যোধপুর থেকে পোকরান
যোধপুর থেকে পোকরান প্রায় একশো কুড়ি মাইল রাস্তা। সেখান থেকে জয়সলমীর আবার সত্তর মাইল। সবসুদ্ধ এই দুশো মাইল যেতে আন্দাজ সাড়ে ছ সাত ঘণ্টা লাগা উচিত। অন্তত আমাদের ড্রাইভার গুরুবচন সিং তাই বলল। বেশ গোলগাল হাসিখুশি শিখ ড্রাইভারটিকে লক্ষ করছিলাম মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে মাথার পিছনে দিয়ে শরীরটা পিছন দিকে হেলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। গাড়ি অবশ্য তখনও চলছে, আর স্টিয়ারিং ঘোরানোর কাজটা সেরে নিচ্ছে ভূড়িটাকে এগিয়ে দিয়ে। কাজটা অবিশ্যি শুনতে যত কঠিন মনে হয় ততটা নয়, কারণ প্রথমত গাড়ি চলাচল এ রাস্তায় প্রায় নেই বললেই চলে, আর দ্বিতীয়ত পাঁচ ছ মাইল ধরে একটানা সাজা রাস্তা এর মধ্যে অনেকবারই লক্ষ করলাম। পথে কোনও গোলমাল না হলে মনে হয় সন্ধ্যা ছটা নাগাদ জয়সলমীর পৌঁছে যাক।
যোধপুর ছাড়িয়ে মাইল দশেক পর থেকেই এমন সব দৃশ্য আরম্ভ হয়েছে, যেমন আমি এর আগে কখনও দেখিনি। যোধপুরের আশেপাশে অনেক পাহাড় আছে, যে সব পাহাড়ের লালচে রঙের পাথর দিয়েই যোধপুরের কেল্লা তৈরি। কিন্তু কিছুক্ষণ থেকেই মনে হচ্ছে যেন পাহাড় ফুরিয়ে গেছে। তার বদলে আরম্ভ হয়েছে দিগন্ত অবধি গড়িয়ে যাওয়া ঢেউ খেলানো জমি। এই জমির কিছুটা ঘাস, কিছুটা লালচে মাটি, কিছুটা বালি আর কিছুটা কাঁকর। সাধারণ গাছপালাও ক্রমশ কমে গিয়ে তার বদলে চোখে পড়ছে। বাবলা গাছ, আর নাম-না-জানা সব কাঁটা গাছ আর কাঁটা ঝোপ।
আর দেখছি। বুনো উট। গোরু, ছাগলের মতো উট চরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে। তার কোনওটার রং দুধ-দেওয়া চায়ের মতো, আর কোনওটা আবার ব্ল্যাক কফির কাছাকাছি। একটা উটকে দেখলাম। ওই শুকনো কাঁটা গাছই চিবিয়ে খাচ্ছে। ফেলুদা বলল, কাঁটা গাছ খেয়ে নাকি অনেক সময় ওদের মুখের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কিন্তু এ সব অঞ্চলে এটাই ওদের খাদ্য বলে ওরা নাকি সেটা গ্রাহ্যই করে না।
জয়সলমীরের কথাও ফেলুদা বলছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই শহর নাকি ভাটি রাজপুতদের রাজধানী ছিল। ওখান থেকে মাত্র চৌষট্টি মাইল দূরে পাকিস্তানের বন্ডার। দশ বছর আগেও নাকি জয়সলমীরে যাওয়া খুব মুশকিল ছিল। ট্রেন তো ছিলই না, রাস্তাও যা ছিল, তা অনেক সময়ই বালিতে ঢাকা পড়ে হারিয়ে যেত। জায়গাটা নাকি এত শুকনো যে ওখানে বছরে একদিন বৃষ্টি হলেও লোকেরা সেটাকে সৌভাগ্য বলে মনে করে। যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বলল যে আলাউদ্দীন খিলজি নাকি একবার জয়সলমীর আক্রমণ করেছিল।
নব্বই কিলোমিটার বা ছাপন্ন মাইলের কাছাকাছি এসে হঠাৎ আমাদের ট্যাক্সির একটি টায়ার পাংচার হয়ে গাড়িটা একটা বিশ্ৰী শব্দ করে রাস্তার একপাশে কেতরে থেমে গেল। গুরুবচন সিং-এর উপর মনে মনে বেশ রাগ হল। ও বলেছিল টায়ার চেক করে নিয়েছে, হাওয়া দেখে নিয়েছে ইত্যাদি। সত্যি বলতে কী, গাড়িটা বেশ নতুনই।
সদরজির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাইরে বেরেলাম। টায়ার চেঞ্জ করার হ্যাঁঙ্গাম আছে, অস্তুত পনেরো মিনিটের ধাক্কা।
চ্যাপটা টায়ারের দিকে চোখ যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পাংচারের কারণটা বুঝতে পারলাম।
রাস্তার অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে অজস্র পেরেক। সেগুলো দেখেই বোঝা যায় যে, সদ্য কেনা হয়েছে।
আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সিং সাহেব দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা কথা বলল, যেটা অবিশ্যি বইয়ে লেখা যায় না। ফেলুদা কিছুই বলল না, শুধু কোমরে হাত দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল। লালমোহনবাবু একটা পুরনো জাপান এয়ার লাইনসের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি ধরনের সবুজ খাতা বার করে তাতে খসখস করে পেনসিল দিয়ে কী জানি লিখলেন।
নতুন টায়ার পরিয়ে, ফেলুদার কথামত্তো রাস্তা থেকে পেরেক সরিয়ে, যখন আবার রওনা হচ্ছি, তখন ঘড়িতে পীনে দুটো। ফেলুদা ড্রাইভারকে বলল—একটু রাস্তার দিকে নজর রেখে চালাবেন সদরেজি-আমাদের পেছনে যে দুশমন লেগেছে সে তো বুঝতেই পারছেন।
এদিকে বেশি আস্তে গেলে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে, কাজেই গুরুবচন সিং ষাট থেকে নামিয়ে চল্লিশে রাখলেন স্পিডোমিটার। সত্যি বলতে কী, রাস্তার উপর চোখ রাখতে গেলে ঘণ্টায় দশ-পনেরো মাইলের বেশি স্পিড তোলা চলে না।
প্রায় একশো ষাট কিলোমিটার অর্থাৎ একশো মাইলের কাছাকাছি এসে সর্বনাশটা আর এড়ানো গেল না।
এবার কিন্তু পেরেক না, এবার পিতলের বোর্ড পিন। আন্দাজে মনে হয় প্রায় হাজার দশোক পিন বিশ-পঁচিশ হাত জায়গা জুড়ে ছড়ানো রয়েছে। বুঝতেই পারলাম যে, টায়ার ফাঁসি নেওয়ালারা কোনও রিস্ক নিতে চাননি।
আর এটাও জানি, গুরুবচন সিং-এর ক্যারিয়ারে আর স্পেয়ার নেই।
চারজনেই আবার গাড়ি থেকে নামলাম। সিং সাহেবের স্বভাব দেখে মনে হল, মাথায় পাগড়ি না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই মাথা চুলকোতেন।
ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, পোকরান টাউন হ্যাঁয় ইয়া গাঁও হ্যাঁয়?
টাউন হ্যাঁয় বাবু।
কিতনা দূর ইঁহাসে?
পঁচিশ মিল হোগা।
সর্বনাশ!…তব্ আভি হোগা কেয়া?
গুরুবচন বুঝিয়ে দিল যে, এ লাইনে যে ট্যাক্সিই যাক না কেন, সেটা তার চেনা হবেই। এখানে অপেক্ষা করে যদি সেরকম ট্যাক্সি একটা ধরা যায়, তা হলে তাদের কাছ থেকে স্পেয়ার চেয়ে নিয়ে তারপর পোকরানে গিয়ে পাংচার সারিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সে রকম ট্যাক্সি যাবে কি না, আর গেলেও, সেটা কখন যাবে! কতক্ষণ আমাদের এই ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!
পাঁচটা উট আর তার সঙ্গে তিনটি লোকের একটা দল আমাদের পাশ দিয়ে যোধপুরের দিকে চলে গেল। লোকগুলোর প্রত্যেকটার রং একেবারে মিশকালো। তার মধ্যে আবার একজনের ধবধবে সাদা দাড়ি আর গালপাট্টা। তারা আমাদের দিকে দেখতে দেখতে চলেছে। দেখেই বোধহয় লালমোহনবাবু একটু ফেলুদার দিক ঘেঁষে দাঁড়ালেন।
সব্সে নজ্দিক কোন্ রেল স্টেশন হ্যাঁয়? ফেলুদা বার্ড পিন তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল। আমরাও অন্য গাড়ির কথা ভেবে এই সৎকাৰ্যটায় হাত লাগিয়েছিলাম।
সাত-আট মিল হোগা রামদেওরা।
রামদেওরা…
রাস্তা থেকে বোর্ড পিন সরানো হলে পর, ফেলুদা তার ঝোলা থেকে ব্র্যাড্শ টাইম টেবল বার করল। একটা বিশেষ পাতা ভাঁজ করা ছিল, সেখানটা খুলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, লাভ নেই। তিনটে পঁয়তাল্লিশে যোধপুর থেকে সকালের ট্রেনটা রামদেওরা পৌঁছনার কথা। অৰ্থাৎ সে গাড়ি নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাদের ছড়িয়ে চলে গেছে।
আমি বললাম, কিন্তু রাত্রের দিকে আর একটা ট্রেন যায় না জয়সলমীর?
হুঁ। কিন্তু সেটা রামদেওরা পৌঁছবে ভোর রাত্তিরে-তিনটে তিপন্ন। এখান থেকে এখন হাঁটা দিলে রামদেওরা পৌঁছতে ঝাড়া দু ঘণ্টা। সকালের ট্রেনটা ধরার যদি আশা থাকত, তা হলে হেঁটে যাওয়াতে একটা লাভ ছিল। অন্তত পোকরানটা পৌঁছনো যেত। এই মাঠের মাঝখানে…
লালমোহনবাবু এই অবস্থার মধ্যেও হেসে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, যাই বলুন মশাই, এ সব সিচুয়েশন। কিন্তু উপন্যাসেই পাওয়া যায়। রিয়েল লাইফেও যে এ রকমটা—
ফেলুদা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ভদ্রলোককে থামতে বললেন। চারিদিকে একটাও শব্দ নেই, সারা পৃথিবী যেন এখানে এসে বোবা হয়ে গেছে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা ক্ষীণ আওয়াজ-ঝুক্-ঝুক্ ঝুক্-ঝুক্ ঝুক্-ঝুক্ ঝুক্-ঝুক্…
ট্রেন আসছে। পোকরানের ট্রেন। কিন্তু লাইন কোথায়? শব্দের দিকে একদৃষ্টি চেয়ে থেকে হঠাৎ দূরে চোখে পড়ল। ধোঁয়া। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলাম টেলিগ্রাফের পোল। জমিটা ঢালু হয়ে গেছে। তাই বোঝাই যায় না। পিছনের লাল মাটির সঙ্গে লাল টেলিগ্ৰাফ-পোল মিশে প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। আকাশে মাথা উচিয়ে থাকলে আগেই চোখে পড়ত।
দৌড়ো!
ফেলুদা চিৎকারটা দিয়েই ধোঁয়া লক্ষ্য করে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। আর আমার পিছনে জটায়ু। আশ্চর্য। ভদ্রলোক ওই লিক্পিকে শরীর নিয়ে এমন ছুটতে পারেন, তা আমি ভাবতে পারিনি। আমাকে ছাড়িয়ে প্রায় ফেলুদাকে ধরে ফেলেন আর কী!
পায়ের তলায় ঘাস, কিন্তু সে ঘাসের রং সবুজ নয়—একেবারে তুলোর মতা সাদা। তার উপর দিয়ে পড়ি-কি-মারি ছুটি দিয়ে আমরা ঢালুর নীচে লাইনের ধারে পৌঁছে দেখি, ট্রেনটা আমাদের একশো গজের মধ্যে এসে পড়েছে।
ফেলুদা এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে এক লাফে একেবারে লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে দুটো হাত মাথার উপর তুলে হই-হই করে নাড়তে আরম্ভ করে দিল। ট্রেন এদিকে হুইসল দিতে আরম্ভ করেছে, আর সেই হুইসল ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে জটায়ুর চিৎকার—, রোক্কে, রোক্কে, হল্ট, হল্ট, রোক্কে ।…
কিন্তু কে কার কথা শোনে। এ ট্রেন যদিও ছোট, কিন্তু মার্টিন কোম্পানির ট্রেনের মতো নয় যে, মাঝ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত দেখালে বাসের মতো থেমে যাবে। প্রচণ্ড হুইসলামারতে মারতে স্পিড বিন্দুমাত্র না কমিয়ে ট্রেনটা একেবারে হই-হই করে আমাদের সামনে এসে পড়ল। ফলে ফেলুদাকে বাধ্য হয়ে লাইন থেকে বাইরে চলে আসতে হল, আর ট্রেনও দিব্যি আমাদের সামনে দিয়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং শব্দ করতে করতে কুচকুচে কালো ধোঁয়ায় সূর্যের তেজ কিছুক্ষণের জন্য কমিয়ে দিয়ে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই দুঃসময়েও মনে হল যে, এমন অদ্ভুত ট্রেন একমাত্র হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবিতেই দেখেছি, এ দেশে কোনওদিন দেখিনি, দেখব ভাবিওনি।
শুঁয়োপোকার রোয়াবটা দেখলেন? মন্তব্য করলেন লালমোহন গাঙ্গুলী।
ফেলুদা বলল, ব্যাড লাক্। ট্রেনটা লেট ছিল। অথচ সেটার সুযোগ নিতে পারলাম না। পোকরানে হয়তো একটা ট্যাক্সিও পাওয়া যেতে পারত।
গুরুবচন সিং বুদ্ধি করে আমাদের মালগুলো সব হাতে করে নিয়ে আসছিল, কিন্তু এখন আর তার প্রয়োজন হবে না। লাইনের দিকে চেয়ে দেখলাম, এখন আর ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
বাট হায়ার্ট অ্যাবাউট ক্যামেলস? উত্তেজিত স্বরে হঠাৎ বলে উঠলেন জটায়ু।
ক্যামেলস? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ওই তো!
সত্যিই দেখি, আরেকটা উটের দল আসছে যোধপুরের দিক থেকে।
গুড আইডিয়া। চলুন!
ফেলুদার কথায় আবার দৌড়।
সে রকম খেপে উঠলে নাকি উট টায়েন্টি মাইলস্ পার আওয়ার ছুটতে পারে—ছুটতে ছুটতেই বললেন লালমোহনবাবু।
উটের দলকে থামানো হল। এবারে দুজন লোক আর সাতখানা উট। ফেলুদা প্রস্তাব করল—রামদেওরা যাব, তিনটে উট কত লাগবে বলো। এদের ভাষা আবার হিন্দি নয়; স্থানীয় কোনও একটা ভাষায় কথা বলে। তবে হিন্দি বোঝে, আর ভাঙা ভাঙা বলতেও পারে। গুরুবচন সিং এসে আমাদের হয়ে কিছুটা কথাবার্তা বলে দিল। দশ টাকায় রাজি হয়ে গেল উট ভাড়া দিতে।
দৌড়ানে সেকেগা আপকা উট? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ট্রেন ধরনে হোগা।
লুব্ধ হেসে বলল, আগে তা উঠুন। দৌড়ের কথা পরে।
উঠব?
এই প্রথম বোধহয় লালমোহনবাবু উটের সামনে পড়ে তার পিঠে ওঠার ব্যাপারটা তলিয়ে দেখলেন। আমি জানোয়ারগুলোকে ভাল করে দেখছিলাম। কী বিদঘুটে চেহারা, কিন্তু কী–বাহারের সাজ পরিয়েছে তাদের। হাতির পিঠে যেমন ঝালরাওয়ালা জাজিম দেখেছি। ছবিতে, এদের পিঠেও তাই! একটা কাঠের বসবার ব্যবস্থা রয়েছে, তার নীচে জাজিম। জাজিমে আবার লাল-নীল-হলদে সবুজ জ্যামিতিক নকশা। উটের গলাও দেখলাম। লাল চাদর দিয়ে ঢাকা, আর তাতে আবার কড়ি দিয়ে কাজ করা। বুঝলাম, যতই কুশ্রী হোক, জানোয়ারগুলোকে এরা ভালবাসে।
তিনটে উটি আমাদের জন্য মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসেছে। আমাদের দুটো সুটকেস, দুটো হোণ্ড-আল আর ছোটখাটো যা জিনিস ছিল, সবই গুরুবচন সিং এনে জড়ো করেছে। সে বলে দিল, ট্রেন ধরতে পারলে আমরা যেন পোকরানে অপেক্ষা করি; আজ রাত্রের মধ্যে সে অবশ্যই পৌঁছে যাবে। মালগুলো অন্য দুটো উটের পিঠে চাপিয়ে বেঁধে দেওয়া হল।
ফেলুদা লালমোহনবাবুকে বলল, উটের বসাটা লক্ষ করলেন তো? সামনের পা দুটো প্রথমে দুমড়ে শরীরের সামনের দিকটা আগে মাটিতে বসছে। তারপর পেছন। আর ওঠার সময় কিন্তু হবে ঠিক উলটাটা। আগে উঠবে পিছন দিকটা, তারপর সামনেটা। এই হিসেবটা মাথায় রেখে শরীরটা আগু-পিছু করে নেবেন, তা হলে আর কোনও কেলেঙ্কারি হবে না।
কেলেঙ্কারি? জটায়ুর গলা কাঠ।
দেখুন, ফেলুদা বলল, আমি আগে উঠছি। ফেলুদা উটের পিঠে চাপল। উটওয়ালাদের মধ্যে একজন মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করতেই ঠিক যে রকমভাবে ফেলুদা বলেছিল, সেইভাবে উটটা তেরেকেঁকে ভীষণ একটা ল্যাগব্যাগে ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। এটা বুঝতে পারলাম যে, ফেলুদার বেলা কোনও কেলেঙ্কারি হল না।
তোপসে ওঠ। তোরা হালকা মানুষ, তোদের ঝামেলা অনেক কম।
উটওয়ালারা দেখি বাবুদের কাণ্ড দেখে দাঁত বার করে হাসছে। আমিও সাহস করে উঠে পড়লাম, আর সেই সঙ্গে উটটাও উঠে দাঁড়াল। বুঝলাম যে আসল গোলমালটা হচ্ছে এই যে, পিছনের পা-টা যখন খাড়া হয়, সওয়ারির শরীরটা তখন এক ঝটিকায় সামনের দিকে অনেকখানি এগিয়ে যায়। মনে মনে ঠিক করলাম যে, এর পরে যদি কখনও উঠি তা হলে প্রথম দিকে শরীরটাকে পিছনে হেলিয়ে টান করে রাখব, তা হলে ব্যালেন্সটা ঠিক হবে।
জয় ম্যা—
লালমোহনবাবুর মা-টা ম্যা হয়ে গেল এই কারণেই যে, তিনি কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই উটের পিছন দিকটা এক ঝটিকায় উঁচু হয়ে গেল, যার ফলে তিনি খেলেন এক রাম-হুমড়ি। আর তারপরেই উলটো হ্যাঁচকায় হেঁইক করে এক বিকট শব্দ করেই ভদ্রলোক একেবারে পারপেণ্ডিকুলার।
গুরুবচন সিং-এর কাছে বিদায় নিয়ে আমরা তিন বেদুইন রামদেওরা স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম।
আধা ঘণ্টে মে আট মিল যান হ্যাঁয়, টিরেন পাকড়ন হ্যাঁয়, ফেলুদা উটওয়ালাদের উদ্দেশ করে হাঁক দিল। কথাটা শুনে একজন উটওয়ালা আরেকটা উটের পিঠে চড়ে খচুমাচু খচুমাচু করে সামনে এগিয়ে গেল। তারপর অন্য লোকটার মুখ দিয়ে হেঁই হেঁই করে কয়েকটা শব্দ বেরোতেই শুরু হল উটের দৌড়।
নড়বড়ে জানোয়ার, দৌড়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা ঝাঁকুনিও খায় রীতিমতো, কিন্তু তাও ব্যাপারটা আমার মোটেই খারাপ লাগছিল না। আর তা ছাড়া বালি আর সাদা ঝলসানো ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছি, জায়গাটাও রাজস্থান—সব মিলিয়ে বেশ একটা রোমাঞ্চই লাগছিল।
ফেলুদা আমার চেয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। লালমোহনবাবু আমার পিছনে। ফেলুদা এক বার ঘাড়টা পিছনে ফিরিয়ে হাঁক দিল—
শিপ অফ দ্য ডেজার্ট কী রকম বুঝছেন মিস্টার গাঙ্গুলী?
আমিও এক বার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলাম লালমোহনবাবুর অবস্থাটা। খুব শীত লাগলে লোকে যেমন মুখ করে–তলার ঠোঁট ফাঁক হয়ে দেখা যায় দাঁতে দাঁত লেগে রয়েছে, আর গলার শিরাগুলো সব বেরিয়ে আসে–লালমোহনবাবুর দেখি সেই রকম অবস্থা।
কী মশাই? ফেলুদা হাঁকল, কিছু বলছেন না যে?
পিছন থেকে এবার পাঁচটা ইনস্টলমেন্টে পাঁচটা কথা বেরোল।–শিপ… অলরাইট… বাট… টকিং… ইম্পসিবল…
কোনও রকমে হাসি চেপে সওয়ারির দিকে মন দিলাম। আমরা এখন রেল লাইনের ধারা দিয়ে চলেছি। একবার মনে হল, দূরে যেন ট্রেনের ধোঁয়াটা দেখতে পেলাম, তারপর আবার সেটা মিলিয়ে গেল। সূর্য নেমে আসছে। দৃশ্যও বদলে আসছে। আবার আবছা পাহাড়ের লাইন দেখতে পাচ্ছি। বহু দূরে। ডান দিকে একটা প্রকাণ্ড বালির স্তুপ পড়ল। দেখে বুঝলাম, তার উপরে মানুষের পায়ের ছাপা পড়েনি। সমস্ত বালির গায়ে ঢেউয়ের মতো লাইন।
উন্টগুলোর বোধহয় একটানা এত দৌড়ে অভ্যোস নেই, তাই মাঝে মাঝে তাদের স্পিড কমে যাচ্ছিল, তারপর পিছন থেকে হেঁই হেঁই শব্দে তারা আবার দৌড়তে শুরু করছিল।
সোয়া চারটে নাগাদ আমরা দূরে লাইনের ধারে চৌকো ঘরের মতো কিছু দেখতে পেলাম। এটা স্টেশন ছাড়া আর কী হতে পারে?
আরও কাছে এলে পর বুঝলাম, আমাদের আন্দাজ ঠিকই। একটা সিগন্যালিও দেখা যাচ্ছে। এটা একটা রেলওয়ে স্টেশন, এবং নিশ্চয়ই রামদেওরা স্টেশন।
আমাদের উটের দৌড় টিমে হয়ে এসেছে। কিন্তু আর হেঁই হেঁই করার প্রয়োজন হবে না, কারণ ট্রেন এসে চলে গেছে; কতক্ষণের জন্য ট্রেনটা ফসকে গেল জানি না, তবে ফসকে যে গেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তার মানে এখন থেকে রাত তিনটে পর্যন্ত আমাদের এই জনমানবশূন্য প্রান্তরে এক অজানা জায়গায় একটা নাম-কা-ওয়াস্তে রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে কাটাতে হবে।