নৌকাডুবি (57-62)
নৌকাডুবি ৫৭
ক্ষেমংকরী কমলাকে গিয়া কহিলেন, “মা, কাল হেমকে আর তার বাপকে দুপুর-বেলায় এখানে আহার করিতে নিমন্ত্রণ করা গেছে। কী রকম আয়োজনটা করা যায় বলো দেখি। বেয়াইকে এমন করিয়া খাওয়ানো দরকার যে, তিনি যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারেন যে এখানে তাঁহার মেয়েটির খাওয়ার কষ্ট হইবে না। কী বল মা ? তা, তোমার যেরকম রান্নার হাত, অপযশ হইবে না তা জানি। আমার ছেলে আজ পর্যন্ত কোনো রান্না খাইয়া কোনোদিন ভালোমন্দ কিছুই বলে নাই, কাল তোমার রান্নার প্রশংসা তাহার মুখে ধরে না মা। কিন্তু তোমার মুখখানি আজ বড়ো শুকনো দেখাইতেছে যে ? শরীর কি ভালো নাই ?”
মলিন মুখে একটুখানি হাসি আনিয়া কমলা কহিল, “বেশ আছি মা !’
ক্ষেমংকরী মথা নাড়িয়া কহিলেন, “না না, বোধ করি তোমার মন কেমন করিতেছে। তা-তো করিতেই পারে, সেজন্য লজ্জা কিসের। আমাকে পর ভাবিয়ো না মা ! আমি তোমাকে আপন মেয়ের মতোই দেখি, এখানে যদি তোমার কোনো অসুবিধা হয়, বা তুমি আপনার লোক কাহাকেও দেখিতে চাও তো আমাকে না বলিলে চলিবে কেন ?”
কমলা ব্যগ্র হইয়া কহিল, “না, মা, তোমার সেবা করিতে পারিলে আমি আর কিছুই চাই না।”
ক্ষেমংকরী সে কথায় কান না দিয়া কহিলেন, “নাহয় কিছুদিনের জন্য তোমার খুড়ার বাড়িতে গিয়া থাকো, তার পরে যখন ইচ্ছা হয় আবার আসিবে।”
কমলা অস্থির হইয়া উঠিল; কহিল, “মা, আমি যতক্ষণ তোমার কাছে আছি সংসারে কাহারো জন্য ভাবি না। আমি যদি কখনো তোমার পায়ে অপরাধ করি আমাকে তুমি যেমন খুশি শাস্তি দিয়ো, কিন্তু একদিনের জন্যও দূরে পাঠাইয়ো না।”
ক্ষেমংকরী কমলার দক্ষিণ কপোলে দক্ষিণ হস্ত বুলাইয়া কহিলেন, “তাই তো বলি মা, আর জন্মে তুমি আমার মা ছিলে। নহিলে দেখিবামাত্র এমন বন্ধন কী করিয়া হয়। তা, যাও মা, সকাল-সকাল শুইতে যাও। সমস্ত দিন তো এক দণ্ড বসিয়া থাকিতে জান না।”
কমলা তাহার শয়নগৃহে গিয়া, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দীপ নিবাইয়া, অন্ধকারে মাটির উপরে বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ বসিয়া, অনেকক্ষণ ভাবিয়া, এই কথা সে মনে বুঝিল— ‘কপালের দোষে যাহার উপরে আমার অধিকার হারাইয়াছি তাহাকে আমি আগলাইয়া বসিয়া থাকিব, এ কেমন করিয়া হয়। সমস্তই ছাড়িবার জন্য মনকে প্রস্তুত করিতে হইবে; কেবল সেবা করিবার সুযোগটুকু, যেমন করিয়া হউক, প্রাণপণে বাঁচাইয়া চলিব। ভগবান করুন, সেটুকু যেন হাসিমুখে করিতে পারি; তাহার বেশি আর-কিছুতে যেন দৃষ্টি না দিই। অনেক দুঃখে যেটুকু পাইয়াছি সেটুকুও যদি প্রসন্নমনে না লইতে পারি, যদি মুখ ভার করি, তবে সবসুদ্ধই হারাইতে হইবে।’
এই বুঝিয়া একাগ্রমনে বার বার করিয়া সে সংকল্প করিতে লাগিল, ‘আমি কাল হইতে যেন কোনো দুঃখকে মনে স্থান না দিই, যেন এক মুহূর্ত মুখ বিরস না করি, যাহা আশার অতীত, তাহার জন্য যেন কোনো কামনা মনের মধ্যে না থাকে। কেবল সেবা করিব, যতদিন জীবন আছে কেবল সেবা করিব, আর কিছু চাহিব না— চাহিব না— চাহিব না।’
তাহার পরে কমলা শুইতে গেল। এ পাশ-ও পাশ করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রে দুই-তিন বার ঘুম ভাঙিয়া গেল। ভাঙিবামাত্রই সে মন্ত্রের মতো আওড়াইতে লাগিল, ‘আমি কিছুই চাহিব না, চাহিব না, চাহিব না।’ ভোরের বেলায় সে বিছানা হইতে উঠিয়াই জোড়হাত করিয়া বসিল এবং সমস্ত চিত্ত প্রয়োগ করিয়া কহিল, ‘আমি আমরণকাল তোমার সেবা করিব; আর-কিছু চাহিব না, চাহিব না, চাহিব না।’
এই বলিয়া তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া, বাসি কাপড় ছাড়িয়া, নলিনাক্ষের সেই ক্ষুদ্র উপাসনা-ঘরের মধ্যে গেল; নিজের আঁচলটি দিয়া সমস্ত ঘর মুছিয়া পরিষ্কার করিল এবং যথাস্থানে আসনটি বিছাইয়া রাখিয়া দ্রুতপদে গঙ্গাস্নান করিতে গেল। আজকাল নলিনাক্ষের একান্ত অনুরোধে ক্ষেমংকরী সূর্যোদয়ের পূর্বে স্নান করিতে যাওয়া পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাই উমেশকেই এই দুঃসহ শীতের ভোরে কমলার সহিত স্নানে যাইতে হইল।
স্নান হইতে ফিরিয়া আসিয়া কমলা ক্ষেমংকরীকে প্রফুল্লমুখে প্রণাম করিল। তিনি তখন স্নানে বাহির হইবার উপক্রম করিতেছিলেন। কমলাকে কহিলেন, “এত ভোরে কেন নাহিতে গেলে ? আমার সঙ্গে গেলেই তো হইত।”
কমলা কহিল, “আজ যে কাজ আছে মা ! কাল সন্ধ্যাবেলায় যে তরকারি আনানো হইয়াছে তাহাই কুটিয়া রাখি; আর যা-কিছু বাজার করা বাকি আছে, উমেশ সকাল-সকাল সারিয়া আসুক।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেশ বুদ্ধি ঠাওরাইয়াছ মা। বেয়াই যেমনি আসিবেন অমনি খাবার প্রস্তুত পাইবেন।
এমন সময় নলিনাক্ষ বাহির হইয়া আসিবামাত্র কমলা ভিজা চুলের উপর তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল। নলিনাক্ষ কহিল, “মা, আজই তুমি স্নান করিতে চলিলে ? সবে কাল একটু ভালো ছিলে।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন, তোর ডাক্তারি রাখ্। সকালবেলায় গঙ্গাস্নান না করিলেও লোকে অমর হয় না। তুই এখন বাহির হইতেছিস বুঝি ? একটু সকাল-সকাল ফিরিস।”
নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “ কেন মা ?”
ক্ষেমংকরী। কাল তোকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ অন্নদাবাবু তোকে আশীর্বাদ করিতে আসিবেন।
নলিনাক্ষ। আশীর্বাদ করিতে আসিবেন ? কেন, হঠাৎ আমার উপরে এত বিশেষভাবে প্রসন্ন হইলেন যে ? তাঁর সঙ্গে তো রোজই আমার দেখা হয়।
ক্ষেমংকরী। আমি যে কাল হেমনলিনীকে একজোড়া বালা দিয়া আশীর্বাদ করিয়া আসিলাম, এখন অন্নদাবাবু তোকে না করিলে চলিবে কেন ? যা হোক, ফিরিতে দেরি করিস নে, তাঁরা এখানেই খাইবেন।
এই বলিয়া ক্ষেমংকরী স্নান করিতে গেলেন। নলিনাক্ষ মাথা নিচু করিয়া ভাবিতে ভাবিতে রাস্তা দিয়া চলিয়া গেল।
নৌকাডুবি ৫৮
হেমনলিনী রমেশের নিকট হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িল। প্রথম আবেগটা শান্ত হইবামাত্র একটা লজ্জা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। ‘কেন আমি রমেশবাবুর সঙ্গে সহজভাবে দেখা করিতে পারিলাম না ? যাহা আশা করি না, তাহাই হঠাৎ কেন আমার মধ্য হইতে এমন অশোভন ভাবে দেখা দেয় ? বিশ্বাস নাই, কিছুই বিশ্বাস নাই। এমন করিয়া টল্মল্ করিতে আর পারি না।’
এই বলিয়া সে জোর করিয়া উঠিয়া পড়িয়া দরজা খুলিয়া দিল, বাহির হইয়া আসিল; মনে মনে কহিল, ‘আমি পলায়ন করিব না, আমি জয় করিব।’ পুনর্বার রমেশবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চলিল। হঠাৎ কী মনে পড়িল। আবার সে ঘরের মধ্যে গেল। তোরঙ্গ খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে ক্ষেমংকরীর প্রদত্ত বালাজোড়া বাহির করিয়া পরিল, এবং অস্ত্র পরিয়া যুদ্ধে যাইবার মতো সে আপনাকে দৃঢ় করিয়া মাথা তুলিয়া বাগানের দিকে চলিল।
অন্নদাবাবু আসিয়া কহিলেন, “হেম, তুমি কোথায় চলিয়াছ ?”
হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু নাই ? দাদা নাই ?”
অন্নদা। না, তাঁহারা চলিয়া গেছেন।
আশু আত্মপরীক্ষাসম্ভাবনা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া হেমনলিনী আরাম বোধ করিল।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “এখন তবে— ”
হেমনলিনী কহিল, “হাঁ বাবা, আমি চলিলাম; আমার স্নান করিয়া আসিতে দেরি হইবে না, তুমি গাড়ি ডাকিতে বলিয়া দাও।
এইরূপে হেমনলিনী নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য হঠাৎ তাহার স্বভাববিরুদ্ধ অত্যন্ত উৎসাহ প্রকাশ করিল। এই উৎসাহের আতিশয্যে অন্নদাবাবু ভুলিলেন না, তাঁহার মন আরো উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল।
হেমনলিনী তাড়াতাড়ি স্নান সারিয়া সজ্জিত হইয়া আসিয়া কহিল, ‘বাবা, গাড়ি আসিয়াছে কি ?”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “না, এখনো আসে নাই।”
ততক্ষণ হেমনলিনী বাগানের রাস্তায় পদচারণা করিয়া বেড়াইতে লাগিল।
অন্নদাবাবু বারান্দায় বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন।
অন্নদাবাবু যখন নলিনাক্ষের বাড়ি গিয়া পৌঁছিলেন বেলা তখন সাড়ে দশটার অধিক হইবে না। তখনো নলিনাক্ষ কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসে নাই। কাজেই অন্নদাবাবুর অভ্যর্থনাভার ক্ষেমংকরীকেই লইতে হইল।
ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুর শরীর ও সংসারের নানা কথা লইয়া প্রশ্ন ও আলোচনা উত্থাপিত করিলেন; মাঝে মাঝে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাঁহার কটাক্ষ ধাবিত হইল। সে মুখে কোনো উৎসাহের লক্ষণ নাই কেন ? আসন্ন শুভঘটনার সম্ভাবনা সূর্যোদয়ের পূর্বে অরুণরশ্মিচ্ছটার মতো তাহার মুখে দীপ্তিবিকাশ করে নাই তো ! বরঞ্চ হেমনলিনীর অন্যমনস্ক দৃষ্টির মধ্য হইতে একটা ভাবনার অন্ধকার যেন দেখা যাইতেছিল।
অল্পেই ক্ষেমংকরীকে আঘাত করে। হেমনলিনীর এইরূপ ম্লানভাব লক্ষ্য করিয়া তাঁহার মন দমিয়া গেল। ‘নলিনের সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ যে-কোনো মেয়ের পক্ষেই সৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু এই শিক্ষামদমত্তা মেয়েটি আমার নলিনকে কি তাঁহার যোগ্য বলিয়াই মনে করিতেছেন না ? এত চিন্তা, এত দ্বিধাই বা কিসের জন্য ? আমারই দোষ। বুড়া হইয়া গেলাম, তবু ধৈর্য ধরিতে পারিলাম না। যেমন ইচ্ছা হইল, অমনি আর সবুর সহিল না। বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে নলিনের বিবাহ স্থির করিলাম, অথচ তাহাকে ভালো করিয়া চিনিবার চেষ্টাও করিলাম না। হায় হায়, চিনিয়া দেখিবার মতো সময় যে হাতে নাই, এখন সংসারের সব কাজ তাড়াতাড়ি সারিয়া যাইবার জন্য তলব আসিয়াছে।’
অন্নদাবাবুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ক্ষেমংকরীর মনের ভিতরে ভিতরে এই সমস্ত চিন্তা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কথাবার্তা কহা তাঁহার পক্ষে কষ্টকর হইয়া উঠিল। তিনি অন্নদাবাবুকে কহিলেন, “দেখুন, বিবাহের সম্বন্ধে বেশি তাড়াতাড়ি করিয়া কাজ নাই। এঁদের দুজনেরই বয়স হইয়াছে, এখন এঁরা নিজেরাই বিচার করিয়া কাজ করিবেন, আমাদের তাগিদ দেওয়াটা ভালো হইতেছে না। হেমের মনের ভাব আমি অবশ্য বুঝি না— কিন্তু আমি নলিনের কথা বলিতে পারি, সে এখনো মন স্থির করিতে পারে নাই।”
এ কথাটা ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে বিশেষ করিয়া শুনাইবার জন্যই বলিলেন। হেমনলিনী অপ্রসন্নমনে চিন্তা করিতেছে, আর তাঁর ছেলেই যে বিবাহের প্রস্তাবে একেবারে নাচিয়া উঠিয়াছে, এ ধারণা তিনি অপর পক্ষের মনে জন্মিতে দিতে পারেন না।
হেমনলিনী আজ এখানে আসিবার সময় খুব একটা চেষ্টাকৃত উৎসাহ অবলম্বন করিয়া আসিয়াছিল; সেই জন্য তাহার বিপরীত ফল হইল। ক্ষণিক উত্তেজনা একটা গভীর অবসাদের মধ্যে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। যখন ক্ষেমংকরীর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হঠাৎ তাহার মনকে একটা আশঙ্কা আক্রমণ করিয়া ধরিল— যে নূতন জীবনযাত্রার পথে সে পদক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে তাহা তাহার সম্মুখে অতিদূর-বিসর্পিত দুর্গম শৈলপথের মতো প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল।
সমস্ত শিষ্টালাপের মধ্যে নিজের প্রতি অবিশ্বাস হেমনলিনীর মনকে আজ ভিতরে ভিতরে ব্যথিত করিতে লাগিল।
এই অবস্থায় যখন ক্ষেমংকরী বিবাহের প্রস্তাবটাকে কতকটা প্রত্যাখ্যান করিয়া লইলেন, তখন হেমনলিনীর মনে দুই বিপরীত ভাবের উদয় হইল। বিবাহবন্ধনের মধ্যে শীঘ্র ধরা দিয়া নিজের সংশয়দোলায়িত দুর্বল অবস্থা হইতে শীঘ্র নিষ্কৃতি পাইবার ইচ্ছা তাহার থাকাতে প্রস্তাবটাকে সে অনতিবিলম্বে পাকা করিয়া ফেলিতে চায়, অথচ প্রস্তাবটা চাপা পড়িবার উপক্রম হইতেছে দেখিয়া উপস্থিতমত সে একটা আরামও পাইল।
ক্ষেমংকরী কথাটা বলিয়াই হেমনলিনীর মুখের ভাব কটাক্ষপাতের দ্বারা লক্ষ্য করিয়া লইলেন। তাঁহার মনে হইল, যেন এতক্ষণ পরে হেমনলিনীর মুখের উপরে একটা শান্তির স্নিগ্ধতা অবতীর্ণ হইল। তাহাতে তাঁহার মনটা তৎক্ষণাৎ হেমনলিনীর প্রতি বিমুখ হইয়া উঠিল। তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘আমার নলিনকে আমি এত সস্তায় বিলাইয়া দিতে বসিয়াছিলাম !’ নলিনাক্ষ আজ যে আসিতে দেরি করিতেছে ইহাতে তিনি খুশি হইলেন। হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “দেখেছ নলিনাক্ষের আক্কেল ? তোমরা আজ এখানে আসিবে সে জানে, তবু তাহার দেখা নাই। আজ নাহয় কাজ কিছু কমই করিত। এই তো আমার একটু ব্যামো হলেই সে কাজকর্ম বন্ধ করিয়া বাড়িতেই থাকে, তাহাতে এতই কী লোকসান হয় ?”
এই বলিয়া আহারের আয়োজন কতদূর অগ্রসর হইয়াছে দেখিবার উপলক্ষে কিছুক্ষণের ছুটি লইয়া ক্ষেমংকরী উঠিয়া আসিলেন। তাঁহার ইচ্ছা, হেমনলিনীকে তিনি কমলার উপর ভিড়াইয়া দিয়া নিরীহ বৃদ্ধটিকে লইয়াই কথাবার্তা কহিবেন।
তিনি দেখিলেন, প্রস্তুত অন্ন মৃদু আগুনের আঁচে বসাইয়া রাখিয়া কমলা রান্নাঘরের এক কোণে চুপটি করিয়া এমন গভীরভাবে কী-একটা ভাবিতেছিল যে, ক্ষেমংকরীর হঠাৎ আবির্ভাবে সে একেবারে চমকিয়া উঠিল। পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া স্মিতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “ওমা, আমি বলি, তুমি বুঝি রান্নার কাজে ভারি ব্যস্ত হইয়া আছ।”
কমলা কহিল, “রান্না সমস্ত সারা হইয়া গেছে মা।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, এখানে চুপ করিয়া বসিয়া আছ কেন মা ? অন্নদাবাবু বুড়োমানুষ, তাঁর সামনে বাহির হইতে লজ্জা কী ? হেম আসিয়াছে, তাহাকে তোমার ঘরে ডাকিয়া লইয়া একটু গল্পসল্প করো’সে। আমি বুড়োমানুষ, আমার কাছে বসাইয়া রাখিয়া তাহাকে দুঃখ দিব কেন ?”
হেমনলিনীর নিকট হইতে প্রত্যাহত হইয়া কমলার প্রতি ক্ষেমংকরীর স্নেহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল।
কমলা সংকুচিত হইয়া কহিল, “মা, আমি তাঁর সঙ্গে কী গল্প করিব ! তিনি কত লেখাপড়া জানেন, আমি কিছুই জানি না।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে কী কথা ! তুমি কাহারো চেয়ে কম নও মা ! লেখাপড়া শিখিয়া যিনি আপনাকে যত বড়োই মনে করুন, তোমার চেয়ে বেশি আদর পাইবার যোগ্য কয়জন আছে ? বই পড়িলে সকলেই বিদ্বান হইতে পারে, কিন্তু তোমার মতো অমন লক্ষ্মীটি হওয়া কি সকলের সাধ্য ? এসো মা, এসো। কিন্তু তোমার এ বেশে চলিবে না। তোমার উপযুক্ত সাজে তোমাকে আজ সাজাইব।”
সকল দিকেই ক্ষেমংকরী আজ হেমনলিনীর গর্ব খাটো করিতে উদ্যত হইয়াছেন। রূপেও তিনি তাহাকে এই অল্পশিক্ষিতা মেয়েটির কাছে ম্লান করিতে চান। কমলা আপত্তি করিবার অবকাশ পাইল না। তাহাকে ক্ষেমংকরী নিপুণহস্তে মনের মতো করিয়া সাজাইয়া দিলেন, ফিরোজা রঙের রেশমি শাড়ি পরাইলেন, নূতন ফ্যাশানের খোঁপা রচনা করিলেন, বার বার কমলার মুখ এ দিকে ফিরাইয়া ও দিকে ফিরাইয়া দেখিলেন এবং মুগ্ধচিত্তে তাহার কপোল চুম্বন করিয়া কহিলেন, “আহা, এ রূপ রাজার ঘরে মানাইত।”
কমলা মাঝে মাঝে কহিল, “মা, উঁহারা একলা বসিয়া আছেন, দেরি হইয়া যাইতেছে।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, হোক দেরি। আজ আমি তোমাকে না সাজাইয়া যাইব না।”
সাজ সারা হইলে তিনি কমলাকে সঙ্গে করিয়া চলিলেন, “এসো এসো মা, লজ্জা করিয়ো না। তোমাকে দেখিয়া কালেজে-পড়া বিদুষী রূপসীরা লজ্জা পাইবেন, তুমি সকলের কাছে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পার।”
এই বলিয়া যে ঘরে অন্নদাবাবুরা বসিয়াছিলেন সেই ঘরে ক্ষেমংকরী জোর করিয়া কমলাকে টানিয়া লইয়া গেলেন। গিয়া দেখিলেন, নলিনাক্ষ তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। কমলা তাড়াতাড়ি ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল, কিন্তু ক্ষেমংকরী তাহাকে ধরিয়া রাখিলেন; কহিলেন, “লজ্জা কী মা, লজ্জা কিসের ! সব আপনার লোক।”
কমলার রূপে এবং সজ্জায় ক্ষেমংকরী নিজের মনে একটা গর্ব অনুভব করিতে ছিলেন; তাহাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হউক, এই তাঁহার ইচ্ছা। পুত্রাভিমানিনী জননী তাঁহার নলিনাক্ষের প্রতি হেমনলিনীর অবজ্ঞা কল্পনা করিয়া আজ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন, আজ নলিনাক্ষের কাছেও হেমনলিনীকে খর্ব করিতে পারিলে তিনি খুশি হন।
কমলাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হইল। হেমনলিনী প্রথম দিন যখন তাহার পরিচয় লাভ করিয়াছিল তখন কমলার সাজসজ্জা কিছুই ছিল না; সে মলিনভাবে সংকুচিত হইয়া এক ধারে বসিয়া ছিল, তাও বেশিক্ষণ ছিল না। তাহাকে সেদিন ভালো করিয়া দেখাই হয় নাই। আজ মুহূর্তকাল সে বিস্মিত হইয়া রহিল, তাহার পরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া লজ্জিতা কমলার হাত ধরিয়া তাহাকে আপনার পাশে বসাইল।
ক্ষেমংকরী বুঝিলেন, তিনি জয়লাভ করিয়াছেন; উপস্থিত-সভায় সকলকেই মনে মনে স্বীকার করিতে হইয়াছে, এমন রূপ দৈবপ্রসাদেই দেখিতে পাওয়া যায়। তখন তিনি কমলাকে কহিলেন, “যাও তো মা, তুমি হেমকে তোমার ঘরে লইয়া গল্পসল্প করো গে যাও। আমি ততক্ষণ খাবারের জায়গা করি গে।”
কমলার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল। সে ভাবিতে লাগিল, “হেমনলিনীর আমাকে কেমন লাগিবে কে জানে।’
এই হেমনলিনী এক দিন এই ঘরের বধূ হইয়া আসিবে, কর্ত্রী হইয়া উঠিবে— ইহার সুদৃষ্টিকে কমলা উপেক্ষা করিতে পারে না। এ বাড়ির গৃহিণীপদ তাহারই ছিল, কিন্তু সে কথা সে মনেও আনিতে চায় না— ঈর্ষাকে সে কোনোমতেই অন্তরে স্থান দিবে না। তাহার কোনো দাবি নাই। তাই হেমনলিনীর সঙ্গে যাইবার সময় তাহার পা কাঁপিয়া যাইতে লাগিল।
হেমনলিনী আস্তে আস্তে কমলাকে কহিল, “তোমার সব কথা আমি মা’র কাছে শুনিয়াছি। শুনিয়া বড়ো কষ্ট হইল। তুমি আমাকে তোমার বোনের মতো দেখিয়ো ভাই। তোমার কি বোন কেহ আছে ?”
কমলা হেমনলিনীর সস্নেহ সকরুণ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া কহিল, “আমার আপন বোন কেহ নাই, আমার একটি খুড়তুতো বোন আছে।”
হেমনলিনী কহিল, ‘ভাই, আমার বোন কেহ নাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার মা মারা গেছেন। কতবার কত সুখদুঃখের সময় ভাবিয়াছি, মা তো নাই, তবু যদি আমার একটি বোন থাকিত ! ছেলেবেলা হইতে সব কথা কেবল মনের মধ্যেই চাপিয়া রাখিতে হইয়াছে, শেষকালে এমন অভ্যাস হইয়া গেছে যে, আজ মন খুলিয়া কোনো কথা বলিতেই পারি না। লোকে মনে করে, আমার ভারি দেমাক— কিন্তু তুমি ভাই, এমন কথা কখনো মনে করিয়ো না। আমার মন যে বোবা হইয়া গেছে।”
কমলার মন হইতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল; সে কহিল, “দিদি, আমাকে কি তোমার ভালো লাগিবে ? আমাকে তো তুমি জান, আমি ভারি মূর্খ।”
হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “আমাকে যখন তুমি ভালো করিয়া জানিবে, দেখিবে আমিও ঘোর মূর্খ। আমি কেবল গোটাকতক বই পড়িয়া মুখস্থ করিয়াছি, আর কিছুই জানি না। তাই আমি তোমাকে বলি, যদি আমার এ বাড়িতে আসা হয় তুমি আমাকে কখনো ছাড়িয়ো না ভাই ! কোনোদিন সংসারের ভার আমার একলার হাতে পড়িয়াছে মনে করিলে আমার ভয় হয়।”
কমলা শিশুর মতো সরলচিত্তে কহিল, “ভার তুমি সমস্ত আমার উপর দিয়ো। আমি ছেলেবেলা হইতে কাজ করিয়া আসিয়াছি, আমি কোনো ভার লইতে ভয় করি না। আমরা দুই বোনে মিলিয়া সংসার চালাইব, তুমি তাঁহাকে সুখে রাখিবে, আমি তোমাদের সেবা করিব।”
হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা ভাই, তোমার স্বামীকে তো তুমি ভালো করিয়া দেখ নাই, তাঁহাকে তোমার মনে পড়ে ?”
কমলা কথার স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “স্বামীকে যে মনে করিতে হয় তাহা আমি জানিতাম না দিদি ! খুড়ার বাড়িতে যখন আসিলাম তখন আমার খুড়তুতো বোন শৈলদিদির সঙ্গে আমার ভালো করিয়া পরিচয় হইল। তিনি তাঁহার স্বামীকে যেরকম করিয়া সেবা করেন তাহা চক্ষে দেখিয়া আমার প্রথম চৈতন্য জন্মিল। আমি যে-স্বামীকে কখনো দেখি নাই বলিলেই হয় আমার সমস্ত মনের ভক্তি তাঁহার উদ্দেশে যে কেমন করিয়া গেল, তাহা আমি বলিতে পারি না। ভগবান আমার সেই পূজার ফল দিয়াছেন, এখন আমার স্বামী আমার মনের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন, তিনি আমাকে গ্রহণ না’ই করিলেন— কিন্তু আমি তাঁহাকে এখন পাইয়াছি।”
কমলার এই ভক্তিসিঞ্চিত কথা কয়টি শুনিয়া হেমনলিনীর অন্তঃকরণ আর্দ্র হইয়া গেল। সে খানিক ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তোমার কথা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। অমনি করিয়া পাওয়াই পাওয়া। আর সমস্ত পাওয়া লোভের পাওয়া, তাহা নষ্ট হইয়া যায়।”
কমলা এ কথা সম্পূর্ণ বুঝিল কি না বলা যায় না— সে হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া রহিল, খানিক বাদে কহিল, “তুমি যাহা বলিতেছ দিদি, তা সত্যই হইবে। আমি মনে কোনো দুঃখ আসিতে দিই না, আমি ভালোই আছি ভাই ! আমি যেটুকু পাইয়াছি তাই আমার লাভ।”
হেমনলিনী কমলার হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া কহিল, “যখন ত্যাগ এবং লাভ একেবারে সমান হইয়া যায় তখনই তাহা যথার্থ লাভ, এই কথা আমার গুরু বলেন। সত্য বলিতেছি বোন, তোমার মতো অমনি সমস্ত নিবেদন করিয়া দিয়া যে সার্থকতা তাহাই যদি আমার ঘটে, তবে আমি ধন্য হইব।”
কমলা কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন দিদি, তুমি তো সবই পাইবে, তোমার তো কোনো অভাবই থাকিবে না।”
হেননলিনী কহিল, “যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ। আমার মুখে এ-সব কথা তোমার আশ্চর্য লাগিবে, আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগে, কিন্তু এ-সব কথা ঈশ্বর আমাকে ভাবাইতেছেন। জান না, বোন, আজ আমার মনে কী ভার চাপিয়া ছিল— তোমাকে পাইয়া আমার হৃদয় হালকা হইল, আমি বল পাইলাম, তাই আমি এত বকিতেছি। আমি কখনো কথা কহিতে পারি না, তুমি কেমন করিয়া আমার সব কথা টানিয়া লইতেছ ভাই ?”
নৌকাডুবি ৫৯
ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার উপরকার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা রমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল।
চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে—
তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন, সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত
সমর্পণ করিয়াছ— সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ো না। যদিও আমি এক দিনের জন্য কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল,
এ কথা তোমার কাছে আমার স্বীকার করা কর্তব্য। আজ আমার হৃদয় কী অবস্থায় আছে তাহা আমি নিশ্চয় জানি না। তুমি
যদি আমাকে ত্যাগ না করিতে তবে তোমার মধ্যে আমি আশ্রয় লাভ করিতে পারিতাম। সেই আশ্বাসেই আমি আমার বিক্ষিপ্ত
চিত্ত লইয়া তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট দেখিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করিয়া
আমার নিকট হইতে বিমুখ হইয়াছ, যখন শুনিলাম অন্যের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধে তুমি সম্মতি দিয়াছ, তখন আমারও মন
আবার দোলায়িত হইয়া উঠিল। দেখিলাম এখনো কমলাকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই। ভুলি বা না ভুলি, তাহাতে সংসারে
আমি ছাড়া আর- কাহারো কোনো ক্ষতি নাই। আমারই বা ক্ষতি কিসের ! সংসারে যে দুটি রমণীকে আমি হৃদয়ের মধ্যে
গ্রহণ করিতে পারিয়াছি তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হইবার সাধ্য আমার নাই এবং তাঁহাদিগকে চিরজীবন স্মরণ করাই আমার পরম
লাভ। আজ প্রাতে যখন তোমার সহিত ক্ষণিক সাক্ষাতের বিদ্যুদ্বৎ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম তখন
একবার মনে মনে বলিলাম, ‘আমি হতভাগ্য !’ কিন্তু আর আমি সে কথা স্বীকার করিব না। আমি সবলচিত্তে আনন্দের
সহিত তোমার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিতেছি— আমি পরিপূর্ণ-হৃদয়ে তোমার নিকট হইতে প্রস্থান করিব—তোমাদের
কল্যাণে, বিধাতার কল্যাণে, আমি অন্তরের মধ্যে এই বিদায়কালে যেন কিছুমাত্র দীনতা অনুভব না করি। তুমি সুখী হও,
তোমার মঙ্গল হউক। আমাকে তুমি ঘৃণা করিয়ো না, আমাকে ঘৃণা করিবার কোনো কারণ তোমার নাই।
অন্নদাবাবু চৌকিতে বসিয়া বই পড়িতেছিলেন। হঠাৎ হেমনলিনীকে দেখিয়া তিনি চমকিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “হেম, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?”
হেমনলিনী কহিল, “অসুখ করে নাই। বাবা, রমেশবাবুর একখানি চিঠি পাইয়াছি। এই লও, পড়া হইলে আবার আমাকে ফেরত দিয়ো।”
এই বলিয়া চিঠি দিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু চশমা লইয়া চিঠিখানি বার-দুয়েক পড়িলেন, তাহার পরে হেমনলিনীর নিকট ফেরত পাঠাইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। অবশেষে ভাবিয়া স্থির করিলেন, এ একপ্রকার ভালোই হইয়াছে। পাত্র হিসাবে রমেশের চেয়ে নলিনাক্ষ অনেক বেশি প্রার্থনীয়। ক্ষেত্র হইতে রমেশ যে আপনিই সরিয়া পড়িল, এ হইল ভালো।
এ কথা ভাবিতেছেন, এমন-সময় নলিনাক্ষ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া অন্নদাবাবু একটু আশ্চর্য হইলেন। আজ পূর্বাহ্নে নলিনাক্ষের সঙ্গে অনেক ক্ষণ দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছে, আবার কয়েক ঘণ্টা যাইতে না যাইতেই সে কী মনে করিয়া আসিল ? বৃদ্ধ মনে মনে একটুখানি হাসিয়া স্থির করিলেন, হেমনলিনীর প্রতি নলিনাক্ষের মন পড়িয়াছে।
কোনো ছুতা করিয়া হেমনলিনীর সহিত নলিনাক্ষের দেখা করাইয়া দিয়া নিজে সরিয়া যাইবেন কল্পনা করিতেছেন, এমন সময় নলিনাক্ষ কহিল, “অন্নদাবাবু, আমার সঙ্গে আপনার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব উঠিয়াছে। কথাটা বেশি দূর অগ্রসর হইবার পূর্বে আমার যাহা বক্তব্য আছে, বলিতে ইচ্ছা করি।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঠিক কথা, সে তো বলাই কর্তব্য।”
নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি জানেন না, পূর্বেই আমার বিবাহ হইয়াছে।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “জানি। কিন্তু— ”
নলিনাক্ষ। আপনি জানেন শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। কিন্তু তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ আপনি অনুমান করিতেছেন। নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। এমন-কি, তিনি বাঁচিয়া আছেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “ঈশ্বর করুন, তাহাই যেন সত্য হয়। হেম, হেম।”
হেমনলিনী আসিয়া কহিল, “কী বাবা !”
অন্নদাবাবু। রমেশ তোমাকে যে চিঠি লিখিয়াছেন, তাহার মধ্যে যে অংশটুকু—
হেমনলিনী সেই চিঠিখানি নলিনাক্ষের হাতে দিয়া কহিল, “এ চিঠির সমস্তটাই উঁহার পড়িয়া দেখা কর্তব্য।” এই বলিয়া হেমনলিনী চলিয়া গেল।
চিঠিখানি পড়া শেষ করিয়া নলিনাক্ষ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “এমন শোচনীয় ঘটনা সংসারে প্রায় ঘটে না। চিঠিখানি পড়িতে দিয়া আপনার মনে আঘাত দেওয়া হইল, কিন্তু ইহা আপনার কাছে গোপন করাও আমাদের পক্ষে অন্যায় হইত।”
নলিনাক্ষ একটুখানি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া উঠিল। চলিয়া যাইবার সময় উত্তরের বারান্দায় অদূরে হেমনলিনীকে দেখিতে পাইল।
হেমনলিনীকে দেখিয়া নলিনাক্ষের মনে আঘাত লাগিল। ঐ-যে নারী স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া, উহার স্থির-শান্ত মূর্তিটি উহার অন্তঃকরণকে কেমন করিয়া বহন করিতেছে ? এই মুহূর্তে উহার মন যে কী করিতেছে তাহা ঠিকমত জানিবার কোনো উপায় নাই; নলিনাক্ষকে তাহার কোনো প্রয়োজন আছে কি না সে প্রশ্নও করা যায় না, তাহার উত্তর পাওয়াও কঠিন। নলিনাক্ষের পীড়িত চিত্ত ভাবিতে লাগিল, ইহাকে কোনো সান্ত্বনা দেওয়া যায় কি না। কিন্তু মানুষে মানুষে কী দুর্ভেদ্য ব্যবধান ! মন জিনিসটা কী ভয়ংকর একাকী !
নলিনাক্ষ একটু ঘুরিয়া ঐ বারান্দার সামনে দিয়া গাড়িতে উঠিবে স্থির করিল, মনে করিল যদি হেমনলিনী তাহাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে। বারান্দার সম্মুখে যখন আসিল, দেখিল হেমনলিনী বারান্দা ছাড়িয়া ঘরের মধ্যে সরিয়া গেছে। হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সাক্ষাৎ সহজ নহে, মানুষের সহিত মানুষের সম্বন্ধ সরল নহে, এই কথা চিন্তা করিয়া ভারাক্রান্তচিত্তে নলিনাক্ষ গাড়িতে উঠিল।
নলিনাক্ষ চলিয়া গেলে যোগেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী যোগেন, একলা যে ?”
যোগেন্দ্র কহিল, “দ্বিতীয় আর কোন্ ব্যক্তিকে প্রত্যাশা করিতেছ শুনি ?”
অন্নদা কহিলেন, “কেন ? রমেশ ?”
যোগেন্দ্র। তাহার প্রথম দিনের অভ্যর্থনাটাই কি ভদ্রলোকের পক্ষে যথেষ্ট হয় নাই। কাশীর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়া মরিয়া যদি তাহার শিবত্বলাভ না হইয়া থাকে, তবে আর কী হইয়াছে আমি নিশ্চয় জানি না। কাল হইতে এ পর্যন্ত তাহার আর দেখা নাই, টেবিলে একখানা কাগজে লেখা আছে— ‘পালাই— তোমার রমেশ।’ এ সব কবিত্ব আমার কোনোকালে অভ্যাস নাই। সুতরাং আমাকেও এখান হইতে পালাইতে হইল, আমার হেড্মাস্টারিই ভালো, তাহাতে সমস্তই খুব স্পষ্ট— ঝাপসা কিছুই নাই।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমের জন্য তো একটা-কিছু স্থির— ”
যোগেন্দ্র। আর কেন ? আমিই কেবল স্থির করিব, আর তোমরা অস্থির করিতে থাকিবে, এ খেলা বেশি দিন ভালো লাগে না। আমাকে আর-কিছুতে জড়াইয়ো না— আমি যাহা ভালো বুঝিতে পারি না, সেটা আমার ধাতে সয় না। হঠাৎ দুর্বোধ হইয়া পড়িবার যে আশ্চর্য ক্ষমতা হেমের আছে, সেটা আমাকে কিছু কাবু করে। কাল সকালের গাড়িতে আমি বিদায় হইব, পথে বাঁকিপুরে আমার কাজ আছে।
অন্নদাবাবু চুপ করিয়া বসিয়া নিজের মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। সংসারের সমস্যা আবার দুরূহ হইয়া আসিয়াছে।
নৌকাডুবি ৬০
শৈলজা এবং তাহার পিতা নলিনাক্ষের বাড়িতে আসিয়াছেন। শৈলজা কমলাকে লইয়া একটা কোণের ঘরে বসিয়া ফিস্ফিস্ করিতেছিল, চক্রবর্তী ক্ষেমংকরীর সঙ্গে আলাপ করতেছিলেন।
চক্রবর্তী। আমার তো ছুটি ফুরাইয়া আসিল, কালই গাজিপুরে যাইতে হইবে। যদি হরিদাসী আপনাদের কোনোরকমে বিরক্ত করিয়া থাকে, বা যদি আপনাদের পক্ষে—
ক্ষেমংকরী। ও আবার কী রকম কথা চক্রবর্তীমশায় ? আপনার মনের ভাবটা কী শুনি। আপনি কি কোনো ছুতা করিয়া আপনাদের মেয়েটিকে ফিরাইয়া লইতে চান ?
চক্রবর্তী। আমাকে তেমন লোক পান নাই। আমি দিয়া ফিরাইয়া লইবার পাত্র নই, কিন্তু যদি আপনার কিছুমাত্র অসুবিধা হয়—
ক্ষেমংকরী। চক্রবর্তীমশায়, ওটা আপনার সরল কথা নয়— মনে মনে বেশ জানেন, হরিদাসীর মতো অমন লক্ষ্মী মেয়েটিকে কাছে রাখিলে সুবিধার সীমা নাই, তবু—
চক্রবর্তী। না না, আর বলিতে হইবে না, আমি ধরা পড়িয়া গেছি। ওটা একটা ছলমাত্র— আপনার মুখে হরিদাসীর গুণ শুনিবার জন্যই কথাটা আমার পাড়া। কিন্তু একটা ভাবনা আছে— পাছে নলিনাক্ষবাবু মনে করেন যে, এ আবার একটা উপসর্গ কোথা হইতে ঘাড়ে পড়িল। আমাদের মেয়েটি অভিমানী, যদি নলিনাক্ষের লেশমাত্র বিরক্তিভাবও দেখিতে পায় তবে উহার পক্ষে বড়ো কঠিন হইবে।
ক্ষেমংকরী। হরি বলো ! নলিনের আবার বিরক্তি ! ওর সে ক্ষমতাই নাই।
চক্রবর্তী। সে কথা ঠিক। কিন্তু দেখুন, হরিদাসীকে আমি নাকি প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, তাই তার সম্বন্ধে আমি অল্পে সন্তুষ্ট হইতে পারি না। নলিনাক্ষ যে ওর ’পরে বিরক্ত হইবেন না, উদাসীনের মতো থাকিবেন, এইটুকুই আমার পক্ষে যথেষ্ট মনে হয় না। তাঁর বাড়িতে যখন হরিদাসী আছে তখন তাকে তিনি আপনার লোক বলিয়া স্নেহ করিবেন, এ না হইলে মনে বড়ো সংকোচ বোধ হয়। ও তো ঘরের দেয়াল নয়, ও একটা মানুষ— ওর প্রতি বিরক্তও হইবেন না, স্নেহও করিবেন না, ও আছে তো আছে, এইটুকুমাত্র সম্বন্ধ, সেটা যেন কেমন—
ক্ষেমংকরী। চক্রবর্তীমশায়, আপনি বেশি ভাবিবেন না— কোনো লোককে আপনার লোক বলিয়া স্নেহ করা আমার নলিনের পক্ষে শক্ত নয়। বাহির হইতে কিছুই বুঝিবার জো নাই, কিন্তু এই-যে হরিদাসী আমার এখানে আছে, ও কিসে স্বচ্ছন্দে থাকে, ওর কিসে ভালো হয়, সে চিন্তা নিশ্চয়ই নলিনের মনে লাগিয়া আছে, খুব সম্ভব, সেরকম ব্যবস্থাও সে কিছু-না-কিছু করিতেছে, আমরা তাহা জানিতেও পারিতেছি না।
চক্রবর্তী। শুনিয়া বড়ো নিশ্চিন্ত হইলাম। তবু আমি যাইবার আগে একবার বিশেষ করিয়া নলিনাক্ষবাবুকে বলিয়া যাইতে চাই। একটি স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ ভার লইতে পারে, এমন পুরুষ জগতে অল্পই মেলে; ভগবান যখন নলিনাক্ষবাবুকে সেই যথার্থ পৌরুষ দিয়াছেন তখন তিনি যেন মিথ্যা সংকোচে হরিদাসীকে তফাতে রাখিয়া না চলেন, তিনি যেন যথার্থ আত্মীয়ের মতো তাহাকে নিতান্ত সহজভাবে গ্রহণ ও রক্ষা করেন, তাঁহার কাছে এই প্রার্থনাটি জানাইতে চাই।
নলিনাক্ষের প্রতি চক্রবর্তীর এই বিশ্বাস দেখিয়া ক্ষেমংকরীর মন গলিয়া গেল। তিনি কহিলেন, “পাছে আপনারা কিছু মনে করেন এই ভয়েই হরিদাসীকে আমি নলিনাক্ষের সামনে তেমন করিয়া বাহির হইতে দিই নাই; কিন্তু আমার ছেলেকে আমি তো জানি, তাহাকে বিশ্বাস করিয়া আপনি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন।”
চক্রবর্তী। তবে আপনার কাছে সব কথা খোলসা করিয়াই বলি। শুনিয়াছি, নলিনাক্ষবাবুর বিবাহের প্রস্তাব হইতেছে; বধূটির বয়সও নাকি অল্প নয় এবং তাঁহার শিক্ষাদীক্ষা আমাদের সমাজের সঙ্গে মেলে না। তাই ভাবিতেছিলাম, হয়তো হরিদাসীর—
ক্ষেমংকরী। সে আর আমি বুঝি না ? সে হইলে ভাবনা ছিল বৈকি। কিন্তু সে বিবাহ হইবে না—
চক্রবর্তী। সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে ?
ক্ষেমংকরী। গড়েই নি, তার ভাঙিবে কী। নলিনের একেবারেই ইচ্ছা ছিল না, আমিই জেদ করিতেছিলাম। কিন্তু সে জেদ ছাড়িয়াছি। যাহা হইবার নয় তাহা জোর করিয়া ঘটাইয়া মঙ্গল নাই। ভগবানের কী ইচ্ছা জানি না, মরিবার পূর্বে বুঝি আর বউ দেখিয়া যাইতে পারিলাম না।
চক্রবর্তী। অমন কথা বলিবেন না। আমরা আছি কী করিতে ? ঘটক-বিদায় এবং মিষ্টান্ন-আদায় না করিয়া ছাড়িব বুঝি ?
