ব্যারিস্টার শরদিন্দু সান্যালের বাড়িতে
পরের রবিবারে সকাল।
ব্যারিস্টার শরদিন্দু সান্যালের বাড়িতে আজ মিটিং বসেছে বৈঠকখানায়। প্রায় ষাট বছরের পুরনো অভিজাত বাড়ির প্রকাণ্ড ড্রইংরুম। ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়ালে যাঁর বাঁধানো ছবি রয়েছে, তাঁরই কীর্তি এই বাড়ি। ইনি শরদিন্দু সান্যালের পরলোকগত পিতৃদেব দ্বারকানাথ সান্যাল। ছেলে বাপেরই পেশা নিয়েছেন, তবে বাপের মতো অত অঢেল রোজগারের ভাগ্য তাঁর কখনও হয়নি। শোনা যায়, দ্বারিক সান্যালের এক সময় আয় ছিল গড়ে দিনে হাজার টাকা।
আগের দিনের চেয়ে আজ যেন মিস্টার সান্যালের দাপটটা একটু কম। আসলে এতদিনেও গুণ্ডাদের কাছ থেকে কোনও হুমকি, চিঠি না পেয়ে তিনি একটু ধাঁধায় পড়েছেন। সেইসঙ্গে ছেলের সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাটাও আরও বেড়ে গেছে। আজ শুধু মিস্টার সান্যাল ও দারোগা সাহেব নন–ঘরে আরও দুজন লোক রয়েছেন, মিস্টার সান্যালের দুই ছেলে-মেজো আর সেজো। বড়টিও এসেছিল, তবে দু দিনের বেশি থাকতে পারেনি, দিল্লিতে তার একটা জরুরি মিটিং আছে।
মেজো ছেলে সুধীন্দ্রই এখন কথা বলছে। বছর ছাব্বিশেক বয়স, রঙ ফরসা, আজকের ফ্যাশানে ঝুলপিটা বড়, আর চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। সুধীন্দ্র বলছে, মেমরি লসের অনেক ইয়ে তো বিলিতি ম্যাগাজিনে পড়া যায় বাবা। এটা তো হতেই পারে। তুমি যে কেন বিশ্বাস করছ না, সেটা আমি বুঝতেই পারছি না। অ্যামনিসিয়ার কথা পড়োনি?
সেজো ছেলে প্রীতীন কিছুই বলছে না। হারানো ভাইয়ের সঙ্গে নিজের বয়সের তফাতটা সবচেয়ে কম বলেই বোধহয় প্রীতীনের মনটা অন্যদের চেয়ে বেশি ভারী। ও বাবলুকে ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছে, মোনোপলি শিখিয়েছে, দরকার হলে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছে, এই সেদিনও সাকাস দেখাতে নিয়ে গেছে। প্রীতীন খড়্গপুর চলে যাবার পর থেকে অবিশ্যি দু-ভাইয়ের দেখা কমে। গেছে। এখন যে প্রীতীন মাঝে মাঝে দু-হাতের তেলো দিয়ে কপালে আঘাত করছে, তার কারণ ওর বিশ্বাস, ও কলকাতায় থাকলে বাবলুকে এইভাবে কিডন্যাপ করা সম্ভব হত না। ওর কেন যে এরকম ধারণা হল, সেটা বলা মুশকিল। কারণ ও সেই সময় কলকাতায় থাকলেও ভাইয়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকত না। বাবলু ফিরছিল ইস্কুল থেকে। বাড়ি কাছে হওয়ায় বৃষ্টি না থাকলে ও হেঁটেই ফেরে। সঙ্গে থাকে ওর বন্ধু পরাগ–যার বাড়ি ওর তিনটে বাড়ি পরেই। সেদিন ইস্কুল ছুটি ছিল, কিন্তু ইস্কুলেরই খেলার মাঠে শিশুমেলা হবে কয়েক দিনের মধ্যেই, তাই কিছু ছেলেকে বাছাই করা হয়েছিল, তার তোড়জোড়ে সাহায্য করার জন্য। বাবলু ছিল তাদের মধ্যে একজন। পরাগ ছিল না। তাই বাবলু সেদিন একাই বাড়ি ফিরছিল বিকেল সাড়ে-পাঁচটার সময়। সেই সময় তাকে ধরে নিয়ে যায় গুণ্ডার দল, একটা নীল রঙের অ্যামবাসাড়ার গাড়িতে। ঘটনাটার একজন সাক্ষীও ছিল, পোদ্দারদের বাড়ির বুড়ো দারোয়ান মহাদেও পাঁড়ে।
তাই যদি হয়, মিস্টার সান্যাল একটু ভেবে বললেন, তা হলে তো সে ছেলে বাড়ি ফিরে এলে কাউকে চিনতেই পারবে না।
সেটারও ট্রিটমেন্ট হয়, সুধীন্দ্র বলল। লস্ট মেমরি ফিরিয়ে আনা যায়। তুমি এ বিষয়ে ডক্টর বোসকে কনসাল্ট করে দেখতে পারো। আর এখানে যদি সেরকম স্পেশালিস্ট না থাকে, বিদেশে নিশ্চয়ই আছে।
তা হলে–মিস্টার সান্যাল সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তিনি তাঁর কথা শেষ করার আগেই দারোগা মিস্টার চন্দ বললেন, আমি যেটা বলছি, সেটাই করুন স্যার। অ্যাদ্দিনেও যখন তারা কোনও উচ্চবাচ্য করল না, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপনার ছেলে অন্য কোথাও আছে। আর সে যদি সবকিছু ভুলে গিয়েই থাকে, তা হলে তো সে আর নিজে থেকে বাড়ি ফিরবে না। তাই বলছি, আপনি কাগজে বিজ্ঞাপন দিন। রিওয়ার্ড অফার করুন। তার পর দেখুন ক হয়। এতে তো আর কোনও ক্ষতি হচ্ছে না আপনার।
ওই লোক দুটোর কোনও হদিস পেলেন? মিস্টার সান্যাল জিজ্ঞেস করলেন।
মনে হয়, তারা কলকাতাতেই আছে, বললেন দারোগাসাহেব, তবে খোঁজ যাকে বলে সেটা এখনও ঠিক…
শরদিন্দু সান্যাল ড্রেসিং গাউনের পকেটে হাতটা চালিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে তাই করা যাক। বলু, তুই কালকের দিনটা থেকে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থাটা করে দে। পিটু ছেলেমানুষ, পারবে না।
সুধীন্দ্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অপমানবোধে একটু নড়েচড়ে বসল প্রীতীন্দ্র।
কটা কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার কথা বলছেন আপনি?
প্রশ্নটা দারোগাসাহেবকে করলেন মিস্টার সান্যাল। চন্দ্র বললেন, পাঁচটা তো বটেই–মিনিমাম। ইংরিজি বাংলা হিন্দি তিনটে ভাষাতেই দেওয়া উচিত। আমি হলে উর্দু আর গুরুমুখীটাও বাদ দিতাম না। কোন দলে গিয়ে পড়েছে আপনার ছেলে, সে তো জানার উপায় নেই।
ওর একটা ছবিও দিতে হবে তো?
এবার প্রীতীন্দ্র কথা বলল।
আমার কাছে ছবি আছে বাবলুর। লাস্ট ইয়ার দার্জিলিঙে ভোলা।
দেওয়াই যখন হচ্ছে, বললেন মিস্টার সান্যাল, তখন ভাল করে চোখে পড়ার মতো বিজ্ঞাপন হয় যেন। খরচটা কোনও কথা নয়।