Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বটুকবুড়োর চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay

বটুকবুড়োর চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay

কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল

“কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল।”

“কী কথা?”

“বলছিলাম কী, এই লম্বা লোকেরা মানুষ কেমন হয়?”

“এ আবার কেমন ধারা কথা, লম্বা লোকেরা আবার আলাদা করে ভাল বা খারাপ হতে যাবে কেন?”

“একটা ধাঁধায় পড়েই জানতে চাইছি আর কী!”

“তা লম্বা লোক নিয়ে তোর সমস্যা হচ্ছে কেন? এই তো আমিই তো একজন লম্বা লোক। আমার তিন ছেলে লম্বা, পুরুতমশাই ব্রজ ভটচাজ লম্বা, সাত্যকি বাঁড়ুজ্যে লম্বা, দারোগা পরেশ ঘোষ লম্বা, নব মিত্তির লম্বা, তা আমরা কি খারাপ লোক?”

বটু ওরফে বটকেষ্ট গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আপনারা তার কাছে নস্যি। আপনাদের মাথা তার কোমরের কাছ বরাবর হবে বড়জোর। তার বেশি নয়।”

“বটে! তা এ তল্লাটে তেমন লম্বা কে আছে? হরিপুরে বৃন্দাবন পাল অবশ্য বেজায় লম্বা, আর নবগঞ্জের বিষ্ণু পাঠকও বটে বিশাল ঢ্যাঙা…!”

“আজ্ঞে, তাঁরাও তার বুক পর্যন্ত হবেন কি না সন্দেহ।”

“অ, কিন্তু লম্বা লোক তুই পেলি কোথায়? আর তাকে নিয়ে তোর সমস্যাই বা হচ্ছে কেন?”

বটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে কাছেপিঠেই আছে। বাড়ির পিছনের ফটকে একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল কিনা!”

“দাঁড়িয়ে ছিল মানে? ফটকে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? হয় ভিতরে আসবে, না হয় বিদেয় হবে। লোকটা কে, কী চায় জিজ্ঞেস করেছিস?”

“আজ্ঞে, ঠিক সাহস হয়নি।”

“কেন, লোকটা কিষণ্ডাগুন্ডা গোছের?”

“বলা মুশকিল।”

“পোশাক আশাক কেমন?”

“আজ্ঞে, পোশাক তেমন খারাপ কিছুও নয়। পরনে বোধহয় একটা পাতলুনের মতো দেখলুম, গায়ে একটা জামাও মনে হয় ছিল, গলায় একটা মাফলার জড়ানো ছিল কি না ঠিক মনে পড়ছে না, গায়ে একটা কোট থাকলেও থাকতে পারে।”

“বুঝলাম। এখন দয়া করে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো লোকটা কী চায়, কোথা থেকে এসেছে, এ বাড়ির আত্মীয়-কুটুম কি না, আর যদি ভিখিরি হয় তো সোজা বলে দিয়ো, কানাখোঁড়া ছাড়া আমরা কাউকে ভিক্ষে দিই না।”

“আজ্ঞে, আমারও সেই সব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু লোকটা এমন ভেকুড়ি কাটল যে, ঠিক সাহস হল না।”

“ভেচকুড়ি! সেটা আবার কী?”

“আজ্ঞে, ভেচকুড়ি খুব ভয়ের জিনিস। বড় বড় চোখ করে মুখটা ভেংচি কেটে এমন একখানা ভাব করা যাতে লোকে ভড়কে যায়।”

“তুই তো ভড়কেই আছিস। পাগল দেখলে ভড়কাস, মাতাল দেখলে ভড়কাস, পুলিশ দেখলে ভড়কাস। তোর হল রজ্জুতে সর্পভ্রম!”

“আজ্ঞে কর্তাবাবু, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে হয়তো। তবু বলি, ভয়ভীতি থাকা কিন্তু ভাল। ধরুন সর্পে রঞ্জুম হওয়াই কি তা হলে ঠিক হত?”

