কলকাতায় যাবার সময়
০৯.
এখান থেকে কলকাতায় যাবার সময় হয়ে এল। বিকেলে আমি বটতলায় পুকুরের ঘাটে বসে মাছ-ধরা দেখচি, নবীন মুহুরী এসে বললে–তোমায় ডাকচেন মেজবাবু।
ওর মুখ দেখে আমার মনে হ’ল গুরুতর একটা কিছু ঘটেছে কিংবা ও-ই আমার নামে কি লাগিয়েচে। নবীন মুহুরী এ-রকম বার-কয়েক আমার নামে লাগিয়েছে এর আগেও। কারণ তার চুরির বেজায় অসুবিধে ঘটত আমি থাকার দরুন।
মেজবাবু চেয়ারে বসে, কুঞ্জ নায়েবও সেখানে দাঁড়িয়ে।
মেজবাবু আমাকে মানুষ বলেই কোনো দিন ভাবেননি। এ পর্যন্ত আমি পারতপক্ষে তাঁকে এড়িয়েই চলে এসেচি। লোকটার মুখের উগ্র দাম্ভিকতা আমাকে ওর সামনে যেতে উৎসাহিত করে না। আমায় দেখে বললেন–শোন এদিকে। কলকাতায় গিয়ে তুমি অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করবে। তোমাকে এক মাসের নোটিশ দিলাম।
–কেন, কি হয়েচে?
–তোমার মাথা ভাল না, এ আমিও জানি নবীনও দেখেচে বলচে। হিসেব-পত্রে প্রায়ই গোলমাল হয়। এ-রকম লোক দিয়ে আমার কাজ চলবে না। স্টেটের কাজ তো ছেলেখেলা নয়!
নবীন এবার আমায় শুনিয়েই বললে–এই তো সেদিন আমার সামনেই হিসেব মেলাতে মেলাতে মৃগীরোগের মত হয়ে গেল–আমি তো ভয়েই অস্থির।
মেজবাবুকে বিদ্বান বলে আমি সম্ভ্রমের চোখেও দেখতাম–বললাম–দেখুন, তা নয়। আপনি তো সব বোঝেন, আপনাকে বলচি। মাঝে মাঝে আমার কেমন একটা অবস্থা হয় শরীরের ও মনের, সেটা বলে বোঝাতে পারি নে–কিন্তু তখন এমন সব জিনিস দেখি, সহজ অবস্থায় তা দেখা যায় না। ছেলেবেলায় আরও অনেক দেখতুম, এখন কমে গিয়েছে। তখন বুঝতাম না, মনে ভয় হ’ত, ভাবতাম এ-সব মিথ্যে, আমার বুঝি কি রোগ হয়েচে। কিন্তু এখন বুঝেচি ওর মধ্যে সত্যি আছে অনেক।
মেজবাবু কৌতুক ও বিদ্রূপ মিশ্রিত হাসি-মুখে আমার কথা শুনছিলেন–কথা শেষ হলে তিনি কুঞ্জ নায়েবের দিকে চেয়ে হাসলেন। নবীন মুহুরীর দিকে চাইলেন না, কারণ সে অনেক কম দরের মানুষ। স্টেটের নায়েবের সঙ্গে তবুও দৃষ্টি-বিনিময় করা চলে। আমার দিকে চেয়ে বললেন–কতদূর পড়াশুনা করেচ তুমি?
–আই-এ পাস করেছিলাম শ্রীরামপুর কলেজ থেকে–
–তাহলে তোমায় বোঝানো আমার মুশকিল হবে। মোটের ওপর ও-সব কিছু না। নিউরোটিক যারা–নিউরোটিক বোঝ? যাদের স্নায়ু দুর্বল তাদের ওই রকম হয়। রোগই বইকি, ও এক রকম রোগ–
আমি বললাম–মিথ্যে নয় যে তা আমি জানি। আমি নিজের জীবনে অনেকবার দেখেচি–ও-সব সত্যি হয়েছে। তবে কেন হয় এইটেই জানি নে, সেইজন্যেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আমি সেন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসির লাইক-এ পড়েচি, তিনিও এ-রকম দেখতেন–
মেজবাবু ব্যঙ্গের সুরে বললেন–তুমি ‘তাহলে’—তুমি সেন্ট হয়ে গিয়ে দেখচি? পাগল কি আর গাছে ফলে?
নবীন ও কুঞ্জ দুজনেই মেজবাবুর প্রতি সম্ভ্রম বজায় রেখে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসতে লাগল।
আমি নানাদিক থেকে খোঁচা খেয়ে মরীয়া হয়ে উঠলাম। বললাম–আর শুধু ওই দেখি যে তা নয়, অনেক সময় মরে গিয়েছে এমন মানুষের আত্মার সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের দেখতে পেয়েছি।
নবীন মুহুরীর বুদ্ধিহীন মুখে একটা অদ্ভুত ধরনের অবিশ্বাস ও ব্যঙ্গের ছাপ ফুটে উঠল, কিন্তু নিজের বুদ্ধির ওপর তার বোধ হয় বিশেষ আস্থা না থাকাতে সে মেজবাবুর মুখের দিকে চাইলে। মেজবাবু এমন ভাব দেখালেন যে, এ বদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে আর কথা বলে লাভ কি আছে! তিনি কুঞ্জ নায়েবের দিকে এভাবে চাইলেন যে, একে আর এখানে কেন? পাগলামি চড়ে বসলেই একটা কি করে ফেলবে এক্ষুনি!
আমি আরও মরীয়া হয়ে বললাম–আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন তাতে যে-জিনিস সত্যি তা মিথ্যে হয়ে যাবে না। আমার মনে হয়, আপনি আমার কথা বুঝতেও পারেননি। যার নিজের অভিজ্ঞতা না হয়েছে, সে এ-সব বুঝতে পারবে না, এ-কথা এতদিনে আমি বুঝেচি। খুব বেশী লেখাপড়া শিখলেই বা খুব বুদ্ধি থাকলেই যে বোঝা যায় তা নয়। আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে বলি, আমি যে ঘরটাতে থাকি, ওর ওপাশে যে ছোট্ট বাড়িটা আছে, ভাঙা রোয়াক যার সামনে–ওখানে আমি একজন বড়োমানুষের অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছি–কি করে পেরেছি, সে আমি নিজেই জানি নে–খুব তামাক খেতেন, বয়স অনেক হয়েছিল, খুব রাগী লোক ছিলেন, তিনি মারা গিয়েচেন কি বেঁচে আছেন তা আমি জানি নে। ওই জায়গাটায় গেলেই এই ধরনের লোকের কথা আমার মনে হয়। বলুন তো ওখানে কেউ ছিলেন এ-রকম?
কুঞ্জ নায়েবের সঙ্গে মেজবাবুর অর্থসূচক দৃষ্টি বিনিময় হ’ল। মেজবাবু শ্লেষের সঙ্গে বললেন–তোমাকে যতটা সিম্পল ভেবেছিলাম তুমি তা নও দেখচি। তোমার মধ্যে ভণ্ডামিও বেশ আছে–তুমি বলতে চাও তুমি এত দিন এখানে এসেচ, তুমি কারও কাছে শোননি ওখানে কে থাকতো?
–আপনি বিশ্বাস করুন, আমি তা শুনিনি। কে আমায় বলেচে আপনি খোঁজ নিন?
—ওখানে আমাদের আগেকার নায়েব ছিল, ওটা তার কোয়ার্টার ছিল, সে বছর-চারেক আগে মারা গিয়েছে, শোননি এ-কথা?
–না আমি শুনিনি। আরও কথা বলি শুনুন, আপনার ছেলে হওয়ার আগের দিন কলকাতায় আপিসে আপনাকে কি বলেছিলুম মনে আছে? বলেছিলুম একটা খোকা দাঁড়িয়ে আছে–দরজা খুলে মেজবৌরাণী এসে তাকে নিয়ে গেলেন–এ-কথা বলেছিলুম কিনা? মনে করে দেখুন।
–হ্যাঁ আমার খুব মনে আছে। সেও তুমি জানতে না যে আমার স্ত্রী আসন্ন-প্রসবা ছিল? যদি আমি বলি তুমি একটা বেশ চাল চেলেছিলে–যে কোনো একটি সন্তান তো হ’তই– তুমি অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলে, দৈবাৎ লেগে গিয়েছিল। শার্লাটানরা ও-রকম বুজরুকি করে–আমি কি বিশ্বাস করি ওসব ভেবেচ?
–বুজরুকি কিসের বলুন? আমি কি তার জন্যে আপনার কাছে কিছু চেয়েছিলুম? বা আর কোনোদিন সে-কথার কোনো উল্লেখ করেছিলুম? আমি জানি আমার এ একটা ক্ষমতা–ছেলেবেলায় দার্জিলিঙের চা-বাগানে আমরা ছিলাম, তখন থেকে আমার এ ক্ষমতা আছে। কিন্তু এ দেখিয়ে আমি কখনও টাকা রোজগারের চেষ্টা তো করিনি কারোর কাছে? বরং বলিই নে–
মেজবাবু অসহিষ্ণুভাবে বললেন–অল ফিডলস্ট্রিক–মনের ব্যাপার তুমি কিছু জানো না। তোমাকে বোঝাবার উপায়ও আমার নেই। ইট প্লেজ কুইয়ার ট্রিকস উইথ আস– যদি ধরে নিই তুমি মিথ্যাবাদী নও–ইউ মে বি এ সেলফ ডিলিউডেড ফুল এবং আমার মনে হয় তুমি তাই-ই। আর কিছু নয়। যাও এখন–
আমি চলে এলাম। নবীন মুহুরী আমার পিছু পিছু এসে বললে–তোমার সাহস আছে বলতে হবে–মেজবাবুর সঙ্গে অমন ক’রে তর্ক আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। না! যা হোক, তোমার সাহস আছে। আমার তো ভয় হচ্চিল এই বুঝি মেজবাবু রেগে ওঠেন–
আমি জানি নবীনই আমার নামে লাগিয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবার প্রবৃত্তি আমার হ’ল না। কেবল একটা কথা ওকে বললাম–দেখ নবীন-দা, চাকুরির ভয় আমি আর করি নে। যে-জন্যে চাকুরি করছিলাম, সে কাজ মিটে গিয়েছে। এখন আমার চাকুরি করলেও হয় না-করলেও হয়। ভেবো না, আমি নিজেই শীগগির চলে যাবো ভাই।
ক-দিন ধরে একটা কথা ভাবছিলাম। এই যে এতগুলো পাড়াগেঁয়ে গরীব চাষীলোক এখানে পুজো দিতে এসেছিল–এরা সকলেই মূর্খ, ভগবানকে এরা সে ভাবে জানে না, এরা চেনে বটতলার গোসাঁইকে। কে বটতলার গোসাঁই? হয়ত একজন ভক্ত বৈষ্ণব, গ্রাম্য লোক, বছর পঞ্চাশ আগে থাকত ওই বটতলায়। সেই থেকে লৌকিক প্রবাদ এবং বোধ হয় মেজবাবুদের অর্থগুধ্নতা দুটোতে মিলে বটতলাকে করেছে পরম তীর্থস্থান। কোথায় ভগবান, কোথায় প্রথিতযশা ঐতিহাসিক অবতারের দল–এই বিপুল জনসঙ্ঘ তাঁদের সন্ধানই রাখে না হয়ত। এদের এ কি ধর্ম? ধর্মের নামে ছেলেখেলা।
কিন্তু নিমচাঁদকে দেখেচি। তার সরল ভক্তি, তাদের ত্যাগ। তার স্ত্রীর চোখে যে অপূর্ব ভাবদৃষ্টি, যা সকল ধর্মবিশ্বাসের উৎসমুখ—এ-সব কি মূল্যহীন, ভিত্তিহীন, জলজ শেওলার মত মিথ্যার মহাসমুদ্রে ভাসমান? এ রকম কত নিমচাঁদ এসেছিল মেলায়। জ্যাঠাইমাদের আচারের শেকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ঐশ্বর্যের ঘটা দেখানো দেবার্চনার চেয়ে, এ আমার ভাল লেগেচে। ঘুসুড়ির সেই ষষ্ঠীমন্দিরের মত।
কোন দেবতার কাছে নিমচাঁদের তিনটে টাকার ভোগ অর্ঘ্য গিয়ে পৌঁছুলো, জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে পরম ত্যাগে সে যা নিবেদন করলে?
আর একটা কথা বুঝেচি। কাউকে কোন কথা বলে বুঝিয়ে বিশ্বাস করানো যায় না। মনের ধর্ম মেজবাবু আমায় কি শেখাবেন, আমি এটুকু জেনেচি নিজের জীবনে মানুষের মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না সে জিনিসকে, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরের। আমি যা নিজের চোখে কতবার দেখলুম, বাস্তব বলে জানি–ঘরে-বাইরে সব লোক বললে ও মিথ্যে। পণ্ডিত ও মূর্খ এখানে সমান–ধরা-ছোঁয়ার গণ্ডীর সীমানা পার হয়ে কারুর মন অনন্ত অজানার দিকে পাড়ি দিতে চায় না। যা সত্যি, তা কি মিথ্যা হয়ে যাবে?
কলকাতায় ফিরে এলাম বড়বাবুর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে। জামাইকে বিয়ের রাত্রে বেবি অস্ট্রিন গাড়ী যৌতুক দেওয়া হ’ল–বিবাহ মণ্ডপের মেরাপ বাঁধতে ও ফুল দিয়ে সাজাতেই ব্যয় হ’ল আটশ টাকা। বিয়ের পরে ফুলশয্যার তত্ব সাজাতে আট-দশজন লোক হিমশিম খেয়ে গেল। ছোটবাবুর বন্ধুবান্ধবদের একদিন পৃথক ভোজ হ’ল, সেদিন শখের থিয়েটারে হাজার টাকা গেল এক রাত্রে। তবুও তো শুনলাম এ তেমন কিছু নয়– এরা পাঁড়াগাঁয়ের গৃহস্থ জমিদার মাত্র, খুব বড়মানুষি করবে কোথা থেকে।
ফুলশয্যার তত্ব সাজাতে খুব খাটুনি হ’ল। দু-মণ দই, আধ মণ ক্ষীর, এক মণ মাছ, লরি-বোঝাই তরিতরকারি, চল্লিশখানা সাজানো থালায় নানা ধরনের তত্বের জিনিস–সব বন্দোবস্ত করে তত্ব বার করে ঝি-চাকরের সারি সাজাতে ও তাদের রওনা করতে–সে এক রাজসূয় ব্যাপার।
ওদের রঙীন কাপড়-পরা ঝি-চাকরের লম্বা সারির দিকে চেয়ে মনে হ’ল এই বড়মানুষির খরচের দরুন নিমচাঁদের স্ত্রী তিনটে টাকা দিয়েছে। অথচ এই হিমবর্ষী অগ্রহায়ণ মাসের রাত্রে হয়ত যে অনাথা বিধবার খেজুরডালের ঝাঁপে শীত আটকাচ্চে না, সেই যে বুড়ী যার গলা কাঁপছিল, তার সেই ধার-করে দেওয়া আট আনা পয়সা এর মধ্যে আছে। ধর্মের নামে এরা নিয়েছে, ওরা স্বেচ্ছায় হাসিমুখে দিয়েছে।
সব মিথ্যে। ধর্মের নামে এরা করেচে ঘোর অধর্ম ও অবিচারের প্রতিষ্ঠা। বটতলার গোসাঁই এদের কাছে ভোগ পেয়ে এদের বড়মানুষ করে দিয়েছে, লক্ষ গরীব লোককে মেরে–জ্যাঠামশায়দের গৃহ-দেবতা যেমন তাদের বড় করে রেখেছিল, মাকে, সীতাকে ও ভুবনের মাকে করেছিল ওদের ক্রীতদাসী।
সত্যিকার ধর্ম কোথায় আছে? কি ভীষণ মোহ, অনাচার ও মিথ্যের কুহকে ঢাকা পড়ে গেছে দেবতার সত্য রূপ সেদিন, যেদিন থেকে এরা হৃদয়ের ধর্মকে ভুলে অর্থহীন অনুষ্ঠানকে ধর্মের আসনে বসিয়েছে।
দাদার একখানা চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। দাদা যেখানে কাজ করে, সেখানে এক গরীব ব্রাহ্মণের একটি মাত্র মেয়ে ছিল, ওখানকার সবাই মিলে ধরে-পড়ে মেয়েটির সঙ্গে দাদার বিয়ে দিয়েচে। দাদা নিতান্ত ভালমানুষ, যে যা বলে কারও কথা ঠেলতে পারে না। কাউকে জানানো হয়নি, পাছে কেউ বাধা দেয়, তারাই জানাতে দেয়নি। এদিকে জ্যাঠামশায়ের ভয়ে বাড়ীতে বৌ নিয়ে যেতে সাহস করছে না, আমায় লিখেচে, সে বড় বিপদে পড়েছে, এখন সে কি করবে? চিঠির বাকী অংশটা নব-বধূর রূপগুণের উচ্ছ্বসিত সুখ্যাতিতে ভর্তি।
–জিতু, আমার বড় মনে কষ্ট, বিয়ের সময় তোকে খবর দিতে পারিনি। তুই একবার অবিশ্যি অবিশ্যি আসবি, তোর বউদিদির বড় ইচ্ছে তুই একবার আসিস। মায়ের সম্বন্ধে কি করি আমায় লিখবি। সেখানে তোর বউদিকে নিয়ে যেতে আমার সাহসে কুলোয় না। ওরা ঠিক কুলীন ব্রাহ্মণ নয়, আমাদের স্বঘরও নয়, অত্যন্ত গরিব, আমি বিয়ে না করলে মেয়েটি পার হবে না সবাই বললে, তাই বিয়ে করেচি। কিন্তু তোর বৌদিদি বড় ভাল মেয়ে, ওকে যদি জ্যাঠামশায় ঘরে নিতে না চান, কি অপমান করেন, সে আমার সহ্য হবে না…
পত্র পড়ে বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই হ’ল। দাদা সংসারে বড় একা ছিল, ছেলেবেলা থেকে আমাদের জন্যে খাটচে, জীবনটাই নষ্ট করলে সেজন্যে, অথচ ওর দ্বারা না হ’ল বিশেষ কোনো উপকার মায়ের ও সীতার, না হ’ল ওর নিজের। ভালই হয়েছে ওর মত স্নেহপ্রবণ, ত্যাগী ছেলে যে একটি আশ্রয়নীড় পেয়েছে, ভালবাসার ও ভালবাসা পাবার পাত্র পেয়েছে, এতে ওর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হলুম। কত রাত্রে শুয়ে শুয়ে দাদার দুঃখের কথা ভেবেচি!
মাকে কাছে নিয়ে আসতে পত্র লিখে দিলাম দাদাকে। জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে রাখবার আর দরকার নেই। আমি শীগগিরই গিয়ে দেখা করবো।
মাঘ মাসের প্রথমে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মনে কেমন একটা উদাস ভাব, কিসের একটা অদম্য পিপাসা। আমার মনের সঙ্গে যা খাপ খায় না, তা আমার ধর্ম নয়। ছেলেবেলা থেকে আমি যে অদৃশ্য জগতের বার বার সম্মুখীন হয়েচি, অথচ যাকে কখনও চিনি নি, বুঝিনি–তার সঙ্গে যে ধর্ম খাপ খায় না, সেও আমার ধর্ম নয়।
অথচ চারিদিকে দেখচি সবাই তাই। তারা সৌন্দর্যকে চেনে না, সত্যকে ভালবাসে না, কল্পনা এদের এত পঙ্গু যে, যে-খোঁটায় বদ্ধ হয়ে ঘাসজল খাচ্চে গরুর মত–তার বাইরে ঊর্ধ্বের নীলাকাশের দেবতার যে-সৃষ্টি বিপুল ও অপরিমেয় এরা তাকে চেনে না।
বছরখানেক ঘুরে বেড়ালুম নানা জায়গায়। কতবার ভেবেচি একটা চাকরি দেখে নেবো, কিন্তু শুধু ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কিছু ভাল লাগতো না। যেখানে শুনতাম কোনো নতুন ধর্মসম্প্রদায় আছে, কি সাধু-সন্ন্যাসী আছে, সেখানে যেন আমায় যেতেই হবে, এমন হয়েছিল।
কালনার পথে গঙ্গার ধারে একদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। কাছেই একটা ছোট গ্রাম, চাষী কৈবর্তের বাস। ওখানেই আশ্রয় নেবো ভাবলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খড়ের ঘর, বেশ নিকোনো-পুছোনো, উঠোন পর্যন্ত এমন পরিষ্কার যে সিঁদুর পড়লে উঠিয়ে নেওয়া যায়। সকলের ঘরেই ধানের ছোটবড় গোলা, বাড়ির সামনে-পিছনে ক্ষেত-খামার। ক্ষেতের বেড়ায় মটরশুঁটির ঝাড়ে সাদা গোলাপী ফুল ফুটে মিষ্টি সুগন্ধে সন্ধ্যার অন্ধকার ভরিয়ে রেখেচে।
একজন লোক গোয়ালঘরে গরু বাঁধছিলো। তাকে বললাম–এখানে থাকবার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে? সে বললে–কোত্থেকে আসা হচ্চে? আপনারা?
‘ব্রাহ্মণ’ শুনে নমস্কার করে বললে–ওই দিকে একটু এগিয়ে যান–আমাদের অধিকারী মশাই থাকেন, তিনি ব্রাহ্মণ, তাঁর ওখানে দিব্বি থাকার জায়গা আছে।
একটু দূরে গিয়ে অধিকারীর ঘর। উঠোনের এক পাশে একটা লেবুগাছ। বড় আটচালা ঘর, উঁচু মাটির দাওয়া। একটি ছোট ছেলে বললে, অধিকারী বাড়ী নেই, হলুদপুকুরে কীর্তনের বায়না নিয়ে গাইতে গিয়েচে-কাল আসবে।
আমি চলে যাচ্ছি এমন সময় একটি মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে বললে–চলে কেন যাবেন? পায়ের ধুলো দিয়েছেন যদি রাতে এখানে থাকুন না কেনে?
কথার মধ্যে রাঢ় দেশের টান। মেয়েটি তারপর এসে দাওয়ায় দাঁড়াল। বয়স সাতাশ আটাশ হবে, রং ফর্সা, হাতে টেমির আলোয় কপালের উল্কি দেখা যাচ্ছে।
মেয়েটি দাওয়ায় একটা মাদুর বিছিয়ে দিলে, এক ঘটি জল নিয়ে এল। আমি হাত পা ধুয়ে সুস্থ হয়ে বসলে মেয়েটি বললে–রান্নার কি যোগাড় করে দেবো ঠাকুর?
আমি বললাম–আপনারা যা রাঁধবেন, তাই খাবো।
রাত্রে দাওয়ায় শুয়ে রইলাম। পরদিন দুপুরের পরে অধিকারী মশাই এল। পেছনে জনতিনেক লোক, একজনের পিঠে একটা খোল বাঁধা। তামাক খেতে খেতে আমার পরিচয় নিলে, খুব খুশী হ’ল আমি এসেচি বলে।
বিকেলে উল্কি-পরা স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কি নিয়ে তার ঝগড়া বেধে গেল। স্ত্রীলোকটি বলচে শুনলাম–এমন যদি করবি মিন্সে, তবে আমি বলরামপুরে চলে যাব। কে তোর মুখনাড়ার ধার ধারে? একটা পেট চলে যাবে ঢের, সেজন্যে তোর তোয়াক্কা রাখি ভেবেচিস।
আগুনে জল পড়ার মত অধিকারীর রাগ একদম শান্ত হয়ে গেল। রাত্রে ওদের উঠোনে প্রকাণ্ড কীর্তনের আসর বসল। রাত তিনটে পর্যন্ত কীর্তন হ’ল। আসরসুদ্ধ সবাই হাত তুলে নাচতে শুরু করলে হঠাৎ। দু-তিন ঘণ্টা উদ্দণ্ড নৃত্যের পরে ক্লান্ত হয়ে পড়ার দরুনই হোক বা বেশী রাত হওয়ার জন্যেই হোক, তারা কীর্তন বন্ধ করলে।
আমি যেতে চাই, ওরা–বিশেষ করে সেই স্ত্রীলোকটি–আমায় যেতে দেয় না। কি যত্ন সে করলে! আর একটা দেখলাম, অধিকারীকেও সেবা করে ঠিক ক্রীতদাসীর মত– মুখে এদিকে যখন-তখন যা-তা শুনিয়ে দেয়, তার মুখের কাছে দাঁড়াবার সাধ্যি নেই অধিকারীর।
যাবার সময় মেয়েটি দিব্যি করিয়ে নিলে যে আমি আবার আসবো। বললে–তুমি তো ছেলেমানুষ, যখন খুশী আসবে। মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাবে। তোমার খাওয়ার কষ্ট হচ্চে এখানে–মাছ মিলে না, মাংস মিলে না। বোশেখ মাসে এস, আম দিয়ে দুধ দিয়ে খাওয়াবো।
কী সুন্দর লাগল ওর স্নেহ!
আমার সেই দর্শনের ক্ষমতাটা ক্রমেই চলে যাচ্চে। এই দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে মাত্র একটিবার জিনিসটা ঘটেছিল।
ব্যাপারটা যেন স্বপ্নের মত। তারই ফলে আটঘরায় ফিরে আসতে হচ্চে। সেদিন দুপুরের পরে একটি গ্রাম্য ডাক্তারের ডিসপেন্সারী-ঘরে বেঞ্চিতে শুয়ে বিশ্রাম করছি– ডাক্তারবাবু জাতিতে মাহিষ্য, সর্বদা ধর্মকথা বলতে ও শুনতে ভালবাসে বলে আমায় ছাড়তে চাইত না, সব সময় কেবল ঘ্যান ঘ্যান করে ওই সব কথা পেড়ে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল–আমি ধর্মের কথা বলতেও ভালবাসি না, শুনতেও ভালবাসি না– ভাবছি শুয়ে শুয়ে কাল সকালে এর এখান থেকে চলে যাব–এমন সময় একটু তন্দ্রা-মত এল। তন্দ্রাঘোরে মনে হ’ল আমি একটা ছোট্ট ঘরের কুলুঙ্গি থেকে বেদানা ভেঙে কার হাতে দিচ্ছি, যার হাতে দিচ্চি সে তার রোগজীর্ণ হাত অতিকষ্টে একটু করে তুলে বেদানা নিচ্চে, আমি যেন ভাল দেখতে পাচ্চি নে, ঘরটার মধ্যে ধোঁয়া-ধোঁয়া কুয়াশা–বারকতক এই রকম বেদানা দেওয়া-নেওয়ার পরে মনে হ’ল রোগীর মুখ আর আমার মায়ের মুখ এক। তন্দ্রা ভেঙে মন অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠল এবং সেই দিনই সেখান থেকে আঠারো মাইল হেঁটে এসে ফুলসরা ঘাটে স্টীমার ধরে পরদিন বেলা দশটায় কলকাতা পৌঁছুলাম। মায়ের নিশ্চয়ই কোনো অসুখ করেচে, আটঘরা যেতেই হবে।
শেয়ালদ’ স্টেশনের কাছে একটা দোকান থেকে আঙুর কিনে নেবো ভাবলাম, পকেটেও বেশী পয়সা নেই। পয়সা গুনচি দাঁড়িয়ে, এমন সময় দূর থেকে মেয়েদের বিশ্রাম ঘরের সামনে দণ্ডায়মানা একটি নারীমূর্তির দিকে চেয়ে আমার মনে হ’ল দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা আমার পরিচিত। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পারলাম না–আঙুর কিনতে চলে গেলাম। ফিরবার সময় দেখি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শ্রীরামপুরের ছোট বৌঠাকরুন। আমি কাছে যেতেই বৌঠাকরুন চমকে উঠলেন প্রায়। বললেন–আপনি! কোত্থেকে আসচেন? এমন চেহারা?
আমি বললুম–আপনি একটু আগে মেয়েদের ওয়েটিং রুমের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ, এই যে আমরা এখন এলাম যোগবাণীর গাড়ীতে–আমরা শ্রীরামপুরে যাচ্চি। ইনি মেজদা–এঁকে দেখেন নি কখনও?
যুবকটি আমায় বললে–আপনি তাহলে একটু দাঁড়ান দয়া ক’রে–আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি–এখানে দরে বনচে না–
সে চলে গেল। ছোট-বৌঠাকরুন বললেন–মাগো কি কালীমূর্তি চেহারা হয়েছে! বড়দি বলছিল আপনি নাকি কোথায় চলে গিয়েছিলেন, খোঁজ নেই–সত্যি?
–নিতান্ত মিথ্যে কি করে বলি! তবে সম্প্রতি দেশে যাচ্চি।
ছোট-বৌঠাকরুন হাসিমুখে চুপ করে রইলেন একটু, তারপর বললেন–আপনার মত লোক যদি কখনও দেখে থাকি! আপনার পক্ষে সবই সম্ভব। জানেন, আপনি চলে আসবার পরে বড়দির কাছ থেকে আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে করে শুনেচি। তখন কি অত জানতাম? বড়দি বাপের বাড়ি গিয়েচে আশ্বিন মাসে–আপনার সঙ্গে দেখা হবে’খন। আচ্ছা, আর শ্রীরামপুরে গেলেন না কেন? এত ক’রে বললাম, রাখলেন না কথা? আমার ওপর রাগ এখনও যায়নি বুঝি?
–রাগ কিসের? আপনি কি সত্যি ভাবেন আমি আপনার ওপর রাগ করেছিলাম?
ছোট-বৌঠাকরুন নতমুখ চুপ করে রইলেন।
—বলুন!
ছোট-বৌঠাকরুন নতমুখেই বললেন–ও কথা যাক। আপনি এ-রকম ক’রে বেড়াচ্ছেন কেন? পড়াশুনো করলেন না কেন?
–সে সব অনেক কথা। সময় পাই তো বলব একদিন।
–আসুন না আজ আমাদের সঙ্গে শ্রীরামপুরে? দিনকতক থেকে যান, কি চেহারা হয়ে গিয়েছে আপনার! সত্যি, আসুন আজ।
–না, আজ নয়, দেশে যাচ্চি, খুব সম্ভব মায়ের বড় অসুখ–
ছোট-বৌঠাকরুন বিস্ময়ের সুরে বললেন–কই সে কথা তো এতক্ষণ বলেননি! সম্ভব মানে কি, চিঠি পেয়েচেন তো, কি অসুখ?
একটু হেসে বললাম–না, চিঠি পাইনি। আমার ঠিকানা কেউ জানতো না। স্বপ্নে দেখেচি–
ছোট-বৌঠাকরুন একটু চুপ করে থেকে মৃদু শান্ত সুরে বললেন–আমি জানি। তখন জানতাম না আপনাকে, তখন তো বয়সও আমার কম ছিল। বড়দি তার পরে বলেছিল। একটা কথা রাখবেন? চিঠি দেবেন একখানা? অন্তত একখানা লিখে খবর জানাবেন?…
ছোট-বৌঠাকরুন আগের চেয়ে সামান্য একটু মোটা হয়েছেন, আর চোখে সে বালিকাসুলভ তরল ও চপল দৃষ্টি নেই, মুখের ভাব আগের চেয়ে গম্ভীর। আমি হেসে বললাম–আমি চিঠি না দিলেও, শৈলদির কাছ থেকেই তো জানতে পারবেন খবর–
এই সময় ওঁর মেজদাদা ট্যাক্সিতে চড়ে এসে হাজির হলেন। আমি বিদায় নিলুম।
সন্ধ্যার সময় আটঘরা পৌঁছে দেখি সত্যিই মায়ের অসুখ। আমাদের ঘরখানায় মেঝের ওপর পাতা বিছানায় মা শুয়ে। অন্ধকারে আমায় চিনতে না পেরে ক্ষীণস্বরে বললে–কে ওখানে, হারু?
তারপর আমায় দেখে কেঁদে উঠে বললেন–কে জিতু, আয় বাবা আয়, এতদিন পরে মাকে মনে পড়লো তোর? আয় এই বালিশের কাছে আয়–ওমা, এ কি হয়ে গিয়েছিস রে! রোগা কালো চেহারা–ওরা সত্যিই বলত তো!
মা একটি ঘরে শুয়ে–জনপ্রাণী কেউ কাছে নেই। সন্ধ্যা হব-হব, ঘরে একটা আলো পর্যন্ত কেউ জ্বালেনি। এমনিই বাড়ি বটে! কেন, এত ছেলে মেয়ে বৌ বাড়িতে, একজন কাছে থাকতে নেই? অথচ—, কিন্তু পরের দোষ দিয়ে লাভ কি, আমিই বা কোথায় ছিলুম এতদিন?
বললাম–মা, দাদা কোথায়? সীতা আসেনি?
মা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। বললেন–ওরা কেউ চিঠি দেয় না, ব’লে ব’লে আজ বুঝি হারু একখানা পত্র দিয়েচে সীতাকে।
–ক’দিন অসুখ হয়েছে তোমার, মা? ওরা কেউ দেখে না? জ্যাঠাইমা কাকিমারা আসে না?
–ভুবনের মা মাঝে মাঝে আসে। এই বিকেলে সাবু দিয়ে গেল–তা সাবু কি খেতে পারি, ওই রয়েছে বাটিতে। ছোটবৌ এসেছিল বিকেলবেলা। বটঠাকুর বাড়ি নেই বুঝি– আর কেউ এদিকে মাড়ায় না।
তারপর আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন–হ্যাঁরে জিতু, তুই নাকি সন্নিসী হয়ে গিয়েচিস–দিদি, হারু, মেজবৌ, ঠাকুরপোরা সবাই বলে–সত্যি? বলে সে আর আসবে না, সে কোন দিকে বেরিয়ে চলে গিয়েছে, তার ঠিকানা কেউ জানে না। আমি ভাবি জিতু আমায় ভুলে যাবে এমনি হবে? আবার ভাবি আমার কপাল খারাপ, নইলে এ-সব হবেই বা কেন–ভেবে ভেবে রাত জেগে বসে থাকি।
–কেঁদো না, কেঁদো না, ছিঃ! ওসব মিথ্যে কথা। কে বলেচে সন্নিসী হয়ে গেছি! এই দ্যাখ না সাদা কাপড় পরনে, সন্নিসী কি সাদা কাপড় পরে?
মনে বড় অনুতাপ হ’ল–কি অন্যায় কাজ করেচি এতদিন এভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে! আর এদেরও কি অন্যায়, সবাই মিলে মাকে এমন করে ভয় দেখানোই বা কেন, মা সরল মানুষ, সকলের কথাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু আমার দোষ ছিল না, আমি ভেবেছিলাম মা আছেন দাদার কাছে। নিশ্চিন্ত ছিলুম অনেকটা সেজন্যে। জিজ্ঞেস করলাম–মা, দাদা তোমায় নিয়ে যায়নি?
–সে অনেক কথা। নিতু নিতেও এসেছিল, বটঠাকুর বললেন–যাও, কিন্তু আমার এখানে আর আসতে পাবে না। সীতার শ্বশুরবাড়ির লোক ভাল না এখন দেখচি–তারাও বটঠাকুরের হাতের লোক, বললে, তা হলে মেয়ে-জামায়ের সঙ্গে সম্বন্ধ ঘুচে যাবে। মেয়ে তারা আর পাঠাবে না। বৌমাকেও এখনও দেখিনি, এমনি আমার কপাল। বটঠাকুর সেই বউকে এ-বাড়ি নাকি ঢুকতে দেবেন না। তা নিতু আমায় লিখলে, মা, এই কটা মাস যাক–কোথায় নাকি ভাল চাকরি পাবে–এখানে পাড়াগাঁয়ে বাসাও পাওয়া যায় না। আমি আবার গিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি উঠবো সেটা ভাল দেখাবে না। মাঘ মাসে একেবারে নিয়ে যাবে এখান থেকে। এই তো নিতু ওমাসেও এসেছিল। আহা, বাছাকে কি অপমান করলে সবাই মিলে। আমার কপালে কেবল চারিদিকে অপমান ছাড়া আর কিছু জোটে না–
কেন চাকরি ছেড়ে দিলাম? কেন এভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াই? এখন দেখতে পাচ্চি সীতার বিবাহ হয়ে গেলেই আমার কর্তব্য শেষ হয়েচে ভাবা উচিত ছিল না। মাকে আমি উপেক্ষা করে এসেচি এতদিন, দাদা সাধ্যমত অবিশ্যি করেচে–কিন্তু আমি কিছুই করিনি। কেন আমার এমন ধারা মতিগতি হ’ল? কোথায় আমার কর্তব্য, সে সম্বন্ধে আমি অন্ধ ছিলাম কেন?
লজ্জিত ও অনুতপ্ত সুরে বললাম–মা আঙুর খাবে?… আঙুর এনেছি, ভাল আঙুর শেয়ালদ’ থেকে–
–ভূতোকে বললাম, একটা আলো নিয়ে আয়, তা দেয়নি দেখচি–বলতে বলতে ছোট-কাকীমা ঘরের দোরের কাছে এসে আমায় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন–কে বসে ওখানে?
আমি অপরাধীর মত কুণ্ঠিত স্বরে বললাম–আমি, কাকীমা।
এগিয়ে এসে বললেন–কে নিতু?
—না, আমি।
কাকীমা অবাক হয়ে বললেন–ওমা, জিতু যে দেখচি, কোত্থেকে, কি ভাগ্যি তোমার মায়ের? তারপর, কি মনে করে?
আমি মাথা হেঁটে ক’রে বসে রইলাম, কি আর বলব।
কাকীমা বললেন–তোমার কাণ্ডজ্ঞান যে কবে হবে, তা ভেবেই পাই নে। একেবারে একটা বছর নিরুদ্দেশ নিখোঁজ।–আর এই এ-ভাবে মাকে ফেলে রেখে! তোমাদের একটু জ্ঞান নেই যে এটা কার বাড়ি? এখানে কে দ্যাখে তোমার মাকে? সবই তো জান– বয়েস হয়েছে, এখনও বুদ্ধি হ’ল না? বটঠাকুর বাড়ি নেই, একটা ডাক্তার-বদ্যি কে দেখায় তার নেই ঠিক। হরি ডাক্তারকে একবার আনতে হয়–টাকাকড়ি কিছু আছে? নেই বোধ হয়, সে দেখেই বুঝিচি–নেই। আচ্ছা, টাকা আমি দেব এখন, ভেব না, ডাক্তার আন।
ছোটকাকীমার পায়ের ধুলো নেবার ইচ্ছা হ’ল। এ বাড়িতে সবাই পশু, সবাই অমানুষ–সত্যিকারের মেয়ে বটে ছোটকাকীমা।
রাত্রেই ডাক্তার এল। ওষুধপত্রও হ’ল। দাদাকে পত্র দিলাম পরদিন সকালে।
আমায় নিয়ে খুব হৈ-চৈ হ’ল। জ্যাঠাইমা আমায় রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে খেতে দেবেন না–আমি জাতবিচার মানি নে, বাগদি দুলে সবার হাতে খেয়ে বেড়াই, এ-সব কথা কে এসে গাঁয়ে বলেচে। নানা রকম অলঙ্কার দিয়ে কথাটা রাষ্ট্র হয়েচে গাঁয়ে।
মায়ের অবস্থা শেষরাত থেকে বড় খারাপ হ’ল। সকালে আমাকে আর চিনতে পারেন না–ভুল বকতেও লাগলেন।
সন্ধ্যার সময় একটা মিটমিটে টেমি জ্বলচে ঘরের মেজেতে–আমি একা বসে আছি মায়ের শিয়রে, এমন সময় বাইরে উঠোনে একখানা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ হ’ল। একটু পরেই ব্যস্তসমস্ত ভাবে মাটিতে আঁচল লুটোতে লুটোতে সীতা ঘরে ঢুকল। আমায় দেখে বললে, ছোড়দা?
আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম। সীতা একেবারে বদলে গিয়েছে, মাথায় কত বড় হয়েচে, দেখতেও কি সুন্দর হয়েছে–ওকে চেনা যায় না আর।
মাকে বললাম–মা, ওমা, সীতা এসেচে–
মা চাইলেন, কি বললেন বোঝা গেল না। বোধ হয় বুঝতে পারলেন না যে সীতা এসেচে।
সীতা খুব শক্ত মেয়ে। সে কেঁদেকেটে আকুল হয়ে পড়লো না। আমায় বললে– ছোড়দা, আমার বালাজোড়াটা দিচ্চি, তাই দিয়ে ভাল ডাক্তার নিয়ে এস। এখানকার হরিডাক্তার তো? তার কাজ নয়।
আমি অক্ষমতার লজ্জায় কুণ্ঠিত সুরে বললাম–তার পর তোর শ্বশুরবাড়ির লোকে তোকে বকবে। সে কি করে হয়–
সীতা বললে–ইস! বকবে কিসের জন্যে, বালা কি ওদের? মায়ের বালা, মা দিয়েছিলেন বিয়ের সময়। বাবা গড়িয়ে দিয়েছিলেন মাকে। তুমি বালা নিয়ে যাও, তারপর ওরা যা বলে বলবে–
এই সময় সীতার স্বামী ঘরে ঢুকল। আমি যে-রকম চেহারা কল্পনা করেছিলাম, লোকটা তার চেয়েও খারাপ। কালো তো বটেই, পেটমোটা, বোধ হয় পিলে আছে, কাঠখোট্টা গড়ন, চোয়ালের হাড় উঁচু–গায়ে একটা ছেলেমানুষের মত ছিটের জামা, একটা রাঙা আলোয়ান, পায়ে কেম্বিসের জুতো। আমায় দেখে দাঁত বার করে হেসে বললে–এই যে, ছোটবাবু না? কখন আসা হ’ল, বড়বাবু বুঝি এখনও আসবার ফুরসত পাননি–তার পর অসুখটা কি?…এখন কেমন আছেন?
তারপর সে খানিকক্ষণ বসে থেকে বললে–বসো তোমরা। আমি জ্যাঠাইমাদের সঙ্গে দেখা করে আসি–একটু চায়ের চেষ্টাও দেখা যাক, গরুর গাড়িতে গা-হাত ব্যথা হয়ে গিয়েচে।
ওর কথার ভঙ্গিতে একটা চাষাড়ে ভাব মাখানো। এই লোকটা সীতার স্বামী! সীতার মত মেয়ের! সীতাকেও আমরা সবাই মিলে উপেক্ষা করচি।
এই সময় হঠাৎ শৈলদিদির কথা আমার মনে পড়ল। শেয়ালদ’ স্টেশনে ছোট বৌঠাকরুন বলেছিল শৈলদি এখানে আছে। সীতার বালাজোড়াটা নেব না–ওকে তার জন্যে অনেক দুঃখ পোয়াতে হবে সেখানে। ও যে-রকম চাপা মেয়ে, কোন অভিযোগ করবে না কখনও কারু কাছে। শৈলদিদির কাছ থেকে টাকা ধার নেবো, মায়ের অসুখের পর যে-ক’রে হোক দেনা শোধ হবেই।
একবার বাড়ির মধ্যে গিয়ে দেখি সীতার স্বামী ওদের রান্নাঘরে বসে হুঁকো হাতে তামাক খেতে খেতে খুব গল্প জমিয়েচে–আমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভায়েদের সকলেরই প্রায় বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং বৌয়েরা সকলেই ওর শালাজ–তাদের সঙ্গে।
রাত দশটার সময় শৈলদিদি এসে হাজির। আমায় দেখে বললে–এই যে সন্নিসী ঠাকুর ফিরে এসেচ দেখচি। এই যে সীতা–এস এস, সাবিত্রীসমান হও, কখন এলে ভাই? আমি শুনলাম এই খানিকটা আগে, আমাদের ও-পাড়ায় কে খবর দেবে বল।
আমি আর সীতা শুধু ঘরে মায়ের পাশে বসে। সীতার স্বামী খেয়ে-দেয়ে শুয়েচে, অবিশ্যি সে বসে থাকতে চেয়েছিল–আমি বলেছিলাম, তার দরকার নেই তুমি খেয়ে একটু বিশ্রাম কর–দরকার হলে ডাকব রাত্রে।
শৈলদিদি রাত্রে থাকতে চাইলে, বললে–আজ রাতে লোকের দরকার। তোরা দুটিতে মোটে বসে আছিস। আমি খেয়ে আসি, আমিও থাকব।
আমি বললাম–না শৈলদি, আমরা দুজন আছি, ভগ্নীপতি এসেচে–তোমার আর কষ্ট করতে হবে না।
তারপর বাইরে ডেকে টাকার কথা বললাম। শৈলদি বললে–কত টাকা?
—গোটাকুড়ি দাও গিয়ে এখন। কাল সকালেই আমি তা হ’লে চলে যাই ডাক্তার আনতে–
–তা হলে কাল সকালে যাবার সময় আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি। ওখান দিয়েই তো পথ–কেমন তো?
ছোটকাকীমা এই সময় এলেন। শৈলদিকে দেখে বললেন–জিতুর মাকে নিয়ে বেজায় মুশকিল হয়েচে ভাই–ওরা ছেলেমানুষ, কি বা বোঝে–নিতু এখনও তো এল না। হঠাৎ চার পাঁচ দিনের জ্বরে যে মানুষ এমন হয়ে পড়বে তা কি ক’রেই বা জানবো। তবুও তো জিতু কোথা থেকে ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল তাই রক্ষে।
রাতে জ্যাঠাইমাও এসে খানিকটা বসে রইলেন। অনেক রাত্রে সবাই চলে গেল, আমি সীতাকে বললাম–তুই ঘুমিয়ে নে সীতা। আমি জেগে থাকি। রাতে কোন ভয় নেই।
সকাল বেলা আটটা-নটার পর থেকে মা’র অবস্থা খুব খারাপ হ’ল। দশটার পর দাদা এল–সঙ্গে বৌদিদি ও দাদার খোকা। বৌদিদিকে প্রথম দেখেই মনে হ’ল শান্ত, সরল, সহিষ্ণু মেয়ে। তবে খুব বুদ্ধিমতী নয়, একটু অগোছালো আনাড়ি ধরনের। নিতান্ত পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, বাইরে কোথাও বেরোয়নি বিশেষ, এই বোধ হয় প্রথম, কিছু তেমন দেখেও নি। গরম জলের বোতল পায়ে সেঁক করতে হবে শুনে ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিপন্ন মুখে সীতার দিকে চেয়ে রইল। কাপড়-চোপড় পরবার ধরনও অগোছালো–আজকালকার মত নয়। বৌদিদি যেন বনে-ফোঁটা শুভ্র কাঠমল্লিকা ফুল, তুলে এনে তোড়া বেঁধে ফুলের দোকানে সাজিয়ে রাখবার জিনিস নয়। আর একেবারে অদ্ভুত ধরনের মেয়েলী, ওর সবটুকুই নারীত্বের কমনীয়তা মাখানো।
সীতা আমায় আড়ালে বললে–চমৎকার বৌদি হয়েচে, ছোড়দা। আহা, মা যদি একটিবারও চোখ মেলে চেয়ে দেখতেন। আমাদের কপাল!
বেলা তিনটের সময় মা মারা গেলেন। যে মায়ের কথা তেমন করে কোন দিন ভাবি নি, আমাদের কাজকর্মে, উদ্যমে, আশায়, আকাঙ্ক্ষায়, উচ্চাভিলাষে মায়ের কোন স্থান ছিল না, সবাই মিলে যাকে উপেক্ষা করে করে এসেচি এত দিন–আজ সেই মা কতদূরে কোথায় চলে গেলেন–সেই মায়ের অভাবে হঠাৎ আমরা অনুভব করলাম। অনেকখানি খালি হয়ে গিয়েচে জীবনের। ঘরের মধ্যে যেমন প্রকাণ্ড ঘরজোড়া খাট থাকে, আজন্ম তার ওপর শুয়েচি, বসেছি, খেলেছি, ঘুমিয়েচি, সর্বদা কে ভাবে তার অস্তিত্ব, আছে তো আছে। হঠাৎ একদিন খাটখানা ঘরে নেই–ঘরের পরিচিত চেহারা একেবারে বদলে গিয়েছে–সে ঘরই যেন নয়, একদিন ঘরের সে নিবিড় সুপরিচিত নিজস্বতা কোথায় হারিয়ে গেল, তখন বোঝা যায় ঘরের কতখানি জায়গা জুড়ে কি গভীর আত্মীয়তায় ওর সঙ্গে আবদ্ধ ছিল সেই চিরপরিচিত একঘেয়ে সেকেলে খাটখানা–ঘরের বিরাট ফাঁকা আর কিছু দিয়েই পূর্ণ হবার নয়।
সীতার ধৈর্যের বাঁধ এবার ভাঙলো। সে ছোট মেয়ের মত কেঁদে আবদার করে যেন মাকে জড়িয়ে থাকতে চায়। মা আর সে দুজনে মিলে এই সংসারে সকালে-সন্ধ্যায় খেটে দুঃখের মধ্যে দিয়ে পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসেছিল–সে-সব দিনের দুঃখের সঙ্গিনী হিসাবে মা আমাদের চেয়েও ওর কাছে বেশী আপন, বেশী ঘনিষ্ঠ–অভাগী এত দিনে সত্যি সত্যি নিঃসঙ্গ হ’ল সংসারে। ওর স্বামী যে ওর কেউ নয়, সে আমার বুঝতে দেরি হয় নি এতটুকু। কিন্তু ও হয়ত এখনও তা বোঝেনি।
দিন দুই পরে বৌদিদি দুপুরবেলায় ওদের রান্নাঘরে একটা ঘড়া আনতে গিয়েছেন। জ্যাঠাইমা বলেচেন-ওখানে দাঁড়াও, দাওয়াটাতে–অমনি হট করে ঘরে ঢুকলে যে?
বৌদিদি অবাক হয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েচেন, জ্যাঠাইমা ঘড়া বার করে দিয়েচেন দাওয়াতে। বৌদিদি নিয়ে এসেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা কি, বুদ্ধিমতী মেয়ে হ’লে তখনই বুঝত।
এ-কথা তখন সে কাউকে বলেনি।
পরদিন মেজকাকা আমায় ডেকে বললেন–একটা কথা আছে, শোন। তোমার মায়ের কাজটা এখানে না করে অন্য জায়গায় গিয়ে করো। মানে তোমার দাদার বৌয়ের এখানে তো পাকস্পর্শ হয়নি, বড়দাদাও নেই বাড়ি–এ অবস্থায় শ্রাদ্ধের সময় কেউ খেতে আসবে না। তোমার দাদার বৌকে আমরা সেভাবে ঘরে তো নিইনি। এই বুঝে যা হয় ব্যবস্থা করো। বলো তোমার দাদাকে।
তলায় তলায় এঁরা সীতার স্বামী গোপেশ্বরকে কি পরামর্শ দিয়েচেন জানি নে, সে হঠাৎ বেঁকে দাঁড়িয়ে বললে চতুর্থীর শ্রাদ্ধ সীতাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে করবে–অথচ আগে ঠিক হয়েছিল চতুর্থীর শ্রাদ্ধ এখানেই হবে। এর কোনও দরকার ছিল না, সীতা এখানে শ্রাদ্ধ করলে তাতে কোন দোষ সমাজের মতেও হবার কথা নয়। কিন্তু সে কিছুতেই শুনলে না এই অবস্থায় বৌদিদিকে পেয়ে সীতা অনেকটা সান্ত্বনা পেয়েছিল–কিন্তু সে ওদের সইল না। বৌদিদির সঙ্গে সীতার বেশী মেলামেশিটা যেন গোড়া থেকেই আমার ভগ্নীপতি পছন্দ করে নি। নিজেই হোক আর ওদের পরামর্শেই হোক।
যাবার সময় সীতা বৌদিদির গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আমায় আড়ালে বললে– ছোড়দা আমায় বনবাসে ফেলে রেখে ভুলে থেকো না যেন, মাঝে মাঝে আসবে বল? আর শোনো, বৌদি বড্ড ভালমানুষ, ও এখনও জানে না যে ওর জন্যেই মায়ের কাজ এখানে করতে দিচ্চে না ওরা। এ কথা যেন বৌদিদির কানে না যায়, বলে দিও দাদাকে।
বৌদিদিকে বুঝিয়ে দেওয়া হ’ল এখানে শ্রাদ্ধ করতে খরচ বেশী পড়বে, কারণ জ্যেঠামশায়দের নাম বেশী, লোকজন নিমন্ত্রণ করতে হয় অনেক। গঙ্গাতীরে শ্রাদ্ধের কাজ করলে অনেক কম খরচ হবে। বৌদিদি তাই বুঝে গেল।
যাবার সময় আমাদের ঘরের চাবিটা ছোটকাকীমার হাতে দিয়ে বললুম-–এ বাড়িতে আর কাউকে আপন বলে জানি নে, কাকীমা। সীতার খোঁজখবর মাঝে মাঝে একটু নিও–ওর তো এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক একরকম মিটেই গেল।
ছোটকাকীমার চোখে জল এল। বললেন–আমার কোনো ক্ষমতা নেই, নইলে নিতুর বৌকে এ বাড়ি থেকে আজকে অন্য জায়গায় যেতে বলে?
আমি বললুম–সে কথা বলো না কাকীমা। আমরা এখানে এসেছিলাম প্রার্থী হয়ে, পরের দয়ার ওপর নির্ভর করে। এখানে কোন অধিকার নেই আমাদের।
কাকীমা বললেন–তুই ও কি কথা বলচিস জিতু? এ তোদের যে সাতপুরুষের ভিটে। জায়গা-জমি আর দুখানা ইট থাকলেই বা কি, আর গেলেই বা কি? এ ভিটেতে হারু কি যোগেশের যে অধিকার, তোদের দু-ভায়ের তার চেয়ে এক চুল কম নয়।
ছোটকাকীমার এক মূর্তি দেখেছিলাম বাল্যে, এ আর এক মূর্তি। এই একজনই এ বাড়ির মধ্যে বদলে গিয়েছে একেবারে। গাড়িতে যেতে যেতে সেই কথাটা বার বার মনে হচ্চিল।
.
১০.
মাস পাঁচ-ছয় পরে ঘুরতে ঘুরতে একবার গেলাম দাদার বাড়িতে।
দাদা ছিল না বাড়ি, বৌদিদি বাটনা-মাখা হাতে ছুটে বার হয়ে এল–আমার হাত থেকে পুঁটুলিটা নিয়ে বললে–এস এস ঠাকুরপো, রদ্দুরে মুখ রাঙা হয়ে গিয়েচে একেবারে। কই আসবে বলে চিঠি দেও নি তো! তা হ’লে একখানা গরুর গাড়ি স্টেশনে যেত।
তখনই বৌদিদি চিনি ভিজিয়ে শরবৎ করে নিয়ে এল। বললে–ঠাকুরপো তোমার মায়া নেই শরীরে। এত দেরি করে আসতে হয়? উনি কেবল বলেন তোমার কথা।
বিকেলে দাদা এল। আমায় পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেলে। কিসে আমার সুখ-সুবিধে হবে, কিসে আমায় বড় মাছ, ভালটা-মন্দটা খাওয়ানো যাবে, এই যোগাড়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এরা বেশ সুখে আছে। দাদা যা চাইত, তা সে পেয়েছে। সে চিরকালই সংসারী মানুষ, ছেলেপুলে গৃহস্থালী নিয়েই ও সুখী, তাই নিয়েই ও থাকতে ভালবাসে। ছেলেবেলা থেকে দাদাকে দেখে এসেছি, সংসার কিসে গোছালো হবে, কিসে সংসারের দুঃখ ঘুচবে, এই নিয়েই সে ব্যস্ত থাকত। লেখাপড়াই ছেড়ে দিলে আমাদের দু-পয়সা এনে খাওয়াবার জন্যে। কিন্তু পরের বাড়িতে পরের তৈরী ব্যবস্থার গণ্ডীর মধ্যে সেখানে তো কোন স্বাধীনতা ছিল না, কাজেই দাদার সে সাধ তখন আর মেটে নি। যার জন্যে ওর মন চিরকাল পিপাসিত ছিল, এতদিনে তার সন্ধান মিলেছে, তাই দাদা সুখী। দাদা ও বৌদিদি একই ধরনের মানুষ। নীড় বাঁধবার আগ্রহ ওদের রক্তে মেশানো রয়েছে। বৌদিদির বাপের বাড়ির অবস্থা খারাপই। একান্নবর্তী প্রকাণ্ড পরিবারের মেয়ে সে। তার বাপের বাড়িতে সবাই একসঙ্গে কষ্ট পায়, সবাই ছেঁড়া কাপড় পরে, একঘরে পুরানো লেপকাঁথা পেতে শীতের রাতে তুলো বেরুনো, ওয়াড়-হীন ময়লা লেপ টানাটনি করে ছেলেপুলেরা রাত কাটায়–সব জিনিসই সকলের, নিজের বলে বিশেষ কোন ঘরদোরও নেই, তৈজসপত্রও নেই–সেই রকম ঘরে বৌদিদি মানুষ হয়েছে। এতকাল পরে সে এমন কিছু পেয়েছে যাকে সে বলতে পারে এ আমার। এ আমার স্বামী, আমার ছেলে, আমার ঘরদোর–আর কারও ভাগ নেই এতে। এ অনুভূতি বৌদিদির জীবনে একেবারে নতুন।
দাদা আমায় তার পরদিন সকালে ওর কপির ক্ষেত, শাকের ক্ষেত দেখিয়ে বেড়ালে। বৌদিদি বললে–শুধু ওদিক দেখলে হবে না ঠাকুরপো, তুমি আমার গোয়াল দেখে যাও ভাই এদিকে। এই দ্যাখো এই হচ্ছে মুংলী। মঙ্গলবারে সন্ধেবেলা ও হয়, ওই সজনে গাছতলায় তখন গোয়াল ছিল। ও হ’ল, সেই রাতেই বিষম ঝড় ভাই। গোয়ালের চালা তো গেল উড়ে। তারপর এই নতুন গোয়াল হয়েছে এই বোশেখ মাসে।–বৌদিদি বাছুরের গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললে–বড় পয়মন্ত বাছুর, যে-মাসে হ’ল সেই মাসেই ওঁর সেই মনিব আমায় শাঁখা-শাড়ি পাঠিয়ে দিলে, ওঁর দু-টাকা মাইনে বাড়ালে।
দিনকতক যাবার পরে বৌদিদির একটা গুণ দেখলাম, লোককে খাওয়াতে বড় ভালবাসে। অসময়ে কোন ফকির বৈষ্ণব, কি চুড়িওয়ালী বাড়িতে এসে খেতে চাইলে নিজের মুখের ভাত তাদের খাওয়াবে। নিজে সে-বেলাটা হয়ত মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিলে।
এক দিন একটা ছোকরা কোথা থেকে একখানা ভাঙা খোল ঘাড়ে ক’রে এসে জুটলো। তার মুখে ও গালে কিসের ঘা, কাপড়-চোপড় অতি নোংরা, মাথায় লম্বা চুল। ছ-সাত দিন রইল, দাদাও কিছু বলে না, বৌদিদিও না। আমি একদিন বৌদিদিকে বললাম– বৌদি, দেখচো না ওর মুখে কিসের ঘা। বাড়ির থালা গেলাসে ওকে খেতে দিও না। ও ভাল ঘা নয়, ছেলেপুলের বাড়ি, ওকে পাতা কেটে আনতে বললেই তো হয়, তাতেই খাবে। আটদিন পরে ছোকরা চলে গেল। বোধ হয় আরও আট দিন থাকলে দাদা বৌদিদি আপত্তি করত না।
বৌদিদি খাটতে পারে ভূতের মত। ঝি নেই, চাকর নেই, একা হাতে কচি ছেলে মানুষ করা থেকে শুরু করে ধানসেদ্ধ, কাপড়-কাচা, বাসন-মাজা, জল-তোলা–সমস্ত কাজই করতে হয়। কোনদিন ব্যাজার হতে দেখলাম না সেজন্যে বৌদিদিকে।
এদের মায়ায় আমিও যেন দিনকতক জড়িয়ে গেলাম। এরকম শান্তির সংসার কতকাল ভোগ করি নি–বোধ হয় চা-বাগানেও না, কারণ সেখানে বাবা মাতাল হয়ে রাত্রে ফিরবেন, সে ভয় ছিল। ভেবে দেখলাম সত্যিকার শান্তি ও আনন্দভরা জীবন আমরা কাকে বলে কোনদিন জানি নি–স্রোতের শেওলার মত বাবা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এ চা বাগানে ও চা-বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, শেষকালে না-হয় কিছুদিন উমপ্লাং বাগানে ছিলেন–এতে মন আমাদের এক জায়গায় বসতে না বসতেই আবার অন্য জায়গায় উঠে যেতে হত–এইসব নানা কারণে নিজের ঘর, নিজের দেশ, এমন কি নিজের জাতি বলে কোন জিনিস আমাদের ছিল না। তার অভাব যদিও আমরা কোনদিন অনুভব করি নি– অত অল্পবয়সে করবার কথাও নয়–বিশেষ করে যখন হিমালয় আমাদের সকল অভাবই পূর্ণ করেছিল আমাদের ছেলেবেলাতে।
এখানে সকলের চেয়ে আমার ভাল লেগেচে বৌদিকে। আমি বৌদিদির ধরনের মেয়ে কখনও দেখি নি। যা তা জিনিস দিয়ে বৌদিকে খুশী করা যায়, যে-কোন ব্যাপার যত অসম্ভবই হোক না কেন–বৌদিদিকে বিশ্বাস করানো যায়, খুব অল্পেই ভয় দেখানো যায়–ঠকিয়ে কোন জিনিস বৌদিদির কাছ থেকে আদায় করা মোটেই কঠিন নয়। অথচ একটি সহজাত বুদ্ধির সাহায্যে বৌদিদি ঘরকন্না ও সংসার সম্বন্ধে দাদার চেয়েও ভাল বোঝে, বড় কিছু একটা আশা কখনও করে না, ভারি গোছালো, নিজের ধরনে। ঠাকুরদেবতার ওপর ভক্তিমতী। কেবল একটা দোষ আমার চোখে বড় লাগে–নিজে যে সব কুসংস্কার মানে, অপরকে সেই সব মানতে বাধ্য করবে। অনেক ব্যাপারে দেখলাম ভাবটা এইরকম, আমার সংসারে যতক্ষণ আছ ততক্ষণ তোমায় মানতেই হবে, তার পর বাইরে গিয়ে হয় মেনো না-হয় না-মেনো,–কড়া কথা বলে নয়, মিনতি অনুরোধ করে মানাবে। কড়া কথা বলতে বৌদিদি জানে না–টকের ঝাঁজ নেই কোথাও বৌদিদির স্বভাবে, সবটাই মিষ্টি।
সপ্তাহ দুই পরে ওদের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসবার সময় দাদা বললে–শোন জিতু, আটঘরার বাড়ি সম্বন্ধে কি করা যাবে, তুই একটা মত দিস। ছোটকাকীমা ঠিকই বলেচেন–ও বাড়ি আমরা ছাড়বো না। আর একটা কথা শোন, একটা চাকরি দেখে নে, এরকম করে বেড়াস নে। তোর বৌদিদি বলছিল এই বছরই তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিতে। তার পর দু-ভায়ে ঘরবাড়ি করি আয়, দুজনে মিলে টাকা আনলে ভাবনা কিসের সংসার চালাবার? সংসারটা বেশ গড়ে তুলতে পারবো এখন। আর দ্যাখ, পয়সা রোজগার করতে না পারলে, ঘরবাড়ি না থাকলে কি কেউ মানে? নিজের বাড়ি কোথাও একখানা থাকা চাই, নইলে লোকে বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
দাদার শুধু সংসার আর সংসার। আর লোকে আমার সম্বন্ধে কি ভাবলে না-ভাবলে তাতেই বা আমার কি? লেখাপড়া শিখলে না, কিছু না, দাদা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। লোকে কি বলবে সেই ভাবনাতেই আকুল। দাদার ওই সব ছাপোষা গেরস্তালী-ধরনের কথাবার্তায় আমার হাসি পায়, দাদার ওপর কেমন একটা মায়াও হয়।
ভাবলুম, কোথায় যাওয়া যায়? কলকাতায় গিয়ে একটা চাকুরি দেখে নেবো? দাদা যদি তাতেই সুখী হয়, তাই না-হয় করা যাক। আমি নিজে বিয়ে করি আর না-করি, ওদের সংসারে কিছু সাহায্য করা তো যাবে! নৈহাটির কাছে অনেক পাটের কল আছে, কলকাতা গিয়ে সেখানে গেলে কেমন হয়? পাটের কলে শুনেচি চাকুরি জোটানো সহজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই এলাম। মাস দুই কাটল, একটা মেসে থাকি আর নানা জায়গায় চাকুরির চেষ্টা করি। কোন জায়গাতেই কিছু সুবিধে হয় না।
একদিন রবিবারে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে বেড়াতে বেড়াতে অনেক দূর চলে গেছি, দমদমও প্রায় ছাড়িয়েচি, হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি এল। দৌড়ে একটা বাগানবাড়ির ঘরে আশ্রয় নিলাম। ঘরটাতে বোধ হ’ল বহুদিন কেউ বাস করে নি, ছাদ ভাঙা, মেজের সিমেন্ট উঠে গিয়েছে। বাগানটাতেও জঙ্গল হয়ে গিয়েছে।
একটা লোক সেই ভাঙা ঘরের বারান্দাটাতে শুয়ে ছিল, বোধহয় ক’দিন থেকে সেখানে সে বাস করচে, একটা দড়ির আলনায় তার কাপড়-চোপড় টাঙানো। আমায় দেখে লোকটা উঠে বসল–এসো, বসো বাবা। বেশ ভিজেচ দেখচি বৃষ্টিতে! বসো।
লোকটার বয়স পঞ্চাশের ওপর, পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, দাড়ি-গোঁফ কামানো। আমায় জিজ্ঞেস করলে–তোমার নাম কি বাবা? বাড়ি এই কাছাকাছি বুঝি?
নাম বললাম, সংক্ষেপে পরিচয় দিলাম।
বললে–বাবা, ভগবান তোমায় এখানে পাঠিয়েচেন আজ। তুমি বসো, তুমি আমার অতিথি। একটু মিষ্টি খেয়ে জল খাও–
আমি খেতে না চাইলেও লোকটা পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তারপর কথা বলতে বলতে হঠাৎ ডান হাতটা শূন্যে একবার নেড়েই হাত পেতে বললে–এই নাও—
হাতে একটা সন্দেশ …
আমি ওর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে বললে–আর একটা খাবে? এই নাও।
হাত যখন ওঠালে, আমি তখন ভাল করে চেয়েছিলাম, হাতে কিছু ছিল না। শূন্যে হাতখানা বার দুই নেড়ে আমার সামনে যখন পাতলে তখন হাতে আর একটা সন্দেশ। অদ্ভুত ক্ষমতা তো লোকটার! আমার অত্যন্ত কৌতূহল হ’ল, বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল কিন্তু আমি আর নড়লাম না সেখান থেকে।
লোকটা অনেক গল্প করলে। বললে–আমি গুরুর দর্শন পাই কাশীতে। সে অনেক কথা বাবা। তোমার কাছে বলতে কি আমি বাঘ হতে পারি, কুমীর হ’তে পারি। মন্ত্রপড়া জল রেখে দেবো, তারপর আমার গায়ে ছিটিয়ে দিলে বাঘ কি কুমীর হয়ে যাব–আর একটা পাত্রে জল থাকবে, সেটা ছিটিয়ে দিলে আবার মানুষ হবো। সাতক্ষীরেতে করে দেখিয়েছিলাম, হাকিম উকিল মোক্তার সব উপস্থিত সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতে পার সত্যি না মিথ্যে। আমার নাম চৌধুরী-ঠাকুর–গিয়ে নাম করো।
আমি অবাক হয়ে চৌধুরী-ঠাকুরের কথা শুনছিলাম। এসব কথা আমার অবিশ্বাস হত যদি না এইমাত্র ওকে খালি-হাতে সন্দেশ আনতে দেখতুম। জিজ্ঞেস করলাম–আপনি এখন কি কলকাতায় যাচ্ছেন?
–না বাবা, মুর্শিদাবাদ জেলায় একটা গাঁয়ে একটা চাঁড়ালের মেয়ে আছে, তার অদ্ভুত সব ক্ষমতা। খাগড়াঘাট থেকে কোশ-দুই তফাতে। তার সঙ্গে দেখা করবো বলে বেরিয়েচি।
আমি চাকরি-বাকরি খুঁজে নেওয়ার কথা সব ভুলে গেলাম। বললাম–আমায় নিয়ে যাবেন? অবিশ্যি যদি আপনার কোন অসুবিধা না হয়।
চৌধুরী-ঠাকুর কি সহজে রাজী হন, অতি কষ্টে মত করালুম। তারপর মেসে ফিরে জিনিসপত্র নিয়ে এলাম। চৌধুরী-ঠাকুর বললেন–এক কাজ করা যাক এস বাবা। আমার হাতে রেলভাড়ার টাকা নেই, এস হাঁটা যাক।
আমি বললাম–তা কেন? আমার কাছে টাকা আছে, দু’জনের রেলভাড়া হয়ে যাবে।
চাঁড়াল মেয়েটির কি ক্ষমতা আছে দেখবার আগ্রহে আমি অধীর হয়ে উঠেচি।
খাগড়াঘাট স্টেশনে পৌঁছতে বেলা গেল। স্টেশন থেকে এক মাইল দূরে একটা ছোট মুদির দোকান। সেখানে যখন পৌঁছেচি, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ প্রায়। দোকানের সামনে বটতলায় আমি আশ্রয় নিলাম। রাত্রে শোবার সময় চৌধুরী-ঠাকুর বললেন, আমার এই দুটো টাকা রেখে দাও গে তোমার কাছে। আজকাল আবার হয়েচে চোর-ছেঁচড়ের উৎপাত। তোমার নিজের টাকা সাবধানে রেখেচ তো?
চৌধুরী-ঠাকুরের ভয় দেখে আমার কৌতুক হ’ল। পাড়াগাঁয়ের মানুষ তো হাজার হোক, পথে বেরুলেই ভয়ে অস্থির। বললাম–কোন ভয় নেই, দিন আমাকে। এই দেখুন ঘড়ির পকেটে আমার টাকা রেখেচি, বাইরে থেকে বোঝাও যাবে না, এখানে রাখা সবচেয়ে সেফ–
সকালে একটু বেলায় ঘুম ভাঙল। উঠে দেখি চৌধুরী-ঠাকুর নেই, ঘড়ির পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার টাকাও নেই, চৌধুরী-ঠাকুরের গচ্ছিত দুটো টাকাও নেই, নীচের পকেটে পাঁচ-ছ আনার খুচরো পয়সা ছিল তাও নেই।
মানুষকে বিশ্বাস করাও দেখচি বিষম মুশকিল। ঘণ্টাখানেক কাটল, আমি সেই বটতলাতে বসেই আছি। হাতে নেই একটি পয়সা, আচ্ছা বিপদে তো ফেলে গেল লোকটা! মুদিটি আমার অবস্থাটা দেখে শুনে বললে–আমি চাল ডাল দিচ্ছি, আপনি রেঁধে খান বাবু। ভদ্রলোকের ছেলে, এমন জুয়াচোরের পাল্লায় পড়লেন কি করে? দামের জন্যে ভাববেন না, হাতে হ’লে পাঠিয়ে দেবেন। মানুষ দেখলে চিনতে দেরি হয় না, আপনি যা দরকার নিন এখান থেকে। ভাগ্যিস আপনার সুটকেসটা নিয়ে যায়নি।
দুপুরের পরে সেখান থেকে রওনা হয়ে পশ্চিম মুখে চললাম। আমার সুটকেসে একটা ভাল টর্চলাইট ছিল, মুদিকে ওর চাল-ডালের বদলে দিতে গেলাম, কিছুতেই নিলে না।
পথ হাঁটি, একেবরে নিঃসম্বল অবস্থা। সন্ধ্যার কিছু আগে একটা বড় পাকুড়গাছের তলায় পথের ধারে জনকয়েক লোক দেখে সেখানে গেলাম। চারজন পুরুষমানুষ ও একটি ত্রিশ-বত্রিশ বছরের স্ত্রীলোক–তারা গাছতলায় উনুন জ্বেলে রাঁধবার উদ্যোগ করছে।
একজন বললে–কনে থেকে আসছেন বাবু?
—খাগড়াঘাট থেকে–তোমরা আসচ কোথা থেকে?
—আমরা আসতেছি তো বড় দূর থেকে। যাব কেঁদুলির মেলায়।
একজন তামাক সেজে নিয়ে এসে বললে–তামাক ইচ্ছে করুন বাবু। ও জুড়ন, বাবুকে বসবার কিছু দে।
–আমি তামাক খাইনে, তোমরা খাও। তোমরা দেশ থেকে বেরিয়েচ কতদিন?
জুড়ন বৈরাগী এগিয়ে এসে সঙ্গীর হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে বসলে–বাবু বড় কষ্ট, আর পুন্নিমেতে বাড়ির বার হওয়া হয়েচে। রাস্তায় কি অনাবিষ্টি! তিনদিন ধরে আর থামে না, জিনিসপত্তর ভিজে একশা, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট কোশ এখান থেকে–নওদা, চেনেন? সেই নওদার সন্নিপত্য আমাদের বাড়ি, হাতীবাঁধা গ্রাম, যশোর জেলা।
গল্পগুজবে আধঘণ্টা কাটলো। জুড়ন বললে–দাদাঠাকুরের খাওয়াদাওয়ার কি হবে? এক কাজ করুন দাদাঠাকুর, আমাদের সঙ্গে সবই আছে, রসুই করুন, আমরা পেরসাদ পাব এখন। ব্রাহ্মণের পাতের অন্ন কতকাল খাই নি। ও কাপাসীর মা, পুকুর থেকে জল নিয়ে এস, আর রাত কোরো না।
আমি বিশেষ কোন আপত্তি করলাম না। এদের সঙ্গ আমার বড় ভাল লাগছিল, ওই রাত্রে তা ছাড়া যাবই বা কোথায়? রান্না চড়িয়ে দিলাম। কাপাসীর মা আলু বেগুন ছাড়াতে বসলো। ওদের মধ্যে একজনের নাম বাবুরাম–সে পুকুরে চাল ধুতে গেল। জুড়ন শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনতে গেল।
পথের ধারে এই দরিদ্র, সরল মানুষগুলির সঙ্গে গাছতলায় রাত্রিযাপন, জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা। রাতটিও বেশ, কি রকম সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। নির্জন মাঠে জ্যোৎস্নায় অনেক দূর দেখা যাচ্ছে।
এই জ্যোৎস্নারাতে আমার কেবল মনে হয় আমি আর সে সব জিনিস দেখি নে। কতদিন দেখি নি। যখন চিনতে শিখি নি, তখন রোগ ভেবে যাকে ভয় করেছি কত, এখন তা হারিয়ে বুঝেছি কি অমূল্য সম্পদ ছিল তা জীবনের। বোধ হয় মাঠের ধারের এই সবুজ দূর্বাঘাসের শয্যায় শুয়ে চোখ বুজে ভাবলে আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাই–এই সব বিজন মাঠে শেষ প্রহরের জ্যোৎস্নাভরা রাত্রে মুখ উঁচু করে চেয়ে থাকলে অনন্তপথের যাত্রীদের দেখা যায়…ওপর আকাশের জ্যোৎস্নাভরা বায়ুস্তর তাদের গমন পথে-পথ। দেহগন্ধে সুরভিত হয়। পরের দুঃখে কোনো দয়ালু আত্মা যে চোখের জল ফেলে, নদী সমুদ্রে ঝিনুকের মধ্যে পড়লে তা মুক্তা হয়, বিল-বাঁওড়ের পদ্মফুলে পড়লে পদ্মমধু সৃষ্টি করে…আমার নিবে-যাওয়া দৃষ্টি-প্রদীপে আলো জ্বেলে দিতে যদি কেউ পারে তো সে ওরাই পারবে।
সীতার কথা মনে হয়। আচ্ছা, এই রাত্রে এতক্ষণ সে কি করছে? যে জীবনের মধ্যে সে আছে, সে জীবনের জন্যে সে তৈরী হয় নি। হয়ত রান্নাঘরে বসে এতক্ষণে এইরকম রাঁধচে, ও অত বই পড়তে ভালবাসে, তাদের ঘরে একখানাও বই নেই, বই পড়া হয়ত সেখানে ঘোর অপরাধ–যেমন ছিল জ্যাঠাইমার কাছে। জীবনের যে-কোনো আনন্দভরা অভিজ্ঞতার সময়েই সীতার ব্যর্থ জীবনের কথা আমার মনে না এসে পারে না।
সবাই মিলে খেতে বসলাম। রান্না হ’ল বড়ির ঝোল, আলুভাতে, পটলভাজা। কাপাসীর মা অবিশ্যি দেখিয়ে দিল। কাল ঠিক এই সময়ে খাগড়াঘাটের পথে বটতলায় চৌধুরী-ঠাকুর ভজন গাইচে। কি খারাপ লোকটা! টাকার দরকার ছিল, আমায় বললে তো আমি দিতামই। চুরি করে কি হ’ল!
জুড়ন বৈরাগী খাওয়া-দাওয়ার পরে গল্প করতে লাগল। বললে–শুনুন দাদাঠাকুর, এই যে কাপাসীর মা দেখচেন, এর বাবা অনেক টাকা জমিয়ে মারা গিয়েছিল। খেতো না, শুধু টাকা জমাতো। মরবার সময় ভাইকে বললে, অমুক জায়গায় মালসায় টাকা পোঁতা আছে, নিয়ে এসে আমায় দেখা। তা এই পানচালার কোণে ভাঙা উনুনের মধ্যি মালসা পোঁতা ছিল–কেউ জানতো না। মরবার সময় তাই টাকার মালসা সামনে নিয়ে খোলে। টাকা দেখতি দেখতি মরে গেল।
–সে টাকা কে পেলে তার পর?
–তারপর বুড়ো তো মরে গেল। তার ভাই রটালে মালসাসুদ্ধ টাকা সেই রাতি গোলমালে চুরি হয়েছে। এমন কি টাকার অভাবে বুড়োর ছেরাদ্দটাও হ’ল না। পেটের ওপর বাণিজ্য করে টাকা জমিয়ে গেল, নিজের ভোগে তো লাগলোই না–একটিমাত্র মেয়ে। এই কাপাসীর মা, তার ভোগেও হ’ল না। টাকার মালসা রাতারাতি কে যে কোথায় সরিয়ে ফেললে–
কাপাসীর মা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল–হ্যাঁগো হ্যাঁ। সরিয়ে ফেলতে এসেছিল পাড়ার লোক! যে নেবার সে নিয়েছে। আমি কি আর কিছু জানি নে, না বুঝি নে? ধম্ম আছেন মাথার ওপর–তিনি দেখবেন। ছ-মাসের মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়ে লোকের দোর দোর ঘূরিচি দুটো ভাতের জন্যি–আমায় যিনি বাপের ধনে–
বাবুরাম বললে–আর শাপমন্নি করো না বাপু। তোমার অদেষ্টে থাকত, পেতে। বাদ দেও ওসব কথা। উনুনে আগুন আছে কিনা দেখো তো, আর একবার কলকেটা ধরাই।
ওদের মধ্যে আর একজন বললে–ও জুড়নখুড়ো, স্বরূপগঞ্জের বাজারে কাল দুপুরের আগে পৌঁছানো যাবে না?
–দুটোর কম হবে না। ছ’ডী কোশ, তার আগে খাওয়া-দাওয়া করে নেওয়া যাবে।
বাবুরাম বললে–এবার কেঁদুলির মেলায় লোক যাচ্ছে কই তেমন জুড়নখুড়ো? …সে বছর দেখেছিলে তো? পথে সারারাতই লোক হাঁটতো।
অদ্ভুত লাগছিল এ রাতটি আমার কাছে। এত কথাও মনে এনে দেয়! ঘুম আর আসে না। ভাবছিলাম মানুষ এত অল্পেও সুখী হয়? আর সুখ জিনিসটা কি অনির্দেশ্য রহস্যময় ব্যাপার–এই নির্জন রাত্রে মুক্ত অপরিচিত প্রান্তরের মধ্যে তারাখচিত আকাশের নীচে শুয়ে সবাই সুখের স্বপ্ন দেখছে–কিন্তু একজনের সুখের ধারণার সঙ্গে অন্য আর একজনের ধারণার কি বিষম পার্থক্য!
সকালে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পশ্চিম মুখে হাঁটি। রাঢ় দেশের বড় বড় মাঠের ওপর দিয়ে। রাঙা বালি, দিগন্তে তালবনের সারি। হয়ত মাঠের মাঝে প্রাচীন কালের প্রকাণ্ড দীঘি, তালবনে ঘেরা কি ফাঁকা জায়গা এ-সব! মনে হত যেন সীমাহারা দিকসমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে চলেছি, কোন অজ্ঞাত দিগন্তের বননীল উপকূলে গিয়ে ভিড়বো, কোনখানে তমালতরুনিরে বনভূমি শ্যামায়মান, সেখানে গন্ধভরা অন্ধকার বীথিপথ বেয়ে অভিসারিকারা চিরদিন পা টিপে টিপে হাঁটে বৃন্দাবনের দিন ফুরিয়ে গেল, মহাভারতের যুগ কেটে গেল, যমুনার তটে কেলিকদম্বের ছায়া কালের অন্ধকারে লুকিয়েছে, তবুও ওদের ও যাওয়ার শেষ হবে না, আমারও না।
মাঠের পথের প্রথমটায় কেঁদুলি মেলার লোকজনের সঙ্গে দেখা হত। পরে আর তেমন লোক দেখি নি, এত বড় মাঠের মধ্যে অনেক সময় আমি একাই পথিক। এই ধু ধু সীমাহীন প্রান্তরে সূর্যাস্তের কি মূর্তি! আমাদের অঞ্চলে কোনোদিন তা দেখি নি। অন্ধকার হলে মাঠের মধ্যেই কতদিন রাত কাটিয়েছি। ছেলেবেলায় চা-বাগানে কাটিয়ে এই শিক্ষা পেয়েছিলাম, রাত্রিতে যে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে, একথা মনেই ওঠে না। শীতের দেশ নয়, ঘন হিমারণ্যের হিংস্র শ্বাপদ নেই এখানে–নিতান্ত নিরীহ, নিরাপদ দেশ–এখানে নক্ষত্রভরা মুক্ত আকাশের চাঁদোয়ার তলায় মাটির ওপর যা-হয় একটা কিছু পেতে রাত কাটানোর মত আনন্দ খাট-পালঙ্কে শুয়ে পাইনি।
একদিন এই অবস্থায় একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হ’ল। একটা অপূর্ব নাম-না-জানা অনুভূতির অভিজ্ঞতা। মুখে সে কথা বলা যায় না, বোঝানো যায় না, শুধু সেই-ই বোঝে যার এ রকম হয়েছে।
সকালে বামুনহাটি বলে একটা গ্রামে এক গ্রাম্য হাতুড়ে কবিরাজের অতিথি হয়েছিলুম। সেদিন তাঁর স্ত্রী একটি রণচণ্ডী–যতক্ষণ সেখানে ছিলাম, তাঁর গালবাদ্যের বিরাম ছিল না। আমি গিয়ে সবে বসেছি, তিনি দোরের আড়াল থেকে স্বামীর উদ্দেশে আরম্ভ করলেনও–অলপ্পেয়ে মিনসে, আমার সঙ্গে তোমার এত শত্তুরতা কিসের বল দিকি? রান্নাঘরের রোয়াকে চালা তুলতে তোমায় বলেছে কে? গরমে একে ঘরের মধ্যে টেঁকা যায় না উনুন জ্বললে, যাও বা একটু হাওয়া আসতো, চালা তুললেও হাওয়া আসবে তো ও ড্যাকরা? ওই অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে তোমার পিণ্ডি রাঁধবো খেও।
স্ত্রী চলে গেলে কবিরাজ-মশায় বললেন–আর বলেন কেন মশাই, হাড় ভাজা-ভাজা হয়ে গেল। শুনলেন তো দাঁতের বাদ্যি–ওই রকম সদাসর্বদা চলছে। আর ঘোর শুচিবাই, দুনিয়ার জিনিস সব অশুদ্ধ। দিনের মধ্যে সাতবার নাইছে, নিমুনিয়া হয়ে যদি না মরে তবে কি বলেছি। আজ এক বছর ধরে এই গোয়ালের একপাশে তক্তপোশ পেতে শোয় আলাদা–ঘরের জিনিস সব অশুদ্ধ যে, সেখানে কি শোয়া যায়? ওরকম ছিল না মশায়, ছেলেটা মরে গিয়ে অবদি ওই রকম–
তারপর যেকথা বলছিলাম! বামুনহাটি থেকে বিকেলে বার হয়ে ক্রোশতিনেক যেতে না-যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাঠের মধ্যে একটা ছোট নদী, রাস্তা থেকে একটু দূরে। নদী এত ছোট যে তাকে আমাদের দেশ হ’লে বলতো খাল। দু-পাড়ে রাঙা কাঁকর বিছানো, ধারে ধারে কাঁটাঝোপ আর তালগাছ। সেখানে রাত্রি যাপন করবো বলে মাটির ওপর ছোট শতরঞ্চিখানা পেতে তার ওপরে বসলাম। কোনদিকে জনপ্রাণী নেই।
খালের ওপারে একটা তালগাছের মাথায় শুকনো পাতা হাওয়ায় খড় খড় শব্দ করছে–এই অন্ধকার প্রদোষে তালগাছের মাথার ওপরকার আকাশে নিঃসঙ্গ একটি তারা–আমি একবার তারাটির দিকে চাইছি, একবার চারিদিকের নিস্তব্ধ, পাতলা অন্ধকারের দিকে চাইছি। হঠাৎ আমার মনে কেমন একটা আনন্দ হ’ল। সে আনন্দ এত অদ্ভুত যে বেদনা থেকে তা বেশী পৃথক নয়, সে পুলক চোখে জল এনে দিল, মনে কেমন একটা অনির্দেশ্য অভাবের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে যেন।
কিছুক্ষণ আগেও যে-জগতে ছিলাম, এ যেন সে-জগৎ নয়!
এ জগৎ যুগযুগের তুচ্ছ জনকোলাহল কত গভীর মাটির স্তরের নীচে চাপা পড়ে যাওয়ার জগৎ। ফুল ফুটে নির্জনে ঝরে পড়ার জগৎ…অজানা কত বনপ্রান্তরে কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থের জগৎ…কত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া..কত আশার হাসি মিলিয়ে যাওয়া…
শুধু নির্জনে চূতবীথির তালীবনরেখার মাথার ওপর শ্যামলতার পাড়টানা সীমাহীন নীল শূন্যে বহুদূরের কোন ক্ষীণরশ্মি নক্ষত্রের সঙ্গে এ জগৎ এক..শতাব্দীতে শতাব্দীতে কত লক্ষ মনের আনন্দ, আশা, গর্ব, হাসি, দৃষ্টি-ক্ষমতার বাহাদুরি কোথায় মুছিয়ে নিয়ে ফেলে দেয়, ক্ষীণ দুর্বল হাত প্রিয়কে নির্মম জীবনের গ্রাস থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে না, না বুঝে হাসে, খুশী হয়, আশার স্বপ্নজাল বোনে…
অন্ধকারে কোন খনিগর্ভে চুনপাথর হয়ে যায় তাদের হাড়…
আবার নবীন বুকে নবীন আনন্দ জেগে ওঠে। আবার হাসি, আবার খুশী হওয়া, আবার আশার স্বপ্ন-জাল বোনা…অথচ সব সময় তাদের মাথার ওপর দিয়ে অনন্ত কালের প্রবাহ ছুটে চলে, পুরোনো পাতা ঝরে পড়ে, নতুন গান পুরোনো হয়ে যায়। গ্রহে গ্রহে, নক্ষত্রে নক্ষত্রে কত দৃশ্য-অদৃশ্য লোকে, কত অজানা জীবজগতেও এরকম বেদনা, দীনতা, দুঃখ। দূরের সে-সব অজানালোকে ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদী দীর্ঘ বটগাছের ছায়ায় বয়ে যায়, তাদের শান্ত বন-বীথির মূলে প্রিয়জনের, বহুদিন-হারা প্রিয়জনের কথা ভাবে–নদীর স্রোতে শেওলা-দাম-ভাসা জলে অনন্তের স্বপ্ন দেখে..যে অনন্ত তার চারধারে ঘিরে আছে সব সময়, তার নিঃশ্বাসে, তার বুকের অদম্য প্রাণস্রোতে, তার মনের খুশীতে, নাক্ষত্রিক শূন্যপারের মিটমিটে তারার আলোয়। দূরের ওই দিগ্বলয় যেখানে চুপি চুপি পৃথিবীর পানে মুখ নামিয়ে কথা কইছে, শূন্যপথে অদৃশ্য চরণে দেবদেবীরা যেন এই সন্ধ্যায় ওখানে নেমে আসেন। যখন নদীজল শেষরৌদ্রে চিক চিক করে, কূলে কূলে অন্ধকার ফিরে আসে, পানকলস শেওলার ফুল কালো জলে সন্ধ্যার ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়–তখনই। আমার মনে সব ওলট-পালট হয়ে গেল, এমন এক দেবতার ছায়া মনে নামে-যেন জ্যাঠাইমাদের শালগ্রামশিলার চেয়ে বড়, আটঘরার বটতলার সেই পাথরের প্রাচীন মূর্তিটির চেয়ে বড়, মহাপুরুষ খ্রীষ্ট্রের চেয়েও বড়––চালরেখায় দূরের স্বপ্নরূপে সেই দেবতারই ছায়া, এই বিশাল প্রান্তরে স্নান সন্ধ্যার রূপে মাথার ওপর উড়ে যাওয়া। বালিহাঁসের সাঁই সাঁই পাখীর ডাকে…সেই দেবতা আমায় পথ দেখিয়ে দিন। আমি যা হারিয়েছি তা আর চাই নে, আমি চাই আজকার সন্ধ্যার মত আনন্দ, এবং যে নতুন দৃষ্টিতে এই এক মুহূর্তের জন্যে জগৎটাকে দেখেছি সে দৃষ্টি হারিয়ে যাবে জানি, সে আনন্দ জীবনে অক্ষয় হবে না জানি–কিন্তু আর একবারও যেন অন্তত তারা আসে আমার জীবনে।
.
১১.
পরদিন দুপুরে সন্ধান মিলল ক্রোশ-চারেক দূরে দ্বারবাসিনী গ্রামে একটি প্রসিদ্ধ আখড়াবাড়ি আছে, সেখানে মাঝে মাঝে ভাল ভাল বৈষ্ণব সাধু আসেন। গাঁয়ের বাইরে আখড়াবাড়ি, সেখানে থাকবার জায়গাও মেলে।
সন্ধ্যার সামান্য আগে দ্বারবাসিনীর আখড়াবাড়িতে পৌঁছলাম। গ্রামের প্রান্তে একটা পুকুরের ধারে অনেকগুলো পাছপালা-ছায়াশূন্য, কাঁকরভরা, ঊষর ধু-ধু মাঠের মধ্যে এক জায়গায় টলটলে স্বচ্ছ জলে ভরা পুকুর। পুকুরপাড়ে বকুল, বেল, অশোক, তমাল, নিমগাছের ছায়াভরা ঘনকুঞ্জ, দু-চারটে পাখীর সান্ধ্যকাকলি–মরুর বুকে শ্যামল মরুদ্বীপের মত মনে হ’ল। এ-অঞ্চলে এর নাম লোচনদাসের আখড়া। আমি যেতেই একজন প্রৌঢ় বৈষ্ণব, গলায় তুলসীর মালা, পরনে মোটা তসরের বহির্বাস, উঠে এসে জিজ্ঞেস করলে,–কোত্থেকে আসা হচ্চে বাবুর? তারপর তালপাতার ছোট চাটাই পেতে দিলে বসতে, হাত-মুখ ধোয়ার জল নিজেই এনে দিলে। গোলমত উঠোনের চারিধারে রাঙা মাটির দেওয়াল-তোলা ঘর, সব ঘরের দাওয়াতেই দুটি-তিনটি বৈষ্ণব, খুব সম্ভবত আমার মতই পথিক, রাত্রের জন্য আশ্রয় নিয়েছে।
সন্ধ্যার পরে আমি তালপাতার চাটাইয়ে বসে একটি বৃদ্ধ বৈষ্ণবের একতারা বাজনা ও গান শুনচি–এমন সময় একটি মেয়ে আমার সামনে উঠোনে এসে জিজ্ঞেস করলে– আপনি রাত্তিরে কি খাবেন–?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম–আমায় বলছেন?
মেয়েটি শান্ত সুরে বললে–হ্যাঁ। রাত্তিরে কি ভাত খান?
আমি থতমত খেয়ে বললাম–যা হয়, ভাতই খাবো। আপনাদের যাতে সুবিধে।
মেয়েটি বললে–আমাদের সুবিধে নিয়ে নয়–এখানে আপনার যা ইচ্ছে হবে খেতে তাই বলবেন। চা খান কি আপনি?
এ পর্যন্ত কোন জায়গায় এমন কথা শুনি নি, কোন মন্দিরে বা বৈষ্ণবের আখড়াতেই নয়। ডেকে কেউ জিজ্ঞেস করে নি আমি কি খেতে চাই। বললাম–চা খাওয়া অভ্যেস আছে, তবে সুবিধে না হ’লে–
মেয়েটি আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই চলে গেল এবং মিনিট কুড়ি পরে এক পেয়ালা চা নিয়ে এসে নিঃসঙ্কোচে আমার হাতে দিলে। বললে–চিনি ঠিক হয়েছে কিনা দেখুন।
আবার তাকে দেখলাম রাত্রে খাবার সময়ে। লম্বা দাওয়ায় সারি দিয়ে সাত-আটজন লোক খেতে বসেছে, মেয়েটি নিজের হাতে সবাইকে পরিবেশন করলে। প্ৰকাণ্ড বড় ভাতের ডেকচি নিজে দু-হাতে ধরে নিয়ে এসে আমাদের সামনে রাখলে–তা থেকে থালা করে ভাত নিয়ে সকলকে দিতে লাগল। আমার পাশের লোকটিকে বললে–ও কি শ্যামা কাকা, নাউয়ের ঘণ্ট দিয়ে আর দুটো খান। ওবেলা তো খাওয়াই হয় নি!
সে সম্ভ্রমে বললে–না দিদিঠাকরুন, আমাকে বলতে হবে না আপনার। পেটে জায়গা নেই। তেঁতুল মেখে বরং দুটো খাবো–
–হ্যাঁ কাসছেন, তেঁতুল না খেলে চলবে কেন? দুধ দিচ্ছি–
তারপর আমার সামনে এসে বললে–আপনার বোধ হয় ওবেলা খাওয়াই হয় নি? আপনাকেও দুধ দিচ্ছি।
এতগুলো লোক খেতে বসেছে, দুধ দেওয়া হ’ল মোটে তিনজনকে–কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনবিশেষে এবং তার বিচারকর্ত্রী ওই মেয়েটিই। আমার কৌতুক হ’ল ভারি।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম চমৎকার মেয়েটি ত! দেখতে সুশ্রী বটে, তবে খুব সুন্দরী নয়। কিন্তু আমি ওরকম মুখের গড়ন কখনও দেখি নি, প্রথমে সন্ধ্যাবেলায় ওকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল একথা। বার বার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়–সে ওর সুন্দর ডাগর চোখ দুটির জন্যে, না ওর মুখের একটি বিশিষ্ট ধরনের লাবণ্যময় গড়নের জন্যে, রাত্রে তা ভাল বুঝতে পারি নি। মেয়েটি কে? নিতান্ত ছেলেমানুষ তো নয়–সারাদেহে যৌবনশ্রী ফুটে উঠেছে পরিপূর্ণ ভাবেই–এখানে ওভাবে থাকে কেন? আখড়ার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক? নানা প্রশ্ন মনে উঠে ঘুম আর আসে না।
পরদিন সকালে মেয়েটির সঙ্গে অনেকবার দেখা হ’ল। অতিথিদের কারও অযত্ন না হয় সেদিকে দেখলাম ওর বেশ দৃষ্টি আছে। এ অঞ্চলে চালে কাঁকর ব’লে সে নিজে সকালে কুলো নিয়ে বসে প্রায় আধমণ চাল ঝাড়লে। বেলা ন’টার সময় হঠাৎ এসে আমায় বললে–আপনার ময়লা জামা-কাপড় যদি পুঁটলিতে থাকে ত দিন, কেচে দেবো। আপনার গায়ের জামাটাও ময়লা হয়ে গিয়েছে, খুলে দিন। খুব রোদ, দুপুরের মধ্যে শুকিয়ে যাবে।
আমি প্রথমটা একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলাম। তার পর দেখলাম সে সকলকেই জিজ্ঞেস করছে তারও ময়লা কাপড়-চোপড় কিছু আছে কিনা। একজন বৃদ্ধ বাউলের গেরুয়া আলখাল্লা ময়লা হয়েছিল বলে খুলিয়ে নিয়ে গেল। পরে শুনলাম মেয়েটি ওরকম প্রায়ই করে, আখড়াতে ময়লা-কাপড়ে থাকবার জো নেই।
এখানে দিন দুই কাটবার পরে আর একটা জিনিস আমার বিশেষ করে চোখ পড়ল যে, মেয়েটির মধ্যে কোন মিথ্যে সঙ্কোচ নেই, সহজ সিধে ব্যবহার, কি কাজে, কি কথাবার্তায়। সজীব ও দীপ্তিময়ী, যেন সঞ্চারিণী দীপশিখা, যদি শ্যামাঙ্গী মেয়েকে দীপশিখার সঙ্গে তুলনা করা যায়। তৃতীয় দিন বিকেলে এসে বললে-পুকুরপাড়ের বাগান দেখেছেন? আসুন দেখিয়ে নিয়ে আসি।
এই কথাটা আমার বড় ভাল লাগল–এ পর্যন্ত আমি কোন মেয়ে দেখিনি যে বাগান ভালবাসে, দেখাবার জিনিস ব’লে মনে করে।
ওর সঙ্গে গেলাম। অনেক গাছ আমাকে সে চিনিয়ে দিলে। কাঞ্চন ফুলের গাছ এই প্রথম চিনলাম। এক কোণে একটা বড় তমাল গাছের তলায় ইটের একটা তুলসীমঞ্চ ও বেদী দেখিয়ে বললে–বাবা এখানে বসে জপ করতেন।
জিজ্ঞেস করলাম–আপনার বাবা এখন কোথায়?
মেয়েটি কেমন যেন একটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললে–বাবা তো নেই, এই চার বছর হ’ল মারা গিয়েছেন। এই যে পুকুরটা, বাবা কাটিয়েছিলেন, আর এই বকুলগাছের ওপাশে বিষ্ণুমন্দির তুলছিলেন, শেষ করে যেতে পারেন নি।
এই কথায় সূত্র খুঁজে পেলাম ওর সম্পূর্ণ পরিচয় জিজ্ঞেস করবার। এ দু-দিন কাউকে ওর সম্বন্ধে কোন কথা বলি নি, পাছে কেউ কিছু মনে করে। কৌতূহলের সঙ্গে বললাম– আপনার বাবার নামেই বুঝি এই আখড়া?
–কি, লোচনদাসের আখড়া? তা নয়, আমরা ব্রাহ্মণ, আমার বাবার নাম ছিল কাশীশ্বর মুখুয্যে। লোচনদাস এই আখড়া বসান, কিন্তু মরবার সময়ে বাবার হাতে এর ভার দিয়ে যান। তারপর বাবা আট-ন’ বছর আখড়া চালান। আখড়ার নামে যত ধানের জমি, সব বাবার। আসুন, বিষ্ণুমন্দির দেখবেন না?
মনে ভাবি বিষ্ণুমন্দির তুচ্ছ, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত আমি সঙ্গে যেতে রাজী আছি। পুকুরপাড়ের একটা বকুলগাছের পাশে একটা আধ-তৈরি ইটের ঘর। মেয়েটি বললে– গাঁথা শেষ হয় নি তো, হঠাৎ বাবা–তাইতে আদ্দেক হয়ে আছে। কাঁচা গাঁথুনি, আর বছরের বর্ষায় ওদিকের দেওয়ালের খানিকটা আবার ভেঙে পড়ে গিয়েছে।
বকুলগাছে কি লতা উঠেচে, দেখিয়ে বললাম–বেশ ফুল ফুটেছে তো, কি লতা এটা?
ও বললে–মালতী লতা।
একটু চুপ করে থেকে হেসে বললে–জানেন? আমার নাম–
ওর কথার ভঙ্গিতে মনে হ’ল এ এখনও ছেলেমানুষ। বললাম–আপনার নাম মালতীলতা? ও! কাল উদ্ধদাস বাবাজী রুনি বলে ডাকছিলেন আপনাকে, তাই ভাবলাম বোধ হয়–
ও সলজ্জ মুখে বললে-লতা নয়, মালা।
দুজনেই আখড়াবাড়ির নাটমন্দিরে ফিরে এলাম। তার পর মালতীকে আর দেখতে পেলাম না, সেই যে সে রান্নাঘরে কি কাজ নিয়ে ঢুকল রাত দশটা পর্যন্ত আর সেখান থেকে বেরুল না।
সকালে ঘুম ভেঙে উঠে মনে কেমন এক ধরনের মধুর অনুভূতি। মালতীকে যেন স্বপ্নে দেখেছি–ওর প্রকৃতপক্ষে কোন পার্থিব অস্তিত্ব যেন নেই। স্বপ্ন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তার কথা মনে পড়ল, বকুলতলায় তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছি, সে হাসিমুখে নিজের নাম বলেছে, তার চোখমুখের সেই সচেতন নারীত্বের সলজ্জতা অথচ বালিকার প্রগলভ কৌতুক প্রিয়তা–তার সারা দেহের সুঠাম লাবণ্য, এ-সব যেন অবাস্তব স্বপ্নজগৎ থেকে সংগ্রহ করা স্মৃতি। কিন্তু মনে সে বেদনা অনুভব করলাম না, যা আসে এই কথা ভেবে যে স্বপ্নে যা দেখেচি ও সব মিথ্যে, মায়া, মায়া–ও আর পাব না, ও ছায়ালোকের রচা স্বর্গ, ওর চন্দ্রালোকিত নির্জন পর্বতশিখরও মিথ্যে, ও দিব্যাঙ্গনারাও মিথ্যে। মালতী এইখানি আছে, কাছে কাছেই আছে, তাকে আরও কতবার দেখবো। মালতী আসবে তো?
মালতী সকালে একরাশ তুলো পিঁজতে বসল। বেলা এগারোটা পর্যন্ত সে আর কোনো কাজে গেল না। প্রথম এখানে এসে যে প্রৌঢ় বৈষ্ণবটিকে দেখেছিলাম, তার নাম উদ্ধবদাস–সেই লোকটিই মালতীর অভিভাবক, কার্যত কিন্তু মালতীর খেয়ালে তাকে চলতে হয়। সেও মালতীর কাছে বসে তুলো পিঁজতে ব্যস্ত আছে, মালতীর কথা ঠেলবার সাধ্য তার নেই।
মালতীর ইতিহাস উদ্ধবদাসের মুখে একদিন ইতিমধ্যে শুনলুম। উদ্ধব বাবাজীকে একদিন আখড়ার বাইরের মাঠে নিয়ে গিয়ে কৌশলে ঘুরিয়ে মালতীর কথা জিজ্ঞেস করতেই ও বললে–ওর বাবা আমার পাঠশালার পোড়ো বন্ধু। ওরা ব্রাহ্মণ, এ দেশের সমাজে কুলীন। মালতীর ঠাকুরদাদা শ্রীধর মুখুটি বেশ নাম-করা কীর্তন গাইয়ে ছিলেন। নিজের দল ছিল। দু-পয়সা হাতে করেছিলেনও। একদিন রাত্তিরে বাইরে বেরুচ্চেন, দরজার চৌকাঠের কাছে বাড়ির বেড়ালটা যেন কিসের সঙ্গে খেলা করছে। ফুটফুট করছে অনন্তচতুর্দশীর রাত, ভাদ্র মাস…যেমন বাইরে পা দিতে গিয়েছে অমনি সাপে ছোবল দিয়েছে পায়ে। সাপ ছিল চৌকাঠের বাইরে, আলো-আঁধারে লেগে বুড়ো তা টের পায় নি। ঘরে তখন ছেলের বৌ মালতীর মা, মালতীর বাবা বাড়ি নেই। চেঁচিয়ে বললেন–বৌমা, শীগগির আলো জ্বালো, আমায় এক গাছা দড়ি দাও শীগগির। দড়ি নিয়ে বাঁধন দিয়ে উঠোনে গিয়ে বসলো। বললে–আমায় আর ঘরে যেতে হবে না বৌমা, তলব পড়েছে। লোকজন এল, ঝাড়ানো হ’ল–কিছুতেই কিছু হ’ল না, ভোর রাত্রে মারা গেল।
মালতীর বাবা পৈতৃক কিছু হাতে পেয়ে একটা লবণ-কলায়ের দোকান করলে। তার মত অতিথিসেবার বাতিক আমি কখনও কারও দেখি নি। দোকান ত ছাই, বাড়ি হয়ে উঠল একটা মস্ত বড় অতিথিশালা। যত লোকই বাড়িতে আসুক, ফিরতো না। একবার রাত-দুপুরের সময় পঁচিশজন সাধু এসে হাজির, গঙ্গাসাগর যাচ্ছে, অনেক দূর থেকে শুনে এসেছে এখানে জায়গা পাবে। দোকানের জিনিসপত্র ভাঙিয়ে পঁচিশমূর্তি সাধুর সেবা হ’ল। সকালে তারা বললে, আমাদের জনপিছু দু-টাকা প্রণামী দাও। অত টাকা নগদ কোথায় পাবে? সাধুরা বললে–না দাও তো অভিসম্পাত দেবো। আমি বললাম–মিত, অভিসম্পাত দেয় দিক, টাকা দিও না ওদের। ওরা লোক ভাল না। সে বললে– অভিসম্পাতের ভয় করি নে, তবে আমার কাছে চেয়েছে, আমি যেখান থেকে পাই, নিয়ে এসে দেবোই। মালতীর মায়ের কানের মাকড়ী আর ফাঁদি নথ শ্ৰীমন্তপুরের বাজারে বিক্রী করে টাকা নিয়ে এল। তাতেও কুলোয় না, আমি বাকী সাতটা টাকা দিলাম–তবে সাধুরা বিদেয় হয়।
মালতী তখন ছোট, একদিন হঠাৎ স্ত্রীকে এসে বললে-দ্যাখ আর সংসারে থাকবো না। স্ত্রীও বললে–আমায় সঙ্গে নাও। স্ত্রীকে বললে–বাঁশবাগানে ওই হাঁড়িটা পড়ে আছে, নিয়ে এসে ধুয়ে ওতে ভাত রাঁধো। খেয়ে চলো। লবণ-কলায়ের দোকান বিলিয়ে দিলে। ডোমপাড়া থেকে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে বললে–যার যা খুশী নিয়ে যাও। দশ মিনিটের মধ্যে দোকানসাফ। সবাই বললে–পাগল হয়ে গিয়েছে। তার পর বৌ আর মেয়ের হাত ধরে কোথায় চলে গেল। বছর দুই পরে এসে এই লোচনদাস বাবাজীর আখড়ায় উঠলো। বাবাজী তখন বুড়ো হয়েছেন, বড় ভালবাসতেন, তিনি বললেন–বাবা, মহাপ্রভু তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমার আখড়ার ভার তোমায় নিতে হবে, আমি আর বেশী দিন নয়। পরের বছর বাবাজী দেহ রাখলেন, ওই পুকুরপাড়ের তমালতলায় তাঁকে সমাধি দেওয়া হল।
ক্রমে মালতীর বাবার নাম দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। গোসাঁইজী বলতো সবাই। গোসাঁইজীকে দেবতা বলে জানতো এ-দেশের লোক। অমন নির্লোভ, অমন অমায়িক লোক কেউ কখনও দেখে নি। শরীরে অহঙ্কার বলে পদার্থ ছিল না। আর অমন মুক্ত মানুষ হয় না–কোন বাঁধন, কোন নিয়মগণ্ডীর ধার ধারত না। আমাদের বোষ্টমের সমাজেও অনেক আইন-কানুন আছে, মেনে না চললে সমাজে নিন্দে হয়, বড় বড় মচ্ছবের সময় নেমন্তন্ন পাওয়া যায় না। সে গ্রাহ্যও করতো না, একেবারে আপনভোলা, সদানন্দ, মুক্তপুরুষ ছিল। দ্বারবাসিনী কামারদের গাড়ির কাজ আছে কলকাতায়, একবার তাদের বাড়ি কাঙালীভোজন হচ্ছে, বেশ বড়লোক তারা। কামারদের মেজকর্তা রতনবাবু। দাঁড়িয়ে তদারক করছেন–এমন সময় দেখেন গোসাঁইজী কাঙালীদের সারিতে পাতা পেতে বসে খাচ্ছেন। পাছে কেউ টের পায় বলে থামের আড়ালে বসেছেন। হৈ হৈ কাণ্ড, বাড়িসুদ্ধ এসে হাতজোড় করে দাঁড়ালো। এ কি কাণ্ড গোসাঁইজী, আমাদের অকল্যাণ হবে যে! লোকটা এত সরল–কোনো লম্বা-চওড়া কথা নয়, কোনো উপদেশ নয়, অবাক হয়ে বললে, তাতে দোষ কি? আমি শুনলাম কাঙালীভোজন হবে, ভাল-মন্দ খেতে পাওয়া যাবে, তাই এসেছি, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে জাত মানতো না, সমাজ মানতো না, আপন পর বুঝতো না, নিয়ম-কানুনের ধার ধারতো না। কত লোক মন্ত্র নিতে আসতো। বলতো–মন্ত্র কি দেবো? আপনাকে ভাববে সবাইয়ের চাকর, ব্যস, এই মন্ত্র। মালতীর মা আগেই মারা গিয়েছিল। গোসাঁইজীর নিজের মরণও হ’ল স্ত্রীর মৃত্যুর তিন বছর পরে। একদিন কোথা থেকে বৃষ্টি মাথায় ভিজে আখড়ায় এলেন। তার পরদিন সকালে আমায় বললেন–উদ্ধব, কাল আমার বড় ঠাণ্ডা লেগেছে, একটু যেন জ্বর-মত হয়েছে। আজ আর ভাত খাব না, কি বলো? দু-দিন পরে জ্বর নিমোনিয়ায় দাঁড়ালো। বুঝতে পেরেছিলেন বাঁচবেন না, মেয়েকে মরণের আগের দিন ডেকে বলে গেলেন-মালতী মা, তোর বিয়ে দিয়ে যেতে পারলাম না, তা আমার বলা রইল যাকে তোর মন চায়, তাকেই বিয়ে করিস। তিনি তো চলে গেলেন, মালতীকে একেবারে নিঃসম্বল অসহায় ফেলে রেখে। হাতে পয়সা রাখতে জানতেন না। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতেন না–সেটা আমি গুণ বলি নি, দোষই বলি–বিশেষ করে অত বড় মেয়ে–আর ওর কেউ নেই ত্রিসংসারে। বাপ নেই, মা নেই, পয়সা নেই, বাড়ি নেই, ঘরবাড়ি এই আখড়া। মালতীও যে দেখছেন–ও মেয়েও পাগল, ও বাপের ধারায় গিয়েছে। লোকজনকে খাওয়াচ্ছে, সেবা করছে–ওই নিয়েই থাকে। কিছু মানে না, ভয় করে না। অন্য মেয়ে হলে এই সব পাড়াগাঁয়ে কত বদনাম রটত–গোসাঁইজীর মেয়ে বলে সবাই মানে, তাই কেউ কিছু বলে না।
দিন-পনের কেটে গেল।
মালতীর বাবার ইতিহাস শুনে বুঝেছি আমি এখানে ছ-মাস থাকলেও এরা আমায় চলে যেতে বলবে না–বিশেষ করে মালতী তো বলবেই না। কিন্তু আমার পক্ষে থাকাও যেমন অসম্ভব হয়ে উঠছে, চলে যাওয়া তার চেয়েও অসম্ভব যে! মালতীকে নতুন চোখে দেখতে শিখেছি ওর বাবার পরিচয় শুনে পর্যন্ত। মালতীর বাবার মত লোকের সন্ধানে কত ঘুরেছি, এতদিন পরে সন্ধান মিলেছে, কিন্তু চাক্ষুষ দেখা হ’ল না। জগতের সকল নিঃস্বার্থ নিঃসম্পর্ক লোক পরস্পরের সগোত্র–তা সে লোক গঙ্গাতীরে নবদ্বীপের আকাশেই প্রথম দিনের আলো দেখুন কিংবা দেখুন কপিলাবস্তু বা প্যালেস্টাইন বা আসিসির ওপরকার ইতালীর ইন্দ্রনীল আকাশের তলে।
মালতীকে কত কথা বলবার আছে ভাবি কিন্তু ওর সঙ্গে আর আমার তেমন নির্জনে দেখা হয় না। আমি দেখি মালতীর আশাতেই আমি সারাদিন বসে থাকি–ও কখন আসবে। ও থাকে সারাদিন নিজের কাজে ব্যস্ত–হয়ত দেখলাম ঘর থেকে ও বার হ’ল, ভাবি আমার কাছেই আসছে বুঝি–কিন্তু তা না এসে থালা-হাতে কাকে ভাত দিতে গেল নয়ত আলনাতে কাপড় টাঙাতে ব্যস্ত আছে। হয়ত একবার থাকতে না পেরে ডেকে বলি–ও মালতী–
মালতী বললে–আসছি।
আমি বসেই আছি, বেলা দুপুর গড়িয়ে গেল। ও এল কই?
দিনগুলো প্রায়ই এই রকম। তা ছাড়া আমার ওপর ওর কোন বিশেষ পক্ষপাত আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রথম দিনকতক যে সে রকম ধারণা না হয়েছিল এমন নয়। কিন্তু এখন সে ভুল ভেঙেছে। সকলকে যেমন যত্ন করে, আমাকেও তেমনি করে।
একদিন বসে উদ্ধবদাসের একতারা মেরামত করছি–মালতী দেখতে পেয়ে উঠোনের ও-কোণ থেকে চঞ্চলপদে এসে সামনে দাঁড়াল। সকৌতুক সুরে বললে–ও! কাকার সেই একতারাটা? আপনি সারাচ্ছেন নাকি? কি জানেন আপনি একাতারা সারানোর?
আমি অপ্রতিভ না হয়ে বললাম–জানাজানির কি আছে এতে? খানিকটা তার হাতে এসেছিল–তাই পরিয়ে দিচ্ছি। কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে চোখ তুলে চাইতেই ওর সঙ্গে চোখাচোখি হ’ল। সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমার মনে হ’ল মালতীকে এখানে একা নিঃসহায়, নির্বান্ধব, রিক্ত অবস্থায় ফেলে আমি কোথাও যেতে পারব না। ওর এখানে কে আছে? একপাল অনাত্মীয়, অশিক্ষিত গেঁয়ো বৈষ্ণবের মেলার মধ্যে ওকে ফেলে রেখে যাব কি করে? তারা ওর কেউ নয়। তারা ওকে বুঝবে না। তার চেয়ে আমার মনের দেশে ও আমার অনেক আপন, আমার নিকটতম প্রতিবেশী।
ভাবলাম মালতীকে সব কথা বলি। বলি, মালতী, সংসারে তোমারও কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। তুমি সাধু বাপের সতী মেয়ে, তোমার সংসার-বিবাগী আপন-ভোলা বাপের আশীর্বাদ ওই শ্যামসুন্দর তমালতরু ছায়ার মত তোমাকে ঘিরে রেখেছে জানি, কিন্তু আমিও যে-সন্ধানে বেরিয়েছি, সে-সন্ধান সফল হবে না তুমি যদি পাশে এসে না দাঁড়াও।
কিন্তু তার বদলে বললাম–ভাল কথা মালতী, তোমাকে অনেক দিন থেকে বলব ভাবছি। উদ্ধব বাবাজীকে বলে আমায় এখানে একটা পাঠশালা করার ব্যবস্থা করে দিতে পার? আমার কিছু হয় তা থেকে।
মালতী এসে দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসল। ওর মুখের পাশটা দেখা যাচ্ছে, একটা সুকুমার লাবণ্য যেন ওর মুখের চারিপাশে ঘিরে আছে–এক ধরনের সুন্দর মুখ আছে, মনে হয় যেন তাদের মুখের চারিপাশে একটা অদৃশ্য সৌন্দর্যজালের বেষ্টনী রয়েছে, যখন কথা না বলে চুপ করে থাকে, তখন তাদের মুখের এই ভাবটা সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে– মালতীর মুখ সেই ধরনের। আমার কথায় ওর মুখচোখ চিন্তাকুল হয়ে উঠল, যেন কি একটা বিষম সমস্যা তার ঘাড়ে আমি চাপিয়ে দিয়েছি। বললে–কিন্তু এখানে যা ভেবে করবেন, তার কিছু হবে না। এখানে মাইনে দেবে না কেউ। এখানে ভদ্রলোক নেই। দ্বারবাসিনীতে কামারেরা আছে, ওদের কলকাতায় গাড়ির কারখানা, সেইখানেই থাকে। সরকারেরা তিন বছর পরে এসেছিল পুজোর সময় দেশে।–তারপর হেসে ছেলেমানুষের মত ঘাড় দুলিয়ে বললে–ধান নিয়ে ছেলে পড়াতে পারবেন? এদেশে মাইনের বদলে ধান দেয়। নাঃ, সে-সব আপনার কাজ নয়। তা আপনি তো এখানে জলে পড়ে নেই? হাতে কিছু নেই, একদিন হবেই। যতদিন না হয়, এখানে থাকুন। আপনাকে এ অবস্থায় কোথাও যেতে দেব না। এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বোধ হয়, না? সত্যি কথা বলুন।
–সত্যি কথা কি সব সময় বলা যায় মালতী?
—কেন, বলুন না কি বলবেন?
—এখন থাক, আমার কাজ আছে। শোন, উদ্ধবদাসের একতারাটা এখানে রইল, ব’লো তাকে। তোমার জন্যে সারানো হ’ল না।
মালতী অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললে–কোথায় যাবেন? শুনুন। বা রে, অদ্ভুত মানুষ কিন্তু আপনি!
বাইরের মাঠে এসে দাঁড়িয়ে মনে হ’ল আকাশ-বাতাসের রূপ ও রং যেন এই এক মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেছে আমার চোখে। মালতী ও-কথা বললে কেন যে, আপনাকে এ অবস্থায় কোথায় যেতে দিতে পারব না?–এই সেই মাঠ, সেই নীলাকাশ, মাঠের মধ্যে দ্বারবাসিনীর কামারদের কাটানো বড় দীঘিটা, সবই সেই আছে–কিন্তু মালতীর মুখের একটি কথায় সব এত সুন্দর, এত অপরূপ, এত মধুময় হয়ে উঠল কেন?
ঠিক সেই অদ্ভুত রাত্রিটির মত- মাঠের মধ্যে নির্জন নদীর ধারে শুয়ে যেমন হয়েছিল সেদিন। অনুভূতি হিসেবে দুই-ই এক। কোন প্রভেদ নেই দেখলুম। কোথায় সেই বিরাট দেবতা, আর কোথায় সেই মালতী!
তারপর দিন-কতক মালতীর সঙ্গে কি জানি কেন আমার প্রায়ই দেখা হয়। সময়ে অসময়ে, কারণে-অকারণে ও আমার সামনে যখনই এসে পড়ে কিংবা কাছ দিয়ে যায়, দাঁড়িয়ে দুটো কথা না বলে যায় না। হয়ত অতি তুচ্ছ কথা–বসে আছি, সামনে দিয়ে যাবার সময় বলে গেল–বসে আছেন? এ-কথা বলবার কোন প্রয়োজন নেই–কিন্তু সারাদিনের এই টুকরো টুকরো অকারণ কথা, একটুখানি হাসি, কৃত্রিম শ্লেষ, কখনো বা শুধু চাহনি..এর মধ্যে দিয়ে ওর কাছে আমি অনেকটা এগিয়ে যাই–ও আমার কাছে এগিয়ে আসে। এতে করে বুঝি ও আমার অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে চলতে পারে না–ও আমার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পায়।
বিকেলে যখন ওর সঙ্গে এক-এক দিন গল্প করি, তখন দেখি ওর মনের চমৎকার একটা সজীবতা আছে। নিজে বেশী কথা বলতে ভালবাসে না–কিন্তু শ্রোতা হিসাবে সে একেবারে প্রথম শ্রেণীর। যে-কোনো বিষয়ে ওর কৌতূহল জাগানো যায়–মনের দিক থেকে সেটা বড় একটা গুণ। এমনভাবে সকৌতূহল ডাগর চোখ দুটি তুলে একমনে সে শুনবে–তাতে যে বলছে তার মনে আরও নতুন নতুন কথা যোগায়, ওকে আরও বিস্মিত করবার ইচ্ছে হয়।
মালতী বড় চাপা মেয়ে কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ সেদিন উদ্ধবের মুখে শুনলাম যে ও বেশ সংস্কৃত জানে। ওর বাবার এক বন্ধু ত্রিগুণাচরণ কাব্যতীর্থ নাকি শেষ বয়সে এই আখড়ায় ছিলেন, এইখানেই মারা যান। তাঁর কেউ ছিল না–মালতীর বাবা তখন বেঁচে– তিনিই এখানে তাঁকে আশ্রয় দেন। ত্রিগুণা-পণ্ডিতেরই কাছে মালতী তিন-চার বছর সংস্কৃত পড়েছিল। মালতীকে জিজ্ঞেস করতেই মালতী বললে–এখন আর ওসব চর্চা নেই, ভুলে গিয়েছি। সামান্য একটা ধাতুর রূপও মনে নেই। তবে রঘুর শ্লোক অনেক মুখস্থ আছে, যা যা ভাল লেগেছিল তাই কিছু কিছু মুখস্থ করেছিলাম, সেইগুলো ভুলি নি। তবে সহজ ভাষা যদি হয়, পড়লে মানেটা খানিকটা বুঝতে পারি। সে এমন কিছু হাতী ঘোড়া নয়! উদ্ধবজ্যাঠা আবার তাই আপনাকে গিয়েছে বলতে–উদ্ধব-জ্যাঠার যা কাণ্ড!
বৈষ্ণব-ধর্মের আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছে বটে, কিন্তু ও নিজে যেন কিছুই মানে না– এই ভাবের। কখনও কোনও পূজা-অর্চনা ওকে করতে দেখি নি, এক ওর বাবার বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দেখানো ছাড়া। আখড়ায় প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের পূজার যোগাড় করে উদ্ধব নিজে, মালতীকে সেদিকে বড় একটা ঘেঁষতে দেখি নি। তা বলে ওর মন ওর বাপের মত সংস্কারমুক্তও নয়। ছোটখাটো বাছ-বিচার এত মানে যে, আখড়ার লোকে অতিষ্ঠ। সন্ধ্যাবেলা ঝিঙে তুলেছিল বলে একটি বাবাজীকে মালতীর কাছে কড়া কথা শুনতে হয়েছিল। ছোঁয়াছুঁয়ির বালাই বড়-একটা নেই- মুচির ছেলেকেও ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে খাওয়াচ্ছে, কাওড়া পাড়ায় অসুখ হ’লে সাবু করে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে আসতে দেখেছি।
একদিন বিকেলে আখড়ার সামনের মাঠে পাঠশালা করছি, মালতী এসে বললে–দিন আজ ওদের ছুটি। আসুন একটা জিনিস দেখিয়ে আনি।
আখড়ার পাশে ছোট একটা মাঠ পেরিয়ে একটা রাঙা মাটির টিলা। তার ওপর শাল পলাশের বন–টিলার নীচে ঘন বনসিদ্ধির জঙ্গল। টিলার ওপারে পলাশবনের আড়ালে একটা ছোট মন্দির। মালতী বললে–এই দেখাতে আনলাম আপনাকে। নন্দিকেশ্বর শিবের মন্দির-বড় জাগ্রত ঠাকুর–খৃস্টান হ’লেও মাথাটা নোয়ান–দোষ হবে না।
মন্দিরের পূজারী দু’খানা বাতাসা দিয়ে আমাদের জল দিলে। সে উড়িষ্যার ব্রাহ্মণ, উপাধি মহান্তি, বহুকাল এদেশে আছে, বাংলা জানে ভাল। মালতীকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে।
তারপর আমরা তিনজনেই মন্দিরের পশ্চিম দিকের রোয়াকে বসলুম। মালতী বললে–মহান্ত-কাকা, বলুন তো এই মন্দির-প্রতিষ্ঠার কথাটা এঁকে। ইনি আবার খৃস্টান কিনা, ওসব মানেন না–
আমি বললুম–আঃ, কেন বাজে বকছ মালতী? কি মানি না-মানি–মানে প্রত্যেক মানুষের–
মালতী আমার কথাটা শেষ করতে দিলে না। বললে–আপনার বক্তৃতা রাখুন। শুনুন, এটা খুব আশ্চর্য কথা–বলুন তো মহান্তি-কাকা?
মহান্তি বললে–এইখানে আগে গোয়ালাদের বাগান ছিল, বছর-পঞ্চাশ আগেকার কথা। রোজ তাদের দুধ চুরি যেত। দু-তিনটে গরু সকালে একদম দুধ দিত না। একদিন তারা রাত জেগে রইল। গভীর নিষুতি রাতে দেখে টিলার নীচের ওই বনসিদ্ধির জঙ্গল থেকে কে এক ছোকরা বার হয়ে গরুর বাঁটে মুখ দিয়ে দুধ খাচ্ছে। যে-সব গরু বাছুর ভিন্ন পানায় না, তারাও বেশ দুধ দিচ্ছে। ছোকরার রূপ দেখে ওরা কি জানি কি বুঝলে, কোন গোলমাল করলে না ছোকরাও দুধ খেয়ে ওই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরের দিন সকালে বনে খোঁজ করে দেখে কিছুই না। খুঁজতে খুঁজতে এক শিবলিঙ্গ পাওয়া গেল। ওই যে শিবলিঙ্গ দেখছেন মন্দিরের মধ্যে। মাঘ মাসে মেলা হয়–ভারি জাগ্রত ঠাকুর।
মালতী গর্বের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললে–শুনলেন পাদ্রিমশাই? মানেন না যে বড় কিছু?
আমি বললাম–আমি বেড়াতে বেড়াতে অনেক জায়গায় এ-রকম দেখেছি। কত গাঁয়ে প্রাচীন বটতলায় নুড়ি, ষষ্ঠীদেবী, ওলাদেবী, কালীমূর্তির প্রতিষ্ঠার মূলে এই ধরনের প্রবাদ আছে। লোকে কত দূর থেকে এসে পুজো দেয়, তাদের মধ্যে সত্যকার ভক্তি দেখেছি। এক পাড়াগাঁয়ের বোষ্টমের আখড়ায় একখানা পাথর দেখেছিলাম–তার ওপরে পায়ের চিহ্ন খোদাই করা, আখড়ার অধিকারী পয়সার লোভে যাত্রীদের বলতো ওটা খোদ শ্রীকৃষ্ণের পায়ের দাগ, সে বৃন্দাবন থেকে সংগ্রহ করে এনেছে পাথরখানা। আমি দেখেছি একটি তরুণী ভক্তিমতী পল্লীবধূকে চোখের জলে আকুল হয়ে পাথরটা গঙ্গাজলে ধুয়ে নিজের মাথার লম্বা চুল দিয়ে মুছিয়ে দিতে। কি জানি কোথায় পৌঁছলো ওর প্রণাম। কোন ঊর্ধ্বমূল অধোশাখ দেবতা ওর সেবা গ্রহণ করতে সেদিন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বহুপল্লবিত বাহু?
কি অপূর্ব সূর্যাস্ত হচ্ছে বিশাল পশ্চিম দিগন্তে! দূরের তালগাছের মাথাগুলো যেন বাঁধাকপির মত ছোট দেখাচ্ছে, গুঁড়িগুলো দেখাচ্ছে যেন সরু সরু নলখাগড়ার ডাঁটা–আর তার ওপরকার নীলাকাশে রঙীন মেঘলোকে পিঙ্গলবর্ণের পাহাড়, সমুদ্র, কোন স্বপ্নসাগরের অজানা বেলাভূমি …পায়ের নীচের মাটি সারাদিন রোদে পুড়েছে–বাতাসে তারই সুগন্ধ।
মালতী বললে–বিষ্ণুমন্দিরে সাঁজ জ্বলে নি এখনও। প্রদীপ দিইগে চলুন–
সেখানে ওর বাবার মন্দিরে প্রদীপ দেওয়া হয়ে গেল। আমি পুকুরপাড়ের তেঁতুলগাছের মোটা শেকড়ে বসলুম, ও দাঁড়িয়ে রইল। বললাম–আমায় তুমি যে খৃস্টান বল, তুমি আমার কথা কিছু জান না। তার পর ওকে আমার বাল্যজীবন, মিশনারী মেমদের কথা, আমাদের দারিদ্র্য, মা সীতা ও দাদার কথা সব বললাম। বিশেষ করে উল্লেখ করলাম আমার সেই দৃষ্টিশক্তির কথাটা–যা এখন হারিয়েছি। ছেলেবেলার ঘটনা আমার এখন আর তেমন মনে নেই–তবুও বললাম যা মনে ছিল–যেমন চা-বাগানের দু একটা ঘটনা, বাল্যে পানীর মৃত্যুদিনের ব্যাপার, হীরু রায়ের মৃত্যুর কথা, মেজবাবুর পুত্রসন্তান হওয়া সংক্রান্ত ব্যাপার।
বললাম–যীশুখৃস্টকে ভক্তি করি বলে অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করেছি জীবনে। কিন্তু সে আমার দোষ নয়, ছেলেবেলার শিক্ষা। ওই আবহাওয়াতেই মানুষ হয়েছিলাম। আমি এখনও তাঁর ভক্ত। তুমি তাঁর কথা কিছু জান না–বুদ্ধ চৈতন্য যেমনি মহাপুরুষ, তিনিও তেমনি। মহাপুরুষদের কি জাত আছে মালতী? কর আদায় করতো লেভি, ইহুদীসমাজে সে ছিল নীচ, পতিত, সমাজের ঘৃণ্য। সবাই তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে যেত। যীশু তাকে বললেন–লেভি, তুমি নীচ কে বলে? তুমি ভগবানের সন্তান। লেভি আনন্দে কেঁদে ফেললে। সমাজের যত হেয় লোককে তিনি কোল দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ্যা ছিল, জালজীবী ছিল, কুষ্ঠী ছিল। তাঁকে সবাই বলতো পাগল, ধর্মহীন, আচারভ্রষ্ট। তাঁর বাপ, মা, ভাই আপনার জনও তাঁকে বলতো পাগল–তারা জানত না ঈশ্বরকে যে জেনেছে, তার বাইরের আচারের প্রয়োজন নেই। তাঁর ধর্ম সেবার ধর্ম।
তার পর আমি ওকে সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা বললাম। পুকুরের ওপারে দূরবিসর্পিত আকাশের দিকে চোখ রেখে আমার মনে এল যে রাঢ়দেশের এই সীমাহীন রাঙামাটির মাঠের মধ্যে সেদিন আমি অন্য এক দেবতার স্বপ্ন দেখেছি। সে কি বিরাট রূপ! ওই রাঙা গোধূলির মেঘে, বর্ণে, আকাশে তাঁর ছবি। তাঁর আসন সর্বত্র–তালের সারিতে, তমাল-নিকুঞ্জে, পুকুরে-ফোঁটা মৃণালদলে, দুঃখে শোকে, মানুষের মুখের লাবণ্যে, শিশুর হাসিতে…সে এক অদ্ভুত দেবতা! কিন্তু কতটুকুই বা সে অনুভূতি হ’ল! যেমন আসা অমনি মিলিয়ে যাওয়া!..
মালতী, আগেই বলেছি, অদ্ভুত শ্রোতা। সে কি একান্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলে যখন আমি বকে গেলুম। চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, যেন কি ভাবছে।
তারপর হঠাৎ বললে–আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা বলি। প্রেম ও সেবার ধর্ম কি শুধু যীশুখৃষ্টের দেওয়া? আমাদের দেশে ওসব বুঝি বলে নি? আমাদের আখড়ায় লোচনদাস বাবাজী ছিলেন, ঠ্যাং-ভাঙা কুকুর পথ থেকে বুকে করে তুলে আনতেন। একবার একটা ষাঁড়ের শিং ভেঙে গিয়েছিল, ঘায়ে পোকা থুক থুক করছে, গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। লোচনজ্যাঠা তাকে জোর করে পেড়ে পেলে ঘা থেকে লম্বা লম্বা পোকা বার করে ফিনাইল দিয়ে দিতেন ন্যাকড়া করে। তাতেই এক মাস পরে ঘা সারলো।
–এ-সব কথা বলার দরকার করে না, মালতী। আমি তোমাকে বলেছি তো ধর্মের দেশকাল নেই, মহাপুরুষদের জাত নেই। যখন শুনি তোমার বাবা গরিব প্রতিবেশীদের মেয়ের বিয়েতে নিজের বাড়ি থেকে দানসামগ্রী বাসন বার করে দিতেন–দিতে দিতে পৈতৃক আমলের বাসনের বড় সিন্দুক খালি করে ফেলেছিলেন–তখনই আমি বুঝেছি ভগবান সব দেশেই অদৃশ্যলোক থেকে তাঁর বাণী প্রচার করেছেন, কোন বিশেষ দেশ বা জাতের ওপর তাঁর পক্ষপাত নেই। মানুষের বুকের মধ্যে বসে তিনি কথা কন, আর যার কান আছে, সে শুনতে পায়।
ওর বাবার কথায় ওর চোখে জল ভরে এল। অন্যমনস্ক হয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। দেখেছি মালতী শুষ্কচোখে কখনও ওর বাপের কথা শুনতে পারে না। সন্ধ্যা হয়েছে। উঠছি এমন সময় তমালছায়ায় বিষ্ণুমন্দিরের দিকে আর একবার চোখ পড়তেই আমাদের গ্রামের পুকুরপাড়ের বটতলার সেই হাতভাঙা পরিত্যক্ত সুন্দর বিষ্ণুমূর্তির কথা আমার কেমন করে মনে এল। মনে এল ছেলেবেলায় সীতা আর আমি কত ফুলের মালা গেঁথে মূর্তির গলায় পরিয়েছি–তার পর আর কতদিন সেদিকে যাই নি, কি জানি মূর্তিটার আজকাল কি দশা হয়েছে, সেইখানে আছে কিনা, কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলুম যেন, মালতী কি একটা কথা বললে, তা আমার কানেই গেল না ভাল ক’রে। বা রে, পুকুরপাড়ের সে ভাঙা দেবমূর্তির সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক?
বিষ্ণুমন্দির থেকে দু-জনে যখন ফিরছি, আখড়ায় তখন আরতি আরম্ভ হয়েছে। দিগন্তপ্রসারী মাঠের প্রান্তে গাছপালার অন্তরালবর্তী এই নিভৃত ছোট দেবালয়টির সন্ধ্যারতি প্রতিদিনই আমায় কেমন একটা অপূর্ব ভাবে অনুপ্রাণিত করত–আজ কিন্তু আমার আনন্দ যেন হাজার গুণে বেড়ে গেল। তার ওপর আজ একজন পথিক বৈষ্ণব জীবগোস্বামীর সংস্কৃত পদাবলী একতারায় অতি সুস্বরে গাইলে–আমার মানসবৃন্দাবনের বংশীবটমূলে কিশোর হরি চিরকাল বাঁশী বাজান, আমার প্রাণের গোষ্ঠে তাঁর ধেনুদল চরে সেখানে তাঁর খেলাধুলো চলে রাখালবালকদের নিয়ে দীর্ঘ সারাদিন, দীর্ঘ সারারাত।
কেন এত আনন্দ আমার মনে এল কে বলবে? আমি যেন অন্য জন্ম গ্রহণ করেছি। ঘুম আর আসে না–সে গভীর রাত্রে তমালশাখার আড়ালে চাঁদ অস্ত গেলে আমি আখড়ার সামনের মাঠে গাছের তলায় এসে বসলুম।
আকাশের অন্ধকার দূর করেছে শুধু জ্বলজ্বলে শুকতারার আলোয়। কে জানে হয়ত এই শুকতারার দেশের নদীতীরে, জ্যোৎস্নামাখা বনপ্রান্তরে, উপবনে মৃত্যুহীন জরাহীন দেবকন্যারা মন্দারবীথির ঘন ছায়ায় প্রণয়ীজনের সঙ্গে গোপনে মিলনে সারারাত্রি কাটায়…তৃপ্তিহীন অমর প্রেম তাদের চোখের জ্যোৎস্নায় জেগে থাকে, লজ্জাভরা হাসিতে ধরা দেয়। পীত সূর্যাস্তের আলোয় করুণ সুরে বহুদূরের শূন্য বেয়ে সেখানে ভেসে এসে সান্ধ্য আকাশকে আরও মধুর করে তোলে–কোথা থেকে সে সুর আসে কেউ জানে না..কেউ বলে বহু দূরের কোন নক্ষত্রলোকে এক বিরহী দেবতা একা বসে বসে এমনি তাঁর বীণা বাজান, সেই সুর ভেসে আসে প্রতি সন্ধ্যায়..ঠিক কেউ বলতে পারে না…কেবল আধ-আলো আধ-ছায়ায় পুষ্পবীথিতে লুকিয়ে বসে সুখী প্রেমিক-প্রেমিকা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে… তাদের চোখে অকারণে জল এসে পড়ে…অবাক হয়ে তারা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
হঠাৎ আমার সামনে অস্পষ্ট অন্ধকারে একজন তরুণ যুবক হাসিমুখে এসে দাঁড়িয়ে বললে–এস আমার সঙ্গে–
তার গেরুয়া উত্তরীয় আমার গায়ে এসে পড়ছে উড়ে। আমি বলি–কোথায় যাব? কে আপনি?
নবীন বৈষ্ণব বললে–আমি জীবগোস্বামী–আমারই পদাবলী তুমি সন্ধেবেলা শুনেচ যে। এত শীগগির ভুলে যাও কেন হে ছোকরা? এস আমি বৃন্দাবনে যাব। শ্রীকৃষ্ণকে আমার পাওয়া চাই।
–আপনি তো মারা গিয়েছেন আজ তিন-শো বছরের ওপর। আপনি আবার কোথায়?
—পাগল! কে বলে আমি মরেছি? আর মলেই কি আমার যাওয়া ফুরিয়েছে নাকি? এসো…এসো..আমি সংসার ছেড়েছি, সব ছেড়েছি তাঁর জন্যে। দেখছ না পাগল হয়ে পথে পথে বেড়াচ্ছি?
এমন ভাবে কথাগুলো সে বললে আমি যেন শিউরে উঠলুম। বললাম–তা তো দেখতে পাচ্ছি, পাগলের আর বাকী কি? আপনি যান, আমি যীশুখৃষ্ট্রের ভক্ত, আমি বৃন্দাবনে যাব না। তাছাড়া মালতীকে ফেলে এক পা-ও এখান থেকে নড়ছি নে আমি।
তরুণ বাউল হেসে একতারা বাজাতে বাজাতে চলে গেল––পথের মাঝে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে, যেতে যেতে দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল…অন্ধকারের মধ্যে থেকে তার গলার মিষ্টি সুর তখনও যেন ভেসে আসছে…
মধু রিপুরূপমুদারম
মধু রিপুরূপমুদারম
সুখদং সুখদং ভবসারম
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে শেষরাতের ঠাণ্ডায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কে জানে–শিশিরে কাপড়-চোপড় ভিজে গিয়েছে। ফরসা হবার আর দেরি নেই।
.
১২.
দেখতে দেখতে এখানে ছ-সাত মাস হয়ে গেল। এখানে সময় কাটে কোথা দিয়ে বুঝতে পারি নে। সকালে আখড়ার কাজ করি, বিকেলে গোটাকতক ছেলে নিয়ে একটা পাঠশালা করি, তাতে যা পাই উদ্ধব বাবাজীর হাতে তুলে দিই। একদিন মালতী আমায় বললে– ছেলে পড়িয়ে যা পান, তা আপনি উদ্ধব জ্যাঠার হাতে দেন কেন? থাকা-খাওয়ার দরুন টাকা নেওয়া তো এখানে নিয়ম নেই, ও-টাকা আপনি নিজে রেখে দেবেন, আপনারও তো নিজের টাকার দরকার আছে। আমি বললাম–তা কি করে হয় মালতী, আমি এমনি খেতে পারি নে। আর আমি তো খাওয়া থাকা বলে টাকা দিই নে, বিগ্রহের সেবার জন্যে দিই। এতে দোষ কি?
সেদিন মালতী আর কিছু বললে না। দিন-চারেক পরে আবার এক দিন ওই কথাই তুললে। টাকা আমি কেন দিই? আখড়া তো হোটেলখানা নয় যে এখানে টাকা দিয়ে খেতে হবে? ওতে তার মনে বাধে। তা ছাড়া আমার তো টাকার দরকার আছে। আমি তাকে বুঝিয়ে বলি, টাকা না দিতে দিলে আমার এখানে থাকা হবে না। চলে যেতে হবে।
সেদিন থেকে মালতী এ নিয়ে আর কিছু বলে নি।
পাড়াগাঁয়ের দিনগুলো অদ্ভুত কাটে।–দীঘির পাড়ে রাঙামটির উঁচু বাঁধে এ-সময়ে একরকম ফুল ফোটে, ছায়া পড়ে এলে মাঝে মাঝে একা গিয়ে বসি। বাগদীদের মেয়েরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে মাছ ধরে, আখড়ার গোয়াল থেকে সাঁজালের ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে ওঠে–তালের দীর্ঘসারির ফাঁক দিয়ে এই সন্ধ্যায় কতদূর দেখতে পাই–দাদার দোকান, দাদার বাতাসার কারখানা, সীতার শ্বশুরবাড়ি, তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা, নিমচাঁদের বৌ, শৈলদি ….
মালতীর স্বভাব কি মধুর! কি খাটুনিটা খাটে আখড়ায়–এক দিন উঁচু কথা শুনি নি ওর মুখে–কারও ওপর রাগ দেখি নি–বাপের মেয়ে বটে!
আখড়ায় ছোট একটা অশ্বত্থ-চারা আছে, উদ্ধবদাস রোজ স্নান করে এসে গাছটা প্রদক্ষিণ করে, গাছটাকে জল দেয়। এ তার রোজ করাই চাই। একদিন মালতীকে ডেকে বলি–তোমার উদ্ধব জ্যাঠা পাগল নাকি? ও-গাছটার চারিপাশে ঘোরার মানে কি? মালতী বললে–কেন ঘুরবে না সবাই তো আর আপনার মত নাস্তিক না। অশ্বত্থগাছ নারায়ণ–ওর সেবা করলে নারায়ণের সেবা করা হয়–জানেন কিছু?
আমি বললুম–তাহ’লে তুমিও সেবাটা শুরু করে পুণ্যি কিছু করে নাও না সময় থাকতে?
মালতী শাসনের সুরে বললে–আচ্ছা, আচ্ছা থাক। আপনি ও-রকম পরের জিনিস নিয়ে টিটকিরি দেন কেন? ওদের ওই ভাল লাগে, করে। আপনার ভাল লাগে না, করবেন না। তা নয়, সারাদিন কেবল এর খুঁত ওর খুঁত–ছি, আপনার এ স্বভাব সারবে কবে?
বললাম–তোমার মত উপদেশ দেওয়ার মানুষের দেখা পেতাম যদি তাহলে এতদিন কি আর স্বভাব সারে না? তা সবই অদৃষ্ট!
কথা শেষ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতেই মালতী রাগ ক’রে আমার সামনে থেকে উঠে গেল।
বিকেলে কিন্তু ওকে আমার কাছেই আসতে হ’ল আবার। নিকটে নকাশিপাড়া গাঁয়ে একটা যাত্রার দল ছিল, তাদের অধিকারী এসে উদ্ধবদাসকে বলে–বাবাজী, তিন মাস বসে আছি, বায়না-পত্তর একদম বন্ধ। দল তো আর চলে না। কালনা থেকে ভাল বাজিয়ে এনেছিলাম–ঢোলকে যখন হাত দেবে, আঃ, যেন মেঘ ডাকচে, বাবাজী। তা অপনাদের আখড়ায় এক দিন শ্যামসুন্দরজীউকে শুনিয়ে দিই। কিছু খরচ দিতে হবে না, তেল তামাক আর কিছু জলখাবার–
–জলখাবার-টাবার হবে না পাল-মশায়। তা ছাড়া আসর খাটানো ওসব কে করে? এখন থাক।
মালতী আমায় এসে বললে–উদ্ধব জ্যাঠাকে বলুন, যাতে যাত্রাটা হয়। আমি জলখাবার দেব, জ্যাঠাকে সেজন্যে ভাবতে হবে না। আপনাকে কিন্তু আসরের ভার নিতে হবে।
আমি বললাম–আমার দ্বারা ওসব হবে না। আমি পারব না।
মালতী মিনতির সুরে বললে–লক্ষ্মীটি, নিতেই হবে। যাত্রা যে আমি কতকাল শুনি নি! দেশের দলটা উৎসাহ না পেলে নষ্ট হয়ে যাবে! আপনি আসরের ভার নিলেই আমি ওদের ব’লে পাঠাই।
–না, আমি পারবো না, সোজা কথা। তুমি ওবেলা ও-রকম রাগ করে চলে গেলে কেন?
–তাই রাগ হয়েছে বুঝি? কথায় কথায় রাগ!
—রাগ জিনিস তোমার একচেটে যে! আর কারও কি রাগ হ’তে আছে?
—আচ্ছা, আমি আর কখনও ও-রকম করব না। আপনি বলুন ওদের, কেমন তো?
যাত্রা হয়ে গেল–মালতী ওদের ছানা খাওয়ালে পেট ভ’রে। বললে–বাবা রাস্তা থেকে লোক ডেকে এনে খাওয়াতেন আর আমরা মুখ ফুটে যারা খেতে চাইছে, তাদের খাওয়াব না? দলে ছোট ছোট ছেলেরা আছে, রাত জেগে চেঁচিয়ে শুধু-মুখে ফিরে যাবে, এ কখনও হয়?
মালতী অনেক বৈষ্ণব-গ্রন্থ পড়েছে। সময় পেলেই বিকেলে আমার কাছে বই নিয়ে আসে, দুজনে পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় গিয়ে বসি। আমার হয়েছে কি, সব সময় ওকে পেতে ইচ্ছে করে, নানা কথাবার্তায় ছল-ছুতোয় ওকে বেশীক্ষণ কাছে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিকেলের দিকে ছাড়া সারাদিন ওর দেখা পাওয়া ভার। ওর কাছে বুদ্ধের কথা বলি, সেন্ট ফ্রান্সিসের কথা বলি। ও আমাকে শ্রীচৈতন্যের কথা, শ্রীকৃষ্ণের কথা শোনায়।
এক দিন হঠাৎ আবিষ্কার করা গেল মালতী বই লেখে। কি কাজে পুকুরের ঘাটে গিয়েছি দুপুরের পরে, দেখি বাঁধানো সিঁড়ির ওপর জামগাছের ছায়ায় একখানা খাতা পড়ে আছে–পাশেই দোয়াত কলম–খাতাখানা উল্টে দেখি মালতীর হাতের লেখা। এখানে ব’সে লিখতে লিখতে হঠাৎ উঠে গিয়েছে। অত্যন্ত কৌতূহল হ’ল–না দেখে পারলাম না, প্রথমেই ওর গোটা গোটা মুক্তার ছাঁদে একটা সংস্কৃত শ্লোক লেখা :–
অনৰ্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ
তার পরে রাধাকৃষ্ণের লীলা-বর্ণনা, বৃন্দাবনের প্রকৃতি বর্ণনা মাঝে মাঝে। খাতার ওপরে লেখা আছে–পাষণ্ডদলন-গ্রন্থের অনুকরণে লিখিত।
দেখছি এমন সময় মালতী কোথা থেকে ফিরে এসে আমার হাতে খাতা দেখে মহাব্যস্ত হয়ে বললে–ও কি? ও দেখছেন কেন? দিন আমার খাতা–
আমি অপ্রতিভ হয়ে বললাম–এইখানে পড়ে ছিল, তাই দেখছিলাম কার খাতা-
—-না, দিন–ও দেখবার জো নেই।
–যখন দেখে ফেলেছি তখন তার চারা নেই। কে জানতো তুমি কবি! এ শ্লোকটা কিসের?
মালতী সলজ্জ সুরে বললে-চৈতন্যচরিতামৃতের। কেন দেখছেন, দিন–
–শোনো মালতী–লিখেছ এ বেশ ভাল কথাই। কিন্তু তোমার এ লেখা সেকেলে ধরনের। পাষণ্ডদলনের অনুকরণে বই লিখলে একালে কে পড়বে? তুমি আজকালকার কবিতার বই কিছু পড় নি বোধ হয়?
মালতী আগ্রহের সুরে বললে–কোথায় পাওয়া যায়, আমায় দেবেন আনিয়ে? আমি তো জানি নে আজকালকার কবিতার বই আছে–আনিয়ে দেবেন? আমি দাম দেবো।
দাম দেওয়ার কথা বলাতে আমার মনে ঘা লাগল। মালতী কাছে থেকেও যেন দূরে। বড় অদ্ভুত ধরনের মেয়ে, ও একালেরও নয়, সেকালেরও নয়। এই পাড়াগাঁয়ে মানুষ হয়েছে, যেখানে কোনো আধুনিকতার ঢেউ এসে পৌঁছয় নি, কিন্তু বুদ্ধিমতী এমন যে আধুনিকতাকে বুঝতে ওর দেরি হয় না। এমন সুন্দর চা করে, শ্রীরামপুরের শৈলদিরা অমন চা করতে পারত না। নিজে মাছমাংস খায় না কিন্তু আমার জন্যে এক দিন মাংস রাঁধলে রান্নাঘরের উনুনেই। আমায় প্রায়ই বলে–আপনি যখন যা খেতে ইচ্ছে হবে বলবেন। আপনি তো আর বৈষ্ণব হন নি যে মাছমাংস খাবেন না! আমায় বলবেন, আমি রেঁধে দেব এখন।
মালতী উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী বটে, কিন্তু সে সুশ্রী। ওর টান করে বাঁধা চুলও ছেলেমানুষের মত মুখশ্রীর একটা নবীন, সতেজ সুকুমার লাবণ্য-বিশেষ করে যখন মুখে ওর বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়, কিংবা একটা অদ্ভুত ভঙ্গীতে মুখ উঁচু করে হাসে–তখন সে বিজয়িনী, তখন সে পুরুষের সমস্ত দেহ, আত্মাকে সুন্দরী মৎস্যনারীর মত মুগ্ধ করে কূলের কাছের অগভীর জল থেকে টেনে বহুদূরের অথৈ জলে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ওর সে-রূপ যখন-তখন দেখা যায় না। কালেভদ্রে দৈবাৎ হয়ত একবার চোখে পড়তে পারে। আমি একবার মাত্র দেখেছিলুম।
সেদিন সন্ধ্যার পরে সারাদিন খররৌদ্র ও গুমটের পরে উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে মেঘ উঠে সারা আকাশ জুড়ে ফেললে এবং হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠল। আখড়ার বাইরের মাঠে কাঠ, ধান, ছোলা, তুলো সব রোদে দেওয়া ছিল। কেউ তোলে নি, আখড়ায় আবার ঠিক সেই সন্ধ্যার সময়টাতে লোকজন কেউ নেই। আমিও ছিলাম না। মাঠের মধ্যে বেড়াচ্ছিলাম–ঝড় উঠতেই ছুটে আখড়ায় এসে দেখি মালতী একা মহাব্যস্ত অবস্থায় জিনিসপত্র তুলছে। আমায় দেখে বললে–দৌড়ে আলোটা জ্বেলে আনুন, অন্ধকারে কিছু কি ছাই টের পাচ্ছি–সব উড়ে গেল—
সঙ্গে সঙ্গে এল বৃষ্টি…
ওকে দেখলাম নতুন চোখে। কোমরে কাপড় জড়িয়ে সে একবার এখানে একবার ওখানে বিদ্যুতের বেগে ছুটোছুটি করতে লাগল–অদ্ভুত কাজ করবার শক্তি–দেখতে দেখতে সেই ঘোর অন্ধকার আর ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ক্ষিপ্র নিপুণতার সঙ্গে অর্ধেক জিনিস তুলে দাওয়ায় নিয়ে এসে ফেললে। এদিকে আমি অন্ধকারে দেশলাই খুঁজে পাচ্ছি নে দেখে ছুটে এসে বললে–কোথায় দেশলাই রেখেছিলেন মনে আছে? কোথা থেকে হাতড়ে দেশলাই বার করলে–তার পরে সেই ঝড়ের ঝাপটার মধ্যে আলো জ্বালা–সে এক কাণ্ড! অন্ধকারে দুজনে মিলে অনেক চেষ্টার পরে শেষে ওরই ক্ষিপ্রতা ও কৌশলে আলো জ্বলল।
আলো জ্বেলে আমার হাতে দেশলাই দিয়ে আমার মুখের অসহায় ভঙ্গীর দিকে চেয়ে গলা কেমন এক ধরনের উঁচু করে হেসে উঠল–ছুটোছুটির ফলে কানের পাশের চুল আলুথালু হয়ে মুখের দু-পাশে পড়েছে, ফুল্ল শ্ৰমোজ্জ্বল গণ্ডদেশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে উজ্জ্বল কৌতুকের হাসি–দুজনে মিলে আলো ধরাচ্ছি, ওর মুখ আমার মুখের অত্যন্ত কাছে–সেই মুহূর্তে আমি ওর দিকে চাইলাম–আমার মনে হ’ল মালতীকে এতদিন ঠিক দেখি নি, আমি ওকে নতুন রূপে দেখলাম, ওর বিজয়িনী নারী রূপে। মনে হ’ল মালতী সত্যিই সুন্দরী, অপূর্ব সুন্দরী।–কিন্তু বেশীক্ষণ দেখার অবকাশ পেলাম না ওর সে রূপ। আলো জ্বেলেই ও আবার ছুটল এবং আমার আনাড়ি সাহায্যের অপেক্ষা না করেই বাকী জিনিস আধ-ভেজা, আধ-শুকনো অবস্থায় অল্প সময়ের মধ্যে দাওয়ায় এনে জড়ো করলে।
একদিন পুকুরে সকালের দিকে ঘড়া বুকে দিয়ে সাঁতার দিতে দিতে মালতী গিয়ে পড়েছে গভীর জলে। সেই সময় আমিও জলে নেমেছি। আমি জানতাম না যে ও এ সময়ে নাইতে এসেছে, কারণ সাধারণত ও স্নান করে অনেক বেলায়, আখড়ার কাজকর্ম মিটিয়ে। নাইতে নাইতে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে চেয়ে দেখি মালতী নেই, তার ঘড়াও নেই। আমি প্রথমে ভাবলাম মাঝপুকুরে ইচ্ছে করে ডুব দিয়েছে বোধ হয়। বিশেষত সে সাঁতার জানে–কিন্তু খানিক পরে যখন ও উঠল না, তখন আমার ভয় হ’ল, আমি তাড়াতাড়ি সেখানটাতে সাঁতার দিয়ে গেলাম, হাতড়ে দেখি মালতী নেই, ডুব দিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে ওকে পেলাম–চুলে কাপড় জড়িয়ে গিয়েছে কেমন বেকায়দায়, অতিকষ্টে তাকে ভাসিয়ে নিজে ডুবে জল খেতে খেতে ডাঙার কাছে নিয়ে এলুম। মালতী তখন অর্ধ অচৈতন্য, আমার ডাক শুনে আখড়া থেকে সবাই ছুটে এল–মিনিট পাঁচ-ছয় পরে ওর শরীর সুস্থ হ’ল। উদ্ধব বাবাজী বকলে, আমি বকলাম, সবাই বকলে।
এই দিনটা থেকে ওর ওপর আমার একটা কি যেন মায়া পড়ে গেল। সেদিন সন্ধ্যাবেলা কেবলই মনে হতে লাগল ও এখানে নিঃসহায়, একেবারে একা। ও সবার জন্যে খেটে মরে। ওর বাপের ধানের জমির উপস্বত্ব আখড়াসুদ্ধ বৈষ্ণব বাবাজীরা ভোগ করছে, কিন্তু ওর মুখের দিকে চাইবার কেউ নেই। ও সকলের ময়লা জামা-কাপড় কেচে বেড়াবে, ভাত রেঁধে খাওয়াবে–সবরকমে সেবা করবে, ওকে ছেলেমানুষ পেয়ে সবাই ওকে মুখের মিষ্টি তোষামোদে নাচিয়ে নিজেদের স্বার্থ ষোল আনার ওপর সতের আনা বজায় রাখবে, কিন্তু ওর সুখ-দুঃখ কেউ দেখছে? এই যে আজ পুকুরের ঘাটে ডুবে মরে যাচ্ছিল আর একটু হলে–আমি যদি না থাকতাম।
ভগবান আমাকে এ কিসের মধ্যে এনে ফেললেন, এ কি জালে দিন-দিন জড়িয়ে পড়ছি আমি! এদের আখড়াতে যে বিগ্রহ আছেন, তাঁকে ওরা মানুষের মত সেবা করে। সকালবেলায় তাঁকে বাল্যভোগ দেওয়া হয়, দুপুরের ভোগ তো আছেই। ভোগের পর দুপুরে বিগ্রহকে খাটে শুইয়ে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। বৈকালে বৈকালিক ভোগ দেওয়া হয়–ফল, মিষ্টান্ন। রাত্রে আবার খাটে শুইয়ে মশারি টাঙিয়ে দেয়–শীতের রাত্রে বিগ্রহের গায়ে লেপ, আশেপাশে বালিশ। উদ্ধবদাস বাবাজী সেদিন লাল শালু কাপড়ের ভাল লেপ করে এনেচে বিগ্রহের ব্যবহারের জন্যে––আগের লেপটা অব্যবহার্য হয়ে গিয়েছিল।
এ-সব পুতুল-খেলা দেখলে আমার হাসি পায়। সেদিন সন্ধ্যার সময় একা পেয়ে মালতীকে বললাম–তোমাদের এতদিন হুঁশ ছিল না মালতী? ছেঁড়া লেপটা এই শীতে কি বলে দিতে ঠাকুরকে? যদি অসুখ-বিসুখ হ’ত এই তেপান্তরের মাঠে–না ডাক্তার, না কবিরাজ, দেখত কে তখন? ছিঃ ছিঃ, কি কাণ্ড তোমাদের?
মালতী রাগে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। ও এ-সব কথা আর কাউকে বলে দেয় না ভাগ্যে, নইলে উদ্ধবদাস আখড়া থেকে আমায় বিদেয় দিতে এক বেলাও দেরি করত না। অনেক কথা আমি বলি ওদের আখড়া সম্বন্ধে, উদ্ধবদাস সম্বন্ধে—-যা অপরের কানে উঠলে আমায় অপমানিত হয়ে বিদায় হ’তে হ’ত, কিন্তু মালতী কোন কথা প্রকাশ করে নি কোনদিন। আজকাল মালতী আমার দিকে একটু টেনে চলে বলে সেটা অনেকের চক্ষুশূলের ব্যাপার হয়ে উঠেছে–আমি তা বুঝি।