জন সব কথা মন দিয়ে শুনল
জন সব কথা মন দিয়ে শুনল। তারপর মাথা নেড়ে ম্লান হেসে বলল, “আমি যাদের সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম এরা বোধহয় তারাই।”
রতন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে, “কারা?”
জন বলল, “এরা সি-আই-এ বা কে-জি-বি নয়। এরা কোনো বিশেষ রাষ্ট্রের লোকও নয়। তবে এদের ঘাঁটি অ্যামেরিকায়। পৃথিবীর কয়েকজন কুখ্যাত ধনী ব্যক্তির এক দুষ্টচক্র। রাব্বি এদের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খেতে গিয়েছিল। তারপর একদিন সে হাপিস হয়ে যায়। এই দুষ্টচক্রের ক্ষমতা অসীম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুণ্ডা সংগঠন মাফিয়া এদের হাতের মুঠোয়। এদের এত টাকার জোর, যার বলে এরা যে-কোনো রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র অচল করে দিতে পারে, যে-কোনো পুলিশবাহিনীকে রাতারাতি কিনে নিতে পারে। হিট অ্যামপ্লিফায়ারের ফরমুলা হাতে পেলে তার আন্তজাতিক পেটেন্ট কিনে নেবে। তারপর শুরু করবে একচেটিয়া ব্যবসা। আরো একটা ভয় আছে। হিট অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রটা তো শুধু মানুষের উপকারই করবে না। তাই দিয়ে মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করাও সম্ভব।”
রতন আচমকা বলল, “কিন্তু তোমরাও তো যন্ত্রটা হাত করতে চাইছ। তোমরাই বা এটা নিয়ে কী করবে?”
জন বলে, “আমাদের কুমতলব নেই। আগেই তোমাকে বলেছি, আমি তৃতীয় বিশ্বের লোক। আমার দল গরিব দেশগুলির বন্ধু। আমরা সন্ত্রাসবাদী বটে, কিন্তু আমাদের লড়াই ধনী ও ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে। ওরা আমাদের ঘৃণা করে, মানুষ বলে মনে করে না। সেই তৃতীয় বিশ্বের একজন বৈজ্ঞানিকের এই মহামূল্যবান আবিষ্কারকে আমি বা আমরা বেহাত হতে দিতে চাই না। এই যন্ত্র একদিন তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে শক্তিশালী দেশগুলির সম্পদ ও ক্ষমতার পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আমি চেয়েছিলাম ফরমুলাটা আমাদের হাতে থাক।”
রতন উদ্বেগের সঙ্গে বলে, “কিন্তু আমার বাবার কী হবে?”
জন চিন্তিত স্বরে বলে, “যদি ওরা ইতিমধ্যে ফরমুলাটা হাতে না পেয়ে থাকে তবে তোমার বাবাকে ওরা মারবে না। কাজেই আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।”
“আমার বাবাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে জানো?”
“আন্দাজ করতে পারি। বঙ্গোপসাগরে একটা গ্রীক জাহাজ নোঙর ফেলে আছে। জাহাজটার নাম এম এস ফেবুলাস। মস্ত জাহাজ। সম্ভবত তাতে।”
“আমরা কি সেই জাহাজটার কথা পুলিশকে জানাব?”
জন বলে, “তুমি বোকা। কোনো পুলিশ বা আর কারো সাধ্য নেই কিছু করার। তাছাড়া পুলিশের এক্তিয়ারও অতদূর নয়। ধৈর্য ধরো। আমার ক্ষীণ আশা, ওরা ফরমুলাটা এখনো পায়নি। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে ওরা আবার এখানে হানা দিতে আসবে। তখন আমরা ওদের পিছু নেব।”
“ওরা কতজন?”
জন হাসল। “ওরা সংখ্যায় অনেক। তবে জাহাজের মাঝি মাল্লা সবাই মাফিয়া নয়। তারা বোধহয় জানেও না, জাহাজটার খোলের অসংখ্য কেবিনে কী কাণ্ড হচ্ছে। তবু বলি, সংখ্যায় ওরা কম নয়, দুর্বল তো নয়ই। ওদের মেলা বন্দুক পিস্তল আছে। আমাদের সম্বল তোমার আর রোলোর ঘুষির জোর। আমার কাছে একটা ছোট্ট সাব-মেশিনগান মাত্র আছে। কিন্তু ওদের অস্ত্রবলের সামনে সেটা নস্যি। কাজেই গায়ের জোরে কাজ হবে না। বুদ্ধির জোরই আসল। শোনো রতন, আমি আর রোলো আপাতত এখানেই আস্তানা নিচ্ছি। আমাদের সাদা চামড়া খুবই চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আমাদের কাছে কৃত্রিম গায়ের রং আছে। বিদেশে মেয়েরা গায়ের চামড়া ট্যান করার জন্যে এই রং মাখে। আমি আর রোলো সেই রং মেখে ইণ্ডিয়ান হওয়ার চেষ্টা করব। তুমি শুধু আমাদের দুটো পাজামা আর পাঞ্জাবি যোগাড় করে দাও।”
রতন মাথা নেড়ে ভিতরবাড়িতে গিয়ে পাজামা আর পাঞ্জাবি নিয়ে এসে যখন ফের ল্যাবরেটরিতে ঢুকল, তখন জন আর রোলো প্রায় ভারতীয় সেজে বসে আছে। দুজনেরই চোখে গগলস। পাজামা পাঞ্জাবি পরার পর দুজনেই খাঁটি ভারতীয় বনে গেল। চুলগুলিও ইতিমধ্যে কলপ লাগিয়ে কালো করে নিয়েছে।
ভোর হয়ে এসেছে। জন বলল, “রতন, ওরা আজ যে-কোনো সময়ে এসে হাজির হবে। চারদিকে লক্ষ রেখো। ওরা এলে বাধা দিও না। আমার মনে হয়, ওরা আসবে আজ গভীর রাতে। তুমি দিনের বেলা যতটা পারো, ঘুমিয়ে নাও। আমি আর রোলো বেরোচ্ছি। কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। দুপুরের মধ্যেই আমরা ফিরে আসব।”
রতন অবশ্য ঘুমোল না। ঘুমোনোর মতো মনের অবস্থা নয়। বাবার জন্য উদ্বেগ আর তীব্র উত্তেজনায় সে অস্থির। জন আর রোলো চলে যাওয়ার পর সে খুব সাবধানে সারা বাড়ি সার্চ করল। কোথাও কিছু পেল না। তবে বাবার ঘরের স্টীলের আলমারিতে সে বাবার কয়েকটা পুরনো ডায়েরি খুঁজে পেল। বেশির ভাগ ডায়েরিতেই কোনো রোজনামচা নেই, কেবল কিছু বৈজ্ঞানিক আঁক কষা আছে। তবে একটা ডায়েরিতে সে কিছু বাংলা লেখা খুঁজে পেল। এগারো বছর আগেকার এক ডিসেম্বর মাসে বাবা লিখেছেন : জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না! রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই কথাটুকুর পাশে ব্র্যাকেটে লেখা : “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে? যেখানে দেখহ ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। মিলিলে মিলিতে পারে অমূল্য রতন।”
এসব হেঁয়ালির কোনো মাথামুণ্ডু বুঝল না রতন। সে গিয়ে তার বুড়ি পিসিকে জিজ্ঞেস করল, “পিসি, বাবা কোনো জিনিস লুকোতে হলে কোথায় লুকোতে পারে বলো তো?”
পিসি ভাইয়ের জন্য কেঁদেকেটে শয্যা নিয়েছে। বলল, “কী জানি বাছা। কী লুকোবে বল্ তো?”
“দশ-বারো বছর আগে বাবা একটার ফরমুলা লুকিয়ে রেখে তারপর সে কথা ভুলে যায়।”
পিসি অনেক ভেবেচিন্তে বলে, “সে তো অনেকদিন হয়ে গেছে।”
“তুমি তো বাবার সব কিছু জানো, আর এটা মনে করতে পারছ?”
পিসি বলল, “কিছু কিছু মনে আছে। বাঞ্ছ তখন একটা ভারী ক্যামেরা দিয়ে কাগজপত্রের ছবি তুলত। রাত জেগে জেগে রোজ ঐসব করত বলে কত বকেছি। তারপর সেইসব কাগজপত্র আগুনে পুড়িয়ে দিত। ঘর নোংরা হত।”
উত্তেজিত হয়ে রতন বলে, “সেই ক্যামেরাটা কোথায়?”
“কবে বিক্রি হয়ে গেছে।”
“আর ফোটোগুলো?”
“সে তো বাঞ্ছার পাগলামি। জন্মে শুনিনি বাবা কেউ কাগজের ফোটো তোলে।”
“আর কিছু করতে দেখোনি বাবাকে?”
“তা দেখব না কেন? কোনোদিন তার গাছপালার শখ ছিল না। পাগল হওয়ার আগে হঠাৎ তার টবে গাছ করার বাই চাপল। হাঁড়িকুড়ি যা পেত, তাতেই মাটি ভরে গাছপালা লাগাত। তার জন্যেও আমার কাছে বকুনি খেয়েছে।”
“গাছ? কিসের গাছ?”
“কত রকমের। সবই আগাছা।” রতন খুব হতাশ হল। সে জানে, জনের কথামতো যদি সত্যিই মাফিয়ারা ফরমুলার সন্ধানে আসে আর যদি সেটা সহজে খুঁজে না পায় তাহলে বাড়ির কাউকে ছেড়ে দেবে না। পুলিশকে খবর দিয়ে লাভ নেই। পুলিশ আজ তাদের রক্ষা করলেও রোজ তা পারবে না। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই ফরমুলাটা খুঁজে পাওয়া দরকার।
রতন জিজ্ঞেস করে, “পিসি, সেই গাছের টবগুলো কোথায় আছে জানো?”
“সে-সব করে ফেলে দিয়েছি।”
“কোথায় ফেলেছে মনে আছে?”
“পিছনে জঙ্গুলে জমিটায়। কেন, সেগুলো দিয়ে এখন কী করবি?”
“কাজ আছে।” বলে রতন উঠে গেল।
বাড়ির পিছন দিকে অনেকটা জমি তাদের। এক সময়ে সজির বাগান ছিল। এখন অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। বুক-সমান উঁচু আগাছা। সাপখোপ সবই থাকতে পারে। রতন একটা ভোজালি দিয়ে গাছপালা সাফ করতে লাগল। প্রায় তিন-চার ঘন্টা পরিশ্রমের পর অবশেষে একদম বাগানের শেষ প্রান্তে দেওয়াল ঘেঁষে গোটা দশেক ভাঙা হাঁড়ি আর টব দেখতে পেল সে। গাছগুলো কবে মরে গেছে। শুধু একটা ক্যাকটাস আজও ধুকধুক করে বেঁচে আছে কোনোক্রমে।
“কাঁটা হেরি” কথাটা ঝট করে মনে পড়ে গেল রতনের। সে হাঁড়ি থেকে ক্যাকটাস গাছটাকে টেনে বের করে আনল। হাঁড়িটা ভেঙে গেল, আর ক্যাকটাসের সঙ্গে গোল মাটির চাপড়া উঠে এল। সেই মাটির ডেলার সঙ্গে সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের মোড়ক।
কাঁপা হাতে মোড়ক খুলে রতন দেখে, তার মধ্যে খুব ছোট্ট একটা নেগেটিভ ফিল্মের টুকরো। সযত্নে পার্চমেন্ট কাগজে মোড়া।
আর-একটা হাঁড়ি যোগাড় করে তাতে সেই প্ল্যাস্টিকের মোড়ক সমেত ক্যাকটাসটাকে লাগিয়ে ভিতরের বারান্দায় রেখে দিল রতন। খানিকটা নিশ্চিন্ত। তারপর দরদালানে ঘুষি মারা বস্তায় অনেকক্ষণ ধরে ঘুষি চালিয়ে শরীর গরম করে নিল। সব অবস্থার জন্যই নিজেকে তৈরি রাখা দরকার।
জন আর রোলো ফিরল দুপুর গড়িয়ে। তারা একটা গাড়ি সঙ্গে করে এনেছে।
জন বলল, “সম্ভবত আমাদের সমুদ্রযাত্রা করতে হবে। অবশ্য দ ডগলাসের লোকেরা এ বাড়িতে হানা দেয়। তা না হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। ধরে নিতে হবে যে, ওরা ফরমুলা পেয়ে গেছে এবং তোমার বাবাকেও মেরে ফেলেছে।”
রতন বলল, “ওরা ফরমুলা পায়নি।”
“কী করে জানলে?”
রতন কিছুই গোপন করল না। জন সব শুনে বলল, “রতন, বক্সাররা একটু নির্বোধ হয়। আমরা বলি পাঞ্চ-ড্রাঙ্ক। ঘুষি খেয়ে খেয়ে তাদের ব্রেন সূক্ষ্মতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তুমি খুবই বুদ্ধিমান।”
রতন একটু হাসল মাত্র।
সন্ধের পর জন ও রোলো আশ্রয় নিল গবেষণাগারে। রতন তার ঘরের জানালা ফাঁক করে বসে রইল। ক্রমে সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি হল। রাত্রি নিশুত হতে চলল। জানালার ফাঁক দিয়ে রতন ভেতরের বারান্দাটা দেখতে পাচ্ছিল। হাঁড়ির ক্যাকটাস গাছটাও।
থানার ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টি পড়ল। নিশুতি নিঃঝুম রাত চিরে একটা কুকুর ভুক-ভুক করে উঠল কাছেপিঠে। একটা বেড়াল ডাকল।
চেয়ে থাকতে থাকতে রতনের চোখ টনটন করছিল। হাই উঠছিল বার বার। এক সময়ে সে হয়তো ঘুমে একটু চুলেও পড়েছিল। হঠাৎ টানটান হয়ে বসে সে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিক নজর করতে লাগল। কোনো শব্দ হয়নি। অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে একটা বিপদের গন্ধ ধরা পড়েছে।
অল্প জ্যোৎস্না আছে আকাশে। তারই আবছা আলোয় সে দেখতে পেল, কালো পোশাক পরা দুই মূর্তি নিঃশব্দে উঠোনের পাঁচিলে উঠে দাঁড়াল। তারপর শব্দহীন লাফে নেমে এল ভিতরে। চকিত এবং নিঃশব্দ তাদের গতিবিধি। চোখের পলকে তারা ক্যাকটাস গাছটাকে তুলে ফেলল হাঁড়ি থেকে। কয়েক মুহূর্তে বের করে ফেলল সেই মোড়ক। আবার নিঃশব্দে দেওয়াল টপকে চলে গেল।
রতন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই তার কাঁধে হাত রাখল জন। মৃদু স্বরে বলল, “তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওরা যাবে ক্যানিং। আমি জানি। তুমি তৈরি তো?”
“হ্যাঁ।”
“চলো।” দুজন চোরের মতোই দেয়াল ডিঙিয়ে তারা পিছনের পোড়ো জমিটায় নামল। বাগানের বাইরে জনের গাড়ি দাঁড় করানো। স্টীয়ারিং হুইল ধরে রোলো বসে আছে। তারা উঠতেই গাড়ি বিদ্যুৎবেগে নিশুত রাতের ফাঁকা রাস্তা ধরে দৌড়োতে লাগল।
রতন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কী করব?”
জন বলে, “আমাদের লোকসংখ্যা মাত্র তিনজন। মুখোমুখি আমরা পারব না। তবে আমি একটা স্পীডবোটের ব্যবস্থা করেছি। জাহাজটা কোথায় আছে তারও খোঁজ নিয়েছি। আমরা জাহাজটার কাছাকাছি পৌঁছে মোটরবোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব। তারপর বেতার সংকেতে একটা এস ও এস পাঠাব ওই জাহাজে। বলব যে, আমরা বিপন্ন, আমাদের উদ্ধার করো।”
“ওরা তা করবে?”
জন মৃদু হেসে বলল, “করবে। দুটো কারণে। আমরা সন্দেহজনক লোক কিনা তা জানার জন্য। দ্বিতীয়ত, ওই জাহাজের সবাই মাফিয়া নয়।”
“কিন্তু তারপর?”
“তারপর দেখা যাবে। আগে তো জাহাজে উঠি।”
“তুমি মস্ত ঝুঁকি নিচ্ছ জন।”
“ঝুঁকি নেওয়াই আমার অভ্যাস।”
রতন আর কথা বলল না।
তারা যখন ক্যানিং পৌঁছল তখনো রাতের অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। সরু রাস্তা বেয়ে কুয়াশার মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জন আর রোলোর পিছুপিছু একটা আঘাটায় নেমে চমৎকার ছোট্ট একটা স্পীডবোটে উঠল রতন। উঠতে না উঠতেই বোট ছেড়ে দিল রোলো।
কোথায় যাচ্ছে, রতন জানে না। কিন্তু জন বা রোলোর কোনো ভাবান্তর নেই। রোলো বোট চালাচ্ছে আর জন একটা ম্যাপ আর কম্পাস নিয়ে বসে আছে। কারো মুখে কথা নেই।
ভোর-ভোর একটা আভা যখন আকাশে ফুটে উঠেছে, তখন জন একটা অদ্ভুত ধরনের দূরবিন তুলে চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল। কী দেখল সে-ই জানে। মৃদু স্বরে বলল, “স্পীড কমাও, এস ও এস পাঠাতে থাকো।”
রতন তার চারধারে সমুদ্রের বিপুল কালো জলরাশি দেখতে থাকে। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে ফিরে যাওয়ার আশা তাদের খুবই কম। তবু এখন এখন নিজের চেয়ে তার বাবার কথাই বেশি ভাবছে রতন। ভাবছে বুড়ি পিসিটার কথাও। সে আর তার বাবা যদি এদের হাতে খুন হয়, তবে পিসিকে দেখার কেউ থাকবে না।
জন হঠাৎ দূরবিনটা রতনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “দ্যাখো, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।”
রতন দূরবিনটা চোখে লাগাল। আশ্চর্য দূরবিন। কুয়াশা এবং অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত তা দিয়ে দেখা যায়। সে দক্ষিণ দিকে অনেকটা দূরে প্রকাণ্ড কালো জাহাজটাকে দেখতে পেল। রতন জিজ্ঞেস করে, “এটা কী রকম দূরবিন জন?”
“ইনফ্রা রেড দূরবিন। শোনো, একটু বাদেই আমাদের এস ও এস জাহাজে পৌঁছবে। সম্ভবত ওরা জল থেকে তুলে নেবে আমাদের। তারপরই শুরু হবে খেল। মাথা ঠাণ্ডা রেখো। বন্দুক পিস্তল দেখে ঘাবড়ে যেও না। আমার কাছে যে সাব-মেশিনগান আছে তা সঙ্গে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ ওরা আমাদের জাহাজে তুলেই সম্ভবত সার্চ করবে। সাব-মেশিনগান সঙ্গে থাকলে ওরা সঙ্গে-সঙ্গেই আমাদের জলে ফেলে দেবে। সুতরাং নিরীহ ভাল মানুষের মতো নিরস্ত্র অবস্থায় আমরা শত্ৰুপুরীতে ঢুকছি। অস্ত্রের বিরুদ্ধে, সংঘবদ্ধ হিংস্রতার বিরুদ্ধে আমাদের একমাত্র সম্বল বুদ্ধি আর ঠাণ্ডা মাথা। মনে রেখো।”
ইঞ্জিন বন্ধ করে ধীরে-ধীরে ঢেউয়ে দোল খেয়ে-খেয়ে স্পীডবোট জাহাজের দিকে এগোতে লাগল। যত এগোয়, তো বুক দুরদুর করে রতনের। অস্থির বোধ করে সে। কিন্তু জন আর রোলোর ভাবান্তর নেই। আজ পর্যন্ত রোলোকে একটিও কথা বলতে শোনেনি রতন। অথচ ওকে বোবা বলেও মনে হয় না।
জাহাজটা যে কত বড়, কাছাকাছি এসে তার খানিকটা আন্দাজ পেল রতন। একটা মস্ত দুর্গও তার মধ্যে এঁটে যায়। এম এস ফেবুলাস সত্যিই ফেবুলাস।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল, ওপরের ডেকে কয়েকজন লোক সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই ওপর থেকে একটা দড়ির মই নেমে এল। রোলো স্পীডবোটের ছাদে উঠে মইটাকে ধরল, তারপর প্রথমে জন আর পিছনে রতন আস্তে-আস্তে মই বেয়ে উঠতে লাগল। তার পিছনে রোলো। সমুদ্রে হাওয়া নেই, তবু মইটা দোল খাচ্ছে। আর কত ওপরে যে উঠে যাচ্ছে তারা! দশতলা বাড়ির চেয়েও উঁচু বুঝি জাহাজটা!
ডেকের কাছাকাছি পৌঁছতেই শক্ত বলবান কয়েকটা হাত তাদের টেনে তুলে নিল ওপরে।
জন হাঁফাচ্ছিল। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে অভ্যাস আছে বলে রতন বা রোলোর হাঁফ ধরেনি। কিন্তু গায়ে মোটা পুলওভার থাকা সত্ত্বেও শীতে কাঁপছিল রতন। জন এবং রোলো শীতের দেশের লোক। পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর দুজনেরই জহর কোট মাত্র পরা। তবু তাদের শীত লাগছিল না।
ডেকের ওপর কর্কশ এবং শক্তসমর্থ চেহারার কয়েকজন নাবিক দাঁড়িয়ে আছে। সকলেই বিদেশী। তাদের মধ্যে একটু লম্বাচওড়া চেহারার একজন বোধহয় একটু উচ্চপদস্থ। সে জন-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের বিপদটা কী ধরনের?”
জন বলল, “আমাদের মোটরবোটের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। সারানোর যন্ত্রপাতি সঙ্গে নেই। আমরা সাহায্য চাই।”
মোড়ল গোছের লোকটা বিরক্তির সঙ্গে বলল, “তুমি যা বলছ তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টুল বক্স ছাড়া কোনো বোকাও সমুদ্রে বেরোয় না।”
“আমরা ভুলে টুল বক্স ফেলে এসেছি।”
লোকটা তেমনই তিক্ত স্বরে বলে, “ঠিক আছে, আমাদের একজন মেকানিক গিয়ে তোমাদের যন্ত্র পরীক্ষা করবে। তোমরা ভিতরে যাও। যদি কোনো চালাকি করতে এসে থাকো, তাহলে মুশকিল হবে।”
জন দৃঢ়স্বরে বলে, “আমাদের কোনো খারাপ মতলব নেই।”
“দেখা যাবে। এখন হাত তুলে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের সার্চ করব।”
জন বিস্ময়ের ভান করে বলে, “সার্চ করবে? কেন, আমরা কি ডাকাত?”
“কে জানে! আমরা ঝুঁকি নিতে চাই না। হাত তোলো।”
অগত্যা তিনজনই হাত তোলে। তিনটে লোক তাদের সার্চ করে। কিছুই পাওয়া যায় না অবশ্য।
মোড়ল লোকটা ভ্রু কুঁচকে দেখছিল। সার্চ হয়ে গেলে অবহেলার গলায় বলে, “এদের সিক বে-তে নিয়ে যাও। ফরোয়ার্ড ডেকে।”
জন চারেক হোঁতকা নাবিক তাদের প্রায় ঘিরে ধরে নিয়ে চলল। অনেকটা পথ। লোহার সিঁড়ি দিয়ে দুইতলা নামতে হল। একতলা ফের উঠতে হল। অনেক গলিঘুজি পেরোতে হল। অবশেষে তারা পৌঁছল জাহাজের সামনের দিকে খোলের মধ্যে একটা জনহীন জায়গায়। একজন সাদা পোশাক পরা লোক ৭৬
এসে চাবি দিয়ে একটা দরজা খুলল। তিনজন ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার।
রতন দেখে, তারা লম্বাটে একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো লোহার খাট সার বাঁধা। সেগুলোর পায়া মেঝের কাঠের তক্তায় নাট বল্ট দিয়ে আঁটা, যাতে জাহাজের দুলুনিতে সরে
যেতে পারে। ঘরটার মধ্যে বীজাণুনাশকের গন্ধ, যেমন গন্ধ হাসপাতালে পাওয়া যায়। দেয়ালে সারি-সারি কাবার্ড।
জন একটা খাটে বসে হাঁফ ছেড়ে বলে, “ও গড।” রতন এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি। কিন্তু জন ও রোলোর মুখে নিরুদ্বেগ ভাব দেখে সে বুঝতে পারে, এরকম বিপদ ওদের নিত্যকার সাথী। সে বলল, “এখন আমরা কী করব?”
জন মাথা নেড়ে বলে, “কিছু নয়। নৌকো সার্চ করে ওরা ফিরে আসুক। তারপর যা করার ওরাই করবে।”
“কী করবে?”
জন এ কথার জবাবে মৃদু হাসল শুধু। তারপর বলল, “ভয় নেই, সার্চ করে ওরা কিছুই পাবে না। আমাদের ইঞ্জিনও যথার্থই খারাপ। রোলো ইঞ্জিন খারাপ করার ওস্তাদ। সুতরাং এক্ষুনি আমাদের বিপদ নেই।”
তিনজন চুপচাপ বসে রইল।
অন্তত ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ পাওয়া গেল। ভিতরে এসে দাঁড়াল লম্বা-চওড়া লোকটা। সঙ্গে বিশাল আকৃতির এক দানব। দানবটা বিদেশী নয়। সম্ভবত ভারতীয়। তার চোখমুখ অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং খুনের মতো শীতল।
মোড়ল লোকটা বলল, “তোমাদের ইঞ্জিনের স্পার্ক প্লাগ খারাপ। কিন্তু আমাদের কাছে ওই মাপের প্লাগ নেই। দুঃখিত।”
বলে তাদের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইল লোকটা। তারপর মৃদু হেসে জনকে বলল, “তোমাদের দুজনের চোখের গগলসটা একটু রহস্যজনক। তোমাদের কি কনজাংটিভাইটিস হয়েছে?”
“হ্যাঁ।” জন বলল।
“রোগটা ছোঁয়াচে। আরো ছোঁয়াচে হল সন্দেহবাতিক।”
জন একটু ফুঁসে উঠে বলে, “তার মানে?”
লোকটা মৃদু হাসিমুখেই বলে, “আমার এই বন্ধুটি ভারতীয়। সে জানতে চাইছে তোমরা ভারতের কোন্ অঞ্চলের লোক।”
রতন এই সময়ে এক পা এগিয়ে গিয়ে বলে, “আমরা বাঙালি।”
“তোমার গগলস পরা বন্ধুরাও বাঙালি?”
একটু দ্বিধার গলায় রতন বলে, “হ্যাঁ।”
“আমার এই বন্ধু বাংলা জানে। তোমার বন্ধুদের একটু বাংলায় কথা বলতে বলল।”
জন চুপ করে বসে রইল। রতনও কী করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। সন্দেহ যখন করেছে তখন শেষ দেখে ছাড়বে।
ঠিক এই সময়ে রোলো আস্তে উঠে দাঁড়াল। চোখের রোদচশমাটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে দুটো হাত ঘষাঘষি করে নিল একটু। তারপর রতনের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে একটা চোখ সামান্য ছোট করল। ইঙ্গিতটা বুঝে নিল রতন। আর দেরি নয়। অ্যাকশন।
রতন ব্যাঙের মতো একটা লাফ দিয়ে দরজার কাছে পৌঁছেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে রোলোর বাঁ হাতের একটা ঘুষি গিয়ে পড়ল মোড়লের চোয়ালে।
এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে, প্রতিপক্ষ কিছু ঠাহর করার সময় পেল না। কিন্তু তারাও পেশাদার বখাটে। বিপদ-আপদ তাদেরও নিত্যসঙ্গী। ঘুষি খেয়ে মোড়ল লোকটা ছিটকে পড়লেও দানবটা তড়িৎগতিতে পিছু হটে গেল। তারপর আচমকা লম্বা একটা ঠ্যাং বাড়িয়ে রোলোর পেটে দুর্দান্ত একটা লাথি ঝাড়ল সে। লাথিটা পুরোপুরি এড়াতে পারেনি রোলো। কোঁক’ শব্দ করে সে উবু হয়ে বসে পড়ল মেঝেয়। দানবটা এক থাবায় জনকে ধরে দাঁড় করাল। তারপর ডান হাতে এত জোরে একটা ক্যারাটে চপ মারল যে, জনের কাঁধের হাঁড় হাতে ভেঙে যাওয়ার কথা। সেই মার খেয়ে জন চোখ উল্টে পড়ে গেল বিছানার ওপর। দানবটা এবার ঘুরে দাঁড়াল রতনের দিকে।
এতক্ষণ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া রতন আর কিছুই করেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তাছাড়া এই দানবের সঙ্গে লড়ার জন্য অনেক ক্ষমতা থাকা দরকার। এ শুধু প্রচণ্ড শক্তিমানই নয়, ভাল ক্যারাটে জানে। নিশ্চিত একজন ব্ল্যাক বেল্ট।
দানবটার চোখে চোখ রেখে রতন লোকটাকে মেপে নিচ্ছিল। অন্তত ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা। মেদহীন পেটানো শরীর। অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং বিপজ্জনক।
রতনের অবশ্য তাতে ভয় নেই। সে অনেক লড়াই করেছে। তার ওপর বাবার জন্য উদ্বেগে সে এখন মরিয়া।
দানবটাও তাকে মেপে নিল একটু। তারপর লম্বা ডান হাতটা বাড়িয়ে তার গলাটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। রতন প্রস্তুত ছিল। চট করে সরে গেল বাঁ দিকে। তারপর শরীরের ভারসাম্য রেখে বাঁ হাতে একটা বিষ মেশানো পাঞ্চ চালাল দানবের মুখে। ঘুষিটা ৮০
সোজা গিয়ে চোয়ালে বোমার মতো ফাটল।
অন্য কেউ হলে এক ঘুষিতেই জমি ধরে নিত। কিন্তু দানবটা যেন কংক্রিটে তৈরি। একটু টলল বটে, কিন্তু নড়ল না। ফিরে লম্বা বাঁ হাতে সেও একটা কামানের গোলার মতো ঘুষি চালাল রতনের মাথায়।
মাথাটা নামিয়ে নেয় রতন। তারপর নিচু হয়েই পর পর তিনটে ঘুষি পিস্টনের মতো চালিয়ে দেয় লোকটার মাথায়, নাকে আর থুতনিতে। তিনটেই মারাত্মক ঘুষি। গড়পড়তা যে-কোনো ভাল মুষ্টিযোদ্ধারও সহ্য করার কথা নয়। কিন্তু দানবটা তিনটে ঘুষিই হজম করল।
রতন বুঝল, দানবটা ক্যারাটে জানলেও বক্সিং খুব ভাল জানে। জানলে এই তিনটে ঘুষি খেত না বোকার মতো। তবে ঘুষি খেয়েও লোকটা দমেনি। একটু সতর্ক হয়েছে মাত্র। আগের মতো এগিয়ে এল না। দুটো মুগুরের মতো হাত মুঠো পাকিয়ে রতনের দিকে চোখ রেখে ঘুরতে লাগল।
রতন বুঝল, লোকটা সতর্ক হয়েছে। সুযোগ খুঁজছে। সেই সুযোগ ওকে দেওয়াটা বোকামি হবে। লোকটার একটা ঘুষিও যদি ঠিকমতো লাগে, তবে রতন সম্ভবত দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।
রতন আস্তে করে এগিয়ে যায়। আত্মরক্ষার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় হল আক্রমণ। প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত নাজেহাল করে না। তুললে লড়াই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুধু ভয়, এই লোকটা তো বক্সিংয়ের নিয়ম মেনে লড়বে না। দরকার হলে ক্যারাটের সাহায্য নেবে, পা চালাবে। তবু রতন সাপের মতো এগিয়ে গেল। পিছু হটতে গিয়ে দানবটা তার সঙ্গীর অচেতন দেহে পা ঠেকে টাল খেল। আর সেই মুহূর্তে রতন দু দুটো নক-আউট পাঞ্চ করল লোটার বাঁ চোখে আর ডান কানের একটু ওপরে।
দানবটা পড়ে গিয়েই স্প্রিং-এর পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল। তারপরই বিদ্যুৎ-বেগে ডান পা তুলে চালিয়ে দিল রতনের পেটে।
কিন্তু রতন তৈরিই ছিল। রোলোকে লাথি খেতে সে দেখেছে। কুঁজো হয়ে সে পেট সরিয়ে নিল। কিন্তু দু হাতে শক্ত ক্যাচ লোফার মতো চেপে ধরল দানবটার পায়ের গোড়ালি। জুডো খানিকটা সেও জানে। গোড়ালিটা চেপে ধরেই সে শরীর বাঁকিয়ে ঘুরে গেল উল্টো দিকে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে দানবটাকে খানিকটা শুন্যে তুলে আছড়ে ফেলল মেঝেয়। স্তম্ভিত দানবটা তখনো চেতনা হারায়নি। পড়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে মাত্র। রতন বক্সিংয়ের নিয়ম ভেঙে নিচু হয়ে দানবটার মুখে পরপর দুটো ঘুষি মারল। ভারতের জাতীয় চ্যামপিয়নের এতগুলো একতরফা ঘুষি স্বয়ং মহম্মদ আলিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দিত না নিশ্চয়ই। দানবটা তো মহম্মদ আলির একশো ভাগের এক ভাগও নয়। শেষ দুটো ঘুষিতে তার চেতনা লুপ্ত হল। হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রইল মেঝেয়। শান্ত, ঘুমন্ত।
“শাবাশ!” রতন একটু চমকে চেয়ে দেখে, জন উঠে বসে চেয়ে আছে তার দিকে। মুখে মৃদু হাসি। চোখে চোখ পড়তেই বলল, “শাবাশ!”
রোলোও আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছে। বোঝা গেল তার আঘাত গুরুতর নয়। কিন্তু জন! দানবটার ক্যারাটে চপ ওর কলারবোন ভেঙে দেয়নি তো?
জন মাথা নেড়ে বলল, “ভাঙেনি। তবে চোট মারাত্মক। আমি বাঁ হাত নাড়তে পারছি না। ঘাড়টাও স্টিফ লাগছে।”
“তাহলে?” রতন অসহায় ভাবে প্রশ্ন করে।
জন মৃদু ক্লিষ্ট হাসি হেসে বলে, “কিন্তু আমি অনেক মার খেয়েও শেষ পর্যন্ত যা করার তা ঠিকই করি। চলো, এখনো আসল কাজ বাকি। দরজার বাইরে বোধহয় একজন লোক পাহারা দিচ্ছে। তার ভার রোলোর ওপর ছেড়ে দাও। রোলো, তুমি আগে দরজা খুলে বেরোও।”
রোলো চকিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা এক ঝটকায় খুলে ফেলল। তারপর বাইরে থেকে একটিমাত্র ঘুষির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর একটি পতনশীল দেহের পাটাতনে আছড়ে পড়ার শব্দ।
জন ততক্ষণে মোড়ল আর দানবকে সার্চ করে একটা রিভলভার পেয়ে গেছে। সেটা পকেটে পুরে বলল, “চলো। এই জাহাজের প্ল্যান আমার মুখস্থ। ইন ফ্যাক্ট গ্রীসের যে ডকে এই জাহাজ তৈরি হচ্ছিল, আমি সেই ডক-এ কাজ করতাম। ফেবুলাস আমার চোখের সামনে জন্মায়।”
“তুমি ডকে কাজ করতে?”
“আমি সব রকম কাজ করেছি; বেঁচে থাকতে এবং বাঁচিয়ে রাখতে যত রকম কাজ সম্ভব, সবই করেছি। চলো রতন। আর সময় নেই।”
“চলো।” রতন দাঁতে দাঁত চেপে বলে।