সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ৩১
মাঠের ধার ঘেঁষে ফাঁকা রাস্তা ধরে আসছিল। মাইলখানেকের মধ্যে ব্রেকে আপনা থেকে চাপ পড়ল আবার। রাস্তার পাশে মাঠের আবছা অন্ধকার ধরে একজন হনহন করে হেঁটে চলেছে।…মেয়ে।
বাপী হেড লাইট জ্বালল। সেই মেয়ে।
মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে কুমকুম।
জোরালো হেড লাইটের ধাক্কায় দাঁড়িয়ে গেল। চোখে মুখে কয়েক মুহূর্তের চকিত প্রত্যাশা। তার পরেই কাঠ একেবারে।
গাড়িটা নিঃশব্দে পাশে এসে থামল। হেড লাইট নিভিয়ে বাপী নেমে এলো। মুখোমুখি দাঁড়াল। পরনে ক্যাটকেটে গোলাপী শাড়ি। গায়ে সস্তা সিল্কের সাদা ব্লাউস। পায়ে লাল স্ট্রাইপ স্যান্ডাল। ঠোঁট লাল, গাল লাল। নাকে ঝকঝকে সাদা পাথরের ফুল। বানারজুলিতে চা-বাগানের ক্লাবে জেল্লা ঠিকরনো এই সাদা ফুলটা দেখেছিল। কপালে কালো টিপ।
বাপী বেশ ধীরেসুস্থে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। রাতের কলকাতায় শিকারে বেরিয়েছিল যে মেয়ে সে নিজেই হঠাৎ এক নির্মম শিকারীর জালে আটকে গেছে। সম্ভব হলে এখনো সত্রাসে ছুটে পালানোর ইচ্ছে, কিন্তু পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। অসহায় বড় বড় দু’ চোখ মেলে সে চেয়ে আছে।
অকরুণ গাম্ভীর্যে বাপী দেখছেই। ওই চোখ-তাতানো প্রসাধন ধুয়ে মুছে ফেললে মুখখানা এখনো মন্দ সুশ্রী নয়। লম্বা আর ফর্সা বলে আগে বেশ স্মার্টই দেখাতো। ডাটাবাবুর ক্লাবে ব্রিজমোহনের সঙ্গিনী হিসেবে যেমন দেখেছিল, চার বছর বাদে বাগডোগরার এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে তার থেকেও বেশি সুন্দর দেখেছিল। সেই চেকনাইয়ে টান ধরেছে। শুকনো মুখ, চোখের কোলে কালি। তবু কলকাতার রাস্তায় এই যৌবনের পসরা নিয়ে দাঁড়ালে খদ্দের না জোটার কথা নয়। আজ চারিদিকের গণ্ডগোলের দরুন রসিক হায়নারা সব গর্তে বোধ হয়।
কিন্তু বাপী এখন কি করবে? মিষ্টিকে ছেড়ে এসে আবার এই পথে এসেছিল কেন? খুঁজছিল কেন? এখন…? ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে যে পশুটা এতক্ষণ ধরে ফুঁসছিল আর গজরাচ্ছিল তাকে ছেড়ে দেবে?…একবার ছেড়ে দিয়েছিল। এই দিনের মতোই এক সবখোয়ানো আক্রোশের মুখে রাতের অন্ধকারে কমলা বনিক সেধে তার খুপরি ঘরে এসেছিল। …
…পরপর তিন রাত এসেছিল। কিন্তু সেই অকরুণ উল্লাসের মুহূর্তে কমলা বণিকের অস্তিত্বও ছিল না। চেতনার মুগুর মাথায় এসে না পড়া পর্যন্ত আর একজন সেই জায়গায় জুড়ে ছিল। খানিক আগে তার লোলুপ গ্রাস থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যে গাড়ি থেকে নেমে গেল—সেই মেয়ে। আজও এই একজনকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারে। তারপর কামনার অন্ধকার গহ্বরে আছড়ে ফেলে তারও অস্তিত্ব মুছে দিয়ে সে জায়গায় অনায়াসে সেই মেয়েকেই বাসনার নরকে টেনে আনতে পারে। বিস্মৃতির শেষে কদর্য বাস্তবে ফেরার পরেও এবারে কোনো বিবেকের মুগুর মাথায় এসে পড়বে না।
চাপা আগুনের হলকা বেরুলো গলা দিয়ে। কেমন কলকাতা দেখছ? কুমকুম জবাব দিল না। কাতর চোখে চেয়ে রইল। মুখে ভয়ের ছায়া ঘন হয়ে উঠছে আরো। সামনে যে দাঁড়িয়ে সে বুঝি মেরেই বসবে তাকে
গলা দিয়ে আর এক প্রস্থ আগুন ঝরল বাপীর।—অত ভয় পাচ্ছ কেন…এ—রকম খদ্দের পছন্দ হচ্ছে না?
ভীত ত্রস্ত চাউনিটা এবারে মুখের ওপর স্থির হল একটু। বাপী অভিনয় দেখছে হয়তো। মুখে কিছু যন্ত্রণার রেখা টেনে আনার চেষ্টা দেখছে। গলার স্বরও ফুটল এবার।—বাপীদা বিশ্বাস করো, ওটা তোমার গাড়ি ভাবতে পারি নি, তাহলে এগোতাম না।…তোমার সঙ্গে যে ছিল তার কাছে হয়তো তুমি অপ্রস্তুত হয়েছ, কিছু রোজগারের তাগিদে মাথা এত খারাপ হয়েছিল যে তাকেও আমি লক্ষ্য করি নি। আমাকে ধরে মারো বাপীদা, তুমি আমাকে বাঁচার রাস্তায় টেনে নিতে চেয়েছিলে, বাবার জন্য পাগল হয়ে আমি তাও—
—চোপ! কথা শেষ হবার আগেই বাপীর মাথায় বিপরীত আগুন জ্বলে উঠল। দুটো হাতের থাবা তার দুই কাঁধে উঠে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা কতক প্রবল ঝাঁকুনি।বাবার জন্যে? বাবার জন্য পাগল হয়ে তুমি এই নরকে চলে এসেছ? এখনো এই নাম মুখে?
মেয়েটার চোখে মুখে আর্ত বিস্ময়। তারপর মুক্তি।—তুমি বিশ্বাস করো বাপীদা—শুধু বাবার জন্য, আমি জানতাম বাবা কলকাতায় আছে, সেই এয়ার পোর্টে তোমাকে বলেছিলাম, তুমি তখনো বিশ্বাস করো নি—আমি এসে পড়তে পেরেছিলাম বলেই বাবা এখনো বেঁচে আছে—
বাপীর হাতের থাবা দুটো আপনা থেকেই শিথিল হল। নেমে এলো। কিন্তু দু’চোখের অবিশ্বাস তারপরেও ওই মুখে বিঁধে আছে।তোমার বাবা এখন কোথায়?
—আমার কাছে…ঘরে…
—কার ঘর? কোথায় ঘর?
—এন্টালির কাছাকাছি…ঘর বলতে ভাঙা টালির ঘর। ভয় গিয়ে দু’চোখে হঠাৎ বুভুক্ষু আশার আলো জ্বলে উঠল।—বাবা আর বেশি দিন বাঁচবে না বাপীদা, তুমি একবারটি এসে তাকে দেখে যাবে? গেলে দেখবে, আমি ফিরলে কিছু খেতে পাবে এই আশায় বসে আছে আর ছটফট করছে। তোমাকে দেখলে চিনতে পারবে না, কাউকে চিনতে পারে না…তবু আসবে একবারটি?
আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বাপী ওই মুখ ফালা ফালা করে দেখে নিচ্ছে। প্রাণের দায়ে এমন অভিনয়ও কারো দ্বারা সম্ভব? এ-রকম গাড়ির মালিক যাবে না বা যেতে পারে না ধরে নিয়ে করুণা উদ্রেক করে কিছু পাওয়ার চেষ্টা? কিন্তু এই দুটো চোখকে এত বড় ফাঁকিও কেউ দিতে পারে ভাবা যাচ্ছে না বলেই অস্বস্তি।
—এসো।
বাঁ-দিকের সামনের দরজাটা খুলে দিতে গিয়েও থমকালো। নিজের ভিতর থেকেই বাধা পড়ল। তার পাশে এই সীটে এতক্ষণ মিষ্টি বসে ছিল। পিছনের দরজাটা খুলে দিল।
কুমকুম তক্ষুনি উঠে বসল। বাপীর অস্বস্তি আরো বাড়ল। ওই মুখে এখনো ছলনা দেখছে না। ভয় দেখছে না। ক্ষুধার্ত আশা দেখছে। আকুতি দেখছে। বাপীর অস্বস্তি বাড়ছেই।
নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। বাপী সামনে। পিছনে কুমকুম। বাপী এখনো আশা করছে কোনো অজুহাতে কুমকুম গাড়ি থামাতে বলবে। নেমে যেতে চাইবে। ভিতরে যে কাটা-ছেঁড়া শুরু হয়েছে সেটা থামবে তাহলে। গাড়ি থামিয়ে বাপী তক্ষুনি ওকে নেমে যাওয়ার সুযোগ দেবে। এমন কি পকেটে যা আছে তাও ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। এমন নিষ্ঠুর বাস্তব থেকে ছলনা বরদাস্ত করাও সহজ।
দু’ মাইল রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি ধর্মতলায় এসে পড়ল। পিছনে কেউ আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। ঘাড় সরিয়ে রিয়ারভিউ গ্লাসে দেখতে চেষ্টা করল। তেমনি আশা ঠিকরনো অপলক দুটো চোখের ধাক্কায় বাপী মাথা সরিয়ে নিল। সামনে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, মাস্টারমশাই কলকাতায় আছেন তুমি জানলে কি করে?
পিছনে যে বসে তার গলার স্বরে এতটুকু উচ্ছ্বাস নেই। কি করে জেনেছে বাপী শুনল। শিলিগুড়িতে একটি বাঙালী ছেলের সঙ্গে খাতির হয়েছিল। সরকারী কাজে মাঝে মাঝে তাকে কলকাতা যাতায়াত করতে হত। কুমকুমকে সে চা—বাগানের এক নেশাখোর অত্যাচারী অফিসারের শিক্ষিতা বউ বলে জানত। খাতির কদর পেতে হলে এ-রকম মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হয়। কথায় কথায় কুমকুম একদিন তার আর্টিস্ট বাবার কিছু গল্প করেছিল। তার দু’দিন আগে সেই লোক কালকাতা থেকে ফিরেছে। বাবা আর্টিস্ট শুনে সে-ও কলকাতায় সদ্য দেখা ফুটপাথের এক তাজ্জব আর্টিস্টের কথা বলল। লোকটা বোধ হয় বদ্ধ পাগল। চুল-দাড়ির জঙ্গলের ভিতরে মুখের সামান্যই দেখা যায়, তবু দেখলে ভয় করে। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক-আশাকও তেমনি। খোলা ফুটপাথে বসে থাকে, আর যখন খেয়াল হয়, মস্ত একটা খড়ির ডেলা নিয়ে ফুটপাথে নানা রকমের ছবি আঁকতে থাকে। ফুটপাথের দশ-পনের হাত জুড়ে বড় বড় ছবি। সে-সব এত সুন্দর আর এত পরিষ্কার যে রাস্তার লোক ভিড় করে দেখতে দাঁড়িয়ে যায়। সেই সব তকতকে খাবারের ছবি দেখে লোকটার খিদে পেয়েছে ভেবে কেউ কেউ পয়সাও ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু লোকটা যখন মুখের দিকে তাকায় তখন ভয়ে ভয়ে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়।
শোনামাত্র কুমকুম বুঝেছিল তার বাবা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সেই থেকে তার কলকাতায় আসার তাড়না। সেই বাঙালী ছেলেকেই কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য ধরেছিল। সে কথাও দিয়েছিল পরের বারে যখন যাবে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই সে জেনে ফেলল ও চা-বাগানের কোনো অফিসারের শিক্ষিতা বউ-টউ কিছু নয়। যাদের ভোগের দাসী ছিল তাদেরই কেউ বলে দিয়ে থাকবে। তাই তার নেশা ছুটে গেল আর তাড়িয়েও দিল। তার পরেও কলকাতায় আসার জন্য পাগলের মতো হয়ে উঠেছিল। ট্রেনে চেপে একলাই কলকাতায় চলে আসতে পারত, কিন্তু সাহসে কুলোয় নি। এ-সব জায়গার মানুষই হাঙর এক—একটা, অসহায় একলা মেয়ে দেখলে কলকাতায় মানুষ ওকে জ্যান্ত ছিঁড়ে খাবে, তারপর রাস্তায় ফেলে দেবে সেই ভয়। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা দুই একটা মেয়ের মুখে কলকাতার মানুষদের যে গল্প শুনেছে, তাতে বুকের রক্ত আগেই হিম হয়ে ছিল। কিন্তু অনেকে আশা দেওয়া সত্ত্বেও লোক আর শেষ পর্যন্ত জুটলই না। মরীয়া হয়ে শেষে একলাই কলকাতায় চলে এলো। কলকাতায় হায়নারা যে দিনে-দুপুরে স্টেশনে রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকে জানত না। বাইরের গৃহস্থঘরের বউ অজানা অচেনা জায়গায় এসে পড়েছে বুঝে নিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই একজন তাকে আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়ে তুলে নিয়ে গেল—
বাপীর এই বিবরণ শোনার ইচ্ছে আর নেই। বলল, এ-সব কথা থাক, কলকাতায় এসেই তুমি মাস্টারমশায়ের দেখা পেয়ে গেলে?
—যেখানে গিয়ে পড়েছিলুম, এক মাসের মধ্যে সেখান থেকে বেরুতে পারি নি। শেষে সেখানকার সর্বেসর্বা মাসি যখন বুঝল কোথাও পালাবার মতো আশ্রয় আর নেই, তখন কড়াকড়ি গেল। সেই বাঙালী লোকটা বাবাকে কোন্ রাস্তার ফুটপাথে দেখেছিল জানতাম। সেই এলাকা ধরে খোঁজাখুঁজি করতে এক জায়গায় পেয়ে গেলাম। কি যে দেখলাম, আর দেখা না হলেই ভালো ছিল বাপীদা।
আশ্চর্য! এই মেয়ের এখনো চোখে জল আসে, কান্নায় গলা বুজে যায়। সেই পাওয়ার চিত্রটাও বাপী শুনল।…এক জায়গায় অনেক লোক ভিড় করে আছে। তাদের মুখ দেখেই বোঝা গেছে সেখানে অশুভ কিছু হয়েছে। কাছে গিয়ে কুমু যা দেখল, বুক শুকিয়ে কাঠ। ফুটপাথে সারি সারি আঁকা খাবারের ওপর মুখ থুবড়ে পাগলের মতো একটা লোক পড়ে আছে। প্রাণ আছে কি নেই বোঝা যায় না। মুখের ওপর মাছি ভন ভন করছে। রাস্তার লোকেরাই কর্পোরেশানের গাড়ি ডেকেছিল। একটু বাদে সেই গাড়ি ফুটপাথের আর্টিস্টকে তুলে নিয়ে গেল। তাদের হাতে পায়ে ধরে কুমকুমও সঙ্গে গেল। চার-পাঁচ দিন বাদে বাবাকে তারা ছেড়ে ছিল। কুমকুমকে বলল, করার কিছুই নেই, শিগগীরই মরে যাবে—যে কদিন টেঁকে ভালো-মন্দ খেতে দাও।
এই বোঝা দেখে ওদের মুরুব্বী মাসি শুধু ওকে ছেড়ে দিল না, দয়া করে মাসে চার টাকা ভাড়ায় একটা ঘরও যোগাড় করে দিল। আজ দেড় মাসের ওপর হয়ে গেল, বাবা এখনো বেঁচেই আছে। ওকেও সব সময় চিনতে পারে না—খুব যখন খিদে পায় তখন চিনতে পারে।
…বাপী এবার কি করবে। গাড়ি থামিয়ে কুমকুমকে টেনে হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে? তারপর পকেটে যা আছে-ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজে পালিয়ে বাঁচবে?
কুমকুমের নিশানা মতো গাড়ি বড়রাস্তা ছেড়ে দু’তিনটে আঁকা-বাঁকা গলি পেরিয়ে একেবারে একটা ঘুটঘুটি অন্ধকার সরু গলির মুখে এসে দাঁড়াল। ওখানে গাড়ি ঢুকবে না। ওই গলির মধ্যে ঘর।
গাড়ি লক করে, অন্ধকারে পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেতে খেতে কুমকুমের পিছনে একটা টালির খুপরির সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে টিমটিম হারিকেন জ্বলছে। মেঝেতে হাড় চামড়া সার একটা বুড়ী বসে। তার সামনে দড়ির খাটিয়ায় আর একটা লোক আধ-বসা। গায়ে মোটা শতেক ফুটোর কম্বল, শনের মতো চুল-দাড়ির বোঝা পিঠ আর বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। কাঠামো দেখে এখনো বোঝা যায় এককালে বেশ লম্বা চওড়া ছিল মানুষটা। হারিকেনের অল্প আলোয় ঘুরে তাকাতে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল বাপীর।
কুমকুমের অনুপস্থিতিতে বুড়ীটার হয়তো তাকে আগলানোর ভার। হাতে ভর করে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাছের মতো ঘোলাটে দুই চোখ একবার বাপীর মুখের ওপর বুলিয়ে কুমকুমের দিকে চেয়ে খনখনে চাপা গলায় বলে উঠল, একটামাত্র ঘরে আবার কাকে এনে হাজির করলি, আমি এখন আমার ঘরে একটু না শুয়ে পারব না—
বাপীর দু’কান গরম। আরো চাপা গলায় কুমকুম তাকে ধমকে উঠল, আঃ! তুমি তোমার ঘরে চলে যাও!
খাটিয়ার দিকে এগিয়ে স্বর চড়িয়ে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, বাবা—কে এসেছে তোমাকে দেখতে, চিনতে পারছ? তোমার সেই আদরের ছাত্র বাপীদা—জলপাইগুড়িতে আমাদের বাড়িতে আসত— পরে অনেক দিন তোমরা একসঙ্গে সেই বাড়িতে ছিলে—মনে আছে? চিনতে পারছ?
গর্তের ভেতর থেকে দুটো চোখ বাপীর দিকে ঘুরল। দৃষ্টি নয়, মুখের ওপর একটা অস্বাভাবিক ক্ষুধার্ত ঝাপটা এসে লাগল। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে বাপীকেই মুখ ফেরাতে হত। একটু বাদেই সেই দৃষ্টি মেয়ের দিকে ঘুরল। ক্রুদ্ধ ফ্যাসফেসে গলায় ধমকে উঠলেন, কাকে চিনব—তুই কে?
মেয়ে নির্ভয়ে আরো কাছে গিয়ে জট-বোঝাই মাথায় হাত রাখল।—এই দেখো, এর মধ্যে নিজের মেয়েকেও ভুলে গেলে? আমি কুমু! চিনেছ?
চিনলেন হয়তো। কারণ রাগে আরো বেশি গরগর করতে করতে বললেন, খিদেয় নাড়ি জ্বলছে ও এলো এখন আমাকে লোক চেনাতে—কি খেতে দিবি?
বাবার মাথার ওপর থেকে হাতটা খসে পড়ল। বিব্রত, বিবর্ণ মুখ। এই যোগাযোগের উত্তেজনায় ঘরে ফেরার আসল সমস্যা ভুলে গেছিল। হালছাড়া অসহায় চোখে বাপীর দিকে তাকালো।
চোখের কোণ দুটো অদ্ভুত দাপাদাপি করছে বাপীর। সামান্য মাথা নেড়ে ওকে কাছে ডাকল। পকেট থেকে পার্স বার করে তিনটে দশ টাকার নোট তার হাতে দিল। বিড়বিড় করে বলল, আমি এদিকের কিছু চিনি না, তুমি নিয়ে এসো…আমি অপেক্ষা করছি।
তিরিশ টাকা হাতে পেয়ে কুমকুমের দ্বিধা। অস্ফুট স্বরে বলল, এত কি হবে… এবারে বাপীরও ধমকে উঠতে ইচ্ছে করল তাকে। তাড়াতাড়ি খাটিয়ার দিকে ফিরে কুমকুম বলল, এক্ষুনি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি বাবা—তুমি ঠাণ্ডা হয়ে থাকো—
চোখের পলকে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল। ললিত ভড় গায়ের কম্বলটা ভালো করে টেনে সোজা সামনের দিকে চেয়ে আবার আধ শোয়া হলেন। হয়তো কথা বলার মেজাজ বা অভিরুচি নেই। হয়তো বা ঘরে আর কেউ আছে ভুলেই গেছেন।
ভদ্রলোক গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে আছেন, বাপী দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে। শার্টের তলায় গেঞ্জিটা সপসপে ভিজে। গুমোটে দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরের এই বাতাস শ্বাস-যন্ত্রটা টানতে পারছে না। বুকের ভিতরেও একটা চাপা যন্ত্রণা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওই খাটিয়ার দিকে চেয়ে আছে। মানুষের বেঁচে থাকার ও কি দুর্জয় শক্তি—দেখছে। নিজেদের খাওয়া জোটে না, তবু এই লোক স্ত্রীর বাক্স থেকে দশ টাকা চুরি করে দুর্ভিক্ষের ফান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল। …জেল থেকে ফিরে আসার পর বাপী তাঁর সঙ্গে তাঁরই ঘরে দেড় মাস কাটিয়েছিল। তখন নিজে হাতে ওকে রান্না শিখিয়েছে, যোগব্যায়াম শিখিয়েছে। তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছে তবু কারো বিরুদ্ধে একটা অভিযোগের কথা শোনে নি। একমাত্র অভিযোগ ছিল শাসন-যন্ত্রের বিরুদ্ধে, আর মানুষের বে-সামাল লোভের বিরুদ্ধে।
বাপীর এখনো ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। সব-কিছু দুঃস্বপ্ন ভাবার মতো অনেক দূরে কোথাও। পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে আছে তাই পারছে না। সারি সারি সেই সব স্মৃতির মিছিলে আগুন ধরিয়ে ছাই করে দিতেও পারছে না।
কুমু ফিরে এলো। হাতে বড় একটা শালপাতার ঠোঙা আর একটা মাঝারি সাইজের ভাঁড়। দরজার কাছে আবছা অন্ধকারে বাপীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো একটু। তারপর ত্রস্তে ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের কোণে ঠোঙা আর ভাঁড় রেখে বাবার খাটিয়ার পায়ের দিক থেকে বিবর্ণ তেলচিটে একটা মোড়া এনে বাপীর সামনে পেতে দিল। এ-রকম ভুলের অপরাধটুকু শুধু চোখেই ব্যক্ত করল, মুখে কিছু বলল না।
বাপী আপাতত স্থানকাল ভুলেছে। ওকেই একটু খুশি করার তাগিদে মোড়াটা দরজার কাছে টেনে নিয়ে বসল। একটা কলাই-করা বাসনে কুমু বাবার খাবার সাজালো। কচুরি তরকারি ডাল। থালাটা বাবার সামনে ধরে বলল, খেয়ে নাও।
খাওয়ার নামে শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে বসলেন মানুষটা। গায়ের কম্বল খসে পড়ল। ব্যগ্র দু’হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত থেকে থালাটা ছিনিয়ে নিলেন। ঝুঁকে দেখলেন কি দেওয়া হয়েছে। দাড়ির খানিকটা খাবারের ওপর এসে পড়ল।
সেই খাওয়া দেখেও মাথাটা ঝিকঝিম করছে বাপীর। আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে কুমকুম ইচ্ছে করেই ও-দিকে ফিরে আছে। খেতে খেতে ললিত ভড় একবার মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে বাপীর দিকে। খাওয়ার আনন্দে গর্তের দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে।
বাপী পাথরের মূর্তির মতো বসে। …শহরের হাঙ্গামার রাতেও মেয়ে এই বাপকে ফেলে চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে খদ্দের ধরতে গেছিল। কারো মত্ত ভোগের মাশুল আদায় হলে তবে বাবার খাবার আসবে। সেই খদ্দেরও আজ জোটে নি। বাপীর সঙ্গে আজ দেখা না হলে জঠরের এই খিদে নিয়ে মানুষটার রাত ভোর হত।
থালা খালি। কুমু জিজ্ঞাসা করল, আর দেব?
ব্যগ্র দু’চোখ. মেয়ের মুখের ওপর। কিন্তু একটু বাদে তাঁর গলার স্বরে হঠাৎ জলপাইগুড়ির সেই মানুষটাকেই সামনে দেখল বাপী।—তোমাদের আছে?
—অনেক আছে। কুমু আর দুটো কচুরি আর একটু তরকারী তাঁর থালায় এনে দিল। বলল, বেশি সহ্য হবে না, এর পর মিষ্টি আছে।
‘মিষ্টি’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর চোখের সামনে হঠাৎ মিষ্টির মুখ। কিন্তু ও চেয়ে আছে ললিত ভড়ের দিকে। ‘মিষ্টি’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখের ভাষাও অবর্ণনীয়। দুই-ই লোভ। কত তফাৎ অথচ কত অমোঘ।
খাওয়া হতে কুমু নিজের হাতে তাঁকে জল খাওয়ালো। দাড়ি-ভরতি মুখ মুছিয়ে দিল। একটা গুমরনো যন্ত্রণায় বাপীর শব্দ করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল। দুনিয়ার লোককে চিৎকার করে ডেকে বলতে ইচ্ছে করল, একটা ঘৃণ্য অসতী মেয়ে দেখে যাও তোমরা!
জলের গেলাস হাতে ভিতরের একটা চাপা তাগিদে কুমকুম বলে উঠল, এবারে বাপীদাকে একটু ভালো করে দেখো বাবা—চিনতে চেষ্টা করো— জলপাইগুড়ি থাকতে কত ভালবাসতে বাপীদাকে তুমি—বাপীদাই তো আজ তোমাকে খাওয়ালো!
জবাবে ঘাড় ফিরিয়ে ললিত ভড় একবার দেখলেন। কোটরগত দু’চোখের একটা ঝাপটা মেরে ঘর থেকে বিদায় করতে চাইলেন ওকে। তারপর আবার মেয়ের দিকে ফিরে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, দূর হ’, দূর হ’, এখান থেকে— আমি কাউক্কে চিনি না, কাউকে চিনতে চাই না—তুই আসিস কেন এখানে? কি চাস? আমাকে খাবি? খাবি? খাবি?
মোড়া ছেড়ে বাপী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। গাড়িতে কুমকুম বাড়িয়ে বলেনি। পেট ভরেছে। এখন তাঁর চোখে নিজের মেয়েও অচেনা।
চোখের ইশারায় ওকে ডেকে বাপী বাইরে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের টিমটিমে হারিকেনটা তুলে নিয়ে কুমু তক্ষুনি এগিয়ে এলো। ঘর এখন অন্ধকার কিন্তু সেজন্য ভিতরের মানুষের কোন রকম আপত্তির আভাস পেল না বাপী।
নিজের পকেটে হাত ঢোকালো। কিন্তু আশপাশের খুপরিগুলো থেকে কারো উকিঝুঁকি দেবার সম্ভাবনা মনে আসতে তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিল। আগে গলির বাইরে আসার তাড়া। অস্ফুট স্বরে বলল, এসো আমার সঙ্গে—
গলির মুখে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পার্স থেকে দু’টো একশ’ টাকার নোট বার করে বলল, এই টাকা এখন তোমার কাছে রাখো—
একসঙ্গে দু’শ টাকা মেয়েটার কাছে অভাবনীয় ব্যাপার কিছু। হাত বাড়ালো না। শুধু চেয়ে রইল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে অল্প অল্প।
অসহিষ্ণু বিরক্তিতে বাপী ধমকের সুরে বলল, ধরো! ওর এক হাতে হারিকেন। অন্য হাত তুলে বাপী নিজেই টাকাটা ধরিয়ে দিল। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে শাসনের সুরে হুকুম করল, বাবাকে ফেলে আর তুমি ঘর ছেড়ে বেরুবে না…আমি কাল ঠিক কখন আসতে পারব বলতে পারছি না।
গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে বেরিয়ে গেল। মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই খচখচ করছে। সে না হয় ফ্ল্যাটে গিয়েই মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দিয়ে গা জুড়বে। এখানে যাদের দেখে গেল তারা কি করবে।
পরদিন জিত্ মালহোত্রা একটু সকাল-সকাল এসে হাজির। শহরে কখন আবার হাঙ্গামা বেধে যায় ঠিক নেই। আগে এসে যতটা সম্ভব কাজ সারার তাগিদ। বাপীও তার প্রতীক্ষায় ছিল। দেরাজ খুলে একগোছা টাকা বার করে পকেটে পুরল। তারপর ওকে সঙ্গে করে নিচে নেমে গাড়িতে উঠল।
এন্টালি এলাকারই ভদ্র জায়গায় মোটামুটি পছন্দসই একটা ফ্ল্যাট ঠিক করতে ঘণ্টা আড়াই সময় লেগে গেল। একতলায় ছোট-বড় ছিমছাম দুটো ঘর। বাড়িঅলা দোতলায় থাকে। আলাদা ব্যবস্থা। মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া, ছমাসের ভাড়া আগাম। টাকা গুনে দিয়ে আর রসিদ নিয়ে বাপী বাড়িঅলাকে জানালো, আজই ঘণ্টা-কতকের মধ্যে থাকার লোক এসে যাবে, এর মধ্যে একটু ঝাড়ামোছা করিয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়।
জিতকে সেখানে রেখে এর পর কাছাকাছির একটা ফার্নিচারের দোকানে ঢুকল। ম্যাট্রেসসুদ্ধ রেডিমেড ছোট ছোট দুটো খাট কিনল। একটা ড্রেসিং টেবিল আর আলনাও। ঠিকানা লিখে কুলি দিয়ে সেগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করে সেখান থেকে সাইন বোর্ড দেখে দেখে একটা বেডিং স্টোরস-এ ঢুকল। বিছানা বালিশ তোষক চাদর ওয়াড় সব এক জায়গাতেই পেয়ে গেল। সেসবও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গায় পৌঁছুনোর নির্দেশ দিয়ে বড় রকমের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
অভ্যস্ত না হলেও পকেটে টাকার জোর থাকলে কলকাতা শহরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র যোগাড় করে দুটো ঘর বাসযোগ্য করে তোলা খুব কঠিন কিছু নয়। বাপীও পেরেছে। কিন্তু ভিতরের তৃপ্তিটুকুর স্বাদ আলাদা। জিত্ মালহোত্রা মুখ বুজে তাকে সাহায্য করেছে। মালিকটির মেজাজ জানে বলেই এতক্ষণ একটি কথাও জিজ্ঞাসা করে নি। এমন কে আসছে এখানে যার জন্য মনিবের এত দরদ, সে কৌতূহল ছিলই। বেলা প্রায় একটার সময় বাপী তাকে ছুটি দিয়ে চলে যেতে বলতে জিজ্ঞাসা করল, কে আসছেন এখানে…আপনারজন কেউ?
বাপী গম্ভীর। বুড়ো আঙুলটা নিজের বুকে ছুঁইয়ে জবাব দিল, একেবারে এখানকার। কাছাকাছির হোটেলে খাওয়া সারার ফাঁকে আর একটা সমস্যা মনে এলো। যে মূর্তি হয়েছে মাস্টারমশাইয়ের, দেখে সকলেই আঁতকে উঠবে। চুল—দাড়ির ওপর আপাতত হাত নেই। হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে মাঝারি সাইজের একটা সুটকেস কিনল। তারপর রেডিমেড জামা-কাপড়ের দোকান থেকে সব চেয়ে বড় সাইজের দুজোড়া টুইলের সার্ট আর দু’জোড়া পাজামা কিনে ফেলল। শরীরে কিছু নেই, কিন্তু দেহের খাঁচাটা কম নয়। জলপাইগুড়িতে টুইলের শার্টই পরতে দেখত ভদ্রলোককে।
বেলা আড়াইটে তিনটে নাগাদ গলির সেই খুপরি থেকে মাস্টারমশাই আর কুমুকে নিজের গাড়িতে তুলে নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। ললিত ভড়ের বেশবাস শুধু বদলেছে। আচরণে রকম-ফের নেই। কোটরের দু’চোখ ঘর দুটোর ওপর ঘোরাফেরা করে বাপীর মুখের ওপর এসে থেমেছে, তারপর আরো উষ্ণ হয়ে মেয়ের দিকে ফিরেছে। বিড়বিড় করে বলেছেন, খেতে দে, খিদে পেয়েছে।
পরের পাঁচ-ছ’টা দিনও বাপীর এক রকম ঝোঁকের ওপর কেটে গেল। ওপরতলার বয়স্ক বাড়িঅলা লোকটি ভদ্র। তার সঙ্গে আলাপ করে বাপী একজন বড় ডাক্তারের হদিস পেয়ে তাঁকে ধরে এনেছে। কদিনের মধ্যে যাবতীয় পরীক্ষা—নিরীক্ষার পর তিনি জানিয়েছেন রোগীর বাঁচার কোনো আশা নেই। বুক ঝাঁঝরা, পেটে ঘা, মাত্রাতিরিক্ত রক্তাল্পতা—বেঁচে আছেন কি করে সেটাই আশ্চর্য। তবু যতদিন বাঁচেন…। লম্বা ওষুধপত্রের ফিরিস্তি দিয়ে যতটা সম্ভব কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করে গেলেন তিনি। যখন তখন রাজ্যের খিদে ছাড়া আর কি যে কষ্ট মাস্টারমশায়ের বাপী ভেবে পায় না।
ওপরতলার ভদ্রলোক তাঁর চাকরকে বলে একটা বাচ্চা চাকর যোগাড় করে দিয়েছেন। কুমকুমকে সাত কথা জিজ্ঞাসা করলে সহজে একটার জবাব দেয় না। মুখের দিকে চেয়ে থাকে শুধু। পরিষ্কার আটপৌরে জামা-কাপড়ে এখন বেশ সুশ্রীই দেখায় মেয়েটাকে। প্রসাধনের প্রলেপ না থাকতে আরো ভালো লাগে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে না পেয়ে ওই রকম করে চেয়ে থাকে যখন, তখন মুশকিল হয়। মেয়েটার চোখের তারায় কতকালের কান্না জমে আছে ঠিক নেই। বাপীর ভয়, কখন না ভেঙে পড়ে। ও কাঁদতে জানে না, কান্নাকাটি দেখতেও পারে না। তাই ছোকরা চাকরটার সঙ্গেই পরামর্শ করে ওই ছোট্ট সংসারের যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হয়েছে তাকে। চাল ডাল তেল নুন চিনি কেরোসিন, ঝাঁটা মশলাপাতি স্টোভ বালতি মগ হাঁড়ি কড়া সসপ্যান চায়ের কেটলি পেয়ালা প্লেট খাবার ডিশ বাটি— দুজনের একটা সংসার চালাতে এমন আরো কত কি যে লাগে বাপীর ধারণা ছিল না। চাকরটা এসে দফায় দফায় ফিরিস্তি দেয়, অমুক অমুক জিনিস চাই। কুমকুম সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বাপী তক্ষুনি গাড়ি নিয়ে ছোটে। বাপকে ছেড়ে মেয়ে এক ঘণ্টার জন্যেও বাইরে যাক চায় না। কিন্তু নিজের ওদিকে হাঁপ ধরার দাখিল। তবু বাপীর ভিতরের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য রকমের আনন্দের উৎসও খুলে গেছে। এক খাওয়া ভিন্ন আর সব-কিছুর ওপর বীতশ্রদ্ধ এবং ক্রুদ্ধ ওই বিদায়ী মানুষটার জন্য যেটুকু করতে পারছে তাই যেন ওরই পরম ভাগ্য
বাপীর হুকুমমতো মাস্টারমশাইয়ের চুল-দাড়ির জঙ্গল পরামাণিক ডাকিয়ে কুমু কিছুটা সাফ করতে পেরেছে। সবটা পারে নি। এটুকু করতেই নাকি ক্ষেপে গেছিল। পারে তো দু-জনকেই মারে আর কুমু হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে। সব দাড়ি কামিয়ে ফেললে চামড়ার ওপর হাড় উঁচিয়ে উঠবে। একমুখ দাড়ির জঙ্গল জলপাইগুড়ি থাকতেও বাপী অনেক সময় দেখেছে। এটুকু সংস্কারের ফলে এখন সেই মানুষের কিছুটা আদল এসেছে।
ফাঁক পেলে বাপী দু’বেলাই আসছে। সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে এসে দেখে মাস্টারমশাই ঘরে একলা খাটের ওপর বসে আছেন। কুমকুম ঘরে নেই। বাড়িতেও না। সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ুগুলো টান-টান বাপীর। কখন কিজন্যে দরকার হয় ভেবে আরো অনেক টাকাই ওই মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়েছে। টাকার অভাবে বাপকে ফেলে বেরুতে হয়েছে এমন হতে পারে না। ওর কড়া নিষেধ সত্ত্বেও নেই কেন? এদিক—ওদিক চেয়েও বাচ্চা চাকরটাকেও না দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।
মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করল, কুমু কোথায়? আপনি একলা কেন?
কথা জিজ্ঞাসা করলে রোজ যা করেন ভদ্রলোক আজও তাই করলেন। গর্তে—ঢোকা দুই চোখের একটা ঝাপটা মেরে অন্য দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
বাপী তবু অসহিষ্ণু।—আপনাকে বলে কোথাও গেছে না এমনি চলে গেছে? মুখ না ফিরিয়ে রাগে গজগজ করে উঠলেন—ওষুধ আনতে গেছে, খিদে পেয়েছে খেতে দেবার নাম নেই—আমাকে ওষুধ গেলাবে!
বাপী নিজের কাছেই অপ্রস্তুত একটু। যার মনে চোর সে-ই অন্যের মধ্যে চোর দেখে। দরকারে বেরুতে পারে সেটা না ভেবে প্রথমেই সন্দেহ। একটা মোড়া টেনে কাছাকাছি বসল। ভদ্রলোক এখনো তাকে চেনে না বা পছন্দ করে না। পছন্দ অবশ্য কাউকেই করে না, খিদের তাগিদ ভিন্ন নিজের মেয়েকেও চেনে না। কাছাকাছি বসার দরুন বিরক্ত মুখে ভদ্রলোক আরো একটু ঘুরে বসলেন।
মানুষটা বেশি দিন নেই আর জানা কথাই। ঘরে তাঁকে একলা পেয়ে একটা চাপা আবেগ ভেতর থেকে ঠেলে উঠলে। বলল, আচ্ছা মাস্টারমশায়—
কানে ঢুকল না। অন্য দিকেই মুখ ফিরিয়ে আছেন।
—মাস্টারমশাই! আমি আপনাকে ডাকছি—এদিকে ফিরুন না, দেখুন না আমাকে চিনতে পারেন কি না?
এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ওর দিকে। কোটরের চোখে রাগের ঝাপটা— কে তোমার মাস্টারমশাই?
—আপনি। আমি বাপী—বানারহাট স্কুলে আপনি আমাদের ড্রইং করাতেন, জলপাইগুড়িতে আপনার বাড়িতে আপনার কাছে আমি থেকেছি—কত গল্প করেছি—আপনি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন, যোগ-ব্যায়াম শিখিয়েছেন—আপনার কিচ্ছু মনে পড়ে না?
গর্তে-ঢোকা দুটো চোখ অস্বাভাবিক চিকচিক করছে। রাগে কিনা বাপী বুঝছে না। সাগ্রহে আবার বলল, আপনি কত গল্প করতেন, যুদ্ধের গল্প দুর্ভিক্ষের গল্প— আর কত সুন্দর সুন্দর শ্লোক শোনাতেন—আপনি বলতেন, “দারিদ্র্যে দোষো গুণরাশিনাশী’—বলতেন, স্বদেশের ঠাকুর বিদেশের কুকুর—মনে আছে?
হঠাৎ বুকের তলায় একটা মোচড় পড়ল বাপীর। মনে হল মানুষটার কোটরগত ওই চকচকে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। তার দিকেই চেয়ে আছে। বাপী কি ঠিক দেখছে? ব্যগ্র মুখে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, মনে পড়ছে মাস্টারমশাই—আমাকে চিনতে পারছেন?
এবারে বিড়বিড় করে যে জবাব দিলেন, শুনে বাপীরই রোমে রোমে কাঁটা দিয়ে উঠল।—সব মনে আছে…চিনতেও সব সময়েই পারি…কিন্তু মনে পড়ে কি লাভ…চিনে কি লাভ…কুমুর অসুবিধে, আমারও অসুবিধে…আবার হয়তো আমাকে ফেলে সব পালাবে…কুমুকে বলিস না।
নিজের অগোচরে বাপী ছিটকে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁর সামনে তাঁর খাটে এসে বসেছে। ও কত বড় হয়েছে এখন এই মুহূর্তে অন্তত মনে নেই। জোরে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না মাস্টারমশাই না—আপনার কোনো ভয় নেই। আপনি যতকাল বাঁচবেন আপনার সব ভার আমার—এই আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, আমাকে বিশ্বাস করুন!
বিশ্বাস যে করলেন, অনুভব করতে একটুও সময় লাগল না। গর্তের দু’চোখ জলে ভরে গেছে। দাড়ি-ছাওয়া মুখে হাসি। দেখছেন। নির্নিমেষে চেয়ে আছেন। বললেন, জেল-ফেরত তোর সঙ্গে দেখা হতে ডিস্টিংশনে বি-এস-সি পাশের কথা বলে তুই আমাকে মিষ্টির দোকানে টেনে নিয়ে গিয়ে খুব খাইয়েছিলি, আর আমি তোকে বলেছিলাম বড় নরম মন তোর, তোর কিসু হবে না—মনে আছে?…এখনো এই মন তোর, এত হল কি করে রে!
বাপী চেষ্টা করছে হাসতে। চেষ্টা করছে কিছু বলতে। কোনোটাই পারছে না।
ওষুধের প্যাকেট হাতে কুমকুম ফিরল। এক খাটে দু’জনকে এমন ঘন হয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক।
বাপী খাট ছেড়ে উঠে পড়ল। কুমকুমকে বলল, মাস্টারমশাই আমাকে চিনতে পেরেছেন, সব মনেও পড়েছে! আর ভুল হবে না কথা দিয়েছেন—কিন্তু আমাদের যেন আর এতটুকু ভুল না হয়—বুঝলে?
অপ্রত্যাশিত খুশির ধাক্কায় কুমকুম তাড়াতাড়ি বাবার দিকে তাকালো। তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। গলার কাছে কি দলা পাকিয়ে আছে বাপীর। সেটা আনন্দের কি যন্ত্রণার জানে না। ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা পা ফেলে গাড়িতে এসে উঠল।