যোগাযোগ-2
বিপ্রদাস নবগোপালকে ডেকে বললে, “নবু, আড়ম্বরে পাল্লা দেবার চেষ্টা,—ওটা ইতরের কাজ।”
নবগােপাল বললে, “চতুর্মুখ তাঁর পা ঝাড়া দিয়েই বেশি মানুষ গড়েছেন; চারটে মুখ কেবল বড়াে বড়াে কথা বলবার জন্যেই। সাড়ে পনেরাে আনা লােক যে ইতর, তাদের কাছে সম্মান রাখতে হলে ইতরের রাস্তাই ধরতে হয়।”
বিপ্রদাস বললে, “তাতেও তুমি পেরে উঠবে না। তার চেয়ে সাত্ত্বিকভাবে কাজ করি, সে দেখাবে ভালাে। উপযুক্ত ব্রাহ্মণপণ্ডিত আনিয়ে আমাদের সামবেদের মতে বিশুদ্ধভাবে অনুষ্ঠান পালন করব। ওরা রাজা হয়েছে করুক আড়ম্বর; আমরা ব্রাহ্মণ, পুণ্যকর্ম আমাদের।”
নবগােপাল বললে, “দাদা, পাঁজি ভুলেছ, এটা সত্যযুগ নয়। জলের নৌকো চালাতে চাও পাঁকের উপর দিয়ে। তােমার প্রজারা আছে,— তিনু সরকার আছে তােমার তালুকদার,—ভাদু পরামানিক, কমরদ্দি বিশ্বেস, পাঁচু মণ্ডল,—এরা কি তােমার ওই কাঁচকলাভাতে হবিষ্য়ি-করা বামনাইয়ের এক অক্ষর মানে বুঝবে? এরা কি যাজ্ঞবন্ধ্যের প্রপৌত্র? এদের যে বুক ফেটে যাবে। তুমি চুপ করে থাকো, তােমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”
নবগােপাল প্রজাদের সঙ্গে মিলে উঠে-পড়ে লাগল। সবাই বুক ঠুকে বললে, টাকার জন্যে ভাবনা কী? আমলা ফয়লা পাইক বরকন্দাজ সবারই গায়ে চড়ল নতুন লাল বনাতের চাদর, রঙিন ধুতি। সালুতেমােড়া ঝালর-ঝােলানাে নিশেন-ওড়ানাে এক নহবতখানা উঠল, সাত ক্রোশ তফাত থেকে তার চুড়ো দেখা যায়। দুই শরিকে মিলে তাদের চার-চার হাতি বের করলে, সাজ চড়ল তাদের পিঠে, যখন-তখন বিনা কারণে ঘােষালদিঘির সামনের রাস্তায় শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে তারা টহলিয়ে বেড়ায়, গলায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে থাকে। আর যাই হােক, পাটের বস্তা থেকে হাতি বের হয় না, এই বলে সকলেই দুই পা চাপড়ে হাে হো করে হেসে নিলে।
অঘ্রানের সাতাশে পড়েছে বিয়ের দিন; এখনও দিনদশেক বাকি। এমন সময় লােকমুখে জানা গেল, রাজা আসছে দলবল নিয়ে। ভাবনা পড়ে গেল, কর্তব্য কী। মধুসূদন এদের কাছে কোনাে খবর দেয় নি। বুঝি মনে করেছে ভদ্রতা সাধারণ লােকের, অভদ্রতাই রাজোচিত। এমন অবস্থায় নিজেরা গায়ে পড়ে স্টেশন থেকে ওদের এগিয়ে আনতে যাওয়া কি সংগত হবে? খবর না-দেওয়ার উচিত জবাব হচ্ছে খবর না-নেওয়া।
সবই সত্য, কিন্তু যুক্তির দ্বারা সংসারের দুঃখ ঠেকানাে যায় না। কুমুর প্রতি বিপ্রদাসের গভীর স্নেহ; পাছে তাকে কিছুতেই আঘাত করে এ-কথাটা সকল তর্ক ছাড়িয়ে যায়। মেয়েদের পীড়ন করা এতই সহজ; তাদের মর্মস্থান চারদিকেই অনাবৃত। জবরদস্তের হাতেই সমাজ চাবুক জুগিয়েছে; আর যারা বর্মহীন তাদের স্পর্শকাতর পিঠের দিকে কোনাে বিধিবিধান নজর করে না। এমন অবস্থায় স্নেহের ধনকে রােষ-বিদ্বেষ-ঈর্ষার তুফানে ভাসিয়ে দিয়ে নিজের অভিমান বাঁচাবার চেষ্টা করা কাপুরুষতা, বিপ্রদাসের মনের এই ভাব।
বিপ্রদাস কাউকে না-জানিয়ে ঘােড়ায় চড়ে গেল স্টেশনে। গাড়ি এসে পৌঁছল, তখন বেলা পাঁচটা। সেলুন-গাড়ি থেকে রাজা নামল দল বল নিয়ে। বিপ্রদাসকে দেখে শুষ্ক সংক্ষিপ্ত নমস্কার করে বললে, এ কী, আপনি কেন কষ্ট করে?”
বিপ্রদাস। বিলক্ষণ। এই প্রথম আসা আমার দেশে, অভ্যর্থনা করে নেব না?
রাজা। ভুল করছেন। আপনার দেশে এখনও আসি নি। সে হবে বিয়ের দিনে।
বিপ্রদাস কথাটার মানে বুঝতে পারলে না। স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে তর্ক করবার জায়গা নয়—তাই কেবল বললে, “ঘাটে বজরা তৈরি।”
রাজা বললে, “দরকার হবে না, আমাদের স্টীমলঞ্চ এসেছে।”
বিপ্রদাস বুঝলে সুবিধে নয়। তবু আর-একবার বললে, “খাওয়া-দাওয়ার জিনিস-পত্র, রসুইয়ের নৌকো সমস্তই প্রস্তুত।”
“কেন এত উৎপাত করলেন! কিছুই দরকার হবে না। দেখুন, একটা কথা মনে রাখবেন, এসেছি আমার পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিতে— আপনাদের দেশে না। বিয়ের দিনে সেখানে যাবার কথা।”
বিপ্রদাস বুঝলে কিছুতেই নরম হবার আশা নেই। বুকের ভিতরটা দমে গেল। স্টেশনের বসবার ঘরে কেদারায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার হয়ে এসেছে। উত্তর থেকে গাড়ি আসবার জন্যে ঘণ্টা পড়ল, স্টেশনে আলো জ্বলল,—লাগাম ছেড়ে ঘোড়াকে নিজের মরজিমতো চলতে দিয়ে বিপ্রদাস যখন বাড়ি ফিরলে তখন যথেষ্ট রাত। কোথায় গিয়েছিল, কী ঘটেছিল, কাউকে কিছুই বললে না।
সেইদিন রাত্রে ওর ঠাণ্ডা লেগে কাশি আরম্ভ হল। ক্রমেই চলল বেড়ে। উপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যামোটাকে আরও উসকে তুললে। শেষকালে কুমু ওকে অনেক ধরে কয়ে এনে বিছানায় শোওয়ায়। অনুষ্ঠানের সমস্ত ভারই পড়ল নবগোপালের উপর।
দু-দিন পরেই নবগোপাল এসে বললে, “কী করি একটা পরামর্শ দাও।”
বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন? কী হয়েছে?”
“সঙ্গে গোটাকতক সাহেব,—দালাল হবে, কিংবা মদের দোকানের বিলিতি শুঁড়ি, কাল পীরপুরের চরের থেকে কিছু না হবে তো দু-শ কাদাখোঁচা পাখি মেরে নিয়ে উপস্থিত। আজ চলেছে চন্দনদহের বিলে। এই শীতের সময় সেখানে হাঁসের মরসুম—রাক্ষুসে ওজনের জীবহত্যা হবে,অহিরাবণ মহীরাবণ হিড়িম্ব ঘটোৎকচ ইস্তিক কুম্ভকর্ণের পর্যন্ত পিণ্ডি দেবার উপযুক্ত,—প্রেতলােকে দশমুণ্ড রাবণের চোয়াল ধরে যাবার মতাে।”
বিপ্রদাস স্তম্ভিত হয়ে রইল, কিছু বললে না।
নবগােপাল বললে, “তােমারই হুকুম ওই বিলে কেউ শিকার করতে পাবে না। সেবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেটকে পর্যন্ত ঠেকিয়েছিলে— আমরা তো ভয় করেছিলুম তােমাকেও পাছে সে রাজহাঁস ভুল করে গুলি করে বসে। লােকটা ছিল ভদ্র, চলে গেল। কিন্তু এরা গাে-মৃগ-দ্বিজ কাউকে মানবার মতো মানুষ নয়। তবু যদি বল তো একবার না হয়—”
বিপ্রদাস ব্যস্ত হয়ে বললে, “না না, কিছু বােলাে না।”
বিপ্রদাস বাঘ শিকারে জেলার মধ্যে সব-সেরা। কোনাে একবার পাখি মেরে তার এমন ধিক্কার হয়েছিল যে, সেই অবধি নিজের এলেকায় পাখি মারা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।
শিয়রের কাছে কুমু বসে বিপ্রদাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নবগােপাল চলে গেলে সে মুখ শক্ত করে বললে, “দাদা, বাবণ করে পাঠাও।”
“কী বারণ করব?”
“পাখি মারতে।”
“ওরা ভুল বুঝবে কুমু, সইবে না।”
“তা বুঝুক ভুল। মান-অপমান শুধু ওদের একার নয়।”
বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে মনে-মনে হাসলে। সে জানে কঠিন নিষ্ঠার সঙ্গে কুমু মনে-মনে সতীধর্ম অনুশীলন করছে। ছায়েবানুগতাস্বচ্ছা। সামান্য পাখির প্রাণ নিয়ে কায়ার সঙ্গে ছায়ার পথভেদ ঘটবে না কি?
বিপ্রদাস স্নেহের স্বরে বললে, “রাগ করিস নে কুমু, আমিও একদিন পাখি মেরেছি। তখন অন্যায় বলে বুঝতেই পারি নি। এদেরও সেই দশা।”
অক্লান্ত উৎসাহের সঙ্গে চলল শিকার, পিকনিক, এবং সন্ধ্যেবেলার ব্যাণ্ডের সংগীতসহযােগে ইংরেজ অভ্যাগতদের নাচ। বিকালে টেনিস; তা ছাড়া দিঘির নৌকোর ’পরে তিন-চার পর্দা তুলে দিয়ে বাজি রেখে পালের খেলা;—তাই দেখতে গ্রামের লােকেরা দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাত্রে ডিনারের পরে চীৎকার চলে, “ফর হী ইজ এ জলি গুড ফেলো।” এই সব বিলাসের প্রধান নায়কনায়িকা সাহেব-মেম, তাতেই গাঁয়ের লােকের চমক লাগে। এরা যে সােলার টুপি মাথায় ছিপ ফেলে মাছ ধরে, সেও বড়ো অপরূপ দৃশ্য। অন্য পক্ষে লাঠিখেলা কুস্তি নৌকোবাচ যাত্রা শখের থিয়েটার এবং চারটে হাতির সমাবেশ এর কাছে লাগে কোথায়?
বিবাহের দুদিন আগে গায়ে-হলুদ। দামি গহনা থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাত যা বরের বাসা থেকে এল তার ঘটা দেখে সকলে অবাক। তার বাহনই বা কত! চাটুজ্যেরা খুব দরাজ হাতেই তাদের বিদেয় করলে।
অবশেষে জনসাধারণকে খাওয়ানাে নিয়ে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের দ্রোণপর্ব শুরু হল।
সেদিন ঢােল পিটিয়ে সর্বসাধারণের নিমন্ত্রণ মধুসাগরের তীরে মধুপুরীতে। রবাহূত অনাহূত কারও বাদ নেই। নবগােপাল রেগে
আগুন। এ কী আস্পর্ধা! আমরা হলুম জমিদার, এর মধ্যে উনি ওঁর মধুপুরী খাড়া করেন কোথা থেকে?
এদিকে ভােজের আয়ােজনটা খুব ব্যাপকরূপেই সকলের কাছে প্রকাশমান হয়ে উঠল। সামান্য ফলার নয়। মাছ দই ক্ষীর সন্দেশ ঘি ময়দা চিনি খুব শোরগােল করে আমদানি। গাছতলায় মস্ত-মস্ত উনন পাতা; রান্নার জন্যে নানা আয়তনের হাঁড়ি হাঁড়া মালসা কলসী জালা; সারবন্দি গােরুর গাড়িতে এল আলু বেগুন কাঁচকলা শাকসবজি। আহারটা হবে সন্ধ্যের সময় বাঁধা রােশনাইয়ের আলােয়।
এদিকে চাটুজ্যেদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজন। দলে দলে প্রজার মিলে নিজেরাই আয়ােজন করেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র জায়গা। মুসলমান প্রজার সংখ্যাই বেশি—রাত না পােয়াতেই তারা নিজেরাই রান্না চড়িয়েছে। আহারের উপকরণ যত না হোক, ঘন ঘন, চাটুজ্যেদের জয়ধ্বনি উঠছে তার চতুর্গুণ। স্বয়ং নবগােপালবাবু বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত অভুক্ত অবস্থায় বসে থেকে সকলকে খাওয়ালেন। তার পরে হল কাঙালিবিদায়। মাতব্বর প্রজারা নিজেরাই দানবিতরণের ব্যবস্থা করলে। কলধ্বনিতে জয়ধ্বনিতে বাতাসে চলল সমুদ্রমন্থন।
মধুপুরীতে সমস্তদিন রান্না বসেছে। গন্ধে বহুদূর পর্যন্ত আমােদিত। খুরি ভাঁড় কলাপাতা হয়েছে পর্বতপ্রমাণ। তরকারি ও মাছকোটার আবর্জনা নিয়ে কাকেদের কলরবের বিরাম নেই—রাজ্যের কুকুরগুলােও পরস্পর কামড়াকামড়ি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে। সময় হয়ে এল, রােশনাই জ্বলেছে, মেটিয়াবুরুজের রােশনচৌকি ইমনকল্যাণ থেকে কেদারা পর্যন্ত বাজিয়ে চলল। অনুচরপরিচরেরা থেকে-থেকে উদ্বিগ্নমুখে রাজাবাহাদুরের কানের কাছে ফিস ফিস করে জানাচ্ছে এখনও খাবার লােক যথেষ্ট এল না। আজ হাটের দিন, ভিন্ন এলেকা থেকে যারা হাট করতে এসেছে তাদের কেউ কেউ পাত-পাড়া দেখে বসে গেছে। কাঙাল-ভিক্ষুকও সামান্য কয়েকজন আছে।
মধুসূদন নির্জন তাঁবুর ভিতর ঢুকে মুখ অন্ধকার করে একটা চাপা হুংকার দিলে,—“হুঁ।”
ছোটো ভাই রাধু এসে বললে, “দাদা, আর কেন? চলো।”
“কোথায়?
“ফিরে যাই কলকাতায়। এরা সব বদমাইশি করছে। এদের চেয়ে বড়ো বড়ো ঘরের পাত্রী তোমার কড়ে আঙুল নাড়ার অপেক্ষায় বসে। একবার তু করলেই হয়।”
মধুসূদন গর্জন করে উঠে বললে, “যা চলে।”
এক-শ বছর পূর্বে যেমন ঘটেছিল আজও তাই। এবারেও একপক্ষের আড়ম্বরের চুড়োটা অন্যপক্ষের চেয়ে অনেক উঁচু করেই গড়া হয়েছিল, অন্যপক্ষ তা রাস্তা পার হতে দিলে না। কিন্তু আসল হারজিত বাইরে থেকে দেখা যায় না। তার ক্ষেত্রটা লোকচক্ষুর অগোচরে।
চাটুজ্যেদের প্রজারা খুব হেসে নিলে। বিপ্রদাস রোগশয্যায়; তার কানে কিছুই পৌঁছল না।
বিয়ের দিনে, রাজার হুকুম, কনের বাড়ি যাবার পথে ধুমধাম একেবারেই বন্ধ। আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না, সঙ্গে কেবল নিজেদের পুরোহিত, আর দুই জন ভাট। পালকিতে করে নিঃশব্দে বিয়ে বাড়িতে বর এল, লোকে হঠাৎ বুঝতেই পারলে না। ওদিকে মধুপুরীর তাঁবুতে আলো জ্বালিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে বিপরীত হৈ হৈ শব্দে বরযাত্রীর দল আহারে আমোদে প্রবৃত্ত। নবগোপাল বুঝলে এটা হল পালটা জবাব। এমন স্থলে কন্যাপক্ষ হাতে পায়ে ধরে বরপক্ষের সাধ্যসাধনা করে;—নবগোপাল তার কিছুই করলে না। একবার জিজ্ঞাসা করলে না, বরযাত্রীদের হল কী।
কুমুদিনী সাজসজ্জা করে বিবাহ-আসরে যাবার আগে দাদাকে প্রণাম করতে এল; তার সর্বশবীর কাঁপছে। বিপ্রদাসের তখন এক-শ পাঁচ ডিগ্রী জ্বর, বুকে পিঠে রাইসরষের পলস্তারা; কুমুদিনী তার পায়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে আর থাকতে পারলে না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ক্ষেমা পিসি মুখে হাত চাপা দিয়ে বললে, “ছি, ছি, অমন করে কাঁদতে নেই।”
বিপ্রদাস একটু উঠে বসে ওকে হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল—দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ক্ষেমা পিসি বললে, “সময় হল যে।”
বিপ্রদাস কুমুর মাথায় হাত দিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বললে, “সর্বশুভদাতা কল্যাণ করুন।” বলেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
বিবাহের সমস্তক্ষণ কুমুর দু-চোখ দিয়ে কেবল জল পড়েছে। বরের হাতে যখন হাত দিলে সে-হাত ঠাণ্ডা হিম, আর থরথর করে কাঁপছে। শুভদৃষ্টির সময় সে কি স্বামীর মুখ দেখেছে? হয়তো দেখে নি। এদের ব্যবহারে সবসুদ্ধ জড়িয়ে স্বামীর উপর ওর ভয় ধরে গেছে। পাখির মনে হচ্ছে তার জন্যে বাসা নেই, আছে ফাঁস।
মধুসূদন দেখতে কুশ্রী নয় কিন্তু বড় কঠিন। কালো মুখের মধ্যে যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে সে হচ্ছে পাখির চঞ্চুর মতো মস্ত বড়ো বাঁকা নাক, ঠোঁটের সামনে পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ে যেন পাহারা দিচ্ছে। প্রশস্ত গড়ানে কপাল ঘন ভ্রূর উপর বাধাপ্রাপ্ত স্রোতের মতো স্ফীত। সেই ভ্রূর ছায়াতলে সংকীর্ণ তির্যক চক্ষুর দৃষ্টি তীব্র। গোঁফদাড়ি কামানো, ঠোঁট চাপা, চিবুক ভারি। কড়া চুল কাফ্রিদের মতাে কোঁকড়া, মাথার তেলাে ঘেঁষে ছাটা। খুব আঁটসাঁট শরীর; যত বয়েস তার চেয়ে __ বােধ হয়, কেবল দুই রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। বেঁটে, মাথায় প্রায় কুমুদিনীর সমান। হাত দুটো রােমশ ও দেহের তুলনায় খাটো। সবসুদ্ধ মনে হয় মানুষটা একেবারে নিরেট; মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বদাই কী একটা প্রতিজ্ঞা যেন গুলি পাকিয়ে আছে। যেন ভাগ্যদেবতার কামান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে একাগ্রভাবে চলেছে একটা একগুঁয়ে গােলা। দেখলেই বােঝা যায় বাজে কথা বাজে বিষয় বাজে মানুষের প্রতি মন দেবার ওর একটুও অবকাশ নেই।
বিবাহটা এমন ভাবে হল যে, সকলেরই মনে খারাপ লাগল। বরপক্ষকন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পর্শমাত্রই এমন একটা বেসুর ঝনঝনিয়ে উঠল যে, তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে। থেকে-থেকে কুমুর মনের একটা প্রশ্ন অভিমানে বুক ঠেলে ঠেলে উঠছে, “ঠাকুর কি তবে আমাকে ভােলালেন?” সংশয়কে প্রাণপণে চাপা দেয়, রুদ্ধঘরের মধ্যে একলা বসে বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলে, মন যেন দুর্বল না হয়। সবচেয়ে কঠিন হয়েছে দাদার কাছে সংশয় লুকোনো।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কুমুদিনীর সেবার ’পরেই বিপ্রদাসের একান্ত নির্ভর। কাপড়চোপড়, দিনখরচের টাকাকড়ি, বইয়ের আলমারি, ঘােড়ার দানা, বন্দুকের সম্মার্জন, কুকুরের সেবা, ক্যামেরার রক্ষণ, সংগীতযন্ত্রের পর্যবেক্ষণ, শােবার বসবার ঘরের পারিপাট্যসাধন,—সমস্ত কুমুর হাতে। এত বেশি অভ্যাস হয়ে এসেছে যে, প্রাত্যহিক ব্যবহারে কুমুর হাত কোথাও না থাকলে তার রােচে না। সেই দাদার রােগশয্যায় বিদায়ের আগে শেষ কয়দিন যে-সেবা করতে হয়েছে তার মধ্যে নিজের ভাবনার কোনাে ছায়া না পড়ে এই তার দুঃসাধ্য চেষ্টা। কুমুর এসরাজের হাত নিয়ে বিপ্রদাসের ভারি গর্ব। লাজুক কুমু সহজে বাজাতে চায় না। এই দুদিন সে আপনি যেচে দাদাকে কানাড়া-মালকোষের আলাপ শুনিয়েছে। সেই আলাপের মধ্যেই ছিল তার দেবতার স্তব, তার প্রার্থনা, তার আশঙ্কা, তার আত্মনিবেদন। বিপ্রদাস চোখ বুজে চুপ করে শোনে আর মাঝে মাঝে ফরমাশ করে—সিন্ধু, বেহাগ, ভৈরবী— যে-সব সুরে বিচ্ছেদ-বেদনার কান্না বাজে। সেই সুরের মধ্যে ভাইবোন দুজনেরই ব্যথা এক হয়ে মিশে যায়। মুখের কথায় দুজনে কিছুই বললে না; না দিলে পরস্পরকে সান্ত্বনা, না জানালে দুঃখ।
বিপ্রদাসের জ্বর কাশি বুকে ব্যথা সারল না, বরং বেড়ে উঠছে। ডাক্তার বলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, হয়তো ন্যুমোনিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, খুব সাবধান হওয়া চাই। কুমুর মনে উদ্বেগের সীমা নেই। কথা ছিল বাসি-বিয়ের কালরাত্রিটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরবে। কিন্তু শোনা গেল মধুসূদন হঠাৎ পণ করেছে, বিবাহের পরদিনে ওকে নিয়ে চলে যাবে। বুঝলে, এটা প্রথার জন্যে নয়, প্রয়োজনের জন্যে নয়, প্রেমের জন্যে নয়, শাসনের জন্যে। এমন অবস্থায় অনুগ্রহ দাবি করতে অভিমানিনীর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। তবু কুমু মাথা হেঁট করে লজ্জা কাটিয়ে কম্পিতকণ্ঠে বিবাহের রাতে স্বামীর কাছে এইমাত্র প্রার্থনা করেছিল যে, আর দুটো দিন যেন তাকে বাপের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়, দাদাকে একটু ভালো দেখে যেন সে যেতে পারে। মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “সমস্ত ঠিকঠাক হয়ে গেছে।” এমন বজ্রে-বাঁধা একপক্ষের ঠিকঠাক, তার মধ্যে কুমুর মর্মান্তিক বেদনারও এক তিল স্থান নেই। তার পর মধুসূদন ওকে রাত্রে কথা কওয়াতে চেষ্টা করেছে, ও একটিও জবাব দিল না—বিছানার প্রান্তে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল।
তখনও অন্ধকার, প্রথম পাখির দ্বিধাজড়িত কাকলি শােনবামাত্র ও বিছানা ছেড়ে চলে গেল।
বিপ্রদাস সমস্ত রাত ছটফট করেছে। সন্ধ্যার সময় জ্বর-গায়েই বিবাহসভায় যাবার জন্যে ওর ঝোঁক হল। ডাক্তার অনেক চেষ্টায় চেপে রেখে দিলে। ঘন ঘন লােক পাঠিয়ে সে খবর নিয়েছে। খবরগুলাে যুদ্ধের সময়কার খবরের মতাে, অধিকাংশই বানানাে। বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “কখন বর এল? বাজনাবাদ্যির আওয়াজ তাে পাওয়া গেল না।”
সংবাদদাতা শিবু বললে, “আমাদের জামাই বড়ো বিবেচক-বাড়িতে অসুখ শুনেই সব থামিয়ে দিয়েছে—বরযাত্রদের পায়ের শব্দ শােনা যায় না, এমনি ঠাণ্ডা।”
“ওরে শিবু, খাবার জিনিস তো কুলিয়েছিল? আমার ওই এক ভাবনা ছিল, এ তো কলকাতা নয়!”
“কুলােয় নি? বলেন কী হুজুর? কত ফেলা গেল। আরও অতগুলাে লােককে খাওয়াবার মতাে জিনিস বাকি আছে।”
“ওরা খুশি হয়েছে তাে?”
“একটি নালিশ কারও মুখে শোনা যায় নি। একেবারে টুঁ শব্দটি না। আরও তাে এত এত বিয়ে দেখেছি, বরযাত্রের দাপাদাপিতে কন্যাকর্তার ভির্মি লাগে! এরা এমনি চুপ, আছে কি না-আছে বােঝাই যায় না।”
বিপ্রদাস বললে, “ওরা কলকাতার লােক কি না, তাই ভদ্র ব্যবহার জানা আছে। ওরা বােঝে যে, যে-বাড়ি থেকে মেয়ে নেবে তাদের অপমানে নিজেদেরই অপমান।”
“আহা হুজুর যা বললেন এই কথাটি ওদের লােকজনদের আমি শুনিয়ে দেব। শুনলে ওরা খুশি হবে।”
কুমু কাল সন্ধ্যের সময়েই বুঝেছিল অসুখ বাড়বার মুখে। অথচ সে যে দাদার সেবা করতে পারবে না এই দুঃখ সর্বক্ষণ তার বুকের মধ্যে ফাঁদে-পড়া পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। তার হাতের সেবা যে তার দাদার কাছে ওষুধের চেয়ে বেশি।
স্নান করে ঠাকুরকে ফুল দিয়ে কুমু যখন দাদার ঘরে এল তখনও সূর্য ওঠে নি। কঠিন রোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করে ক্ষণকাল ছুটি পাবার সময় যে অবসাদের বৈরাগ্য আসে সেই বৈরাগ্যে বিপ্রদাসের মন তখন শিথিল। জীবনের আসক্তি, সংসারের ভাবনা সব তার কাছে শস্যশূন্য মাঠের মতো ধূসরবর্ণ। সমস্ত রাত দরজা বন্ধ ছিল, ডাক্তার ভোরের বেলায় পুবদিকের জানালাটা খুলে দিয়েছে। অশথগাছের শিশির-ভেজা পাতার আড়ালে অরুণবর্ণ আকাশের আভা ধীরে ধীরে শুভ্র হয়ে আসছে,—অদূরবর্তী নদীতে মহাজনি নৌকোর বৃহৎ তালিদেওয়া পালগুলি সেই আরক্তিম আকাশের গায়ে স্ফীত হয়ে উঠল। নহবতে করুণ সুরে রামকেলি বাজছে।
পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নিচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল। কুমু খাটে এসে বসতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে দু-পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে।
বিপ্রদাসের মনে ভিতরে-ভিতরে কী একটা চিন্তার ধারা চলছিল, তাই হঠাৎ এক সময়ে অসংলগ্নভাবে বলে উঠল, “দিদি, আসলে কিছুই নয়,—কে বড়ো কে ছোটো, কে উপরে কে নিচে, এ সমস্তই বানানো কথা। ফেনার মধ্যে বুদ্বুদ্গুলোর কোন্টার কোথায় স্থান তাতে কী আসে যায়। আপনার ভিতরে আপনি সহজ হয়ে থাকিস কিছুতেই তোকে মারবে না।”
“আমাকে আশীর্বাদ করাে, দাদা, আমাকে আশীর্বাদ করো,” বলে কুমু দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চাপা দিলে।
বিপ্রদাস বালিশে ঠেস দিয়ে একটু উঠে বসে কুমুর মুখ নামিয়ে ধরে তার মাথায় চুমাে খেলে।
ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললে, “আর নয়, কুমুদিদি, এখন ওর একটু শান্ত থাকা দরকার।”
কুমু রােগীর বালিশ একটু চেপে-চুপে ঠিক করে গায়ের উপর গরম কাপড়টা টেনে দিয়ে, পাশের টিপাইটার উপরকার বিশৃঙ্খলতা একটু সেরে নিয়ে দাদার কানের কাছে মৃদুস্বরে বললে, “সেরে গেলেই কলকাতায় যেয়াে দাদা, সেখানে তােমাকে দেখতে পাব।”
বিপ্রদাস বড়াে বড়ো দুই স্নিগ্ধ চোখ কুমুর মুখের উপর স্থির রেখে বললে, “কুমু পশ্চিমের মেঘ যায় পুবে, পুবের মেঘ যায় পশ্চিমে, এ-সব হাওয়ায় হয়। সংসারে সেই হাওয়া বইছে। মেঘের মতােই অমনি সহজে এটাকে মেনে নিস দিদি। এখন থেকে আমাদের কথা বেশি ভাবিস নে। যেখানে যাচ্ছিস সেখানে লক্ষ্মীর আসন ওই জুড়ে থাকিস—এই আমার সকল মনের আশীর্বাদ। তাের কাছে আমরা আর কিছুই চাই নে।”
দাদার পায়ের কাছে কুমু মাথা রেখে পড়ে রইল। “আজ থেকে আমার কাছে আর কিছুই চাবার নেই। এখানকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমার কোনাে হাতই থাকবে না”—এক মুহূর্তে এতবড় বিচ্ছেদের কথা মনে মেনে নেওয়া যায় না। ঝড়ে যখন নৌকাকে ডাঙা থেকে টেনে নিয়ে যায় তখন নােঙর যেমন করে মাটি আঁকড়ে থাকতে চায়, দাদার পায়ের কাছে কুমুর তেমনি এই শেষ ব্যগ্রতার বন্ধন। ডাক্তার আবার এসে ধীরে ধীরে বললে, “আর নয় দিদি।” বলে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে ফেললে। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে যৈ-চৌকিটা ছিল তার উপর বসে পড়ে মুখে আঁচল দিয়ে কুমু নিঃশকে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ এক সময়ে মনে পড়ে গেল দাদার “বেসি” ঘোড়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে যাবে বলে কাল রাত্রে সে গুড়মাখা আটার রুটি তৈরি করে রেখেছিল। সইস আজ ভোরবেলায় তাকে খিড়কির বাগানে রেখে এসেছে। কুমু সেখানে গিয়ে দেখলে ঘোড়া আমড়া-গাছতলায় ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে কুমুর পায়ের শব্দ শুনেই কান খাড়া করলে এবং তাকে দেখেই চিঁহিঁ চিঁহিঁ করে ডেকে উঠল। বাঁ হাত তার কাঁধের উপর রেখে ডান হাতে কুমু তার মুখের কাছে রুটি ধরে তাকে খাওয়াতে লাগল। সে খেতে খেতে তার বড়ো বড়ো কালো স্নিগ্ধ চোখে কুমুর মুখের দিকে কটাক্ষে চাইতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে বেসির দুই চোখের মাঝখানকার প্রশস্ত কপালের উপর চুমো খেয়ে কুমু দৌড়ে চলে গেল।
বিপ্রদাস নিশ্চয় মনে করেছিল মধুসূদন এই কয়দিনের মধ্যে একবার এসে দেখা করে যাবে। তা যখন করলে না তখন ওর বুঝতে বাকি রইল না যে, দুই পরিবারের এই বিবাহের সম্বন্ধটাই এল পরস্পরের বিচ্ছেদের খড়্গ হয়ে। রোগের নিরতিশয় ক্লান্তিতে এ-কথাটাকেও সহজভাবে সে মেনে নিলে। ডাক্তারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, “একটু এসরাজ বাজাতে পারি কি?”
ডাক্তার বললে, “না, আজ থাক্।”
“তাহলে কুমুকে ডাকো, সে একটু বাজাক। আবার কবে তার বাজনা শুনতে পাব, কে জানে।”
ডাক্তার বললে, “আজ সকালে ন-টার গাড়িতে ওঁদের ছাড়তে হবে, নইলে সূর্যাস্তের আগে কলকাতায় পৌঁছতে পারবেন না। কুমুর তো আর সময় নেই।”
বিপ্রদাস নিশ্বাস ফেলে বললে, “না, এখানে ওর সময় ফুরোল। উনিশ বছর কাটতে পেরেছে, এখন এক ঘণ্টাও আর কাটবে না।”
বিদায়ের সময় স্বামীস্ত্রী জোড়ে প্রণাম করতে এল। মধুসূদন ভদ্রতা করে বললে, “তাই তো, আপনার শরীর তো ভালো দেখছি নে।”
বিপ্রদাস তার কোনো উত্তর না করে বললে, “ভগবান তোমাদের কল্যাণ করুন।”
“দাদা, নিজের শরীরের একটু যত্ন কোরো” বলে আর-একবার বিপ্রদাসের পায়ের কাছে পড়ে কুমু কাঁদতে লাগল।
হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি ঢাক-কাঁসর-নহবতে একটা আওয়াজের সাইক্লোন ঝড় উঠল। ওরা গেল চলে।
পরস্পরের আঁচলে চাদরে বাঁধা ওরা যখন চলে যাচ্ছে সেই দৃশ্যটা আজ, কেন কী জানি, বিপ্রদাসের কাছে বীভৎস লাগল। প্রাচীন ইতিহাসে তৈমুর জঙ্গিস অসংখ্য মানুষের কঙ্কালস্তম্ভ রচনা করেছিল। কিন্তু ওই যে চাদরে-আঁচলের গ্রন্থি, ওর সৃষ্ট জীবন-মৃত্যুর জয়তোরণ যদি মাপা যায় তবে তার চূড়া কোন্ নরকে গিয়ে ঠেকবে! কিন্তু এ কেমনতরো ভাবনা আজ ওর মনে!
পূজার্চনায় বিপ্রদাসের কোনোদিন উৎসাহ ছিল না। তবু আজ হাত জোড় করে মনে-মনে প্রার্থনা করতে লাগল।
এক সময়ে চমকে উঠে বললে, “ডাক্তার, ডাকো তো দেওয়ানজিকে।”
বিপ্রদাসের হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিয়ে দিতে আসবার কিছুদিন আগে যখন সুবোধকে টাকা পাঠানো নিয়ে মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, হিসাবের খাতাপত্র ঘেঁটে ক্লান্ত, বেলা এগারোটা,—এমন সময়ে অত্যন্ত বে-মেরামত গোছের একটা মানুষ, কিছু-কালের না-কামানো কণ্টকিত জীর্ণ মুখ, হাড়-বের-করা শির-বের-কর হাত, ময়লা একখানা চাদর, খাটো একখানা ধুতি, ছেঁড়া একজোড়া চটি-পরা, এসে উপস্থিত। নমস্কার করে বললে, “বড়োবাবু মনে পড়ে কি?”
বিপ্রদাস একটু লক্ষ্য করে বললে, “কী, বৈকুণ্ঠ নাকি?”
বিপ্রদাস বালককালে যে-ইস্কুলে পড়ত সেই ইস্কুলেরই সংলগ্ন একটা ঘরে বৈকুণ্ঠ ইস্কুলের বই খাতা কলম ছুরি ব্যাটবল লাঠিম আর তারই সঙ্গে মোড়কে-করা চীনাবাদাম বিক্রি করত। তার ঘরে বড়ো ছেলেদের আড্ডা ছিল—যতরকম অদ্ভুত অসম্ভব খোশগল্প করতে এর জুড়ি কেউ ছিল না।
বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “তোমার এমন দশা কেন?”
কয়েক বৎসর হল সম্পন্ন অবস্থার গৃহস্থের ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। তাদের পণের বিশেষ কোনো আবশ্যক ছিল না বলেই বরের পণও ছিল বেশি। বারোশ টাকায় রফা হয়, তাছাড়া আশি ভরি সোনার গয়না। একমাত্র আদরের মেয়ে বলেই মরিয়া হয়ে সে রাজি হয়ে ছিল। একসঙ্গে সব টাকা সংগ্রহ করতে পারে নি, তাই মেয়েকে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে ওর বাপের রক্ত শুষেছে। সম্বল সবই ফুরোল তবু এখনও আড়াইশ টাকা বাকি। এবারে মেয়েটির অপমানের শেষ নেই। অত্যন্ত অসহ্য হওয়াতেই বাপের বাড়ি পালিয়ে এসেছিল। তাতে করে জেলের কয়েদির জেলের নিয়ম ভঙ্গ করা হল, অপরাধ বেড়েই গেল। এখন ওই আড়াই-শ টাকা ফেলে দিয়ে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলে বাপ মরবার কথাটা ভাববার সময় পায়।
বিপ্রদাস ম্লান হাসি হাসলে। যথেষ্টপরিমাণে সাহায্য করবার কথা সেদিন ভাববারও জো ছিল না। ক্ষণকালের জন্যে ইতস্তত করলে, তার পরে উঠে গিয়ে বাক্স থেকে থলি ঝেড়ে দশটি টাকার নোট এনে তার হাতে দিল। বললে, “আরও দু-চার জায়গা থেকে চেষ্টা দেখো, আমার আর সাধ্য নেই।”
বৈকুণ্ঠ সে-কথা একটুও বিশ্বাস করলে না। পা টেনে টেনে চলে গেল, চটিজুতোয় অত্যন্ত অপ্রসন্ন শব্দ।
সেদিনকার এই ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল, আজ হঠাৎ বিপ্রদাসের মনে পড়ল। দেওয়ানজিকে ডেকে হুকুম হল—বৈকুণ্ঠকে আজই আড়াইশ টাকা পাঠানো চাই। দেওয়ানজি চুপ করে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোয়। জেদাজেদির মুখে খরচ করে বিবাহ তো চুকেছে, কিন্তু অনেকদিন ধরে তার হিসাব শোধ করতে হবে—এখন দিনের গতিকে আড়াই-শ টাকা যে মস্তবড়ো অঙ্ক।
দেওয়ানজির মুখের ভাব দেখে বিপ্রদাস আঙুল থেকে হীরের আংটি খুলে বললে, “ছোটোবাবুর নামে যে-টাকা ব্যাঙ্কে জমা রেখেছি, তার থেকে ওই আড়াইশ টাকা নাও, তার বদলে আমার আংটি বন্ধক রইল। বৈকুণ্ঠকে টাকাটা যেন কুমুর নামে পাঠানো হয়।”
বিবাহের লঙ্কাকাণ্ডের সব-শেষ অধ্যায়টা এখনও বাকি।
সকালবেলায় কুশণ্ডিকা সেরে তবে বরকনে যাত্রা করবে এই ছিল কথা। নবগোপাল তারই সমস্ত উদ্যোগ ঠিক করে রেখেছে, এমন সময় বিপ্রদাসের ঘর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসে রাজাবাহাদুর ব’লে বসল-কুশণ্ডিকা হবে বরের ওখানে, মধুপুরীতে।
প্রস্তাবের ঔদ্ধত্যটা নবগোপালের কাছে অসহ্য লাগল। আর কেউ হলে আজ একটা ফৌজদারি বাধত। তবু ভাষার প্রাবল্যে নবগোপালের আপত্তি প্রায় লাঠিয়ালির কাছ পর্যন্ত এসে তবে থেমেছিল।
অন্তঃপুরে অপমানটা খুব বাজল। বহুদূর থেকে আত্মীয়-কুটুম সব এসেছে, তাদের মধ্যে ঘরশত্রুর অভাব নেই। সবার সামনে এই অত্যাচার। ক্ষেমা পিসি মুখ গোঁ করে বসে রইলেন। বরকনে যখন বিদায় নিতে এল তাঁর মুখ দিয়ে যেন আশীর্বাদ বেরোতে চাইল না। সবাই বললে এ-কাজটা কলকাতায় সেরে নিলে তো কারও কিছু বলবার কথা থাকত না। বাপের বাড়ির অপমানে কুমু একান্তই সংকুচিত হয়ে গেল,— মনে হতে লাগল সে-ই যেন অপরাধিনী তার সমস্ত পূর্বপুরুষদের কাছে। মনে-মনে তার ঠাকুরের প্রতি অভিমান করে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি যে-জন্যে আমার এত শাস্তি! আমি তো তোমাকেই বিশ্বাস করে সমস্ত স্বীকার করে নিয়েছি।”
বরকনে গাড়িতে উঠল। কলকাতা থেকে মধুসূদন যে-ব্যাণ্ড এনেছিল তাই উচ্চৈঃস্বরে নাচের সুর লাগিয়ে দিলে। মস্ত একটা শামিয়ানার নিচে হোমের আয়োজন। ইংরেজ মেয়েপুরুষ অভ্যাগত কেউ বা গদিওআলা চৌকিতে বসে কেউ কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। এরই মধ্যে তাদের জন্যে চা-বিস্কুটও এল। একটা টিপায়ের উপর মস্তবড়ো একটা ওয়েডিং কেকও সাজানো আছে। অনুষ্ঠান সারা হয়ে গেলে এরা এসে যখন কন্গ্র্যাচুলেট করতে লাগল, কুমু মুখ লাল করে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। একজন মোটাগোছের প্রৌঢ়া ইংরেজ মেয়ে ওর বেনারসি শাড়ির আঁচল তুলে ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে; ওর হাতে খুব মোটা সোনার বাজুবন্ধ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেও তার বিশেষ কৌতুহল বোধ হল। ইংরেজি ভাষায় প্রশংসাও করলে। অনুষ্ঠান সম্বন্ধে মধুসূদনকে একদল বললে, “how interesting,” আর একদল বললে, “isn’t it?”
এই মধুসূদনকে কুমু তার দাদা আর অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে দেখেছে, আজ তাকেই দেখলে ইংরেজ বন্ধুমহলে। ভদ্রতায় অতি গদ্গদভাবে অবনম্র, আর হাসির আপ্যায়নে মুখ নিয়তই বিকসিত। চাঁদের যেমন এক পিঠে আলাে আর এক পিঠে চির-অন্ধকার, মধুসূদনের চরিত্রেও তাই। ইংরেজের অভিমুখে তার মাধুর্য পূর্ণচাঁদের আলাের মতােই যেমন উজ্জ্বল তেমনি স্নিগ্ধ। অন্য দিকটা দুর্গম, দুর্দৃশ্য এবং জমাট বরফের নিশ্চলতায় দুর্ভেদ্য।
সেলুন-গাড়িতে ইংরেজ বন্ধুদের নিয়ে মধুসূদন; অন্য রিজার্ভ-করা গাড়িতে মেয়েদের দলে কুমু। তারা কেউ বা ওর হাত তুলে টিপে দেখে, কেউ বা চিবুক তুলে মুখশ্রী বিশ্লেষণ করে; কেউ বা বলে ঢ্যাঙা, কেউ বা বলে রােগা। কেউ বা অতি ভালােমানুষের মতাে জিজ্ঞাসা করে, হাঁগা, গায়ে কী রং মাখ, বিলেত থেকে তােমার ভাই বুঝি কিছু পাঠিয়েছে?” সকলেই মীমাংসা করলে, চোখ বড়ো নয়, পায়ের মাপটা মেয়েমানুষের পক্ষে অধিক বড়ো। গায়ের প্রত্যেক গয়নাটি নেড়েচেড়ে বিচার করতে বসল,— সেকেলে গয়না, ওজনে ভারি, সােনা খাটি— কিন্তু কী ফ্যাশান, মরে যাই।
ওদের গাড়িতে স্টেশন-প্ল্যাটফর্মের উলটো দিকের জানলা খােলা ছিল সেই দিকে কুমু চেয়ে রইল, চেষ্টা করতে লাগল এদের কথা যাতে কানে না যায়। দেখতে পেলে একটা এক-পা-কাটা কুকুর তিন পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছে। আহা, কিছু খাবার যদি হাতের কাছে থাকত! কিছুই ছিল না। কুমু মনে-মনে ভাবতে লাগল, যে-একটি পা গিয়েছে তারই অভাবে ওর যা-কিছু সহজ ছিল তার সমস্তই হয়ে গেল কঠিন এমন সময় কুমুর কানে গেল সেলুন-গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলােক বলছে, “দেখুন এই চাষির মেয়েকে আড়কাটি আসাম চা-বাগানে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে এসেছে; গােয়ালন্দ পর্যন্ত টিকিটের টাকা আছে, ওর বাড়ি দুমরাঁও, যদি সাহায্য করেন তাে এই মেয়েটি বেঁচে যায়। সেলুন-গাড়ি থেকে একটা মস্ত তাড়ার আওয়াজ কুমু শুনতে পেলে। সে আর থাকতে পারলে না, তখনই ডানদিকের জানলা খুলে তার পুঁতিগাঁথা থলে উজাড় করে দশ টাকা মেয়েটির হাতে দিয়েই জানালা বন্ধ করে দিলে। দেখে এক জন মেয়ে বলে উঠল, “আমাদের বউয়ের দরাজ হাত দেখি।” আর-একজন বললে, “দরাজ নয় তাে দরজা, লক্ষ্মীকে বিদায় করবার।” আর-এক জন বললে, “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।” এটাকে ওরা দেমাক বলে ঠিক করলে, বাবুরা যাকে এক পয়সা দিলে না, ইনি তাকে অমনি ঝনাত করে টাকা ফেলে দেন, এত কিসের গুমাের! ওদের মনে হল এও বুঝি সেই চাটুজ্যে-ঘােষালদের চিরকেলে রেষারেষির অঙ্গ।
এমন সময়ে ওদের মধ্যে একটি মােটাসােটা কালােকোলাে মেয়ে, মস্ত ডাগর চোখ, স্নেহরসে ভরা মুখের ভাব, কুমুর সমবয়সী হবে, ওর কাছে এসে বসল। চুপি চুপি বললে, “মন কেমন করছে ভাই? এদের কথায় কান দিয়াে না, দু-দিন এই রকম টেপাটেপি বলাবলি করবে, তার পরে কণ্ঠ থেকে বিষ নেমে গেলেই থেমে যাবে।” এই মেয়েটি কুমুর মেজো জা, নবীনের স্ত্রী। ওর নাম নিস্তারিণী, ওকে সবাই মােতির মা বলে ডাকে।
মােতির মা কথা তুললে, “যেদিন নুরনগরে এলুম, ইস্টিশনে তােমার দাদাকে দেখলুম যে।”
কুমু চমকে উঠল। ওর দাদা যে স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল সে-খবর এই প্রথম শুনলে।
“আহা কী সুপুরুষ! এমন কখনাে চক্ষে দেখি নি। ওই-যে গান শুনেছিলেম কীর্তনে—
গোরার রূপে লাগল রসের বান,—
ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীয়ার পুরনারীর প্রাণ
আমার তাই মনে পড়ল।”
মুহূর্তে কুমুর মন গলে গেল। মুখ আড় করে জানলার দিকে রইল চেয়ে,— বাইরের মাঠ বন আকাশ অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে গেল।
মােতির মার বুঝতে বাকি ছিল না কোন্ জায়গায় কুমুর দরদ, তাই নানারকম করে ওর দাদার কথাই আলোচনা করলে। জিজ্ঞাসা করলে, বিয়ে হয়েছে কি না।
কুমু বললে, “না।”
মােতির মা বলে উঠল, “মরে যাই! অমন দেবতার মতো রূপ, এখনও ঘর খালি! কোন্ ভাগ্যবতীর কপালে আছে ওই বর?”
কুমু তখন ভাবছে— দাদা গিয়েছিলেন সমস্ত অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে, কেবল আমারই জন্যে। তার পরে এঁরা একবার দেখতেও এলেন না! কেবলমাত্র টাকার জোরে এমন মানুষকেও অবজ্ঞা করতে সাহস করলেন! তাঁর শরীর এই জন্যেই বুঝি বা ভেঙে পড়ল।
বৃথা আক্ষেপের সঙ্গে বার বার মনে-মনে বলতে লাগল— দাদা কেন গেল ইস্টেশনে। কেন নিজেকে খাটো করলে। আমার জন্যে? আমার মরণ হল না কেন?
যে-কাজটা হয়ে গেছে, আর ফেরানাে যাবে না, তারই উপর ওর মনটা মাথা ঠুকতে লাগল। কেবলই মনে পড়তে লাগল, সেই রােগে-ক্লান্ত শান্ত মুখ, সেই আশীর্বাদে-ভরা স্নিগ্ধগম্ভীর দুটি চোখ।
রেলগাড়ি হাওড়ায় পৌঁছল, বেলা তখন চারটে হবে। ওড়নায়-চাদরে গ্রন্থিবদ্ধ হয়ে বরকনে গিয়ে বসল ব্রুহাম গাড়িতে। কলকাতার দিবালোকের অসংখ্য চক্ষু, তার সামনে কুমুর দেহমন সংকুচিত হয়ে রইল। যে একটি অতিশয় শুচিতাবোধ এই উনিশ বছরের কুমারীজীবনে ওর অঙ্গে অঙ্গে গভীর করে ব্যাপ্ত, সেটা যে কর্ণের সহজ কবচের মতো, কেমন করে ও হঠাৎ ছিন্ন করে ফেলবে? এমন মন্ত্র আছে যে-মন্ত্রে এই কবচ এক নিমেষে আপনি খসে যায়। কিন্তু সে-মন্ত্র হৃদয়ের মধ্যে এখনও বেজে ওঠে নি। পাশে যে-মানুষটি বসে আছে মনের ভিতরে সে তো আজও বাইরের লোক। আপন লোক হবার পক্ষে তার দিক থেকে কেবল তো বাধাই এসেছে। তার ভাবে ব্যবহারে যে একটা রূঢ়তা সে যে কুমুকে এখনও পর্যন্ত কেবলই ঠেলে ঠেলে দূরে ঠেকিয়ে রাখল।
এদিকে মধুসূদনের পক্ষে কুমু একটি নূতন আবিষ্কার। স্ত্রীজাতির পরিচয় পায় এ-পর্যন্ত এমন অবকাশ এই কেজো মানুষের অল্পই ছিল। ওর পণ্যজগতের ভিড়ের মধ্যে পণ্য-নারীর ছোঁওয়াও ওকে কখনো লাগে নি। কোনো স্ত্রী ওর মনকে কখনো বিচলিত করে নি এ-কথা সত্য নয়, কিন্তু ভূমিকম্প পর্যন্তই ঘটেছে— ইমারত জখম হয় নি। মধুসূদন মেয়েদের অতি সংক্ষেপে দেখেছে ঘরের বউঝিদের মধ্যে। তারা ঘরকন্নর কাজ করে, কোঁদল করে, কানাকানি করে, অতি তুচ্ছ কারণে কান্নাকাটিও করে থাকে। মধুসূদনের জীবনে এদের সংস্রব নিতান্তই যৎসামান্য। ওর স্ত্রীও যে জগতের সেই অকিঞ্চিৎকর বিভাগে স্থান পাবে, এবং দৈনিক গার্হস্থ্যের তুচ্ছতায় ছায়াচ্ছন্ন হয়ে প্রাচীরের আড়ালে কর্তাদের কটাক্ষচালিত মেয়েলি জীবনযাত্রা অতিবাহিত করবে এর বেশি সে কিছুই ভাবে নি। স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহার করবারও যে একটা কলানৈপুণ্য আছে, তার মধ্যেও যে পাওয়ার বা হারাবার একটা কঠিন সমস্যা থাকতে পারে, এ-কথা তার হিসাবদক্ষ সতর্ক মস্তিষ্কের এক কোণেও স্থান পায় নি; বনস্পতির নিজের পক্ষে প্রজাপতি যেমন বাহুল্য, অথচ প্রজাপতির সংসর্গ যেমন তাকে মেনে নিতে হয় ভাবী স্ত্রীকেও মধুসূদন তেমনি করেই ভেবেছিল।
এমন সময় বিবাহের পরে সে কুমুকে প্রথম দেখলে। এক রকমের সৌন্দর্য আছে তাকে মনে হয় যেন একটা দৈব আবির্ভাব, পৃথিবীর সাধারণ ঘটনার চেয়ে অসাধারণ পরিমাণে বেশি,— প্রতিক্ষণেই যেন সে প্রত্যাশার অতীত। কুমুর সৌন্দর্য সেই শ্রেণীর। ও যেন ভােরের শুকতারার মতাে, রাত্রের জগৎ থেকে স্বতন্ত্র, প্রভাতের জগতের ওপারে। মধুসূদন তার অবচেতন মনে নিজের অগােচরে কুমুকে একরকম অস্পষ্ট ভাবে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বােধ করলে— অন্তত একটা ভাবনা উঠল এর সঙ্গে কী রকম ভাবে ব্যবহার করা চাই, কোন্ কথা কেমন করে বললে সংগত হবে।
কী বলে আলাপ আরম্ভ করবে ভাবতে ভাবতে মধুসূদন হঠাৎ এক সময়ে কুমুকে জিজ্ঞাসা করলে, “এদিক থেকে রােদ্দুর আসছে, না?”
কুমু কিছুই জবাব করলে না। মধুসূদন ডান দিকের পর্দাটা টেনে দিলে।
খানিকক্ষণ আবার চুপচাপ কাটল। আবার খামকা বলে উঠল, “শীত করছে না তাে?” বলেই উত্তরের প্রতীক্ষা না করে সামনের আসন থেকে বিলিতি কম্বলটা টেনে নিয়ে কুমুর ও নিজের পায়ের উপর বিছিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে এক-আবরণের সহযােগিতা স্থাপন করলে। শরীর-মন পুলকিত হয়ে উঠল। চমকে উঠে কুমুদিনী কম্বলটাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, শেষে নিজেকে সম্বরণ করে আসনের প্রান্তে গিয়ে সংলগ্ন হয়ে রইল।
কিছুক্ষণ এইভাবে যায় এমন সময় হঠাৎ কুমুর হাতের দিকে মধুসূদনের চোখ পড়ল।
“দেখি, দেখি” বলে হঠাৎ তার বাঁ হাতটা চোখের কাছে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলে, “তোমার আঙুলে এ কিসের আংটি? এ যে নীলা দেখছি।”
কুমু চুপ করে রইল।
“দেখো, নীলা আমার সয় না, ওটা তোমাকে ছাড়তে হবে।”
কোনো এক সময়ে মধুসূদন নীলা কিনেছিল, সেই বছর ওর গাধাবোটবোঝাই পাট হাওড়ার ব্রিজে ঠেকে তলিয়ে যায়। সেই অবধি নীলাপাথরকে ও ক্ষমা করে না।
কুমুদিনী আস্তে আস্তে হাতটাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করলে। মধুসূদন ছাড়লে না; বললে, “এটা আমি খুলে নিই।”
কুমু চমকে উঠল; বললে “না থাক্।”
একবার দাবাখেলায় ওর জিত হয়; সেইবার দাদা ওকে তার নিজের হাতের আংটি পারিতোষিক দিয়েছিল।
মধুসূদন মনে-মনে হাসলে। আংটির উপর বিলক্ষণ লোভ দেখছি। এইখানে নিজের সঙ্গে কুমুর সাধর্ম্যের পরিচয় পেয়ে একটু যেন আরাম লাগল। বুঝলে সময়ে অসময়ে সিঁথি কণ্ঠহার বালা বাজুর যোগে অভিমানিনীর সঙ্গে ব্যবহারের সোজা পথ পাওয়া যাবে,— এই পথে মধুসূদনের প্রভাব না মেনে উপায় নেই, বয়স না হয় কিছু বেশিই হল।
নিজের হাত থেকে মস্তবড়ো কমলহীরের একটা আংটি খুলে নিয়ে মধুসূদন হেসে বললে, “ভয় নেই, এর বদলে আর-একটা আংটি তোমাকে পরিয়ে দিচ্ছি।”
কুমু আর থাকতে পারলে না,— একটু চেষ্টা করেই হাত ছাড়িয়ে নিলে! এইবার মধুসূদনের মনটা ঝেঁকে উঠল। কর্তৃত্বের খর্বতা তাকে সইবে না। শুষ্ক গলায় জোর করেই বললে, “দেখো, এ আংটি তোমাকে খুলতেই হবে।”
কুমুদিনী মাথা হেঁট করে চুপ করে রইল, তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
মধুসূদন আবার বললে, “শুনছ? আমি বলছি ওটা খুলে ফেলা ভালো। দাও আমাকে।” বলে হাতটা টেনে নিতে উদ্যত হল।
কুমু হাত সরিয়ে নিয়ে বললে, “আমি খুলছি।”
খুলে ফেললে।
“দাও ওটা আমাকে দাও।”
কুমুদিনী বললে, “ওটা আমিই রেখে দেব।”
মধুসূদন বিরক্ত হয়ে হেঁকে উঠল, “রেখে লাভ কী? মনে ভাবছ, এটা ভারি একটা দামি জিনিস! একিছুতেই তোমার পরা চলবে না, বলে দিচ্ছি।”
কুমুদিনী বললে, “আমি পরব না।” বলে সেই পুঁতির কাজ-করা থলেটির মধ্যে আংটি রেখে দিলে।
“কেন, এই সামান্য জিনিসটার উপরে এত দরদ কেন? তোমার তো জেদ কম নয়।”
মধুসূদনের আওয়াজটা খরখরে; কানে বাজে, যেন বেলে-কাগজের ঘর্ষণ। কুমুদিনীর সমস্ত শরীরটা রী রী করে উঠল।
“এ আংটি তোমাকে দিলে কে?”
কুমুদিনী চুপ করে রইল।
“তোমার মা নাকি?”
নিতান্তই জবাব দিতে হবে বলেই অর্ধস্ফুটস্বরে বললে, “দাদা”।
দাদা! সে তো বোঝাই যাচ্ছে। দাদার দশা যে কী, মধুসূদন তা ভালোই জানে। সেই দাদার আংটি শনির সিঁধকাঠি— এ ঘরে আনা চলবে না। কিন্তু তার চেয়েও ওকে এইটেই খোঁচা দিচ্ছে যে, এখনও কুমুদিনীর কাছে ওর দাদাই সব চেয়ে বেশি। সেটা স্বাভাবিক বলেই যে সেটা সহ্য় হয় তা নয়। পুরােনাে জমিদারের জমিদারি নতুন ধনী মহাজন নিলেমে কেনার পর ভক্ত প্রজারা যখন সাবেক আমলের কথা স্মরণ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে থাকে তখন আধুনিক অধিকারীর গায়ের জ্বালা ধরে, এও তেমনি। আজ থেকে আমিই যে ওর একমাত্র, এই কথাটা যত শীঘ্র হােক ওকে জানান দেওয়া চাই। তাছাড়া গায়ে-হলুদের খাওয়ানাে নিয়ে বরের যা অপমান হয়েছে তাতে বিপ্রদাস নেই এ-কথা মধুসূদন বিশ্বাস করতেই পারে না। যদিও নবগােপাল বিবাহের পরদিনে ওকে বলেছিল, “ভায়া, বিয়েবাড়িতে তােমাদের হাটখােলার আড়ত থেকে যে-চালচলন আমদানি করেছিলে, সে-কথাটা ইঙ্গিতেও দাদাকে জানিয়ো না; উনি এর কিছুই জানেন না, ওঁর শরীরও বড়ো খারাপ।”
আংটির কথাটা আপাতত স্থগিত রাখলে, কিন্তু মনে রইল।
এদিকে রূপ ছাড়া আরও একটা কারণে হঠাৎ কুমুদিনীর দর বেড়ে গিয়েছে। নুরনগরে থাকতেই ঠিক বিবাহের দিনে মধুসূদন টেলিগ্রাফ পেয়েছে যে এবার তিসি চালানের কাজে লাভ হয়েছে প্রায় বিশ লাখ টাকা। সন্দেহ রইল না, এটা নতুন বন্ধুর পয়ে। স্ত্রীভাগ্যে ধন, তার প্রমাণ হাতে হাতে। তাই কুমুকে পাশে নিয়ে গাড়িতে বসে ভিতরে ভিতরে এই পরম পরিতৃপ্তি তার ছিল যে, ভাবী মুনফার একটা জীবন্ত বিধিদত্ত দলিল নিয়ে বাড়ি চলেছে। এ নইলে আজকের এই ব্রুহাম-রথযাত্রার পালাটায় অপঘাত ঘটতে পারত।
রাজা উপাধি পাওয়ার পর থেকে কলকাতায় ঘোষালবাড়ির দ্বারে নাম খোদা হয়েছে “মধুপ্রাসাদ”। সেই প্রাসাদের লোহার গেটের এক পাশে আজ নবহত বসেছে, আর বাগানে একটা তাঁবুতে বাজছে ব্যাণ্ড। গেটের মাথায় অর্ধচন্দ্রাকারে গ্যাসের টাইপে লেখা “প্রজাপতয়ে নমঃ”। সন্ধ্যাবেলায় আলোকশিখায় এই লিখনটি সমুজ্জ্বল হবে। গেট থেকে কাঁকর-দেওয়া যে-পথ বাড়ি পর্যন্ত গেছে, তার দুইধারে দেবদারুপাতা ও গাঁদার মালার শোভাসজ্জা; বাড়ির প্রথম তলার উঁচু মেজেতে ওঠবার সিড়ির ধাঁপে লাল সালু পাতা। আত্মীয়বন্ধুর জনতার ভিতর দিয়ে বরকনের গাড়ি গাড়িবারান্দায় এসে থামল। শাঁখ উলুধ্বনি ঢাক ঢোল কাঁসর নহবত ব্যাণ্ড সব একসঙ্গে উঠল বেজে—যেন দশ-পনেরোটা আওয়াজের মালগাড়ির এক জায়গাতে পুরো বেগে ঠোকাঠুকি ঘটল। মধুসূদনের কোন্ এক সম্পর্কের দিদিমা, পরিপক্ক বুড়ী, সিঁথিতে যত মোটা ফাঁক তত মোটা সিঁদুর, চওড়া-লালপেড়ে শাড়ি, মোটা হাতে মোটা মোটা সোনার বালা এবং শাঁখার চুড়ি, একটা রুপোর ঘটিতে জল নিয়ে বউ এর পায়ে ছিটিয়ে দিয়ে আঁচলে মুছে নিলেন, হাতে নোয়া পরিয়ে দিলেন, বউয়ের মুখে একটু মধু দিয়ে বললেন, “আহা, এতদিন পরে আমাদের নীল গগনে উঠল পূর্ণ চাঁদ, নীল সরোবরে ফুটল সোনার পদ্ম।” বরকনে গাড়ি থেকে নাবল। যুবক-অভ্যাগতদের দৃষ্টি ঈর্ষান্বিত। একজন বললে, “দৈত্য স্বর্গ লুঠ করে এনেছে রে, অপ্সরী সোনার শিকলে বাঁধা।” আর-একজন বললে, “সাবেক কালে এমন মেয়ের জন্য়ে রাজায় রাজায় লড়াই বেধে যেত, আজ তিসি-চালানির টাকাতেই কাজ সিদ্ধি। কলিযুগে দেবতাগুলো বেরসিক। ভাগ্যচক্রের সব গ্রহনক্ষত্রই বৈশ্যবর্ণ।”
তারপরে বরণ, স্ত্রী-আচার প্রভৃতির পালা শেষ হতে হতে যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে তখন কালরাত্রির মুখে ক্রিয়াকর্ম সাঙ্গ হল।
একটিমাত্র বড়ো বোনের বিবাহ কুমুর স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু তাদের নিজেদের বাড়িতে কোনো নতুন বউ আসতে সে দেখে নি। যৌবনারম্ভের পূর্বে থেকেই সে আছে কলকাতায়, দাদার নির্মল স্নেহের আবেষ্টনে। বালিকার মনের কল্পজগৎ সাধারণ সংসারের মোটা ছাঁচে গড়া হতে পায় নি। বাল্যকালে পতিকামনায় যখন সে শিবের পূজা করেছে, তখন পতির ধ্যানের মধ্যে সেই মহাতপস্বী রজতগিরিনিভ শিবকেই দেখেছে। সাধ্বী নারীর আদর্শরূপে সে আপন মাকেই জানত। কী স্নিগ্ধ শান্ত কমনীয়তা, কত ধৈর্য, কত দুঃখ, কত দেবপূজা, মঙ্গলাচরণ, অক্লান্ত সেবা। অপর পক্ষে তাঁর স্বামীর দিকে ব্যবহারের ত্রুটি চরিত্রের স্খলন ছিল; তৎসত্ত্বেও সে-চরিত্র ঔদার্যে বৃহৎ, পৌরুষে দৃঢ়, তার মধ্যে হীনতা কপটতা লেশমাত্র ছিল না, যে একটা মর্যাদাবোধ ছিল সে যেন দূরকালের পৌরাণিক আদর্শের। তাঁর জীবনের মধ্যে প্রতিদিন এইটেই প্রমাণ হয়েছে যে, প্রাণের চেয়ে মান বড়, অর্থের চেয়ে ঐশ্বর্য। তিনি ও তাঁর সমপর্যায়ের লোকেরা বড়ো বহরের মানুষ। তাঁদের ছিল নিজেদের ক্ষতি করেও অক্ষত সম্মানের গৌরব রক্ষা, অক্ষত সঞ্চয়ের অহংকার প্রচার নয়।
কুমুর যেদিন বাঁ চোখ নাচল সে দিন সে তার সব ভক্তি নিয়ে, আত্মোৎসর্গের পূর্ণ সংকল্প নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোথাও কোন বাধা বা খর্বতা ঘটতে পারে এ-কথা তার কল্পনাতেই আসে নি। দয়মন্তী কী করে আগে থাকতে জেনেছিলেন যে, বিদভরাজ নলকেই বরণ করে নিতে হবে! তাঁর মনের ভিতরে নিশ্চিত বার্তা এসে পৌঁছেছিল—তেমনি নিশ্চিত বার্তা কি কুমু পায় নি? বরণের আয়োজন সবই প্রস্তুত ছিল, রাজাও এলেন, কিন্তু মনে যাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বাইরে তাকে দেখলে কই? রূপেতেও বাধত না, বয়সেও বাধত না। কিন্তু রাজা? সেই সত্যকার রাজা কোথায়?
তার পরে আজ, যে-অনুষ্ঠানের দ্বার দিয়ে কুমুকে তার নূতন সংসারে আহ্বান করলে তাতে এমন কোনো বজ্রগম্ভীর মঙ্গলধ্বনি বাজল না কেন যার ভিতর দিয়ে এই নববধূ আকাশের সপ্তর্ষিদের আশীর্বাদমন্ত্র শুনতে পেত! সমস্ত অনুষ্ঠানকে পরিপূর্ণ করে এমন বন্দনাগান উদাত্ত স্বরে কেন জাগল না—
জগতঃ পিতরৌ বলে পার্বতীপরমেশ্বরৌ
সেই “জগতঃ পিতরৌ” যাঁর মধ্যে চিরপুরুষ ও চিরনারী বাক্য ও অর্থের মতো একত্র মিলিত হয়ে আছে?
মধুসূদন যখন কলকাতায় বাস করতে এল, তখন প্রথমে সে একটি পুরোনো বাড়ি কিনেছিল, সেই চকমেলানো বাড়িটাই আজ তার অন্তঃপুরমহল। তার পরে তারই সামনে এখনকার ফ্যাশানে একটা মস্ত নতুন মহল এরই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সেইটে ওর বৈঠকখানা-বাড়ি। এই দুই মহল যদিও সংলগ্ন তবুও এরা সম্পূর্ণ আলাদা দুই জাত। বাইরের মহলে সর্বত্রই মার্বলের মেজে, তার উপরে বিলিতি কারপেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানা রকমের ছবি, কোনোটা এনগ্রেভিং, কোনোটা ওলিয়োগ্রাফ, কোনোটা অয়েলপেন্টিং— তার বিষয় হচ্ছে, হরিণকে তাড়া করেছে শিকারি কুকুর, কিংবা ডার্বির ঘোড়দৌড় জিতেছে এমন সব বিখ্যাত ঘোড়া, বিদেশী ল্যাণ্ডস্কেপ, কিংবা স্নানরত নগ্নদেহ নারী। তাছাড়া দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদাবাদি পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যত প্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা সমাবেশ। এই সমস্ত গৃহসজ্জা পছন্দ করা, কেনা, এবং সাজানোর ভার মধুসূদনের ইংরেজ অ্যাসিস্টেন্টের উপর। এ ছাড়া মকমলে বা রেশমে মোড়া চৌকি-সোফার অরণ্য। কাঁচের আলমারিতে জমকালো বাঁধানো ইংরেজি বই, ঝাড়ন-হস্ত বেহারা ছাড়া কোনো মানুষ তার উপর হস্তক্ষেপ করে না— টিপাইয়ে আছে অ্যালবাম, তার কোনোটাতে ঘরের লোকের ছবি, কোনোটাতে বিদেশিনী অ্যাক্ট্রেসদের।
অন্তঃপুরে একতলার ঘরগুলো অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, ধোঁয়ায় ঝুলে কালো। উঠোনে আবর্জনা, সেখানে জলের কল, বাসন মাজা কাপড় কাচা চলছেই, যখন ব্যবহার নেই তখনও কল প্রায় খোলাই থাকে। উপরের বারান্দা থেকে মেয়েদের ভিজে কাপড় ঝুলছে, আর দাঁড়ের কাকাতুয়ার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনে। বারান্দার দেয়ালের যেখানে-সেখানে পানের পিকের দাগ ও নানাপ্রকার মলিনতার অক্ষয় স্মৃতিচিহ্ন। উঠোনের পশ্চিম দিকের রোয়াকের পশ্চাতে রান্নাঘর, সেখান থেকে রান্নার গন্ধ ও কয়লার ধোঁয়া উপরের ঘরে সর্বত্রই প্রসার লাভ করে। রান্নাঘরের বাইরে প্রাচীরবদ্ধ অল্প একটু জমি আছে তারই এক কোণে পোড়া কয়লা, চুলোর ছাই, ভাঙা গামলা, ছিন্ন ধামা, জীর্ণ ঝাঁঝরি রাশীকৃত; অপর প্রান্তে গুটিদুয়েক গাই ও বাছুর বাঁধা, তাদের খড় ও গোবর জমছে, এবং সমস্ত প্রাচীর ঘুঁটের চক্রে আচ্ছন্ন। এক ধারে একটি মাত্র নিমগাছ, তার গুঁড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে। অন্তঃপুরে এই একটুমাত্র জমি, বাকি সমস্ত জমি বাইরের দিকে। সেটা লতামণ্ডপে, বিচিত্র ফুলের কেয়ারিতে, ছাঁটা ঘাসের মাঠে, খোয়া ও সুরকি-দেওয়া রাস্তায়, পাথরের মূর্তি ও লোহার বেঞ্চিতে সুসজ্জিত।
অন্দরমহলে তেতলায় কুমুদিনীর শােবার ঘর। মস্ত বড় খাট মেহগনি কাঠের; ফ্রেমে নেটের মশারি, তাতে সিল্কের ঝালর। বিছানার পায়ের দিকে পুরাে বহরের একটা নিরাবরণ মেয়ের ছবি, বুকের উপর দুই হাত চেপে লজ্জার ভান করছে। শিয়রের দিকে মধুসূদনের নিজের অয়েলপেন্টিং, তাতে তার কাশ্মীরি শালের কারুকার্যটাই সব চেয়ে প্রকাশমান। একদিকে দেয়ালের গায়ে কাপড় রাখবার দেরাজ, তার উপরে আয়না; আয়নার দু-দিকে দুটো চীনেমাটির শামাদান, সামনে চীনেমাটির থালির উপর পাউডারের কৌটো, রুপাে-বাঁধানাে চিরুনি, তিন-চার রকমের এসেন্স, এসেন্স ছিটোবার পিচকারি এবং আরও নানা রকমের প্রসাধনের সামগ্রী, বিলিতি অ্যাসিস্টেন্টের কেনা। নানাশাখাযুক্ত গােলাপি কাঁচের ফুলদানিতে ফুলের তােড়া। আর-একদিকে লেখবার টেবিল, তাতে দামি পাথরের দোয়াতদান, কলম ও কাগজকাটা। ইতস্তত মােটা গদিওআলা সােফা ও কেদারা— কোথাও-বা টিপাই, তাতে চা খাওয়া যায়, তাসখেলা যেতেও পারে। নতুন মহারানীর উপযুক্ত শয়নঘর কী রকম হওয়া বিধিসংগত এ-কথা মধুসূদনকে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হয়েছে। এমন হয়ে উঠল, যেন অন্দরমহলের সর্বোচ্চতলার এই ঘরটি ময়লা কাঁথা গায়ে-দেওরা ভিখিরির মাথায় জরিজহরত-দেওয়া পাগড়ি।
অবশেষে একসময়ে গােলমাল-ধুমধামের বানডাকা দিন পার হয়ে রাত্রিবেলা কুমু এই ঘরে এসে পৌঁছল। তাকে নিয়ে এল সেই মােতির মা। সে ওর সঙ্গে আজ রাত্রে শােবে ঠিক হয়েছে। আরও একদল মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। তাদের কৌতুহল ও আমােদের নেশা মিটতে চায় না—মােতির মা তাদের বিদায় করে দিয়েছে। ঘরের মধ্যে এসেই এক হাতে সে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমি কিছুখনের জন্যে যাই ওই পাশের ঘরে,— তুমি একটু কেঁদে নাও ভাই, চোখের জল যে বুক ভরে জমে উঠেছে।” বলে সে চলে গেল।
কুমু চৌকির উপর বসে পড়ল। কান্না পরে হবে, এখন ওর বড়াে দরকার হয়েছে নিজেকে ঠিক করা। ভিতরে ভিতরে সকলের চেয়ে যে-ব্যথাটা ওকে বাজছিল সে হচ্ছে নিজের কাছে নিজের অপমান। এতকাল ও যা-কিছু সংকল্প করে এসেছে ওর বিদ্রোহী মন সম্পূর্ণ তার উলটো দিকে চলে গেছে। সেই মনটাকে শাসন করবার একটুও সময় পাচ্ছিল না। ঠাকুর, বল দাও, বল দাও, আমার জীবন কালি করে দিয়াে না। আমি তােমার দাসী, আমাকে জয়ী করো, সে জয় তােমারই।
পরিণতবয়সী আঁটসাঁট গড়নের শ্যামবর্ণ একটি সুন্দরী বিধবা ঘরে ঢুকেই বললে “মােতির মা তােমাকে একটু ছুটি দিয়েছে সেই ফাঁকে এসেছি; কাউকে তাে কাছে ঘেঁষতে দেবে না, বেড়ে রাখবে তােমাকে— যেন সিঁধকাটি নিয়ে বেড়াচ্ছি, ওর বেড়া কেটে তােমাকে চুরি করে নিয়ে যাব। আমি তােমার জা, শ্যামাসুন্দরী; তােমার স্বামী আমার দেওর। আমরা তাে ভেবেছিলেম শেষ পর্যন্ত জমাখরচের খাতাই হবে ওর বউ। তা ওই খাতার মধ্যে জাদু আছে ভাই, এত বয়সে এমন সুন্দরী ওই খাতার জোরেই জুটল। এখন হজম করতে পারলে হয়। ওইখানে খাতার মন্তর খাটে না। সত্যি করে বলো ভাই, আমাদের বুড়াে দেওরটিকে পছন্দ হয়েছে তাে?”
কুমু অবাক হয়ে রইল, কী জবাব দেবে ভেবেই পেলে না। শ্যামা বলে উঠল, “বুঝেছি, তা পছন্দ না হলেই বা কি, সাত পাক যখন ঘুরেছ তখন একুশ পাক উলটো ঘুরলেও ফাঁস খুলবে না।”
কুমু বললে, “এ কী কথা বলছ দিদি!”
শ্যামা জবাব দিলে, “খােলসা করে কথা বললেই কি দোষ হয় বােন? মুখ দেখে কি বুঝতে পারি নে? তা দোষ দেব না তােমাকে। ও আমাদের আপন বলেই কি চোখের মাথা খেয়ে বসেছি? বড়াে শক্ত হাতে পড়েছ বউ, বুঝে সুঝে চ’লো?”
এমন সময় মােতির মাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বলে উঠল, “ভয় নেই, ভয় নেই, বকুলফুল, যাচ্ছি আমি। ভাবলুম তুমি নেই এই ফাঁকে আমাদের নতুন বউকে একবার দেখে আসি গে। তা সত্যি বটে, এ কৃপণের ধন, সাবধানে রাখতে হবে। সইকে বলছিলুম আমাদের দেওরের এ যেন হল আধ-কপালে মাথাধরা; বউকে ধরেছে ওর বাঁ-দিকের পাওয়ার-কপালে, এখন ডানদিকের রাখার-কপালে যদি ধরতে পারে তবেই পুরােপুরি হবে।
এই বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মূহূর্ত পরে ঘরে ঢুকে কুমুর সামনে পানের ডিবে খুলে ধরে বললে, “একটা পান নেও। দোক্তা খাওয়া অভ্যেস আছে?”
কুমু বললে, “না।” তখন এক টিপ দোক্তা নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে শ্যামা মন্দগমনে বিদায় নিলে।
“এখনই বদ্দিমাসিকে খাইয়ে বিদায় করে আসছি, দেরি হবে না” বলে মােতির মা চলে গেল।
শ্যামাসুন্দরী কুমুর মনের মধ্যে ভারি একটা বিস্বাদ জাগিয়ে দিলে। আজকে কুমুর সব চেয়ে দরকার ছিল মায়ার আবরণ, সেইটেই সে আপন মনে গড়তে বসেছিল, আর যে-সৃষ্টিকর্তা দ্যুলোকে ভূলােকে নানা রং নিয়ে রূপের লীলা করেন, তাঁকেও সহায় করবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় শ্যামা এসে ওর স্বপ্ন-বােনা জালে ঘা মারলে। কুমু চোখ বুজে খুব জোর করে নিজেকে বলতে লাগল, “স্বামীর বয়স বেশি বলে তাঁকে ভালোবাসি নে এ-কথা কখনােই সত্য নয়— লজ্জা, লজ্জা! এ যে ইতর মেয়েদের মতাে কথা।” শিবের সঙ্গে সতীর বিয়ের কথা কি ওর মনে নেই? শিবনিন্দুকরা তাঁর বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়েছিল, কিন্তু সে-কথা সতী কানে নেন নি।
স্বামীর বয়স বা রূপ নিয়ে এ-পর্যন্ত কুমু কোনো চিন্তাই করে নি। সাধারণত যে-ভালোবাসা নিয়ে স্ত্রীপুরুষের বিবাহ সত্য হয়, যার মধ্যে রূপগুণ দেহমন সমস্তই মিলে আছে, তার যে প্রয়োজন আছে এ-কথা কুমু ভাবেও নি। পছন্দ করে নেওয়ার কথাটাকেই রং মাখিয়ে চাপা দিতে চায়।
এমন সময় ফুলকাটা জামা ও জরির পাড়ওআলা ধুতি-পরা ছেলে, বয়স হবে বছর সাতেক, ঘরে ঢুকেই গা ঘেঁষে কুমুর কাছে এসে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো মিগ্ধ চোখ ওর মুখের দিকে তুলে ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে মিষ্টি সুরে বললে, “জ্যেঠাইমা।” কুমু তাকে কোলের উপর টেনে নিয়ে বললে, “কী বাবা, তোমার নাম?” ছেলেটি খুব ঘটা করে বললে, শ্রীটুকুও বাদ দিলে না, “শ্রীমোতিলাল ঘোষাল।” সকলের কাছে, পরিচয় ওর হাবলু বলে। সেইজন্যেই উপযুক্ত দেশকালপাত্রে নিজের সম্মান রাখবার জন্যে পিতৃদত্ত নামটাকে এত সুসম্পূর্ণ করে বলতে হয়। তখন কুমুর বুকের ভিতরটা টনটন করছিল— এই ছেলেকে বুকে চেপে ধরে যেন বাঁচল। হঠাৎ কেমন মনে হল কতদিন ঠাকুরঘরে যে-গোপালকে ফুল দিয়ে এসেছে, এই ছেলেটির মধ্যে সে-ই ওর কোলে এসে বসল। ঠিক যে-সময়ে ডাকছিল সেই দুঃখের সময়েই এসে ওকে বললে, “এই যে আমি আছি তোমার সান্ত্বনা।” মোতির গোল গোল গাল টিপে ধরে কুমু বললে, “গোপাল, ফুল নেবে?”
কুমুর মুখ দিয়ে গোপাল ছাড়া আর কোনো নাম বেরোল না। হঠাৎ নিজের নামান্তরে হাবলুর কিছু বিস্ময় বোধ হল— কিন্তু এমন সুর ওর কানে পৌঁছেছে যে কিছু আপত্তি ওর মনে আসতে পারে না।
এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে মোতির মা ছেলের গলা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বললে, “ওই রে, বাঁদর ছেলেটা এসেছে বুঝি।” শ্রীমোতিলাল ঘোষাল-এর সম্মান আর থাকে না। নালিশে-ভরা চোখ তুলে নিঃশব্দে মায়ের মুখের দিকে সে চেয়ে রইল, ডান হাতে জ্যেঠাইমার আঁচল চেপে। কুমু হাবলুকে তার বাঁ হাত দিয়ে বেড়ে নিয়ে বললে, “আহা থাক্ না।”
“না ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন শুতে যাক্— এ-বাড়িতে ওকে খুব সহজেই মিলবে, ওর মত সস্তা ছেলে আর কেউ নেই।” বলে মোতির মা অনিচ্ছুক ছেলেকে শোয়াবার জন্যে নিয়ে গেল। এতটুকুতেই কুমুর মনের ভার গেল হালকা হয়ে। ওর মনে হল প্রার্থনার জবাব পেলুম, জীবনের সমস্যা সহজ হয়ে দেখা দেবে, এই ছোটো ছেলেটির মতোই।
অনেক রাত্তিরে মোতির মা এক সময়ে জেগে উঠে দেখলে কুমু বিছানায় উঠে বসে আছে, তার কোলের উপর দুই হাত জোড়া, ধ্যানাবিষ্ট চোখ দুটি যেন সামনে কাকে দেখতে পাচ্ছে। মধুসূদনকে যতই সে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে বাধা পায়, ততই তার দেবতাকে দিয়ে সে তার স্বামীকে আবৃত করতে চায়। স্বামীকে উপলক্ষ্য করে আপনাকে সে দান করছে তার দেবতাকে। দেবতা তাঁর পূজাকে বড়ো কঠিন করেছেন, এ প্রতিমা স্বচ্ছ নয়, কিন্তু এই তো ভক্তির পরীক্ষা। শালগ্রামশিলা তো কিছুই দেখায় না, ভক্তি সেই রূপহীনতার মধ্যে বৈকুণ্ঠনাথের রূপকে প্রকাশ করে কেবল আপন জোরে। যেখানে দেখা যাচ্ছে না সেইখানেই দেখব এই হোক আমার সাধনা, যেখানে ঠাকুর লুকিয়ে থাকেন সেইখানে গিয়েই তাঁর চরণে আপনাকে দান করব, তিনি আমাকে এড়াতে পারবেন না।
“মেরে গিরিধর গােপাল, ঔর নাহি কোহি”— দাদার কাছে শেখা মীরাবাই-এর এই গানটা বারবার মনে-মনে আওড়াতে লাগল।
মধুসূদনের অত্যন্ত রূঢ় যে-পরিচয় সে পেয়েছে তাকে কিছুই নয় বলে, জলের উপরকার বুদ্বুদ বলে উড়িয়ে দিতে চায়— চিরকালের যিনি সত্য, সমস্ত আবৃত করে তিনিই আছেন, “ঔর নাহি কোহি, ঔর নাহি কোহি।” এ ছাড়া আর-একটা পীড়ন আছে তাকেও মায়া বলতে চায়— সে হচ্ছে জীবনের শূন্যতা। আজ পর্যন্ত যাদের নিয়ে ওর সমস্ত কিছু গড়ে উঠেছে, যাদের বাদ দিতে গেলে জীবনের অর্থ থাকে না, তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ,— সে নিজেকে বলছে এই শূন্য ও পূর্ণ—
বাপে ছাড়ে, মায়ে ছাড়ে, ছাড়ে সগা সহী,
মীরা প্রভু লগন লগী যো ন হোয়ে হােয়ী।
ছেড়েছেন তাে বাপ, ছেড়েছেন তাে মা; কিন্তু তাঁদের ভিতরেই যিনি চিরকালকার তিনি তাে ছাড়েন নি। ঠাকুর আরও যা-কিছু ছাড়ান না কেন, শূন্য ভরাবেন বলেই ছাড়িয়েছেন। আমি লেগে রইলুম, যা হয় তা হােক। মনের গান কখন তার গলায় ফুটে উঠল তা টেরই পেলে না দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
মােতির মা কথাটি বললে না, চুপ করে দেখলে, আর শুনলে। তার পরে কুমু যখন অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল তখন মােতির মার মনে একটা চিন্তা দেখা দিল যা পূর্বে আর কখনাে ভাবে নি।
ও ভাবতে লাগল, আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমরা তাে কচি খুকী ছিলুম, মন বলে একটা বালাই ছিল না। ছােটোছেলে কাঁচা ফলটাকে যেমন টপ করে বিনা আয়ােজনে মুখে পুরে দেয়, স্বামীর সংসার তেমনি করেই বিনা বিচারে আমাদের গিলেছে, কোথাও কিছু বাধে নি। সাধন করে আমাদের নিতে হয় নি, আমাদের জন্যে দিন-গোনা ছিল অনাবশ্যক। যেদিন বললে ফুলশয্যে সেইদিনই হল ফুলশয্যে, কেননা ফুলশয্যের কোনো মানে ছিল না, সে ছিল একটা খেলা। এই তো কালই হবে ফুলশয্যে, কিন্তু এ মেয়ের পক্ষে সে কতবড়ো বিড়ম্বনা! বড়ঠাকুর এখন পর; আপন হতে অনেক সময় লাগে। একে ছোঁবে কী করে? এ-মেয়ের সেই অপমান সইবে কেন? ধন পেতে বড়ঠাকুরের কত কাল লাগল আর মন পেতে দু-দিন সবুর সইবে না? সেই লক্ষ্মীর দ্বারে হাঁটাহাঁটি করে মরতে হয়েছে, এ লক্ষ্মীর দ্বারে একবার হাত পাততে হবে না?
এত কথা মোতির মার মনে আসত না। এসেছে তার কারণ, কুমুকে দেখবামাত্রই ও তাকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। এই ভালোবাসার পূর্বভূমিকা হয়েছিল স্টেশনে যখন সে দেখেছিল বিপ্রদাসকে। যেন মহাভারত থেকে ভীষ্ম নেমে এলেন। বীরের মত তেজস্বী মূর্তি, তাপসের মতো শান্ত মুখশ্রী, তার সঙ্গে একটি বিষাদের নম্রতা। মোতির মার মনে হয়েছিল কেউ যদি কিছু না বলে তবে একবার ওর পা দুটো ছুঁয়ে আসি। সেই রূপ আজও সে ভুলতে পারে নি। তার পরে যখন কুমুকে দেখলে, মনে মনে বললে, দাদারই বোন বটে!
একরকম জাতিভেদ আছে যা সমাজের নয়, রক্তের,— সে-জাত কিছুতে ভাঙা যায় না। এই যে রক্তগত জাতের অসামঞ্জস্য এতে মেয়েকে যেমন মর্মান্তিক করে মারে পুরুষকে এমন নয়। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে মোতির মা এই রহস্য নিজের মধ্যে বোঝবার সময় পায় নি, কিন্তু কুমুর ভিতর দিয়ে এই কথাটা সে নিশ্চিত করে অনুভব করলে তার গা কেমন করতে লাগল। ও যেন একটা বিভীষিকার ছবি দেখতে পেলে,— যেখানে একটা অজানা জন্তু লালায়িত রসনা মেলে গুঁড়ি মেরে বসে আছে, সেই অন্ধকার গুহার মুখে কুমুদিনী দাঁড়িয়ে দেবতাকে ডাকছে। মোতির মা রেগে উঠে মনে-মনে বললে, “দেবতার মুখে ছাই! যে-দেবতা ওর বিপদ ঘটিয়েছে সেই নাকি ওকে উদ্ধার করবে! হায় রে।”
পরের দিন সকালেই কুমু দাদার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছে, “ভগবান তোমাকে আশীর্বাদ করুন।” সেই টেলিগ্রামের কাগজখানি জামার মধ্যে বুকের কাছে রেখে দিলে। এই টেলিগ্রামে যেন দাদার দক্ষিণ হাতের স্পর্শ। কিন্তু দাদা নিজের শরীরের কথা কেন কিছুই লিখলে না? তবে কি অসুখ বেড়েছে? দাদার সব খবরই মুহূর্তে মুহূর্তে যার প্রত্যক্ষগোচর ছিল, আজ তার কাছে সবই অবরুদ্ধ।
আজ ফুলশয্যা, বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। আত্মীয়-মেয়েরা সমস্ত দিন কুমুকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কিছুতে তাকে একলা থাকতে দিলে না। আজ একলা থাকবার বড়ো দরকার ছিল।
শোবার ঘরের পাশেই ওর নাবার ঘর; সেখানে জলের কল পাতা এবং ধারা-স্নানের ঝাঁঝরি বসানো। কোনো অবকাশে বাক্স থেকে যুগলরূপের ফ্রেমে-বাঁধানো পটখানি বের করে স্নানের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। সাদা পাথরের জলচৌকির উপর পট রেখে সামনে মাটিতে বসে নিজের মনে বারবার করে বললে, “আমি তোমারই, আজ তুমিই আমাকে নাও। সে আর কেউ নয়, সে তুমিই, সে তুমিই, সে তুমিই। তোমারই যুগল-রূপ প্রকাশ হোক আমার জীবনে।”
ডাক্তাররা বলছে বিপ্রদাসের ইনফ্লুয়েঞ্জা ন্যুমোনিয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। নবগোপাল একলা কলকাতায় এল ফুলশয্যার সওগাত পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। খুব ঘটা করেই সওগাত পাঠানো হল। বিপ্রদাস নিজে থাকলে এত আড়ম্বর করত না।
কুমুর বিবাহ উপলক্ষ্যে ওর বড়ো বোন চারজনকেই আনতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু খবর রটে গেছে—ঘোষালরা সদ্ব্রাহ্মণ নয়। বাড়ির লোক এ-বিয়েতে কিছুতে তাদের পাঠাতে রাজি হল না। কুমুর তৃতীয় বোন যদি বা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে বিয়ের পরদিন কলকাতায় এসে পৌঁছল, নবগোপাল বললে, “ও বাড়িতে তুমি গেলে আমাদের মান থাকবে না।” বিবাহরাত্রির কথা আজও সে ভুলতে পারে নি। তাই প্রায়-অসম্পর্কীয় গুটিকয়েক ছোটো ছোটো মেয়ে এক বুড়ী দাসীর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলে নিমন্ত্রণ রাখতে। কুমু বুঝলে, সন্ধি এখনও হল না, হয়তো কোনো কালে হবে না।
কুমুর সাজসজ্জা হল। ঠাট্টার সম্পর্কীয়দের ঠাট্টার পালা শেষ হয়েছে— নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো শুরু হবে। মধুসূদন আগে থাকতেই বলে রেখেছিল, বেশি রাত করলে চলবে না, কাল ওর কাজ আছে। ন-টা বাজবামাত্রই হুকুম-মতে নিচের উঠোন থেকে সশব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। আর এক মুহূর্ত না। সময় অতিক্রম করবার সাধ্য কারও নেই। সভা ভঙ্গ হল। আকাশ থেকে বাজপাখির ছায়া দেখতে পেয়ে কপোতীর যেমন করে, কুমুর বুকটা তেমনি কাঁপতে লাগল। তার ঠাণ্ডা হাত ঘামছে, তার মুখ বিবর্ণ। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই মোতির মার হাত ধরে বললে, “আমাকে একটুখানির জন্যে কোথাও নিয়ে যাও আড়ালে। দশ মিনিটের জন্যে একলা থাকতে দাও।” মোতির মা তাড়াতাড়ি নিজের শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে। বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললে, “এমন কপালও করেছিলি।”
দশ মিনিট যায়, পনেরো মিনিট যায়। লোক এল,— বর শোবার ঘরে গেছে, বউ কোথায়? মোতির মা বললে, “অত ব্যস্ত হলে চলবে কেন? বউ গায়ের জামা গয়নাগুলাে খুলবে না?” মােতির মা যতক্ষণ পারে ওকে সময় দিতে চায়। অবশেষে যখন বুঝলে আর চলবে না তখন দরজা খুলে দেখে, বউ মূর্ছিত হয়ে মেজের উপর পড়ে আছে।
গােলমাল পড়ে গেল। ধরাধরি করে বিছানার উপর তুলে দিয়ে কেউ জলের ছিটে দেয়, কেউ বাতাস করে। কিছুক্ষণ পরে যখন চেতনা হল, কুমু বুঝতে পারলে না কোথায় সে আছে— ডেকে উঠল, “দাদা”। মােতির মা তাড়াতাড়ি তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললে, “ভয় নেই দিদি, এই যে আমি আছি।” বলে ওর মুখটা বুকের উপর তুলে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। সবাইকে বললে, “তােমরা ভিড় ক’রাে না আমি এখনই ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি।” কানে-কানে বলতে লাগল, “ভয় করিস নে ভাই, ভয় করিস নে।” কুমু ধীরে ধীরে উঠল। মনে-মনে ঠাকুরের নাম করে প্রণাম করলে। ঘরের অন্য পাশে একটা তক্তাপােশের উপর হাবলু গভীর ঘুমে মগ্ন— তার পাশে গিয়ে তার কপালে চুমাে খেলে। মােতির মা তাকে শোবার ঘর পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এখনও ভয় করছে দিদি?”
কুমু হাতের মুঠো শক্ত করে একটু হেসে বললে, “না, আমার কিচ্ছু ভয় করছে না।” মনে-মনে বলছে, “এই আমার অভিসার, বাইরে অন্ধকার ভিতরে আলাে।”
মেরে গিরিধর গােপাল ঔর নাহি কোহি।
ইতিমধ্যে শ্যামাসুন্দরী হাঁপাতে হাঁপাতে মধুকে এসে জানালে, “বউ মুর্ছো গেছে।” মধুসূদনের মনটা দপ করে জ্বলে উঠল; বললে, “কেন, তাঁর হয়েছে কী?”
“তা তো বলতে পারি নে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল। তা একবার কি দেখতে যাবে?”
“কী হবে! আমি তো ওর দাদা নই।”
“মিছে রাগ করছ ঠাকুরপো, ওরা বড়োঘরের মেয়ে, পোষ মানতে সময় লাগবে।”
“রোজ রোজ উনি মুর্ছো যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিস করব। এই জন্যেই কি ওঁকে বিয়ে করেছিলুম?”
“ঠাকুরপো তোমার কথা শুনে হাসি পায়। তা দোষ হয়েছে কী, আমাদের কালে কথায় কথায় মানিনীর মান ভাঙাতে হত, এখন না হয় মুর্ছো ভাঙাতে হবে।”
মধুসূদন গোঁ হয়ে বসে রইল। শ্যামাসুন্দরী বিগলিত করুণায় কাছে এসে হাত ধরে বললে, “ঠাকুরপো অমন মন খারাপ ক’রো না, দেখে সইতে পারি নে।”
মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেয় ইতিপূর্বে এমন সাহস শ্যামার ছিল না। প্রগল্ভা শ্যামা ওর কাছে ভারি চুপ করে থাকত; জানত মধুসূদন বেশি কথা সইতে পারে না। মেয়েদের সহজ বুদ্ধি থেকে শ্যামা বুঝেছে মধুসূদন আজ সে-মধুসূদন নেই। আজ ও দুর্বল, নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। মধুর হাতে হাত দিয়ে বুঝল এটা ওর খারাপ লাগে নি। নববধূ ওর অভিমানে যে ঘা দিয়েছে, কোনো একটা জায়গা থেকে চিকিৎসা পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটু আরাম বোধ হয়েছে। শ্যামা অন্তত ওকে অনাদর করে না এটা তো নিতান্ত তুচ্ছ কথা নয়। শ্যামা কি কুমুর চেয়ে কম সুন্দরী, না হয় ওর রং একটু কালো,— কিন্তু ওর চোখ, ওর চুল, ওর রসালো ঠোঁট!
শ্যামা বলে উঠল, “ওই আসছে বউ, আমি যাই ভাই। কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারাগি ক’রো না, আহা, ও ছেলেমানুষ!”
কুমু ঘরে ঢুকতেই মধুসূদন আর থাকতে পারলে না, বলে উঠল, “বাপের বাড়ি থেকে মুর্ছো অভ্যেস করে এসেছ বুঝি? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ওই নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে।”
কুমু নির্নিমেষ চোখ মেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, একটি কথাও বললে না।
মধুসূদন ওর মৌন দেখে আরও রেগে গেল। মনের গভীর তলায় এই মেয়েটির মন পাবার জন্যে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বলেই ওর এই তীব্র নিষ্ফল রাগ। বলে উঠল, “আমি কাজের লোেক, সময় কম, হিসটিরিয়াওআলী মেয়ের খেদমদগারি করবার ফুরসত আমার নেই, এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।”
কুমু ধীরে ধীরে বললে, “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে। তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না।”
কুমু কাকে এ-সব কথা বলছে? ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? মধুসূদন অবাক হয়ে গেল, ভাবলে এ-মেয়ে ঝগড়া করে না কেন? এর ভাবখানা কী?
মধুসূদন বক্রোক্তি করে বললে, “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচতে পারি।”
ও যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ-কথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্যে মূঢ় আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না।
কুমু বললে, “দেখো, নিষ্ঠুর হও তো হ’য়ো, কিন্তু ছোটো হ’য়ো না।” বলে সোফার উপর বসে পড়ল।
কর্কশস্বরে মধুসূদন বলে উঠল, “কী! আমি ছোটো! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো?”
কুমু বললে, “তোমাকে বড়ো জেনেই তোমার ঘরে এসেছি।”
মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বললে, “বড়ো জেনেই এসেছ, না, টাকার লোভে?”
তখন কুমু সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে খোলা ছাদে মেজের উপর গিয়ে বসল।
কলকাতায় শীতকালের কৃপণ রাত্রি, ধোঁয়ায় কুয়াশায় ঘোলা, আকাশ অপ্রসন্ন, তারার আলো যেন ভাঙা গলার কথার মতো। কুমুর মন তখন অসাড়, কোনো ভাবনা নেই, কোনো বেদনা নেই। একটা কুয়াশার মধ্যে সে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে।
কুমু যে এমন করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে মধুসূদন এ একেবারে ভাবতেই পারে নি। নিজের এই পরাভবের জন্যে সকলের চেয়ে রাগ হচ্ছে কুমুর দাদার উপর। শোবার ঘরে চৌকির উপরে বসে পড়ে শূন্য আকাশের দিকে সে একটা ঘুষি নিক্ষেপ করলে। খানিকক্ষণ বসে থেকে ধৈর্য আর রাখতে পারলে না। ধড়ফড় করে উঠে ছাদে বেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলে, “বড়োবউ।”
কুমু চমকে উঠে পিছন ফিরে দাঁড়ালে।
“ঠাণ্ডায় হিমে বাইরে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? চলো ঘরে।”
কুমু অসংকোচে মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মধুসূদনের মধ্যে যেটুকু প্রভুত্বের জোর ছিল তা গেল উড়ে। কুমুর বাঁ হাত ধরে আস্তে আস্তে বললে, “এস ঘরে।”
কুমুর ডানহাতে তার দাদার আশীর্বাদের সেই টেলিগ্রাম ছিল সেটি সে বুকে চেপে ধরল। স্বামীর হাত থেকে হাত টেনে নিলে না, নীরবে ধীরে ধীরে শোবার ঘরে ফিরে গেল।
পরদিন ভোরে যখন কুমু বিছানায় উঠে বসেছে তখন ওর স্বামী ঘুমোচ্ছ। কুমু তার মুখের দিকে চাইলে না, পাছে মন বিগড়ে যায়। অতি সাবধানে উঠে পায়ের কাছে প্রণাম করলে, তার পরে স্নান করবার ঘরে গেল। স্নান সারা হলে পর পিছন দিকের দরজা খুলে গিয়ে বসল ছাদে, কুয়াশার ভিতর দিয়ে পূর্ব-আকাশে একটা মলিন সোনার রেখা তখন দেখা দিয়েছে।
বেলা হল, রোদ্দুর উঠল যখন, কুমু আস্তে আস্তে শোবার ঘরে ফিরে এসে দেখলে তার স্বামী তখন চলে গেছে। আয়নার দেরাজের উপর তার পুঁতির কাজ-করা থলিটি ছিল। তার মধ্যে দাদার টেলিগ্রামের কাগজটি রাখবার জন্যে সেটা খুলেই দেখতে পেলে সেই নীলার অংটি নেই।
সকালবেলাকার মানসপূজার পর তার মুখে যে একটি শান্তির ভাব এসেছিল সেটা মিলিয়ে গিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল। কিছু মিষ্টি ও দুধ খাওয়াবে বলে ডাকতে এল মোতির মা। কুমুর মুখে জবাব নেই, যেন কঠিন পাথরের মূর্তি।
মোতির মা ভয় পেয়ে পাশে এসে বসল— জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে, ভাই?” কুমুর মুখে কথা বেরোল না, ঠোঁট কাপতে লাগল।
“বলো, দিদি, আমাকে বলো, কোথায় তোমার বেজেছে?”
কুমু রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললে, “নিয়ে গেছে চুরি করে!”
“কী নিয়ে গেছে দিদি?”
“আমার আংটি, আমার দাদার আশীর্বাদী আংটি।”
“কে নিয়ে গেছে?”
কুমু উঠে দাঁড়িয়ে কারও নাম না করে বাইরের অভিমুখে ইঙ্গিত করলে।
“শান্ত হও ভাই, ঠাট্টা করেছে তোমার সঙ্গে, আবার ফিরিয়ে দেবে।”
“নেব না ফিরিয়ে— দেখব কত অত্যাচার করতে পারে ও!”
“আচ্ছা, সে হবে পরে, এখন মুখে কিছু দেবে এস।”
“না, পারব না; এখানকার খাবার গলা দিয়ে নাববে না।”
“লক্ষ্মীটি ভাই, আমার খাতিরে খাও।”
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, আজ থেকে আমার নিজের বলে কিছুই রইল না?”
“না, রইল না। যা-কিছু রইল তা স্বামীর মর্জির উপরে। জান না চিঠিতে দাসী বলে দস্তখত করতে হবে।”
দাসী! মনে পড়ল, রঘুবংশের ইন্দুমতীর কথা—
গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ
প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ—
ফর্দের মধ্যে দাসী তো কোথাও নেই। সত্যবানের সাবিত্রী কি দাসী? কিংবা উত্তররামচরিতের সীতা?
কুমু বললে, “স্ত্রী যাদের দাসী তারা কোন্ জাতের লোক?”
“ও-মানুষকে এখনও চেন নি। ও যে কেবল অন্যকে গোলামি করায় তা নয়, নিজের গোলামি নিজে করে। যেদিন আপিসে যেতে পারে না নিজের বরাদ্দ থেকে সেদিনকার টাকা কাটা পড়ে। একবার ব্যামো হয়ে এক মাসের বরাদ্দ বন্ধ ছিল, তার পরের দু-তিন মাস খাইখরচ পর্যন্ত কমিয়ে লোকসান পুষিয়ে নিয়েছে। এতদিন আমি ঘরকন্নার কাজ চালিয়ে আসছি সেই অনুসারে আমারও মাসহারা বরাদ্দ। আত্মীয় বলে ও কাউকে মানে না। এ-বাড়িতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম।”
কুমু একটু চুপ করে থেকে বললে, “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব। আমি এ-বাড়িতে বিনা মাইনের স্ত্রী বাঁদী হয়ে থাকব না। চলো, আমাকে কাজে ভরতি করে নেবে। ঘরকন্নার ভার তোমার উপরেই তো,—আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে।”
মোতির মা হেসে কুমুর চিবুক ধরে বললে, “তাহলে তো আমার কথা মানতে হবে। আমি হুকুম করছি; চলো এখন খেতে।”
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে, “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না।”
মোতির মা বললে, “কাঠুরে গাছকে কাটতেই জানে, সে গাছ পায় কাঠ পায়। মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল। তুমি পড়েছ কাঠুরের হাতে, ও যে ব্যবসাদার। ওর মনে দরদ নেই কোথাও।”
এক সময়ে শোবার ঘরে ফিরে এসে কুমু দেখলে, তার টিপাইয়ের উপর একশিশি লজেঞ্জস। হাবলু তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে নিবেদন করে নিজে কোথায় লুকিয়েছে। এখানে পাষাণের ফাঁক দিয়েও ফুল ফোটে। বালকের এই লজেঞ্জসের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কাঁদালে হাসালে। তাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখে বাইরে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারণ করেছিল। তার ভয় ছিল পাছে কোনো কিছু উপলক্ষ্যে কর্তার বিরক্তি ঘটে। মোটের উপরে, মধুসূদনের নিজের কাজ ছাড়া অন্য বাবদে তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই নিরাপদ, এ-কথা এ-বাড়ির সবাই জানে।
কুমু হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে কোলে বসালে। ওর গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুল-জাতীয় যা-কিছু জিনিস ছিল সেইগুলো দুজনে নাড়াচাড়া করতে লাগল। কুমু বুঝতে পারলে একটা কাগজচাপা হাবলুর ভারি পছন্দ— কঁচের ভিতর দিয়ে রঙিন ফুল যে কী করে দেখা যাচ্ছে সেইটে বুঝতে না পেরে ওর ভারি তাক লেগেছে।
কুমু বললে, “এটা নেবে গোপাল?”
এতবড়ো অভাবনীয় প্রস্তাব ওর বয়সে কখনো শোনে নি। এমন জিনিসও কি ও কখনো আশা করতে পারে? বিস্ময়ে সংকোচে কুমুর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইল।
কুমু বললে, “এটা তুমি নিয়ে যাও।”
হাবলু আহ্লাদ রাখতে পারলে না— সেটা হাতে নিয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল।
সেইদিন বিকেলে হাবলুর মা এসে বললে, “তুমি করেছ কী ভাই? হাবলুর হাতে কাঁচের কাগজচাপা দেখে বড়ঠাকুর হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছে। কেড়ে তে নিয়েইছে—— তার পর তাকে চোর বলে মার। ছেলেটাও এমনি, তোমার নামও করে নি। হাবলুকে আমিই যে জিনিসপত্র চুরি করতে শেখাচ্ছি এ-কথাও ক্রমে উঠবে!”
কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল।
এমন সময়ে বাইরে মচ মচ শব্দে মধুসূদন আসছে। মোতির মা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। মধুসূদন কাঁচের কাগজচাপা হাতে করে যথাস্থানে ধীরে ধীরে সেটা গুছিয়ে রাখলে। তার পরে নিশ্চিতপ্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত গম্ভীর স্বরে বললে, “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো।”
কুমু তীক্ষ্ণ স্বরে বললে, “ও চুরি করে নি।”
“আচ্ছা, বেশ, তাহলে সরিয়ে নিয়েছে।”
“না, আমিই ওকে দিয়েছি।”
“এমনি করে ওর মাথা খেতে বসেছ বুঝি? একটা কথা মনে রেখো, আমার হুকুম ছাড়া জিনিসপত্র কাউকে দেওয়া চলবে না। আমি এলোমেলো কিছুই ভালোবাসি নে।”
কুমু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “তুমি নাও নি আমার নীলার আংটি?”
মধুসূদন বললে, “হাঁ নিয়েছি।”
“তাতেও তোমার ওই কাঁচের ঢেলাটার দাম শোধ হল না?”
“আমি তো বলেছিলুম, ওটা তুমি রাখতে পারবে না।”
“তোমার জিনিস তুমি রাখতে পারবে, আর আমার জিনিস আমি রাখতে পারব না?”
“এ-বাড়িতে তোমার স্বতন্ত্র জিনিস বলে কিছু নেই।”
“কিছু নেই? তবে রইল তোমার এই ঘর পড়ে।”
কুমু যেই গেছে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে শ্যামা ঘরে প্রবেশ করে বললে, “বউ কোথায় গেল?”
“কেন?”
“সকাল থেকে ওর খাবার নিয়ে বসে আছি, এ-বাড়িতে এসে বউ কি খাওয়াও বন্ধ করবে?”
“তা হয়েছে কী? নুরনগরের রাজকন্যা না হয় নাই খেলেন? তোমরা কি ওঁর বাঁদী নাকি।”
“ছি ঠাকুরপো, ছেলেমানুষের উপর অমন রাগ করতে নেই। এমন না খেয়ে খেয়ে কাটাবে এ আমরা সহ্য করতে পারি নে। সাধে সেদিন মুর্ছো গিয়েছিল?”
মধুসূদন গর্জন করে উঠল, “কিছু করতে হবে না, যাও চলে! খিদে পেলে আপনিই খাবে।”
শ্যামা যেন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে চলে গেল।
মধুসূদনের মাথায় রক্ত চড়তে লাগল। দ্রুতবেগে নাবার ঘরে জলের ঝাঁঝরি খুলে দিয়ে তার নিচে মাথা পেতে দিলে।