ক্ষেমংকরী। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক চক্রবর্তীমশায়। আমার মনে বড়ো দুঃখ আছে যে, নলিন এই বয়সে আমারই জন্যে সংসারধর্মে প্রবেশ করিতে পারিল না। তাই আমি বড়ো ব্যস্ত হইয়া সকল দিক না ভাবিয়া একটা সম্বন্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম— সে আশা ত্যাগ করিয়াছি, কিন্তু আপনারা একটা দেখিয়া দিন। দেরি করিবেন না— আমি বেশি দিন বাঁচিব না।
চক্রবর্তী। ও কথা বলিলে শুনিব কেন। আপনাকে বাঁচিতেও হইবে, বউয়েরও মুখ দেখিবেন। আপনার যেরকম বউটি দরকার, সে আমি ঠিক জানি; নিতান্ত কচি হইলেও চলিবে না, অথচ আপনাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করিবে, বাধ্য হইয়া চলিবে— এ নহিলে আমাদের পছন্দ হইবে না। তা, সে আপনি কিছুই ভাবিবেন না, ঈশ্বরের কৃপায় নিশ্চয়ই সে ঠিক হইয়াই আছে। এখন যদি অনুমতি করেন, একবার হরিদাসীকে তার কর্তব্য সম্বন্ধে দু-চারটে কথা উপদেশ করিয়া আসি, অমনি শৈলকেও এখানে পাঠাইয়া দিই— আপনাকে দেখিয়া অবধি আপনার কথা তাহার মুখে আর ধরে না।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “না, আপনারা তিন জনেই এক ঘরে গিয়া বসুন, আমার একটু কাজ আছে।”
চক্রবর্তী হাসিয়া কহিলেন, “জগতে আপনাদের কাজ আছে বলিয়াই আমাদের কল্যাণ। কাজের পরিচয় নিশ্চয় যথাসময়ে পাওয়া যাইবে। নলিনাক্ষবাবুর বধূর কল্যাণে ব্রাহ্মণের ভাগ্যে মিষ্টান্নের পালা শুরু হউক।”
চক্রবর্তী, শৈল ও কমলার কাছে আসিয়া দেখিলেন, কমলার দুটি চক্ষু চোখের জলের আভাসে এখনো ছল্ছল্ করিতেছে ! চক্রবর্তী শৈলজার পাশে বসিয়া নীরবে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। শৈল কহিল, “বাবা, আমি কমলকে বলিতেছিলাম যে, নলিনাক্ষবাবুকে সকল কথা খুলিয়া বলিবার এখন সময় হইয়াছে, তাই লইয়া তোমার এই নির্বোধ হরিদাসী আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতেছে।”
কমলা বলিয়া উঠিল, “না দিদি, না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি এমন কথা মুখে আনিয়ো না। সে কিছুতেই হইবে না।”
শৈল কহিল, “কী তোমার বুদ্ধি ! তুমি চুপ করিয়া থাকো, আর হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষবাবুর বিবাহ হইয়া যাক। বিবাহের পরদিন হইতে আর আজ পর্যন্ত কেবলই তো যত রাজ্যের অঘটন ঘটনার মধ্যে পাক খাইয়া মরিলি, আবার আর-একটা নূতন অনাসৃষ্টির দরকার কী ?”
কমলা কহিল, “দিদি, আমার কথা কাহাকেও বলিবার নয়, আমি সব সহিতে পারিব, সে লজ্জা সহিতে পারিব না। আমি যেমন আছি, বেশ আছি, আমার কোনো দুঃখ নাই, কিন্তু যদি সব কথা প্রকাশ করিয়া দাও তবে আমি কোন্ মুখে আর একদণ্ড এ বাড়িতে থাকিব ? তবে আমি বাঁচিব কেমন করিয়া ?”
শৈল এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাই বলিয়া হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের বিবাহ হইয়া যাইবে ইহা চুপ করিয়া সহ্য করা তাহার পক্ষে বড়ো কঠিন।
চক্রবর্তী কহিলেন, “যে বিবাহের কথা বলিতেছ সেটা ঘটিতেই হইবে, এমন কী কথা আছে !”
শৈল। বল কী বাবা, নলিনাক্ষবাবুর মা যে আশীর্বাদ করিয়া আসিয়াছেন !
চক্রবর্তী। বিশ্বেশ্বরের আশীর্বাদে সে আশীর্বাদ ফাঁসিয়া গেছে। মা কমল, তোমার কোনো ভয় নাই, ধর্ম তোমার সহায় আছেন।
কমলা সব কথা স্পষ্ট না বুঝিয়া দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া খুড়ামশায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
তিনি কহিলেন, “সে বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে। এ বিবাহে নলিনাক্ষবাবুও রাজি নহেন এবং তাঁহার মার মাথায়ও সুবুদ্ধি আসিয়াছে।”
শৈলজা ভারি খুশি হইয়া কহিল, “বাঁচা গেল বাবা ! কাল এই খবরটা শুনিয়া রাত্রে আমি ঘুমাইতে পারি নাই। কিন্তু সে যাই হোক, কমল কি নিজের ঘরে চিরদিন এমনি পরের মতো কাটাইবে ? কবে সব পরিষ্কার হইয়া যাইবে ?”
চক্রবর্তী। ব্যস্ত হোস কেন শৈল ? যখন ঠিক সময় আসিবে তখন সমস্ত সহজ হইয়া যাইবে।
কমলা কহিল, “এখন যা হইয়াছে এই সহজ, এর চেয় সহজ আর-কিছু হইতে পারে না। আমি বেশ সুখে আছি, আমাকে এর চেয়ে সুখ দিতে গিয়া আবার আমার ভাগ্যকে ফিরাইয়া দিয়ো না খুড়ামশায় ! আমি তোমাদের পায়ে ধরি, তোমরা কাহাকেও কিছু বলিয়ো না, আমাকে এই ঘরের একটা কোণে ফেলিয়া আমার কথা ভুলিয়া যাও। আমি খুব সুখে আছি।”
বলিতে বলিতে কমলার দুই চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
চক্রবর্তী ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, “ও কী, মা, কাঁদ কেন ? তুমি যাহা বলিতেছ আমি বেশ বুঝিতেছি। তোমার এই শান্তিতে আমরা কি হাত দিতে পারি ? বিধাতা আপনি যা ধীরে ধীরে করিতেছেন, আমরা নির্বোধের মতো তার মধ্যে পড়িয়া কি সমস্ত ভণ্ডুল করিয়া দিব ? কোনো ভয় নাই। আমার এত বয়স হইয়া গেল, আমি কি স্থির হইয়া থাকিতে জানি না ?”
এমন সময় উমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া তাহার আকর্ণবিস্ফারিত হাস্য লইয়া দাঁড়াইল।
খুড়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রে উম্শে, খবর কী ?”
উমেশ কহিল, “রমেশবাবু নীচে দাঁড়াইয়া আছেন, ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।”
কমলার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। খুড়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলেন; কহিলেন “ভয় নাই মা, আমি সব ঠিক করিয়া দিতেছি।”
খুড়া নীচে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া কহিলেন, “আসুন রমেশবাবু, রাস্তায় বেড়াইতে বেড়াইতে আপনার সঙ্গে গোটা-দুয়েক কথা কহিব।”
রমেশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, “খুড়ামশায়, আপনি এখানে কোথা হইতে ?”
খুড়া কহিলেন, “আপনার জন্য আছি; দেখা হইল, বড়ো ভালোই হইল। আসুন, আর দেরি নয়, কাজের কথাটা শেষ করিয়া ফেলা যাক !”
বলিয়া রমেশকে রাস্তায় টানিয়া লইয়া কিছুদূর গিয়া কহিলেন, “রমেশবাবু, আপনি এ বাড়িতে কেন আসিয়াছেন ?”
রমেশ কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে খুঁজিতে আসিয়াছিলাম। তাঁহাকে কমলার কথা আগাগোড়া সমস্ত খুলিয়া বলা উচিত স্থির করিয়াছি। আমার এক-একবার মনে হয়, হয়তো কমলা বাঁচিয়া আছে।”
খুড়া কহিলেন, “যদি কমলা বাঁচিয়াই থাকে এবং যদি নলিনাক্ষের সঙ্গে তার দেখা হয়, তবে আপনার মুখে নলিনাক্ষ সমস্ত ইতিহাস শুনিলে কি সুবিধা হইবে। তাঁহার বৃদ্ধা মা আছেন, তিনি এ-সব কথা জানিতে পারিলে কমলার পক্ষে কি ভালো হইবে ?”
রমেশ কহিল, “সামাজিক হিসাবে কী ফল হইবে জানি না, কিন্তু কমলাকে যে কোনো অপরাধ স্পর্শ করে নাই সেটা তো নলিনাক্ষের জানা চাই। কমলার যদি মৃত্যুই হইয়া থাকে, তবে নলিনাক্ষবাবু তাঁহার স্মৃতিকে তো সম্মান করিতে পারিবেন।”
খুড়া কহিলেন, “আপনাদের ও-সব একেলে কথা আমি কিছু বুঝিতে পারি না— কমলা যদি মরিয়াই থাকে তবে তাহার এক রাত্রির স্বামীর কাছে তাহার স্মৃতিটাকে লইয়া টানাটানি করিবার কোনো দরকার দেখি না। ঐযে বাড়িটা দেখিতেছেন ঐ বাড়িতে আমার বাসা। কাল সকালে যদি একবার আসিতে পারেন, তবে আপনাকে সব কথা স্পষ্ট করিয়া বলিব। কিন্তু তাহার পূর্বে নলিনাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা করিবেন না, এই আমার অনুরোধ।”
রমেশ বলিল, “আচ্ছা।”
খুড়া ফিরিয়া আসিয়া কমলাকে কহিলেন, “মা, কাল সকালে তোমাকে আমাদের বাড়িতে যাইতে হইবে। সেখানে তুমি নিজে রমেশবাবুকে বুঝাইয়া বলিবে, এই আমি স্থির করিয়াছি।”
কমলা মাথা নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। খুড়া কহিলেন, “আমি নিশ্চয় জানি তাহা না হইলে চলিবে না— একেলে ছেলেদের কর্তব্যবুদ্ধি সেকেলে লোকের কথায় ভোলে না। মা, মন হইতে সংকোচ দূর করিয়া ফেলো— এখন তোমার যেখানে অধিকার অন্য লোককে আর সেখানে পদার্পণ করিতে দিবে না, এ তো তোমারই কাজ। এ সম্বন্ধে আমাদের তো তেমন জোর খাটিবে না।”
কমলা তবু মুখ নিচু করিয়া রহিল। খুড়া কহিলেন, “মা, অনেকটা পরিষ্কার হইয়া আসিয়াছে, এখন এই ছোটোখাটো জঞ্জালগুলো শেষবারের মতো ঝাঁটাইয়া ফেলিতে সংকোচ করিয়ো না।”
এমন সময় পদশব্দ শুনিয়া কমলা মুখ তুলিয়াই দেখিল, দ্বারের সম্মুখে নলিনাক্ষ। একেবারে তাহার চোখের উপরেই নলিনাক্ষের দুই চোখ পড়িয়া গেল— অন্যদিন নলিনাক্ষ যেমন তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরাইয়া চলিয়া যায়, আজ যেন তেমন তাড়া করিল না। যদিও ক্ষণকালমাত্র কমলার দিকে সে চাহিয়াছিল, কিন্তু তাহার সেই ক্ষণকালের দৃষ্টি কমলার মুখ হইতে কী যেন আদায় করিয়া লইল, অন্য দিনের মতো অনধিকারের সংকোচে দেখিবার জিনিসটিকে প্রত্যাখ্যান করিল না। পরমুহূর্তেই শৈলজাকে দেখিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই খুড়া কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, পালাইবেন না— আপনাকে আমরা আত্মীয় বলিয়াই জানি। এটি আমার মেয়ে শৈল, এরই মেয়েকে আপনি চিকিৎসা করিয়াছেন।”
শৈল নলিনাক্ষকে নমস্কার করিল এবং নলিনাক্ষ প্রতিনমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার মেয়েটি ভালো আছে ?”
শৈল কহিল, “ভালো আছে।”
খুড়া কহিলেন, “আপনাকে যে পেট ভরিয়া দেখিয়া লইব এমন অবসর তো আপনি দেন না— এখন, আসিলেন যদি তো একটু বসুন।”
নলিনাক্ষকে বসাইয়া খুড়া দেখিলেন, পশ্চাৎ হইতে কমলা কখন সরিয়া পড়িয়াছে। নলিনাক্ষের সেই এক মুহূর্তের দৃষ্টিটি লইয়া সে পুলকিত বিস্ময়ে আপনার ঘরে মনটাকে সংবরণ করিতে গেছে। ইতিমধ্যে ক্ষেমংকরী আসিয়া কহিলেন, “চক্রবর্তীমশায়, কষ্ট করিয়া একবার উঠিতে হইতেছে।”
চক্রবর্তী কহিলেন, “যখনই আপনি কাজে গেলেন তখন হইতেই এটুকু কষ্টের জন্য আমি পথ চাহিয়া বসিয়া ছিলাম।”
আহার সমাধা হইলে পর বসিবার ঘরে আসিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “একটু বসুন, আমি আসিতেছি।”
বলিয়া পরক্ষণেই অন্য ঘর হইতে কমলার হাত ধরিয়া তাহাকে নলিনাক্ষ ও ক্ষেমংকরীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিলেন, তাঁহার পশ্চাতে শৈলজাও আসিল।
চক্রবর্তী কহিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, আপনি আমাদের হরিদাসীকে পর মনে করিয়া সংকোচ করিবেন না— এই দুঃখিনীকে আপনাদেরই ঘরে আমি রাখিয়া যাইতেছি, ইহাকে সম্পূর্ণই আপনাদের করিয়া লইবেন। ইহাকে আর-কিছু দিতে হইবে না, আপনাদের সকলের সেবা করিবার সম্পূর্ণ অধিকার দিবেন— আপনি নিশ্চয়ই জানিবেন, আপনাদের কাছে জ্ঞানপূর্বক এ একদিনের জন্যও অপরাধিনী হইবে না।”
কমলা লজ্জায় মুখখানি রাঙা করিয়া নতশিরে বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “চক্রবর্তীমশায়, আপনি কিছুই ভাবিবেন না, হরিদাসী আমাদের ঘরের মেয়েই হইল। ওকে আমাদের কোনো কাজ দিবার জন্য আমাদের তরফ হইতে আজ পর্যন্ত কোনো চেষ্টা করিবার দরকারই হয় নাই। এ বাড়ির রান্নাঘরে ভাঁড়ার-ঘরে এতদিন আমার শাসনই একমাত্র প্রবল ছিল, এখন আমি সেখানে কেহই না। চাকর-বাকররাও আমাকে আর বাড়ির গৃহিণী বলিয়া গণ্যই করে না। কেমন করিয়া যে আস্তে আস্তে আমার এমন অবস্থাটা হইল, তাহা আমি টেরও পাইলাম না। আমার গোটাকয়েক চাবি ছিল, সেও কৌশল করিয়া হরিদাসী আত্মসাৎ করিয়াছে— চক্রবর্তীমশায়, আপনার এই ডাকাত মেয়েটির জন্যে আপনি আর কী চান বলুন দেখি ! এখন সব চেয়ে বড়ো ডাকাতি হয় যদি আপনি বলেন, এই মেয়েটিকে আমরা লইয়া যাইব।”
চক্রবর্তী কহিলেন, “আমি যেন বলিলাম, কিন্তু মেয়েটি কি নড়িবে ? তা মনেও করিবেন না। উহাকে আপনারা এমন ভুলাইয়াছেন যে, আজ আপনারা ছাড়া ও আর পৃথিবীতে কাহাকেও জানে না। দুঃখের জীবনে এতদিন পরে ও আপনাদের কাছেই আজ শান্তি পাইয়াছে— ভগবান ওর সেই শান্তি নির্বিঘ্ন করুন, আপনারা চিরদিন ওর ’পরে প্রসন্ন থাকুন, উহাকে সেই আশীর্বাদ করি।”
বলিতে বলিতে চক্রবর্তীর চক্ষু সজল হইয়া আসিল। নলিনাক্ষ কিছু না বলিয়া স্তব্ধ হইয়া চক্রবর্তীর কথা শুনিতেছিল; যখন সকলে বিদায় লইয়া গেলেন তখন ধীরে ধীরে সে আপনার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। তখন শীতের সূর্যাস্তকাল তাহার সমস্ত শয়নঘরটিকে নববিবাহের রক্তিমচ্ছটায় রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল। সেই রক্তবর্ণের আভা নলিনাক্ষের সমস্ত রোমকূপ ভেদ করিয়া তাহার অন্তঃকরণকে যেন রাঙাইয়া তুলিল।
আজ সকালে নলিনাক্ষের এক হিন্দুস্থানি বন্ধুর কাছ হইতে এক টুকরি গোলাপ আসিয়াছিল। ঘর সাজাইবার জন্য সেই গোলাপের টুকরি ক্ষেমংকরী কমলার হাতে দিয়াছিলেন। নলিনাক্ষের শয়নঘরের প্রান্তে একটি ফুলদানি হইতে সেই গোলাপের গন্ধ তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। সেই নিস্তব্ধ ঘরের বাতায়নের আরক্ত সন্ধ্যার সঙ্গে গোলাপের গন্ধ মিশিয়া নলিনাক্ষের মনকে কেমন যেন উতলা করিয়া তুলিল। এতদিন তাহার বিশ্বে চারি দিকে সংযমের শান্তি, জ্ঞানের গম্ভীরতা ছিল, আজ সেখানে হঠাৎ এমন নানা সুরের নহবত বাজিয়া উঠিল কোথা হইতে— কোন্ অদৃশ্য নৃত্যের চরণক্ষেপে ও নূপুরঝংকারে আজ আকাশতল এমন চঞ্চল হইয়া উঠিতে লাগিল !
নলিনাক্ষ জানলা হইতে ফিরিয়া ঘরের মধ্যে চাহিয়া দেখিল, তাহার বিছানার শিয়রের কাছে কুলুঙ্গির উপরে গোলাপফুলগুলি সাজানো রহিয়াছে। এই ফুলগুলি জানি না কাহার চোখের মতো তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, নিঃশব্দ আত্মনিবেদনের মতো তাহার হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে নত হইয়া পড়িল।
নলিনাক্ষ ইহার মধ্যে একটি ফুল তুলিয়া লইল— সেটি কাঁচা সোনার রঙের হলদে গোলাপ,পাপড়িগুলি খোলে নাই, কিন্তু গন্ধ লুকাইতে পারিতেছে না। সেই গোলাপটি হাতে লইতেই যেন সে কাহার আঙুলের মতো তাহার আঙুলকে স্পর্শ করিল, তাহার শরীরের সমস্ত স্নায়ুতন্তুকে রিমিঝিমি করিয়া বাজাইয়া তুলিল। নলিনাক্ষ সেই স্নিগ্ধকোমল ফুলটিকে নিজের মুখের উপরে, চোখের পল্লবের উপরে বুলাইতে লাগিল !
দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যাকাশ হইতে অস্তসূর্যের আভা মিলাইয়া আসিল। নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইবার পূর্বে একবার তাহার বিছানার কাছে গিয়া শয্যার আচ্ছাদনটি তুলিয়া ফেলিল এবং মাথার বালিশের উপর সেই গোলাপফুলটি রাখিল। রাখিয়া উঠিয়া আসিবে, এমন সময় খাটের ও পাশে মেঝের উপরে ও কে অঞ্চলে মুখ ঝাঁপিয়া লজ্জায় একেবারে মাটিতে মিশাইতে চাহিল ! হায় রে কমলা, লজ্জা রাখিবার আর স্থান নাই। সে আজ কুলুঙ্গিতে গোলাপ সাজাইয়া স্বহস্তে নলিনাক্ষের বিছানা করিয়া বাহির হইয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ নলিনাক্ষের পায়ের শব্দ শুনিয়া তাড়াতাড়ি বিছানার ও পাশে গিয়া লুকাইয়াছিল— এখন পালানোও অসম্ভব, লুকানোও কঠিন। তাহার রাশীকৃত-লজ্জা-সমেত এই ধূলির উপরে সে এমন একান্তভাবে ধরা পড়িয়া গেল।
নলিনাক্ষ এই লজ্জিতাকে মুক্তি দিবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিল। দরজা পর্যন্ত গিয়া একবার দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ কী ভাবিয়া সে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল; কমলার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, “তুমি ওঠো, আমার কাছে তোমার কোনো লজ্জা নাই।”
নৌকাডুবি ৬১
পরদিন সকালেই কমলা খুড়ামশায়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। যখন নির্জনে একটু অবকাশ পাইল অমনি সে শৈলজাকে জড়াইয়া ধরিল; শৈল কমলার চিবুক ধরিয়া কহিল, “কী বোন, এত খুশি কিসের ?”
কমলা কহিল, “আমি জানি না দিদি, কিন্তু আমার মনে হইতেছে, যেন আমার জীবনের সমস্ত ভার চলিয়া গেছে।”
শৈল। বল্-না, সব কথা বল্-না আমাকে। এই তো কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ছিলাম, তার পরে তোর হইল কী ?
কমলা। এমন কিছুই হয় নাই, কিন্তু আমার কেবলই মনে হইতেছে, আমি যেন তাঁহাকে পাইয়াছি, ঠাকুর যেন আমার ’পরে সদয় হইয়াছেন।
শৈল। তাই হোক বোন, কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকোস নে।
কমলা। আমার লুকাইবার কিছুই নাই দিদি, কী যে বলিবার আছে, তাও খুঁজিয়া পাই না। রাত পোহাইতেই সকালে উঠিয়া মনে হইল আমার জীবনটা সার্থক— আমার সমস্ত দিনটা এমন মিষ্ট, আমার সমস্ত কাজ এমন হালকা হইয়া গেছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি ইহার চেয়ে আর বেশি কিছুই চাই না— কেবল ভয় হয় পাছে এটুকু নষ্ট হয়— আমি যে প্রতিদিন এমন করিয়া দিন কাটাইতে পারিব, আমার ভাগ্য যে এত প্রসন্ন হইবে, তাহা আমি মনে করিতেই পারি না।
শৈল। আমি তোকে বলিতেছি বোন, তোর ভাগ্য তোকে এইটুকু দিয়াই ফাঁকি দিবে না, তোর যাহা পাওনা আছে তার সমস্তই শোধ হইবে।
কমলা। না না দিদি, ও কথা বলিয়ো না— আমার সমস্ত শোধ হইয়াছে, আমি বিধাতাকে কোনো দোষ দিই না, আমার কোনো অভাব নাই।
এমন সময় খুড়া আসিয়া কহিলেন, “মা, তোমাকে তো একবার বাহিরে আসিতে হইতেছে, রমেশবাবু আসিয়াছেন।”
খুড়া এতক্ষণ রমেশের সঙ্গেই কথা কহিতেছিলেন। রমেশকে বলিতেছিলেন “আপনার সঙ্গে কমলার কী সম্বন্ধ, তাহা আমি সমস্তই জানিয়াছি। এখন আপনার প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, আপনার জীবন এখন পরিষ্কার হইয়া গেছে, এখন আপনি কমলার সমস্ত প্রসঙ্গ একেবারে পরিত্যাগ করুন। কমলা সম্বন্ধে যদি কোনো গ্রন্থি কোথাও মোচন করিবার প্রয়োজন থাকে তবে বিধাতার উপর সে ভার দিন, আপনি আর হাত দিবেন না।”
রমেশ ইহার উত্তরে কহিতেছিল, “কমলা সম্বন্ধে সকল কথা নিঃশেষে পরিত্যাগ করিবার পূর্বে নলিনাক্ষের কাছে সকল ঘটনা না জানাইয়া আমার নিষ্কৃতি হইতেই পারে না। এ পৃথিবীতে কমলার কথা তুলিবার সমস্ত প্রয়োজন হয়তো শেষ হইয়া গেছে, হয়তো শেষ হয় নাই— যদি না হইয়া থাকে তবে আমার যেটুকু বক্তব্য সেটুকু সারিয়া ছুটি পাইতে চাই।”
খুড়া কহিলেন, “আচ্ছা, আপনি একটুখানি বসুন, আমি আসিতেছি।”
রমেশ ঘুরিয়া বসিয়া জানলা হইতে শূন্যদৃষ্টিতে লোকপ্রবাহের দিকে চাহিয়া রহিল; কিছুক্ষণ পরেই পায়ের শব্দে সতর্ক হইয়া দেখিল, একটি রমণী ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া তাহাকে প্রণাম করিল। যখন সে প্রণাম করিয়া উঠিল তখন রমেশ আর বসিয়া থাকিতে পারিল না; তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “কমলা !” কমলা স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
খুড়া কহিলেন, “রমেশবাবু, কমলার সমুদয় দুঃখকে সৌভাগ্যে পরিণত করিয়া ঈশ্বর তাহার চারি দিক হইতে সমস্ত কুয়াশা কাটিয়া দিতেছেন। আপনি তাহাকে পরম সংকটের সময় যেমন রক্ষা করিয়াছেন, তাহার জন্য যে বিষম দুঃখ আপনাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে, তাহাতে আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ ছেদনের সময় কোনো কথা না বলিয়া কমলা বিদায় লইতে পারে না। আপনার কাছে ও আজ আশীর্বাদ লইতে আসিয়াছে।”
রমেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া সবলে রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “তুমি সুখী হও কমলা— আমি না জানিয়া এবং জানিয়া তোমার কাছে যা-কিছু অপরাধ করিয়াছি, সব মাপ করিয়ো।”
কমলা ইহার উত্তরে কিছুই বলিতে পারিল না, দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
রমেশ কিছুক্ষণ পরে কহিল, “যদি কাহাকেও কিছু বলিবার জন্য, কোনো বাধা দূর করিবার জন্য, আমাকে তোমার প্রয়োজন থাকে তো বলো।”
কমলা জোড়হাত করিয়া কহিল, “আমার কথা কাহারো কাছে বলিবেন না, আমার এই মিনতি রাখিবেন।”
রমেশ কহিল, “অনেক দিন তোমার কথা কাহারো কাছে বলি নাই, খুব গোলমালে পড়িলেও চুপ করিয়া কাটাইয়াছি। অল্পদিন হইল, যখন মনে করিয়াছিলাম তোমার কথা বলিলে তোমার কোনো ক্ষতি হইবে না, তখনই কেবল একটি পরিবারের কাছে তোমার কথা প্রকাশ করিয়াছি। তাহাতেও বোধ হয় তোমার অনিষ্ট না হইয়া ভালোই হইতে পারে। খুড়ামশায় বোধ হয় খবর পাইয়া থাকিবেন— অন্নদাবাবু, যাঁহার মেয়ের সঙ্গে— ”
খুড়া কহিলেন, “হেমনলিনী, জানি বৈকি। তাঁহারা সব শুনিয়াছেন ?”
রমেশ কহিল, “হাঁ। তাঁহাদের কাছে আর কিছু বলা যদি প্রয়োজন বোধ করেন তবে আমি যাইতে পারি-কিন্তু আমার আর ইচ্ছা নাই— আমার অনেক সময় গেছে এবং আরো আমার অনেক গেছে, এখন আমি মুক্তি চাই— হাত-নাগাদ সমস্ত দেনা-পাওনা শোধ করিয়া দিয়া এখন বাহির হইতে পারিলে বাঁচি !”
খুড়া রমেশের হাত ধরিয়া সস্নেহকণ্ঠে কহিলেন, “না রমেশবাবু, আপনাকে আর কিছুই করিতে হইবে না। আপনাকে অনেক বহন করিতে হইয়াছে, এখন ভারমুক্ত হইয়া নিজেকে স্বাধীনভাবে চালনা করুন, সুখী হউন, সার্থক হউন, এই আমার আশীর্বাদ !”
যাইবার সময় রমেশ কমলার দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি তবে চলিলাম।”
কমলা কোনো কথা না কহিয়া আর-একবার ভূতলে মাথা ঠেকাইয়া রমেশকে প্রণাম করিল।
রমেশ পথে বাহির হইয়া স্বপ্নাবিষ্টের মতো চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল, ‘কমলার সঙ্গে দেখা হইল, ভালোই হইল; দেখা না হইলে এ পালাটা ভালো করিয়া শেষ হইত না। যদিও ঠিক জানিলাম না, কমলা কী জানিয়া কী বুঝিয়া সে রাত্রে হঠাৎ গাজিপুরের বাংলা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল, কিন্তু ইহা বুঝা গেছে, আমি এখন সম্পূর্ণই অনাবশ্যক। এখন আমার আবশ্যক কেবল নিজের জীবনটুকু লইয়া, এখন তাহাকেই সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়া পৃথিবীতে বাহির হইলাম— আমার আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইবার কোনো প্রয়োজন নাই।’
নৌকাডুবি ৬২
কমলা বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল— অন্নদাবাবু ও হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর কাছে বসিয়া আছে। কমলাকে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এই-যে হরিদাসী, তোমার বন্ধুকে তোমার ঘরে লইয়া যাও বাছা ! আমি অন্নদাবাবুকে চা খাওয়াইতেছি।”
কমলার ঘরে প্রবেশ করিয়াই হেমনলিনী কমলার গলা ধরিয়া কহিল, “কমলা !”
কমলা খুব বেশি বিস্মিত না হইয়া কহিল, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে আমার নাম কমলা।”
হেমনলিনী কহিল, “একজনের কাছে আমি তোমার জীবনের ঘটনা সব শুনিয়াছি। যেমনি শুনিলাম অমনি তখনই আমার মনে সন্দেহ রহিল না তুমিই কমলা। কেন যে, তা বলিতে পারি না।”
কমলা কহিল, “ভাই, আমার নাম যে কেহ জানে সে আমার ইচ্ছা নয়। আমার নিজের নামে একেবারে ধিক্কার জন্মিয়া গেছে।”
হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু ঐ নামের জোরেই তো তোমাকে তোমার অধিকার পাইতে হইবে।”
কমলা মাথা নাড়িয়া কহিল, “ও আমি বুঝি না। আমার জোর কিছুই নাই, আমার অধিকার কিছুই নাই, আমি জোর খাটাইতেই চাই না।”
হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু তোমার স্বামীকে তোমার পরিচয় হইতে বঞ্চিত করিবে কী বলিয়া। তোমার ভালোমন্দ সবই কি তাঁহার কাছে নিবেদন করিবে না ? তাঁর কাছে কি কিছু লুকানো চলিবে ?”
হঠাৎ কমলার মুখ যেন বিবর্ণ হইয়া গেল— সে কোনো উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া নিরূপায়ভাবে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। আস্তে আস্তে কমলা মেজের মাদুরের ’পরে বসিয়া পড়িল; কহিল, “ভগবান তো জানেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই, তবে তিনি কেন আমাকে এমন করিয়া লজ্জায় ফেলিবেন ? যে পাপ আমার নয় তার শাস্তি আমাকে কেন দিবেন ? আমি কেমন করিয়া তাঁর কাছে আমার সব কথা প্রকাশ করিব ?”
হেমনলিনী কমলার হাত ধরিয়া কহিল, “শাস্তি নয় ভাই, তোমার মুক্তি হইবে। যতদিন তুমি তোমার স্বামীর কাছে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতেছ ততদিন তুমি আপনাকে একটা মিথ্যার বন্ধনে জড়িত করিতেছ-তাহা তেজের সহিত ছিঁড়িয়া ফেলো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করিবেনই।”
কমলা কহিল, “আবার পাছে সব হারাই এই ভয় যখন মনে আসে তখন সব বল চলিয়া যায়। কিন্তু তুমি যা বলিতেছ আমি তা বুঝিয়াছি— অদৃষ্টে যা থাকে তা হোক, কিন্তু তাঁর কাছে আপনাকে লুকানো আর চলিবে না, তিনি আমার সবই জানিবেন।”
এই বলিতে বলিতে সে আপনার দুই হাত দৃঢ়বলে বদ্ধ করিল।
হেমনলিনী সকরুণচিত্তে কহিল, “তুমি কি চাও আর-কেহ তোমার কথা তাঁহাকে জানায় ?”
কমলা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “না না, আর-কাহারো মুখ হইতে তিনি শুনিবেন না— আমার কথা আমিই তাঁহাকে বলিব— আমি বলিতে পারিব।”
হেমনলিনী কহিল, “সেই কথাই ভালো। তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কি না, জানি না। আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, তাহা তোমাদের বলিতে আসিয়াছি।”
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে ?”
হেমনলিনী কহিল, “কলিকাতায়। তোমাদের সকালে কাজকর্ম আছে, আমরা আর দেরি করিব না। আমি তবে আসি ভাই ! বোনকে মনে রাখিয়ো।”
কমলা তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “আমাকে চিঠি লিখিবে না ?”
হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা, লিখব।”
কমলা কহিল, “কখন কী করিতে হইবে, আমাকে তুমি উপদেশ দিয়া লিখিয়ো— আমি জানি তোমার চিঠি পাইলে আমি বল পাইব।”
হেমনলিনী একটু হাসিয়া কহিল, “আমার চেয়ে ভালো উপদেশ দিবার লোক তুমি পাইবে, সেজন্য কিছুই ভাবিয়ো না।”
আজ হেমনলিনীর জন্য কমলা মনের মধ্যে বড়োই একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিল। হেমনলিনীর প্রশান্ত মুখে কী-একটা ভাব ছিল যাহা দেখিয়া কমলার চোখে যেন জল ভরিয়া আসিতে চাহিতেছিল। কিন্তু হেমনলিনীর কেমন-একটা দূরত্ব আছে— তাহাকে কোনো কথা বলা যেন চলে না, তাহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে যেন বাধে। আজ কমলার সকল কথাই হেমনলিনীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে, কিন্তু সে আপনার সুগভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া চলিয়া গেল, কেবল একটা-কী রাখিয়া গেল যাহা বিলীয়মান গোধূলির মতো অপরিমেয় বিষাদের বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ।
গৃহকর্মের অবকাশকালে আজ সমস্ত দিন কেবল হেমনলিনীর কথাগুলি এবং তাহার শান্ত-সকরুণ চোখের দৃষ্টি কমলার মনকে আঘাত দিতে লাগিল। কমলা হেমনলিনীর জীবনের আর-কোনো ঘটনা জানিত না— কেবল জানিত, নলিনাক্ষের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া ভাঙিয়া গেছে। হেমনলিনী তাহাদের বাগান হইতে আজ এক সাজি ফুল আনিয়া দিয়াছিল। বৈকালে গা ধুইয়া আসিয়া কমলা সেই ফুলগুলি লইয়া মালা গাঁথিতে বসিল। মাঝে একবার ক্ষেমংকরী আসিয়া তাহার পাশে বসিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আহা মা, আজ হেম যখন আমাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল, আমার মনের মধ্যে যে কী করিতে লাগিল বলিতে পারি না। যে যাই বলুক, হেম মেয়েটি বড়ো ভালো। আমার এখন কেবলই মনে হইতেছে, উহাকে যদি আমাদের বউ করিতাম তো বড়ো সুখের হইত। আর-একটু হইলেই তো হইয়া যাইত, কিন্তু আমার ছেলেটিকে তো পারিবার জো নাই-ও যে কী ভাবিয়া বাঁকিয়া বসিল তা সে ওই জানে।”
শেষকালে তিনিও যে এই বিবাহের প্রস্তাবে বিমুখ হইয়াছিলেন সে কথা ক্ষেমংকরী আর মনের মধ্যে আমল দিতে চান না।
বাহিরে পায়ের শব্দ শুনিয়া ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, ‘ও নলিন, শুনে যা।”
কমলা তাড়াতাড়ি আঁচলের মধ্যে ফুল ও মালা ঢাকিয়া ফেলিয়া মাথায় কাপড় তুলিয়া দিল। নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিলে ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হেমরা যে আজ চলিয়া গেল। তোর সঙ্গে কি দেখা হয় নাই ?”
নলিন কহিল, “হাঁ, আমি যে তাঁহাদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আসিলাম।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যাই বলিস বাপু, হেমের মতো মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।”
যেন নলিনাক্ষ এ সম্বন্ধে বরাবর তাঁহার প্রতিবাদ করিয়াই আসিয়াছে। নলিনাক্ষ চুপ করিয়া একটুখানি হাসিল।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হাসলি যে বড়ো ! আমি তোর সঙ্গে হেমের সম্বন্ধ করিলাম, আশীর্বাদ পর্যন্ত করিয়া আসিলাম, আর তুই যে জেদ করিয়া সব ভণ্ডুল করিয়া দিলি, এখন তোর মনে কি একটু অনুতাপ হইতেছে না ?
নলিনাক্ষ একবার চকিতের মতো কমলার মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; দেখিল কমলা উৎসুকনেত্রে তাহার দিক তাকাইয়া আছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবামাত্র কমলা লজ্জায় মাটি হইয়া চোখ নিচু করিল।
নলিনাক্ষ কহিল, “মা, তোমার ছেলে কি এমনি সৎপাত্র যে, তুমি সম্বন্ধ করিলেই হইল ? আমার মতো নীরস গম্ভীর লোককে সহজে কি কারো পছন্দ হইতে পারে।”
এই কথায় কমলার চোখ আপনি আবার উপরে উঠিল, উঠিবামাত্র দেখিল নলিনাক্ষের হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টি তাহার উপরেই পড়িয়াছে— এবার কমলার মনে হইতে লাগিল ‘ঘর হইতে ছুটিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচি।’
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যা যা, আর বকিস নে, তোর কথা শুনিলে আমার রাগ ধরে।”
এই সভা ভঙ্গ হইয়া গেলে পর কমলা হেমনলিনীর সব ক’টি ফুল লইয়া একটি বড়ো মালা গাঁথিল। ফুলের সাজির উপরে সেই মালাটি লইয়া জলের ছিটা দিয়া সেটি নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরের এক পার্শ্বে রাখিয়া দিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, আজ বিদায় হইয়া যাইবার দিনে এইজন্যই হেমনলিনী সাজি ভরিয়া ফুল আনিয়াছিল— মনে করিয়া তাহার চোখ ছল্ ছল্ করিয়া উঠিল।
তাহার পরে আপনার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মুখের দিকে নলিনাক্ষের সেই দৃষ্টিপাত কমলা অনেকক্ষণ ধরিয়া আলোচনা করিতে লাগিল। নলিনাক্ষ কমলাকে কী মনে করিতেছে ? কমলার মনের কথা যেন নলিনাক্ষের কাছে সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। কমলা পূর্বে যখন নলিনাক্ষের সম্মুখে বাহির হইত না, তখন সে একরকম ছিল ভালো। এখন প্রতিদিন কমলা তাহার কাছে ধরা পড়িয়া যাইতেছে। আপনাকে গোপন করিয়া রাখিবার এই তো শাস্তি ! কমলা ভাবিতে লাগিল, নিশ্চয়ই নলিনাক্ষ মনে মনে বলিতেছেন, ‘এই হরিদাসী মেয়েটিকে মা কোথা হইতে আনিলেন, এমন নির্লজ্জ তো দেখি নাই !’ নলিনাক্ষ যদি এক মুহূর্তও এমন কথা মনে করে তবে তো সে অসহ্য।
কমলা রাত্রে বিছানায় শুইয়া মনে মনে খুব জোর করিয়া প্রতিজ্ঞা করিল, ‘যেমন করিয়া হউক, কালই আপনার পরিচয় দিতে হইবে, তাহার পরে যাহা হয় তাহা হউক।”
পরদিন কমলা প্রত্যুষে উঠিয়া স্নান করিতে গেল। স্নানের পর প্রতিদিন সে একটি ছোটো ঘটিতে গঙ্গাজল আনিয়া নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরটি ধুইয়া মার্জনা করিয়া তবে অন্য কাজে মন দিত। আজও সে তার দিবসের প্রথম কাজটি সারিতে গিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ আজ সকাল-সকাল তাহার উপাসনা-ঘরে প্রবেশ করিয়াছে— এমন তো কোনোদিন হয় নাই। কমলা তাহার মনের মধ্যে অসমাপ্ত কাজের একটা ভার বহন করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। খানিকটা দূরে গিয়া সে হঠাৎ থামিল, স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কী-একটা ভাবিল। তার পরে আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহাকে যে কিসে আবিষ্ট করিয়া ধরিল তাহা সে জানে না; সমস্ত জগৎ তাহার কাছে ছায়ার মতো হইয়া আসিল, সময় যে কতক্ষণ চলিয়া গেল তাহা তাহার বোধ রহিল না। হঠাৎ এক সময় দেখিল, নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা মুহূর্তের মধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তখনই ভূতলে হাঁটু গাড়িয়া একেবারে নলিনাক্ষের পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল— তাহার সদ্যস্নানে আর্দ্র চুলগুলি নলিনের পা ঢাকিয়া মাটিতে ছড়াইয়া পড়িল। কমলা প্রণাম করিয়া উঠিয়া পাথরের মূর্তির মতো স্থির হইয়া দাঁড়াইল; তাহার মনে রহিল না যে, তাহার মাথার উপর হইতে কাপড় পড়িয়া গেছে— সে যেন দেখিতেই পাইল না, নলিনাক্ষ অনিমেষ স্থিরদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে— তাহার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত, সে একটি অন্তরের চৈতন্য-আভায় অপূর্বরূপে দীপ্ত হইয়া অবিচলিতকণ্ঠে কহিল, “আমি কমলা।”
এই কথাটি বলিবার পরেই তাহার আপনার কণ্ঠস্বরে তাহার যেন ধ্যানভঙ্গ হইয়া গেল, তাহার একাগ্র চেতনা বাহিরে ব্যাপ্ত হইল। তখন তাহার সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল; মাথা নত হইয়া গেল; সেখান হইতে নড়িবারও শক্তি রহিল না, দাঁড়াইয়া থাকাও যেন অসাধ্য হইয়া উঠিল; সে তাহার সমস্ত বল, সমস্ত পণ ‘আমি কমলা’ এই একটি কথায় নলিনাক্ষের পায়ের কাছে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছে— নিজের কাছে নিজের লজ্জা রক্ষা করিবার কোনো উপায় সে আর হাতে রাখে নাই, এখন সমস্তই নলিনাক্ষের দয়ার উপরে নির্ভর। নলিনাক্ষ আস্তে আস্তে তাহার হাতটি আপনার হাতের উপর তুলিয়া লইয়া কহিল, “আমি জানি, তুমি আমার কমলা। এসো, আমার ঘরে এসো।”
উপাসনা-ঘরে তাহাকে লইয়া গিয়া তাহার গলায় কমলার গাঁথা সেই মালাটি পরাইয়া দিল এবং কহিল, “এসো, আমরা তাঁহাকে প্রণাম করি।”
দুই জনে পাশাপাশি যখন সেই শ্বেতপাথরের মেজের উপরে নত হইল, জানালা হইতে প্রভাতের রৌদ্র দুই জনের মাথার উপরে আসিয়া পড়িল।
প্রণাম করিয়া উঠিয়া আর-একবার নলিনাক্ষের পায়ের ধুলা লইয়া যখন কমলা দাঁড়াইল তখন তাহার দুঃসহ লজ্জা আর তাহাকে পীড়ন করিল না। হর্ষের উল্লাস নহে কিন্তু একটি বৃহৎ মুক্তির অচঞ্চল শান্তি তাহার অস্তিত্বকে প্রভাতের অকুণ্ঠিত উদারনির্মল আলোকের সহিত ব্যাপ্ত করিয়া দিল। একটি গভীর ভক্তি তাহার হৃদয়ের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহার অন্তরের পূজা সমস্ত বিশ্বকে ধূপের পুণ্য গন্ধে বেষ্টন করিল। দেখিতে দেখিতে কখন অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল; বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা তাহার দুই কপোল দিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, আর থামিতে চাহিল না, তাহার অনাথ জীবনের সমস্ত দুঃখের মেঘ আজ আনন্দের জলে ঝরিয়া পড়িল। নলিনাক্ষ তাহাকে আর-কোনো কথা না বলিয়া একবার কেবল দক্ষিণ হস্তে তাহার ললাট হইতে সিক্ত কেশ সরাইয়া দিয়া ঘর হইতে চালিয়া গেল।
কমলা তাহার পূজা এখনো শেষ করিতে পারিল না— তাহার পরিপূর্ণ হৃদয়ের ধারা এখনো সে ঢালিতে চায়, তাই সে নলিনাক্ষের শোবার ঘরে গিয়া আপনার গলার মালা দিয়া সেই খড়ম-জোড়াকে জড়াইল এবং তাহা আপনার মাথায় ঠেকাইয়া যত্নপূর্বক যথাস্থানে তুলিয়া রাখিল।
তার পরে সমস্ত দিন তাহার গৃহকর্ম যেন দেবসেবার মতো মনে হইতে লাগিল। প্রত্যেক কর্মই যেন আকাশে এক-একটি আনন্দের তরঙ্গের মতো উঠিল পড়িল। ক্ষেমংকরী তাহাকে কহিলেন, “মা, তুমি করিতেছ কী ? এক দিনে সমস্ত বাড়িটাকে ধুইয়া মাজিয়া মুছিয়া একেবারে নূতন করিয়া তুলিবে না কি ?”
বৈকালের অবকাশের সময় আজ আর সেলাই না করিয়া কমলা তাহার ঘরের মেজের উপরে স্থির হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় নলিনাক্ষ একটি টুকরিতে গুটিকয়েক স্থলপদ্ম লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল; কহিল, “কমলা, এই ফুল-ক’টি তুমি জল দিয়া তাজা করিয়া রাখো, আজ সন্ধ্যার পর আমরা দুজনে মাকে প্রণাম করিতে যাইব।”
কমলা মুখ নত করিয়া কহিল, “কিন্তু আমার সব কথা তো শোন নাই।”
নলিনাক্ষ কহিল, “তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, আমি সব জানি।”
কমলা দক্ষিণ করতল দিয়া মুখ ঢাকিয়া কহিল, “মা কি— ”
বলিয়া কথা শেষ করিতে পারিল না।
নলিনাক্ষ তাহার মুখ হইতে হাত নামাইয়া ধরিয়া কহিল, “মা তাহার জীবনে অনেক অপরাধকে ক্ষমা করিয়া আসিয়াছেন, যাহা অপরাধ নহে তাহাকে তিনি ক্ষমা করিতে পারিবেন। ”