আকুতি
ঘোষপুকুর লেনের গা ঘেঁষে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে সুবিশাল তিনতলা বাড়িখানা,সেটি একটি যৌথ পরিবার।পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা,আর বাড়ির গিন্নিরা প্রায় ভোর থেকেই কোমরে আঁচল কষে গুঁজে নিয়ে লেগে যায় গৃহকর্ম সম্পাদনার কাজে আর সন্ধ্যার পর নিজের নিজের স্বামীকে আরও বেশি টাকা ইনকাম করার জন্য তাগাদা দেওয়ার রোজনামচায় ব্যস্ত থাকে।পরিবারের একমাত্র কত্রী সুহাসিনী দেবীর কথাতেই এই সংসারটা ওঠে আর বসে।তাঁর দাপটে পরিবারের প্রতিটি সদস্য একেবারে তটস্হ থাকে।তিনি ঘোর হিসাবী এবং কঠোর অনুশাসনের জীবনে বিশ্বাসী।টাকা ইনকাম করার জন্য বইএর অক্ষর গিলে এবং উগরে নিজের অর্থসমাগমের নিরাপদ ব্যবস্হা করা এবং তারপর বিষয় আশয়ের হিসাবে মগ্ন থেকে জীবন অতিবাহিত করার আদর্শে তিনি দীক্ষিত এবং নিজের এই সুবিশাল যৌথ পরিবারটিকে তিনি এই একটিমাত্র মন্ত্রে নিজের মতো করে পরিচালনা করেন।এই বাড়িতে তাই বাড়তি কোনো কথা নেই।হাসি নেই।আবেগ নেই।সবাই যেন টাকার পিছনে ছুটতে থাকা দম দেওয়া পুতুল।সুবিশাল এই পরিবারটিতে এই চেনা ছকের বাইরের বাতাসের স্বাদ গন্ধ অনুভব করা মানুষ মাত্র দুটি।একজন এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য তাতান আর অপরজন হলেন সবথেকে প্রবীণ সদস্য অরূপবাবু।অরূপবাবুর সাথে তার ছোটনাতি তাতানের দারুণ বন্ধুত্ব।কারণ এই আস্ত পরিবারের মধ্যে শুধুমাত্র এদের দুজনের কাছেই জীবনের অর্থ শুধুমাত্র টাকার পিছনে ছোটা নয়।কিছু অনুভূতি,কিছু উপলব্ধি যা অন্তরের চোখ মেলে দেখতে হয়…অনুভব করতে হয়।তাতান লেখালেখি করতে ভালোবাসে খুব।এই নিয়ে বাড়িতে প্রতিমূহুর্তে তীব্র অশান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে সে বাড়ি ছেড়েছে কয়েকদিন হল।কাছাকাছি একটা মেসে থাকে আর দিনে স্কুল মাস্টারি আর রাতে লেখালেখি নিয়ে তার জীবন কাটে।সে বাড়ির পরিবেশ থেকে নিজের একটা শৌখিন দূরত্ব বজায় রেখে নিজের মতো করে বাঁচে।সপ্তাহখানেক হল সে অনির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য কিছু জামাকাপড় ও জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে।কারণ তার প্রাণাধিক প্রিয় দাদু এখন রোগশয্যা নিয়েছেন।খবরটা পাওয়া মাত্র তাতান তাড়াতাড়ি করে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে।তাতান ছোট থেকেই দেখে এসেছে,দাদুর সাথে ঠাকুরমার একেবারেই কোনো বনিবনা নেই।ঠাকুরমা দাপুটে শাসনে যখন সারাবাড়ি তটস্হ,তখন দাদু ঘরের লাইব্রেরীর একটা কোণায় চেয়ার পেতে কোনো বইএর পাতার কোনো গহিন মণিমুক্তো আস্বাদনে বুঁদ হয়ে আছেন।তাতান ইতিমধ্যে লেখালেখি করে সাহিত্য জগতে বেশ নাম করে ফেলেছে।ইতিমধ্যে দিনকয়েক আগে এক প্রকাশনী তাতানের লেখা দশটি উপন্যাস নিয়ে একটি বই প্রকাশ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।নয়টি উপন্যাস লেখা শেষ হয়ে গিয়েছে।শেষ উপন্যাসটির জন্য বিষয়বস্তু ছেঁড়া ছেঁড়া মতন একটা কিছু ভেবেছে বটে,কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত্য তেমন মনঃপূত না হওয়ায় সে সেইসমস্ত ভাসা ভাসা চিন্তার সমস্ত বিষয়বস্তু একেবারে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে একেবারে আনকোরা নতুন কোনো বিষয় নিয়ে লিখবে বলে বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে নতুন করে একটা প্লট তৈরি করার কাজে সবেমাত্র মনোনিবেশ করেছিল ঠিক এমনই সময়ে দাদুর রোগশয্যা নেওয়ার খবরটা আসায় সমস্ত চিন্তাভাবনায় অস্হায়ী বিরতির যবনিকা টেনে দিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে তো এল।কিন্তু সে ফিরে এসে বাড়ির যে চিত্র দেখল,তাতে সে যাদপরনাই মর্মাহত হল।যদিও সে দাদু আর ঠাকুরমার মধ্যেকার এই বিঘতখানেকের দূরত্বটা ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছে,কিন্তু আজ রোগশয্যায় শায়িত অবস্হাতেও যখন দাদু তার ঘরে,তার বিছানায় চিরকালের মতোই একা দিনযাপন করছেন,আর ঠাকুরমা বহিরাগত অতিথির মতো দিনে দুইবেলা কি তিনবেলা নিয়ম করে এসে খোঁজখবর করে নিয়ে প্রয়োজন মতো ওষুধ খাইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে যাচ্ছেন,তখন সেই দৃশ্য দেখে তাতানের মনটা ভীষণরকম খারাপ হয়ে গেল।সে বাড়িতে ফিরেই যখন দাদুর কাছে গিয়েছিল,তখন সেই সময়টা ছিল সূর্যাস্তের অন্তিম লগ্ন।জানলা দিয়ে দাদুর মুখের চতুর্দিকে যে চৌকোনা স্বর্ণালী ও রক্তিম আভা মিশ্রিত মায়াবী আলোর আভরণ এক অপূর্ব স্নিগ্ধতার পরশে ঘরখানিকে শোভিত করছিল,সেই আলোতে তাতান অসুস্হ দাদুর মুখখানি দেখল।বার্ধক্যের ভারে ক্লিষ্ট মুখখানিতে এক অদ্ভুত প্রশান্তির তৃপ্ততা পরতে পরতে মাখানো।যেন বন্দীদশা থেকে হঠাৎ মুক্তির কোনো গোপন চাবিকাঠি তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন।তাঁর ক্লিষ্ট দুচোখে এক অনাবিল কৈশোরের চাহনি দেখে তাতানের মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন,অনেক কথা যেন তোলপাড় শুরু করে দিল।সে তার ব্যাগপত্র কোনোভাবে নিজের ঘরে রেখে দিয়েই তড়িঘড়ি করে দাদুর ঘরে চলে এসেছিল।ধীর পায়ে ঢুকেছিল সে দাদুর ঘরে।আস্তে করে দাদুর বিছানার পাশে রাখা চেয়ারখানি নিয়ে বসেছিল।তারপর সে নিষ্পলক তাকিয়েছিল দাদুর চোখের দিকে আর দাদুর যন্ত্রনাক্লিষ্ট চোখ দুখানি স্হিরভাবে নিবদ্ধ ছিল তাতানের চোখের দিকে।বেশ কিছুক্ষণের এই নিস্তব্ধতাতেই নিঃশব্দে হয়ে গেল অনেক কথার মূক বিনিময়।যাবার সময়ে তাতান দাদুর হাত ধরে বলেছিল,”দাদু…তুমি এই ঘরে আর একা থাকবে না।আমি আমার ব্যাগপত্র নিয়ে এই ঘরে আসছি।বাইরের লোক নয়,এবার থেকে আমিই তোমার সেবাযত্ন করব।”
বৃদ্ধ ভগ্নকন্ঠে কোনোমতে বললেন,”আমায় একটু একা থাকতে দে দাদুভাই,একটু একা থাকতে দে”।
তাতান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,”তা কি করে হয় দাদু…তোমার শরীরের এই অবস্হায়…
“শ্ শ্ শ্ শ্ শ্”…
চাপা অথচ প্রখর তীব্র কন্ঠে দাদু তার মুখের কাছে আঙুল এনে দৃঢ়স্বরে বললেন,এই বিষয়ে আর একটাও কথা নয়।এটা আমার আদেশ।”
তাতান যারপরনাই বিস্মৃত হল।তারপর ধীরকন্ঠে বলল,”ঠিক আছে দাদু।যেমন তোমার ইচ্ছা…আমি মাঝে মাঝে তোমায় দেখতে আসব।সাবধানে থেকো !আর আমার ঘর তো কাছেই,দরকার মতো আমায় ডেকে নিও কেমন!”
এই বলে সবেমাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তাতান।এমন সময়ে দাদু হঠাৎই এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন।তিনি তাতানের হাত দুখানি জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
“আামার একটা কাজ করে দিবি দাদুভাই?”
অবাক হয়ে তাতান বলল,”হ্যাঁ নিশ্চয়ই।বলো না দাদু”।
দাদু বললেন,”আমায় একটা বড় ক্যানভাস আর কিছু রং তুলি এনে দিবি?”
তাতান অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করল,তুমি এই শরীর নিয়ে রং তুলি ক্যানভাস নিয়ে কি করবে?
রোগক্লিষ্ট মুখে অল্প হাসি এনে দাদু বললেন,এনে দে না রে দাদুভাই…মরবার আগে একটু বেঁচে নিই…
দাদুর সারা মুখে এক অদ্ভুত আকুতি দেখল তাতান।মৃদুস্বরে সে বলল,ঠিক আছে দাদু।আমি আজ বিকেলের মধ্যে তোমায় এনে দেব।এখন আমি আসি…সাবধানে থেকো…
ঘরের পরদা সরিয়ে ধীরপায়ে ঘর থেকে বিদায় নিল সে।সেদিন বিকেলের মধ্যে সে একটা বড় ক্যানভাস আর কিছু রংতুলি কিনে এনে দাদুকে দিয়ে এল।তার অল্পকিছু দিন পর পরই দাদুর মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল।দাদুর শরীর থেকে যেন কোনো অজানা যাদুমন্ত্রে রোগ যন্ত্রণার সমস্ত লক্ষণ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকল।এমনকি দাদুর মধ্যে ক্রমশ বার্ধক্যের সমস্ত লক্ষণ ও চিহ্নও অবিশ্বাস্যভাবে গায়েব হয়ে যেতে থাকল।আশি পার করা দাদুর সারা শরীর ক্রমশ বিশবর্ষীয় অকাল তারুণ্যে লাবণ্যময় হয়ে উঠতে লাগল যেন।দাদু মরার আগে তাঁর চার ছেলের মধ্যে কোনজন আগে সিংহভাগ সম্পত্তি তাঁকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নেবেন সেটা নিয়ে যখন পরিবারের প্রতিটি আনাচ কানাচ জুড়ে চাপা উত্তেজনার পারদ ক্রমাগত উচুতে চড়ছিল,ঠিক সেই সময়ে তাঁর অপ্রত্যাশিত এবং অপার্থিব এই ভোলবদলে গোটা পরিবার এখন বিস্ময়ে একেবারে বাকরুদ্ধ।দাদু এখন শয্যাত্যাগ করেছেন এবং একেবারে রোগমুক্ত সুস্হ শরীর নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।কিন্তু যেটা আশ্চর্য ব্যাপার,সেটা হল,তিনি সব সময়ে নিজের ঘর বন্ধ রাখেন এবং বন্ধ দরজার আড়ালে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে এক অজ্ঞাত অতিপ্রাকৃতিক একাকিত্বে মগ্ন জীবন যাপন করেন।বন্ধ দরজার বাইরের পৃথিবীর যেন জানা বারণ তাঁর এই আত্মমগ্ন জীবনের স্বরলিপি।
তাতান যত সবকিছু সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে থাকল ততই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকল।চারপাশে দাদুর মৃত্যুর দিনক্ষণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝখানে এই অপ্রত্যাশিত যবনিকার অমোঘ বিস্ময় এবং সম্পত্তি টাকাপয়সার ভাগবাঁটোয়ারার চিন্তাভাবনার খেই হারিয়ে নোঙর খোঁজার পরিস্হিতিতে পরিবারের সবার যখন হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্হা তখন এইসব পার্থিব হিসেবনিকেশের চিন্তার উর্দ্ধে অবস্হান করা তাতানের
মনে দেখা দিল এক তোলপাড় করা কৌতূহল। দাদুর শরীর আরোগ্যলাভ করাতে তাতান যারপরনাই খুশি হলেও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে দাদুর এই অপার্থিব পরিবর্তনে তাতান ভীষণভাবে এক কূহেলী আচ্ছন্ন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে যা তাকে উদঘাটন করতেই হবে।বন্ধ ঘরের ভিতরে,জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সেই অলীক দুনিয়ার পর্দা সরিয়ে দেখার কৌতূহলটা ক্রমে তাতানের ভিতরে একেবারে গোঁজ হয়ে চেপে বসল।সে বুঝতে পারল এটা সহজ কাজ নয়।কারণ দাদু নিজের সেই ঘরখানার দরজা এবং জানলার মধ্যে কোনোরকম ফাঁকফোকরটাও উন্মুক্ত রাখবার পক্ষপাতী নন।অতএব এই রহস্য উদঘাটন করতে যদি হয় তাহলে তাতানকে একেবারে সবসময় মনযোগ দিয়ে তক্কে তক্কে থাকতে হবে সময় অথবা সুযোগের অপেক্ষায়।অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।দাদুকে সে যত চোখের সামনে দেখছে,তার সমস্ত চেনা হিসেবনিকেশ নিমেষে গুলিয়ে যাচ্ছে।সে সারারাত বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে বিস্তর পড়াশোনা করল।কিছু কোনোকিছুর কোনো কূলকিনারা করতে পারল না।সে বুঝল,রহস্য উদঘাটন করতে হলে তাকে আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে।সেইমতো পরিকল্পনা করে সে পরদিন সকাল সকালই বেরিয়ে গেল মেসের উদ্দেশ্যে আরো কয়েকদিন বাড়িতে থাকবার জন্য পর্যাপ্ত আরো কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবার জন্য।মেসে পৌঁছে জিনিসপত্র গোছগাছ করে,রুমমেটদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা সেরেটেরে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরীই হয়ে গেল তাতানের।বাড়িতে ফিরে তাতান একটা অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ শুনে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।দাদু আজ সকালেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন।অলীক আরোগ্যপ্রাপ্ত দাদুর এই অকস্মাৎ মৃত্যুতে একেবারে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ল তাতান।সেই সাথে দাদুর এই অপার্থিব পরিবর্তনের রহস্য শুধু রহস্য হয়েই অধরা রয়ে যাবার আপশোষে তাতান ভীষণরকম মুষড়ে পড়ল।সারাবাড়ি এখন লোকে লোকারণ্য।সারাদিন বিভিন্ন মানুষের শোকপ্রকাশ আর কান্নাকাটির পর্ব শেষ হওয়ার পর দাদুর দেহ সৎকার সেরে তাতান বিমর্ষ মুখ নিয়ে বিছানায় তার পরিশ্রান্ত দেহ এলিয়ে দিল।হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে আসতেই সে হঠাৎ শোয়া থেকে এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।তারপর দাদুর শুন্য ঘরখানার দিকে দ্রুতবেগে ধাবমান হল।দাদু বেঁচে থাকতে তো সে ঘরখানায় তিনি নিজে ছাড়া দ্বিতীয় মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।এখন তো আর সেসবের বালাই নেই।দাদু মৃত্যুর আগেই যে পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে সম্পত্তির সমান ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে উইল করে দিয়ে গেছেন সেটা দাদুর মৃত্যুর পরেই তাঁর উকিল মারফৎ সে খবর পেয়ে সবাই এখন মোটামুটিভাবে আশ্বস্ত। অতএব দাদুর সৎকার করে ফেরার সাথে সাথেই সকলের মাথা থেকেই দাদুর সাথে সম্পর্কিত সমস্তরকমের চিন্তাভাবনাও একলহমায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কাজেই তাঁর ব্যবহৃত ঘরখানা নিয়ে এখন আলাদা করে আর কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই।সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন সে ঘরে যে ইচ্ছে ঢুকতে পারে কোনো বাধা নেই।আর তাতানের মন বলছে দাদুর মৃত্যুর সাথে সাথেই দাদু সম্পর্কিত রহস্যের কিনারা হওয়ার সম্ভবনা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি।সে ঘরে খুঁজে দেখলে এখনো কোনো চিহ্ন বা সূত্র হয়তো মিলে যাওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে যার মাধ্যমে একটা লক্ষে পৌছাতে পারবে তাতান।সে মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে দাদুর ঘরের সামনে পৌছে বাইরের শিকলটা খুলে দিল।দিনের বেলায় এই ঘরই একেবারে লোকে লোকারণ্য ছিল।কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘরের কোনো জিনিস যে এদিক ওদিক হয়নি সে বিষয়ে নিশ্চিত তাতান।আস্তে করে আলোটা জ্বেলে নিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল তাতান আর ভাবতে থাকল,কিভাবে কোথা থেকে শুরু করবে।হঠাৎ বিছানার পাশের দেওয়াল ঘেষা ক্যানভাসটার দিকে নজর পড়তেই বেশ চমকে উঠল তাতান।যেদিন সে দাদুকে ক্যানভাসটা এনে দিয়েছিল তার পর দুই তিন দিন মতো স অল্পবিস্তর উঁকিঝুঁকি দিয়ে অল্পের উপর যেটুকু দেখার সু্যোগ হয়েছিল তাতে সে দেখেছিল দাদু একমনে ক্যানভাসের গায়ে ফুটিয়ে তুলছেন এক লাস্যময়ী নারীর প্রতিকৃতি।সে নারীর দুচোখে সুপ্ত আকুতির প্রচ্ছন্ন আগুন ছাইচাপা হয়ে কয়লার মতো প্রতিনিয়ত জ্বলেপুড়ে যেন খাক হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।এতখানি জীবন্ত সে মায়াবী মুখের চাপা অথচ দৃপ্ত চাহনি,যে সেই ছবি দেখলে মনে হবে বহুযুগের ওপার থেকে জ্বালাময়ী আকুতি নিয়ে ক্যানভাস ফুঁড়ে যেন এক্ষুণি তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে এই আগুন নারী।মুখ আঁকা শেষ করে যখন দাদু তার শরীরের নীচের অংশ এবং চারপাশের দৃশ্য আঁকায় মনোনিবেশ করেছিলেন সেই সময়েই তাতান খুব বিশ্রীভাবে ধরা পড়ে যায় দাদুর কাছে।এরপর থেকেই সে ঘরের দরজা তো বটেই,তার ফাঁকফোকর পর্যন্ত সবার জন্য সপাটে বন্ধ হয়ে যায়।আর তারপর থেকেই দাদুর মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করে বিশবর্ষীয় উদ্দাম যৌবন।দাদুর ভগ্ন দুচোখে বয়সের ভার ও যাবতীয় ক্ষীণতা আর রোগক্লিষ্টতা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হতে থাকে।দামাল গতিতে সেই দুচোখে জেগে ওঠে এক নাম না জানা তুফান।দাদুর এই পরিবর্তনের সাথে ক্যানভাসের এই প্রতিকৃতির পরিপূর্ণতা যে আসলেই একে অপরের পরিপূরক ছিল তা এখন বুঝে নিতে একটুও অসুবিধা হয় না তাতানের।কিন্তু অঙ্কে যে একটা বড় ধরণের গোলমাল রয়েছে।ক্যানভাসে আজ সে দেখতে পাচ্ছে কল্লোলিনী পাহাড়ী ঝরণা,প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্য বড় সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে। শুধু সেই পাহাড়ী ঝরনার কোলে স্নানরতা সেই কুহকিনী নারীর প্রতিকৃতির জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। সাদা।এটা কেন হল!ক্যানভাস জুড়ে থাকা প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাজোসাজো উৎসবের মধ্যমণিকেই এভাবে উধাও করে দেওয়া হল কেন!এত ধৈর্য্য আর যত্ন দিয়ে লালিত এই অনির্বাচনীয় সৃষ্টিকর্মটিকে কেন মুছে দিলেন দাদু!রহস্য আরো ঘনীভূত হতে থাকল।
তাতান এখন একসমুদ্র প্রশ্নের মাঝে সঠিক দিশা খুঁজে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।সে এবার কোনো একটা সূত্র পাবার জন্য দাদুর ব্যবহার্য টেবিলে রাখা খাতাপত্র আর টুকরো কিছু কাগজ নিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে নিয়ে জোরালো গবেষণা করতে বসে গেল। সামনে রাখা চেয়ারখানি টেনে নিয়ে তাতে বসে সেগুলো নিয়ে কিঞ্চিৎ নাড়াচাড়া করতে লাগল।দাদুর প্রতিদিন ডায়েরী লেখার অভ্যাসের কথা বাড়ির সবাই জানে।অন্যের ডায়েরী পড়া কোনো ভদ্ররুচির পরিচয় যে নয় এই শিক্ষাটা যথেষ্ট ভালোভাবেই আছে তাতানের।কিন্তু দিনে দিনে চোখের সামনে দাদুর যে অপার্থিব পরিবর্তন সে চাক্ষুষ করেছে।প্রকৃতির নিয়মের সম্পূর্ণ উল্টোস্রোতে যেভাবে টগবগিয়ে উঠেছিল দাদুর অকাল তারুণ্য,তার কোনো কূলকিনারা যে না পেলে চলবে না তাতানের।সে একটা সূত্রের কাছাকাছি এসেও বড়ো কিন্তু কিন্তু করতে লাগল ।কাজটা হয়তো ঠিক নয়।সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক চারিধার দেখতে লাগল।এমন সময় আনমনা তাতানের হাত লেগে দাদুর ডায়েরীটাতে ধাক্কা টেবিল থেকে নীচে পড়ে গেল একটি পুরোনো মলাটছেঁড়া পুরু বই আর তার ভিতর দিয়ে একটা খাম বেরিয়ে এল।খামটি হাতে নিয়ে দেখল তাতান,সেটি আসলে একটি চিঠির খাম।চিঠির প্রাপকের স্হানে তাতানের নাম লেখা।দাদু জীবদ্দশায় থাকতে তাতানকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে গিয়েছেন!অধীর আগ্রহ আর উৎকন্ঠা নিয়ে ভীষণ তাড়াহুড়ো করে খামখানা ছিঁড়ে চিঠিখানি খুলল তাতান।চোখের সামনে মেলে ধরল তার প্রতি স্বর্গীয় দাদুর শেষ উদ্ধৃতিগুলি।
স্নেহের তাতান,
আমি জানি আমার মৃত্যুর পরে তুমি আমার পরিত্যক্ত শূন্য ঘরটিতে আসবে।তোমার মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর আমার জীবদ্দশায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি তোমায় দিয়ে যেতে পারিনি।বাড়ির বাকি সকলের বিষয় আশয়ের হিসেব নিকেশের উর্দ্ধে উঠে তোমার সেই নিষ্পলক চোখের প্রশ্নপিপাসু দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।কিন্তু তখন আমি নিরুপায় ছিলাম।আজ আমার মুক্তির পর আর তোমার কাছে অন্তত আমার কোনো পর্দা নেই কারণ এই বাড়িতে আমার একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরী তুমি।তাই তোমার কাছে নিঃসংকোচে আমি আমার মুক্তিপ্রাপ্তির প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি দিয়ে গেলাম।আমার যাবতীয় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কোনোরকম সংকোচ না করেই অকপটে তোমার জন্য রেখে গেলাম তোমার যাবতীয় সংশয়ের উত্তর যেটি ক্যানভাসের পিছন দিকটা খুঁজে দেখলে তুমি হাতে পাবে।তোমার সব প্রশ্নের উত্তর সেখানেই রয়েছে। আমার আশীর্বাদ নিয়ো।
ইতি,
তোমার দাদু
চিঠিখানি পড়ে তাতানের মনটা উৎফুল্লতায় ভরে গেল।দাদু জীবদ্দশায় তাকে যে তাঁর হৃদয়ে কতখানি জায়গা দিয়েছিলেন সেটা আবার নতুন করে উপলব্ধি করতে পারল তাতান।আর দেরী না করে সে ক্যানভাসের কাছে চলে গেল আর তার পিছনটায় দাদুর রেখে যাওয়া কোনো কাগজের টুকরো খুঁজতে লাগল।ক্যানভাসের পিছনে একেবারে নীচের দিকে দেখল একটা চাবি রাখা রয়েছে।তাতান দেখল,এটা তো তাতানের ডায়েরীর লকএর চাবি।তাজ্জব বনে গেল তাতান।তার ডায়েরী আর তার চাবি তো মেসে রাখা ছিল।সেই চাবি দাদুর হাতে এল কি করে!কোনো কিছুরই কোনো মাথামুন্ডু খুঁজে পেল না তাতান।বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে চাবি হাতে সে মাটিতে বসে পড়ল।সে এবারে মেস থেকে ফেরার সময়ে ডায়েরীটা আর চাবি সাথে করেই নিয়ে এসেছিল। এটা তাহলে কিভাবে সম্ভব!একটা সাংঘাতিক কিছুর আঁচ করতে পেরে সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রায় একছুটে টেবিলের কাছে চলে আসল এবং আর কোনো দ্বিধা বা সংশয় না রেখে সে দাদুর ডায়েরী খুলে তার পাতা ওলটাতে শুরু করল।তারপর যে দৃশ্য সে চাক্ষুষ করল তাতে তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল।সে দেখল, দাদুর ডায়েরীর ভিতরের প্রতিটি পাতায় জ্বলজ্বল করে ভাসছে তার নিজের স্বহস্তে লেখা প্রতিদিনকার দিনলিপি।সে আর কালবিলম্ব করল না।সাথে সাথে সে ছুট লাগাল নিজের ঘরের অভিমুখে।এই মাঘ মাসেও তার কপালে শিশির ফোঁটার মত দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিজের ঘরে ঢুকেই নিজের শেলফ থেকে এক ঝটকায় টেনে বার করল নিজের ডায়েরীখানা।যে চাবি সে মেসবাড়ি থেকে নিজে হাতে করে নিয়ে এসেছে সেই চাবি এইভাবে দাদুর ঘরের এমন একটি জায়গা থেকে পেয়ে তার মাথা ইতিমধ্যেই খারাপ হয়ে আছে।সে এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে ডায়েরী হাতে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে।আনমনাভাবে ওলটাতে লাগল নিজের ডায়েরীর পাতা।সে দেখল,ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় ভেসে উঠেছে দাদুর মৃত্যুর পূর্বেকার দিনলিপি।সে আর বৃথা চিন্তাভাবনার মধ্যে না গিয়ে ক্রমশ ডায়েরীর পাতায় মনোনিবেশ করল।
১৯.১১.২০২৩
রাত ঘনিয়ে এসেছে।আমি জানি কালকের মতো তুমি স্বপ্নে দেখা দিয়েই আমায় ফেলে আর কোনো অজানার দুনিয়ায় উধাও হয়ে যাবে না।কথা তুমি রাখবে।আমি জানি আমার আশেপাশেই আছ তুমি।আমার পার্থিব অনুভবের বাইরে তোমার বিচরণ।তোমার সাথে আমি চাইলেও আমার হৃদয়ে পঞ্চাশটি বছর ধরে জমে থাকা হাজারো শব্দ কথা সুর কান্নাগুলো তোমার সামনে এনে ফেলে ক্ষমাভিক্ষার ঝুলিখানি মেলে ধরে তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে পারব না।তাই আজ থেকে এই ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় আমি তোমায় ডাকব।কাঁদব আর দীর্ঘ বছর ধরে জমে থাকা সমস্ত কথা অনুভূতির ধূলো ঝেড়ে তুলে ধরব তোমার সামনে।আমি জানি তুমি আমার এই ডাক শুনবে।ঠিক শুনবে…
২২.১২.২০২৩
আজ সকাল থেকে আবার আমার হাঁটুর ব্যাথাটা ভীষণভাবে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। সারা শরীর বার্ধক্যের ভারে বোঝা হয়ে উঠেছে। আর পরিবারের সকলের ক্ষমাঘেন্না কুড়িয়ে এই ঘৃণ্য জীবন টানতে ইচ্ছা হয় না।তবু জীবনের অমোঘ প্রাপ্তির বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের বাঁধনহীন ঝড়ে আমার হৃদয় হয়ে উঠেছে দামাল যুবা।যে ঝড় পঞ্চাশ বছর আগে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে এক গহিন জঙ্গলের শত গাছগাছালির আড়ালে কৃষ্ণকলির মতো তামা পোড়ানো সর্বাঙ্গে, শিশিরবিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা ঘামে সিক্ত তোমার শরীরে চাগিয়ে উঠেছিল কাঠ কাটার ক্লান্তি,সেই পাগল করা তুফান আজও যেন আমার প্রতিটি রোমকূপে জাগিয়ে তুলছে এক অলীক সুরের মূর্ছনা।পরীক্ষা শেষে কলেজের বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে পুরুলিয়া ঘুরতে আসা একটা সাদামাটা ছেলের জীবন এভাবে এক অপ্রত্যাশিত দামাল ঝড়ের দাপটে দিশাহীন হয়ে যাবে সে কি আমি স্বপ্নেও ভেবেছিলুম!বারো ভাইবোন,বাপ মা আর বৃদ্ধ দাদু দিদিমাকে নিয়ে গড়ে ওঠা সুবিশাল সংসারের মুখ্য কান্ডারীর গুরুদায়িত্ব যখন তোমার কাঁধে,তখন সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও আমার জন্য তোমাদের পরবের পিঠেটা,আমার পছন্দের টুকিটাকি খাবার নিজে হাতে রেঁধে যখন নির্জন জঙ্গলের পথ ধরে লুকিয়ে এসে আমার হাতে দিয়েই উধাও হয়ে যেতে…চাঁদের ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় স্নাত তোমার ওই প্রশান্ত গভীর নিটোল চোখদুটির মূক তুফানে ক্ষণিকের ওই মূহুর্তটুকুই আমার অন্তরাত্মা উথালপাথাল করে যে কি অবর্ণনীয় আলোড়ন তুলে দিয়ে যেত তা কোনোদিন সেভাবে বলা হয়ে ওঠেনি তোমায়।আজ এতদিন বাদে এই ভগ্ন শরীরের ভিতরে যে আহত ক্ষতবিক্ষত হৃদয়খানি শুধুমাত্র ডানা ঝাপটে মরেছে এতদিন,আজ যেন পঞ্চাশ বছর আগের সেইদিনের আলোড়ন আবার নতুন করে অনুভব করতে পারছে।সেইদিন তোমার দুচোখ আশ্বাস ছিল…তুমি যেন দুচোখে উদ্বেলিত প্রেমের ঢেউএ পৃথিবী কাঁপিয়ে আমায় আশ্বাস দিয়ে যেতে…”আমি আছি…আমি থাকব”…
আজ দীর্ঘযুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরে স্বপ্নে যখন তুমি দেখা দিলে,তখন সেই আশ্বাস আবার যেন নতুন করে ফিরে পেলাম।আমি জানি তুমি আজও কথার খেলাপ করবে না।তাই তো তোমার কথামতো আমি রংতুলি ক্যানভাস সব আনিয়ে রেখেছি।আমার মুক্তির দিন যে ঘনিয়ে এসেছে…
২৪.১২.২০২৩
বড় ঠান্ডা পড়েছে শরীরটাকে আর যেন বইতে পারছি না।তার মধ্যেই যখনই প্যালেটে রং আর তুলি নিয়ে আসি ক্যানভাসের সামনে তখনই যেন অনুভব করি আমার বয়স দ্রুতগতিতে যেন কমতে শুরু করেছে।রং তুলি হাতে নেওয়ার সাথে সাথে প্রতিবার এ কোন তড়িৎকম্পন যে আমার সারা শরীর তীব্রভাবে আন্দোলিত করে যায় এখন তা আমি বুঝতে পারি।আমি জানি আমার হাতের প্রতিটি অঙ্গুলীসঞ্চালনের কম্পনের সাথে সাথে আবির্ভূত হচ্ছ তুমি।কথার খেলাপ করার মানুষ তো তুমি নও।যে মানুষ কথা রাখবার জন্য নিজেকে জীবন্ত লেলিহান অগ্নিশিখায় অবলীলায় ছুঁড়ে দিতে পারে…আমি জানি…কথা রাখতে সে মৃত্যুর ওপার হতে ফিরেও আসতে পারে।ক্যানভাসে প্রস্ফুটিত অগ্নিকুন্ডের ছায়া প্রতিকৃতির মধ্যে দিয়েও কি অবর্ণনীয় সুন্দরভাবে জীবন্ত তুমি।আমার হাতকে তোমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমার জীবনে পুনরায় এভাবে আবির্ভূত হয়ে দীর্ঘবছর আগে দেওয়া কথা যে তুমি অবশেষে রাখবে আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি।পঞ্চাশ বছর আগে সেই দুর্যোগের রাতটার কথা আমার আজও মনে পড়ে।যেই মায়াবী পূর্ণিমার জ্যোৎস্না সিক্ত অভিলাষের লাস্যময়ী সমুদ্রে দুজনে নোঙর ফেলেছিলাম একান্ত নির্জনে…দুজনের অতল পিয়াসী অধরের এক পৃথিবী তৃষ্ণার বুকে হঠাৎ ভয়াল বাজ হেনে আামাদের দুজনকে ঘিরে ধরে গ্রামবাসীরা।আমরা তখন আর প্রেম-বাগানের অমৃতফল খুঁজতে থাকা চাতক রইলাম না।গ্রাম্য সমাজের নিয়মের বুকে ছুরি বসানোর অপরাধে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে।হঠাৎই তুমি সমস্ত গ্রামবাসীর সামনে সমস্ত দায় নিয়ে নিলে নিজের ওপর।নিজের মুখে চিৎকার করে বললে,এতবড় পরিবারের দায়ভার সামলাতে সামলাতে পরিশ্রান্ত তুমি হাতে কিছু টাকাপয়সা পাওয়ার জন্য আমার সাথে এই নাটকটা করেছ।আমি শুধু তোমার ফাঁদে পড়া শিকার বই আর কিছুই না।কিন্তু তাও গ্রামবাসীরা আমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়ল না।আমাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেবার ব্যবস্হা আরম্ভ হয়ে গেল চারদিকে আর বলির পাঁঠার মতো হাত পা বাঁধা আমি কাঁপছি থরথর করে।হঠাৎ আমার নিধনযজ্ঞের উদ্দেশ্যে জ্বালানো আগুনে উন্মাদিনীর মতো ছুটে এসে যখন ঝাঁপিয়ে পড়লে তুমি আমার তখন ভয়ে আতঙ্কে চেতনা লোপ পাবার উপক্রম।কিন্তু তাও জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে দগ্ধ হতে হতে ধরিত্রী কাঁপিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন আমায়।”আমি আবার আসব…তোমার হাত ধরব যখন তুমি এভাবেই ডাকবে আমায়…”
আজ বুঝি…জগৎ সংসারের স্বার্থপরতা,নিষ্ঠুরতার মধ্যে দগ্ধে দগ্ধে তোমার মতই জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে অর্ধভস্মে পরিণত হয়ে যখন তীব্র আকুতিতে তোমায় ডাকব…তুমি এইভাবে আবির্ভূত হবে আমায় মুক্তি দিতে…
আমার তুলির প্রতিটি আঁচড়ে আজ যেন তোমার জীবনের সেই অন্তিম প্রতিধ্বনি যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠছে।আমি বুঝতে পারছি আমার মুক্তির আর বেশি দেরি নেই।রাত অনেক হল…এখন শরীরের বিশ্রাম প্রয়োজন।কাল থেকে তোমায় জাগিয়ে তুলে প্রাণসঞ্চার করার কাজে নতুন উদ্যম নিয়ে মনোনিবেশ করব।
২৯.১২.২০২৩
ক্যানভাস জুড়ে তুমি বড় জ্বালাময়ী রূপ নিয়ে জেগে উঠেছ।দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছ আমার প্রতিটি রোমকূপে।আমার সারা শরীর জুড়ে রক্তের প্রতিটি কণা যেন বিশ বছরের যুবকের ন্যায়ে শিরা উপশিরা তোলপাড় করে ভীষণ এক তেজোদৃপ্ততার প্রবল আস্ফালনে গর্জে উঠছে।আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই আমি নিজেকে নিজে চিনতে পারি না।আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না।আমি যেন ফিরে গেছি সেই দিনটিতে,যেদিন তোমায় জীবন্ত দগ্ধ হতে দেখে আমি ভয়ানক শক পেয়ে দীর্ঘদিনব্যাপী কোমায় চলে গিয়েছিলাম।দশটি বছর পার করার পর যখন আমি অতীতের স্মৃতি ফিরে পেলাম ততদিনে আমার বাবার পছন্দ করে রাখা মেয়ের সাথে আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়ে সন্তানাদি হয়ে গিয়েছে।টাকা আর সম্পত্তির প্রাচুর্য দেখে এক স্মৃতিভ্রংশ মানুষ কে খুশিমনে বিবাহ করে নিলেও আমার স্ত্রীর অন্তরে আমি মনুষ্যেতর ব্যবহার ভিন্ন আর কিছুই পাইনি।এরপর দীর্ঘ এতগুলি বছর কেটে গেল স্রোতের মতই…কোনোদিন আমার সর্বশরীর মন জুড়ে জীবন এইভাবে জীবন্ত স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠেনি।আমার প্রতিটি রক্তসঞ্চালন এই আকুতিই শুধু উথালপাথাল করে প্রতিধ্বনিত করছে একটিই আকুতি।তুমি যে দুনিয়ায় থাকো আমায় সেখানে পৌছাতে হবে।আমার মুক্তি যে সেখানেই…
তাতান অবাক বিস্ময়ে নিজের ডায়েরীর পরের পাতাখানি উল্টালো।পাতা খালি।ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখ আজ।আজ সকালে দাদু ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। সমস্ত ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তাতানের কাছে।হঠাৎ তাতান ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে দেখল।একটা জিনিস বোধগম্য হতেই তার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল।সে ক্যানভাসের দিকে আরো ভালো করে নিরীক্ষণ করতেই সে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হল,ক্যানভাসের যে অংশ জুড়ে এক কৃষ্ণবর্ণা অপরূপ সৌন্দর্যস্নাত কুহকিনীর অবয়ব দেখতে পেয়েছিল লুকিয়েচুরিয়ে…ক্যানভাসের সেই অংশ এমনভাবে সাদা হয়ে রয়েছে যে সেই অংশটি ভালোভাবে দেখলে কোনো মানুষ বুঝতে পারবে ক্যানভাসের ওই অংশটিতে রংএর কোনো আঁচড়ও ফেলা হয়নি।হঠাৎ তাতানের চোখের সামনে এমন এক অপার্থিব ঘটনা ঘটতে থাকল যে অবাক বিস্ময়ে তাতানের পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল।নিজের চোখকে তার বিশ্বাস করা সম্ভব হচ্ছিল না।ক্যানভাসে ওই নারী অবয়ব তাতানের চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হচ্ছে ধীরে ধীরে।আর সেই অবয়বকে আলিঙ্গনরত অবস্হায় জীবন্ত হচ্ছে আরেকটি যুবার অবয়ব।সেই যুবা আর কেউ নন…দাদু।তাতানের ভয়ে বিস্ময়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত টলমল করে উঠল।এরপর সে ক্রমশ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল পুরো ক্যানভাসটি কিভাবে আস্তে আস্তে সমস্ত রং আর অবয়বের সব চিহ্ন মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।মিনিট দশেক বাদে ক্যানভাসটি পুরো সাদা আর নতুন হয়ে গেল যেন সেখানে কোনোদিন রঙের কোনো আঁচড়ই পড়েনি।তাতান আর সহ্য করতে পারল না।সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
পরদিন তাতানের ভীষণ জ্বর এল।সেই ধূমজ্বরের মধ্যেই তাতান জানল,দাদু তার সম্পত্তি সকলের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছেন এবং দাদুর উইল অনুযায়ী দাদুর ব্যবহৃত ঘরখানি তাতানের ভাগেই পড়ছে।নিজস্ব কিছু জমি ও সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে তাতান এটা বুঝল,বাড়ির সকলের সাথে তার মতের বনিবনা না হলেও আর মেসবাড়িতে গিয়ে তার থাকবার প্রয়োজন পড়বে না।শরীর সুস্থ হওয়ার পর সে মেসবাড়ি থেকে তার যাবতীয় জিনিসপত্র গুটিয়ে এনে দাদুর ঘরখানিতে তার নিজস্ব থাকবার বন্দোবস্ত করে নিল এবং এরপর আর দেরী না করে সে তার দশটি উপন্যাসের সংকলনের জন্য শেষ উপন্যাসটি লেখার কাজে মনোনিবেশ করল।এবার আর ছেঁড়া ছেঁড়া চিন্তাভাবনার জাল জুড়ে প্লট তৈরি করার প্রয়োজন নেই।বিষয়বস্তু সে পেয়ে গেছে।একটি শহুরে যুবা এবং একটি আদিবাসী গ্রাম্য মেয়ের, সমাজ পৃথিবী সমস্তকিছুর উর্দ্ধে উঠে যে নিঃস্বার্থ নিখাদ প্রেমের হৃদয়স্পর্শী কাহিনী সকলের অগোচরে ছিল আজ তা মানুষের সামনে আনবার জন্য হাতে কলম তুলে নিল।কলম হাতে মনে মনে সে বলল,দাদু… তুমি ভালো থেকো…শান্তিতে থেকো…