Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোসাঁইপুর সরগরম (১৯৭৬) – ফেলুদা || Satyajit Ray

গোসাঁইপুর সরগরম (১৯৭৬) – ফেলুদা || Satyajit Ray

গোসাঁইপুরে আপনার চেনা একজন কে থাকেন না? রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলীকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

আমরা, থ্রি মাস্কেটিয়ারস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গঙ্গার ধারে পৌঁছে গেছি। প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে যে গম্বুজওয়ালা ঘরটা আছে সেটার মধ্যে বসে চানাচুর আর গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছি। সময় হচ্ছে বিকেল পাঁচটা, তারিখ অক্টোবরের তেরোই। আমাদের সামনেই জলের মধ্যে একটা বয়া ভাসছে, সেটার ব্যবহার কী সেটা লালমোহনবাবুকে বুঝিয়ে দিয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভদ্রলোক বললেন, আছে। বইকী। তুলসীবাবু। তুলসীচরণ দাশগুপ্ত। এথিনিয়ামে অঙ্ক আর জিয়োগ্রাফি পড়াতেন। রাজা দীনেন্দ্ৰ স্ট্রিটে থাকতেন, এখন রিটায়ার করে চলে গেছেন গোসাঁইপুর। ওখানে পৈতৃক বাড়ি আছে। ভদ্রলোক তো কতবার আমাকে যাবার জন্য লিখেছেন। আমার বিশেষ ভক্ত, জানেন তো? নিজেও গল্প-টল্প লেখেন, ছোটদের জন্য। সন্দেশে গোটা দুই বেরিয়েচে। -কিন্তু হঠাৎ গোসাঁইপুর কেন?

ওখান থেকে একটা চিঠি এসেছে। লিখেছেন জীবনলাল মল্লিক। শ্যামলাল মল্লিক, তস্য পুত্র জীবনলাল। বংশ-পরিচয় তৃতীয় খণ্ড খুলে দেখলাম গোসাঁইপুরের জমিদার ছিলেন এই মল্লিকরা।

ফেলুদা থামল। কারণ একটা জাহাজ প্রচণ্ড জোরে ভোঁ দিয়ে উঠেছে। আজই সকালে গোসাঁইপুরের চিঠিটা এসেছে সেটা জানি। যদিও তাতে কী লেখা ছিল জানি না। চিঠিটা পড়ে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল সেটা লক্ষ করেছিলাম।

কী লিখেছেন ভদ্রলোক? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

লিখেছেন তাঁর পিতাকে নাকি কেহ বা কাহারা হত্যা করার সংকল্প করেছে। আমি গিয়ে যদি ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে পারি তা হলে উনি বিশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করবেন এবং আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করবেন।

চলুন না মশাই বললেন লালমোহনবাবু। বেশ তো ঝাড়াঝাপটা এখন; আমার নতুন বই বেরিয়ে গেছে। আপনার হাতেও ইমিডিয়েট কিছু নেই, তা ছাড়া হিল্লি-দিল্লি তো অনেক হল, এবার স্বাদবাদলের জন্য পল্লীগ্রামটা মন্দ কী? কাছেই সেগুনহাটিতে শুনিচি বিরাট মেলা হয় এই সময়টাতেই। চলুন স্যার, বেরিয়ে পড়ি।

ওঁদের বাড়িতে নাকি থাকার অসুবিধে আছে, তাই মাইল তিনেক দূরে শ্ৰীপুরে কোন এক চেনা বাড়িতে আমার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন। সাইকেল রিকশাতে যাতায়াত। আমার মনে হচ্ছিল গোসাঁইপুরেই থাকতে পারলে সুবিধে হত। তাই আপনার বন্ধুটির কথা জিজ্ঞেস করলাম।

আমার বন্ধু উইল বি ড্যাম গ্র্যাড। আর আপনি যাচ্ছেন শুনলে তো কথাই নেই। উনি আপনার দারুণ ভক্ত।

আর কার কার ভক্ত সেটা জেনে নিই।

লালমোহনবাবু এই খোঁচা-দেওয়া প্রশ্নটাকেও সিরিয়াসলি নিয়ে বললেন, জগদীশ বোসের নাম করতে শুনিচি এককালে, বলতেন। অত বড় মনীষী পৃথিবীতে নেই; আর গোবরবাবুর কাছে বোধহয় ছেলেবেলা কুস্তি শিখেছে; আর—

আর, ওই যথেষ্ট।


গোসাঁইপুর যেতে গেলে কাটায়া জংশনে নেমে বাস ধরতে হয়। কাটায়া থেকে সাত মাইল; তার মানে বড় জোর আধা ঘণ্টা। শ্যামলাল তস্য পুত্র জীবনলালকে ফেলুদা লিখে দিয়েছিল। আমরা আসছি বলে, আর বলেছিল গোসাঁইপুরেই আমাদের থাকার বন্দাবস্ত হয়েছে। এদিকে তুলসীবাবু জটায়ুর চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দেন। শুধু যে খুশি হয়েছেন তা নয়, লিখেছেন গোসাঁইপুর সাহিত্য সংঘ ফেলুদা আর লালমোহনবাবুকে একটা জয়েন্ট সংবর্ধনা দেবার আয়োজন করতে চায়। লালমোহনবাবুর একেবারেই আপত্তি ছিল না, কিন্তু ফেলুদা কথাটা শুনেই চোখ রাঙিয়ে বলল, দেশে ক্রাইম বন্ধ হয়ে গেলে গোয়েন্দাদের হাঁড়ি চড়ে না। কী অবস্থায় কাজ করছি সেটা বুঝতে পারছেন? এতে আমার সংবর্ধনার কী আছে মশাই? আর বলে দিন যে আমার পরিচয়টা দিয়া করে যেন গোপন রাখেন, নইলে তদন্তের বারোটা বেজে যাবে।

লালমোহনবাবুকে বাধ্য হয়েই আদেশ পালন করতে হল। তবে এটাও লিখলেন যে সংবর্ধনা নিতে ওঁর নিজের কোনও বাধা নেই। এই অনুষ্ঠানের কথা ভেবেই বোধহয় উনি নীল সুতোয় চিকানের কাজ করা একটা মলমলের পাঞ্জাবি সঙ্গে নিলেন।

তুলসীবাবু জানিয়ে রেখেছিলেন যে গোসাঁইপুর গ্রামে ঢোকবার মুখে যোগেশের মুদির দাকানে তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। সেখান থেকে তাঁর বাড়ি দশ মিনিটের হাঁটা পথ।

কাটোয়া থেকে বাস ধরে গোসাঁইপুর যাবার পথে একটা পালকি দেখে বেশ অবাক লাগল। ফেলুদা আর লালমোহনবাবুও দেখলাম ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখল পালকিটাকে।কোন সেঞ্চরিতে এসে পড়লাম মশাই, বললেন লালমোহনবাবু, গোসাঁইপুরে বিজলি পৌঁছেচে তো? এতটা অজ পাড়াগাঁ বলে তো আমার ধারণা ছিল না।

বাসের কন্ডাকটার যোগেশের দোকানের নাম জানে, তাকে বলা ছিল। ঠিক জায়গায় চেরা গলায় গোসাঁইপুর, গোসাঁইপুর। বলে দুটো চিৎকার দিয়ে বাস থামিয়ে আমাদের নামিয়ে দিল। যে ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন তিনি যে এককালে ইস্কুলমাস্টার ছিলেন সেটা আর বলে দিতে হয় না। ভদ্রলোকের হাতে তাপ্লি-মারা ছাতা, পায়ে ব্ৰাউন কেড্‌স জুতো, চোখে চশমা, পরনে হাফ পাঞ্জাবি আর খাটা করে পরা ধূতি, আর বগলে একটা মান্ধতার আমলের পুরনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন। ফেলুদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ভদ্রলোক হেসে চোখ টিপে বললেন, আপনার আদেশ পালন করিচি-কোনও চিন্তা নেই। আপনি হলেন টুরিস্ট, হোল লাইফ ক্যানাডায় কাটিয়েছেন, দেশে ফিরে পাড়াগাঁ দেখার শখ হয়েছে। ভাবলুম আপনি যদি তদন্তের ব্যাপারেই এসে থাকেন, তা হলে তল্লাশির জন্য এখেনে-সেখেনে ঘাপটি মারতে হতে পারে, কাজেই সেফ সাইডে থাকা ভাল। টুরিস্টদের উগ্ৰ কৌতুহল থাকে সেটা সকলেই জানে।

আপনার বাড়িতে ক্যানাডা সম্বন্ধে তথ্যওয়ালা বই আছে আশা করি? ফেলুদা হেসে বলল।

কোনও চিন্তা নেই, আবার বললেন তুলসীবাবু। তারপর লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আর গাঙ্গুলী ভায়া, তোমাকে কিন্তু একটু ঝক্কি পোয়াতে হচ্ছে, তাঁরশু অর্থাৎ শুকুরবার, আমাদের নিউ প্রাইমারি স্কুলে একটা ফাংশন অ্যারেঞ্জ করিচি। সুরেশ চাকলাদার উকিল পৌরোহিত্য করবেন। কিছু না—একটু নাচ গান, দুটো আবৃত্তি, দুটো ভাষণ। এই আর কী ! আমাদের পোস্টমাস্টার হরিহরের ছেলে বলদেব ভাল ছবি আঁকে, সে একটা মানপত্র লিখছে। ভাষাটা অবিশ্যি, হে হে, আমার।

অলংকারের আবার বেশি বাড়াবাড়ি–, কাঁচা রাস্তায় কীসে জানি ঠোক্কর খাওয়াতে লালমোহনরূকুর কথা শেষ হল না। কিন্তু বাকিটা বুঝে নিয়েই তুলসীবাবু বললেন, তা এ সব ব্যাপারে একটু তো বাড়াবাড়ি হবেই। আর তোমার মতো সাকসেসফুল অথর আর কাঁটা এসেছে বলে এখেনে। লাস্ট এসিচিল। পরীক্ষিত চাটুজ্যে।–তাও সিকস্‌টি সেভেনে।

ফেলুদা বলল, আসবার পথে একটা পালকি দেখলাম। এদিকে এখনও পালকি ব্যবহার হয় নাকি?

শুধু পালকি? তুলসীবাবু ছাতার বাড়িতে একটা বাছুরকে পথ থেকে সরিয়ে বললেন, “আপনি বিগত যুগের কোন জিনিসটা চান বলুন। পাইক-বীরকন্দাজ? পাবেন। ইকোবরাদার? পাবেন। টানা-পাখা? পাবেন। লম্প-পিদিম-পিলসুজা? পাবেন। —

কিন্তু এখানে তো ইলেকট্রিসিটি আছে দেখছি।

সব জায়গাতেই আছে, কেবল যেখানে সব চাইতে বেশি থাকার কথা সেইখেনেই নেই।

কোথায় মশাই? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

মল্লিকদের বাড়ি।

আমরা তিনজনেই অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে চাইলাম।

মল্লিক মানে শ্যামলাল মল্লিক? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

ওই একটিই তো মল্লিক গোসাঁইপুরে। এখেনকার জমিদার ছিলেন ওঁরা। দুর্লভ মল্লিকের নামে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। শ্যামলাল তাঁর ছেলে। জমিদারি উচ্ছেদ হবার পর কলকাতায় গিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবসা করে বিস্তর টাকা করিছিল। একদিন অন্ধকারে হাতড়ে ঘরের সুইচ জ্বালতে গোসল, সুইচ বোর্ডে একটা খোলা তার ছিল, তাতে হাত লেগে যায়। এ সি কারেন্ট মশাই, হাত আঁটকে গিয়ে হুলুস্থূল ব্যাপার। হাসপাতালে ছিল বেশ কিছুদিন। বেরিয়ে এসে ব্যবসা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে গোসাঁইপুরে চলে আসে। এসেই ইলেকট্রিক কানেকশন কেটে দেয়। শুধু সে হলে না হয় তবু বোঝা যেত। সেই সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সব কিছু বাতিল করে দিয়েছে। চুরুট ছেড়ে গড়গড়া ধরেছে ; ফাউনটেন পেন ব্যবহার করে না ; টুথব্রাসের বদলে দাঁতন। ইংরিজি বই যা ছিল বাড়িতে সব বেচে দিয়েছে, নিজের গাড়িটা বেচে দিয়েছে, তার জায়গায় পালকি হয়েছে। একটা পুরনো ভাঙা পালকি বাড়িতেই ছিল, সেটাকে সারিয়ে নিয়েছে, তার জন্য চারটি বেহারা বহাল হয়েছে। বিলিতি ওষুধ যা ছিল সব নর্দমায় ফেলে দিয়েছে; এখন ওনলি কবরেজি। ফাঁকতালে তারক কবরেজের কপাল ফিরে গেছে। আরও কত কী যে করেছে তার হিসেব নেই। এখেনে যখন এসেছেন তখন আলাপ হবে নিশ্চয়ই; তখন সৰ্ব্ব জানতে পারবেন।

আলাপ না হয়ে উপায় নেই বলল ফেলুদা। আমি এসেছি ওঁর ছেলের কাছ থেকে তলব পেয়ে।

হ্যাঁ, তা ছেলে। ক’দিন হল এসেছে বটে। কিন্তু রহস্যটা কী?

শ্যামলাল মল্লিককে খুন করার চেষ্টা চলেছে বলে কোনও খবর আপনার কানে এসেছে কি?

তুলসীবাবু কথাটা শুনে বেশ অবাক হলেন।কই তেমন কিছু শুনিনি। তা খুন করার কথাই যদি বলেন, তার জন্যে বাইরের লোকের দরকার কী? ঘরেই তো রয়েছে।

কীরকম?

ওই যিনি আপনাকে তলব দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাপের তো বনিবনা নেই একদম। এখেনে এলেই তো ঝগড়াঝাটি হয়। অবিশ্যি আমি জীবনলালকে দোষ দিই না। ওরকম উদ্ভট খেয়াল যে কাপের, তাকে কোন ছেলে মানবে বলুন। জীবনলালকে তো এসে। ওই বাড়িতেই থাকতে হয়। ওই ভূতের বাড়িতে মাথা ঠিক রাখা খুব মুশকিল।

এক বিঘে জমির উপর তুলসীবাবুর কোঠাবাড়ি, বললেন বয়স নাকি প্রায় একশো। বাপ-ঠাকুরদা দুজনেই মোক্তারি করতেন, বাড়িটা ঠাকুরদাই বানিয়েছেন। তুলসীবাবুর স্ত্রী কলকাতাতেই মারা গেছেন। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তার স্বামী লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা করে আজিমগঞ্জে। দুই ছেলের একজনের সাইন পেন্টিং-এর ব্যবসা আছে কলকাতায়, আরেকজন ওষুধের সেলসম্যান। এখানে তুলসীবাবু একই থাকেন। —তবে কী জানেন, পাড়াগাঁয়ে এক মনে হয় না। এখানে সবাই পরস্পরের খোঁজখবর রাখে, রোজই দেখা হয়, মেলামেশাটা অনেক বেশি।

বিকেল চারটে নাগাত তুলসীবাবুর বাড়িতে পৌঁছে হাত মুখ ধুয়ে প্রথমেই চায়ের আয়োজন হল। ফেলুদা সঙ্গে ভাল চা এনেছিল, কারণ ওই একটা ব্যাপারে ও সত্যিই খুঁতখুঁতে। অবিশ্যি সে চা সকলেই খেল, আর তার সঙ্গে চিড়ে-নারকেল। জোগাড়-যন্ত্র করল তুলসীবাবুর চাকর গঙ্গা।

একতলার দুটো ঘরের একটাতে তুলসীবাবু নিজে থাকেন, দোতালার ছাতে একটা বড় ঘর, তাতে তিনটে তক্তপোষা পেতে আমাদের জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এ ঘর নাকি তুলসীবাবুর মেয়ে-জামাই তাদের ছেলেপুলে নিয়ে বছরে একবার করে এসে থেকে যায়।

চা খেতে খেতে ফেলুদা বলল, আমাকে কিন্তু একবার ওই বিজলিহীন বাড়িতে যেতে হবে জীবনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। ওঁকে লিখে জানিয়েছি যে সাড়ে পাঁচটা নাগাত যাব।

তুলসীবাবু বললেন, তা বেশ তো, আমি পৌঁছে দেবখন। মল্লিকবাড়ি পাঁচ-সাত মিনিটের পথ। তবে গাঙ্গুলীভায়াকে আমি ছাড়াচি নে। আজ সন্ধেবেলা কিছু লোক আসবে আমার এখেনে; একটু সদালাপ করতে চান সাহিত্যিকের সঙ্গে। মিত্তির মশাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবেন তো?

কেন বলুন তো?

একবার আত্মারামবাবুর ওখানে আপনাকে নিয়ে যেতে চাই। উনি গোসাঁইপুরের একটি অ্যাট্রাকশন।

আত্মারামবাবু?

আসল নাম অবিশ্যি মৃগেন ভটচায। আত্মা-টাত্মা নিয়ে চৰ্চা করেন। তাই এখানকার কয়েকজন নাম দিয়েছে আত্মারাম। আমি দিইনি কিন্তু! আমার ধারণা ভদ্রলোকের মধ্যে সত্যিই ইয়ে আছে।

আত্মা নিয়ে চাঁচটা যে কী সেটা আর জিজ্ঞেস করা হল না। কারণ ঠিক তখনই আবার দেখতে পেলাম পালকিটাকে। আমরা বাইরের দাওয়ায় বসে চা-চিড়ে খাচ্ছিলাম, সামনেই রাস্তা, আর সেই রাস্তা দিয়েই পালকিটা আসছে। এবার দেখতে পেলাম যে ভিতরে একজন লোক বসে আছে।

ভদ্রলোক পালকির দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি মারছিলেন। বেহারিাগুলো ঠিক গল্পে যেরকম পড়া যায় সেইভাবে হুমাহাম শব্দ করতে করতে এগোচ্ছিল, এমন সময় শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পালকিটাও থেমে গেল।

পালকি মাটিতে নামতেই, তার ভিতর থেকে একজন বছর পয়ত্ৰিশের ভদ্রলোক বেশ কষ্ট করে বাইরে বেরিয়ে আরও খানিকটা কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন। সমস্ত ব্যাপারটা বেমানান, কারণ ভদ্রলোকের স্মার্ট কলকাতিয়া চেহারা, গায়ে বুশ শার্ট আর টেরিলিনের প্যান্ট।

মিস্টার মিত্তির? ফেলুদার দিকে এগিয়ে এসে হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমার নাম জীবনলাল মল্লিক।

বুঝেছি। ইনি আমার বন্ধু মিস্টার গাঙ্গুলী, আর এ হল আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ। তুলসীবাবুর সঙ্গে বোধহয় আপনার পরিচয় আছে।

আমার নাম জীবনলাল মল্লিক।

তুলসীবাবুর সঙ্গে বোধহয় আপনার পরিচয় আছে!

জীবনবাবু পালকিটাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার বাড়ি মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আসবেন একবারটি? আপনাদের চা খাওয়া হয়েছে? একটু কথা ছিল।

লালমোহনবাবু রয়ে গেলেন, আমি আর ফেলুদা ভদ্রলোকের সঙ্গে মল্লিকবাড়ি রওনা দিলাম। রাস্তা ছেড়ে একটা বাঁশ বনে ঢুকে বুঝলাম এটা শর্টকাট। জীবনবাবু বললেন, কলকাতায় একটা টেলিফোন করার দরকার ছিল, তাই স্টেশনে যেতে হল।

পালকি ছাড়া গতি নেই বুঝি?।

জীবনবাবু ফেলুদার দিকে আড়চাখে চেয়ে বললেন, আপনাকে তুলসীবাবু বলেছেন বুঝতে পারছি।

হ্যাঁ, বলছিলেন ইলেকট্রিক শকের পরিণাম।

পরিণামটা গোড়ায় এত ভয়াবহ ছিল না, আক্রোশটা ছিল, শুধু ইলেকট্রিসিটির বিরুদ্ধে। এখন কী দাঁড়িয়েছে সেটা আমাদের বাড়ি গেলেই বুঝতে পারবেন।

আপনি এখানে প্রায়ই আসেন?

দুমাসে একবার। আমাদের একটা ব্যবসা আছে, সেটা এখন আমাকেই দেখতে হয়। সেই নিয়ে কথা বলতেই আসি।

তা হলে ব্যবসায় এখনও ইন্টারেস্ট আছে আপনার বাবার?

মোটেই না। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। যাতে উনি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।

কোনও আশা দেখছেন কি?

এখনও না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress