আনন্দমঠ – ৩য় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ
কাল ৭৬ সাল ঈশ্বরকৃপায় শেষ হইল। বাঙ্গালার ছয় আনা রকম মনুষ্যকে, – কত কোটী তা কে জানে, -যমপুরে প্রেরণ করাইয়া সেই দুর্বৎসর নিজে কালগ্রাসে পতিত হইল। ৭৭ সালে ঈশ্বর সুপ্রসন্ন হইলেন। সুবৃষ্টি হইল, পৃথিবী শস্যশালিনী হইল, যাহারা বাঁচিয়া ছিল, তাহারা পেট ভরিয়া খাইল। অনেকে অনাহারে বা অল্পাহারে রুগ্ন হইয়াছিল, পূর্ণ আহার একেবারে সহ্য করিতে পারিল না। অনেকে তাহাতেই মরিল। পৃথিবী শস্যশালিনী, কিন্তু জনশূন্যা। গ্রামে গ্রামে খালি বাড়ী পড়িয়া পশুগণের বিশ্রামভূমি এবং প্রেতভয়ের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। গ্রামে গ্রামে শত শত উর্বর ভূমিখণ্ডসকল অকর্ষিত, অনুৎপাদক হইয়া পড়িয়া রহিল, অথবা জঙ্গলে পুরিয়া গেল। দেশ জঙ্গলে পূর্ণ হইল। যেখানে হাস্যময় শ্যামল শস্যরাশি বিরাজ করিত, যেখানে অসংখ্য গো-মহিষাদি বিচরণ করিত, যে সকল উদ্যান গ্রাম্য যুবক-যুবতীর প্রমোদভূমি ছিল, সে সকল ক্রমে ঘোরতর জঙ্গল হইতে লাগিল। এক বৎসর, দুই বৎসর, তিন বৎসর গেল। জঙ্গল বাড়িতে লাগিল। যে স্থান মনুষ্যের সুখের স্থান ছিল, সেখানে নরমাংসলোলুপ ব্যাঘ্র আসিয়া হরিণাদির প্রতি ধাবমান হইতে লাগিল। যেখানে সুন্দরীর দল অলক্তাঙ্কিতচরণে চরণভূষণ ধ্বনিত করিতে করিতে, বয়স্যার সঙ্গে ব্যঙ্গ করিতে করিতে, উচ্চ হাসি হাসিতে হাসিতে যাইত, সেইখানে ভল্লুকে বিবর প্রস্তুত করিয়া শাবকাদি লালনপালন করিতে লাগিল। যেখানে শিশুসকল নবীন বয়সে সন্ধ্যাকালের মল্লিকাকুসুমতুল্য উৎফুল্ল হইয়া হৃদয়তৃপ্তিকর হাস্য হাসিত, সেইখানে আজি যূথে যূথে বন্য হস্তিসকল মদমত্ত হইয়া বৃক্ষের কাণ্ডসকল বিদীর্ণ করিতে লাগিল। যেখানে দুর্গোৎসব হইত, সেখানে শৃগালের বিবর, দোলমঞ্চে পেচকের আশ্রয়, নাটমন্দিরে বিষধর সর্পসকল দিবসে ভেকের অন্বেষণ করে। বাঙ্গালায় শস্য জন্মে, খাইবার লোক নাই ; বিক্রেয় জন্মে, কিনিবার লোক নাই ; চাষায় চাষ করে, টাকা পায় না – জমীদারের খাজনা দিতে পারে না ; জমীদারেরা রাজার খাজনা দিতে পারে না। রাজা জমীদারী কাড়িয়া লওয়ায় জমীদারসম্প্রদায় সর্বহৃত হইয়া দরিদ্র হইতে লাগিল। বসুমতী বহুপ্রসবিনী হইলেন, তবু আর ধন জন্মে না। কাহারও ঘরে ধন নাই। যে যাহার পায়, কাড়িয়া খায়। চোর ডাকাতেরা মাথা তুলিল, সাধু ভীত হইয়া ঘরের মধ্যে লুকাইল।
এদিকে সন্তানসম্প্রদায় নিত্য সচন্দন তুলসীদলে বিষ্ণুপাদপদ্ম পূজা করে, যার ঘরে বন্দুক পিস্তল আছে, কাড়িয়া আনে। ভবানন্দ বলিয়া দিয়াছিলেন “ভাই! যদি এক দিকে এক ঘর মণিমাণিক্য হীরক প্রবালাদি দেখ, আর এক দিকে একটা ভাঙ্গা বন্দুক দেখ, মণিমাণিক্য হীরক প্রবালাদি ছাড়িয়া ভাঙ্গা বন্দুকটি লইয়া আসিবে |”
তার পর, তাহারা গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে, বলে, ভাই, বিষ্ণুপূজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড় করিয়া, মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্বস্ব লুঠ করিয়া নূতন বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুঠের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লোকে প্রীত হইলে বিষ্ণুমন্দিরে আনিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লোকে দেখিল, সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে। বিশেষ মুসলমানরাজ্যের অরাজকতায় ও অশাসনে সকলে মুসলমানের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুধর্মের বিলোপে অনেক হিন্দুই হিন্দুত্ব স্থাপনের জন্য আগ্রহচিত্ত ছিল। অতএব দিনে দিনে সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবানন্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া দিগ্দিগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল। যেখানে রাজপুরুষ পায়, ধরিয়া মারপিট করে, কখন কখন প্রাণবধ করে, যেখানে সরকারী টাকা পায়, লুঠিয়া লইয়া ঘরে আনে, যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায়, দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে। স্থানীয় রাজপুরুষগণ তখন সন্তানদিগের শাসনার্থে ভূরি ভূরি সৈন্য প্রেরণ করিতে লাগিলেন ; কিন্তু এখন সন্তানেরা দলবদ্ধ, শস্ত্রযুক্ত এবং মহাদম্ভশালী। তাহাদিগের দর্পের সম্মুখে মুসলমান সৈন্য অগ্রসর হইতে পারে না। যদি অগ্রসর হয়, অমিতবলে সন্তানেরা তাহাদিগের উপর পড়িয়া, তাহাদিগকে ছিন্নভিন্ন করিয়া হরিধ্বনি করিতে থাকে। যদি কখনও কোন সন্তানের দলকে যবনসৈনিকেরা পরাস্ত করে, তখনই আর একদল সন্তান কোথা হইতে আসিয়া বিজেতাদিগের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া হরি হরি বলিতে বলিতে চলিয়া যায়। এই সময়ে প্রথিতনামা, ভারতীয় ইংরেজকুলের প্রাত:সূর্য ওয়ারেন হেষ্টিংস সাহেব ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনরল। কলিকাতায় বসিয়া লোহার শিকল গড়িয়া তিনি মনে মনে বিচার করিলেন যে, এই শিকলে আমি সদ্বীপা সসাগরা ভারতভূমিকে বাঁধিব। একদিন জগদীশ্বর সিংহাসনে বসিয়া নি:সন্দেহে বলিয়াছিলেন, তথাস্তু। কিন্তু সে দিন এখন দূরে। আজিকার দিনে সন্তানদিগের ভীষণ হরিধ্বনিতে ওয়ারেন হেষ্টিংসও বিকম্পিত হইলেন।
ওয়ারেন হেষ্টিংস প্রথমে ফৌজদারী সৈন্যের দ্বারা বিদ্রোহ নিবারণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ফৌজদারী সিপাহীর এমনি অবস্থা হইয়াছিল যে, তাহারা কোন বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের মুখেও হরিনাম শুনিলে পলায়ন করিত। অতএব নিরুপায় দেখিয়া ওয়ারেন হেষ্টিংস কাপ্তেন টমাস নামক একজন সুদক্ষ সৈনিককে অধিনায়ক করিয়া একদল কোম্পানির সৈন্য বিদ্রোহ নিবারণ জন্য প্রেরণ করিলেন।
কাপ্তেন টমাস পৌঁছিয়া বিদ্রোহ নিবারণের অতি উত্তম বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। রাজার সৈন্য ও জমীদারদিগের সৈন্য চাহিয়া লইয়া, কোম্পানির সুশিক্ষিত সদস্ত্রযুক্ত অত্যন্ত বলিষ্ঠ দেশী বিদেশী সৈন্যের সঙ্গে মিলাইলেন। পরে সেই মিলিত সৈন্য দলে দলে বিভক্ত করিয়া, সে সকলের আধিপত্যে উপযুক্ত যোদ্ধৃবর্গকে নিযুক্ত করিলেন। পরে সেই সকল যোদ্ধৃবর্গকে দেশ ভাগ করিয়া দিলেন ; বলিয়া দিলেন, তুমি অমুক প্রদেশে জেলিয়ার মত জাল দিয়া ছাঁকিতে ছাঁকিতে যাইবে। যেখানে বিদ্রোহী দেখিবে, পিপীলিকার মত তাহার প্রাণ সংহার করিবে। কোম্পানির সৈনিকেরা কেহ গাঁজা, কেহ রম মারিয়া বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া সন্তানবধে ধাবিত হইল। কিন্তু সন্তানেরা এখন অসংখ্য অজেয়, কাপ্তেন টমাসের সৈন্যদল চাষার কাস্তের নিকট শস্যের মত কর্তিত হইতে লাগিল। হরি হরি ধ্বনিতে কাপ্তেন টমাসের কর্ণ বধির হইয়া গেল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
তখন কোম্পানির অনেক রেশমের কুঠি ছিল। শিবগ্রামে ঐরূপ এক কুঠি ছিল। ডনিওয়ার্থ সাহেব সেই কুঠির ফ্যাক্টর অর্থাৎ অধ্যক্ষ ছিলেন। তখনকার কুঠিসকলের রক্ষার জন্য সুব্যবস্থা ছিল। ডনিওয়ার্থ সাহেব সেই জন্য কোন প্রকারে প্রাণ রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার স্ত্রী-কন্যাদিগকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন এবং তিনি স্বয়ংও সন্তানদিগের দ্বারা উৎপীড়িত হইয়াছিলেন। সেই প্রদেশে এই সময়ে কাপ্তেন টমাস সাহেব দুই চারি দল ফৌজ লইয়া তশরিফ আনিয়াছিলেন। এখন কতকগুলা চোয়াড়, হাড়ি, ডোম, বাগদী, বুনো সন্তানদিগের উৎসাহ দেখিয়া পরদ্রব্যাপহরণে উৎসাহী হইয়াছিল। তাহারা কাপ্তেন টমাসের রসদ আক্রমণ করিল। কাপ্তেন টমাসের সৈন্যের জন্য গাড়ি গাড়ি বোঝাই হইয়া উত্তম ঘি, ময়দা, মুরগী, চাল যাইতেছিল – দেখিয়া ডোম বাগদীর দল লোভ সম্বরণ করিতে পারে নাই। তাহারা গিয়া গাড়ি আক্রমণ করিল, কিন্তু কাপ্তেন টমাসের সিপাহীদের হস্তস্থিত বন্দুকের দুই চারিটা গুঁতা খাইয়া ফিরিয়া আসিল। কাপ্তেন টমাস তৎক্ষণেই কলিকাতায় রিপোর্ট পাঠাইলেন যে, আজ ১৫৭ জন সিপাহী লইয়া ১৪,৭০০ বিদ্রোহী পরাজয় করা গিয়াছে। বিদ্রোহীদিগের মধ্যে ২১৫৩ জন মরিয়াছে, আর ১২৩৩ জন আহত হইয়াছে। ৭ জন বন্দী হইয়াছে। কেবল শেষ কথাটি সত্য। কাপ্তেন টমাস, দ্বিতীয় ব্লেনহিম বা রসবাকের যুদ্ধ জয় করিয়াছি মনে করিয়া, গোঁপ দাড়ি চুমরাইয়া নির্ভয়ে ইতস্তত: বেড়াইতে লাগিলেন। এবং ডনিওয়ার্থ সাহেবকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন যে, আর কি, এক্ষণে বিদ্রোহ নিবারণ হইয়াছে, তুমি স্ত্রী-পুত্রদিগকে কলিকাতা হইতে লইয়া আইস। ডনিওয়ার্থ সাহেব বলিলেন, “তা হইবে, আপনি দশ দিন এখানে থাকুন, দেশ আর একটু স্থির হউক, স্ত্রী-পুত্র লইয়া আসিব |” ডনিওয়ার্থ সাহেবের ঘরে পালা মাটন মুরগী ছিল। পনীরও তাঁহার ঘরে অতি উত্তম ছিল। নানাবিধ বন্য পক্ষী তাঁহার টেবিলের শোভা সম্পাদন করিত। শ্মশ্রুমান বাবুর্চীটি দ্বিতীয় দ্রৌপদী, সুতরাং বিনা বাক্যব্যয়ে কাপ্তেন টমাস সেইখানে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
এদিকে ভবানন্দ মনে মনে গর গর করিতেছে ; ভাবিতেছে, কবে এই কাপ্তেন টমাস সাহেব বাহাদুরের মাথাটি কাটিয়া, দ্বিতীয় সম্বরারি বলিয়া উপাধি ধারণ করিবে। ইংরেজ যে ভারতবর্ষের উদ্ধারসাধনের জন্য আসিয়াছিল, সন্তানেরা তাহা তখন বুঝে নাই। কি প্রকারে বুঝিবে? কাপ্তেন টমাসের সমসাময়িক ইংরেজরাও তাহা জানিতেন না। তখন কেবল বিধাতার মনে মনেই এ কথা ছিল। ভবানন্দ ভাবিতেছিলেন, এ অসুরের বংশ এক দিনে নিপাত করিব ; সকলে জমা হউক, একটু অসতর্ক হউক, আমরা এখন একটু তফাৎ থাকি। সুতরাং তাহারা একটু তফাৎ রহিল। কাপ্তেন টমাস সাহেব নিষ্কণ্টক হইয়া দ্রৌপদীর গুণগ্রহণে মনোযোগ দিলেন।
সাহেব বাহাদুর শিকার বড় ভালবাসেন, মধ্যে মধ্যে শিবগ্রামের নিকটবর্তী অরণ্যে মৃগয়ায় বাহির হইতেন। এক দিন ডনিওয়ার্থ সাহেবের সঙ্গে অশ্বারোহণে কতকগুলি শিকারী লইয়া কাপ্তেন টমাস শিকারে বাহির হইয়াছিলেন। বলিতে কি, টমাস সাহেব অসমসাহসিক, বলবীর্যে ইংরেজ জাতির মধ্যেও অতুল্য। সেই নিবিড় অরণ্য ব্যাঘ্র, মহিষ, ভল্লুকাদিতে অতিশয় ভয়ানক। বহু দূর আসিয়া শিকারীরা আর যাইতে অস্বীকৃত হইল, বলিল, ভিতরে আর পথ নাই, আমরা আর যাইতে পারিব না। ডনিওয়ার্থ সাহেবও সেই অরণ্যমধ্যে এমন ভয়ঙ্কর ব্যাঘ্রের হাতে পড়িয়াছিলেন যে, তিনিও আর যাইতে অনিচ্ছুক হইলেন। তাঁহারা সকলে ফিরিতে চাহিলেন। কাপ্তেন টমাস বলিলেন, “তোমরা ফের, আমি ফিরিব না |” এই বলিয়া কাপ্তেন সাহেব নিবিড় অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
বস্তুত: অরণ্যমধ্যে পথ ছিল না। অশ্ব প্রবেশ করিতে পারিল না। কিন্তু সাহেব ঘোড়া ছাড়িয়া দিয়া, কাঁধে বন্দুক লইয়া একা অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া ইতস্তত: ব্যাঘ্রের অন্বেষণ করিতে করিতে ব্যাঘ্র দেখিলেন না। কি দেখিলেন? এক বৃহৎ বৃক্ষতলে প্রস্ফুটিত ফুল্লকুসুমযুক্ত লতাগুল্মাদিতে বেষ্টিত হইয়া বসিয়া ও কে? এক নবীন সন্ন্যাসী, রূপে বন আলো করিয়াছে। প্রস্ফুটিত ফুল যেন সেই স্বর্গীয় বপুর সংসর্গে অধিকতর সুগন্ধযুক্ত হইয়াছে। কাপ্তেন টমাস সাহেব বিস্মিত হইলেন, বিস্ময়ের পরেই তাঁহার ক্রোধ উপস্থিত হইল। কাপ্তেন সাহেব দেশী ভাষা বিলক্ষণ জানিতেন, বলিলেন, “টুমি কে?”
সন্ন্যাসী বলিল, “আমি সন্ন্যাসী |”
কাপ্তেন বলিলেন, “টুমি rebel |”
সন্ন্যাসী। সে কি?
কাপ্তেন। হামি টোমায় গুলি করিয়া মারিব।
সন্ন্যাসী। মার।
কাপ্তেন একটু মনে সন্দেহ করিতেছিলেন যে, গুলি মারিবেন কি না, এমন সময় বিদ্যুদ্বেগে সেই নবীন সন্ন্যাসী তাঁহার উপর পড়িয়া তাঁহার হাত হইতে বন্দুক কাড়িয়া লইল। সন্ন্যাসী বক্ষাবরণচর্ম খুলিয়া ফেলিয়া দিল। এক টানে জটা খুলিয়া ফেলিল ; কাপ্তেন টমাস সাহেব দেখিলেন, অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রীমূর্তি। সুন্দরী হাসিতে হাসিতে বলিলে, “সাহেব, আমি স্ত্রীলোক, কাহাকেও আঘাত করি না। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, হিন্দু মোছলমানে মারামারি হইতেছে, তোমরা মাঝখানে কেন? আপনার ঘরে ফিরিয়া যাও।”
সাহেব। টুমি কে?
শান্তি। দেখিতেছ সন্ন্যাসিনী। যাঁহাদের সঙ্গে লড়াই করিতে আসিয়াছ, তাঁহাদের কাহারও স্ত্রী।
সা। টুমি হামারা গোড়ে গোড়ে3 ঠাকিব?
শা। কি? তোমার উপপত্নীস্বরূপ?
সা। ইষ্ট্রির মট ঠাকিটে পার, লেগেন সাদি হইব না।
শা। আমারও একটা জিজ্ঞাসা আছে ; আমাদের ঘরে একটা রূপী বাঁদর ছিল, সেটা সম্প্রতি মরে গেছে ; কোটর খালি পড়ে আছে। কোমরে ছেকল দেব, তুমি সেই কোটরে থাকবে? আমাদের বাগানে বেশ মর্তমান কলা হয়।
সা। টুমি বড় spirited woman আছে, টোমাড় courage-এ আমি খুসি আছে। টুমি আমার গোড়ে চল। টোমাড় স্বামী যুড্ডে মড়িয়া যাইব। টখন টোমাড় কি হইব?
শা। তবে তোমার আমার একটা কথা থাক। যুদ্ধ ত দু দিন চারি দিনে হইবেই। যদি তুমি জেত, তবে আমি তোমার উপপত্নী হইয়া থাকিব স্বীকার করিতেছি, যদি বাঁচিয়া থাকি। আর আমরা যদি জিতি, তবে তুমি আসিয়া, আমাদের কোটরে বাঁদর সেজে কলা খাবে ত?
সা। কলা খাইটে উট্টম জিনিস। এখন আছে?
শা। নে, তোর বন্দুক নে। এমন বুনো জেতের সঙ্গেও কেউ কথা কয়!
শান্তি বন্দুক ফেলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শান্তি সাহেবকে ত্যাগ করিয়া হরিণীর ন্যায় ক্ষিপ্রচরণে বনমধ্যে কোথায় প্রবিষ্ট হইল। সাহেব কিছু পরে শুনিতে পাইলেন, স্ত্রীকণ্ঠে গীত হইতেছে,-
এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
আবার কোথায় সারঙ্গের মধুর নিক্কণে বাজিল তাই;-
এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
তাহার সঙ্গে পুরুষকণ্ঠ মিলিয়া গীত হইল–
এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
তিন স্বরে এক হইয়া গানে বনের লতাসকল কাঁপাইয়া তুলিল। শান্তি গাইতে গাইতে চলিল,-
“এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
জলেতে তুফান হয়েছে,
আমার নূতন তরী ভাসল সুখে,
মাঝিতে হাল ধরেছে,
হরে মুরারে! Hore মুরারে!
ভেঙ্গে বালির বাঁধ, পুরাই মনের সাধ,
জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে রাখিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
সারঙ্গেও ঐ বাজিতেছিল,-
জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে রাখিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
যেখানে অতি নিবিড় বন, ভিতরে কি আছে, বাহির হইতে একেবারে অদৃশ্য, শান্তি তাহারই মধ্যে প্রবেশ করিল। সেইখানে সেই শাখাপল্লবরাশির মধ্যে লুক্কায়িত একটি ক্ষুদ্র কুটীর আছে। ডালের বাঁধন, পাতার ছাওয়া, কাটের মেজে, তার উপর মাটি ঢালা। তাহারই ভিতরে লতাদ্বার মোচন করিয়া শান্তি প্রবেশ করিল। সেখানে জীবানন্দ বসিয়া সারঙ্গ বাজাইতেছিলেন।
জীবানন্দ শান্তিকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এতদিনের পর জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে কি?”
শান্তিও হাসিয়া উত্তর করিল, “নালা ডোবায় কি জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটে?”
জীবানন্দ বিষণ্ণ হইয়া বলিলেন, “দেখ শান্তি! এক দিন আমার ব্রতভঙ্গ হওয়ায় আমার প্রাণ ত উৎসর্গই হইয়াছে। যে পাপ, তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে। এতদিন এ প্রায়শ্চিত্ত করিতাম, কেবল তোমার অনুরোধেই করি নাই। কিন্তু একটা ঘোরতর যুদ্ধের আর বিলম্ব নাই। সেই যুদ্ধের ক্ষেত্রে, আমার সে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এ প্রাণ পরিত্যাগ করিতেই হইবে। আমার মরিবার দিন_”
শান্তি আর বলিতে না দিয়া বলিল, “আমি তোমার ধর্মপত্নী, সহধর্মিণী, ধর্মে সহায়। তুমি অতিশয় গুরুতর ধর্ম গ্রহণ করিয়াছ। সেই ধর্মের সহায়তার জন্যই আমি গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। দুই জন একত্র সেই ধর্মাচরণ করিব বলিয়া গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়া বনে বাস করিতেছি। তোমার ধর্মবৃদ্ধি করিব। ধর্মপত্নী হইয়া, তোমার ধর্মের বিঘ্ন করিব কেন? বিবাহ ইহকালের জন্য, এবং বিবাহ পরকালের জন্য। ইহকালের জন্য যে বিবাহ, মনে কর, তাহা আমাদের হয় নাই। আমাদের বিবাহ কেবল পরকালের জন্য। পরকালে দ্বিগুণ ফল ফলিবে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের কথা কেন? তুমি কি পাপ করিয়াছ? তোমার প্রতিজ্ঞা স্ত্রীলোকের সঙ্গে একাসনে বসিবে না। কৈ, কোন দিন ত একাসনে বসো নাই। প্রায়শ্চিত্ত কেন? হায় প্রভু! তুমিই আমার গুরু, আমি কি তোমায় ধর্ম শিখাইব? তুমি বীর, আমি তোমায় বীরব্রত শিখাইব?”
জীবানন্দ আহ্লাদে গদ্গদ হইয়া বলিলেন, “শিখাইলে ত!”
শান্তি প্রফুল্লচিত্তে বলিতে লাগিল, “আরও দেখ গোঁসাই, ইহকালেই কি আমাদের বিবাহ নিষ্ফল? তুমি আমায় ভালবাস, আমি তোমায় ভালবাসি, ইহা অপেক্ষা ইহকালে আর কি গুরুতর ফল আছে? বল “বন্দে মাতরম্।” তখন দুই জনে গলা মিলাইয়া “বন্দে মাতরম্” গায়িল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ভবানন্দ গোস্বামী একদা নগরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রশস্ত রাজপথ পরিত্যাগ করিয়া একটা অন্ধকার গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন। গলির দুই পার্শ্বে উচ্চ অট্টালিকাশ্রেণী; সূর্যদেব মধ্যাহ্নে এক একবার গলির ভিতর উঁকি মারেন মাত্র। তৎপরে অন্ধকারেরই অধিকার। গলির পাশের একটি দোতলা বাড়ীতে ভবানন্দ ঠাকুর প্রবেশ করিলেন। নিম্নতলে একটি ঘরে যেখানে অর্ধবয়স্কা একটি স্ত্রীলোক পাক করিতেছিল, সেইখানে গিয়া ভবানন্দ মহাপ্রভু দর্শন দিলেন। স্ত্রীলোকটি অর্ধবয়স্কা, মোটাসোটা, কালো-কোলো, ঠেঁটি পরা, কপালে উল্কি, সীমন্তপ্রদেশে কেশদাম চূড়াকারে শোভা করিতেছে। ঠন্-ঠন্ করিয়া হাঁড়ির কানায় ভাতের কাটি বাজিতেছে, ফর্ ফর্ করিয়া অলকদামের কেশগুচ্ছ উড়িতেছে, গল্গল্ করিয়া মাগী আপনা আপনি বকিতেছে, আর তার মুখভঙ্গীতে তাহার মাথার চূডার নানা প্রকার টলুনি-টালুনির বিকাশ হইতেছে। এমন সময় ভবানন্দ মহাপ্রভু গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “ঠাকরুণ দিদি, প্রাত:প্রণাম!”
ঠাকরুণ দিদি ভবানন্দকে দেখিয়া শশব্যস্তে বস্ত্রাদি সামলাইতে লাগিলেন। মস্তকের মোহন চূড়া খুলিয়া ফেলিবেন ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সুবিধা হইল না ; কেন না, সকড়ি হাত। নিষেকমসৃণ সেই চিকুরজাল–হায়! তাহাতে পূজার সময় একটি বকফুল পড়িয়াছিল!–বস্ত্রাঞ্চলে ঢাকিতে যত্ন করিলেন ; বস্ত্রাঞ্চল তাহা ঢাকিতে সক্ষম হইল না ; কেন না, ঠাকরুণটি একখানি পাঁচ হাত কাপড় পরিয়াছিলেন। সেই পাঁচ হাত কাপড় প্রথমে গুরুভারপ্রণত উদরদেশ বেষ্টন করিয়া আসিতে প্রায় নি:শেষ হইয়া পড়িয়াছিল, তার পর দু:সহ ভারগ্রস্ত হৃদয়মণ্ডলেরও কিছু আবরু পর্দা রক্ষা করিতে হইয়াছে। শেষে ঘাড়ে পৌঁছিয়া বস্ত্রাঞ্চল জবাব দিল। কাণের উপর উঠিয়া বলিল, আর যাইতে পারি না। অগত্যা পরমব্রীড়াবতী গৌরী ঠাকুরাণী কথিত বস্ত্রাঞ্চলকে কাণের কাছে ধরিয়া রাখিলেন। এবং ভবিষ্যতে আট হাত কাপড় কিনিবার জন্য মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া বলিলেন, “কে, গোঁসাই ঠাকুর? এস এস! আমায় আবার প্রাত:প্রণাম কেন ভাই?”
ভ। তুমি ঠান্দিদি যে!
গৌ। আদর করে বল বলিয়া। তোমরা হলে গোঁসাই মানুষ, দেবতা! তা করেছ করেছ, বেঁচে থাক। তা করিলেও করিতে পার, হাজার হোক আমি বয়সে বড়।
এখন ভবানন্দের অপেক্ষা গৌরী দেবী মহাশয়া বছর পঁচিশের বড়, কিন্তু সুচতুর ভবানন্দ উত্তর করিলেন, “সে কি ঠান্দিদি! রসের মানুষ দেখে ঠান্দিদি বলি। নইলে যখন হিসাব হয়েছিল, তুমি আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট হইয়াছিলে, মনে নাই? আমাদের বৈষ্ণবের সকল রকম আছে জান, আমার মনে মনে ইচ্ছা, মঠধারী ব্রহ্মচারীকে বলিয়া তোমায় সাঙ্গা করে ফেলি। সেই কথাটাই বলতে এসেছি |”
গৌ। সে কি কথা, ছি! অমন কথা কি বলতে আছে! আমরা হলেম বিধবা।
ভ। তবে সাঙ্গা হবে না?
গৌ। তা ভাই, যা জান তা কর। তোমরা হলে পণ্ডিত, আমরা মেয়েমানুষ, কি
বুঝি? তা, কবে হবে?
ভবানন্দ অতিকষ্টে হাস্যসংবরণ করিয়া বলিলেন, “সেই ব্রহ্মচারীটার সঙ্গে একবার দেখা হইলেই হয়। আর – সে কেমন আছে?”
গৌরী বিষণ্ণ হইল। মনে মনে সন্দেহ করিল, সাঙ্গার কথাটা তবে বুঝি তামাশা। বলিল, “আছে আর কেমন, যেমন থাকে |”
ভ। তুমি গিয়া একবার দেখিয়া আইস কেমন আছে, বলিয়া আইস, আমি আসিয়াছি একবার সাক্ষাৎ করিব।
গৌরী দেবী তখন ভাতের কাটি ফেলিয়া, হাত ধুইয়া বড় বড় ধাপের সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া, দোতালার উপর উঠিতে লাগিল। একটা ঘরে ছেঁড়া মাদুরের উপর বসিয়া এক অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু সৌন্দর্যের উপর একটা ঘোরতর ছায়া আছে। মধ্যাহ্নে কূলপরিপ্লাবিনী প্রসন্নসলিলা বিপুলজলকল্লোলিনী স্রোতস্বতীর বক্ষের উপর অতি নিবিড় মেঘের ছায়ার ন্যায় কিসের ছায়া আছে। নদীহৃদয়ে তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হইতেছে, তীরে কুসুমিত তরুকুল বায়ুভরে হেলিতেছে, ঘন পুষ্পভরে নমিতেছে, অট্টালিকাশ্রেণীও শোভিতেছে। তরণীশ্রেণী-তাড়নে জল আন্দোলিত হইতেছে। কাল মধ্যাহ্ন, তবু সেই কাদম্বিনীনিবিড় কালো ছায়ায় সকল শোভাই কালিমাময়। এও তাই। সেই পূর্বের মত চারু চিক্কণ চঞ্চল নিবিড় অলকদাম, পূর্বের মত বিস্ফারিত সজল উজ্জ্বল কৃষ্ণতার বৃহচ্চক্ষু, তত কটাক্ষময় নয়, তত লোলতা নাই, কিছু নম্র। অধরে তেমনি রাগরঙ্গ, হৃদয় তেমনি শ্বাসানুগামী পূর্ণতায় ঢল ঢল, বাহু তেমনি বনলতাদুষ্প্রাপ্য কোমলতাযুক্ত। কিন্তু আজ সে দীপ্তি নাই, সে উজ্জ্বলতা নাই, সে প্রখরতা নাই, সে চঞ্চলতা নাই, সে রস নাই। বলিতে কি, বুঝি সে যৌবন নাই। আছে কেবল সে সৌন্দর্য আর সে মাধুর্য। নূতন হইয়াছে ধৈর্য গাম্ভীর্য। ইঁহাকে পূর্বে দেখিলে মনে হইত, মনুষ্যলোকে অতুলনীয়া সুন্দরী, এখন দেখিলে বোধ হয়, ইনি দেবলোকে শাপগ্রস্তা দেবী। ইঁহার চারি পার্শ্বে দুই তিনখানা তুলটের পুথি পড়িয়া আছে। দেওয়ালের গায়ে হরিনামের মালা টাঙ্গান আছে, আর মধ্যে মধ্যে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার পট, কালিয়দমন, নবনারীকুঞ্জর, বস্ত্রহরণ, গোবর্ধনধারণ প্রভৃতি ব্রজলীলার চিত্র রঞ্জিত আছে। চিত্রগুলির নীচে লেখা আছে, “চিত্র না বিচিত্র?” সেই গৃহমধ্যে ভবানন্দ প্রবেশ করিলেন।
ভবানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন কল্যাণী, শারীরিক মঙ্গল ত?”
ক। এ প্রশ্ন আপনি ত্যাগ করিবেন না? আমার শারীরিক মঙ্গলে আপনারই কি ইষ্ট, আর আমারই বা কি ইষ্ট?
ভ। যে বৃক্ষ রোপণ করে, সে তাহাতে নিত্য জল দেয়। গাছ বাড়িলেই তাহার সুখ। তোমার মৃত দেহে আমি জীবন রোপণ করিয়াছিলাম, বাড়িতেছে কি না, জিজ্ঞাসা করিব না কেন?
ক। বিষবৃক্ষের কি ক্ষয় আছে?
ভ। জীবন কি বিষ?
ক। না হলে অমৃত ঢালিয়া আমি তাহা ধ্বংস করিতে চাহিয়াছিলাম কেন?
ভ। সে অনেক দিন জিজ্ঞাসা করিব মনে ছিল, সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে পারি
নাই। কে তোমার জীবন বিষময় করিয়াছিল?
কল্যাণী স্থিরভাবে উত্তর করিলেন, “আমার জীবন কেহ বিষময় করে নাই। জীবনই বিষময়। আমার জীবন বিষময়, আপনার জীবন বিষময়, সকলের জীবন বিষময় |”
ভ। সত্য কল্যাণী, আমার জীবন বিষময়। যে দিন অবধি–তোমার ব্যাকরণ শেষ
হইয়াছে?
ক। না।
ভ। অভিধান?
ক। ভালো লাগে না।
ভ। বিদ্যা অর্জনে কিছু আগ্রহ দেখিয়াছিলাম। এখন এ অশ্রদ্ধা কেন?
ক। আপনার মত পণ্ডিতও যখন মহাপাপিষ্ঠ, তখন লেখাপড়া না করাই ভাল। আমার স্বামীর সংবাদ কি প্রভু?
ভ। বার বার সে সংবাদ কেন জিজ্ঞাসা কর? তিনি ত তোমার পক্ষে মৃত।
ক। আমি তাঁর পক্ষে মৃত, তিনি আমার পক্ষে নন।
ভ। তিনি তোমার পক্ষে মৃতবৎ হইবেন বলিয়াই ত তুমি মরিলে। বার বার সে কথা কেন কল্যাণী?
ক। মরিলে কি সম্বন্ধ যায়? তিনি কেমন আছেন?
ভ। ভাল আছেন।
ক। কোথায় আছেন? পদচিহ্নে?
ভ। সেইখানেই আছেন।
ক। কি কাজ করিতেছেন?
ভ। যাহা করিতেছিলেন। দুর্গনির্মাণ, অস্ত্রনির্মাণ। তাঁহারই নির্মিত অস্ত্রে সহস্র সহস্র সন্তান সজ্জিত হইয়াছে। তাঁহার কল্যাণে কামান, বন্দুক, গোলা, গুলি, বারুদের আমাদের আর অভাব নাই। সন্তানমধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ। তিনি আমাদিগকে মহৎ উপকার করিতেছেন। তিনি আমাদিগের দক্ষিণ বাহু।
ক। আমি প্রাণত্যাগ না করিলে কি এত হইত? যার বুকে কাদাপোরা কলসী বাঁধা, সে কি ভবসমুদ্রে সাঁতার দিতে পারে? যার পায়ে লোহার শিকল, সে কি দৌড়ায়? কেন সন্ন্যাসী, তুমি এ ছার জীবন রাখিয়াছিলে?
ভ। স্ত্রী সহধর্মিণী, ধর্মের সহায়।
ক। ছোট ছোট ধর্মে। বড় বড় ধর্মে কণ্টক। আমি বিষকণ্টকের দ্বারা তাঁহার অধর্মকণ্টক উদ্ধৃত করিয়াছিলাম। ছি! দুরাচার পামর ব্রহ্মচারী! এ প্রাণ তুমি ফিরিয়া দিলে কেন?
ভ। ভাল, যা দিয়াছি, তা না হয় আমারই আছে। কল্যাণী! যে প্রাণ তোমায় দিয়াছি, তাহা কি তুমি আমায় দিতে পার?
ক। আপনি কিছু সংবাদ রাখেন কি, আমার সুকুমারী কেমন আছে?
ভ। অনেক দিন সে সংবাদ পাই নাই। জীবানন্দ অনেক দিন সে দিকে যান নাই।
ক। সে সংবাদ কি আমায় আনাইয়া দিতে পারেন? স্বামীই আমার ত্যাজ্য, বাঁচিলাম ত কন্যা কেন ত্যাগ করিব? এখনও সুকুমারীকে পাইলে এ জীবনে কিছু সুখ সম্ভাবিত হয়। কিন্তু আমার জন্য আপনি কেন এত করিবেন?
ভ। করিব কল্যাণী। তোমার কন্যা আনিয়া দিব। কিন্তু তার পর?
ক। তার পর কি ঠাকুর?
ভ। স্বামী?
ক। ইচ্ছাপূর্বক ত্যাগ করিয়াছি।
ভ। যদি তার ব্রত সম্পূর্ণ হয়?
ক। তবে তাঁরই হইব। আমি যে বাঁচিয়া আছি, তিনি কি জানেন?
ভ। না।
ক। আপনার সঙ্গে কি তাঁহার সাক্ষাৎ হয় না?
ভ। হয়।
ক। আমার কথা কিছু বলেন না?
ভ। না, যে স্ত্রী মরিয়া গিয়াছে, তাহার সঙ্গে স্বামীর আর সম্বন্ধ কি?
ক। কি বলিতেছেন?
ভ। তুমি আবার বিবাহ করিতে পার, তোমার পুনর্জন্ম হইয়াছে।
ক। আমার কন্যা আনিয়া দাও।
ভ। দিব, তুমি আবার বিবাহ করিতে পার।
ক। তোমার সঙ্গে নাকি?
ভ। যদি তাই হয়?
ক। সন্তানধর্ম কোথায় থাকিবে?
ভ। অতল জলে।
ক। পরকাল?
ভ। অতল জলে?
ক। এই মহাব্রত? এই ভবানন্দ নাম?
ভ। অতল জলে।
ক। কিসের জন্য এ সব অতল জলে ডুবাইবে?
ভ। তোমার জন্য। দেখ, মনুষ্য হউন, ঋষি হউন, সিদ্ধ হউন, দেবতা হউন, চিত্ত অবশ ; সন্তানধর্ম আমার প্রাণ, কিন্তু আজ প্রথম বলি, তুমিই আমার প্রাণাধিক প্রাণ। যে দিন তোমায প্রাণদান করিয়াছিলাম, সেই দিন হইতে আমি তোমার পদমূলে বিক্রীত। আমি জানিতাম না যে, সংসারে এ রূপরাশি আছে। এমন রূপরাশি আমি কখন চক্ষে দেখিব জানিলে, কখন সন্তানধর্ম গ্রহণ করিতাম না। এ ধর্ম এ আগুনে পুড়িয়া ছাই হয়। ধর্ম পুড়িয়া গিয়াছে, প্রাণ আছে। আজি চারি বৎসর প্রাণও পুড়িতেছে, আর থাকে না! দাহ! কল্যাণী দাহ! জ্বালা! কিন্তু জ্বলিবে যে ইন্ধন, তাহা আর নাই। প্রাণ যায়। চারি বৎসর সহ্য করিয়াছি, আর পারিলাম না। তুমি আমার হইবে?
ক। তোমারই মুখে শুনিয়াছি যে, সন্তানধর্মের এই এক নিয়ম যে, যে ইন্দ্রিয়পরবশ হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু। এ কথা কি সত্য?
ভ। এ কথা সত্য।
ক। তবে তোমার প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু?
ভ। আমার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত মৃত্যু।
ক। আমি তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ করিলে, তুমি মরিবে?
ভ। নিশ্চিত মরিব।
ক। আর যদি মনস্কামনা সিদ্ধ না করি?
ভ। তথাপি মৃত্যু আমার প্রায়শ্চিত্ত; কেন না, আমার চিত্ত ইন্দ্রিয়ের বশ হইয়াছে।
ক। আমি তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ করিব না। তুমি কবে মরিবে?
ভ। আগামী যুদ্ধে।
ক। তবে তুমি বিদায় হও। আমার কন্যা পাঠাইয়া দিবে কি?
ভবানন্দ সাশ্রুলোচনে বলিল, “দিব। আমি মরিয়া গেলে আমায় মনে রাখিবে কি?”
কল্যাণী বলিল, রাখিব। ব্রতচ্যুত অধর্মী বলিয়া মনে রাখিব |”
ভবানন্দ বিদায় হইল, কল্যাণী পুথি পড়িতে বসিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
ভবানন্দ ভাবিতে ভাবিতে মঠে চলিলেন। যাইতে যাইতে রাত্রি হইল। পথে একাকী যাইতেছিলেন। বনমধ্যে একাকী প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, বনমধ্যে আর এক ব্যক্তি তাঁহার আগে আগে যাইতেছে। ভবানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে হে যাও?”
অগ্রগামী ব্যক্তি বলিল, “জিজ্ঞাসা করিতে জানিলে উত্তর দিই–আমি পথিক |”
ভ। বন্দে।
অগ্রগামী ব্যক্তি বলিল, “মাতরম্ |”
ভ। আমি ভবানন্দ গোস্বামী।
অগ্রগামী। আমি ধীরানন্দ।
ভ। ধীরানন্দ, কোথায় গিয়াছিলে?
ধী। আপনারই সন্ধানে।
ভ। কেন?
ধী। একটা কথা বলিতে।
ভ। কি কথা?
ধী। নির্জনে বক্তব্য।
ভ। এইখানেই বল না, এ অতি নির্জন স্থান।
ধী। আপনি নগরে গিয়াছিলেন?
ভ। হাঁ।
ধী। গৌরী দেবীর গৃহে?
ভ। তুমিও নগরে গিয়াছিলে নাকি?
ধী। সেইখানে একটি পরমাসুন্দরী যুবতী বাস করে?
ভবানন্দ কিছু বিস্মিত, কিছু ভীত হইলেন। বলিলেন, “এ সকল কি কথা?”
ধী। আপনি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন।
ভ। তার পর?
ধী। আপনি সেই কামিনীর প্রতি অতিশয় অনুরক্ত।
ভ। (কিছু ভাবিয়া) ধীরানন্দ, কেন এত সন্ধান লইলে? দেখ ধীরানন্দ, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা সকলই সত্য। তুমি ভিন্ন আর কয় জন একথা জানে?
ধী। আর কেহ না।
ভ। তবে তোমাকে বধ করিলেই আমি কলঙ্ক হইতে মুক্ত হইতে পারি?
ধী। পার।
ভ। আইস, তবে এই বিজন স্থানে দুই জনে যুদ্ধ করি। হয় তোমাকে বধ করিয়া আমি নিষ্কণ্টক হই, নয় তুমি আমাকে বধ করিয়া আমার সকল জ্বালা নির্বাণ কর। অস্ত্র আছে?
ধী। আছে – শুধু হাতে কার সাধ্য তোমার সঙ্গে এ সকল কথা কয়। যুদ্ধই যদি তোমার মত হয়, তবে অবশ্য করিব। সন্তানে সন্তানে বিরোধ নিষিদ্ধ। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য কাহারও সঙ্গে বিরোধ নিষিদ্ধ নহে। কিন্তু যাহা বলিবার জন্য আমি তোমাকে খুঁজিতেছিলাম, তাহা সবটা শুনিয়া যুদ্ধ করিলে ভাল হয় না?
ভ। ক্ষতি কি – বল না।
ভবানন্দ তরবারি নিষ্কাশিত করিয়া ধীরানন্দের স্কন্ধে স্থাপিত করিলেন। ধীরানন্দ না পলায়।
ধী। আমি এই বলিতেছিলাম – তুমি কল্যাণীকে বিবাহ কর –
ভ। কল্যাণী, তাও জান?
ধী। বিবাহ কর না কেন?
ভ। তাহার যে স্বামী আছে।
ধী। বৈষ্ণবের সেরূপ বিবাহ হয়।
ভ। সে নেড়া বৈরাগীর – সন্তানের নহে। সন্তানের বিবাহই নাই।
ধী। সন্তান-ধর্ম কি অপরিহার্য – তোমার যে প্রাণ যায়। ছি! ছি! আমার কাঁধ যে কাটিয়া গেল! (বাস্তবিক এবার ধীরানন্দের স্কন্ধ হইতে রক্ত পড়িতেছিল।)
ভ। তুমি কি অভিপ্রায়ে আমাকে অধর্মে মতি দিতে আসিয়াছ? অবশ্য তোমার কোন স্বার্থ আছে।
ধী। তাহারও বলিবার ইচ্ছা আছে – তরবারি বসাইও না – বলিতেছি। এই সন্তানধর্মে আমার হাড় জরজর হইয়াছে, আমি ইহা পরিত্যাগ করিয়া স্ত্রীপুত্রের মুখ দেখিয়া দিনপাত করিবার জন্য বড় উতলা হইয়াছি। আমি এ সন্তানধর্ম পরিত্যাগ করিব। কিন্তু আমার কি বাড়ী গিয়া বসিবার যো আছে? বিদ্রোহী বলিয়া আমাকে অনেকে চেনে। ঘরে গিয়া বসিলেই হয় রাজপুরুষে মাথা কাটিয়া লইয়া যাইবে, নয় সন্তানেরাই বিশ্বাসঘাতী বলিয়া মারিয়া ফেলিয়া চলিয়া যাইবে। এই জন্য তোমাকে আমার পথে লইয়া যাইতে চাই।
ভ। কেন, আমায় কেন?
ধী। সেইটি আসল কথা। এই সন্তানসেনা তোমার আজ্ঞাধীন – সত্যানন্দ এখন
এখানে নাই, তুমি ইহার নায়ক। তুমি এই সেনা লইয়া যুদ্ধ কর, তোমার জয় হইবে, ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যুদ্ধ জয় হইলে তুমি কেন স্বনামে রাজ্য স্থাপন কর না, সেনা ত তোমার আজ্ঞাকারী। তুমি রাজা হও – কল্যাণী তোমার মন্দোদরী হউক, আমি তোমার অনুচর হইয়া স্ত্রীপুত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করি, আর আশীর্বাদ করি। সন্তানধর্ম অতল জলে ডুবাইয়া দাও।
ভবানন্দ, ধীরানন্দের স্কন্ধ হইতে তরবারি ধীরে ধীরে নামাইলেন। বলিলেন, “ধীরানন্দ, যুদ্ধ কর, তোমায় বধ করিব। আমি ইন্দ্রিয়পরবশ হইয়া থাকিব, কিন্তু বিশ্বাসহন্তা নই। তুমি আমাকে বিশ্বাসঘাতক হইতে পরামর্শ দিয়াছ। নিজেও বিশ্বাসঘাতক, তোমাকে মারিলে ব্রহ্মহত্যা হয় না। তোমাকে মারিব |” ধীরানন্দ কথা শেষ হইতে না হইতেই ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। ভবানন্দ তাহার পশ্চাদ্বর্তী হইলেন না। ভবানন্দ কিছুক্ষণ অন্যমনা ছিলেন, যখন খুঁজিলেন, তখন আর তাহাকে দেখিতে পাইলেন না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
মঠে না গিয়া ভবানন্দ গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেই জঙ্গলমধ্যে এক স্থানে এক প্রাচীন অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ আছে। ভগ্নাবশিষ্ট ইষ্টকাদির উপর, লতাগুল্মকণ্টকাদি অতিশয় নিবিড়ভাবে জন্মিয়াছে। সেখানে অসংখ্য সর্পের বাস। ভগ্ন প্রকোষ্ঠের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত অভগ্ন ও পরিষ্কৃত ছিল, ভবানন্দ গিয়া তাহার উপরে উপবেশন করিলেন। উপবেশন করিয়া ভবানন্দ চিন্তা করিতে লাগিলেন।
রজনী ঘোর তমোময়ী। তাহাতে সেই অরণ্য অতি বিস্তৃত, একেবারে জনশূন্য, অতিশয় নিবিড়, বৃক্ষলতা দুর্ভেদ্য, বন্য পশুরও গমনাগমনের বিরোধী। বিশাল জনশূন্য, অন্ধকার, দুর্ভেদ্য, নীরব! রবের মধ্যে দূরে ব্যাঘ্রের হুঙ্কার অথবা অন্য শ্বাপদের ক্ষুধা, ভীতি বা আস্ফালনের বিকট শব্দ। কদাচিৎ কোন বৃহৎ পক্ষীর পক্ষকম্পন, কদাচিৎ তাড়িত এবং তাড়নকারী, বধ্য এবং বধকারী পশুদিগের দ্রুতগমন-শব্দ। সেই বিজনে অন্ধকারে ভগ্ন অট্টালিকার উপর বসিয়া একা ভবানন্দ। তাঁহার পক্ষে তখন যেন পৃথিবী নাই, অথবা কেবল ভয়ের উপাদানময়ী হইয়া আছেন। সেই সময় ভবানন্দ কপালে হাত দিয়া ভাবিতেছিলেন ; স্পন্দ নাই, নিশ্বাস নাই, ভয় নাই, অতি প্রগাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন। মনে মনে বলিতেছিলেন, “যাহা ভবিতব্য, তাহা অবশ্য হইবে। আমি ভাগীরথীজলতরঙ্গসমীপে ক্ষুদ্র গজের মত ইন্দ্রিয়স্রোতে ভাসিয়া গেলাম, ইহাই আমার দু:খ। এক মুহূর্তে দেহের ধ্বংস হতে পারে – দেহের ধ্বংসই ইন্দ্রিয়ের ধ্বংস – আমি সেই ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হইলাম? আমার মরণ শ্রেয়। ধর্মত্যাগী? ছি! মরিব!” এমন সময়ে পেচক মাথার উপর গম্ভীর শব্দ করিল। ভবানন্দ তখন মুক্তকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ও কি শব্দ? কাণে যেন গেল, যম আমায় ডাকিতেছে। আমি জানি না –কে শব্দ করিল, কে আমায় ডাকিল, কে আমায় বিধি দিল, কে মরিতে বলিল! পুণ্যময়ি অনন্তে! তুমি শব্দময়ী, কিন্তু তোমার শব্দের ত মর্ম আমি বুঝিতে পারিতেছি না। আমায় ধর্মে মতি দাও, আমায় পাপ হইতে নিরত কর। ধর্মে,-হে গুরুদেব! ধর্মে যেন আমার মতি থাকে!”
তখন সেই ভীষণ কাননমধ্যে হইতে অতি মধুর অথচ গম্ভীর, মর্মভেদী মনুষ্যকণ্ঠ শ্রুত হইল ; কে বলিল, “ধর্মে তোমার মত থাকিবে – আশীর্বাদ করিলাম |”
ভবানন্দের শরীরে রোমাঞ্চ হইল। “এ কি এ? এ যে গুরুদেবের কণ্ঠ। মহারাজ, কোথায় আপনি! এ সময়ে দাসকে দর্শন দিন |”
কিন্তু কেহ দর্শন দিল না – কেহ উত্তর করিল না। ভবানন্দ পুন: পুন: ডাকিলেন – উত্তর পাইলেন না। এদিক ওদিক খুঁজিলেন – কোথাও কেহ নাই।
যখন রজনী প্রভাতে প্রাত:সূর্য উদিত হইয়া বৃহৎ অরণ্যের শির:স্থ শ্যামল পত্ররাশিতে প্রতিভাসিত হইতেছিল, তখন ভবানন্দ মঠে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কর্ণে প্রবেশ করিল–“হরে মুরারে! হরে মুরারে!” চিনিলেন – সত্যানন্দের কণ্ঠ। বুঝিলেন, প্রভু প্রত্যাগমন করিয়াছেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
জীবানন্দ কুটীর হইতে বাহির হইয়া গেলে পর, শান্তিদেবী আবার সারঙ্গ লইয়া মৃদু মৃদু রবে গীত করিতে লাগিলেন, –
“প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্
বিহিতবহিত্রচরিত্রখেদম্
কেশব ধৃতমীনশরীর
জয় জগদীশ হরে |”
গোস্বামীবিরচিত মধুর স্তোত্র যখন শান্তিদেবীকণ্ঠনি:সৃত হইয়া, রাগ-তাল-লয়-সম্পূর্ণ হইয়া, সেই অনন্ত কাননের অনন্ত নীরবতা বিদীর্ণ করিয়া, পূর্ণ জলোচ্ছ্বাসের সময়ে বসন্তানিলতাড়িত তরঙ্গভঙ্গের ন্যায় মধুর হইয়া আসিল, তখন তিনি গায়িলেন–
“নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম্
সদয়-হৃদয়-দর্শিতপশুঘাতম্
কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর
জয় জগদীশ হরে |”
তখন বাহির হইতে কে অতি গম্ভীর রবে গায়িল, গম্ভীর মেঘগর্জনবৎ তানে গায়িল, –
“ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্
ধূমকেতুমিব কিমপি করালম্
কেশব ধৃতকল্কিশরীর
জয় জগদীশ হরে |”
শান্তি ভক্তিভাবে প্রণত হইয়া সত্যানন্দের পদধূলি গ্রহণ করিল ; বলিল, “প্রভো, আমি এমন কি ভাগ্য করিয়াছি যে, আপনার শ্রীপাদপদ্ম এখানে দর্শন পাই – আজ্ঞা করুন, আমাকে কি করিতে হইবে |” বলিয়া সারঙ্গে সুর দিয়া শান্তি আবার গাইল,-
“তব চরণপ্রণতা বয়মিতি ভাবয় কুরু কুশলং প্রণতেষু |”
সত্যানন্দ বলিলেন, “মা, তোমার কুশলই হইবে |”
শা। কিসে ঠাকুর – তোমার ত আজ্ঞা আছে আমার বৈধব্য!
স। তোমারে আমি চিনিতাম না। মা! দড়ির জোর না বুঝিয়া আমি জেয়াদা টানিয়াছি, তুমি আমার অপেক্ষা জ্ঞানী, ইহার উপায় তুমি কর, জীবানন্দকে বলিও না যে, আমি সকল জানি। তোমার প্রলোভনে তিনি জীবন রক্ষা করিতে পারেন, এতদিন করিতেছেন। তাহা হইলে আমার কার্যোদ্ধার হইতে পারে।
সেই বিশাল নীল উৎফুল্ল লোচনে নিদাঘকাদম্বিনীবিরাজিত বিদ্যুত্তুল্য ঘোর রোষকটাক্ষ হইল। শান্তি বলিল, “কি ঠাকুর! আমি আর আমার স্বামী এক আত্মা, যাহা যাহা তোমার সঙ্গে কথোপকথন হইল, সবই বলিব। মরিতে হয় তিনি মরিবেন, আমার ক্ষতি কি? আমি ত সঙ্গে সঙ্গে মরিব। তাঁর স্বর্গ আছে, মনে কর কি, আমার স্বর্গ নাই?”
ব্রহ্মচারী বলিলেন যে, “আমি কখন হারি নাই, আজ তোমার কাছে হারিলাম। মা, আমি তোমার পুত্র, সন্তানকে স্নেহ কর, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা কর, আপনার প্রাণরক্ষা কর, আমার কার্যোদ্ধার হইবে |”
বিজলী হাসিল। শান্তি বলিল, “আমার স্বামীর ধর্ম আমার স্বামীর হাতে ; আমি তাঁহাকে ধর্ম হইতে বিরত করিবার কে? ইহলোকে স্ত্রীর পতি দেবতা, কিন্তু পরলোকে সবারই ধর্ম দেবতা – আমার কাছে আমার পতি বড়, তার অপেক্ষা আমার ধর্ম বড়, তার অপেক্ষা আমার কাছে আমার স্বামীর ধর্ম বড়। আমার ধর্মে আমার যে দিন ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে পারি; আমার স্বামীর ধর্মে জলাঞ্জলি দিব? মহারাজ! তোমার কথায় আমার স্বামী মরিতে হয় মরিবেন, আমি বারণ করিব না |”
ব্রহ্মচারী তখন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “মা, এ ঘোর ব্রতে বলিদান আছে। আমাদের সকলকেই বলি পড়িতে হইবে। আমি মরিব, জীবানন্দ, ভবানন্দ, সবাই মরিবে, বোধ হয় মা, তুমিও মরিবে ; কিন্তু দেখ, কাজ করিয়া মরিতে হইবে, বিনা কার্যে কি মরা ভাল? – আমি কেবল দেশকে মা বলিয়াছি, আর কাহাকেও মা বলি নাই ; কেন না, সেই সুজলা সুফলা ধরণী ভিন্ন আমরা অনন্যমাতৃক। আর তোমাকে মা বলিলাম, তুমি মা হইয়া সন্তানের কাজ কর, যাহাতে কার্যোদ্ধার হয়, তাহা করিও, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা করিও, তোমার প্রাণরক্ষা করিও |”
এই বলিয়া সত্যানন্দ “হরে মুরারে মধুকৈটভারে” গায়িতে গায়িতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ক্রমে সন্তানসম্প্রদায়মধ্যে সংবাদ প্রচারিত হইল যে, সত্যানন্দ আসিয়াছেন, সন্তানদিগের সঙ্গে কি কথা কহিবেন, এই বলিয়া তিনি সকলকে আহ্বান করিয়াছেন। তখন দলে দলে সন্তানসম্প্রদায় নদীতীরে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। জ্যোৎস্নারাত্রিতে নদীসৈকতপার্শ্বে বৃহৎ কাননমধ্যে আম্র, পনস, তাল, তিন্তিড়ী, অশ্বত্থ, বেল, বট, শাল্মলী প্রভৃতি বৃক্ষাদিরঞ্জিত মহাগহনে দশ সহস্র সন্তান সমবেত হইল। তখন সকলেই পরস্পরের মুখে সত্যানন্দের আগমনবার্তা শ্রবণ করিয়া মহা কোলাহলধ্বনি করিতে লাগিল। সত্যানন্দ কি জন্য কোথায় গিয়াছিলেন, তাহা সাধারণে জানিত না। প্রবাদ এই যে, তিনি সন্তানদিগের মঙ্গলকামনায় তপস্যার্থ হিমালয়ে প্রস্থান করিয়াছিলেন। আজ সকলে কাণাকাণি করিতে লাগিল, “মহারাজের তপ:সিদ্ধি হইয়াছে – আমাদের রাজ্য হইবে |” তখন বড় কোলাহল হইতে লাগিল। কেহ চীৎকার করিতে লাগিল, “মার, মার, নেড়ে মার |” কেহ বলিল, “জয় জয়! মহারাজকি জয়।” কেহ গায়িল, “হরে মুরারে মধুকৈটভারে!” কেহ গায়িল, “বন্দে মাতরম্!” কেহ বলে–“ভাই, এমন দিন কি হইবে, তুচ্ছ বাঙ্গালি হইয়া রণক্ষেত্রে এ শরীরপাত করিব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধামাধবের মন্দির গড়িব?” কেহ বলে, “ভাই, এমন দিন কি হইবে, আপনার ধন আপনি খাইব?” দশ সহস্র নরকণ্ঠের কল কল রব, মধুর বায়ুসন্তাড়িত বৃক্ষপত্ররাশির মর্মর, সৈকতবাহিনী তরঙ্গিণীর মৃদু মৃদু তর তর রব, নীল আকাশে চন্দ্র, তারা শ্বেত মেঘরাশি, শ্যামল ধরণীতলে হরিৎ কানন, স্বচ্ছ নদী, শ্বেত সৈকত, ফুল্ল কুসুমদাম। আর মধ্যে মধ্যে সেই সর্বজনমনোরম “বন্দে মাতরম্!” সত্যানন্দ আসিয়া সেই সমবেত সন্তানমণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়াইলেন। তখন সেই দশ সহস্র সন্তানমস্তক বৃক্ষবিচ্ছেদপতিত চন্দ্রকিরণে প্রভাসিত হইয়া শ্যামল তৃণভূমে প্রণত হইল। অতি উচ্চস্বরে অশ্রুপূর্ণলোচনে উভয় বাহু ঊর্ধ্বে উত্তোলন করিয়া সত্যানন্দ বলিলেন, “শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বনমালী, বৈকুণ্ঠনাথ যিনি কেশিমথন, মধুমুরনরকমর্দন, লোকপলান, তিনি তোমাদের মঙ্গল করুন, তিনি তোমাদের বাহুতে বল দিন, মনে ভক্তি দিন, ধর্মে মতি দিন, তোমরা একবার তাঁহার মহিমা গীত কর |” তখন সেই সহস্র কণ্ঠে উচ্চৈ:স্বরে গীত হইতে লাগিল, –
“জয় জগদীশ হরে!
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্
বিহিতবহিত্রচরিত্রমখেদম্
কেশব ধৃতমীনশরীর
জয় জগদীশ হরে।”
সত্যানন্দ তাহাদিগকে পুনরায় আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, “হে সন্তানগণ, তোমাদের সঙ্গে আজ আমার বিশেষ কথা আছে। টমাসনামা এক জন বিধর্মী দুরাত্মা বহুতর সন্তান নষ্ট করিয়াছে। আজ রাত্রে আমরা তাহাকে সসৈন্যে বধ করিব। জগদীশ্বরের আজ্ঞা – তোমরা কি বল?”
ভীষণ হরিধ্বনিতে কানন বিদীর্ণ করিল। “এখনই মারিব – কোথায় তারা, দেখাইয়া দিবে চল!” “মার! মার! শত্রু মার!” ইত্যাদি শব্দ দুরস্থ শৈলে প্রতিধ্বনিত হইল। তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “সেজন্য আমাদিগকে একটু ধৈর্যাবলম্বন করিতে হইবে। শত্রুদের কামান আছে – কামান ব্যতীত তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধ সম্ভবে না। বিশেষ তাহারা বড় বীরজাতি। পদচিহ্নের দুর্গ হইতে ১৭টা কামান আসিতেছে – কামান পোঁছিলে আমরা যুদ্ধযাত্রা করিব। ঐ দেখ, প্রভাত হইতেছে – বেলা চারি দণ্ড হইলেই–ও কি ও–”
“গুড়ুম্–গুড়ুম্–গুম্!” অকস্মাৎ চারি দিকে বিশাল কাননে তোপের আওয়াজ হইতে লাগিল। তোপ ইংরেজের। জালনিবদ্ধ মীনদলবৎ কাপ্তেন টমাস সন্তানসম্প্রদায়কে এই আম্রকাননে ঘিরিয়া বধ করিবার উদ্যোগ করিয়াছে।
নবম পরিচ্ছেদ
“গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্ |” ইংরেজের কামান ডাকিল। সেই শব্দ বিশাল কানন কম্পিত করিয়া প্রতিধ্বনিত হইল, “গুড়ুম্ গুড়ুম গুম্।” নদীর বাঁকে বাঁকে ফিরিয়া সেই ধ্বনি দূরস্থ আকাশপ্রান্ত হইতে প্রতিক্ষিপ্ত হইল, “গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্ |” নদীপারে দূরস্থ কাননান্তরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই ধ্বনি আবার ডাকিতে লাগিল, “গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্!” সত্যানন্দ আদেশ করিলেন, “তোমরা দেখ, কিসের তোপ |” কয়েক জন সন্তান তৎক্ষণাৎ অশ্বারোহণ করিয়া দেখিতে ছুটিল, কিন্তু তাহারা কানন হইতে বাহির হইয়া কিছু দূর গেলেই শ্রাবণের ধারার ন্যায় গোলা তাহাদের উপর বৃষ্টি হইল, তাহারা অশ্বসহিত আহত হইয়া সকলেই প্রাণত্যাগ করিল। দূর হইতে সত্যানন্দ তাহা দেখিলেন। বলিলেন, “উচ্চ বৃক্ষে উঠ, দেখ কি |” তিনি বলিবার অগ্রেই জীবানন্দ বৃক্ষে আরোহণ করিয়া প্রভাতকিরণে দেখিতেছিলেন, তিনি বৃক্ষের উপরিস্থ শাখা হইতে ডাকিয়া বলিলেন, “তোপ ইংরেজের |” সত্যানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, “অশ্বারোহী, না পদাতি?”
জী। দুই আছে।
স। কত?
জী। আন্দাজ করিতে পারিতেছি না, এখনও বনের আড়াল হইতে বাহির হইতেছে।
স। গোরা আছে? না কেবল সিপাহী?
জী। গোরা আছে।
তখন সত্যানন্দ জীবানন্দকে বলিলেন, “তুমি গাছ হইতে নাম |”
জীবানন্দ গাছ হইতে নামিলেন।
সত্যানন্দ বলিলেন, “দশ হাজার সন্তান উপস্থিত আছে ; কি করিতে পার দেখ। তুমি আজ সেনাপতি।” জীবানন্দ সশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া উল্লম্ফনে অশ্বে আরোহণ করিলেন। একবার নবীনানন্দ গোস্বামীর প্রতি দৃষ্টি করিয়া নয়নেঙ্গিতে কি বলিলেন, কেহ তাহা বুঝিতে পারিল না। নবীনানন্দ নয়নেঙ্গিতে কি উত্তর করিল, তাহাও কেহ বুঝিল না, কেবল তাহা দুই জনেই মনে মনে বুঝিল যে, হয়ত এ জন্মের মত এই বিদায়। তখন নবীনানন্দ দক্ষিণ বাহু উত্তোলন করিয়া সকলকে বলিলেন, “ভাই! এই সময় গাও “জয় জগদীশ হরে’!” তখন সেই দশ সহস্র সন্তান এককণ্ঠে নদী কানন আকাশ প্রতিধ্বনিত করিয়া, তোপের শব্দ ডুবাইয়া দিয়া, সহস্র সহস্র বাহু উত্তোলন করিয়া গায়িল,-
“জয় জগদীশ হরে
ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্ |”
এমন সময়ে সেই ইংরেজের গোলাবৃষ্টি আসিয়া কাননমধ্যে সন্তানসম্প্রদায়ের উপর পড়িতে লাগিল। কেহ গায়িতে গায়িতে ছিন্নমস্তক ছিন্নবাহু ছিন্নহৃদপিণ্ড হইয়া মাটিতে পড়িল, তথাপি কেহ গীত বন্ধ করিল না, সকলে গায়িতে লাগিল, “জয় জগদীশ হরে!” গীত সমাপ্ত হইলে সকলেই একেবারে নিস্তব্ধ হইল। সেই নিবিড় কানন, সেই নদীসৈকত, সেই অনন্ত বিজন একেবারে গম্ভীর নীরবে নিবিষ্ট হইল ; কেবল সেই অতি ভয়ানক কামানের ধ্বনি আর দূরশ্রুত গোরার সমবেত অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা ও পদধ্বনি।
তখন সত্যানন্দ সেই গভীর নিস্তব্ধতামধ্যে অতি উচ্চৈ:স্বরে বলিলেন, “জগদীশ হরি তোমাদিগকে কৃপা করিবেন – তোপ কত দূর?”
উপর হইতে এক জন বলিল, “এই কাননের অতি নিকট, একখানা ছোট মাঠ পার মাত্র!”
সত্যানন্দ বলিলেন, “কে তুমি?”
উপর হইতে উত্তর হইল, “আমি নবীনানন্দ |”
তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা দশ সহস্র সন্তান, আজ তোমাদেরই জয় হইবে, তোপ কাড়িয়া লও”। তখন অগ্রবর্তী অশ্বারোহী জীবানন্দ বলিলেন, “আইস |”
সেই দশ সহস্র সন্তান – অশ্ব ও পদাতি, অতিবেগে জীবানন্দের অনুবর্তী হইল। পদাতির স্কন্ধে বন্দুক, কটীতে তরবারি, হস্তে বল্লম। কানন হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবামাত্র, সেই অজস্র গোলাবৃষ্টি পড়িয়া তাহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিল। বহুতর সন্তান বিনা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া ভূমিশায়ী হইল। একজন জীবানন্দকে বলিল, “জীবানন্দ, অনর্থক প্রাণিহত্যায় কাজ কি?”
জীবানন্দ ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলেন ভবানন্দ – জীবানন্দ উত্তর করিলেন, “কি করিতে বল |”
ভ। বনের ভিতর থাকিয়া বৃক্ষের আশ্রয় হইতে আপনাদিগের প্রাণরক্ষা করি – তোপের মুখে, পরিষ্কার মাঠে, বিনা তোপে এ সন্তানসৈন্য এক দণ্ড টিকিবে না ; কিন্তু ঝোপের ভিতর থাকিয়া অনেক্ষণ যুদ্ধ করা যাইতে পারিবে।
জী। তুমি সত্য কথা বলিয়াছ, কিন্তু প্রভু আজ্ঞা করিয়াছেন, তোপ কাড়িয়া লইতে হইবে, অতএব আমরা তোপ কাড়িয়া লইতে যাইব।
ভ। কার সাধ্য তোপ কাড়ে? কিন্তু যদি যেতেই হবে, তুমি নিরস্ত হও, আমি যাইতেছি।
জী। তা হবে না – ভবানন্দ! আজ আমার মরিবার দিন।
ভ। আজ আমার মরিবার দিন।
জী। আমার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।
ভ। তুমি নিষ্পাপশরীর – তোমার প্রায়শ্চিত্ত নাই। আমার চিত্ত কলুষিত – আমাকেই মরিতে হইবে – তুমি থাক, আমি যাই।
জী। ভবানন্দ! তোমার কি পাপ, তাহা আমি জানি না। কিন্তু তুমি থাকিলে সন্তানের কার্যোদ্ধার হইবে। আমি যাই।
ভবানন্দ নীরব হইয়া শেষে বলিলেন, “মরিবার প্রয়োজন হয় আজই মরিব, যে দিন মরিবার প্রয়োজন হইবে, সেই দিন মরিব, মৃত্যুর পক্ষে আবার কালাকাল কি?”
জী। তবে এস।
এই কথার পর ভবানন্দ সকলের অগ্রবর্তী হইলেন। তখন দলে দলে, ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা পড়িয়া সন্তানসৈন্য খণ্ড বিখণ্ড করিতেছে, ছিঁড়িয়া চিরিতেছে, উল্টাইয়া ফেলিয়া দিতেছে, তাহার উপর শত্রুর বন্দুকওয়ালা সিপাহী সৈন্য অব্যর্থ লক্ষ্যে সারি সারি সন্তানদলকে ভূমে পাড়িয়া ফেলিতেছে। এমন সময়ে ভবানন্দ বলিলেন, “এই তরঙ্গে আজ সন্তানকে ঝাঁপ দিতে হইবে – কে পার ভাই? এই সময় গাও “বন্দে মাতরম্!” তখন উচ্চ নিনাদে মেঘমল্লার রাগে সেই সহস্রকণ্ঠ সন্তানসেনা তোপের তালে গায়িল, “বন্দে মাতরম্ |”
দশম পরিচ্ছেদ
সেই দশ সহস্র সন্তান “বন্দে মাতরম্” গায়িতে গায়িতে বল্লম উন্নত করিয়া অতি দ্রুত বেগে তোপশ্রেণীর উপর গিয়া পড়িল। গোলাবৃষ্টিতে খণ্ড বিখণ্ড বিদীর্ণ উৎপতিত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল হইয়া গেল, তথাপি সন্তানসৈন্য ফেরে না। সেই সময়ে কাপ্তেন টমাসের আজ্ঞায় এক দল সিপাহী বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া প্রবলবেগে সন্তানদিগের দক্ষিণ পার্শ্বে আক্রমণ করিল। তখন দুই দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া সন্তানেরা একেবারে নিরাশ হইল। মুহূর্তে শত শত সন্তান বিনষ্ট হইতে লাগিল। তখন জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন্দ, তোমারই কথা ঠিক, আর বৈষ্ণবধ্বংসের প্রয়োজন নাই; ধীরে ধীরে ফিরি |”
ভ। এখন ফিরিবে কি প্রকারে? এখন যে পিছন ফিরিবে, সেই মরিবে।
জী। সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে আক্রমণ হইতেছে। বাম পার্শ্বে কেহ নাই, চল, অল্পে অল্পে ঘুরিয়া বাম দিক্ দিয়া বেড়িয়া সরিয়া যাই।
ভ। সরিয়া কোথায় যাইবে? সেখানে যে নদী – নূতন বর্ষায় নদী যে অতি প্রবল হইয়াছে। তুমি ইংরেজের গোলা হইতে পলাইয়া এই সন্তানসেনা নদীর জলে ডুবাইবে?
জী। নদীর উপর একটা পুল আছে, আমার স্মরণ হইতেছে।
ভ। এই দশ সহস্র সেনা সেই পুলের উপর দিয়া পার করিতে গেলে এত ভিড় হইবে যে, বোধ হয়, একটা তোপেই অবলীলাক্রমে সমুদয় সন্তানসেনা ধ্বংস করিতে পারিবে।
জী। এক কর্ম কর, অল্পসংখ্যক সেনা তুমি সঙ্গে রাখ, এই যুদ্ধে তুমি যে সাহস ও
চাতুর্য দেখাইলে – তোমার অসাধ্য কাজ নাই। তুমি সেই অল্পসংখ্যক সন্তান লইয়া সম্মুখ রক্ষা কর। আমি তোমার সেনার অন্তরালে অবশিষ্ট সন্তানগণকে পুল পার করিয়া লইয়া যাই, তোমার সঙ্গে যাহারা রহিল, তাহারা নিশ্চিত বিনষ্ট হইবে, আমার সঙ্গে যাহা রহিল, তাহা বাঁচিলে বাঁচিতে পারিবে।
ভ। আচ্ছা, আমি তাহা করিতেছি।
তখন ভবানন্দ দুই সহস্র সন্তান লইয়া পুনর্বার “বন্দে মাতরম্” শব্দ উত্থিত করিয়া ঘোর উৎসাহ সহকারে ইংরেজের গোলন্দাজ সৈন্য আক্রমণ করিলেন। সেইখানে ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল, কিন্তু তোপের মুখে সেই ক্ষুদ্র সন্তানসেনা কতক্ষণ টিকে? ধানকাটার মত তাহাদিগকে গোলন্দাজেরা ভূমিশায়ী করিতে লাগিল।
এই অবসরে জীবানন্দ অবশিষ্ট সন্তানসেনার মুখ ঈষৎ ফিরাইয়া বাম ভাগে কানন বেড়িয়া ধীরে ধীরে চলিলেন। কাপ্তেন টমাসের এক জন সহযোগী লেপ্টেনাণ্ট ওয়াটসন দূর হইতে দেখিলেন যে, এক সম্প্রদায় সন্তান ধীরে ধীরে পলাইতেছে, তখন তিনি এক দল ফৌজদারী সিপাহী, এক দল পরগণা সিপাহী লইয়া জীবানন্দের অনুবর্তী হইলেন।
ইহা কাপ্তেন টমাস দেখিতে পাইলেন। সন্তানসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রধান ভাগ পলাইতেছে দেখিয়া তিনি কাপ্তেন হে নামা একজন সহযোগীকে বলিলেন যে, “আমি দুই চারি শত সিপাহী লইয়া এই উপস্থিত ভগ্নবিদ্রোহীদিগকে নিহত করিতেছি, তুমি তোপগুলি ও অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া উহাদের প্রতি ধাবমান হও, বাম দিক দিয়া লেপ্টেনাণ্ট ওয়াটসন যাইতেছেন, দক্ষিণ দিক দিয়া তুমি যাও। আর দেখ, আগে গিয়া পুলের মুখ বন্ধ করিতে হইবে ; তাহা হইলে তিন দিক হইতে উহাদিগকে বেষ্টিত করিয়া জালের পাখীর মত মারিতে পারিব। উহারা দ্রুতপদ দেশী ফৌজ, সর্বাপেক্ষা পলায়নেই সুদক্ষ, অতএব তুমি উহাদিগকে সহজে ধরিতে পারিবে না, তুমি অশ্বারোহীদিগকে একটু ঘুর পথে আড়াল দিয়া গিয়া পুলের মুখে দাঁড়াইতে বল, তাহা হইলে কর্ম সিদ্ধ হইবে।” কাপ্তেন হে তাহাই করিল।
“অতিদর্পে হতা লঙ্কা |” কাপ্তেন টমাস সন্তানদিগকে অতিশয় ঘৃণা করিয়া দুই শত মাত্র পদাতিক ভবানন্দের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য রাখিয়া, আর সকল হের সঙ্গে পাঠাইলেন। চতুর ভবানন্দ যখন দেখিলেন, ইংরেজের তোপ সকলই গেল, সৈন্য সব গেল, যাহা অল্পই রহিল, তাহা সহজেই বধ্য, তখন তিনি নিজ হতাবশিষ্ট দলকে ডাকিয়া বলিলেন যে, “এই কয়জনকে নিহত করিয়া জীবানন্দের সাহায্যে আমাকে যাইতে হইবে। আর একবার তোমরা ‘জয় জগদীশ হরে’ বল |” তখন সেই অল্পসংখ্যক সন্তানসেনা “জয় জগদীশ হরে” বলিয়া ব্যাঘ্রের ন্যায় কাপ্তেন টমাসের উপর লাফাইয়া পড়িল। সেই আক্রমণের উগ্রতা অল্পসংখ্যক সিপাহী ও তৈলঙ্গীর দল সহ্য করিতে পারিল না, তাহারা বিনষ্ট হইল। ভবানন্দ তখন নিজে গিয়া কাপ্তেন টমাসের চুল ধরিলেন। কাপ্তেন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করিতেছিল। ভবানন্দ বলিলেন, “কাপ্তেন সাহেব, তোমায় মারিব না, ইংরেজ আমাদিগের শত্রু নহে। কেন তুমি মুসলমানের সহায় হইয়া আসিয়াছ? আইস – তোমার প্রাণদান দিলাম, আপাতত: তুমি বন্দী। ইংরেজের জয় হউক, আমরা তোমাদের সুহৃদ |” কাপ্তেন টমাস তখন ভবানন্দকে বধ করিবার জন্য সঙ্গীনসহিত একটা বন্দুক উঠাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ভবানন্দ তাহাকে বাঘের মত ধরিয়াছিলেন, কাপ্তেন টমাস নড়িতে পারিল না। তখন ভবানন্দ অনুচরবর্গকে বলিলেন যে, “ইহাকে বাঁধ।” দুই তিন জন সন্তান আসিয়া কাপ্তেন টমাসকে বাঁধিল। ভবানন্দ বলিলেন, “ইহাকে একটা ঘোড়ার উপর তুলিয়া লও; চল, উহাকে লইয়া আমরা জীবানন্দ গোস্বামীর আনুকূল্যে যাই |”
তখন সেই অল্পসংখ্যক সন্তানগণ কাপ্তেন টমাসকে ঘোড়ায় বাঁধিয়া লইয়া “বন্দে মাতরম্” গায়িতে গায়িতে লেপ্টেনাণ্ট ওয়াটসনকে লক্ষ্য করিয়া ছুটিল।
জীবানন্দের সন্তানসেনা ভগ্নোদ্যম, তাহারা পলায়নে উদ্যত। জীবানন্দ ও ধীরানন্দ, তাহাদিগকে বুঝাইয়া সংযত রাখিলেন, কিন্তু সকলকে পারিলেন না, কতকগুলি পলাইয়া আম্রকাননে আশ্রয় লইল। অবশিষ্ট সেনা জীবানন্দ ও ধীরানন্দ পুলের মুখে লইয়া গেলেন। কিন্তু সেইখানে হেও ওয়াটসন তাহাদিগকে দুই দিক হইতে ঘিরিল। আর রক্ষা নাই।
একাদশ পরিচ্ছেদ
এই সময়ে টমাসের তোপগুলি দক্ষিণে আসিয়া পৌঁছিল। তখন সন্তানের দল একেবারে ছিন্নভিন্ন হইল, কেহ বাঁচিবার আর কোন আশা রহিল না। সন্তানেরা যে যেখানে পাইল, পলাইতে লাগিল। জীবানন্দ ধীরানন্দ তাহাদিগকে সংযত এবং একত্রিত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই পারিলেন না। সেই সময় উচ্চৈ:শব্দ হইল, “পুলে যাও, পুলে যাও! ও পারে যাও। নহিলে নদীতে ডুবিয়া মরিবে, ধীরে ধীরে ইংরেজসেনার দিকে মুখ রাখিয়া পুলে যাও |”
জীবানন্দ চাহিয়া দেখিলেন, সম্মুখে ভবানন্দ। ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ পুলে লইয়া যাও, রক্ষা নাই |” তখন ধীরে ধীরে পিছে হঠিতে হঠিতে সন্তানসেনা পুলের পারে চলিল। কিন্তু পুল পাইয়া বহুসংখ্যক সন্তান একেবারে পুলের ভিতর প্রবেশ করায় ইংরেজের তোপ সুযোগ পাইল। পুল একেবারে ঝাঁটাইতে লাগিল। সন্তানের দল বিনষ্ট হইতে লাগিল। ভবানন্দ জীবানন্দ ধীরানন্দ একত্র। একটা তোপের দৌরাত্ম্যে ভয়ানক সন্তানক্ষয় হইতেছিল। ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ, ধীরানন্দ, এস – তরবারি ঘুরাইয়া আমরা তিন জন এই তোপটা দখল করি |” তখন তিন জনে তরবারি ঘুরাইয়া সেই তোপের নিকটবর্তী গোলন্দাজ সেনা বধ করিলেন। তখন আর আর সন্তানগণ তাহাদের সাহায্যে আসিল। তোপটা ভবানন্দের দখল হইল। তোপ দখল করিয়া ভবানন্দ তাহার উপর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। করতালি দিয়া বলিলেন, “বল বন্দে মাতরম্ |” সকলে গায়িল, “বন্দে মাতরম্।” ভবানন্দ বলিলেন, “জীবানন্দ, এই তোপ ঘুরাইয়া বেটাদের লুচির ময়দা তৈয়ার করি।” সন্তানেরা সকলে ধরিয়া তোপ ঘুরাইল। তখন তোপ উচ্চনাদে বৈষ্ণবের কর্ণে যেন হরি হরি শব্দে ডাকিতে লাগিল। বহুতর সিপাহী তাহাতে মরিতে লাগিল। ভবানন্দ সেই তোপ টানিয়া আনিয়া পুলের মুখে স্থাপন করিয়া বলিলেন, “তোমরা দুই জনে সন্তানসেনা সারি দিয়া পুল পার করিয়া লইয়া যাও, আমি একা এই ব্যুহমুখ রক্ষা করিব – তোপ চালাইবার জন্য আমার কাছে জন কয় গোলন্দাজ দিয়া যাও |” কুড়ি জন বাছা বাছা সন্তান ভবানন্দের কাছে রহিল।
তখন অসংখ্য সন্তান পুল পার হইয়া জীবানন্দ ও ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে সারি দিয়া পরপারে যাইতে লাগিল। একা ভবানন্দ কুড়ি জন সন্তানের সাহায্যে সেই এক কামানের বহুতর সেনা নিহত করিতে লাগিলেন – কিন্তু যবনসেনা জলোচ্ছ্বাসোত্থিত তরঙ্গের ন্যায়! তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ ! – ভবানন্দকে সংবেষ্টিত, উৎপীড়িত, নিমগ্নের ন্যায় করিয়া তুলিল। ভবানন্দ অশ্রান্ত, অজেয়, নির্ভীক – কামানের শব্দে শব্দে কতই সেনা বিনষ্ট করিতে লাগিলেন। যবন বাত্যাপীড়িত তরঙ্গাভিঘাতের ন্যায় তাঁহার উপর আক্রমণ করিতে লাগিল, কিন্তু কুড়ি জন সন্তান, তোপ লইয়া পুলের মুখ বন্ধ করিয়া রহিল। তাহারা মরিয়াও মরে না – যবন পুলে ঢুকিতে পায় না। সে বীরেরা অজেয়, সে জীবন অবিনশ্বর। অবসর পাইয়া দলে দলে সন্তানসেনা অপর পারে গেল। আর কিছুকাল পুল রক্ষা করিতে পারিলেই সন্তানেরা সকলেই পুলের পারে যায় – এমন সময় কোথা হইতে নূতন তোপ ডাকিল–“গুড়ুম্ গুড়ুম্ বুম্ বুম্ |” উভয় দল কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া চাহিয়া রহিল – কোথায় আবার কামান! দেখিল, বনের ভিতর হইতে কতকগুলি কামান দেশী গোলন্দাজ কর্তৃক চালিত হইয়া নির্গত হইতেছে। নির্গত হইয়া সেই বিরাট কামানের শ্রেণী সপ্তদশ মুখে ধূম উদ্গীর্ণ করিয়া হে সাহেবের দলের উপর অগ্নিবৃষ্টি করিল। ঘোর শব্দে বন নদ গিরি সকলই প্রতিধ্বনিত হইল। সমস্ত দিনের রণে ক্লান্ত যবনসেনা প্রাণভয়ে শিহরিল। অগ্নিবৃষ্টিতে তৈলঙ্গী, মুসলমান, হিন্দুস্থানী পলায়ন করিতে লাগিল। কেবল দুই চারি জন গোরা দাঁড়াইয়া মরিতে লাগিল।
ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিলেন। ভবানন্দ বলিলেন, “ভাই, নেড়ে ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ কর।” তখন পিপীলিকাস্রোতবৎ সন্তানের দল নূতন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না – যেমন ভাগীরথীতরঙ্গ সেই দম্ভকারী বৃহৎ পর্বতাকার মত্ত হস্তীকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সন্তানেরা তেমনি যবনদিগকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। যবনেরা দেখিল, পিছনে ভবানন্দের পদাতিক সেনা, সম্মুখে মহেন্দ্রের কামান। তখন হে সাহেবের সর্বনাশ উপস্থিত হইল। আর কিছু টিকিল না – বল, বীর্য, সাহস, কৌশল, শিক্ষা, দম্ভ, সকলই ভাসিয়া গেল। ফৌজদারী, বাদশাহী, ইংরেজী, দেশী, বিলাতী, কালা, গোরা সৈন্য নিপতিত হইয়া ভূতলশায়ী হইল। বিধর্মীর দল পলাইল। মার মার শব্দে জীবানন্দ, ভবানন্দ, ধীরানন্দ, বিধর্মী সেনার পশ্চাতে ধাবমান হইলেন। তাহাদের তোপ সন্তানেরা কাড়িয়া লইল, বহুতর ইংরেজ ও সিপাহী নিহত হইল। সর্বনাশ হইল দেখিয়া কাপ্তেন হে ও ওয়াটসন ভবানন্দের নিকট বলিয়া পাঠাইল, “আমরা সকলে তোমাদিগের নিকট বন্দী হইতেছি, আর প্রাণিহত্যা করিও না |” জীবানন্দ ভবানন্দের মুখপানে চাহিলেন। ভবানন্দ মনে মনে বলিলেন, “তা হইবে না, আমায় যে আজ মরিতে হইবে।” তখন ভবানন্দ উচ্চৈ:স্বরে হস্তোত্তোলন করিয়া হরিবোল দিয়া বলিলেন, “মার মার |”
আর এক প্রাণী বাঁচিল না – শেষ এক স্থানে ২০/৩০ জন গোরা সৈন্য একত্রিত হইয়া আত্মসমর্পণে কৃতনিশ্চয় হইল, অতি ঘোরতর রণ করিতে লাগিল। জীবানন্দ বলিলেন, “ভবানন্দ, আমাদের রণজয় হইয়াছে, আর কাজ নাই, এই কয় জন ব্যতীত আর কেহ জীবিত নাই। উহাদিগকে প্রাণ দান দিয়া চল আমরা ফিরিয়া যাই”। ভবানন্দ বলিলেন, “এক জন জীবিত থাকিতে ভবানন্দ ফিরিবে না – জীবানন্দ, তোমায় দিব্য দিয়া বলিতেছি যে, তুমি তফাতে দাঁড়াইয়া দেখ, একা আমি এই কয় জন ইংরেজকে নিহত করি |”
কাপ্তেন টমাস বাঙ্গালা বুঝিত, বুঝিয়া ইংরেজসেনাকে বলিল, “ইংরেজ! আমি ত মরিয়াছি, প্রাচীন ইংলণ্ডের নাম তোমরা রক্ষা করিও, তোমাদিগকে খ্রীষ্টের দিব্য দিতেছি, আগে আমাকে মার, তার পর এই বিদ্রোহীদিগকে মার |”
ভোঁ করিয়া একটি বুলেট ছুটিল, এক জন আইরিসম্যান কাপ্তেন টমাসকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িয়াছিল। ললাটে বিদ্ধ হইয়া কাপ্তেন টমাস প্রাণত্যাগ করিল। ভবানন্দ তখন ডাকিয়া বলিলেন, “আমার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হইয়াছে, কে এমন পার্থ বৃকোদর নকুল সহদেব আছে যে, এ সময় আমাকে রক্ষা করিবে! দেখ, বাণাহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গোরা আমার উপর ঝুঁকিয়াছে। আমি মরিবার জন্য আসিয়াছি; আমার সঙ্গে মরিতে চাও, এমন সন্তান কেহ আছে?”
আগে ধীরানন্দ অগ্রসর হইল, পিছে জীবানন্দ–সঙ্গে সঙ্গে আর ১০/১৫/২০/৫০ জন সন্তান আসিল। ভবানন্দ ধীরানন্দকে দেখিয়া বলিলেন, “তুমিও যে আমাদের সঙ্গে মরিতে আসিলে?”
ধী। “কেন, মরা কি কাহারও ইজারামহল না কি?” এই বলিতে বলিতে ধীরানন্দ এক জন গোরাকে আহত করিলেন।
ভ। তা নয়, কিন্তু মরিলে ত স্ত্রীপুত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করিতে পারিবে না!
ধী। কালিকার কথা বলিতেছ? এখনও বুঝ নাই?–(ধীরানন্দ আহত গোরাকে বধ করিলেন।)
ভ। না–(এই সময়ে এক জন গোরার আঘাতে ভবানন্দের দক্ষিণ বাহু ছিন্ন হইল।)
ধী। আমার সাধ্য কি যে, তোমার ন্যায় পবিত্রাত্মাকে সে সকল কথা বলি। আমি সত্যানন্দের প্রেরিত চর হইয়া গিয়াছিলাম।
ভ। সে কি? মহারাজের আমার প্রতি অবিশ্বাস? (ভবানন্দ তখন এক হাতে যুদ্ধ করিতেছিলেন) ধীরানন্দ তাঁহাকে রক্ষা করিতে করিতে বলিলেন, “কল্যাণীর সঙ্গে তোমার যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা তিনি স্বকর্ণে শুনিয়াছিলেন |”
ভ। কি প্রকারে?
ধী। তিনি তখন স্বয়ং সেখানে ছিলেন। সাবধান থাকিও। (ভবানন্দ এক জন গোরা কর্তৃক আহত হইয়া তাহাকে প্রত্যাহত করিলেন।) তিনি কল্যাণীকে গীতা পড়াইতেছিলেন, এমত সময়ে তুমি আসিলে। সাবধান! (ভবানন্দের বাম বাহুও ছিন্ন হইল।)
ভ। আমার মৃত্যুসংবাদ তাঁহাকে দিও! বলিও, আমি অবিশ্বাসী নহি।
ধীরানন্দ বাষ্পপূর্ণলোচনে যুদ্ধ করিতে করিতে বলিলেন, “তাহা তিনি জানেন। কালি রাত্রের আশীর্বাদবাক্য মনে কর। আর আমাকে বলিয়া দিয়াছেন, ‘ভবানন্দের কাছে থাকিও, আজ সে মরিবে। মৃত্যুকালে তাহাকে বলিও, আমি আশীর্বাদ করিতেছি, পরলোকে তাহার বৈকুণ্ঠপ্রাপ্তি হইবে’।“
ভবানন্দ বলিলেন, “সন্তানের জয় হউক, ভাই! আমার মৃত্যুকালে একবার ‘বন্দে মাতরম্’ শুনাও দেখি!”
তখন ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে যুদ্ধোন্মত্ত সকল মহাতেজে “বন্দে মাতরম্” গায়িল। তাহাতে তাহাদিগের বাহুতে দ্বিগুণ বলসঞ্চার হইয়া উঠিল। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে অবশিষ্ট গোরাগণ নিহত হইল। রণক্ষেত্রে আর শত্রু রহিল না।
সেই মুহূর্তে ভবানন্দ মুখে “বন্দে মাতরম্” গায়িতে গায়িতে, মনে বিষ্ণুপদ ধ্যান করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন।
হায়! রমণীরূপলাবণ্য! ইহসংসারে তোমাকেই ধিক্।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
রণজয়ের পর অজয়তীরে সত্যানন্দকে ঘিরিয়া বিজয়ী বীরবর্গ নানা উৎসব করিতে লাগিল। কেবল সত্যানন্দ বিমর্ষ, ভবানন্দের জন্য।
এতক্ষণ বৈষ্ণবদিগের রণবাদ্য অধিক ছিল না, কিন্তু সেই সময় কোথা হইতে সহস্র সহস্র কাড়া নাগরা, ঢাক ঢোল, কাঁসি সানাই, তুরী ভেরী, রামশিঙ্গা, দামামা, আসিয়া জুটিল। জয়সূচক বাদ্যে কানন প্রান্তর নদীসকল শব্দ ও প্রতিধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। এইরূপে সন্তানগণ অনেক্ষণ ধরিয়া নানারূপ উৎসব করিলে পর সত্যানন্দ বলিলেন, “জগদীশ্বর আজ কৃপা করিয়াছেন, সন্তানধর্মের জয় হইয়াছে, কিন্তু এক কাজ বাকি আছে। যাহারা আমাদিগের সঙ্গে উৎসব করিতে পাইল না, যাহারা আমাদের উৎসবের জন্য প্রাণ দিয়াছে, তাহাদিগকে ভুলিলে চলিবে না। যাহারা রণক্ষত্রে নিহত হইয়া পড়িয়া আছে, চল যাই, আমরা গিয়া তাহাদিগের সৎকার করি ; বিশেষ যে মহাত্মা আমাদের জন্য এই রণজয় করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, চল – মহান উৎসব করিয়া সেই ভবানন্দের সৎকার করি |” তখন সন্তানদল “বন্দে মাতরম্” বলিতে বলিতে নিহতদিগের সৎকারে চলিল। বহু লোক একত্রিত হইয়া হরিবোল দিতে দিতে ভারে ভারে চন্দনকাষ্ঠ বহিয়া আনিয়া ভবানন্দের চিতা রচনা করিল, এবং তাহাতে ভবানন্দকে শায়িত করিয়া, অগ্নি জ্বালিত করিয়া, চিতা বেড়িয়া বেড়িয়া “হরে মুরারে” গায়িতে লাগিল। ইহারা বিষ্ণুভক্ত, বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত নহে, অতএব দাহ করে।
কাননমধ্যে তৎপরে কেবল সত্যানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র, নবীনানন্দ ও ধীরানন্দ আসীন ; গোপনে পাঁচ জনে পরামর্শ করিতেছেন। সত্যানন্দ বলিলেন, “এত দিনে যে জন্য আমরা সর্বধর্ম সর্বসুখ ত্যাগ করিয়াছিলাম, সেই ব্রত সফল হইয়াছে, এ প্রদেশে যবন সেনা আর নাই, যাহা অবশিষ্ট আছে, এক দণ্ড আমাদিগের নিকট টিকিবে না, তোমরা এখন কি পরামর্শ দাও?”
জীবানন্দ বলিলেন, “চলুন, এই সময়ে গিয়া রাজধানী অধিকার করি |”
স। আমারও সেই মত।
ধী। সৈন্য কোথায়?
জী। কেন, এই সৈন্য?
ধী। এই সৈন্য কই? কাহাকে দেখিতে পাইতেছেন?
জী। স্থানে স্থানে সব বিশ্রাম করিতেছে, ডঙ্কা দিলে অবশ্য পাওয়া যাইবে।
ধী। এক জনকেও পাইবেন না।
স। কেন?
ধী। সবাই লুঠিতে বাহির হইয়াছে। গ্রামসকল এখন অরক্ষিত। মুসলমানের গ্রাম আর রেশমের কুঠি লুঠিয়া সকলে ঘরে যাইবে। এখন কাহাকেও পাইবেন না। আমি খুঁজিয়া আসিয়াছি।
সত্যানন্দ বিষণ্ণ হইলেন, বলিলেন, “যাই হউক, এ প্রদেশ সমস্ত আমাদের অধিকৃত হইল। এখানে আর কেহ নাই যে, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। অতএব বরেন্দ্রভূমিতে তোমরা সন্তানরাজ্য প্রচার কর। প্রজাদিগের নিকট হইতে কর আদায় কর এবং নগর অধিকার করিবার জন্য সেনা সংগ্রহ কর। হিন্দুর রাজ্য হইয়াছে শুনিলে, বহুতর সেনা সন্তানের নিশান উড়াইবে |”
তখন জীবানন্দ প্রভৃতি সত্যানন্দকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, “আমরা প্রণাম করিতেছি–হে মহারাজধিরাজ! আজ্ঞা হয় ত আমরা কাননেই আপনার সিংহাসন স্থাপিত করি |”
সত্যানন্দ তাঁহার জীবনে এই প্রথম কোপ প্রকাশ করিলেন। বলিলেন, “ছি! আমায় কি শূন্য কুম্ভ মনে কর? আমরা কেহ রাজা নহি – আমরা সন্ন্যাসী। এখন দেশের রাজা বৈকুণ্ঠনাথ স্বয়ং। নগর অধিকার হইলে, যাহার শিরে তোমাদিগের ইচ্ছা হয়, রাজমুকুট পরাইও, কিন্তু ইহা নিশ্চিত জানিও যে, আমি এই, ব্রহ্মচর্য ভিন্ন আর কোন আশ্রমই স্বীকার করিব না। এক্ষণে তোমরা স্ব স্ব কর্মে যাও |”
তখন চারি জনে ব্রহ্মচারীকে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। সত্যানন্দ তখন অন্যের অলক্ষিতে ইঙ্গিত করিয়া মহেন্দ্রকে রাখিলেন। আর তিন জন চলিয়া গেলেন, মহেন্দ্র রহিলেন। সত্যানন্দ তখন মহেন্দ্রকে বলিলেন, “তোমরা সকলে বিষ্ণুমণ্ডপে শপথ করিয়া সন্তানধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলে। ভবানন্দ ও জীবানন্দ দুই জনেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছে, ভবানন্দ আজ তাহার স্বীকৃত প্রায়শ্চিত্ত করিল, আমার সর্বদা ভয় কোন্ দিন জীবানন্দ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া দেহ বিসর্জন করে। কিন্তু আমার এক ভরসা আছে, কোন নিগূঢ় কারণে সে এক্ষণে মরিতে পারিবে না। তুমি একা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়াছ। এক্ষণে সন্তানের কার্যোদ্ধার হইল ; প্রতিজ্ঞা ছিল যে, যতদিন না সন্তানের কার্যোদ্ধার হয়, ততদিন তুমি স্ত্রী কন্যার মুখদর্শন করিবে না। এক্ষণে কার্যোদ্ধার হইয়াছে, এখন আবার সংসারী হইতে পার |”
মহেন্দ্রের চক্ষে দরদরিত ধারা বহিল। মহেন্দ্র বলিলেন, “ঠাকুর, সংসারী হইব কাহাকে লইয়া? স্ত্রী ত আত্মঘাতিনী হইয়াছেন, আর কন্যা কোথায় যে, তা ত জানি না, কোথায় বা সন্ধান পাইব? আপনি বলিয়াছেন, জীবিত আছে। ইহাই জানি, আর কিছু জানি না |”
সত্যানন্দ তখন নবীনানন্দকে ডাকিয়া মহেন্দ্রকে বলিলেন, “ইনি নবীনানন্দ গোস্বামী – অতি পবিত্রচেতা, আমার প্রিয়শিষ্য। ইনি তোমার কন্যার সন্ধান বলিয়া দিবেন।” এই বলিয়া সত্যানন্দ শান্তিকে কিছু ইঙ্গিত করিলেন। শান্তি তাহা বুঝিয়া প্রণাম করিয়া বিদায় হয়, তখন মহেন্দ্র বলিলেন, “কোথায় তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে?”
শান্তি বলিল, “আমার আশ্রমে আসুন |” এই বলিয়া শান্তি আগে আগে চলিল।
তখন মহেন্দ্র ব্রহ্মচারীর পাদবন্দনা করিয়া বিদায় হইলেন এবং শান্তির সঙ্গে সঙ্গে তাহার আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তখন অনেক রাত্রি হইয়াছে। তথাপি শান্তি বিশ্রাম না করিয়া নগরাভিমুখে যাত্রা করিল।
সকলে চলিয়া গেলে ব্রহ্মচারী, একা ভূমে প্রণত হইয়া, মাটিতে মস্তক স্থাপন করিয়া মনে মনে জগদীশ্বরের ধ্যান করিতে লাগিলেন। রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিল। এমন সময়ে কে আসিয়া তাঁহার মস্তক স্পর্শ করিয়া বলিল, “আমি আসিয়াছি |”
ব্রহ্মচারী উঠিয়া চমকিত হইয়া অতি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আপনি আসিয়াছেন? কেন?” যে আসিয়াছিল সে বলিল, “দিন পূর্ণ হইয়াছে।” ব্রহ্মচারী বলিলেন, “হে প্রভু! আজ ক্ষমা করুন। আগামী মাঘী পূর্ণিমায় আমি আপনার আজ্ঞা পালন করিব |”