তড়িৎবাবুর মৃতদেহ
যেখানে তড়িৎবাবুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, আমরা সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছি। সেদিনও এই সময়টাতেই এসেছিলাম, কিন্তু আজ কিছুক্ষণ হল মেঘ কেটে গিয়ে রোদ ওঠার ফলে আলোটা অনেক বেশি। এখানে ওখানে পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ মাটিতে পড়েছে, আর লক্ষ করছি সেদিনের চেয়ে পাখিও ডাকছে অনেক বেশি। লালমোহনবাবু অবিশ্যি যে কোনও পাখি ডেকে উঠলেই, সেটাকেই বাঘ কাছাকাছি থাকার লক্ষণ বলে মনে করছেন।
তড়িৎবাবুর মৃতদেহ সেদিনই সকালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কলকাতায় টেলিফোন করে খবর দেওয়াতে ওঁর বড় ভাই এসেছিলেন, শেষ কাজ তিনিই করে দিয়ে গেছেন। আজ আর সেই বাঁশ ঝাড়টার আশেপাশে সেদিনকার সাংঘাতিক ঘটনার কোনও চিহ্নই নেই। কিন্তু তাও ফেলুদা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে চারদিকের জমি পরীক্ষা করছে। মাধবলালও ফেলুদার সঙ্গে কাজে লেগে গেছে। মনে হল বেশ উৎসাহই পাচ্ছে। লোকটাকে যত দেখছি ততই ভাল লাগছে। চেহারাটাও বেশ। হাসলেই গালের দু পাশে দুটো খাঁজ পড়ে, আর ভুরু না কুঁচকালেও কপালে পাঁচ-ছটা লাইন পড়েই আছে। জিপে আসতে আসতে ও বলছিল, বনবিভাগ থেকে মানুষখেকোর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন শিকারি নাকি বাঘাটা মারার ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছে। তার মধ্যে কার্সিয়াং-এর এক চা বাগানের ম্যানেজার মিস্টার সাঙ্গু নাকি আজকালের মধ্যেই এসে পড়বেন। সাপ্র নামকরা শিকারি, তেরাইয়ের জঙ্গলে নাকি এককালে অনেক বাঘ মেরেছেন। মাধবীলাল নিজেই অনেক বাঘ হরিণ বুনো শুয়োর ইত্যাদি মেরেছে, তারই একটি গল্প সে সবে বলতে আরম্ভ করেছে, এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে তার নাম ধরে ডাক দিল। মাধবীলাল ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেল ফেলুদার দিকে, তার পিছন পিছন আমরাও। এটা বলা দরকার যে আমাদের দুজনের জিপ থেকে নামার ব্যাপারে ফেলুদা আজ কোনও আপত্তি করেনি।
ফেলুদা মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা বাঁশের গোড়ার দিকে চেয়ে আছে।
দেখুন তো এটা কী ব্যাপার, ফেলুদা মাধবলালকে উদ্দেশ করে বলল।
মাধবলাল ঝুকে পড়ে এক ঝলক দেখেই বলল, বুলেট লাগা থা।
মাধবীলালের পদবি দুবে, বাড়ি সাহেবগঞ্জ, কিন্তু বাংলা বুঝতে বা বলতে কোনও অসুবিধা হয় না।
বাঁশটার গায়ে যে একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলেন। ফেলুদাও যে অবাক সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বার তিনেক অসহিষ্ণুভাবে নিজের হাতের তেলোতে ঘুষি মেরে বলল, দাগটা পুরনো কি টাটকা সেটা বলতে পারেন?
মাধবলাল বলল, দিন দুয়েকের বেশি পুরনো হতেই পারে না।
ব্যাপারটা কী?…ব্যাপারটা কী?… ফেলুদা বিড়বিড় করে বলল, বন্দুক…তলোয়ার…সব যে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তড়িৎবাবুকে মারুল তলোয়ারের খোঁচা, বাঘকে মারল গুলি.সে গুলি তো আবার মনে হচ্ছে বাঘের গায়ে লাগেনি। নাকি–
মাধবীলাল বাঁশ ঝাড়ের নীচ থেকেই কী যেন কুড়িয়ে নিয়েছে। এমনি চোখে ভাল দেখাই যায় না। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ইঞ্চি দুয়েক লম্বা লম্বা কতকগুলো রোঁয়া।
বাঘের লোম কি? বলল ফেলুদা।
বাঘের লোম, বলল মাধবলাল। গুলি বাঘের গা ঘেঁষে গিয়েছিল বলে মনে হয়।
আর তাই কি বাঘ খানিকটা মাংস খেয়েই পালিয়েছিল?
সেই রকমই মালুম হচ্ছে।
ফেলুদা দু-এক পা করে এগিয়ে যেতে শুরু করল। মাধবলালও হাতে বন্দুক নিয়ে দৃষ্টি সজাগ রেখে তাকে অনুসরণ করল। আমরা দুজনের মাঝামাঝি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা বেছে নিলাম। ফেলুদার পকেটে রিভলভার আছে জানি, আর তাতে টোটাও ভরা আছে। কিন্তু তাতে তো আর বাঘের কিছু হবে না। পিছন থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনে বুঝলাম, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জিপটাও এগোচ্ছে। তার ফলে ব্যবধান কিছুটা কমলেও জিপ আমাদের কাছে আসতে পারবে না, কারণ আমরা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর চলে এসেছি।
মিনিট তিনেক এভাবে হাঁটার পর ফেলুদা হঠাৎ কী যেন দেখে ডান দিকে কোনাকুনিভাবে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।
একটা কাঁটা-ঝোপ। তার মধ্যে একটা কাপড়ের টুকরো আটকে রয়েছে। সবুজ কাপড়। নিঃসন্দেহে তড়িৎবাবুর শার্টের অংশ; মাধবীলাল না বললেও আন্দাজ করেছিলাম, বাঘ তড়িৎবাবুকে মুখে করে নিয়ে যাবার সময় ঝোপের কাঁটায় তড়িৎবাবুর শাটের একটা অংশ ছিঁড়ে আটকে গিয়ে এই চিহ্ন রেখে গেছে।
এবার দেখলাম মাধবলাল আমাদের ছাড়িয়ে নিজেই এগিয়ে গেল! বুঝলাম সে-ই এবার পথ দেখাবে, কারণ সে আন্দাজ করেছে বাঘ কোন পথে এসেছিল। বোধহয় আমাদের কথা ভেবেই মাধবীলাল ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, কারণ চারদিকে কাঁটা-ঝোপ।
সামনে একটা তেঁতুল গাছ। তার গুড়ির কাছ থেকে জমিটা ঢালু হয়ে পিছন দিকে নেমে গেছে বলেই বোধহয় সেখানটা শুকনো রয়েছে। মাধবলাল সেখানে পৌঁছে থেমে গেল, তার দৃষ্টি মাটির দিকে। আমরাও এগিয়ে গেলাম।
যদিও এ জিনিসটা এর আগে কোনও দিন দেখিনি, তাও বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আমরা বাঘের পায়ের ছাপ দেখছি। আমরা যেদিকে যাচ্ছি। সেই দিকেই গেছে ছাপগুলো।
কাঁপা ফিসফিসে গলায় লালমোহনবাবুর প্রশ্ন এল, এ কি দু-পেয়ে বাঘ নাকি মশাই?
মাধবলাল হেসে উঠল। ফেলুদা বলল, এইভাবেই বাঘ হাঁটে। সামনের পা আর পিছনের পা ঠিক একই জায়গায় ফেলে, তাই মনে হয় দু পায়ে হাঁটছে।
মাধকলাল এগিয়ে চলেছে, আমরা তার পিছনে। জিপের আওয়াজ আর পাচ্ছি না। বোধহয় হল ছেড়ে দিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা কুলকুল শব্দ পাচ্ছি। একটা নালা জাতীয় কিছু আছে বোধহয় কাছাকাছির মধ্যে। লালমোহনবাবুর নতুন বুটটা প্রথম দিকে বড্ড বেশি মচমচ শব্দ করছিল, তাতে ফেলুদা মন্তব্য করেছিল, সেটা নাকি ম্যান-ইটারের কৌতুহল উদ্রেক করার পক্ষে আইডিয়াল, কিন্তু এখন কাদায় ভিজে। আওয়াজটা প্ৰায় মরে এসেছে।
একটা শিমুল গাছ পেরিয়ে কয়েক পা যেতেই মাধবলাল আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
আপকা পাস রিভলভার হ্যাঁয় না?
এবার আমাদের চোখ গেল হাত বিশেক দূরে সামনের ঘাসের দিকে। ঘাসগুলো চিরে কী যেন একটা জিনিস এগিয়ে আসছে।
ক্রেইৎ, বলল মাধবলাল।
নামটা জানি। অসম্ভব বিষধর সাপ।
এবার সাপটাকে দেখতে পেলাম। চলা থামিয়ে স্থির হয়ে ঘাসের উপর দিয়ে মাথাটা তুলে আমাদের দেখছে। ফণা নেই। সারা গায়ে হলদে আর কালো ডোরা।
ফেলুদা যে কখন রিভলভারটা বার করল টেরই পেলাম না। হঠাৎ একটা কনফাটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম সাপের মাথাটা ৰ্থেতলে গেল। আর একটা গুলি। এবার সব স্থির। গাছ থেকে পাখি ডেকে উঠেছে। দূরে আরেকটা গাছ থেকে বাঁদরের কিচির মিচির। মাধবলাল শুধু বলল, সাবাস, আর লালমোহনবাবু হাঁচি হাসি আর কাশি মিলিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে একদম চুপ মেরে গেলেন।
ফেলুদা বাঁ দিকে যাচ্ছে দেখে মাধবলাল বারণ করল। বলল, ওদিকে একটা নালা আছে, সেটা পেরোলেই নাকি একটা উঁচু পাথুরে ঢিবি আর অনেকগুলো বড় বড় পাথরের চাই। ওখানে নাকি বাঘের বিশ্রামের খুব ভাল জায়গা রয়েছে, কাজেই ওদিকটায় যাওয়া খুব নিরাপদ নয়। অগত্যা ফেলুদা মাধবলালের নির্দেশ মতো সোজাই চলল।
বন যে সব জায়গায় সমান ঘন, তা নয়। বাঁ দিকে চাইলেই বোঝা যায়। ওদিকে নালা থাকার দরুন বন পাতলা হয়ে গেছে। জানোয়ারের মধ্যে এক বাঁদরই দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে— ল্যাজ পাকিয়ে গাছের ডাল থেকে দোল খাচ্ছে, এ গাছ থেকে ও গাছে দিব্যি লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমাদের দেখলে দাঁত খিঁচোচ্ছে।
ফেলুদা নিশ্চয়ই আশা করছিল যে, আরও অনুসন্ধান করলে আরও কিছু পাবে, কিন্তু এবারে পাওয়াটা জুটে গেল। লালমোহনবাবুর কপালে। লালমোহনবাবুর বুটের ঠোক্কর খেয়ে একটা জিনিস ছিটকে প্রায় দশ হাত দূরে গিয়ে পড়তেই আমাদের চোখ সেদিকে গেল।
একটা গাঢ় ব্ৰাউন রঙের চামড়ার মানিব্যাগ। ফেলুদা সেটা খুলতেই তার ভিতর থেকে দুটো একশো টাকার নোট আর বেশ কিছু অন্য ছাট ছাট নাট বেরিয়ে পড়ল। এসব ছিল বড় খাপটায়। অন্য খাপ থেকে কয়েকটা রং চটে যাওয়া কুড়ি পয়সার ডাকটিকিট, দু-একটা ক্যাশ মেমো আরেকটা ওষুধের প্রেসক্রিপশন বেরোল। বৃষ্টিতে ভিজে ব্যাগটার অবস্থা বেশ শোচনীয় হলেও নোটগুলো এখনও দিব্যি ব্যবহার করা চলে।
ফেলুদা সব জিনিস আবার ব্যাগের মধ্যে পুরে ব্যাগটা শার্টের বুকপকেটে ঢুকিয়ে নিল।
আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
এদিকটায় জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে উঠেছে। চারিদিকে প্ৰকাণ্ড প্ৰকাণ্ড শাল গাছ, মাঝে মাঝে অন্য গাছ— সেগুন, শিমুল, আম, কাঁঠাল, ছাতিম। অৰ্জ্জুন গাছও রয়েছে এখানে সেখানে। আমি জানি ফেলুদা সেগুলোর দিকে বিশেষভাবে চোখ রাখছে, আর এও জানি যে অৰ্জ্জুনের কাছাকাছি কোনও তাল গাছ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মাধবলাল এরই মধ্যে এক ফাঁকে পকেট থেকে একটা ছুরি বার করে দুটো গাছের ডাল কেটে আমাকে আর লালমোহনবাবুকে দিয়েছে; আমরা সেগুলো লাঠি হিসাবে ব্যবহার করছি। ফেলুদা হাঁটতে হাঁটতেই মাধবলালকে প্রশ্ন করল, বাঘের পায়ের ছাপ দেখে বাঘ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানা যায়, তাই না?
মাধবলাল বলল, হ্যাঁ, এটাকে বেশ বড় বাঘ বলেই তো মনে হয়।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম— একটা আস্ত মানুষের লাশ মুখে করে বাঘটা এতখানি পথ এসেছে, তার মানে, কী সাংঘাতিক শক্তি বাঘের! অবিশ্যি মানুষের আর কীই বা ওজন। গোরু মোষ মেরেও তো শুনেছি বাঘ ওইভাবেই মুখে করে নালা টালা লাফিয়ে ডিঙিয়ে মাইলের পর মাইল পথ চলে যায়। মহীতোষবাবুর বইতেই নাকি আছে যে বাঘের ছাল ছাড়ালেই দেখা যায় ভিতরে কেবল মাস্ল আর মাস্ল।
ফেলুদা এবার আর একটা প্রশ্ন করল মাধবলালকে।
মহীতোষবাবু এ জঙ্গলে কখনও শিকার করেননি। তাই না?
মাধবলাল বলল, মহীতোষঝাবুর কুসংস্কারের কথাটা সে জানে। তবে এ রকম কুসংস্কার নাকি অনেক শিকারির মধ্যেই দেখা যায়। আমার নিজের নেই, মাধবীলাল বলল, তবে আমার বাবার ছিল। জোয়ান বয়সে একবার বাঘ মারতে যাবার আগে হাতে বিছুটি লেগেছিল, আর সেই দিনই একটা প্রায় দশ ফুট লম্বা বাঘকে বন্দুকের এক গুলিতে ঘায়েল করেছিলেন। সেই থেকে বাঘ মারতে যাবার আগে হাতে বিছুটি ঘষে নিতেন।
ফেলুদা বলল, করবেটসাহেবেরও কুসংস্কার ছিল। ম্যান-ইটার মারুতে যাবার দিন সকালে একটা সাপ দেখলে তার মনটা খুশি হয়ে যেত।
মহীতোষবাবুর বাপ-ঠাকুরদা দুজনেই এ জঙ্গলে বাঘের হাতে প্ৰাণ দেন, কাজেই মহীতোষবাবুর পক্ষে এখানে শিকার করায় আপত্তিটা খুব স্বাভাবিক।
আমরা মাধবলালের পিছন পিছন প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে হাঁটার পর ফেলুদা আসলে যে জিনিসটা খোঁজার জন্য এসেছিল, সেটা পেয়ে গেল। হালকা বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুলে ভরা একটা ঝোপের ধারে পড়ে আছে, তার পাথর-বিসানো হাতলটি খালি দেখা যাচ্ছে, ইস্পাতের অংশটা ঝোপে ঢাকা।
আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার!
জিনিসটা চোখে পড়তেই ফেলুদা প্রায় বাঘের মতোই নিঃশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে তলোয়ারটা মাটি থেকে তুলে নিল।
খুব মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় তলোয়ারের ডগায় এখনও খয়েরি রঙের রক্তের দাগ।
ফেলুদা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বলল, তার মানে খুনের জায়গাটা এর চেয়ে খুব বেশি দূরে নয়। আরও একটু এগোনো যায় কি, মাধবীলালজি?
মাধবলাল বলল, আর একশো গজ গেলে তো মন্দির পড়বে।
কী মন্দির?
এখানে বলে কাটা ঠাকুরানীর মন্দির। ভিতরে কিছু নেই। শুধু দালানটা ভাঙাচোরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
কাটা ঠাকুরানীর মন্দিরের কথা কালই বিকেলে শুনেছি। দেবতোষবাবুর কাছে। ওরই পশ্চিমে ফোকলা ফকিরের গাছ।
ফেলুদা আর কিছু না বলে এগিয়ে চলল, তার হাতে আদিত্যনারায়ণের তলোয়ার। দেখে মনে হয় সেও যেন শের শা-র মতোই তলোয়ার হাতে বাঘ মারতে চলেছে!
কাটা ঠাকুরানীর মন্দির যে বহুকালের পুরনো সেটা দেখলেই বোঝা যায়। তার ফাটল থেকে অশখ গাছের চারা বেরিয়েছে। তার মাথাটাকে পাশের একটা বটগাছের ঝুরি নেমে আকড়ে ধরে পিষে যেন তার প্রাণটাকে বের করে দিয়েছে। ফেলুদা কিন্তু মন্দিরের দিকে দেখছিলই না। তার চোখ চলে গেছে। মন্দিরের ডান দিকে। প্রায় বিশ হাত দূরে সত্যিই একটা প্রকাণ্ড বুড়ো অশ্বত্থ গাছ শুকনো ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। গাছে পাতা প্রায় নেই বললেই চলে। যেটা আছে সেটা হল মাটি থেকে প্রায় এক-মানুষ উঁচুতে একটা ফোকর।
ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে গাছটার দিকে এগিয়ে যেতে ক্ৰমে ফোকরের চারিদিক ঘিরে গাছের গায়ের ছোপ-ছোপা এবড়ো-খেবড়ো শিরা উপশিরা সব মিলিয়ে একটা দাড়িওয়ালা বুড়োর চেহারা আমাদের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। দাড়িটা গজিয়েছে যেন ফোকরের ঠিক নীচে। হাঁ করা ফোকলা বুড়োর সঙ্গে আশ্চর্য মিল।
ফেলুদার দৃষ্টি আবার ঘুরে গেল।
ওই দিকটা উত্তরদিক কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল মাধবললালকে।
হ্যাঁ–ওটাই উত্তর।
হতেই হবে। ওই তো অর্জন গাছ। আর ওই যে জোড়া তাল।
অবাক হয়ে দেখলাম, সংকেতের নির্দেশের সঙ্গে সব হুবহু মিলে যাচ্ছে।
পঞ্চান্ন হাতই হবে। সেখানেও ভুল নেই, বলে ফেলুদা অর্জুন গাছটার দিকে এগিয়ে গেল।
গাছটার কাছে পৌঁছে জোড়া তাল গাছ লক্ষ্য করে খানিক দূরে এগোতেই একটা ঝোপড়ার পিছনে জল-কাদায় ভরা একটা বেশ বড় গর্ত চোখে পড়ল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গর্তটা এই কয়েক’দিন আগেই খোঁড়া হয়েছে।
আর এটাও বোঝা যাচ্ছে যে তার ভিতর থেকে একটা হাঁড়ি-টাড়ি গোছের জিনিস বার করে নেওয়া হয়েছে।
গুপ্তধন হাওয়া? লালমোহনবাবু এই প্ৰথম গলা চড়িয়ে কথা বললেন।
ফেলুদার মুখের ভাব থমথমে। এটাকে অবিশ্যি নতুন কোনও রহস্য বলা চলে না। বোঝাই যাচ্ছে তড়িৎবাবুকে যে খুন করেছে। সেই গুপ্তধন হাত করেছে। ফেলুদা। তবুও গর্তের দিকে একদৃষ্টি চেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, তোরা একটু জিরিয়ে নে। আমি আশপাশটা একটু সার্ভে করে নিচ্ছি।
সত্যি বলতে কী, এতক্ষণ পা টিপে টিপে কটা বাঁচিয়ে জঙ্গলে হেঁটে বেশ ক্লাস্ত লাগছিল, তাই আমি আর লালমোহনবাবু বিশ্রামের একটা সুযোগ পেয়ে খুশিই হলাম। ফোকলা ফকিরের তলায় একটা শুকনো জায়গা বেছে আমরা মাটিতেই বসলাম, আর মাধবীলাল গাছের গুড়িতে বন্দুকটাকে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে আমাদের সামনে বসে তার তেরো বছর বয়সে সে ভাল্লুকের আক্রমণ থেকে কীভাবে উদ্ধার পেয়েছিল সেই গল্প বলতে লাগল। আমার মন কিন্তু পুরোপুরি গল্পের দিকে যাচ্ছে না, কারণ একটা চোখ রয়েছে ফেলুদার দিকে। সে ঠোঁটের ফাঁকে একটা টাটকা ধরানো চারমিনার নিয়ে মন্দিরের চারপাশটা সাৰ্ভে করছে। একবার মনে হল একটা সিগারেটের টুকরো তুলে নিয়ে আবার সেটাকে ফেলে দিল। আরেকবার হাঁটু গেড়ে বসে কোমরটাকে ভাঁজ করে প্রায় মাটিতে নাক ঠেকিয়ে কী যেন দেখিল।
প্রায় দশ মিনিট ধরে তন্ন তন্ন করে চারিদিকে সার্ভে করে ফেলুদা মন্দিরের ভেতর ঢুকল। ধন্যি সাহস ফেলুদার। বাইরের থেকে মন্দিরের ভেতরটা অন্ধকূপের মতো মনে হয়। এককালে নাকি দশভূজার মূর্তি ছিল, কালাপাহাড়ের দৌলতে সে মূর্তির মাথা, চারটে হাত আর পেটের খানিকটা কাটা যায়। সেই থেকে মন্দিরের নাম হয়ে যায়৷ পেটকাটি বা কাটা ঠাকুরানীর মন্দির। এখন ওর ভিতরে নিঘাত সাপ, তক্ষক আর গিরগিটির বাসা। তাও ফেলুদা নির্বিকারে মন্দিরের ভিতর ঢুকে সার্ভে করে মিনিটখানেক পরে বেরিয়ে এসে রহস্যজনকভাবে বলল, তাজ্জব ব্যাপার। আলো পেতে হলে যে অন্ধকারে প্রবেশ করতে হয় তা এই প্রথম জানলাম।
কী মশাই, ডার্কনেস গান? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
খানিকটা, বলল ফেলুদা, অমাবস্যার পর প্রতিপদের চাঁদ বলতে পারেন।
তা হলে তো ষোল কলা পুরতে এখনও অনেক দিন মশাই।
আপনি শুধু চাঁদের কথা ভাবছেন কেন? সূৰ্য বলেও তো একটা জিনিস আছে। রাতটা কেটে গেলেই তো তার দেখা পাওয়ার কথা।
কালই, তার মানে, ক্লাইম্যাক্স বলছেন?
আমি আর কিছুই বলছি না লালমোহনবাবু, শুধু বলছি যে এই প্রথম একটা আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছি। চ তোপসে, বাড়ি চ।