Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফেরারি || Moti Nandi

ফেরারি || Moti Nandi

আজ যা কিছু হল

আজ যা কিছু হল, সব তোরই জন্য।

ধীর, ফিসফিস স্বরে মোটরচালক কথাগুলো বলল। তার পাশে বসা যুবকটি সামনে তাকিয়ে চুপ করে রইল। এই ভাবে সে গত আধ ঘণ্টারও বেশি বসে আছে।

কী ভুল যে তুই করলি।

সামনে থেকে হু হু করে ভারী ট্রাক আসছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তার ধাঁধানো আলো থেকে চোখ বাঁচাবার জন্য মোটরটা বাঁ দিকে সরিয়ে মন্থর করে চালক বলল, কোথায় নামাব?

যুবকটি এতক্ষণ যেন গভীর কোনও ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিল। চটকা ভেঙে জানলা দিয়ে বিভ্রান্তের মতো তাকাল। দুপাশে বড় বড় গাছ। সরু শাখাপথ তৈরি করেছে ছোট ছোট মোড়। দোকান। বেড়া বা পাঁচিল দেওয়া একতলা পাকা বাড়ি, পুকুর, সবজি বাগান, ধানখেত। অন্ধকার পিচের রাস্তায় মাঝে মাঝে টিমটিমে বাতি। বাড়ির আলো দূরে দূরে।

ঠিক বুঝতে পারছি না যুবক আমতা আমতা করে বলল, সামনের দোকানটায় একটু জিজ্ঞেস করে—

একদম নয়। চাপা তীক্ষ্ণ স্বরে মোটরচালক ধমকে উঠল। তোর মুখ যেন কেউ না দেখতে পায়। কলকাতা থেকে মাত্র বারো-চোদ্দো মাইল, এখানকার সব লোকই নিশ্চয় ইতিমধ্যে ঘটনা জেনে গেছে। এসব অঞ্চল সারথির সাপোর্টারে ভরা। নিশ্চয় আজ অনেকেই মাঠে গেছল, এখন তোকে পেলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, আমাকেও শেষ করে গাড়ি জ্বালিয়ে তার মধ্যে ফেলে দেবে।… মানুষ এখন ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠেছে, জানোয়ারও লজ্জা পাবে। সামান্য সামান্য কারণে দলবেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলছে।

হঠাৎ ব্রেক কষে মোটর থামিয়ে চালক গম্ভীর স্বরে বলল, এইখানেই নেমে যা।

যুবক ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে যেন কথাটার অর্থ বুঝে উঠতে পারেনি! এই লাল স্পোর্টস শার্ট পরা, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি, ফরসা, সুদর্শন, কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ির সন্তান দুলালচাঁদ শীল তাকেই কি নেমে যা বলল?

অনুপম নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

অথচ এই দুলালচাঁদ—যাকে সারথি সঙ্ঘের মালি থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দুলোবাবু, দুলোদা বা দুলো বলে—আজ দুপুরেও প্রায় এক ঘণ্টা এই আকাশি রঙের মারুতি গাড়িটা নিয়ে অপেক্ষা করেছে তাকে নিয়ে সারথির টেন্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

গত পাঁচ বছর দুলোদা তাকে নিয়মিত গাড়িতে করে মাঠে আনেন, আবার বেলেঘাটায় তার ফ্ল্যাটে নামিয়ে দিয়ে সল্ট লেকে নিজের বাড়িতে চলে যান।

যখনই কোনও দরকারে গাড়ি চেয়েছে, দুলোদা পেট্রল ট্যাঙ্ক ভর্তি করে মারুতি বা অ্যাম্বাসাডার ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিজের গাড়ির মতোই সারাদিন সে ব্যবহার করেছে।

আর সেই দুলোদা এখন এই অপরিচিত, অন্ধকার রাস্তায় তাকে হুকুম করল— নেমে যা!

অনুপম ঢোঁক গিলল। একটা অভিমান বুকের থেকে ঠোঁটে এবং চোখে ধোঁয়ার মতো উঠে আসছে। ঠোঁট কামড়ে, চোখ বন্ধ করে সে নিজেকে সামলাল।

অনেক কথাই এখন সে শুনিয়ে দিতে পারে দুলোদাকে। কিন্তু না, এখন সে কোণঠাসা। এখন সে পলাতক, ফেরারি।

তাকে পালিয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। ম্যাচটা শেষ হওয়ার দশ সেকেন্ডও আগে, টাই ব্রেকারের শেষ কিক্‌টার আগে পর্যন্ত যারা তার অন্ধ ভক্ত ছিল, তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে গা-ঢাকা দিতে হবে।

চোর বা জালিয়াত সে নয়, কিন্তু আজ প্ল্যাটিনাম জুবিলি কাপ সারথির হাতে উঠেও হাত থেকে পড়ে গেল শুধুমাত্র, হ্যাঁ একমাত্র সে-ই এজন্য দায়ী।

গত তিন বছর সারথি গর্ব করে বলার মতো একটাও মেজর ট্রফি জেতেনি। ক্লাব-সমর্থকরা বুভুক্ষের মতো সারি দিয়ে আজ মাঠে এসেছিল। গোয়ার ডেম্পোর জয় চেয়ে কজন সমর্থক গ্যালারিতে ছিল? ছিল তো সব সারথিরই।…পঁচিশ হাজার? তিরিশ হাজার? আর মাঠের বাইরে কত লক্ষ?… পাঁচ লাখ, দশ লাখ? রেডিয়ো রিলে হয়েছে, মাঠে টিভি-ক্যামেরাও ছিল। লাখ লাখ লোক শুনেছে, দেখেছে অনুপম বিশ্বাসের মুখ।

সে এই মুহূর্তে একটা ঘৃণ্য মানুষ। তাই বা কেন,…একটা আততায়ী। একটা খুনির থেকে এখন তাকে কেউ অন্য কিছু ভাববে না।

এই দুলোদাও বোধ হয় ভাবছে না। নয়তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লোকটা এভাবে বদলে গেল কেন?

অনুপম, আর আমি তোকে বয়ে বেড়াত পারব না, নাম।

কিন্তু দুলোদা, এখানে…

কিন্তু ফিন্তু নয়, কোথায় তেঁতুলতলা, কোথায় তোর রবিদা, এবার তুই খুঁজে বের কর।

চারদিক বড্ড অন্ধকার, কী করে বের করব? মনে হচ্ছে ছাড়িয়ে এসেছি।

সামনে থেকে একটা যাত্রীবাহী বাস এসে ওদের পাশ দিয়েই বেরিয়ে গেল। রাস্তাটা গ্রামের মধ্য দিয়ে জেলার মহকুমা সদরে, অনেকগুলো গ্রামের মধ্য দিয়ে জেলার মহকুমা সদরে পৌঁছেছে। মিনিট দশেক হাঁটলে রেল স্টেশন। সেখান থেকে বাস ছাড়ে। এখানকার মানুষ ট্রেনে কলকাতা যাতায়াত করে। রাস্তার ধারে একতলা-দোতলা পাকা বাড়ির সঙ্গে টিনের বা খড়ের চাল দেওয়া কাঁচা মাটির কিছু বাড়িও আছে। মাঝে মাঝে পৌরসভার ইলেকট্রিক বাতির কাঠের থাম, কিন্তু বেশির ভাগেরই বালব নেই বা জ্বলছে না।

নেমে খুঁজে দ্যাখ। আগে তো এখানে এসেছিস।

বছর চারেক আগে। মনে আছে একটা বড় অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে। সাইকেল রিকশা যায়। গাছের গোড়াটা বাঁধানো, একটা শিবের পাথর আর একটা ত্রিশূল আছে। পুজো হয়।

কই, তেমন তো কিছু চোখে পড়ল না, বোধ হয় আরও এগিয়ে হবে। নাম এখন, হেঁটে গিয়ে দ্যাখ।

দুলোদা ড্যাশ বোর্ডের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ই, প্রায় দশটা বেজে গেল।

অনুপম ইতস্তত করে বলল, হাঁটুতে রড মেরেছে, ব্যথা বড্ড। গাড়িটা আর একটু…

আরে হাঁটুফাটু এখন রাখ। ওদিকে আমার বাড়িতে আবার হুজ্জতি ফুজ্জতি হল কি না কে জানে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।

দুলোদা আর একটু যদি সামনে…

আবার সামনে কী? অনেক সামনেই তো তোকে এনে দিয়েছি। তার কোনও প্রতিদান তুই দিয়েছিস?

দুলোদা হঠাৎ গলা চড়িয়ে উত্তেজিত থাপ্পড়টা স্টিয়ারিঙের ওপর কষাল। তার চোখে হতাশা, ক্ষোভ, ঘৃণা মিশে অদ্ভুত এক চাহনি তৈরি করেছে। ঠোঁটের কোণ মুচড়ে সে বলল, আজ অনেকগুলো প্রাণ তুই নিয়েছিস। নিরপরাধ মানুষ, তারা শুধু এসেছিল সারথির জিত দেখতে। তারা তোকে এতকাল মাথায় তুলে রেখেছিল, মনে মনে তোকে পুজো করত। যখনই ভাল খেলেছিস, ম্যাচ জিতিয়েছিস, ওরা তোকে কাঁধে তুলে নিত, যুগ যুগ জিয়ো বলত তোর নাম করে। আর তাদেরই তুই…।

অনুপম একদৃষ্টে তার বাঁ হাতের আঙুলে চুনি বসানো আংটিটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, কজন মারা গেছে, জাননা?

টেন্টের সামনের লনে আটটা বডি এনে রেখেছিল। তা ছাড়া মরো মরো অবস্থায় কতজনকে যে হাসপাতালে নিয়ে গেছে তা বলতে পারব না।

দরজা খুলে অনুপম বাঁ পা জমিতে রেখে বেরোবার জন্য শরীরের ভর পায়ের ওপর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেই কাতরে উঠল।

দুলাদা চোখটা কোঁচকাল মাত্র, কিন্তু সহানুভূতি জানাতে একটা শব্দও মুখ থেকে বের করল না।

দুবারের চেষ্টায় অনুপম সোজা হয়ে দাঁড়াল।

একটা কথা বলে রাখি তোকে। এখন তোর জীবন তোর হাতে। ইউ আর ইন রিয়েল ডেঞ্জার। তিরিশ বছর মাঠ করছি, কিন্তু মানুষকে এমন ভাবে খেপে যেতে কখনও দেখিনি। তোকে পেলে পিটিয়ে আজ শেষ করে দিত। সারা জীবন মনে রাখবি, এই দুলেদাকে, আজ তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর এটাও মনে রাখবি, সারথির সাপোর্টার সর্বত্র রয়েছে, তাই সাবধান…খুব সাবধান, খুব সাবধান।

দৈববাণীর মতো শেষের কথাগুলো বলতে বলতে দুলাদা স্টার্ট দিল এবং কোনও বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই মারুতিকে একটু এগিয়ে নিয়ে রাস্তার চওড়া জায়গায় ঘুরিয়ে নিল।

চোখ ঝলসানো দুটো হেডলাইট জ্বলা মারুতির মধ্যে একটা আবছা মাথা সাঁ করে অনুপমের চোখের সামনে দিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল। দুলালচাঁদ একবার মুখ। ফিরিয়ে তাকালও না তার দিকে। রাস্তার দুধারের গাছগুলো আলোয় ভেসে উঠেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। মারুতির পেছনে লাল আলো দুটো অন্ধকারকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে আলোর পেছন পেছন।

অনুপমের বুকের মধ্যে অজানা একটা ভয় গুড় গুড় করে উঠল। এইবার কি ওই দুটো রক্তচক্ষুর নজরে থাকা অন্ধকারের মধ্যে তাকে ঢুকতে হবে? তার কি আলোর দিন শেষ!

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। সকালে মিনিট পনেরোর বৃষ্টিতে শীত বিদায় নিতে নিতেও আজকের মতো থমকে গেছে। রাস্তায় লোক চলাচল করছে না। গাছের ফাঁক দিয়ে বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। অনুপমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল।

এখন তাকে তেঁতুলতলা খুঁজে বের করতেই হবে। সারারাত অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে চলবে না, রবিদার বাড়ি তাকে পৌঁছতেই হবে, সেই অশ্বথ গাছ আর শিবের চত্বরটার হদিস আগে চাই।

অনুপম সন্তর্পণে বাঁ পা ফেলল। লোহার রডটা পেছন থেকে চালিয়েছিল, বোধ হয় কোমর লক্ষ্য করে। ঠিক সেই সময় কে যেন ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। রডটা হাঁটুর পেছনে লেগে পিছলে গেলেও চোটটা দিয়ে গেছে।

পায়ে ভর রেখেই সে আহ্হ বলে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। সতেরো বছর বয়সে ময়দানে সেকেন্ড ডিভিশনে সে খেলতে এসেছিল। দুটো পা এগারো বছর ধরে কম চোট তো পায়নি! জখম হওয়ার অভ্যাস তার আছে। এক পা হেঁটেই সে বুঝতে পারল হাড়ে, লেগেছে। এখন দরকার গরম জল ঠাণ্ডা বরফ জল আর বিশ্রাম। হাঁটাচলা একদম না করা। রবিদার বাড়িতে রেফ্রিজারেটার আছে, এত রাতে বরফও পাওয়া যাবে।

মা হলে বলতেন, রাখ তোর ঠাণ্ডা-গরম জল, চুন-হলুদ করে দিচ্ছি, লাগা। এই লাগিয়েই তো এত বড়টা হলি।

তাদের বিদ্যুৎপুরের বাড়িতে অনুপম গত বছর বাবা-মায়ের জন্য টিভি সেট কিনে। দিয়ে এসেছে। বাবা ফুটবলের ভক্ত, মা নন। বড়দা দেবোপম স্কুল শিক্ষক। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্কুল ও কোচিং নিয়েই ব্যস্ত। টিভি দেখার সময়ই পায় না। ছেলে-মেয়েদের দেখতে দেয় না লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে।

আজকের খেলা বাড়ির কেউ কি দেখেছে? বাবা নিশ্চয়, ভাইপোরাও, মা-ও হয়তো মাঝে মাঝে টিভির সামনে এসেছেন। খেলাশেষের ঘটনাগুলো কি দেখানো হয়েছে? নির্মম, বীভৎস পাশবিক দৃশ্য কি টিভিতে দেখাবে? কিন্তু টাই ব্রেকারের শেষ কিটির নেওয়াটা ওরা নিশ্চয় দেখিয়েছে।

ডেম্পোর পঞ্চম কিক্টা নিয়েছিল মিগুয়েল, রাজীব বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে বলটা পেয়ে যায়। ফল তখন ডেম্পোর পক্ষে ৪–৩ সারথির পঞ্চম কিক্‌টা বাকি। একটা বিশাল টাইফুন মাঠের তিনদিকের গ্যালারির ওপর দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনুপমকে পেনাল্টি মারার জন্য এগিয়ে যেতে দেখেই সেটা স্তব্ধ হয়ে পড়ল। অবধারিত ৪— ৪। তারপর সাড়ন ডেথ। কিন্তু তার আগে ৪–৪ তো হওয়া চাই। আর হবে নাই বা কেন? কিক নিচ্ছে তো অনুপম বিশ্বাস! টাইফুনের যদি প্রাণ থাকে তা হলে তখন সে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল ডেম্পোর গোলের মধ্যে বল দেখার জন্য।

বাঁ পা টেনে টেনে অনুপম অন্ধকারের মধ্যে এগোচ্ছে। ঘড়িটা হাতে নেই, বোধ হয় পকেট থেকে কোথাও পড়ে গেছে। খালি গায়ে, কালো হাফ প্যান্টটা পরে, শর্ট আর ট্রাউজার্সটা পাকিয়ে বগলে নিয়ে তাঁবুর পেছন দিকের জানলা গলে অন্ধকারের মধ্যে মাটিতে নেমেছিল। হামাগুড়ি দিয়ে সে ক্যান্টিনের পেছনে কাঠের বেড়া পর্যন্ত যায়। বৃদ্ধ সহদেব মালি বেড়ার নীচের একটা তক্তা সরিয়ে বলেছিল, রাস্তার দিকে একদম যাবে না, অন্ধকার অন্ধকার মাঠ দিয়ে কেল্লার ওই কোনায় চলে গিয়ে চুপচাপ মাটিতে শুয়ে থাকবে। খারাপ লোকেরা এখন মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুলোবাবু গাড়ি নিয়ে আসবে, দেখতে পেলেই ছুটে গিয়ে উঠে পড়বে।…যাও, যাও, আর এ-মুখো হয়ো না। এত নামডাক, এতবড় পেলেয়ার…

অনুপমের আর কিছু শোনার মতো মনের অবস্থা তখন ছিল না। কিন্তু এখন তার কানে সহদেবের কথাটা স্পষ্ট বেজে উঠল, যাও, যাও, আর এ-মুখো হয়ো না। কয়েক পা গিয়েই সে আবার শুনল, যাও, যাও। অনুপম বুঝতে পারছে না, ভয় না ঘৃণা, কী ছিল ওর স্বরে?

রাস্তাটা ধনুকের মতো বেঁকেছে। বাঁক ঘুরেই অনুপমের মনে হল কিছু দূরেই একটা বাজার আর মোড়। অনেকগুলো দোকানের সাইনবোের্ড সে দেখতে পাচ্ছে, তবে বেশিরভাগই বন্ধ। রাত দশটায় মফস্বলে দোকান খোলা রাখা নির্ভর করে লোক চলাচলের ওপর। একটা মিষ্টির দোকান, তার পাশে বিড়ি-সিগারেটের দোকান আর সেলাই মেশিনে ব্যস্ত এক দরজি শুধু দোকান খোলা রেখেছে দেখল। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা স্টেশনে গেছে।

বাজারের আগে রাস্তার ডানদিকে অন্ধকারে যে একটা অশ্বত্থ গাছ রয়েছে, কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত অনুপম তা বুঝতে পারেনি। গাছতলায় বাঁধানো গোল চত্বরটা ঠাহর হতেই সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

এই তো রবিদার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা।

.

চার বছর আগে রবিদা হঠাৎই এক দুপুরে তার ব্যাঙ্কে হাজির হয়েছিল দুটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে।

কী ব্যাপার রবিদা!

অনু, তোকে জ্বালাতন করতে এলুম। কী করব বল, বিখ্যাত ভাইয়ের দাদা হওয়া যে কী দুর্ভোগের, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তুই আমাকে বাঁচা।

আমি বিখ্যাত? দুপুরবেলা এত পথ ঠেঙিয়ে ঠাট্টা করতে এলে?

যা সত্যি তাই বলেছি। সারা ভারতে এখন সেরা মিডফিল্ডার বলতে তো শুধু একজনই, অনুপম বিশ্বাস।

কথাটা বলে রবিদা সঙ্গের যুবক দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। তারা বিগলিত হাসি দিয়ে জানিয়ে দেয়, সিদ্ধান্তটা তর্কাতীত।

অনু, আমার ওখানে অনেকদিন তুই যাসনি। এগারোই, এই রোববারের পরের রোববার আয়।

কী ব্যাপার, কিছু আছে টাছে নাকি?

আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের মায়ের নামে শিল্ড চালু হয়েছে, এই বছরই প্রথম, রোববার তাই ফাইনাল। এরা এসে ধরল আপনার ভাইকে প্রধান অতিথি করে দিতে হবে। কার্ডফার্ড সব ছাপিয়েও ফেলেছে।

অ্যাঁ, আমাকে জিজ্ঞেস না করেই?

কেন, তোর অনুমতি নিতে হবে নাকি আমার ওখানে যাওয়ার জন্য? রবিদা তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিখুশি ঢঙে কথাটা বলেছিল।

আমার অসুবিধে থাকতে পারে তো ওই দিন। প্রতি রোববারই হয় সভাপতি নয়তো প্রধান অতিথি হওয়া..অন্তত একমাস আগে আমায় না বললে…। অনুপম গম্ভীর স্বরে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে রবিদার মুখ থেকে আমুদে সজীবতাটা মুছে দিয়েছিল।

অপ্রতিভ রবিদা যুবক দুটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে কুণ্ঠিত স্বরে বলে, আমি তো এদের বলেছি তোকে নিয়ে যাব। হ্যাঁরে দু-চার মিনিটের জন্যও কি সময় করতে পারবি না? তুই না গেলে আমার তো।

মাথা কাটা যাবে! অনুপম তখন মনে মনে রেগে উঠেছিল। এরা সব ভাবে কী! ধরেই নিয়েছে যেন, অনুপম বিশ্বাস ফুটবল খেলে এত নাম এত সম্মান পেয়েছে এদেরই অনুগ্রহে, তাই যখন খুশি ওকে ডাকলেই যেতে হবে।

আর এই রবিদা। তার নিজের দাদা নয়, দূর সম্পর্কের মামার ছেলে। বিদ্যুৎপুরে তাদের বাড়িতে থেকেই মানুষ। লেখাপড়া স্কুল ফাইনাল পাশ, তবে অসম্ভব পরিশ্রমী আর উদ্যোগী। অল্প বয়স থেকেই খুচখাচ ব্যবসা করত। বছর দশেক আগে তেঁতুলতলায় দোতলা বাড়ি করেছে, এখানেই শ্বশুরবাড়ি। এখন আলুর বড় ব্যবসায়ী, কোল্ড স্টোরেজের অংশীদার, সার আর বীজের দোকান আছে। নিঃসন্তান।

রবিদা ভাল ফুটবল খেলত। অনুপমের শিশু বয়সে তরুণ রবিদাই ছিল তার হিরো। তার ফুটবলকে ভালবাসার প্রথম শিখাটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল যে রবিদাই— এটা অনুপম মনে মনে স্বীকার করে।

এক সময় বাড়িতে তার ফুটবল খেলা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি উঠেছিল, যখন সে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করল। তখন রবিদা যদি না…

ঠিক, আছে, যাব। অনুপম তার গাম্ভীর্য সরিয়ে হালকা চালে বলেছিল। রবিদার মুখ চোখে ঔজ্জ্বল্যের দপ করে নিভে যাওয়াটা তার মনে খচখচ শুরু করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা হালকা করার জন্য সে তখন বলেছিল, কিন্তু রবিদা, আমি দুপুরে বউদির রান্না খাব। ঠিক এক বিঘত লম্বা কই মাছের ঝাল আর পোস্তর বড়া রাঁধতে বলবে।

রবিদার মুখে আবার ফিরে এসেছিল আমুদে উচ্ছলতা। যুবক দুটির সামনে সে নানা ভাবে দেখাবার চেষ্টা করল—তোমাদের এই হিরো অনুপম বিশ্বাস আমার খুব অনুগত ভাই। আমায় খুব মান্য করে। অনুপম স্মিত হেসে রবিদার সব কথাই মেনে নেয়।

ওরা চলে যাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল, সে যেন অনেক বদলে গেছে। কেমন যেন এক ধরনের দাম্ভিকতা, পায়াভারী ভাব তার মধ্যে আসতে শুরু করেছে যেটা মাঝে মাঝে তাচ্ছিল্য দেখানো ঔদ্ধত্যের মতো তার নিজের কাছেই মনে হয়েছে। অনুপম তখন জানত না একদিন অবস্থার ফেরে পড়ে, ঘটনাচক্রে তাকে এই রবিদার বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য রাত্রির অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হবে।

অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটার দিকে অনুপম তাকাল। একটা সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। চার বছর আগে এখানেই সে মোটর গাড়ি থেকে নেমেছিল। রবিদার সঙ্গে যে দুজন যুবক তার ব্যাঙ্কে গেছল তাদেরই একজন, গোপাল নাম ছিল, তাকে বেলেঘাটা থেকে মোটরে নিয়ে এসেছিল।

অনুপম মোটর থেকে নেমে বলেছিল, এখান থেকে কতটা হাঁটতে হবে?

গোপাল বিব্রত হয়ে বলেছিল, মিনিট-তিনেকের পথ, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে আসি।

আরে না, না। তিন-চার মিনিট হাঁটলে আমার পা খুলে পড়বে না। অতটা অথর্ব এখনও হইনি।

মাত্র চার বছরের মধ্যে কথাগুলো কেমন বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। এখন গোপাল যদি অন্ধকার কুঁড়ে তার সামনে এসে হাজির হয়!

অশ্বত্থ তলার বাঁধানো জায়গাটায় বাঁ পা-কে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য বসে অনুপম দ্বিধান্বিত মনে ভাবল, তা হলে কি সে বেঁচে যাবে? গোপাল যে তার অন্ধ ভক্ত সেটা বুঝে নিতে তার তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি। ওর চোখ মুখই বলে দেয়, অনুপম আর সারথি সঙ্ঘকে সে পুজো করে। সেদিন সারাক্ষণ গোপাল ছায়ার মতো তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরেছে। অন্য ভক্তদের কাছে আসতে না দিয়ে আগলে রেখেছিল, যেন অনুপম একা তারই সম্পত্তি।

আগের দিন বিকেলে পুকুরে জাল ফেলিয়ে এক বিঘত লম্বা কই পাওয়া যায়নি, গোপাল কলকাতায় এসে তিন-চারটে বাজার ঘুরে নাকি এক বিঘতের কাছাকাছি মাপের কই মাছ কিনে রাত সাড়ে দশটার ট্রেনে ফিরেছিল। দুপুরে খাওয়ার সময় অনুপম মাছ দেখে বলেছিল, ইস, কত বড়! যদি আজ না আসতাম তা হলে তো জীবনের একটা বিরাট আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম। রবিদা, তোমার পুকুরে এত বড় কই আছে জানলে তো আমি হপ্তায় দুবার করে আসতাম।

রবিদা আঙুল তুলে দরজার কাছে দাঁড়ানো গোপালকে দেখিয়ে বলেছিল, ওর জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। বুঝলি অনু, আমাদের এই অঞ্চলটাই সারথির সাপোর্টার। তোর কী দরকার সেটা শুধু একবার বলবি। তারপর দ্যাখ এই গোপাল আর ওর মতো কয়েকটা সারথি-পাগল ছেলে কী করতে পারে। এখানকার পুজো প্যান্ডেলের শামিয়ানার কাপড়ে, সাইনবোর্ডে, পরদায়, ঘুড়িতে, সব ব্যাপারেই সারথির ফ্ল্যাগের কলাপাতা আর গাঁদাফুল রং তুই পাবি। এখানে কার্ড হোল্ডার মেম্বার কত আশে জানিস? অন্তত এগারোজন শুধু তেঁতুলতলাতেই।

তেরোজন! গোপাল রবিদার ভুলটা শুধরে দিয়েছিল।

সারথি পয়েন্ট লস করলে বা হারলে এখানে বহু বাড়িতেই অরন্ধনের উপবাস চলে। গত বছর লিগে যুগের যাত্রীর কাছে হারের পর শক্তিপ্রসাদ বলে একটা ছেলে এগারো দিন না খেয়ে ছিল।

কিন্তু আমরাই শেষ পর্যন্ত লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম। অনুপম বলেছিল।

এবারেও হব তো? গোপাল তার ব্যাকুলতা গোপন না রেখেই ব্যগ্র স্বরে জানতে চেয়েছিল।

নিশ্চয়ই। আমি তো সিজনের শুরুতেই বলেছিলাম, এবারও সারথিকে চ্যাম্পিয়ন করাব।

চার বছর আগের কথা। সত্যিই লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল সারথি। তারপর আর হয়নি। কিন্তু প্রতি সিজনের শুরুতেই অনুপম বলে গেছে, চ্যাম্পিয়ান করাব। প্রতি সিজনে সে টাকার দাবি বাড়িয়েছে এবং আদায়ও করেছে, কিন্তু বড় ট্রফি এনে দিতে পারেনি। সমর্থকরা প্রথমে বিস্মিত হয়েছে, তারপর বিরক্ত। এখন হাসাহাসি করে।

গোপালও কি এখন তাকে দেখে হাসবে? আজ আটটা বডি টেন্টের লনে রেখেছিল। এটা নিয়ে হাসাহাসি হবে? রডটা চালিয়েছিল তার কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য, ভাগ্যক্রমে লাগেনি। ভেঙে গেলে কি হাসাহাসি হত? পঙ্গু অনুপম বিশ্বাসকে কেউ কি মনে রেখে দেবে?

রাস্তা দিয়ে একটা সাইকেল এগিয়ে আসছে। অনুপম শক্ত হয়ে গেল। তাকে দেখতে পেয়ে যদি লোকটা কাছে আসে? এখানকার লোক নয় অথচ অন্ধকারে নির্জনে বসে রয়েছে। চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজ ভেবে চেঁচামেচি করে যদি লোক জড়ো করে।

কে রে, পাগলা নাকি?

লোকটা সাইকেল না থামিয়েই কথাটা বলে গেল। পেছনের কেরিয়ারে একটা বস্তা। অনুপম সাড়াশব্দ দিল না।

আর বসে থাকা ঠিক নয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেই মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাবে, কিন্তু পথে যদি ওদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? অন্ধকারে নিশ্চয় তাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু সঙ্গে যদি টর্চ থাকে? মফস্বলে, গ্রামে রাতে টর্চ ছাড়া মানুষ বেরোয় না। বিদ্যুৎপুরে সন্ধেবেলা কেউ বেরোলেই বাবা মনে করিয়ে যেন, সঙ্গে টর্চ নিয়েছিস তো, পথে যা সাপখোপ।

সাপ! অনুপম সরু রাস্তাটায় নামতে নামতে থমকে গেল। কিন্তু এই অন্ধকারে সে দেখবে কী করে। শব্দ করলে ওরা ভয়ে সরে যায়, কিন্তু ওরা তো শুনতে পায় না। পা দিয়ে জমিতে ধপধপ করে চললে মাটিতে যে কম্পন হয় সেটা ওরা অনুভব করে সরে যায়। বাবাই একদিন বুঝিয়ে বলেছিলেন। তবে এখনও শীত যায়নি, ওরা এখনও গর্তের মধ্যেই রয়েছে।

কিন্তু অন্য ওরা?

তারা যদি ধপধপ শুনে এগিয়ে আসে। মুখে টর্চের আলো ফেলে। যদি চিনতে পারে!

দুলোদা বলে গেল, সাবধান, খুব সাবধান।

রবিদা বলেছিল, তারপর দ্যাখ, এই গোপাল আর ওর মতো কয়েকটা সারথি-পাগল ছেলে কী করতে পারে।

কী পারে? পিটিয়ে মানুষ মারতে কি পারবে? কী খাতির-যত্নই না গোপালরা করেছিল। ভৃত্যের মতো ক্রীতদাসের মতো পেছন পেছন ঘুরছিল তার কী দরকার জানার জন্য। ওরা চোখের চাউনি দিয়ে সারাক্ষণ তাকে পুজো পাঠিয়ে গেছে। চার বছরেই কি ওরা বদলে যাবে? ওদের ভক্তি, ভালবাসা কি এতই ঠুনকো? কিন্তু দুলোদা তো কয়েক ঘণ্টাতেই বদলে গেল। বড় ভাল লাগত এদের স্তুতি, এদের মুগ্ধতা, এগুলোকে সে সত্যি বলে, স্থায়ী বলেই ধরে নিয়েছিল।

পা ঘষটে অনুপম এগোতে লাগল রাস্তার দিকে চোখ রেখে। দুপাশে বাড়ি। জানলাগুলোও বন্ধ। কোনও বাড়ি পাঁচিল ঘেরা, কোনওটায় বাইরের দালানে লোহার গ্রিল। তিনতলা পুরনো বাড়িও আছে কয়েকটা। টালির চালের বাড়িটার পরই একটা ডোবা।

কাছে এবং দূরের থেকে একই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে। রেডিয়োয় গাইছে কোনও মেয়ে। এই গান বাদে সারা বিশ্বচরাচর অনুপমের কাছে শব্দহীন মনে হচ্ছে। কলকাতার বিকট আওয়াজের মধ্যে বাস করার জন্য তার স্নায়ু যে চড়া সুরে বাঁধা হয়ে পড়েছে তাতে মফস্বলের রাতের এই নৈঃশব্দ্য তাকে খুব জোরে আঘাত করল। তার শরীরে ক্লান্তি নেমে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে সে অভ্যাসবশেই ভীত হয়ে উঠল। ম্যাচ শেষ হতে অনেক সময় বাকি, এখনই টায়ার্ড হয়ে গেলে চলবে না। তাকে পালাতে হবে, সারথির লোকেদের, ভক্তদের, অনুগতদের হাত থেকে বাঁচতে হলে এখন কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে।

তেঁতুলতলায় আসাটাই ভুল হয়েছে। কেন যে সেই দিশাহারা, তুলকালাম, নারকীয় পরিস্থিতির মধ্যে তার রবিদাকেই মনে পড়ল! ঠাণ্ডা, নরম, স্নেহশীল। ওর কাছে সাহায্য চাইলে প্রত্যাখ্যান করবে না, এই ধারণাটা তার মধ্যে কী ভাবে তখন যে এল, অনুপম তা ভেবে পেল না।

সে তো বিদ্যুৎপুরেও বাবা-মা দাদার কাছে চলে যেতে পারত। কিন্তু ষাট-পঁয়ষট্টি মাইল দূরে কে তাকে এক রাতে গাড়ি করে পৌঁছে দিত? দুলোদা দশ-বারো মাইল পর্যন্ত যে এসেছে, আজকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটাই অদ্ভুত ব্যাপার। হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধের ছিটেফোঁটা এখনও ওর মধ্যে রয়েছে। সারথির একজিকিউটিভ কমিটিতে ওকে ঢোকাবার জন্য শেষ পর্যন্ত অনুপমকে ভোট জোগাড়ে নামতে হয়েছিল।

বাঁ দিকে টানা একটা নিচু পাঁচিল। বাড়িটার বাইরের দালানে একটা টিভি সেট। অনেকগুলো মানুষ। বাড়ির লোক ছাড়াও বাইরের লোকও বোধ হয় রয়েছে। হিন্দি কোনও সিরিয়াল হয়তো। দালানের আলো নেভানো কিন্তু ভেতরের ঘরের আলো জ্বলছে। চেয়ারে দু-তিনজন, বাকিরা মেঝেয় বসে। অনুপম মাথা নামিয়ে কুঁজো হয়ে এগোল।

পাঁচিলের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গা। লোহার গেট। ওর সামনে দিয়ে তাকে যেতে হবে। অনুপম থমকে গিয়ে ভাবল, দালান থেকে কেউ কি দেখে ফেলতে পারে?

মাথাটা তুলে দূরত্ব আর অন্ধকার সম্পর্কে একটা আন্দাজ করে নিয়ে সে স্বাভাবিক হেঁটে ছ-সাত হাত চওড়া গেটের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হোঁচট খেল।

আহহ। হাঁটুতে ধাক্কাটা পেয়ে অনুপমের মুখ থেকে একটু জোরেই কাতরানিটা বেরিয়ে এল। পাঁচিলের ওধার থেকে ডেকে উঠল একটা কুকুর।

কে, কে, কে রে?

অনুপম ছুটল। হাঁটুর যন্ত্রণা ভুলে সে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট গজ ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তাটা এখান থেকে দু ভাগ হয়ে দু দিকে গেছে। সে বুঝতে পারছে না কোনটা ধরে এগোলে রবিদার বাড়ি পৌঁছনো যাবে।

অন্য দিন, অন্য সময় হলে সে রাস্তার লোককে কি কোনও বাড়ির লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিত। এখন ওসব ভাবাই যায় না। বাঁ পা তুলে ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে শ্রবণশক্তি তীক্ষ করল।

কুকুর ডাকছে না। মানুষের গলাও শোনা যাচ্ছে না। আবার সব আগের মতোই নিস্তব্ধ। অনুপমের বুকের মধ্যে ছমছম করে উঠল। বলটা স্পটে বসিয়ে কি নেওয়ার জন্য যখন পিছিয়ে যাচ্ছিল, সারা মাঠ তখন এইরকম নিশ্বাস বন্ধ করা শব্দহীনতার মধ্যে ডুবে ছিল।

এখন তার দরকার যা হোক কোনও শব্দ। অনুপমের মনে হল ডানদিকের রাস্তাটাতেই রবিদার বাড়ি। কেন যে মনে হল, তার কোনও ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। এই রকম অনুভূতির জন্যই সে অনেক বার এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে বল পেয়েছে, যেখানে বল আসার কোনও সম্ভাবনা তখন ছিল না। সবাই বলে, তার সিক্সথ সেন্স নাকি খুব তীক্ষ্ণ। দারুণ ভাবে কাজ করে। করে বলেই আজ সে প্রাণ নিয়ে এখনও টিকে রয়েছে।

লোহার রডটা কোমরেই লাগত যদি না ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে সে তিন-চার পাক গড়িয়ে যেত। তারপর লাফিয়ে উঠে সে তাঁবুর দিকে ছোটে। তিরিশ-চল্লিশ গজ মাত্র। দু দিক থেকে জনতা ছুটে আসছে, কয়েকজন মাত্র পুলিশ লাঠি তুলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনুপম তাঁবুর মধ্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিল।

কী ভাবে যে তাঁবুটা রক্ষা পেল, সে এখনও বুঝতে পারছে না। অন্য কোনও ফুটবলারকে ওরা মারধোর করার খুব বেশি সুযোগ পায়নি। সরল আর অপূর্বর মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। পুলকেশ চিত হয়ে কাতরাচ্ছিল, বোধ হয় পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। রঞ্জনের বাঁ চোখটা বন্ধ হয়ে গেছে, থুথু করে রক্ত ফেলছিল মুখ থেকে।

তাঁবুর কোলাপসিবল গেটটা বন্ধ করে দেওয়ার মুহূর্তে ছোটখাটো চেহারার একটা লোক ছুটে এসে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তাঁবুতে ঢুকে পড়েছিল। পরে সে ড্রেসিংরুমের কোণে আধো-অন্ধকারে বসে থাকা অনুপমের কাছে গিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে, পানের ছোপ ধরা দাঁতগুলো দেখিয়ে বলেছিল, অনু, তোর উত্থান আমি দেখেছি, এখন পতনটাও খুব কাছ থেকে দেখব বলে ঢুকে পড়েছি।

অনুপম তখন বোবা চোখে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল প্রভাতী সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার, পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি, বাহান্ন কেজি, আটত্রিশ বছর বয়সি সুপ্রিয় গুপ্তর দিকে।

তোর একটা ফাইনাল ইন্টারভিউ নেব..অনু না বলিস না, তোর দেওয়া অপমানগুলো আমি এখন ভুলে যেতে রাজি…জাস্ট ওয়ান ইন্টারভিউ, হার্ট টু হার্ট টক…

সামনে থেকে সরে যাও সুপ্রিয়দা। তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না। অনুপম চাপা স্বরে চোয়াল চেপে বলেছিল।

আমাকে সরিয়ে দিতে তুই পারিস, কিন্তু আমি কি তোকে সরিয়ে দিতে পারব আমার মন থেকে? তুই যতক্ষণ থাকবি, যেখানে থাকবি, আমিও সেখানে

কে? কে যেন আসছে? অনুপম শক্ত হয়ে গেল। একজন, না কয়েকজন? তার বুকের মধ্যে আবার টাই ব্রেকার কি নেওয়ার আগের মুহূর্তটা ফিরে এল। যতজনই হোক অন্ধকার পথে কেউ কাউকে দেখলেই বলবে, কে? পরিচয় নিতে চাইবে। তখন সে কী বলবে? রবিদার নাম করে বলবে তার বাড়িতে যাচ্ছি। তাইতে বাড়ির রাস্তা বাতলে দিয়ে চলে যেতে পারে কিংবা আরও কৌতূহলী হয়ে টর্চ জ্বেলে কিংবা সিগারেট ধরাবার ছলে দেশলাই জ্বেলে তার মুখটা দেখে!..যদি দেখেই ভ্রূ কোঁচকায়? তারপর হনহন করে অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে যদি চেঁচায়। ওরে অনুপম বিশ্বাস, আমাদের তেঁতুলতলায় অনুপম বিশ্বাস…তোরা শিগগির বেরিয়ে আয়; পালিয়ে যাবে। ধর ওকে, লাশ ফেলে দে।

রডটা পায়ে লাগার আগে সে শুনতে পেয়েছিল—শেষ করে দে। টাকা হাতে না পেলে বাবু পায়ে বল ছোঁবে না। বিদ্রুপে মোচড়ানো স্বরে কুৎসিত নোংরা গালাগালিতে আরও বলেছিল, বছর বছর প্যাঁচ কষে টাকাই শুধু বাড়িয়েছিস। ট্রোফি আর আনতে পারিসনি।

দুলোদার কথাটা মনে পড়ল—সাবধান, সাবধান।…এখন তোর জীবন তোর হাতে। সারথির সাপোর্টার সর্বত্র রয়েছে।

অনুপম বাঁ দিকে দুটো খেজুর গাছ দেখতে পেল। ঘেঁষাঘেঁষি করে একটা মোটা থামের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে। সে গাছ দুটোর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

দুটো ছায়ামূর্তি আসছে। আকার দেখে সে বুঝল ওদের একজন নেহাতই অল্পবয়সি।

বলিস কী, ছোটমামা রেডিয়োটা আছড়ে ভেঙে ফেলল?

হ্যাঁ বাবা বলল, ঘুষ খেয়েছে। টাকা খেয়ে ইচ্ছে করে পেনালটি মিস করল।… গুলি করে মারা উচিত। ক্লাবের মধ্যে পলিটিক্স করবে, প্লেয়ারদের নিয়ে জোট বেঁধে…

অনুপমের পাঁচ-ছ হাত সামনে দিয়ে ওরা চলে গেল। ছেলেটার বয়স কতই বা, নয় কি দশ। যা শুনেছে তাই বলল। এইসব শুনতে শুনতে বড় হবে, বিশ্বাসও করবে, অনুপম ঘুষ নিয়ে খেলত।

বুকের মধ্যে হঠাৎই একটা বিশাল কালো গহ্বর তৈরি হয়ে গেল বলে তার মনে হল। কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিল, আমেরিকার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মিল্কি ওয়েতে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা সূর্যের থেকে দশ লক্ষ গুণ বড় ব্ল্যাক হোল পেয়েছেন। সেটা নাকি প্রতি পাঁচ থেকে দশ হাজার বছরে একটা করে নক্ষত্র গিলে ফেলছে। পড়ার পর সে কল্পনা করতে চেয়েছিল বিশাল একটা অন্ধকার গহ্বরকে। কিন্তু পারেনি। সূর্যটা যে কত বড়, পৃথিবী থেকে চোখে দেখে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। কিলোমিটার আর মাইলে গড়া ব্যাসার্ধ বা পরিধির কথা বলেও কিছু আন্দাজ হয় না। সূর্যের দশ লক্ষ গুণ যে কত বড় হতে পারে, সে কিছুই ধারণায় আনতে পারেনি।

এখন সে অনুভব করতে পারল।

আটজন নাকি মাঠেই মারা গেছে। কথাটা সে দশ-বারোবার শুনেছে। তাঁবুর গেট আর জানলাগুলো বন্ধ করে কে চেঁচিয়ে বলেছিল, চুপচাপ সবাই বসে থাক।…ডেডবডি এনে শুইয়ে রেখেছে সামনের লনে। জানলা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করিসনি।

অন্ধকার তাঁবুর মধ্যে গিসগিসে ভিড়। আর একজন চাপা গলায় বলেছিল, পাপ। পাপের ভারে পূর্ণ হয়ে গেছে সারথির পথ। তাই চাকা বসে গেল।

কেউ সেই কথার প্রতিবাদ বা সমর্থন করেনি। শুধু সরল তার পাশ থেকে বলেছিল, মাথার চুল না কামিয়ে কি জায়গাটা সেলাই করা যায় না?

তা কী করে হয়! যে ভাবে রক্ত বেরোচ্ছিল, তাতে কম করে বারো-চোদ্দোটা স্টিচ তো তোর লাগবেই। প্রকাশ বলল।

সরল, তোর বিয়েটা কবে? আর-একজনের প্রশ্ন।

আঠারো দিন বাকি।

তদ্দিনে চুল গজিয়ে যাবে, আর তা নইলে কামানো জায়গাটায় চুল লাগিয়ে নিবি।

অনুপম দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ চেপে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসে ছিল। কেউ তার সঙ্গে ইচ্ছে করেই কথা বলছে না, এটা সে বুঝতে পারছিল। সে জানে তার প্রতি কারও কোনও সহানুভূতি নেই। এই ঘটনায় বরং সবাই মনে মনে খুশিই হয়েছে এই ভেবে—অনুপম বিশ্বাস ফিনিশ হয়ে গেল। আর মাঠে ফেরা সম্ভব হবে না।

একটা অস্ফুট গোঙানি অনুপমের মুখ থেকে বেরিয়ে এল। খেজুর গাছে কপালটা ঘষার জন্য জ্বালা করছে। এখন তাকে পেছনে নয় সামনে তাকাতে হবে। জীবন এখন নিজের হাতে, এটা কোনও ভাবেই ভুললে চলবে না।

রাস্তায় উঠে সে হাঁটতে শুরু করল। বাঁ হাঁটু ভাঙতে পারছে না, অসাড় হয়ে গেছে। তাতে অসুবিধে বোধ করছে না। এখনও পর্যন্ত ওদের কারও সঙ্গে দেখা। হয়নি।

চার বছর আগে ফাইনাল ম্যাচে তাকে মঞ্চে তোলার আগে, মাঠের চারধারে। তাকে জোড় হাতে ঘুরতে হয়েছিল অন্তত হাজার পাঁচেক দর্শকের অভিনন্দন উচ্ছ্বাস-হাততালিতে আপ্লুত হওয়ার জন্য। মনে হচ্ছিল, দুটো দলের ফাইনাল খেলা তো নয়, অনুপম বিশ্বাসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। গোপাল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাকুতি মিনতিতে সে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

রবিদাও বলেছিল, অনু যা, সব সারথিরই সাপোর্টার, তোর দারুণ ভক্ত। ওদের নিরাশ করিসনি। তোকে দেখার আশাতেই ওরা এসেছে। না গেলে তোকে অহঙ্কারী ভাববে।

অতগুলো লোক তাকে চিনে রেখেছে। কিন্তু চার বছরে কি তার মুখটা বদলায়নি? বা চার বছরে কি ওদের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসেনি?

সেও কি জনতার সেদিনের কোনও মুখ মনে করে রেখেছে? সবই তো এক রকম! গদগদ, কৃতার্থ, দাঁত বের করা, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কলম আর খাতা এগিয়ে..আহহ, একটা মুখ মনে পড়ছে, একটা মুখ।

রুগণ, লম্বাটে মুখ, ফরসা রং। পাতাকাটা চুল কপালে ঝুলে ছিল। ড্যাবড্যাবে চোখের মণি দুটো ঘন কালো। বছর বারো বয়স হবে। ওরই বয়সি অনেকে অটোগ্রাফ নিচ্ছে দেখে বোধ হয় ইচ্ছে হয়েছিল। একটা হ্যান্ডবিল কুড়িয়ে এনে তার সাদা উলটো পিঠটা এগিয়ে ধরেছিল একটা পেনসিল হাতে নিয়ে। অনুপম তখন বিরক্ত হয়ে উঠেছিল সই দিতে দিতে। হ্যান্ডবিলটা দেখে তার মেজাজ রুক্ষ হয়ে উঠেছিল।

আমার নাম জানো?

ছেলেটি থতমত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গভীর, সরল, লাজুক চোখ।

আমি কোন ক্লাবে খেলি জানো?

ছেলেটির মুখে হাসি ফুটেছিল। আপনি অনুপম বিশ্বাস, সারথি সঙ্ঘে খেলেন।

কোন পজিশানে?

ছেলেটির চোখে বিড়ম্বনা ফুটে উঠেছিল। আমতা আমতা করছে, তখন দুষ্টুমি করেই একজন ফিসফিসিয়ে ছেলেটিকে বলেছিল, বল, গোলে খেলেন।সঙ্গে সঙ্গে ও বলে ওঠে, আপনি তো গোলকিপার।

হোহো করে তাকে ঘিরে থাকা ভিড়টা হেসে উঠেছিল আর অনুপমের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। তাকে চেনে না এই বয়সি একটা ছেলে? তা হলে তার কীসের নাম, কীসের খ্যাতি! এতগুলো হাসি যেন তাকেই বিদ্রুপ করে উঠল।

হ্যান্ডবিলটা মুঠোয় দলা করে পাকিয়ে ছেলেটির কপালে সে ছুড়ে মেরে বলেছিল, আমি কে, সেটা আগে জেনে এসো, তারপর সই নিয়ো…অটোগ্রাফ বুকে, এ রকম বাজে কাগজে নয়।

ড্যাবড্যাবে চোখের সেই অপ্রতিভ চাহনিটা টিভি রিপ্লের মতো অনুপমের স্মৃতিতে ফিরে এল মন্থর গতিতে। ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সই নেওয়ার জন্য জায়গা করে দু-তিনজন এগিয়ে এসেছে। চোখের কোণ দিয়ে সে দেখেছিল, পায়ে পায়ে ছেলেটি ভিড়ের বাইরে চলে গেল। গোপালরা তাকে ভিড় থেকে উদ্ধার করে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটি তার মুখোমুখি পড়ে যায়। তাকে দেখে রুণ মুখটায় লাজুক হাসি ফুটিয়ে ও অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।

জীবনে প্রথমবার অপমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার বিস্ময়ই কি ছেলেটির চাহনিতে ছিল? অবাক হয়ে দেখছিল কি অভব্যতা, দাম্ভিকতার প্রতিমূর্তিকে?

চার বছরে এখন ছেলেটি কিশোর। এতদিনে সে কি জেনেছে অনুপম বিশ্বাস কে?

ঝাঁঝি আর কচুরিপানা পুকুর থেকে তুলে পাড়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো থেকেই আঁশটে সোঁদা গন্ধটা আসছে। তাঁবুর মধ্যে দরজা জানলা বন্ধ অবস্থায় এইরকম একটা গন্ধ তার লেগেছিল। অতগুলো মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস আর ঘাম থেকে, তাঁবুর ওপর এসে পড়া ইট, কাঠ, লোহার টুকরো থেকে, ভয়ার্ত ফিসফাস আর বাইরে থেকে আসা বীভৎস চিৎকার আর গালিগালাজ থেকে একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে উঠেছিল, যার মধ্যে অনুপম এই পুকুরপাড়ের গন্ধটা পেয়েছিল।

কে একজন তখন বলেছিল, শুধু অনুপমকে এর জন্য দায়ি করছ কেন? সবাই তো ক্লাবটাকে ডুবিয়েছে।

সবাই বলতে কাকে বোঝাচ্ছিস?

তুমি, আমি, প্লেয়াররা, অফিসিয়ালরা। যে যার নিজের স্বার্থ আগলাতে গিয়ে এমন সব আশকারা প্লেয়ারদের দিয়েছে, এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে ডোবাবার জন্য…

থাক, থাক, এখন এই নিয়ে ঝগড়া করার সময় এটা নয়।… যা কখনও হয়নি তাই হল আজ, মানুষ খেপে উঠে মানুষ মারল।

ইচ্ছে করে মারেনি। ভিড়ের চাপে, পায়ের চাপে..ওরা পালাতে যাচ্ছিল।

ধোঁয়া দেখেছিলাম, আগুন লাগিয়েছে কোথাও।

পুলিশের উচিত হয়নি গ্যালারিতে উঠে লাঠি লার্জ করা।

না করলে অবস্থা কী হত জানিস? সারথির একটা প্লেয়ারও প্রাণ নিয়ে মাঠ থেকে বেরোতে পারত না।

কিন্তু এখন আমরা বেরোব কী করে? পুলিশ কী করছে?

অনুপমের তখন ভোঁতা হয়ে পড়ছিল মানসিক প্রখরতা। পেশিগুলো যেন জরাগ্রস্ত। ঝিমুনি এসেছিল। চোখ আর খুলে রাখতে পারছিল না। তবু সে বাস্তব পরিস্থিতিকে মন থেকে ছিটকে যেতে দেয়নি। সে বুঝে নিয়েছিল। তাকে সবাই বলির পাঁঠা করবে। জল্লাদের সামনে তাকেই ঠেলে দিয়ে সবাই বাঁচতে চাইবে।

পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তাটা এবার ধনুকের মতো ঘুরে গেছে। এইটুকু পথ আসতে কতটা সময় লাগল? অভ্যাস মতো বাঁ হাত তুলল ঘড়ি দেখার জন্য। কোথায় পড়ে গেল কে জানে!

বাতাস বইছে না, তাই কনকনে ঠাণ্ডা ভাবটা নেই। হাঁটুর ওপরে হাত বুলিয়ে দেখল ফুলে উঠেছে কি না। ব্যথা হবে, কাল সকাল থেকেই বুঝতে পারবে আঘাতটা কত জোরে হয়েছে। আজ রাতেই ঠাণ্ডা-গরম করতে পারলে ভাল হয়। অনুপম ধীরে ধীরে, যতটা সম্ভব হাঁটু না ভেঙে হাঁটতে লাগল।

কীসের যেন শব্দ হল।

রাস্তার কিনারে খাড়াই ঢাল নেমে গেছে পুকুরে, এই সময় পুকুরে জল প্রায় থাকে না। ঢালে আগাছা ঝোপ আর একটা পাতা ছাড়া মাঝারি আকারের গাছ। এই ঢালে গুঁড়ি মেরে কেউ থাকতে পারে।

দরদরিয়ে ঘেমে উঠল অনুপম। কেউ কি রয়েছে! একজন, দুজন বা তিনজন। জানল কী করে আমি এখান দিয়ে রবিদার বাড়ি যাব। ফলো করেছিল? শিবের চত্বরে যখন বসে ছিলাম, তখন কেউ দেখে থাকবে, হয়তো সেই সাইকেলওয়ালাই। তারপর অন্য কোনও পথ ধরে এইখানে এসে অপেক্ষা করছে।

পিটিয়ে খুন করার পক্ষে জায়গাটা চমৎকার। একদিকে ফাঁকা জায়গা, বড় বড় গাছ ঘেরা কয়েকটা পাকা বাড়ি, অন্যদিকে পুকুর। নির্জন, অন্ধকার। চিৎকার করলে কোনও বাড়ি থেকে কেউ ছুটে আসবে না। কুকুরগুলো দু-চারবার ঘেউ ঘেউ করবে মাত্র।

আবার সরসর শব্দ হল। ঝোপ যেন নড়ে উঠল। চোখের ভুলও হতে পারে। অনুপম কাঠ হয়ে গেছে। কোনও মানুষ, নাকি জানোয়ার? ইঁদুর, বেড়াল, সাপ, গিরগিটি, শেয়াল কিংবা ছোটখাটো চিতাবাঘ! বুক আর পিঠ বয়ে ঘাম নামছে। মনে হচ্ছে পিঁপড়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।

ছুটব কি? অনুপম কুঁজো হয়ে বাঁ পা বাড়াল রেসে স্টার্ট নেওয়ার ভঙ্গিতে। কিন্তু কতটা ছুটে পালাতে পারব? রাস্তাটা বেঁকে পুকুর ঘুরে আর একটু গেলেই রবিদার বাড়ি দেখা যাবে। তার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেলবে। এখন তার থেকেও জোরে দৌড়তে পারবে যে-কেউই, একটা বাচ্চা ছেলেও।

অনুপমের চেতনা জুড়ে হঠাৎই একজোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ ভেসে উঠল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই দুটো চোখের দিকে। নিস্পাপ, সরল, গভীর দৃষ্টি মেলে যেন বুঝতে চেষ্টা করছে, তার অপরাধটা কী? সেও তো আর সকলের মতো সই নিতেই গিয়েছিল। সই নেওয়াটা তো শ্রদ্ধা, অনুরাগেরই প্রকাশ!

চার বছর ধরে কি মনে করে রেখে দিয়েছে! চার বছরে মানুষ কত বদলায়। অনুপম কান আর চোখ তীক্ষ্ণ করে ঝোপের দিকে তাকাল। মনে হচ্ছে না ওখানে কোনও মানুষ আছে। থাকলে এতক্ষণে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। চার বছর সে নিজেও কত বদলে গেছে, ছেলেটাও নিশ্চয়ই কঠিন, নিষ্ঠুর, হিংস্র পরিবেশের থেকে রেহাই পায়নি।

অনুপম এগোতে লাগল। একটা টালির বাড়ি। একটা জানলা আধভেজানো। হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। ঠং করে বাসন রাখার শব্দ এল। সে আশ্বস্ত বোধ করল। মিছিমিছিই ভয় পাচ্ছিল এতক্ষণ। এতদূর পর্যন্ত ধাওয়া করে কে আসবে তাকে মারতে? কী জন্যই বা তাকে মারবে? আটজন মারা গেছে, এটা খুবই দুঃখের। কিন্তু সেজন্য তাকে কেন দায়ী করা হবে, সে কি নিজের হাতে তাদের মেরেছে? তাকে মারধোর করে কী লাভ, হারা ম্যাচটা কি তাতে জেতা যাবে? তাকে মেরে ফেললে সারথির ট্রফি জেতার রাস্তা পরিষ্কার হবে?

যত্তসব আজেবাজে ভয়। অনুপম নিজের মনে বিড়বিড় করে মুখ তুলে রবিদার বাড়ির দিকে তাকাল।

ব্যাপার কী, সদর দরজার দু ধারে বসার জন্য সিমেন্টের রক। তার ওপরের বাটা এত রাতে জ্বলছে যে! দোতলায় দক্ষিণের দুটো ঘরের খোলা জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, বারান্দাটা অন্ধকার। একতলার ঘরের জানলা বন্ধ, ভেতরে আলো জ্বলছে। গ্রিল ঘেরা বাইরের দালানটাও অন্ধকার। সদরের কাঠের দরজা আর কোলাপসিবল গেট পুরো বন্ধ নয়। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসছে না। এত রাত্রে অন্ধকারে গ্রামের মধ্যে আলো-জ্বলা অথচ নিঝুম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনুপম হতভম্ব হয়ে গেল। তার মনে হল, কিছু একটা ঘটেছে আর সঙ্গে সঙ্গে সে দু পা। পিছিয়ে গেল।

রবিদার বাড়ি কি ওরা অ্যাটাক করেছিল! হতে পারে। অনুপম বিশ্বাসের আত্মীয় বলে হয়তো আক্রোশে রবিদাকেই মারধোর করেছে। অবশ্য রবিদা এখানকার নানান ব্যাপারে টাকা খরচ করে। খুবই জনপ্রিয়, নির্বিরোধ, আমুদে। কিন্তু মানুষকে তো এখন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। দুলোদা তাকে তো প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল।

অনুপম সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। বাঁ দিকে দোতলার সিঁড়ি। রবিদা আর বউদি দোতলায় থাকে। একতলায় এক দম্পতিকে চার বছর আগে সে ভাড়া থাকতে দেখেছিল। হয়তো এখনও তারা রয়েছে। কিন্তু অন্য কেউ…ওরা কেউ আছে কি না সেটা বুঝে নিতে হবে। এই সময় সদর দরজা খোলা। আলো-জ্বলা যথেষ্ট অস্বাভাবিকই।

অনুপম বাড়ির বাইরে এসে প্লাস্টার না-হওয়া পাশের একতলা বাড়ির দিকে এগোল। রবিদার বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া নিচু পাঁচিল, ঘরের জানলায় পরদা, ভেতরে আলো জ্বলছে। এদেরও বাইরের দালানে গ্রিল দেওয়া। ভেতরে যাওয়ার দরজাটা খোলা। বাড়ির ছাদে অ্যান্টেনা নেই দেখে সে আশ্বস্ত হল।

বয়স্কার গলার শব্দ ভেতর থেকে ভেসে এল, বউমা, দালানের দরজাটা বন্ধ করে দাও, সন্তু এলে বরং খুলে দিয়ো..দ্যাখো আজ আর ফেরে কি না।

সরে এল অনুপম। এই বাড়ির সন্তু নামে কেউ এখন বাইরে। রবিদার ওপাশের বাড়িটা একটু তফাতে, জঙ্গুলে একটা পোড়ো বাগানের মধ্যে। ইট বের করা, জরাজীর্ণ। ভাঙা দোতলা বাড়ি। তেঁতুলতলারই একদা ধনী, প্রাচীন কোনও পরিবার থাকে।

কে?

অনুপম চমকে উঠে থরথরিয়ে কাঁপল। দোতলা থেকে কেউ থাকে লক্ষ্য করেই বলল। মুখ তুলে রবিদার বারান্দায় সে আবছা একটা মাথা দেখল। আপনা থেকেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, রবিদা আছে? আমি অনু।

মাথাটা সরে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর আর-একজন এল ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ঝুঁকে তাকে দেখেই ওহ নাহ্ ধরনের একটা শব্দ করে বলল, অনু ঠাকুরপো!… ওপরে চলে এসো, তাড়াতাড়ি।

শুনেই কেঁপে উঠল অনুপম। কী রকম যেন চাপা ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে তাড়াতাড়ি শব্দটা তার দিকে ছুড়ে দিল!

আবার সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দোতলার সিঁড়ির দিকে ঘুরতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একতলায় ভাড়াটেদের দরজা অল্প ফাঁক করে একটি বছর চারেকের শিশু দাঁড়িয়ে, তার পেছনে একটি বউ, বোধ হয় ওর মা।

বউটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছ্যাঁত করে উঠল অনুপমের বুক। একটা অসহায় করুণ আর্তি নিয়ে দুটি চোখ তার কাছে কিছু যেন জানতে চাইছে।

চার বছর আগে এই বাড়িতে কয়েক ঘণ্টার জন্য থাকলেও নীচের ভাড়াটেদের সে। দেখেনি। বউটিকে সে এই প্রথম দেখল। শিশুটি এক পা পিছিয়ে শাড়ির আঁচল ধরল। টানা টানা চোখ দুটি ঘুমের ভারে শ্রান্ত। এখনও বাচ্চাটা ঘুমোয়নি কেন?

কোনও খবর পেলেন? ব্যাকুল কিন্তু মৃদু স্বরে জানতে চাইল বউটি। অনুপম বিভ্রান্ত হল। কারও জন্য অপেক্ষা করছে বোধ হয়।

কীসের খবর?

আপনি কি ওদের সঙ্গে কলকাতায় গেছলেন?

অনুপমের সিক্সথ সেন্স সজাগ হয়ে উঠল। তার মনে হল, কিছু একটা ঘটেছে এখানে, যে জন্য এত রাতেও আলো জ্বলছে, সবাই জেগে। নিশ্চয়ই কোনও বিপদ-আপদ।

না তো! অনুপম চোখের কোণে দেখল সিঁড়ির বাঁকে মুখ বাড়িয়ে বউদি হাতছানি দিয়ে তাকে ওপরে আসতে ইশারা করছে।

না, আমি তেঁতুলতলার লোক নই।

কথাটা বলেই অনুপম সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাঁ হাঁটু ভাঙতে না পারায় ঠোক্কর খেয়েছে। অপ্রতিভ হয়ে পেছন ফিরে দেখল দু জোড়া চোখ দরজার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। অবসন্ন, হতাশ, উদ্বেগে কাতর আর কৌতূহলী বিস্ময় নিয়ে সারল্যে ভরা দু রকম চাহনি। অনুপম হাসল, যে হাসির কারণটা সে নিজেও জানে না।

সিঁড়ি থেকেই বউদি হাত ধরে তাকে টেনে ঘরে নিয়ে এল।

কী ব্যাপার বউদি, রবিদা কোথায়?

চুপ, আস্তে। তোমার দাদা পাড়ার দুজনকে নিয়ে কলকাতায় গেছেন।

বউদির ত্রস্ত চোখ খোলা জানলায় গিয়ে পড়ল। জানলার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ানো ফ্ৰকপরা কিশোরীটিকে ধমক দিয়ে বলল, অমন হাঁ করে কী দেখছিস, রান্নাঘরটা ধুয়ে পরিষ্কার কর।

করেছি।

তা হলে দালানে গিয়ে বোস, ঘুমোসনি। সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়, কতক্ষণ আর ভোলা রাখা যায়। আলোটা জ্বালাই থাক আর রাস্তার দিকে নজর রাখিস। মেসোমশাইরা কখন ফিরবেন কে জানে!

অনুপম বিমূঢ়ের মতো বউদির কথা শুনে যাচ্ছিল আর নিশ্চিত হচ্ছিল, বড় ধরনের কোনও বিপর্যয় এই বাড়িতে আজ ঘটে গেছে। কী সেটা?

নিয়তির কী পরিহাস ঠাকুরপো, তুমি কিনা আজই এলে?

কী হয়েছে?

বউদি যে ভাবে খাটের ওপর বসে পড়ল তাতেই অনুপম বুঝল টেনশনটা আর নিতে পারছে না।

না এলেই ভাল হত, তোমার আর আমাদের…সবারই একদিক থেকে ভাল হত। এখন সমস্যাটা আরও বেড়ে গেল।

হয়েছে কী, সেটা তো আগে বলবে? আমি খুব বিপদে পড়েই এখানে এসেছি। তোমাদের যদি কোনও অসুবিধে হয় আমি চলে যাব, আজ রাতটা থেকে কাল ভোরেই চলে যাব।

ঘরের একধারে টেবল আর চেয়ার। অনুপম চেয়ারটার দিকে এগোবার সময়। খোঁড়াল। বউদি সেটা লক্ষ করে বলল, কী হয়েছে পায়ে?

লেগেছে…লোহার রড দিয়ে মেরেছে।

চাপা আর্তনাদ করল বউদি।

কখন, কোথায়…মাঠেই?

হ্যাঁ।

অনুপম চেয়ারে বসে আলতো স্বরে আহহ বলল। অনেকক্ষণ পর হাঁটুটা ভারমুক্ত হল।

খুব কি গোলমাল হয়েছে?.. অনেক লোক নাকি মারা গেছে? বউদি ঝুঁকে ফিসফিস করে এমন ভাবে বলল, যেন কোনও গুপ্তকথা ফাঁস করে দিচ্ছে।

আমি দেখিনি, দেখার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। পরে শুনেছি আটজন নাকি স্পট ডেড। ভয়ে পালাতে গিয়ে ভিড়ের চাপে আর পায়ের নীচে পড়ে…আর বহু লোককে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

কোন হাসপাতালে?

বোধ হয় পিজি-তে। আমার তখন ওসব খবর জানার মতো অবস্থা ছিল না বউদি, আমি নিজেই তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলাম। দেখছনা, নিজের ঘরে কি আর কোথায় না গিয়ে তোমাদের এখানে এসেছি রাতের অন্ধকারে…একটা চোরও আমার থেকে এখন অনেক নিরাপদ, কেননা কেউ তাকে চেনে না বা দু-চারজন চেনে। সে সাহসভরে রাস্তায় হাঁটতে পারবে কিন্তু আমি পারব না। আমি বিখ্যাত। আমার ছবি বহুবার কাগজে, ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে, টিভিতে কতবার দেখানো হয়েছে। সারা দেশ আমার মুখটা চেনে। আমাকে এখন মানুষের চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে, লুকিয়ে থাকতে হবে…তাই তো এখানে চলে এলাম।

একটানা কথাগুলো বলে অনুপম উত্তেজিত হয়ে উঠল। ঝুঁকে, ব্যগ্র চাহনিতে বহু ধরনের প্রশ্ন রেখে সে বউদির দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এখানে আজ তাকে আশ্রয় দেওয়া হবে কি না।

এমন হল কেন? আগের মতো ফিসফিস স্বরে বউদি বলল, তোমার এত নাম, যশ, সম্মান, হাজার হাজার লোকের এত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, টাকাও যথেষ্ট করেছ, তবু কেন আজ এই দশায় পড়লে?…তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালাতে হচ্ছে কেন?

জবাব না দিয়ে অনুপম শুধু চোখের পাতা টেনে নামাল। কী বলবে সে মাঠ থেকে বহু দূরে জীবনযাপন করে এমন এক গৃহস্থ বউকে! কেন, কেন, কেন…সব কেনর কি উত্তর হয়? একটা ফুটবলার কি সারাজীবন একই পর্যায়ে ফর্ম রেখে খেলে যেতে পারে? এটা কি রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা?

জানো, আজ কী ব্যাপার হয়েছে?

অনুপম সন্ত্রস্ত হয়ে গেল বউদির কণ্ঠস্বরে। তার মন বলছে, কিছু একটা ঘটেছে যার সঙ্গে সে সরাসরি না হলেও জড়িত। ভাল নয়, আজ কিছুই তার পক্ষে ভাল নয়। সর্বনেশে কিছু একটা বউদি তাকে বলবে।

কী হয়েছে। অনুপমের গলা বসে গেল। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে শুধু। সে বলতে চাইছিল—আমার জন্যই কি?

নীচের ভাড়াটে, প্রদীপবাবু…প্রদীপ হালদার, দেখেছ কি ওকে?

না। অনেক লোেক সেদিন আলাপ করতে এসেছিল, মনে হয় না তোমাদের ভাড়াটে বলে রবিদা কারও সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছিল।

তখন সবে এসেছে বউ আর সঙ্গে চার মাসের ছেলে। অফিসের পরীক্ষায় পাশ করে আমাদের এখানকার ব্যাঙ্কেই প্রথম পোস্টিং। চাষিদের লোনটোন দেওয়ার ভার ওর ওপরেই। খেলাধুলোয় কোনও আগ্রহই নেই। তোমার দাদা ওর কাছে তোমার কথা বলতেন। একদিন বলল, দেবেন তো একটা টিকিট, একদিন আপনার ভাইয়ের খেলা দেখে আসব। তাই তোমার দাদা টিকিটটা ওকে—

আজ খেলা দেখতে গেছল। বউদিকে শেষ করতে না দিয়ে অনুপম নিজেই কথাটা সম্পূর্ণ করে তিক্ত মুখে তাকিয়ে রইল।

হ্যাঁ।

এখনও বাড়ি ফেরেনি।

না।

দুজনেই চুপ করে রইল। একটা ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় ছেয়ে গেল দুজনের ভাবনা। যে আটজন মারা গেছে তাদের মধ্যে হয়তো প্রদীপ হালদার রয়েছে।

কখনও বড় ম্যাচ দেখতে মাঠে যায়নি?

ছোট কি বড় কোনও ম্যাচই নয়, জীবনে এই প্রথম কলকাতার মাঠে খেলা দেখতে গেল। কী বিচ্ছিরি একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লুম বলো তো। টিকিট দিয়ে তোমার দাদাই তো পাঠিয়েছিলেন। কে জানত যে, এই রকম একটা কাণ্ড খেলার মাঠে ঘটবে।

বউদি অসহায় চোখে অনুপমের দিকে তাকাল। চোখ সরিয়ে সে দরজার দিকে রাখল। তারপর মুখ ফিরিয়ে ট্রলির ওপর রাখা টিভি সেটটায় দৃষ্টি নিবন্ধ করল।

টিভিতে খেলা দেখেছিলে?

তোমার দাদা আর পাড়ার কয়েকজন দেখছিলেন।

মাঠে গোলমাল দেখিয়েছে।

আমি তো খেলা দেখিনি, ওসব কিছু বুঝিটুঝি না, দেখিয়েছে কি না বলতে পারব। নীচে মণির সঙ্গে, প্রদীপের বউ, ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন। ওপরে খুব হইচই চেঁচামিচি হচ্ছিল, তারপর কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। তোমার দাদা গুম মেরে বারান্দায় বসে রইলেন।

তা হলে মাঠে যে গোলমাল হয়েছে সেটা জানলে কী করে?

সাতটা নাগাদ গোপাল আর কজন খেলা দেখে ফিরে এসে মাঠের ঘটনা বলতেই তো আমরা জানলুম। শুনে তো আমার রক্ত জল হয়ে গেল। পঞ্চাশ-ষাটজন নাকি পায়ের চাপে থেতলে মারা গেছে। তারপর কী খারাপ খারাপ কথাই না ওরা তোমার সম্পর্কে বলল যে…

রবিদা শুনে কী বলল?

অনুপম জানতে চায়, তার পক্ষ নিয়ে অন্তত একজনও বিরোধিতার সামনে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। রবিদা ছাড়া আর কেউ যে এখন তার সহায় হবে না, এমন একটা আশা নিয়ে সে প্রশ্ন করল।

উনি আর কী বলবেন, মুখ বুজে সব শুনে গেলেন! ওরা চলে যাওয়ার পর বললেন, অনুর জন্যই আজ মাঠে এতগুলো নিরীহ লোক মারা গেল। এখানকার লোকে বলবে, আমার ভায়ের জন্য একটা মেয়ে আর তার বাচ্চা পথে বসল। আজীবন এই কথা শুনতে হবে।

এই কথা বলল রবিদা!

হ্যাঁ। বললেন, এখন আমি ঘরে বসে থাকলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাবে, অমানবিক হবে। আমিও বললাম, খোঁজ নিতে যাওয়া তোমার কর্তব্য, দোষের ভাগী তো তুমিও।

অনুপম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কপালে ঘামের বিন্দু ফুটছে। মাথার মধ্যে হাজার হাজার গলায় তালগোল পাকানো চিৎকার ওঠানামা করছে। মনে মনে সে আউড়ে গেল, ভুল করেছি, মারাত্মক ভুল করেছি এখানে এসে।

ঠাকুরপো আজ তোমার এখানে আসা কেন জানি ভাল ঠেকছে না। প্রদীপের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে কী যে এখন হচ্ছে। ওরা ভাল খবর আনুক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করে যাচ্ছি।

নীচে সিঁড়িতে কার গলার শব্দ শোনা গেল। অনুপম চকিতে বউদির দিকে তাকিয়ে দেখল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

কে? রবিদার গলা তো নয়!

বুঝতে পারছি না। দেখছি। বউদি ব্যস্ত পায়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় দরজার পরদাটা টেনে দিল। অনুপম প্রায় লাফিয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়েই ভাবল স্টিলের আলমারিটার আড়ালে দাঁড়াবে কি না।

একটু পরেই বউদি ফিরে এল। ঘর অন্ধকার। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুপমকে উদ্দেশ করে বলল, আলো নেভানোই থাক। তুমি এখন ঘরের বাইরে এসো না। কাছেই থাকে একটা ছেলে, খোঁজ নিতে এসেছিল। বলল, বাজারে স্টেশনারি দোকানের মালিকের ছোট ভাই খেলা দেখতে গেছল, সেও ফেরেনি। তোমাদের দুজন প্লেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর গড়ের মাঠের অনেক জায়গায় নাকি নিরীহ লোকদের ধরে ধরে মারা হয়েছে, চৌরঙ্গিতে অনেক দোকান ভাঙচুর করে লুটপাট হয়েছে, ট্রামে বাসে ঢিল মেরেছে। আমাদের সাবধানে থাকতে বলল।

তোমাদের এখানে আর কী হবে?

হবে না, একথা বোলো না। বউদির স্বরে আতঙ্কের ছোঁয়াটা স্পষ্ট বোঝা গেল। তোমার দাদা পঞ্চমুখে এখানকার লোকের কাছে তোমার খেলা সম্পর্কে যে প্রশংসা করেন…

যে কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল তা বুঝে নেওয়ার মতো বুদ্ধি অনুপম এখনও হারায়নি। তার এখানে আসাটা বউদি পছন্দ করেনি। গৃহকত্রীর অপছন্দ সত্ত্বেও আজ রাতটা অন্তত তাকে এখানে থাকতে হবে।

আমি কালকেই চলে যাব। এখানে রয়েছি, এটা জানাজানি হওয়াই উচিত। কেউ আমাকে এখানে আসতে দ্যাখেনি সুতরাং তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

অন্ধকারে সে বুঝতে পারল না, তার কথা শুনে বউদির মুখে কতটা স্বস্তি ফুটে উঠল।

না, ভয় আমি পাচ্ছি না। ভয় এখন তোমাকে নিয়ে। এখানে দুদিন ধরে ছেলেধরার কথা শোনা যাচ্ছে। গ্যাঁদালপাড়ায় কার ছেলেকে নাকি ফুল শুকিয়ে অজ্ঞান করে পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে গেছে। আর একটা বাচ্চাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দোকানে বিস্কুট কিনছিল। দোকানির সন্দেহ হওয়ায় দু-চারটে প্রশ্ন করতেই লোকটা সাইকেল চেপে পালায়। অচেনা অপরিচিত লোক দেখলেই এখানে ঘিরে ধরছে।

আর যাই হোক ছেলেধরা বলে আমাকে অন্তত এখানকার লোেক পিটোবে না। তবে তোমরা যাতে হ্যারাশমেন্টের টার্গেট না হও, সেটাই এখন দেখা দরকার। রবিদা কখন বেরিয়েছে?

গোপালরা এসে বলার পরই উনি আমাকে বললেন, দ্যাখো তো প্রদীপ ফিরেছে কি না। নীচে গিয়ে দেখলুম ফেরেনি। মণি বলল, তাড়াতাড়িই ফিরবে বলে গেছে। ওঁকে নিয়ে দোকানে গিয়ে ফ্রিজ পছন্দ করে আসার কথা বলে সেজেগুজে অপেক্ষা করছেন। তারপর নটা যখন বাজল তোমার দাদা বললেন, ভাল মনে হচ্ছে না, বেরিয়ে একটু খোঁজখবর করি। পাশের বাড়ির সন্তুকে গিয়ে বললেন, তারপর আরও দু তিনজনের সঙ্গে কথা বলে, এখানে প্রাইভেটে ভাড়া খাটায় একজন, তার গাড়িতে সন্তুকে নিয়ে উনি কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন। বললেন, আগে লালবাজারে খোঁজ নেবেন, তারপর হাসপাতালে।

অনুসন্ধিৎসু হয়ে অনুপম কোনও প্রশ্ন করল না। করার কিছু নেইও। প্রদীপ হালদার আটজনের একজন হতে পারে, নাও পারে। আহতদের মধ্যে থাকতে পারে, নাও পারে। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এই নিয়ে ভেবে তার নিজের সঙ্কটের কোনও সুরাহা হবে না।

বউদি, তোমার ফ্রিজ চলছে?

হ্যাঁ, কেন?

বরফ চাই আর গরম জল, পাওয়া যাবে? রডটা হাঁটুতে লেগে মুশকিলে ফেলেছে, ভাল করে চলতে পারছি না। তোমাদের বাজারের কাছাকাছি শিবতলায় একজন মোটরে নামিয়ে দিয়ে গেল, সেখান থেকে হেঁটে আসছি। এখন আর হাঁটু ভাঙতে পারছি না। পেলে একটু ঠাণ্ডা-গরম লাগাতাম।

এখুনি বরফ আর গরম জল দিচ্ছি। বউদি ঘর থেকে বেরিয়ে পঞ্চি, এই পঞ্চি, বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

অন্ধকার ঘরে দুই তালুতে মুখ ঢেকে, সামান্য কুঁজো হয়ে অনুপম বসে রইল। এই মুহুর্তে তার অতীত ও ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছু নেই। বর্তমানটা তালগোল পাকিয়ে একটা ফুটবলের রূপ নিয়েছে, যেটা নিয়ে খেলতে তার কোনও আগ্রহ নেই।

অতীতের দিকে কত দূর পর্যন্ত অনুপম এখন যাবে? রবিদার সময় পর্যন্ত? যখন রবিদা তাদের বাড়িতে থাকত। বিদ্যুৎপুর স্পোর্টিং ক্লাবের মাঠে গোল পোস্টের পেছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখত একটা কারণেই। খেলার উদ্দেশ্য গোল দেওয়া, তাই বল মারা হত গোলের দিকে। বেশির ভাগ বল গোলের বাইরে দিয়ে চলে যেত। অনুপম দৌড়ে কুড়িয়ে এনে হাই কিক করে সেটা মাঠের ভেতর পাঠিয়ে দিত। শুধু এই কিকটা করার উত্তেজনা বা সুখ পাওয়ার লোভ তাকে বল কুড়োনে অনু নামে স্কুলে চিহ্নিত করে।

বড়দের মাঠের লাগোয়া ছোট জমিটায় খেলত ছোটরা। অনুপমের ফুটবল খেলার শুরু সেখান থেকেই। কী করে ফুটবল খেলতে হয় সেটা একজনও তাকে শেখায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই খেলাটা তার কাছে এসেছে। বড়দের খেলা দেখে দেখে, বিশেষ করে রবিদার, সে অনুকরণের চেষ্টা করত। বড়রা মাঝেমধ্যে কলকাতায় গিয়ে খেলা দেখে এসে সেই ভাবে খেলতে চাইত। তবে তাদের মধ্যে ফুটবল খেলে প্রতিষ্ঠা অর্জনের কোনও চিন্তা ছিল না।

খেলার আগে যখন দুটো দল তৈরির জন্য ছেলেরা জড়ো হত, তখন মুশকিল হত অনুপমকে নিয়ে। দু দলই তাকে চাইত। তাই নিয়ে ঝগড়া, হাতাহাতিও হয়েছে। অনেকদিন তাকে দুই দলের হয়েই আধাআধি করে খেলে খুশি করতে হয়েছে দু পক্ষকে।

লাথালাথি, ঘুসি, খিমচে দেওয়া, এগুলো হতই। প্রায় সবাই ছিল তার থেকে বয়সে বড়। অনুপম বল ধরলেই পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বা পায়ের গোছে লাথি মেরে বা সররা কেটে ফেলে দিয়ে তাকে বলচ্যুত করাই ছিল বিপক্ষের অন্যতম সফল কাজ। প্রথম প্রথম সে খেপে উঠত, চিৎকার করত, খেলা ছেড়ে মাঠের ধারে গিয়ে বসে থাকত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সে মার খাওয়া থামাতে পারেনি।

একদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফিরল। রবিদা কারণ জিজ্ঞেস করে, সব শোনার পর শুধু বলেছিল, তুই মার খাচ্ছিস যেহেতু তুই ওদের থেকে ভাল খেলিস। যখন মার খাবি না তখন বুঝবি তুই খারাপ খেলছিস, সেটাই তখন দুর্ভাবনার বিষয়। যে যত বড় হয় ততই লোকে তার নিন্দেমন্দ করে, তার দোষ খোঁজে, তার পেছনে লাগে। এটা আমাদের স্বভাব। এবার থেকে তুই চেষ্টা কর নিজেকে বাঁচিয়ে খেলার।

রবিদার কথাগুলো তার যে কী উপকারে লেগেছিল সেটা অনুপম বহুবার মনে মনে স্বীকার করেছে ভারতের এক নম্বর মিডিও হয়ে। সেই বিদ্যুৎপুরের ছোটবেলার ফুটবল থেকেই সে জানতে পারে, হঠাৎ যদি নিজের দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। কিংবা বল ধরার সময়টাকে নিখুঁত আন্দাজে বুঝে নিয়ে যদি এগোয় তা হলে বিপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারবে। কখন তাকে মারতে আসবে, সেটা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাও সে ওই সময় পেয়ে গিয়েছিল।

লোকে এটাকেই তার সিক্সথ সেন্স বলে। এটাই তাকে আজ বাঁচিয়েছে, এটা কি তাকে কাল বাঁচাবে?

অবশ্যই তাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে। রবিদাকে হেনস্থা হতে হবে সে জন্য নয়। নীচের প্রদীপ হালদারের বউ আর বাচ্চাটির জন্যই তার এখানে থাকা সম্ভব নয়। ঘুরেফিরে মাঠের এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটার জন্য সব দায় তার ঘাড়েই চাপবে। দুলোদার কথাগুলো—আজ অনেকগুলো প্রাণ তুই নিয়েছিস, আমৃত্যু তার কানে ফিসফিস করে যাবে। সব মৃত্যু, সব আঘাত, সব ক্ষয়ক্ষতির দায় তাকেই বইতে হবে। কারণ গোল থেকে বারো গজ দূরে বসানো একটা বলে সে যে শটটা নিয়েছিল সেটা বারের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়।

অনুপমের মুখ থেকে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ গোঙানির মতো বেরিয়ে এল। সেটা হাঁটুর ব্যথার জন্য হতে পারে। সে অন্ধকার ঘরে এধার-ওধার তাকিয়ে টিভি সেট, খাট, আলমারি, টেল ছাড়া আর কী কী আছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। এত অন্ধকার, কিছুই আন্দাজে আসছে না। অথচ পরদার তলা দিয়ে দালানের আলো সে দেখতে পাচ্ছে। কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে।

অনুপম এটুকু বুঝতে পারল, তার ইন্দ্রিয়গুলো একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি।

বউদি ঘরে এসে আলো জ্বালল। বেরিয়ে গিয়ে আবার ঢুকল ডেকচি হাতে। তাতে গরম জল থেকে ধোঁয়া উঠছে।

বরফ ভাল জমেনি। দুপুর পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল। ধারেকাছে কারও বাড়িতে ফ্রিজও নেই যে, আনিয়ে নেব।

ঠাণ্ডা জল থাকে তো তাতেও হবে। দুটো বালতি আর একটা মগ দাও…জলটা বড্ড গরম, এতে একটু ঠাণ্ডা জল ঢেলে দাও।

অনুপম উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ে জোর পেল না। চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে অপ্রতিভ হেসে বলল, রেস্ট পেলেই ঠিক হয়ে যাবে। এসব আমার অভ্যেস আছে।

বউদি অনুপমের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বোধ হয় খিদে পেয়েছে ঠাকুরপো।

না, না, একদম নয়। আজ রাতটা উপোস দেব, শরীর ফিট থাকবে। যদিও ঘণ্টা দশেক তার পাকস্থলীতে শক্ত কোনও খাদ্য পৌঁছয়নি তবু অনুপম বিন্দুমাত্র খিদে বোধ করছে না।

বউদি বালতি, মগ, তোয়ালে, ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জল ভরা দুটো বোতল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে এনে দিয়ে বলল, মেঝেয় যদি জল পড়ে তো পড়ুক, আমি মুছে দেব। রাতে অল্পবয়সি বউটা বাচ্চা নিয়ে একা থাকবে, আমি এখন নীচে গিয়ে রাতটা ওর সঙ্গেই থাকব। বেচারা একেবারে…।

বউদিকে থামিয়ে অনুপম অসহায় এবং কিছুটা ভীত স্বরে বলে উঠল, আমি কোথায় থাকব। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই এই ঘরটা, বাইরের কেউ যদি এসে পড়ে?

বউদিকে বিচলিত দেখাল। সমস্যার এই দিকটা বোধ হয় ভেবে দ্যাখেনি। ইতস্তত করে বলল, কাজের মেয়েটা জিজ্ঞেস করেছিল তুমি কে হও। ও আগে তো তোমায় দ্যাখেনি। তুমি আমাকে বউদি বলছ তাই বাপের বাড়ির কেউ হও বলতে ভরসা হল না। আবার ওনার ভাই হও বললে যদি পঞ্চি বাইরে কারও কাছে বলেটলে বসে এই ভেবে তাও বলতে পারলাম না। শেষমেশ বললাম, তোর মেসোমশায়ের আলুর ব্যবসার একজন বড় খদ্দের, ভাইয়ের মতো। আলু নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছিল, টেম্পোটা উলটে গিয়ে পায়ে চোট লেগেছে তাই রাতটায় থাকতে এসেছে।

শেষকালে আলুর খদ্দের! তাকে এখন দেওর বা ভাই বলে পরিচয় দিতে ভয় পেল। মুহুর্তের জন্য অনুপমের মনে হল শিকড়হীন একটা গাছের মতো সে খাড়া রয়েছে। আঁকড়ে ধরার মতো জমি তার নীচে নেই। তার নিজের কেউ নেই, কিসু নেই।

পঞ্চি বোকাসোকা মেয়ে, যা বলবে বিশ্বাস করবে। কিন্তু ভেতর দিকে ঘর বলতে, কলঘরের পাশে একটা আছে, হাবিজাবি ভাঙাচোরা জিনিস রাখা হয়। থাকতে পারবে? তবে চট করে কেউ দেখে ফেলতে পারবে না।

খুব থাকতে পারব।

বউদি ইতস্তত করতে লাগল। অনুপম জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে।

খুব নোংরা হয়ে রয়েছে, আর একটা মাত্র জানলা।

চারটে দেয়াল আর মাথায় ছাদ আছে এমন যে-কোনও জায়গায় এখন আমি থাকতে পারব।

লোহার ফোল্ডিং খাটটা তা হলে বের করতে বলি পঞ্চিকে।

বউদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পনেরো পর পঞ্চি ঢুকল। খালি গায়ে তোয়ালে পরা অনুপমকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

মাসিমা কোথায়?

বিছানা করে মশারি টাঙাচ্ছে।

ঠাণ্ডা-গরম জলে সেঁক দিয়ে অনুপমের মনে হচ্ছে হাঁটুটা যেন একটু সহজ লাগছে। চেয়ারে বসে পা দুটো সামনে তুলে আবার নামাল। কয়েকবার করল। প্যান্টটা দু পায়ে গলিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে টেনে পরে নিল।

টেম্পোটা উলটোল কী করে? পঞ্চির কৌতূহলী প্রশ্ন।

খুব জোরে যাচ্ছিল। সামনে হঠাৎ একটা ছাগলছানা ছুটে আসতেই সেটাকে বাঁচাতে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আর ব্যস সঙ্গে সঙ্গে বে-টাল হয়ে কাত হয়ে পড়ল।

আলুগুলো কী হল?

বস্তার মধ্যে ছিল তাই আর ছড়িয়ে যায়নি।

আর যারা ছিল তাদের কী হল?

কিছু হয়নি। শুধু আমারই হাঁটুটায় লেগেছে। ওরা সব টেম্পোটাকে তুলে সোজা করে বসাল। বস্তাগুলো তুলল। কিন্তু গাড়ির একটা পাইপ ভেঙে গেছে, না সারালে চলবে না। ওরা মিস্ত্রি খুঁজতে গেছে, কখন ফিরবে কে জানে। আমি দেখলাম কাছেই দাদার বাড়ি তাই চলে এলাম।

মেসোমশাইও নীচের দাদাকে খুঁজতে বেইরেচে, এখনও ফেরেনি।…কখন ফিরবে কে জানে!

নীচের দাদা কোথায় গেছে? অনুপম প্রশ্নটা করেই ভাবল জিজ্ঞেস না করলেই ভাল হত। তাকে জড়িয়ে যে দুঃখের ঘটনা ঘটেছে বা হয়তো ঘটেনি, সেটা নিয়ে আর নাড়াচাড়ার দরকার কী! কিন্তু মনের গভীরে কী একটা অস্বস্তি খচখচ করে বিঁধে চলেছে, যে জন্য সে কৌতূহলও সংবরণ করতে পারছে না।

আজ কলকাতায় ফুটবল খেলা ছিল, খুব বড় খেলা! মেসোমশাইয়ের ভাই, সে খুব ভাল, নামকরা প্লেয়ার, সে খেলবে। আপনি জানেন না? এখান থেকে কত লোক খেলা দেখতে গেছে। আমাদের এখানে টিভি দেখতেও কত লোক এসেছিল। নীচের দাদা তো খেলা দেখতে কলকাতায় গেছে, এখনও ফেরেনি।

কেন? খেলা তো অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে।

সেইজন্যই তো এত ভাবনায় সবাই পড়েছে। পঞ্চি হঠাৎ গলা নামিয়ে দিয়ে যোগ করল, খেলার মাঠে আজ খুব মারপিট হয়েছে, অনেক লোক মরেছে। আপনি জানেন না?

না তো! তুমি জানলে কী করে?

এখানে সবাই বলছিল। মেসোমশাইয়ের ভাইয়ের জন্যই—

ঘরে ঢুকল বউদি।

পঞ্চি তুই শুতে যা। ঠাকুরপো এসো, ঘরটা দেখিয়ে দিই।

বউদি যে ঘরটিতে অনুপমকে নিয়ে গেল সেটি লম্বায় দশ ফুট, চওড়ায় আট ফুট। লোহার পাইপের নাইলন ফিতের খাটে তোশক পাতা। একটা নীল রঙের মশারি তিনদিকের দেয়ালে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার আর একদিকের দড়িটা দরজা বন্ধ করে ছিটকিনিতে বাঁধতে হবে। ঘরে এক হাত চওড়া দু পাল্লার একটা বন্ধ জানলা। ঘরে জ্বলছে একটা টিউব বাতি।

বাঁশের ধামা, চটের বস্তা, থাক দেওয়া খালি টিনের কৌটো, ক্যানেস্তারা থেকে পুরনো খবরের কাগজ, ছবির ফ্রেম, ভাঙা হ্যারিকেন, পুরনো ছেঁড়া জুতো এবং অন্যান্য জিনিসের একধারে খাটটা পাতা। ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই বললেই হয়।

ঘরে ঢোকা মাত্র অদ্ভুত একটা বোঁটকা গন্ধ অনুপমকে থমকিয়ে দেয়। সে কোনও ভাবান্তর প্রকাশ করেনি। এখন পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের সময় নয়। ভাগ্য যা দিচ্ছে সেটাই মুখ বুজে মেনে নেওয়া উচিত। সে ধনী বা সম্পন্ন পরিবারের সন্তান নয়। বিদ্যুৎপুরের বাড়িতে জন্ম থেকে যেভাবে থেকেছে সেটা এই গন্ধের মতো এতটা উৎকট না হলেও, মলিনতায়, অপরিচ্ছন্নতায় কাছাকাছিই।

কী করব বলো, ভাল ঘর দুটো বাইরের দিকে। বিচ্ছিরি লাগছে তোমাকে এখানে

অনুপম থামিয়ে দিয়েছিল, বউদিকে।

পাশেরটাই তো কল-বাথরুম, এটাই বিরাট লাভ। হাঁটতে বেশি হবে না। অনুপম এই বলে বউদির সঙ্কোচ কাটাতে চেষ্টা করেছিল।

বউদি চলে যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। তখন তার মনে পড়ল, কটা বাজে জিজ্ঞেস করা হল না। আলোর সুইচটা বোধ হয় ঘরের বাইরেই। জলতেষ্টা পেলে কলঘরে গিয়ে কল থেকেই খেতে হবে।

মশা আছে। ইতিমধ্যেই সে হাতে কামড় খেয়েছে। মশারি খাটিয়ে শুতে হবেই, কিন্তু কী দমবন্ধ করা গরম এই ঠাণ্ডার দিনেও! বোধ হয় বস্তাগুলোর জন্যই।

হাতড়ে হাতড়ে সে খাটটার অপর ধারে গিয়ে জানলায় হাত রাখল। ছিটকিনি তুলে ঠেলা দিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার জন্য পাল্লা দুটো আটকে গেছে। জোরে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতেই শব্দ করে আছড়ে খুলে গেল।

ঠাণ্ডা বাতাস সারা মুখে যেন আদর বোলাল। অনুপম আজ এই প্রথম সহানুভূতির ছোঁয়া পেল প্রকৃতির কাছ থেকে। বন্ধ চোখ কিছুক্ষণ পর খুলে বাইরে তাকিয়ে সে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। না পাওয়ার জন্য তার কোনও খেদ হচ্ছে না। তাকে কেউ যেন না দেখে এটাই সে এখন চায়।

মশারির চতুর্থ দড়িটা লাগিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল পা দুটো লম্বা টানটান করে। সারাদিনে এই প্রথম তার বিশ্রাম নেওয়া। চোখ বুজল সে।

ঘুমের মধ্যে সে বারবার পাশ ফিরল। তার খুবই গাঢ় ঘুম হয় কিন্তু আজ হল না। কী এক অস্বাচ্ছন্দ্যে সে ছটফট করে গেল। পাতলা ঘুমের মধ্যেই একসময় তার মনে হল মোটর গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ, দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ যেন সে শুনতে পেল। আবার ফুপিয়ে চাপা কান্নার আওয়াজও পেল।

ঘুম ভেঙে চোখ মেলতেই চৌকো একটা উজ্জ্বলতা তাকে আঘাত করল। জানলাটা ঠিক তার পায়ের ওপরেই। প্রখর রোদে আকাশটা ঝকঝকে। অনুপম আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। একটা শালিখ জানলার পাল্লায় বসে কর্কশ ডাকে তাকে বিরক্ত করতেই সে সচেতন হল।

বিছানায় উঠে বসে মশারি তুলে পা দুটো মেঝেয় নামাল। কিন্তু দু কদম গিয়েই সে বন্ধ দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নিথর হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজা খুলল। বাঁ হাঁটু কংক্রিটের মতো জমাট আর ভারী লাগছে। সারা বাড়িতে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বউদি, পঞ্চি, এরা সব গেল কোথায়? ছমছমে একটা চিন্তা নিয়ে সে। কলঘরে ঢুকল।

মশারিটা পাকিয়ে বিছানার একধারে রাখা। চাদরটা পরিপাটি করে বিছানো। ইতিমধ্যে পঞ্চি এইসব কাজ সেরে রেখে গেছে। অনুপম পা টেনে টেনে দালানে এল।

কেউ নেই, তবে রান্নাঘরের দিক থেকে বাসনের শব্দ ভেসে এল। নিচু গলায় সে ডাকল, বউদি।

যাই। পঞ্চির গলা।

ব্যস্ত হয়ে এল পঞ্চি, হাতে একটা ন্যাতা। মাসিমা বলে গেছে উঠলেই আপনাকে খেতে দিতে। আগে চা খাবেন?

হ্যাঁ, কিন্তু বউদি কোথায়, আর সব?

সবাই তো ভোরবেলায় চলে গেছে। মেসোমশাই মাঝরাতে কলকাতা থেকে এল। তারপর মাসিমাকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে কী সব বলল। মাসিমা নীচে গেল। তারপর নীচের বউদিকে নিয়ে তিন জন কলকাতা চলে গেল। যাওয়ার আগে বাচ্চুকে পাশের বাড়িতে রেখে আমাকে বলে গেল, দাদা হাসপাতালে, অবস্থা ভাল নয় তাই মণিকে নিয়ে যাচ্ছি। ঠাকুরপো রইল, কাল থেকে না খেয়ে রয়েছে, ভাল করে দেখিস, উঠলেই খেতে দিস। আমি বললুম, সে তোমায় ভাবতে হবে না। রান্নাবান্না, জলখাবার করা সব আমি পারি। আপনাকে মামলেট করে দোব, টোস দিয়ে খাবেন?

পঞ্চির কথা শুনতে শুনতে অনুপমের মনে হল নতুন কিছুই সে শুনছে না। রাতে। ঘুমের মধ্যেই সে এসব জেনে গেছে।

দালানে খাবারের টেবিল আর চারটে চেয়ার। অনুপম একটা চেয়ারে বসল। টেবিলে আজকের খবরের কাগজ ভাঁজ করা অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। কেউ হাত দেয়নি। বারান্দায় যাওয়ার দরজা দিয়ে দূরে নারকেল গাছের মাথা আর আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল।

একবার কাগজটার দিকে তাকাল। দেখেই বুঝতে পারল প্রভাতী সংবাদ। কালকের ঘটনার কথা কী ভাবে লিখেছে জানার জন্য তার এখন আর কোনও কৌতূহল হচ্ছে না। সুপ্রিয় গুপ্ত এই রকম একটা সুযোগই খুঁজছিল, পেয়ে গেছে। সত্যি-মিথ্যে যা খুশি লিখে দেবে তার বিরুদ্ধে। কে প্রতিবাদ করবে? লোকে তো এখন তাকে শয়তান রূপেই দেখতে চায়।

কিন্তু সে সত্যিই কি শয়তান? প্রদীপ হালদারের যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে ওর বউ-ছেলে কি পথে বসবে? এর মধ্যে তার শয়তানিটা কোথায়! প্লেন ক্র্যাশ করে, ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হয়ে তো এর থেকেও বেশি লোক মরে, সেটা কি পাইলটের বা ড্রাইভারের ইচ্ছাতে হয়?

ঘুমের মধ্যে যেন কান্নার শব্দ পেয়েছিল। নিশ্চয় মণি নামের ওই বউটির। হাসপাতালে কেউ ভর্তি হয়েছে শুনলেই তো মেয়েরা আগে কাঁদতে শুরু করে। প্রদীপ হালদারের সিরিয়াস কিছু নাও হতে পারে। যদি বড় ধরনের অপারেশন করাতে হয় বা ভাল নার্সিংহোমে রাখার দরকার হয় তা হলে খরচ দেওয়ার সামর্থ্য কি ওদের আছে? পাশ করে কিছুদিন হল অফিসার হয়েছে, কত আর পায়, তিন-চার হাজার!

চিকিৎসার জন্য যদি টাকার দরকার হয় তা হলে আমিই দিয়ে দেব। অনুপম একটা গুমোট আলো বাতাসহীন ঘরের জানলা খুলে দিয়ে যেন হাঁফ ছাড়ল। আমিই টাকা দেব। বেলেঘাটায় তার আলমারির লকারে বারো হাজার টাকা পরশুই সে রেখেছে।

ফুটবলারদের পাওনাগণ্ডা মেটাবার ভার বারিন দত্তের। তাকে সে দুবার জানিয়ে দিয়েছিল গত বছরের বারো হাজার টাকা হাতে না পেলে সে আর পায়ে বল ছোঁয়াবে না। কথাটা অন্য ভাবে ঘুরিয়ে রং ফলিয়ে প্রভাতী সংবাদে বেরোয়। ক্লাবের ভেতরের সব খবর বারিন যে গোপনে সুপ্রিয়কে জোগায় এটা অনেকেই জানে, আর সেই খবরগুলো সবই বারিন গোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে আর বিরোধী গোষ্ঠীর, যার অন্যতম নেতা দুলাল শীল, তাদের স্বার্থের বিপক্ষে যাতে যায়, সেই ভাবেই সুপ্রিয় লেখে।

সকালে প্র্যাকটিসের পর মাঠ থেকে তাঁবুতে যাওয়ার সময় সে সুপ্রিয়কে গ্যালারিতে বসে থাকতে দেখে উঠে আসে।

একগাল হেসে সুপ্রিয় তাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অনুপম ওর জামা ধরে টেনে তোলে।

অনু, অ্যাই কী করছিস! সুপ্রিয় অবাক হয়ে বলেছিল। গ্যালারি এবং মাঠের ধারে তিরিশ-চল্লিশজন সারথি-ভক্ত ছেলে তখন মজা দেখার সম্ভাবনা নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।

অনুপম বুকের কাছে জামাটা ধরে শীর্ণকায় সুপ্রিয়কে এমন ঝাঁকাতে থাকে যে, ফড়ফড় করে ফেঁসে যায় পুরনো জামা।

অ্যাই দ্যাখো, থাম থাম, এটা যে নিউজ হয়ে যাবে রে।

নিকুচি করেছে তোমার নিউজের। বারিন দত্ত কত টাকা দেয় তোমায় আমার বিরুদ্ধে লেখার জন্য? বলো, বলো। অনুপম ধাক্কা দিয়ে সুপ্রিয়কে বসিয়ে দেয়।

এক পয়সাও নয়। যা সত্যি, যা খবর, তাই লিখি। তুই বুকে হাত দিয়ে বল, ও কথা তুই বলিসনি? টাকা না পেলে পায়ে বল ছুঁবি না বলিসনি?

হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু তুমি যেভাবে লিখেছ সেভাবে নয়। সারথির এখন ক্রাইসিসের সময়ে তুমি এমন ভাবে আমাকে প্রেজেন্ট করলে। যেন ক্লাবের ওপর আমার দরদ নেই, ভালবাসা নেই, শুধু টাকার সঙ্গেই সম্পর্ক, একটা অর্থপিশাচ? হাজার হাজার মেম্বার, সাপোর্টার কী ধারণা করছে আমার সম্পর্কে, সেটা কি জানো?

ওই হল। প্ল্যাটিনাম জুবিলি ট্রফিটা গোল দিয়ে জিতে নে, দেখবি সব ধারণা উলটে গেছে। আবার তোকে মাথায় তুলে সাপোর্টাররা নাচবে। কবে কী বলেছিস কেউ মনে করে রাখবে না।

সুপ্রিয়দা, ট্রফি নেব, গোলও দেব আর তোমার কলমটাও সেদিন ভেঙে দু টুকরো করব।

তখন ওদের ঘিরে জড়ো হয়ে গিয়েছিল অনুপম-ভক্তরা। তারা সুপ্রিয়কে গালি দিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকে। সুপ্রিয় নেমে আসার সময় দু-চারজন পেছন থেকে তাকে চড়চাপড় মেরেছিল। কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়। অনুপমই টেনে তোলে। তখন সুপ্রিয় মুখে হাসি নিয়ে বলেছিল, গোল দিয়ে ট্রফি নিতে না পারলে এরাই কিন্তু তোকে ছিঁড়ে খাবে।

পরদিনের প্রভাতী সংবাদে শিরোনাম হয়েছিল: অনুপমের দম্ভ: গোল দেব, ট্রোফি নেব। খবরের মধ্যে সাংবাদিকের জামা ধরা ও ছেড়া এবং মারধোরের কথা ছিল। শেষদিকে লেখা হয়—গত বছরের বকেয়া বারো হাজার টাকা না পেলে অনুপম আর পায়ে বল ছোঁবে না। এই কথা প্রভাতী সংবাদে প্রকাশিত হওয়ায় ফুটবল কমিটির সদস্য বারিন দত্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ক্লাবের আর্থিক সঙ্কট চলছে। এই সময় টাকার জন্য এই ভাবে চাপ দেওয়া ক্লাবের কোনও হিতাকাঙক্ষীর পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকেরই টাকা বাকি আছে কিন্তু তারা কেউ পায়ে বল ঠেকাবে না বলেনি। অনুপম বড় খেলোয়াড়। সে জানে তাকে ছাড়া টিম করা যাবে না। ওকে বলেছি প্ল্যাটিনাম ট্রফি সেমিফাইনালে উঠলেই যতটা সম্ভব ওর টাকা মিটিয়ে দেব।—এ ব্যাপারে অনুপমের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেও তাকে রাতে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

খবরটা সারথির সাপোর্টারদের মধ্যে অনুপম-বিরোধী একটা বিষাক্ত মনোভাব তৈরি করে দেয়। কিন্তু প্ল্যাটিনাম ট্রফি জেতার আশায় তারা বুক বেঁধে থাকে। কিন্তু দুলোলাদা অনুপমকে বলেছিল, বাড়াবাড়ি করলি। গোল দেব, ট্রফি নেব, এতটা বলা তোর উচিত হয়নি। ফুটবলে কেউ আগে থাকতে জিতবেই, বলতে পারে না।

আরে রাখো তোমার ওসব কথা। অনুপম বিশ্বাস যদি খেলব মনে করে তা হলে ইন্ডিয়ায় এমন কোনও টিম নেই যে, তাকে আটকাতে পারে।

দুলোদা অবিশ্বাসভরে তো বটেই, বিরক্তিমাখানো চোখে তাকিয়ে বলেছিল, এতটা অহঙ্কার কিন্তু ভাল নয়। এই ট্রফিটা আমাদের চাই-ই, না হলে ক্ষমতা থেকে আমরা ছিটকে যাব। বারিন দত্ত গ্রুপ ড্যাংডাঙিয়ে ভোট তুলে নেবে। মনে রাখিস ইলেকশান আসছে।

তুমি নিশ্চিন্ত থাকো দুলোদা, ভোটে তোমরা জিতছ। ট্রফি পেলেই হাওয়া ঘুরে যাবে। কিন্তু একটা কথা, বাকি টাকা না পেলে আমি কিন্তু মাঠে নামব না।

বারিন তোর টাকাটা দিয়ে দেবে মনে হচ্ছে। ট্রফি জিতে ওকেও তো বাঁচতে হবে।

বারিন দত্ত আর সুবোধ বোস টাকা নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন তার ফ্ল্যাটে এসেছিল। আধঘণ্টা থেকে চলে যাওয়ার সময় সুবোধ বলে, কাউকে আর টাকা দিচ্ছি না, শুধু তোকেই দিলাম। পুলকেশ, রঞ্জন, অপূর্ব ওদেরও বাকি আছে, চেয়েওছে। বলেছি, কাউকেই দিচ্ছি না, টুর্নামেন্ট থেকে না পেলে দিতেও পারব না। জোট করে বলেছিল খেলব না, কিন্তু শেষমেশ রাজি হয়েছে। অনু তোকে যে এই বারো হাজার দিলাম এটা যেন ওরা জানতে না পারে। এটা যদি লিক হয়ে যায় তা হলে কিন্তু ওরা প্রচণ্ড ঝামেলায় ফেলে দেবে। তুই শুধু বলবি সেমিফাইনালে উঠলে বারিনদা কিছু টাকা দেবে বলেছে তাই খেলছি। মনে থাকবে?

অনুপমকে কিছু বলতে হয়নি। প্রথম খেলা ছিল আই. টি. আই-এর সঙ্গে। সরল আর রঞ্জনের দেওয়া গোলে ম্যাচ জেতার রিপোর্টের সঙ্গেই আলাদা একটা খবরে বলা হল, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, অনুপম বিশ্বাস আজকের ম্যাচ খেলতে সকাল দশটা পর্যন্তও রাজি ছিল না। কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে হাতেপায়ে ধরেও রাজি করাতে পারেননি। অবশেষে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে একজন বারো হাজার টাকা পৌঁছে দেওয়ায় সে মাঠে আসে।

খবরটায় যেন আগুনে ঘি পড়েছিল। সমর্থকদের মধ্যে তো বটেই, টিমের অন্যরাও রাগে ফেটে বলেছিল, তা হলে অনুপমই খেলুক। শুধু একজনই টাকা পাবে আর বাকিরা সব ফালতু, তা হলে ফালতুর মতোই এবার আমরা খেলব।

সেই খেলাটা তারা ফাইনালে উঠে ডেম্পোর সঙ্গে খেলল।

কিন্তু তার আগে দুলোদাই হুঁশিয়ারি করে অনুপমকে বলেছিল, তোকে শেষ করে দেওয়ার মারাত্মক চাল বারিন চেলেছে রে। কাউকে জানাতে মানা করে টাকা দেওয়ার খবরটা সুপ্রিয়কে দিয়ে কাগজে বের করল। শুধু মেম্বার-সাপোর্টাররাই নয়, প্লেয়াররাও তোর ওপর খেপে রইল।

কিন্তু দুলোদা, আমি তো অন্য কারও নয়, শুধু নিজের পাওনাটা নিয়েছি, কারও বাড়া ভাতে তো ছাই দিইনি। অনুপম অসহায়ভাবে নিজেকে বাঁচাতে চেয়ে বলেছিল।

এ কথা আমাকে বলে কোনও লাভ নেই। সুপ্রিয়কে বললে আরও খারাপ হবে, দেখবি পরের দিন উলটো কথা কাগজে বেরিয়েছে। তার থেকে বরং চুপচাপ থাক। আর খেলে যা। গাবিয়ে কথা বলাটাই তোর সর্বনাশ করছে। এখন ট্রফি যদি না আসে তা হলে বারিনরা বলবে, বারো হাজার টাকা তো দিলাম, অনুপম কী করল? টিমের মধ্যে ঝগড়া তৈরি করা ছাড়া ওর অবদানটা কী? বারিনরা ভাল করেই জানে, তোকে টাকা দেওয়ার খবর ফাঁস হলে কয়েকজন মাঠে নেমেও খেলবে না। তাতে সারথি হারবে, আর তার ফলে আমরাও কমিটি থেকে আউট হয়ে যাব, সেটাই ওদের লক্ষ্য। টাকাটা এখন নিয়ে ভুল করলি অনু…এই বারো হাজার তোকে ডোবাবে।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress