারপর প্রায় ছুটে ওর কাছে এসে বিস্মিত চকিত আনন্দভরা কণ্ঠে বললে– তুমি এখানে!

সঙ্গেসঙ্গে মিনিও ছুটে এল। মিনির চেহারাটা বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে নানা কষ্টে, উদবেগে, এবং খুব সম্ভবত অনাহারেও বটে। সে বললে, তোমার বন্ধু কই?

.

ঘণ্টা কয়েক পরে।

একটা রিচ গাছের তলায় বসে মিনি, এ্যালিস ও বিমল কথা বলছিল। এখনও রাত আছে, তবে পূর্ব আকাশে শুকতারা উঠেছে–ভোর হওয়ার বেশি দেরি নেই।

মিনি ও এ্যালিস তাদের গল্প বলে যাচ্ছিল। ওদের ভালো করে খেতে দেওয়া হয়েছে, কারণ ওদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল পেটভরে খাওয়া ওদের অদৃষ্টে অনেকদিন ধরে জোটেনি।

বিমল বললে–এখানে তোমরা কী করে এলে?

এ্যালিস বললে–এখনও ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু বড় খুশি হয়েছি তোমায় দেখে, বিমল। আমরা তো আশঙ্কা করছিলাম জাপানিরা আক্রমণ করেছে–এইবার ঘর জ্বালিয়ে আমাদের বন্দি অবস্থায় পুড়িয়ে মারবে–কে আর উদ্ধার করবে আমাদের? আর আমাদের অস্তিত্ব জানেই বা কে?

কবে তোমরা এ গ্রামে এসেছ?

আজ তিন দিন হল খুব সম্ভব–কারণ দিনরাত্রির জ্ঞান আমাদের বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

কে তোমাদের আনে?

কয়েকজন চীনা দস্যু।

সাংহাইয়ের চর আড্ডায় তোমাদের নিয়ে গিয়েছিল ধরে?

এ্যালিস বিস্ময়ের সুরে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–তুমি কী করে জানলে? বিমল হেসে বললে–আমি আর সুরেশ্বর সেই চড়ুর আড্ডাতে যাই তোমাদের খুঁজতে। কিন্তু বড়ো বিভ্রাট বেধে গেল সে রাত্রে। জাপানি বম্বারগুলি সেইরাত্রে ভীষণ বোমা বর্ষণ শুরু করলে। মিনি বললে, আমরা খুব জানি। আমরা তখন হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় একটি গোরুর গাড়ির মধ্যে শুয়ে। একটি বোমা তো আমাদের গাড়ির পাশে পড়ল।

এ্যালিস বললে–তারপর ওরা আমাদের নানা জায়গায় ঘোরালে। দশ হাজার ডলার মুক্তিপণ না দিলে আমাদের ছাড়বে না। দেশে বাপ-মায়ের কাছে চিঠি লিখবে বলে ঠিকানা চেয়েছিল–আমরা দিইনি। আজ ওরা আমাদের শাসিয়েছিল জাপানি সৈন্যেরা গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে–ঠিকানা যদি না দিই তবে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখে পালাবে–আমরা নিঃশব্দে পুড়ে মরব। করেছিলও তাই। চীনা মেয়ে সৈন্যেরা না এলে জাপানিরা গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। আমরাও পুড়ে মরতাম।

বিমল বললে–কী সর্বনাশ!

এ্যালিস বললে–সর্বনাশ আর কী, পুড়ে মরতাম এর আর সর্বনাশ কী? কতই তো মরছে! কিন্তু তুমি এখানে কী করে এলে বিমল?

আমাকে হাসপাতাল থেকে জাপানিরা বন্দি করে এনেছিল। আমি নাকি স্পাই। এতদিন গুলি করেই মারত যদি একথা ওদের না বলতুম যে ব্রিটিশ কনসুলেট অফিসে আমার নাম রেজেস্ট্রি করা আছে।

মিনি বললে–সুরেশ্বর কোথায় গেল একটা খোঁজ করতে হয়। আর আমেরিকান কনসুলেটে আমাদের বিষয়ে একটা খবর দিতে হয়–চলো কম্যাণ্ডান্টকে বলি।

জনকয়েক তরুণী চীনা মেয়ে-সৈন্য ওদের হাসিমুখে ঘিরে দাঁড়াল। এদের হাস্যদীপ্ত সুন্দর চেহারা বিমলের বড়ো ভালো লাগল, এমন একটি জিনিস নতুন দেখছে সে–বহুশতাব্দীর জড়তা দূর করে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নারী–রণক্ষেত্রের নিষ্ঠুরতা, কঠোরতার মধ্যে। দেশের দুর্দিনে দেশমাতৃকার সেবাযজ্ঞে তারা আজ মস্ত বড় হোতা–মিথ্যে জড়তা, মিথ্যে লজ্জা-সঙ্কোচ দূর করে ফেলেছে টেনে।

একটি মেয়ে ইংরেজিতে বললে–তোমরা হ্যাং-চাউতে রাজকুমারী তাং-এর দেউল দেখেছ?

এ্যালিস বললে–না, সে কী?

পাঁচশো বছর আগে মিং রাজবংশের একজন রাজকুমারী ছিলেন তাং। তাঁর পুণ্যচরিত্র এখনও আমাদের দেশের লোকের মুখে মুখে আছে। এখান থেকে বেশি দূর নয়–দেখে যেও।

বিমল বললে–তুমি বেশ ইংরেজি বলতে পার তো?

মেয়েটি এমন হাসলে যে তার তেরচা চোখ দুটি বুজে গিয়ে দুটো কালো রেখার মতো দেখাতে লাগল।

ভালো ইংরেজি বলছি? তবুও এ ইয়াংকি ইংরেজি। মিশনারি স্কুলে পাঁচ বছর পড়েছিলুম এক সময়ে। ইংরেজি গান পর্যন্ত গাইতে পারি–শুনবে?

হঠাৎ বিউগল বেজে উঠল। সবাই ব্যস্ত হয়ে কমাণ্ডান্টের তাঁবুর দিকে চলল। এখনি মার্চ শুরু করতে হবে। খবর পাওয়া গিয়েছে জাপানিদের বড়ো একটি দল এখানে আসছে।

বিমল বাঁ-দিকে চেয়ে দেখলে।

একটা অনুচ্চ পাহাড়ের মতো লম্বা ঢিবির আড়াল থেকে মাঝে মাঝে যে সাদা ধোঁয়া বার হচ্ছে–আর সঙ্গেসঙ্গে ফটফট শব্দ হচ্ছে। শব্দটা অনেকটা যেন বিমলদের দেশের লিচু বাগানে পাখি তাড়াবার জন্যে চেরা বাঁশের ফটাফট আওয়াজের মতো।

রাইফেল ছোঁড়ার শব্দ। আধুনিক যুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেলে শব্দ হয় খুব কম–বিমল জানত।

সবাই বললে–মাথা নীচু করো–মাথা নীচু করো—

জাপানি সৈন্যরা আক্রমণ করে ওই ঢিবিটাতে আড়াল নিয়েছে–কিন্তু হয়তো এখুনি বেওনেট চার্জ করবে কিংবা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড নিয়ে ছুটে আসবে।

চক্ষের নিমেষে সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেলের মুখ ঢিবিটার দিকে ফেরালে। একটি মেয়ে হঠাৎ অস্পষ্ট চিৎকার করে উপুড় অবস্থা থেকে চিৎ হয়ে গেল–তার হাত থেকে বন্দুকটি ছিটকে গিয়ে পড়ল আর একটি মেয়ের পিঠের ওপরে– সে কিছু দূরে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল বন্দুক বাগিয়ে। এ্যালিস ছুটে উঠে গিয়ে মেয়েটির মাথা নিজের কোলে তুলে নিলে–আশপাশের মেয়েরা বললে–মাথা নীচু–মাথা নীচু–শুয়ে পড়ো—

বিমল শঙ্কিত চোখে অল্পক্ষণের জন্যে এ্যালিসের দিকে চেয়ে দেখলে–তারপর সেও উঠে গিয়ে এ্যালিসের পাশে বসল। আহত মেয়ে-সৈনিকের হাতের নাড়ি দেখে বললে–এ শেষ হয়ে গিয়েছে। এঃ এই দ্যাখো গলায় লেগেছে গুলি–তোমার কাপড় যে রক্তে ভেসে গেল।

এ্যালিসকে একরকম জোর করে টেনে বিমল তাকে আবার উপুড় করে শোয়ালে। বিমল ভাবছিল, এখুনি যদি দুর্দান্ত জাপানি গ্রেনেডিয়ারেরা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড নিয়ে ছুটে আসে ঢিবিটা ডিঙিয়ে, তবে এই শায়িতা নারী-সৈনিকের দল একটিও টিকবে না। জাপানি হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের বিস্ফোরণের ফল অতি সাংঘাতিক, এদের কম্যাণ্ডান্ট কী ভরসায় এদের এখনও শুইয়ে রেখেছে? মরবে তো সবগুলিই মরবে। যা করে করুক, ওদের সৈন্য ওরা বাঁচাতে হয় বাঁচাক, নয় তো যা হয় করুক। কিন্তু মিনি ও এ্যালিসের জীবন আবার বিপন্ন হল।

ফটাফট–ফটাফট—

আবার একটি অস্ফুট শব্দ। তারপর বিমল চেয়ে দেখলে চিৎকার না করেও সারির মাঝামাঝি দু-টি মেয়ে উপুড় অবস্থাতেই মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে। হাতের শিথিল মুঠিতে তখনও রাইফেল ধরাই রয়েছে। তার মধ্যে একটি মেয়ের মুখ থেকে রক্ত বার হয়ে সামনের মাটি রাঙা হয়ে গিয়েছে। আর একটি মেয়েও দেখতে দেখতে মুখ গুঁজে পড়ে গেল। আঃ– কী ভীষণ হত্যাকান্ড! পুরুষদের এ-রকম অবস্থায় দেখলে সহ্য করা হয় তো যায়–কিন্তু এই ধরনের নারীবলির দৃশ্যটা বিমলের কাছে অতি করুণ ও অসহনীয় হয়ে উঠল।

বিমল বললে–এ্যালিস। কমাণ্ডান্টটি কেমন লোক? এদের দাঁড়িয়ে খুন করাচ্ছে কেন? হঠে যাবার অর্ডার না দেওয়ার মানে কী? জাপানিরা বেওনেট কি হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড চার্জ করলে একজনও বাঁচবে?

এ্যালিস বিমলের পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে–তার ওদিকে মিনি।

মিনি বললে–কমাণ্ডান্টের এ-রকম ব্যবহারের নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে। মানে কী আছে তা জানবার আগেই আরও দু-টি মেয়ে মুখ খুঁজড়ে পড়ে গেল–এদের এই নিঃশব্দ মৃত্যু বিমলের কাছে বড়ো মর্মস্পর্শী বলে মনে হল। হঠাৎ একটা লম্বা কাশীর পেয়ারার আকারে বস্তু শায়িতা মেয়েদের সারির অদূরে এসে পড়ল–বিমল ও এ্যালিস দু জনেই বলে উঠল–গ্রেনেড!

কিন্তু হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডটা ফাটল না। বোধ হয় এবার জাপানিরা চার্জ করবে। এ্যালিস ও মিনির জন্যে বিমল শঙ্কিত হয়ে উঠল।

ঠিক সেই সময় কমাণ্ডান্ট ওদের হঠবার অর্ডার দিলে।

পেছনের সারি শুয়ে-শুয়েই পিছু দিকে হঠতে লাগল। সামনের সারিগুলি ততক্ষণ রাইফেল বাগিয়ে তাদের রক্ষা করছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামনের সারিও হঠতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে জাপানিরা চার্জ করলে। দলে দলে ওরা ঢিবিটা পেরিয়ে বানজাই বলে ভীষণ বাজখাঁই চিৎকার করতে করতে ছুটে এল–এদিকে নারী-বাহিনীর সব বন্দুকগুলি একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। এখানে-ওখানে জাপানি সৈন্য ধুপ-ধাপ করে মুখ থুবড়ে পড়তে লাগল। তবুও ওদের দল এগিয়ে আসছে।

সব পেছনের সারি উঠে দাঁড়িয়ে একযোগে সাত-আটটা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুড়ল, চার-পাঁচটা ফাটল। আরও কতকগুলি জাপানি সৈন্য মাটিতে পড়ে গেল। তিন জন মাত্র জাপানি এদের দলের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল। তাদের মধ্যে দু-জন বেওনেটের ঘায়ে সাংঘাতিক আহত হল–বাকি একজনের মাথায় গুলি লেগে সাবাড় হল।

ততক্ষণ নারী-বাহিনী প্রায় এক-শো-দেড়-শো গজ দূরে চলে গিয়েছে। এতদূর থেকে হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড কোনো কাজে আসবে না– কেবল কার্যকরী হতে পারে মিলস বম্ব জাতীয় বোমা। সে কোনো দলের কাছেই নেই, বেশ বোঝা গেল।

কমাণ্ডান্ট বিমলকে ডেকে বললেন–এ-রকম কেন করেছি, আপনি বোধ হয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন। এর কিছু দূরে মিং-চাউ এর রেলস্টেশন। দু-টি সৈন্যবাহী ট্রেন পরপর চলে যাবার কথা। জাপানিরা রেলস্টেশন আক্রমণ করত। আমি ওদের বাধা দিয়ে এখানে আটকে রাখলাম। টাইম অনুসারে ট্রেন দু-টি চলে গিয়েছে। এখন আর আমার সৈন্যদের মৃত্যুর সম্মুখীন করা অনাবশ্যক। জাপানিরাও তা বুঝেছে, ওরাও আর আসবে না। ওদের লক্ষ্যস্থল আমরা নই– সেই ট্রেন দু-খানা।

কিন্তু এরোপ্লেন যদি বোমা ফেলে?

আমার ঘাঁটি পার করে দিলাম নিরাপদে–তারপর অন্য এলাকার লোক গিয়ে বুঝুক সে কথা।

মিং-চাউয়ের রেলস্টেশন পৌঁছে সবাই খাওয়া-দাওয়া করবার হুকুম পেলে। বিমল ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিনি ও এ্যালিসকে কিছু খাওয়াতে। খাবার কিছুই নেই। অন্তত সভ্য খাদ্য কিছু নেই। কমাণ্ডান্টকে বলে কিছু চাল জোগাড় করে একটা গাছতলায় এ্যালিস একটি পুরোনো সসপ্যানে ভাত চাপিয়ে দিলে তিনজনের মতো।

বেলা প্রায় বারোটা। রৌদ্র বেশ প্রখর, কিন্তু গরম নেই, বেশ শীত।

ভাত প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় দলে দলে ছোট্ট শীর্ণকায় ছেলে-মেয়ে গাছতলায় নীরবে এসে দাঁড়াল। তারা ক্ষুধার্তের ব্যগ্র দৃষ্টিতে সসপ্যানের দিকে চেয়ে রইল। জনৈক মেয়ে সৈনিক বললে–এরা আশপাশের গ্রামের দুর্ভিক্ষপীড়িত ছেলে-মেয়ে; আমাদের দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে। ওরা খাবার লোভে এসেছে।

এ্যালিস বললে–পুওর লিটল ডিয়ারস! … ওদের কী খেতে দিই, বিমল?

বিমল মুশকিলে পড়ে গেল। নিজের খাওয়ার জন্যে নয়–মিনি এ্যালিস কত দিন পেট ভরে খায়নি বলেই ওদের খাওয়াতে ব্যর্থ ছিল। নিজে না হয় না খাবে, কিন্তু এ্যালিস যেমন মেয়ে নিজের মুখের ভাত সব এক্ষুনি তুলে দেবে এখন এদের।

সুখের বিষয় একটা সমাধান হল। ওরা চীনা ছেলে-মেয়ে, চীনা খাবার খেতে আপত্তি নেই। অন্য অন্য মেয়ে-সৈনিকরা ওদের দেশীয় খাদ্য কিছু দিলে। তারা চলে গেল তাই খেয়ে। এ্যালিসের ইচ্ছে ওদের মধ্যে একটা ছোট্ট ছেলে নিয়ে যায়। বললে–বিমল, বলো না ওদের মধ্যে কেউ আমার সঙ্গে যাবে। আমি খুব যত্ন করব। বিমল হাসলে, তা কী কখনো হয়?

একটু পরে একখানা ট্রেন এল। তাতে সব খোলা ট্রাক, কয়লার গাড়ির মতো। কম্যাণ্ডান্টের আদেশে সবাই তাতে উঠে পড়ল। ট্রেনের গার্ডের মুখে শোনা গেল জাপানিরা এখান থেকে বাইশ মাইল ডাউন লাইনে একখানা সৈন্যবাহী ট্রেন এরোপ্লেন থেকে বোমা মেরে উড়িয়ে চুরমার করে দিয়েছে।

ট্রেন ছাড়ল। গার্ড বললে–ভয়ানক বিপজ্জনক অবস্থা। ওরা প্রত্যেক সৈন্যবাহী ট্রেনের ওপর কড়া লক্ষ্য রেখেছে। পৌঁছে দিতে পারব কিনা নিরাপদে তার ঠিক নেই।

মাইল ত্রিশেক দু-ধারে ফাঁকা মাঠ, ধানের খেত, গমের খেতের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলল। বেলা প্রায় পাঁচটা বাজে, রোদ নেই। মাঠে ঘন ছায়া পড়ে এসেছে। এমন সময় একটি পরিচিত আওয়াজ শুনে বিমলের বুকের মধ্যেটা কেমন করে উঠল। মুখ উঁচু করে দেখতে গিয়ে দেখলে ট্রেনের সবাই মুখ তুলে চেয়ে রয়েছে। অনেকগুলি এরোপ্লেনের সম্মিলিতি ঘড় ঘড় আওয়াজ। ট্রেন যেন গতি বাড়িয়ে দিয়ে জোরে চলতে লাগল।

মিনি বললে–ওই দেখো বিমল এরোপ্লেনের সারি! বম্বার!

চক্ষের নিমেষে এরোপ্লেনের সারি নিকটবর্তী হল–কিন্তু ট্রেনখানাকে গ্রাহ্য না করেই যেন এরোপ্লেনগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যাচ্ছিল–হঠাৎ একখানা বম্বার দল ছেড়ে বেশ নীচু হয়ে এল। ট্রেনের সকলের মুখ শুকিয়েছিল আগেই–এখন যেন বুকের রক্ত পর্যন্ত জমে গেল। এই ফাঁকা মাঠে বোমা ফেললে ট্রেনের চিহ্ন খুঁজে মিলবে না। তার ওপরে ছাদ-খোলা ট্রাক গাড়ি বোঝাই সৈন্য, কারো মৃতদেহ এর পর সনাক্ত পর্যন্ত করা যাবে না। এ্যালিস ও মিনিকে বাঁচানো গেল না শেষে।

এরোপ্লেনখানা নীচে নেমে ছোঁ-মারা চিলের মতো একটি বোমা ফেলেই তখনি ওপরে উঠে গেল। সঙ্গেসঙ্গে ভীষণ বিস্ফোরণের শব্দ! সমস্ত ট্রেনখানা কেঁপে নড়ে উঠল যেন, কিন্তু ট্রেনের বেগ কমল না। বিমল চেয়ে দেখলে রেললাইন থেকে দশ গজ দূরে একটি জায়গায় বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে মাটি, ধুলো, ঘাস, বালি অন্তত পঁচিশ ত্রিশ হাত উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করে কালো ধোঁয়ার আবরণের মধ্যে বোমাটি সমাধি লাভ করেছে। বোমারু তাগ ঠিক করতে পারেনি।

আর মাইল পাঁচ-ছয় পরে একটি রেলস্টেশন। গাড়িখানা সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার পূর্বেই দেখা গেল স্টেশন থেকে প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে–লোকজন ছোটাছুটি করছে–একটা হট্টগোল, কলরব, ব্যস্ততার ভাব। ট্রেনখানা স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াতেই বোঝা গেল জাপানি বিমান থেকে বোমা ফেলে স্টেশনটিকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। টিনের ছাদ দুমড়ে বেঁকে ছিটকে বহু দূরে গিয়ে পড়েছে, একপাশে আগুন লেগে গিয়েছে–গোটা প্ল্যাটফর্মে মানুষের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ, কারো হাত, কারো পা, কারো মুন্ড।

নিকটে একখানা গ্রাম। গ্রামের চিহ্ন রাখেনি বোমারুর দল। ইনসেনডিয়ারি বোমা ফেলে সারাগ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ট্রেন থেকে সবাই নেমে সাহায্য করতে ছুটল। গ্রামের লোক বেশি মরেনি–তবুও বিমল দেখলে গ্রামের পথে চার-পাঁচটা বীভৎস মৃতদেহ পড়ে আছে। এরোপ্লেনগুলির চিহ্ন নেই আকাশে, তাদের কাজ শেষ করে তারা চলে গিয়েছে। গ্রামের নর-নারী ভয়ে বিহ্বল হয়ে মাঠের মধ্যে ছুটে পালিয়েছিল, যদিও বিপদের সম্ভাবনা ছিল সেখানেই সর্বাপেক্ষা বেশি, একটি মেয়ে একা ভাঙা ঘরের সামনে ভাঙাচোরা হাঁড়িকুড়ি বেতের পেটরা কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করছে আর কাঁদছে। একজন মেয়ে-সৈন্য তার কাছে গিয়ে চীনা ভাষায় কী জিজ্ঞেস করলে। বিমলের দল গ্রামের অন্য অন্য লোকজনের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

একটু পরেই সেখানে ভারি একটি অদ্ভুত দৃশ্য সবারই চোখে পড়ল।

গ্রামের পাশে একটা ছোট্ট মাঠ–তারই এক গাছতলায় জনৈক বৃদ্ধ গ্রামের লোকজনকে চারিপাশে নিয়ে কী বলছেন বক্তৃতার ধরনে। বিমল চিনলে–প্রোফেসর লি!

এ্যালিস সকলের আগে এগিয়ে গিয়ে বললে–ড্যাডি! চিনতে পার?

সৌম্য মূর্তি শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধ বক্তৃতা থামিয়ে একগাল হেসে ওর দিকে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন–তোমরা কোথা থেকে?

এ্যালিস হেসে বললে–এই ট্রেন থেকে নামলাম। আর একটু হলে আমাদের কাউকে দেখতে পেতে না–আমাদের ট্রেনেও বোমা পড়েছিল।

বিমল বললে–গুডমর্নিং, প্রোফেসর লি। আপনার দলবল কোথায়? আপনি কী করছেন এখানে?

বৃদ্ধ বললে–দলবল এখান থেকে তিন মাইল দূরে আর একখানা বোমায় বিধ্বস্ত গ্রামে সাহায্য করছে। আমি এদের উপদেশ দিচ্ছি এরোপ্লেন বোমা ফেলতে এলে কী করে আত্মরক্ষা করতে হয়। এরা কিছুই জানে না–দাঁড়িয়ে মরছে, নইলে দেখো গ্রামের অধিকাংশ লোক ফাঁকা মাঠে ছুটে পালায়?

–আপনাকে তো সর্বত্র দেখি, প্রোফেসর লি। পরের সাহায্য করতে এমন আর ক-জন লোক চীনদেশে আছেন জানি না। আপনাকে দেখে আপনার দেশের ওপর ভক্তি আমার অনেক বেড়ে গেল।

প্রোফেসর লি হেসে বললেন–আমার দেশ অতি হতভাগ্য, আমরা অতি প্রাচীন সভ্য জাতি কিন্তু জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছি। ভগবান নদীর এক কূল ভাঙেন আর এক কূল গড়েন। জাপান আজ উঠছে–আবার আমাদের দিন আসবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে, যে ক-দিন বাঁচি, মূঢ়তা ও বর্বরতার দ্বারা অত্যাচারিত দেশের সেবা করে দিন কাটিয়ে যেতে চাই কিন্তু আমার দ্বারা আর কতটুকু উপকারই বা হবে?

বিমল বললে–বড়ো ইচ্ছে ভারতবর্ষের প্রথা অনুসারে আপনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। আপনি কি অনুমতি করবেন? বৃদ্ধ মহাচীন যেন তাঁর সন্তানদের রক্ষা করেন আপনার মূর্তিতে।

বিমলের দেখাদেখি মিনি, এ্যালিস এবং আরও কয়েকটি মেয়ে-সৈনিক বৃদ্ধের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে হাসিমুখে।

ট্রেন হুইসল দিলে। কমাণ্ডান্টের হুকুম শোনা গেল–ট্রেনে গিয়ে উঠে পড়ো।

এ্যালিস বললে–ড্যাডি, তোমার সঙ্গে কোথায় আবার দেখা হবে? আমরা দু-টি মেয়ে এবং আমার এই ভারতবর্ষীয় বন্ধুটি তোমার সঙ্গে থেকে কাজ করতে চাই–অনুমতি দেবে ড্যাডি?

বৃদ্ধ বললেন–এখন তোমরা যাও খুকিরা–শিগগির আমার সঙ্গে দেখা হবে। এ কাজ তোমাদের নয়।

ট্রেন আবার চলল।

দু-ধারে শস্যক্ষেত্র, মাঝে মাঝে ধোঁয়ায় কালো অগ্নিদগ্ধ গ্রাম। জাপানি বোমারু বিমানের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন।

এ্যালিস বললে–বিমল, আমার কী মনে হচ্ছে জান? প্রোফেসর লি-কে আবার আমাদের মধ্যে পেতে। এত ভালো লেগেছে ওঁকে! আমার নিজের বাবা নেই, ওকে দেখে সেই বাবার কথা মনে আসে।

বিমল দেখলে এ্যালিসের বড়ো বড়ো চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।

মিনি বললে–আমারও বড়ো ভক্তি হয় সত্যি! ভারি চমৎকার লোক।

বিমল বললে–অথচ কীভাবে ওঁর সঙ্গে আলাপ তা জান? আমি যখন প্রথম চীনদেশে আসি–আজ প্রায় একবছর আগের কথা–তখন হ্যাং-চাউ রেলস্টেশনে উনি ওঁর ছাত্রদল নিয়ে উঠলেন–বললেন, যুদ্ধের সময় ওখানকার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে যাচ্ছেন। শুনে আমার হাসি পেয়েছিল।

এ্যালিস বললে–তখন কী জানতে উনি একজন মহাপুরুষ লোক! উনি যুদ্ধ-উপদ্রুত অঞ্চলের মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন এটা ঠিকই কিন্তু পরের দুঃখ দেখে সেসব ওঁর ভেসে গেল। People such as these are the salts of the Earth-নয় কী?

বিমল মৃদু হেসে চুপ করে রইল।

একটি নদীর পুল বোমায় ভেঙে গিয়েছে। আর ট্রেন যাবার উপায় নেই। রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীরা দিনরাত খাটছে যদি পুলটা কোনো রকমে মেরামত করে কাজ চালানো যায়।

কাছেই একটা তাঁবু। মাঠের মধ্যে কিছুদূরে জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে। এটা ফিল্ড হাসপাতাল।

ট্রেন থেকে মেয়ে-সৈন্যদের পথেই নামিয়ে দেওয়া হল। ট্রেনখানা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যাবে বলে পিছু হঠে চলে গেল। কোনো বড়ো স্টেশনে গিয়ে এঞ্জিনখানা সোজা করে জুড়ে নেবে। সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। যেন অনেকটা পূর্ববঙ্গের বড়ো বড়ো জলা অঞ্চলের মতো। ফসলের খেত নেই–সামনে একটি বিল কিংবা ওই ধরনের জলাশয়–দীর্ঘ দীর্ঘ জলজ ঘাসের বন জলের ধারে। দূরে দূরে মেঘের মতো নীল পাহাড়। জায়গাটার নাম সিং চাং। বিমল নেমে চারিদিক দেখে অবাক হয়ে গেল।

ট্রেনে করে এতদূরে এসে এখানে আবার যুদ্ধক্ষেত্র কী করে এল।

বিমলের ধারণা ছিল জাপানিদের আসল ঘাঁটি কোনকালে পার হয়ে আসা গিয়েছে।

কিন্তু কমাণ্ডান্ট তাকে বুঝিয়ে বললেন–এখান থেকে আরও প্রায় পঁচিশ মাইল দূর হ্যাং কাউ শহর পর্যন্ত ওদের সৈন্যরেখা বিস্তৃত। সমুদ্রের উপকূলভাগে অনেক দূর অবধি ওরা নিজেদের লাইন ছড়িয়ে রেখেছে। মাটিতে একটা নকশা এঁকে বুঝিয়েও দিলেন।

বিমল একটি অনুচ্চ ঢিবির ওপর উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখলে।

কিছুদূরে একটি গ্রাম–পাশে কাদের অনেকগুলি ছোটো বড়ো তাঁবু–সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে, বোধ হয় রান্নাবান্না চলেছে। পশ্চিম দিকে একটি বড়ো শস্যক্ষেত্র, তার ধারে লম্বা লম্বা কী গাছের সারি। মোটের ওপর সবটা নিয়ে বেশ শান্তিপূর্ণ পল্লিদৃশ্য।

এ কী ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র?

কিন্তু বিমলদের সেখানে উপস্থিত হবার আধ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ-ছ-জন আহত সৈন্যকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতাল তাঁবুতে আনা হল। সকলেই রাইফেলের গুলিতে আহত।

বিমল জিজ্ঞেস করে জানল যুদ্ধক্ষেত্র যে বেশিদূর তাও নয়–ওই গাছের সারির পাশেই, এখান থেকে আধমাইলের মধ্যে। একটি ক্ষুদ্র গ্রাম জাপানিরা দখল করে সেখানে ঘাঁটি করেছে–চীনা সৈন্য ওদের সেখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে।

কমাণ্ডান্টের আদেশে মেয়ে-সৈনিকরা রান্নাবান্না করে খাবার আয়োজন করতে লাগল– কারণ অনেকক্ষণ তারা বিশেষ কিছু খায়নি। বিমল বললে–খাইয়ে নিয়ে এদের কী এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে? কমাণ্ডান্ট বললে–না, এরা পরিশ্রান্ত। ক্লান্ত সৈন্যদের দিয়ে যুদ্ধ হয় না–ওদের অন্তত দশঘণ্টা বিশ্রাম করতে দেব।

তারপর?

তারপর যুদ্ধে পাঠাতে পারি–রিজার্ভ রাখতে পারি। এখান থেকে সাত মাইল দূরে হ্যাং কাউ-ক্যান্টন রেলের ধারে একটি গ্রামে নাইনথ রুট আর্মির এক ঘাঁটি। সেখানে জেনারেল মাও-সি-তুং আছেন–তাঁর হুকুমমতো কাজ হবে।

হুকুম আসবে কী করে?

ঘোড়ার পিঠে যায় আসে ডেসপ্যাঁচ দল। আমাদের ফিল্ড টেলিফোন নেই।

কমাণ্ডান্টের সঙ্গে কথা বলে ফিরে গিয়ে বিমল হাসপাতাল তাঁবুতে আহত সৈন্যদের চিকিৎসার কাজে মন দিল। তিনটি হতভাগ্য সৈনিক কোননাপ্রকার সাহায্য পাবার পূর্বেই মারা গেল। বাকি কয়েকজনের করুণ আর্তনাদে হাসপাতাল মুখরিত হয়ে উঠল। কী নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ব্যাপার এই যুদ্ধ! একথা বিমলের মনে না এসে পারল না।

এ্যালিস এসে বললে–এদের জন্যে বৃথা চেষ্টা। এদের একজনও বাঁচবে না।

বিমল বললে–তাই মনে হয়। না আছে ওষুধ, না আছে যন্ত্রপাতি, কী দিয়ে চিকিৎসা করব?

বিমল, এদের জন্যে আমেরিকান রেডক্রসে লিখে কিছু জিনিস আনার চেষ্টা করব?

লেখো না। নইলে সত্যি বলছি আমাদের খাটুনি বৃথা হবে।

ঠিকই তো? এটা কি একটা হাসপাতাল? কী ছাই আছে এখানে?

মিনি কোথায় গেল?

সে রাঁধছে। খেতে হবে তো? রাঁধবার কোনো বন্দোবস্ত নেই। দু-টি চাল ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।

টিনবন্দি খাবার কিছু সাংহাই থেকে আনিয়ে নিই। ও খেয়ে তোমরা বাঁচবে না।

একটা কথা শোনো। তুমি একবার সাংহাই যাও–মিনি সুরেশ্বর সম্বন্ধে বড়ো উদবিগ্ন হয়েছে আমায় বলছিল। ও আমায় কাল থেকে বলছে তোমায় বলতে।

আমিও যে তা না ভেবেছি এমন নয়। কিন্তু সাংহাই পর্যন্ত কোনো ট্রেন এখান থেকে যাচ্ছে তো? আচ্ছা, কমাণ্ডান্টকে বলে দেখি।

আবার চারজন আহত সৈনিককে স্ট্রেচারে করে আনা হল। একজনের মাথার খুলির অর্ধেকটা উড়ে গিয়েছে বললেই হয়। বিমল বললে–এ তো গেল! একে এখানে কেন এনেছে?

কিন্তু অদ্ভুত জীবনীশক্তি চীনা সৈনিকটির। মাথার ব্যাণ্ডেজ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, দু-বার ব্যাণ্ডেজ বদলাতে হল, তবুও সৈনিকটি মারা গেল না–বিমল ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে।

একজন সৈনিক ডেসপ্যাঁচ-রাইডার হাসপাতাসে ঢুকে বললে–আমাদের তাঁবু ওঠাতে হবে এখান থেকে–শত্রু খুব নিকটে এসে পড়েছে। রেললাইনের ওপর ওদের লক্ষ কিনা? রেললাইনটি দখল করবে। আমাদের সৈন্য প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে কিন্তু আজ সারাদিনে জাপানিরা প্রায় একমাইল এগিয়েছে। দেখবে এসো।

তারপরে সৈনিকটি একটা ফিল্ড গ্লাস বার করে বিমলের হাতে দিয়ে বললে–পূর্ব দিকে ওই যে গাঁ-খানা দেখা যাচ্ছে ওদিকে চেয়ে দেখো–বিমল একখানা গ্রাম বেশ স্পষ্ট দেখছিল, কিন্তু তার অতিরিক্ত কিছু না। সৈনিকটি বললে–ওই গ্রামখানির পেছনেই শত্রুর লাইন। গ্রামখানা দখল করতে ওরা আজ ক-দিন চেষ্টা করছে–ওখানেই আমরা বাধা দিচ্ছিলাম। আজ গ্রামের অর্ধেকটা দখল করেছে। সুতরাং, বোধ হয় কাল কী পরশু রেললাইনে এসে পৌঁছোবে।

গ্রামে লোকজন আছে?

পাগল! কবে পালিয়েছে। পশ্চিম দিকে একটা নদী আছে–তার ওপারে পলাতক গৃহহারাদের একটা বস্তি বসে গেছে। আট-দশখানা গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে ওখানে।

খাবার দিচ্ছে কে?

কে দেবে? অনাহারে অনেকে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দুর্দশা দেখলে বুঝবে বর্তমান কালের যুদ্ধ কী নিষ্ঠুর ব্যাপার।

বিমল কথায় কথায় জানতে পারলে, ডেসপ্যাঁচ রাইডার সৈনিকটি শিক্ষিত ভদ্রসন্তান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট–পূর্বে স্কুল মাস্টারি করত, যুদ্ধ বাধবার পর সৈন্যদলে যোগ দিয়েছে।

বিমল বললে–তুমি আমাকে ওই গ্রামে নিয়ে চলো না।

এমনিই তো যেতে হবে। বোধ হয় ওখানেই হাসপাতাল উঠে যাবে–কারণ শত্রুর লাইন থেকে জায়গাটা দূরে।

এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলতে বারণ করেছে কে? কেউ না। সে তো সর্বত্রই ফেলছে। তবে একটি পাইনবনের তলায় এ বস্তি–জাপানি প্লেন হঠাৎ সন্ধান পাবে না। ভয়ে ওরা রান্না করে না।–পাছে ধোঁয়া দেখে বোমারু প্লেন সন্ধান পায়।

সৈনিকটি চলে গেলে বিমল এ্যালিসকে ডেকে কথাটি বলতে যাচ্ছে, এমন সময় একখানা ট্রেনের শব্দ শোনা গেল দূরে।

এ্যালিস তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে এসে বললে–ট্রেন আসছে, না এরোপ্লেন? বিমল বললে–ট্রেনই। বোধ হয় আরও সৈন্য আসছে। চলো দেখি গিয়ে। অনেকে রেললাইনের ধারে জড়ো হল। এখানে স্টেশন নেই। একজন লোক নিশান হাতে অপেক্ষা করছিল–নিশান দেখিয়ে ট্রেন দাঁড় করাবে। ট্রেন এসে পড়ল। সারি সারি খোলা মালগাড়িতে সৈন্য বোঝাই– অন্য সাধারণ যাত্রীও আছে। কতকগুলি ছাদ-আঁটা মাল-গাড়ি পেছনের দিকে–তাতে সৈন্যদের রসদ বোঝাই।

গাড়ি থেকে দলে দলে সৈন্য নামতে লাগল। জাপানি সৈন্যদের হাত থেকে গ্রাম রক্ষা করবার জন্যে এরা আসছে ক্যান্টন থেকে। রসদ বোঝাই মালগাড়িগুলি থেকে রসদ নামানোর ব্যবস্থা করা হতে লাগল–কারণ বেশিক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলে এখুনি কোনদিক থেকে জাপানি বিমান আকাশপথে দেখা দেবে হয়তো। হঠাৎ এ্যালিস উত্তেজিত সুরে বললে–বিমল, বিমল–ও কে? প্রোফেসর লি না?

তারপরেই সে হাসিমুখে সামনের দিকে ভিড়ের মধ্যে ছুটে গেল—ড্যাডি–ড্যাডি—

সত্যিই তো–হ্যাঁস্যমুখ বৃদ্ধ একটি বড়ো ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে ভিড় ঠেলে বাইরে আসতে চেষ্টা করছেন।

বিমল এগিয়ে গিয়ে বললে–নমস্কার প্রোফেসর লি–ব্যাগটা আমার হাতে দিন। আপনি কোথা থেকে?

এ্যালিস ততক্ষণ গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। বৃদ্ধ তার কাঁধে সস্নেহে হাত রেখে বিমলের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন–তোমরা এখানে আছ? বেশ বেশ। আমি এসেছি পলাতক গ্রামবাসীদের যে বস্তি আছে নদীর ওপারে–সেখানে কয়েক পিপে আপেল বিলি করতে। আমেরিকান জুনিয়র রেডক্রস দু-শো পিপে ভালো ক্যালিফোর্নিয়ার আপেল পাঠিয়েছে দুঃস্থ বালক-বালিকাদের খাওয়ানোর জন্যে। আমার ঠিকানাতেই পাঠিয়েছিল। আর সব বিলি করে দিয়েছি অন্য অন্য স্থানে–দশ পিপে মজুত আছে এখনও। তা তোমরা আছ ভালোই হয়েছে–তোমরা সাহায্য করো এখন।

এ্যালিস তো বেজায় খুশি। বললে–ড্যাডি, খুব ভালো কথা। তা বাদে আরও অনেক কাজ হবে যখন তুমি এসে পড়েছ। চলো, আপেলের পিপে সব নামিয়ে নিই।

এমন সময় মিনি ভিড়ের মধ্যে কোথা থেকে ছুটে এসে ব্যস্তভাবে বললে–শিগগির এসো বিমল, শিগগির এসো এ্যালিস–সুরেশ্বর নামছে ওই দেখো ট্রেন থেকে

সুরেশ্বর সত্যিই নামছে বটে–তার সঙ্গে দু-জন চীনা ডাক্তার, এদেরও বিমল চেনে– সাংহাই চীনা রেডক্রস হাসপাতালে এরা ছিল।

বিমল বললে–প্রোফেসর লি–একটু আমায় ক্ষমা করুন, পাঁচমিনিটের জন্যে আসছি।

সুরেশ্বর তো ওদের দেখে অবাক। বললে– তোমরা এখানে! মিনি আর এ্যালিসই বা এখানে কী করে এল! সাংহাইতে বেজায় গুজব এদের চীনা গুন্ডারা গুম করেছে–আর বিমল তুমি জাপানিদের হাতে বন্দি। মিনি কেমন আছে?

বিমল বললে–সেসব কথা হবে এখন। চলো এখন সবাই মিলে তাঁবুতে গিয়ে বসা যাক। অনেক কথা আছে। প্রোফেসর লি-কে ডেকে আনি–উনিও আমাদের সঙ্গে আসুন। তোমরা এগিয়ে চলো ততক্ষণ। আমি ওঁর আপেলের পিপেগুলি নামাবার কী ব্যবস্থা হল দেখে আসি।

কিছুক্ষণ পরে দুঃস্থ চীনা নর-নারীদের তাঁবুতে সুরেশ্বর, বিমল, এ্যালিস ও মিনি আপেল বিলির কাজে প্রফেসর লিকে সাহায্য করছিল। এ জায়গা ঠিক তাঁবু নয়, একটি পাইন বন, তার মাঝে মাঝে পুরোনো ক্যাম্বিস, চট, মাদুর, ভাঙা টিন প্রভৃতি জোড়াতালি দিয়ে আশ্রয় বানিয়ে তারই মধ্যে হতভাগ্য গৃহহারার দল মাথা গুঁজে আছে। ওদের দুর্দশা দেখে বিমলের কঠিন মনেও দুঃখ ও সহানুভূতির উদ্রেক হল। ছোটো ছোটো উলঙ্গ, ক্ষুধার্ত, কাদামাটি মাখা শিশুদের ব্যগ্র প্রসারিত হাতে আপেল বিলি করবার সময় এ্যালিসের চোখ দিয়ে জল পড়তে দেখলে বিমল। নাঃ–বড়ো ছেলেমানুষ এই এ্যালিস! … এ্যালিসের প্রতি একটা কেমন অকারণ স্নেহে ও মমতায় বিমলের মন গলে যায়। কী সুন্দর মেয়ে এ্যালিস আর কী ছেলেমানুষ!

হঠাৎ একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল। আপেল বিলি করতে করতে প্রফেসর লি এক সময় একটা আপেলের পিপের মধ্যে ঘাড় নীচু করে দেখে বললেন–চারটে আপেল আর বাকি আছে। আমি ক্যালিফোর্নিয়ার আপেল কখনো খাইনি–একটি আমি খাব।

বলেই সদানন্দ বৃদ্ধ বালকের মতো আনন্দে একটি আপেল তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিলেন। বিমল অবাক, সে যেন একটি স্বর্গীয় দৃশ্য দেখলে। শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে তার মাথা লুটিয়ে পড়তে চাইল বৃদ্ধের পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে একটি অদ্ভুত ধরনের ভালোবাসা এসে তার মনে উপস্থিত হল, বৃদ্ধের প্রতি। এঁকে ছেড়ে আর সে থাকতে পারবে না–অসম্ভব! যেমন সে আর এ্যালিসকে ছেড়ে কখনো থাকতে পারবে না। চীনদেশে তার আসা সার্থক হয়েছে এই দু-জনের সাক্ষাৎ পেয়ে। এই যুদ্ধের বর্বরতা, হত্যা, বোমাবর্ষণ, রক্তপাত, অনাহার, দারিদ্র্য, এই চারিদিকের বীভৎস নরবলির হৃদয়হীন অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রফেসর লি আর এ্যালিস (অবশ্য মিনিও আছে)–এদের আবির্ভাব দেবতার আবির্ভাবের মতোই অপ্রত্যাশিত ও সুন্দর।

এ্যালিস ও মিনি ছুটে গেল ছেলেমানুষের মতো।

–ড্যাডি, ড্যাডি, আমাদের একটা আপেল দেবে না? …

বৃদ্ধ হাসিমুখে বললেন–মেয়েদের না দিয়ে কী বুড়োবাবা খায়? দু-টি রেখে দিয়েছি তোমাদের দুজনের জন্যে–আর একটি বাকি আছে, কে নেবে?

বিমল বললে–সুরেশ্বর নাও।

সুরেশ্বর বললে–বিমল, তুমি নাও, আমি আপেল খাই না।

এ্যালিস বললে–খাও, সুরেশ্বর, আমি আমার আধখানা বিমলকে দিচ্ছি।

মিনি বললে–তা নয়, বিমল খাও, আমি আধখানা সুরেশ্বরকে দেব।

প্রোফেসর লি মীমাংসা করে দিলেন–একটি আপেল ভাগাভাগি করে খাবে বিমল ও সুরেশ্বর। মেয়েরা আস্ত আপেল খাবে। তাঁর কথার ওপর আর কেউ কথা বলতে সাহস করলে না।

সেই সৈনিক ডেসপ্যাঁচ-রাইডারটি এসে খবর দিলে, হাসপাতাল তাঁবু এখানেই উঠে আসছে–পাইনবনের মাঝখানে। সামনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কম্যাণ্ডান্ট খবর পাঠিয়েছেন। ডেসপ্যাঁচ-রাইডার আরও এক করুণ সংবাদ দিলে–আজ সকালে জাপানিদের হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড চার্জে নারীবাহিনীর সতেরোটি তরুণী একদম মারা পড়েছে। একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে তাদের দেহ–হাত, পা, মুন্ড, আঙুল–ছড়িয়ে ছত্রাকার হয়ে গিয়েছে।

মিনি শিউরে উঠে বললেও হাউ সিম্পলি ড্রেডফুল!

কেন জানি না এই দুঃসংবাদে বিমলের মন এ্যালিসের প্রতি মমতায় ভরে উঠল। এ্যালিসের মতই উদার, নিস্বার্থ সতেরোটি তরুণী–কত গৃহ অন্ধকার করে, কত বাপ-মায়ের হৃদয় শূন্য করে চলে গেল!–মানুষ মানুষের ওপর কেন এমন নিষ্ঠুর হয়?

হঠাৎ পলাতকদের মধ্যে একটা ভয়ার্ত শোরগোল উঠল। সবাই ছুটছে, গাছের তলায় গুঁড়ি মেরে বসেছে, ঘাসের মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছে–একটা হুড়োহুড়ি, এ ওকে ঠেলছে, দু-একজন ঊর্ধ্বশ্বাসে খোলা মাঠের দিকে ছুটছে।

ডেসপ্যাঁচ রাইডার সৈনিক যুবকটি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে–নীচু হয়ে বসে পড়ন–সবাই শুয়ে পড়ুন,–জাপানি বম্বার!

আকাশে এরোপ্লেনের আওয়াজ বেশই স্পষ্ট হয়ে উঠল…বিমল চোখ তুলে দেখলে পাইনবনের মাথার ওপর আকাশে দু-খানা কাওয়াসাকি বম্বার…নিজের অজ্ঞাতসারে সে তখুনি এ্যালিসের হাত ধরে তাকে একটি গাছের তলায় নিয়ে দাঁড় করালে।

প্রোফেসর লি–প্রোফেসর লি–এদিকে আসুন–

ভীষণ একটা আওয়াজ … বিদ্যুতের মতো আলোর চমক … ধোঁয়া, মাটি … পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল ভূমিকম্পের মতো … সবারই কানে তালা … চোখে অন্ধকার … জাপানি বম্বার বোমা ফেলছে।

সঙ্গেসঙ্গে চারিদিকে আর্তনাদ কান্না … গোঁঙানি … নারীকন্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার।

আবার একটি … বিমলের মনে হল পৃথিবীর প্রলয় সমাগত। পৃথিবী দুলছে, আকাশ দুলছে … কেউ বাঁচবে না, মিনি, এ্যালিস, সে, সুরেশ্বর, প্রোফেসর লি, সবাই এই প্রলয়ের অনলে ধ্বংস হবে।

তারপর কটা বোমা পড়ল এরোপ্লেন থেকে–তা আর শূনে নেওয়া সম্ভব হল না বিমলের পক্ষে। বিস্ফোরণের আওয়াজ ও মনুষ্য-কণ্ঠের আর্তনাদের একটি একটানা শব্দপ্রবাহ তার মস্তিষ্কের মধ্যে বয়ে চলেছে–একটি থেকে আর একটিকে পৃথক করে নেওয়া শক্ত।

তারপর হঠাৎ যখন সব থেমে গেল, এরোপ্লেন চলে গিয়েছে–যখন বিমল আবার সহজ বুদ্ধি ফিরে পেল–তখন দেখলে এ্যালিসের একখানা হাত শক্ত করে তার নিজের মুঠোর মধ্যে ধরা–মিনি, সুরেশ্বর, প্রোফেসর লি সকলে মাটিতে শুয়ে–হয়তো সবাই মারা গিয়েছে সে-ই একমাত্র রয়েছে বেঁচে।

প্রথমে মাটি থেকে ঝেড়ে উঠল এ্যালিস। তারপর প্রোফেসর লি, তারপর সুরেশ্বর।–মিনি মূৰ্ছা গিয়েছে–অনেক কষ্টে তার চৈতন্য সম্পাদনা করা হল। হঠাৎ এ্যালিস চমকে উঠে আঙুল দিয়ে কী দেখিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

সেই তরুণ ডেসপ্যাঁচ-রাইডারের দেহ অস্বাভাবিকভাবে শায়িত কিছুদুরে। রক্তে আশপাশের মাটি ভেসে গিয়েছে–একখানা হাত উড়ে গিয়েছে–বীভৎস দৃশ্য। সেদিকে চাওয়া যায় না।

কিন্তু দেখা গেল পলাতক গৃহহীন ব্যক্তিদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি ছেলে-মেয়ে এবং একটি বৃদ্ধ জখম হয়েছে মাত্র। পাইনবনের পাতার আড়ালে ছিল এরা–ওপর থেকে বোমার লক্ষ্য ঠিকমতো হয়নি।

প্রোফেসর লি-র সঙ্গে এ্যালিস ও মিনি আহতদের সাহায্যে অগ্রসর হল।

সন্ধ্যার পরে একখানা ট্রেন এসে দাঁড়াল। নাইনথ রুট আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন ট্রেন থেকে নামল–এরা এসেছে রেলপথ রক্ষা করতে এবং দু-টি সাঁকো পাহারা দিতে।

বিমল সুরেশ্বরকে বললে–আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে বলতে গেলে একরকম বাস করছি, অথচ লড়াই যে কোনদিকে হচ্ছে–কীভাবে হচ্ছে–তা কিছুই জানিনে, চোখেও দেখতে পাচ্ছি নে।

রাত্রে কমাণ্ডান্টের সারকুলার বেরোলো– রেললাইনের প্রান্ত পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে–আজ শেষ রাত্রে জাপানিরা আক্রমণ করবে–সকলে তৈরি থাকো, যারা সৈন্য নয় যুদ্ধ করছে না–এমন শ্রেণির লোক দূরে চলে যাও।

রাত প্রায় বারোটা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।

সুরেশ্বর বর্ষাতি কোট গায়ে বাইরে থেকে হাসপাতাল তাঁবুতে ঢুকে বললে–আমাদের আয়ু মনে হচ্ছে ফুরিয়ে এসেছে। সারকুলার দেখেছ?

বিমল বললে–গতিক সেইরকমই বটে। জাপানিরা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড চার্জ করলে কেউ বাঁচবে না।

আমি ভাবছি মেয়েদের কথা—

প্রেফেসর লি-কে কথাটা বলা ভালো। উনি কি বলেন দেখি।

প্রোফেসর লি-কে ডাকতে গিয়ে একটি সুন্দর দৃশ্য বিমলের চোখে পড়ল। হাসপাতাল তাঁবুর পাশে একটি ছোট্ট চটে-ছাওয়া তাঁবুতে এ্যালিস ও মিনি কী রান্না করছে আগুনের ওপর—বৃদ্ধ লি ওদের কাছে উনুন ঘেঁষে বসে বুড়ো ঠাকুরদাদার মতো গল্প করছেন। এ্যালিস বললে–তোমার বন্ধু কোথায় বিমল–খেতে হবে না তোমাদের আজ? ড্যাডি আমাদের এখানে খাবেন। উঃ–কী সত্যি কথা। গোলমালে তার মনেই নেই যে সন্ধ্যা থেকে কারো পেটে কিছু যায়নি! বিমল সুরেশ্বরকে ডেকে নিয়ে এল। খাবার বিশেষ কিছু নেই। শুধু ভাত ও শুকনো সিঙ্গাপুরি কাঁচকলা, চর্বিতে ভাজা।

একজন ডেসপ্যাঁচ-রাইডার ব্যস্তভাবে তাঁবুর বাইরে এসে বিমলকে ডাক দিলে। তার হাতে একখানা ছোট্ট শিল-করা খাম।

আপনি হাসপাতালের ডাক্তার?

আপনার চিঠি। ট্রেন এখুনি একখানা আসছে। টেলিগ্রামে অর্ডার দিয়ে আনানো হচ্ছে। আপনি আপনার নার্স ও রোগী নিয়ে হ্যাং-কাউতে এই ট্রেনে যাবেন আপনাকে একথা বলার আদেশ আছে আমার ওপর। গুড নাইট।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। কেন হঠাৎ এ আদেশ জানেন?

আমরা এই রেলের জন্যে আর লোক ক্ষয় করব না। জেনারেল চু-টে-র আদেশ এসেছে হেডকোয়ার্টার্স থেকে। পরবর্তী যুদ্ধ হবে এর দশমাইল দূরে। আর এখুনি আপনারা তৈরি হোন। আজ শেষ রাত্রে জাপানিরা আড্ডা দখল করবে। তার আগে হয়তো গোলা ছুঁড়তে পারে।

প্রোফেসর লি কাছেই দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলেন। তিনি বললেন–আমি এই ট্রেনে গরিব গ্রামবাসীদের উঠিয়ে নিয়ে যাব। নইলে জাপানি বোমা থেকে যাও-বা বেঁচেছে, গোলা আর হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড খেলে তাও যাবে। আপনি দয়া করে আমার এই অনুরোধ কমাণ্ডান্টকে জানিয়ে আমায় খবর দিয়ে যাবেন?

ডেসপ্যাঁচ-রাইডার অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হল।

আরও দেড়ঘণ্টা পরে এল ট্রেন। প্রায় খালি। তবে পেছনের গাড়িগুলি পুঁটকি মাছ বোঝাই –বিষম দুর্গন্ধ। বিমল হাসপাতালের সব লোকজন নিয়ে ট্রেনে উঠল–মিনি, এ্যালিস, দুটি চীনা নার্স, সাত-আটটি রোগী। প্রোফেসর লি ইতিমধ্যে তাঁর দলবল নিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু ট্রেনের সামরিক গার্ড কমাণ্ডান্টের বিনা আদেশে তাঁর দলবল গাড়িতে ওঠাতে চাইলে না।

এ্যালিস বললে–বিমল, ওদের বলো তাহলে আমরাও যাব না। ওঁকে ফেলে আমরা যাব না। ট্রেনের সামরিক গার্ড বললে–আমার কোনো হাত নেই। আপনারা না যান, পনেরো মিনিট পরে আমি গাড়ি ছেড়ে দেব।

এ্যালিস ও মিনি নামল। চীনা নার্স দু-টিও এদের দেখাদেখি নাবল। ট্রেনের গার্ড বললে– রোগীরা কাদের চার্জে যাবে? একজন ডাক্তার চাই। আমি রিপোর্ট করলে আপনাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আপনারা হাসপাতালের কর্মচারী, সামরিক আদেশ অনুসারে কাজ করতে বাধ্য।

বিমল বললে–সে এঁরা নন–এই মেয়ে দু-টি। এঁরা আমেরিকান রেডক্রস সোসাইটির। চীনা পার্লামেন্টের হাত নেই এদের ওপর।

এদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হচ্ছে, এমন সময়ে ডেসপ্যাঁচ-রাইডারটিকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেখা গেল এবং কিছুক্ষণ পরে প্রোফেসর লি তাঁর দলবল নিয়ে হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠে পড়লেন। ট্রেনও ছেড়ে দিল।

.

দিন পনেরো পরে।

হ্যাং-কাউ শহরের উপকণ্ঠে পবিত্র ফা-চীন মন্দির। মিং রাজবংশের রাজকুমারী ফা-চিন তাঁর প্রণয়ীর স্মৃতির মান রাখবার জন্যে চিরকুমারী ছিলেন–এবং একটি ক্ষুদ্র বৌদ্ধ মঠে দেহত্যাগ করেন একষট্টি বছর বয়সে। তাঁর দেহের পুণ্য ভস্মরাশির ওপরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের চারিধারে অতি মনোরম উদ্যান ও ফোয়ারা।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে এ্যালিস ও বিমল মার্বেলের চৌবাচ্চায় মন্দিরের অতি বিখ্যাত লাল মাছ দেখছিল। অনেক দূর থেকে লোকে এই লাল মাছ দেখতে আসে–আর আসে নব-বিবাহিত দম্পতি–তাদের বিবাহিত জীবনের কল্যাণ কামনায়।

একটি গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে এ্যালিস ক্লান্তভাবে বসল।

বিমল বললে–মিনিরা কোথায়?

মন্দিরের মধ্যে ঢুকেছে। এখানে বোসো। কেমন সুন্দর লাল মাছ খেলা করছে দেখো। আমি কী ভাবছি বিমল জান, এমন পবিত্র মন্দির, এমন সুন্দর শান্তি, এই প্রাচীন পাইন গাছের সারি–সব জাপানি বোমায় একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। যুদ্ধের এই পরিণাম, প্রাচীন দিনের শান্তি ও সৌন্দর্যকে চুরমার করে বর্বরতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

এ্যালিস, আর কতদিন চীনে থাকবে?

যতদিন যুদ্ধ শেষ না হয়, যতদিন একজন আহত চীন সৈনিকও হাসপাতালে পড়ে থাকে। ততদিন ড্যাডি লি তাঁর সাহায্যকারিণী মেয়ের দরকার অনুভব করেন।

এ্যালিস বিমলের দিকে চেয়ে বললে–কিন্তু বিমল ততদিন তোমাকেও তো থাকতে হবে –তোমাকে যেতে দেব না।

পাইন গাছের ওদিকে নিকটেই প্রোফেসর লি-র প্রাণখোলা হাসি ও কথাবার্তার আওয়াজ শোনা গেল।

এ্যালিস বললে–ওরা এদিকেই আসছে।

এ্যালিসের ভুল হয়েছিল, মিনি আর সুরেশ্বর এল না–এলেন প্রোফেসর লি। এই বয়সেও তাঁর চোখের অমন অদ্ভুত দীপ্তি যদি না থাকত, তবে তাঁকে জনৈক বৃদ্ধ চীনা রিকশাওয়ালা বলে ভুল করা অসম্ভব হয় না–এমনি সাদাসিধে তাঁর পরিচ্ছদ।

প্রোফেসর লি বললেন–হ্যাং-কাউ শহরে এসে আমার গরিব গ্রামবাসীরা আশ্রয় পেয়ে বেঁচেছে। কিন্তু গভর্নমেন্টের তৈরি মাটির নীচের ঘরে লুকিয়ে থাকলে আমার চলবে না এ্যালিস, আমি কালই এখান থেকে গ্রামে চলে যাব।

এ্যালিস বললে, কেন?

দক্ষিণ চীনে সর্বত্র ভীষণ দুর্ভিক্ষ। লোক না খেয়ে মরছে, তার সাথে বোমা আছে। মড়ক লেগেছে। আমার এখানে বসে থাকলে চলে?

আমি আবেদন পাঠিয়েছি আমেরিকায় মার্কিন রেডক্রস সোসাইটির মধ্যস্থতায়। তারাই আপেল পাঠিয়েছিল এদের খাওয়াতে। যতদূর জানা গিয়েছে, ওরা কিছু অর্থ মঞ্জুর করেছে! টাকাটা শিগগির আসবে।

এ্যালিস বললে–ড্যাডি, আমার একটি প্রস্তাব শুনবেন? আমার মাসিমা নিঃসন্তান বিধবা, অনেক টাকার মালিক। আমায় তিনি উইল করে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন, টাকাটা আমি চাইলেই পাব। সেই টাকা আপনাকে দিচ্ছি–হ্যাং-কাউ শহরে দুঃস্থ বালক-বালিকাদের জন্যে একটি হোম খুলুন। আপনি লেখালেখি করলে গভর্নমেন্টও কিছু সাহায্য করবে। আমি আর মিনি ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনো করব।

প্রোফেসর লি বললেন–তোমার ধন্যবাদ, এ্যালিস। অতি দয়াবতী মেয়ে তুমি, কিন্তু তোমার টাকা নেব না। তা ছাড়া, এমন কোনো বড় আশ্রয়স্থল আমরা গড়তে পারব না, যাতে সকল দুঃস্থ বালক-বালিকাদের আমরা জায়গা দিতে পারি। সারা দক্ষিণ-চীন বিপন্ন, কত ছেলে-মেয়েকে আমরা পুষতে পারি? মাঝে পড়ে তোমার টাকাগুলি যাবে।

বিমল একটি জিনিস লক্ষ করেছে, এ্যালিসের ওপর প্রোফেসর লি-র স্নেহ নিজের সন্তানের ওপর পিতার স্নেহের মতোই। উনি চান না এ্যালিসের টাকাগুলি খরচ করিয়ে দিতে। নইলে উনি হোম গঠনের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দেখালেন, সেটি এমন কিছু জোরালো নয়। সব দুঃস্থ লোকদের আশ্রয় দিতে পারছি নে বলে তাদের মধ্যে কাউকেও আশ্রয় দেব না?

এমন সময় সুরেশ্বর ও মিনি এসে বললে–এসো এ্যালিস, এসো বিমল, একটি জিনিস দেখে যাও।

ওরা বাগানের বেঞ্চি থেকে উঠে মন্দিরের উঁচু চত্বরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখলে ওদের আগে আগে দু-টি চীনা তরুণ-তরুণী মন্দিরে উঠছে। তাদের হাতে ছোটো ছোটো ধ্বজা, মোমবাতি ও ফুল।

মিনি বললে–ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ছেলেটি বেশ ইংরেজি জানে। ওর ডাক পড়েছে যুদ্ধে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে ওই মেয়েটিকে কাল বিয়ে করেছে; অনেকদিন থেকে মেয়েটি ওর বাগদত্তা। ফা-চীন মন্দিরে আশীর্বাদ নিতে এসেছে–

বিমল ও এ্যালিস নিজেদের অজ্ঞাতসারে শিউরে উঠল। বর্তমান যুগের ভীষণ মারণাস্ত্রের সামনে যুদ্ধ। আয়ু ফুরিয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। একটি বোমার অপেক্ষা মাত্র। তরুণীর বয়স অল্প–ষোলো-সতেরো।

চীন দেশে সম্ভ্রান্ত-সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত নেই।

তরুণ-তরুণীর মুখ প্রফুল্ল ও হাস্যময়। কোনোদিকে ওদের লক্ষ নেই। মন্দিরের অন্ধকার গর্ভগৃহে মোমবাতি জ্বলছে। ওরা খোদাই-করা কাঠের চৌকাঠ পার হয়ে রাজকুমারী ফা-চীন এর কৃত্রিম সমাধির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলে, ফুল ছড়িয়ে দিলে, দু-জনে পাশাপাশি বসে রইল খানিকক্ষণ চুপ করে। তারপর ওরা উঠল–ঘর থেকে বাইরে এসে মন্দিরের চত্বরে দাঁড়াল। দু-জনে দু-জনের হাত ধরে আছে–দু-জনের হাসি-হাসি মুখ।

এ্যালিস বললে–মিনি, ওঁদের এখানে দাঁড়াতে বলো না। আমাদের অনুরোধ—

মিনি বললে–আপনারা একটু দয়া করে যদি দাঁড়ান–মন্দিরের চত্বরে—

যুবক ওদের দিকে হাসিমুখে চাইল, তারপর মেয়েটিকে চীনাভাষায় কী বললে। তরুণীও অল্প হাসিমুখে ওদের দিকে একবার চেয়ে দেখে চোখ নীচু করলে।

যুবক হাসিমুখে বললে–ফোটো নেবে বুঝি? আলো নেই মোটে–ফোটো উঠবে?

এ্যালিস এই সময় মন্দিরের বাইরের ফুলের দোকান থেকে একরাশ ফুল কিনে নিয়ে এল। বৃদ্ধ লিকেও সে ডেকে এনেছে বাগান থেকে। হাসিমুখে বললে–ড্যাডি, এই ফুল নিয়ে ওদের আশীর্বাদ করুন– তোমরাও সবাই ফুল নাও।

যুবকের সঙ্গে প্রোফেসর লি চীনা ভাষায় কী কথাবার্তা বললেন, তারপর সকলে অর্ধচক্রাকারে ঘিরে দাঁড়াল নবদম্পতিকে।

প্রোফেসর লি চিনা ভাষায় গম্ভীর স্বরে কয়েকটি কথা উচ্চারণ করে ওদের ওপর ফুল ছড়িয়ে দিলেন–তারপর সকলে ফুল ছড়ালে ওদের ওপর। এ্যালিস ও মিনির কী হাসি ফুল ছড়াতে ছড়াতে।

তরুণ-তরুণী অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বিমল একবার চারিদিকে চেয়ে দেখল–সন্ধ্যা নেমেছে। কোথাও আর রোদ নেই–এই পবিত্র, প্রাচীন ফা-চীন মন্দির, পাইন বন, লাল মাছের চৌবাচ্চা, শান্ত গভীর সন্ধ্যা–এই কলহাস্যমুখরা বিদেশিনি মেয়ে দু-টি,–নবদম্পতি। দেখে মনেও হয় না এই পবিত্র স্থানের তিন মাইলের মধ্যে মানুষ মানুষকে অকারণে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে বিষবাষ্প দিয়ে, বোমা দিয়ে, কলের কামান দিয়ে। যুদ্ধ বর্বরের ব্যবসায়। অথচ এই হাসি, এই আনন্দ, তরুণ দম্পতির কত আশা, উৎসাহ।

এ্যালিস ঠিকই বলেছে। সব যাবে–কাল সকালেই হয়তো যাবে, জাপানি বোমায়। পবিত্র ফা-চীন মন্দির যাবে, পাইন গাছের সারি যাবে, লাল মাছ যাবে, এই তরুণ দম্পতি যাবে, সে যাবে, মিনি, এ্যালিস, সুরেশ্বর, বৃদ্ধ লি–সব যাবে। যুদ্ধ বর্বরের ব্যাবসায়।

ফুল ছড়ানো শেষ হয়েছে। মন্দিরের বাঁকানো ঢালু ছাদে পোষা পায়রার দল উড়ে এসে বসেছে। পাথরের সিঁড়ির ওপরের ধাপটা ফুলে ভরতি। নবদম্পতি তখন হাসছে–এ একটি ভারি অপ্রত্যাশিত আমোদের ব্যাপার হয়েছে তাদের কাছে। ওদের হাসি ও আনন্দ যেন দানবীয় শক্তির ওপর,–মৃত্যুর ওপর,–মানুষের জয়লাভ। মহাচীনের নবজন্ম হয়েছে এই তরুণ-তরুণীতে। স্বর্গ থেকে ফা-চীন-এর পবিত্র অমর আত্মা ওদের আশীর্বাদ করুন।

এ্যালিস এসে বিমলের হাত ধরল।

চলো যাই বিমল। হাসপাতালে ডিউটি রয়েছে–তোমার আমার এক্ষুনি–

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress