ধাত্রী দেবতা : 01
বাংলা দেশের কৃষ্ণাভ কোমল উর্বর ভূমি-প্রকৃতি বর্তমান বেহারের প্রান্তভাগে বীরভূমে আসিয়া অকস্মাৎ রূপান্তর গ্রহণ করিয়াছে। রাজরাজেশ্বরী অন্নপূর্ণা ষড়ৈশ্বর্য পরিত্যাগ করিয়া যেন ভৈরবীবেশে তপশ্চর্যায় মগ্ন। অসমতল গৈরিকবর্ণের প্রান্তর তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে দিগন্তের নীলের মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে; মধ্যে মধ্যে বনফুল আর খৈরিকাটার গুল্ম; বড় গাছের মধ্যে দীর্ঘ তালগাছ তপস্বিনীর শীর্ণ বাহুর মত উর্ধ্বলোকে প্রসারিত। বীরভূমের দক্ষিণাংশে বক্রেশ্বর ও কোপাই—দুইটি নদী মিলিত হইয়া কুয়ে নাম লইয়া মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করিয়া ময়ূরাক্ষীর সহিত মিলিত হইয়াছে।
এই কুয়ের পলিমাটির সুবিধা গ্ৰহণ করিয়াই লাঘাটা বন্দরের বাঁড়ুজ্জে-বাড়ির সাত-আনির মালিক কৃষ্ণদাসবাবু দেবীবাগ নামে শখের বাগানখানা তৈয়ারি করিয়াছিলেন। নানা প্রকার ফল ও ফুলের গাছগুলি পরিচর্যায় ও চরভূমির উর্বরতার সতেজ পুষ্টিতে বেশ ঘন হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে। বাগানের মধ্যে একটি পাকা কালীমন্দির, একটি মেটে দুই কুঠুরি বাংলোঘর, একখানি রান্নাঘর; মধ্যে মধ্যে ছায়াঘন গাছের তলায় বসিবার জন্য পাকা আসনও কৃষ্ণদাসবাবু তৈয়ারি করাইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার অকালমৃত্যুতে গ্রাম হইতে এতদূরে, এই নির্জনে বাগানের শোভা ও সুখ উপভোগ করিবার মত বয়স্ক উত্তরাধিকারীর অভাবেও বাগানখানা ম্লান নিস্তেজ হয় নাই, বরং বেশ একটু বন্য হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু তবুও চারিদিকের গৈরিক অনুর্বর রুক্ষ প্রকৃতির মধ্যে বাগানখানির শ্যামশোভায় চোখ জুড়াইয়া যায়।
বাগানের মধ্যে কালীবাড়ির পাকা বারান্দায় বসিয়া কৃষ্ণদাসবাবুর পুত্র শিবনাথ একটা ধনুকে জ্যা-রোপণ করিয়া টান দিয়া ধনুকটার সামর্থ্য পরীক্ষা করিতেছিল। অনতিদূরে মন্দিরের উঠানে তাহাদের রাখাল শম্ভু বাউরি বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে প্রভুর মুখের দিকে চাহিয়া ছিল। প্রভু এবং ভৃত্য দুই জনেই বালক, বয়স তের-চৌদ্দের বেশি নয়। এক পাশে খানদুই ছোট বাঁশের লাঠি ও কতকগুলা পাথর জমা করা রহিয়াছে। এগুলি তাহার যুদ্ধের সরঞ্জাম। গ্রামের অপর পাড়ার ছেলেদের সহিত সে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে। পূজার সময় হইতেই দুই পাড়ার কিশোর-রাষ্ট্রের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতেছিল। দুই পাড়ার প্রতিমার শ্রেষ্ঠত্ব লইয়া তর্ক হইতে এ বিরোধের সূত্রপাত। দুই পাড়ার প্রতিমাই অবশ্য একই কারিগরের গড়া, তবুও তো তাহার ভালমন্দ আছে। এ বিষয়ে কোনো মীমাংসা না হওয়ায় ওপাড়ার ছেলেরা দাবি করিয়াছিল, তাহাদের প্রতিমা অধিক জাগ্রত। সে বিষয়ে শিবনাথের পাড়ার পরাজয় হইয়াছে, কারণ ওপাড়ার মানসিক বলিদান হয় বাহান্নটি আর তাহার পাড়ায় মাত্র আটটি। এ শোচনীয় পরাজয়ের হাত হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য শিবনাথ ওপাড়ার ছেলেদের ফুটবল ম্যাচে চ্যালেঞ্জ করিয়াছিল। ম্যাচে হারিয়া ওপাড়ার ছেলেরা শিবনাথের দলের একটি ছেলের মাথা ফাটাইয়া দিল। শিবনাথ। ওপাড়ার দলপতির কাছে চরম পত্র পাঠাইল, যদি অবিলম্বে অন্যায় আঘাতকারিগণ ক্ষমাপ্রার্থনা না করে, তবে তাহারাও ইহার প্রতিশোধ লইবে।
তাহার পরই খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হইয়া গেল, ওপাড়ার ছেলেরা এপাড়ায় আসিলেই ইহারা বন্দি করিবার চেষ্টা করে, বন্দিত্ব স্বীকার না করিলে যুদ্ধ শুরু হয়। এপাড়ার ছেলেরা ওপাড়ায় গেলে বেশ ঘা-কতক খাইয়া বাড়ি ফেরে। শেষ পর্যন্ত শিবনাথ শক্তির চরম পরীক্ষার জন্য বিপক্ষকে প্রকাশ্য যুদ্ধে আহ্বান করিল। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে রণাঙ্গন নির্দিষ্ট হইয়াছে ওই গৈরিক প্রান্তর। বাল্যমনের চাপল্য এবং খেয়ালের অন্তরালে শিবনাথের মনে আরও একটি বস্তু ছিল, সেটা তাহার শিক্ষার বৈশিষ্ট্য। ইহারই মধ্যে স্কুলপাঠ্য পুস্তক ছাড়াও সে আরও অনেক বই পড়িয়া ফেলিয়াছে। অসমতল রণক্ষেত্রের কথা মনে হইতেই তাহার রাজসিংহের কথা মনে পড়িয়া গেল। বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ সে পড়িয়াছে। ওই অসমতল খোয়াইগুলিও তো ঠিক পার্বত্য পথের মত। সে অবিলম্বে মনে মনে রজসিংহের পদ্ধতিতে আপন সৈন্য-সমাবেশপদ্ধতি ছকিয়া লইল, এবং কয়জন বন্ধুকে লইয়া বেশ করিয়া দেখিয়া শুনিয়া নিপুণ সেনাপতির মতই সৈন্যসমাবেশ করিল। পথের দুই পাশের অদূরবর্তী খোয়াইয়ের মধ্যে তার দলস্থ ছেলেদের লুকাইয়া রাখিল। কিছুদূরে সম্মুখে প্রকাশ্যভাবে জনকয়েককে লইয়া সে যেন শত্রুপক্ষের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। ফলও হইল আশানুরূপ, শত্ৰুপক্ষীয়েরা শিবনাথকে ক্ষীণবল দেখিয়া হইহই করিয়া। তাহাদের সমীপবর্তী হইবামাত্র পশ্চাতের লুক্কায়িত দল আত্মপ্রকাশ করিয়া পশ্চাদ্ভাগ আক্রমণ করিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শিবনাথের জয় হইয়া গেল, শত্রুপক্ষ ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিল। শিবনাথ শুধু অগ্র ও পশ্চাদ্ভাগের কথাই ভাবিয়াছিল, দুই পাশের মুক্ত পথ অবরোধের কথা ভাবে নাই। সেই পথ দিয়া শত্ৰুরা যে যেমন পারিল পলায়ন করিল। বন্দি হইল জনকয়েক, পলায়ন পথে কাকরে পা হড়কাইয়া পড়িয়া আহত হইল, বাকি দলের পশ্চাতে শিবনাথের দল দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া অনুসরণ করিল। বন্দি যাহারা হইয়াছিল, শিবনাথ তাহাদের সহিত মন্দ ব্যবহার করিল না, সসম্মানে সকলের সহিত সন্ধি করিয়া আপনার বাগানের কিছু ফল উপহার দিয়া বিদায় করিল। তাহাদের সহিত শিবনাথের বা তাহাদের পাড়ার আর কোনো বিরোধ নাই। তাহারা স্বীকার করিয়াছে, শিবনাথদের পাড়ার ঠাকুর শ্রেষ্ঠ; তাহারা স্বীকার করিয়াছে, শিবনাথের পাড়ার ফুটবল টিম শ্ৰেষ্ঠ এবং শিবনাথ শ্ৰেষ্ঠ। এখন শিবনাথ বসিয়া আছে বিপক্ষদলের দলপতির প্রতীক্ষায়। কিন্তু অনুসরণকারী কেহ এখনও ফেরে নাই। শিবনাথ সঙ্কল্প করিয়াছে, দলপতির সহিতও বন্দি পুরুজের মতই ব্যবহার করিবে। কিন্তু তাহার মন্ত্রী ও সেনাপতি সেই পা বঁকা কানাই আর রজনীকে পাইলে তাহাদের দন্তে তৃণ করাইয়া ছাড়িবে।
শম্ভু বলিল, ওরা আর আসবে না বাবু। সন্জে হয়ে এল, চলেন, বাড়ি যাই। সেই কখন আইচেন বলেন দেখি।
শিবনাথ এইবার মুখ তুলিয়া চাহিল, সত্যই বেলা আর নাই, সূর্য পাটে বসিয়াছে, পূর্ব দিগন্ত অস্পষ্ট হইয়া আসিতেছে। সে বারান্দার উপর উঠিয়া পঁড়াইয়া চারিদিক লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া বলিল, তা হলে সব গেল কোথায় বল্ দেখি?
শম্ভু বিজ্ঞভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বাড়ি চলে গিয়েছে সব। খিদে নেগেছে, আর সব যে যার বাড়ি গিয়েছে।
মীমাংসাটা শিবনাথের মনঃপূত হইল না, যুদ্ধ করিতে আসিয়া ক্ষুধার তাড়নায় সৈন্যসামন্তেরা বাড়ি চলিয়া যাইবে কি! সে একটু চিন্তা করিয়া বলিল, তুই একবার গাছে চড়ে দেখ দেখি, কোথাও কাউকে দেখা যায় কি না! ওই বয়ড়াগাছটাতে ওঠ, অনেকটা লম্বা, অনেক দূর দেখতে পাবি।
শম্ভু স্বচ্ছন্দে দীর্ঘ গাছটার কাণ্ড বাহিয়া উঠিয়া গেল, ঠিক সরীসৃপের মত। গাছের প্রায় শীর্ষদেশে উঠিয়া সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিল, কোথা পাবেন আজ্ঞে! উ ঠিক সব মুড়ি খেতে বাড়ি চলে গিয়েছে।
শিবনাথ হতাশ হইয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। শম্ভু গাছ হইতে নামিয়া আসিতেছিল। শিবনাথ দিগন্তের দিকে দৃষ্টি ফেলিয়া বেশ সুর করিয়া আবৃত্তি করিল, The boy stood on the burning deck. ক্যাসাবিয়াঙ্কার কথা তাহার মনে পড়িয়া গিয়াছে। ক্যাসাবিয়াঙ্কা আপনার স্থান ছাড়িয়া এক পা সরিয়া যায় নাই। সমুদ্র সে দেখে নাই; যুদ্ধজাহাজও কখনও দেখে নাই, কিন্তু তবু তাহার চোখের সম্মুখে ক্যাসাবিয়াঙ্কার ছবি ফুটিয়া উঠিল। নীল জল, জ্বলন্ত জাহাজ, তাহার মধ্যে দাঁড়াইয়া কিশোর ক্যাসাবিয়াঙ্কা। তাহার চারিপাশে দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিতেছে! তাহার দীর্ঘ চুল অগ্ন্যুত্তপ্ত বাতাসে দুলিতেছে।
And shouted but once more aloud,
My father! must I stay?
While oer him fast through sail and shroud,
The wreathing tires made way.
সহসা তাহার কল্পনায় বাধা পড়িল। ও কি! দুইটা বড় শিয়ালে একটা কচি বাছুর মুখে করিয়া লইয়া আসিতেছে! না, শিয়াল তো নয়। জানোয়ার দুইটা আরও অনেক বড়। দেখিতে শিয়ালের মত হইলেও শিয়ালের ভঙ্গির সহিত অনেক পার্থক্য; শিয়াল তো এমন লেজ সোজা করিয়া চলে না! তাহাদের গমন-ভঙ্গি তো এমন দৃপ্ত নয়! মুখের চেহারার সঙ্গে তো শিয়ালের মুখাকৃতি ঠিক মেলে না। সে সতর্কতা প্রকাশ করিয়া শঙ্কুকে ডাকিল, শম্ভু! শম্ভু!
কণ্ঠস্বরের ভঙ্গিমায় শম্ভু চকিত হইয়া উঠিয়া সাড়া দিল, কী? সে ঝপ করিয়া খানিকটা উঁচু হইতেই লাফ দিয়া মাটিতে পড়িল। শিবনাথ অঙ্গুলিনিৰ্দেশ করিয়া বলিল, দেখেছিস!
শম্ভু বলিল, এঃ, কাজ সেরে ফেলিয়েছে শালারা। মরে গিয়েছে বাছুরটা।
শিবনাথ প্ৰশ্ন করিল, শিয়াল তো নয়, হেঁড়োল নাকি রে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। বড়া পাজি জাত। এঃ, রক্ত পড়েছে দেখেন দেখি।
শিবনাথ ধনুকটা নামাইয়া বলিল, মারব এক তীর?
না। যাক, শালারা চলে যাক। তেড়ে আসবে, ছিঁড়ে ফেলাবে আমাদিগকে। বাঘের জাত তো।
নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া উভয়ে জানোয়ার দুইটার দিকে চাহিয়া রহিল। শিবনাথ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখিতেছিল। তাহার বার বার মনে হইতেছিল, বন্দুকটা থাকিলে আজ সে ওই দুইটাকে শিকার করিয়া ফেলিতে পারিত। জানোয়ার দুইটা বাছুরটাকে মুখে করিয়া চলিয়াছে। সে চলার ভঙ্গিমার মধ্যে বিজয়গর্ব, আনন্দের আভাস। বাগানখানা পার হইয়াই উদাস পুকুর, প্রকাণ্ড দিঘি মজিয়া এখন চাষের জমিতে পরিণত হইয়াছে। পুকুরটার সু-উচ্চ পাড়গুলি বনফুল খৈরি শেওড়া শিমুল তাল প্রভৃতি গাছ ও গুল্মের ঘন সমাবেশে এখন দুৰ্ভেদ্য জঙ্গলে পরিণত। জানোয়ার দুইটা সেই পাড়ের নিচেই বাছুরটাকে ফেলিয়া বসিয়া হাঁপাইতে আরম্ভ করিল।
শিবনাথের কৌতূহল ধীরে ধীরে বাড়িয়া উঠিতেছিল, রাশিয়ার বরফাচ্ছন্ন মেরুপ্রদেশের বিবরণের মধ্যে উফের কথা পড়িয়াছে—উলফ, হায়েনা, নেকড়েবাঘ, হুড়ার।
সে বলিল, চল, একটু এগিয়ে দেখি।
কৌতূহল শম্ভুরও বাড়িতেছিল, সে বলিল, গাছের আড়ালে আড়ালে চলেন।
গাছের আড়ালে আড়ালে আসিয়া অনেকটা নিকটেই পৌঁছানো গেল। শিবনাথ দেখিল, জানোয়ার দুইটা জিভ বাহির করিয়া হাঁপাইতেছে। আশ্চর্য, সে মুখব্যাদানভঙ্গিমার মধ্যে হাসির রেখা পরিস্ফুট! জানোয়ার হাসে! হ্যাঁ, হাসে, বাড়ির কালুয়া কুকুরটার মুখেও আনন্দের আতিশয্যে এমন ভঙ্গি দেখা দেয়, সেও হাসে। একটু পরেই একটা জানোয়ার অদ্ভুত শব্দ করিয়া উঠিল, আবার আবার। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছিল, তবুও অস্পষ্ট আলোকে শিবনাথ দেখিতে পাইল, ছোট ছোট কুকুরছানার মত কয়টা ছানা একটা গৰ্ত হইতে কুঁ-কুঁ শব্দ করিতে করিতে বাহির হইয়া আসিল।
শম্ভু বলিল, বাচ্চা হয়েছে শালদের। একটা দুটো তিনটে। দেখেন, দেখেন, মজা দেখেন, বাচ্চাগুলোর তেজ দেখেন।
বাছুরটার ক্ষতস্থান হইতে নির্গত রক্তধারা চাটিতে চাটিতে ছানাগুলি বিবাদ শুরু করিয়া দিয়াছিল। পরস্পরকে তাড়াইয়া দিয়া প্রত্যেকেই একা খাইতে চায়। যে বাধা পাইতেছে সেই কুদ্ধবিক্ৰমে গোঙাইয়া উঠিতেছে। বড় জানোয়ার দুইটা তেমনই বসিয়া আছে, বাচ্চাগুলির দিকে চাহিয়া এখনও তেমনই হাসিতেছে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ধাড়ী দুইটা মৃত পশুশাবকটাকে টানিয়া লইয়া বুকের দুই পাশ ছিঁড়িয়া খাইতে আরম্ভ করিল। সঙ্গে সঙ্গে শাবকগুলার সে কী গর্জন।
শম্ভু বলিল, লেন, আর লয়। এই সময়ে আমরা চলে যাই। খেতে নেগেছে বেটারা, এইবার মারামারি করবে। অ্যাঁধারও হয়ে এল। খোয়াইগুলোর ভেতরে আবার সাপ-খোপ বেরুবে।
শিবনাথের কৌতূহল মেটে নাই, পশু দুইটার আহার-আত্মসাতের কলহ দেখিবার জন্য প্রবল আগ্ৰহ হইতেছিল, কিন্তু সে আর আপত্তি করিতে পারি না। তাহার মায়ের সুন্দর কঠিন মুখের দৃষ্টি তাহার মনশ্চক্ষে ভাসিয়া উঠিল।
গাছের আড়ালে আড়ালে আত্মগোপন করিয়া বাগানের গাড়ি-চলা পথটা ধরিয়া তাহারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হইল। সরল সোজা পথটার দুই ধারে আমগাছের সারি, পূর্বে লাল কাকর বিছানো ছিল, এখন সে কাকরের উপর কুশ ও কুঁচি ঘাস পথটিকে অপরিচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছে। ওদিকে ক্রুদ্ধ পশু দুইটার কলহ-গৰ্জনে সন্ধ্যাটা ভয়াল হইয়া উঠিতেছে। চলিতে চলিতে শিবনাথ বলিল, আচ্ছা শঙ্কু , হেঁড়োলের বাচ্চা পোষ মানে না?
শম্ভু বলিয়া উঠিল, দাঁড়ান, কাল সন্জের মুখে ধাড়ী দুটো যখন বেরিয়ে যাবে, তখন একটা ধরে নিয়ে যাব।
পুলকিত হইয়া শিবনাথ বলিল, ও দুটোকে আমি মেরে দিতে পারি বন্দুক পেলে। তা বন্দুক যে ছুঁতে দেন না মা।
শম্ভু বলিল, সাঁওতালদিগে বললে তীরিয়ে মেরে দেবে।
শিবনাথ থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, শোন্ শোন, খেলা করছে বোধহয়। কিন্তু দেখেছি, ঠিক যেন মানুষের মত কথা বলছে। হাসছে—রাগছে—কাতরাচ্ছে, সব বোঝা যাচ্ছে।
তখন তাহাদের কলহ-গৰ্জন থামিয়া গিয়াছে, পিতামাতা এবং শাবক তিনটির আনন্দকলরবে অন্ধকার বাগানখানা মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে।
শম্ভু দাঁড়াইয়া শুনিল, সত্যই হ্যাঁ-হ্যাঁ রবের মধ্যে যেন হাসির আভাস ফুটিয়া উঠিতেছে। সে বলিল, কী বলছে বেটারা ওরাই জানে—খুব খেতে পেয়েছে কিনা।
গ্রামে যখন তারা প্রবেশ করিল, তখন ঘরে ঘরে আলো জ্বলিতে শুরু করিয়াছে। পথের উপর গাঢ় অন্ধকার। গ্রামের দেবমন্দিরে-মন্দিরে কাসরঘণ্টা ধ্বনিত হইতেছে। শিবনাথ আশ্বস্ত হইল, তাহার মা পিসিমা এখন ঠাকুরবাড়িতে; সে তাড়াতাড়ি বই লইয়া পড়িতে বসিয়া যাইবে। পথেই তাহাদের কাছারি-বাড়িতে তখন আলো জ্বলিয়াছে। শিবনাথ একেবারে তাহার পড়ার ঘরে গিয়া উঠিল, টেবিলের উপর রক্ষিত আলোটার মৃদু শিখাটাকে উজ্জ্বল করিয়া দিয়া একখানা বই হাতে করিয়া বসিয়া পড়িল। পরক্ষণেই সেখানাকে রাখিয়া দিয়া ডিকশনারিখানা খুলিয়া বাহির করিল–Wolf—Erect-eared straight-tailed harshfurred_tawny-grey wild carnivorous quadruped, the Abyssinian Wolf, the Antarctic Wolf, the maned Wolf and the Prairie Wolf—আর কিছু নাই। কিন্তু নেকড়ে তো এ দেশেও পাওয়া যায়। এমন অসম্পূর্ণ বিবরণে শিবনাথের মন ভরিল না। সে ক্ষুণ্ণমনে বইখানি বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর আবার ডিকশনারি খুলিয়া বাহির করিল টাইগার, রয়াল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর বাঘেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বিক্ৰমে দুৰ্জয়, অপার সাহস,-বাঘেদের রাজা।
সমস্ত বিকেলটা কোথায় ছিলি রে শিবু?
শিবনাথ চমকিত হইয়া বইখানা রাখিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার পিসিমা গৃহদেবতার নির্মাল্য হাতে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার সঙ্গে মাকে না দেখিয়া শিবনাথ আশ্বস্ত হইয়া উৎসাহভরেই বলিল, আজ দুটো হেঁড়োল দেখলাম পিসিমা!
শিবনাথের মাথায় নির্মাল্য স্পর্শ করাইয়া পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, কোথায়?
আমাদের দেবীবাগের পাশেই বাসা করেছে। আজ একটা বাছুর মেরে মুখে করে নিয়ে এল। এঃ, যে রক্তটা পড়ছিল!
মুশকিল করলে তো! বাছুর ছাগল ভেড়া মেরে সর্বনাশ করবে দেখছি!
তিনটে ছোট ছোট এইটুকু–
শিবনাথের কথা আর শেষ হইল না, দ্বারপথের দিকে সহসা দৃষ্টিপাত করিয়াই সে নীরব হইয়া গেল। দুয়ারের সম্মুখেই তাহার মা কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
মা বলিলেন, কিন্তু ওপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করেছ কেন শিরু?
শিবনাথ সম্মুখে অভয়দাত্রী পিসিমার উপস্থিতির ভরসায় সাহস করিয়া বলিল, মারামারি কেন করব? যুদ্ধ করেছি।
যুদ্ধ?
হ্যাঁ, যুদ্ধ। ওরা যুদ্ধ করবে বলে এই দেখ পত্র দিয়েছে। সে নিজের পকেট হইতে বিপক্ষের যুদ্ধপ্রস্তাব গ্রহণ করার সম্মতিপত্রখানা বাহির করিল।
কিন্তু যুদ্ধ কিসের জন্য? এক গ্রামে বাড়ি, ভাইয়ের মত সকলে—
পিসিমা এবার বাধা দিয়া বলিলেন, বেশ করেছে। ওদের বাপেরা চিরকাল আমাদের হিংসে করে এসেছে, এখনও অপমান করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না! এখন থেকেই আবার ছেলেদের আক্রোশ দেখ না! মা হাসিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, না না ঠকুরঝি, দেশে ঘরে ঝগড়া করা কি ভাল? তা হলে জানোয়ারে আর মানুষে তফাত কী?
শিবনাথ মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিল নেকড়েগুলার কলহের কথা। এক-এক সময় মাকে তাহার এত ভাল লাগে!