মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদ
মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অনাবৃত চত্বরে বহুদিন ধরিয়া একখানি রাজসিংহাসন পড়িয়া থাকিত। ইহার নাম তক্ত মোবারক—মঙ্গলময় সিংহাসন। অতি সাধারণ প্রস্তরে নির্মিত অনতিবৃহৎ সিংহাসন, বোধ করি দেড় শত বৎসর এমনি অনাদরে অবহেলায় পড়িয়াছিল। যে বণিক-সম্প্রদায়ের তুলাদণ্ড সহসা একদিন রাজদণ্ডে পরিণত হইয়াছিল, তাঁহারা সুড়ঙ্গপথের অন্ধকারে আপন সিংহাসন লইয়া আসিয়াছিলেন, এই পুরাতন সিংহাসন ব্যবহার করেন নাই। তক্ত মোবারকে শেষ উপবেশন করিয়াছিলেন প্রভুদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর।
পরবর্তী কালে লর্ড কার্জন প্রত্নরক্ষায় তৎপর হইয়া এই সিংহাসন কলিকাতায় আনয়ন করেন, পরে উহা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত হয়।
তক্ত মোবারক—মঙ্গলময় সিংহাসন! কথিত আছে, এখনও গ্রীষ্মকালে এই সিংহাসনের পাষাণগাত্র বহিয়া রক্তবর্ণ স্বেদ ঝরিতে থাকে, যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত ক্ষরিত হইতেছে। সেকালে মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, বাদশাহীর অতীত গৌরবগরিমা স্মরণ করিয়া তক্ত মোবারক শোণিতাণু বিসর্জন করে। কিন্তু তাহা ভ্রান্ত বিশ্বাস। তক্ত মোবারকের শশাণিত-ক্ষরণের ইতিকথা আরও নিগুঢ়, আরও মর্মান্তিক।
তক্ত মোবারকের মতো এমন অভিশপ্ত সিংহাসন বোধ করি পৃথিবীতে আর নাই। সুবা বিহারের অন্তর্ভুক্ত মুঙ্গের শহরে এই সিংহাসন নির্মিত হইয়াছিল, সম্রাট সাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুলতান সুজা আদেশ দিয়া উহা নির্মাণ করাইয়াছিলেন। জন্মক্ষণ হইতেই অভিশাপের কালকূট যে এই সিংহাসনের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ডটি নিষিক্ত করিয়া রাখিয়াছে সুজা তাহা জানিতেন না, বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বুঝিতে পারেন নাই; এই বিশেষত্বহীন স্থূল কারুকার্যখচিত সিংহাসনটির প্রতি তাঁহার অহেতুক মোহ জন্মিয়াছিল।
তখন সাজাহানের রাজত্বশেষে ভ্রাতৃযুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। ঔরংজেবের নিকট পরাভূত হইয়া সুলতান সুজা পলায়নের পথে কিছুকাল মুঙ্গেরে অবস্থান করিয়াছিলেন; তারপর ঔরংজেবের সেনাপতি মীরজুর তাড়া খাইয়া সেখান হইতে রাজমহলে পলায়ন করেন। তক্ত মোবারক তাঁহার সঙ্গে ছিল। কিন্তু রাজমহলেও বেশি দিন থাকা চলিল না, তিনি সিংহাসন লইয়া ঢাকায় গেলেন।
মীরজুমলা যখন তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ঢাকায় উপস্থিত হইলেন তখন সুজার শোচনীয় অবস্থা; তিনি তক্ত মোবারক ঢাকায় ফেলিয়া আরাকানে পলায়ন করিলেন। অতঃপর যে রক্ত-কলুষিত স্বখাত-সলিলে তাঁহার সমাধি হইল তাহার বহু কিম্বদন্তী আছে, কিন্তু জীবিতলোকে আর তাঁহাকে দেখা যায় নাই। শাহেনশা বাদশার পুত্র এবং ময়ূর সিংহাসনের উমেদার সুজার ইতিবৃত্ত এইখানেই শেষ। অভিশাপ কিন্তু এখনই শেষ হইল না।
পরিত্যক্ত সিংহাসন মীরজুমলার কবলে আসিল। মীরজুমলা অন্তরে অন্তরে দুরন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন; সুবা বাংলার সিংহাসনের উপর তাঁহার লোভ ছিল। তক্ত মোবারক হাতে পাইয়া তাঁহার লোভ আরও বাড়িল। কিন্তু ঔরংজেবকে তিনি যমের মতো ভয় করিতেন। একদিন গোপনে তিনি নিজ শিবিরে তক্ত মোবারকের উপর মসলন্দ পাতিয়া বসিলেন এবং আলবোলায় অম্বুরী তামাকু সেবন করিতে করিতে প্রভু-দ্রোহিতার স্বপ্ন দেখিলেন।
ইহার কিছুদিন পরে অকস্মাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল।
অতঃপর তক্ত মোবারক কি করিয়া ঢাকা হইতে আবার পশ্চিম বঙ্গে ফিরিয়া আসিল তাহার কোনও ইতিহাস নাই। নবাবী আমলে মুরশিদকুলি খাঁর জামাতা সুজা খাঁ এই সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। শীঘ্রই তাঁহার মৃত্যু হইল।
তাঁহার পুত্র সরফরাজ সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। সরফরাজকেও বেশি দিন রাজ্য ভোগ করিতে হয় নাই। গিরিয়ার প্রান্তরে বিদ্রোহী ভৃত্য আলিবর্দির সহিত যুদ্ধে তিনি নিহত হইলেন। আলিবর্দি শূন্য সিংহাসন দখল করিলেন!
আলিবর্দির পালা শেষ হইলে আসিলেন সিরাজদ্দৌলা। তাঁহার পর মীরজাফরও এই সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। তারপর যবনিকা পড়িল।
তক্ত মোবারকের রক্তক্ষরণ শোকাশ্রু নয়! ইহার মূল উৎস অন্বেষণ করিতে হইলে তক্ত মোবারকের রচয়িতা মুঙ্গের নিবাসী খ্বাজা নজর বোখারী নামক জনৈক প্রস্তর-শিল্পীর জীবন কাহিনী অনুসন্ধান করিতে হয়। কে ছিল এই খ্বাজা নজর বোখারী?
তক্ত মোবারকের গায়ে পারস্য ভাষায় নিম্নোক্ত কথাগুলি খোদিত আছে—এই পরম মঙ্গলময় তক্ত মোবারক সুবা বিহারের মুঙ্গের শহরে ১০৫২ সালের ২৭ শাবান তারিখে দাসানুদাস খ্বাজা নজর বোখারী কর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল।
এই পরম মঙ্গলাস্পদ তক্ত মোবারকের প্রত্যেকটি প্রস্তরখণ্ডে শিল্পী খ্বাজা নজর বোখারী তাহার পিতৃহৃদয়ের জ্বলন্ত রক্তাক্ত অভিশাপ ঢালিয়া দিয়াছিল। যতদিন সিংহাসনের অস্তিত্ব থাকিবে ততদিন এই অভিশাপের বিষক্রিয়া শান্ত হইবে না। শুধু সুলতান সুজার বিরুদ্ধেই নয়, এ অভিশাপ গবান্ধ উস্ফুঙ্খল রাজশক্তির বিরুদ্ধে, মানুষের মনুষ্যত্বকে যাহারা শক্তির দর্পে অপমান করে তাহাদের বিরুদ্ধে। তাই বোধ হয় ইহার ক্রিয়া এখনও শেষ হয় নাই।