Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 7

বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

রতিকান্ত ফিরিয়া আসিলে আমরা সকলে মিলিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। হল-ঘরের মধ্যে ছায়ান্ধকার‌, মানুষ কেহ নাই। আমরা পাঁচজনে প্রবেশ করিয়া পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ম্যানেজারবাবু্‌, আপনাকে আমরা অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। আপনার নিশ্চয় অন্য কাজ আছে—‘

ম্যানেজার মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘আমার আজ কোনই কাজ নেই। আজ রবিবার‌, সেরেস্তা বন্ধ। নেহাৎ অভ্যাসবিশেই এসেছিলাম।’

বোঝা গেল। তিনি আমাদের সঙ্গ ছাড়িবেন না। তিনি গভীর মনঃসংযোগে আমাদের কথা শুনিতেছেন এবং তাহার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহার চক্ষু দু’টি মধুসঞ্চয়ী ভ্রমরের মত আমাদের মুখের উপর পরিভ্রমণ করিতেছে। কিন্তু তিনি নিজে বাক্যব্যয় করিতেছেন না। গভীর জলের মাছ।

পান্ডেজি ব্যোমকেশের পানে একটি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন‌, ‘ভাল কথা বংশীজি‌, আপনার সেরেস্তায় টাকাকড়ির হিসেব সব ঠিক আছে তো? হয়তো আমাদের পরীক্ষা করে দেখবার দরকার হতে পারে।’

বংশীজি তৎক্ষণাৎ বলিলেন‌, ‘সব হিসেব ঠিক আছে‌, আপনারা যখন ইচ্ছে দেখতে পারেন।’ তারপর একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন‌, ‘কেবল একটা হিসেবের চুক্তি হয়নি—’

‘কোন হিসেব?’

ম্যানেজার বলিলেন‌, ‘আট-দশ দিন আগে দীপনারায়ণজি আমাকে ডেকে হুকুম দিয়েছিলেন। ভাক্তার পালিতকে বারো হাজার টাকা দিতে। টাকাটা ডাক্তারবাবুকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু রসিদ নেওয়া হয়নি।’

‘রসিদ নেওয়া হয়নি কেন?’

‘ডাক্তারবাবু টাকাটা ধার হিসাবেই চেয়েছিলেন, কিন্তু দীপনারায়ণজি ঠিক করেছিলেন টাকাটা ডাক্তারবাবুকে পুরস্কার দেবেন‌, তাই রসিদ নিতে মানা করেছিলেন।’

‘ও—’ ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া নীরব রহিল‌, তারপর রতিকান্তকে বলিল‌, ‘এবার তাহলে বাড়ির সকলকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। তাঁরা কোথায়?

রতিকান্ত বলিল‌, ‘তাঁরা সবাই উপরিতলায়। শোবার ঘর সব ওপরে। আপনারা বসুন‌, আমি একে একে ওঁদের ডেকে নিয়ে আসি। কাকে আগে ডাকব-শকুন্তলা দেবীকে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শকুন্তলা দেবীকে কষ্ট দেবার দরকার নেই‌, আমরাই ওপরে যাচ্ছি। দুচারটে মামুলী কথা জিজ্ঞাসা করা বৈ তো নয়। দেবনারায়ণবাবুও বোধহয় ওপরে আছেন?’

‘হ্যাঁ। চাঁদনী দেবীও আছেন।’

‘তবে চলুন।’ পাশের একটি ছোট ঘর হইতে উপরে উঠিবার সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম।

সিঁড়ির উপরে একটি ঘর‌, তাহার দুইদিকে দুইটি দরজা। উপরতলাটি দুই ভাগে বিভক্ত। আমরা উপরে উঠিলে রতিকান্ত বলিল‌, ‘কোনদিকে যাবেন? এদিকটা দেবনারায়ণবাবুর মহল‌, ওদিকটা দীপনারায়ণবাবুর।’

ব্যোমকেশ কোনদিকে যাইবে ইতস্তত করিতেছে এমন সময় দেবনারায়ণের দিকের দ্বারা দিয়া চাঁদনী বাহির হইয়া আসিল। তাহার হাতে এক বাটি দুধ্‌্‌, কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোেখ মুখ ফুলিয়া উঠিয়াছে। আমাদের দেখিয়া সে সসঙ্কোচে দাঁড়াইয়া পড়িল‌, স্বভাব্যবশত মাথার কাপড় টানিতে গেল‌, তারপর বাড়ির সাম্প্রতিক কায়দা স্মরণ করিয়া থামিয়া গেল। আমাদের মধ্যে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীকে দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া জড়িতস্বরে বলিল‌, ‘চাচিজি আজ সারাদিন এক ফোঁটা জল মুখে দেননি.তাই যাচ্ছি। আর একবার চেষ্টা করতে যদি একটু দুধ খাওয়াতে পারি। চাচাজি তো গেছেন‌, উনিও যদি না খেয়ে প্রাণটা দেন কি হবে বলুন দেখি? বলিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

আমরা থাতমত খাইয়া গেলাম। এই একান্ত ঘরোয়া সেবার মূর্তিটিকে দেখিবার জন্য কেহই যেন প্রস্তুত ছিলাম না। গঙ্গাধর বংশী বিচলিতভাবে গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন‌, ‘যাও বেটি‌, ওঁকে আগে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা কর। কিছু না খেলে কি করে চলবে।’

চাঁদনী দুধ লইয়া চোখ মুছিতে মুছতে চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল‌, চলুন‌, দেবনারায়ণবাবুর কাছে আগে যাওয়া যাক।’

আমরা দেবনারায়ণের মহলে প্রবেশ করিলাম, ম্যানেজার আমাদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলিলেন।

ঘরের পর ঘর‌, সবগুলিই দেশী বিদেশী আসবাবে ঠাসা; কিন্তু কিছুরই তেমন ছিরি-ছাঁদ নাই‌, সবই এলোমেলো বিশৃঙ্খল। অবশেষে বাড়ির শেষ প্রান্তে একটি পদৰ্ণ ঢাকা দরজার সম্মুখীন হইলাম।

ঘরের ভিতর কে আছে তখনও দেখি নাই‌, আমাদের সমবেত পদশব্দে আকৃষ্ট হইয়া একটি লোক পদার্থ সরাইয়া উঁকি মারিল‌, তারপর চিকিতে অন্তহিঁত হইয়া গেল। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি বেশ বড়‌, তিনদিকে জানোলা। মেঝের অর্ধেক জুড়িয়া পুরু গদির উপর ফরাস পাতা‌, তাহার উপর কয়েকটা মোটা মোটা তাকিয়া। দেবনারায়ণ মাঝখানে তাকিয়া পরিবৃত হইয়া বসিয়া আছে‌, তাহার পাশে একটু পিছনে কোঁকড়া-চুল কোঁকড়া-গোঁফ বিদূষক বেণীপ্রসাদ। আমাদের দেখিয়া বেণীপ্রসাদ উঠিয়া দাঁড়াইল।

ম্যানেজার দেবনারায়ণকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন‌, ‘এঁরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ দেবনারায়ণ কোনও কথা না বলিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্যাঙের মত চাহিয়া রহিল।

ম্যানেজার আমাদের বসিতে বলিলেন। আমি ও ব্যোমকেশ বিছানার পাশে বসিলাম। আর সকলে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ব্যোমকেশ এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল‌, ‘ঘরে আর একজন ছিলেন-যিনি পদাৰ্থ ফাঁক করে উঁকি মেরেছিলেন–তিনি কোথায় গেলেন?’

বেণীপ্রসাদ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল‌, ‘তিনি-মানে লীলাধর’–ম্যানেজারের দিকে একটি ক্ষিপ্ত চিকিত চাহনি হানিয়া সে কথা শেষ করিল–’সে পাশের ঘরে গেছে।’

ব্যোমকেশ ভাল মানুষের মত জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘পাশের ঘরে কী আছে?’

বেণীপ্রসাদ বলিল‌, ‘মানে–গোসলখানা।’

ব্যোমকেশ ফিক করিয়া হাসিল‌, ‘বুঝেছি। গোসলখানার লোগাও পাকানো লোহার সিঁড়ি আছে‌, লীলাধরবাবু সেই দিক দিয়ে বাড়ি গেছেন। কেমন?

বেণীপ্রসাদ উত্তর দিল না‌, নিতম্ব চুলকাইতে চুলকাইতে ম্যানেজারের দিকে আড় চোখে চাহিতে লাগিল।

লীলাধর যে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীর পুত্র এবং দেবনারায়ণের সহকারী বিদূষক তাহা আমরা কাল রাত্রে জানিতে পারিয়াছিলাম। দেখিলাম‌, গঙ্গাধর বংশীর মুখ কালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি উদগত হৃদয়াবেগ যথাসাধ্য সংযত করিয়া বেণীপ্রসাদকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘তোমরা এখানে কি করছি?’

নিতম্ব ছাড়িয়া বেণীপ্রসাদ এক হাত তুলিয়া বগল চুলকাইতে আরম্ভ করিল‌, বলিল‌, আজ্ঞো-ছোট-মালিকের মন খারাপ হয়েছে তাই আমরা ওঁকে একটু—’

মন খারাপের উল্লেখে দেবনারায়ণের বোধহয় খুড়ার মৃত্যুর কথা মনে পড়িয়া গেল‌, সে হঠাৎ চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আকাশ-পাতাল হ্যাঁ করিয়া হাতির মত লোকটা কাঁদিতে লাগিল।

কাল দেবনারায়ণের হাসি শুনিয়াছিলাম‌, আজ কান্না শুনিলাম। আওয়াজ প্ৰায় একই রকম‌, যেন এক পাল শেয়াল ডাকিতেছে।

পাঁচ মিনিট চলিবার পর হঠাৎ কান্না আপনিই থামিয়া গেল। দেবনারায়ণ রুমালে চোখ মুছিয়া পানের ডাবা হইতে এক খামচা পান মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিল। ব্যোমকেশ এতক্ষণ নির্বিকারভাবে দেয়ালে টাঙানো রবি বামার ছবি দেখিতেছিল‌, কান্না থামিলে সহজ স্বরে বলিল‌, ‘দেবনারায়ণবাবু্‌, আপনি মদ খান?

দেবনারায়ণবাবু বলিল‌, ‘নাঃ। আমি ভাঙ‌, খাই।’

‘তবে তাকিয়ার তলায় ওটা কি? বলিয়া ব্যোমকেশ অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

বেণীপ্রসাদ ইতিমধ্যে তেরছাভাবে গোসলখানার দ্বারের দিকে যাইতেছিল‌, এখন সুট করিয়া অন্তহিঁত হইল। আমি নির্দিষ্ট তাকিয়া উল্টাইয়া দেখিলাম‌, তলায় একটি ছিপি-আটা বোতল রহিয়াছে; বোতলের মধ্যে শ্বেতবর্ণ তরল দ্রব্য।

দেবনারায়ণ বোকাটে মুখে বোতলের দিকে একবার দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল‌, ‘ও তো তাড়ি। লীলাধর আর বেণীপ্রসাদ খাচ্ছিল।’

বোতলে তাড়ি! এই প্রথম দেখিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও—আপনার মন প্রফুল্ল করবার জন্য ওঁরা তাড়ি খাচ্ছিলেন। তা সে যাক। বলুন তো‌, আপনি ভাঙা ছাড়া আর কি কি নেশা করেন?’

দেবনারায়ণ খানিকটা জব্দ মুখে দিয়া বলিল‌, ‘আর কিছু না।’

‘কোকেন?’

‘বুকনি? নাঃ।’

‘গাঁজা?

‘নাঃ। গাজাধির গাঁজা খায়।’

‘আচ্ছা‌, যেতে দিন। —আপনার বোধহয় অনেক বন্ধু আছে?’

‘বন্ধু-আছে। লাখো লাখো বন্ধু আছে।’

‘তাই নাকি? তাদের দু’চারটে নাম করুন তো।’

‘নাম? লীলাধর।–বেণীপ্রসাদ-গজাধির সিং–’

‘কোন গজাধর সিং?’

‘চৌকিদার। খুব ভাল ভাঙ খুঁটতে পারে।’

‘আর কে?’

‘আর বদ্রিলাল। রোজ আমার পা টিপে দেয়।’

দেবনারায়ণের বন্ধুরা কোন শ্রেণীর লোক তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝলাম। ডাক্তার পালিতের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব নেই?

দেবনারায়ণের বিপুল শরীর একবার ঝাঁকানি দিয়া উঠিল; সে বিহুলকণ্ঠে বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিত। ওকে আমি রাখব না‌, তাড়িয়ে দেব। চাচাকে ও খুন করেছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকাইয়া মুদিত চক্ষে বসিয়া রহিল‌, তারপর চোখ খুলিয়া বলিল‌, ‘আপনার কাকার মৃত্যুর পর আপনি ষোল আনা সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এখন কি করবেন?’

‘কি করব?—দেবনারায়ণ যেন পূর্বে একথা চিন্তাই করে নাই এমনিভাবে ইতি-উতি তাকাইতে লাগিল। আমি বিস্মিত হইয়া ভাবিলাম‌, দেবনারায়ণ কি সত্যই এতবড় গবেট?

ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল‌, বলিল‌, চলুন‌, এর কাছে আর কিছু জানবার নেই।’

দরজার দিকে ফিরিতেই দেখিলাম, চাঁদনী কখন পর্দার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার মুখে উদ্বেগ ও আশঙ্কার ব্যঞ্জনা। আমাদের দৃষ্টি তাহার উপর পাড়িতেই সে চকিতে সরিয়া গেল।

আমরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। রতিকান্ত পাণ্ডেজিকে নিম্নস্বরে প্রশ্ন করিল‌, ‘চাঁদনী দেবীকে সওয়াল করা হবে নাকি?’

পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন। ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘পরে দেখা যাবে। এখন চলুন‌, শকুন্তলা দেবীর মহলে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *