Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিষিদ্ধ লোবান || Syed Shamsul Haque » Page 9

নিষিদ্ধ লোবান || Syed Shamsul Haque

শ্রী প্রদীপ কুমার বিশ্বাস

সঙ্গে সঙ্গে পাড়ে ঢালুর ওপর ছিটকে উপুড় লম্বা হয়ে পড়ে বিলকিস আর সিরাজ। একবার মনে হয় খালের ওপার থেকে, আবার মনে হয় বাজারের দিক থেকে শব্দটা আসছে। শব্দ থেমে যায়, শব্দের অনুপস্থিতির ভেতরেও তারা দীর্ঘ অনুরণন শুনতে পায়। তারপর স্তব্ধতা ফিরে আসে।

কোথায়?

বুঝতে পারছি না।

গুলির শব্দ আর ফিরে আসে না। খালের অপর পাড়ে তাকিয়ে আগের মতোই সব কিছু মনে হয়। বাজারের দিকেও কোনো মানুষের সাড়া বাঁ পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না।

আস্তে গা ছেড়ে দেওয়াতে ঢালু বেয়ে কবরের পাশে এসে পড়ে তারা। সময় পেলে মাটি সমান করে দেওয়া যেত, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসছে, আগে বুঝে দেখা দরকার।

এখানে থাকা বোধহয় ঠিক হবে না, সিরাজ।

গুলিটা কোনদিকে হলো, বুঝতে পারলে হতো।

আমার মনে হয় দূরে কোথাও।

খুব দূরে নাও হতে পারে।

এখনো অনেক লাশ বাকি।

খোকা ভাইকে পেলেও হতো।

খোকাকেও আমরা মাটি দেব, সিরাজ। ফিরে যাব না।

ভীত কণ্ঠে সিরাজ বলে, রাত তো বাকি নেই।

তাহলে কাল আবার আমরা শুরু করব।

কিন্তু এখান থেকে এখন চলে যাওয়া নিরাপদ হবে না।

এখানে?

হাঁ, এখানে। এত বড় একটা বাজার, একটা দিন লুকিয়ে থাকা যাবে না?

খুব মুশকিল হবে।

এর চেয়ে অনেক বড় মুশকিলের ভেতরে আমরা আছি। বাজার থেকে এখনো কোনো শব্দ পাচ্ছি না, আপা।

বিলকিস কান খাড়া করে এখনো শোনবার চেষ্টা করে।

বাজারে কেউ নেই।

তাহলে কী করবে?

আগে এসো, মাটি সমান করে দিই। কবরের। লাশের তাতে কোনো লাভ নেই। আমাদের মন বলবে, একটা কাজ আমরা ভালো করে শেষ করেছি।

আপা, আমার একটা কথা মনে এল।

কী, সিরাজ?

এত কুঁকি নিয়ে এলাম, কবর দিলাম, যারা মরে গেছে তাদের তো কোনো লাভ নেই।

নেই? কে বললে নেই?

আমি তো দেখি না।

ঐ যারা মরে গেছে, তুমি ওদের আলাদা করে দেখছ বলেই একথা বলতে পারছি। যদি মনে করতে পারতে ওরা তোমারই অংশ, তাহলে দেখতে ওদের সৎকার করে তুমি জীবনকে শ্রদ্ধা করছ, সম্মান দিচ্ছ।

টিনের সেই টুকরো দুটো দিয়ে কবরের মাটি সমান করে উঠে দাঁড়ায় ওরা। গলিপথে এসে থামে। তারপর সন্তৰ্পণে চত্বরের মুখে গিয়ে সতর্ক চোখে চারদিকে দেখে নেয়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই সব মনে হচ্ছে। তবু সাবধানের সঙ্গে পা ফেলে। দোকানগুলোর গা ঘেঁষে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যথাসম্ভব মিশে থেকে চলে।

কোথায় যাবেন?

আমি ঠিক করে ফেলেছি। এসো আমার সঙ্গে।

বাজারের চত্বরটা পেরিয়ে পাটগুদামের পাশে টিনের ঘরগুলোর ছায়ায় দাঁড়ায় বিলকিস। সেখান থেকে লাশগুলোর দিকে আবার পরিপূর্ণ সম্পূর্ণ চোখে সে তাকায়।

সিরাজ, যদি পারতাম, আজ রাতে আমি সবাইকে মাটি দিতাম। দেখতাম ওদের হুকুম কত বড়! ওরা দেখত আমরা পশু নই, আমরা আমাদের মৃতদেহ ফেলে রাখতে দেই না, আমরা শকুনের খাদ্য হতে চাই না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিলকিস আবার বলে, আমাদের দুটি করে মাত্ৰ হাত, লাশ তো অনেক।

এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

তাই তো।

আকাশ ফিকে হয়ে আসছে।

সিরাজ, এই পাট গুদামগুলোর কথা ভাবছিলাম। এর ভেতরে নিশ্চয়ই আমরা লুকিয়ে থাকতে পারব।

সারাদিন?

দরকার হলে দিনের পর দিন। খোকাকে, সবাইকে কবর দিয়ে, তবে আমি যাব।

গুদামের বড় বড় লোহার দরোজা বিরাট তালা দিয়ে আটকানো। দুএকটাতে টান দিয়ে দেখে সিরাজ, যদি দৈবাৎ খোলা থাকে। অবশেষে ব্যাপারিদের টিনের আপিস ঘরের পাশে দরোজা-জানালাহীন ছোট একটা গুদামের দরোজায় দেখা যায় আংটা দুটো পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা। তালা নেই। সন্তৰ্পণে ভেতরে সরে যায় ওরা। একটু পর আবার আসে। ধীরে, অতি ধীরে দরোজা একটু ফাঁক করে প্রথম সিরাজ ঢোকে, তারপর বিলকিস।

ভেতরে ঢুকতেই সারা গায়ে যেন আগুনের হালকা লাগে, ভেতরটা এত গরম। আর সেই সঙ্গে তীব্র খসখসে গন্ধ। বোধ আচ্ছন্ন হয়ে যেতে চায়। এক ধরনের নেশায় মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। চোখের সম্মুখে অন্ধকার সূচীভেদ্য মনে হয়। পেছনে সামান্য ফাঁক করা দরোজায় তরল আঁধারের রিবনটিকে উজ্জ্বলতর দেখায়।

সিরাজ চাপা উত্তেজিত গলায় বলে, এখানে থাকতে পারবেন না, আপা।

পারতেই হবে।

পাটের ভীষণ গরম হয়। দুএক ঘণ্টার ব্যাপার না। সারাদিন থাকলে মরে যাবেন।

দরোজটা সাবধানে বন্ধ করে দাও।

দরোজা বন্ধ করে দিতেই কবরের মতো নিরেট হয়ে যায় ভেতরটা। হাতড়ে হাতড়ে একটু এগিয়ে এসে সিরাজ ফিস ফিস করে ডাকে–আপা। সাড়া পায় না। আবার সে হাতড়ে হাতড়ে কিছুদূর এগোয়। যতদূর হাত পৌছোয় ওপরে। পাহাড়ের মতো স্তুপ করা পাট। আরো খানিক এগোতে আর পথ পায় না। সে আবার ডাকে–অপ। অকস্মাৎ তার মনে হয় সে একটা দুঃস্বপ্নের ভেতরে আকণ্ঠ ড়ুবে আছে, বিলকিস তাকে ছেড়ে গেছে, এখান থেকে আর কোনোদিন সে বেরুতে পারবে না। হয়তো আর্তনাদ করে উঠত, এমন সময় বিলকিসের গলা শোনা যায়।

সিরাজ, তুমি কোথায়?

পিছু হটে এসে একটা খোলা জায়গা অনুভূত হতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আপা।

বিলকিসের হাত তার গায়ে ঠেকতেই হাতটা আঁকড়ে ধরে।

আপা, কী অন্ধকার!

ভয় করছে?

আপনার সাড়া না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আমি ওদিকটা হাতড়ে দেখে এলাম। সারা ঘরে পাটের বেল। এক্ষণি একটা দুটো টেনে দরোজার ওপরে ঠেসে রাখা দরকার। বাইরে থেকে খোলার চেষ্টা কেউ করলে বাধা পাবে। এসো।

বিলকিস তার হাত ধরে বাঁ দিকে নিচু একটা স্তুপের দিকে নিয়ে যায়। দুজনে মিলে একটা বেল সরাতে প্রাণান্ত হয়ে যায় তাদের। কিন্তু মানুষের শক্তি আসে তার প্রয়োজনের মাত্রায়। অচিরেই তারা একটা বেল এনে দরোজার কাছে ঠেলে ফেলে।

আরো একটা হলে ভালো হয়।

আরো একটা বেল এনে দরোজার আরেক পাটে রাখে। দরোজার কাছে কিছুটা হাওয়া, পাটের প্রচণ্ড গরমের তেজ কিছুটা পরিমাণে সহনীয়। তবু দরোজার কাছে বসা ঠিক নয়। সিরাজের হাত ধরে বিলকিস তাকে আবার অনন্ত অন্ধকারের গহবরে নিয়ে যায়। অনুমানে বোঝা যায়, দুদিকে দুসার চলে গেছে, মাঝখানে সরু গলির মতো। গলিটার একটু ভেতরে ঢুকে বিলকিস মাটিতে বসে পড়ে।

বোসে।

পাছে গায়ের ওপর পড়ে যায়, সিরাজ অনেকটা সরে, আস্তে আস্তে বসে।

কোথায় তুমি?

এই যে!

খুব যখন ছোট ছিলাম, পাট গুদামে লুকোচুরি খেলতে আসতাম। সবচে মজা কি জান, এর মধ্যে যতই তুমি হাট, চল, কথা বল, মানে খুব জোরে যদি না বল, বাইরে কেন, ভেতর থেকেই কারো টের পাবার জো নেই। লুকোবার জায়গার কথা মনে হতেই ছেলেবেলার খেলা মনে পড়ে গেল। একটা খেলাও পেয়ে গেলাম। তুমি যে তখন বললে, আল্লাহ্ বিশ্বাস কর না, দ্যাখ তো, এখন পর্যন্ত সব ঠিক ঠিক হয়ে যাচ্ছে, কী করে হচ্ছে, কেউ যদি ওপরে না থাকেন?

উত্তরের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিলকিস।

কই, কিছু বলছি না?

ওপরে কেউ থাকলে আমার মা-বাবা খুন হতেন না, আমার বোনের লজ্জা নষ্ট হতো না, আপনার ভাই গুলি খেয়ে বাজারে পড়ে থাকত না, দিদি। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনেছেন? লক্ষ লক্ষ লোককে ওরা মেরে ফেলেছে। বেতার কেন, নিজের হাতে আজ কবর দিলেন না? কতজনকে দিতে পেয়েছেন? তারচে অনেক বেশি পড়ে আছে না, ওদের ছুলে পর্যন্ত গুলি করার হুকুম আছে না? আপনি বলেছেন, ওপরে কেউ আছে। কে আছে? কেউ নেই। থাকলেও ঐ ওদের জন্যে আছে, আমাদের জন্যে নেই।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত সিরাজের আর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বিলকিস, সে নিজেই কি এখন বিশ্বাস করে আল্লাহকে? নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে বিলকিস? মানুষের মৃত্যু দেখে বরং এখনো তার চোখ ভিজে ওঠে, কিন্তু আল্লাহর ওপর আস্থা হারিয়েও এখন সে বিচলিত বোধ করে না।

তাহলে কেন মিছেমিছি আল্লাহর কথা তুলতে গেল সে? অভ্যাস বলে? রক্তের অন্তর্গত বলে? না, রক্ত থেকেও সে বিদায় দিয়েছে তাকে। জলেশ্বরীতে পা রাখা অবধি, পদে পদে এত কুঁকি, এত মৃত্যু, তবু তো সে একবারও আল্লাহকে স্মরণ করে নি?

সিরাজ।

কোনো উত্তর আসে না।

রাগ করেছ?

নীরবতা।

বিলকিস হাতড়ে হাতড়ে একটু এগোয়। সিরাজের শরীর হাতে ঠেকে। তার চিবুকের নিচে হাত রাখে বিলকিস। আঙুল দিয়ে অতি ধীরে বুলিয়ে দেয়।

তোমার জন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। তুমি তো একা নও। আমার মা কোথায় আমি জানি না, ভালো আছে কিনা কে জানে, আমার বোন, তার বাচ্চারা। আমি তো ভাইকে হারলাম। ওর সুন্দর মুখটাকে ওরা নোংরা করে দিয়েছে তাই তো শুনতে হলো। আর আমি জানি না, আমি বিধবা না। সধবা। মনের একটা দিক বলে, আলতাফ বেঁচে আছে, আরেকটা দিক হাহাকার করে ওঠে, নেই নেই। আমার মনের ঠিক যে দিকটা বলে নেই ঠিক সেই দিকটাই একদিন আল্লাকে বিশ্বাস করত, বিচার আছে বলে মনে করত, মানুষের ভেতরে মানুষ সব সময়ই আছে বলে নিশ্চিন্ত থাকত।

চিবুকের নিচে বিলকিসের হাতটা হঠাৎ দুহাতে চেপে ধরে সিরাজ।

বড় অকস্মাৎ বড় অপ্রত্যাশিত মনে হয় তার এই প্ৰাণপণে আঁকড়ে ধরা।

মুহূর্তকাল পরে একই আকস্মিকতার সঙ্গে হাতটা ছেড়ে দিয়ে সিরাজ বলে, দিদি। আমি আপনাকে একটা মিথ্যে কথা বলছি।

তার এই ঘোষণাটি আরো প্ৰত্যাশিত।

আমি সিরাজ নই। মনসুরদা আমাকে এই নাম দিয়েছেন। আমি প্ৰদীপ।

প্ৰদীপ?

শ্ৰী প্ৰদীপ কুমার বিশ্বাস।

তবু তুমি এখানে আছ?

আছি। ইন্ডিয়া যাই নি। এখানে থেকে এখানেই আবার আমি প্ৰদীপ হতে চাই। দিদি, আপনি বুঝতে পারেন আমার দুঃখ? মা-বাবা-বোন, আমার নাম, আমার পরিচয় একটা মাত্র রাতে আমার সব কিছু হারিয়ে যাবার দুঃখ? দিদি, আমাদের ধর্মে বলে, ধৰ্মই মানুষকে রক্ষা করে। কই, আমার ধর্ম তো আমাকে রক্ষা করতে পারল না?

কথাগুলো বিলকিস ভালো করে শুনতে পায় না। তার মনের ভেতরে বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটির টুকরো টুকরো কথা, আচরণ, প্রতিক্রিয়া, সম্বোধন দ্রুত আবতির্ত হতে থাকে।

প্ৰদীপ।

দিদি।

কে বলে তুমি ভীতু? তোমার জন্যে আমার গর্ব হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *