বছরের এ সময়ে বৃষ্টি
বছরের এ সময়ে বৃষ্টি হয় কেউ কখনো শোনেনি। এ হচ্ছে এমন একটা সময়, যখন আকাশটা প্রজাপতির পাখার মতো ফিনফিন করতে থাকে রোদ্দুরে, নীল রঙে; যখন উত্তর থেকে নতুন প্রেমের মতো গা–শির–শির–করা মিষ্টি বাতাস বয় কী বয় না তা বোঝাও যায় না; যখন লোকেরা খুব স্ফুর্তির মেজাজে থাকে আর বলাবলি করে সংসারে বেঁচে থাকাটা কিছু মন্দ নয়; আর ছেলেমেয়েরা কাঁচের জিনিসপত্তর ভাঙলেও যখন মায়েরা কিছু বলে না; যখন হাট বসতে থাকে বিকেলের অনেক আগে থেকেই আর ভাঙতে ভাঙতে অনেক রাত্তির হয়ে যায়, কারণ বছরের এ রকম সময়ে অনেক রাত্তিরেও মানুষ একা হয়ে যায় না, ভয়। করে না, নদীর খেয়া বন্ধ হয় না। এ রকম দিনে বৃষ্টি হয় বলে কেউ কখনো শোনেনি।
কিন্তু আজ কোথা থেকে একখণ্ড কালো মেঘ এসে জমেছিল, ট্রেজারির পেটা ঘড়িতে চারটে বাজবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বাতাস দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের। রাস্তার ওপর সবে আধখানা হাট বসেছিল, সবে গিন্নীরা পয়সা বার করে দিচ্ছিল কর্তাদের হাতে, সবে তেলেভাজাওলা তার উনুন জ্বালিয়েছিল, এমন সময় বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে দুহাত দূরেও কিছু আর দেখা গেল না। কেউ আর বাইরে রইল না। ডাকাত পড়ার মতো একটা শোরগোল পড়ে গেল; যে যেমন পারল রাস্তার দুপাশে জুতো কাপড় ট্রাঙ্কের দোকানের বারান্দায় ভিজতে ভিজতে এসে দাঁড়াল। এমনকি মসজিদের ভেতরটাও লোকে আর তাদের কাপড় থেকে চুঁইয়ে পড়া পানিতে গমগম সপসপ করতে লাগল; মন খারাপ করে নিমিলিত নেত্রে বসে রইলেন ইমাম সাহেব; আলু পটল কুমড়োর বড় বড় ঝাঁকাগুলো পথের ওপরেই ভিজতে লাগল। একটা খেয়া এপারে এসেছিল বৃষ্টি মাথায় করে কিন্তু আর ফিরে যেতে পারল না। ক্যাশবাক্স গামছা দিয়ে ঢেকে ভিজতে লাগল ঘাটিয়াল। যাকে তাকে খামোকা গালাগাল দিতে লাগল সে। ওপারে ধু ধু পাড়ের ওপর কয়েকজন হাটুরে হতভম্ভ হয়ে কোথায় পালাবে বুঝতে না পেরে যে যেদিকে পারল দৌডুল।
সে বৃষ্টি আর থামল না।
এক সময় বাতাসের এক প্রচণ্ড নিঃশ্বাসে মড়মড় করে ভেঙে পড়ল টাউন হলের মাথা থেকে কাঠের ফ্রেমে চটের ওপর সাটা বিরাট প্ল্যাকার্ডখানা। তাতে লেখা ছিল—
হৈহৈ কাণ্ড, রৈরৈ ব্যাপার, সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। আর্টিস্টকুলের যুবরাজ মায়াশক্তিসম্পন্ন প্রফেসর নাজিম পাশার অদ্ভুত ইন্দ্রজাল। সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারি যাদুকরের শেষ প্রদর্শনী।
রূপসী মিস চম্পার অপূর্ব ক্রীড়া চাতুর্য।
নয়ন-মন সার্থক করুন।
আসুন, আসুন, আসুন।
প্ল্যাকার্ডের এক কোণে চিত্র ছিল প্রফেসর নাজিম পাশার হাসি ভরা পাগড়ি বাঁধা চেহারার। তার নিচে দুখানা হাড় ক্রশ করে রাখা। আরেকদিকে, একটা মেয়েকে গলা থেকে হাঁটু অবধি বাসে বন্ধ করে করাত দিয়ে দুখানা করা হচ্ছে, রক্ত পড়ছে। একেবারে নিচে আঁকা, কালো বোর্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো একটা মেয়ে, তাকে, ছোরা তুলে তাক করে আরেকজন। বসে বসে পোষা পায়রাগুলোকে দানা খাওয়াচ্ছিলেন নাজিম পাশা, এমন সময় প্ল্যাকার্ড ভেঙে পড়ল। হাতের বাটি সরিয়ে রেখে চিৎকার করে উঠলেন তিনি– চম্পা, চম্পা।
টাউন হলের পেছনেই লাগোয়া দুটো ছোট কামরা আ সাজঘর। কামরা দুটোয় শহরের কর্তারা প্রাইভেট মিটিং করেন। আর সাজঘরটা কালে–ভদ্রে নাটক হলে ধুলো ঝেড়ে চামচিকে তাড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। সাজঘরে বসে প্রফেসরের কোটের আস্তিনে লুকোনো পকেট নতুন করে টাকছিল চম্পা। কাল রাত্তিরের শো–এ বড় সাকরেদ জহির উইংসের আড়াল থেকে কালো সুতো–যেটা বাধা ছিল আস্তিনের এই গোপন পকেটে লাল রুমালের সঙ্গে—-টানতে গিয়ে মটমট করে সেলাই শুদ্ধ খসিয়ে এনেছিল; আরেকটু হলেই দর্শকের সামনে ফাস হয়ে যেতো জারিজুরি, ভাগ্যিস প্রফেসর টের পেয়ে তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। চম্প সেলাই করতে করতে প্রথমে শুনল প্ল্যাকার্ড ভেঙে পড়বার শব্দ, পরক্ষণেই প্রফেসরের ডাক–চম্পা, চম্পা।
নিঃশব্দে এ ঘরে এসে চম্পা দেখল, প্রফেসর নাজিম পাশা দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন—-কিন্তু বাতাসের, বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। পায়রাগুলো তার পায়ের কাছে ঘুরছে।
চম্পা অবাক হল না। একটু বিরক্ত হল।
বাবা যখন কাঁদেন, কোন শব্দ কবেন না, মনে মনে ভাবল সে। কেবল গোলগাল মোটা। শরীরটা একটু একটু কাঁপতে থাকে আর লাল হয়ে ওঠে চোখ, যেমন এখন কাঁপছে। তাকে কাঁদতে দেখে চম্পা অবাক হল না, কারণ, বাবা প্রায়ই কাঁদেন, রোজই কাঁদেন, একটা কিছু হলেই কাঁদেন–যা কেউ আশাও করবে না, বিশ্বাসও করবে না। প্রথম যেদিন বাবাকে কাঁদতে দেখেছিল, অবাক হয়েছিল চম্পা। সে তখন বছর নয়েকের। মা–কে তো সারাক্ষণ বকে বকে মাথা খারাপ করে রাখতেন বাবা; সেদিন চম্পা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে বাবার ম্যাজিক দেখাবার রঙিন লাঠিটা মা আমার সতীন, আমার সতীন বলতে বলতে বটি দিয়ে দুখানা করছেন, আর পশ্চয!–বাবা বারান্দায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। সে বছরই বাবা তার নিজের দল করেছিলেন। চৌদ্দ বছর বয়সে চম্পা এসে দলের একজন। হল। সেই থেকে আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে। বাবা যখন স্টেজে গিয়ে দাঁড়ান, চোখ বাঁধা অবস্থায় কালো বোর্ডে অঙ্ক কষে ফেলেন, চম্পা যখন স্টেজে আসে, সবাইকে ঝুঁকে সালাম করে দুটো টুলের ওপর রাখা বাসের মধ্যে গিয়ে সেঁধোয় আর তার বাবা আর জহির করাত নিয়ে দুপাশে দাঁড়ায় তাকে জীবন্ত দুখণ্ড করবার জন্যে; টুপির ভেতর থেকে নাবা যখন পাঁচটা পায়রা বের করে উড়িয়ে দেন আর ওরা চা কারে হলের মধ্যে ঘুরতে থাকে, অচেনা অন্ধকার দেখে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আবার ফিরে আসে বাবার হাতেই, তখন প্রচণ্ড হাততালিতে হল ফেটে না পড়লে বাবার ভারি কষ্ট হয়। শশা ভাঙলে কোট পান্ট শুদু বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন, মিথ্যে করে বলেন, জ্বর এসেছে। চম্পা জানে, বাবা তখন কাঁদছেন। চম্পা বোঝাতে চেষ্টা করে ঠাণ্ডা পড়েছে, আলোয়ানের ভেতর থেকে সবাই হাত বের করতে চায়নি, তালিটা তাই ফিকে হয়েছিল; কিংবা গায়ের লোক তো!–ব্যাপার দেখে চক্ষু চড়কগাছ, হাততালি দেবে কী! কিন্তু বাবা তা শুনবেন না। কাঁদবেন। এমনকি টিকেট কতো বিক্রি হল, তাও আব সেদিন খোঁজ নেবেন না; সেদিন জহির আর সামাদ ক্যাশবাক্স থেকে কম করে হলেও দুখানা দশ টাকার নোট সরাবে। চম্পা ও নিয়ে হৈচৈ করতে পারে না, বাবা শুনলে তাদের কিছু তো বলবেনই না, আবার দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে নতুন করে কাঁদতে বসবেন।
একবার কী হল, জহির তাক করে ছোরা ছুঁড়তে জানে, লক্ষ্য ফসকায় না এক চুল। বাবা বললেন, তাহলে একটা বোর্ডে কাউকে দাঁড় করিয়ে জহির তার দিকে তাক করে ছোরা ছুঁড়বে–ছোরাগুলো চারপাশে চোখ–মুখ–গা ঘেঁষে বোর্ডে গিয়ে বিধবে। কিন্তু মুশকিল হল জহিরের ছোরার সামনে দলের কেউ বোর্ডে দাঁড়াতে সাহস পেল না। ব্যাপাটির চারজন যারা শহরে বাজনা বাজিয়ে হ্যাণ্ডবিল বিলি করে, আবার শোর সময় টিকেট বিক্রি করে এসে ম্যাজিকের সঙ্গে বাজনা বাজায়, তাদের চারটে চমৎকার নাম দিয়েছিল চম্পা খাড়ানাক, বোচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো। ছোরার কথা শুনে খাড়ানাক চাকরি ছেড়ে দেবার হুমকি দেখাল, বোচানাক ক্রমাগত ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ল, পটকা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, আর চালকুমড়ো গড়াতে গড়াতে গুম হয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন একটা বুদ্ধি করলেন বাবা। খড় মাটি দিয়ে সুন্দর একটা কার্তিক বানিয়ে আনলেন কুমোরদের দোকান থেকে নগদ পনেরো টাকা দিয়ে। সেটাকে বোর্ডে দাঁড় করিয়ে জহিরের হাতে তিরিশটা ছোরা দিয়ে রিহার্সেল নেওয়া হল– দেখা গেল, চমৎকার তাক। একটাও মূর্তির গায়ে লাগেনি একেবারে গা ঘেঁষে বোর্ডে বিধছে। মূর্তিটা যখন সরিয়ে আনা হল, মনে হল, ছোরা গেঁথে গেঁথে কে যেন বোর্ডে আস্ত একটা মানুষের ড্রয়িং করে রেখেছে। এমনকি মূর্তির দুপায়ের মাঝখানে আধ ইঞ্চি ফাঁক– তার মধ্যেও তিনটে ছোরা বাঁট পর্যন্ত গাঁথা।
রিহার্সেল চলল কয়েকদিন। বায়না ছিল শান্তাহারে রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে। সেখানে স্টেজে নাবানো হল মূর্তিটাকে, জহির তাক করে চমৎকার ছুঁড়ে গেল একের পর এক তিরিশটা ছোরা। কিন্তু কেউ তালি দিল, উল্লাসে চিৎকার করে উঠল না। বরং শোনা গেল, লোকজন পটপট চেয়ারের হাতল ভাঙছে আর বলছে, মাটির মূর্তি দিয়ে ছোরার বাহাদুরি দেখানো হচ্ছে! হতো জ্যান্ত মানুষ, বুঝতাম কেমন ম্যাজিশিয়ান। দুত্তোর, বাজে, বাজে! সে রাতে আর খেলা জমল না, সবাই হৈচৈ করে বেরিয়ে গেল, টিকেটের দাম ফেরতের জন্যে। মহা হট্টগোল বাধল, ওদিকে রেলের লোক এসে উনিশখানা চেয়ারের হাতল বাবদ দেড়শো টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসল, বাবা সাজঘরে ট্রাঙ্কের ওপর বসে কাঁদতে লাগলেন– এককোণে, অন্ধকারে।
পরদিন চম্পা এসে দাঁড়াল বোর্ডের সামনে–মিস চম্পা–প্রাচ্যের সেরা রূপসী–যার অঙ্গুলি হেলনে আকাশের বিদ্যুত স্তম্ভিত হয়। পরনে গলা থেকে পা পর্যন্ত সিল্কের আটো পোশাক। কোমর, নিতম্ব আর হাঁটুর প্রতিটি ভাঁজে যেন দাঁত কামড়ে বসেছে কাপড়, ওপরে লাল সিল্কের তেমনি আঁটোসাটো খাটো কোর্তা, চক্রাকারে কাপড় সেলাই করে দুটো বুক চাঁদের মতো স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে, মাথার চুল সাবান ঘষে ফোলানোপায়ে নীল সিল্কের জুতো। বাজনা বাজল, চম্পা এসে দাঁড়িয়েছে, জহির ছোরা তুলে তাক করল। বিদ্যুত নেচে উঠল চম্পার চোখে একপলকের জন্যে। জহিরকে কিন্তু সে কথা ভাববার সময় নেই। দুম্। চোখ না নাবিয়েও চম্পা বুঝতে পারল একটা ছোরা এসে ঠিক তার গালের পাশে গাঁথল। একটা নিঃশ্বাস পড়ল চম্পার সারা হল এতো নিস্তব্ধ যে, সেটাই তার নিজের কানে শোনাল ঝড়ের মতো। দুম দুম দুম্। আর নিঃশ্বাস পড়ল না। সাতাশ–আঠাশ উনত্রিশ–ত্রিশ। সারা হল ফেটে পড়ল উল্লাসিত হাততালিতে। বোর্ড থেকে সরে এসে তিনবার মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করল চম্পা। জহির তার কোমর জড়িয়ে ধরে মাথা নুইয়ে আবার লম্বা এক সালাম করল। আবার হাততালি। আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তখন চম্পার মনে হলো জহির ফিসফিস করে বলছে, মন বলছিল, তোকে জখম করে দিই চম্পা। তার ভেতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কিছু বলতে পারল না সে। জহির বলল, কিরে ভয় পেলি নাকি! ঠাট্টা করছিলাম।
কিন্তু চম্পার এতো করাও শুধু শুধু। বাবার কাঁদতে হলে কারণ লাগে না। একেক সময় তার মনে হয়, বাবার মতো শিশু দ্বিতীয়টি আর নেই। আবার এক সময়ে মনে হয়, ঐ কান্না তার সমস্ত দুর্ভাগ্যের প্রতীক। মনে হয়, দল থেকে পালিয়ে যাই। ওপরের গ্যালারীতে বউ ঝিয়েরা বাচ্চা–কাচ্চা নিয়ে এসে বসে ঘোমটা তুলে এ ওর হাত ধরে মাথা কাৎ করে তন্ময় হয়ে দেখে, কোলের ছেলেটা কাঁদলে তার মুখে মাই তুলে দিতে দিতে দেখে একের পর এর তাস উড়ে যাচ্ছে হাত থেকে, কংকাল নাচতে নাচতে এসে জড়িয়ে ধরছে চম্পাকে, চুমো খেতে চাইছে আবার ভ্রূকুটি করতেই দূরে সরে যাচ্ছে। চম্পা ভাবে, সেও যদি এ রকম ম্যাজিক দেখতে পারতো বিরাট বিস্ময় নিয়ে, কোলে থাকতে খোকা, পাশে বসে ননদ কাঁধ জড়িয়ে ধরত ভয়ে।
ছোবার সেই প্রথম শো–এর পর থেকে, আজ বছর দুই হবে, চম্পা একটু বিরক্তই হয় বাবাকে কাঁদতে দেখলে! এ এক অদ্ভুত কান্না। এক ফোঁটা পানি পড়ে না, একটু শব্দ হয় না। কাল রাত্তিরেও। কাল জহিরের দোষে আস্তিনের লুকোনো পকেট ছিঁড়ে গিয়ে খেলা প্রায় ফাঁস হয়ে যাবার যোগাড়, জোর সামলে নিলেন বাবা; কিন্তু শো শেষে কিসসু বললেন না জহিরকে, খেতে বসে ঠিক ঐ রকম শব্দহীন কান্না। বাবা যেন ভয় করেন, জহির চলে গেলে দল ভেঙে যাবে তার বাবা মায়াশক্তিসম্পন্ন প্রফেসর নাজিম পাশা।
.
বৃষ্টিটা একটুও কমেনি। বরং বুঝি আরে; জোব হয়েছে। প্রফেসর দুহাতে মুখ ঢেকে বসে। আছেন। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে শিশিরের মতো সাজ হয়ে পড়েছে তার দুহাতের পিঠে। চম্পার পায়ের শব্দে পায়রাগুলো হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। চম্পা একটু বিরক্তি নিয়েই ডাকাল, কী বাবা?
প্রফেসর চোখ তুলে তাকালেন। হাত আস্তে আস্তে নেবে এলো তার কোলের ওপর। দেখলেন, সন্ধ্যের শো–র জন্যে চম্পা মুখে রঙ মেখে একেবারে তৈরি। বাকি কেবল ড্রেস করে নেয়া। যে জানালা দিয়ে শোনা গিয়েছিল প্ল্যাকার্ড পড়ে যাবার শব্দ, সেদিকে অস্পষ্ট একটা হাতের ইঙ্গিত করে প্রফেসর বললেন, চম্পা, আজ বোধহয় শো হবে না।
তার কথায় সায় দিয়েই যেন কড় কড় দীর্ঘ একটা বিদ্যুত ডেকে উঠল দূরে দূর থেকে নিকটে।
এতো বিষ্টিতে কে আসবে?
দেখল, বাবার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে শব্দহীন কান্নায়। হঠাৎ কেমন মায়া হল চম্পার। বলল, তুমি কি জানো, বিষ্টি যেতে কতোক্ষণ? তা ছাড়া আজ এদের হাট। মফঃস্বল থেকে অনেকে আমাদের দেখবে বলে এসেছে। যতো রাতই হোক আসবে।
আসবে?
চম্পা সেদিকে কান না দিয়ে বলল, বরং শো এক ঘণ্টা পিছিয়ে দাও। আর তুমি এক্ষুনি গিয়ে স্টেজ গুছিয়ে ফ্যাল, ড্রেস করে নাও। সময় কই?
তার কথায় যেন কাজ হল। উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। পকেট থেকে রুমাল বের করে ফাঁচ করলেন একবার। চম্পা বলল, তোমার কোটের আস্তিন হয়ে গেছে।
ভাল। তারপর চোরের মতো তাকিয়ে হঠাৎ শুধোলেন, প্ল্যাকার্ডটা পড়ে গেল শুনেছিস?
হ্যাঁ।
আর কিছু না বলে তখন সাজঘরের দিকে চলে গেলেন প্রফেসর। চম্পা দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। এতোক্ষণে তার চোখে পড়ল, পাশের দরোজটা খোলা। ওঘরে চৌকির ওপর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে জহির। ঘুমোচ্ছে না, চোখ পিটপিট করে দেখছে চম্পাকে। আর তার পায়ের আঙুল মটকাচ্ছে সামাদ।
প্রফেসর চলে যেতেই তড়াক করে উঠে বসল জহির। বলল, চম্পা, শোন।
কী?
এদিকে।
চম্পা এলে জহির হাসল। বিরক্ত হয়ে চম্পা শুধোল, কী বলবে?
যা বৃষ্টি, সব ভেসে যাবে নাকি, অ্যাঁ?
যাক।
একটু চা হয় না চম্পা?
বানিয়ে নাও গে। আমি জানি না।
খপ করে হাত ধরে ফেলল জহির। তার কী ইশারা ছিল, সামাদ কেটে পড়েছে।
চম্পা, তোকে পায়রা বানিয়ে রাখতে পারি, থাকবি?
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চম্পা বলল, কোথায়?
আমার আস্তিনে।
বানাও দেখি কেমন ওস্তাদ!
চম্পার কণ্ঠে বিদ্রূপ ঝরে পড়ে। কিন্তু জহির সেটা বুঝতে পারে না। সে মনে করে, চম্পার মনটাও আজ বৃষ্টিতে হু হু করছে তার মতো। বলে, তাহলে চোখ বন্ধ কর।
করল চম্পা। সে জানে, এ রকম একটা সুযোগ হয় না। ঠোঁট তাই হাসিতে মাখা মাখা হয়ে ওঠে। জহির বলে, হাসছিস যে?
এমনি।
জহির চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকা চম্পার রূপ নিরিখ করে কিছুক্ষণ। মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ লাফিয়ে ওঠে তার। সারা শরীরের মধ্যে শুধু ঐ হাসি–হাসি–ঠোঁট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
প্রায়-চিৎকার করে ওঠে সে। মুখটা নাবিয়ে এনেছিল, চম্পা তার নিচের ঠোঁটে আচমকা দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। রক্ত পড়ছে। আর একটা চড়। খিলখিল করে হেসে উঠল চম্পা।
পায়রা! ইস, ওস্তাদ কতো? আয়না এনে দেবো, কেমন গাধার মতো দেখাচ্ছে?
স্টেজে নামবার জন্যে মুখে রঙ মেখেছিল চম্পা, তার খানিকটা লেগেছে জহিরের চিবুকে। তাই দেখে চম্পা লুটিয়ে পড়ল হাসিতে। হাসতে হাসতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেল সাজঘরের দিকে।
.
কিন্তু বৃষ্টি কমবার কোন লক্ষণই নেই। আস্তে আস্তে সূর্য অস্তাচলে গেল। তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আরো ভয় করতে লাগল সবার। মনে হল, সমস্ত পৃথিবীকে কোন এক অশরীরি শক্তি দুহাতে সংকুচিত করে শ্বাসরোধ করতে চাইছে। বিদ্যুতের মধ্যে দিয়ে তার দম্ভ, বৃষ্টিতে তার সংহারের সংকল্প, হঠাৎ নেমে আসা শীতের মধ্যে তার জয়ের উল্লাস লেখা।
হ্যাজাক দুটো ধরাল সামাদ। একটা সে রাখল স্টেজের ওপর, আরেকটা সাজঘর আর পাশের ঘরের মাঝখানে টুলের ওপরে, যেখানে বসে প্রফেসর একটু আগেই কাঁদছিলেন। হ্যাঁজাকের ফিনফিনে আলো থেকে ভ্রমরের মতো একটানা একটা গুঞ্জন সারা টাউন হলের ভেতরে ঘুরতে লাগল। প্রফেসর ড্রেস করে খামোকা পায়চারি করছেন খালি স্টেজে। চম্পা ড্রেস করেনি, সে একটা টুলের ওপর বসে অস্বচ্ছ চোখে বাবাকে দেখছে। আর জহির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের নিচে চম্পার দাঁতের দাগ পড়ছে একমনে। ছোট সাগরেদ সামাদ কী করবে বুঝতে না পেরে উবু হয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে আড়ালে। তার কোন কথা নেই, শো হোক আর না হোক, চম্পা জহিরকেই বিয়ে করুক আর হাতিকেই করুক, মাস কাবারে তার আশি টাকা পেলেই হল।
এমন সময় ভিজতে ভিজতে ব্যাপার্টির চারমূর্তি ভূতের মতো এসে হাজির খাড়ানাক, বোচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো। তারা এসে মহা গম্ভীর হয়ে রইল, কাউকে কিছু বলল না। পটকা বারান্দার এককোণে বাতাস বাঁচিয়ে আগুন করল খানিকটা; খাড়ানাক বসে বসে তার ড্রাম দুটো সেঁকতে লাগল সেই আগুনে। বৃষ্টির পানিতে একেবারে মিইয়ে গেছে। খোলটা। কিন্তু পরনের কাপড় ভিজে একসা সে–দিকে চোখ নেই। বোচানাক আর পটকা বসে বসে ভিজে হ্যাণ্ডবিলগুলো একটা আরে টার গা থেকে ছাড়াতে লাগল। আর চালকুমড়ো তার বিউগিল থেকে ঝাঁকিয়ে পানি বার করতে লাগল আর ক্ষণে ক্ষণে চোঙের মধ্যে চোখ লাগিয়ে পরখ করতে শুরু করল। এ যন্তর নিয়ে আবার ভারি মুশকিল। আগুনের আঁচ পেলে সোনালি কলাই উঠে তামা বেরিয়ে পড়বে।
চম্পা এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। এক মুহূর্তে দেখল ওদের কাণ্ডকারখানা। বিশেষ কাউকে লক্ষ না করেই সে জানান দিল, কী রে?
আবার কী? হাটের দিকে যাবো, বৃষ্টি নাবলো। বলল খাড়ানাক। রাগটা তারই বেশি। কারণ ড্রামটা আঁচে ধরতে গিয়ে বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছিল তাকে।
চম্পা বলল, এই পটকা, ওর সঙ্গে হাত লাগা না। নবাব হয়েছিস?
সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ড্রাম নাবিয়ে চেঁচিয়ে উঠল খাড়ানাক, থাক, থাক, অমন কাজের কর্তা আমার দরকার নেই। চাই কী খোল শুদ্ধ দেবে পুড়িয়ে।
পটকা চম্পার ডাক শুনে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, আবার নিবিষ্ট মনে সে ভিজে হ্যাণ্ডবিল ছাড়াতে লাগল। হি হি করে হেসে উঠল চম্পা। একটা টুল টেনে জুৎ করে বসল তার ওপর। বলল, সবগুলোর মেজাজ একেবারে ছিপ হয়ে আছে। হি হি হি।
চালকুমড়োর একটু বুদ্ধি কম। সে হাঁ করে ভাবল খানিক, পরে জিগ্যেস করল, ছিপ মানে?
মানে?– বলছি। বলেই চম্পা একটা সরু ভাঙা ডাল হাতে তুলে নিয়ে এক মাথা ধনুকের মতো টেনে শন করে ছেড়ে দিল, চটাং করে গিয়ে পড়ল চালকুমড়োর পিঠে। তিড়বিড় করে উঠল সে ব্যথায়।
চম্পা বলল, এর নাম ছিপ। বুঝলি? এই পটকা। পটকা?
জ্বি।
থাক আর হ্যাণ্ডবিল ছাড়িয়ে কাজ নেই। চাট্টি খিচুড়ি রাঁধবার জোগাড় দেখ গে। আজ আর শো হবে না। আড়মোড়া ভাঙল চম্পা, যেন কদ্দিন ঘুম হয় না তার, আজ একটু ঘুমোবে। চারকণ্ঠ একসঙ্গে শুধোল, কেন, শো হবে না কেন?
বোঁচানাক বলল, বারে, আমরা তো বিলি কাগজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমাদের দোষ কী! দূর গাধা। চম্পা পা দিয়ে বোচানাকের পেটে খোঁচা দিল একটা। দেখছিস না বৃষ্টি, লোক হবে কোত্থেকে?
ওস্তাদ বলেছে?
আমি বলছি। না বাপু আর পারি না। এই খাদা, এক কেলি পানি দে–না চায়ের। বসে বসে খাই। আর আমার বালিশের নিচে একখানা পাউরুটি আছে, আনবি?
চম্পার ঐ একটা স্বভাব। এই চারমূর্তির সঙ্গে বসলে কথার খই ফুটতে থাকে। এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দেয় না কাউকে। আজ শো না হলে যে তাদের আসা যাওয়ার খরচই উঠবে না, খাবার পয়সা থাকবে না, সেটা যেন বেমালুম ভুলে গেছে চম্পা। সে ভাবনা করছেন একা স্টেজে পায়চারি করতে করতে প্রফেসর নাজিম পাশা, বারো বছর আগে যিনি তাঁর ওস্তাদ প্রফেসর জে, সি, দত্ত হিন্দুস্থানে চলে যাবার পরে নিজের নাম নাজিমুদ্দি ভূঁইয়া থেকে নাজিম পাশা বানিয়ে দল করেছিলেন।
খাড়ানাক এসে খবর দিল, পাউরুটি বোধ হয় ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে, পাওয়া যাচ্ছে না।
ইঁদুরে না তুই? তারস্বরে জানতে চাইল চম্পা। বল, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?
জহির এসে বসল চম্পার গা ঘেঁসে আরেকটা টুল নিয়ে। বলল, থাক, আর রাগ করিস নি চম্পা। সিগারেট খাবি?
চম্পা তাকে কিছু বলল না, বলল খাড়ানাককে। যাক, আজ মাফ করে দিলাম। আর বলতে বলতে জহিরের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে গুজল। ম্যাচ জ্বালিয়ে ধরল জহির। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে চম্পা বলল, কী বাজে সিগারেট যে খাও। গন্ধে পেট মোচড়াতে থাকে। আরেকটা টান দিয়ে বলল, ঠাণ্ডাও নেহাত মন্দ পড়েনি।
তার সিগারেটের দুর্নাম শুনে জহির একটু মুখ শুকোল। রাগ ঝাড়ল পটকার ওপর। মাথায় তার চাটি মেরে বলল, হারামজাদা, চায়ের পানি বসাতে এতোক্ষণ?
চারমূর্তির মধ্যে পটকাই সবচে নিরীহ। কিন্তু তার চোখও জ্বলে উঠল জহিরের মার খেয়ে। অথচ মুখে কিছু বলল না, ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে চায়ের পানি আগুনে বসাল দুখানা ইট পেতে।
ঠিক তখন। একসঙ্গে চমকে মুখ ফিরিয়ে সবাই দেখে, বারান্দার নিচে তাদের পেছনে একটা মানুষ গাছের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে অন্ধকারে। নড়ছে না, শব্দ করছে না। বৃষ্টি আর অন্ধকারে ভাল করে ঠাহরও হচ্ছে না সত্যি সত্যি মানুষ, না আর কিছু।
কে? কে ওখানে? টুল থেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল জহির। বৃষ্টির এই ঠাণ্ডার জন্যে কি–না কে জানে, তার কণ্ঠ বড় দুর্বল আর ভাঙা শোনাল। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল চম্পা।
লোকটা তখন আস্তে আস্তে বারান্দায় উঠে দাঁড়াল! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সবাই। কেউ তাকে চেনে না, এর আগে কখনো দেখেনি। ওরা ভাবল, এ শহরের কেউ হবে হয়তো থানার দারোগার জন্যে দশখানা পাশ চাই, কী কোন কর্তা পাঠিয়েছেন জানবার জন্যে যে চম্পা রাতে নেমন্তন্ন নিয়ে থাকে কি–না। বড় অস্বস্তি বোধ করল চম্পা। কিন্তু সে এক
মুহূর্তের জন্যে। সবার ভেতরে চম্পাই প্রথম বুঝতে পারল, ওরকম প্রস্তাব নিয়ে যারা আসে তারা দেখতে আলাদা, তাদের চলন অন্যরকম এ লোকটার পোশাক সাধারণ, কিন্তু কেমন সুন্দর গায়ে–মানানো, চেহারা কিছু না, কিন্তু চোখ ফেরানো যায় না। শ্যাম বর্ণ লম্বাটে মুখের মধ্যে সবকিছু হারানো খোয়ানোর স্থির একটা ছবি যেন। যেন, লোকটা সারাক্ষণ কী ভাবছে তার কোন সমাধান হচ্ছে না, তাই ভারি অন্যমনস্ক।
জহির একবার দ্বিধা করল–তুমি না আপনি? জিগ্যেস করল, কী চাই?
লোকটা এবারও কোন জবাব দিল না। তার মোটা পাজামা থেকে পানি নিংড়ে শার্টের খুঁট দিয়ে মুখ মুছল। বড় পরিতৃপ্ত দেখাল তাকে তখন।
ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি তখন থেকে থ। জহির কিছু বুঝতে না পেরে চম্পার কাঁধে হাত রাখল, চম্পা সেটা সরিয়ে দিল কাঁধ নামিয়ে–কিন্তু দুজনের কারো মন ছিল না তাতে। তারা দেখছে লোকটাকে। আর লোকটা তখন হাঁটু গেড়ে আগুনের পাশে বসে হাত সেঁকছে। একমনে।
আর সহ্য হল না জহিরের। এতোক্ষণ কথার জবাব না পেয়ে মেজাজ সপ্তমে ওঠবারই কথা। হয়তো একটা কিছু করতে যাচ্ছিল, তার আগেই চম্পা হাতের সিগারেটটা আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধোল, থাকো কোথায়?
লোকটা ফিরে তাকাল চম্পার দিকে। অস্পষ্ট একটা হাসিতে এক পলকের জন্যে মুখটা আলো হয়ে উঠল তার। এক হাতে বিশেষ কোন দিকে না দেখিয়ে, যার মানে যে–কোন দিকে হতে পারে, বলল, ওদিকে। তার কণ্ঠ শোনান অদ্ভুত, যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটা গম্ভীর ঘে। সে কণ্ঠ সবাইকে অবশ করে দিয়ে গেল। বিশেষ করে জহিরকে।
লোকটা চম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, বিষ্টিটা এখুনি যাবে। আমি দেখে এসেছি, ওদিকে আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে।
ওদিকে বলতে কোন দিক বোঝাল কে জানে। হঠাৎ সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, এ–কী! তারা দেখা যাচ্ছে। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, বাতাস নেই– একেবারে ছবির মতো।
আকাশ থেকে তাড়াতাড়ি চোখ ফেরাল চম্পা। লোকটা তখন একমনে তার জামা শুকোচ্ছে আগুনে। কী একটা বলতে গেল চম্পা, পারল না। লোকটা এমন তন্ময় হয়ে আছে যে সাহস হলো না।
তাকে সম্ভ্রম করে পটকাও কেৎলিটা নাবিয়ে নিয়ে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। তার পানিও গরম হয়ে গিয়েছিল; সে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল চা বানাতে। আর বৃষ্টি থেমেছে দেখে জহির তাড়াতাড়ি দৌঁডুল সাজঘরের দিকে।
সেখানে গিয়ে প্রফেসরকে সে পেল না। স্টেজে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানে তিনি একটা চেয়ারে বসে আছেন, পা দোলাচ্ছেন। তাকে গিয়ে বলল, বিষ্টি তো নেই!
নেই মানে?
ধরে গেছে।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর। জহিরকে ধমক দিয়ে বললেন, তা হ্যাঁ করে আমার চেহারা দেখছো কী? সামাদ কই, ব্যাণ্ডপার্টি গেল কোন চুলোয়? বাজনা বাজাক, টিকিট ঘরটা খুলে দিচ্ছে না কেন? আমি মরে গেছি নাকি, বলে কী এরা, চম্পা–চম্পা।
আবার সেই ডাক। কিন্তু এ ডাক শুনতে পেল না সে এবার। সে তখন কথা জুড়ে দিয়েছে সেই লোকটার সঙ্গে, পটকা চা এনে দিয়েছে, চুমুক দিতে দিতে।
কী নাম?
আল্লারাখা।
হি হি হি।
আল্লারাখা তখন খাড়ানাকের সঙ্গে ড্রামটা আগুনের ওপর ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গরম করছে। চম্পাকে হাসতে শুনে এক পলক চোখ তুলেই নাবিয়ে নিল। তারপর নিচু গলায় কৈফিয়ত দিল, আমার সব ভাইবোনগুলো হতো আর মরে যেতো। তাই সবশেষে আমি যখন হলাম, মা নাম রাখলেন আল্লারাখা। আমি কী করব?
হি হি। বাহ নিজের নাম কেউ বদলাতে পারে না নাকি? আমার বাবাও নাম বদলেছে। তুমি বদলাবে?
লোকটা খুব উৎসাহী হয়ে উঠল। চম্পার দিকে হঠাৎ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধোল, আমাকে তোমরা নেবে?
নেবো মানে? হকচকিয়ে গেল চম্পা।
দলে।
না বাপু, আমাদের লোক দরকার নেই।
তাহলে নাম বদলে কী হবে?
তখন প্রফেসরের পেছনে এলো জহির। দেখেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।
এ লোকটা আছে এখনো? আঁ? চম্পা, এতো হাসি কিসের?
প্রফেসর কিছু বুঝতে না পেরে একবার চম্পার দিকে একবার লোকটার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলেন। আরো খিলখিল করে হেসে উঠল চম্পা।
বাবা, বলে নাম আল্লারাখা। হি হি হি।
লোকটা আগুনের ওপর ড্রামটা ধরে রেখে আড়চোখে দেখছিল চম্পাকে, তার কপালের ওপর আধখানা চাঁদের মতো দুলতে থাকা একগুচ্ছ চুল। আর ভাবছিল, সে পারতো, সে এক্ষুনি অবাক করে দিতে পারতো চম্পাকে, যদি চম্পার ঐ চুলের চাঁদ সে একটুখানি স্পর্শ করতে পারতো।
হাসির সঙ্গে সঙ্গে নেচে উঠছিল চম্পার কপালে সেই চুলের গুচ্ছ। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বুঝি আল্লারাখা। হঠাৎ এক অঘটন ঘটল। হাত থেকে ড্রামটা পড়ে গেল গনগনে আগুনে। ভাল করে বোঝার আগেই পটাস করে একটা শব্দ হল খোল ফেটে যাওয়ার, তারপর উঠতে লাগল চামড়া পোড়ার কটু গন্ধ।
হতভম্ব হয়ে গেল সবাই। বেওকুফের মতো উঠে দাঁড়াল আল্লারাখা। খাড়ানাক আর চালকুমড়ো ড্রামটাকে কোনরকমে তুলে বারান্দার নিচে বৃষ্টির জমা পানিতে ছুঁড়ে ফেলল।
ঝাঁপিয়ে পড়ে আল্লারাখার কলার চেপে ধরল জহির। তোকে ড্রাম ধরতে বলেছিল কে। বলেই এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিল সে, যার টাল সামলাতে অনেকক্ষণ লাগল আল্লারাখার।
প্রফেসর বললেন, চম্পা, আমি বুঝতে পারছি না আমার ওপর এতো গজব কেন?
কী হয়েছিল, চম্পা থরথর করে কাঁপছিল। প্রফেসর তাকেই ধমকাতে লাগলেন, এখন ড্রামটাও পুড়ল। এইটার দাম কতো জানিন? আমাকে কাটলেও দশটা ফালতু টাকা বেরোবে না। কোত্থেকে এ উজবুক এলোরে? চম্পা?
পানিতে চুবিয়ে ড্রামটা আবার বারান্দায় তুলে এনেছে খাড়ানাক আর চালকুমড়ো। গোলমাল শুনে সামাদ, পটকা আর বোচানাকও ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সামাদ বলে উঠল, ব্যাটা মিচকে যেন কিছু জানে না। বোবা নাকি?
আল্লারাখা ড্রামটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর চম্পা আর প্রফেসরকে বলল, ফ্রেমটা বেঁচে গেছে। একটা খোল পেলে আমি ছেয়ে দিতে পারতাম। আশেপাশে সে তাকাল, যেন এখানেই কোথাও এক আধটা খোল পাওয়া যাবে।
হুংকার দিয়ে উঠল জহির, ছেয়ে দিতে পারতাম! শুয়ার কা বাচ্চা। তোর পিঠ থেকে চামড়া তুলে আমি খোল বানাবো আজ।
একটা কিছু নেই এখানে? আল্লারাখা বিড়বিড় করে বলল, যার অর্থ কেউ বুঝতে পারল না।
প্রফেসর ড্রামের কাছে উবু হয়ে বসে হাত বুলোতে লাগলেন পোড়া খোলর ওপর, যেন এক্ষুনি তিনি যাদুবলে ভাল করে দিতে পারবেন। মন্ত্র পড়ার মতো তিনি বলে চললেন, আমার কাছে বলে একটা পয়সা টাকার সমান। এটাকে ঢোকাল কে এখানে? কোত্থেকে এলোরে গরুটা। আমাকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেলরে চম্পা।
এতোক্ষণে চম্পার মনে পড়ল কপালের ওপর একগুচ্ছ চুল তখন থেকে সুড়সুড় করছে। সেটাকে হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে তার চোখে চোখ পড়ল আল্লারাখার। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চম্পার দিকে।
আবার মেয়েছেলের দিকে চোখ! জহির ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল আল্লারাখার গালে।
যেন আগুন ধরিয়ে দিল কেউ। চোখের ওপর থেকে চম্পার চেহারা মুছে গেল। আল্লারাখা ঘুরে পড়তে পড়তে কাঠের মোটা থামের সঙ্গে মাথা ঠুকে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ফুলে উঠল কপালের বাঁ দিক টোম্যাটোর মতো।
প্রফেসর আর্তনাদ করে উঠলেন, চম্পা, ওকে মারিস নে। মরে যাবে যে। আবার সেই শব্দহীন কান্না।
চম্পা বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোথায় মারছি!
আল্লারাখা একবার আকুল হয়ে প্রফেসরকে দেখবার চেষ্টা করল ব্যথা ভুলে। কিন্তু ভয় করল আবার যদি চম্পার দিকে চোখ পড়ে তার। পটকা আর বোচানাক তাকে টেনে তুলল পায়ের ওপর। কপালটা দেখে দুজনে দাঁত বার করে বলল, মাথা ফাটেনি ওস্তাদ। অ্যাকটিং করছে।
জহির তখন গজরাচ্ছে, মারবে না, শালাকে সোহাগ করবে।
জহিরের মুখের কথা মাটিতেও পড়তে পায়নি, এমন সময় বাইরে একটা প্রচণ্ড হৈচৈ ফেটে পড়ল। অনেকগুলো তোক একসঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করছে আর টাউন হলের টিনের বেড়ায় পড়ছে দমাদম ইট–পাটকেল। আল্লারাখার হাত ছেড়ে দিয়ে পটকা কানখাড়া করে বলল, কী যেন শুনছি? ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেল।
ভয় পাবার কথাই। শখানেক লোক কোত্থেকে একসঙ্গে হয়েছে, অন্ধকারে তাদের ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, রাস্তাটা ভরে গেছে, শুধু চিৎকার শোনা যাচ্ছে আর ইট–পাটকেল। ভেঙে পড়া প্ল্যাকার্ডটার ওপর কয়েকজন বেদম নাচছে আর লাথি মারছে। আবার কেউ আমলকি গাছ বেয়ে উঠে গেছে ওপরে, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ল হলের ছাদের ওপর। বিকট একটা শব্দ হল।
বেরিয়ে আয় ম্যাজিকের বাচ্চা। বেরিয়ে আয়। ঘুড়িটা গেল কোথায়? কোন ভাগাড়ে মরল সব? চালাকির জায়গা পাওনি বদমাশ!–এই রকম সব হাঁকডাক চলছে। কেউ আবার চিৎকার করে উঠছে, নাজিম পাশা–সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করছে সবাই ধ্বংস হোক। আরেকবার একজন হাক দিল কুড়িগ্রাম– আবার সমবেত চিৎকার ছাড়তে হবে। কে যেন এরিমধ্যে ফোড়ন কাটল, যাদু মেরে হাওয়া হয়ে গেল নাকি বাপ! অমনি দুপ-দাপ পড়তে লাগল ইট। ছাদে যে লোকটা লাফিয়ে পড়েছিল সে উপুড় হয়ে কঁকিয়ে উঠল, আমি ভাই আমি। একটা ঢিল এসে লেগেছে তার। কিন্তু তার কণ্ঠ কেউ শুনতেই পেল না।
জহির উঁকি মেরে ব্যাপার দেখেই ছুট দিল। হাঁফাতে হাঁফাতে প্রফেসরকে গিয়ে খবর বলল, পাবলিক খেপেছে।
হ্যাঁই! পাবলিক খেপেছে? কেন?
কী জানি!
প্রফেসর তিরিশ বছর ধরে ম্যাজিক দেখিয়ে খাচ্ছেন। লোকের নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর জানা। কিন্তু তিনিও যেন ঘাবড়ে গেলেন আজ। কারণ, কোন কারণ খুঁজে পেলেন না তিনি কেন ওরা খেপতে পারে। কাল রাতের শো–তো চমৎকার গেছে। আর আজ শো হলই বা কোথায় যে ওরা খেপবে? বেওকুফের মতো তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন দলের সবার দিকে।
চম্পা বলল, জহির তুমি একবার যাও না, দেখে এসো কী ব্যাপার।
প্রফেসর যেন এই সোজা কথাটাই এতোক্ষণ মাথা থেকে বার করতে পারছিলেন না। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, হ্যাঁ চম্পা, ও যাক, দেখে আসুক।
দড়াম করে একটা ইট এসে পায়ের কাছে দশ টুকরো হয়ে ছিটিয়ে পড়ল।
ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি নিমেষে অন্তর্হিত হল ঘরের মধ্যে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর। তারপর চম্পার দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলেন, চম্পা, শিগগীর ঘরে যা, খিল দে। পরমুহূর্তেই ফাঁকা হয় গেল বারান্দা।
একা আল্লারাখা দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে, কেউ তাকে লক্ষও করল না। বাইরে যে এভোবড় একটা গোলমাল চলছে তার যেন কোন প্রতিক্রিয়াই নেই আল্লারাখার মুখে। সে নিঃশব্দে তার ডান হাতের আঙুলগুলো চোখের সামনে তুলে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।
বাইরে একজন হঠাৎ হৈহৈ করে উঠল, ঐ যে ঐ বেরিয়েছে।
সবাই তখন চোখ তুলে দেখে দোতলার বারান্দায় এক মূর্তি; জহির এসে দাঁড়িয়েছে ওপরতলায় মেয়েদের গ্যালারির পাশে ছোট্ট ঝোলানো বারান্দায়। ক্ষীণকণ্ঠে সে দুহাত তুলে বলল, শান্ত হোন ভাইসব! ভাইসব, আপনারা শান্ত হোন।
সবাই একটু চুপ করল। এক মুহূর্তের জন্যে। কে একজন বলল, আরে, এটা তো সাকরেদটা। সঙ্গে সঙ্গে আবার গোলমাল শুরু হয়ে গেল।
সাহস থাকে, তোর ওস্তাদকে বেরিয়ে আসতে বল।
মার, মার শালাকে।
আবার উড়তে লাগল থান ইট! জহির কোনরকমে দৌড়ে পালাতে গিয়ে অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নষ্ট করবার মতো সময় নেই। তক্ষুনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গ্যালারির দরোজাটা বন্ধ করে হাঁফাতে লাগল সে।
সাজঘরে প্রফেসর চম্পাকে জড়িয়ে ধরে ঠক ঠক করে কাঁপছিলেন। এ শহরে কি পুলিশ নেই? আইন নেই? তার মনে হচ্ছিল যেন এ যান বাচলেও বিশ্বাস হবে না, বেঁচেছেন। চম্পাকে ডাকাতি করে নিয়ে যাবে নাকি? ভরসা কী! যোয়ান মেয়েছেলে, তার ওপর শো এর মেয়ে, কোন কর্তার চোখ পড়েছে আল্লা জানে। প্রফেসর বিড়বিড় করে চম্পাকে বললেন, ভয় করিস না চম্পা। ভয় করিস না। দরজা বন্ধ আছে।
কিন্তু চম্পারও ততোক্ষণে ভয় করতে শুরু করেছে। ছাদের ওপর পর পর দুটো ইট এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাঙ্কের ওপর বসে পড়ল বাপ মার মেয়ে।
কোলাহল শুনে মনে হল, ওরা এবার হলের মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। স্পষ্ট গলা শোনা যাচ্ছে নাজিম পাশা– ধ্বংস হোক। এমনকি স্টেজের ওপরেও দুপদাপ শুরু হয়ে গেছে। চড়চড় করে পর্দাটা ছিঁড়ে পড়ল বুঝি।
হঠাৎ সব চুপ। বিশ্বাস হল না প্রফেসরের। ভাবলেন, তাঁর কান খারাপ হয়ে গেল নাকি? চম্পার মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন, চম্পাও অবাক হয়ে মাথা তুলেছে।
সত্যি, একেবারে নিঃশব্দ। পিন পড়লেও শোনা যাবে। কী ব্যাপার? থেমে গেল কেন সব? পুলিশ?
গ্যালারির নিচে লুকিয়ে ছিল জহির, সেও হামাগুড়ি দিয়ে বেরুল। ব্যাণ্ডপার্টির চারমূর্তি ঘরের খিল খুলে উঁকি দিল।
সাজঘর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর আর চম্পা।
তারা সবাই দেখল, স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আল্লারাখা। আর জনতা সারা হলে যে যেখানে ছিল স্থাণুর মতো স্থির হয়ে আছে। হ্যাঁজাকে তেল পোড়ার সুমসুম শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
প্রফেসর কি স্বপ্ন দেখছেন?
চম্পার কপালের ওপর চাঁদের মতো আবার সেই একগুচ্ছ চুল লাফিয়ে পড়ল।
বিস্ময়ে চোয়াল স্কুলে পড়ল জহিরের।
আল্লারাখা এক হাত তুলল, সময় নিয়ে সবার চোখ বুলিয়ে আনল, তারপর সেই মেঘের মতো কণ্ঠ ধ্বনিত হল সারা হলে।
দেখুন, এটা আপনাদের নিজেদের ক্ষতি। নিজেদের টাউন হল নিজেরাই ভাঙছেন, আপনাদের যা বলবার আছে বলুন, হৈচৈ করবেন না।
কেউ কোন উত্তর দিল না।
বলুন।
কেউ নড়ল না। যেন কারো আর একফোঁটা শক্তি নেই মনে কিংবা শরীরে। এমনকি অনেককে লজ্জিত দেখাল, বিব্রত মনে হল।
তাহলে আপনাদের কিছু বলবার নেই? আল্লারাখার গম্ভীর কণ্ঠ আবার বৃথাই ঘুরে বেড়াল সারা হলে। তখন সে স্টেজ থেকে চলে যাবার জন্যে মুখ ফেরাল।
জনতার একজন হঠাৎ কথা বলে উঠল। থামল আল্লারাখা।
বিষ্টিতে আমাদের জিনিশপত্র সব ভেসে গেছে। নৌকাডুবিতে মরেছে তেরোজন। মসজিদের ছাদ ভেঙে পড়েছে।
তখন আরেকজন যোগ দিল, শুনছি, রেল লাইন ডুবে গেছে, আজ আর ট্রেন আসবে না।
হাটে যারা দোকান দিয়েছিল, সব ভেসে গেছে রাস্তার ফকির হয়ে গেছে বড় বড় ব্যাপারীরা।
এবার কয়েকজন একসঙ্গে বলল, এ মওসুমে কোনদিন এমন বিষ্টি হয় না।
আল্লারাখা সবার কথা শুনল। এক বুড়ো এবার ভিড় ঠেলে কাছে এলো তার। চোখে বোধহয়। ভাল দেখতে পায় না। চোখ পিটপিট করে সে বলল, এ বিষ্টি তো আসবার কথা না বাবা। যাদুতে কী না হয়? এ যাদুর কীর্তি। তোমাদের কীর্তি। আমি বাবা অনেক দেখেছি। কাল তোমরা এসেছ, আর অমনি ঝড় তুফান।
সবাই হৈহৈ করে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ সব যাদু চলবে না। টাকা দিয়ে যেতে হবে। কই হে, কার কতো বলো।
ভিড় হঠাৎ এগিয়ে আসছিল, আল্লারাখা হাত তুলতে সবাই থেমে গেল। উইংসের আড়াল থেকে চম্পা ফিসফিস করে বলল, বাবা, লোকটার কথা ওরা এতো শুনছে কেন? কী জানি। বোধহয় কিছু জানে?
প্রফেসর আর চম্পার দৃষ্টি বিনিময় হল, যার অর্থ একমাত্র যাদুকরেরাই বোঝে।
আল্লারাখা তখন বলে চলেছে, শুনুন, বিষ্টি এনে প্রফেসর নাজিম পাশার কোন লাভ নেই। বরং বিষ্টি হলে তার শো হবে না। বিষ্টি দেখে তিনি নিজেও খুব মন খারাপ করেছিলেন। তারই তো ক্ষতি। আজ হাটের দিন, আজ অনেক দূর থেকে সবাই আপনারা আসবেন, বিষ্টি এনে নিজের শো নষ্ট করে তার কী লাভ?
এ কথার জবাব কেউ দিতে পারল না। এবারে সবাইকে উসখুস করতে দেখা গেল বেরিয়ে যাবার জন্যে। মাথা নিচু করে ফেলেছে জনতা। যে বুড়োটা স্টেজের কাছে এসেছিল সে আমতা আমতা করতে লাগল।
আপনারা বলছিলেন প্রফেসর নাজিম পাশা লুকিয়ে আছেন। মিথ্যে। তিনি আপনাদের সামনেই আছেন। দেখুন।
আল্লারাখা থামবার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্টেজে এসে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তার পেছনে চম্পা। চম্পার পর জহির, সামাদ, ব্যাপার্টির চারমূর্তি। জনতা হাততালি দিয়ে উঠল একসঙ্গে। হাসিতে ঝলমল করে উঠল প্রত্যেকের মুখ। তরঙ্গের মতো উঠতে পড়তে লাগল হাততালির শব্দ। উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠল টাউন হল।
দেখুন, এটা কী?
গোলাপ। শখানেক কণ্ঠ উত্তর দিল একসঙ্গে।
আল্লারাখার হাতে একটা গোলাপ। লাল, তার ভারি সুগন্ধ, বিরাট। এক মুহূর্ত আগে গোলাপটা কোথাও ছিল না, সে একবারও হাত পকেটে ঢোকায়নি, তবু কোত্থেকে তার হাতে এলো কেউ ভাবল না। যেন সারাক্ষণই ওটা তার সঙ্গে ছিল। তখন আল্লারাখা চম্পার কপালের ওপর লুটিয়ে পড়া আধখা চঁড়ের মতো চুলের গুচ্ছ স্পর্শ করল– আরেকটা গোলাপ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।
হাততালি দিয়ে উঠল জনতা। এবারে আরো প্রবল। চমকে উঠল চম্পা। এ–কী? তার সারা শরীর এক নিমেষে গোলাপের সুবাসে ভরে উঠেছে। বিস্ময় নিয়ে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল আল্লারাখার দিকে।
আল্লারাখা তখন প্রফেসরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্রফেসর একবার বিব্রত হয়ে হাসতে চেষ্টা করলেন। সে বলল, আপনার কাছেও অনেক গোলাপ আছে! দিন এরা অনেক দূর থেকে এসেছে। খুশি হবে। তবেই তো ওরা জানবে, আপনি ওদের ভাল চান। প্রফেসর প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলেন। তার পকেটে গোলাপ আসবে কোত্থেকে?
তখন আল্লারাখা মাফ করবেন বলে প্রফেসরের পকেটে হাত ঢোকাল, বের করে আনল একমুঠো গোলাপ। রক্তের মতো টকটকে লাল, তাজা, যেন এইমাত্র বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে। সুগন্ধে ভরে গেল সারা স্টেজ। চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল আল্লারাখার মুখ।
হঠাৎ লোকটা যেন খ্যাপা হয়ে গেলে। পাগলের মতো যেখানে হাত দিল সেখান থেকেই বেরুল গোলাপ। সে ছুঁড়ে দিতে লাগল গোলাপ জনতার মধ্যে। একশ, দুই শ, তিন শ, শত শত। তার আর শেষ নেই। চেয়ার, টুল, দরোজা, চুল, কান, আস্তিন, মেঝে– সারা হল থেকে বেরুচ্ছে গোলাপ। জনতার মধ্যে নেমে এসে সবার শরীর স্পর্শ করছে আল্লারাখা, আর বেরিয়ে আসছে গোলাপ। সবার হাত ভরে গেল, পকেট উপচে উঠল, সারা হল সুগন্ধে মম করতে লাগল– তবু শেষ হল না। বিদ্যুৎগতিতে চলছে আল্লারাখার দশ আঙুল, যেন এক সঙ্গে অনেকগুলো পাখির ডানা ঝটপট করছে আর তা থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে রক্তগোলাপ।