Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আরও একজন জাগিয়া থাকে

আরও একজন জাগিয়া থাকে। কামার-বউ, পদ্ম। অন্ধকার রাত্রে ঘরের মধ্যে অন্ধকার স্পর্শসহ, গাঢ়তর হইয়া ওঠে। পদ্ম অন্ধকারের মধ্যে চোখ মেলিয়া জাগিয়া থাকে।-—এলোমেলো চিন্তা। শুধু এক বেদনার একটানা সুরে সেগুলি গাঁথা।

উঃ, কি অন্ধকার। নিস্তেজ হাতখানা চোখের সামনে ধরিয়াও দেখা যায় না।

গ্রামখানায় লোক অঘোরে ঘুমাইতেছে। সাড়া-শব্দ নাই, শুধু ব্যাঙের শব্দ, বোধহয় হাজার ব্যাঙ একসঙ্গে ডাকিতেছে। দুইটা বড় ব্যাঙএখানে বলে হাঁড়াব্যাঙ-পাল্লা দিয়া ডাকিতেছে। এটা ডাকিতেছে ওটা থামিয়া আছে, এটা থামিলেই ওটা ডাকিবে। যেন কথা বলিতেছে। একটা পুরুষ অন্যটা তাহার স্ত্রী। বেঙা চলিয়াছে জলে, পরমানন্দে জলে সাঁতার কাটিয়া আহারের সন্ধানে, পূর্ণ বেগে তীরের মতন। বেঙী ছানাগুলি লইয়া পিছনে পড়িয়া আছে কচি কচি পায়ে এত জোরে জল কাটিয়া যাইবার তাহাদের শক্তি নাই, বেঙী তাহাদিগকে ফেলিয়া যাইতে পারে না; সে ডাকিতেছে—

যেও না যেও না বেঙা—আমাদিগে ছেড়ে,
মুই নারী অভাগিনী ভাসি যে পাথরে—
ও হায় কচি কাঁচা নিয়ে!

বেঙা গম্ভীর গলায় শাসন করিয়া বলে—

মর্‌–মর্‌—একি জ্বালা পিছে ডাকিস্ কেনে?
কেতাত্থ করেছ আমায়—ছেলেপিলে এনে–
মরতে কেন করলাম বিয়ে!

পুরুষগুলা এমনি বটে। প্রথম প্রথম ক-ত্ত ভালবাসা। তারপর ফিরিয়াও চায় না।… অনিরুদ্ধ গেল—বলিয়া গেল নাকাকের মুখে একটা বার্তাও পাঠাইল না। একখানা পোস্টকার্ড, কিই বা তাহার দাম! হঠাৎ মনে হয়, সে কি বাঁচিয়া আছে? না, মরিয়া গিয়াছে? সে নাই–নিশ্চয়ই মরিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিলে একটা খবরও সে কখনও-না-কখনও দিত। বেঙারা এমনি করিয়াই মরে। শোলমাছের পোনার ঝাকের লোভে, কাকড়াবাচ্চার ঝাকের লোভে বেঘোরে ছুটিয়া যায়—কালকেউটে যম ওত পাতিয়া থাকে—সে খপ করিয়া ধরে।… সে দুঃখের মধ্যেও হাসে। তখন বেঙার কি কাতরানি!

ও বেঙী—ও বেঙী—আমায় যমে ধরেছে।

এবার সে অন্ধকারের মধ্যে হাসিয়া সারা হয়।

বাহিরে বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল; বিদ্যুতের ছটা জানালা দরজার ফাঁক দিয়া—দেওয়ালের ফটক দিয়া চালের ফুটা দিয়া ঘরের ভিতর চকচক করিয়া খেলিয়া গেল। উঃ! কি ছটা!

ঘরের ভিতরে অন্ধকার পরমুহূর্তেই হইয়া উঠিল দ্বিগুণিত। পদ্ম ঘরের চারিদিক সেই অন্ধকারের মধ্যে চাহিয়া দেখিল। আর কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বিদ্যুতের এক চমকেই সব দেখা গিয়াছে। শিবকালীপুরের কর্মকারের ঘর ফাটিয়া চৌচির হইয়াছে, চালে অজস্ৰ ফুটা-এইবার ধসিয়া গিয়া ঢিপিতে পরিণত হইবে। কর্মকার মরিল—তাহার ঘর ভাঙিল, এখন শুধু টিকিয়া রহিল। কামারের বউ। কিন্তু কর্মকার মরিয়াছে, এমন কথাই বা কে নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে?

সকল বেঙাই কি মরে? তাহারা শোলের পোনা খাইয়া আরও আগাইয়া চলে—শেষে গাঙে গিয়া পড়ে; সেখানে পায় রুই-কাতলের ডিম, পোনার কাঁক। সেই ঝাকের সঙ্গে স্রোতে ভাসিয়া চলিয়া যায়। গাঙের ধারের বেঙীর দেখা হয়, সেইখানে জমিয়া যায়। আবার এমনও হয় যে, বেঙা সারারাত্রি খাইয়াদাইয়া সকালে ফেরে, ফিরিয়া দেখে বেঙী-ই নাই; তাহাকে ধরিয়া খাইয়াছে গ্রামের গোখুরা। ছেলেগুলারও কতক খাইয়াছে, কতকগুলা চলিয়া গিয়াছে কোথায় কে জানে! আবার কত বেঙী ছেলে ফেলিয়া পলাইয়া যায়। ওই উচ্চিংড়ের মা তারিণীর বউ! ওই। উচ্চিংড়ে ছেলেটা! আবার তাদের মিতেকে—দেবু পণ্ডিতকে দেখ না কেন। মিতেনী মরিয়াছে, মিতে কাহারও দিকে কি ফিরিয়া চাহিল!

