Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নৌকাডুবি (21-25)

নৌকাডুবি ২১

রাত্রি নয়টার সময় রমেশ কমলাকে লইয়া শেয়ালদহ-স্টেশনে যাত্রা করিল। যাইবার সময় একটু ঘুরপথ দিয়া গেল। গাড়োয়ানকে অনাবশ্যক গোটাকতক গলি ঘুরাইয়া লইল। কলুটোলায় একটা বাড়ির কাছে আসিয়া আগ্রহসহকারে মুখ বাড়াইয়া দেখিল। পরিচিত বাড়ির তো কোনো পরিবর্তন হয় নাই।
রমেশ এমন একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল যে, নিদ্রাবিষ্ট কমলা চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার কী হইয়াছে?”
রমেশ উত্তর করিল, “কিছুই না।” আর কিছুই বলিল না; গাড়ির অন্ধকারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। দেখিতে দেখিতে গাড়ির কোণে মাথা রাখিয়া কমলা আবার ঘুমাইয়া পড়িল। ক্ষণকালের জন্য কমলার অস্তিত্বকে রমেশের যেন অসহ্য বোধ হইল।
গাড়ি যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছিল। একটি সেকেণ্ড্‌-ক্লাস গাড়ি পূর্ব হইতেই রিজার্ভ্‌ করা ছিল; রমেশ ও কমলা তাহাতে উঠিল। এক দিকের বেঞ্চিতে কমলার জন্য বিছানা পাতিয়া গাড়ির বাতির নীচে পর্দা টানিয়া অন্ধকার করিয়া দিয়া রমেশ কমলাকে কহিল, “অনেকক্ষণ তোমার শোবার সময় হইয়া গেছে, এইখানে তুমি ঘুমাও।”
কমলা কহিল, “গাড়ি ছাড়িলে আমি ঘুমাইব, ততক্ষণ আমি এই জানালার ধারে বসিয়া একটু দেখিব?”
রমেশ রাজি হইল। কমলা মাথায় কাপড় টানিয়া প্ল্যাটফর্মের দিকের আসনপ্রান্তে বসিয়া লোকজনের আনাগোনা দেখিতে লাগিল। রমেশ মাঝের আসনে বসিয়া অন্যমনস্কভাবে চাহিয়া রহিল। গাড়ি যখন সবে ছাড়িয়াছে এমন সময় রমেশ চমকিয়া উঠিল–হঠাৎ মনে হইল, তাহার একজন চেনা লোক গাড়ির অভিমুখে ছুটিয়াছে।
পরক্ষণেই কমলা খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রমেশ জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিল–রেলওয়েকের্মচারীর বাধা কাটাইয়া একজন লোক কোনোক্রমে চলন্ত গাড়িতে উঠিয়াছে এবং টানাটানিতে তাহার চাদর কর্মচারীর হাতেই রহিয়া গেছে। চাদর লইবার জন্য সে ব্যক্তি যখন জানলা হইতে ঝুঁকিয়া পড়িয়া হাত বাড়াইল তখন রমেশ স্পষ্ট চিনিতে পারিল, সে আর কেহ নয়, অক্ষয়।
এই চাদর-কাড়াকাড়ির দৃশ্যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কমলার হাসি থামিতে চাহিল না।
রমেশ কহিল, “সাড়ে দশটা বাজিয়া গেছে, গাড়ি ছাড়িয়াছে, এইবার তুমি ঘুমাও।”
বালিকা বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ না ঘুম আসিল, মাঝে মাঝে খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
কিন্তু এই ব্যাপারে রমেশের বিশেষ কৌতুকবোধ হইল না। রমেশ জানিত, কোনো পল্লিগ্রামের সহিত অক্ষয়ের কোনো সম্বন্ধ ছিল না; সে পুরুষানুক্রমে কলিকাতাবাসী; আজ রাত্রে এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে সে কলিকাতা ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছে? রমেশ নিশ্চয় বুঝিল, অক্ষয় তাহারই অনুসরণে চলিয়াছে।
অক্ষয় যদি তাহাদের গ্রামে গিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করে এবং সেখানে রমেশের স্বপক্ষবিপক্ষমণ্ডলীর মধ্যে এই কথা লইয়া একটা ঘাঁটাঘাঁটি হইতে থাকে, তবে সমস্ত ব্যাপারটা কিরূপ জঘন্য হইয়া উঠিবে, তাহাই কল্পনা করিয়া রমেশের হৃদয় অশান্ত হইয়া উঠিল। তাহাদের পাড়ায় কে কী বলিবে, কিরূপ ঘোঁট চলিবে, তাহা রমেশ যেন প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে লাগিল। কলিকাতার মতো শহরে সকল অবস্থাতেই অন্তরাল খুঁজিয়া পাওয়া যায়, কিন্তু ক্ষুদ্র পল্লির গভীরতা কম বলিয়াই অল্প আঘাতেই তাহার আন্দোলনের ঢেউ উত্তাল হইয়া উঠে। সেই কথা যতই চিন্তা করিতে লাগিল রমেশের মন ততই সংকুচিত হইতে লাগিল।

নৌকাডুবি ২১ (২)

বারাকপুরে যখন গাড়ি থামিল রমেশ মুখ বাড়াইয়া দেখিতে লাগিল, অক্ষয় নামিল না। নৈহাটিতে অনেক লোক উঠানামা করিতে লাগিল, তাহার মধ্যে অক্ষয়কে দেখা গেল না। একবার বৃথা আশায় বগুলা স্টেশনেও রমেশ ব্যগ্র হইয়া মুখ বাড়াইল–অবরোহীদের মধ্যে অক্ষয়ের চিহ্ন নাই। তাহার পরের আর-কোনো স্টেশনে অক্ষয়ের নামিবার কোনো সম্ভাবনা সে কল্পনা করিতে পারিল না।
অনেক রাত্রে শ্রান্ত হইয়া রমেশ ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন প্রাতে গোয়ালন্দে গাড়ি পৌঁছিলে রমেশ দেখিল, অক্ষয় মাথায় মুখে চাদর জড়াইয়া একটা হাতব্যাগ লইয়া তাড়াতাড়ি স্টীমারের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে।
যে স্টীমারে রমেশের উঠিবার কথা সে স্টীমার ছাড়িবার এখনো বিলম্ব আছে। কিন্তু অন্য ঘাটে আর-একটা স্টীমার গমনোন্মুখ অবস্থায় ঘন ঘন বাঁশি বাজাইতেছে। রমেশ জিজ্ঞাসা করিল, “এ স্টীমার কোথায় যাইবে?”
উত্তর পাইল, “পশ্চিমে।”
“কতদূর পর্যন্ত যাইবে?”
“জল না কমিলে কাশী পর্যন্ত যায়।”
শুনিয়া রমেশ তৎক্ষণাৎ সেই স্টীমারে উঠিয়া কমলাকে একটা কামরায় বসাইয়া আসিল এবং তাড়াতাড়ি কিছু দুধ চাল ডাল এবং এক ছড়া কলা কিনিয়া লইল।
এ দিকে অক্ষয় অন্য স্টীমারে সকল আরোহীর আগে উঠিয়া মুড়িসুড়ি দিয়া এমন একটা জায়গায় দাঁড়াইয়া রহিল, যেখান হইতে অন্যান্য যাত্রীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। যাত্রিগণের বিশেষ তাড়া ছিল না। জাহাজ ছাড়িবার দেরি আছে–তাহারা এই অবকাশে মুখ হাত ধুইয়া, স্নান করিয়া, কেহ কেহ বা তীরে রাঁধাবাড়া করিয়া খাইয়া লইতে লাগিল। অক্ষয়ের কাছে গোয়ালন্দ পরিচিত নহে। সে মনে করিল নিকটে কোথাও হোটেল বা কিছু আছে, সেইখানে রমেশ কমলাকে খাওয়াইয়া লইতেছে।
অবশেষে স্টীমারে বাঁশি দিতে লাগিল। তখনো রমেশের দেখা নাই; কম্পমান তক্তার উপর দিয়া যাত্রীর দল জাহাজে উঠিতে আরম্ভ করিল। ঘন ঘন বাঁশির ফুৎকারে লোকের তাড়া ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু আগত ও আগন্তুকদের মধ্যে রমেশের কোনো চিহ্ন নাই। যখন আরোহীর সংখ্যা শেষ হইয়া আসিল, তক্তা টানিয়া লইল এবং সারেং নোঙর তুলিবার হুকুম করিল, তখন অক্ষয় ব্যস্ত হইয়া কহিল, “আমি নামিয়া যাইব।” কিন্তু খালাসিরা তাহার কথায় কর্ণপাত করিল না। ডাঙা দূরে ছিল না, অক্ষয় স্টীমার হইতে লাফ দিয়া পড়িল।
তীরে উঠিয়া রমেশের কোনো খবর পাওয়া গেল না। অল্পক্ষণ হইল, গোয়ালন্দ হইতে সকালবেলাকার প্যাসেঞ্জার-ট্রেন কলিকাতা-অভিমুখে চলিয়া গেছে। অক্ষয় মনে মনে ভাবিল, কাল রাত্রে গাড়িতে উঠিবার সময়কার টানাটানিতে নিশ্চয় সে রমেশের দৃষ্টিপথে পড়িয়াছে এবং রমেশ তাহার কোনো বিরুদ্ধ অভিসন্ধি অনুমান করিয়া দেশে না গিয়া আবার সকালের গাড়িতেই কলিকাতায় ফিরিয়া গেছে। কলিকাতায় যদি কোনো লোক লুকাইবার চেষ্টা করে, তবে তো তাহাকে বাহির করাই কঠিন হইবে।

নৌকাডুবি ২২

অক্ষয় সমস্তদিন গোয়ালন্দে ছট্‌ফট্‌ করিয়া কাটাইয়া সন্ধ্যার ডাকগাড়িতে উঠিয়া পড়িল। পরদিন ভোরে কলিকাতায় পৌঁছিয়া প্রথমেই সে রমেশের দরজিপাড়ার বাসায় আসিয়া দেখিল, তাহার দ্বার বন্ধ; খবর লইয়া জানিল, সেখান কেহই আসে নাই।
কলুটোলায় আসিয়া দেখিল, রমেশের বাসা শূন্য। অন্নদাবাবুর বাসায় আসিয়া যোগেন্দ্রকে কহিল, “পালাইয়াছে, ধরিতে পারিলাম না।”
যোগেন্দ্র কহিল, “সে কী কথা?”
অক্ষয় তাহার ভ্রমণবৃত্তান্ত বিবৃত করিয়া বলিল।
অক্ষয়কে দেখিতে পাইয়া রমেশ কমলাকে সুদ্ধ লইয়া পালাইয়াছে, এই খবরে রমেশের বিরুদ্ধে যোগেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হইল।
যোগেন্দ্র কহিল, “কিন্তু অক্ষয়, এ-সমস্ত যুক্তি কোনো কাজেই লাগিবে না। শুধু হেমনলিনী কেন, বাবা-সুদ্ধ ঐ এক বুলি ধরিয়াছেন–তিনি বলেন, রমেশের নিজের মুখে শেষ কথা না শুনিয়া তিনি রমেশকে অবিশ্বাস করিতে পারিবেন না। এমন-কি, রমেশ আজও আসিয়া যদি বলে ‘আমি এখন কিছুই বলিব না’, তবু নিশ্চয় বাবা তাহার সঙ্গে হেমের বিবাহ দিতে কুণ্ঠিত হন না। ইহাদের লইয়া আমি এমনি মুশকিলে পড়িয়াছি। বাবা হেমনলিনীর কিছুমাত্র কষ্ট সহ্য করিতে পারেন না; হেম যদি আজ আবদার করিয়া বসে ‘রমেশের অন্য স্ত্রী থাক্‌–আমি তাহাকেই বিবাহ করিব’, তবে বাবা বোধ হয় তাহাতেই রাজি হন। যেমন করিয়া হউক এবং যত শীঘ্র হউক, রমেশকে দিয়া কবুল করাইতেই হইবে। তোমার হতাশ হইলে চলিবে না। আমিই এ কাজে লাগিতে পারিতাম, কিন্তু কোনোপ্রকার ফন্দি আমার মাথায় আসে না, আমি হয়তো রমেশের সঙ্গে একটা মারামারি বাধাইয়া দিব। এখনো বুঝি তোমার মুখধোওয়া চা-খাওয়া হয় নাই?”
অক্ষয় মুখ ধুইয়া চা খাইতে খাইতে ভাবিতে লাগিল। এমন সময়ে অন্নদাবাবু হেমনলিনীর হাত ধরিয়া চা খাইবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অক্ষয়কে দেখিবামাত্র হেমনলিনী ফিরিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
যোগেন্দ্র রাগ করিয়া কহিল, “হেমের এ ভারি অন্যায়। বাবা, তুমি উহার এইসকল অভদ্রতায় প্রশ্রয় দিয়ো না। উহাকে জোর করিয়া এখানে আনা উচিত। হেম! হেম!”
হেমনলিনী তখন উপরে চলিয়া গেছে। অক্ষয় কহিল, “যোগেন, তুমি আমার কেস আরো খারাপ করিয়া দিবে দেখিতেছি। উঁহার কাছে আমার সম্বন্ধে কোনো কথাটি কহিয়ো না। সময়ে ইহার প্রতিকার হইবে, জবর্দস্তি করিতে গেলে সব মাটি হইয়া যাইবে।”
এই বলিয়া অক্ষয় চা খাইয়া চলিয়া গেল। অক্ষয়ের ধৈর্যের অভাব ছিল না। যখন সমস্ত লক্ষণ তাহার প্রতিকূলে তখনো সে লাগিয়া থাকিতে জানে। তাহার ভাবেরও কোনো বিকার হয় না। অভিমান করিয়া সে মুখ গম্ভীর করে না বা দূরে চলিয়া যায় না। অনাদর-অবমাননায় সে অবিচলিত থাকে। লোকটা ট্যাঁকসই। তাহার প্রতি যাহার ব্যবহার যেমনি হউক, সে টিঁকিয়া থাকে।
অক্ষয় চলিয়া গেলে আবার অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে ধরিয়া চায়ের টেবিলে উপস্থিত করিলেন। আজ তাহার কপোল পাণ্ডুবর্ণ, তাহার চোখের নীচে কালি পড়িয়া গেছে। ঘরে ঢুকিয়া সে চোখ নিচু করিল, যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। সে জানিত, যোগেন্দ্র তাহার ও রমেশের উপর রাগ করিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে কঠিন বিচার করিতেছে। এইজন্য যোগেন্দ্রের সঙ্গে মুখোমুখি-চোখোচোখি হওয়া তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। ভালোবাসায় যদিও হেমনলিনীর বিশ্বাসকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল, তবু যুক্তিকে একেবারেই ঠেকাইয়া রাখা চলে না। যোগেন্দ্রের সম্মুখে হেমনলিনী কাল আপনার বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখাইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে শয়নঘরের মধ্যে একলা সেই বল সম্পূর্ণ থাকে না। বস্তুতই প্রথম হইতেই রমেশের ব্যবহারের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না। সন্দেহের কারণগুলিকে হেমনলিনী যত প্রাণপণ বলে তাহার বিশ্বাসের দুর্গের মধ্যে ঢুকিতে দেয় না–তাহারা বাহিরে দাঁড়াইয়া ততই সবলে আঘাত করিতে থাকে। সাংঘাতিক আঘাত হইতে মা যেমন ছেলেকে বুকের মধ্যে দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া রক্ষা করে, রমেশের প্রতি বিশ্বাসকে হেমনলিনী সমস্ত প্রমাণের বিরুদ্ধে তেমনি জোর করিয়া হৃদয়ে আঁকড়িয়া রাখিল। কিন্তু হায়, জোর কি সকল সময় সমান থাকে?

নৌকাডুবি ২২ (২)

হেমনলিনীর পাশের ঘরেই রাত্রে অন্নদাবাবু শুইয়াছিলেন। হেম যে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করিতেছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। এক-এক বার তাহার ঘরে গিয়া তাহাকে বলিতেছিলেন, “মা, তোমার ঘুম হইতেছে না?” হেমনলিনী উত্তর দিতেছিল, “বাবা, তুমি কেন জাগিয়া আছ? আমার ঘুম আসিতেছে, আমি এখনি ঘুমাইয়া পড়িব।”
পরের দিন ভোরে উঠিয়া হেমনলিনী ছাদের উপর বেড়াইতেছিল। রমেশের বাসার একটি দরজা একটি জানলাও খোলা নাই।
সূর্য ক্রমে পূর্বদিকের সৌধশিখরমালার উপরে উঠিয়া পড়িল। হেমনলিনীর কাছে আজিকার এই নূতনঅভ্যুদিত দিনটি এমনি শুষ্ক শূন্য, এমনি আশাহীন আনন্দহীন ঠেকিল যে, সে সেই ছাদের এক কোণে বসিয়া পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আজ সমস্তদিন কেহই আসিবে না, চায়ের সময় কাহাকেও আশা করিবার নাই, পাশের বাড়িতে কেহ একজন আছে, এই কল্পনা করিবার সুখটুকু পর্যন্ত ঘুচিয়া গেছে।
“হেম! হেম!”
হেমনলিনী তাড়াতাড়ি উঠিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিয়া সাড়া দিল, “কী বাবা!
অন্নদাবাবু ছাদে উঠিয়া আসিয়া হেমনলিনীর পিঠে হাত বুলাইয়া কহিলেন, “আমার আজ উঠিতে দেরি হইয়া গেছে।”
অন্নদাবাবু উৎকন্ঠায় রাত্রে ঘুমাইতে পারেন নাই, ভোরের দিকে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। আলো চোখে লাগিতেই উঠিয়া পড়িয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া হেমনলিনীর খবর লইতে গেলেন। দেখিলেন ঘরে কেহ নাই। সকালে তাহাকে একলা বেড়াইতে দেখিয়া তাঁহার বুকের মধ্যে আঘাত লাগিল। কহিলেন, “চলো মা, চা খাইবে চলো।”
চায়ের টেবিলে যোগেন্দ্রের সম্মুখে বসিয়া চা খাইবার ইচ্ছা হেমনলিনীর ছিল না। কিন্তু সে জানিত, কোনোরূপ নিয়মের অন্যথা তাহার বাপকে পীড়া দেয়। তা ছাড়া, প্রত্যহ সে নিজের হাতে তাহার বাপের পেয়ালায় চা ঢালিয়া দেয়, এই সেবাটুকু হইতে সে নিজেকে বঞ্চিত করিতে চাহিল না।
নীচে গিয়া ঘরে পৌঁছিবার পূর্বে যখন সে বাহির হইতে শুনিল যোগেন্দ্র কাহার সঙ্গে কথা কহিতেছে, তখন তাহার বুক কাঁপিয়া উঠিল–হঠাৎ মনে হইল, বুঝি রমেশ আসিয়াছে! এত সকালে আর কে আসিবে?
কম্পিতপদে ঘরে ঢুকিয়া যেই দেখিল অক্ষয়, অমনি সে আর কিছুতেই আত্মসংবরণ করিতে পারিল না-তেৎক্ষণাৎ ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল।
দ্বিতীয়বার অন্নদাবাবু যখন তাহাকে ঘরের মধ্যে লইয়া আসিলেন, তখন সে তাহার পিতার চৌকির পাশে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া নতমুখে তাঁহার চা প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল।
যোগেন্দ্র হেমনলিনীর ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিল। হেম যে রমেশের জন্য এমন করিয়া শোক অনুভব করিবে, ইহা তাহার অসহ্য বোধ হইতেছিল। তাহার পরে যখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাহার এই শোকের সঙ্গী হইয়াছেন এবং সেও যেন সংসারের আর-সকলের নিকট হইতে অন্নদাবাবুর স্নেহচ্ছায়ায় আপনাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছে, তখন তাহার অধৈর্য আরো বাড়িয়া উঠিল।–’আমরা যেন সবাই অন্যায়কারী! আমরা যে স্নেহের খাতিরেই কর্তব্যপালনে চেষ্টা করিতেছি, আমরাই যে যথার্থভাবে উহার মঙ্গলসাধনে প্রবৃত্ত, তাহার জন্য লেশমাত্র কৃতজ্ঞতা দূরে থাক্‌, মনে মনে আমাদের দোষী করিতেছে। বাবার তো কোনো বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান নাই। এখন সান্ত্বনা দিবার সময় নহে, এখন আঘাত দিবারই সময়। তাহা না করিয়া তিনি ক্রমাগতই অপ্রিয় সত্যকে উহার নিকট হইতে দূরে খেদাইয়া রাখিতেছেন।’
যোগেন্দ্র অন্নদাবাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “জান বাবা, কী হইয়াছে?”
অন্নদাবাবু ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “না, কী হইয়াছে?”
যোগেন্দ্র। রমেশ কাল তাহার স্ত্রীকে লইয়া গোয়ালন্দ মেলে দেশে যাইতেছিল, অক্ষয়কে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়া দেশে না গিয়া আবার সে কলিকাতায় পালাইয়া আসিয়াছে।
হেমনলিনীর হাত কাঁপিয়া উঠিল, চা ঢালিতে চা পড়িয়া গেল। সে চৌকিতে বসিয়া পড়িল।
যোগেন্দ্র তাহার মুখের দিকে একবার কটাক্ষপাত করিয়া বলিতে লাগিল, “পালাইবার কী দরকার ছিল, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারি না। অক্ষয়ের কাছে তো পূর্বেই সমস্ত প্রকাশ হইয়া গিয়াছিল। একে তো তাহার পূর্বের ব্যবহার যথেষ্ট হেয়, তাহার পরে এই ভীরুতা, এই চোরের মতো ক্রমাগত পালাইয়া বেড়ানো আমার কাছে অত্যন্ত জঘন্য মনে হয়। জানি না হেম কী মনে করে, কিন্তু এইরূপ পলায়নেই তাহার অপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ হইতেছে।”
হেমনলিনী কাঁপিতে কাঁপিতে চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কহিল, “দাদা, আমি প্রমাণের কোনো অপেক্ষা রাখি না। তোমরা তাঁহার বিচার করিতে চাও করো, আমি তাঁহার বিচারক নই।”
যোগেন্দ্র। তোমার সঙ্গে যাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে সে কি আমাদের নিঃসম্পর্ক?
হেমনলিনী। বিবাহের কথা কে বলিতেছে? তোমরা ভাঙিয়া দিতে চাও ভাঙিয়া দাও–সে তোমাদের ইচ্ছা। কিন্তু আমার মন ভাঙাইবার জন্য মিথ্যা চেষ্টা করিতেছ।
বলিতে বলিতে হেমনলিনী স্বরবদ্ধ হইয়া কাঁদিয়া উঠিল। অন্নদাবাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহার অশ্রুসিক্তমুখ বুকে চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “চলো হেম, আমরা উপরে যাই।”

নৌকাডুবি ২৩

স্টীমার ছাড়িয়া দিল। প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় কেহই ছিল না। রমেশ একটি কামরা বাছিয়া লইয়া বিছানা পাতিয়া দিল। সকালবেলা দুধ খাইয়া সেই কামরার দরজা খুলিয়া কমলা নদী ও নদীতীর দেখিতে লাগিল।
রমেশ কহিল, “জান, কমলা, আমরা কোথায় যাইতেছি?”
কমলা কহিল, “দেশে যাইতেছি।”
রমেশ। দেশ তো তোমার ভালো লাগে না–আমরা দেশে যাইব না।
কমলা। আমার জন্যে তুমি দেশে যাওয়া বন্ধ করিয়াছ?
রমেশ। হাঁ, তোমারই জন্যে।
কমলা মুখ ভার করিয়া কহিল, “কেন তা করিলে? আমি একদিন কথায় কথায় কী বলিয়াছিলাম, সেটা
বুঝি এমন করিয়া মনে লইতে আছে? তুমি কিন্তু ভারি অল্পেতেই রাগ কর।”
রমেশ হাসিয়া কহিল, “আমি কিছুমাত্র রাগ করি নাই। দেশে যাইবার ইচ্ছা আমারও নাই।”
কমলা তখন উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে আমরা কোথায় যাইতেছি?”
রমেশ। পশ্চিমে।
‘পশ্চিমে’ শুনিয়া কমলার চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। পশ্চিমে! যে লোক চিরদিন ঘরের মধ্যে কাটাইয়াছে এক ‘পশ্চিম’ বলিতে তাহার কাছে কতখানি বোঝায়! পশ্চিমে তীর্থ, পশ্চিমে স্বাসথ্য, পশ্চিমে নব নব দেশ, নব নব দৃশ্য, কত রাজা ও সম্রাটের পুরাতন কীর্তি, কত কারুখচিত দেবালয়, কত প্রাচীন কাহিনী, কত বীরত্বের ইতিহাস!
কমলা পুলকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “পশ্চিমে আমরা কোথায় যাইতেছি?”
রমেশ কহিল, “কিছুই ঠিক নাই। মুঙ্গের, পাটনা, দানাপুর, বক্‌সার, গাজিপুর, কাশী, যেখানে হউক এক জায়গায় গিয়া উঠা যাইবে।”
এই-সকল কতক-জানা এবং না-জানা শহরের নাম শুনিয়া কমলার কল্পনাবৃত্তি আরো উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সে হাততালি দিয়া কহিল, “ভারি মজা হইবে।”
রমেশ কহিল, “মজা তো পরে হইবে, কিন্তু এ কয়দিন খাওয়াদাওয়ার কী করা যাইবে? তুমি খালাসিদের হাতের রান্না খাইতে পারিবে?”
কমলা ঘৃণায় মুখ বিকৃত করিয়া কহিল, “মা গো! সে আমি পারিব না।”
রমেশ। তাহা হইলে কী উপায় করিবে?
কমলা। কেন, আমি নিজে রাঁধিয়া লইব।
রমেশ। তুমি রাঁধিতে পার?
কমলা হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “তুমি আমাকে কী যে ভাব জানি না। রাঁধিতে পারি না তো কী? আমি কি কচি খুকি? মামার বাড়িতে আমি তো বরাবর রাঁধিয়া আসিয়াছি।”
রমেশ তৎক্ষণাৎ অনুতাপ প্রকাশ করিয়া কহিল, “তাই তো, তোমাকে এই প্রশ্নটা করা ঠিক সংগত হয় নাই। তাহা হইলে এখন হইতে রাঁধিবার জোগাড় করা যাক–কী বল?”
এই বলিয়া রমেশ চলিয়া গেল এবং সন্ধান করিয়া এক লোহার উনুন সংগ্রহ করিল। শুধু তাই নয়, কাশী পৌঁছাইয়া দিবার খরচ ও বেতনের প্রলোভনে উমেশ বলিয়া এক কায়স্থবালককে জল-তোলা বাসন-মাজা প্রভৃতি কাজের জন্য নিযুক্ত করিল।
রমেশ কহিল, “কমলা, আজ কী রান্না হইবে?”
কমলা কহিল, “তোমার তো ভারি জোগাড় আছে! এক ডাল আর চাল–আজ খিচুড়ি হইবে।”
রমেশ খালাসিদের নিকট হইতে কমলার নির্দেশমত মসলা সংগ্রহ করিয়া আনিল।
রমেশের অনভিজ্ঞতায় কমলা হাসিয়া উঠিল; কহিল, “শুধু মসলা লইয়া কী করিব? শিল-নোড়া নহিলে বাটিব কী করিয়া? তুমি তো বেশ!”
বালিকার এই অবজ্ঞা বহন করিয়া রমেশ শিল-নোড়ার সন্ধানে ছুটিল। শিল-নোড়া না পাইয়া খালাসিদের কাছ হইতে এক লোহার হামানদিস্তা ধার করিয়া আনিল।
হামানদিস্তায় মসলা কোটা কমলার অভ্যাস ছিল না। অগত্যা তাহাই লইয়া বসিতে হইল। রমেশ কহিল, “মসলা নাহয় আর কাহাকেও দিয়া পিষাইয়া আনিতেছি।”

নৌকাডুবি ২৩ (২)

কমলার তাহা মনঃপূত হইল না। সে নিজেই উৎসাহসহকারে কাজ আরম্ভ করিল। এই অনভ্যস্ত প্রণালীর অসুবিধাতে তাহার কৌতুকবোধ হইল। মসলা লাফাইয়া উঠিয়া চারি দিকে ছিটকাইয়া পড়ে, আর সে হাসি রাখিতে পারে না। তাহার এই হাসি দেখিয়া রমেশেরও হাসি পায়।
এইরূপে মসলা কোটার অধ্যায় শেষ করিয়া কোমরে আঁচল জড়াইয়া একটা দরমাঘেরা জায়গায় কমলা রান্না চড়াইয়া দিল। কলিকাতা হইতে একটা হাঁড়িতে করিয়া সন্দেশ আনা হইয়াছিল, সেই হাঁড়িতেই কাজ চালাইয়া লইতে হইল।
রান্না চড়াইয়া দিয়া কমলা রমেশকে কহিল; “তুমি যাও, শীঘ্র স্নান করিয়া লও, আমার রান্না হইতে বেশি দেরি হইবে না।”
রান্নাও হইল, রমেশও স্নান করিয়া আসিল। এখন প্রশ্ন উঠিল, থাল তো নাই, কিসে খাওয়া যায়?
রমেশ অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কহিল, “খালাসিদের কাছ হইতে সানকি ধার করিয়া আনা যাইতে পারে।”
কমলা কহিল, “ছি!”
রমেশ মৃদুস্বরে জানাইল, এরূপ অনাচার পূর্বেও তাহার দ্বারা অনুষ্ঠিত হইয়াছে।
কমলা কহিল, “পূর্বে যা হইয়াছে তা হইয়াছে, এখন হইতে হইবে না–আমি ও দেখিতে পারিব না।”
এই বলিয়া সে নিজেই সন্দেশের মুখে যে সরা ছিল, তাহাই ভালো করিয়া ধুইয়া আনিয়া উপস্থিত করিল। কহিল, “আজকের মতো তুমি ইহাতেই খাও, পরে দেখা যাইবে।”
জল দিয়া ধুইয়া আহারস্থান প্রস্তুত হইলে রমেশ শুদ্ধভাবে খাইতে বসিয়া গেল। দুই-এক গ্রাস মুখে তুলিয়া কহিল, “বাঃ, চমৎকার হইয়াছে।”
কমলা লজ্জিত হইয়া কহিল, “যাও, ঠাট্টা করিতে হইবে না।”
রমেশ কহিল, “ঠা ঠাট্টা নয় তাহা এখনি দেখিতে পাইবে।” বলিয়া পাতের অন্ন দেখিতে দেখিতে নিঃশেষ করিয়া আবার চাহিল। কমলা এবারে অনেক বেশি করিয়া দিল। রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “ও কী করিতেছ? তোমার নিজের জন্য কিছু আছে তো?”
“ঢের আছে–সেজন্যে তোমার ভাবিতে হইবে না।”
রমেশের তৃপ্তিপূর্বক আহারে কমলা ভারি খুশি হইল। রমেশ কহিল, “তুমি কিসে খাইবে?”
কমলা কহিল, “কেন, ঐ সরাতেই হইবে।”
রমেশ অস্থির হইয়া উঠিল। কহিল, “না, সে হইতেই পারে না।”
কমলা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “কেন, হইবে না কেন?”
রমেশ কহিল, “না না, সে কি হয়!”
কমলা কহিল, “খুব হইবে–আমি সব ঠিক করিয়া লইতেছি। উমেশ, তুই কিসে খাইবি?”
উমেশ কহিল, “মাঠাকরুন, নীচে ময়রা খাবার বেচিতেছে তাহার কাছ হইতে শালপাতা চাহিয়া আনিতেছি।”
রমেশ কহিল, “তুমি যদি ঐ সরাতেই খাইবে তো আমাকে দাও, আমি ভালো করিয়া ধুইয়া আনিতেছি।”
কমলা কেবল সংক্ষেপে কহিল, “পাগল হইয়াছ!” ক্ষণকাল পরে সে বলিয়া উঠিল, “কিন্তু পান তৈরি করিতে পারি নাই, তুমি আমাকে পান আনাইয়া দাও নাই।”
রমেশ কহিল, “নীচে পানওয়ালা পান বেচিতেছে।”
এমনি করিয়া অতি সহজেই ঘরকন্না শুরু হইল। রমেশ মনে মনে উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিল। সে ভাবিতে লাগিল-দোম্পত্যের ভাবকে কেমন করিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায়।
গৃহিণীর পদ অধিকার করিয়া লইবার জন্য কমলা বাহিরের কোনো সহায়তা বা শিক্ষার প্রত্যাশা রাখে না। সে যতদিন তাহার মামার বাড়িতে ছিল, রাঁধিয়াছে-বাড়িয়াছে, ছেলে মানুষ করিয়াছে, ঘরের কাজ চালাইয়াছে। তাহার নৈপুণ্য, তৎপরতা ও কর্মের আনন্দ দেখিয়া রমেশের ভারি সুন্দর লাগিল; কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও সে ভাবিতে লাগল, ‘ভবিষ্যতে ইহাকে লইয়া কী ভাবে চলা যাইবে? ইহাকে কেমন করিয়া কাছে রাখিব, অথচ দূরে রাখিয়া দিব? দুই জনের মাঝখানে গণ্ডির রেখাটা কোন্‌খানে টানা উচিত?’ উভয়ের মধ্যে যদি হেমনলিনী থাকিত তাহা হইলে সমস্তই সুন্দর হইয়া উঠিত। কিন্তু সে আশা যদি ত্যাগ করিতেই হয়, তবে একলা কমলাকে লইয়া সমস্ত সমস্যার মীমাংসা যে কী করিয়া হইতে পারে তাহা ভাবিয়া পাওয়া কঠিন। রমেশ স্থির করিল–আসল কথাটা কমলাকে খুলিয়া বলাই উচিত, ইহার পর আর চাপিয়া রাখা চলে না।

নৌকাডুবি ২৪

তখনো বেলা যায় নাই, এমন সময় স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেল। সেদিন অনেক ঠেলাঠেলিতেও স্টীমার ভাসিল না। উঁচু পাড়ের নীচে জলচর পাখিদের পদাঙ্কখচিত এক স্তর বালুকাময় নিমনতট কিছু দূর হইতে বিস্তীর্ণ হইয়া নদীতে আসিয়া নামিয়াছে। সেইখানে গ্রামবধূরা তখন দিনান্তের শেষ জলসঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য ঘট লইয়া আসিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে কোনো কোনো প্রগল্‌ভা বিনা অবগুণ্ঠনে এবং কোনো কোনো ভীরু ঘোমটার অন্তরাল হইতে স্টীমারের দিকে চাহিয়া কৌতূহল মিটাইতেছিল। উর্ধ্বনাসিক স্পর্ধিত জলযানটার দুর্বিপাকে গ্রামের ছেলেগুলো পাড়ের উপরে দাঁড়াইয়া চীৎকারস্বরে ব্যঙ্গোক্তি করিতে করিতে নৃত্য করিতেছিল।
ও পারের জনশূন্য চরের মধ্যে সূর্য অস্ত গেল। রমেশ জাহাজের রেলিং ধরিয়া সন্ধ্যার আভায় দীপ্যমান পশ্চিম দিগন্তের দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া ছিল। কমলা তাহার বেড়া-দেওয়া রাঁধিবার জায়গা হইতে আসিয়া কামরার দরজার পাশে দাঁড়াইল। রমেশ শীঘ্র পশ্চাতে মুখ ফিরাইবে এমন সম্ভাবনা না দেখিয়া সে মৃদুভাবে একটু-আধটু কাসিল, তাহাতেও কোনো ফল হইল না; অবশেষে তাহার চাবির গোছা দিয়া দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ করিতে লাগিল। শব্দ যখন প্রবলতর হইল তখন রমেশ মুখ ফিরাইল। কমলাকে দেখিয়া তার কাছে আসিয়া কহিল, “এ তোমার কিরকম ডাকিবার প্রণালী?”
কমলা কহিল, “তা, কিরকম করিয়া ডাকিব?”
রমেশ কহিল, “কেন, বাপ-মায়ে আমার নামকরণ করিয়াছিলেন কিসের জন্য, যদি কোনো ব্যবহারেই না লাগিবে? প্রয়োজনের সময় আমাকে রমেশবাবু বলিয়া ডাকিলে ক্ষতি কী?”
আবার সেই একই রকম ঠাট্টা! কমলার কপোলে এবং কর্ণমূলে সন্ধ্যার আভার উপরে আরো একটুখানি রক্তিম আভা যোগ দিল; সে মাথা বাঁকাইয়া কহিল, “তুমি কী যে বল তাহার ঠিক নাই। শোনো, তোমার খাবার তৈরি, একটু সকাল-সকাল খাইয়া লও। আজ ও বেলায় ভালো করিয়া খাওয়া হয় নাই।”
নদীর বাতাসে রমেশের ক্ষুধাবোধ হইতেছিল। আয়োজনের অভাবে পাছে কমলা ব্যস্ত হইয়া পড়ে সেইজন্য কিছুই বলে নাই; এমন সময়ে অযাচিত আহারের সংবাদে তাহার মনে যে একটা সুখের আন্দোলন তুলিল তাহার মধ্যে একটু বৈচিত্র্য ছিল। কেবল ক্ষুধানিবৃত্তির আসন্ন সম্ভাবনার সুখ নহে; কিন্তু সে যখন জানিতেছে না তখনো যে তাহার জন্য একটি চিন্তা জাগ্রত আছে, একটি চেষ্টা ব্যাপৃত রহিয়াছে, তাহার সম্বন্ধে একটি কল্যাণের বিধান স্বতই কাজ করিয়া চলিয়াছে, ইহার গৌরব সে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব না করিয়া থাকিতে পারিল না। কিন্তু ইহা তাহার প্রাপ্য নহে, এতবড়ো জিনিসটা কেবল ভ্রমের উপরেই প্রতিষ্ঠিত এই চিন্তার নিষ্ঠুর আঘাতও সে এড়াইতে পারিল না–সে শির নত করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।
কমলা তাহার মুখের ভাব দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, ‘তোমার বুঝি খাইতে ইচ্ছা নাই? ক্ষুধা পায় নাই? আমি কি তোমাকে জোর করিয়া খাইতে বলিতেছি?”
রমেশ তাড়াতাড়ি প্রফুল্লতার ভান করিয়া কহিল, “তোমাকে জোর করিতে হইবে কেন, আমার পেটের মধ্যেই জোর করিতেছে। এখন তো খুব চাবি ঠক্‌ ঠক্‌ করিয়া ডাকিয়া আনিলে, শেষকালে পরিবেশনের সময় যেন দর্পহারী মধুসূদন দেখা না দেন।”
এই বলিয়া রমেশ চারি দিকে চাহিয়া কহিল, “কই, খাদ্যদ্রব্য তো কিছু দেখি না। খুব ক্ষুধার জোর থাকিলেও এই আসবাবগুলা আমার হজম হইবে না; ছেলেবেলা হইতে আমার অন্যরকম অভ্যাস।”

নৌকাডুবি ২৪ (২)

রমেশ কামরার বিছানা প্রভৃতি অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।
কমলা খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসির বেগ থামিলে কহিল, “এখন বুঝি আর সবুর সহিতেছে না? যখন আকাশের দিকে তাকাইয়া ছিলে তখন বুঝি ক্ষুধাতৃষ্ণা ছিল না? আর যেমনি আমি ডাকিলাম অমনি মনে পড়িয়া গেল, ভারি ক্ষুধা পাইয়াছে। আচ্ছা তুমি এক মিনিট বোসো, আমি আনিয়া দিতেছি।”
রমেশ কহিল, “কিন্তু দেরি হইলে এই বিছানাপত্র কিছুই দেখিতে পাইবে না–তখন আমার দোষ দিয়ো না।”
রসিকতার এই পুনরুক্তিতে কমলার কম আমোদ বোধ হইল না। তাহার আবার ভারি হাসি পাইল। সরল হাস্যোচ্ছ্বাসে ঘরকে সুধাময় করিয়া দিয়া কমলা দ্রুতপদে খাবার আনিতে গেল। রমেশের কাষ্ঠপ্রফুল্লতার ছদ্মদীপ্তি মুহূর্তের মধ্যে কালিমায় ব্যাপ্ত হইল।
উপরে-শালপাতা-ঢাকা একটা চাঙারি লইয়া অনতিকাল পরেই কমলা কামরায় প্রবেশ করিল। বিছানার
উপরে চাঙারি রাখিয়া আঁচল দিয়া ঘরের মেঝে মুছিতে লাগিল। রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “ও কী করিতেছ?” কমলা কহিল, “আমি তো এখনি কাপড় ছাড়িয়া ফেলিব।” এই বলিয়া শালপাতা তুলিয়া পাতিল ও তাহার
উপরে লুচি ও তরকারি নিপুণ হস্তে সাজাইয়া দিল। রমেশ কহিল, “কী আশ্চর্য! লুচির জোগাড় করিলে কী করিয়া?’ কমলা সহজে রহস্য ফাঁস না করিয়া অত্যন্ত নিগূঢ়ভাব ধারণ করিয়া কহিল, “কেমন করিয়া বলো দেখি।” রমেশ কঠিন চিন্তার ভাব করিয়া কহিল, “নিশ্চয়ই খালাসিদের জলখাবার হইতে ভাগ বসাইয়াছ।” কমলা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া কহিল, “কক্‌খনো না। রাম বলো!” রমেশ খাইতে খাইতে লুচির আদিকারণ সম্বন্ধে যত রাজ্যের অসম্ভব কল্পনা দ্বারা কমলাকে রাগাইয়া তুলিল। যখন বলিল ‘আরব্য-উপন্যাসের প্রদীপওয়ালা আলাদীন বেলুচিস্থান হইতে গরম-গরম ভাজাইয়া তাহার দৈত্যকে দিয়া সওগাদ পাঠাইয়াছে’ তখন কমলার আর ধৈর্য কিছুতেই রহিল না; সে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “তবে যাও আমি বলিব না।”
রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না, না, আমি হার মানিতেছি। মাঝদরিয়ায় লুচি,এ যে কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে, আমি তো ভাবিয়া পাইতেছি না, কিন্তু তবু খাইতে চমৎকার লাগিতেছে।” এই বলিয়া রমেশ তত্ত্বনির্ণয় অপেক্ষা ক্ষুধানিবৃত্তির শ্রেষ্ঠতা সবেগে সপ্রমাণ করিতে লাগিল। স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেলে, শূন্যভাণ্ডারপূরণের চেষ্টায় কমলা উমেশকে গ্রামে পাঠাইয়াছিল। স্কুলে থাকিতে জলপানি-স্বরূপে রমেশ কমলাকে যে কয়টি টাকা দিয়াছিল, তাহারই মধ্য হইতে অল্প কিছু বাঁচিয়াছিল, তাহাই দিয়া কিছু ঘি-ময়দা সংগ্রহ হইল। উমেশকে কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কী খাবি বল্‌ দেখি।”
উমেশ কহিল, “মাঠাকরুন, দয়া কর যদি, গ্রামে গোয়ালার বাড়িতে বড়ো সরেস দই দেখিয়া আসিলাম। কলা তো ঘরেই আছে, আর পয়সা-দুয়েকের চিঁড়ে-মুড়কি হইলেই পেট ভরিয়া আজ ফলার করিয়া লই।” লুব্ধ বালকের ফলারের উৎসাহে কমলাও উৎসাহিত হইয়া উঠিল; কহিল, “পয়সা কিছু বাঁচিয়াছে উমেশ?”

নৌকাডুবি ২৪ (৩)

উমেশ কহিল, “কিছু না মা।” কমলা মুশকিলে পড়িয়া গেল। রমেশের কাছে কেমন করিয়া মুখ ফুটিয়া টাকা চাহিবে, তাই ভাবিতে লাগিল। একটু পরে বলিল, “তোর ভাগ্যে আজ যদি ফলার না’ই জোটে, তবে লুচি আছে–তোর ভাবনা নাই।
চল্‌, ময়দা মাখবি চল্‌।” উমেশ কহিল, “কিন্তু মা, দই যা দেখিয়া আসিলাম সে আর কী বলিব।” কমলা কহিল, “দেখ্‌ উমেশ, বাবু যখন খাইতে বসিবেন তখন তুই তোর বাজারের পয়সা চাইতে আসিস।” রমেশের আহার কতকটা অগ্রসর হইলে, উমেশ আসিয়া দাঁড়াইয়া সসংকোচে মাথা চুলকাইতে লাগিল।
রমেশ তাহার মুখের দিকে চাহিল। সে অর্ধোক্তিতে কহিল, “মা, বাজারের পয়সা–”
তখন রমেশের হঠাৎ চেতনা হইল যে, আহারের আয়োজন করিতে হইলে অর্থের প্রয়োজন হয়, আলাদীনের প্রদীপের অপেক্ষা করিলে চলে না। ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কমলা, তোমার কাছে তো টাকা কিছুই নাই। আমাকে মনে করাইয়া দাও নাই কেন?”
কমলা নীরবে অপরাধ স্বীকার করিয়া লইল। আহারান্তে রমেশ কমলার হাতে একটি ছোটো ক্যাশব্যাক্স দিয়া কহিল, “এখনকার মতো তোমার ধনরত্ন সব এইটেতেই রহিল।” এইরূপে গৃহিণীপনার সমস্ত ভারই আপনা হইতেই কমলার হাতে গিয়া পড়িতেছে, রমেশ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া আবার একবার জাহাজের রেলিং ধরিয়া পশ্চিম আকাশের দিকে চাহিল। পশ্চিম আকাশ দেখিতে দেখিতে তাহার চোখের উপরে সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া আসিল।
উমেশ আজ পেট ভরিয়া চিঁড়ে দই কলা মাখিয়া ফলার করিল। কমলা সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার জীবনবৃত্তান্ত সবিস্তারে আয়ত্ত করিয়া লইল।
বিমাতা-শাসিত গৃহের উপেক্ষিত উমেশ কাশীতে তাহার মাতামহীর কাছে পালাইয়া যাইতেছিল; সে কহিল, “মা, যদি তোমাদের কাছেই রাখ তবে আমি আর কোথাও যাই না।”
মাতৃহীন বালকের মুখে মা-সম্ভাষণ শুনিয়া বালিকার কোমল হৃদয়ের কোন্‌-এক গভীরদেশ হইতে জননী সাড়া দিল; কমলা স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই আমাদের সঙ্গেই চল্‌”

নৌকাডুবি ২৫

তীরের বনরাজি অবিচ্ছিন্ন মসীলেখায় সন্ধ্যবধূর সোনার অঞ্চলে কালো পাড় টানিয়া দিল। গ্রামান্তরের বিলের মধ্যে সমস্ত দিন চরিয়া বন্যহংসের দল আকাশের মলানায়মান সূর্যাস্তদীপ্তির মধ্য দিয়া ও পারের তরুশূন্য বালুচরে নিভৃত জলাশয়গুলিতে রাত্রিযাপনের জন্য চলিয়াছে। কাকেদের বাসায় আসিবার কলরব থামিয়া গেছে। নদীতে তখন নৌকা ছিল না; একটিমাত্র বড়ো ডিঙি গাঢ় সোনালি-সবুজ নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া আপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চালিয়াছিল।
রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবোদিত শুক্লপক্ষের তরুণ চাঁদের আলোকে বেতের কেদারা টানিয়া লইয়া বসিয়া ছিল।
পশ্চিম-আকাশ হইতে সন্ধ্যার শেষ স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল; চন্দ্রালোকের ইন্দ্রজালে কঠিন জগৎ যেন বিগলিত হইয়া আসিল। রমেশ আপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল “হেম, হেম!” সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন সুমধুর স্পর্শরূপে তাহার সমস্ত হৃদয়কে বারংবার বেষ্টন করিয়া প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিল, সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন অপরিমেয়করুণারসার্দ্র দুইটি চক্ষুরূপে তাহার মুখের উপরে বেদনা বিকীর্ণ করিয়া চাহিয়া রহিল। রমেশের সর্বশরীর পুলকিত এবং দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া আসিল।
তাহার গত দুই বৎসরের জীবনের সমস্ত ইতিহাস তাহার মনের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল; হেমনলিনীর সহিত তাহার প্রথম পরিচয়ের দিন মনে পড়িয়া গেল। সে দিনকে রমেশ তাহার জীবনের একটি বিশেষ দিন বলিয়া চিনিতে পারে নাই। যোগেন্দ্র যখন তাহাকে তাহাদের চায়ের টেবিলে লইয়া গেল, সেখানে হেমনলিনীকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া লাজুক রমেশ আপনাকে নিতান্ত বিপন্ন বোধ করিয়াছিল। অল্পে অল্পে লজ্জা ভাঙিয়া গেল, হেমনলিনীর সঙ্গ অভ্যস্ত হইয়া আসিল, ক্রমে সেই অভ্যাসের বন্ধন রমেশকে বন্দী করিয়া তুলিল। কাব্যসাহিত্যে রমেশ প্রেমের কথা যাহা-কিছু পড়িয়াছিল সমস্তই সে হেমনলিনীর প্রতি আরোপ করিতে আরম্ভ করিল। ‘আমি ভালোবাসিতেছি’ মনে করিয়া সে মনে মনে একটা অহংকার অনুভব করিল। তাহার সহপাঠীরা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হইবার জন্য ভালোবাসার কবিতার অর্থ মুখস্থ করিয়া মরে, আর রমেশ সত্যসত্যই ভালোবাসে, ইহা চিন্তা করিয়া অন্য ছাত্রদিগকে সে কৃপাপাত্র মনে করিত। রমেশ আজ আলোচনা করিয়া দেখিল, সেদিনও সে ভালোবাসার বহির্‌দ্বারেই ছিল। কিন্তু যখন অকসমাৎ কমলা আসিয়া তাহার জীবন-সমস্যাকে জটিল করিয়া তুলিল তখনই নানা বিরুদ্ধ ঘাতপ্রতিঘাতে দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর প্রতি তাহার প্রেম আকার ধারণ করিয়া, জীবন গ্রহণ করিয়া, জাগ্রত হইয়া উঠিল।
রমেশ তাহার দুই করতলের উপরে শির নত করিয়া ভাবিতে লাগিল, সম্মুখে সমস্ত জীবনই তো পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার ক্ষুধিত উপবাসী জীবন–দুশ্ছেদ্য সংকটজালে বিজড়িত। এ জাল কি সে সবলে দুই হাত দিয়া ছিন্ন করিয়া ফেলিবে না?
এই বলিয়া সে দৃঢ়সংকল্পের আবেগে হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল, অদূরে আর-একটা বেতের চৌকির পিঠের উপরে হাত রাখিয়া কমলা দাঁড়াইয়া আছে। কমলা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তুমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলে, আমি বুঝি তোমাকে জাগাইয়া দিলাম?”
অনুতপ্ত কমলাকে চলিয়া যাইতে উদ্যত দেখিয়া রমেশ তাড়াতাড়ি কহিল, “না না কমলা, আমি ঘুমাই নাই–তুমি বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি।”
গল্পের কথা শুনিয়া কমলা পুলকিত হইয়া চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল। রমেশ স্থির করিয়াছিল, কমলাকে সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বলা অত্যাবশ্যক হইয়াছে। কিন্তু এতবড়ো একটা আঘাত হঠাৎ সে দিতে পারিল নাতোই বলিল, “বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি।”
রমেশ কহিল, “সেকালে এক জাতি ক্ষত্রিয় ছিল, তাহারা–”
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কবেকার কালে? অনেককাল আগে?”
রমেশ কহিল, “হ্যাঁ সে অনেককাল আগে। তখন তোমার জন্ম হয় নাই।”
কমলা। তোমারই নাকি জন্ম হইয়াছিল ! তুমি নাকি বহুকালের লোক। তার পরে ?
রমেশ। সেই ক্ষত্রিয়দের নিয়ম ছিল, তাহারা নিজে বিবহ করিতে না গিয়া তলোয়ার পাঠাইয়া দিত। সেই তলোয়ারের সহিত বধূর বিবাহ হইয়া গেলে তাহাকে বাড়িতে আনিয়া আবার বিবাহ করিত।”

নৌকাডুবি ২৫ (২)

কমলা। না না, ছিঃ ও কী রকম বিবাহ!
রমেশ। আমিও ও রকম বিবাহ পছন্দ করি না,কিন্তু কী করিব, যে ক্ষত্রিয়দের কথা বলিতেছি তাহারা শ্বশুরবাড়ি নিজে গিয়া বিবাহ করিতে অপমান বোধ করিত। আমি যে রাজার গল্প বলিতেছি সে ঐ জাতের ক্ষত্রিয় ছিল। একদিন সে-
কমলা। তুমি তো বলিলে না, সে কোথাকার রাজা?
রমেশ বলিয়া দিল, “মদ্রদেশের রাজা। একদিন সেই রাজা–”
কমলা। রাজার নাম কী আগে বলো।
কমলা সকল কথা স্পষ্ট করিয়া লইতে চায়, তাহার কাছে কিছুই উহ্য রাখিলে চলিবে না। রমেশ এতটা জানিলে আগে হইতে আরো বেশি প্রস্তুত হইয়া থাকিত; এখন দেখিল, কমলার গল্প শুনিতে যতই আগ্রহ থাক্‌, গল্পের কোনো জায়গায় তাহার ফাঁকি সহ্য হয় না।
রমেশ হঠাৎ প্রশ্নে একটু থমকিয়া বলিল, “রাজার নাম রণজিৎ সিং।”
কমলা একবার আবৃত্তি করিয়া লইল, “রণজিৎ সিং, মদ্রদেশের রাজা। তার পরে?”
রমেশ। তার পরে একদিন রাজা ভাটের মুখে শুনিলেন, তাঁহারই জাতের আর-এক রাজার এক পরমাসুন্দরী কন্যা আছে।
কমলা। সে আবার কোথাকার রাজা?
রমেশ। মনে করো, সে কাঞ্চীর রাজা।
কমলা। মনে করিব কী! তবে সত্য কি সে কাঞ্চীর রাজা নয়?
রমেশ। কাঞ্চীরই রাজা বটে। তুমি তার নাম জানিতে চাও? তার নাম অমর সিং।
কমলা। সেই মেয়ের নাম তো বলিলে না?–সেই পরমাসুন্দরী কন্যা!
রমেশ। হাঁ হাঁ, ভুল হইয়াছে বটে। সেই মেয়ের নাম–তাহার নাম–ওঃ, তাহার নাম চন্দ্রা-
কমলা। আশ্চর্য! তুমি এমন ভুলিয়া যাও! তুমি তো আমারই নাম ভুলিয়াছিলে।
রমেশ। কোশলের রাজা ভাটের মুখে এই কথা শুনিয়া-
কমলা। কোশলের রাজা কোথা হইতে আসিল? তুমি যে বলিলে মদ্রদেশের রাজা-
রমেশ। সে কি এক জায়গার রাজা ছিল মনে কর? সে কোশলেরও রাজা, মদ্রেরও রাজা।
কমলা। দুই রাজ্য বুঝি পাশাপাশি?
রমেশ। একেবারে গায়ে গায়ে লাগাও।
এইরূপে বারংবার ভুল করিতে করিতে ও সতর্ক কমলার প্রশ্নের সাহায্যে সেইসকল ভুল কোনোমতে সংশোধন করিতে করিতে রমেশ এইরূপ ভাবে গল্পটি বলিয়া গেল-
মদ্ররাজ রণজিৎ সিং কাঞ্চীরাজের নিকট রাজকন্যাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব জানাইয়া দূত পাঠাইয়া দিলেন। কাঞ্চীর রাজা অমর সিং খুশি হইয়া সম্মত হইলেন।
তখন রণজিৎ সিংহের ছোটো ভাই ইন্দ্রজিৎ সিং সৈন্যসামন্ত লইয়া নিশান উড়াইয়া কাড়া-নাকাড়া দুন্দুভি-দামামা বাজাইয়া কাঞ্চীর রাজোদ্যানে গিয়া তাঁবু ফেলিলেন। কাঞ্চীনগরে উৎসবের সমারোহ পড়িয়া গেল।
রাজার দৈবজ্ঞ গণনা করিয়া শুভ দিনক্ষণ স্থির করিয়া দিল। কৃষ্ণা দ্বাদশীতিথিতে রাত্রি আড়াই প্রহরের পর লগ্ন। রাত্রে নগরের ঘরে ঘরে ফুলের মালা দুলিল এবং দীপাবলী জ্বলিয়া উঠিল। আজ রাত্রে রাজকুমারী চন্দ্রার বিবাহ।
কিন্তু কাহার সহিত বিবাহ রাজকন্যা চন্দ্রা সে কথা জানেন না। তাঁহার জন্মকালে পরমহংস পরমানন্দস্বামী রাজাকে বলিয়াছিলেন, ‘তোমার এই কন্যার প্রতি অশুভগ্রহের দৃষ্টি আছে, বিবাহকালে পাত্রের নাম যেন এ কন্যা জানিতে না পারে।’

নৌকাডুবি ২৫ (৩)

যথাকালে তরবারির সহিত রাজকন্যার গ্রন্থিবন্ধন হইয়া গেল। ইন্দ্রজিৎ সিং যৌতুক আনিয়া তাঁহার ভ্রাতৃবধূকে প্রণাম করিলেন। মদ্ররাজ্যের রণজিৎ এবং ইন্দ্রজিৎ যেন দ্বিতীয় রামলক্ষ্মণ ছিলেন। ইন্দ্রজিৎ আর্যা চন্দ্রার অবগুণ্ঠিত লজ্জারুণ মুখের দিকে তাকাইলেন না; তিনি কেবল তাঁহার নূপুরবেষ্টিত সুকুমার চরণযুগলের অলক্তরেখাটুকুমাত্র দেখিয়াছিলেন।
যথারীতি বিবাহের পরদিনেই মুক্তামালার-ঝালর-দেওয়া পালঙ্কে বধূকে লইয়া ইন্দ্রজিৎ স্বদেশের দিকে যাত্রা করিলেন। অশুভগ্রহের কথা সমরণ করিয়া শঙ্কিতহৃদয়ে কাঞ্চীরাজ কন্যার মস্তকের উপরে দক্ষিণ হস্ত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন, মাতা কন্যার মুখচুম্বন করিয়া অশ্রুজল সংবরণ করিতে পারিলেন না-দেবমন্দিরে সহস্র গ্রহবিপ্র স্বস্ত্যয়নে নিযুক্ত হইল।
কাঞ্চী হইতে মদ্র বহুদূর, প্রায় এক মাসের পথ। দ্বিতীয় রাত্রে যখন বেতসা-নদীর তীরে শিবির রাখিয়া ইন্দ্রজিতের দলবল বিশ্রামের আয়োজন করিতেছে, এমন সময় বনের মধ্যে মশালের আলো দেখা গেল। ব্যাপারখানা কী জানিবার জন্য ইন্দ্রজিৎ সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন।
সৈনিক আসিয়া কহিল, ‘কুমার, ইহারাও আর-একটি বিবাহের যাত্রিদল। ইহারাও আমাদের স্বশ্রেণীয় ক্ষত্রিয়, অসেত্রাদ্‌বাহ সমাধা করিয়া বধূকে পতিগৃহে লইয়া চলিয়াছে। পথে নানা বিঘ্নভয় আছে, তাই ইহারা কুমারের শরণ প্রার্থনা করিতেছে; আদেশ পাইলে কিছুদূর পথ ইহারা আমাদের আশ্রয়ে যাত্রা করে।”
কুমার ইন্দ্রজিৎ কহিলেন, “শরণাপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের ধর্ম। যত্ন করিয়া ইহাদিগকে রক্ষা করিবে।”
এইরূপে দুই শিবির একত্র মিলিত হইল।
তৃতীয় রাত্রি অমাবস্যা। সম্মুখে ছোটো ছোটো পাহাড়, পশ্চাতে অরণ্য। শ্রান্ত সৈনিকেরা ঝিল্লির শব্দে ও অদূরবর্তী ঝর্নার কলধ্বনিতে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।
এমন সময়ে হঠাৎ কলরবে সকলে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, মদ্র-শিবিরের ঘোড়াগুলি উন্মত্তের ন্যায় ছুটাছুটি করিতেছে–কে তাহাদের রজ্জু কাটিয়া দিয়াছে–এবং মাঝে মাঝে এক-একটা তাঁবুতে আগুন লাগিয়াছে ও তাহার দীপ্তিতে অমারাত্রি রক্তিমবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।
বুঝা গেল, দস্যু আক্রমণ করিয়াছে। মারামারি-কাটাকাটি বাধিয়া গেল–অন্ধকারে শত্রু-মিত্র ভেদ করা কঠিন; সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল। দস্যুরা সেই সুযোগে লুটপাট করিয়া অরণ্যে-পর্বতে অন্তর্ধান করিল।
যুদ্ধ-অন্তে রাজকুমারীকে আর দেখা গেল না। তিনি ভয়ে শিবির হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং একদল পলায়নপর লোককে স্বপক্ষ মনে করিয়া তাহাদের সহিত মিশিয়া গিয়াছিলেন।
তাহারা অন্য বিবাহের দল। গোলেমালে তাহাদের বধূকে দস্যুরা হরণ করিয়া লইয়া গেছে। রাজকন্যা চন্দ্রাকেই তাহারা নিজেদের বধূ জ্ঞান করিয়া দ্রুতবেগে স্বদেশে যাত্রা করিল।
তাহারা দরিদ্র ক্ষত্রিয়; কলিঙ্গে সমুদ্রতীরে তাহাদের বাস। সেখানে রাজকন্যার সহিত অন্যপক্ষের বরের মিলন হইল। বরের নাম চেৎসিং।
চেৎসিংহের মা আসিয়া বরণ করিয়া বধূকে ঘরে তুলিয়া লইলেন। আত্মীয়স্বজন সকলে আসিয়া কহিল, ‘আহা, এমন রূপ তো দেখা যায় না।”
মুগ্ধ চেৎসিং নববধূকে ঘরের কল্যাণলক্ষ্মী বলিয়া মনে মনে পূজা করিতে লাগিল। রাজকন্যাও সতীধর্মের মর্যাদা বুঝিতেন; তিনি চেৎসিংকে আপন পতি বলিয়া জানিয়া তাহার নিকট মনে মনে আত্মজীবন উৎসর্গ করিয়া দিলেন।
নবপরিণয়ের লজ্জা ভাঙিতে কিছুদিন গেল। যখন লজ্জা ভাঙিল তখন কথায় কথায় চেৎসিং জানিতে পারিল যে, যাহাকে সে বধূ বলিয়া ঘরে লইয়াছে, সে রাজকন্যা চন্দ্রা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *