Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঠাম্মা || Rana Chatterjee

ঠাম্মা || Rana Chatterjee

ঠাম্মা

‘তোমায় কোত্থাও যেতে হবে না ,এই দাওয়ায় চুপ দিয়ে বসো দেখি। দাঁড়াও একখান কচি ডাব কেটে দেই’ বলে পাঁচু দত্ত লেনের তিন নম্বর গলির মুখটায় যে ডাব ওলাটা রোজ ভ্যান নিয়ে, বসে পথ আটকালো চেনা ঠাম্মাকে।আলু থালু ময়লা শাড়িটায় মুখ শুকনো করে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছিল আপন মনে। বেশ বোঝা যাচ্ছে অন্যদিনের মতো রোজ অশান্তি হলেও আজ একটু বেশি মাত্রায় বিচলিত।’ও ঠাম্মা কপালে কিসের কালসিটে গো’-বলতেই ভ্রূক্ষেপহীন ভাবে হাঁটার গতি বাড়ালেও যেই ডাব ওয়ালা পল্টু রাস্তা পেরিয়ে হাতটা ধরেছে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো অসহায় বৃদ্ধাটি।এই তল্লাটে তো কম দিন হলো না পল্টুর! আগে ওর বাবা যখন চট কলে কাজ করতো পল্টুরা কাছেই খাল পাড়ের বস্তিতে চালা ঘরে বহুবছর থেকেছে! এ পাড়ার নাড়ি নক্ষত্র,প্রায় প্রতিটা মানুষের তাদের সংসারের অনেক হাল হালহকিকত তার প্রায় মুখস্থ।

‘ও ঠাম্মা আজ আবার কিছু বাড়াবাড়ি হলো নাকি গো’-প্রশ্ন করতে গিয়েও থমকালো পল্টু। মা বলতেন যার যেটায় কষ্ট সে বিষয়ে প্রশ্ন করে খুঁচিয়ে রক্ত ক্ষরণ করতে নেই।”নাও গো ঠাম্মা এই নাও,চোখের জল মুছে খেয়ে নাও দেখি ডাবটা!” কুঞ্চিত চামড়া বয়সের ভারে থরথর করে কাঁপছিল প্রায় চার কুড়ি বয়স হওয়া বৃদ্ধাটি।সময় ও বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিছু বটগাছ যেমন প্রচুর ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে তেমনি বাড়ির বয়স্ক মানুষগুলো অভিজ্ঞতা দিয়ে মঙ্গল কামনায় সংসারকে ছাতার মতো আগলে রাখেন।কখনো প্রবল সাইক্লোনে যখন আর পেরে ওঠতে বা যুঝতে পারে না তখন বাইরে থেকে নড়বড়ে ভাবটা বেশ বোঝা যায়। তেমনই আজ এই বৃদ্ধা ঠাম্মাটিকে যেন খুবই নড়বড়ে লাগছে।

” নাও নাও এত ভাবতে হবে না- এটা তুমিই খাবে” -কথাটা একটু জোরেই বেরিয়ে গেল পল্টুর,কিছুটা রাগ কিছুটা ওবাড়ির প্রতি তাচ্ছিল্য থেকে! আসলে এই ঠাম্মা প্রায়ই গুটি গুটি পায়ে এসে শাড়ির খুঁট থেকে তার জমানো খুচরো পয়সায় নাতির জন্য ডাব কিনে নিয়ে যেত আর বলতো ,’শাঁস দেখে দিস ছেলে,আমার খোকা,বৌমা শাঁস খুব ভালো বাসে কিনা!’

শুধু পল্টু নয় এ তল্লাটে প্রায় সবাই জানে কোন ছোটতে স্বামী হারিয়ে বিধবা এই মহিলা আজকের প্রায় সকলের এই ঠাম্মা হয়ে ওঠা বৃদ্ধাটি বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভেজে তার ছেলে রমেনকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে।পাড়ার অত্যন্ত অমায়িক ভদ্রলোক কলেজের প্রফেসরকে হাতে পায়ে ধরে ছেলের জন্য কাজের হিল্লে করেছিল। যেখানে ছিল বাঁশের চাঁচ দিয়ে বাড়ি সেখানে আজ ছেলে পেল্লাই বাড়ি হাঁকিয়েছে কিন্তু ঘরের মা লক্ষীকে প্রতি দিন প্রতি মুহুর্ত অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য যেন নিত্য দিনের রুটিং হয়ে গেছিলো।পাড়ার লোকেরা সবাই বহু বুঝিয়েছে ওদের কিন্তু যা মুখের ভাষা,জুটেছে নানান কটূক্তি। আজ তাবলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে অল্প একটু শুনেই পল্টুর মন হু হু করে ওঠে।তার ঠাম্মা ছিল বটে কিন্তু এত দজ্জাল যে স্নেহ ভালোবাসা তো দূর ,দিনরাত খিটখিট ছাড়া কিছুই জোটে নি।পল্টু আবার একটু খাই খাই করতো কিনা তাই তার মায়ের কপালেও জুটতো কত কিছুই না কটূক্তি!

“কই গো খেলে-চুপ করে ধরে কাঁদছ যে তুমি”-পল্টু জানে ওই ডাবের জল ঠাম্মার গলা দিয়ে নামবে না।যে মানুষটা নিজের সর্বোচ্চ টুকু সংসারের জন্য ত্যাগ করে দিয়েছে কি করে নিজের হাতে বিশুদ্ধ জিনিস খাবে!তারওপর যেহেতু কোনোদিন নিজে না খেয়ে বাড়িতে কিনে নিয়ে যেত !এটাই তো বাড়ির মহিলাদের ধর্ম, বাজে ব্যবহার কপালে জোটার পরেও সংসার সর্বস্ব প্রাণ নিয়ে শরীরের শেষ বিন্দুতে গায়ে গতরে খেটে যায়।খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়ে সংসার সন্তানকে সুস্থ রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় থেকেও যখন শেষ বয়সে বোঝে সে অপাক্তেয় তখন ভেতরে ভেতরে নিঃস্ব হয়ে ভেঙে পড়ে অথৈ জলে।

এমনও দিন গেছে পল্টুকে বলতে হয়েছে,’ ও ঠাম্মা তুমি এই ভারী ডাব বইতে পারো নাকি! বাড়িতে এত বড়ো নাতি যখন আনতে পারো না গো ঠাম্মা!’পরক্ষনেই চুপ হয়ে যেত এটা বুঝে,যে বাড়িতে কাজের ঝি ছাড়া কিছুই ভাবা হয় না এই বয়স্কা মানুষটাকে।শত গঞ্জনা-লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় দুবেলা খাবার জোটাতে,তার আবার কষ্ট হলো কিনা শরীর অসুস্থ কিনা খোঁজ নিতে,ভাবতে বয়েই গেছে কারুর!সে যতই তার নিজের সন্তান হোক আর নাতি! শুধু করে যাও আর খেটে যাও।পল্টু এগুলো খুব অনুভব করে, না হয় সে সামান্য ডাব ওলা,কাউকে ধরাধরি করে ছোটখাটো চাকরি জোটাতে পারে নি।বাড়িতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় মা,বাবা গিন্নি সবার সাথে উঠোনে মাদুর পেতে গল্প করে।বাচ্চাটির সঙ্গে নিয়ম করে হুল্লোড় করে খেলা তো চাই ই চাই। কার কি প্রয়োজন, সংসারের খুঁটি নাটি বিষয় সহ তার বাড়ির মানুষগুলো ঠিক আছে কিনা জেনে তবে রাতের দিকে অভ্যাস বশে একবার ক্লাবে যায়।কোনোদিন মা বা গিন্নি অসুস্থ হলে কিছুতেই বিছানা থেকে উঠতে দেবে না পল্টু-সকাল সকাল বাড়ির কাজ যতটা পারে সামলে তবে দোকানের জন্য ওই মঙ্গলা হাট থেকে পাইকারি দরে ডাবের কাঁদি কিনতে যায়।সংসারের স্বার্থে বাড়ির মানুষগুলোর জন্য এটুকু যদি খেয়াল নাই রাখতে পারলো তবে কিসের সে সন্তান!তাই এমন ঘটনা গুলো এমন অত্যাচার অবজ্ঞার ঘটনা সামনে দেখলে তার চোখের কোল ভিজে যায় কিন্তু বুঝতে দেয় না।

‘কিচ্ছু চিন্তা করো নি কো-এই পল্টুটাও তো তোমার নাতি হয় জানবে বুঝলে ঠাম্মা’ বলে একটা টোটোকে হাঁক দিয়ে দাঁড় করালো সে।একজনকে দোকানটা খানিক দেখতে বলে ঠাম্মাকে নিয়ে সোজা নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেল পল্টু।মা তখন স্নান করে তুলসী মণ্ডপে জল ঢালছিল অবাক হয়ে দেখে তার পল্টু অল্প মুখ চেনা বয়স্কা মানুষটাকে পরম যত্নে হাত ধরে নামাচ্ছে।”কি রে পল্টু এই অসময়ে এলি”-কৌতূহলী মায়ের মুখ থেকে প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে খুশি হয়ে ছেলে জানালো,’মা গো কে বলে আমার ভালো ঠাম্মা নেই-ইনি ওই দত্তদের বাড়ির, আজ থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে ,যেমন জোটাতে পারবো মিলেমিশে খাবো কেমন।’ফর্সা টুকটুকে গায়ের রং বয়স হয়েছে নেহাৎ সরলা দেবীর লক্ষী প্রতিমার মতো পল্টুর হাত ধরে উনি নামলেন,ভীষণই চুপ ও আনমনা আছেন।হয়তো ভেতরের গুমোট অসহায় ভাবটা এখনো বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।রাতে খেতে বসে বাবা পল্টুকে বললো ,’হ্যাঁ রে তুই যে ঠাম্মাকে আনলি যত্নে রাখবি বলে কিন্তু ওনার ছেলে যদি তোর নামে থানায়,পার্টিতে নালিশ করে তখন কি হবে ভেবে দেখেছিস পল্টু?

অভিজ্ঞতার এটাই বোধহয় দাম। সকাল হতে না হতেই এক ভ্যান পুলিশ উঠোন জুড়ে পল্টুদের বাড়িতে!’হ্যাঁ স্যর এই বেয়াদপটাই মায়ের নামে থাকা জমি লিখিয়ে নেওয়ার লোভে বুঝিয়ে শুনিয়ে মা কে নিজের কাছে এনে রেখেছে,ছাড়বেন না একদম বেয়াদপটাকে’।দাঁড়ান দাঁড়ান ব্যাপারটা বুঝতে দিন বলে এগিয়ে এলো পুলিশ অফিসারটি। ‘আপনি তো ওই রাস্তায় ডাব বিক্রি করেন তাই না’! ‘হ্যাঁ স্যর তাই তো বলছি লোভী ভীষণ যত্তসব ছোটলোক, একদম চালান করে দিন জেলে, যেন এ জীবনে কিচ্ছু আর করতে না পারে।’-ঠাম্মার ছেলের অমন বড় বড় কথায় বিরক্ত হয়ে পুলিশটি হাত দেখিয়ে থামতে বললো। “উফ আশ্চর্য্য তো,থামুন মশাই আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ওই ডাব ওলা আমার আজকের চেনা নয়-ওর মতো নির্লোভ পরোপকারী মানুষ আমার কমই দেখা আছে।’ততক্ষণে পল্টু হাত জোর করে দাঁড়িয়েছে আমতা আমতা করে। বলল ‘স্যর,কাল ঠাম্মার কপালে মারের কালসিটে রক্ত জমাট দাগ আর এমন কাঁদছিলেন দেখে থাকতে পারি নি আমি।কোনো লোভের জন্য নয় একটু আশ্রয় দিতে, ভালো রাখতে রাস্তায় ভবঘুরে হওয়া থেকে বাঁচাতে বাড়ি নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে।অন্যান্য পুলিশ গুলো হাঁ করে শুনছিলো আর একবার করে ঘুরে দেখছে ভদ্রবেশি কুলাঙ্গার সন্তানকে। পল্টু তখনো বলে যাচ্ছে,’স্যর ঠাম্মার শরীরে নাকি এত মারের চিন্হ মা ওষুধ দিয়েছে তবু সারারাত ঘুমাতে পারেন নি বৃদ্ধা মানুষটি!’শুনে তো ভদ্রবেশী বেয়াদপ সন্তানের অবস্থা দেখার মতো ! চেঁচিয়ে উঠোন থেকেই,’ মা-মা গো তুমি কোথায় গো মা জননী বেরিয়ে এসো ,খবরদার এদের পাল্লায় পড়ো না মা,তোমার সব কিছু কেড়ে নিঃস্ব করে তুলবে।’

ঠাম্মা স্নান করে এক মনে পূজা করছিল,পল্টুর মা একটা পাট ভাঙা নতুন শাড়ি দিয়েছেন,সূর্যের আলোয় কি সুন্দর দেখতে লাগছে বৃদ্ধামানুষটাকে। কাল যে মানুষটা কিছুটা ভয়ে বাড়ির জন্য মন খারাপ নিয়ে গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ছিলেন আজ পল্টদের সামান্য যত্নে কতখানি শান্তিতে। ছেলের গলা পেয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে এলো দেওয়াল ধরে ঠাম্মা। ছেলের মাথায় প্রসাদি ফুল ছুঁইয়ে হাতে বাতাস দিয়ে বললেন,’এই নে বাপ আমার টিনের বাক্সের চাবিটা।’ খুঁট থেকে চাবি খুলে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলেন।বললেন ওর মধ্যে কিছু সোনার গয়না, টুকরো যা আছে,আমার নাতির জন্য একটা কিছু হার গড়িয়ে নিস আর ওতেই পাবি তোর বাবার যাবতীয় সম্পত্তির কাগজ।’সবার সামনে ছেলের নাটক চাবি পেতেই থেমে গেল! ঠাম্মা উপদেশের ছলে বললো,’বৌমা কে বলিস কড়াই বাসন গুলো এত যেন না পোড়ায়-কাজের মেয়ের গায়ে হাত তুললে রেওয়াত করবে না মোটেই। আমার খবর আর নেওয়ার প্রয়োজন নেই আমি যতদিন বাঁচি এই আপনজন দের মধ্যেই ভাল থাকবো।’ পুলিশ অফিসারটি পল্টুর পিঠ চাপড়ে সাবাস বলে বেরিয়ে গেলেন।’না না আপনি পালাবেন না একবার থানায় গিয়ে কমপ্লেন তুলে আনুন নইলে আপনার নামে বয়স্কা মাকে অত্যাচারের এমন কেস দেবো যে জেলেই পচতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *