নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান
ধূসর অ্যাম্বাসাডারটা ফ্যালাকে লক্ষ করেই যোলো হাত চওড়া রাস্তাটায় থামল। ড্রাইভারের আসন থেকে প্রশ্ন হল, এটাই কি ঘোষপাড়া লেন?
বিমূঢ় হয়ে ফ্যালা উঠে দাঁড়াল। প্রশ্নকারী জানলা থেকে মুখটাকে একটুখানি বার করেছে। ফ্যালার আর কোনো সন্দেহ রইল না। অবশ্য কণ্ঠস্বরেই আধখানা চিনেছিল। ঘাড় নেড়ে পাশের গলিটাকে আঙুল তুলে দেখাল।
থ্যাঙ্ক ইউ।
মোটরটা আধখানা ফিরে তাক করতে লাগল গলির মুখটাকে। রিকশা বা ঠেলাগাড়িচালক হলে এত সময় নিত না। ঘোষপাড়া লেনের প্রবেশমুখ সাত হাত চওড়া। ফ্যালার ইচ্ছে করল, হারকিউলিস হয়ে দু-হাতের চাড়ে বাড়িগুলোকে ঠেলে জায়গাটাকে সতেরো হাত করে দিতে।
তা যখন সম্ভব নয়, ফ্যালা যোলো হাত চওড়া রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে বন্ধুদের খুঁজল। কেউ নেই। দোকানে দোকানি, রাস্তায় পথিক। রাস্তাটায় যদিও মাঝে মাঝে প্রাইভেট মোটর আসে, কিন্তু কৌতূহলী হয়ে এখন এক বারও কেউ মুখ তুলে দেখছে না যে গাড়িটা কে চালাচ্ছে। কিংবা দেখেও চিনল না।
সুতরাং ফ্যালা কিছু বিরক্ত হল, কিছু লজ্জা পেল। সর্বসাধারণের এই উদাসীনতা-দোষ স্খলনের জন্য এগিয়ে গিয়ে বলল, ক-নম্বর বাড়ি খুঁজছেন?
তিন। সুনীতি ভটচায। কর্পোরেশন স্কুলের হেডমিস্ট্রেস।
অঃ, একটুখানি গিয়ে ডান দিকে রকওলা বাড়ি, তার পরেরটা।
গাড়িটা কষ্টেসৃষ্টে ঢুকে গেল। বেশিদূর যেতে পারবে না, কারণ মাস দুয়েক আগে কর্পোরেশন থেকে রাস্তায় একটি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ওখানে গাড়িটাকে রেখে হেঁটে যেতে হবে। ফ্যালা ঘাড় কাত করে থাকল যাবতীয় ব্যাপার লক্ষ করার জন্য।
টিউবওয়েলে স্নান করছিল গোবিন্দ দত্ত। গাড়িটা ওর পিছনেই থামল। জলটা ঠাণ্ডা, তাই মাথায় জল ঢেলে থাবড়ে থাবড়ে আমোদ করছিল গোবিন্দ। ভোর ছটায় বেরিয়ে সন্ধ্যা ছ টায় ফেরা। এসময় তিন নম্বর বাড়িটা কোথায় জিজ্ঞাসা করল। ও যে জল ঢালা থামিয়ে কথার জবার দেবে না, প্রশ্নকারী তা কেমন করে জানবে? সুতরাং দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসা করে গোবিন্দর দাঁতখিচুনি দেখে আর কথা বাড়াল না।
ফ্যালা ছুটে এসে গোবিন্দকে চাপা স্বরে ধমকাল, ও কে জান, অমন করে যে কথা বললে?
গোবিন্দ হকচকাল। ঘাড়ের কাছেই গাড়িটা, ঘাড় ফিরিয়ে এক বার তাকিয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, কে?
কী ভাবল বলোতো, আমাদের পাড়া সম্পর্কে! ফ্যালা তাকিয়ে রইল তিন নম্বর বাড়ি পর্যন্ত চোখ পেতে। বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু কীরকম লজ্জা করল। তবে তিন নম্বরের সদর দরজাটা রাস্তার ওপরেই, নম্বরটাও স্পষ্ট দেখা যায় রাস্তার আলোয়। তিনের এক কি তিনের দুই হলে নিশ্চয়ই সঙ্গে যেত।
শেফালিদের বাড়িটা এক-তলা, ছাদে পাঁচিল নেই। সন্ধ্যার পর সে ছাদের ধারে বসে থাকে, রক থেকে ওদের ছাদটা দেখা যায়। ফ্যালারা ওকে বলে শাঁকচুন্নি। বত্রিশে পড়লেও বিয়ে হচ্ছে না। শেফালি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদের কিনারে বসে থাকে। পাড়ার মেয়েরা রাস্তা দিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করে, কোথায় গেছলে গো, সিনেমা? ছোটো ছেলেরা খাবারের ঠোঙা নিয়ে ফিরলে বলে, কে এসেছে রে? পাশের বাড়ির বউ শোবার ঘরের জানালাটা ওর জন্যই সন্ধ্যা থেকে বন্ধ করে দেয়।
শেফালি আগাগোড়া সব দেখেছে। যদিও ফ্যালা পাড়ার ছেলে, বয়সে দু-বছরের ছোটো তবু কথাবার্তা বিশেষ বলে। এখন বলল, এই ফ্যালা, কাদের বাড়িতে রে?
সেই মাস্টারনি, কুকুরকে যে বিস্কুট কিনে খাওয়ায়।
শেফালি এইটুকু শুনেই ইলাবউদির বন্ধ জানালায় কিল বসাতে শুরু করল।
বরুণ মিত্র পাড়ার মাস ছয়েকের ভাড়াটে, কারোর সঙ্গেই মেশে না। ফিরছিল অফিস থেকে। ফ্যালা তাকেই বলল, কার গাড়ি বলতে পারেন?
বাড়িগুলো কলিচটা; বালি বেরিয়ে পান্ডুরবর্ণ। ওর মধ্যেই কালীবাবুর বাড়িটা সদ্য কলি ফেরানো, ফলে মনে হয় গলিটার শ্বেতি হয়েছে। তেইশ নম্বরের ভাঙা ট্যাঙ্কের পাশে অশ্বথ গাছটা বাড়তে চাইলেই লাঠি পিটিয়ে ডালগুলো ভেঙে দেয় ও-বাড়ির সত্যচরণ। ফলে গাছটা ছোট্ট রয়ে গিয়ে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি-জলের পাইপগুলো শিরার মতো দেওয়াল বেয়ে রাস্তা পর্যন্ত নামাননা, কিন্তু এবারের বল খেলার ধকল সইতে না পেরে তলার অংশ অধিকাংশেরই ভাঙা। জানালাগুলো লটপটে বুকপকেটের থেকেও অর্থহীন, ঝড়বৃষ্টিতে কাজে আসে না। গলিতে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকালে প্রথমেই মনে হবে, চিরকুট শাড়ি ফেঁসে গিয়ে বিব্রত কোনো গৌরাঙ্গীর দেহ। গলিতে ঢোকার সময় মানুষজন মুখ তুলে তাকায়, বেরোবার সময় আড়ে আর এক বার।
টিউবওয়েলটা বসানোর ব্যাপারে অনন্ত সিংগির সঙ্গে বাসুদেব নাগের প্রচন্ড একচোট হয়ে গেছল। কুমার চৌধুরি কাউন্সিলর হয়েছে তাঁরই কৃপায়, এরকম একটা ধারণা সিংগিমশাই বরাবরই পোযণ করে আসছেন। সুতরাং কর্পোরেশনের টিউবওয়েলটা তাঁর বাড়ির সামনে বসবে না কেন? বাসুদেবের যুক্তিগুলো অবশ্য পাবলিক বেনিফিটের কথা ভেবেই বলা। তা ছাড়া সিংগিমশাইয়ের বাড়ির দেওয়ালে রাস্তার ইলেকট্রিক আলো বসেছে, টিউবওয়েলটাকেও কি তিনি নিজের সম্পত্তি করতে চান? পাড়ার পাঁচজনের কাছেই বাসুদেব গলা ফুলিয়ে প্রশ্নটা তুলেছিল। ফলে দু-ভাগ হয়ে যায় পাড়াটা। সিংগিমশায়ের বাড়ির সামনেই টিউবওয়েল বসেছে, মধ্যস্থতা করেছেন কালীবাবু। টিউবওয়েলের খ্যাচাং খ্যাচাং শব্দটা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। তা ছাড়া রাস্তাটাও দিনরাত কাদা হয়ে থাকবে। তাই যুক্তি দিলেন ধরো হঠাৎ কারুর রান্নার জল ফুরিয়ে গেল, বাড়িতেও তখন কোনো পুরুষ বা ছোটো ছেলেপিলে নেই যে এক বালতি জল এনে দেয়, তখন কি বউ-ঝিরা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কল থেকে পাম্প করে জল আনবে? বরং পাড়ার ভেতর দিকেই কলটা বসানো ভালো, দেখতেও ডিসেন্ট হয়। বেপাড়ার লোকেরা এসে কলটা খারাপ করে দিতে পারবে না।
বাসু নাগ সেই থেকে কালীবাবুর উপর চটা। বাড়ি সারাবার সময় কালীবাবু দো-তলায় বেআইনি একটা পায়খানা করে। বাসুগিন্নি খবরটা জোগাড় করে আনে, বাসুদেব সেটা কর্পোরেশনে জানিয়ে কালীবাবুর কিছু খসিয়ে দেয়। রাগটা তাতে অনেকখানি কমে গেছে।
ধূসর অ্যাম্বাসাডারটা সিংগিমশায়ের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে তিনি আর পথ খুঁজে পেলেন না। সুতরাং চিৎকার করলেন, গাড়ি কার অ্যা, রাখবার কি জায়গা পেল না; এটা লোকের বেরোবার পথ, এ কী অন্যায়।
কী হল, চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?
ফ্যালা ছুটে এল। সিংগিমশায়ের মেয়ে হাসি রেডিয়ো থেকে গান তুলছিল, সে নেমে এল। সামনের বাড়ির ভবদেব অর্থাৎ ভোম্বলও জানালা থেকে উঁকি দিল।
এদের দেখে ফ্যালা কিছুটা ভারিক্কি হয়ে বলল, অচেনা লোক, আমিই বললুম এখানে রাখুন। তা নয় একটু ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি।
ফ্যালার নির্দেশে গাড়িটা রাখা হয়েছে, এবং ফ্যালা দিন কয়েক আগেই বেপাড়ার একটা ছেলেকে গলির মধ্যে টেনে এনে ঠেঙিয়ে লাট করেছে। সিংগিমশাই চুপ করে রইলেন। বেনেটোলায় তাঁর গন্ধেশ্বর ভান্ডার নামে একটা দোকান আছে। বাড়িওলাটা হজ্জত শুরু করেছে, সিংগিমশায়ের মনোগত বাসনা–ফ্যালাদের দিন কয়েক ঘুরিয়ে আনবেন। সুতরাং ফ্যালাকে চটালেন না, বরং হাত লাগিয়ে তিনিও সাহায্য করলেন।
গাড়িটা দু-হাত এগিয়ে রাখা হল। বাসুদেব অফিস থেকে ফিরছিল। সিংগিমশায়ের বাড়ির সামনে গাড়ি দেখে বিস্মিত হয়ে তাকাল। তাই দেখে সিংগিমশায় ডান পা-টা পিছনের বাম্পারে তুলে দিয়ে শ্লথ ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। গাড়িটা যেন কোনো আত্মীয়ের এবং এতই নিকট যে পা পর্যন্ত তুলতে পারেন। বাসুদেব ঈর্ষাচ্ছন্ন হলেন। ফ্যালা দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল, শালার ঠ্যাংটা ভেঙে দোব নাকি।
ভবদেব অর্থাৎ ভোম্বল, ঘোষপাড়া লেনের অত্যন্ত মানী ছেলে। বর্তমান বয়স চব্বিশ। স্কুলের ম্যাগাজিনে ধর্ম সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে পাড়ার মাতব্বরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কলেজের ম্যাগাজিনে প্রগতিশীল কবিতা লিখে বড়দা, মেজদা এবং সেজদার দুশ্চিন্তা, ক্রোধ এবং বিরক্তি উৎপাদন করে। বর্তমানে সে এই পাড়ার একমাত্র যুবক যে গ্র্যাজুয়েট, একটি লাইব্রেরির সদস্য, রকে আড্ডা দেয় না, বড়োদের সামনে সিগারেট ফোঁকে না, মেয়েদের দিকে মুখ তুলে তাকায় না, এবং তিনশো পঁচাত্তর টাকা মাইনের চাকুরিয়া। এ পাড়ার পিতারা সন্তানদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করার সময় ভোম্বলকে পুত্ররূপে না পাওয়ায় আক্ষেপ করে থাকেন। ফলে ভোম্বলের সমবয়সিরা তাকে অপছন্দ করে।
ভোম্বল ছেলেটি বড়ো ভাবুক, তাই কম কথা বলে। সিংগিমশায়ের দোরগোড়ায় একটি মোটরগাড়ি দেখে সে ভাবল, কার হতে পারে। ফ্যালাকে জিজ্ঞাসা করলেই ল্যাঠা চোকে। কিন্তু দীর্ঘকাল যাবৎ কম কথা বলার জন্য তার স্বভাবে একপ্রকার জড়ত্ব এসে গেছে। বাসুদেবের জ্যেষ্ঠা কন্যা মনীষা অর্থাৎ মানু এইবার তিন বছর ডিগ্রি কলেজে ভরতি হয়েছে। বাড়িতে সে মেজোবউদির সখীস্থানীয়া। প্রায়ই আসে। ভোম্বলের সাধ হয় ওর সঙ্গে হাস্যপরিহাসের, কিছুক্ষণের সান্নিধ্য উপভোগের। কিন্তু গত দুই বছরে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে এই যে বলা ছাড়া আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি।
লুঙ্গির উপর গেঞ্জি চড়িয়ে ভোম্বল দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। সত্যচরণ গামছা পরে বালতি হাতে এল। ওর স্ত্রীর বাতিকের জন্য জল একটু বেশি দরকার হয়। ভোম্বলকে দেখে বলল, হ্যাঁ গো গাড়িটা কার?
সত্যচরণকে ভোম্বল পছন্দ করে না। তাই স্বল্প কথায় উত্তর দিল, কী জানি।
সত্যচরণ ডিঙি মেরে কিছু-একটা অতিক্রম করে, টিউবওয়েলের চৌহদ্দিতে পৌঁছে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।
যত রাজ্যের গু-মুত চাকায় চাকায় এবার পাড়ার মধ্যে ঢুকতে শুরু করল। চেঁচিয়ে বলেছিল যাতে ভোম্বল শুনতে পায়, মোড় থেকে ফ্যালা ছুটে এল। কেন, চাকায় আসে আর লোকের পায়ে পায়ে আসে না? রাস্তাটা কি আপনার ঠাকুরঘর?
সত্যচরণ গভীর মনোযোগে বালতি ধুতে শুরু করল। ভোম্বল কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসাটা করেই বসল, ফ্যালা গাড়িটা কার?
বউ, অ-বউ কোথায় গেলি? খোকাকে বলিস কিন্তু কচুর মুখী আনতে। অ-বউ বাজার যাবার সময় খোকাকে মনে করে বলিস কিন্তু। বড়ি দিয়ে ঝাল করিস।
থুথুড়ে শাশুড়ি, দালানের এক কোনায় সকাল-সন্ধে উবু হয়ে বসে থাকে। হামা দিয়ে নর্দমা পর্যন্তও যেতে পারে না। চোখে দেখে না, কানে কম শোনে।
অ-বউ খোকা ফিরেছে? এরপর বিরক্ত হয়ে—আঁটকুড়ির গেরায্যি নেই। মর তুই, খোকার আবার বিয়ে দোব, দেখি তোর দেমাক থাকে কোথায়।
বুড়ি এখন ঘণ্টা খানেক এইভাবে কথা বলবে। কিন্তু যাকে শোনাবার জন্য, সে তখন দোতলায় ভাড়াটে বাসন্তীর রান্নাঘরের দরজায়।
আচমকা ধাক্কাটা সামলে উঠে বাসন্তী বলল, বলিস কী পারুল, সত্যি? ওগো শুনছ? আমাদের পাড়ায়… বলতে বলতে বাসন্তী পাশের ঘরে ঢুকল।
শুনেছি। মেঝেয় চিত হয়ে গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে রবীন জবাব দিল। বাঁ হাতটা যন্ত্রের মতো ঘুমন্ত ছেলের মাথা চাপড়ে যাচ্ছে।
পারুল বলল, আমাকে ওবাড়ির শেফালি এসে বলল, ও দেখেছে। ঠিক ওদের বাড়ির সামনেই গাড়ি রেখে নামল। তারপর হেঁটে তিন নম্বর বাড়িতে গেল।
বাসন্তী বলল, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে?
পারুল বলল, তা না তো আর যাবে কোদ্দিয়ে। রোজই তো বাপু এই সময় জানালার ধারে বসে এটা করি ওটা করি, কেউ গেলে চোখে পড়েই। আর আজকেই বরাত এমন–মাথার ঠিক কি আর আছে, বিকেল থেকে শাশুড়ি খালি খাব খাব করে যাচ্ছে।
অন্য সময় হলে পারুলের শাশুড়ির বিষয়ে শোনার মতো সময় হত বাসন্তীর। এখন হাঁসফাঁস করে বলল, ওগো দেখে এসো-না এক বার।
কেন?
যদি রাস্তা দিয়ে দেখা যায় তাহলে আমরাও গিয়ে দেখব।
রাস্তা থেকে? রবীন মুখ থেকে বই নামাল। বাড়ির বউয়েরা রাস্তায় নেমে আজেবাজে লোকদের ঘা ঘেঁষে অন্যের জানালায় উঁকি দেবে?
অপ্রস্তুতে পড়ল দুজনেই। পারুল তো রেগেও উঠল। নিজের বউকে ঠেস দিয়ে তাকেও তো শোনানো হল। শাসন করতে হয় নিজের বউকে করো, সভ্যতা শেখাতে হয় তো নিজের বউকে শেখাও। দু-চারটে কথা পারুলের ঠোঁটেও এসে গেছল কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারের কথা ভেবে ঢোক গিলল। ব্যাপারগুলি হল : রবীনের অফিসে নব্বই টাকার একটা চাকরি খালি হয়েছে, ভাইয়ের জন্য পারুল কালকেই কথাটা পেড়েছে। এবাড়ির ছাদ ব্যবহারের একমাত্র অধিকারী দোতলার ভাড়াটে যেহেতু ভাড়া বেশি দেয়। যেকোনো মুহূর্তেই একতলার লোকদের ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এ ছাড়াও বাসন্তী মৃতবৎসা দোষ কাটানোর অব্যর্থ মাদুলির হদিস জানে।
আহা, আমরা কি আর ঠেলাঠেলি করতে যাচ্ছি। যদি চলতে চলতে দেখা যায় তাহলে নারুদের বাড়ি যাবার নাম করে এক বার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নেব। ওতে তো দোষ নেই।
দরজার পাশ থেকে উঁচু গলায় পারুল বলল, সেদিন দক্ষিণেশ্বর যেতে কীরকম ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে হল।
সেদিন রবীন ওদের নিয়ে গেছল। এবং বাড়ি ফিরেই স্ত্রীর কাছে খোঁজ নেয়, যে-লোকটা বরাবর বাসে ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল তার স্বভাবটা কেমন? ফলে বাসন্তী ঝগড়া করে, না খেয়ে আলাদা শয্যা নেয়।
উঠে পড়ল রবীন। পাঞ্জাবিটা ঘাড়ে ফেলে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরোল। সিঁড়িটা অন্ধকার। মুখস্থ থেকেও ভুল হয়ে গেল। দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে টপকে তালগোল পাকিয়ে পড়ল। প্রথমে ছুটে নামল পারুল। হতভম্বের মতো রবীন তখনও বসে। পারুল বগলের নীচে হাত দিয়ে টেনে তুলতে গেল। পিছন থেকে শান্তগলায় বাসন্তী বলে উঠল, আমি দেখছি, তুমি সরো তো।
ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল রবীন। ওঠার সময় পারুলের বুকে কুনুইটা এত জোরে লাগল যে পারুলকে আঃ বলে উঠতে হল।
দালানের কোণ থেকে শাশুড়ি বলল, অ-বউ কী পড়ল রে।
ঠিক এইখানটায় আমি দাঁড়িয়ে আর গাড়িটা ওইখানে। হাত দুয়েক দূরে রাস্তার একটা জায়গা দেখিয়ে ফ্যালা বলল, মাত্র এইটুকু ডিস্টেন্স থেকে কথা হল।
জনা ছয়েক ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তারা সবাই চুপ করে থাকল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে গলিতে দাঁড়িয়ে-থাকা গাড়িটাকে দেখল।
ওর আর একটা গাড়ি আছে। সেটা আনলে গলিতে ঢুকত না। একজন বলল।
সকলে গলির মুখটাকে লক্ষ করল।
কে জানত বাবা গলির মধ্যে মোটর ঢুকবে, তাহলে চওড়া করেই তৈরি করত। আর একজন বলল।
শালার বাড়িগুলো ভেঙে না পড়লে আর গলি চওড়া হবে না। ফ্যালা বলল।
হ্যাঁ, সব বাড়িগুলো মাঠ হয়ে যাক শুধু উনিশের বি-টা বাদে।
এবার সবাই চাপা হাসল। উনিশের বি-তে বরুণ মিত্তির থাকে। সম্প্রতি ওর দূর সম্পর্কের এক বোন এসে রয়েছে। ফ্যালা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং ধারণা নমিতাও যে দরজার কাছে মাঝে মাঝে দাঁড়ায়, একমাত্র তাকেই দেখার জন্য।
কথাটা শুনে ফ্যালা স্বভাবতই লাজুক হয়ে পড়ল। খুশিও হল। তাই মোড়ের ঠাকুরের পানের দোকানে গিয়ে হাঁকল, এক প্যাকেট ক্যাপস্টান।
ঠাকুর এক বার আড়ে তাকিয়ে পান সাজায় ব্যস্ত রইল। তাড়া দিল ফ্যালা। শুনেও শুনল না যেন। সাধারণত যা করে থাকে, ফ্যালা নিজেই সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিতে গেল। ঠাকুর ওর হাত চেপে ধরল। বিস্ময়ে ফ্যালা স্তম্ভিত।
তিন মাস ধরে তো দেব দেব কচ্ছেন। আর ধারে হবে না।
আত্মসংবরণ করো। গম্ভীর স্বরে ফ্যালা বলল, ঠিক আছে সামনের হপ্তায় শোধ করে দোব। ঠাকুর নিজ হাতে প্যাকেট এগিয়ে দিল।
ইতস্তত করে ফ্যালা নিল। কানের ডগা দুটো ঝাঁঝাঁ করছে।
কত টাকা বাকি? স্বরটা কেঁপে উঠল।
ছ-টাকা বারো আনা।
ফ্যালা আসতেই ওরা ছোঁ দিয়ে প্যাকেটটা কেড়ে নিল।
ওরেব্বাস, ক্যাপস্টান!
কাল ছাতে উঠেছিল। মালা সিনহা একদম মাইরি, মাইরি।
কেন, মুখের আদলটাও ঠিক হুবহু।
ওর দাদার সঙ্গে ভাব করে নে-না, লোকটা কনজারভেটিভ নয়। অফিসের বন্ধুদের নিয়ে তাস খেলে, বউ তাদের সঙ্গে খেলে।
কোঁতপেড়ে গিয়ে ফুক ফুক করে ওরা ধোঁয়া ছাড়ল। ফ্যালা রেগে উঠল আপন মনে। কিন্তু রাগটা প্রকাশ করার কোনো মওকা আপাতত পাচ্ছে না। জোরে জোরে টান দিয়ে সিগারেটটাকে নিঃশেষ করে রাস্তায় আছড়ে ফেলল।
কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে।
ওরা ফালার দিকে তাকাল। কেউ কিছু বলল না।
কালীবাবু পাঁচ বছর অন্তর বাড়ির কলি ফেরান। দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন ঝাড়া হাত-পা। চারুশীলা ওরফে শীলার সঙ্গে ঝগড়া করা ছাড়া বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর আর কোনো শখ নেই। অবশ্য নিয়মিত রেডিয়োর থিয়েটার শশানেন আর সত্যচরণকে মাঝে মাঝে রাজনীতি বুঝিয়ে থাকেন। চারুশীলার জ্বালা ঝিয়েদের নিয়ে। ওরা আসে হতকুচ্ছিত চেহারা নিয়ে। তারপর কেমন যেন পরিপাটি হয়ে যায় চারুশীলার নজরে। চুলে তেল, গায়ে ব্লাউজ, মুখে পান, ঢলানি ঢলানি ভাব। কালীবাবুও সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে উঠোনের ধার ঘেঁষে জানালায় বসে রেডিয়োর কীর্তন শোনেন নয়তো খবরের কাগজ পড়তে শুরু করেন। তুলকালাম ঝগড়া বাঁধে। ঝি বরখাস্ত হয়ে যায়। রাত্রে পারুল-বাসন্তী ও-বাড়ির কর্তা-গিন্নির ঝগড়া শুনে মুখ টিপে হাসে আর ফিসফিস করে।
ওরা যে কী অত ফিসফিস করে চারুশীলা তাও জানে। অনিলের মা এখন আর অতটা আঁটসাট নেই, ওদের বাড়িতে কাজ করার সময় যতটা ছিল। অনিলের ছোটো দুই ভাই নাকি চারুশীলার দুই মেয়ে ভূতি আর টুনুর মতো হুবহু দেখতে। কেন হল? এ বিষয়ে পারুলের গবেষণার ফলাফল চারুশীলা শেফালি মারফত জেনেছে। এবং চারুশীলার মতামত পারুলকে সযত্নে জানিয়ে গেছে শেফালি।
কালীবাবু আজ বাড়ি ফিরলেন সন্দেশের বাক্স হাতে। স্ত্রীর পিসতুতো ভাইয়ের নতুন জামাইয়ের রাত্রে নেমন্তন্ন। ছেলেটি বিলেতফেরত, সাহেব কোম্পানিতে আটশো টাকায় ঢুকেছে। খুব বড়ো ঘরের ছেলে, বাপ রায়বাহাদুর।
বাড়ি ঢোকার মুখেই কালীবাবুর মনে পড়ল, ইসবগুলের ভুসি ফুরিয়েছে। এখনই না কিনে রাখলে রাতে কেনার কথা মনে নাও থাকতে পারে। অতিথিকে ফেলে মুদি-দোকানে ছোটা উচিত হবে না। এইসব ভেবে কালীবাবু নিজের বাড়ির দরজা থেকেই আবার ফিরলেন। বাসুদেববাবুর বাড়ির কাজ সেরে অনিলের মা-ও তখন ফিরছিল।
মুদির দোকানটা ষোলো হাত রাস্তার উপর বস্তির গলিটার মুখেই। সুতরাং দুজনের গন্তব্যই একমুখী। কালীবাবু যখন ইসবগুল কিনছেন তখন অনিলের মা-ও কাপড়কাচা সোডা কিনতে ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফ্যালা সেইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। নজরে পড়ল কালীবাবু যেন ফিসফিস করে অনিলের মাকে কী বললেন। অতঃপর ভুসি কিনে কালীবাবু বাড়িমুখো হলেন।
চারুশীলা এটুকু লক্ষ করেছে, বাড়িতে পা দিয়েই কালীবাবু গেলেন। ফেরা মাত্রই সে কারণটা জানতে চাইল। এতে কালীবাবু হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, এত খোঁজে দরকার কী, কোথায় যাই বা না যাই?
চারুশীলা কথা বাড়াল। ব্যাপারটা পরে জেনে নেওয়া যাবে, এখন ময়দা মেখে বেলে রাখতে হবে। হাতের কাজ সেরে না রাখলে জামাইয়ের সঙ্গে গল্প করার সময় পাওয়া যাবে না।
আঙুর অর্থাৎ অনিলের মা দশটা টাকা চেয়েছে। আজকেই চাই। কালীবাবু বলেছেন, রাত্রে গিয়ে দিয়ে আসব। চারুশীলার দাদার জামাই আসবে একটু পরেই, তার সঙ্গে বসে ভ্যাজভ্যাজ করতে হবে। খেয়ে দেয়ে বিদেয় হতে রাত দশটা। অত রাতে বস্তিতে ঢুকলে যদি কেউ দেখে ফেলে। বখাটে ছোঁড়াগুলো তো ওখানেই গুলতানি করে, তাহলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। কমপক্ষে চার মাস আঙুরকে স্পর্শ করা হয়নি। থলথলে, দলমলে মাংসের স্কুপে আঙুল ডুবিয়ে—ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন কালীবাবু। গোটা কতক ভারী নিশ্বাস পড়ল। নানা ধরনের যৌনছবি মাথার মধ্যে ফুটে উঠছে আর তখনই ঘরের আলো জ্বেলে চারুশীলা গনগনে স্বরে বলল, এইমাত্র চাদর ভেঙে পাতলুম, আর ময়লা কচ্ছ। নীচের ঘরে গিয়ে বসো-না। আসার সময় তো হল।
কালীবাবু উঠে বসে বললেন, শরিরটা কীরকম ম্যাজম্যাজ করছে। শীলু, এক কাপ চা করে দাও-না।
বাসু নাগ বাড়ি ফিরেই পায়খানা যান। এটা তাঁর বাইশ বছরের অভ্যাস। পালন করতে গিয়ে টের পেলেন প্যানের মধ্যে কিছু-একটা পড়ে বুজে রয়েছে। বলাই বাহল্য এতে তিনি চটলেন। ধকলটা গিয়ে পড়ল স্ত্রীর উপর। তিনি সাত চড়ে রা করেন না।
তোমরা জেনেশুনেও চুপ করে দেখছিলে। আগে বললে বাঁ-হাত দিয়ে তুলে নিতুম। এখন তুলি কী করে?
অতঃপর ছোটোছেলে নালুকে তিনি বেধড়ক কয়েক ঘা দিলেন। হতচ্ছাড়াটার পড়াশোনা নেই, দিনরাত শুধু বল খেলা আর বল খেলা। এখন এই বল তুলবে কে? স্ত্রী পরামর্শ দিলেন একটা ধাঙড় ডেকে আনলেই সমস্যাটা মিটে যায়।
সন্ধ্যার পর ধাঙড়রা পায়খানা থেকে বল তোলার জন্য নিশ্চয় বসে নেই। স্ত্রীকে এই কথাটা জানিয়ে বাসু নাগ কয়েক বালতি জল ঢেলে বলটিকে তুললেন এবং পাছে নালু সেটিকে হস্তগত করে তাই রাস্তায় বেরোলেন পরিত্যাগ করে আসতে। বল আর বেড়ালে কোনো তফাত নেই, যেখানেই ছেড়ে এসো-না কেন ঠিক বাড়ি ফিরে আসবে। তাই গলির বাইরে বড়ো ডাস্টবিনে ফেলার উদ্দেশ্যে বাসু নাগ রওনা হলেন।
অনন্ত সিংগির বাড়ির দোরে মোটরটাকে দেখতে পেয়ে বাসু নাগ এগোলেন না। ভাবলেন, বেটা নিশ্চয় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এখান দিয়ে গেলেই দেখিয়ে গাড়িতে পা তুলে দাঁড়াবে। গাড়িটা কি কিনল? হারামজাদার পয়সা আছে বটে তবে কিপটে, তা ছাড়া মুখও।
বাসু নাগ বাড়ি ফিরে সটান ছাদে উঠলেন। বলটা প্রাণপণে ছুড়ে দেবেন যেদিকে খুশি। কিন্তু কোনদিকে ছোড়া যায়? নজর পড়ল অনন্ত সিংগির ছাদের ঘরটা। ওটা ঠাকুরঘর। দরজাটাও ভোলা রয়েছে। বাসু নাগ রাগ করে বলটা ছুড়ে দিলেন।
মনীষা অর্থাৎ মানু এসেছে। মেজোবউদি বাপের বাড়ি গেছে সকালে, এখনও ফেরেনি। বড়োবউদি ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী। দাদারা বাড়ি নেই। ভোম্বল যে কী করবে ভেবে পেল না। তাই যথারীতি বলল, এই যে।
মনীষা হাসল।
পাড়ায় ওটা কার গাড়ি ভোম্বলদা? শুনলুম নাকি…
থেমে গেল। তারপর বুকের আঁচল ঠিক করে একটু আদুরে গলায় ওপরে আপনার ঘর থেকে তো দেখা যায়। রাস্তায় বেরোলে দেখব।
ভোম্বলের মুখে রা নেই। মানুর পিছু পিছু ঘরে এল।
সিনেমায় অনেক বার দেখেছি। এমনি চোখে তো দেখিনি, কেমন দেখায় তাই দেখতে এলুম। এত সুন্দর ন্যাচারাল পার্ট করে-না—জানেন ও কিন্তু মেয়েদের খুব ফেভারিট।
ভোম্বল হাসল। মানুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু অস্বস্তি লাগছে, বাড়িতে কেউ নেই। মেজোবউদিও যদি থাকত। যদি এই নিয়ে কথা ওঠে? বড়োবউদি অল্পবিস্তর কুচুটে।
নীচের ঘর থেকে দেখলে হত না?
কেন, আপনার ঘরে অসুবিধে কী?
মানুর পালটা প্রশ্নে ভোম্বল দিশাহারা হল।
মানে, কেউ তো বাড়ি নেই, নীচের দরজাটা খোলা।
তাতে কী হয়েছে?
কেউ যদি কিছু বলে?
মানু যেন কুপিত হয়েছে এমন মুখভঙ্গি করে বলল, কেন আমি কি খুব খারাপ মেয়ে যে অপবাদ দেবে?
তা নয়, মানে…
রাগ করে মানু বেরিয়ে যাচ্ছে। হায় হায় করে উঠল ডোম্বলের অন্তরাত্মা। এ কী করে বসল সে, মানু যে চলে যাচ্ছে। প্রায় ছুটে গিয়ে সে মানুর হাত ধরল।
অপবাদে আমিও ভয় পাই না।
মানু হাসল। লাজুক সুরে বলল, কী যে করেন।
হাত ছেড়ে দিয়ে ভোম্বল টুলের উপর বসল। ঘাড় হেঁট করে মানু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকা বা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কেউই প্রস্তুত নয়। সুতরাং মানু ঘরের ভিতর এসে বলল, আপনার ঘরটা খুব টিপটপ, সাজানো, আপনি খুব গোছানো।
ভোম্বল হাসল এবং ভাবল মানুও খুব টিপ টিপ।
আচ্ছা আপনি যে অত বই কিনেছেন, এর সব পড়া হয়ে গেছে?
ভোম্বলের বুক দুলে উঠল।
তা না হলে কি অমনি সাজিয়ে রেখেছি? সগর্বে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে, প্রত্যেকটা লাইন পড়া।
মুগ্ধ হয়ে মানুও বইগুলোর দিকে তাকাল।
বাবা বলছিল, এপাড়ায় আপনার মতো কোনো ছেলে নেই। সত্যি, পাড়ার ছেলেরা যা হয়েছে-না.. জানেন বরুণবাবুর এক বোন এসেছে-না, মেয়েটা ভারি বেহায়া চাল্লুশ। আর পাড়ার যত বখাটে ছেলে ওদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করবে। ফ্যালার সঙ্গে নাকি এর মধ্যেই ভাব হয়ে গেছে।
তাই নাকি?
ওমা, পাড়ার সবাই তো জেনে গেছে।
মানু খাটের ওপর বসল। সানের দেয়ালে আয়না, মুখ দেখা যায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে। বলল, আপনি তো নামেও ভোম্বল, কাজেও ভোম্বল।
বটে, তাই নাকি। আমিও অনেক খবর রাখি তা জান?
মানু সচকিত হল। চুলের একটা গুচ্ছ কপালের ওপর ঝুলিয়ে দিলে কেমন দেখাবে সেইটা পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা দমিয়ে ব্যগ্রস্বরে বলল, কী? কীসের খবর?
মানুর চোখে খানিকক্ষণ চোখ রেখে ভোম্বল বলল, মনীষা বলে একটা মেয়ে এ-পাড়ায় আছে সে খুব সুন্দরী, তা জান?
বুঝতে একটু সময় লাগল। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে মানু বলল, কী। অসভ্য।
মুখটা তোলার সময় মানু আঙুল দিয়ে চুলের গুচ্ছটা চট করে কপালের উপর টেনে ফেলল। ভোম্বল দেখতে পেল না। মুখোমুখি বসে থাকতে লজ্জা করল তার। উঠে জানলায় গেল। ফিরে এল। বসল। আয়না দেখল। ভোম্বলের দিকে তাকাল। বলল, মেজোবউদি কখন আসবে?
সময় তো হয়ে গেছে।
আবার চুপচাপ।
মেজোবউদি বলছিল একদিন প্ল্যানেটোরিয়াম দেখতে যাবে। কেউ না-নিয়ে গেলে বাবা যেতে দেবে না। ওসব দিকে যেতেও কেমন যেন লাগে। গড়ের মাঠটা এমন-না… কোথায় যে বাস থেকে নামতে হবে…
সামনের রোববার চলো-না, যাবে?
আমি কী জানি, মেজোবউদি যদি যেতে চায় তবেই তো।
তোমার বাড়িতে কিছু বলবে না?
ঘাড় নাড়ল মানু। আপনি তো সঙ্গে থাকবেন।
টুল থেকে উঠে খাটে বসল ভোম্বল।
শেফালি এসে বলল, অ বউদি দেখতে যাবে?
পারুল বিছানায় শুয়ে। কপালে হাত, চোখ বন্ধ। মাথা নেড়ে বলল, মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। ভাই, ভীষণ ধরেছে।
বলেই মুখভঙ্গি করল যন্ত্রণায়, তাই দেখে শেফালি কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির পথ দেখল।
বাসন্তী শাড়ি বদলে চুল আঁচড়াচ্ছে। শেফালি বলল, বউদি, তারকাদের গলির মধ্যে একতলা একটা বাড়ি আছে, তার নীচের ভাড়াটেদের ঘর থেকে কিন্তু মাস্টারনির ঘরের খানিকটা দেখা যায়, যাবে?
বাসন্তী থ। এত বড়ো একটা খবর পেয়ে কী যে করবে সে।
ঠিক জান? দেখা যায়? একটুখানি, একবার হলেই হবে।
ছোটোবেলায় ও-বাড়িতে যে খুব যেতুম। তখন যে ভাড়াটে ছিল তাদের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। আমি জানি, উঠোনের ডান দিকের ঘরটায় একটা ছোট্ট জানলা আছে।
পারুলকে ডেকে বলে নাও। আমি দরজায় তালা দিই।
নীচের বউদির মাথা ধরেছে, যাবে না।
সে কী?
বাসন্তী দরজায় তালা দিয়ে চাবি হাতে নামল।
ওঠ ওঠ, দেখতে যাবি তো চ এইবেলায়। পারুলকে ঠেলা দিল বাসন্তী। যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে পারুল বলল, সত্যি বলছি, ভয়ংকর মাথা ধরেছে।
সাধাসাধি করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। চাবিটা পারুলকে দিয়ে বলল, ছেলেটা রইল. কাঁদলে দেখিস। আমি এখুনি আসছি।
শেফালির সঙ্গে বাসন্তী বেরিয়ে গেল। দালানের কোণ থেকে বুড়ি বলল, অ বউ, তোর কী হয়েছে?
রাস্তার আলোর নীচেই গাড়িটা। একটা বেড়ালবাচ্চা গুটিগুটি এসে গাড়ির নীচে ঢুকল। অনন্ত সিংগি বৈঠকখানা থেকে তা লক্ষ করে উঠে এসে হাঁকডাক শুরু করলেন। ওঁর ভাবভঙ্গিতে সেই জিনিসটিই প্রকট, যার দ্বারা অন্যের এই ধারণা হয়—গাড়িটির অভিভাবক তিনিই। বেড়ালবাচ্চাই হোক আর একটা মাছিই হোক, কাউকেই তিনি রেয়াত করবেন না।
এ সবই হচ্ছে ডেঞ্জারাস। চুপচাপ রয়ে গেল কেউ জানল না, তারপর গাড়ি স্টার্ট দেওয়ামাত্রই চটকে গেল। অযথা একটা প্রাণীহত্যা। দেখেছি যখন, তখন বার করে দেওয়াই ভালো।
নিশ্চয়। সত্যচরণ বলল, মরলে তো রাস্তাটাই নোংরা হয়ে গেল। কাক এসে ঠুকরে নিয়ে এখানে-ওখানে উড়ে বসবে। আপনি ঠিকই বলেছেন।
উবু হয়ে সত্যচরণ হুশ হুশ শুরু করল। বেড়ালবাচ্চা ভয়ে সিঁটিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে রইল। ফ্যালা মোড় থেকে দেখল গাড়ির নীচে সত্যচরণ কী খোঁচাচ্ছে। ছুটে এল সে।
দ্যাখো তো ফ্যালা, ওটাকে বার করা যায় কি না, গাড়ি চললেই তো চাপা যাবে। সিংগিমশাই বললেন।
তাই ওটাকে বার করে দিচ্ছিলুম। সত্যচরণ কৈফিয়ত দিল।
ফ্যালা নীচু হয়ে দেখল। দেখে বলল, স্টার্টের আওয়াজ শুনলেই ব্যাটা সটকান দেবে। আছে থাক।
নীচু হয়ে যখন দেখছিল, তখন একটা ব্যাপার ফ্যালার চোখে পড়ল। গাড়ির পিছনে মাল রাখার ক্যারিয়ারের চাবিটা ভাঙা। ডালাটা একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে।
তাই বলে চীনারা মহান জাতি, চীনাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই। নেহরু এই যে সব বলল, এটা কি বলা ঠিক হয়েছে? অ্যাজ এ প্রাইম মিনিস্টার অব ইণ্ডিয়া, তাঁর তো ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত।
কী এমন অন্যায় বলেছে নেহরু। পিসতুতো শালার বিলেতফেরত জামাই গম্ভীর হবার চেষ্টা করল। কালীবাবু নার্ভাস বোধ করলেন।
চীনেরাই তো আমাদের অ্যাটাক করেছে।
তা করেছে।
ওরা তো এনিমি।
নিশ্চয়।
তবে কেন ওরা মহান?
ঊরু চাপড়ালেন কালীবাবু। জামাই কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, থামিয়ে দিয়ে দুলতে দুলতে বললেন, মানি নেহরু খুব শিক্ষিত কালচার্ড। আমরা তাঁর সমকক্ষও নই। কিন্তু ইনিই তো বলেছিলেন সুভাষ যদি আসে তো তরোয়াল নিয়ে তাকে রুখব। কী, বলেছিল তো?
জামাই কিছু বলতে যাচ্ছিল, কালীবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কাশ্মীরে যখন ইণ্ডিয়ান আর্মি মোচোলমানদের ঠেঙাতে ঠেঙাতে পগারপার করছিল তখন যুদ্ধ বন্ধ করে ইউএনও-তে মামলা করার কী দরকার ছিল? পনেরো বছরেও তো মামলা মিটল না। বুঝলে বাবু, শুধু শিক্ষা কালচার দিয়ে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এজন্য দরকার ডিক্টেটর। চাবুক হাতে নিয়ে দেশশাসন করতে হয়। হিটলার করেছিল, স্ট্যালিন করেছিল, তবেই-না চড়চড় করে ওরা বড়ো হতে পারল।
বাবাজি রীতিমতো ঘায়েল। সত্যচরণ থাকলে কী অবাকটাই-না হত। কালীবাবু দুলে দুলে আপশোস মেটাতে লাগলেন। জামাই অস্ফুটে বিড়বিড় করে দেয়ালে-টাঙানো চারুশীলার সূচিশিল্পের নমুনা দেখতে লাগল।
প্রথম রাউণ্ড জিতে কালীবাবুর উৎসাহ বেড়েছে। দ্বিতীয় রাউণ্ড শুরু করলেন।
আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, ইণ্ডিয়ার নন অ্যালাইড থাকা উচিত?
জবাবের জন্য কালীবাবু উদগ্রীব। জামাই তখনও চারুশিল্পে মগ্ন। ঠিক সেই সময়েই দপ করে আলো নিভে গেল। লোডশেডিং। ঘোষপাড়া লেন এলাকায় আজ অন্ধকার নামল।
আঃ, আবার। এই এক জ্বালা হয়েছে রোজ রোজ। চারুশীলা ছুটে এল নীচ থেকে। কালীবাবুকে ঘরের বাইরে ডেকে বলল, মোমবাতি আনতে বলেছিলুম, এনেছ?
এই যা। বলেই দুড়দুড় করে নেমে তিনি রাস্তায় পড়লেন। গোটা অঞ্চলটাই মিশমিশে। এখন দশ চক্ষু হয়েও কেউ কাউকে চিনতে পারবে না।
কে বলেছে ওটা আমার ছেলের বল?
রবারের বলটা বাসু নাগের মুখের সামনে তুলে অনন্ত সিংগি বলল, বলটা তবে কার? কার তা আমি কী করে বলব। উইদাউট এনি প্রুফ বললেই হল? ওরকম বল হাজার হাজার থাউজেণ্ড অ্যাণ্ড থাউজেণ্ড ছেলের কাছে পাওয়া যাবে। আমি জানতে চাই, আই ডিমাণ্ড, আমার ছেলেকে কেন, কীসের ভিত্তিতে দায়ী করা হচ্ছে যে সে বলটা আপনার ঠাকুরঘরে ছুড়েছে?
বাসু নাগ গামছা পরে সদর দরজায় চিৎকার জুড়েছে। আশপাশের বাড়ি থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে। লোকজন দেখে তার চিৎকার বাড়ল। স্রেফ আহম্মকি। গায়ে পড়ে ঝগড়া। অবশ্য কারণটাও জানি।
কী কারণ? কী জান? সিংগিমশাই রুখে উঠলেন।
গরম, পয়সার গরম। ওরকম পয়সা ঢের ঢের দেখেছি বুঝলেন, গাড়ি একসময় আমাদেরও ছিল। গাড়ি দেখাতে আসবেন না। পয়সা আজ আছে কাল নেই কিন্তু বনেদি বংশের শিক্ষাদীক্ষা চিরকাল রক্তে থেকে যায় বুঝলেন।
সত্যচরণ এই সময় বলল, ব্যাপারটা কী? বাসুদা চটলে কেন গা?
আর বলিস কেন ভাই, ইনি এসে বলছেন এই বলটা নাকি আমার ছেলে ওঁর ছাদে ঠাকুরঘরে ছুড়েছে। কোনো প্রুফ নেই, কোনো উইটনেস নেই। একেবারে চড়াও হয়ে এসে হম্বিতম্বি।
আলবাত তোমার ছেলের বল এটা। এই যে ফুটো, টিপলে চুপসে যায়। বলটা বাসুর মুখের সামনে ধরে সিংগিমশাই টিপলেন। হাওয়াটা বাসুবাবুর মুখে লাগতেই তিনি আঁতকে পিছনে লাফ মারলেন।
হোয়াট ইজ দিস? অ্যাাঁ, নোংরা বলের হাওয়া মুখের উপর? রাগে ঠকঠক করে বাসু নাগ কাঁপতে থাকলেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, আহ উইল কল পুলিশ, পুলিশ ডাকব। তেল বার করে ছাড়ব।
ডাক তোর পুলিশ, আমিও দেখে নোব তোর বনেদিপনার তেল কত। বুঝলে সত্য, যত রাজ্যের মেয়েলি পরচর্চা, পরনিন্দে হল এই লোকটার পেশা। ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে কী বলেছে জান? বলেছে ইলার মা নাকি অনন্ত সিংগির বিয়ে-করা বউ নয়। মুদির কাছে কী বলেছে জান? নোটজালের কারবারিদের সঙ্গে আমার দোস্তি আছে। আরে বাবা নিজের চরকায় তেল দিয়ে তারপর কথা বলতে আসুক। মাসের মধ্যে দশ দিন তো উনুন ধরে না।
আমার উনুন ধরে কি ধরে না তা দিয়ে কার বাপের কী? বাসু নাগ রাস্তায় লাফাতে শুরু করলেন। অনন্ত সিংগি একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন, খবরদার বাপ তুলবে না, তাহলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে বলছি।
তোমরা শুনে রাখো, আমায় থ্রেট করল। আমাকে খুন করবে বলল।
মিথ্যে কথা, খুন করব বলিনি। সত্য তুমিই বলো?
সত্যচরণ ফাঁপরে পড়ল, এখনও সে মনস্থির করতে পারেনি কার পক্ষ নেবে। সিংগিমশাইকে কোণঠাসা হতে দেখে বাসু নাগের দেহ মনে মত্তহস্তীর বল দেখা দিল। গামছাটাকে মালকোঁচা করে এগিয়ে গেলেন।
বাপের বেটা যদি হোস তো আয়, খুন কর দেখি, চলে আয়।
অনন্ত সিংগির ভাই বসন্ত সদ্য বাড়ি ফিরে ব্যাপার শুনেই সেইমাত্র এসে হাজির হয়েছে। বসন্ত রগচটা লোক। বাসু নাগের আহ্বানে সে এগোল। আর ঠিক সেই সময়েই অন্ধকার নামল ঘোষপাড়া লেনে।
শুয়ে রয়েছে পারুল। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে রবীন। উপরে গিয়ে দেখবে তালাবন্ধ। চাবি নিয়ে পারুল উঠল।
অ বউ, কোথায় চললি? খোকা ফিরল? অ বউ সাড়া না দিয়ে যাচ্ছিস কোথা?
যমের বাড়ি। দাঁতে দাঁত ঘষে পারুল।
বুড়ির মুখের সামনে চড় তুলল। বুড়ি দেখতে পেল না, পারুল বেড়ালের মতো উপরে উঠে গেল।
সেই মাথাধরার ওষুধটা আছে?
বন্ধ দরজার সামনে রবীন দাঁড়িয়ে ছিল। পারুলকে দেখে এবং বাসন্তীকে না দেখে জড়সড় হয়ে পড়েছে। তোতলার মতো বলল, কীসের ওষুধ, কোন ওষুধ।
আঃ! আপনাকে দু-বার করে না বললে কিছুই বোঝেন না। মাথাধরার ওষুধ, মাথাধরার। ছিঁড়ে পড়ছে মাথাটা।
দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দু-হাতে চেপে ধরল কপালটা, অস্ফুট যন্ত্রণায় আক্ষেপধ্বনি তুলে মাথা ঝাঁকাল।
ওষুধ তো বহুদিন আগে একটা কিনেছিলুম। মলম। এখনও আছে কি না…
জানেন না। পারুল ধমক দিল যেন, বাড়িতে এমন একটা কেউ নেই যাকে বলব মাথাটা টিপে দিক। আপনাকে বলা তো বৃথা। বউ বাড়িতে নেই, এখন তো আমার দিকে তাকাতেও সাহস পাবেন না।
কেন, আমি কি ভীতু? এই তো তাকাচ্ছি।
সাহস বোঝাবার জন্য রবীন চোখ দুটো বিস্ফারিত করল। পারুল মুখ টিপে হাসল। রবীন সে-হাসি দেখল।
সাহস বোঝা গেছে, তখন যেভাবে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লেন। পারুল আঁচলটা মুখে চাপল হাসি লুকোতে এবং মুখ লুকোতে কুঁজো হয়ে পড়ল। শেষে বউয়ের উপর রেগে আমাকেই এক ঘা দিয়ে দিলেন। আমি কি আপনার বউ?
মোটেই আমি মারিনি। রবীন ব্যাকুল হয়ে পড়ল। মুখ থেকে আঁচল নামিয়ে পারুল গলা খাটো করে বলল, যাক আর মিথ্যেকথা বলতে হবে না। এখনও ব্যথা করছে জায়গাটা। একে মাথার যন্ত্রণা তার ওপর আপনার যন্ত্রণা। বক বক করিয়ে আরও বাড়িয়ে দিলেন, দিন না বাপু মাথাটা টিপে।
রবীনের হাতটা ধরে পারুল হ্যাঁচকা টান দিল। উভয়ের ব্যবধানটুকু তাতে ঘুচে গেল। হাতটা কপালে রেখে পারুল বলল, বউকে অত ভয় করেন কেন।
আর ঠিক সেই সময়েই, ঘোষপাড়া লেনে দপ করে অন্ধকার নামল।
সত্যি বলছি, রোজ জানলার কাছে সেইজন্য অপেক্ষা করি। ঘুমভাঙা ফোলা ফোলা চোখ, সকালের বাতাসে চুলগুলো কপালের ওপর ফুরফুর করে ওড়ে। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় তোমাকে দেখি। ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়ে তোমার পিছু পিছু কলেজ পর্যন্ত যাই। তারপর ভাবি—না:, চ্যাংড়া ছেলেরা এসব করে। তুমি হয়তো আমাকে তাই ভাবতে পার।
শুনতে শুনতে নুয়ে পড়ল মানুর মাথা। নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আপনার সম্বন্ধে এইরকম ভাবব তাই-বা আপনি ভাবলেন কী করে? আপনি কি আর সবায়ের মতো।
মানুর স্বরে ক্ষোভ, অভিমান যেন। ভোম্বল ভাবল, এর দ্বারা কি এই বোঝায় যে মানু তাকে মোটেই চ্যাংড়া ভাবে না। তাহলে কী ভাবে?
আচ্ছা যদি তোমার কলেজ পর্যন্ত যাই, অনেকটা পিছনেই থাকব অবশ্য কেউ বুঝতেই পারবে না, তাহলে তুমি কি রাগ করবে?
মানুর মাথা আবার নুয়ে পড়ল। ভোম্বল বাক্যহারা। পলকহীন। মানু এক বার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে হার মেনে জানলার কাছে উঠে গেল। মাথাটা কাত করে ত্যারছা চোখে দেখল ধূসর মোটর গাড়িটা দাঁড়িয়ে।
এখনও বেরোয়নি, শুনেছি নিজের পিসি হয় মাস্টারনি।
আমাদের সঙ্গে এক ইয়ারেই বিএ পাস করেছে। আমি সিটি ও স্কটিশ। ভোম্বল উঠে গিয়ে তাক থেকে একটা বই পেড়ে নিল। বড়োবউদির বাচ্চা ছেলেটা এইমাত্র দরজায় উঁকি দিয়ে গেল। নিশ্চয় মা-র কাছে রিপোর্ট করবে, তিনি হয়তো এক বার এসে ঘুরে যাবেন।
পড়াশুনোয় এমন-কিছু ছিল না, তবু দ্যাখো হাজার হাজার টাকা কামাচ্ছে, শুধু চেহারার জন্য। ওর পার্ট তোমার ভালো লাগে?
মানু এইবার চোখে চোখ রাখল। বড়ো করে মাথা নেড়ে বলল, মা গো, কেমন যেন। মেয়েলি মেয়েলি।
খুশিতে হাসল ভোম্বল। ওকে দেখার জন্য মেয়েরা কেন যে এত ব্যস্ত হয়!
বইয়ের পাতা উলটোতে শুরু করল সে। মানু জানলা থেকে পা-পা করে করে সরে এল। দরজায় দিকে তাকাল ভোল। গলা খাঁকারি দিয়ে নীচু গলায় বলল, কই বললে না তো সেকথার জবাব।
কীসের।
ওই যে বললুম।
মাথা নুয়ে পড়ল মানুর। পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলব?
বাঃ, সেটা কি আমি বলে দেব?
জানি না।
এড়িয়ে যাচ্ছ।
দুজনেই চুপ। দূর থেকে একটা চেঁচামেচির আভাস আসছে।
অনেকেই তো আসে। কলেজের অনেক মেয়ের সঙ্গেই তো আসে, পৌঁছে দিয়ে যায়। একসঙ্গে পাশাপাশি গল্প করতে করতে আসে। মানুর কণ্ঠস্বর যেন মেঝেয় মিশে যাচ্ছে। ওরা কিন্তু খুব ভদ্র। আমাদের ক্লাসের সুলেখা আলাপ করিয়ে দিয়েছে একজনের সঙ্গে। রোজ আসে। ওর সঙ্গে সুলেখার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল ভোম্বল। কারণ সে ভাবতে শুরু করেছে, এতদ্বারা মানু কি এই বোঝাতে চায় যে, যদি বিয়ে করো তাহলেই কলেজ পর্যন্ত সঙ্গে যেতে পারো। কিন্তু মানুকে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাটা মিথ্যে নয়। ওর সঙ্গে গল্পকরা বা একসঙ্গে পথচলার ইচ্ছাটাও সত্যি। অতএব ভোম্বল আর ভাবনাচিন্তা না করে বলল, একদিনেই তো আর ওরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়নি, তার আগে.. বলেই ভোম্বল থেমে গেল।
মানু চোখ তোলেনি। হঠাৎ প্রাণপণে কিছু বলার চেষ্টায় মুখটা তুলেই সবটুকু ক্ষমতা যেন ওর ফুরিয়ে গেল।
বাবা সামনের বছর রিটায়ার করছে। আমায় বলেছে খবরের কাগজে কর্মখালির কলম যেন রোজ দেখি। আমিই তো বড়ো। আবার প্রাণপণে ও ক্ষমতা সংগ্রহ করল, আমার বিয়ে করলে চলবে কেন।
ভোম্বল দেখছিল মানুর ঠোঁট কেমন থরথর করে কাঁপছে। ও তখন ভাবতে যাচ্ছিল, আর সেই সময়েই দপ করে ঘোষপাড়া লেন অন্ধকার হয়ে গেল।
উঠোনটা অন্ধকার, ভিজে। সাবধানে পেরিয়ে দরজার কাছে ওরা দাঁড়াল। টিমটিমে বালব জ্বলছে ঘরে। বাসন্তী কনুই দিয়ে শেফালিকে খোঁচাল।
ওই কোণের জানলাটা। ফিসফিস করে শেফালি বলল। বাসন্তী আবার খোঁচা দিল।
বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে পিছু ফিরে বসে বাটিতে কিছু-একটা গুলছে। ছেঁড়া কাগজ কুচিয়ে ভাগা দিচ্ছে একটা বাচ্চা। আর একটি মেঝে থেকে খুঁটে খুঁটে মুড়ি খাচ্ছে। বছর দেড়েকের বাচ্চাটি তক্তায় উঠতে গিয়ে কেঁদে উঠল।
তক্তায় এদের মা শুয়ে, চোখ বোজা। হাত দুটি এলানো। ব্লাউজের বোতাম খোলা। ছোটোটি বোধ হয় মাই খাবার জন্য তক্তায় উঠতে চায়। মায়ের কাপড় অসম্ভব ময়লা। পায়ের আঙুলে হাজা। মুখটি হাঁ করা। সম্পূর্ণ চেহারাটি দেখলে মনে হয় বহুকালের বিসর্জিত প্রতিমাকে জল থেকে টেনে তুলে শুইয়ে রাখা হয়েছে। শেফালির মনে হল, মরে পড়ে আছে।
বাচ্চাগুলো ওদের দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকাল। বড়োমেয়েটি টের পেল। সে ফিরে তাকাল।
এবার একটা-কিছু বলতে হয়। যেহেতু এদের মধ্যে বয়স্ক তাই বাসন্তীই বলল, কী হয়েছে?
অসুখ। ঠাণ্ডা নিরুদবিগ্ন স্বরে কথাটি বলে সে বাটিতে কিছু-একটা গুলতে থাকল।
কী অসুখ। শেফালি বলল। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে পা রাখল।
এমনি অসুখ, অনেক দিনের। মেয়েটি ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।
ডাক্তার দেখে না? এবার বাসন্তী।
হাসপাতালে যেত। এখন বাবা গিয়ে ওষুধ আনে।
ওরা দুজন ঘরের ভিতর ঢুকল।
তোমার মা কথা বলতে পারে?
কাল থেকে খুব জ্বর, অজ্ঞানের মতো হয়ে আছে।
বাসন্তী জানলাটার দিকে তাকাল। বন্ধ রয়েছে।
জানলাটা খুলে দাও, ঘরে হাওয়া চলাচল করুক। বলে সে নিজে এগোচ্ছিল জানলাটা খুলতে।
না।
মেয়েটির ঠাণ্ডা গলার স্বরে বাসন্তী জমে গেল।
পাশের বাড়ির ওরা খুব বিরক্ত হয়। এরা তো গোলমাল চিৎকার করে। বাবা তাই সবসময় বন্ধ রাখতে বলেছে।
শেফালি বলল, বাচ্চা ছেলেপুলে থাকলে গোলমাল তো হবেই তাই বলে অসুস্থ মানুষটার কথাও তো ভাবতে হবে। খুলেই দাও, বলুক ওরা যা বলার।
না, বাবা বারণ করেছে। ঠাণ্ডা গলায় আপত্তি জানাল মেয়েটি। বাসন্তী আর শেফালি, মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাহলে আর থেকে লাভ কী, চলে যাওয়াই ভালো।
কিন্তু কেমন যেন বাধোবাধো লাগছে। এভাবে এসেই চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। বাসন্তী বলল, ওকে হাসপাতালে দিলেই তো হয়।
জবাব পেল না। খুঁটে খাচ্ছিল যে-বাচ্চাটা তাকে টেনে নিয়ে বাটিতে-গোলা জিনিসটি খাওয়াতে থাকল। বছর দেড়েকের বাচ্চাটা হামা দিয়ে শেফালির পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে তাকাল। মজা দেবার জন্য শেফালি চোখ দুটো বড়ো করে জিভ বার করল। বাচ্চাটা ধীরে ধীরে হেসে উঠল।
রান্না করে কে, তুমি?
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। বাসন্তী আবার বলল, সংসারের ঝামেলাতেই সদাব্যস্ত। এসে যে দেখে যাব তার সময় কোথা? এমনভাবে বলল যেন এরা বহুকালের চেনা। এতদিন না আসায় কৈফিয়ত একটা দেওয়া দরকার।
কাচ্চাবাচ্চার সংসার আমাদেরও তো।
তোমার বাবা কখন ফিরবে? শেফালি অনেকক্ষণ চুপ রয়েছে, তাই বলল।
রাত দুটো-আড়াইটে হয়।
এতক্ষণ?
ইভনিং ডিউটি থাকলে রাত হয়। মর্নিং ডিউটি হলে দুপুরে দুটো-আড়াইটেয় ফেরে।
কী কর অতক্ষণ?
কিছু না।
তক্তা বাদ দিয়ে যতটুকু মেঝে, শুয়োপোকার মতো ছেলেগুলি নড়াচড়া করছে। বাচ্চাটা হামা দিয়ে তক্তা ধরে দাঁড়াল। মায়ের একটা পা ধরে টানতে শুরু করেছে। হঠাৎ চোখ খুলল। হাত মুঠো করে মুখ দিয়ে শ্বাস টানছে। দৃষ্টি কড়িকাঠে ঠায় হয়ে রয়েছে। ঘরের কাউকেই দেখছে না।
বাচ্চাটা পেচ্ছাপ করেছে। মেয়েটি ন্যাতা আনার জন্য উঠোনে বেরোল। সে-সময় বাসন্তী বলল, চলো, চলে যাই এবার।
মেয়েটি আসুক। বলে শেফালি তক্তার দিকে তাকাল। মরামানুষের দৃষ্টির মতো তার মুখেই ঠায় তাকিয়ে। মাথাটা ঘোরায়নি। চোখের মণি দুটো কোণে সরে গিয়ে সাদা অংশটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দাঁতগুলো ফাঁক ফাঁক। তাতে হলুদ ময়লা।
বউদি এবার চলো।
শেফালি কথা শেষ করা মাত্রই ঝুপ করে ঘোষপাড়া লেনে অন্ধকার লাফিয়ে পড়ল। শিউরে কাঠ হয়ে গেল শেফালি। কে কঠিনভাবে তার হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। ঘরটা স্তব্ধ। কে যেন ভারী হয়ে শ্বাস টানছে।
প্রথমে কেঁদে উঠল ছোটো বাচ্চাটা, তারপর একে একে বাকিরা। বড়োমেয়েটি অন্ধকারেই ঘরের মেঝেতে ন্যাতা বোলাল। বাসন্তী বলল, মোমবাতি কি। হ্যারিকেন এসব কিছু নেই?
না।
ফিসফিস করে শেফালি বলল, আমার আঁচলে একটা সিকি আছে। খুলে নিয়ে ওকে দাও। মোমবাতি আনুক।
অন্ধকার কঠিনভাবে ওর হাত ধরে রয়েছে। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল মরে গেছে।
বস্তির গলিটা দিয়ে প্রায় ছুটছিল ফ্যালা। হাতে মোটরের চাকা। মোটর গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ারে বাড়তি যেটা থাকে সেই জিনিস। অন্ধকারে ধাক্কা লাগল সামনের একজনের সঙ্গে। টায়ারটা হাত থেকে পড়ে গেল। লোকটা বলল, আস্তে চলুন-না, দেখছেন না কী অন্ধকার। ফ্যালা জবাব দিয়ে কথা বাড়াল। লোকটা কালীবাবু।
রাস্তায় উবু হয়ে বসে ফোঁপাচ্ছেন বাসুদেব নাগ। ছেলে-মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে। স্ত্রী মাথায় জল ঢালছে। সামনের বাড়ির একজন লম্প হাতে দাঁড়িয়ে। বাসুবাবুর মাথা ফেটেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তিনি বললেন, সব তোমার জন্য, এ সব তোমার জন্য। ছেলে-মেয়ে-সংসার সব ফেলে রেখে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাব। বুঝবে কী করে সংসার চলে। কত অপমান সয়ে চলতে হয়।
বাসুবাবুর স্ত্রী সাত চড়ে রা করেন না। তিনি জল ঢালতে লাগলেন।
মানু বলল, আমি এখন যাই।
ভোম্বল বলল, কেন যেতে তো বলছি না।
মানু বলল, না অন্ধকারে আমাদের দুজনের থাকা উচিত নয়।
ভোম্বল বলল, কথা উঠবে, অপবাদ দেবে?
মানু বলল, হ্যাঁ, তাতে আমাদের দুজনেরই ক্ষতি হবে।
দুজনেই চুপ করে থাকল। ভোম্বল হাত বাড়িয়ে মানুর হাত চেপে ধরল। মানু বলল, ছেলেদের অনেক সুবিধে, বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় না। যদি ছেলে হতুম।
তাহলে তোমায় দেখবার জন্য কষ্ট করে জানলায় দাঁড়াতুম না। অবশ্য তুমি যদি চাও তাহলে এবার থেকে মেয়ে হিসেবে তোমায় আর ভাবব না।
বেড়ালের মতো নেমে এসে পারুল বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথাধরা সেরে গেছে। ঘুম পাচ্ছে। বুড়িটা চ্যাঁচাচ্ছে, বলে ছেলের আবার বিয়ে দেব। দিয়ে দ্যাখো না, সেও আটকুড়ি থাকবে। পুজো-মানত-মাদুলি কত কী তো হল, তাতে কি ফল ফলল? যত্তসব ধাপ্পা। বাসন্তীর ছেলে হয়েছে। পারুল ভাবল, তাহলে আমারই-বা হবে না কেন?
একসময় ঘোষপাড়া লেনে আবার আলো জ্বলে উঠল। ইতিমধ্যে ধূসর রঙের সেই মোটর গাড়িটা কখন চলে গেছে। বেড়ালবাচ্চাটা চটকে পড়ে রয়েছে।
একমাত্র সত্যচরণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবল, মৃতদেহটার সদগতি না করলে কাল সকালেই তো কাক আর কুকুরে মিলে সারা রাস্তাটাকে নোংরা করবে।