আবার মারো
হল না, হল না… আবার মারো। দেখালাম তো, কতবার বলেছি র্যাকেটটা এইভাবে উঁচু করে, কাঁধ পর্যন্ত তুলে পেছনে টানো, তারপর নীচের দিকে নামাও।
তপতী একটা কাল্পনিক বল লক্ষ্য করে ধীরগতিতে ফোরহ্যান্ড মারলেন। নেটের ওধারে দুটি ছেলে গভীর মনোযোগে তাঁকে নকল করে র্যাকেট চালাল।
অনিরুদ্ধ, তোমার চোখ বল থেকে কিন্তু সরে গেল আর মিনু ফোরহ্যান্ড মারার সময় বাঁ পায়ে ভর রেখে ফিনিশটা ঠিক হচ্ছে না। …আচ্ছা, আবার আমি বল। দিচ্ছি। তপতী বল মারলেন অনিরুদ্ধর ডান দিকে। বলটা তার পাঁচ গজ আগে পড়ে উঠে এল কাঁধের ওপর। অনিরুদ্ধর ফোরহ্যান্ড বলের নাগাল পেল না।
মুভ। মুভ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেনিস খেলা যায় না। …লক্ষ করো কোথায় বলটা পড়ছে, অনুমান করো কতটা লাফাবে, সেইমতো তুমিও এগিয়ে এসো। দুপা এগোলেই বলটা পেয়ে যেতে… আচ্ছা, আবার…।
গৌরবর্ণ, এগারো বছরের অনিরুদ্ধর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাকে আর মিনুকে ফোরহ্যান্ড গুলে খাওয়াতে চেষ্টা করছেন তপতী। দুজনকে অন্তত তিরিশবার করে তিনি ফোরহ্যান্ড মারিয়েছেন। মিনু তাঁর কাছে সমস্যা নয়, কিন্তু গোলগাল, ভারী দেহের অনিরুদ্ধ তাঁকে বিব্রত করছে। ছেলেটির চলাফেরা কিঞ্চিৎ গদাইলশকরি, চটপট মাথাটাও কাজ করে না। কোর্টের ধারে চেয়ারে অনিরুদ্ধর ঠাকুমা চোখ কুঁচকে বসে রয়েছেন।
চিনুর হাতে র্যাকেট। সে একাই খেলছে নিজের সঙ্গে। বল আকাশের দিকে মেরে ছুটে যাচ্ছে জমিতে পড়ার আগেই বলটাকে আবার আকাশে তুলে দেওয়ার জন্য। গৌতম আজ আসেনি। সে থাকলে চিনু তার সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়া করে, যখন তপতী ব্যস্ত থাকেন মিনু আর অনিরুদ্ধকে নিয়ে।
এবার মিনু।
তপতী একটু জোরেই বল পাঠালেন এবং তাঁকে অবাক করে মিনু সপাটে বলটা ফেরত দিল তিন ফুট উঁচু নেট ঘেঁষে, ফোরহ্যান্ডে। মারটাকে তারিফ জানাবার সুযোগ পাওয়ার আগেই তাঁর র্যাকেটের দুগজ বাইরে দিয়ে বলটা বেরিয়ে গিয়ে ক্লাবের সুরকির রাস্তা পেরিয়ে একটা নিমগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা দিল। তপতী বলটা পাওয়ার জন্য দুপা দৌড়বার চেষ্টা করেই থেমে গিয়ে হতাশ চোখে বলটার দিকে তাকালেন। চিনু ছুটে গেল বলটা ফিরিয়ে আনতে।
বলটা হাতে নিয়ে চিনু আলতো করে আকাশের দিকে ছুড়ে নেমে আসার সময়। র্যাকেট দিয়ে মাথার ওপর থেকে হিট করল। তপতী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। প্রায় নিখুঁত সার্ভিস! ওইটুকু ছেলে। কী চমৎকার তাঁকে নকল করে ফেলেছে।
চিনু, তুই দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়া। যেরকম করে ফোরহ্যান্ড দেখিয়ে দিয়েছি, মারতে পারবি?
অনেকখানি মাথা হেলিয়ে চিনু বলল, হ্যাঁ-আআ।
তপতী পরপর দশটা বল চিনুকে দিলেন আর সদ্য ছবছর পার হওয়া বাচ্চা ছেলেটি হুবহু মাকে নকল করে ফোরহ্যান্ড মারল। গায়ে জোর কম, দুটো বল। নেটে আটকে গেল, বাকিগুলো এপারে এল দুর্বল গতিতে।
অনিরুদ্ধ, দেখলে তো? ওইটুকু ছেলে কী সুন্দরভাবে শট নিল। তাও ওকে কিছুই শেখাইনি। আর তোমাকে কতবার দেখালাম তবু তুমি পারছ না। নাও, আবার করো।
তপতী অনিরুদ্ধকে নিয়ে আবার শুরু করলেন। কোর্টের একধারে মিনু আর চিনুও ফোরহ্যান্ড আয়ত্ত করার কাজে মন দিল। রীতিমতো গরম পড়ে গেছে। বাতাস নেই, গাছের পাতা নড়ছে না। দরদর ঘামছে সবাই। মহাদেবপুরের একটা কিনারে নির্জন এলাকায় এই ক্লাব। সন্ধ্যার আগে ক্লাব মেম্বাররাও এদিক মাড়ান না। এদিকে লোকচলাচলও কম। তবু পথিকরা, সাইকেল আরোহীরা পথ দিয়ে যাওয়ার সময় টেনিস কোর্টের দিকে একবার তাকাবেই। তাদের দ্রষ্টব্য বিষয় হল। তপতী। সাদা তাঁতের শাড়ি গাছকোমর করে বাঁধা, পায়ে কেডস জুতো, অবিরাম চেঁচিয়ে যাওয়া একটা বউ, আর চারটি বা তিনটি বাচ্চা ছেলে প্রকাশ্যে একটা অপরিচিত খেলা খেলছে, হোক না শিল্পশহর বা কলকাতা থেকে মাত্র আটাশ মাইল দূরে, এখানে সেটা দেখার মতো ব্যাপার।
কিন্তু ক্লাব মেম্বারদের বাড়ির কেউ কৌতূহলবশে বা নিছক উৎসাহ দিতেও বিকেলে আসেন না। রাজেনের কাজের ছুটি যখন হয় তখন তপতী ছেলেদের নিয়ে বাড়ির পথে। তবু ছুটির দিনে কলকাতার আড্ডা ফেলে দু-তিনবার সে এসেছে।
বউদি, বাচ্চাদের আমি ঠিক হ্যান্ডল করতে পারি না, আমার ধৈর্যটা একটু কম। তা ছাড়া ছুটির পর এত টায়ার্ড লাগে! রাজেন বলেছিল। কিন্তু প্রাথমিক যা করা দরকার, অ আ ক খ শেখানো, সেটা তো আপনি ভালভাবেই শেখাচ্ছেন।
ইলাহাবাদে যার কাছে প্রথম শিখেছিলাম, তিনি যা-যা করেছিলেন আমি সেটাই করে যাচ্ছি ঠাকুরপো। কিন্তু আমারও তো বিদ্যের একটা সীমা আছে। ওপরের দিকের খেলার কিছুই জানি না। খেলার বই কি ম্যাগাজিন, বিশেষ করে টেনিসের, কিছুই আমাদের দেশে নেই যে, পড়ে-পড়ে শিখব। বিদেশ থেকে হয়তো বইটই আসে, কিন্তু কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না।
ছোটবেলায় আমরা খবরের কাগজে উইম্বলডনের রেজাল্ট কি দু-একটা ছবি দেখতাম। বিয়ের আগে দাদার কাছে অনেকের নাম শুনতাম। এখনও কয়েকটা নাম মনে আছে ডোনাল্ড বাজ, ববি রিগস, ক্র্যামার, বরোত্রা, পাঞ্চো গঞ্জালেস; মেয়েদের মধ্যে লুই ব্রাও, মুডি, হার্ট। বিয়ের পর খেলা থেকে এতদূরে চলে। গেলাম যে, খবরের কাগজের খেলার পাতাটাও আর দেখতাম না। তপতীর স্বর ছেলেবেলার স্মৃতি আর বর্তমানের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন বিষণ্ণতায় ভরে রয়েছে।
বউদি, ছোটদের খেলা শেখানোর সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি কী জানেন? ভাল প্লেয়ারদের খেলা ওদের নিজের চোখে দেখাননা। ওরা তা হলে নিজেরাই বুঝে নিতে পারবে কোনটা করতে হবে আর কোনটা করতে হবে না। একটা ছেলে। দশটা বই পড়ে যা জানবে, মাত্র একটা ভাল ম্যাচ দেখেই সেটা সে শিখে নিতে পারবে। অবশ্য যদি তার মনে ইচ্ছা আর ঘটে কিছু বুদ্ধি থাকে। আর কিছুদিন পরই তো সাউথ ক্লাবে ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ হবে। সুইডেনের হলস্ট্রোম ইন্ডিয়ান সার্কিটে এখন খেলছে, ওকে আনার চেষ্টা চলছে। আমাদের কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপ তো থাকবেই। ফাইনালের দিন ছেলেদের নিয়ে চলুন। রাজেন অনুরোধ করেছিল খুব আন্তরিকভাবে। আমি আপনাদের সবাইকে নিয়ে যাব। এই বয়সে ওদের খেলা দেখাটা খুব দরকার।
কিন্তু এখন তিনি অনিরুদ্ধকে বারবার বল দিয়ে দেখিয়ে এবং মুখে বলেও, ফোরহ্যান্ড মারার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাঁধ কতটা ঘুরবে আর র্যাকেট কতটা উঠবে ফলো-থুতে সেটা ঠিক করাতে পারলেন না।
মা, অনিরুদ্ধটা একটা ভোঁদা। মিনু বলে উঠল। চিনুর সঙ্গে খেলতে খেলতে সে লক্ষ করছিল তপতীর নাকাল অবস্থাটা।
তুমি বরং আমাদের সঙ্গে খেলো।
তপতীও তাই ভাবছিলেন, শুধুই পণ্ডশ্রম করে যাচ্ছেন। বাড়ির আদুরে এই ছেলেটির টেনিস কেন, কোনও খেলাই হবে না। বরং চিনু মিনুকে বল দিয়ে গেলে ওরা ঝালাই করার কাজে এগোতে পারবে।
ঠিক আছে অনিরুদ্ধ, তুমি এখন একটু রেস্ট নাও, আর দেখো ওরা কীভাবে স্ট্রোক করছে।
তপতীর কথা সবে শেষ হয়েছে তখন একটা গম্ভীর গলা বলে উঠল, অনি, চলে আয়। আর তোকে খেলতে হবে না। গলাটা অনিরুদ্ধর ঠাকুমার। তিনি মিনুর কথা শুনতে পেয়েছেন।
বাধ্য নাতির মতো অনিরুদ্ধ ঠাকুমার কাছে হাজির হল।
বাড়ি চল। ঠাকুমা উঠে দাঁড়ালেন। তপতী ছুটে গেলেন ওদের কাছে।
সে কী মাসিমা, অনিরুদ্ধকে যে আবার প্র্যাকটিস করাব।
করিয়ে কাজ নেই, ভোঁদা ছেলের পেছনে সময় নষ্ট না করে বরং নিজের ছেলেদেরই দেখো। ঠাকুমা আর রাগ চাপতে পারলেন না। আমার নাতিটাকেই শুধু খাটিয়ে যাচ্ছ, যেন ও একটা কুলিমজুর। কই, নিজের ছেলেদের তো খাটাচ্ছ। না। আমি তখন থেকে বসে বসে লক্ষ করে যাচ্ছি তুমি খালি ওর পেছনেই লাগছ।… দরকার নেই বাপু অমন খেলায়… এমন একচোখামি জম্মে কখনও দেখিনি, আয়। ঠাকুমা অনিরুদ্ধর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন।
আমি তো ওর ভালর জন্যই খাটাচ্ছি মাসিমা। তপতীর গলায় করুণ মিনতি। যাও-বা দুটো ছেলে পেয়েছেন, তার একটি যদি চলে যায় তা হলে মিনু-চিনু ছাড়া তো কিছুই থাকবে না!
না, না, আর ভাল করতে হবে না, দেখেছ বাছার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আয়, খেলে তো চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করবি।
ঠাকুমা, বাবা গাড়ি নিয়ে আসবে যে! অনিরুদ্ধ নিরস্ত করার চেষ্টা করল। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় অনিরুদ্ধর বাবা ওদের তুলে নিয়ে যান। নাতির কথা শুনে ঠাকুমা বসে পড়লেন।
কয়েক সেকেন্ড তপতীর নিজেকেই ভোঁদা মনে হল। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল। চোয়ালের পেশি দপদপ করে উঠল কয়েকবার। তিনি দ্বিতীয়বার অনুরোধ করলেন না।
মিনু, এবার ভলি… দেখছিস তো আমার দুটো পা-ই পঙ্গু, তুই কি আমাকে কষ্ট দিবি? যদি কষ্ট না দিতে চাস, তা হলে এমনভাবে ভলিতে রিটার্ন করবি যেন আমাকে এক পা-ও নড়তে না হয়, সব বল যেন আমার র্যাকেটে আসে।… চিনু, যা বললাম শুনলি?
দুই ভাই মাথা হেলাল। আড়চোখে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তপতী সহজ করে বল জোগাতে লাগলেন। একবার মিনুকে, তারপর চিনুকে। মুখের সামনে, বুকের সামনে, কাঁধের পাশে, মাথার ওপর থেকে আসা জমি না। ছোঁয়া বলগুলো দুই ভাই নেটের ওধারে মায়ের র্যাকেটে পৌঁছে দিতে লাগল। যদি কোনও রিটার্ন তপতীর থেকে একটু আগে বা একটু বেশি দূর হয়ে যায় তা হলে অন্য ভাই উৎকণ্ঠিত চোখে পাশের দিকে তাকায়।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা বল ফেরাচ্ছে। তপতী এবার বলগুলো ফোরহ্যান্ডের দিকে একটু-একটু করে সরাতে লাগলেন। ডান হাত লম্বা করে পাশে বাড়িয়ে ওদের ভলি করতে হবে। দুবার চিনু পারল না, ওর থেকে বলিষ্ঠ মিনু পারল। তপতী একটা ব্যাপারে সচেতন হলেন, গায়ের জোর না বাড়ালে তাঁর ছেলেরা খেলোয়াড় হতে পারবে না। এই প্র্যাকটিস বেশিক্ষণ নেওয়ার মতো গায়ের তাগদ চিনুর নেই, মিনুর কিছুটা আছে। কিন্তু যথেষ্ট নয়।
নিমগাছের সামনে অনিরুদ্ধর বাবার গাড়ি এসে থামল। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন, ছেলে চেয়ারে বসে তার ঠাকুমার সঙ্গে। অন্য দুটি ছেলে তাদের মায়ের সঙ্গে খেলছে। ভ্রূ কুঁচকে গেল তাঁর।
অনি খেলছ না? বাবা জানতে চাইলেন।
অনিরুদ্ধ ঠাকুমার দিকে তাকাল। ঠাকুমা ব্যাজার মুখে বললেন, ওঠ। নাতি চেয়ার থেকে উঠল র্যাকেট হাতে।
কী ব্যাপার! বিস্মিত বাবা তাঁর মায়ের দিকে তাকালেন।
খেলবে না অনি। ঠাকুমা নাতিকে টানতে টানতে গাড়ির দিকে রওনা হলেন।
কী ব্যাপার মিসেস বসুমল্লিক, অনি খেলবে না কেন?
তপতী ঘামে ভেজা মুখ আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে মাসিমার কথা থেকে মনে হল উনি পছন্দ করছেন না অনিরুদ্ধর ওপর কোনওরকম চাপ দিই। ওর ফোরহ্যান্ডটা ঠিক করার জন্য বারবার ওকে বল দিচ্ছিলাম। মাসিমা সেটাকে কুলিমজুরের মতো খাটানো মনে করলেন।
অনিরুদ্ধর বাবার মুখ অপ্রতিভ দেখাল। তিনি আড়ষ্ট স্বরে বললেন, খেলাধুলো করতে গেলে তো খাটতেই হবে। আর খাটবার জন্যই তো ওকে এখানে পাঠিয়েছি। দিন-দিন কীরকম মোটা হয়ে যাচ্ছে!
তপতীর মনে হল ভদ্রলোক তাঁর মায়ের উলটোটি। ছেলেকে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন-আদর দিয়ে নষ্ট করতে চান না।
অনিরুদ্ধর শরীর যথেষ্ট ফিট নয় বলেই ওর বডি কোঅর্ডিনেশন খারাপ। ওর হাত, পা, মাথা, কোমর একসঙ্গে কাজ করে না। সেটাই যথাসম্ভব করাবার চেষ্টা করছিলাম।
ঠিকই করেছেন। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে কী জানেন, আমার মার আবার নাতি-অন্ত প্রাণ, আমার স্ত্রীও একমাত্র ছেলেকে নয়নের মণি করে রেখেছেন। মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। অনি সম্পর্কে একটু কড়া হলেই সংসারে অশান্তি বেধে যায়, তাই আমি আর কিছু বলি না। যাই, ওকে খেলতে আসার জন্য বলি গিয়ে। হতাশ এবং তিক্ত মুখ করে তিনি গাড়ির দিকে এগোলেন।
ওরা তিনজন গাড়ির দিকে তাকিয়ে। অনিরুদ্ধর বাবা তাঁর মার সঙ্গে কথা বলছেন। মা হাত নেড়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু বলতে শুরু করলেন। তারপর গাড়ির দরজা খুলে নাতিকে নিয়ে উঠে বসলেন। তপতীদের দিকে একবার তাকিয়ে অনিরুদ্ধর বাবা মাথা নামিয়ে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং ধরলেন।
মা, অনি বোধ হয় আর আসবে না। মিনু বলল।
না।
ভালই হল, মা শুধু গৌতম আর আমাদেরই এবার থেকে শেখাবে। চিনু তারিয়ে মন্তব্য করল।
গৌতমও আসবে না, মিনু বলল, জানো মা, গৌতম আমাকে বলেছে টেনিস ওর ভাল লাগে না, ওর ভাল লাগে ক্রিকেট। ও বলেছে টেস্ট ম্যাচ খেলবে। হাফ প্যান্ট পরে খেলার থেকে ফুলপ্যান্ট পরে খেললে দেখতে সুন্দর লাগে।
মিনু আয়, ভলি এখনও বাকি। তপতী কোর্টের দিকে এগোলেন।
মা আমি? চিনুর চোখে ভীরু আবেদন। তপতী ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।
তোর শরীরের সামর্থ্যের থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে না? একদিনেই এতটা করা ভাল নয়। কথাগুলো বলে কী ভেবে তিনি মত বদলালেন, আচ্ছা আয়।
রোদ পড়ে আসছে। আকাশ ম্লান, দূরের গাছপালা, বাড়ির রং ধূসর কালো হয়ে উঠছে। তপতী এইরকম সময়েই খেলা বন্ধ করে ছেলেদের নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।
মা, আর পাঁচটা। মিনু বলল।
তপতী পাঁচবার ভলির জন্য বল দিলেন। আর নয়, এবার বাড়ি।
মা, আরও পাঁচটা, এই শেষ, আর বলব না। মিনু মিনতি জানাল।
তপতী দুবার দিলেন চিনুকে। ব্যাডমিন্টনের শাটলকক ফেরাবার মতো করে মুখের সামনে থেকে ভলি মেরে সে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল। মাকে এক পাও নড়তে হল না দেখে আনন্দে ভরা চোখে সে দাদার দিকে তাকাল।
মিনু, লাস্ট বল। তপতী ইচ্ছে করেই বলটা মিনুর ডান দিকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে উঁচু করে ফেললেন। দেখা যাক ছেলেটা পারে কি না। মিনু আশা করেনি তার অতদূরে বল আসবে। হুঁশ হওয়া মাত্র সে ডান দিকে দ্রুত দুপা ছুটে ঝুঁকে র্যাকেট বাড়িয়ে দিল। কোর্ট প্রায় ছুঁয়েছে সেই অবস্থা থেকে সে বলটাকে তুলে দিল। আর নিজে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আলতো হয়ে উঁচুতে উঠে নেট পেরিয়ে বলটা অবাক তপতীর মাথার ওপর নেমে এল।
ধড়মড়িয়ে কোর্ট থেকে দাঁড়িয়ে উঠে দুহাত তুলে মিনু লাফাল। পেরেছি.. মা, আমি পেরেছি।
.
ইস্ট ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। হলক্ট্রোম খেলছে রামনাথন কৃষ্ণনের সঙ্গে।
মিনু আর চিনু বসেছে রাজেনের দুপাশে। তপতী ও তন্ময় আসেননি। তপতীর বাঁ পায়ে যেখানে কোদালের আঘাতটা লেগেছিল সেই জায়গাটা গত রাতে ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন, ওষুধ দিয়ে গেছেন। তাঁর অবস্থা হাঁটাচলার মতো নয়। তন্ময় তাঁর জন্যই বাড়িতে রয়ে গেছেন।
চতুর্থ সেট, নবম গেম। হলস্ট্রোম ৩-৫ এবং নিজের সার্ভিসে ০-৩০ পিছিয়ে। সে প্রথম সেট জিতেছিল ৬-৪, পরের দুটি সেট হেরেছে ১-৬; ২-৬। খেলা প্রায় দু ঘণ্টা গড়িয়েছে, জয়ের জন্য কৃষ্ণনের দরকার আর মাত্র দুটি পয়েন্ট।
হলক্ট্রোম সার্ভ করছে। রাজেন আড়চোখে তার ডানপাশে বসা চিনুর ডান হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল। হলস্ট্রোম বলধরা বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে উঁচুতে তুলতে-তুলতে বলটাকে শূন্যে ছুড়ে দিল। রাজেন দেখল, বাচ্চা ছেলেটার বাঁ হাত গলার কাছে উঠে ফুলের পাপড়ির মতো আঙুলগুলো খুলে গিয়ে কাল্পনিক বলটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিল। ডান হাতের মুঠো কাঁধের কাছে, র্যাকেট ধরা কজিটা মোচড়ানো, পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে চেয়ারে কাঁধ ঠেকে গেছে। তারপরই চিনুর কোমর থেকে উধ্বাঙ্গ হলস্ট্রোমের সার্ভিসের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকল আর ডান কজিটা চাবুক মারার মতো সামনে ঝাপটা দিল।
রাজেনের অবাক চোখ হঠাৎ চিনুর নজরে আসতেই সে লজ্জা পেয়ে হাত দুটো কোলের কাছে গুটিয়ে নিল। হলস্ট্রোমের সার্ভিস কৃষ্ণনের ডান দিকে সার্ভিস কোর্টের মাঝামাঝি পড়েছে, সে ডান দিকে সামান্য হেলে সপাটে ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মারল ডাউন দ্য লাইন। বেস লাইনের ছ ইঞ্চি আগে সাইড লাইনে বল পড়ল। উত্তেজনায় মিনু উঠে দাঁড়িয়েছে।
লাভ ফর্টি। মাইকে ঘোষণা করলেন আম্পায়ার।
মারটা মনে থাকবে তো? রাজেন ফিসফিস করে বলল। মিনু মাথা হেলাল। কৃষ্ণনের ব্যাক হ্যান্ড মনে থাকবে তো?
হ্যাঁ। আর একটু হলেই বলটা বাইরে পড়ত।… রাজেনকাকা, কৃষ্ণন খুব প্র্যাকটিস করে?
করে, আর সেজন্যই মারগুলো এত মাপা হয়।
ফিফটিন ফর্টি।
হলস্ট্রোমের লব কৃষ্ণনের মাথার ওপর দিয়ে বেস লাইনের কাছে পড়েছিল, কৃষ্ণন পিছু হটতে পারেনি।
দেখলে মিনু, ফিজিক্যাল ফিটনেসে কৃষ্ণন কত পিছিয়ে। শুধু শট নিতে পারলেই হয় না, খুব চটপটে খুব ফাস্ট মুভ করার জন্য শরীরও তৈরি করতে হবে।
দৌড়লে হবে? চিনুর প্রশ্ন।
বড় প্লেয়াররা রোজ সাত-আট মাইল দৌড়য়! ব্যায়ামও করে। রাজেন ফিসফিসিয়ে বলল।
দাদা, আমরা কতটা দৌড়ই রে?
চুপ, চুপ। রাজেন ঠোঁটে আঙুল দিল। হলস্ট্রোম সার্ভ করছে। ম্যাচে এই নিয়ে প্রায় আশিবার। এত সার্ভিস দেখার পর, রাজেনের মনে হল, বাচ্চা দুটো নিশ্চয় এর ছবি মনের মধ্যে তুলে রেখে দেবে। প্রচণ্ড জোরালো সার্ভিস করে এই সুইড। কিন্তু শুধু জোরে সার্ভ করতে পারলেই যে ম্যাচ জেতা যায় না, কৃষ্ণন সেটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে।
থার্টি ফর্টি। হলক্ট্রোমের সার্ভিস এস হয়েছে।
আবার সার্ভ করল। ফোরহ্যান্ড রিটার্ন কৃষ্ণনের। বলটা উঁচু হয়ে মাঝ কোর্টে। ডান দিকে ভলি মারল হলক্ট্রোম। কৃষ্ণন যেন আগাম জানতই বল। কোথায় আসবে। বাঁ দিকে সরে গিয়ে সে অপেক্ষা করছিল। হলক্ট্রোমের কোমরের পাশ দিয়ে আড়াআড়ি মারা একটা ঝলসানো ব্যাকহ্যান্ডে বলটা বেস লাইনের কাছে পড়ে বেরিয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে হলস্ট্রোম একবার তাকিয়ে দেখে নেটের দিকে এগিয়ে গেল হাত বাড়িয়ে। হাজার দুয়েক লোক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে মিনু-চিনুও। উত্তেজনায় দুজনের মুখ টসটস করছে।
মহাদেবপুরে ফেরার সময় গাড়ি চালাবার ফাঁকে রাজেন পাশে বসা দুই ভাইকে বলল, আজ যা-যা দেখলে সব যেন মনে থাকে।
অত জোরে জোরে মারলে যদি মায়ের পাশ দিয়ে বল বেরিয়ে যায়! চিনুর সামনে এখন এটাই প্রকাণ্ড সমস্যা।
তুমি কি এখনই অত জোরে জোরে মারতে পারবে? হালকা সুরে রাজেন বলল।
না। তবে দাদা জোরে মারতে পারে।
ধ্যাত, জোরে মারি নাকি? জোরে মারলে বল এধার-ওধার চলে যায়, মার তাতে অসুবিধে হবে না? জানেন রাজেনকাকা, মা যেখানে দাঁড়ায় ঠিক সেই জায়গাটা লক্ষ্য করে আমরা দুজনেই বল মারি। আস্তে না মারলে কি ঠিক জায়গায় বল পাঠানো যায়? বিচক্ষণের মতো মিনু বলল।
তা বটে, আস্তে আস্তে মেরেই শুরু করতে হয়। কিন্তু মিনু, মার অসুবিধের কথা ভেবে কতদিন তুমি আস্তে মারবে? জোরে জোরে না মারলে বড় প্লেয়ার হবে কী করে? তুমি তো বড়ই হতে চাও, চাও না?
রাজেনের কথাগুলো এবার মিনুকে সমস্যায় ফেলে দিল। মাকে সে ভালবাসে, আবার বড় প্লেয়ার হওয়ার ইচ্ছাটাও কৃষ্ণনকে দেখার পর তার মধ্যে আলোড়ন তুলছে। তার ছোট্ট মাথা এমন একটা কঠিন অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি।
তুমি তো দাবা খেলেছ। রাজার কিস্তি হতে পারে এমন একটা অবস্থা তো খেলায় একসময় আসবেই। সেজন্য তুমি আগে থেকে নিশ্চয়ই ভেবে রাখো কী কী চাল দেবে, রাখো না কি? রাজেন সামনের ভিড় রাস্তায় রাখা সতর্ক দৃষ্টিটা পলকের জন্য ঘুরিয়ে মিনুর মুখটা দেখার চেষ্টা করল। তার মনে হল ছেলেটি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ চিনু বলে উঠল, আচ্ছা রাজেনকাকা, কৃষ্ণন কি মায়ের সঙ্গে খেলত?
হো হো করে হেসে ওঠার ইচ্ছেটা দমন করতে হল রাজেনকে। জি টি রোডের সালকিয়া, লিলুয়া, বেলুড়ের দিকটায় গাড়ি চালাতে চালাতে সন্ধ্যার মুখে হেসে ওঠা যায় না। সরু রাস্তা, রাস্তায় দোকান, গাঁক গাঁক করা ট্রাক আর বাস এবং ছুটির দিনের বিশৃঙ্খল ভিড় ঠেলে মোটর গাড়িকে এগোতে হয় চোখ কান খুলে।
চিনু, তুমি কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা ভাল বিষয় তুলেছ। কৃষ্ণন ছোট বেলায় মায়ের সঙ্গে নয়, বাবার সঙ্গে খেলত। ভদ্রলোক দিল্লিতে চাকরি করতেন। ঠিক করলেন ছেলেকে বড় টেনিস প্লেয়ার করবেন। রাজেন ব্রেক কষল। এক স্ত্রীলোক ছুটে রাস্তা পার হচ্ছিল কোমরে একটা শিশুকে নিয়ে। হঠাৎ গায়ের পাশে গাড়ি দেখে দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
মিনুর তর সইছে না। আবার গাড়ি চলা মাত্র সে বলল তারপর?
তারপর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সবকিছু বিক্রি করে যা টাকা পয়সা পেলেন তাই নিয়ে দিল্লি থেকে তামিলনাড়তে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন। সেখানে একটা ক্লে কোর্ট বানালেন, গ্রামে মাটি দিয়ে লেপা উঠোন দেখেছ তো?
না দেখিনি। মিনু বলল।
মহাদেবপুরের পাশেই তো গ্রাম, একদিন গিয়ে দেখে নিয়ো। গোবর জল আর মাটি দিয়ে লেপা, একেবারে সিমেন্টের মেঝের মতো তকতকে হয়। সেইরকম কোর্টে তিনি ছেলেকে দিনের পর দিন হাতে ধরে টেনিস শেখালেন। ছেলেও রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করল, সেই সঙ্গে লেখাপড়াও। তারপর এল মাদ্রাজ শহরে। তারপর একের পর এক চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল। এখন কৃষ্ণন ভারতের সেরা।
বুঝলে মিনু, বাবা বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ছিলেন ছেলেকে বড় প্লেয়ার বানাবার জন্য, ছেলেও সেটা বুঝেছিল। আর তাই সে মন প্রাণ দিয়ে খেটে গেছে বাবার স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে।
মাও খুব খাটে। চিনু বলল।
কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। একসময় রাজেন আড়চোখে দেখল মিনু তার ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে। তার কানে এল দুটো কথা, মারও স্বপ্ন আছে। চিনু বলল, বাবারও আছে। শুনে রাজেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
অধীর হয়ে তপতী অপেক্ষা করছিলেন ওদের ফেরার জন্য। ফিরে এসেই দুই ভাই কলকল করে শুরু করল যা দেখে এসেছে তার বর্ণনা দিতে। কৃষ্ণন আর হলস্ট্রোমের ভলি, লব, সার্ভিস, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড যা কিছু দেখেছে, দুই ভাই র্যাকেট হাতে মাকে সেগুলো দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তন্ময় মুখে হাসি নিয়ে তপতীর মতোই চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে দেখে গেলেন।
বেলা এসে তাড়া দিল রাতের খাবার খেয়ে নেবার জন্য। এই ব্যাপারে বাড়ির নিয়ম ভীষণ কড়া। অনিচ্ছুক দুই ভাই খাবার ঘরে চলে যেতেই তপতী বললেন, ঠাকুরপো, এদের উৎসাহ তো আপনি চাগিয়ে দিলেন, এবার আমি সামলাই কী করে।
উৎসাহের আগুন তো আপনিই জ্বালিয়েছেন, আমি শুধু একটু বাতাস দিলাম। কিন্তু সমস্যাটা সত্যিই এবার এসে পড়েছে। টপ ক্লাস টেনিস কী বস্তু, ওরা আজ তা দেখল; কিছু বুঝেছেও হয়তো। ওরা এবার চাইবে কৃষ্ণন কি হলক্ট্রোমের নকল করে বল মারতে। এবার তো সেই সুযোগগুলো ওদের জন্য করে দিতে হবে, অবশ্য যদি.. রাজেন থেমে গেল।
উৎকণ্ঠিত তন্ময় বললেন, যদিটা কী?
আগে ঠিক করুন ওদের বড় খেলোয়াড় বানাতে চান, না ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার করতে চান? যদি ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার করতে চান তা হলে খেলাটাকে। সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই। দুজনে যেভাবে চালাচ্ছে চালাক, একটু আধটু ছুটুক আর মন দিয়ে পড়াশুনো করুক। কিন্তু দাদা, দেশে প্রচুর ডাক্তার, উকিল, জজ ব্যারিস্টার আছে, কজনের নাম দেশের লোক জানে? কিন্তু কৃষ্ণনের নাম করুন, বহু লোক তাকে চিনবে। মিলখা সিং, শৈলেন মান্না, পঙ্কজ রায়, ভিনু মানকা, লক্ষ লক্ষ লোক এঁদের নাম জানে, ঠিক কি না?
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাথা নাড়লেন।
আমি লক্ষ করেছি টেনিস ওরা ভালবাসে, খেলতেও চায়। বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য যে ইচ্ছাটা থাকা দরকার, এই বয়সেই ওদের মধ্যে সেটা ফুটে উঠছে। সেটাকে যদি আরও ফুটিয়ে তোলা যায়, আমার ধারণা ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে।
তুমি বলছ রাজেন? তন্ময়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে ভেতরের উত্তেজনায়।
হ্যাঁ বলছি। বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হবে ঠিকই, কিন্তু কোনও বড় কাজই ঝুঁকি না নিয়ে করা যায় না। আপনি দুটো বছর ওদের সময় দিন। যদি বোঝেন কিছু হবে না, ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে, তখন নয় বন্ধ করে দেবেন, যদি বোঝেন হবে, তা হলে অল আউট ওদের পিছনে খরচ করবেন।
খরচ! তপতী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।
হ্যাঁ খরচ। ওদের জন্য কোচ রাখতে হবে, তাকে টাকা দিতে হবে।
কত টাকা।
এখনই বলতে পারব না। খোঁজখবর করে দেখি ভাল কাউকে পাই কি না। এতটুকু ছেলেদের কোচ করতে কলকাতা থেকে আসতে কেউ রাজি হবে কি না সেটাও তো দেখা দরকার। তবে দাদাবউদি, আপনাদের একটা কথা বলে রাখি, ভেবেচিন্তে নামবেন। শুধু আমার কথা শুনে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেবেন না। …টেনিস খেলে টাকা রোজগার করা যায় না ঠিকই, কিন্তু নাম করতে পারলে ভাল চাকরি, খ্যাতি, সম্মান এগুলো তো পাবে। প্রতি বছর ভারতে লক্ষ লক্ষ ছেলে কলেজ থেকে বেরোচ্ছে, কিন্তু কৃষ্ণন তো একটাই।
.
০৬.
রাজেন চলে যাবার পর তন্ময় ও তপতী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। দুজনের মাথায় ঘুরছে একই চিন্তা আর কয়েকটা কথা— দুটো বছর ওদের দিন…. ওরা টেনিসে কিছু একটা করে দেখাবে… কৃষ্ণন তো একটাই।
তা হলে কী করা যায়, কোচ রাখব? তন্ময় স্ত্রীর কাছে পরামর্শর থেকে যেন সমর্থনই চাইলেন।
খরচ বাড়বে, তা ছাড়া ঝুঁকিও রয়েছে। তপতী চিন্তিত স্বরে মনে করিয়ে দিলেন।
তোমার পায়ের যা অবস্থা তাতে ডাক্তার যা বলে গেলেন সেটাই করা উচিত, কোর্টে নামা একদম বন্ধ। আবার যদি ফুলে ওঠে কি যন্ত্রণা শুরু হয়, তা হলে কী হতে পারে সেটাও তো শুনলে ওঁর কাছে।
জন্মের মতো পঙ্গু হয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমি কোর্টে না নামলে কে ওদের…। তপতী থেমে গেলেন। স্বামীর মুখের দিকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা বললেন, আমি ঝুঁকি নেব।
পঙ্গু হয়ে যেতে পার শুনেও? তন্ময় বিরক্তি চাপতে পারলেন না।
ঝুঁকি নেব দুটো বছর। খরচ যাই হোক, মিনু কি চিনুকে দেশের লোক চিনবে— আমি তাই চাই। তুমিও কি চাও না ওরা টেনিসের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাক? …ঝুঁকির ভয়ে আমি পিছিয়ে যাব না। ধীর অচঞ্চল স্বরে তপতী বললেন। সঙ্কল্পে তাঁর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে।
ভোরে বেরোনো বন্ধ হয়ে রয়েছে, আমিই ওদের নিয়ে বেরোব। তন্ময় উঠে দাঁড়ালেন। ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত এমন একটা ভাব তাঁরও মুখে।
পরদিন ভোরে মিনু এক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। বাথরুমে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে তার কপাল কাটল, গালে কালশিটে পড়ল আর ডান হাঁটু ফুলে উঠল। দিন সাতেক লাগল তার সবগুলো আঘাত সেরে উঠতে।
অতঃপর এক ভোরে তন্ময় দুই ছেলের সঙ্গে ছুটতে বেরোলেন। যে পথ ধরে মিনু আর চিনু ফেরিঘাট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসত, তিনজন সেই পথই ধরল। তন্ময়ের অভ্যাস নেই এতটা দৌড়বার। তিনি ফেরিঘাটে পৌঁছবার আগেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
হ্যাঁ রে তোদের মা এতটা ছুটত কী করে?
মা তো ছুটত না, জোরে হাঁটত। আমরা ছুটতাম। চিনু বলল, তুমি হাঁটো আমরা ছুটটে ফেরিঘাট ছুঁয়ে ফিরে আসছি। মিনু খুবই সহানুভূতির সঙ্গে জানিয়ে দিল দশ মিনিটেই ফিরব।
তাই যা, আমি একটু জিরোই। দুই হাঁটুতে হাত রেখে তন্ময় ঝুঁকে পড়লেন।
বাড়িতে ফিরেই তিনি স্ত্রীকে বললেন, আমার দ্বারা ছোটা হবে না, রাজেনকে আজই বলব একজন কোচ ঠিক করে দিক।
বিকেলে মিনুকে কি স্কুল থেকে ক্লাবে নিয়ে যেতে পারবে?
পারব। কিন্তু খেলতে তো পারব না তোমার মতো।
তোমায় খেলতে হবে না, ওরাই খেলবে। নিজেদের মতো করে। ….অফিস থেকে বাড়ি এসে চিনুকে নিয়ে গাড়িতে করেই যেয়ো।
তন্ময় যথেষ্ট আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়িতে এলেন। গাড়ি বার করে চিনুকে নিয়ে স্কুলে গেলেন, সেখান থেকে মিনুকে তুলে নিয়ে ক্লাবে! কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে বসলেন।
নেটের দুধারে দুই ভাই, বয়স দশেরও কম। মিনু বলল, আমি জোরে জোরে মারব তুই বল ধরে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে ফেরত পাঠাবি। আমি আবার মারব।
কথা মতোই চিনু কাজ করল। অবশ্য বল ধরতে তাকে কোর্টের নানা দিকে ছুটতে হল, কেননা মিনুর জোরালো মারের মধ্যে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। একসময় চিনু হাঁফিয়ে পড়ল।
দাদা, আমি আর পারব না। তুই একাই মারবি আর আমি বুঝি মারব না।
তা হলে তুই র্যাকেট ধর, আমি ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছি।
ওরা যখন নিজেদের মধ্যে ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, সার্ভিস ও ভলি মারায় ব্যস্ত সেই সময় নিমগাছের তলায় সাইকেল থেকে একটি বয়স্ক লোক নামলেন। এক হাতে সাইকেলটা ধরে তিনি দুটি ছেলের দিকে তীক্ষ নজরে তাকিয়ে রইলেন।
লোকটির পরনে সাদা শর্টস আর নীল স্পোর্ট শার্ট। পায়ে সাদা ময়লা কেডস। লম্বায় ছ ফুটের ওপর, গড়ন ছিপছিপে হলেও পেশিগুলো শুকনো দরকচা নয়। বলিষ্ঠ দুটো পা দেখে বোঝা যায় লোকটি পরিশ্রমী, দুই কাঁধের পেশিতেও সেই আভাস। মুখ ঈষৎ লম্বাটে, নাকের পাশে গভীর ভাঁজ, গালেও। মুখখানি বহু অভিজ্ঞতায় পোড়খাওয়া। ছোট করে কাটা চুল কাঁচাপাকায় মেশানো। লোকটিকে ঘিরে রয়েছে কঠিন এমন এক আবরণ, যা থেকে মনে হতে পারে তিনি তোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। তাঁর বয়স অনুমান করা শক্ত, তবে পঞ্চাশের নীচে নয়, এইটুকু বলা যেতে পারে।
প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তিনি দুটি বাচ্চার নিজেদের মধ্যে খেলা দেখলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখে কখনও হাসি ফুটে উঠল, কখনও প্রসন্নতা, কখনও কুঁচকে উঠল কপাল। একটা বল তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়লে তিনি বলটা হাতে তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। চিনু ছুটে এসেছিল।
কার কাছে খেলা শিখছ? লোকটি বললেন। মৃদু গম্ভীর অন্তরঙ্গ স্বর।
মার কাছে।
লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল। কোথায় মা, তোমরা তো একা একাই খেলছ!
মার পায়ে ব্যথা, আসেনি… বলটা দিন।
উনি কে, ওই যে চেয়ারে বসে?
বাবা।… দিন না।
নাম কী তোমার?
চিন্ময় বসুমল্লিক।
চিনুর হাতে বলটা দেওয়ার সময় তিনি বললেন, জুতোর ফিতেটা খুলে গেছে, বেঁধে নাও।
পরের দিন সন্ধ্যায় রাজেন এল। তপতী তখন দুই ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন।
বউদি, একজনকে পেয়ে গেছি। সহদেব মিশ্র। আজ দুপুরে অফিসে এসে বলে গেলেন তিনি রাজি।… খুব অভিজ্ঞ, আমিও ওঁর কাছে কোচিং নিয়েছি কিছুদিন… খুব কড়া কোচ, সাউথ ক্লাবে অনেকদিন আছেন। এই মাইল ছয়েক দূরে হুগলিতে ওঁর বাড়ি, একা মানুষ, বউ মারা গেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, বাড়ির একটা ঘরে থাকেন, বাকিটা ভাড়া দিয়েছেন। কোচিং আর ভাল লাগছে না তাই ছেড়ে দেবেন ঠিক করেছেন। বড়লোকদের ছেলেমেয়ে, কেউ বড় প্লেয়ার হওয়ার জন্য তো কোচিং নেয় না, অত খাটুনি ওদের পোষাবে কেন? একশো-দুশো টাকা দিয়ে কোচ রেখেছি, হাতে র্যাকেট নিয়ে ঘুরছি, অভিজাত ক্লাবে যাচ্ছি, এইটে দেখাবার জন্যই তো ওদের খেলার ভান করা। সহদেব মিশ্র তাই বিরক্ত হয়ে ঠিক করেছেন আর কোচিং করে সময় নষ্ট করবেন না। তবে মাসকাবারে কিছু টাকা তো ওঁর দরকার, তাই বাড়িতে গিয়ে ওঁকে ধরে বললাম, সহদেবদা, দুটো বাচ্চা ছেলে আছে, আপনার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, নেবেন ওদের? রাজি হননি। অনেক বলার পর বললেন, আগে ওদের দেখব, তারপর হা কি না জানাব। আমার কাছ থেকে ক্লাবের হদিসও নিলেন।
মা, কাল একটা লোক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছিল! চিনু বলল।
আমিও লোকটাকে দেখেছি। কাঁচাপাকা চুল,সাইকেলে এসেছিল!তন্ময় বললেন।
তা হলে এই লোকটাই সহদেবদা। উনি সাইকেলেই কাছেপিঠে ঘোরেন।
বললে ছ মাইল, সেটা কি খুব কাছেপিঠে হল! তন্ময় অবাক হলেন।
ছ মাইলটা ওঁর কাছে নস্যি, কোনও ব্যাপারই নয়। বারো-চোদ্দো মাইল রেগুলার সাইকেলে ঘোরেন শরীরটাকে ফিট রাখার জন্য।
ঠাকুরপো, মিনু-চিনু সম্পর্কে কী বললেন উনি? তপতী অধীর হয়ে উঠেছেন তাঁর ছেলেদের দেখে কী ধারণা হয়েছে জানার জন্য।
সহদেবদা কম কথার মানুষ, শুধু বললেন, গুড। আর জিজ্ঞেস করলেন। বাবা-মা লেগে থাকতে পারবে তো? আমি ওঁকে আপনাদের সম্পর্কে সবই বলেছি।
কত নেবেন? ভয়ে ভয়ে তপতী জানতে চাইলেন।
রাজেন কিন্তু কিন্তু করে বলল, এক একজনের জন্য একশো টাকা মাসে, একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উনি এর কমে রাজি নন।
তপতী চোখ বন্ধ করলেন। কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, রাজি।
মাসে দুশো টাকা তো, হয়ে যাবে। তন্ময় যোগ করলেন খুব সহজ গলায়।
তপতী দু হাতের তালু দুই ছেলের মাথায় রেখে হাসলেন। ওরা জড়িয়ে ধরল মাকে।
.
অতঃপর এক একটি ঋতু আসে আর চলে যায়, মিনু আর চিনু ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটা বছর। সহদের মিশ্রর কঠিন শিক্ষায় তারা ধাপে ধাপে খেলায় উন্নতি করে চলল। কোর্টের বাইরে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ স্নেহ আর শাসনের সতর্ক প্রহরার দ্বারা মসৃণ করে তোলার জন্য তপতী আর তন্ময় তাঁদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন। প্রতিদিন ভোরে কি শীতে কি বর্ষায় দুই ভাইকে ছুটতে দেখায় মহাদেবপুর অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খরচ বেড়েছে। নতুন দু জোড়া র্যাকেট কিনতে হয়েছে। আর কিনতে হয় প্রতি মাসে দু ডজন বল। দু দিকের বেস লাইনের পেছনে ছ্যাচাবাঁশের দরমা দিয়ে দশ ফুট উঁচু বেড়া তোলার জন্য প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ করতে হয়েছে তন্ময়কে। এই বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে ছোটখাটো অশান্তিও ঘটে গেল ক্লাবে। কমিটির অনেকেই আপত্তি তুলেছিল এই বলে, টেনিস কোর্টের জমিটা ক্লাবের সম্পত্তি। সেটা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে এবং বেড়া তুলতে দেওয়া যায় না।
প্রতিবাদ করেছিল রাজেন। তার বক্তব্য : মেম্বারদের ছেলেমেয়েদের যে কেউই চাঁদা দিয়ে খেলতে পারে, টাকা দিয়ে কোচিং নিতে পারে। কিন্তু দুটি ছেলে ছাড়া যদি আর কেউ না আসে তা হলে ক্লাব কী করতে পারে? ছেলে দুটিকে কি খেলা বন্ধ করে দিতে হবে? তা ছাড়া ক্লাবকে তো এখনও পর্যন্ত একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি? ক্লাব থেকে পাওয়া গেছে শুধু পুরনো ফুটোয় ভরা একটা নেট। কোর্টের ঘাসকাটা, জল দেওয়া, ঘাস লাগানো ইত্যাদি কাজ করে কান্তি। সেজন্য ক্লাবের কাছ থেকে সে বাড়তি পারিশ্রমিক কখনও চায়নি। তা হলে আপত্তি উঠছে কেন? রাজেন আরও বলেছিল, শুধু তাস আর ক্যারম খেললেই। ক্লাব হয় না, আউটডোর খেলারও ব্যবস্থা থাকা চাই। এর পরও রাজেন এম জে টি এম-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে সবিস্তার জানায় তপতী ও তন্ময়ের এই টেনিস কোর্টটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কথা। এজন্য তাদের কত কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, সে কথাও রাজেন বলে। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং সেক্রেটারি কমল ভট্টাচার্যকে ডাকিয়ে এনে এম ডি নির্দেশ দেন ক্লাব মেম্বারদের ছেলেরা প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য কোর্ট ব্যবহার করতে এবং খেলার সুবিধার জন্য বেড়াও তুলতে পারবে। তিনি মনে করিয়ে দেন মহাদেবপুরের যাবতীয় জমির মালিকই এম জে টি এম।
এই ধরনের ছোটখাটো বাধা ছাড়া মিনু বা চিনুর খেলা তরতরিয়ে এগিয়েছে। তপতী ভোরে আর ছেলেদের সঙ্গে বেরোন না, তবে অতিরিক্ত ধকল এড়াতে দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে স্কুলে আর স্কুল থেকে টেনিস কোর্টে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি গাড়ি নিয়ে বেরোন। শুধু দুবারই সারাদিনে ভক্সহলকে ব্যবহার করা হয়। সাড়ে তিনটেয় স্কুল ছুটি হওয়ামাত্র দুজনে ছুটতে ছুটতে এসে গাড়িতে ওঠে। যেতে যেতে গাড়ির মধ্যেই তপতীর হাতে গড়া চিজ স্যান্ডুইচ আর কলা খেয়ে নেয়, জুতো, শর্টস, জামা বদলে নেয় যাতে কোর্টে নামতে একমিনিটও দেরি না হয়। সার ছ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে কোর্টের ধারে চেয়ারে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। দেরি হলে বলবেন, পাঁচ মিনিট পিছিয়ে পড়লে, পঁচিশটা সার্ভিস কমে গেল।
ভোর ঠিক পাঁচটায় বাংলোর ফটকে ক্রিং ক্রিং দুবার সাইকেলের বেল বাজবে। অন্ধকার থাকতেই সহদেব ছ মাইল সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হয়ে যান। মিনু-চিনু অপেক্ষা করে থাকে, বেল বাজার সঙ্গেই বেরিয়ে আসে র্যাকেট হাতে। ওরা ছুটতে শুরু করে, ওদের পাশে পাশে একটা নির্দিষ্ট গতিতে সাইকেল চালান সহদেব। প্রথমে দৌড়ত তিন মাইল, এখন সেটা উঠেছে পাঁচ মাইল। সারা মহাদেবপুরটাকে তিনবার চক্কর দিয়ে ওরা আসে কোর্টে।
বালতি ভর্তি দু ডজন বল নিয়ে শুরু হয় প্র্যাকটিস। কোর্টের একদিক থেকে পরের পর সার্ভ করে যায় মিনু। অন্যদিক থেকে সেগুলো রিটার্ন করে চিনু। সহদেব কোর্টের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শুধরে দেন কারোর কোনও ভুল হলে। নিজে পাশে গিয়ে দেখিয়েও দেন।
মিনুর একটা সার্ভ রিটার্ন করতে গিয়ে চিনুর রাকেটের কাঠে লাগল। বলটা অবশ্য মিস হিট সত্ত্বেও ফিরে এল নেটের এধারে।
এখন তুমি নিজেকে কী বলবে? সহদেব প্রশ্ন করলেন চিনুকে।
বলটাকে নজর করো, বলটাকে নজর করো।
জোরে জোরে বলা যাতে শোনা যায়। ম্যাচ খেলার সময় তোমার হয়ে এই কথাগুলো আমি তো আর বলতে পারব না। তোমাকেই এটা সবসময় নিজেকে মনে করাতে হবে। জোরে বললো, কেউ শুনতে পেল কি না তাতে বয়েই গেল, নিজেকে শোনানোটাই আসল কথা।
পরের বলটা যখন চিনুর দিকে আসছে সে চেঁচিয়ে বলল, বলটাকে নজর করো। বলের দিকে চোখ রেখে সে মারল র্যাকেটের ঠিক মাঝখান দিয়ে। এর পর আবার একটা বল মিস হিট করতেই সারের শেখানো মতো সে চেঁচিয়ে নিজেকে ধমকাল, বলটাকে নজর করছিস?
সহদেব লক্ষ করেছেন মারের পেছনে জোর দেওয়ার জন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রয়োগের মধ্যে যে সামঞ্জস্য দরকার, চিনুর সেটা চমৎকারভাবে রয়েছে। ফলে সে। তার শরীরের ওজন প্রতিটি স্ট্রোকে চাপিয়ে দিয়ে যে জোরটা বার করে আনে সেটা তার চেয়ে বেশি বলবান মিনুরই সমান বা তার চেয়েও বেশি। তিনি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান ছোটভাইটির দৈহিক পরিবর্তন দেখে। পাঁচ বছর আগে দেখা রোগা, ছোটখাটো, দুর্বল গড়নের ছেলেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার বদলে সতেজ চারার মতো বাহু ও পায়ের পেশি নিয়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি লম্বা ছেলেটি যেন মহীরুহ হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে। তিনি জানেন এর জন্য দায়ী হাড়ভাঙা নিয়মিত পরিশ্রম আর ছেলেটির মা।
সকালের কাজ, সহদেব বলেন, ওয়ার্ক আউট, চলে দেড়ঘণ্টা। কোর্টের দু ধার থেকে অবিরাম একজন ব্যাকহ্যান্ড অন্যজন রিটার্নে ফোরহ্যান্ড মেরে যায় সহদেবের নির্দেশিত জায়গাগুলোয়। তিনি মনে মনে গোনেন।
হাত ব্যথা করায় কেউ যদি র্যাকেট নামিয়ে নেয় অমনই গর্জন ওঠে, ডোন্ট স্টপ, কন্টিনিউ, কন্টিনিউ… এখনও তেরোটা বাকি।
ঘড়ি ধরে ঠিক আটটায় ওরা তিনজন বাড়ির পথ ধরে। মিনু জিজ্ঞেস করে, সার, আজ বিকেলে ভলি না সার্ভিস?
দুটোই। সার্ভ, রিটার্ন অ্যান্ড ভলি।… তিনবার বল হিট করার জন্য যদি কুড়ি সেকেন্ড ধরি, তা হলে মিনিটে তিনটে সার্ভ হলে দু ঘণ্টায় কটা হয়? সহদেব নিরাসক্ত স্বরে সাইকেল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেন। দুই ভাই আমতা আমতা করছে দেখে বললেন, দু ঘণ্টায় হয় তিনশো ষাট… এত জানি পারবে না। আমাদের পাঁচ-ছ ডজন বল নেই যে মেশিনগানের মতো ফায়ার করে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, এজন্য যে স্ট্যামিনা আর পাওয়ার দরকার, সেটাও এখনও তোমাদের গড়ে ওঠেনি… কিন্তু না উঠলেই বা, খাটতে খাটতেই গড়ে উঠবে। আজ দেখব কতখানি তোমরা পারো।
দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
একটা ভাল ম্যাচ পাঁচ সেট গড়ালে কম করে পাঁচ মাইল কোর্টে ছোটাছুটি, বল হিট করতে হয়। এজন্য সবার আগে দরকার দুটো পায়ের জোর, শক্তি। যদি না বলের কাছেই যেতে পারো তা হলে বল মারবে কী করে?… যখন খুব টায়ার্ড হয়ে পড়ো তখন শরীরের কোন জায়গাটায় প্রথম ব্যথা শুরু হয়? তলপেটে। দৌড়লে তলপেটের মাল মজবুত হয়। তোমরা এখন যতটা দৌড়চ্ছ সেটা আস্তে আস্তে এবার বাড়াতে হবে।
সার, স্কুলে যে নটার মধ্যে যেতে হবে! দুই ভাইয়ের মধ্যে চিনু কিঞ্চিৎ অলস। সহদেবের দৌড় বাড়াবার পরিকল্পনাতে রাশ টানার চেষ্টায় সে বলল।
ওইটেই তো হয়েছে মুশকিল… তোমাদের আর একটু বেশিক্ষণ কোর্টে থাকা দরকার।
বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খাওয়ার টেবলে বসে তিনজন। সহদেব আবার ছ মাইল সাইকেল চালিয়ে বাড়ি না গিয়ে, তন্ময় ও তপতীর অনুরোধে ছেলেদের ভাত খাওয়ার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নেন। চারখানা হাতে-গড়া রুটি, ডাল, তরকারি আর সামান্য আচার। মাছ-মাংস খান না। খেতে খেতে তিনি নজর রাখেন মিনু-চিনুর পাতের দিকে। ছেলেদুটির খিদে অসম্ভব বেড়ে গেছে, কিন্তু সেজন্য গোগ্রাসে পেট ভরিয়ে খাওয়া সহদেবের চোখের সামনে অন্তত চলবে না। তাঁর কথায়, খাদ্যগুলোকে হজম হওয়ার জন্য নড়াচড়ার জায়গা দরকার, পেটটা একটু খালি রাখো। বলটা গায়ের কাছে এসে পড়লে স্ট্রোক নেওয়ার জন্য জায়গা করে নিতে হয়। মিনু, কথাটা বুঝলে?
বেলামাসি, আর ভাত নেব না।
নেবে না কেন? ভাত না খেলে গতর হবে কী করে? বেলা ভাতের থালা হাতে কটমটিয়ে সহদেবের নির্বিকার মুখের দিকে তাকাল।
গতর হবে, তবে গণেশ মার্কা নয়।
তবে কী মার্কা, মহিষাসুর?
হোক না মহিষাসুর! তবে ও নয়, ওর র্যাকেটটা। সহদেব মুচকি হাসলেন, যেটা কদাচিৎ দেখা যায়। টেল থেকে দুই ভাই উঠে পড়ল।
দিদি, একটা কথা। সহদেব তাকালেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা তপতীর দিকে। ওদের ওয়ার্ক আউটের সময় বাড়াতে হবে। স্কুল থেকে কি একঘণ্টা আগে ওদের ছুটি করানো যায়?
বলা মুশকিল। ওদের এখনকার হেডমাস্টার মিস্টার আচার্য চান মাধ্যমিকে ওঁর স্কুল থেকে নাইন্টি পারসেন্ট ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করুক। ছাত্ররা খেলাধুলো করুক, এটার ঘোর বিরোধী তিনি।
দুই ভাই স্কুল স্পোর্টসে এত যে ট্রফি জেতে, তার কোনও মূল্য নেই? ওদের জন্য স্পেশ্যাল কনসিডার করা উচিত, শুধু ওদেরই জন্য।
আজ বলব, জানি না কনসিডার করবেন কি না।…একটা কথা সহদেববাবু, আমরা দু বছরের জন্য মিনু-চিনুর টেনিসের পেছনে টাকা খরচ করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনার হাতে পড়ে ওদের উৎসাহ আর খেলার মান এমন বাড়তে শুরু করল যে, আমরা আর বন্ধ করতে পারলাম না। এতে আমাদের আর্থিক দিক থেকে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। ওদের ভাল জামা জুতো কিনে দিতে পারি না, প্রায়ই কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যেতাম, কিন্তু খরচের কথা ভেবে এখন আর তাও যেতে পারি না। বছরে একবার বাইরে কোথাও দার্জিলিং, কি পুরী, কি জয়পুর বেড়াতে গেছি, কিন্তু গত পাঁচ বছর এই মহাদেবপুর ছেড়ে কোথাও আমরা যাইনি। খরচের ভয়ে অনেক সামাজিক কাজেও আমরা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে যাইনি। আড়ালে অনেকেই আমাদের কঞ্জুস বলে থাকে। এই সবই আমরা সয়েছি একটা লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের ছেলে দুটোর দিকে একদিন দেশের লোক তাকিয়ে থাকবে। এখন বলুন আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন সফল হতে পারবে কি না, মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছুটছি কি না? তপতী আবেগ চাপতে চাপতে একটানা কথাগুলো বলে উন্মুখ হয়ে সহদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সহদেব মাথা নামিয়ে জবাবটা গুছিয়ে নিতে সময় নিলেন। তিনি আবেগপ্রবণ নন। শুকনো স্বরে বললেন, আজ যদি বলেন আর আপনাকে টাকা দিতে পারব না। আপনি বিদায় হোন, তা হলেও আধপেটা খেয়ে সাইকেল চালিয়ে এসে ভোরবেলায় আমি বেল বাজাব…।
কথা অসমাপ্ত রাখলেন সহদেব, মিনু-চিনু পিঠে ব্যাগ আর ওয়াটারবল হাতে হাজির হয়েছে। তপতী উঠলেন গাড়ি বার করার জন্য। এখান থেকে সহদেব আবার ফিরে যাবেন ক্লাবে। সেখানে দুপুরে দুটো টেক্ল জোড়া দিয়ে টানটান শুয়ে থাকেন চিত হয়ে। কান্তি তার মাথার বালিশটা দিতে চেয়েছিল, নেননি।
তপতীকে চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল হেডমাস্টার আচার্যের দেখা পেতে। একজন শিক্ষক আসেননি, তাঁর ক্লাসটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে তিনি তপতীকে ডেকে পাঠালেন।
তিন মিনিটেই তপতী তাঁর আবেদন শেষ করলেন।
তা কী করে হয়! হেডমাস্টার চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলেন। একঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে খেলার জন্য? এ তো বড় অবাস্তব কথা। আপনার ছেলেরা শুধু খেলে, তার বেশি কিছু নয়। ওরকম তো শত শত ছেলে খেলে। তারা সবাই এসে যদি ছুটি চায় তা হলে স্কুল থেকে লেখাপড়ার পাট তো তুলে দিতে হয়। হা, যদি বুঝতাম ওরা কিছু একটা করেছে, এবার নিজেদের উন্নতির জন্য আরও বেশি ট্রেনিং দরকার, সেজন্য সময় দরকার, তা হলে কনসিডার করে দেখতে পারি। কিন্তু আপনার ছেলেরা যে মস্ত প্লেয়ার হবে সেই প্রতিশ্রুতির প্রমাণ তো চাই। একটা ট্রফি ফ্রফি এনে আগে তো দেখাক। মাপ করবেন মিসেস বসুমল্লিক, আমি ছুটি দিতে পারব না।
পাংশু মুখে তপতী একটি কথাও না বলে হেডমাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিকেলে দুই ছেলেকে নিয়ে গেলেন ক্লাবে। সহদেব একটা বালতিতে চব্বিশটা বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডানদিকের কোর্টের বেস লাইনের কাছে। নেটের ওধারে সার্ভিস বক্সের বাঁ কোণে একটা নীল রুমাল পাতা।
মিনু, সার্ভিসগুলো ওই রুমালটায় ফেলতে হবে,…যাও শুরু করো।
মিনু বালতি থেকে একের পর এক বল তুলে সার্ভ করে যেতে লাগল। শুধু দ্বাদশ সার্ভটা রুমালের কানা ছুঁয়ে গেল, তা ছাড়া পাঁচটা সার্ভ নেটে লাগল, চারটে পড়ল বাইরে। ওধারের বেস লাইন থেকে চিনু এগারোটা বল রিটার্ন পাঠাল। তার মধ্যে মিনু পাঁচটা ভলি করল চিনুর নাগালের বাইরে। সহদেব মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কিস্সু হয়নি। রুমালে মাত্র একবার পড়ল, অন্তত দশবার ফেলতে হবে।… আবার।
চিবুক থেকে ঘাম ঝরছে, মিনুর মুখ থমথমে। আড়চোখে চেয়ারে বসা মায়ের দিকে তাকাতেই তপতী মুখটা আকাশের দিকে তুললেন। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে মিনু আবার শুরু করল। এবার রুমালে বল পড়ল তিনবার। তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম আর র্যাকেটের হাতল মুছে, মাটিতে তালু ঘষে মিনু বলল, আবার।
নেটের কাছে এগিয়ে এসে চিনু বলল, সার, আমি সার্ভ করব না?
না। যতক্ষণ না চব্বিশটায় বারোটা বল ফেলছে, মিনু সার্ভ করে যাবে।
মিনুর ছিয়ানব্বইটা সার্ভ শেষে সহদেব বললেন, মোট তেরোবার, ফিফটিন পার্সেন্টও নয়। মিনু, তুমি সার্ভ করতে শিখেছ?
না সার। আমি আবার করব। জেদি গলায় দাঁত চেপে মিনু বলল।
হাত ভেরে গেছে তোমার, এবার চিনু।
না সার, আবার সার্ভ করব।
এখন থাক। তুমি কনসেনট্রেট করতে পারছ না। রুমালটা ছাড়া আর সব কিছু চোখ থেকে মুছে ফেলতে হবে মিনু। ওইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকো পাঁচ মিনিট।
সহদেব রুমালটা তুলে এনে এধারের সার্ভিস বক্সের মাঝামাঝি জায়গায় পাতলেন। শুরু করো। রিটার্ন করার জন্য মিনুর বদলে র্যাকেট হাতে তিনি বেস লাইনে দাঁড়ালেন।
চিনু সার্ভ করল চব্বিশটা, তার মধ্যে আটটা পড়ল রুমালে। সহদেবের মুখে। পলকের জন্য খুশির ছোঁয়া লেগেই মিলিয়ে গেল।
মিনু এবার ওধারে যাও, চিনু আমার পাশে এসো। সহদেব আর চিনু ডানদিকের কোর্টে বেস লাইনের মাঝামাঝি দাঁড়াল, নেটের ওধারে মিনু। দু জনে। সোজাসুজি বল মারছে তার দিকে। মিনু ব্যাকহ্যান্ড বা ফোরহ্যান্ডে বল ফেরত দিতে লাগল। সহদেব ক্রমশ একটু দূরে দূরে বল পাঠিয়ে তাকে বাধ্য করলেন যাতে ছুটে গিয়ে বল মারতে হয়। এর পর তিনি মারের তীব্রতা বাড়ালেন। সারা কোর্ট চষে ফেলে, এগিয়ে-পিছিয়ে দু পাশে ছুটে গিয়ে মুহূর্তের জন্যও থামার অবকাশ না পেয়ে মিনুকে বল ফেরাতে হচ্ছে। কখনও ডানদিকে ছুটে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে, তার থেকে ভলি করে বা বেস লাইন থেকে কুড়ি গজের ব্যাকহ্যান্ড মেরে। এলোপাতাড়ি ফেরানো নয়, যতটা সম্ভব চিনু আর সহদেবের নাগালের মধ্যে তাকে বল রাখতে হচ্ছে।
পাঁচ মিনিট পরই মিনু দাঁড়িয়ে পড়ল। হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। র্যাকেট কোর্টের ওপর ঠেকিয়ে তাতে শরীরের ভার দু হাতে রেখে মুখ নামিয়ে। সহদেব দু মিনিট মিনুর দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন স্বরে বললেন, আবার।
একটু জিরোই সার।
না। সহদেব চেঁচিয়ে বললেন, ম্যাচ খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে পড়লে কি পেটে যন্ত্রণা শুরু হলে, তখন কি তুমি খেলা বন্ধ করে জিরিয়ে নেবে?…যন্ত্রণার সঙ্গে সড়গড় হও। যন্ত্রণাকে হেসে উড়িয়ে দাও।
সার, আমি তো এখন ম্যাচ খেলছি না। মিনু কাতর স্বরে বলল।
না খেললেই বা! মনে মনে নিজেকে দেখে একটা শক্ত ম্যাচ খেলছ। তুমি পাঁচ মাইল দৌড়েছ, হাজারবার বল মেরেছ, শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে। এগুলো সহজ করে দিতে পারবে যদি আগেই যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়, যদি বুঝে নাও এটা কোনও বড় ব্যাপার নয়, এটা থাকবে না। সহদেব কথা বলতে বলতে নেটের কাছে এলেন। ওয়ার্ক আউট থামিয়ে দিয়ে মাঝে মাঝে তিনি কথা বলেন দুই ভাইকে কাছে ডেকে নিয়ে। হাতছানি দিয়ে তিনি চিনুকে ডাকলেন।
তোমরা হয়তো ভাবতে পারো চার মাইল পর্যন্ত দৌড়বার ক্ষমতা তোমাদের আছে, কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো, যদি একটা বন্দুক তোমাদের মাথায় ঠেকাই তা হলে আবিষ্কার করবে আরও একটা মাইলও দৌড়তে পারো। এটা টেনিস ম্যাচেও খাটাও। বড় বড় প্লেয়াররা যখন খেলে, তখন একে অপরকে যন্ত্রণায় বিপোয়, তখন শুধু একটাই প্রশ্ন, কে আর একটু বেশি যন্ত্রণা দিতে ইচ্ছুক আর কে প্রথম পালাবে। হারতে যতটা সময় লাগে জিততেও ততটা সময় লাগে। ব্যাপারটা যদি তাই হয় তা হলে না জিতে শুধু শুধু যন্ত্রণার শাস্তিটা নেবে কেন? জেতার জন্য নিজেদের তৈরি করো। জিরোবার সবচেয়ে সহজ উপায় কী জানো? সহদেব ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়া। চলো, আমরা বসব এখন।
না। মিনু তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, আপনি গিয়ে বসুন… আয় চিনু।
সহদেব চোখ কুঁচকে নেটের দু দিকে দুই ভাইকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। কী ভেবে তিনি কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে তপতীর পাশের খালি চেয়ারে বসলেন।
আজ গেছলাম হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে। তপতী প্রথম সুযোগেই কথাটা পাড়লেন। মিনু বা চিনু শুনুক এটা তিনি চান না। উনি বললেন, এক ঘন্টা আগে ছুটি দিতে পারবেন না। ওরা শুধুমাত্র খেলে, তার বেশি কিছু নয়। মস্ত প্লেয়ার হবে এমন প্রতিশ্রুতির প্রমাণ না পেলে উনি ছুটি দিতে পারবেন না।
কী প্রমাণ চান উনি? সহদেব কুটি করলেন।
বলেছেন আগে একটা ট্রফি এনে দেখাক।… আমার মনে হয় হেডমাস্টার অন্যায্য কিছু বলেননি। সত্যিই তো, যে লোক খেলাধুলো বোঝেন না তিনি ট্রফি দিয়েই প্রমাণ চাইবেন।
তা হলে আমাদের এখন দরকার একটা ট্রফি। তার মানে ছেলেদুটোকে এবার বাইরে বেরোতে হবে। সহদেব মাথা নিচু করে জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আপনার কি মনে হয় আরও একটা-দুটো বছর— ইতস্তত করে তপতী থেমে গেলেন।
না, না, এই বয়সেই কম্পিটিশনের মুখে পড়া দরকার। কাল আমি বি এল টি এ অফিসে যাব কোথায় কী টুর্নামেন্ট হবে খোঁজখবর করতে।
.
০৭.
দশদিন পর মিনু, চিনু এবং তপতী, বেলা বারোটায় সহদেবের সঙ্গে ট্রেন থেকে নামল হাওড়া স্টেশনে। তারা যাবে নর্থ ক্যালকাটা টেনিস ক্লাবের টুর্নামেন্টে। মিনু আর চিনু এন্ট্রি করেছে। প্রতিযোগিতাটা খুবই ছোট মাপের এবং বড়দের জন্য। সহদেব এন্ট্রি তালিকাটা আগেই দেখে নিয়েছেন। নামী খেলোয়াড় একজনও নেই। কিছু জুনিয়ার আর কিছু সদ্য খেলা ছেড়ে দেওয়া প্রাক্তন নাম দিয়েছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে তারা ট্যাক্সি ধরে ক্লাবের ফটকে এসে নামল। বিরাট একটা পার্কের একধারে ক্লাব। ফটক থেকে মোরামের সরু পথ কিছুটা গিয়ে দু ভাগ হয়ে দুটো টেনিস কোর্টকে বেড় দিয়ে মিলেছে ক্লাব-তাঁবুর সামনে। তাঁবুর বাইরে কয়েকটা বেঞ্চ আর চেয়ার। দু-তিনজন কথা বলল সহদেবের সঙ্গে। তাঁবুর বাইরে অল্প কিছু লোক। ওদের চেয়ারে বসিয়ে সহদেব তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলেন। দুই ভাই সাউথ ক্লাব দেখেছে। সেখানকার গ্যালারি, ভিড়, ক্লাববাড়ি আর টানা বারান্দা তাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে তার সঙ্গে এখানকার কোনও মিলই তারা পাচ্ছে না। তারা ভেবেছিল স্কুল স্পোর্টসের মতো জমজমাট একটা ব্যাপার দেখবে।
চিনু ফিসফিস করে মিনুকে বলল, খেলবে কে রে?
মিনু দুধারে তাকিয়ে বলল, বোধ হয় আমরা আগে এসে পড়েছি।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে সহদেব জানালেন, মিনুর খেলা যার সঙ্গে পড়েছে সে আসতে পারবে না জানিয়েছে, পা মুচকে এখন সে বিছানায়। মিনু সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেছে। চিনুর সঙ্গে খেলবে অদ্বৈত মল্লিক, এই ম্যাচটা দিয়েই। টুর্নামেন্ট শুরু হবে এখনই! সহদেবের কথা শোনা মাত্রই মিনুর মুখ থেকে উদ্দীপনার চকচকে ভাবটা মুছে গেল। আর চিনু খুঁজতে লাগল অদ্বৈত মল্লিককে।
ইতিমধ্যে কোর্টের ধারে কিছু লোক জমা হয়েছে। মালি কয়েকটা টুল রেখে গেল সাইডলাইন আর বেসলাইনের ধারে লাইন্সম্যানদের জন্য। বকের মতো গলা, কোট, প্যান্ট, টাই পরা এক লম্বা লোক, চোখে পুরু কাচ দেওয়া চশমা, স্কোরশিট হাতে নিয়ে আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারে বসলেন। তাঁর মুখের কাছে মাইক্রোফোন। লাইন্সম্যানরা টুলে বসল। দু দিকের বেসলাইনের এবং নেটের দু দিকে বলবয়রা হাজির হল। আম্পায়ার দু বার গলাখাঁকরি দিয়ে মাইক পরীক্ষা করে প্লেয়ারদের নাম ডাকলেন।
চিনু ঢোঁক গিলে সহদেবের কানে চুপিচুপি কী একটা বলতেই তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, টেন্টের মধ্যে ঢুকে একেবারে শেষে গিয়ে ডান দিকে। দেখবে দরজায় জেন্টস লেখা আছে।
মিনু ফিসফিস করে তপতীকে বলল, চিনুটা ঘাবড়ে গেছে।
জীবনের প্রথম ম্যাচে সবাই ঘাবড়ায়, তুইও ঘাবড়াবি।
দেখা যাবে।
অদ্বৈত মল্লিক কোর্টে নেমে পড়েছেন। হৃষ্টপুষ্ট, মাথায় সামান্য টাক, বয়স প্রায়। চল্লিশ। অ্যাডভোকেট। বছর পনেরো আগে পর্যন্ত নিয়মিত প্রতিদিন খেলতেন, এখন শুধু শনি-রবিবারে। নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট দু বার জিতেছেন। মল্লিক গেলেন বাঁ দিকের কোর্টে। গোটা ছয়েক নতুন বল একজন গড়িয়ে দিল। মল্লিক একটা বল তুলে নিয়ে সার্ভ করলেন ওধারের ফাঁকা কোর্টে। বলবয় বল ছুড়ে দিল তাঁকে। তিনি আবার একটা সার্ভ করে তাকালেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পাওয়ার আশায়।
মা, চিনুর বোতামটা! মিনু আঙুল দিয়ে দেখাল। তারপর চাপা গলায় বলল, অ্যাই চিনু, কোমরের বোতাম লাগা। কোমরে হাত দিয়ে চিনু জিভ কাটল।
কোর্টের ধারে একটা চেয়ারে নিরাসক্ত মুখ করে সহদেব একা বসে। চিনু মাকে প্রণাম করে, কপালে চুমু নিয়ে কোর্টের দিকে এগোতেই তপতী মনে করিয়ে দিলেন, সারকে।
সহদেব তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে প্রণামে নত চিনুকে দু কাঁধ ধরে তুললেন। বুকে জড়িয়ে মৃদু স্বরে বললেন, আমার দিকে তাকাবে না, মনে রেখো কোর্টের মধ্যে তুমি একা, নিজেকে নিজেই দেখতে হবে।
অদ্বৈত মল্লিক হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন চিনুর দিকে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড। তিনি ভাবতে পারেননি একটা বালকের সঙ্গে তাঁকে খেলতে হবে। টস করার সময় মল্লিক জিজ্ঞেস করলেন, খোকা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
চিনু গম্ভীর স্বরে বলল, ক্লাস সিক্স।
মল্লিক টস জিতে সার্ভিস নিলেন। ওয়ার্ম-আপের শুরুতে তিনি ফোরহ্যান্ডে প্রথম বলটা পাঠালেন নেটের ওধারে। চিনুর ফোরহ্যান্ড রিটার্ন লাগল নেটে। মল্লিক আবার বল পাঠালেন। চিনু আবার নেটে বল মারল।
মল্লিক নেটের কাছে এসে হাতছানি দিয়ে চিনুকে ডাকলেন। র্যাকেট কাঁধের আর একটু ওপরে তুলে এইভাবে নামিয়ে ফোরহ্যান্ড মারো। তিনি র্যাকেট চালিয়ে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে মারতে হবে। মনে থাকবে?
চিনু বিনীতভাবে মাথা নাড়ল।
প্রথম সার্ভিস করলেন মল্লিক। চিনুর ফোরহ্যান্ড নেটের এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে সাইডলাইন বরাবর বেসলাইনের কাছে পড়ল। জীবনের প্রথম ম্যাচে প্রথম পয়েন্ট! সে প্রথমে সহদেবের, তারপর মা আর দাদার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল। সহদেব মাথাটা সামান্য হেলালেন, মিনু দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিল, তপতী দু হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজলেন। মল্লিক দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। পরের সার্ভিসটার সঙ্গে চিনু একই আচরণ করল। মল্লিকের চোখ আর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তৃতীয় সার্ভিসের ফোরহ্যান্ড রিটার্ন মল্লিকের বুকের কাছে এল, তিনি ভলি করে চিনুর ডান দিকে বল ফেলতেই ফোরহ্যান্ডে সে বাঁ দিকের ফাঁকা কোর্টে বল মারল। চিনু জীবনের প্রথম গেমটা পেল মল্লিক ডা-ফল্ট করায়। সময় লাগল দু মিনিট। ম্যাচ শেষ হল পঁচিশ মিনিটে : ৬-১, ৬-০। হ্যান্ডশেক করার সময় মল্লিক বললেন, আমার কথাগুলো মনে রেখেছিলে তা হলে…গুড মেমারি।
ঘড়ি দেখে সহদেব বললেন, মাত্র দুটো বাজে। চলুন দিদি, একবার সাউথ ক্লাব ঘুরে আসি। বেঙ্গলের ভাল জুনিয়াররা ওখানে প্র্যাকটিস করছে। ওরা একবার দেখুক।
বাইরে বেরিয়ে এসে সহদেব বললেন, বাসে করে চলে যাই, মিছিমিছি কেন ট্যাক্সি ভাড়া দেবেন।
তপতী বললেন, দোব। এটা ছেলেদের ব্যাপার।
কিন্তু ছেলেরা একসঙ্গে বায়না ধরল তারা জীবনে কখনও বাসে-ট্রামে চড়েনি, সুতরাং বাসেই যাবে। চিনু বলল, সার ট্রামে যাব। সহদেব বললেন, এখান থেকে ট্রাম টানা এলগিন রোড পর্যন্ত যায় না, এসপ্ল্যানেডে নেমে আবার ট্রামে উঠতে হবে। তা ছাড়া বাস তাড়াতাড়ি যায় ট্রামের থেকে।
বাসে উঠে কুড়ি মিনিট পর চৌরঙ্গি-এলগিন রোডের মোড়ে নেমে ওরা হেঁটে সাউথ ক্লাবে পৌঁছল। আটটা কোর্টে তখন খেলা চলছে। চারদিকে শুধু খব খব খব শব্দ। তিনজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা কোর্টের ধারে সহদেব ওদের নিয়ে গেলেন, মাঝবয়সি একটি লোক সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান যোলো-সতেরো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে খেলছে। সহদেব বললেন, যে ট্রেনিং করাচ্ছে ওর নাম সৈদুল। আগে বলবয় ছিল, আমার চেনা।
খুব জোরে মারা একটা ক্ৰশকোর্ট ফোরহ্যান্ডে সৈদুল র্যাকেট ছোঁয়াতে পারল না। বলটাকে কোর্টের বাইরে লুফল মিনু। সৈদুল বলটা চাইল র্যাকেট বাড়িয়ে ধরে, আর সেই সময় দেখতে পেল সহদেবকে। হাত তুলে সে চেনা দিল।
সৈদু শোন, সহদেব হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।
আরে দেবুদা, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? একগাল হেসে সৈদুল হাত জড়িয়ে ধরল সহদেবের। কী করছ এখন? আছ কোথায়?
এই ছেলে দুটোকে নিয়ে আছি মহাদেবপুর বলে একটা জায়গায়, আমার বাড়ির কাছেই।
সৈদুল হাসিমুখে মিনু-চিনুর দিকে তাকাল। এদের শেখাচ্ছ? ভাল।
তোর ওই ছেলেটা তো বেশ ভালই খেলে। নাম কী?
অরুণ, অরুণ মেটা। এখন জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান। লাস্ট ইয়ারে জুনিয়ার ন্যাশানাল রানার্স হয়েছে, ফাইনালে হেরেছিল ম্যাড্রাসের মুথান্নার কাছে।
সৈদু একটা কাজ করবি? তোর ওই ছেলেটার সঙ্গে একে একটা সেট খেলাবি? সহদেব আঙুল দিয়ে মিনুকে দেখালেন, ওর নাম মৃন্ময়।
বেশ তো, খেলুক। তুমি যখন চাইছ তখন নিশ্চয় ওর স্ট্যান্ডার্ড ভাল।
সেইটে দেখার জন্যই খেলাতে চাই। মিনু এখনও পর্যন্ত একটা গেমও বাইরের কারো সঙ্গে খেলেনি।
সৈদুল নেটের কাছে গিয়ে অরুণের সঙ্গে কথা বলে হাতছানি দিয়ে মিনুকে কোর্টে নামতে বলল। সহদেব মিনুর কাঁধ ধরে সাইডলাইন পর্যন্ত গেলেন, এটা ম্যাচ খেলা নয় ফ্রেন্ডলি খেলা, রিল্যাক্সড থাকবে। সঙ্কোচে গুটিয়ে যেয়ো না, মনে রেখো অরুণ তোমার মতই জুনিয়ার, ঘাবড়াবার কিছু নেই। খোলাখুলি সহজ মনে হিট করো।
দাদা, চাপা স্বরে চিনু বলল, তুই জেন্টসে যাবি না?
আগুনে-চোখে ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মিনু কোর্টে নামল। ওয়ার্ম-আপ করার সময় কামানের গোলার মতো অরুণের প্রথম সার্ভিসটায় র্যাকেট ছোঁয়াতেই মিনুর মুঠোর মধ্যে র্যাকেটটা সামান্য ঘুরে গেল। সে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। মিনিট তিনেক পর সৈদুল নেটের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, নাউ স্টার্ট…সার্ভিস অরুণ মেটা, লাভ-অল।
দশ মিনিটের মধ্যেই মিনুর সার্ভিস দুবার ভেঙে অরুণ স্কোর নিয়ে গেল ৩-০। প্রচণ্ড জোরালো মারগুলো কোর্টের ঘাসগুলোকে নয়, যেন মিনুর মাথার মধ্যে আঘাত করে করে তাকে অসাড় করে দিয়েছে। তার র্যাকেট উঠছে না, দুটো পা চলছে না। শুধু দেখল তার দুপাশ দিয়ে বলগুলো ঘাসে পড়ে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
অরুণ কোমরে হাত রেখে সৈদুলের দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে। আরও কি খেলতে হবে? এমন একটা ভাব তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। মিনু তাকাল সহদেবের দিকে। দেখি এবার তুমি কী করো, এমন একটা ভাব সহদেবের মুখে।
চতুর্থ গেমে সার্ভিস করেই মিনু এতক্ষণ যা করেনি, নেটের দিকে ছুটে গেল। রিটার্নটা উঁচু হয়ে তার বাঁ দিকে এল। অরুণের নাগালের বাইরে সেটা ভলি করে মিনু পয়েন্ট পেল। তার পরের সার্ভিস পড়ল বক্সের কোণে। অরুণ দাঁড়িয়ে থেকে এসটা দেখল। পরের দুটো সার্ভিসও একই জায়গায় পড়ল। পরপর তিনটে সার্ভিস এস হতে দেখে বিস্মিত সৈদুল হাততালি দিয়ে হাঁকল, ওয়ান-থ্রি।
চিনু ফিসফিস করে তার মায়ের কানে বলল, সারের রুমালটাকে তিন বলে তিনবার হিট করল।
মিনুর মাথার মধ্যে যে খিলটা পড়ে ছিল এবার সেটা খুলে গেছে। অরুণের জোরালো মারগুলো আর তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে না। সহজ বাতাস তার সারা শরীরের মধ্যে ভাসছে। সে স্বচ্ছন্দে এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে, পাশে ছুটছে। দ্রুতগতিতে। চার মিনিটের মধ্যে অরুণের সার্ভিস ভেঙে সে ৩-৩-এ স্কোর নিয়ে গেল। অরুণ তখন হাঁফাচ্ছে।
অরুণ সৈদুলের কাছে গিয়ে বলল, আর খেলব না, পিঠের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। র্যাকেট-ধরা হাতটা মিনুর দিকে একবার তুলে সে ক্লাবহাউসের দিকে হাঁটতে শুরু করল কোনওদিকে দৃকপাত না করে।
বড়লোকের ছেলে, কখন কী মর্জি হয়! সৈদুল অপ্রতিভ স্বরে বলল। দিনে দেড়ঘণ্টার বেশি ট্রেনিং করে না। বলে বলেও ওকে দৌড় করাতে পারিনি। মৃন্ময়ের স্পিড, স্ট্যামিনা তো খুব ভাল!
অরুণের খেলা উচিত ছিল। সহদেব বললেন। তাঁর মনে হয়েছে, অরুণের পিঠব্যথাটা অজুহাত, আসলে সে পালাল। যারা পালায় তারা কখনওই জেতে না। তবে মনে মনে তিনি খুশি। আজ একটা ব্যাপার তিনি জেনে গেলেন, মিনু বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার মতো খেলা খেলতে পারে।
.
নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টে চিনু দ্বিতীয় রাউন্ডে স্ট্রেট সেটে হেরে গেল প্রদীপ ঘোষের কাছে। যে গত বছর সিনিয়ার স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। তিনদিন পর রবিবারে মিনু ২-১ সেটে প্রদীপ ঘোষকে হারাল ফাইনালে। একটা বড় কাপ, একটা মেডেল আর তিনজন আরোহীকে ভক্সহলে বসিয়ে তন্ময় মহাদেবপুর ফিরলেন। সহদেবকে এক পুরনো বন্ধু বাড়িতে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তিনি আর এদের সঙ্গে ফেরেননি।
বাড়ির কাছে এসে তন্ময়ের কী মনে হল, তিনি বললেন, চলো একবার ক্লাবটা ঘুরে আসি। রোববারে অনেকেই থাকবে।
ক্লাব-লনের প্রায় সবকটা টেলই ভরা। একটা বড় কাপ দু হাতে ধরে মিনু আর তার পেছনে তন্ময়, চিনু আর তপতীকে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক চোখে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল।
তন্ময় একটু গলা চড়িয়ে বললেন, আমাদের টেনিস কোর্টের প্রথম ফসল। কাপটা তিনি মাথার ওপর তুললেন। মিনু আজ নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট থেকে। জিতে আনল।
হই-হইয়ের সঙ্গে হাততালির শব্দ উঠল। অবশ্য কেউ কেউ হাততালি দিলেন না, গলা থেকে আওয়াজও বার করলেন না। কান্তি চায়ের ট্রে নিয়ে আসছিল। একটা টেলে ট্রে-টা রেখে ছুটে এসে কাপটা মাথায় তুলে এমনভাবে ঘুরতে শুরু করল, যেন সেটা সে নিজেই জিতেছে! টেনিস কোর্টটা প্রথম দিন থেকে তার হাতেই লালিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। উচ্ছ্বাস ধরে রাখা তার পক্ষে সত্যিই খুব কঠিন। প্রত্যেক টেবলে সে কাপটা দেখাতে দেখাতে অবশেষে প্রতিভা মজুমদারের টেবলে রাখল।
দেখুন মেমসাব, সেই ছোট্ট মিনু কাপ জিতে এনেছে।
দেখেছি, এবার এটা টেবল থেকে সরাও, আর চায়ের একটা পট দিয়ে যাও।
দিচ্ছি। রুপোর কাপ তাই না? দাম কত হবে বলুন তো?
রুপো না ছাই। পেতলের ওপর রুপোর জল-করা।
কান্তি অপ্রতিভ হয়ে কাপটা তুলে নিল।
হোক পেতল, সবাইকে হারিয়ে জিতেছে তো!
কান্তি চলে যেতেই সুধা ঘোষাল বললেন, নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টের নাম তো কখনও শুনিনি।
এরকম টুর্নামেন্ট কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় হয়, শুনবে কী করে? প্রতিভা বললেন।
প্রতিভাদি, দোকান থেকে কিনে এনে দেখাচ্ছে না তো? চন্দ্রিমা দত্ত ফোড়ন কাটলেন।
ওহহো, একটা কথা তো বলা হয়নি। সুধা ঘোষাল টেলে ঝুঁকে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো মাথা। মিসেস বসুমল্লিক ছেলেদের খেলার প্র্যাকটিসের জন্য এক ঘণ্টা আগে স্কুল থেকে ছুটি করাতে হেডমাস্টার আচার্যর হাতে পায়ে ধরেছিলেন, জানেন কি?
না তো! তারপর কী হল? প্রতিভার দমবন্ধ হয়ে এল এমন একটা খবরের সন্ধান পেয়ে। কে বলল তোমায়?।
রমু বলল। ওর ক্লাসেই তো পড়ে হেডমাস্টারের ভাগ্নে। কিন্তু হেডমাস্টারকে জানেন তো, খুব কড়া লোক। তিনি ওসব হাতে পায়ে ধরাধরি, কান্নাকাটিতে গলে যাওয়ার পাত্র নন। দিলেন এককথায় তাড়িয়ে। বললেন, কী এমন করেছে আপনার ছেলে। ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান হয়েছে কি? একটাও বড় টুর্নামেন্ট জিতেছে কি? কী দেখে আমি ছুটি অ্যালাও করব? শুনেই মুখ চুন করে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
এবার তো উনি এই কাপটা নিয়ে গিয়ে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে ছুটি আদায় করবেন। চন্দ্রিমা বিপন্ন স্বরে বললেন।
করলেই হল? রমুর বাবা কী বলল জানেন, তা হলে একটা কাপ কিনে হেডমাস্টারকে দেখিয়ে বলব, রমুকে এক ঘণ্টা আগে ছুটি দিতে হবে, ডায়মন্ড হারবারে ওয়াকিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে, হাঁটায় ওর দারুণ প্রতিভা, ওর আরও প্র্যাকটিস দরকার। বলেই সুধা ঘোষাল হাসতে হাসতে চন্দ্রিমার গায়ে প্রায় গড়িয়ে পড়লেন। অন্য দুজনও খুকখুক শব্দ করলেন।
একটা জিনিস লক্ষ করেছ, টেনিস খেলাকে ছুতো করে বসুমল্লিকরা জমিটাকে নিজেদের সম্পত্তি করে ফেলেছে। কাউকে তো খেলতেই দেয় না! প্রতিভা বললেন গলায় ক্ষোভ নিয়ে।
যা বলেছেন! চন্দ্রিমা সূত্রটা ধরে নিয়ে যোগ করলেন, অনিরুদ্ধ বাগচির কেসটা জানেন তো? ছেলেটা যে কী ভাল, কী বলব! রীতিমতো চাঁদা দিয়ে টেনিস খেলতে পাঠিয়েছিল ওর বাবা। কোথায় খেলা! শুধু নিজের ছেলে দুটোকে খেলাতেই উনি ব্যস্ত, অনিরুদ্ধ বেচারি চুপচাপ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে ওর ঠাকুমা রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই বলে নাতিকে নিয়ে চলে আসেন।
যাক গে এসব কথা, কান্তি চা আনছে, চুপ করো। প্রতিভা হুঁশিয়ার করে দিলেন।
ওদের টেবলের পাশের টেবলেই স্ত্রী বরুণাকে নিয়ে বসে ছিলেন এম জে টি এম-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজার সুভাষ সেন। ওঁর ছেলে শঙ্কু শান্তিনিকেতনে চলে যাবে, টেনিস খেলবে না, তবুও তিনি তপতীকে চাঁদা দিয়েছিলেন, কারণ বাচ্চাদের খেলাধুলোর প্রয়োজনটা তিনি বোঝেন। পাশের টেবলের কথাবার্তার অনেকটাই তাঁদের কানে এসেছে।
শুনলে, কী সব কথা বলল? সুভাষ সেন স্ত্রীকে বললেন।
কেউ ভাল কিছু করলে এইসব পুরস্কারই তার জোটে।
শঙ্কু যদি এখানে থাকত, তা হলে নিশ্চয় আমি ওকে টেনিস খেলতে পাঠাতাম। লক্ষ করেছ ওঁর দুটি ছেলের কী চমৎকার স্বাস্থ্য তৈরি হয়েছে! হাঁটাচলায় কত স্মার্ট! ছোটটি পাঁচ বছর আগে কী রুগণ দেখতে ছিল, রীতিমতো তো ধুকত। আর এখন? সুভাষ সেনের স্বরে প্রশংসার সঙ্গে শ্রদ্ধাও ফুটে উঠল। সবই ওই দুজনের জন্য।
সত্যিই, কষ্ট করেছেন ওদের বাবা মা। বরুণার গলায় অকৃত্রিম সহানুভূতি। মিসেস বসুমল্লিককে ছেড়া ব্লাউজ সেলাই করে পরতে দেখেছি। তন্ময়বাবুর জুতোটা দেখেছ? তোমার বেয়ারাও ওর থেকে ভাল জুতো পরে। অথচ ছেলেদের জন্য খরচ করতে কার্পণ্য করেন না। টেনিসের কোচকেই ওঁরা দেন মাসে দুশো টাকা, ভাবতে পারো?
ভাবতে পারেননি তপতী, মিনুর নর্থ ক্যালকাটা টুর্নামেন্ট জেতার প্রতিক্রিয়া এমন হবে।
সোমবার তিনি ছেলেদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় কাপটাও সঙ্গে নিয়ে গেছলেন হেডমাস্টারকে দেখাবার জন্য। গিয়ে শুনলেন তিনি আজ স্কুলে আসবেন না, কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মিটিংয়ে গেছেন। কাপটা হেডমাস্টারের টেবলের একধারে রেখে তপতী বেয়ারাকে বলে আসেন, ওঁকে বোলো, ক্লাস এইটের বি সেকশনের মৃন্ময় বসুমল্লিক এটা জিতে এনেছে কলকাতা থেকে। আমি কাল এসে নিয়ে যাব।
পরদিন গাড়ি থেকে নেমে তপতী দুই ছেলের সঙ্গে স্কুলের বড় ফটক দিয়ে ঢুকে স্কুলবাড়ির কোলাপসিল ফটকের দিকে এগোচ্ছেন, তখন একটি বড় ছেলে চেঁচিয়ে বলল, কী রে মৃন্ময়, কাকে হারিয়ে কাপটা পেলি, কৃষ্ণনকে, না জয়দীপ মুখার্জিকে?
ওরা তিনজন থমকে পাঁচটি ছেলের জটলার দিকে তাকাল। চিনু চাপা গলায় বলল, দাদা প্রণবেন্দু বলল, চুপ করে থাক, কথা বলিসনি।
তিনজন কোলাপসিল ফটকের কাছে পৌঁছেছে তখন তাদের কানে এল, জিতে আনলি না কিনে আনলি?
কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওদের পা অচল হয়ে পড়ল। তপতী তাকালেন মিনুর মুখের দিকে। অপমানে আর বেদনায় মুখটা দিশাহারা। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল, জল ভরে আসছে চোখে। কথাগুলোর ধাক্কা ওর বুকে বেজেছে। তাড়াতাড়ি ক্লাসে যা। তপতী দুই ছেলের পিঠে হাত রেখে ঠেলা দিলেন। এসব কথায় জবাব দিলে ওরা আশকারা পেয়ে আরও বলবে, ক্লাসে যা।
মা, আমি প্রণবেন্দুকে মারব। চিনু জ্বলন্ত চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল।
মারবে? কেন?
দাদাকে অপমান করেছে, আমাদের সবাইকে, তোমাকে, বাবাকে মিথ্যেবাদী, জোচ্চর বলল।
বলতে দে। মিনু, ক্লাসে যা। চিনু খবদার, যদি মারপিট করিস তা হলে আমি লজ্জায় মরে যাব।
ছেলেরা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোল। তপতী ঠোঁট কামড়ে চোখ বুজলেন। শরীরের ভেতরটা থরথর করছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন, দেয়ালে হাত রেখে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে শুধু বলে গেলেন, হায় ভগবান, এত পরিশ্রম, এত কষ্ট, এত সাধনা করল মিনু আর ওইটুকু ছেলের মাথায় কিনা এমন অপবাদের বোঝা তুলে দিল! ওর জীবন তো শুরুই হয়নি, আর এখনই ঈষা হিংসার আঘাত ওকে পেতে হল! ভেঙে না পড়ে মিনুর নরম কাঁচা মন! ভগবান ওকে শক্তি দাও।
তপতী হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন কাপটা টেল থেকে মেঝেয় নামানো।
আসুন মিসেস বসুমল্লিক। হেডমাস্টার আচার্য তিনটি চেয়ারের মধ্যে একমাত্র খালি চেয়ারটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, বসুন। অন্য দুটি চেয়ারে দুজন অভিভাবক বসে।
কাল এসে কাপটা রেখে গেছেন। বেশ বড় কাপ। আজ সকালে তিনটে কাগজে খুঁজলাম—কিন্তু মৃন্ময়ের নাম তো কোথাও দেখতে পেলাম না! হেডমাস্টারের বিস্মিত চোখে তপতী দেখতে পেলেন প্রশ্ন, কেন পেলাম না?
কেন পেলেন না সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, আমি তো কাগজের সম্পাদক নই। তপতী শান্ত স্বরে পরিহাস মিশিয়ে বললেন।
হয়তো ছাপার যোগ্য খবর নয় বলেই ছাপেনি। হেডমাস্টারের গলা ঈষৎ তির্যক।
তা হতে পারে। তপতী উঠে দাঁড়ালেন। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।
হাঁ, নিশ্চয়। ওটা তো দেখা হয়ে গেছে।
তপতী যত্নভরে কাপটা দুহাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ধীর পায়ে।
বাড়ি ফিরে তিনি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে রইলেন। বেলা একসময় খেতে ডাকল। মাথা ধরেছে, খিদে নেই বলে কিছু খেলেন না। গাড়ি নিয়ে স্কুলে গেলেন ঠিক সাড়ে তিনটেয়। চিনু মিনু যখন গাড়ির দিকে আসছে তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে তাকালেন। দুই ছেলেরই মুখ গম্ভীর। জামাপ্যান্টে মারামারির কোনও চিহ্ন নেই দেখে তিনি খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। তবে মুখের ভাব তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলল। সকালে শোনা কথাগুলো বোধ হয় ওদের মন থেকে মুছে যায়নি।
গাড়িতেই ওরা প্যান্ট শার্ট বদলে খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খানিকটা খেয়ে রেখে দিল। পোশাক বদলাল না।
ড্রেস চেঞ্জ করবি না? গাড়ি চালাতে চালাতে তপতী বললেন।
না। চিনু বলল।
খেলবি না?
ভাল লাগছে না। ..মা এই স্কুলে আর পড়ব না। চিনুর স্বরে ক্ষোভ আর বিরাগের সঙ্গে তিক্ততা মাখানো রয়েছে। মিনু চুপ করে আছে।
তপতী উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝতে পারছেন দুজনের মনের অবস্থা। এখন কথা না বলাই ভাল। জমে ওঠা রাগ আর বেদনা ওরা বার করে দিক আগে।
সহদেব অপেক্ষা করছিলেন। তপতী নিজেই বললেন, আজ আর ওয়ার্ক আউট করাবেন না সহদেববাবু, ওদের মন খুব বিক্ষিপ্ত রয়েছে।
সে কী! একটা তো মোটে টুর্নামেন্ট জিতল, এখনও অনেক জিততে হবে মিনুকে। আমি তো ঠিক করে রেখেছি ওকে এবছরই কলকাতার সব টুর্নামেন্টে নামাব।
তা নামাবেন। কিন্তু আজ থাক, কারণটা আমি পরে বলছি। বরং ওরা নিজেদের মধ্যে খেলুক তা হলে মনটাকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারবে।
সহদেব দুজনকে ডাকলেন। ড্রেস করোনি কেন? যাও চেঞ্জ করে এসো… আজ দুজনে সেকেন্ড সার্ভ প্র্যাকটিস করো। মিনু কাল তিনটে ডাক্ল-ফল্ট করেছ।
আজ আমি কোর্টে নামব না। মুখ নিচু করে গোঁয়ারের মতো মিনু দাঁড়িয়ে রইল।
চিনু?
আমিও না।
সহদেব চোখে প্রশ্ন নিয়ে তপতীর দিকে তাকালেন।
তা হলে আজ থাক। তপতী বললেন।
বেশ, তা হলে মন গুছিয়ে নেওয়ার খেলাই ওরা খেলুক। সহদেব একটা বল তাঁর হাতের র্যাকেটের ওপর রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলটাকে প্রায় পনেরো ফুট শুন্যে ছুড়ে দিলেন। পড়ন্ত বলটা তাঁত ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে র্যাকেটটা নীচে নামিয়ে নিতে নিতে বলটাকে তিনি তাঁতের ওপর স্থিরভাবে বসিয়ে নিলেন, যেন জালে ধরা পড়ল বলটা। দুবার-তিনবার করলেন।
মিনু র্যাকেট নাও। বলেছ যখন কোর্টে তোমায় আজ নামতে হবে না। এখন তুমি ওদিকে কুড়ি পা যাও।
নির্দেশ মতো কোর্টের বাইরের জমিতে মিনু গুনে গুনে কুড়ি পা দূরত্বে গেল। সহদেব র্যাকেটে রাখা বলটা ছুড়ে দিয়েই বললেন, র্যাকেটে ধরো।
মিনু র্যাকেট আলতো করে বলের সঙ্গে নামিয়ে নিতে নিতে তাঁতের ওপর বলটা ধরল।
ছুড়ে দাও, যেমনভাবে আমি দিলাম।
এর পর সহদেব বলটাকে মিনুর পেছনে, দুপাশে কখনও বা পাঁচ গজ সামনে পাঠাতে লাগলেন। মিনু নিখুঁতভাবে প্রতিটি বল র্যাকেটে ধরে পাঠিয়ে দিল।
সহদেব ইশারা করলেন চিনুকে। তুমি এবার আমার জায়গা নাও।… এটা করে যাও তা হলে টাচ তৈরি হবে, কন্ট্রোল আসবে। কথাগুলো বলে তিনি তপতীর পাশে এসে বসলেন। হাঁ বলুন কী বলবেন।
তপতী সকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বললেন, ওরা কতটা দাগা পেয়েছে বুঝতেই পারছেন, খেলতে এত ভালবাসে অথচ খেলতে চাইল না।
শুনতে শুনতে সহদেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল রাগে। কিছুক্ষণ কথা না বলে মুখ নামিয়ে রইলেন। একসময় মুখ তুলে বললেন, দিদি, খেলাটা কোর্টে যতটা না হয় তার থেকেও বেশি হয় মনে। আর মন যদি এইসব কথা শুনে ছত্রাকার হয়ে যায় তা হলে খেলার অবস্থাটাও তাই হবে। ওদের যদি আর একটু বয়স বা অভিজ্ঞতা হত, তা হলে নিজেরাই নিজেদের সামলাতে পারত।… এই কাজটা কি এখন আপনাকেই করতে হবে। ওদের আড়াল করা, ওদের মনের চার পাশে দেয়াল তুলে শুধু ছাদটা খুলে রাখা, সেখান দিয়ে টেনিস ছাড়া আর কিছু যেন না দেখতে পায়।… পারবেন?
পারতে হবে।
.
০৮.
মিনু, চিনু তোমরা কী হতে চাও, তোমাদের জীবনের লক্ষ্য কী?
বড় টেনিস প্লেয়ার হতে চাই।
আমিও।
খাওয়ার টেবলে ছড়ানো বই, খাতা, স্কুলব্যাগ। তপতীর ডান দিকে চিনু, টেবলের ওধারে মিনু। কোর্ট থেকে ফিরে প্রতি সন্ধ্যার মতো তিনি ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসেছেন। চিনুকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে প্রশ্নমালা থেকে দশটা অঙ্ক করতে দিয়েছেন। তারপর মিনুকে করতে দেওয়া ট্রানস্লেশন সংশোধন করতে করতে হঠাৎই তিনি ছেলেদের প্রশ্নটা করলেন। বসার ঘরে সোফায় শুয়ে তন্ময় খবরের কাগজ পড়ছেন, কাগজটা নামিয়ে তিনি দরজা দিয়ে একপলক তাকিয়ে আবার পড়তে শুরু করলেন।
বড় প্লেয়ার হতে গেলে প্রথমেই কী দরকার?
উত্তরটা দুই ছেলেরই বহুবার মায়ের কাছ থেকে শোনা আছে।
কঠোর পরিশ্রম। মিনু বলল।
আর?
লক্ষ্যপূরণের জন্য মনকে চিনু দাদার দিকে তাকাল।
একমুখীন করতে হবে। মিনু সম্পূর্ণ করে দিল।
তোমরা কি তাই করছ? তপতী ছেলেদের যখন গভীর কোনও কথা বলেন তখন তুই হয়ে যায় তুমি। আজ তোমরা কোর্টে নামতে চাইলে না কেন? তোমাদের লক্ষ্য বড় প্লেয়ার হওয়া, কিন্তু আজেবাজে কথা শুনে…।
আজেবাজে? প্রণবেন্দু যে কথাটা বলল সেটা আজেবাজে? রাগে ফুঁসে উঠল মিনু।
হ্যাঁ আজেবাজে। শান্ত ধীর স্বরে তপতী কথাটা বলে ছেলের চোখের দিকে। তাকিয়ে রইলেন। মিনু চোখ নামিয়ে নিল।
তুমি জান, পরিশ্রম করে কোনও অন্যায় সুযোগ না নিয়ে, পাঁচজন প্লেয়ারকে পরিচ্ছন্নভাবে হারিয়ে কাপটা জিতেছ। …নিজের কাছে তুমি সৎ। এটাই হল বড় কথা, একমাত্র কথা। জেতার জন্য তোমার মনের মধ্যে একটা সুন্দর অনুভূতি পেয়েছ, তোমার কাজ এই অনুভূতিটাকে বাঁচিয়ে রাখা। তা করতে পারলে দেখবে একটা দুর্লভ ট্রফি তুমি জিতে ফেলেছ। তপতী কথা শেষ করে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। চিনুমিনু উৎসুক কৌতূহলভরে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজেকে নিজের ভাল লাগছে—এটাই হল ট্রফি আর এই ট্রফিটা তোমাদের জিততে হবে। সেজন্য যা কিছু সুন্দর জিনিস, সংগ্রহ করে মনে ভরে রাখতে হবে। তা করতে পারলে দেখবে মন একমুখীন হয়েছে। কুৎসা ঈর্ষা রটনা এসব হল আবর্জনা। এগুলো দিয়ে মন ভরিয়ে ফেললেই দেখবে তোমাদের ভেতর দুর্গন্ধ জমে উঠেছে, শ্বাস নিতে পারছ না, ছটফট করছ। তখন মন আর একমুখীন হতে পারবে না… তোমরা বড় প্লেয়ার কেন, কিছুই হতে পারবে না।
তপতীর নম্র স্বর সারা ঘরে একটা গম্ভীর পরিবেশ তৈরি করেছে। মিনু একদৃষ্টে টেবলের একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে। চিনু ইরেজারটাকে নখ দিয়ে খুঁটছে। তপতী আড়চোখে দেখলেন বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তন্ময় নিঃশব্দে হাসছেন।
তাই বলে আমরা হজম করে যাব? চিনু এখনও মানতে পারছে না সকালে স্কুলের ঘটনাটা।
হজম করতে না পারলে কোরো না। আমরা কত আশা নিয়ে তোমাদের দিকে তাকিয়ে, তোমরা বড় প্লেয়ার হবে, আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠবে। আমাদের দেখে লোকে বলবে ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময় বসুমল্লিকের। বাবা। আর আমরা বলব, ওই দেখো আমাদের মিনু, ওই দেখো আমাদের চিনু, ওদের জন্য আমরা কত কষ্ট করেছি, কত অপমান কুৎসা সয়েছি। আজ দ্যাখো ওদের কত নাম, কত যশ, ওরা বাবা-মার মুখ রেখেছে, ওরা বাবা-মাকে ভালবাসে। … তপতী থেমে গেলেন মিনুর চোখ ছলছল করছে দেখে। চিনু দু হাতে আঁকড়ে মায়ের ডান বাহুতে মুখ চেপে ধরল।
…কিন্তু মিনু আর চিনু একটা বড় ভুল করে বসল। মায়ের কথা না শুনে ওরা লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে মনকে অশান্তিতে ভরিয়ে তুলল, তাই ওরা বড় হতে পারল না। মা আর বাবাকে দুঃখ দিল। কেউ আর বলবে না ওই যে মৃন্ময় বসুমল্লিকের মা, ওই যে চিন্ময়। তপতীকে থেমে যেতে হল।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে মিনু টেবলের বইগুলিকে দুহাত দিয়ে ছত্রখান করে টেলে একটা ঘুসি বসিয়ে চিৎকার করল, না, না, না। তারপরই সে ছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেল।
চিনু! তপতীর বাহু কামড়ে ধরেছে চিনু।
আমি হজম করব।
মিনিটখানেক পর ব্যস্ত হয়ে বেলা হাজির হল। কী হয়েছে গো বউদি? মিনু বিছানায় উপুড় হয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে কেন গো?
ও কাঁদছে আর এ কামড়াচ্ছে, কী করি বলো তো? কৃত্রিম অসহায়তা ফোটালেন তপতী তাঁর গলায়।
দিনকয়েক পর তপতী কোর্টের ধারে বসে। চিনু-মিনুকে দাঁড় করিয়ে সহদেব কথা বলছেন।
ভলি মারার জন্য, রিফ্লেক্সের স্পিড বাড়াবার জন্য, তোমাদের কজির আর হাতের জোর বাড়াবার জন্য নেট গেম প্র্যাকটিসটা আজ অন্যভাবে করতে হবে। বাঁ হাতটা পিঠে ঠেকিয়ে তোমাদের খেলে যেতে হবে। ব্যালেন্সের জন্য একটা হাত না থাকলে দেখবে তোমাদের আরও চটপট মুভ করতে হচ্ছে, উপরন্তু যাবতীয় চাপ পড়বে ডান হাতের ওপর। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? দুজনে মাথা নাড়ল। এবার করে দেখা যাক।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুজনেই তিন-চারবার কোর্টে পড়ে গেল ভারসাম্য হারিয়ে।
আস্তে খেলো আস্তে, প্রথম দিনেই অত ফাস্ট মুভ করতে যেয়ো না…মিনু ব্যাকহ্যান্ডটা বড় দেরিতে হিট করছ তাই বল বাইরে যাচ্ছে, আরও তাড়াতাড়ি র্যাকেটটা পেছনে নাও, মাথাটা নামিয়ে দাও স্ট্রোক নেওয়ার সময়…লবটা আরও তুলে দাও চিনু, সূর্যের দিকে তাকাতে মিনুকে বাধ্য করো সহদেব সমানে চিৎকার করে গেলেন এবং দশ মিনিট পরই ছেলে দুটি দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁফাতে শুরু করল।
কী হল? সহদেব ধমকে উঠলেন।
সার দু মিনিট। মিনু আবেদন জানাল। সহদেব ঘড়ি দেখতে লাগলেন।
দু মিনিট হয়ে গেছে, স্টার্ট।
বিকেল গড়িয়ে গেছে। চারদিক ধূসর হয়ে উঠছে। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। চিনু, মিনু ক্লাবের কলে মুখ হাত পা ধুয়ে ফিরে এল।
চারটে ক্লাব টুর্নামেন্টে তোমাদের এন্ট্রি করিয়েছি, দুটো হবে হার্ডকোর্টে। শ্যামবাজার, কাশীপুর, অর্ডন্যান্স, স্যাটারডে, টানা প্রায় একমাস।
নানারকমের কোর্টে, নানা কন্ডিশনে, নানা ধরনের প্লেয়ারদের সঙ্গে তোমাদের এখন খেলা দরকার, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তোমাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য।
সহদেব জুততার ভেতর থেকে কাঁকর ঝেড়ে ফেলে ফিতে বাঁধলেন।
একমাস তা হলে স্কুল করা হবে না। মিনু মনে করিয়ে দিল।
তা হবে না। যদি কলকাতায় থাকতে তা হলে হাফ স্কুল করেও খেলতে যেতে পারতে। কিন্তু এখান থেকে পৌঁছতেই তো দেড়-দু ঘণ্টা লেগে যাবে।…স্কুল কামাই করতেই হবে। সহদেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন।
একমাস কামাই করলে আমাদের তো নাম কেটে দেবে।
তপতী গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, আমি বরং একবার হেডমাস্টারমশাইকে বলে দেখি যদি মাসখানেকের জন্য ছুটি দেন।
যদি না দেয়? চিনুর চোখে সংশয়।
না দিলে কী আর করা যাবে, নাম কেটে দিলে দেবে। তপতী সহজ সুরে কথাগুলো বললেন কিন্তু ঋজু ভঙ্গিতে। কেউ যদি অসুখে পড়ে একমাস স্কুলে না যায় তা হলে কি তার নাম কাটা যাবে?
আমাদের তো অসুখ নয়। চিনুর আবার সংশয়।
তার থেকেও বড় ব্যাপার, সুস্থ থাকার জন্য খেলা! হয়েছে এবার, চলো। সহদেববাবু আপনি টুর্নামেন্টের তারিখগুলো যদি দেন তো কথা বলতে সুবিধে হবে। তবে একটা কথা, ছুটি না দিলেও ওরা কিন্তু খেলতে যাবে।
এক সপ্তাহ পর তপতী দেখা করলেন হেডমাস্টারের সঙ্গে। তপতীর কথা শুনে পুরো পনেরো সেকেন্ড তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, ছেলে দুটো লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, বড় হোক, এটা কি আপনি চান না?
মানুষ হোক এটা তো অবশ্যই চাই। কিন্তু লেখাপড়া শিখলেই মানুষ হবে, এধারণাটাও তো ঠিক নয়। জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখান থেকে বড় হওয়া যায়। ছবি আঁকা, গানবাজনা, অভিনয় নাচের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনই খেলার মধ্য দিয়েও তো বড় হওয়া যায়, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। এই স্কুলের সব ছেলেই কি স্টার পেয়ে পাশ করে? আমার ছেলেরাও নয় স্টার লেটার পাবে না কিন্তু অন্যদিকে তো স্টার পেতে পারে। তপতীর গলা আবেগে একটু চড়ে গেল, সেটা বুঝতে পেরেই তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন।
তা ঠিক। সবাই স্টার লেটার পায় না। হেডমাস্টার গম্ভীর মুখে সামনে ঝুঁকে বললেন। মৃন্ময়, চিন্ময় স্ট্যান্ড করে না বটে, কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টও খারাপ নয়। কিন্তু এতদিন স্কুল কামাই করে খেলে বেড়ানো, এটা আমি সমর্থন করতে পারছি না।
আমরা ঝুঁকি নিয়ে দুজনকে টেনিস প্লেয়ার তৈরি করছি, আপনিও একটু ঝুঁকি নিন না আমাদের সঙ্গে। এই স্কুলের দুটি ছেলে যদি খেলায় নাম করে তা হলে তো স্কুলেরও সুনাম হবে। তপতী আশাভরে হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল, স্কুলের সুনাম কথাটায় বোধ হয় কাজ হয়েছে। হেডমাস্টার ঠোঁট টিপে মাথা নাড়লেন, চোখ দুটো একটু বড় হল।
এক মাস স্কুলে না এলে পড়াশুনোয় পিছিয়ে পড়বে।
আমি বাড়িতে পড়িয়ে সেটা মেকআপ করে দেব…গ্যারান্টি দিচ্ছি।
বেশ, ওরা খেলুক। মিসেস বসুমল্লিক এই ফেভার কিন্তু এই একবারই; আর কিন্তু দেব না। আশা করি আপনিও আর চাইবেন না।
চাইব না।
.
মিনু চারটে টুর্নামেন্টের তিনটিতে জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হল একটা সেটও না। হারিয়ে। চিনু তিনটির দুটিতে কোয়াটার ও একটিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল। সহদেব শুধু অর্ডন্যান্স ক্লাবের টুর্নামেন্টে মিনুকে সিনিয়ার বিভাগে এন্ট্রি করিয়েছিলেন ওর যোগ্যতা ও ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য। সেমিফাইনালে উঠে সে ভারতের ডেভিস কাপার প্রেমজিত লালের সামনে পড়ে। ২-৬, ৩-৬-এ হেরে যায় মিনু। ম্যাচটা গড়িয়েছিল পঁয়ষট্টি মিনিট। প্রতিটি পয়েন্টের জন্য মিনু লড়াই করেছে আর সেটাই ভাল লেগেছে দর্শকদের, বিশেষ করে বেঙ্গল লন টেনিসের প্রেসিডেন্ট ভাস্কর মুখার্জির, তিনি অল ইণ্ডিয়া লন টেনিসেরও ট্রেজারার। মিনুকে। কাছে ডেকে বলেন, শুনলাম তুমি সহদেবের হাতে তৈরি, তা হলে তো আর কিছু বলার নেই। তবে এখন তুমি স্টেট আর ন্যাশনাল লেভেলে খেলার কথা ভাবো।
প্রেমজিতের কাছে তুমি যে হারবে এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু কীভাবে হারো সেটাই দেখার ছিল। আমি খুশি তোমার খেলা দেখে। বয়স কত?
চোদ্দোয় পড়েছি।
ভাস্কর মুখার্জির ভুরু উঠে গেল। তোমাকে তো যোলো-সতেরো ভেবেছিলাম। এই বয়সেই প্রেমজিতের কাছ থেকে পাঁচটা গেম নিয়েছ! মিনুর পিঠ চাপড়ে তিনি অন্য লোকের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হলেন। ওদের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক। তিনি ভাস্কর মুখার্জির কথা শুনেছিলেন। সাংবাদিক এক ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন বসুমল্লিক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? ওয়ান অব দ্য মোস্ট প্রমিসিং জুনিয়ারস ইন দ্য কান্ট্রি। পরদিন সাংবাদিক তাঁর রিপোর্টে দুটি বাক্য লিখলেন মিনু সম্পর্কে : বসুমল্লিকের বয়স মাত্র চোদ্দো, কিন্তু লালকে ব্যস্ত রেখে সে পাঁচটা গেম ছিনিয়ে নিয়েছে। টেনিস রসিকদের ধারণা, এই কিশোর ভারতীয় টেনিসে একদিন উজ্জ্বল তারকা হয়ে উঠবে।
পরদিন তপতী বাক্য দুটি পড়তে পড়তে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। একদিন উজ্জ্বল তারকা হয়ে উঠবে এই স্বপ্নই তো তাঁদের চালিয়ে নিয়ে এসেছে পাঁচটা বছর।
সকালে খাওয়ার টেবলে কাগজটা সকলের হাতে ঘুরল। এর আগে মিনু যে তিনটি টুর্নামেন্টে জুনিয়ার খেতাব জিতেছে তাতে শুধু সিনিয়ারদের ফল কাগজে বেরিয়েছিল। আর এবার নামের সঙ্গে দুটো কথাও। তন্ময় বললেন এর কারণ অবশ্য প্রেমজিত লালের সঙ্গে খেলেছে বলে।
তপতী প্রতিবাদ করলেন, সে তো অনেকেই খেলেছে, কই এমন ভাবে তো তাদের সম্পর্কে লেখা হয়নি।
সহদেববাবু, মিনুর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটা এখনই বলার মতো খেলা কি খেলেছে? তন্ময় সিরিয়াস স্বরে জানতে চাইলেন।
ভাস্কর মুখার্জি বহু বছর ধরে বহু প্লেয়ারকে দেখেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, কৃষ্ণন, প্রেমজিত, জয়দীপের পরের একটা ব্যাচ তৈরির জন্য এ আই এল টি এ চারজন জুনিয়ারকে ইউরোপ ট্যুরে পাঠাবে। মিনু যদি জুনিয়ার ন্যাশনালের সেমিফাইনালেও উঠতে পারে তা হলে ট্যুরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সহদেব মিনুর দিকে তাকালেন। মুখে পাতলা হাসি। মুখ নামিয়ে মিনু ভাত খেয়ে যাচ্ছে।
পারবি না মিনু? তন্ময় আশান্বিত স্বরে জানতে চেয়ে একটা ইতিবাচক উত্তরের আশায় তাকালেন।
মুখ না তুলে মিনু ভাত মুখে একটা শুধু শব্দ করল। যেটা হ্যাঁ বা না দুইই হতে পারে।
সেমিফাইনালে যেতে পারবি? তন্ময় আবার বললেন।
তন্ময়বাবু এসব কথা থাক এখন। সহদেব প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, আগে জুনিয়ার বেঙ্গলটা উতরোক। ধাপে ধাপে জিনিসগুলো হওয়া ভাল।
খাওয়া শেষ করে মিনু হাত ধোওয়ার জন্য উঠে যেতেই সহদেব বললেন, জুনিয়ার ন্যাশনাল নিয়ে একটা কথাও ওকে বলবেন না। অযথা মনের ওপর একটা প্রেশার তৈরি হবে। আপনাদের আশা যত বাড়বে, প্রেশারটাও তত বাড়বে, বাচ্চা ছেলে সেটা নিতে পারবে না।
আপনি ঠিকই বলেছেন। কথাটা বলে তপতী চাহনি দিয়ে স্বামীকে ভৎসনা জানালেন। চিনু, এসব নিয়ে কারও সঙ্গে গল্প করবে না।
খাওয়া চিনুরও শেষ হয়েছে। চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে সে বলল, খবরের কাগজটা আমি স্কুলে নিয়ে যাব, সবাইকে দেখাব। নর্থ ক্যালকাটার কাপ জেতার থেকেও স্টাফ রিপোর্টারের এই কথাগুলো দাদার মান বাড়িয়েছে।
একদম নয় চিনু। তপতী ছিলেহেঁড়া ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে উঠলেন। কাউকে কিছু দেখাতে হবে না।… এখানকার কারোর কোনও প্রশংসা আমার দরকার নেই, আমার ছেলেদেরও দরকার নেই। তপতী উত্তেজনায় কাঁপছেন। চিনু যদি তুমি এই কাগজ নিয়ে কাউকে দেখাও বা কাউকে এর উল্লেখ পর্যন্ত করো তা হলে র্যাকেট দিয়ে তোমার পিঠ ভাঙব।
তুই নয় তুমি! মার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনু বুঝে গেল র্যাকেট তার পিঠের সঙ্গে মাথাও ভেঙে দিতে পারে। সে একটি কথাও আর না বলে বেরিয়ে গেল। তপতীর হঠাৎ এমন আচরণে তন্ময় ও সহদেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে ওঁকে রেগে উঠতে তাঁরা কখনও দেখেননি।
এখানকার কয়েকটা লোক এমন সব কথা রটিয়েছে, যা শুনলে মনে হবে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গা …আমি চাই ছেলেরা জানুক পৃথিবীটা খুব ভাল জায়গা। …এরপর হয়তো শুনব কাগজের রিপোটারকে টাকা খাইয়ে লিখিয়ে নিয়েছি। এরা সব কিছুই বলতে পারে।
তপতী বেরিয়ে গেলেন গাড়ি বের করতে। সহদেব নিচু গলায় বললেন, দিদিকে কিন্তু আর রাগতে দেবেন না, তা হলে ছেলেদের ক্ষতি হবে।
আমি কি রাগিয়েছি না কি! রাগ বহুদিন জমে ছিল, আজ সেটা ফেটে বেরোল। তবে এটুকু বলতে পারি, আর কখনও রাগবে না। তন্ময় নিশ্চিত স্বরে জানালেন।
বাইরে হর্ন বাজল। মিনু চিনু স্কুলব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল।
তা হলে এবার? তন্ময় বললেন।
এবার জুনিয়ার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ানশিপ। সহদেব আড়মোড়া ভাঙলেন।
ছেলেদের পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় তপতী একটা শক্ত মলাটের সাদা এক্সারসাইজ খাতা কিনে আনলেন। বাড়ি এসে দেখলেন তন্ময় স্নান করতে কলঘরে গেছেন। খবরের কাগজ থেকে টেনিস ম্যাচের রিপোর্টের অংশটি কাঁচি দিয়ে কেটে গঁদ লাগিয়ে তিনি কাটিংটা খাতার প্রথম পাতায় সেঁটে দিলেন। আঙুল ঠেকল।
ঘুম আসছে না?
না।
কী ভাবছিস?
অনেকদিন আগে আমায় কুকুরে তাড়া করেছিল। তুই আমাকে আড়াল করে ঘুসি চালাচ্ছিলি। একটা লোক এসে কুকুরদুটোকে তাড়িয়ে দিল। তুই আমাকে পরে বললি ভয় কী রে, আমি থাকতে ভয়ের কিছু নেই। এখন আবার বলবি কথাটা।
কেন?
আমার খুব ভয় করছে। কাল তুই বোধ হয় ইচ্ছে করে হেরে যাবি।
মিনু হাত টেনে নিল! অনেকক্ষণ পরে সে বলল, কাল আমি জিতব।…এবার ঘুমো।
তপতী আর তন্ময় ইচ্ছে করেই দুই ছেলের খেলা দেখতে কলকাতায় গেলেন না। সন্ধ্যায় সহদেবের সঙ্গে তারা ফিরতেই বাবা-মা প্রথমেই দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে খেলার ফল বোেঝার চেষ্টা করলেন। দুজনের মুখেই তৃপ্তির ছোঁয়া লেগে। তাঁরা সহদেবের দিকে তাকালেন। সেখানেও সুখের আভাস।
সিক্স-থ্রি, সেভেন-ফাইভ। চিনু যে এমন খেলা খেলবে ভাবতে পারিনি। আপনারা যদি যেতেন তা হলে খেলার মতো খেলা একটা দেখতে পেতেন। কোর্টের ধারে অন্তত জনা ষাটেক লোক জমে গেছল। এত লোক এখনও কোনও ম্যাচে হয়নি। সেকেন্ড সেটটা নরেশকুমার দেখে বলল, ছোটভাইয়ের টাচ খুব ভাল, কৃষ্ণনকে মনে পড়িয়ে দেয় কিন্তু পাওয়ার আর স্পিড এই দুটোতেই ও বড় ভাইয়ের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এমন হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে এরা দুই ভাই! রীতিমতো লড়ে মিনুকে জিততে হয়েছে।
যাক, আমার দুশ্চিন্তা দূর হল, বোধ হয় আপনারও। তপতী বললেন সহদেবকে।
কোথায় দূর হল, এখন তো চিনুর স্পিড আর পাওয়ার নিয়ে আমায় ভাবতে হবে। এখানে দুজনের মধ্যে খেলায় তো এমন প্রচণ্ডভাবে ভেতরের জিনিস বেরিয়ে আসে না, যা আজকে দেখা গেল।
.
আম্পায়ারের উঁচু চেয়ারের দুপাশে দুটি চেয়ার। তার একটি মৃন্ময় বসুমল্লিকের জন্য, অপরটি অরুণ মেটার।
মিনু তার র্যাকেট কভারের চেন টেনে খুলল। সারের উপদেশ মনে পড়ল, যতক্ষণ না রেডি হচ্ছ ততক্ষণ কোর্টে নামবে না। বাঁ কজিতে সোয়েটলেটটা আর একবার ঘুরিয়ে একটু তুলল। এখন তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এসেছে। র্যাকেটটা চোখের সামনে ধরে হাতের তালুতে আঘাত করে তাঁতের বাঁধন টানটান আছে কি না অনুভব করল। বাতাসে কয়েকবার সে র্যাকেট চালিয়ে ব্যাকহ্যান্ড ও ফোরহ্যান্ড মারল।
দেয়ার উইল বি আ থ্রি-মিনিট নক আপ। আম্পায়ার জানিয়ে দিলেন দুজনকে।
মিনু প্রথম বল মারার আগে হাতের খিল ছাড়াবার জন্য র্যাকেটটা ঘোরাতে লাগল। অরুণ বেস লাইনে এগিয়ে গেছে। এর পর দুজনে র্যালি শুরু করতেই মিনুর হাতের আড়ষ্টতা কেটে যেতে লাগল। চারপাশের দর্শক, বাবা-মা, সার আর চিনুকে চোখের বাইরে রেখে ধীরে ধীরে সে তার দৃষ্টিকে গুটিয়ে আনল সাদা লাইন। কাটা ঘাসের জমির মধ্যে, যে জমিতে শুধু টেনিস বল আর অরুণ মেটাকে নিয়ে এবার সে থাকবে।
ওয়ান মোর মিনিট।
অরুণ পরপর দুটো ভলি নেটে মারল। মিনুর মনে হল ও ভাল করে হাতটা তুলতে পারছে না, বল নজর করতেও যেন ওর অসুবিধে হচ্ছে।
প্রথম সার্ভ করল অরুণ। মিনু একটা পয়েন্টও নিতে না দিয়ে ওর সার্ভিস ভেঙে নিজের সার্ভিস ধরে রেখে ২-০ গেমে এগিয়ে গেল।
পরের দুটো গেম, মিনুর সার্ভিস ভেঙে অরুণ দখল করল! ২-২-এর পর পঞ্চম গেমে শুরু হল যেন তলোয়ারের খেলা। ভোঁতা ডগার তলোয়ার নিয়ে ওলিম্পিকসে যে প্রতিযোগিতা হয়— এই বাড়িয়ে দিচ্ছে, পাঁয়তারা করছে, ঝনঝন ঠোকাঠুকি হচ্ছে, একে অপরকে বুঝে নিচ্ছে সেইভাবে যেন তারা খেলতে শুরু করল। ৩-৩, ৪-৪, ৫-৫। এর পরই খোঁচাখুঁচি আর আত্মরক্ষার ভঙ্গিটা বদলে এসে গেল আক্রমণ। এবার ভোঁতা ডগার তলোয়ারের বদলে ওদের হাতে উঠে এল তীক্ষ ডগার ধারালো ফলার বাঁকা তলোয়ার। বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে এবার তারা নিধনের জন্য মেতে উঠল।
মিনুর কপাল থেকে গাল আর নাকের দুধার দিয়ে ঘাম ঝরছে। আঙুল দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল। সে জানে অরুণের থেকে তার শরীর মজবুত, ফুসফুসের ক্ষমতাও বেশি। এখন তাকে শুধু একটা কাজই করতে হবে— কোর্টে টিকে থাকা আর অরুণকে ছুটিয়ে খাটিয়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রণার মধ্যে নিয়ে ফেলা।
প্রথম সেট মিনু জিতল ৭-৫। দ্বিতীয় সেট অরুণ পেল ৮-৬। তৃতীয় সেটে আবার শুরু হল জাঁতাকলে পেষাই। ঘাসের কোর্টে খেলার ধরন হয় সার্ভ আর ভলি, পয়েন্ট জেতা হয় খুব অল্প সময়ে। কিন্তু মিনু খেলার ধরনটা এমনই মন্থর করে দিয়েছে যেন খেলা হচ্ছে ক্লে কোর্টে। বুদ্ধিটা, বলা বাহুল্য, সহদেবের। অরুণকে তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে না দেওয়ার জন্যই এই কৌশল। কিছুদিন আগেই সৈদুলের কাছ থেকে সহদেব শুনে নিয়েছেন অরুণ সহনশীলতা বাড়াবার। জন্য দৌড়য় না। ওকে অবসন্ন করে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ মিনুকে তিনি দিয়েছেন।
এখন দুজনেই পরীক্ষায় নেমেছে শরীর আর মন কতক্ষণ কষ্ট সইতে পারবে তাই নির্ধারণের জন্য, কতক্ষণ অরুণ মনে রাখতে পারবে খেলায় সে জিততে চায়। যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিনুর আগে আগুনের ওপর থেকে সে কখন হাত সরিয়ে নিয়ে জেতার বাসনা জুড়িয়ে ফেলবে, তারই খেলা চলেছে।
অরুণ বুঝতে পেরেছে মিনুর কৌশল। মরিয়া হয়ে এবার সে চেষ্টা শুরু করল দ্রুত পয়েন্ট জেতার জন্য। র্যালি কমিয়ে একটা মার থেকেই পয়েন্ট জেতার জন্য সে শট নিতে থাকল। কোর্টের এধার-ওধার থেকে প্রায় অসম্ভব শট ছোটাছুটি করে নিল। মিনুর র্যাকেট ধরা মুঠোয় আঙুলের ছাল উঠে গেছে। জড়ানো টেপের ফাঁক দিয়ে ঘাম ঢুকে আঙুল জ্বলছে। সে মুঠো শক্ত করল।
দর্শকরা শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন টেনশনের জন্য। নিশ্বাস ধরে রেখে বেশিক্ষণ খেলা দেখা যায় না। অনেকে চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, তখন কোর্টে খেলোয়াড় দুজনও তাদের কাঁধে, তাদের মুঠোয়, পায়ের তলায় এবং হাজার হাজারবার সার্ভিস করায়, পাঁচ-ছ মাইল দৌড়োনোেয় সাহায্য করা পেশিগুলোয় সেই শ্রান্তি বোধ করছে। বোধ করেও তারা কোর্টে দাঁড়িয়ে। পরস্পরের দিকে ওত পেতে। একে অন্যকে ডাইনে বাঁয়ে ছোটাচ্ছে, পেছনে হটাচ্ছে, নেট থেকে ঠেলে দিচ্ছে, শরীরকে শাস্তি দিচ্ছে, ক্রমশ চুপসিয়ে আসছে এবং এইরকমই চলবে যতক্ষণ না কোনও একজনের পেশির ওপর থেকে তার মস্তিষ্ক কর্তৃত্ব হারায়।
অরুণের মস্তিষ্ক তার দুই পা, দুই হাত এবং দুই চোখের কাছে কাজ করার দাবি জানাতে লাগল। কিন্তু পা দুটো মন্থর হতে শুরু করেছে, হাত দুটো দুর্বল হয়ে পড়ছে আর চোখ দুটো সেকেন্ডের ভগ্নাংশের দেরিতে বল দেখছে।
মিনু এবার সংহার শুরু করে দিল। ফেরত দেওয়া অসম্ভব, এমন কিছু সার্ভ আর ভলি পরপর মেরে সে অরুণকে ব্যতিব্যস্ত করল; আর অরুণের সার্ভগুলো গুঁড়িয়ে ভলিগুলোকে ঘুসিয়ে, আঘাতের পর আঘাত হেনে গেল যতক্ষণ না ১১-৯-এ অরুণ পরাজয় মানতে বাধ্য হল।
কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে মিনু চেয়ারে বসল। কথা বলার, জল খাওয়ার, এমনকী হাসার মতো ক্ষমতাও তার নেই। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখ বসা। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। সহদেব জলের বোতল হাতে দিয়ে বললেন, এখন চুপ করে বসে থাকো।
সৈদুলের কাঁধে হাত রেখে ছাপান্ন গেম খেলা শ্রান্ত দেহটাকে টানতে টানতে প্রাক্তন রাজ্য জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ান হেঁটে চলে গেল ড্রেসিং রুমে।
তপতী আঁচল দিয়ে মিনুর মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, কষ্ট হচ্ছে?
মিনু মাথা নাড়ল। মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মা, আমি জিতেছি। তার মুখে পাতলা একটা হাসি ভেসে উঠল। মা, তুমি খুশি?
তপতী বুকে টেনে নিলেন ছেলের মুখ। চুম্বন করলেন ছেলের মাথা আর আশীর্বাদ জানালেন চোখের জল দিয়ে।
বিজয়ীর ট্রফি মিনু নিল ভাস্কর মুখার্জির হাত থেকে। ট্রফি দেওয়ার পর তিনি মৃদুস্বরে বললেন, সামনের মাসে জুনিয়ার ন্যাশনাল বাঙ্গালোরে, জিতে আসতে পারবে তো?
চেষ্টা করব।
খবরের কাগজের ফোটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বাল্ব মুহুর্মুহু ঝলসাল। বহু অপরিচিত লোক মিনুর পিঠ চাপড়ে বলে গেলেন : দারুণ খেলেছ।
দাদার ট্রফিটা বুকে জড়িয়ে ধরে চিনু তার মাকে বলল, এবার কি স্কুলে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারি?
না, কারও দেখার ইচ্ছে হলে আমাদের বাড়িতে এসে দেখে যাবে।
তন্ময় একবার বললেন, রাজেন এই সময়ই দেশের বাইরে। থাকলে খুব খুশি হত। চার মাসের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে রাজেনকে স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে পাঠিয়েছে এম জে টি এম। শুভ্রা, ব্ৰজেনবাবু ও তাঁর স্ত্রী এখন রয়েছেন বাংলোয়। কাল বাংলা, ইংরেজি সবকটা কাগজ কিনতে হবে, রাজেন এলে দেখাব। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে যোগ করলেন দুটো করে কিনতে হবে।
সরি সৈদুল। সহদেব হাত ধরে বললেন।
কনগ্রাচুলেশন্স দেবুদা। আমি কিন্তু খুশি হয়েছি মৃন্ময় জেতায়। ছেলেটা অনেক উঠবে।
খেটেছে তাই উঠেছে, আরও খাটলে নিশ্চয় উঠবে।
আমিও কোচিং করি দেবুদা, ওর খাটনির পেছনে আর একজনকেও যে খাটতে হয়েছে সেটা বুঝতে পারি। তুমি ভাগ্যবান তাই এমন ছেলে পেয়েছ, আমি কুড়ি বছরেও পেলাম না।
পরদিন বহু লোক এলেন অভিনন্দন জানাতে। কাপটা রাখা হয়েছে বসার ঘরের টেবলে। সকালেই এসেছিলেন সুভাষ আর বরুণা সেন। তাঁরা ছোট্ট একটা পোর্সেলিন টব হাতে করে আনলেন, তাতে একটা পাতাবাহার গাছ। গাছটায় কচুপাতার মতো পাতা, তাতে অজস্র সিঁদুরে টিপ। মিনুর হাতে দিয়ে সুভাষ বললেন, তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা এই গাছটার সঙ্গে বাড়বে। মিনু প্রণাম করল।
এলেন রাজেনের বাবা ব্রজেনবাবু। বগলে দাবার বোর্ড আর খুঁটির বাক্স। তপতীকে বললেন, বউমা, তুমি আমার পার্টনারকে কেড়ে নিয়ে গেছলে, তারপর থেকে আমি আর দাবা খেলি না, এগুলো মিনুকে দিয়ে যাচ্ছি। কবে সরে যাই তার ঠিক নেই। টেনিস থেকে রিটায়ার করার পর এই বোর্ড পেতে মিনু খেলবে আর আমাকে মনে করবে। মিনুকে বুকে জড়িয়ে বিশালদেহী বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, সেই ছোট্ট মিনু আজ কত বড়টি হয়ে গেছে!
চিনু ফিসফিস করে মাকে বলল, আজ কি আমরা স্কুলে যাব?
যাওয়ার সময় তো পার হয়ে গেছে, কটা বাজে দেখেছিস?
সার বলেছেন দুদিন ওয়ার্ক আউট বন্ধ থাকবে, উনি বুধবার থেকে আসবেন। আমরাও কি তা হলে বুধবার থেকে স্কুলে যাব?।
না। কালই যাবে। এই কদিন কেউ বই নিয়ে বসেনি। তপতী মনে রেখেছেন হেডমাস্টারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।
কান্তি এল শালপাতার ঠোঙা ভর্তি গুজিয়া নিয়ে। সেটা মিনুর হাতে দিয়ে বলল, খেও। একদিন দুটো মিষ্টি খেলে মা কিছু বলবে না। কান্তি তপতীর দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিতে মিনতি করল চাহনি দিয়ে।
তপতী হেসে বললেন, খাও।
অত! ওইটুকু ছেলে খাবে? তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন।
তুমি অফিস যাবে না? চান করে খেতে বোসসা, কটা বাজে দেখছ? তপতীর স্বরে কিছু একটা ছিল যেজন্য তন্ময় ঠোঙাটা মিনুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তাই তো, এখন তো ভাত খেতে হবে।
বারোটা নাগাদ হইহই করে জনা দশেক ছেলে হাজির হল। মিনুর ক্লাসের। বন্ধু। কী ব্যাপার?
মৃন্ময়, আজ স্কুলে যাসনি কেন?
আজ থার্ড পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তোর জন্য।
আনন্দ আর লজ্জায় আপ্লুত মিনু শুধু বলল, য্যাহহ!
নোটিসে কী লিখেছে জানিস? …গর্বের সঙ্গে আমরা জানাচ্ছি আমাদের স্কুলের ছাত্র—
থাক, থাক, আর বলতে হবে না। মিনু থামিয়ে দিল।
কেন বলতে হবে না? চিনু প্রতিবাদ করল। কী সব কথা শুনতে হয়েছে। ভুলে গেছিস?
বন্ধুদের প্রত্যেকে ট্রফিটা হাতে নিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ট্রফির গায়ে লেখা কথাগুলো পড়ল। সারা বাড়ি ভরে গেল খুশির কলকল উচ্ছ্বাসে। কান্তির গুজিয়াগুলোর সদ্ব্যবহার করলেন তপতী প্রত্যেকের হাতে একটা করে তুলে দিয়ে।
রাত্রে শোবার আগে ছেলেরা দুধ খায়। তপতী দুটো গ্লাস হাতে নিয়ে ছেলেদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে ভেতর থেকে আসা চাপা স্বরের কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।
না না, অনেক টাকা.. এখন বলতে হবে না।
মোটরে স্কুলে যেতে ভাল লাগে? লজ্জা করে না? দুটো সাইকেলের কত আর দাম হবে?।
যতই হোক… বাবার কষ্ট হবে, মারও।
গলাখাঁকারি দিয়ে তপতী ঘরে ঢুকলেন। অনেকেই তো উপহার দিল, আমি কিছু দেব না।
ওরা অবাক হল। মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
আমি তো ভাবছি, মিনু তো বড় হয়েছে, এবার দেখেশুনে সাইকেল চালাতে পারবে।
মা, আমিও বড় হয়েছি। চিনু তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল।
হয়েছিস নাকি! তপতী গম্ভীর হলেন। মিনু, ওর পাশে দাঁড়া তো।
মিনু দাঁড়াল চিনুর পাশে। পলকের জন্য তপতী চোখ নীচে নামালেন। চিনু গোড়ালি নামা।
ধীরে ধীরে চিনুর উচ্চতা হ্রাস পেল।
পরদিন সকালে তন্ময় গাড়ি বার করলেন, তপতীও উঠলেন।
বাবাকে স্টিয়ারিংয়ে বসতে দেখে ওরা অবাক! গম্ভীর মুখে তন্ময় বললেন, একটা জরুরি দরকার, আমাদের কলকাতায় যেতে হবে। দুই ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ওঁরা চলে গেলেন কলকাতায়। স্কুল ছুটির পর ছেলেদের গাড়ি করে আনলেন তপতী। তিনি গাড়ি গ্যারাজ করতে করতে শুনলেন দুই ভাইয়ের উল্লসিত চিৎকার। বাড়িতে ঢুকছেন যখন, ছুটে বেরিয়ে এল দুই ভাই। মিনু দুহাতে মায়ের হাঁটু জড়িয়ে মেঝে থেকে দু ফুট ওপরে তাঁকে তুলে বনবন পাক দিতে লাগল। ঘুরে ঘুরে দু হাত তুলে নাচছে চিনু।
ওরে ছাড় ছাড়, আমার পায়ে ব্যথা। ..মাথা ঘুরছে।
আমাদের ট্রফি, …মা আমাদের ট্রফি…। চিনু সুর করে গেয়ে চলেছে। হিপ হিপ হুররে… মা আমাদের ট্রফি, আমরা বড় হয়েছি …মাকে ট্রফি পেয়েছি…।
মা কখনও ট্রফি হয় নাকি! তপতী দুহাতে মাথা টিপে ধরে বড় বড় চোখ বললেন।
হয়, আমাদের মা হয়। মিনু বলল।
আমাদের কাছে তুমি আমাদের ট্রফি। চিনু যোগ করল। এর থেকে সেরা ট্রফি আর কিছু নেই।
তোরা ট্রফি পেলি, আর আমার ট্রফি তা হলে কোথায়?
দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তপতী হাসতে হাসতে বললেন, একটা নয়, আমার দুটো ট্রফি।
দুহাতে তিনি দুই ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, মিনু এরপর ভারতের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হবে তারপর হবে সিনিয়র চ্যাম্পিয়ন…..তারপর উইম্বলডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া… লোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে বলবে ওই যে মৃন্ময়ের মা।
চিন্ময়ের মা বলবে না? চিনু ভারী গলায় অভিমানী স্বরে বলল।
বলবে, দাদার পরেপরেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠে আসবে ভাই। আমরা তো এত বছর সেই স্বপ্নই দেখেছি রে। তপতীর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল।
ভেতর থেকে তখন বেলার গজগজানি শোনা গেল। খাবার ঘরে এ দুটো রাখা চলবে না, তা হলে কিন্তু চারটে চাকাই ফুটো করে দোব।