অপরাজিত (Aparajito) : 08
একদিন অপু দুপুরবেলা কলেজ হইতে বাসায় ফিরিয়াস আসিয়া গায়ের জামা খুলিতেছে, এমন সময় পাশের বাড়ির জানালাটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়িতে সে আর চোখ ফিরাইয়া সইতে পারিল না। জানালাটার গায়ে খড়ি দিয়া মাঝারি অক্ষরে মেয়েলি ছাঁদে লেখা আছে—হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে। অপু অবাক হইয়া খানিকটা সেদিকে চাহিয়া রহিল এবং পরক্ষণেই কৌতুকের আবেগে হাতের নোটখাতাখানা মেজেতে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া আপন মনে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
পাশের বাড়ি—তাহার ঘরটা হইতে জানালাটা হাত পাঁচ ছয় দূরে—মধ্যে একটা সরু গলি। অনেকদিন সে দেখিয়াছে, পাশের বাড়ির একটি মেয়ে জানালার গরাদে ধরিয়া এদিকে চাহিয়া আছে, বয়স চৌদ্দ-পনেরো। রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কোকড়া কোঁকড়া চুল, বেশ মুখখানা, যদিও তাহাকে সুন্দরী বলিয়া কোনদিনও অপুর মনে হয় নাই। তাহার কলেজ হইতে আসিবার সময় হইলে প্রায়ই সে মেয়েটিকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিত, ক্রমে শুধু দাঁড়ানো নয়, মেয়েটি তাহাকে দেখিলেই হঠাৎ হাসিয়া জানালার আড়ালে মুখ লুকায়, কখনও বা জানলাটার খড়খড়ি বারকতক খুলিয়া বন্ধ করিয়া মনোযোগ আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করে, দিনের মধ্যে দুবার, তিনবার, চারবার কাপড় বদলাইয়া ঘরটার মধ্যে অকারণে ঘোরাফেরা করে এবং ছুতানাতায় জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। কতদিন এরকম হয়, অপু মনে মনে ভাবে—মেয়েটা আচ্ছা বেহায়া তো! কিন্তু আজকের এ ব্যাপার একেবারে অপ্রত্যাশিত।
আজ ও-বেলা উড়ে ঠাকুরের হোটেলে খাইতে গিয়া সে দেখিয়াছিল, সুন্দর ঠাকুর মুখ ভার করিয়া বসিয়া আছে। দুই-তিন মাসের টাকা বাকি, সামান্য পুঁজির হোটেল, অপূর্ববাবু ইহার কি ব্যবস্থা করিতেছেন?…আর কতদিন এভাবে সে বাকি টানিয়া যাইবে?…সুন্দর ঠাকুরের কথায় তাহার মনে যে দুর্ভাবনার মেঘ জমিয়াছিল, সেটা কৌতুকের হাওয়ায় এক মুহূর্তে কাটিয়া গেল!—আচ্ছা তো মেয়েটা? দ্যাখো কি লিখে রেখেছে—ওদের-হো-হো—আচ্ছা—হি-হি–
সেদিন আর মেয়েটিকে দেখা গেল না, যদিও সন্ধ্যার সময় একবার ঘরে ফিরিয়া সে দেখিল, জানালার সে খড়ির লেখা মুছিয়া ফেলা হইয়াছে। পরদিন সকালে ঘরের মধ্যে মাদুর বিছাইয়া পড়িতে পড়িতে মুখ তুলিতেই অপু দেখিতে পাইল, মেয়েটি জানালার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। কলেজে যাইবার কিছু আগে মেয়েটি আর একবার আসিয়া দাঁড়াইল। সবে স্নান সারিয়া আসিয়াছে, লালপাড় শাড়ি পরনে, ভিজে চুল পিঠের উপর ফেলা, সোনার বালা পরা নিটোল ডান হাতটি দিয়া জানালার গরাদে ধরিয়া আছে। অল্পক্ষণের জন্য–
কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সে কলেজে গেল। সেখানে অনেকের কাছে ব্যাপারটা গল্প করিল। প্রণব তো শুনিয়া হাসিয়া খুন, জানকীও তাই। সবাই আসিয়া দেখিতে চায়—এ যে একেবারে সত্যিকার জানালা-কাব্য! সত্যেন বলিল, নভেল ও মাসিকের পাতায় পড়া যায় বটে, কিন্তু বাস্তব জগতে এরকম যে ঘটে তাহা তো জানা ছিল না!…নানা হাসি তামাশা চলিল, সকলেই যে ভদ্রতাসঙ্গত কথা বলিয়াই ক্ষান্ত রহিল তাহা বলিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে।
তারপর দিনচারেক বেশ কাটিল, হঠাৎ একদিন আবার জানালায় লেখা—হেমলতা আপনাকে বিবাহ করিবে। জানালার খড়খড়ির গায়ে এমনভাবে লেখা যে, জানালা খুলিয়া লম্বা কবজাটা মুড়িয়া ফেলিলে লেখাটা শুধু তাহার ঘর হইতেই দেখা যায়, অন্য কারুর চোখে পড়িবার কথা নহে। প্রণবটা যদি এ সময় এখানে থাকিত! তারপর আবার দিন-দুই সব ঠাণ্ডা।
সেদিন একটু মেঘলা ছিল—সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। দুপুরের পরই আবার খুব মেঘ করিয়া আসিল। কারখানার উঠানে মালবোঝাই মোটর লরিগুলার শব্দ একটু থামিলেও দুপুরের শিফট-এ মিস্ত্রিদের প্যাকবাক্সের গায়ে লোহার বেড় পরাইবার দুমদাম আওয়াজ বেজায়। এই বিকট আওয়াজের জন্য দুপুরবেলা এখানে তিষ্ঠানো দায়।
অপু ঘুমাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া উঠিয়া বসিতেই দেখিল, মেয়েটি জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। অল্পক্ষণের জন্য দুজনের চোখাচোখি হইল। মেয়েটি অন্য অন্য দিনের মতো আজও হাসিয়া ফেলিল। অপুর মাথায় দুষ্টুমি চাপিয়া গেল। সেও আগাইয়া গিয়া জানালার গরাদে ধরিয়া দাঁড়াইল-তারপর সে নিজেও হাসিল। মেয়েটি একবার পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল কেহ আসিতেছে কিনা—পরে সেও আসিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইল। অপু কৌতুকের সুরে বলিল,-কি গো হেমলতা, আমায় বিয়ে করবে?
মেয়েটি বলিলকরব। কথা শেষ করিয়া সে হাসিয়া ফেলিল।
অপু বলিল,-কি জাত তোমরা—বামুন? আমি কিন্তু বামুন।
মেয়েটি খোঁপায় হাত দিয়া একটা কাঁটা ভাল করিয়া খুঁজিয়া দিতে দিতে বলিল—আমরাও বামুন।পরে হাসিয়া বলিল—আমার নাম তো জেনেছেন, আপনার নাম কি?
অপু বলিল, ভালো নাম অপূর্ব, আমরা বাঙ্গাল দেশের লোক-শহরের মেয়ে তোমরা–আমাদের তো দুচোখে দেখতেই পারো না—তাই না? তোমায় একটা কথা বলি শোন।…ওরকম লিখো না জানালার গায়ে যদি কেউ টের পায়?
মেয়েটি আর একবার পিছন ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, কে টের পাবে? কেউ দেখতে পায় না ওদিক থেকে আমি যাই, কাকিমা আসবে ঠাকুরঘর থেকে। আপনি বিকেলে রোজ থাকেন?
মেয়েটি চলিয়া গেলে অপুর হাসি পাইল। পাগল না তো? ঠিক—এতদিন সে বুঝিতে পারে নাই…মেয়েটি পাগল! মেয়েটির চোখে তাই কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের দৃষ্টি। কথাটা মনে হইবার সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর করুণা ও অনুকম্পায় তাহার সারা মন ভরিয়া গেল। মেয়ের বাপকে সে মাঝে মাঝে প্রায়ই দেখে—প্রৌঢ়, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোন অফিসের কেরানী বোধ হয়। সে কলেজে যাইবার সময় রোজ ভদ্রলোক ট্রামের অপেক্ষায় ফুটপাথের ধারে দাঁড়াইয়া থাকেন। হয়তো মেয়েটির বাবাই, নয়তো কাকা বা জ্যাঠামশায়, কি মামা-মোটর উপর তিনিই একমাত্র অভিভাবক। খুব বেশি অবস্থাপন্ন বলিয়া মনে হয় না। হয়তো তাহাকে দেখিয়া মেয়েটা ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে— এরকম তো হয়!
তাহার ইচ্ছা হইল, এবার মেয়েটিকে দেখিতে পাইলে তাহাকে দুটা মিষ্ট কথা, দুটা সান্ত্বনাব কথা বলিবে। কেহ কিছু মনে করিবে? যদি নিতাইবাবু টের পায়?—পাইবে।
খবরের কাগজে সে মাঝে মাঝে ছেলে-পড়ানোর বিজ্ঞাপন খুঁজিত, একদিন দেখিল কোন একজন ডাক্তারের বাড়ির জন্য একজন প্রাইভেট টিউটর দরকার। গেল সে সেখানে। দোতলা বড়ো বাড়ি, নিচে বৈঠকখানা কিন্তু সেখানে বড়ো কেহ বসে না, ডাক্তারবাবুর কনসালটিং রুম দোতলার কোণের কামরায়, সেখানেই রোগীর ভিড়। অপু গিয়া দেখিল, নিচের ঘরটাতে অন্ন জন পনেরো নানা বয়সের লোক তীর্থের কাকের মতো হাঁ করিয়া বসিয়া—সেও গিয়া একপাশে বসিয়া গেল। তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, ওই বিজ্ঞাপনটা শুধু তাহারই চোখে পড়িয়াছে—এত সকালে, অত ঘোট ঘোট অক্ষরে এককোণে লেখা বিজ্ঞাপনটা—সেও ভাবিয়াছিল—উঃ…এ যে ভিড় দেখা যায় ক্রমেই বাড়িয়া চলিল।
কাহাকে পড়াইতে হইবে; কোন ক্লাসের ছেলে, কত বড়ো, কেহই জানে না। পাশের একটি লোক জিজ্ঞাসা করিল-মশাই জানেন কিছু, কোন ক্লাসের–
অপু বলিল, সেও কিছুই জানে না। একটি আঠারো উনিশ বছরের ছোরার সঙ্গে অপুর আলাপ হইল। ম্যাট্রিকুলেশন ফেল করিয়া হোমিওপ্যাথি পড়ে, টিউশনির নিতান্ত দরকার, ন হইলেই চলিবে না, সে নাকি কালও একবার আসিয়াছিল, নিজের দুরবস্থার কথা সব কর্তাকে জানাইয়া গিয়াছে, তাহার হইলেও হইতে পারে। ঘণ্টাখানেক ধরিয়া অপু দেখিতেছিল, কাঠের সিড়িটা বাহিয়া এক-একজন লোক উপরের ঘরে উঠিতেছে এবং নামিবার সময় মুখ অন্ধকার করিয়া পাশের দরজা দিয়া বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। যদি তাহারও না হয়। পড়া বন্ধ করিয়া মনসাপোতা—কিন্তু সেখানেই বা চলিবে কিসে?
চাকর আসিয়া জানাইল, আজ বেলা হইয়া গিয়াছে, ডাক্তারবাবু কাহারও সঙ্গে এখন আর দেখা করিবেন না। এক-একখানা কাগজে সকলে নিজের নিজের নামধাম ও যোগ্যতা লিখিয়া রাখিয়া যাইতে পারেন, প্রয়োজন বুঝিলে জানানো যাইবে।
হেঁদো কথা। সকলেই একবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলপ্রত্যেকেরই মনে মনে বিশ্বাস-একবার গৃহস্বামী তাহাকে চাক্ষুষ দেখিয়া তাহার গুণ শুনিলে আর চাকুরি না দিয়া থাকিতে পারিবেন না! অপুও ভাবিল সে উপরে যাইতে পারিলে একবার চেষ্টা করিয়া দেখিত। তবে সে নিজের দুরবস্থার কথা কাহারও কাছে বলিতে পারিবে না। তাহার লজ্জা করে, দৈন্যের কঁদুনি গাহিয়া পরের সহানুভূতি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা—অসম্ভব! লোকে কি করিয়া যে করে! প্রথম প্রথম সে কলিকাতায় আসিয়া ভাবিয়াছিল, কত বড়লোকের বাড়ি আছে কলিকাতায়, চাহিলে একজন দরিদ্র ছাত্রের উপায় করিয়া দিতে কেহ কুণ্ঠিত হইবে না। কত পয়সা তো তাহাদের কত দিকে যায়। কিন্তু তখন সে নিজেকে ভুল বুঝিয়াছিল, চাহিবার প্রবৃত্তি, পরের চোখে নিজেকে হীন প্রতিপন্ন করিবার প্রবৃত্তি, এ-সব তাহার মধ্যে নাইতাহার আছে—সে যাহা নয় তাহা হইতেও নিজেকে বড় বলিয়া জাহির করিবার, বাহাদুরি করিবার, মিথ্যা গর্ব করিয়া বেড়াইবার একটা কুঅভ্যাস। তাহার মায়ের নির্বুদ্ধিতা এই দিক দিয়া ছেলেতে বর্তাইয়াছে, একেবারে হুবহু অবিকল। এই কলিকাতা শহরে মহা কষ্ট পাইলেও সে নিতান্ত অন্তরঙ্গ এক-আধজন ছাড়া কখনও কাহাকে তাও নিজের মুখে কখনও কিছু বলে না। পাছে ভাবে গরিব।
ইতস্ততঃ করিয়া সেও অপরের দেখাদেখি কাঠের সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতে গেল। নিচের উঠান হইতে চাকর হাঁ হাঁ করিয়া উঠিল—আরে কাহে আপনোক উপরমে যাতে হেঁ…বাত্ নেহি মাতে হেঁ, এ বড়া মুশকিল। অপু সে কথা গ্রাহ্য না করিয়া উপরে উঠিয়া গেল। প্রৌঢ় বয়সের একটি ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসিয়া, হোমিওপ্যাথি-পড়া ছোকরাটির সঙ্গে কি তর্ক চলিতেছে বাহির হইতে বুঝা গেল—ছোকরাটি কি বলিতেছে, ভদ্রলোকটি কি বুঝাইতেছেন! সে ছোকরা একেবারে নাছোড়বান্দা, টিউশনি তাহার চাই-ই। ভদ্রলোকটি বলিতেছেন, ম্যাট্রিকুলেশন ফেল টিউটর দিয়া তিনি কি করিবেন? ক্রমে সকলে একে একে বাহিরে আসিয়া চলিয়া গেল। অপু ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সসংকোচে বলিল–আপনাদের কি একজন পড়াবার লোক দরকার—আজ সকালের কাগজে বেরিয়েছে—
যেন সে এত লোকের ভিড়, উপরে উঠার নিষেধাজ্ঞা, কাগজে নামধাম লিখিয়া রাখিবার উপদেশ কিছুই জানে না! আসলে সে ইচ্ছা করিয়া এরুপ ভালোমানুষ সাজে নাই—অপরিচিত স্থানে আসিয়া অপরিচিত লোকের সহিত কথা কহিতে গিয়া আনাড়িপনার দরুন কথার মধ্যে নিজের অজ্ঞাতসারে একটা ন্যাকা সুর আসিয়া গেল।
ভদ্রলোক একবার আপাদমস্তক তাহাকে দেখিয়া লইলেন, তারপর একটা চেয়ার দেখাইয়া বলিলেন, বসুন। আপনি কি পাশ?-ও, আই.এ. পড়ছেন,—দেশ কোথায়?…ও!…এখানে থাকেন কোথায়?!
তিনি আরও যেন খানিকক্ষণ তাহাকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিলেন। মিনিট পনেরো পরে-অপু বসিয়াই আছে—ডাক্তারবাবু হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন,—দেখুন, পড়ানো মানে—আমার একটি মেয়ে—তাকেই পড়াতে হবে। যাকে তাকে তো নিতে পারি নে কিন্তু আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে—ওরে শোন-তোের দিদিমণিকে ডেকে নিয়ে আয় তোবগে আমি ডাকছি
একটু পরে মেয়েটি আসিল। বছর পনেরো বয়স, তন্বী সুন্দরী, বড়ো বড়ো চোখ, আঙুলের গড়ন ভারি সুন্দর, রেশমী জামা গায়ে, চওড়া পাড় শাড়ি, গলায় সোনার সরু চেন, হাতে প্লেন বালা। মাথায় চুল এত ঘন যে দু-ধারের কান যেন ঢাকিয়া গিয়াছে—জাপানী মেয়েদের মতো ফাঁপানো খোপা!
-এইটি আমার মেয়ে, নাম প্রতিবালা। বেথুন স্কুলে পড়ে, এইবার সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছে। ইনি তোমার মাস্টার খুকি—আজ বাদ দিয়ে কাল থেকে উনি আসবেনা, এর মুখ দেখেই আমার মনে হয়েছে ইনিই ঠিক হবেন। বয়স আপনার আর কত হবে—এই উনিশ-কুড়ি, মুখ দেখেই তো মনে হয় ছেলেমানুষ, তাছাড়া একটা distinction-এর ছাপ রয়েছে। খুকি, বোসো মা–
টিউশান জোটার আনন্দে যত হোকনা-হোক, ভদ্রলোক যে বলিয়াছেন তাহার মুখে একটা distinction-এর ছাপ আছে—এই আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া সে সারাটা দিন কাটাইল ও ক্লাসে, পথে, বাসায়, হোটেলে–সর্বত্র বন্ধুবান্ধবদের কাছে কথাটা লইয়া নির্বোধের মতো খুব আঁক করিয়া বেড়াইল। মাহিনা যত নির্দিষ্ট হইয়াছিল, তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি বলিল, মেয়েটির সৌন্দর্যব্যাখ্যা অনেক বাড়াইয়া করিল।
কিন্তু পরদিন পড়াইতে গিয়া দেখিল—মেয়েটি দেওয়ানপুরের নির্মলা নয়। সেরকম সরলা, স্নেহময়ী, হাস্যমুখী নয়—অল্প কথা কয়, খাটাইয়া লইতে জানে, একটু যেন গর্বিত! কথাবার্তা বলে হুকুমের ভাবে। অমুক অঙ্কটা কাল বুঝিয়ে দেবেন, অমুকটা কাল করে আনবেন, আজ আরও একঘণ্টা বেশি পড়াবেন, পরীক্ষা আছে—ইত্যাদি! একদিন কোন কারণে আসিতে না পারিলে পরদিন কৈফিয়ত তলব করিবার সুরে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করে। অপু মনে মনে বড়ো ভয় খাইয়া গেল, যে রকম মেয়ে, কোনদিন পড়ানোর কোন ত্রুটির কথা বাবাকে লাগাইবে, চাকরির দফা গয়া—পথে বসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকিবে না। ছাত্রীর উপর অসন্তুষ্টি ও বিরক্তিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল।
মাসখানেক কাটিয়া গেল। প্রথম মাসের মাহিনা পাইয়াই মাকে কিছু টাকা পাঠাইয়া দিল। বৌবাজার ডাকঘর হইতে টাকাটা পাঠাইয়া সে চলিয়া যাইতেছিল, সঙ্গের বন্ধুটি বলিল, এসো তো ভাই একটু চোরাবাজারে, একটা ভালো অপেরাগ্লাস কাল দর করে রেখে এসেছি–নিয়ে আসি।
চোরাবাজারের নামও কখনও অপু শোনে নাই। ঢুকিয়া দেখিয়াই সে অবাক হইয়া গেল। নানা ধরনের জিনিসপত্র, খেলনা, আসবাবপত্র, ছবি, ঘড়ি, জুতা, কলের গান, বই, বিছানা, সাবান, কৌচ, কেদারা—সবই পুরানো মাল। অপুর মনে হইল-বেশ সস্তা দরে বিকাইতেছে। একটা ফুলের টব, দর বলিল ছআনা। একটা ভালো দোয়াতদান দশ আনা। এগারো টাকায় কলের গান মায় রেকর্ড! এত দিন কলিকাতায় আছে, এত সস্তায় এখানে জিনিসপত্র বেচা-কেনা হয়, তা তো সে জানে না। এত শৌখিন জিনিসের এত কম দাম!
তাহার মাথায় এক খেয়াল আসিয়া গেল। পরদিন সে বাকি টাকা হাতে বৈকালে আসিয়া চোরাবাজারে ঢুকি। মনে ভাবিল—এইবার একটু ভালো ভাবে থাকব, ওরকম গোয়ালঘরে থাকতে পারি নে—যেমন নোংরা তেমনি অন্ধকার। প্রথমেই সে ফুলদানি-জোড়া কিনিল। দোয়াতদানের উপর অনেকদিন হইতে ঝোঁক, সেটিও কিনিল। একটা জাপানী পর্দা, খানচারেক ছবি, খানকতক প্লেট, একটা আয়না, ঝুটা পাথর-বসানো ছোট একটা আংটি! ছেলেমানুষের মতো আনন্দে শুধু জিনিসগুলিকে দখলে আনিবার বেঁকে যাহাই চোখে ভালো লাগিল, তাহাই কিনিল। দাও বুঝিয়া দুএকজন দোকানদার বেশ ঠকাইয়াও লইল। ডবল-উইকের একটা পিতলের টেবিলল্যাম্প পছন্দ হওয়াতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করিল,—এটার দাম কত? দোকানী বলিল, সাড়ে তিন টাকা। অপুর বিশ্বাস…এরকম আলোর দাম পনেরো-যোল টাকা। এরুপ মনে হওয়ার একমাত্র কারণএই যে, অনেকদিন আগে লীলাদের বাড়ি থাকিবার সময় সে এই ধরনের আলো লীলার পড়িবার ঘরে টেবিলে জ্বলিতে দেখিয়াছিল। সে বেশি দর কষিতে ভরসা করিল না, চার আনা মাত্র কমাইয়া তিন টাকা চার আনা মূল্যে সেই মান্ধাতার আমলের টেবিল ল্যাম্পটা মহা খুশির সহিত কিনিয়া ফেলিল। মুটের মাথায় জিনিসপত্র চাপাইয়া সে সোৎসাহে ও সাগ্রহে সব বাসায় আনিয়া হাজির করিল ও সারাদিন খাটিয়া ঘরদোর ঝাড়িয়া ঝাট দিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া হবিগুলি দেওয়ালে টাঙ্গাইল, সস্তা জাপানী পর্দাটা দরজায় ঝুলাইল, আয়নাটাকে গজাল আঁটিয়া বসাইল, ফুলদানির জন্য ফুল কিনিয়া আনিতে ভুলিয়া গিয়াছিল, সেগুলিকে ধুইয়া মুছিয়া আপাতত জানালার ধারে রাখিয়া দিল, দোয়াতদানটা তেঁতুল দিয়া মাজিয়া ঝকঝকে করিয়া রাখিল। বাহিরে অনেকদিনের একটা খালি প্যাকবাক্স পড়িয়াছিল, সেটা ঝাড়িয়া মুছিয়া টেবিলে পরিণত করিয়া সন্ধ্যার পর টেবিল ল্যাম্পটা সেটার উপর রাখিয়া পড়িতে বসিল। বই হইতে মুখ তুলিয়া সে ঘন ঘন ঘরের চারিদিকে খুশির সহিত চাহিয়া দেখিতেছিল—ঠিক একেবারে যেন বোলোকদের সাজানো ঘর। ছবি, পর্দা ফুলদানি টেবিল-ল্যাম্প সব!—এতদিন পয়সা ছিল না, হয় নাই। কিন্তু এইবার কেন সে মহিষের মতো বিলের কাদায় লুটাইয়া পড়িয়া থাকিতে যাইবে?
বাহাদুরি করিবার ঝোঁকে পরদিন সে ক্লাসের বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া নিজের ঘরে খাওয়াইল-প্রণব, জানকী, সতীশ, অনিল এমন কি সেন্ট জেভিয়ার কলেজের সেই ভূতপূর্ব ছাত্র চালবাজ মন্মথকে পর্যন্ত।
মন্মথ ঘরে ঢুকিয়া বলিল-হুররে!—আরে আমাদের অপূর্ব এসব করেছে কি! কোখেকে বাজে রাবিশ এক পুরোনো পর্দা জুটিয়েছে দ্যাখো। এত খাবার কে খাবে?
অপু নিচের কারখানার হেড মিস্ত্রিকে বলিয়া তাহাদের বড়ো লোহার চায়ের কেটলিটা ও একটা পলিতা-বসানো সেকেলে লোহার স্টোভ ধার করিয়া আনিয়া চা চড়াইয়াছে; একরাশ কমলালেবু, সিঙ্গাড়া, কচুরি, পানতুয়া, কলা ও কাঁচা পাঁপর কিনিয়া আনিয়াছে—সবাই দেখিতে দেখিতে খাবার অর্ধেকের উপর কমাইয়া আনিল। কথায় কথায় অপু তাহাদের দেশের বাড়ির কথা তুলিল–মস্ত দোতলা বাড়ি নদীর ধারে, এখনও পূজার দালানটা দেখিলে তাক লাগে, এখনও খুব নাম-দেনার দায়ে মস্ত জমিদারি হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে, তাই আজ এ অবস্থানহিলে ইত্যাদি।
প্রণব চা পরিবেশন করিতে গিয়া খানিকটা জানকীর পায়ের উপর ফেলিয়া দিল। ঘরসুদ্ধ সবাই হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। সতীশ আসিয়াই সটান শুইয়া পড়িয়াছিল অপুর বিছানায়, বলিল,–ওহে তোমরা কেউ আমার গালে একটা পানতুয়া ফেলে দাও তো! হাঁ করে আছি
সতীশ বলিল,-হা হে, ভালো কথা মনে পড়েছে। তোমার সেই জানালা-কাব্যের নায়িকা কোন্ দিকে থাকেন? এই জানালাটি নাকি?–
অনিল বাদে আর সকলেই হাসি ও কলববের সঙ্গে সেদিকে ঝুঁকিয়া পড়িতে গেল–অপু লজ্জামিশ্রিত সুরে বলিলনা না ভাই, ওদিকে যেয়ো না–সে কিছু না, সব বানানো কথা আমার—ওসব কিছু না।
মেয়েটি পাগল এই ধারণা হওয়া পর্যন্ত তাহার কথা মনে উঠিলেই অপুর মন করুণার্ম হইয়া উঠে। তাহাকে লইয়া এই হাসি-ঠাট্টা তাহার মনে বড়ো বিধিল। কথার সুর ফিরাইবাব জন্য সে নতুন কেনা পর্দাটার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। পরে হঠাৎ মনে পড়াতে সেই ঝুটা পাথরের আংটিটা বাহির করিয়া খুশির সহিত বলিল,-এটা দ্যাখো তো কেমন হয়েছে? কত দাম হবে।
মন্মথ দেখিয়া বলিল—এ কোথাকার একটা বাজে পাথর বসানো আংটি, কেমিকেল সোনার, এর আবার দামটা কি…দূর!
অনিলের এ কথাটা ভালো লাগিল না। মন্মথ ইতিপূর্বে অপুর পর্দাটা দেখিয়া নাক সিটকাইয়াছে, ইহাও তাহার ভালো লাগে নাই। সে বলিল—তুমি তো জহুরি নও, সব তাতেই চাল দিতে আস কেন? চেনো এ পাথর?
-জহুরি হবার দরকারটা কি শুনি—এটা কি এমারেল্ড, না হীরে, না—
–শুধু এমারেল্ড আর হীরের নাম শুনে রেখছ বই তো নয়? এটা কর্নেলিয়ান—চেনো কর্নেলিয়ান? অভ্রের খনিতে পাওয়া যায়, আমাদের ছিল, আমি খুব ভালো জানি।
অনিল খুব ভালোই জানে অপুর আংটির পাথরটা কর্নেলিয়ান নয় কিছুই নয়—শুধু মন্মথর কথার প্রতিবাদ করিয়া মন্মথর চালিয়াতি কথাবার্তায় অপুর মনে কোনও ঘা না লাগে সেই চেষ্টায় কনেলিয়ান ও টোপাজ পাথরের আকৃতি প্রকৃতি সম্বন্ধে যা মুখে আসিল তাহাই বলিতে লাগিল। তার অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে মন্মথ সাহস করিয়া আর কিছু বলিতে পারিল না।
তাহার পর প্রণব একটা গান ধরাতে উভয়ের তর্ক থামিয়া গেল। আরও অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিখুশি, কথাবার্তা ও আরও বার-দুই চা খাইবার পর অন্য সকলে বিদায় লইল, কেবল অনিল থাকিয়া গেল, অপুও তাহাকে থাকিতে অনুরোধ করিল।
সকলে চলিয়া যাইবার পর অনিল ভৎর্সনার সুরে বলিল—আচ্ছা, এসব আপনার কি কাণ্ড? (সে এতদিনের আলাপে এখনও অপুকে তুমি বলে না) কেন এসব কিনলেন মিছে পয়সা খরচ করে?
অপু হাসিয়া বলিল,-কেন তাতে কি? এসব তো—ভালো থাকতে কি ইচ্ছে যায় না?
—খেতে পান না এদিকে, আর মিথ্যে এই সব—সে যাক, এই দামে পুরানো বইয়ের দোকানের সেই গিবনের সেটটা যে হয়ে যেত। আপনার মতো লোকও যদি এই ভুয়ো মালের পেছনে পয়সা খরচ করেন তবে অন্য ছেলের কথা কি? একটা পুরানো দূরবীন যে এই দামে হয়ে যেত, আমার সন্ধানে একটা আছে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের এক জায়গায় একটা সাহেবের ছিল—স্যাটার্নের রিং চমৎকার দেখা যায়—কম টাকায় হত, মেম বিক্রি করে ফেলছে অভাবে আপনি কিছু দিতেন, আমি কিছু দিতাম, দুজনে কিনে রাখলে ঢের বেশি বুদ্ধির কাজ হত—
অপু অপ্রতিভের হাসি হাসিল। দূরবীনের উপর তাহার লোভ আছে অনেক দিন হইতে। অতএব তাহার মনে হইল—এ টাকার ইহা অপেক্ষাও সদ্ব্যয় হইতে পারিত বটে। কিন্তু সে যে ভালো থাকিতে চায়, ভালো ঘরে সুদৃশ্য সুরুচিসম্মত আসবাবপত্র রাখিতে চায়—সেটাও তো তার কাছে বড়ো সত্য—তাহাকেও বা সে মনে মনে অস্বীকার করে কি করিয়া?
অনিল আর কিছু বলিল না। পুরানো বাজারের এসব সস্তা খেলো মালকে তাহার বন্ধু যে এত খুশির সহিত ঘরে আনিয়া ঘর সাজাইয়াছে, ইহাতেই সে মনে মনে চটিয়াছিল—শুধু অপুর মনে আব বেশি আঘাত দিতে ইচ্ছা না থাকায় সে বিবক্তি চাপিয়া গেল।
অপু বলিল-হুল্লোড়ে পড়ে তোমার খাওয়া হল না অনিল, আর খানকতক কাঁচা পাঁপর ভাজব?
অনিল আর খাইতে চাহিল না। অপু বলিল—তবে চলো, কোথাও বেরুইগড়ের মাঠে কি গঙ্গার ধারে।
অনিলও তাই চায়, বলিল-দেখুন অপূর্বাবু, উনিশ-কুড়ি-একুশ বছর থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর বয়সের লোক পর্যন্ত কি রকম গলির মধ্যে বাড়ির সামনেকার ছোট্ট বোয়াটুকুতে বসে আড্ডা দিচ্ছে—এমন চমৎকার বিকেল, কোত্থাও বেরুনো নেই, শরীরের বা মনের কোনও অ্যাডভেঞ্চার নেই, আসন-পিঁড়ি হয়ে সব ষষ্ঠী বুড়ি সেজে ঘরের কোণের কথা, পাড়ার গুজব, কি দরে কে ওবেলা বাজারে ইলিশ মাছ কিনেছে সেই সব—ওঃ হাউ আই হেট দে! আপনি জানেন না, এই সব র্যাঙ্ক স্টুপিডিটি দেখলে আমার রক্ত গরম হয়ে ওঠে-বরদাস্ত করতে পারি নে মোটে— গা যেন কেমন–
-কিন্তু ভাই, তোমার ও গড়ের মাঠে আমার মন ভোলে না—মোটরের শব্দ মোটর বাইকের ফটফট আওয়াজ, পেট্রোল গ্যাসের গন্ধ, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি-নামেই ভাই মাঠ, গলার কথা আর না-ই বা তুললাম।
–কাল আপনাকে নিয়ে যাব এক জায়গায়। বুঝতে পারবেন একটা জিনিস—একটা ছেলে—আমার এক বন্ধুর বন্ধু—ছেলেটা সাউথ আফ্রিকায় মানুষ হয়েছে, সেইখানেই জন্ম-সেখান থেকে তার বাবা তাদের নিয়ে চলে এসেছে কলকাতায়, কিয়ার্স লেনে থাকে। তার মুখের কথা শুনে এমন আনন্দ হয়! এমন মন! এখানে থেকে মরে যাচ্ছে—শুনবেন তার মুখে সেখানকার জীবনের বর্ণনা-হিংসে হয়, সত্যি!
অপু এখনই যাইতে চায়। অনিল বলিল, আজ থাক, কাল ঠিক যাব দুজনে! দেখুন অপূর্ববাবু, কিছু যেন মনে করবেন না, আপনাকে তখন কি সব বললাম বলে। আপনারা কি জন্যে তৈরি হয়েছেন জানেন? ওসব চিপ ফাইনারির খদ্দের আপনারা কেন হবেন? দেখুন, এ পুরুষ তো কেটে গেল, এ সময়ের কবি, বৈজ্ঞানিক, দাতা, লেখক, ডাক্তার, দেশসেবক—এঁরা তো কিছুদিন পরে সব ফৌত হবেন, তাদের হাত থেকে কাজ তুলে নিতে হবে কাদের, না, যারা এখন উঠছে। একদল তো চাই এই জেনারেশনের হাত থেকে সেই সব কাজ নেবার? সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, আর্টে, দেশসেবায়, গানে–সব কিছুতে, নতুন দল যারা উঠছে, বিশেষ করে যাদের মধ্যে গিফট আছে, তাদের কি হুল্লোড় করে কাটাবার সময়?
অপু মুখে হাসিয়া কথাটা উড়াইয়া দিল বটে, কিন্তু মনে মনে ভারি খুশি হইল—কথার মধ্যে তাহারও যে দিবার কিছু আছে বা থাকিতে পারে সেদিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে বুঝিয়া।
পরে দু-জনে বেড়াইতে বাহির হইল।