“ওম ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎসবিতুর্ভরেণ্যম
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।”
আমিই সেই বিদূষী বৈদিক নারী,
যে শরীরে উপবীত ধারণ করে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে যজ্ঞবেদীতে বসে পবিত্র অগ্নিকুণ্ডে ঘৃতাহুতি দিয়েছি ,
আমিই সেই অসহায় স্ত্রী,
যার সতীত্বকে সন্দেহ করে
অগ্নিপরীক্ষায় বাধ্য করেছো তোমরা,
মাতৃহারা করেছ আমার লবকুশকে
আমিই সেই অভাগী কুমারী জননী,
যে বাধ্য হয়েছি জন্মের পরেই
সদ্যজাতকে জলে ভাসিয়ে দিতে!
তোমাদের ভয়ে কেড়ে নিয়েছি কর্ণের মাতৃপরিচয়!
আমিই সেই পূণ্যবতী সতী নারী
যাকে তোমরা তার ইচ্ছার বিরদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মেরেছো চিতার আগুনে সতীদাহের নামে…
বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপলেও
ঢাকঢোল এর ঔদ্ধত্বে চাপা দিতে চেয়েছো আমার হাহাকার,আমার আর্তনাদ!
আমিই সেই পতিতা নারী
যার শরীর বেচার ক্ষুন্নিবৃত্তিকে গালি দিয়ে
অসম্মানিত করেছো তোমরা প্রতি মূহুর্তে…
আমিই সেই অবলা নারী
যাকে কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে
অশিক্ষার আভিজাত্যে ঘোমটার আবরণে
ভোগ্য বস্তু করে পায়ের তলায় দাসি করে রাখতে চেয়েছো দিনের পর দিন !
কিন্তু পারোনি!
কিছু যুগপুরুষের হার না মানা বিস্ময়কর দৃঢ়তার কাছে তোমরা পরাজিত!
সেই আলো মানব রাজা রামমোহন রায়,
সেই আলো মানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
যাদের সশ্রদ্ধ নাম উচ্চারণে গর্বিত হয় প্রতিটি নারী হৃদয়…
আমিই সেই পুণ্যাত্মা গর্ভধারিনী,
যার ভূমিষ্ট সন্তান ক্ষুদিরাম সুভাষচন্দ্র বসু,
বিনয় বাদল দিনেশ
যারা নিজের প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা!
আমিই সেই দশভুজা নারী যে এখন উড়োজাহাজ চালাই,
রাজ্য চালাই,রাষ্ট্র চালাই,মহাকাশে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাই..
তবু…
তবু এখনো কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয় আমার ভারতবর্ষে,
এখনো এক দিনের শিশু,কন্যা হওয়ার অপরাধে
বাবার হাতে খুন হয়ে যায়।
কিংবা খুন হয় মায়ের জঠরে!
কিংবা পড়ে থাকে কোনও ফুটপাতে অথবা নোংরা ডাস্টবিনে!
এখনও ছমাসের শিশু কন্যা ধর্ষিত হয়,
বারো থেকে বাহাত্তর বছর বয়স জুড়ে ধর্ষন আঁকা হয় বাসের ভিতর,পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে,
জঙ্গলে কিংবা কোনও পোড়ো ফ্যাক্টরিতে,
রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত শরীর পড়ে থাকে ডোবার জলে,নদীর চরে, ভুট্টা খেতে অথবা কালভার্টের জমাট বাঁধা অন্ধকারে!
এখনো বধূকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়
কালো হওয়ার অপরাধে,
পণের টাকা না দেওয়ার অজুহাতে,
চার্চে যাওয়ার প্রতিবাদে!
অপরাধীর সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাট করার জন্য!
হাত কেটে নেওয়া হয় সামান্য স্বাক্ষর করার সাজা দেওয়ার আছিলায়!
আমিই সেই দুঃসাহসী প্রেমিকা যে বাবা মায়ের মতামতকে অগ্রাহ্য করে তোমাকে ভালবেসে
তোমাকে বিয়ে করার উদ্দ্যেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিলাম,
কিন্তু তোমার পৈশাচিক নৃশংসতা আমার
শরীরকে টুকরো টুকরো করে বন্য জন্তুদের খাওয়াতে দ্বিধাবোধ করেনি একটুও…
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেও তোমরা তুষ্ট হও নি!
তাই এই একবিংশ শতকেও তোমাদের যুদ্ধে নগ্নতাকে অস্ত্র করে আমার পোশাক খুলে হাঁটাও রাজপথে!
কোনো কৃষ্ণ আসে না লজ্জা নিবারণের জন্য…
কেবল শত শত দুর্যোধন লোলুপ দৃষ্টি রাখে আমার গোপন অঙ্গে! স্পর্শ করতে চায় তাদের জন্মস্থান!
নাহ্ আমি দুর্গা হয়ে ত্রিশূল ধরতে পারিনি,
কালী হয়েও এক কোপে অন্যায়ের মুন্ডু আলাদা করতে পারিনি তার ধড় থেকে!
অথচ আমিই তোমার স্ত্রী, তোমার শয্যাসঙ্গিনী…
তোমার প্রেয়সী, তোমার কন্যা,তোমার জননী…
আমিই তোমাকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে প্রাণান্তকর প্রসববেদনা সহ্য করে পৃথিবীর আলো দেখাই,
তারপর নিজের সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমার স্তন্যসুধায়, আমার সোহাগে পরম যত্নে তোমাকে মানুষ করার চেষ্টা করি…
তোমার হাত ধরে হাঁটতে শেখাই
বর্ণপরিচয় এর সাথে আলাপ করিয়ে দিই,
আমিই তোমার মঙ্গল কামনায় উপোস করে ফোঁটা দিই হেমন্তে,রাখি বাঁধি সৌভাগ্য পূর্ণিমায়!
বিনিময়ে পাই শারীরিক আঘাত,
একাকীত্ব,অবহেলা,লাঞ্ছনা,দোষারোপ!
আমিই সেই হতভাগী মা,
বয়স হলেই যাকে ফেলে দিয়ে যাও কোনও প্ল্যাটফর্মে, জনবহুল রাস্তায় কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে,অথবা
ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো!
এক মুঠো ভাতের অপেক্ষায় তোমার পথ চেয়ে বসে থাকি দিনের পর দিন ভিক্ষার থালা হাতে!
নাহ্ আমি মানুষ করতে পারিনি তোমায়..
এ আমার অক্ষমতা!
সরকার অনেক কিছু করেছে আমার জন্য
কিন্তু সমাজের মনোভাব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের মানসিকতা সমাজের চরিত্র কিছুই কি পাল্টেছে?
পোশাকে আধুনিক হলেও মন থেকে কি আধুনিক হতে পেরেছি আমরা?
না পারি নি! আলবাত পারি নি!
অলিতে গলিতে অ্যাসিডে ঝলসানো মুখগুলো শুধু সে কথাই প্রমাণ করে দেয় বার বার,
তোমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালে তবেই
আমি সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকার টুকু পাবো!
নয়তো এই বিকৃত চেহারা মনে করিয়ে দেবে
আমি তোমার বিপক্ষে গিয়েছিলাম
আমি স্বাধীন হতে চেয়েছিলাম…
যে স্বাধীনতায় আমার আনন্দ ছিল..
যে স্বাধীনতায় আমার প্রেম ছিল…
যে স্বাধীনতায় আমার মুক্তি ছিল…
সেই যে রবি ঠাকুর লিখেগেছেন
“এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে…
এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”
এই আমিই গার্গী,আমিই মৈত্রেয়ী,আমিই সীতা,আমিই কুন্তী,আমিই প্রভাবতী,আমিই ভগবতী,আমিই দ্রৌপদী, আমিই নির্ভয়া,আমিই মনীষা, আমিই কামদুনি আমিই হাসরাত আমিই হাঁসখালি আমিই মনিপুর আমিই মালদা