হঠাৎ মনে পড়ে রাঙাদিদিকে। রাঙাদিদি কতই না রসিকতা করিত। কত কথা বলিত। তাহাকে গাল দিয়া বলিত—মরণ তোমার! মর তুমি! ভাল করে যত্ন-আত্যি করতে পারি না?

পদ্ম একদিন হাসিয়া বলিয়াছিল—আমি পারব না। তুমি বরং চেষ্টা করে দেখ দিদি।

–ওলো আমার বয়েস থাকলে রাঙাদিদি তাচ্ছিল্যপরে একটা পিচু কাটিয়া বলিয়াছিল–দেখতিস দেবা আমার পায়ে গড়াগড়ি যেত। দেখ না—এই বুড়ো বয়সে আমার রঙের জৌলুসটা দেখ না!…ওই একজন ছিল তাহার দরদী জন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িয়া যায় দুর্গাকে। ওই এক দরদী আছে তার। দুর্গা বলে—জামাই-পতি পাথর! পাথর হাসে না, পাথর কাঁদে না, পাথর কথা বলে না, পাথর গলে না। পাথর সে অনেক দেখিল। বকুলতলার ষষ্ঠী-পাথরকে দেখিয়াছে, শিবকে দেখিয়াছে, কালীকে দেখিয়াছে,অনেক মাথা কুটিয়াছে। তাহার গলায় হাতে এখনও একবোঝা মাদুলি!

পণ্ডিতও পাথর। বেশ হইয়াছে—লোকে পাথরের গায়ে কলঙ্কের কালি লেপিয়া দিয়াছে বেশ হইয়াছে! খুশি হইয়াছে সে।

বাহিরে পাখার ঝাপটের শব্দ উঠিল; কাক ডাকিতেছে। সকাল হইয়া গেল কি? আঃ তাহা হইলে বাঁচে! পদ্ম বিছানার পাশের জানালাটা খুলিয়া অবাক হইয়া গেল। আহা, এ কি রাত্রি। আকাশে কখন চাঁদ উঠিয়াছে! পাতলা মেঘে ঢাকা চাঁদের আলো ফুটফুট করিতেছে—ফিনফিনে নীলাম্বরী শাড়িপরা ফরসা বউয়ের মত।

সে দরজা খুলিয়া মাঠ-কোঠার বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

চারিদিক নিঝুম। উপরের বারান্দা হইতে দেখিয়া অদ্ভুত মনে হইতেছে। বাড়িটা যেন হাঁ করিয়া গিলিতে চাহিতেছে। মাটির উঠান জলে ভিজিয়া নরম হইয়া আছে, কিন্তু তবু রুপালি জ্যোৎস্নায় তকতক করিতেছে; কোথাও একমুঠো জঞ্জাল, কোথাও একটা পায়ের দাগ নাই। দক্ষিণ-দুয়ারী বারান্দাটা পড়িয়া আছে—কোথাও একটা জিনিস নাই। বারান্দাটা মনে হইতেছে কত বড়! পোড়ো বাড়ি জঞ্জালে ময়লায় ভরিয়া পড়িয়া থাকে—মরা মানুষের মত। চালে খড় থাকে না, দেওয়াল ভাঙিয়া যায়, দুয়ার জানালা খসিয়া যায়—মড়ার মাথায় যেমন চুল থাকে না, মাংস থাকে না, চোখের গর্ত মুখের গহ্বর হা হইয়া থাকে, তেমনি ভাবে। আর এ বাড়িটা ঝকঝাক তত করিতেছে, চাল আজও খড়ে ঢাকা, দরজা জানালা জীৰ্ণ হইলেও ঠিক আছে; শুধু নাই কোথাও মানুষের কোনো চিহ্ন। না আছে পায়ের ছাপ, না আছে জিনিসপত্র, জামা জুতা ছড়ি-কাকল্কে-কল্কে-ঝাড়া গুল; সব থাকিত দক্ষিণ-দুয়ারী ঘরটার দাওয়ায়। লোকের বাড়ির উঠানে থাকে—ছেলের খেলাঘর; যতীন-ছেলে থাকিতে উচ্চিংড়ে, গোবরা ছিল—তখন উঠানটায় ছড়াইয়া থাকিত কত জিনিস, কত উদ্ভট সামগ্ৰী। এখন কিছুই নাই। আর কিছুই নাই। মনে হইতেছে—বাড়িটা নিঃসাড়ে মরিতেছে ক্ষুধার জ্বালায়—যেন হাঁ করিয়া আছে খাদ্যের জন্য; মানুষের কর্মকোলাহলে মানুষের জিনিসপত্রে পেটটা তাহার ভরিয়া দাও। একা পদ্মকে নিত্য চিবাইয়া চুরিয়া তাহার তৃপ্তি হওয়া দূরে থাক—সে বাঁচিয়া থাকিতেও পারিতেছে না। উঠানের একপাশে কাহার পায়ের দাগ পড়িয়াছে যেন! দুর্গার পায়ের দাগ। সন্ধ্যাতেও সে আসিয়াছিল। অন্যদিন সে এইখানে শোয়। আজ আসে নাই।

হয়ত! ঘৃণায় পদ্মের মনটা রিরি করিয়া উঠিল। হয়ত কঙ্কণা গিয়াছে। অথবা জংশনে। কাল জিজ্ঞাসা করিলেই অবশ্য বলিবে। লজ্জা বা কুণ্ঠা তাহার নাই, দিব্য হাসিতে হাসিতে। সবিস্তারে সব বলিবে। দম্ভ করিয়াই সে বলে—পেটের ভাত পরনের কাপড়ের জন্য দাসীবিত্তিও করতে নারব ভাই, ভিক্ষেও করতে নারব।

ভিক্ষা কথাটা তাহার গায়ে বাজিয়াছিল। মনে করিলেই বাজে। ছিঃ, সে ভিক্ষার অন্ন খায়। হ্যাঁ, ভিক্ষার ভাত ছাড়া কি? পণ্ডিতের কাছে এ সাহায্য লইবার তাহার অধিকার কি? নিজের ভাগ্যের উপর একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশ তাহার মনে জাগিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে সে আক্রোশ আকাশ-ছাওয়া মেঘের মত গিয়া পড়িল প্রথমটা অনিরুদ্ধের উপর, পরে শ্ৰীহরির উপর, তারপর সে আক্রোশ গিয়া পড়িল দেবুর উপর। সে-ই বা কেন এমনভাবে করে তাকে? কেন?

দুর্গা বলে মিথ্যা নয়; বলে পণ্ডিতকে দেখে আমার মায়া হয়। আহা বিলু-দিদির বর! নইলে ওর ওপর আবার টান! ও কি মরদ কামার-বউ, ওর কি আছে বল? … তারপর তাচ্ছিল্যভাবে পিচ্ কাটিয়া বলেও আক্ষেপ আমার নাই ভাই। বামুন, কায়েত, সদ্‌গোপ, জমিদার, পেসিডেন, হাকিম, দারোগাকত কামার-বউ। … সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ভাঙিয়া পড়ে, বলে–ওলো, আমি মুচির মেয়ে; আমাদের জাতকে পা ছুঁয়ে পেন্নাম করতে দেয় না, ঘরে ঢুকতে দেয় না; আর আমারই পায়ে গড়াগড়ি সব! পাশে বসিয়ে আদর করেযেন স্বগ্‌গে তুলে দেয়, বলব কি ভাই! সে আর বলিতেই পারে না; হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে।

দুর্গা আজও হয়ত অভিসারে গিয়াছে। হয়ত তাহার পায়ে গড়াইয়া পড়িতেছে কোনো মান্যগণ্য ধনী প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। কঙ্কণায় গিয়াছে হয়ত। বাবুদের বাগানের কত অভিজ্ঞতা দুর্গা বলিয়াছে। বাগানে জ্যোৎস্নার আলোয় বাবুদের শখ হয় দুর্গার হাত ধরিয়া বেড়াইতে। গ্রীষ্মের সময় ময়ূরাক্ষীর জলে স্নান করিতে যায়। আজও হয়ত তেমনি কোনো নূতন অভিজ্ঞতা লইয়া ফিরিবে। কালই তার পরনে দেখা যাইবে নূতন ঝলমলে শাড়ি, হাতে নূতন কাচের চুড়ি। অবশ্য এ সন্দেহ সত্য না হইতেও পারে। কারণ আজকাল দুর্গা আর সে দুর্গা নাই। আজকাল দুর্গা আর বড় একটা অভিসারে যায় না। বলে-ওতে আমার অরুচি ধরেছে ভাই। তবে কি করি, পেটের দায় বড় দায়! আর আমি না বললেই কি ছাড়ে সব? কামার-বউ, বলব কি-ভদ্দনকের ছেলে—সন্দে বেলায়। বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। জানালায় ঢেলা মেরে সাড়া জানায়। জানালা খুলে দেখি গাছের তলায় অন্ধকারের মধ্যে ফটফটে জামাকাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে। আবার রাতদুপুরে ভাই কি বলব, কোঠার জানালায় উঠে শিক ভেঙে ডাকাতের মত ঘরে ঢোকে।

—বাপ রে! পদ্ম শিহরিয়া ওঠে। সর্বাঙ্গ তাহার থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল মুহূর্তের জন্য; উঃ, পশুর জাত সব! পশু! পরমুহূর্তেই তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। তাহার শিয়রে আছে। বগিদা, সে নিৰ্ভয়ে রেলিঙের উপর ভর দিয়া মেঘচ্ছায়া-মলিন জ্যোত্সার দিকে চাহিয়া রহিল। ভদ্রের গুমোট গরমে ওই ঘরে জানালা-দরজা বন্ধ করিয়া কি শোয়া যায়? মিঠে মৃদু হাওয়া বেশ লাগিতেছে। শরীর জুড়াইয়া যাইতেছে। চাঁদের উপর দিয়া সাদা-কালো খানা-খানা মেঘ ভাসিয়া যাইতেছে। কখনও আলো, কখনও অ্যাঁধার।

হঠাৎ সে চমকাইয়া উঠিল। ও কে? ওই যে দক্ষিণ-দুয়ারীর দাওয়ার উপর এক কোণে সাদা। ফটফটে কে দাঁড়াইয়া আছে চোরের মত! কে ও পদ্মের বুকের ভিতরটা দুরদুর করিয়া উঠিল। সন্তৰ্পণে ঘরে ঢুকিয়া—দাখানা হাতে লইয়া দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। লোকটা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ছিরু পাল? সে হইলে কি এমন স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিত? লম্বা মানুষটি। কে? পণ্ডিত হ্যাঁ, পণ্ডিত বলিয়াই মনে হইতেছে। তাহার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন-গতি পরিবর্তিত হইয়া গেল। স্পন্দন হ্রাস হইল না, কিন্তু ভয়-বিহ্বলতা তাহার চলিয়া গেল। পাথর গলিয়াছে। হাজার হউক তুমি বেঙার জাত। আহা, বেচারা আসিয়াও কিন্তু সঙ্কোচভরে দাঁড়াইয়া আছে।

পদ্ম ধীরে ধীরে নামিয়া গেল। পণ্ডিত স্থির হইয়া তেমনি ভাবেই দাঁড়াইয়া আছে। পদ্ম অগ্রসর হইল। চাপা গলায় ডাকিল—মিতে?

না। মিতে নয়। পণ্ডিত নয়। মানুষই নয়। দাওয়াটার ওই কোণটার মাথার উপরে চালে একটা বড় ছিদ্র রহিয়াছে। সেই ছিদ্রপথে চাঁদের আলো পড়িয়াছে দীর্ঘ রেখায়, ঠিক যেন কোণে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া আছে একটি লম্বা মানুষ।

দরজায় ধাক্কা দেয় কে? দরজা ঠেলিতেছে। হ্যাঁ, বেশ ইঙ্গিত রহিয়াছে এই আঘাতের মধ্যে। কামার-বউ আসিয়া দরজার ফাঁক দিয়া দেখিল। তারপর ডাকিল—কে?

কে? কে?

দেবু বিছানায় শুইয়া জাগিয়া ছিল। সে ভাবিতেছিল। হঠাৎ সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া নজরে পড়িল—তাহার বাড়ির কোলের রাস্তাটার ওপারে শিউলি গাছটার তলায় ফটফটে সাদা কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া কে দাঁড়াইয়া আছে। কে? দেবু উঠিয়া বসিল। সে চমকিয়া উঠিল, এ যে স্ত্রীলোক! আকাশের এক স্থানে মেঘ ঘন হইয়া আসিয়াছে, পুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতে শুরু হইয়াছে। গাছের পাতায় টুপটাপ শব্দ শোনা যায়। এই গভীর রাত্রে মেঘজল মাথায় করিয়া কে দাঁড়াইয়া আছে এখানে?

দুর্গা? এক তাহাকেই বিশ্বাস নাই। সে সব পারে। কিন্তু সত্যই কি সে? সে সব পারে, তবু দেবু এ কথা বিশ্বাস করিতে পারে না যে সে তাহার জানালার সম্মুখে আসিয়া এমনভাবে বিনা প্রয়োজনে দাঁড়াইয়া থাকিবে। সে ডাকিল—দুর্গা?

মূর্তিটি উত্তর দিল না, নড়িল না পর্যন্ত।

কে? দুর্গা হইলে কি উত্তর দিত না? তবে? তবে কে?

অকস্মাৎ তাহার মনে হইল এ কি তা হলে তাহার পরলোকবাসিনী বিলু? শিউলিতলায় ঝরা ফুলের মধ্যে দাঁড়াইয়া নিৰ্নিমেষ দৃষ্টিতে তাহাকে গোপনে দেখিতে আসিয়াছে। হয়ত নিত্যই দেখিয়া যায়। নানা পার্থিব চিন্তায় অন্যমনস্ক দেবু তাহাকে লক্ষ্য করে না। সে কাদে; কাঁদিয়া চলিয়া যায়। দেবুর আর সন্দেহ রহিল না। সে ডাকিল—বিলু! বিলু !

মূর্তিটি যেন চঞ্চল হইয়া উঠিল—ঈষৎ, মুহূর্তের জন্য।

দেবুর সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, বুকের ভিতরটা ভরিয়া উঠিল এক অনির্বচনীয় আবেগে। পার্থিব-অপার্থিক দুই স্তরের কামনার আনন্দে অধীর হইয়া, সে দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া দাওয়া হইতে পথে নামিলপথ অতিক্ৰম করিয়া, শিউলিতলায় আসিয়া মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইলব্যথভাবে হাত বাড়াইয়া মূর্তির হাত ধরিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার ভ্ৰম ভাঙিয়া গেল। রক্ত-মাংসের স্থূল দেহ, স্নিগ্ধ উষ্ণতাময় স্পৰ্শ-স্পর্শের মধ্যে সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক প্রবাহ; হাতখানার মধ্যে নাড়ির গতি দ্রুত স্পন্দিত হইতেছে,—এ কে! সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলকে তুমি?

আকাশ একখানা ঘন কালো মেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে; জ্যোৎস্না প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছে–চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন। দেবু আবার প্রশ্ন করিল—কে? আভাসে ইঙ্গিতে মনের চেতনায় তাহাকে। চিনিয়াও তবু প্রশ্ন করিলকে?

পদ্ম আপনার অবগুণ্ঠন মুক্ত করিয়া দিল। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেবুর দিকে চাহিয়া বলিল–আমি।

–কামার-বউ।

–হ্যাঁ, তোমার মিতেনী–পদ্ম হাসিল।

দেবুর শরীরের ভিতর একটা কম্পন বহিয়া গেল; কোনো কথা সে বলিতে পারিল না। চাপা গলায় ফিসফিস করিয়া পদ্ম বলিল-আমি এসেছি মিতে।

দেবু স্থিরদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে।

পদ্মের কণ্ঠস্বর সঙ্কোচলেশশূন্যতাহার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড কামনার আবেগ স্নায়ুমণ্ডলীতে অধীর উত্তেজনা শিরায় শিরায় প্রবহমান রক্তধারায় ক্রমবর্ধমান জর্জর উষ্ণতা। সে বলিল–আমি এসেছি মিতে। ওঘরে আর আমি থাকতে পারলাম না। তোমার ঘরে থাকব আমি। দুজনায় নতুন ঘর বাঁধব। তোমার খোকন আবার ফিরে আসবে আমার কোলে। যে যা বলে বলুক। না-হয় আমরা চলে যাব দুজনায়-দেশান্তরে!

এই কয়টি কথা বলিয়াই সে হাঁপাইয়া উঠিল।

দেবু তেমনি মূঢ়-স্তব্ধ হইয়াই দাঁড়াইয়া রহিল।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া দেবুকে জিজ্ঞাসুভাবে ডাকিল—মিতে!

দেবু একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল—সে সচেতন হইবার চেষ্টা করিল; তারপর সহজভাবে বলিল—চেপে জল আসছে, বাড়ি যাও কামার-বউ।

সে আর দাঁড়াইল না, সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিল। ঘরে ঢুকিয়া দরজাটা বন্ধ করিয়া খিলটা অ্যাঁটিয়া দিবার জন্য উঠাইল—

সেই অবস্থায় হঠাৎ সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। কতক্ষণ সে খিলে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল—তাহার নিজেরই খেয়াল ছিল না। খেয়াল হইল—বিদ্যুতের একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চমকে নীলাভ দীপ্তিতে যখন চোখ ধাধিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রগর্জনে চারিদিক থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। বাহিরের বর্ষণের প্রবল ধারাপাতে গাছের পত্রপল্লবে ঝরঝর শব্দে চারিদিক ভরিয়া উঠিয়াছে। সত্যই বৃষ্টি নামিয়াছে প্রবল বেগে। দেবু সচকিত হইয়া দরজা খুলিয়া বাহির হইল। দাওয়ায় দাঁড়াইয়া রাস্তার ওপারের শিউলিগাছটার দিকে চাহিয়া দেখিল—কিন্তু কিছুই দেখা গেল। না, গাছটাকেও পর্যন্ত দেখা যায় না। ঘন প্রবল বৃষ্টিধারায়, গাঢ় কালো মেঘের ছায়ায় সব বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। মিতেনীর অবশ্য চলিয়া যাওয়ারই কথা; আর কি সে দাঁড়াইয়া থাকে, না থাকিতে পারে? তবুও সে দাওয়া হইতে নামিয়া ছুটিয়া গেল শিউলিতলার দিকে। শিউলিতলা শূন্য। কিছুক্ষণ সে সেই বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়াইয়া রহিল। একবার কয়েক পা অগ্রসরও হইল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিল। ঘরে আসিয়া একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভিজা কাপড় বদলাইয়া সে চুপ করিয়া বসিল। হতভাগিনী মেয়ে! ইহার প্রতিবিধান করার প্রয়োজন হইয়াছে। কিন্তু কি প্রতিবিধান? তাহার মনে পড়িল—স্বর্ণ সেদিন যে কবিতাটি পড়িতেছিল সেই কবিতাটির কথা–স্বামীলাভ। যে মন্ত্ৰ তুলসীদাস সেই বিধবাকে দিয়াছিলেন সে মন্ত্র সে কোথায় পাইবে?

বাহিরে মুষলধারে বর্ষণ চলিয়াছে।

সকালে ঘুম ভাঙিল অনেকটা বেলায়। অনেকটা রাত্রি পর্যন্ত তাহার ঘুম আসে নাই। বোধহয় শেষরাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া ছিল সে। এখনও বর্ষণ থামে নাই। আকাশে ঘোর ঘনঘটা। উতলা এলোমেলো বাতাসও আরম্ভ হইয়াছে। একটা বাদল নামিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে! দেবু ওই শিউলি গাছটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রাত্রির কথাগুলি তাহার মনের মধ্যে ভাসিয়া উঠিল। একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে দৃষ্টি ফিরাইয়া লইল। হতভাগিনী মেয়ে! সংসারে এমনি ভাগ্যহতা কতকগুলি মেয়ে থাকে, যাহাদের ঃখ-দুর্দশার কোনো প্রতিবিধান নাই। যে প্রতিবিধান করিতে যায়, সে পর্যন্ত দুর্ভাগিনীর অনিবার্য দুঃখে আগুনের অ্যাঁচে ঝলসিয়া যায়। অনিরুদ্ধ দেশত্যাগী হইয়াছে, তাহা. জমিজেরাত সব গিয়াছে—সে। বোধহয় ওই মেয়েটির ভাগ্যফলের তাড়নায়। সে তাহাকে আয় দিল—তাহার দিকেও আগুনের অ্যাঁচ আগাইয়া আসিতেছে। শ্ৰীহরি তাহার চারিদিকে পঞ্চায়েতমণ্ডলীর শাস্তির বেড়া-আগুন জ্বালিবার উদ্যোগ করিতেছে। পরশু পঞ্চায়েত বসিবে, চারিদিকে খবর গিয়াছে। উদ্যোগ আয়োজন ঘোষ করিয়াছে। রাঙাদিদির এক উত্তরাধিকারী খাড়া করিয়াছে—সেই শ্ৰাদ্ধ করিবে। সেই উপলক্ষে পঞ্চায়েত বসিবে। পরশু রাঙাদিদির শ্রাদ্ধ। মেয়েটা নিজে তাহাকে জ্বালাইয়া ছাই করিয়া দিবার জন্য পাপের আগুন জ্বালাইয়াছে বারুদের রঙিন বাতির মত। আপনার আদর্শ অনুযায়ী সংস্কার অনুযায়ী দেবু পদ্মকে কঠিন শুচিতা সং্যমে অনুপ্রাণিত করিবার সংকল্প করিল। সে কোনোমতেই আর কামার-বউয়ের বাড়ি যাইবে না। ছাতা মাথায় দিয়া সে মাঠের দিকে। বাহির হইয়া পড়িল।

রাত্রে প্রবল বর্ষণ হইয়া গিয়াছে। গ্রামের নালায় হুড়হুড় করিয়া জল চলিতেছে। কয়েকটা স্থানে নালার জল রাস্তা ছাপাইয়া বহিয়া চলিয়াছে। পুকুর-গড়েগুলি পূর্ব হইতেই ভরিয়া ছিল, তাহার উপর কাল রাত্রে জলে এমন কানায় কানায় ভরিয়া উঠিয়াছে যে, জল প্রবেশের নালা দিয়া এখন পুকুরের জল বাহির হইয়া আসিতেছে। জগন ডাক্তারের বাড়ির খিড়কি গড়েটার ধারে জগন দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার পুকুর হইতে জল বাহির হইতেছে। ডাক্তার নিজে দাঁড়াইয়া মাহিন্দারটাকে নিয়া নালার মুখে বাঁশের তৈরি বার পোঁতাইতেছে। জগনও আজকাল তাহার সঙ্গে বড় একটা কথাবার্তা বলে না। সে পঞ্চায়েতের মধ্যে নাই, থাকিবার কথাও নয়; ডাক্তার কায়স্থ-নবশাখা সমাজের পঞ্চায়েতের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ কি? তবুও গ্রাম্য সমাজে গ্রামবাসী হিসাবে তাহার মতামত সহযোগিতা—এ সবের একটু মূল্য আছে; বিশেষ যখন সে ডাক্তার, প্রাচীন প্রতিপত্তিশালী ঘরের ছেলে-তখন বিশেষ মূল্য আছে। কিন্তু ডাক্তার শ্ৰীহরির নিমন্ত্রিত পঞ্চায়েতের মধ্যে নাই। আবার দেবুর সঙ্গেও সম্বন্ধ সে প্রায় ছিন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। ডাক্তারও কামার-বউয়ের কথাটা বিশ্বাস করিয়াছে। নেহাত চোখাচোখি হইতে ডাক্তার শুষ্কভাবে বলিল–মাঠে চলেছ?

হাসিয়া দেবু বলিল–হ্যাঁ। বার পোঁতাচ্ছ বুঝি?

–হ্যাঁ। পোনা আছে, বড় মাছও কটা আছে, এবারও পোনা ফেলেছি। তারপর আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল—আকাশ যা হয়েছে, যে রকম আওলি-বাউলি ( এলোমেলো বাতাস। বইছে—তাতেও তো মনে হচ্ছে বাদলা আবার নামল। এর ওপরে জল হলে—বার পুঁতেও কিছু হবে না।

দেবুও একবার আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিল–হুঁ।

প্রায় সকল গৃহস্থই, যাহাদের পুকুর-গড়ে আছে—তারা সকলেই জগনের মত নালার মুখে বেড়ার আটক দিতে ব্যস্ত। পল্লী-জীবনে মাঠে-ধান, কলাই, গম, আলু, আখ; বাড়িতে শাক-পাতা, লাউ, কুমড়া; গোয়ালে–গাইয়ের দুধের মত পুকুরের মাছও অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ। বার মাস তো খায়ই, তাহা ছাড়া কাজ-কর্মে, অতিথি অভ্যাগত-সমাগমে ওই মাছই তাহাদের মান রক্ষা করিয়া থাকে। পেটের বাছা, ঘরের গাছা, পুকুরের মাছা-পল্লী গৃহস্থের সৌভাগ্যের লক্ষণ।

সদ্‌গোপ পাড়া পার হইয়া বাউরি, ডোম ও মুচিপাড়া। ইহাদের পাড়াটা গ্রামের প্রান্তে এবং অপেক্ষাকৃত নিচু স্থানে। গ্রামের সমস্ত জলই এই পাড়ার ভিতর দিয়া নিকাশ হয়। পল্লীটার ঠিক মাঝখান দিয়া চলিয়া গিয়াছে একটা বালুময় প্রস্তর পথ বা নালা;সেই পথ বাহিয়া জল গিয়া পড়ে পঞ্চগ্রামের মাঠে। পাড়াটা প্রায় জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। কোথাও একহাটু, কোথাও গোড়ালি-ডোবা জল। পাড়ার পুরুষেরা কেহ নাই, সব মাঠে গিয়া পড়িয়াছে। এই প্রবল বর্ষণে ধানের ক্ষতি তো হইবেই, তাহার উপর জলের তোড়ে আল ভাঙিবে, জমিতে বালি পড়িবে; সেই সব ভাঙনে মাটি দিতে গিয়াছে। মেয়েরা এবং ছোট ছেলেরা হাতজালি-ঝুড়ি লইয়া মাছ ধরিতে ব্যস্ত। ছোট ছেলেগুলার উৎসব লাগিয়া গিয়াছে। কেহ সাঁতার কাটিতেছে কেহ লাফাইতেছে; অপেক্ষাকৃত বয়স্ক কয়টা ছেলে কাহারও একটা কাটা তালগাছের অসার ডগার অংশ জলে ভাসাইয়া নৌকাবিহারে মত্ত। ইহারই মধ্যে কয়েকজনের ঘরের দেওয়ালও ধসিয়াছে।

দেবুর মন তাহাকে এ পথে টানিয়া আনিয়াছিল—দুর্গার উদ্দেশে। দুর্গাকে দিয়া কামারবউয়ের সন্ধান লইবার কল্পনা ছিল তাহার। দুর্গাকে কিছু প্রকাশ করিয়া বলিবার অভিপ্রায় ছিল না। ইঙ্গিতে কতকগুলা কথা জানাইবার এবং জানিবার আছে তাহার। সে সমস্ত রাত্রি ভাবিয়া স্থির করিয়াছিলরাত্রির ঘটনাটার ঘৃণাক্ষরে উল্লেখ না করিয়া সে শুধু কামার-বউয়ের মন্ত্রদীক্ষা লওয়ার প্রস্তাব করিবে। বলিবে—দেখ, মানুষের ভাগ্যের উপর তো মানুষের হাত নাই। ভাগ্যফলকে মানিয়া লইতে হয়। ভগবানের বিধান। মানুষের স্ত্রী-পুত্র যায়, স্ত্রীলোকের স্বামী। পুত্ৰ যায়, থাকে শুধু ধর্ম। তাহাকে মানুষ না ছাড়িলে সে মানুষকে ছাড়ে না। যে মানুষ তাহাকে ধরিয়া থাকে সে দুঃখের মধ্যেও সুখ না হোক শান্তি পায়; পরকালের গতি হয়, পরজন্মে ভাগ্য হয় প্রসন্ন। তুমি এবার মন্ত্রদীক্ষা লও। তোমাদের গুরুকে সংবাদ দিই, তুমি মন্ত্ৰ লও, সেই মন্ত্ৰ জপ কর; বার কর, ব্রত কর। মনে শান্তি পাইবে।

দুর্গার বাড়িতে আসিয়া সে ডাকিল-দুৰ্গা!

দুর্গার মা একটা খাটো কাপড় পরিয়া ছিল—তাহাতে মাথায় ঘোমটা দেওয়া যায় না; সে তাড়াতাড়ি একখানা ছেঁড়া গামছা মাথার উপর চাপাইয়া বলিল—সি তো সেই ভোরে উঠেই চলে যেয়েছে বাবা। কাল রেতে মাথা ধরেছিল; কাল আর কামার মাগীর ঘরে শুতে যায় নি। উঠেই সেই ভাবী-সাবির লোকের বাড়িই যেয়েছে।

পাতুর বিড়ালীর মত বউটা ঘরের মেঝে হইতে খোলায় করিয়া জল সেচিয়া ফেলিতেছে। চালের ফুটা দিয়া জল পড়িয়া মাটির মেঝেয় গর্ত হইয়া গিয়াছে।

ফিরিবার পথে সে অনিরুদ্ধের বাড়ির দিকটা দিয়া গ্রামে ঢুকিল। গ্রামের এই দিকটা অপেক্ষাকৃত উঁচু। এদিকটায় কখনও জল জমে না, কিন্তু আজ এই দিকটাতেই জল জমিয়া গিয়াছে—পায়ের গোড়ালি ড়ুবিয়া যায়। ওদিকে রাঙাদিদির ঘরের দেওয়ালের গোড়াটা বেশ ভিজিয়া উঠিয়াছে। কারণটা সে ঠিক বুঝিল না। সে কামার-বাড়ির দরজার গোড়ায় দাঁড়াইয়া ডাকিল—দুর্গা–দুর্গা রয়েছিস?

কেহ সাড়া দিল না। সে আবার ডাকিল। এবারও কোনো সাড়া না পাইয়া সে বাড়ির মধ্যে ঢুকিল। বাড়ির মধ্যেও কাহারও কোনো সাড়া নাই। উপরের ঘরের দরজাটা ভোলা হাঁহ করিতেছে। দক্ষিণ-দুয়ারী ঘরের একটা কোণে চালের ছিদ্ৰ দিয়া অজস্র ধারায় জল পড়ায় দেওয়ালের একটা কোণ ধসিয়া পড়িয়াছে, কাদায় মাটিতে দাওয়াটা একাকার হইয়া গিয়াছে। সে আরও একবার ডাকিল; এবার ডাকিল—মিতেনী রয়েছ? মিতেনী!

মিতেনী বলিয়াই ডাকিল। হতভাগিনী মেয়েটির দুর্ভাগ্যের কথাও যে সে না ভাবিয়া পারে না। এ-দেশের বালবিধবাদের মত কামার-বউ হতভাগিনী। সংযম যে শ্রেষ্ঠ পন্থা তাহাতে তাহার সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহাদের বঞ্চনার দিকটাও যে বড় সকরুণ। যে যুগে দেবু জন্মিয়াছে। এবং তাহার জীবনে যে সংস্কার ও শিক্ষা সে আয়ত্ত করিয়াছে, তাহাতে তাহার কাছে দুইটা দিকই গুরুত্বে প্রায় সমান মনে হয়। বিশেষ করিয়া কিছুদিন আগে সে শরৎচন্দ্রের বইগুলি পড়িয়া শেষ করিয়াছে, তাহার ফলে এই ভাগ্যহতা মেয়েগুলির প্রতি তাহার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা পাল্টাইয়া গিয়াছে। কাল রাত্রে সংযমের দিকটাই ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিল; তখন সে তাহাকে বিচার করিতে চাহিয়াছিল কঠিন বিচারকের মত প্রাচীন বিধান অনুসারে। আজ এই মুহূর্তে করুণার দিকটা যেন ঝুঁকিয়া পড়িল। সে ডাকিল—মিতেনী রয়েছ? মিতেনী?

এ ডাকেও কোনো সাড়া মিলিল না। বোধহয় দুর্গার সঙ্গে মিলিয়া মিতেনী ঘাটের দিকে গিয়াছে গা ধুইতে। সে ফিরিল। পথের জল ক্রমশ বাড়িতেছে। পথের দুপাশে যাহাদের ঘরতাহাদের মধ্যে জনকয়েক আপন আপন দাওয়ায় বসিয়া আছে নিতান্ত বিমৰ্ষভাবে। অদূরে হরেন। ঘোষাল শুধু ইংরেজিতে চিৎকার করিতেছে। প্রথমেই দেখা হইল-হরিশ ও ভবেশখুড়োর সঙ্গে। দেবু প্রশ্ন করিল—আপনাদের পাড়ায় এত জল খুড়ো!

তাহারা কোনো কিছু বলিবার পূর্বেই হরেন ঘোষাল তাহাকে ডাকিলকাম্ হিয়ার, সি, সি—সি উইথ ইয়োর ওন আইজ। দি জমির-শ্ৰীহরি ঘোষ এস্কোয়ারমেম্বার অব দি ইউনিয়ন বোর্ড হ্যাজ ডান ইট।

দেবু আগাইয়া গেল। দেখিল—নালা দিয়া জল শ্ৰীহরির পুকুরে ঢুকিবার আশঙ্কায় শ্রীহরি। নালায় একটা বাঁধ দিয়াছে। জলের স্রোতকে ঘুরাইয়া দিয়াছে উঁচু পথে। সে পথে জল মরিতেছে। না, জমিয়া জমিয়া গোটা পাড়াটাকেই ড়ুবাইয়া দিয়াছে।

দেবু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াইয়া ভাবিল। তারপর বলিল ঘরে কোদাল আছে ঘোষাল?

–কোদাল?—ব্যাপারটা অনুমান করিয়া কিন্তু ঘোষালের মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল।

–হ্যাঁ, কোদাল—কি টামনা। যাও নিয়ে এস।

বিবৰ্ণমুখে ঘোষাল বলিলবাধ কাটালে ফৌজদারি হবে না তো?

–না। যাও নিয়ে এস।

–বাট দেয়ার ইজ কালু শেখ হি ইজ এ ডেঞ্জারাস্ ম্যান।

–নিয়ে এস ঘোষাল, নিয়ে এস। না হয় বল—আমি আমার বাড়ি থেকে নিয়ে আসি। দেবু সোজা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার দীর্ঘ দেহখানি থরথর করিয়া কপিতেছে। ঘোষাল এবার ঘর হইতে একটা টামনা আনিয়া দেবুর হাতে আগাইয়া দিল। দেবু মাথার ছাতাটা বন্ধ করিয়া ঘোষালের দাওয়ার উপর ফেলিয়া দিয়া কাপড় সঁটিয়া টামনা হাতে বাঁধের উপর উঠিয়া দাঁড়াইল। চিৎকার করিয়া বলিল-আমাদের বাড়ি-ঘর ড়ুবে যাচ্ছে! এ বেআইনী বাঁধ কে দিয়েছে বল-আমি কেটে দিচ্ছি।

শ্ৰীহরির ফটক হইতে কালু শেখ বাহির হইয়া আসিল। কালুর পিছনে নিজে শ্ৰীহরি। দেবু টামনা উঠাইয়া বাঁধের উপর কোপ বসাইল—কোপের পর কোপ।

শ্ৰীহরি হাঁকিয়া বলিল—দিচ্ছে, দিচ্ছে—আমারই লোক কেটে দিচ্ছে। দেবু খুড়ো, নামো তুমি। আমার পুকুরের মুখে একটা বড় বাঁধ দিয়ে নিলাম—তাই জলটা বন্ধ করেছি। হয়ে গেছে বাঁধ। ওরে যা যা কেটে দে বধ। যা যা, জলদি যা।

পাঁচ-সাতজন মজুর ছুটিয়া আসিল। এই গ্রামেরই মজুর, দেবুকে আর সকলে পরিত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু তাহারা করে নাই। একজন শ্রদ্ধাভরে বলিল-নেমে দাঁড়ান পণ্ডিতমশায়, আমরা কেটে দি।

ঘোষালের দাওয়ায় টামনাটা রাখিয়া দিয়া দেবু আপনার ছাতাটা তুলিয়া লইয়া বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল। শ্ৰীহরির পাশ দিয়াই যাইবার পথ। শ্ৰীহরি হাসিমুখে বলিলখুড়ো!

দেবু দাঁড়াইয়া ফিরিয়া চাহিল।

শ্ৰীহরি তাহার কাছে অগ্রসর হইয়া আসিয়া মুদ্‌স্বরে বলিল—অনিরুদ্ধের বউটার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে নাকি?

দেবুর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। ভ্ৰকুটি কুঞ্চিত হইয়া উঠিল—চোখ দুটিতে যেন ছুরির ধার খেলিয়া গেল। তবুও সে আত্মসংবরণ করিয়া বলিল-মানে?

—মানে কাল রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা কি দুটো, বৃষ্টিটা মুষলধারে এসেছে, ঘুম ভেঙে গেল, জানালা দিয়ে ছাট আসছিল, গেলাম জানালা বন্ধ করতে। দেখি রাস্তার উপরেই কে দাঁড়িয়ে। ডাকলাম—কে? মেয়ে গলায় উত্তর এল—আমি। কারও কিছু হয়েছে মনে করে তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। দেখি কামার-বউ দাঁড়িয়ে। আমাকে বললে—আপনার ঘরে তো দাসী-বাদী আছে পাঁচটা আমাকে একটু ঠাঁই দেবেন আপনার ঘরে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম-কেন বল দেখি? দেবু খুডোর কাছে ছিলে, সে তো তোমাকে আদর-যত্ন না করে এমন নয়। সে কথার উত্তর দিলে না, বললে–যদি ঠাঁই না দেন, আমি চলে যাব—যে দিকে দুই চোখ যায়।—কি করব বাবা? বললাম—তা এস।

শ্ৰীহরি সগর্বে হাসিতে লাগিল। দেবু স্তম্ভিত হইয়া গেল।

শ্ৰীহরি আবার বলিল ভালই হয়েছে বাবা। পেত্নী নেমেছে তোমার ঘাড় থেকে। এখন ওই মুচি ছুঁড়ীটাকে বলে দিয়ো—যেন বাড়িটাড়ি না আসে। পঞ্চায়েতকে আমি একরকম করে বুঝিয়ে দোব। একটা প্রায়শ্চিত্ত করে ফেল। বিয়ে-যাওয়া কর, ভাল কনে আমি দেখে দিচ্ছি।

দেবু স্থির হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। শ্ৰীহরির সব কথা শুনিতেছিল না, বিস্ময় এবং ক্রোধের উত্তেজনা সংবরণের প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছিল। এতক্ষণে আত্মসংবরণ করিয়া সে হাসিয়া বলিল-আচ্ছা আমি চললাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress