কপিল নাচছে
আমি তো একা নই। হাজার হাজার লোকের…কারুর পাঁচ, কারুর পঞ্চাশ হাজার, কারুর পাঁচ লাখ। রণেনবাবু রিটায়ার করে যা পেয়েছিল, সারা জীবনের সঞ্চয় নব্বই হাজার ওখানে রেখেছিল, সব গেছে। আমি তো সেই তুলনায় ভাগ্যবান, ষাট হাজার মাত্র।
এক মাস ধরে অনবরত এই শুনছি, আর ভালো লাগে না হাজার হাজারের কথা শুনতে। সর্বনাশের মধ্যে এখন আমরা নিজেরাই।
তিন তলার বারান্দায় রবিবারের বিকেলে স্বামী-স্ত্রী অরুণ এবং বাণী রেলিংয়ে কনুই রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখলে মনে হবে সফল জীবনকে তাদের সামনে স্থির বা ধাবমান প্রকৃতির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে তা ফিরিয়ে নেবার জন্য প্রশান্ত আলস্যে যেন অপেক্ষা করছে।
চল্লিশ ফ্ল্যাটের সমবায় আবাসন সসাসাইটির চার তলা এই বাড়ির নাম বসবাস। বাড়ির সামনের রাস্তা পার হলেই পাঁচিলঘেরা পার্ক। পার্কের তিন দিকে খন্ড খন্ড বসতজমি কয়েকটিতে বাড়ি হয়েছে, কয়েকটিতে হচ্ছে। তারপরই ধু-ধু শূন্যতা। দূরে ছাইরঙের সদ্য সমাপ্ত অতিকায় এক বাড়ি, কোনো সরকারি দপ্তর হয়তো বসবে। আরও দূরে ছড়ানো গাছের আড়ালে গ্রামের আভাস দিচ্ছে কয়েকটি খড়ের চালা। তাতে লতানো গাছ, হয়তো লাউ বা চালকুমড়োর। পার্কের ডাইনে একটা ঝিলের কিছুটা অংশ দেখা যায়, কিন্তু দেখা যাবে না বাড়ি উঠলে। সকালে রোদ পড়লে ঝিলটা আয়নার মতো ঝলসায়। বিরাট কিছু গাছ ঝিলের ধার ঘেঁষে। তার কিছু ফুলের। হলুদ আর লাল এ পর্যন্ত দেখা গেছে। বাতাসে কাঁপানো পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তার বা বাড়ির আলো মিটমিট করে জোনাকির মতো। মেয়ে এবং পুরুষরা ঝিলে দুপুরে স্নান করে।
পার্কেও গাছ রয়েছে। উচ্চতায় এবং ঝাড়ে এখনও কৈশোরে কিন্তু হলুদ, সাদা, বেগুনি, লাল ফুল ফুটিয়েছে। সিমেন্টের বেঞ্চগুলো খালিই পড়ে থাকে। অভিজ্ঞতার প্রাচুর্যে উপচানো সঙ্গলোভী বৃদ্ধদের সংখ্যা এখনও হয়তো বাড়েনি এই অঞ্চলে। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে ঝোপ, বড়ো বড়ো ঘাস। পার্কের যত্ন নেওয়ার লোকটি বোধ হয় অলস কিংবা বেতন কম পায়। ঝোপের উপর প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে, তিন-তলা থেকে দেখা যায়। পার্কের মধ্যে শালিক নামে, ঝগড়া করে। জোড়া বুলবুলি এ গাছ ও-গাছ উড়ে বেড়ায়। লম্বা লেজওয়ালা কালো পাখি পার্কের পাঁচিলে কখনো-সখনো বসে। সকালে বা দুপুরে ঘুঘুর ডাক শোনা যায় দূর থেকে ভেসে আসা মোটর বা বাস বা জেনারেটরের শব্দ ছাপিয়েও।
এক বৃষ্টির দিনে মাটির সোঁদা গন্ধ, ঝাপসা গাছপালা এবং ঝম ঝম আওয়াজের মধ্যে প্রান্তরে একটা তাল গাছকে আবিষ্কার করে অরুণ অবাক হয়েছিল।
বসবাসের উত্তরের অংশে একটি ফ্ল্যাটের কিছুটা অভ্যন্তর দেখা যায় যদি পর্দা সরানো থাকে। একদিন ফুটফুটে একটা বাচ্চা হামা দিচ্ছিল। অবাক হয়ে ঝুঁকে দেখছিল বিরলকেশ, কৃষ্ণকায় হাফ প্যান্টপরা স্বাস্থ্যবান এক যুবক। হঠাৎ পর্দার আড়ালে থাকা কারুর দুটি নিটোল বাহু বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর যুবকটি, সম্ভবত বাবা, বাচ্চাটার নকল করে ঘরে হামা দিয়ে এক বার ঘুরেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সেইসঙ্গে ভেসে এল মাঝরাতে ঝম ঝম বর্ষার মতো হাসি। বাণী এই দৃশ্য ও হাসিতে অভিভূত হয়েছিল।
এভাবে ঠকাবে একদমই ভাবিনি।
ভেবে আর লাভ নেই।
প্রসঙ্গটা দুজনেই এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু মনের মধ্যে সারাক্ষণই বিষাদের বোঝা বহন করে চলার সামর্থ্যও আর নেই। অরুণ কঠিন ধাতের মানুষ, যা তার ছোটোখাটো রুগ্নদেহ ও নম্র আচরণ থেকে বোঝা যায় না। স্কুলের পড়া শেষ করেই চাকরিতে ঢুকেছিল এবং গত তিরিশ বছরে ধাপে ধাপে উঠে এখন বিরাট এক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় বিভাগের তিন নম্বর কর্তা। সে জানে আর তার ওঠার যোগ্যতা নেই, এখানেই আরও বছর দশেক থেকে অবসর নিতে হবে।
আজ ভাত খাবার সময় দেবু কিছু বলেনি?
পর পর তিন রোববার মাংস হল না। গাঁইগুঁই করছিল—অভ্যেস হয়ে গেছে তো। এখনও ব্যাপারটা জানে না।
জানতে হবে। নইলে…
কী জানবে?
সতেরো-আঠারো বয়স, এখন তো নানা ব্যাপারে অভ্যস্ত হবার সময়, নানা প্ল্যান মাথায় খেলে, স্বপ্ন দেখে। আমার ক্ষমতার ভরসাতেই তো সব। এখানে ওর বন্ধুবান্ধবরা সবাই সচ্ছল ঘরের। ওর চালচলন, আবদারগুলোও সেইরকম হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার ক্ষমতা যে নেই এটা ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমি যে মার খেয়ে গেছি…
স্বামী-স্ত্রী নীরবে, পাশাপাশি। ভবিষ্যৎ ওদের অস্থির, কাতর ও ভীত করছে এবং অতীতকে সেইজন্যই বার বার এখন মনে পড়ছে, অথচ সেখানে তারা আর আশ্রয় নিতে চায় না। কেউ কারুর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে বর্তমান থেকে তাদের নিস্তার নেই।
বাবু কী বলছে?
ওর অত খাওয়া নিয়ে বাহানা নেই…কুকুরের পেট ভরলেই সন্তুষ্ট।
অরুণের মুখে পাতলা হাসি ভেসে উঠল। আড়চোখে দেখল বাণীও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এগারো বছরের বাবু আর সাত মাসের একটা স্পিৎজ বাচ্চা মিলে চমৎকার এক উৎপাত তৈরি হয়েছে। রাত্রে কুকুরটিকে বুকের কাছে নিয়ে ঘুমোয়, মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ার সময় টেবিলের নীচে বসিয়ে রাখে। স্নান করানো, ললাম আঁচড়ানো, সহবত শেখানো ইত্যাদি ওর নানান কাজের ব্যস্ততায় তারা মজা পায়, দিন দশেক আগেও স্পিৎজ বাচ্চার নাম ছিল বথাম, এখন হয়েছে কপিল। একসময় টারজান ও বেতালকেও সে সম্মানিত করেছে।
অফিসের লিফটম্যান হামিদ কোথা থেকে বাচ্চাটিকে এনে দিয়েছে সাড়ে চারশো টাকায়। সবাই বলেছে, খুব সস্তায় পেয়েছেন। তখন চব্বিশশো টাকা প্রতি মাসে দিয়ে যেত পরিতোষ। মাসিক আয়টা হঠাৎ দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাওয়ার জোয়ারে সংসারটা ফুলে উঠেছিল উচ্ছাসে। ক্রমশ সেটা থিতিয়ে গেল বটে কিন্তু উচ্ছাসের স্তর আর নামল না। এখন ওরা এই সচ্ছলতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
পরিতোষ তার নিজের ভাগনে। সরকারি অফিসের কেরানি। প্রথম যখন বলেছিল, অরুণ বিশ্বাসই করতে পারেনি।
দেওয়া যায় নাকি বছরে শতকরা আটচল্লিশ?
বাণী বলেছিল, হাজারে চল্লিশ টাকা মাসে? তার মানে?
দেওয়া যায় কি না-যায়, টাকা খাটাচ্ছে এমন লোকের কাছে যাচাই করে দ্যাখো। আমিই তোমায় মাসে মাসে সুদের টাকা দিয়ে যাব বাড়িতে।
দিন দশেক পর রাতে বিছানায় নীচু গলায় অরুণ বলেছিল, এবার টাকার দরকার হবে, এবার তোমার হেল্প চাই।
কীভাবে করব!
খরচ আরও কমিয়ে আনতে হবে। জমাতে হবে। ফ্ল্যাটের জন্য সোসাইটি পনেরো হাজার টাকা চেয়েছে, তিন মাস পর আরও দশ হাজার। এই বছরেই আমাকে মোট দিতে হচ্ছে। পঁয়ত্রিশ হাজার, ব্যাঙ্কে যা আছে তাতে হাজার তিরিশ পারব। তা ছাড়া অ্যাপেক্স থেকে লোন চল্লিশ হাজার, তারপর আরও দশ হাজার প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে তুলতেই হবে, ভেবেছিলুম ওখানে হাত দেব না, কিন্তু আর পাবই-বা কোথা থেকে। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে ওরা বলছে পঁচাশি হাজারে পারা সম্ভব নয়, তার মানে আবার টাকা চাইবে।
নতুন জায়গায় নতুনভাবে থাকতে হলে অনেক কিছু কেনার দরকার হবে, তাতেও তো অনেক টাকা লাগবে।
লাগবেই তো। এখানকার পুরোনো ভাঙা ছেঁড়া রংচটা জিনিসগুলো নিয়ে যাব ভেবেছ নাকি? বালিশ তোশক থেকে শুরু করে বাসন কোসন, পর্দা, চেয়ার, টেবিল, পাখা কত কী করাতে হবে।
গ্যাসের জন্য বলেছ?
হ্যাঁ, হয়ে যাবে। সেও হাজার-বারোশোর মতো পড়বে।
এত!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাণী একগুঁয়ে গলায় বলেছিল, হোক, কয়লার উনুনে আর আমি রাঁধব না।
ওখানে কয়লার উনুন প্রহিবিটেড, কেরোসিন নয়তো গ্যাস।
ডাইনিং টেবিল ছাড়া চলবে না। দেবু আর বাবু আলাদা ঘরে থাকবে। খাট চাই, পড়ার টেবিল চাই।
ওসব পরে হবে, টাকা জমিয়ে জমিয়ে করাব।
আবার কষ্ট করে চলতে হবে?
উপায় কী? অ্যাপেক্সের ধারের টাকা কোয়ার্টারলি শোধ করতে হবে না? তারপর আসবে ট্যাক্স, ইলেকট্রিক, সোসাইটির চাঁদা, সব নিয়ে মাসে অন্তত পাঁচ-ছশো ধরে রাখতে পারো কিংবা তারও বেশি। মাইনের টাকা থেকে এতসব দিতে হলে…
আবার কষ্ট করতে হবে। জীবনে সুখের মুখ দেখা আর…
এসব কথা এক রাত্রে হয়েছিল। তার পরদিনই অফিস থেকে ফিরে অরুণ দেখল পরিতোষ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
মামা কমিশনের টাকাটা তাহলে আমার কপালে আর নেই।
চট করে কি এসব করে ফেলা যায়।
কম করে রাখ…হাজার দশেক। মাসে চারশো টাকা…
কাল আসিস।
রাতে ওরা আবার আলোচনা করেছিল।
ওখানে গিয়েও কষ্ট করা, কী লাভ তাহলে ফ্ল্যাট কিনে। মানুষ উপরে উঠতে চায়, নীচের দিকে নামে না।
প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে হাত দেব না ভেবেছিলুম…আজ খোঁজ নিয়ে দেখলুম অফিসের সাত আট জন টাকা রেখেছে, জানতুমই না। হিমাংশুবাবুর ঝি পর্যন্ত চব্বিশ হাজার রেখেছে।
ঝিয়ের…চব্বিশ হাজার! এত?
ঝিয়ের ছেলে কারখানায় কাজ করত অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছল। দু-বছর ধরে কাঠখড় পুড়িয়ে হিমাংশুবাবুই কম্পেনসেশন চব্বিশ হাজার টাকা আদায় করে এনেছে। তারপর এখানে টাকা রাখার জন্য যা-কিছু করার সব করেছে, এখন সে-ঝি বস্তির ঘরে বসে মাসে মাসে প্রায় এক হাজার টাকা পাচ্ছে, ভাবতে পার? পনেরো টাকা মাইনের বাসনমাজা ঝি…
তুমি প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের সবটাই দাও।
বাণীর স্বরে তীব্রতা ছিল। সবটাই বরং বা সম্ভব হলে ধরনের দ্বিধা ছিল না। অরুণ পরদিন প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে টাকা তোলার জন্য দরখাস্ত করে। আড়াই মাস পর পরিতোষ একটা খাম দেয়, তাতে তার মাইনের থেকেও বেশি টাকা ছিল।
এখনও ইলেকট্রিক এল না, আজ কী সিনেমা আছে?
জানি না।
এখনও বৃষ্টি নামল না, ধানটান কেমন হবে কে জানে?
টিভিটা বিক্রি করে দাও।
অরুণ না শোনার ভান করল। বহু দূরের রাস্তা দিয়ে কয়েক জন মজুর মেয়ে-পুরুষ চলেছে। শাড়ির লালরংগুলো জমির মাটি ও গাছের পাতার মধ্যে চমৎকার সাম্যতা এনে দিয়েছে। এরকম কিছু-একটা তাদেরও থাকা উচিত ছিল, তাহলে লোভ সংবরণ করা যেত। অরুণ অবাক হল, লোভ শব্দটা এখনও বাণী বা সে ব্যবহার করেনি। হয়তো ভয়ে, কেননা তাহলেই ওটা ছোড়াছুড়ি হবে। তারা কেউই ঝগড়া করতে চায় না। এটা ঝগড়ার ব্যাপার নয়।
আমাদের খরচ কমাতে হবে। ভাবছি কাল থেকে আট টাকা হাতে নিয়ে বাজারে যাব। কুকুরের জন্য আর বাড়তি কেনা সম্ভব নয়।
ওতে আর ক-টাকা সাশ্রয় হবে।
যতটুকু হোক। এভাবেই কিছু কিছু করে ছাঁটতে হবে।
অরুণের চোয়ালে ও ঠোঁটে কাঠিন্য দেখে বাণী কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
কুকুরটাকে বিদেয় করলেই ভালো হয়।
বাবুর মনে লাগবে।
টিভিটা দরকার বাড়িতে সময় কাটাতে। আগে কী বিশ্রীই সন্ধে বেলাটা লাগত।
রাস্তা দিয়ে বাবা-মা দুই মেয়ের একটা পরিবার আসছে বসবাস-এর দিকে তাকাতে তাকাতে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর সারা বাড়িটাতে চোখ বোলাচ্ছে। কোনো ফ্ল্যাটে সম্ভবত ওদের আত্মীয় আছে। গেটের কাছে ওরা দাঁড়াল। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করছে।
তোমার জ্যাঠামশাইরা একদিন ফ্ল্যাট দেখতে আসবেন বলেছিলেন।
হ্যাঁ। সেই বেহালা থেকে আসা..জেঠিমার পক্ষে তিন-তলায় ওঠাও আর সম্ভব নয়। দীপু বলছিল বাংলাদেশ ধরার জন্য অ্যান্টেনায় কী-একটা লাগবে, এখানে অনেকেই লাগিয়েছে।
একদম নয়, কোনো খরচের মধ্যে আর যাওয়া নয়। দরকারটা কী? এভাবেই তো লোভেপড়ে…
অরুণ প্রায় অজান্তেই মুখ ফেরাল বাণীর দিকে এবং বাণীও ফেরাল তার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড দুজনের চাহনি বাঁধা রইল।
ওদের এবার বলতে হবে, এভাবে খরচ-টরচ করা আর সম্ভব নয়। শুধু বাজারই নয়, অন্যান্য ব্যাপারেও কমাতে হবে। অনেক কিছুই তো আমাদের আগে ছিল না।
তাহলে তুমিই ওদের বলে দিয়ো।
মেঝেতে টালি না বসিয়ে সিমেন্টের করালে হাজার ছয়-সাত বাঁচত।
আমি করাইনি, তুমি করিয়েছ।
বাণীর কষ শক্ত, গলায় ঝাঁজ। অরুণ অবসাদ বোধ করল। তারা ঝগড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরাম স্বাচ্ছন্দ্যর জন্য লোভী না হলে টাকাগুলো থাকত। বড়ো কষ্ট করে জমানো টাকা।
তখন অনেকেই বলেছিল গবরমেন্ট এ ব্যাবসা চালাতে দেবে না, কিছু-একটা করবে। বিশ্বাস করিনি। এত লোকের এত টাকা…
বাণীর কানে এসব কথা পৌঁছোল না। সে তখন ভাবছিল বসন্ত দাস স্ট্রিটের জীবনে আবার কী করে ফিরে যাবে? অন্ধকার ঝুলকালিভরা রান্নাঘর, শ্যাওলামাখা উঠোন কলঘর, ফোঁটা ফোঁটা কলের জল, হাজা ফাটা ঘরের মেঝে, দরদর ঘাম, ভ্যাপসা বিছানা, বালিখসা ভিজে দেয়াল, জানলার নীচে আস্তাকুঁড়, রাস্তায় দিনরাত বস্তির বাচ্চাদের চিৎকার, লাউডস্পিকার, বোমা নিয়ে খুনোখুনি..নানাবিধ গন্ধ-শব্দ-রং প্রাক্তন জীবন থেকে তালগোল পাকিয়ে হা-হা করে তার উপর আছড়ে পড়ছে এখন। প্রশস্ত, প্রশান্ত, আলোবাতাস-মাখানো জীবনের জন্যই সে যুদ্ধ করে গেছে। বসন্ত দাস স্ট্রিটে ফিরে যেতে হবে না ঠিকই। কিন্তু এই পরিসর, পরিচ্ছন্নতা, অবকাশ, নীরবতা পেয়েও হারাতে হবে। আবার কষ্ট আবার একটা যুদ্ধ। এখন মাইনের টাকাই সম্বল, তাই দিয়ে সব মেটাতে হবে। বাণী ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করল।
দরজায় ধাক্কা পড়ছে আর কুকুরের ডাক। বাবু ফিরেছে। বাণী দরজা খুলে দিতেই উত্তেজিত বাবু বলে উঠল, জান মা, কপিল আজ হাড় খেয়েছে। ওই যে চায়ের দোকানটা, বাসরাস্তায় ব্যাঙ্কের গায়ে টালির চাল-দেওয়া, ওর যে মালিক সে বলেছে মাংসের হাড়টাড় যা প্লেটে পড়ে থাকবে সব রেখে দেবে। আমাকে বলল একটা টিনের কৌটোমৌটো দিয়ে যেতে। স্কুল থেকে ফেরার সময় বাস থেকে ওখানে নেমে কৌটোটা নিয়ে বাড়ি আসব। আজ এই মোটা একটা হাড় ওকে দিয়েছিল, পারে নাকি চিবোতে! একটা লোক তখন মাংস খাচ্ছিল, একটা নরম হাড় ছুড়ে দিতেই ঝাঁপিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে খেল, দাঁতে বেশ জোর হয়েছে। ঘিয়ের কত টিন রয়েছে তো, একটা দেবে? আমার সঙ্গে বলু আর প্রদীপ্ত ছিল, ওরা বলেছে ওদের যেদিন মাংস হবে কপিলের জন্য হাড়গোড় রেখে দেবে।
বাণী বকুনি দিতে গিয়েও দিল না। শুধু বলল, এঁটোকাঁটা ভিক্ষে করে ক-দিন খাওয়াবে, তার থেকে ওকে বরং বিদেয় করাই উচিত।
কথাটা এতই হাস্যকর যে বাবু গ্রাহ্যে না এনে বলল, আচ্ছা, সব ফ্ল্যাটে গিয়ে যদি কপিলের জন্য রাখতে বলি? তাহলে নিশ্চয় এক বালতি হয়ে যাবে। অত খেতে পারবে না।
কুকুরটা ঘুরঘুর করছিল ঘর-বারান্দা। কয়েক বার ওকে মেঝে শুকতে দেখে বাবু ধমকে উঠল, না না এখানে নয়, বাথরুমে।
সে নিজে বাথরুমের ভিতরে গিয়ে ডাকতে লাগল, কাম কাম।
বাণী বারান্দায় আসতেই অরুণ মুখ না ফিরিয়ে বলল, সিগারেট ছেড়ে দেব, শ-খানেক টাকা সেভ হবে।
বাণী নিরুত্তর রইল। বাথরুমের থেকে বাবুর নির্দেশ শোনা যাচ্ছে: নো নো, এইভাবে এইভাবে বোসো। মার খাবে কিন্তু বলছি…
দূরের বাড়িগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। লোডশেডিংয়ের জন্য কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে। কিছু কাক ডাকাডাকি করে চুপ করে গেল। একটু পরে আলো জ্বলে উঠতেই ওরা ঘরে এসে বসল টিভিতে সিনেমা দেখার জন্য।
দু-দিন পর রান্নাঘরের সিঙ্কের নীচে একটা টিনে কিছু হাড় মাছের কাঁটা দেখে অরুণ ব্যাপারটা জানতে চায় এবং বাণী জানায়।
এইভাবে বাইরে থেকে চেয়ে আনলে লোকে ভাববে আমাদের বোধ হয় মাছ-মাংস খাওয়ার পয়সা নেই। এসব বন্ধ করো।
বাচ্চা ছেলে চেয়ে আনছে, এতে কে আর মনে করবে?
পরদিন বাণীকে সকালে ঘর মুছতে দেখে অরুণ প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। বাণী নিজেই বলল, সামান্য কাজের জন্য মাসে পঞ্চাশ টাকা করে দেওয়া…ছাড়িয়ে দিলুম। একটু খাটাখাটনি না করলে বাত ধরে যাবে।
সেই দিনই রাতে দেবু খাওয়ার টেবিলে হাত গুটিয়ে বসল।
রোজ রোজ দু-বেলা এই ডাল-ভাত, ভাত আর তরকারি ভালো লাগে? একটা ভাজা পর্যন্ত নেই, মাছ নেই।
ভালো না লাগলে খেয়ো না। মাসে চার কিলো সর্ষের তেল খরচ হয় এই কটা লোকের জন্য! এবার থেকে দু-কিলোর বেশি আর কিনব না। আগে তো এইরকমই রান্না হত, তখন মুখে রুচত কী করে?
গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে দেবু উঠে গেল। বাণী কষ্ট পেল এইভাবে কথা বলার জন্য। এখানে আসার পর এই প্রথম বসন্ত দাস স্ট্রিটের কণ্ঠস্বর তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।
টেপরেকর্ডারে বিলিতি বাজনার সুর বাজছে নীচু স্বরে। মাস ছয়েক আগে দেবুকে কিনে দিয়েছিল অরুণ। বাণী ঘরে ঢুকতেই দেবু বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে উপুড় হল। ঘরের অন্য কোণে খাটে বাবু ঘুমোচ্ছে। কুকুরটা তার পায়ের কাছে। বাণীকে দেখে এক বার মুখ তুলেই আবার কুন্ডলী পাকাল।
তোকে একটা কথা বলা দরকার।
সে ঠিক করেই ফেলেছে তাদের অবস্থা এবং ক্ষতির কথাটা দেবুকে এবার বলা দরকার। বয়স প্রায় আঠারো, বুঝতে পারবে।
বাণীর মাত্র দু-মিনিট লাগল দেবুকে বিস্ময়ে উঠে বসাতে।
বাবা ওখানে টাকা রেখেছিল। ও আর ফেরত পাবে না। আমার ক্লাসের এক বন্ধুর বাবার তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
এরপর বাণী দেখল কৈশোরের প্রান্ত থেকে দেবুর তাজা মুখটা ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে। কুঁজো হয়ে কাঁধ ঝুকিয়ে স্তিমিত দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। ও রেগে উঠল না, কিছুটা যেন উদাসীন হয়ে পড়েছে। সে ভেবেছিল অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে ছেলেকে, কেন তাদের টেনেটুনে চলতে হবে এবং কেন ভবিষ্যতেও কিছু রেখে যাওয়ার আর উপায় নেই এই ফ্ল্যাটটি ছাড়া।
কিন্তু কিছুই বলার দরকার হল না। খবরের কাগজে পড়েছে নিশ্চয়, শুনেছে অনেক। তবে প্রথমেই বলে উঠেছে মাথা খারাপ হওয়ার কথা কেন?
আমাদের এখন অন্যভাবে চলতে হবে, বুঝতেই তো পারছিস।
বাণী এইটুকু বলে বারান্দায় এল। ইজিচেয়ারে গল্পের বই পড়ছে অরুণ। বইটা হাতে-ধরা, চোখ সামনের অন্ধকারে। একটু ত্ৰস্তে সে বইটায় চোখ ফেরাল।
দূরের জানালার আলো কী সুন্দর লাগে দেখতে।
দেবুকে বলেছি।
কী বলল? কীভাবে নিল?
বাণী মাথা নাড়াল। অরুণ উদবিগ্ন চোখে সিধে হয়ে বসল।
ওর এক বন্ধুর বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তার মানে আমার হতে পারে…পাগল!
অরুণ হাসতে শুরু করল। হাসিটা যখন টানার ক্ষমতা হারিয়ে থেমে গেল তখন বলল, হিমাংশুবাবুর সেই ঝি কী বলে বেড়াচ্ছে জান? বাবু-ই তার টাকা মেরেছে, কাগজপত্তরে সই করিয়ে লিখিয়ে নিয়ে এখন বাবু বলছে কোম্পানি ফেল করেছে। ঝি রোজ এসে কান্নাকাটি, গালাগালি, শাপশাপান্ত করছে। হিমাংশুবাবুর অবস্থাটা ভাবো। ওর তো পাগল হওয়ার কথা, হয়নি।
নিজের টাকা গেলে হত।
অরুণ বইটা আবার চোখের সামনে তুলল। পার্কের থেকে ঝিঝিপোকার ডাক আসছে। দূরে হর্ন দিল ইলেকট্রিক ট্রেনের ইঞ্জিন। দেবু আবার টেপরেকর্ডার চালিয়েছে। বাণী বারান্দার কোনায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।
পর্দাটা সরানো। ঘরে অনেক সুবেশ নারী ও পুরুষ কোনো কারণে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে, অনেকের হাতে প্লেট। হঠাৎ দমকা সমস্বরে হাসি, চেঁচিয়ে ওঠা একক কণ্ঠ, উজ্জ্বল আলো, টেবিলে রজনিগন্ধার গোছা। এইসবের মধ্যে বাচ্চাটিকে সে দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাকে বার দুয়েক দেখা গেল ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবিতে। একেবারে অন্য চেহারা; গলায় মোটা বেলফুলের মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, বরের মতো লাগছে। হয়তো বিবাহবার্ষিকী কিংবা জন্মদিন।
বাণী মুখ ফিরিয়ে অরুণের দিকে তাকাল। দেবুর বন্ধুর বাবা পাগল হয়ে গেছে। সে আরও নিবিষ্ট হয়ে দেবুর বাবার দিকে তাকাল। একইরকম মনে হচ্ছে, বসন্ত দাস স্ট্রিটেরই লোকটা।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বাণীর। দালানে আলো জ্বলছে। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে অরুণ দাঁড়িয়ে। তাকাচ্ছে এধার-ওধারলাইম পানিংয়ের শঙ্খ মসৃণ দেয়ালে হাত বুলোল, উবু হয়ে মার্বেলাইট টালির মেঝেয় হাত বুলোল, হাত বাড়িয়ে পর্দাটা মুঠোয় ধরে অনেকক্ষণ নকশার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রেফ্রিজারেটর, ডাইনিং টেবিল, টিভি সেট, পপার্সেলিনের বেসিন, ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ড ছুঁয়ে ছুঁয়ে আনমনে দালানটায় ঘুরতে লাগল। এক বার রান্নাঘরের দরজা খুলে পাথরের টেবলের উপর নিকেলের ঝকঝকে হটপ্লেটের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। এরপর সে দালানের মাঝে দাঁড়িয়ে আবার প্রত্যেকটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার দু-চোখে অবিশ্বাস, সন্দেহ।
কয়েক দিন পর দেবু জানাল সে একটা টিউশনি পেয়েছে, ক্লাস থ্রি-র ছাত্র, ষাট টাকা মাইনে।
শুনে অরুণ বলল, স্বাবলম্বী হওয়াই তো উচিত, তোর বয়সেই আমি রোজগারে নেমেছি, তবে নিজের পড়ার যেন ক্ষতি না হয়।
বাণীকে সে বলল, আর বছর দশেক, তারপর এই ফ্ল্যাটের জন্য যা-কিছু ধারদেনা ওকেই তো টানতে হবে। অবশ্য আমি মরে গেলে অ্যাপেক্সের টাকাটা আর দিতে হবে না, ইনশিয়ার করানো আছে।
একথা শুনে বাণী বা দেবু কোনো মন্তব্য করল না। রাতে চাপা গলায় বাবু জানতে চায়, যাট টাকা নিয়ে কী করবি রে দাদা?
পড়ার ব্যাপারে আর বাবার কাছ থেকে কিছু পোব না।
কপিলের জন্য একটা চিরুনি কিনে দিবি?
দোব, ওর নামটা এবার বদলা।
প্রবল বৃষ্টিতে বাস চলাচল প্রায় বন্ধ হওয়ায় অরুণ জল ভেঙে ভিজতে ভিজতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। কয়েক দিন সর্দিজ্বরে ভুগে অফিসে গিয়েই শুনল কাজ করতে করতে হিমাংশুবাবুর বুকে ব্যথা ওঠায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানে সিট না পাওয়ায় নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে। অফিসেরই খরচে। অরুণ জেনে নিল নার্সিং হোমটা বসবাস-এর কাছেই। অফিসের অনেকেই দেখে এসেছে।
টেবিলে মাথা রেখে অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছল..স্ট্রোক হয়নি, হাই ব্লাডপ্রেশার আছে, দুশ্চিন্তায় ভাবনায় এইসব হয়। ভাবলুম এক বার দেখে আসি কিন্তু মাঝপথে আর নামতে ইচ্ছে করল না, রোববার দেখে একদিন যাব।
বাণী মৃদু উদবেগ বোধ করল। ব্লাডপ্রেশার অরুণের আছে তবে নীচুর দিকে। বন্ধুর বাবা সম্পর্কে দেবুকে প্রায়ই সে জিজ্ঞাসা করে। ইতিমধ্যে বসবাস-এর এক সদস্য ক্যানসারে মারা গেলেন। দীর্ঘদিনই ভুগছিলেন। বাকি উনচল্লিশ ফ্ল্যাটের লোকেরা ব্যাপারটা প্রায় লক্ষই করল না। শুধু চার তলার দুই বারান্দার মধ্যে কথাবার্তার টুকরো বাণীর কানে এল— …পুরো টাকাটাই তো উনি দিয়ে দিয়েছেন। যদি না দিতেন এখন আর শশাধ করার দরকার হত না, কত হাজার টাকা তা হলে রাখতে পারতেন ভাবুন তো! …উনি তো ঠাট্টা করে বলেন, এখন যদি মরে যাই ইনশিয়োরেন্সই শোধ করবে, হাজার চল্লিশ বেঁচে যাবে।
খরচ কমাবার জন্য বাণী পরের সাত দিন একের-পর-এক ব্যবস্থা নিল। ট্রানজিস্টরের ব্যাটারি ফুরিয়েছে কেনা হয়নি; লন্ড্রিতে আর কিছু যায় না, সবই নিজে কাচছে; ফিরিওয়ালা ।দেখলেই মাথা নেড়ে দরজা বন্ধ করে দেয়; অরুণের দূরসম্পর্কের কাকার মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়েও তারা যায়নি, তাতে অন্তত একশো টাকা বেঁচেছে; জানালার কাচ বাবু ভাঙল কিন্তু বদলায়নি; জিরজিরে তোয়ালে দুটো আর বদল না করলেই নয়, গামছা কিনল। চা কিনেছে অর্ধেক দামের। তার এই ব্যয়সংকোচন চেষ্টার কোনো প্রতিবাদ উঠল না সংসারে বরং ঠাট্টা করেই দেবু বলল, লোডশেডিং মাকে অনেক সাহায্য করছে ইলেকট্রিক বিল কমিয়ে দিয়ে।
আগের মতোই সাজানো গোছানো অথচ কোথায় যেন একটা ফাটল, যেখান থেকে প্রাণরস চুইয়ে চুইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অরুণ অনুভব করে, বাণীও সেটা জানে। সবাই কথা কম বলে। রুটিন মাফিক কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে, অযথা অকারণ কিছু নেই। শুধু কুকুরটার চেঁচামেচি, ছোটাছুটি জিইয়ে রেখেছে মরে আসা উচ্ছাসকে। বাবু তার কপিলের জন্য হাড়গোড় উচ্ছিষ্ট জোগাড় করে আনছে। বসবাস-এর ছেলেরা পিকনিকে যাবে, সে দশ টাকা চেয়েছিল কিন্তু বাণী দেয়নি। ওর মুখ তখন যে-কষ্ট বাণীকে দিয়েছিল সেটা অরুণও পেয়েছে, কেননা তারপর বাবু চুপিচুপি তার কাছেও চেয়েছিল। সেও প্রত্যাখ্যান করে। তখন অরুণের মনে হয়েছিল, তারা যেন বাড়াবাড়িই করছে। তাদের কোনো অধিকার নেই সন্তানদের পীড়ন করার। মানুষ উপরেই উঠতে চায়, নীচের দিকে নামে না, কথাটা তাকে উত্তেজিত করেছিল। কিন্তু এই কি উপরে ওঠা?
কারণটা খুঁজতে খুঁজতে প্রতিবারই সে একটা কানাগলির দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আর বাণী দুজনেই সমান দায়ী, যে-কারণে তারা আর এই মার খাওয়ার প্রসঙ্গ তোলে না, নীরবে প্রাক্তন জীবনে ফিরে যাচ্ছে মুখ নামিয়ে। বারান্দায় বসে গাছ, পাখি, প্রজাপতি, ঘুঘুর ডাক, ধু-ধু মাঠ বা তৈরি-হওয়া বাড়ি কি মাটির গন্ধ এখন তার ভালো লাগে না। এসব শুধুই জড়বস্তু, ওদের কাছ থেকে কিছুই ফিরে আসে না। রোববার হিমাংশুবাবুকে এক বার দেখতে যাব। এই বলে অরুণ খাবার টেবিল থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে লাগল।
আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আমিও বরং তোমার সঙ্গে যাব। অসুস্থ মানুষ, লোকজন দেখলে মনটা ভালো থাকবে।
তাহলে আমিও যাব। বাবু বলে উঠল। আমি কখনো হাসপাতাল দেখিনি।
নার্সিং হোম, তফাত আছে হাসপাতালের সঙ্গে।
ওরা তিন জন রবিবার বেরোল। দেবু তার বন্ধুর বাড়ি গেছে। ফিরবে সন্ধ্যার পর। বারান্দায় কুকুরটিকে বেঁধে দরজায় চাবি দিয়ে ওরা রওনা হল। বাসে মিনিট পাঁচেকের পথ। ফাঁকা চওড়া নতুন রাস্তা। হু হু করে বাস যায়।
অরুণ অফিস থেকে ঘরের নম্বরটা জেনেই এসেছিল। হিমাংশুবাবু বিছানায় বসে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। অরুণের থেকে বয়সে কিছু ছোটো, শীর্ণ, চুলের অর্ধেক পাকা। লম্বাটে মুখে গভীর কয়েকটা ভাঁজ, শান্ত চোখ। খাটের পাশে টুলে বয়স্ক একটি লোক বসে।
অরুণদের দেখে হিমাংশু হাসল।
জানালা দিয়ে দেখেছি আপনারা আসছেন। ..খা.টের উপরই বসুন, টুল ওই একটাই।
আমার স্ত্রী আর ছোটোছেলে বাবু, আছেন কেমন?
ইতিমধ্যে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে টুলটা ঠেলে দিয়েছে বাণীর দিকে।
আমার মেজো ভাগনে,…ভালোই আছি। একটা অ্যাটাক হয়েছে, ফাস্ট, তবে আমাকে ডাক্তাররা কিছু বলছে না। না বললেও বুঝতে ঠিকই পারি। অফিস থেকে মাঝে মাঝে ওরা আসে, আজ বউ আসেনি ওরও শরীরটা খারাপ,…রোজ রোজ আসতে কি ভালো লাগে কারুর, নবদম্পতি তো নয়।
হিমাংশুবাবু অবশ্য খুব জোরে হাসবার চেষ্টা করল না। অরুণ জানালা দিয়ে দেখল আকাশের একদিকে ঘন মেঘ দ্রুত আর একদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিন এই সময় কালববাশেখির মতো ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে।
খুঁটিয়ে ঘরের জিনিসগুলো লক্ষ করার পর বাবু গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাণী কয়েকটা মামুলি কথা বলল। এক নার্স এসে হিমাংশুবাবুকে ক্যাপসুল খাইয়ে গেল। তারা পাঁচ টাকার সন্দেশ কিনে এনেছিল। বাক্সটা খুলে হিমাংশুবাবু ডাকল বাবুকে। সে ইতস্তত করে বাবা-মার দিকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছা নেই কিন্তু অসুস্থ লোকটি খুশি হবে ভেবে বাণী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ওর ভাগনে আকাশের দিকে আড়চোখে বার কয়েক তাকিয়ে বিদায় নিল।
আপনার সেই ঝিয়ের খবর কী? বলেছিলেন রোজ খুব উৎপাত করে। এখানে কটা দিন তাহলে শান্তিতেই ছিলেন বলুন?
হিমাংশুবাবু বার কয়েক জানালা দিয়ে আকাশে তাকাল। কপালের কুঞ্চন ঝিয়ের অথবা আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির জন্য কি না বোঝা গেল না।
উৎপাত ঠিক নয়…আসলে দায়ী তো আমিই। ওকে টাকা রাখতে আমিই পরামর্শ দিয়েছি। অশিক্ষিত, গরিব অসহায়…মরাল রেসপন্সিবিলিটি তো এড়াতে পারি না। মাসে মাসে দুশো করে টাকা দিয়ে শোধ করব, দু-মাস দিয়েছিও।
অরুণ ও বাণী বহু দূরে চমকানো বিদ্যুৎ ও নির্ঘোষের ফলে নিশ্চয় এই রকম বোধরহিতের মতো তাকিয়ে থাকল না।
আপনি টাকা শোধ করবেন? চব্বিশ হাজার!
বাণী তার সঙ্গত বিস্ময় প্রকাশ করল। অরুণও যোগ দিল।
হয় নাকি। এত বছর ধরে কষ্ট করে..ধ্যাত। এ আপনার বাড়াবাড়ি।
হিমাংশুবাবু তার শীর্ণ আঙুলগুলো দিয়ে নিজের দুই গালে চেপে ঝুঁকে বসল বালিশ কোলে নিয়ে।
আই ওয়ান্ট টু এনজয় মাইসেলফ। নিজেকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখতে চাই অরুণবাবু। আমাকে অবশ্যই বাঁচতে হবে আরও কিছু বছর…
চব্বিশ হাজার শোধ না হওয়া পর্যন্ত।
চব্বিশ নয়, আর একটু কম। মাস ছয়েক পেয়েছে তো, সেটা বাদ যাবে।
বৃষ্টি হতে পারে নাও হতে পারে এমন এক পরিবেশের মধ্যে ওরা বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারটা প্রায় সন্ধ্যার মতো। দুটো বাস এসে চলে গেল, তাদের গন্তব্যের নয়।
আর দেরি করা নয়, এবার যেটা আসবে উঠে পড়ব, কাছাকাছি তো পৌঁছোনো যাবে।
অরুণ কথাটা শেষ করামাত্র একটা বাস এল। অন্য দিকে যাবে, তার মোড় ঘুরবে যেখানে, বসবাস হেঁটে সেখান থেকে মিনিট চারের পথ। ওরা উঠল। টিপ টিপ বৃষ্টি, এলোমেলো হাওয়ায় মাছির মতো উড়ে ওদের গায়ে বসল বাস থেকে নামামাত্র।
পৌঁছোতে পৌঁছোতে ভিজে যাবে, একটু জোরে হাঁটো।
গতি দ্রুত করতে গিয়ে বাণীর জীর্ণ চটির স্ট্র্যাপ ছিড়ল। হাতে তুলে নিল।
বরং পাশের এই মাঠটা দিয়ে…
অরুণকে অনুসরণ করে বাণী ও বাবু মাঠে নামল।
বৃষ্টি আসছে কেমন দ্যাখ।
মাঠের ওপারে বহু দূরে গাছপালা বাড়ির ঝাপসা পর্দা ঝুলছে।
বাণী সেদিকে তাকিয়ে চলতে চলতে হোঁচট খেল।
এগিয়ে আসছে, আমাদের ধরে ফেলবে।
বাবা দ্যাখো।
তীক্ষ্ণ তীব্র স্বরে ওরা দুজন থমকে দাঁড়িয়ে বাবুর তোলা হাতের নির্দেশের দিকে তাকাল। দূরে বসবাস দেখা যাচ্ছে। আধো অন্ধকারে জমি গাছপালা আকাশের মাঝখানে ফিকে কমলা রঙের চৌকো একটা বাড়ি। রুপালি-রেলিং-ঘেরা ছোটো ছোটো বারান্দা। বন্ধ কাচের জানলায় ঘরের আলো। অ্যান্টেনাগুলো শীর্ণ আঙুল মেলেছে আকাশের দিকে ভিক্ষুকের মতো। একটি মানুষও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অরুণ অবাক হয়ে ভাবল, এমন করে তো বাড়িটাকে দেখিনি, অদ্ভুত তো।
কপিল কপিল। বাবা বারান্দায় কপিলকে দ্যাখো, নাচছে।
ক্ষীণভাবে ভেসে আসা কুকুরের ডাক যেন ওরা শুনতে পেল। বাবু দৌড়োচ্ছে।