“দ্যাখ, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। তা তুই যদি এতই ভেড়ুয়া যে একটা লোক খানিকটা লম্বা বলে তার কাছেই ঘেঁষতে পারলি না, তখন না হয় নব, হরেন আর কানুকে জুটিয়ে দলবেঁধে গিয়ে লোকটার উপর চড়াও হতিস।”

“আজ্ঞে, নবর কথা আর কবেন না। সে সেই সাতসকালে গিন্নিমার কাছ থেকে বাজারের পয়সা নিয়ে বেরিয়েছে। এখন দেখুন গে, বাজার ফেলে কালীস্যাকরার সঙ্গে দাবা খেলায় মশগুল হয়ে আছে। রোজ সকালে এক পাট্টি দাবা না খেললেই তার নয়।”

“বলিস কী, নব আবার দাবাড়ুও নাকি? তাজ্জব ব্যাপার তো!”

“তবে আর বলছি কী? আর হরেন? তার কথা আর কী বলব কর্তাবাবু। যত কম বলা যায় ততই ভাল। বুড়োকর্তার জন্য রোজ ডাব পাড়তে নারকোল গাছে উঠে কী করে জানেন? নারকোল গাছের সঙ্গে কোমরের গামছাখানা কষে বেঁধে নিয়ে আরামসে ঘুম লাগায়।”

“ওরে বাবা! নারকোল গাছের উপর উঠে ঘুমোয়? কী সব্বোনেশে কথা!”

“গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালে তার নাকের ডাকও শুনতে পাবেন।”

“বটে! একদিন পড়ে মরবে যে!”

“আর কানুর কথা শুনতে চান? না শুনলেই ভাল হত।”

“কেন রে? সে আবার কী করল? দিব্যি তো ভালমানুষের মতো চেহারা, চোখ তুলে কথা কয় না।”

“কর্তাবাবু, আপনার মেলা গুণ আছে বটে, আর সেকথা আমরা বলাবলিও করি। এই যেমন আপনার দয়ার শরীর, আপনার বেজায় বুকের পাটা, সুজনবাবুর ছেলের বিয়েতে আপনি বাহান্নটা রসগোল্লা খেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি মানুষ চেনেন, একথা আপনার বন্ধু কেন, শ্যুরেও বলবে না।”

“এ তো বড় চিন্তায় ফেলে দিলি! কানু করেছেটা কী?”

“গত কদিন ধরে সকালের দিকে অঘোরখুড়ো যে তাঁর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না, সেকথা কি আপনি জানেন? না, জানার কথাও নয়। রোজই সকালে চশমা হারানো নিয়ে খুডোমশাই চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করেন। কিন্তু একটু বেলার দিকে চশমাজোড়া ঠিকই আবার খুড়োমশাইয়ের টেবিলেই পাওয়া যায়। ঠিক কিনা কর্তাবাবু, বলুন?”

“হু। ঠিকই বলছিস বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু চশমার সঙ্গে কানুর কী সম্পর্ক?”

“গভীর সম্পর্ক কর্তাবাবু, গভীর সম্পর্ক। আর শুধু খুড়োমশাইয়ের চশমাজোড়াই তো নয়, ব্ৰজবিহারী ঠাকুরমশাইয়ের নামাবলিখানা আর বিজয়বাবুর ল্যাবরেটরির আতশ কাঁচখানাও সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যায়, একটু বেলার দিকে অবশ্য ফিরেও আসে।”

“দ্যাখ বটু, তোর কথা বুঝবার চেয়ে চিনেম্যানের কথা বোঝা বরং সহজ।”

“কথায় একটু মারপ্যাঁচ না থাকলে ঠিক জুত হয় না কিনা। তবে আসল কথাটা হল, কানু সকালে এ বাড়ির চারটে দুধেল গাইকে নিয়ে গোচারণের মাঠে চরাতে যায়, জানেন তো?”

“তা জানব না কেন? কানু তো আমাদেরই রাখাল।”

“আজ্ঞে, তাই বলছি। মাঠে গোরুগুলোকে খোঁটায় বেঁধে দেওয়ার পর কিন্তু সে আর রাখাল থাকে না। গায়ে নামাবলি জড়িয়ে চোখে চশমা এঁটে হাতে আতশ কাঁচ নিয়ে সে তখন কানাইপণ্ডিত জ্যোতিষার্ণব।”

“বলিস কী?”

“আজ্ঞে, আপনি যদি এখনই বটতলায় গিয়ে হাজির হতে পারেন, তা হলে কানাইপণ্ডিতের চেহারা দেখে তাকে কানু বলে চিনতেও পারবেন না। টিকিতে কল্কে ফুল বেঁধে কম্বলের আসনে বসে লোকের কুষ্টি আর হস্তরেখা বিচার করে গড়গড় করে নিদান আউড়ে যাচ্ছে। তার সামনে অন্তত বিশ-পঁচিশজন লোকের লাইন।”

“বাপ রে! আমাদের বাড়িতে একটা আস্ত জ্যোতিষী ঘাপটি মেরে বসে আছে, কখনও টেরটিও পেলাম না তো! ভাল কথা, আমার বাহান্ন বছর বয়সে নাকি একটা ফাঁড়া আছে। কানু ফিরলে একটু বলিস তো, আমার হাতটা যেন একটু দেখে দেয়।”

“যে আজ্ঞে। সে না হয় হল, কিন্তু ওই লম্বা লোকটার কী করা যায় তা একটু ভেবে দেখবেন কি কর্তা?”

“ও হ্যাঁ, তাই তো! তোর গল্পের চোটে তো ঢ্যাঙা লোকটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তা নব, হরেন আর কানু নেই বলে কি এ বাড়িতে লোকের অভাব? আমার তিন-তিনটে সোমত্ম ছেলে রয়েছে, তা ছাড়া অঘোরখুড়ো, বিরাজজ্যাঠা, একচন্দ্রদাদা, ব্রজঠাকুর, বিজয়মামা…!”

“আর কবেন না কর্তা। আপনার তিন ছেলের মধ্যে বড়জন নীলকান্তদাদাবাবু এ সময়ে লেখাপড়া নিয়ে গম্ভীর মুখে বইপত্তরে ডুবে থাকেন। মেজদাদাবাবু অয়স্কান্ত হাপুস-হুঁপুস করে ব্যায়াম করে যাচ্ছেন, এ সময়ে কথা কন না। আর ছোটদাদাবাবু কৃষ্ণকান্ত তানপুরা সাপটে গলা সাধছেন। কাউকে ডেকে সাড়া পাওয়ার উপায় নেই। অঘোরখুড়ো এ সময় তাঁর কবিরাজি গাছগাছড়ার খোঁজে বেরিয়ে যান। বিরাজজ্যাঠার কথা তো সবাই জানে। গতবার হালদারদের পুকুরের সেই অতিকায় কাতলা মাছটা জ্যাঠাকে লেজে খেলিয়ে তাঁর ছিপ সমেত পালিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে মাছটাকে ধরার জন্য রোজই ছিপ নিয়ে সাতসকালে হালদারপুকুরে হানা দেন। একচন্দ্ৰদাদা রোজ সকালে নিয়ম করে গঞ্জের মোট তিনশো তেইশজনকে কুশল প্রশ্ন করতে বেরিয়ে যান, এতক্ষণে বোধহয় একশো বাইশজন পর্যন্ত হয়েছে। ফিরতে তাঁর বেলা হবে। ব্রজঠাকুরের পাঁচবাড়ির নিত্যপূজা আছে। আর বিজয়মামা তাঁর জাদুইঘরে বসে নুনের সঙ্গে চুন মেশালে কী হয় তাই হাঁ করে ভাবছেন।”

“নুনের সঙ্গে চুন! তা মেশালে কী হয় বল তো?”

“আজ্ঞে, ওটা কথার কথা। জাদুইঘরে বসে তিনি যে নানা সাইজের কাঁচের পাত্রে কোন বিটকেল জিনিসের সঙ্গে কোন বিঘুঁটে জিনিস মেশান, তা কে জানে বাবা! তবে এমন সব কিম্ভুত

গন্ধ বেরোয় যে, নাকে চাপা দিয়ে পালানোর পথ পাই না।”

“বুঝলাম। তা হলে লম্বা লোকটাকে তাড়ালি কী করে?”

“তাড়ালাম? তাড়ালাম আর কোথায়? সে দিব্যি এখনও পিছনের ফটকের কাছে ঝুপড়ি আমগাছটার তলায় গ্যাট হয়ে বসে আছে।”

“এখনও বসে আছে? আগে বলবি তো! চল তো গিয়ে দেখি।”

“তা হলে বরং বন্দুকটা নিয়ে নিন সঙ্গে। দিনকাল ভাল নয়, বলা তো যায় না।”

“দুর পাগল! এই সকালে তো আর চোর-ডাকাত আসবে না।”

“অন্তত মোটা লাঠিগাছটা হাতে থাকলে ভাল হয়।”

“দুর-দুর। ওসবের দরকার নেই।”

“আপনার কর্তা, বড্ড সাহস।” বীরেন রায় ডাকাবুকো মানুষ, লম্বা-চওড়া চেহারা। ইজিচেয়ার থেকে উঠে বীরদর্পে পিছনের ফটকের দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর পিছনে একটু তফাতে বটু ওরফে বটকৃষ্ণ।

পিছনের ফটকের বাইরে ঝুপসি আমগাছটার তলায় সত্যিই একটা লোক বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। পরনে আধময়লা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা সুতির মোটা জামা, গলায় একটা গামছা জড়ানো, মাথা ন্যাড়া এবং টিকি আছে। পাড়ায় নেড়িকুকুরগুলো অচেনা লোক দেখে একটু দুরে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে খুব ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে।

বীরেনবাবু তাকে দেখেই একটা বাঘা গর্জন ছাড়লেন, “অ্যাই! ওঠো তো, উঠে দাঁড়াও। তুমি নাকি বেজায় লম্বা! দেখি তো তোমার হাইটটা!”

লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে না কর্তা, আমি তেমন কিছু লম্বা নই। গরিবের কি আস্পদ্দা সাজে? লম্বা হতেও তো মুরোদ চাই কর্তা!”

বীরেনবাবু এই বিনয়বচনে একটু নরম হয়ে বললেন, “আহা, লম্বা হওয়ার সঙ্গে গরিব-বড়লোকের কথা উঠছে কেন? গরিবেরা কি আর লম্বা হয় না? একটু উঠে দাঁড়াও দেখি বাপু, হাইটটা একটু দেখে নিই।”

লোকটি ভারী অনিচ্ছের সঙ্গে দাঁড়াল। দেখা গেল, বটু যতটা বলেছিল ততটা না হলেও লোকটা বেশ লম্বাই!

ভ্রূ কুঁচকে খুব মন দিয়ে লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করে নিয়ে বীরেনবাবু বটুকে উদ্দেশ করে বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “তোর সব তাইতেই বাড়াবাড়ি। এমনভাবে বললি যে মনে হল, লোকটা বুঝি দু’পেয়ে তালগাছ। তা ছাড়া পরনে পাতলুন নেই, কোট নেই, মাফলারের জায়গায় গামছা। এবার হরডাক্তারকে দেখিয়ে চোখে চশমা নে।”

বটু মাথা চুলকে লজ্জিত হয়ে বলল, “মাপজোকে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে বটে।”

বীরেনবাবু লোকটাকে বললেন, “ওহে বাপু, ভেকুড়ি কাটতে পারো?”

লোকটা ভয় খেয়ে বলল, “আজ্ঞে, না বাবু।”

“এই বটু যে বলছিল তুমি নাকি এমন ভেচকুড়ি কাটতে পারো যে, দেখে লোকে ভড়কে যায়!”

“কক্ষনও নয়। আমি জীবনে কখনও ভেকুড়ি কাটিনি। কাকে ভেচকুড়ি বলে তাই জানি না।”

“আহা, সে তো আমিও জানি না। ওরে বটু, ভেচকুড়ি ব্যাপারটা যেন কী?”

“ভেচকুড়ি খুব ভয়ের জিনিস কর্তাবাবু। চোখ দুটো বড় বড় গোল্লা গোল্লা করে তাকিয়ে মুখটায় বিকট রকমের ভেংচি কেটে… উরে বাপ রে, সে বলা যায় না।”

লোকটার দিকে চেয়ে বীরেনবাবু বললেন, “কিছু বুঝলে?”

লোকটা সবেগে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, না বাবু। ভেচকুড়ি কথাটাই জন্মে শুনিনি। আর অন্যকে ভয় দেখাব কী, নিজেই আমি সর্বদা ভয়ে মরছি।”

“কেন বাপু, তোমার ভয়টা কাকে?”

“আজ্ঞে, কাকে ভয় না পেলে চলে বলুন? চোর, ঠ্যাঙাড়ে, ডাকাত, পুলিশ, গুন্ডা, বদমাশ, ফাজিল ছেলেছোঁকরা, ভূত-প্রেত, সবাইকেই সমঝে চলতে হয় আজ্ঞে। সবাইকেই ভয়।”

“আহা, সেসব তো আমরাও ভয় পাই।”

লোকটা ঘাড় চুলকে লজ্জা পেয়ে বলল, “কী যে বলেন বাবু, কোথায় আপনারা আর কোথায় আমি? এই যে দেখুন না, ঈশেন দাস মাত্র তিনটি হাজার টাকার জন্য আমাকে ভিটেমাটি ছাড়া করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করল, ভেচকুড়ি টেচকুড়ি জানা থাকলে কি আর পারত ওরকম?”

বীরেনবাবু বললেন, “কিন্তু বাপু, বটু যে স্বচক্ষে তোমাকে ভেচকুড়ি কাটতে দেখেছে সেটাও তো মিথ্যে নয়। আর ভেচকুড়ি দেখে ভয় খেয়েই না সে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল।”

“কী যে বলেন কর্তা! ও ভেচকুড়ি টেচকুড়ি নয়, তখন বোধহয় একটা হাই তুলেছিলুম, তাই দেখেই উনি ভয় পেয়েছিলেন।”

“হাই আর ভেচকুড়ি কি এক হল বাপু? কী বলিস রে বটু?”

“আজ্ঞে, না কর্তা। হাই এক জিনিস আর ভেকুড়ি অন্য জিনিস। ভেচকুড়ি হল ভেচকুড়ি, আর হাই হল হাই। জলের মতো সহজ ব্যাপার।”

বীরেনবাবু লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝলে তো! ভেচকুড়ি হল ভেকুড়ি, আর হাই হল হাই। তা তুমি যখন ভেচকুড়িটা পেরে উঠলে না, তখন বরং একটা হাই তুলেই দেখাও।”

লোকটা ভারী দুঃখের সঙ্গে বলল, “কর্তা, হাই কি আমার বাপের চাকর যে, ডাকলেই এসে হাজির হবে? নাঃ, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন বগলা হাইতের মুখ দেখেছিলুম, তখনই বুঝেছিলুম দিনটা আজ খারাপই যাবে।”

বীরেনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বগলা হাইত! সে আবার কে?”

“তাকে আর চিনে আপনার দরকার নেই বাবুমশাই। শুধু খেয়াল রাখবেন, প্রাতঃকালে ঘুম ভেঙে যেন বগলা হাইতের মুখ আপনাকে দেখতে না হয়। দিনমানে দেখুন, ঠিক আছে, রাতবিরেতে দেখুন, তাতেও ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রাতঃকালে দেখেছেন কী হয়ে গেল।”

বীরেনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওরে বাপু, অত সাঁটে বললে কি কিছু বোঝা যায়? কে বগলা হাইত, কী তার বৃত্তান্ত, প্রাতঃকালে তার মুখ দেখলে কী হয়, সব খোলসা করে বলবে তো?”

“প্রাতঃকালে তার মুখ দেখলে কী হয় তা এই আমাকে দেখেই কি অনুমান হচ্ছে না কর্তা? কাল সন্ধেবেলা মদন প্রামাণিকের বাড়িতে সত্যনারায়ণের কাটা ফলের পেসাদ আর একটি সিন্নি খেয়েছিলুম। তারপর চার পো রাত গিয়েছে, এত বেলা অবধি দানাপানি জোটেনি মশাই। এর পরও কি প্রাতঃকালে বগলা হাইতের মুখ দেখলে কী হয় তা বলার দরকার আছে?”

বীরেনবাবু তেরিয়া হয়ে বলেন, “তা এ বাড়িতে কি খ্যাটনের আশায় এসে জুটেছ নাকি?”

“না মশাই, না। আপনার মতো হাড়কেনের বাড়িতে যে এক ঘটি জলও জোটার আশা নেই, তা সবাই জানে। খালি পেটে গাছতলায় বসে একটু জিরেন নিচ্ছিলাম, অমনি এসে আপনি নানা বায়নাক্কা শুরু করলেন। ভেকুড়ি দেখাও, হাই তুলে দেখাও, বগলা হাইতের খতেন দাখিল করো। তা মশাই, খালি পেটে কি ওসব হয়?”

বীরেনবাবু একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, “আমি কেন একথা তোমাকে কে বলল বলো তো বাপু? খগেন তপাদার নয় তো? ওর কথা মোটেই বিশ্বাস কোরো না বাপু। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, আমার ছোট মেয়ের বিয়ের সময় খগেন লুচি-মাংস, পোলাও কালিয়া ঠেসে খাওয়ার পর দশ হাত পায়েস সাঁটায়। তারপর আরও পায়েস চাইছিল বলে আমি ওর ভালর জন্যই বলি, খগেন, আর পায়েস খেয়ো না, পেটে সইবে না। এই তো ক’দিন হল রক্ত আমাশায় ভুগে উঠলে! এই কথাতেই খগেন রেগেমেগে উঠে গেল, আর চারদিকে রটাতে লাগল আমি নাকি হাড়কেপ্পন।”

লোকটা মাথা চুলকে বলল, “কর্তাবাবু, ভুল শুনছি কি না জানি। আপনি তো বললেন হাতা, কিন্তু খগেন তপাদারদাদা তো বলে বেড়াচ্ছেন সেটা নাকি একটা চায়ের চামচ ছিল।”

“আরে না, না। হাতাটা একটু ছোট ছিল ঠিকই। তা বলে অত ছোট নয়। তা বাপু, তোমার মুখোনা তো দেখছি শুকিয়ে গিয়েছে! ওরে বটু, আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? লোকটাকে নিয়ে গিয়ে দক্ষিণের দাওয়ায় বসিয়ে একটু জলটল দে। একধামা মুড়ি বাতাসা, কয়েকটা শশা, যা যা শিগগির। অতিথি হল নারায়ণ!”

বীরেনবাবু শশব্যস্তে ভিতরবাড়িতে চলে যাওয়ার পর লোকটা নাক কুঁচকে বলল, “মুড়ি, বাতাসা আর শশা! ছ্যাঃ, কোনও ভদ্দরলোকে খেতে পারে ওসব? একধামা মুড়ি শেষ করতে তো বেলা গড়িয়ে যাবে।”

বটু বলল, “হু, তবু তো বাপু তোমার বরাত ভাল যে, অন্তত মুড়ি-শশার হুকুম হয়েছে। আর ধামা নিয়ে ভেবো না, এ বাড়ির ধামার সাইজ হল নারকোলের মালার মতো।”

“তা হলে তোমরা সব বেঁচেবর্তে আছ কী করে? চেহারাও বেশ নধরই মনে হচ্ছে।”

“ওরে বাপু, বীরেনবাবু পাষণ্ড বলে তো আর গিন্নিমাও পাষণ্ড নন। তার একটু মায়াদয়া আছে। আর বলতে নেই, আমরাও তো আর লক্ষ্মীছেলে নই রে বাপু, হাতযশে কিছু কম যাই না। কাটা মুলোটা, নাড়ুটা-মোয়াটা, দুধটা-ক্ষীরটা সবই নিয়ম করে হাপিস করি, নইলে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে কি শরীর টিকত? ওই যে দক্ষিণের দাওয়া, গিয়ে চুপ করে বসে থাকো, তোমার মুড়ি শশার ব্যবস্থা দেখছি।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *