Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পেনেটিতে || Lila Majumdar

পেনেটিতে || Lila Majumdar

পেনেটিতে, একেবারে গঙ্গার ধারে, আমার বড়ো মামা একটা বাড়ি কিনে বসলেন। শুনলাম বাড়িটাতে নাকি ভূতের উপদ্রব তাই কেউ সেখানে থাকতে চায় না। সেইজন্য বড়ো মামা ওটাকে খুব সস্তাতেই পেয়েছিলেন।

যাই হোক, বিয়ে-টিয়ে করেননি, আপত্তি করবার লোকও ছিল না। মেজো মাসিমা একবার বলেছিলেন বটে, নাই-বা কিনলে দাদা, কিছু নিশ্চয়ই আছে, নইলে কেউ থাকে না কেন?

বড়ো মামা রেগেমেগে বাড়ির কাগজপত্র সই করবার আগে ওঁদের কুস্তির আড্ডার দু-জন যাকে নিয়ে সেখানে দিব্য আরামে দু-রাত কাটিয়ে এলেন। যাদের অবিশ্যি সবকথা ভেঙে বলা হয়নি। তারা দু-বেলা মুরগি খাবার লোভে মহাখুশি হয়েই থাকতে রাজি হয়েছিল। পরে আড্ডায় ফিরে এসে যখন বড়ো মামা ব্যাপারটা খুলে বলেছিলেন তখন তারা বেজায় চটে গিয়েছিল। যদি কিছু হত দাদা? গায়ের জোর দিয়ে তো ওনাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যেত না!

দু-মাস পরে বড়ো মামা সেখানে রেগুলার বসবাস শুরু করে দিলেন। সঙ্গে গেল বন্ধু ঠাকুর, তার রান্না যে একবার খেয়েছে সে জীবনে ভোলনি; আর গেল নটবর বেয়ারা, তার চুয়াল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, রোজ সকালে-বিকেলে আধ ঘণ্টা করে দুটো আধমনি মুগুর ভাজে। আর ঝগড়ু জমাদার, সে চার-পাঁচ বার জেল খেটে এসেছে গুন্ডামি-টুন্ডামির জন্য। এরা কেউ, শুধু ভূত কেন, ভগবানেও বিশ্বাস করে না।

আমরা বরানগরে ছিলাম, আমি ক্লাস নাইনে পড়ছি। এমন সময় বাবা পাটনা বদলি হয়ে গেলেন আর আমার স্কুল নিয়েই হল মুশকিল। বড়ো মামা তাই শুনে বললেন, কুছ পরোয়া নেই, আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, এমন কিছু দূরও পড়বে না। ব্যাটা বন্ধুর রান্না খাবে আর আমিও আমার নতুন কবিতাগুলো শোনাবার লোক পাব, বন্ধুরা তো আজকাল আর শুনতে চায় না। ভালোই হল।

শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল। মা-রা যেদিন সকালে পাটনা চলে গেলেন, আমার জিনিসপত্র বড়ো মামার ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল, আর আমিও সারাদিন স্কুল করে বিকেলে গিয়ে সেখানে হাজির হলাম।

মনটা তেমন ভালো ছিল না, মা-রাও চলে গেছেন আবার আমাদের ক্লাসের জগু আর ভুটে বলে দুই কাপ্তেন কিছুদিন থেকে এমনি বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল যে, স্কুলে টেকা দায় হয়ে উঠছিল। আগে ওরাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, কিন্তু পুজোর ছুটির সময় সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ওরা এমন প-এ আকার ছোটোলোকের মতো ব্যবহার আরম্ভ করেছিল যে, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন ওরাই হলেন ফুটবলের ক্যাপ্টেন, ক্লাবের সেক্রেটারি। সে দিনও ওদের সঙ্গে বেশ একটা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে; সে আবার অঙ্ক ক্লাসে। আমার একার দোষ নয়, কিন্তু ধরা পড়ে বকুনি খেলাম আমিই। ওরা দেখলাম খাতার আড়ালে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসছে।

বাড়ি এসেও মনটা একটু খারাপই ছিল। একেবারে জলের মধ্যে থেকে ঘাটের সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দা পর্যন্ত। বিশাল বিশাল ঘর, ঝগড়ু আর নটবর তকতকে করে রেখেছে। প্রায় সবগুলোই খালি, শুধু নীচের তলায় বসবার ও খাবার ঘরে আর দোতলায় দুটো শোবার ঘরে বড়ো মামা কয়েকটা দরকারি আসবাব কিনে সাজিয়েছেন।

কেউ কোথাও নেই। বড়ো মামাও কোথায় বেরিয়ে গেছেন। নীচে থেকে বন্ধুর রান্না লুচি-আলুরদম খেয়ে উপরে গেলাম। বই রেখে, আমার ঘরের সামনের চওড়া বারান্দা থেকে দেখি বাগানময় ঝোপঝাপ; আম গাছ, কাঁঠাল গাছও গোটাকতক আছে। গঙ্গার ধার দিয়ে জবা ফুলের গাছ দিয়ে আড়াল করা একটা সরু রাস্তা একেবারে নদীর কিনারা ঘেঁষে চলে গেছে। সেখানে তিনজন মাঝি গোছের লোক মাছ ধরার ছিপ সারাচ্ছে। একজন বুড়ো আর দু-জন আমার চেয়ে একটু বড়ো হবে। ওখানকারই লোক বোধ হয়। আমাকে দেখতে পেয়ে তারা নিজের থেকেই ডাকল। দেখতে দেখতে বেশ ভাব জমে গেল। ওরা বললে, পিছন দিকের পুকুরে আমাকে মাছ ধরা শেখাবে, শনিবার নদীতে জাল ফেলবে, নিশ্চয় নিশ্চয় যেন আসি। বুড়োর নাম শিবু, ছেলে দুটো ওর ভাইপো, সিজি আর গুজি।

বেশ লোকগুলো। বাড়ির মধ্যে আসত-টাসত না, চাকরবাকরদের এড়িয়ে চলত, কিন্তু আমার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম হয়ে গেল। আমাকে সাপ কামড়ানোর ওষুধ, বিছুটি লাগার ওষুধ এইসব শিখিয়ে দিল। আমাদের বাগানেই পাওয়া যায়।

মামা মাঝে মাঝে খুব রাত করে বাড়ি ফিরত। আর দোতলায় একা একা আমি তো ভয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতাম। শিবুদের কাছে সেকথা জানাতেই, যে দিনই মামা বেরোতেন, সে দিনই ওরা জলের পাইপ বেয়ে উপরে উঠে, বারান্দায় বসে আমার সঙ্গে কত যে গল্প করত তার ঠিক নেই। সব মাঝিদের গল্প, ঝড়ের কথা, নৌকাডুবির কথা, কুমির আসার কথা, হাঙর মারার কথা, সমুদ্রের কথা।

ওদিকে স্কুলের ঝগড়া বাড়তে বাড়তে এমন হল যে, ওই জগু, ভুটে, আর নেলে বলে ওদের যে এক শাকরেদ জুটেছে, এই তিন জনকে অন্তত আচ্ছা করে শিক্ষা না দিলে চলে না। শিবু বললে, বাবু, এইখানে ডেকে এনে সবাই মিলে কষে পিটুনি লাগাই।

বললাম, না রে, শেষটা ইস্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দেবে। তার চেয়ে এখানে এনে এমনি ভূতের ভয় দেখাই যে, বাছাধনদের চুল-দাড়ি সব খাড়া হয়ে উঠবে।তাই শুনে ওরা তিন জনেই হেসেই লুটোপুটি।

আমি বললাম, দেখ, তোদের তিন জনকে কিন্তু ভূত সাজতে হবে আর আমি ওদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আনব। তোদের সব সাজিয়ে-গুজিয়ে দেব।

আঁ! সেজিয়ে-গুজিয়ে দেবেন কেনে বাবু? রংটং মেখিয়ে দেবার দরকার হবে না। তিনটে চাদর দেবেন। আমরা সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে, গঙ্গার ধারে ঝোঁপের মধ্যে এমনি এমনি করে হাত লাড়তে থাকব আর ওঁ ওঁ শব্দ করব, দেখবেন ওনাদের পিলে চমকে যাবে। ছেঁড়া চাদর ধুতি যা পেলাম তিনটে দিয়ে দিলাম। সত্যি ওদের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না! ভালোই হবে, তাহলে আমাকে কেউ সন্দেহও করবে না, বাড়িটার একটা অপবাদ তো আছেই।

শুক্রবার ইস্কুলে গিয়ে জগু ভুটেদের সঙ্গে কথা বন্ধ করলাম। বাবা! ওদের রাগ দেখে কে! কী রে, হতভাগা, ভারি লাট সায়েব হয়েছিস যে? কথা বলছিস না যে বড়ো?

বললাম, মেয়েদের সঙ্গে আমি বড়ো-একটা কথা বলি না। ব্যাচেলর মামার শিক্ষা।তারা তো রেগে কাই, মেয়েদের সঙ্গে মানে? মেয়েদের আবার কোথায় দেখলি?

বললাম, যারা ভূতের ভয়ে আমাদের বাড়ি যায় না, তাদের সঙ্গে মেয়েদের আবার কী তফাত?

জগু রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, যা মুখে আসবে, খবরদার বলবি না, গুপে।

এক-শো বার বলব, তোমরা ভীতু, কাপুরুষ, মেয়েমানুষ। জগু আমাকে মারে আর কী! শুধু অঙ্কের মাস্টারমশাই এসে পড়লেন বলে বেঁচে গেলাম।

স্কুল ছুটির সময় ভুটে পিছন থেকে এসে আমার কানে কানে বললে, সন্ধ্যে বেলা সাতটার সময় তোমাদের বাড়ির বাগানে আধ ঘণ্টা ধরে আমরা বেড়াব। দেখি তোমাদের ভূতের দৌড় কতখানি!, আমাদের চিনতে এখনও তোমার ঢের বাকি আছে।

আমি তো তাই চাই; শিবুরা আজকের কথাই বলে রেখেছিল।

বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরলাম, ওদের দেখতে পেলাম না। একটু একটু নার্ভাস লাগছিল, যদি ভুলে যায়। নদীর ধারে একটা ঝোঁপের পিছন থেকে গুজি ডেকে বলল, বাবু, সব ঠিক আছে আমাদের। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই জগু, ভুটে, নেলো তিন কাপ্তেন এসে হাজির।

বড়ো মামা বেরোচ্ছিলেন, ওদের দেখে আমাকে বললেন, বন্ধুদের কেষ্টনগরের মিষ্টিটিষ্টি দি, সব একা একা খেয়ে ফেলিস না যেন। কথাটা যেন না বললেই হত না। ওরা তো হেসেই গড়াগড়ি, যেন ভারি রসিকতা হল।

বড়ো মামা গেলে, খাওয়া-দাওয়া সেরে বাগানে গেলাম। এক্ষুনি বাছারা টের পাবেন! চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটু একটু চাঁদের আলোতে সব যেন কীরকম ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, আমারই গা ছমছ করছে। গল্প করতে করতে ওদের গঙ্গার ধারের সেই সরু রাস্তাটাতে নিয়ে এলাম। বাড়ি থেকে এ জায়গাটা আড়াল করা। পথের বাঁক ঘুরতেই, আমার সুষ্ঠু গায়ে কাঁটা দিল– ঝোঁপের পাশে তিনটে সাদা মূর্তি! মাথা মুখ হাত সব ঢাকা, আবার হাত তুলে তুলে যেন ডাকছে আর অদ্ভুত একটা ওঁ ওঁ শব্দ! একটু একটু হাসিও পাচ্ছিল।

জগুরা এক মিনিটের জন্য ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, তবে রে হতভাগা! চালাকি করবার জায়গা পাসনি! বলে ছুটে গিয়ে চাদরসুদ্ধ মূর্তিগুলোকে জাপটে ধরল।

তার পরের কথা আমি নিজের চোখে দেখেও যখন বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমরা আর কী করে করবে? ছোঁবামাত্র মূর্তিগুলো যেন ঝুরঝুর করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, শুধু চাদর তিনটে মাটিতে পড়ে গেল।

জগু, ভুটে, নেলোও তক্ষুনি মূর্ছা গেল।

আমি পাগলের মতো, ও শিবু, ও সিজি, ও গুজি করে ছুটে বেড়াতে লাগলাম। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল আর গোলযোগ শুনে বন্ধু, নটবর আর ঝগড়ু হল্লা করতে করতে এসে হাজির হল। ওরা জগুদের তুলে, ঘরে নিয়ে গিয়ে, চোখে মুখে জল দিল। আমার গায়ে মাথায়ও মিছিমিছি এক বালতি জল ঢালল।

মামাকেও পাড়া থেকে ডেকে আনা হল। এসেই আমাকে কী বকুনি!

বল লক্ষ্মীছাড়া, চাদর নিয়ে গিয়েছিলি কেন?

যত বলি শিবু-সিজি-গুজির কথা, কেউ বিশ্বাস করে না।

তারা আবার কে? এতদিন আছি, কেউ তাদের কোনদিনও দেখেনি শোনেনি; এ আবার কী কথা? আন তাহলে তাদের খুঁজে। কিন্তু তাদের কি আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়? তারা তো আমার চোখের সামনে ঝুরঝুর করে কর্পূরের মতো উবে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *