লজ্জা (Lojja) : 01
সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে–‘দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর। দেরি হলে কিন্তু অঘটন ঘটে যেতে পারে।’ সুরঞ্জন জানে এই ব্যবস্থার নামে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকা। ইঁদুর যেমন গর্তে ঢোকে ভয়ে, ভয় কেটে গেলে বা পরিস্থিতি শান্ত হলে চারদিক দেখেশুনে লুকোনো জায়গা থেকে ইঁদুর যেমন বেরিয়ে আসে; তেমনই তাদেরও লুকোতে হবে, পরিস্থিতি শান্ত হলে এদিক ওদিক দেখে তবেই বেরোতে হবে লুকোনো জায়গা থেকে। কেন সুরঞ্জনকে নিজের ঘর ছেড়ে পালাতে হবে–-তার নামে সুরঞ্জন দত্ত বলে? বাবার নাম সুধাময় দত্ত, মায়ের নাম কিরণময়ী দত্ত, বোনের নাম নীলাঞ্জনা দত্ত বলে বাবা, মা, বোনকে বাড়ি ছাড়তে হবে? কালাম, বেলাল বা হায়দারের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে যেমন নিয়েছিল দু বছর আগে? তিরিশে অক্টোবর সকালে কামাল তার ইস্কাটনের বাড়ি থেকে কিছু একটা আশঙ্কা আঁচ করে ছুটে এসেছিল, সুরঞ্জনকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে বলেছিল–‘শিগরি চল, দু-চারটে কাপড়চোপড় তড়িঘড়ি গুছিয়ে নে। বাড়িতে তালা দিয়ে সবাই চল তো। দেরি করিস নে, চল চল।’ কামালের বাড়িতে তাদের যত্নআত্তির অভাব হয়নি, সকালে ডিম রুটি–দুপুরে মাছ ভাত–বিকেলে লনে বসে ধুম আড্ডা–রাতে পুরু গদির বিছানায় ঘুম, চমৎকার কেটেছিল। কিন্তু কেন তাকে কামালের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়! কামাল তার অনেক দিনের বন্ধু। আত্মীয়স্বজন নিয়ে তার বাড়িতে ক’দিন সে থাকতে পারে কিন্তু তাতে থাকতেই হবে কেন? তাকে কেন নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, কামালকে তো পালাতে হয় না? এই দেশ কামালের যতটুকু, সুরঞ্জনেরও ঠিক ততটুকু। নাগরিক অধিকার দুজনের সমান হবারই কথা। কিন্তু কামালের মত সে কেন উদ্ধত দাঁড়াতে পারে না! সে কেন দাবি করতে পারে না আমি এই মাটির সন্তান, আমার যেন কোন আমার যেন কোনও অনিষ্ট না হয়!
সুরঞ্জন শুয়েই থাকে, ওঠে না। মায়া এঘরে ওঘরে অস্থির হাঁটে। বোঝাতে চায় কিছু একটা ঘটে গেলে পরে দুঃখ করে লাভ নেই। সি এন এন-এ বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে স্তব্ধ বসে আছেন সুধাময় আর কিরণময়ী। তাঁরাও ভাবছেন সুরঞ্জয় বুঝি এবারও নব্বই-এর অক্টোবরের মত কোনও মুসলমান বাড়িতে তাঁদের লুকোতে নেবে। কিন্তু আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না সুরঞ্জনের। সারাদিন শুয়েই কাটাবে সে ভাবে। কামাল বা কেউ নিতে এলে বলবে–‘বাড়ি ছেড়ে যাবো না, যা হয় হোক।’
আজ ডিসেম্বরের সাত তারিখ। গতকাল দুপুরে অযোধ্যার সরযূ নদীরে তীরে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। করসেবকরা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তিনটি গুম্বুজসহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরং দলের সর্ব্বোচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পি এ সি ও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের নৃশংস কাণ্ড দেখে। দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে একটি গম্বুজ ভাঙা হয়, চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটে পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজও ভেঙে ফেলে উম্মত করসেবকরা। সৌধ ভাঙতে গিয়ে চারজন করসেবক ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক।
সুরঞ্জন শুয়ে শুয়েই পত্রিকার পাতায় চোখ বুলোয়। আজ ব্যানার হেডিং–‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত।’ সে অযোধ্যায় যায়নি। বাবরি মসজিদ দেখেনি। দেখবে কী করে, দেশের বাইরে কোথাও তার যাওয়া হয়নি। রাম কোথায় জন্মেছিল, আর তার কোন মাটি ফুঁড়ে মসজিদ গজিয়েছে এসব তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। তবে ‘ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে যে কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত; সমগ্র কল্যাণবোধের ওপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত’–এ কথা সে মানে। ‘বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ নিয়ে হয়ে যাবে প্রচণ্ড তাণ্ডব। মন্দিরগুলো ধুলিস্যাৎ হবে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়বে, দোকানপাট লুট হবে। বি জে পি-র উস্কানিতে করসেবকেরা বাবরি মসজিদ ভেঙে এ দেশের মৌলবাদী দলকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করছে। বি জে পি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগীরা কি তাদের উন্মত্ত আচরণের জের কেবল ভারতের ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে ভেবেছে? ভারতে শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মরছে পাঁচশ ছশ একহাজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। হিন্দুর স্বার্থরক্ষকরা কি জানে দু থেকে আড়াই কোটি হিন্দু এই বাংলাদেশে আছে? শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিম এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে হিন্দু রয়েছে, তাদের কী দুর্দশা হবে হিন্দু মৌলবাদিরা একবার ভেবেছে? রাজনৈতিক দল হিসাবে ভারতীয় জনতা পার্টির জানা উচিত ভারত কোনও বিচ্ছিন্ন জম্বুদ্বীপ নয়। ভারতে যদি বিষফোঁড়ার জন্ম হয় তার যন্ত্রণা শুধু ভারতই ভোগ করবে না, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বিশ্বে, অন্তত প্রতিবেশী দেশে তো সবার আগে।’
সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। তার গা ধাক্কা দিয়ে মায়া বলে–তুমি উঠবে কি না বল। বাবা মা তোমার ভরসায় বসে আছেন।
সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে–তোর ইচ্ছে হলে তুই চলে যা, আমি এই বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়ব না।
–আর ওঁরা?
–জানি না।
–যদি কিছু হয়?
–কী হবে!
–ধর, বাড়ি লুট করল। পুড়িয়ে ফেলল।
–ফেলবে।
–তুমি তার পরও বসে থাকবে?
–বসে না, শুয়ে থাকব।
সুরঞ্জন খালি পেটে একটা সিগারেট ধরায়। তার চায়ের তেষ্টা পায়। কিরণময়ী সকালে এক কাপ চা তাকে দেন, আজ দিচ্ছেন না। এ সময় তাকে কে দেবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। মায়াকে বলা বৃথা। পালাবার কথা ছাড়া আপাতত মেয়েটি কিছুই ভাবছে না। চা বানাতে বললে ওর গলা আবারও সপ্তমে চড়বে। সে নিজেই উঠে বানিয়ে নিতে অয়ারে, কিন্তু আলস্য তাকে ছাড়ছে না। ওঘরে টেলিভিশন চলছে। তার ইচ্ছে হয় না সি এন এন-এর সামনে চোখ গোল গোল করে বসে থাকতে। ওঘরে খানিক পর পর মায়া চেঁচিয়ে উঠছে–দাদা শুয়ে আছে, পেপার পড়ছে, তার কোনও হুঁশ নেই।
হুঁশ সুরঞ্জনের নেই এ কথা ঠিক নয়। সে ঠিকই বোঝে যে কোন সময় দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে একদঙ্গল লোক, তাদের কতক চেনা কতক অচেনা, তারা বাড়ির জিনিপত্র ভাঙবে, লুট করবে, আর যাবার সময় বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেবে। এ অবস্থায় কামাল বা হায়দারের বাড়িতে উঠলে কেউ বলবে না আমাদের জায়গা নেই। কিন্তু তার খুব লজ্জা হয় যেতে। মায়া চেঁচাচ্ছে–তোমরা না যাও আমি একাই তবে চলে যাই। পারুলের বাড়ি গিয়ে বসে থাকি। দাদা কোথাও নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার না হয় বেঁচে থাকার দরকার নেই, আমার আছে।
মায়া ধারণা করছে সুরঞ্জন যে কারণেই হোক আজ কারও বাড়িতে তাদের লুকোতে নেবে না। অগত্যা সে নিজেই নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছে। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি সুরঞ্জনকে ভোগায় খুব।
নিরাপত্তা নব্বই-এর অক্টোবরেও ছিল না। ঢাকেশ্বরী মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দিল একদল লোক। পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে ছিল পাশে, বাধা দিল না। পুড়ে গেল মূল মন্দির, ওরা ধ্বংস করে ফেলল নাটমন্দির, শিবমন্দির, অতিথিশালা, অতিথিশালার পাশে শ্রীদাম ঘোষের বাস্তুভিটে। মন্দিরের ভেতরের জিনিসপত্র লুট করল। মাধব গৌড়িয় মঠের মূল মন্দির ধ্বংস করল। ওদিকে জয়কালী মন্দির চূর্ণ করে দিল। ব্রাহ্ম সমাজের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরের ঘরটি বোমা মেরে উড়িয়ে দিল। রামসীতা মন্দিরের ভেতর কারুকাজ করা ঠাকুরের সিংহাসনটি বিধ্বস্ত করে ফেলল। বিধ্বস্ত করল মূল ঘর। নয়াবাজারের মঠ ভেঙে ফেলল। বনগ্রাম মন্দির ভেঙে ফেলল শাবল চালিয়ে। শাঁখারি বাজারের মুখে সাতটি হিন্দুর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুড়িয়ে দেওয়া হল। শিলা বিতান, সোমা ট্রেডার্স, সেলুন, টায়ারের দোকান, লণ্ড্রি, মিতা মার্বেল, সাহা কেবিন, রেস্টুরেন্ট কিছুই রক্ষা পেল না। শাঁখারি বাজারের মোড়ে এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল যে যতদূর চোখ যায় ধ্বংসের চিহ্ন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। ডেমরায় শনির আখড়ার মন্দির লুট হল। পঁচিশটি পরিবারের বাড়িঘর লুট করল দু’তিনশ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী। লক্ষ্মী বাজারের বীরভদ্রের মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে ভেতরের সব নষ্ট করে দিল। ইসলামপুর রোডের ছাতা আর সোনার দোকানগুলোয় আগুন লাগিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকান ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলল পুরানা পল্টনের মরণচাঁদও। রায়ের বাজারের কালী মন্দিরের মূর্তি মাটিতে ফেলে ভাঙল। সূত্রাপুরে হিন্দুদের দোকান লুট কর, ভেঙে, মুসলমানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিল। নবাবপুর রোডের ঘোষ এণ্ড সন্স-এর মিষ্টির দোকানটি লুটপাটের পর নবাবপুর যুব ইউনিয়ন ক্লাব-এর একটি ব্যানার দোকানের ওপর টাঙিয়ে দিল। ঠাঁটারি বাজারের বটতলি মন্দির ভেঙে তছনছ করা হল। নবাবপুরে রামধন পশারি নামের পুরনো দোকানটি লুট করা হল। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র কয়েক গজের মধ্যে শুকলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ভেঙে চুরমার করা হল। যতীন এণ্ড কোং-এর দোকান এবং কারখানা ভেঙে ফেলল, ঘরের জিনিসপত্র পুড়ল। ঐতিহাসিক সাপ মন্দিরের অনেকটা গুঁড়ো করে ফেলল, সদরঘাট মোড়ে রতন সরকারের মার্কেট লুটপাট করল, ভাঙচুর করল। সুরঞ্জনের চোখের সামনে একটি একটি করে ভেসে ওঠে ভাঙা পোড়া সেইসব বীভৎস দৃশ্য। এর নাম কি দাঙ্গা? নব্বই-এর ঘটনাকে কি দাঙ্গা বলা যায়? দাঙ্গা অর্থ মারামারি–এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের সংঘর্ষের নাম দাঙ্গা। কিন্তু একে তো দাঙ্গা বলা যায় না, এ হচ্ছে এক সম্প্রদায়ের ওপর আরেক সম্প্রদায়ের হামলা। অত্যাচার। নির্যাতন। জানলা গলে রোদ এসে পড়ে সুরঞ্জনের কপালে। শীতের রোদ, এ রোদে গা পোড়ে না। শুয়ে থেকে সে চায়ের তৃষ্ণা অনুভব করে।