Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মিসির আলি আপনি কোথায় || Humayun Ahmed » Page 8

মিসির আলি আপনি কোথায় || Humayun Ahmed

মনে হয় বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেসন হয়েছে। দুপুর থেকে আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর থেকে টিপটপ বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস। তাঁরকুল ইসলাম আনন্দিত— ঝড় বৃষ্টি উপলক্ষে বিশেষ কিছু রান্না হবে। খিচুড়ি, ঝাল গরুর মাংস। ময়মনসিংহে BT ট্রেনিংয়ের সময় তিনি গরুর মাংস রান্নার একটা পদ্ধতি শিখেছিলেন। সেটা করবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। মাটির হাঁড়িতে মাংস, লবণ সামান্য তেল এবং এক গাদা কাচামরিচ দিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দেয়া। অন্য সব মসলা নিষিদ্ধ। মাংসের বিশেষ যে গন্ধ আছে, কাচামরিচ সেই গন্ধ নষ্ট করবে। আলাদা ফ্লেভার নিয়ে আসবে।। তিনি নিজেই গরুর মাংস আনতে গেলেন। গ্রামে কসাই-এর কোনো স্থায়ী দোকান নেই। শুধু হাটবারে মাংস বিক্রি হয়। সৌভাগ্যক্রমে আজ হাটবার।

বাড়িতে মেহমান শুধু না, জামাইও উপস্থিত। বিশেষ বিশেষ রান্নার অতি উপযুক্ত উপলক্ষ।

মিসির আলি নিজের ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে আছেন। তিনি খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার পায়ের উপর কম্বল। তার সামনে বসেছে আয়না এবং ফারুক। এরা দু’জন বসেছে খাটের শেষ প্রান্তে। সোলার লাইট কাজ করছে না। মেঘলা দিন ছিল বলেই প্যানেল চার্জ হয়নি। ঘরে হরিকেন জ্বলছে। টেবিলে দেয়াশলাই এবং মোমবাতি রাখা আছে।

ফারুক বলল, স্নাতটা ভূতের গল্পের জন্যে অসাধারণ। স্যার আমি অতিথিপুর রেলস্টেশনে একবার একটা ভূত দেখেছিলাম। এই গল্পটা বলব? ভূত সাধারণত মানুষের সাইজের কিংবা মানুষের চেয়ে লম্বা হয়। এই ভূতটা বামণ। ছয় সাত বছরের ছেলের হাইট।

মিসির আলি বললেন, ভূতের গল্প থাকুক। তুমি বরং আয়নার গল্প শোনাও। তুমি একজন সাইকোলজিস্ট। তোমার চোখে আয়না মেয়েটি কি? তুমি তার অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের নিশ্চয়ই কোনো ব্যাখ্যাও দাঁড়া করিয়েছ। সেই ব্যাখ্যাও শুনি। আয়নার কি আপত্তি আছে?

আয়না মুখে কিছু বলল না। তবে মাথা নাড়িয়ে জানালো তার আপত্তি নেই।

মিসির আলি তার ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সামনে সিগারেট খেতে কোনো বাধা নেই। সিগারেট ধরাও। আমি দেখলাম সিগারেটের খোঁজে পকেটে হাত দিয়ে চট করে হাত বের করে নিয়েছ তাই বললাম।

ফারুক বলল, আমার সিগারেট লাগবে না। আপনার কথায় হঠাৎ টেনশান তৈরি হয়েছিল বলে সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিয়েছিলাম। স্যার আয়না বিষয়ে আমার যা বলার তা ডায়েরিতে লিখেছি। এর বাইরে তেমন কিছু নেই।

মিসির আলি বললেন, আয়না এবং তুমি তোমরা দু’জনই ডিলিউসনে ভূগছ এমন কি কখনো মনে হয়েছে?

জ্বি স্যার হয়েছে। শুরুতে আমি নিজেকেই। Delusion এর Patient ভেবেছি! এক সময় নিশ্চিত হয়েছি সমস্যা আমার না।

কি ভাবে নিশ্চিত হয়েছ?

ফারুক বলল, আঙুর মেয়েটা যখন দেখল তার আপ ঢুকে পড়ছে আয়নার ভেতরে তখন আঙুর নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে। সে এমন একটা ঘটনা বানিয়ে বলবে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার স্ত্রীর মানসিক ক্ষমতা প্রবল। সে তার ক্ষমতা দিয়ে আঙুর মেয়েটিকে প্রভাবিত করতে পারে। এমন এক illusion তৈরি করতে পারে যাতে আঙুরের ধারণা হবে তাঁর আপা আয়নার ভেতর ঢুকে গেছে।

ফারুক বলল, আয়না এই কাজ কখনো করবে না। সে আঙুরকে খুব পছন্দ করে। সে তাকে পালক পর্যন্ত নিতে চেয়েছে। মেয়েটা ভয় পায় এমন কিছু সে করবে না।

মিসির আলি বললেন, আয়নার ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বসানোর কথা কখনো ভেবেছ? CCTV. সারাক্ষণ এই টিভি চলবে। আয়নার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের রেকর্ড থাকবে। আয়নার ভেতর ঢুকুল কি ঢুকাল না জানা যাবে।

ফারুক বলল, এটা মাথায় আসে। नि। স্যার এখন আমি একটা সিগারেট ধরাব। হঠাৎ টেনশান বোধ করছি।

মিসির আলি বললেন, সিপারেট ধরাও। একটা বড় আয়না নিয়ে আস। আয়নাটা ব্যবহার করে আমি হিপনোটিক সাজেশন দেব। তোমাদের দু’জনকেই দেব। আয়না রাজি আছে। ফারুক! তুমিও নিশ্চয়ই রাজি।

ফারুক বলল, আপনি যা করতে বলবেন, আমি করব। আমি আয়না নিয়ে আসছি।

ফারুক আয়না আনতে গেল। মিসির আলি নিজেও একটা সিগারেট ধরালেন। আয়না বলল, চা খাবেন স্যার?

মিসির আলি বললেন, ঘন ঘন চা খাবার অভ্যাস আমার নেই। তোমার পাল্লায় পড়ে চা খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে, পান খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে। এখন চা পান কোনোটাই না। তুমি আমাকে এক পিস সাদা কাগজ এবং কলম দাও।

ফারুক আয়না নিয়ে এসেছে। মিসির আলি আয়নাটা তাদের দিকে ধরেছেন। তিনি বসেছেন আয়নার পেছনে। ফারুক বলল, স্যার কেন জানি আমার ভয় ভয় লাগছে।

মিসির আলি বললেন, এই কাগজ এবং কলম নাও! কাগজে লেখ, আমার ভয় ভয় লাগছে। উল্টো করে লিখবে। তোমার ডায়েরিতে তুমি যেমন উল্টো করে লিখেছি সে রকম। তোমার লেখা শেষ হবে। আর হিপনোটিক সাজেশন শুরু হবে।

ফারুক লিখছে— তার সময় লাগছে। আয়না আগ্রহ নিয়ে ফারুকের লেখা দেখছে, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ফারুকের দিকে। মিসির আলি বললেন, ফারুক তোমার কি Dyslexia আছে? যেখানে মানুষ উল্টো করে লেখে?

ফারুক বলল, জি না স্যার।

মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের না? তুমি পুরো একটা চ্যাপ্টার উল্টো করে লিখেছি। নির্ভুল ভাবে লিখেছি আর এখন একটা বাক্য লিখতে পারছি না। তোমার কপাল ঘামছে।

ফারুক কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, স্যার একটা সিগারেট খাব ৷

খাও। একবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি— বার বার অনুমতি চাইতে হবে না। লেখা শেষ?

জ্বি না। লেখা উল্টো হয়েছে কিন্তু মিরর ইমেজ হয় নি।

বাদ দাও পরে লিখবো। সিগারেট শেষ করে- আমরা হোপনোসিস শুরু করব। আয়নাকে নিয়ে আমি এখন। তিনটা হাইপোথিসিস দাঁড়া করিয়েছি। এক এক করে বলি—

হাইপোথিসিস-A

এখানে আমি ধরে নিচ্ছি। আয়নার ভেতর ঢুকে পড়ার অস্বাভাবিক ক্ষমতা এই মেয়েটির আছে! এই হাইপোথিসিসের পেছনে আছে মেয়েটির নিজের স্বীকারোক্তি। ফারুকের বক্তব্য এবং আঙ্গুর মেয়েটির বক্তব্য। বিজ্ঞান এই হাইপোথিসিস অগ্রাহ্য করবে। আমি নিজেও অগ্ৰাহ্য করছি। তারপরেও হাইপোথিস দাঁড়া করানো হ’ল। ভুলের ভেতর দিয়ে শুদ্ধকে খোঁজার নিয়ম আছে।

হাইপোথিসিস-B

হাইপোথিসিস বলছে- আয়নার ভেতর কেউ কখনো ঢুকেনি। এক Reality থেকে অন্য Reality তে যেতে হলে আয়না লাগে না। বিছানায় শুয়ে শুয়েও একজন মানুষ Reality বদলাতে পারে। বিজ্ঞান এই হাইপোথিসিস সমর্থন করবে।

হাইপোথিসিস-C

এই হাইপোথিসিস বলছে পুরো ব্যাপারটাই আয়নার স্বামী ফারুকের কল্পনা। যে সাইকোলজির ছাত্র। Delusion এর বিষয়টা সে জানে। আয়না তার Delusion এ সাহায্য করেছে। মার্থ নামের এক বাচন মেয়ে বলতো সে আয়না জগতে বাস করে। মার্থার কাহিনী ফারুকের Delusion কে ট্রিগার করেছে। তার স্ত্রীর আয়না প্রীতি তাকে সাহায্য করেছে। তার স্ত্রীর নামও আয়না। সব কিছুই তাকে সাহায্য করেছে।

আয়না ৱাতে তার স্বামীর সঙ্গে ঘুমায় না। এটিও ফারুকের Delusion এর অংশ। ফারুক চায় না তার সঙ্গে স্ত্রীর রাত্রি যাপন করতে।

মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে ফারুক বলল, স্যার আমি কেন চাইব না?

মিসির আলি বললেন, তুমি নারী বিদ্বেষী পুরুষদের একজন। বিয়ের আগে তোমার ইচ্ছা হয়নি যে মেয়েটিকে বিয়ে করবে তাকে দেখতে বা তার ছবি দেখতে। বিয়ের পরেও দীর্ঘ সময় তাকে এই বাড়িতে ফেলে রেখেছ। নিজের কাছে নিয়ে যাও নি।

ফারুক বলল, স্যার কোয়ার্টার পাচ্ছিলাম না।

মিসির আলি বললেন, আগ্রহ থাকলে তুমি বাড়ি ভাড়া করতে। মেয়েটির সঙ্গে তুমি বাস করতে চাও না। আবার তাকে পুরোপুরি ছেড়েও দিতে চাও না।

ফারুক বলল, স্যার একটা জিনিস আপনার বুঝতে হবে- আয়নার অসাধারণ সাইকিক ক্ষমতার বিষয়টি আপনি জানেন। এ রকম একজন মহিলার সঙ্গে বাস করা অসম্ভব।

মিসির আলি বললেন, তুমি সাইকোলজির ছাত্র। একজন সাইকোলজির ছাত্রের সাইকিক ক্ষমতাধর স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। হয়ে গেল উল্টা।

ফারুক বলল, স্যার আয়না নিজেই কিন্তু বলছে সে আয়নার ভেতর ঢুকে যায়।

মিসির আলি বললেন, সে আদর্শ স্ত্রী’র মতো আচরণ করেছে। স্বামী যা চাচ্ছে তাই বলছে। সাইকোলজির ভাষায় এই ধরনের আচরণের একটা নাম আছে একে বলে Sympathetic delusion.

ফারুক বলল, এই হাইপোথিসিসটাকেই কি আপনি সমর্থন করছেন?

মিসির আলি বললেন, না। আমার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা। এসো হিপনেটিজম শুরু হোক। ফারুক তুমি যদি আরেকটা সিগারেট খেতে চাও খেয়ে নাও। চোখ মুখ শক্ত করে রাখার কিছুই নেই। স্বাভাবিক হও। তোমাকে হিপনোটিক Trance এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। তুমি একজন Observer.

ফারুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আয়না স্বাভাবিক আছে। তার চোখে কৌতূহল। মিসির আলি বললেন, আয়না! আমি শুরু করব?

শুরু করুন।

আমি তোমাকে যা করতে বলব তুমি করবে। আমার উপর এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমি তোমার ক্ষতি করব না। তোমার অমঙ্গল হয় এমন কিছু করব না।

স্যার এই বিশ্বাস আমার আছে।

এখন তাকাও আমার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আয়না জগতে ঢুকে যাবে। সেই জগৎ তোমার জন্যে আনন্দময়। সেখানে ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। ছায়া ছায়া অস্পষ্ট এক জগৎ। তুমি কি তৈরি?

জ্বি।

আয়না জগতে ঢুকে যাবার পর তোমাকে আমি প্রশ্ন করব তুমি উত্তর দেবে। সব প্রশ্নের উত্তর যে দিতে হবে তা-না। তুমি যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না চাও দেবে না।

মিসির আলি কাগজ কলম হাতে নিলেন। কাগজে লিখলেন- নদী, পাখি, ফুল। কাগজটা বলের মতো গুটি পাকিয়ে আয়নার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

আয়না। এই বলটা হাতের মুঠির মধ্যে নাও। এখন তুমি যাত্রা শুরু করেছ। আয়না জগতের দিকে। জগতটা মাটির নিচে। সিঁড়ি বানানো আছে। তুমি একেকটা সিঁড়ি পার হবে। আর আয়না জগতের কাছাকাছি যেতে থাকবে। তোমার এখন ঘুম পাচ্ছে। আয়না ঘুম পাচ্ছে?

পাচ্ছে।

প্রথম সিঁড়ি পার হলে। এইত দ্বিতীয় সিঁড়ি। আয়না! ঘুম পেলে চোখ বন্ধ করে ফেল।

আয়না চোখ বন্ধ করল। মিসির আলি বললেন, একটা সময় আমি বলব আয়না চলে এসো। তুমি আয়না জগত ছেড়ে চলে আসবে। আয়না শুনতে পাচ্ছ?

হুঁ।

তুমি তৃতীয় সিঁড়ি পার হয়েছ। এখন পার হলে চতুর্থ সিঁড়ি। আর একটা ধাপ শুধু বাকি। এই ধাপটা পার হলেই তুমি আয়না জগতে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

অস্পষ্ট।

আয়না বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। সামান্য দুলছে। ফারুক নিজেও বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। সেও দুলছে। মিসির আলি নিশ্চিত আয়না জগতে আয়না একা ঢুকবে না। ফারুক নিজেও ঢুকে যাবে।

আয়না!

হুঁ।

এখন শেষ ধাপ পার হও। আয়না জগতে ঢুকে যাও।

আয়না দুলুনি বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। মিসির আলি ফারুকের দিকে তাকালেন। সেও মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়ার কিছু নেই।

আয়না আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

তুমি কোথায়?

আয়না জগতে।

তুমি একা না। আরো কেউ আছে তোমার সঙ্গে?

ও আছে।

ফারুক যে তোমার সঙ্গে আছে তোমার কি ভালো লাগছে?

লাগছে।

এখন আমি ফারুককে প্রশ্ন করব। ফারুক তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে?

পাচ্ছি।

তুমি কোথায়?

আয়না জগতে।

তোমার কি ভালো লাগছে?

না।

মিসির আলি বললেন, জগৎটা কেমন?

অন্য রকম।

ভয় লাগছে?

না।

এখানে থেকে যেতে চাও?

চাই।

আয়না জগতে এমন কি আছে যা এখানে নেই।

ফারুক থেমে থেমে বলল, আয়না জগৎ অন্য রকম জগৎ- চিন্তা এবং কল্পনার জগৎ।

মিসির আলির সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরতে ধরতে বললেন, আয়না তোমাকে বলছি। ভালো আছে?

জ্বি স্যার।

আয়না জগতে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে?

হুঁ।

আশেপাশে তুমি কি দেখছ?

কিছুই দেখছি না। স্যার। শুধু ওকে আবছা আবছা দেখছি।

কিছুই দেখছি না কেন?

এই জগৎটা কুয়াশার। ঘন কুয়াশায় সব ঢাকা। হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা বাতাসে সামান্য সরে যায়। তখন কিছু কিছু দেখা যায়।

কি দেখা যায়?

সেটা আমি বলব না।

দরজায় টোকা পড়ছে। তরিকুল ইসলামের গলা শোনা গেল। মিসির আলি সাহেব খাবার দেয়া হয়েছে। এমন গরুর মাংস খাবেন যে মৃত্যুর পরেও মনে থাকবে। গরম গরম খেতে হবে। চলে আসেন। কুইক। দুই মিনিট সময়।

মিসির আলি, আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আয়নার ভেতর থেকে চলে এসো।

ওকে কি সঙ্গে করে নিয়ে আসব?

হ্যাঁ। ফারুক! তুমিও আস।

দু’জনের ঘোর এক সঙ্গে ভাঙল। তারা তাকালো মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বললেন, আয়না! তোমার মুঠোয় যে কাগজটা আছে সেটা দাও। চল খেয়ে আসি। ডিনার টাইম।

রাতের খাবার শেষ হয়েছে। তরিকুল ইসলামের আনন্দের সীমা নেই। গরুর মাংস যতটা ভালো হবার কথা তারচেও ভালো হয়েছে। মিসির আলি খাবার ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে এই নিয়ে কখনো কিছু বলেন না। তিনিও বললেন, মাংসের টেস্টটা অদ্ভুত। তরিকুল ইসলাম, মিসির আলির প্লেটে মাংসের বাটি ঢেলে দিলেন। মিসির আলি তেমন আপত্তি করলেন না। আলোচনা খাবার নিয়ে চলতে লাগিল- কে কখন কি সুখাদ্য খেয়েছে সেই গল্প। জানা গেল তরিকুল ইসলামের সবচে পছন্দের খাবার শুকনা মরিচের ভর্তা। শুকনা মরিচের সঙ্গে একটা রসুন দিয়ে পাটায়। পিষে ভরতা তৈরি করতে হয়। খেতে হয় মাড় গলা ভাত দিয়ে। ফারুক বলল, তার পছন্দের কোনো খাবারই পছন্দ না। সে এমন এক জগতে থাকতে চায় যেখানে কাউকে কিছু খেতে হয় না।

তরিকুল ইসলাম বললেন, তোকে তিন দিন কিছু খেতে না দিলে হাম হাম করে খাবি। যা দিবে। তাই খাবি।

আয়না বলল, তিন চার দিনতো আমি না খেয়ে থাকি।

তরিকুল ইসলাম চুপ করে গেলেন। কারণ ঘটনা সত্যি। আয়না। যখন তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বাস করতে থাকে তখন সে কিছু খায় না।

মিসির আলি বারান্দায় বসেছেন বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি হবার কারণেই হয়ত শীত কমে গেছে। মিসির আলির সামনে আয়না এবং ফারুক। মিসির আলি বললেন, তোমরা আগ্রহ নিয়ে বসেছি- আমি তোমাদের বিষয়ে কি বুঝলাম তা জানার জন্যে। আমি কিছুটা বিবৃতই বোধ করছি কারণ তেমন কিছু বুঝতে পারি নি। মানুষকে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নিজের জগতের বাইরের জগত সম্পর্কে জানার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। ম্যাথমেটিশিয়ানরা চার, পােচ, ছয় ডাইমেনশনের অংক বের করেছেন। সবই Abstract ব্যাপার। তারা বলছেন, আমাদের ত্রি মাত্রিক জগৎ হচ্ছে চার মাত্রার জগতের ছায়া। আবার চার মাত্রা হচ্ছে পাঁচ মাত্রার জগতের ছায়া। দারুণ জটিল ব্যাপার ছায়ার জগৎ।

আয়না বলল, আপনি যা বুঝেছেন। তাই বলুন। আয়না জগৎ কি আছে?

মিসির আলি হতাশ গলায় বললেন, আছে। তার প্রমাণ তোমার হাতের মুঠোয় রাখা কাগজ। সেখানে আমি লিখেছিলাম নদী, পাখি, ফুল। তুমি আয়না জগৎ থেকে বের হয়ে আসার পর লেখাগুলি হয়ে গেল উল্টা–mirror image-এই লেখা আয়নার সামনে না ধরলে পড়া যাবে না!

মজার ব্যাপার হচ্ছে ফারুক একটা দীর্ঘ চ্যাপ্টার এই ভাবে লিখেছে। যা সে লিখতে পারে না। ধরে নিচ্ছি। এই চ্যাপ্টারটা নিয়ে সে একবার আয়না জগতে ঢুকেছিল বলে লেখা mirror image হয়েছে। অবশ্যই ফারুক এমন একজন যার সঙ্গে আয়না জগতের যোগাযোগ আছে। ব্যাপারটা সে অতিযত্নে গোপন রেখেছে। আয়নার যে সব ক্ষমতা আছে তার সবই আমার এই ছাত্রের আছে। আমার যখন প্লুরিসি হলো একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। কেউ তার ঠিকানা জানে না। ফারুক ঠিকই উপস্থিত হলো। আমি কিছুদিন পর পর বাসা বদল করি। নতুন ঠিকানা কাউকে জানাই না। ফারুক ঠিকই ঠিকানা জানে। সে চিঠি লিখেছে।

যে ছাত্রকে নামে চিনতে পারছি না তার একটা চিঠিতে আমি ঢাকা ছেড়ে ছাত্রের শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হব আমি সেই লোক না। ফারুক আমাকে প্রভাবিত করেছে। সে প্ৰাণপণ চেষ্টা করেছে রহস্য উদ্ধারের। আমার সাহায্য সেই কারণে নিয়েছে। সরি আমি সাহায্য করতে পারি নি।

তোমাদের জগৎ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। জানতে পারব তাও মনে হচ্ছে না। তবে তোমাদের দু’জনকেই আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি। প্রকৃতি একই ধরনের দু’জনকে কাছাকাছি এনেছে। তার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। তোমরা আলাদা হয়ে না। তার জন্যে তোমাদের যদি পুরোপুরি আয়না জগতে স্থায়ী হতে হয়- হবে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই। Good luck.

মিসির আলি মাজেদকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। মিসির আলি প্ৰতি সন্ধ্যায়। তাকে পড়াতে বসেন। পাঠে তার প্রবল আগ্রহ।

ফারুক বা আয়নার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে তিনি তরিকুল ইসলাম সাহেবের কাছ থেকে অদ্ভুত একটি চিঠি পেয়েছেন—

প্রিয় ভাইসাহেব,
আসসালাম। মহা বিপদে পড়িয়া আপনাকে পত্ৰ দিতেছি। আপনি যে দিবসে ঢাকা রওনা হয়েছেন সেই দিবসের রাতের কথা। খাবার খাওয়ার জন্যে আমার স্ত্রী মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে ডাকতে গেল। রান্না হয়েছে–সরপুটি ভাজা, কৈ মাছের (মিডিয়াম সাইজ) ঝোল এবং টেংরা মাছ (কোল ঝোল) কন্যার মা ফিরে এসে বললেন, ঘরে কেউ নাই। শুধু যে ঘরে কেউ নাই তা-না, বাহিরেও নাই। আমি অনুসন্ধানের বাকি রাখি নাই। জামাই গোপনে স্ত্রীকে নিয়া কর্মস্থলে চলে গেছে তাও সম্ভব না। রেল স্টেশন পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বাহন ছাড়া যাওয়া অসম্ভব। বাড়িতে রিকশা বা টেম্পে আসে নাই। আমি থানায় জিডি এন্ট্রি করিয়াছি। জামাইয়ের কলেজের প্রিসিপ্যাল সাহেবের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করিয়াছি তিনিও কিছু জানেন না। আমার নিজের ধারণা জীনভূতের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক আছে। জীন অনেক সময় পছন্দের ব্যক্তিকে তাহাদের দেশে নিয়া যায় এবং লালন পালন করে। আমি আমার মনের কথা কাউকে বলিতে পারিতেছি না। এখন মোবাইল টেলিফোনের জমানা। এই জমানায় কেউ জীন-ভূত বিশ্বাস করে না। ভাই সাহেব দয়া করিবেন যেন মহা বিপদ হইতে উদ্ধার পাই।

ইতি
তরিকুল ইসলাম

পুনশ্চ: মাশুল মাছের সন্ধানে আছি। পাওয়া মাত্র মোবাইল করিব। চলিয়া আসিবেন।

মিসির আলি বড় দেখে একটা আয়না কিনে নিজের শোবার ঘরে টানিয়ে রেখেছেন। তার ধারণা কোনো এক দিন আয়নায় ফারুক এবং তার স্ত্রীর দেখা পাওয়া যাবে। তাদের কোলে থাকবে অপূর্ব এক শিশু। শিশুটির দুষ্টমী ভর্তি চোখ দেখার তাঁর খুব শখ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 8 of 8 ): « পূর্ববর্তী1 ... 67 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *